প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Monday, October 31, 2011

অস্ত্রের তৈরি অদ্ভুত শিল্পকর্ম

অস্ত্র সর্বদাই ব্যবহৃত হয় ধ্বংসে! বিনাশের এই খেলনা খেলে চলে মরণ খেলা। সৈন্যের হাতে থাকলে বিনাশ করে শত্রু, সন্ত্রাসীর হাতে থাকলে অত্যাচারের রাজত্ব কায়েম করে, উগ্রপন্থী জঙ্গির হাতে থাকলে হত্যা করে নিরীহ মানুষ। অস্ত্রের চরিত্র নির্ধারিত হয় সে কার হাতে আছে তার উপর। কখনো অস্ত্র ব্যবহৃত হয় শান্তির পক্ষে আবার কখনো এই অস্ত্রই কেড়ে নেয় শান্তির আবহ। কিন্তু আজ আমরা দেখবো এই অস্ত্রই শিল্পীর হাতে পরে কি করে তৈরি হচ্ছে অদ্ভুত সুন্দর কিছু শিল্পকর্মে।
































































































সিরিজের অন্যান্য পর্বগুলি : অদ্ভুত চিত্রকর্ম (পেন্সিল সাপনার), গাছের পাতায় অদ্ভুত শিল্পকর্ম, ডিমের খোসায় অদ্ভুত শিল্পকর্ম, অদ্ভুত বর্ণচিত্র, অদ্ভুত সাদা স্কসটেপ শিল্পকর্ম, অদ্ভুত বিস্কুট সিটি, গাছের পাতায় অদ্ভুত শিল্পকর্ম (২য় অংশ)


এখনো অনেক অজানা ভাষার অচেনা শব্দের মত এই পৃথিবীর অনেক কিছুই অজানা-অচেনা রয়ে গেছে!! পৃথিবীতে কত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে- যারা দেখতে চায় তাদের ঝিঁঝি পোকার বাগানে নিমন্ত্রণ।

Saturday, October 29, 2011

একটি নৌক, কয়েকটি ছবি

এই বর্ষায় বেশ কয়েক বারই বেড়াতে বেরিয়েছিলাম জলভ্রমণে। ইঞ্জিন চালিতো নৌক নিয়ে দুপুরের পর বেরিয়ে রাত পর্যন্ত ঘুরে বেরিয়েছি জলের উপর। অসংখ্য ছবি তুলেছি প্রতিবারই, দৃষ্টিনন্দন হয়নি যার কোনোটাই। সেই অসংখ্য ছবি থেকে আজ একটি নৌকর কয়েকটি ছবি শেয়ার করালাম।







































এখনো অনেক অজানা ভাষার অচেনা শব্দের মত এই পৃথিবীর অনেক কিছুই অজানা-অচেনা রয়ে গেছে!! পৃথিবীতে কত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে- যারা দেখতে চায় তাদের ঝিঁঝি পোকার বাগানে নিমন্ত্রণ।

Tuesday, October 25, 2011

রঙের মেলায় || আবেদীন জনী

ফুলের রাঙা পাপড়ি থেকে
নিলাম মধুর গন্ধ,
পাখির কিচিরমিচির থেকে
নিলাম সুর ও ছন্দ।

বুকের মধ্যে নিলাম তুলে
ভোরের নরম বাও।
সবুজ পাতার সজীবতা
নিলাম ছুঁয়ে তাও।

একটু হলুদ রোদ মাখি এই
মনের মাঠে-ঘাসে।
রূপঝরা এই রঙের মেলায়
দিন কাটুক উচ্ছ্বাসে।
সূত্র : সমকাল

চুলে চাই ফুল || গোলাম নবী পান্না

কানে তার দুল চাই
দুলটাও ফুল,
হয়তো জবার মতো
নয়তো বকুল।

খোঁপায় গোলাপ চাই
হবে না তো ভুল
ওটুকুন মেয়ে, তার
ক'টুকুন চুল!

তবু হেরফের হলে
সে হুলস্থূল
মাথায় তুলবে পাড়া
কাণ্ড ও মূল।
সূত্র : সমকাল

ময়না-টিয়ার গল্প || হাসান শরীফ

পোষা পাখি ময়না
কইতো কথা মিষ্টি স্বরে
এখন তো আর কয় না।

০২.
সবুজ পাখি টিয়া
উড়ে বেড়ায় মনের সুখে
সঙ্গী সাথি নিয়া

০৩.
উড়ে বেড়ায় নীলাকাশে
টিয়া এবং ময়না
কেউ কখনও কারও সাথে
একটু কথা কয় না।
সূত্র : সমকাল

বৃষ্টি শহর || রোকেয়া খাতুন রুবী

বৃষ্টি শহর জল ঝরছে আকাশ ভাঙা গানে,
সে গানে কী সুর ছড়ানো দোলনচাঁপা জানে।
দোলনচাঁপা, কদমকুঁড়ি শহর ভাসে জলে,
বিষণ্ন দিন স্মৃতির খাতায় চোখ দুটো ছলছলে।

বৃষ্টি শহর 'রেইনি ডে'তে স্কুলেতে ছুটি
চঞ্চলা সব কিশোরীরা মাথায় বাঁধে ঝুঁটি।
ঝুঁটিতে লাল পাপড়ি ফিতের ঝুঁটিতে লাল সাদা
মাদল বাজায় বাদল রানী সারাটা দিন কাদা।

কান্না যদি পান্না হতো নিশিত রাতের কালে
নিঝুম শহর উজানো মাছ আটকাতো সব জালে।
মাছকুমারী হারিয়ে গেছে জলের গহীন তলে
পুরনো শহর পুরনো হয়, নতুন হওয়ার ছলে।

মেঘেতে নীল, মেঘের সাদা, কোন আকাশে বাস,
বাদাম ভাজা দুপুর উদাস জলের নিচে ঘাস।
ঘাসের ফাঁকে জলের ফড়িং ডানায় আঁকিবুঁকি
বৃষ্টি শহর মেঘের ভেতর সূর্য কি দেয় উঁকি?
সূত্র : সমকাল

সূর্য ও পাতার গল্প || হোসেন শওকত

লোকটা নাকি জাদুকর দেখতে রবীন্দ্রনাথের মতো বড় বড় চুল আর দাড়ি সকালে ঘুম থেকে উঠে চুল শুকাতে দেয় সেই চুল এতো বড় যে, পৃথিবী অব্দি চলে আসে
পৃথিবী একটা সবুজ গ্রহ। সেটার প্রতি সবার লোভ। সেখানে মানুষের বাস। ওই গ্রহের সবাই ভাবে, পৃথিবীটা দখল করার জন্যই বুঝি বুড়োর এই পাঁয়তারা, ফন্দি-ফিকির। চুলের মায়াজাল ফেলে পৃথিবীকে বশ করতে চায় সে। আবার কেউ কেউ বলে, আগে চুল ফেলে পৃথিবীর প্রতিক্রিয়া পরখ করে নিচ্ছে সে। তেমন প্রতিবাদ না দেখলে আস্তে ধীরে পা ফেলবে। তারপর সারা শরীর। ধীরে ধীরে দখল করে নেওয়ার বুদ্ধি।
পৃথিবীর মানুষজন তো আর বোকা নয়! ধরে ফেললো জাদুকরের বুদ্ধি। ভাবলো, বুড়োকে বাড়তে দেওয়া যাবে না। পাটকাঠিতে আগুন ধরিয়ে লাগিয়ে দিলো বুড়োর চুলে। ধিকিধিকি জ্বলতে লাগলো সেই আগুন। ছড়াতে লাগলো। চুল বেয়ে বেয়ে আগুন পেঁৗছে গেলো বুড়োর মাথা পর্যন্ত।
লক্ষ লক্ষ চুল বেয়ে আগুন যখন মাথায় পেঁৗছালো, তখন বিরাট অগি্নপিণ্ডে পরিণত হলো। কত্তো বিরাট? বোঝানো কষ্টকর। যারা সূর্য দেখেছো, তারাই বুঝবে! সেখানে আগুনের শিখা দাউদাউ জ্বলছে। কিন্তু তবুও পুড়ছে না মুখ। জাদুকরের মুখ বলে কথা!
দিনভর জ্বলে সেই চুল। এতো মিহি চুল_ খালি চোখে ধরা পড়ে না। সবুজ পাতার ফাঁক গলে কেউ তাকালে শুধু চোখে পড়ে সূক্ষ্ম রেখার মতো চুল। অবশ্য তাপ ঠিকই টের পাওয়া যায়। দুপুর হলে সবাই অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে। চুলগুলো ধরে টানাটানি শুরু করে। টানতে টানতে নামিয়ে আনে বুড়োকে নিচে।
কিন্তু জাদুকর বলে কথা! নামানো কি এতো সোজা! বড়শিতে মাছ ধরা পড়লে কতো কসরত করে তুলতে হয়; কত্তো সময় লাগে! তাই নামতে নামতে সন্ধ্যা। সবাই হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। ভাবে, যাক জাদুকরের হাত থেকে বাঁচা গেলো। তাই নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফেরে। খেয়ে-দেয়ে ঘুমোতে যায়।
কিন্তু কী দুর্ভাগ্য! মানুষ অজ্ঞান হলে যে রকম মাথায় পানি দেওয়া হয়, জাদুকরকেও সে রকম ঢালা হয়। তবে বিন্দু বিন্দু। ফলে অজ্ঞান ভাব কাটে তার। আবার জেগে ওঠে। ভোর বেলা। পুবদিকে। যদিও তাকে টেনে নামানো হয়েছিলো পশ্চিমে। কিন্তু ভেসে ওঠে পূর্বে। কীভাবে, জানো? পৃথিবীর মানুষ তো মারমুখী হয়ে তাকে নামিয়ে আনলো। সে ভয় পেলো খুব। সুড়ঙ্গে লুকালো। তারপর পথ হারিয়ে ফেললো। সুড়ঙ্গের গোলকধাঁধায় ঘুরতে ঘুরতে ভেসে ওঠলো পূর্বে। ভয়ে আর উদ্বেগে চোখমুখ লাল।
আকাশ মাঝে মাঝে কালো চাদরে ঢেকে দেয় বুড়োকে। পৃথিবী তখন কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। ভাবে, গুণ্ডা সূর্যটা বুঝি নেই! কিন্তু সূর্য তো জাদুকর। এইসব আড়াল কি তার সহ্য হয়? এক সময় ঠিকই আড়াল ভেদ করে বেরিয়ে আসে। মেঘের ফাঁকে ফিক করে হাসি দেয়। টিটকিরি মেরে বলে, 'কী, পারলে আমাকে চাপা দিয়ে রাখতে? ছাই দিয়ে কি আগুন চেপে রাখা যায়?'
অবশ্য জাদুকর যে সব সময় জেতে, তা কিন্তু নয়। মাঝে মধ্যে মেঘের সঙ্গে বেধে যায় ধুন্ধুমার যুদ্ধ। কড়কড় শব্দ করে একজন আরেকজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। দুজনের হাতের তরবারিতে আলো পড়ে ঝিলিক দিয়ে ওঠে। দাঁতে দাঁত ঘষে কিড়মিড় করে। সে কী বিকট শব্দ! দুজনের সংঘর্ষ দেখে বাতাস পর্যন্ত ছুটে পালাতে চায়। গাছপালা ভয়ে তটস্থ। কাঁপতে থাকে। নারকেল গাছ দুহাত জোড় করে মিনতি করে, 'আমায় বাঁচাও। তোমার সঙ্গে নিয়ে যাও।'
বাতাসের বয়েই গেলো এসব উটকো ঝামেলা কাঁধে নিতে!
এ যুদ্ধ কখনও চলে দশ-পনেরো মিনিট। কখনও এক-দুই ঘণ্টা। তারপর সব শুনসান। সন্ধি হয় দুই পক্ষে। শান্ত হয় বাতাস। জাদুকরকে তখন অনেক ঝলমলে, উজ্জ্বল মনে হয়। যেন পুরনো শার্টকে কাপড় কাচার সাবান দিয়ে ঝকঝকে করে ধোয়া হয়েছে। দ্যুতি ছড়াচ্ছে। ঝড় জলের ওয়াশিং মেশিনে গাছের পাতাগুলো ঝকমকে ধোয়া হয়ে যায়। পরদিন পাতাগুলো জাদুকরের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। বলে, 'আমাকে একটু উত্তাপ দাও। আলো দাও।'
_কী করবে তুমি উত্তাপ আর আলো দিয়ে?
_রান্না করবো।
_কী রান্না করবে?
_খাবার।
_তোমার নিজের জন্য? সে জন্য তোমার এক-সূর্য আলো দরকার?
_শুধু কি আমার নিজের জন্য?
_তাহলে আর?
_আর রাঁধবো সারা পৃথিবীর জন্য। সব প্রাণীর জন্য।
_বলো কী! সারা পৃথিবীর জন্য রান্না করছো তুমি! তাহলে তো তোমার চুলা অনেক বড়। কোথায় রেখেছো তোমার সেই বিশাল চুলা?
_এই যে আমার শিরায় শিরায়। সব পাতাতে ছড়িয়ে রাখা। সবাই ভাগাভাগি করে নিলে বিশাল কাজও সাধ্যের মধ্যে চলে আসে।
_এতো বড় কাজ করলে তো আমরা হুলস্থূল বাধিয়ে দিতাম। তোমাদের ভাব দেখে তো বোঝাই যায় না।
_কাজটা করি আমরা অন্তর থেকে। ভেতরে ভেতরে। বাহিরে তাই হাঁকডাক নেই। ভালোবেসে কোনো কাজ করলে এ রকমই ঘটে। চুপচাপ। কিন্তু নিখাদ আর নির্ভুল।
জাদুকরের আলো মসৃণ পাতায় পড়ে ঠিকরে যায়। একটু বিষণ্ন হয়। সে ভেবেছিলো, সবার মধ্যে সে-ই সেরা। এখন বুঝলো, তার ধারণা ভুল। ফলাও না করলেও অথবা চকচক না করেও অনেকে অনেক বড় কাজ করছে। করে যাচ্ছে। চুপচাপ, নীরবে-নিভৃতে।
সূত্র : সমকাল

কবিতা নিয়ে || জীবনানন্দ দাশ

তোমার সঙ্গে যখন কথা বলবে হাত ছুঁড়ে, মাথা ঘুরিয়ে, চোখ-দু’টোকে কপাল ভেদ করে আকাশের দিকে চিলের মতো উড়িয়ে দিয়ে কঠিন ধাতুর গায়ে কঠিন ধাতুর নিক্ষেপের মতো হাসি ও আওয়াজের সৃষ্টি করে, বাঘের মতন থাবায় টেবিলটাকে একবার আক্রমণ করে এক-একটা বইর টুঁটি ধরে সেটাকে শূন্যে ছুঁড়ে দিয়ে নলিনাক্ষ একখণ্ড বৈশাখের সমুদ্রের মতো রক্তের অকুতোভয় পরস্ফুিরণ নিয়ে তোমার ঘরের ভেতর বর্তমান থাকবে। আমি একটু নির্জন ধরনের মানুষ, দরজায় নলিনাক্ষর ছায়া দেখলে আমার সুবিধার মনে হয় না।
পাঁচ হাত লম্বা মানুষ, অশ্বত্থের মতো কঠিন মাংস দিয়ে সে তার শরীরের প্রসার তৈরি করেছে যেন। মাথায় ফলন্ত চুলের অবিরাম আনন্দ পৃথিবীর ঘাস পাতা ও পাখির কথা মনে করিয়ে দেয়। থুতনিতে তিন ইঞ্চি মাফিক দাড়ি রেখেছে সে, সেটুকুও পৃথিবীর ঘাস, পাতা, পাখির পালকের মতো নিঃসঙ্কোচ প্রাণের আস্বাদ নিয়ে জন্মেছে, কিন্তু তবুও এই চুল ও দাড়িকে নলিনাক্ষ অরণ্যের মতো বাড়তে দেয়নি; কেটে-ছেঁটে শৌখিন করে সাজিয়ে রেখেছে। রক্তের অদ্ভুত পরিস্পন্দনও চিত্কার সত্ত্বেও নলিনাক্ষ আমার মতন মানুষ পর্যন্ত নয়, সে নিতান্ত সাধারণের মতোই। জীবনের কাঁটা তার ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায়ই হাজির হয়। কখনও ভুল করে না, অনাবশ্যক অবান্তর প্রসঙ্গ [...] না তার। মানুষের জীবন কি এবং কি নয় তা সে বুঝছে, মাঠের ঘাস নিয়ে নিস্তব্ধ হয়ে সে কোনোদিন বসে থাকেনি।
নলিনাক্ষর উদ্যোগে একটি সাঁতার সমিতি তৈরি হয়েছে। সে তার সম্পাদক, নিজে একজন ভালো ক্রিকেট খেলোয়াড় না হলেও ক্রিকেট ক্লাবের সে একজন বড় মাতব্বর। ফুটবল খেলার সময় তাকে অনেকদিন রেফারি হয়ে কাজ করতে হয়। ফুটবল সিজনে নলিনাক্ষ একটা স্তম্ভের মতো। সে না থাকলে কি যে হতো, এ জীবনে কোনোদিন ফুটবল গ্রাউন্ডে না গিয়েও আমার ঘরে বসেই আমি তা ভেবে ঠিক করতে পারি না। ডিস্ট্রিক্ট অফিসের প্রিয়পাত্র সে, [...] বাংলাতে গিয়ে মাঝে মাঝে বিকেলবেলা চা খায়, অফিসারদের ক্লাবে গিয়ে ব্রিজ খেলে সন্ধ্যার সময়। ইউনিভার্সিটির ডিগ্রি রয়েছে। কয়েকটা চমত্কার স্যুট আছে তার, পরার কায়দা সাহেবদের মতো। বাংলা কবিতা গল্প কোনোদিন পড়ে না সে, এজন্য মনে মনে আমি তাকে গভীর প্রশংসা করি। বাংলাদেশে সাহিত্য বলে কোনো জিনিস আছে তাও সে জানে না, ইংরেজি সাহিত্য, ঠিক বলতে গেলে ইংরেজি রচনা তার কাছে খবরের কাগজ ও নিতান্ত দুঃসময়ে [...] ইত্যাদি নিয়ে কয়েকটি বইয়ের মধ্যে পর্যবসিত। বাপের জমিদারি পড়ে গেছে অনেকটা, কিন্তু তবুও যা আছে তা দিয়ে এ জীবনটা নিজের মনের স্বাধীনতাকে খর্ব না করে কাটিয়ে যেতে পারবে নলিনাক্ষ।
নলিনাক্ষর তো সবই রয়েছে—এমনকি আইনের ডিগ্রি পর্যন্ত। একসময়ে অবাক হয়ে ভাবতাম সে কেন মফস্বলের ধারে পড়ে রয়েছে, দু-চারটা বক্তৃতা দিয়ে সেখানেও-বা আগুন জ্বালিয়ে দেয় না কেন? [লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে] অনায়াসে সে যেতে পারে। নাম করতে পারে। নলিনাক্ষর চেয়ে কত রদ্দি লোক কাউন্সিলে গিয়ে বক্তৃতা দিয়ে সাহেবদের [...] মুচকি হাসির অবতারণা করল। গেল তো তবু তো বক্তৃতা দিল। কিন্তু বাঙালির প্রতিনিধি হিসেবে নলিনাক্ষর জোর এদের চেয়ে ঢের বেশি; কিন্তু আড্ডায় আড্ডায় টেবিল ভেঙে ফুটবল ফিল্ডে রেফারিগিরি করে—করল কি সে?
নলিনাক্ষ যখন তোমাদের আড্ডা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়, দাঁত দিয়ে একটা চুরুট কামড়ে ধরে, বিরাট গোল চশমার ফাঁক দিয়ে বাঘের মতো চোখে তোমার দিকে তাকায়—বাঘের ভুক্তাবশিষ্ট মহিষের হাড় ক’খানার মতো কতকগুলো দাঁতে ছড়াছড়ি মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে পড়ে তার, কেমন একটা অস্ফুট পরিতৃপ্ত গর্জনের সঙ্গে তখন আর একবার পরিমাপ পাও তার, বুঝতে পার এই পৃথিবীতে তুমি নিজে কি রকম অবাস্তব। বস্তুর শক্তি নলিনাক্ষ কেমন বৈষয়িক কেমন জান্তব গৌরবে ধারণা করে আছে। সংসারের সবচেয়ে বড় বড় সফলতা কেন সে পাবে না?
নলিনাক্ষ আমার কাছে আগে প্রায়ই আসত, কিন্তু যতই সে বুঝতে পারছিল আমার এখানে আড্ডা প্রায়ই একা আমাকে নিয়ে এবং আমি বরং একজন অদ্ভুত জীব, আমার এখানে আসবার আকর্ষণ কমে গেল তার।
তবুও মাঝে মাঝে আমার এখানে ইদানীংও পাওয়া যেত তাকে। এসেছে, এসে বসেছে আমার টেবিলের কাছে, চুরুট টানছে, কথা বলছে, একসঙ্গে দাঁত আর ঘুষি খিঁচিয়ে ঘুষির পর ঘুষি মেরে কাঁঠাল কাঠের টেবিলটার ভেতর থেকে জখমের আর্তনাদ বের করে আনছে সে।
—‘কেন বেরোও না বলতে পার? কেন মানুষের সঙ্গে মেশ না? না আমাদের দেশের সব মানুষ ফুরিয়ে গেছে। আমাদের ফুটবল ক্লাবের বীরেশ ঠ্যাং ভেঙে এই সাত দিন ধরে বিছানায় পড়ে আছে খবর রাখ? খবর রাখ তুমি! সমস্ত শহরের মানুষ ভেঙে পড়েছে সেখানে মায় [...] পর্যন্ত, ডিস্ট্রিক্ট অফিসার সহানুভূতি জানিয়ে খবর নিচ্ছে, বার বার লোক পাঠিয়ে খবর জানার জন্য ওফ্ তাঁর আগ্রহ—আর তুমি, তুমি কোন নবাবের ছেলে, একবার গিয়ে তাকে দেখে আসার মতো সময় তোমার—’ আঘাতের পর আঘাতে টেবিল চৌচির হয়ে যাচ্ছে দেখে নলিনাক্ষকে বাধা দিয়ে বললাম—‘কোন বীরেশ?’
—‘কোন বীরেশ?’
নলিনাক্ষর চোখের দিকে তার উদ্যত হাতের বড় মুষ্ঠির দিকে তাকিয়ে মনে হলো, হলোই-বা কাঁঠাল কাঠের টেবিল, রঘুগঞ্জের সেই নামজাদা কাঁঠাল গাছটার কাঠ দিয়ে অবিনাশ মিস্ত্রিকে লাগিয়ে তৈরি করিয়েছিলাম, আহা তার দিন শেষ হয়ে গেছে।
কিন্তু আশ্চর্য টেবিল স্থির হয়ে রইল, অনেকক্ষণ স্থির হয়ে রইল, নলিনাক্ষর চোখের দিকে ততক্ষণ আমি তাকাতে পারছিলাম না, কিন্তু অনেকক্ষণ পরে একটা আকস্মিক সাহসে হঠাত্ চোখ চেয়ে দেখি নলিনাক্ষর মুখ জানালার দিকে ফেরানো, সে চোখ বুজে আছে। আস্তে আস্তে শুরু করলাম—
—‘বীরেশের কি করে পা ভাঙল?
নলিনাক্ষ কোনো জবাব দিল না, জেগে আছে না ঘুমিয়ে গেছে তাও বোঝার জো নেই।
—‘বীরেশ? কোন বীরেশই-বা? কত বীরেশই তো রয়েছে।’
—‘কত বীরেশ রয়েছে?’ একটা হুঙ্কার ছেড়ে টেবিলটাকে সর্ষেফুলের অন্ধকারের ভেতর পাঠিয়ে দিয়ে নলিনাক্ষ [...] [...] টেবিলের ওপর আবার দামামা বেজে গেল, —‘বীরেশ সব, বীরেশকে ব্যাকে দাও এক একটা বল।’
বাধা দিয়ে।—‘ও সেই ফুটবলিস্ট বীরেশ—’
—‘ফুটবলিস্ট। ও ফুটবলিস্ট! ও সেই ফুটবলিস্ট বীরেশ—উফ্ কি অনুকম্পা তোমার। আহা! আহা! যেন ইসবগুলের শরবত্ দিয়ে প্রাণ ঠাণ্ডা করে দিলেন। ফুটবলার বটে, যেন ফুটবল খেলা পুতুল খেলার মতো—ফুটবলাররা! যেন টিকটিকির ডিম নিয়ে আণ্ডাবাচ্চার পুতুলখেলা হচ্ছে।’
নলিনাক্ষর চুরুট নিভে গিয়েছিল, বিদ্যুতের মতো ক্ষিপ্রতায় চুরুট জ্বালিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললে—‘আই চ্যালেঞ্জ ইউ, কোন ডিকশনারিতে তুমি ওই জঘন্য শব্দ পেয়েছ।’
—‘কি জানি, ডিকশনারিতে আছে কি না বলতে পারি না।’
—‘তোমরা মানুষ নও, তোমরা সরীসৃপ, সেইজন্য [স্পোর্টসম্যানকে] ফুটবলিস্ট বলে তোমাদের নারীত্বের পরিচয় দাও।
—আমরা সরীসৃপ এবং নারী? কিন্তু—’
—‘তোমরা তার চেয়েও অধম, ফুটবলিস্ট! ওঃ সেই ফুটবলিস্ট! ও ফুটবলিস্ট বীরেশ! ওফ্! তোমার সরীসৃপের চেয়ে অধম—নারীর চেয়েও। আমি ভেবে পাই না কোন জাতের জীবের সঙ্গে তোমাদের তুলনা করব।’
—‘সেরকম জীব পৃথিবীতে জন্মায়নি আজও।’
—‘তা নিশ্চয়ই না, কোনোদিন জন্মাবে বলে মনে হয় না।’
—‘এতক্ষণ চিনেছ বীরেশ মুখুয্যে, সেই যে সরকারের দিঘি চল্লিশবার সাঁতরেছিল’—
—‘দেখতে গিয়েছিলে—তুমিও দেখতে গিয়েছিলে—তাহলে তো আমি ভারি অন্যায় করে ফেলেছি প্রথম।’
—‘আ নলিনাক্ষ তুমি এরই মধ্যে ভুলে গেলে সব, প্রায় হাজার তিনেক লোক হয়েছিল।’
—‘দশ হাজারের একটা মাথাও কম না।’
—‘তা হবে, হাজার বিশেক হয়েছিল হয়তো।’
—‘তা হতে পারে, হাজার বিশেক, তা হবে বইকি— হলোইও-বা মফস্বল শহর, শহর তো দিঘির পাড়ে ভেঙে পড়েছিল সেদিন।’
—‘তুমি যে জিনিসে হাত দাও, আ নলিনাক্ষ! কিন্তু এরই মধ্যে কি করে নলিনাক্ষ তুমি সব কথা ভুলে গেলে—’
—‘কেন? কী ভুললাম? ডিস্ট্রিক্ট অফিসার চারু মুখুয্যে আমাকে—’
—‘না, না, সে কথা নয়, সাঁতার শেষ হয়ে গেলে ভিড়ের ভেতর থেকে ছোঁ মেরে তুমি বেছে নিলে যাকে, তোমার যা চিলের মতো চোখ, ঘাড় ধরে একেবারে টেনে নিয়ে গেলে প্যান্ডেলের ভেতর।’
নলিনাক্ষ একটু সন্দিগ্ধভাবে—‘কি জানি, মনে পড়ছে না তো ঠিক, তোমাকে টেনে নিয়ে গিছলাম—’
—‘বাঃ একেবারে প্যান্ডেলের ভেতর টেনে নিয়ে—’
—‘প্যান্ডেল তৈরি করেছিলাম? কী রকম প্যান্ডেল?’
—‘যে কোনো কংগ্রেসের প্যান্ডেলের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।’
—‘ইস্ কুয়াশার মতো আমার মনে পড়ছে প্রমথ, কিন্তু বীরেশ যা সাঁতার কেটেছিল সেদিন—’
—‘আশ্চর্য। অত চেয়ার পেলে কোথায়?’
—‘চেয়ার! শ’ পাঁচেক এনেছিলাম বোধহয়।’
—‘বলো কি? কিছুই মনে নেই তোমার? হেসেখেলে হাজার তিনেক—’
নলিনাক্ষর চোখ আস্তে আস্তে জুড়িয়ে এলো, চুরুট টানতে টানতে সে চুপ করে রইল।
—‘আর চায়ের পেয়ালা ভেঙেছিল তো হাজার দেড় হাজার। দাম দিল কে?’
নলিনাক্ষ আধ সেকেন্ডের জন্য একবার চুরুটটা মুখের থেকে বের করে—‘ওসব দাম দিয়েই দিতে হয়।’
—‘এত টাকা সমিতি পায় কোত্থেকে?’
—‘জোগাড় করতে হয়।’
—‘তোমার নিজের তফিল থেকে কত দিলে?
—‘সেসব প্রাইভেট—সাঁতারের কথা বলো।’
—‘বেশ সাঁতার হয়েছিল।’
—‘না, না, খুলে বলো।’
—‘ছ’বছর আগের ব্যাপার—আজ সেসব কথা... হয়তো দশ হাজার লোক হয়েছিল, হয়তো হাজার খানেকের বেশি হয়নি, হয়তো হাজার দেড়েক পেয়ালা ভেঙেছিল, হয়তো দুইশ’ পেয়ালার বেশি আমদানিই হয়নি। আমি অবাক হয়ে ভাবি চা-ও কি খাওয়া হয়েছিল সেদিন?’
নলিনাক্ষ নিস্তব্ধভাবে চুরুট টানছিল, টেনে যেতে লাগল।
—‘কই আমি তো কাউকে চা খেতে দেখিনি।’
—‘কাউকে সাঁতার কাটতে দেখেছিলে?’
—‘আমি গিয়েছিলাম ভিড় দেখতে।’
—‘ভিড় দেখতে! কেন? নলিনাক্ষ মহালনবিশ যে কাজে হাত দেয় তাতে লোক হয় না, এই তো বলতে চাও তুমি? এর প্রমাণ করতে গিয়েছিলে তো? আই চ্যালেঞ্জ ইউ দশ হাজার গুঁফো হাজির ছিল সেদিন দ-শ-হা-জা-র গুঁফো’ টেবিলে বিকট শব্দ করে—‘একটা মেয়েমানুষ কিংবা প্রমথ ভট্টাচায্যিকে আমি মানুষের মধ্যেই ধরি না—বিধাতা তোমাকে গোঁফ দিয়েছিলেন তা কামিয়ে তুমি শ্রীমতী সেজেছ—কিন্তু না কামালেই-বা কি, একটা আরশোলা একটা শুঁয়োপোকারও অধম। মেয়েমানুষদের ভেতরেও পুরুষ আছে, কিন্তু তুমি প্রমথ ভট্টাচায্যি তোমার মায়ের চেয়ে বোনের চেয়ে বউয়ের চেয়েও নির্ঘাত্ মেয়েমানুষ তুমি, মেয়েমানুষদের ভেতরেও তোমার মতন মেয়েমানুষ আমি দেখিনি। এই রইল চুরুট, তোমার মাথায় ঘোমটা না টেনে দিয়ে আমি একটানও দিচ্ছি না। আর—আজ বেরুচ্ছি না এখান থেকে’—বলে নলিনাক্ষ তার থাবা বাড়িয়ে দিল।
—‘সাঁতার হয়ে গেল, আমাকে তুমি বক্তৃতা করতে ডাকলে। আমি সভাপতি বাড়ুয্যে সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে—’
—‘তুমি কি বক্তৃতা দিয়েছিলে সেদিন?’
—‘টানাহেঁচড়া করে আমাকে প্যান্ডেলে নিয়ে গিয়ে এখন এই কথা বলছ?’
নলিনাক্ষ গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে—‘কি জানি আমার তখন মনে হতো, তুমি একটু-আধটু বলতে পার।’
—‘আমি কি বলেছিলাম মনে নেই তোমার।’
নলিনাক্ষ সহৃদয়ভাবে ভ্রূকুটি করে বললে—‘আমার মনেই নেই তুমি বলেছিলে কিনা।’
—‘তোমাদের বড় মানুষের এই দোষ।’
—‘মুখ ভার করলে কেন? বক্তৃতা দিয়েছিলে তো দশজনের জন্য, কর্মকর্তার জন্য নয় প্রমথ, স্পিচ শুনবার সময় কোথায় আমার, হয়তো চায়ের তদারক করছিলাম।’
—‘চা? তোমার কাছে আজ একটা নালিশ জানাব আমি নলিনাক্ষ, বক্তৃতা পর্যন্ত দিলাম, তবু গলা ভেজাবার জন্য এক চুমুক চা পর্যন্ত সেদিন কপালে জুটল না।’
—‘এতদিন একথা বলোনি কেন আমাকে? চলো আজই রেস্টুরেন্টে যাই, তোমাকে দস্তুরমতো খাইয়ে দিচ্ছি আমি, চপ কাটলেট, কিমার কারি, স্যান্ডউইচ।’
—‘না না এসব খেতে চাই না আমি।’
—‘পানীয়? বেশ [...] হুইস্কি [...] বাধা দিয়ে—‘ওসব আমি খাই না কিছু।’
—‘তাহলে কি কফি খাবে?’
—‘কিছু না নলিনাক্ষ, আমি শুধু বলছিলাম সেদিন অমন ডামিশ বক্তৃতার পর দেড় হাজার পেয়ালাও যখন ভাঙল, এক কাপ চা না পেয়ে নিজের অদৃষ্টকে খুব ধিক্কার দিয়েছি।’
—‘বাস্তবিক আমাদের সভাসমিতির ভেতর কোথায় যেন দোষ আছে।’
—‘কি রকম?’
—‘কিংবা দোষ আমারই, তিন হাজার চায়ের কারবারে এক পেয়ালাও পেলাম না। অথচ আমি বক্তৃতা দিয়েছিলাম।’
—‘আমাকে স্নব বলতে চাও?’
—‘না, না, তুমি কোথায় তখন? তোমাকে পেলে তো হাতের কাছে আকাশ পেতাম। কিন্তু হাতের কাছে মানুষ কোনোদিন আকাশ পায় না, আকাশের এই বিশেষত্ব।’
—‘অর্থাত্ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলা হচ্ছে নলিনাক্ষ মহালনবিশ একটা স্নব’ দুই ঘুষিতে টেবিল দমদম করে বেজে উঠল। নলিনাক্ষ জোর চুরুট টেনে যেতে লাগল, অনেকক্ষণ, টানল। আমার দিকে তাকিয়ে—‘আমি দেখাব তাদের।’
—‘কাদের?’
—‘সেইদিন সেই মিটিঙের ব্যবস্থা যারা করেছিল।’
—‘তাদের কী করবে?’
—‘সমস্ত হিসেব-নিকেশ চাই। ক’পেয়ালা চা হয়েছিল, ক’পেয়ালা ভেঙেছিল, আমার জমিদারির থেকে এসবের জন্য টাকা দিতে আমি কেন বাধ্য, চাঁদার টাকা যায় কোথায়? যায় কোথায় চাঁদার টাকা? চাঁদার টাকা কোথায় যায়? চ্যালেঞ্জ দ্যাট রাশকেল হরেন সরখেল আই সে চাঁদার টাকা সব কার পিণ্ডি চটকাতে যায়? কোন শালার গুষ্টির পিণ্ডি—’
ভেবেছিলাম নলিনাক্ষ এইবার উঠবে, কিন্তু উঠল না, চুপ করে আরও অনেকক্ষণ বসে চুরুট টানল।
অনেকক্ষণ পরে আমি—‘আমার মনে হয়—’ থামলাম, নলিনাক্ষকে সব কথা বলতে সহসা সাহস হয় না।
—‘কী মনে হয়? কী মনে হয় তোমার?
—‘তুমি এসব ছেড়ে দাও।’
—‘কী ছেড়ে দেব?’
—‘হরেন সরখেলকে [...] করে কি আর হবে, কিন্তু সে হলো অবান্তর কথা, আমি কি বলতে চাই জান?’ দেখলাম বাঘের মতো চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
—‘কী ছেড়ে দেব আমি শুনতে চাই। টু দি পয়েন্ট বলবে, না হলে ঘুষিয়ে তোমার মাথা উড়িয়ে দেব।’
—‘বরং বলতে ইচ্ছে করে, বলা উচিত কয়েকটা নতুন জিনিস যদি তুমি ধর, তাহলে ভালো হয়।’
—‘যথা?’
—‘ক্রিকেট ক্লাবের সেক্রেটারি, ফুটবল ফিল্ডের রেফারি চমত্কার নলিনাক্ষ, চমত্কার, কিন্তু তোমার পাঁচহাত লম্বা দারুণ চেহারা শরীর ও মনে আশ্চর্য শক্তি, আশ্চর্য মনের শক্তি তোমার, আমার মনে হয় দেশকে তুমি একটা কিছু দাও।’
—‘অর্থাত্ বায়স্কোপে নামতে হবে?’
—‘না।’
—‘তবে?’
—‘সেদিন দেখলাম একজন ফিরিঙ্গি মোটর ড্রাইভ ও রেফারিগিরি করছে, চমত্কার রেফারি, তুমি হয়তো একজন ভালো মোটর ড্রাইভার, কিন্তু তোমার কাছ থেকে আমরা’—
—‘অতএব আমাকে কবিতা লিখতে হবে?’
—‘তুমি কবিতা বোঝ না, লিখবে কেমন করে?’
—‘উঠি, অনেকটা সময় নষ্ট করে গেলাম, একজন মেয়েমানুষের সঙ্গে কাটালেও ঢের ভালো ছিল। আজ বিকেলে [...] ওখানে চা খেতে যাব। তাকে বলব সকালবেলা একটা গাধার পাল্লায় পড়েছিলাম।’
—‘বোলো শীত রাতের পেঁচার পাল্লায়।’
—‘না না, গাধার পাল্লায়, কিংবা শুয়োরের পাল্লায় পড়েছিলাম, শুয়োরটা বলে একটা ড্রাইভারও যখন রেফারি হতে পারে তখন নলিনাক্ষ মহালনবিশ তুমি কবিতা লেখ—কি আকাট গাধা।’ নলিনাক্ষর সমস্ত শরীরটার উপর দিয়ে একটা প্রবল ধিক্কারের ঝড় বয়ে গেল।
নলিনাক্ষ—‘চায়ের টেবিলে মেমসাহেব থাকবে।’
—‘হাসি জমবে বেশ। কিন্তু—’
টেবিলের ওপর দড়াম করে একটা ঘুষি মেরে নলিনাক্ষ ‘ভটচাজ, তুমি যে তোমার কবিতা খুব বড় মনে করো, আর বড় মনে করো তোমার দেশকে। তোমার লেখা কয়েকটা পয়ার নিয়ে দেশের পথে তুমিও নেমো, আর ফুটবল ফিল্ডের রেফারি হয়ো। আমিও নামব, না হয় সেই ড্রাইভারটাই নামবে, দেখি দেশের লোক কাকেই-বা বাহবা দেয়, কার গায়েই-বা থুথু ফেলে।’ চুরুট জ্বালিয়ে উঠে দাঁড়াল নলিনাক্ষ। বললে—‘তোমার কবিতা নিয়ে ভিজে বিড়ালের মতো ঘরের কোণে পড়ে আছ, কিন্তু সেই ড্রাইভারটার রেফারিগিরি দেখার জন্য এ মুলুকের হাজার স্কুল-কলেজের ছেলে, হাজার হাজার মানুষ কাদাবৃষ্টি ঠেলে মাঠে ভেঙে পড়ছে রোজ।’
সূত্র : আমার দেশ

জীবনানন্দ দাশের 'রূপসী বাংলা' কাব্যগ্রন্থ থেকে

১৫.
যদি আমি ঝ’রে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়
যখন ঝরিছে ধান বাংলার খেতে-খেতে ম্লান চোখ বুজে
যখন চড়াই পাখি কাঁঠালিচাঁপার নীড়ে ঠোঁট আছে গুঁজে
যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে উঠানের খয়েরি পাতায়
যখন পুকুরে হাঁস সোঁদাজলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়
শামুক গুগলিগুলো প’ড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে
তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক ছাওয়া মাঠে খুঁজে
ঠেস দিয়ে ব’সে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়

তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকারে মৃত্যুর আহ্বান
যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড়
একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর
যার ডাক শুনে আজ খেতে-খেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরীর ধান
কবে যে আসিবে মৃত্যু : বাসমতী চালে ভেজা শাদা হাতখান
রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরচনারূপে আমি করিবো যে স্নান—

১৬.
মনে হয় একদিন আকাশের শুকতারা দেখিবো না আর
দেখিবো না হেলেঞ্চার ঝোপ থেকে একঝাড় জোনাকি কখন
নিভে যায়—দেখিবো না আর আমি পরিচিত এই বাঁশবন
শুকনো বাঁশের পাতা-ছাওয়া মাটি হ’য়ে যাবে গভীর আঁধার
আমার চোখের কাছে—লক্ষ্মীপূর্ণিমার রাতে সে কবে আবার
পেঁচা ডাকে জ্যোত্স্নায়—হিজলের বাঁকা ডাল করে গুঞ্জরণ
সারারাত কিশোরীর লালপাড় চাঁদে ভাসে—হাতের কাঁকন
বেজে ওঠে : বুঝি না—গঙ্গাজল, নারকোলনাড়ুগুলো তার

জানি না সে কারে দেবে—জানি না সে চিনি আর শাদা তালশাঁস
হাতে ল’য়ে পলাশের দিকে চেয়ে দুয়ারে দাঁড়ায়ে রবে কি না...
আবার কাহার সাথে ভালোবাসা হবে তার—আমি তা জানি না
মৃত্যুরে কে মনে রাখে?... কীর্তিনাশা খুঁড়ে খুঁড়ে চলে বারোমাস
নতুন ডাঙার দিকে—পিছনের অবিরল মৃত চর বিনা
দিন তার কেটে যায়—শুকতারা নিভে গেলে কাঁদে কি আকাশ?

তোমাকে || জীবনানন্দ দাশ

একদিন মনে হ’তো জলের মতন তুমি।
সকালবেলার রোদে তোমার মুখের থেকে বিভা—
অথবা দুপুরবেলা—বিকেলের আসন্ন আলোয়—
চেয়ে আছে—চ’লে যায়—জলের প্রতিভা।

মনে হ’তো তীরের উপরে ব’সে থেকে।
আবিষ্ট পুকুর থেকে সিঙাড়ার ফল
কেউ কেউ তুলে নিয়ে চ’লে গেলে-নিচে
তোমার মুখের মতন অবিকল

নির্জন জলের রং তাকায়ে রয়েছে;
স্থানান্তরিত হ’য়ে দিবসের আলোর ভিতরে
নিজের মুখের ঠাণ্ডা জলরেখা নিয়ে
পুনরায় শ্যাম পরগাছা সৃষ্টি করে;

এক পৃথিবীর রক্ত নিপতিত হ’য়ে গেছে জেনে
এক পৃথিবীর আলো সবদিকে নিভে যায় ব’লে
রঙিন সাপকে তার বুকের ভিতরে টেনে নেয় :
অপরাহ্নে আকাশের রং ফিকে হ’লে।

তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর অমোঘ সকাল;
তোমার বুকের ’পরে আমাদের বিকেলের রক্তিম বিন্যাস;
তোমার বুকের ’পরে আমাদের পৃথিবীর রাত :
নদীর সাপিনী, লতা, বিলীন বিশ্বাস।

সবিতা || জীবনানন্দ দাশ

সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে:
ভূমধ্যসাগর ঘিরে যেইসব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন;
মনে পড়ে নিবিড় মেরুন আলো, মুক্তার শিকারী,
রেশম, মদের সার্থবাহ,
দুধের মতন শাদা নারী।

অনন্ত রৌদ্রের থেকে তারা
শাশ্বত রাত্রির দিকে তবে
সহসা বিকেলবেলা শেষ হ’য়ে গেলে
চ’লে যেতো কেমন নীরবে।
চারিদিকে ছায়া ঘুম সপ্তর্ষি নক্ষত্র;
মধ্যযুগের অবসান
স্থির ক’রে দিতে গিয়ে ইওরোপ গ্রিস
হতেছে উজ্জ্বল খ্রিস্টান।

তবুও অতীত থেকে উঠে এসে তুমি আমি ওরা—
সিন্ধুর রাত্রির জল জানে—
আধেক যেতাম নব পৃথিবীর দিকে;
কেমন অনন্যোপায় হাওয়ার আহ্বানে
আমরা অকূল হ’য়ে উঠে
মানুষকে মানুষের প্রয়াসকে শ্রদ্ধা করা হবে
জেনে তবু পৃথিবীর মৃত সভ্যতায়
যেতাম তো সাগরের স্নিগ্ধ কলরবে।

এখন অপর আলো পৃথিবীতে জ্বলে :
কী এক অপব্যয়ী অক্লান্ত আগুন!
তোমার নিবিড় কালো চুলের ভিতরে
কবেকার সমুদ্রের নুন;
তোমার মুখের রেখা আজো
মৃত কতো পৌত্তলিক খ্রিস্টান সিন্ধুর
অন্ধকার থেকে এসে নব সূর্যে জাগার মতন;
কতো কাছে—তবু কতো দূর।

বুনো হাঁস || জীবনানন্দ দাশ

পেঁচার ধূসর পাখা উড়ে যায় নক্ষত্রের পানে—
জলা মাঠ ছেড়ে দিয়ে চাঁদের আহ্বানে
বুনো হাঁস পাখা মেলে—সাঁই-সাঁই শব্দ শুনি তার;
এক-দুই-তিন-চার অজস্র-অপার—

রাত্রির কিনার দিয়ে তাহাদের ক্ষিপ্র ডানা ঝাড়া
এঞ্জিনের মতো শব্দে; ছুটিতেছে—ছুটিতেছে তা’রা।
তারপর প’ড়ে থাকে নক্ষত্রের বিশাল আকাশ,
হাঁসের গায়ের ঘ্রাণ—দু-একটা কল্পনার হাঁস;

মনে পড়ে কবেকার পাড়াগাঁর অরুণিমা সান্যালের মুখ;
উড়ুক-উড়ুক তা’রা পউষের জ্যোত্স্নায় নীরবে উড়ুক
কল্পনার হাঁস সব; পৃথিবীর সব ধ্বনি সব রং মুছে গেলে পর
উড়ুক উড়ুক তা’রা হৃদয়ের শব্দহীন জ্যোত্স্নার ভিতর।

Sunday, October 23, 2011

খাদ্য রস - ২

নেটে ঘুরতে ঘুরতে নানান সময় নানান ধরনের মজার ছবি চোখে পড়ে। এর কোন কোনটি হয়তো সুন্দন, রহস্যময় বা উদ্ভট। কখনো ইচ্ছে করে সবার সাথে তা শেয়ার করি। তাই আজ আপনাদের সাথে শেয়ার করছি কিছু চমৎকার খাদ্য রসাত্মক ছবি।


































































আরো দেখুন, খাদ্য রস - ১


এখনো অনেক অজানা ভাষার অচেনা শব্দের মত এই পৃথিবীর অনেক কিছুই অজানা-অচেনা রয়ে গেছে!! পৃথিবীতে কত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে- যারা দেখতে চায় তাদের ঝিঁঝি পোকার বাগানে নিমন্ত্রণ।

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ