প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Monday, April 30, 2012

মুক্তমানবী | সুবহে সাদিক

তুষার পড়া থেমেছে আজ দু’দিন হলো। রাস্তায় ইতিমধ্যে জমা বরফগুলো সবে গলতে শুরু করেছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তুষারে ঢাকা মাঠ, রাস্তাঘাটের দিকে তাকিয়ে ক্যাথেরিন মেঘলা মলিন আবহাওয়া নিয়ে ভাবছিলো। আজ কি আবার তুষারপাত হবে? ওয়েদার ফোরকাষ্টে অবশ্য শুধু মেঘলা আকাশের কথা বলা আছে। নিতান্তই সাদামাটা মেঘলা আকাশ তার পছন্দ না, আকাশের স্থির মেঘগুলো কেমন যেন মন খারাপ করে দেয়। এর চেয়ে তুষার পড়াই ভালো। অবশ্য আজকের দিনটির কথা ভিন্ন। আজ ক্যাথেরিন মনে মনে চাইছে কোনভাবেই যেন তুষারপাত শুরু না হয়। কিছুক্ষনের মধ্যে তাকে বের হতে হবে। এখান থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরের একটা শহরে তার চাকুরী হয়েছে। আজকে তার জীবনে প্রথম অফিসে যাওয়া।

আজ আরো একটি কাজ সে প্রথমবারের মতো করতে যাচ্ছে। কিন্তু এই দ্বিতীয় কাজটির কথা সে তার বাবা-মা কে জানায়নি। অবশ্য জানানোর কথাও নয়। বাবা-মা’র সাথে গত কয়েকমাস ধরে তার সম্পর্ক শীতল। এখানে যতদিন থাকবে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। তাই সে ঠিক করেছে চাকরীস্থল ব্র্যাডফোর্ডেই সে বাসা নিয়ে থাকবে, সপ্তাহান্তে মা-বাবার সাথে দেখা করতে এখানে আসবে।
‘ক্যাথি, তুমি কি এখন নাস্তা করবে?’ নীচতলার সিঁড়ির কাছ থেকে ক্যাথি তার মায়ের ডাক শুনতে পেল।
‘হ্যাঁ, আমি আসছি মা’, ক্যাথি জবাব দিল।
কাপড় চোপড়, কাগজপত্র সব ব্যাগে গুছিয়ে রেডী করে রেখে ক্যাথি নাস্তা করার জন্য নীচে নামল।
‘ব্র্যাডফোর্ডে কি তোমার বাসা ঠিক হয়েছে?’ খাওয়ার টেবিলে বসে বাবা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ হয়েছে’, ক্যাথি জবাব দিল।

‘তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছো ক্যাথি। কাজেই নিজের ভালোমন্দ তুমি নিজেই বুঝতে পারো। কিন্তু আমি তোমাকে আগে যে কথাটি বলেছিলাম সেটা মনে রেখ। আরো কিছুদিন সময় নাও, তারপর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারো’।

ক্যাথি মাথানিচু করে বসে আছে। সে তার বাবার কথার উত্তরে কিছুই বলল না। মাথানিচু করে রাখলেও সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাবার পাশে বসা তার মা উত্তরের আশায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মা-ই প্রথম ক্যাথির ধর্মান্তরের বিষয়টি বুঝতে পারেন। মাসখানেক ধরে তিনি মেয়ের আচরনে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিলেন। ক্যাথি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম, সে তার আর দুই ভাইবোনের মতো নয়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লা করার বা উইক এন্ডে পার্টি দেয়ার, এলকোহল পান করার, কিংবা ধুমপান করার অভ্যাস ওর কখনোই ছিল না। তবে তিনি যখন খেয়াল করলেন সে পর্ক খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তখনই সেটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। তিনি খেয়াল করলেন মেয়ের পোশাক আশাকেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। টাইট-ফিট জামা ছেড়ে সে ফুলহাতা লুজ জামা কাপড় পড়ছে। কিন্তু সেটা সাধারনত ধর্মীয় পোশাক বলতে যা বুঝায় তা নয়। স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকতেও তাকে তিনি কখনো দেখেননি। তাই ধর্মান্তরের বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি মেয়েকে বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করেলন। মায়ের সুতীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসার সামনে ক্যাথি ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করতে পারলো না। কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে শেষে জানালো সে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি চিন্তা করছে। মা তাকে আর কিছু বলেননি।

সেই রাতে বাবা তার রুমে আসলেন। বাবা এর আগে কখনো তার রুমে আসেননি। ক্যাথি বুঝতে পারলো বাবা বিষয়টা খুব সিরিয়াসলী নিয়েছেন। সে কি বলবে সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিল। বাবা বললেন, ‘আমি বিষয়টি তোমার মা’র কাছে শুনেছি। যাহোক, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে তোমার বয়স এখনো অনেক কম। কাজেই আমি বলব সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরো কিছুদিন সময় নাও। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে। আমার বিশ্বাস তুমি ভুল কোন সিদ্ধান্ত নেবে না’।

ক্যাথি কোন কথা বলল না। অবশ্য বাবা সম্ভবত তার কাছে কোন উত্তর আশা করেননি। তিনি তার কথাগুলো বলেই গুডনাইট জানিয়ে চলে গেলেন। বাবা রুম থেকে চলে যাওয়ার পর ক্যাথি একটি স্বস্তির নিঃশাস ফেলল।বাবা-মা জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা নিয়ে সে চিন্তিত ছিল। খুব সহজভাবে তারা ব্যাপারটা মেনে নেবে সেটা সে আশা করেনি।

তবে সে যতটা ভেবেছিল পরিস্থিতি এর পরের কয়েকদিনে আরো কঠিন হয়ে উঠল। মা তার চলাফেরা, চালচলনের উপর সজাগ নজর রাখতেন লাগলেন, সুযোগ বুঝে তীর্যক কথাবার্তাও বলতে লাগলেন। যেমন একদিন সকালবেলা ক্যাথি লিভিংরুমে বসে টিভি দেখছিল। বাবা-মা দু’জনও ছিলেন। মা হঠাৎ করে সেদিনকার পত্রিকার একটা খবরে আফগানিস্তানের কোন এক গ্রামের সম্পূর্ণ বোরকা পরিহিতা দুই মহিলার ছবির দিকে ইংগিত করে বাবাকে বলতে লাগলেন, ‘এই হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত ক্যাথি’। আরেকদিন রাতে খাবার টেবিলে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাসতে হাসতে বললেন, ‘জানো তো ক্যাথি, তোমার ঐ নতুন ধর্মের মেয়েদের বিয়ের পর রাস্তায় হাঁটার সময় স্বামী থেকে কমপক্ষে তিনহাত পিছনে থাকতে হয়!’ ক্যাথি বুঝতে পারে এসব তীর্যক কথাবার্তার উত্তরে সে অনেক কিছু বলতে পারে, কিন্তু সে কিছুই বলে না। সে জানে এর উত্তর দেয়া মানে এগুলোকে আরো উস্কে দেয়া। সে বুঝতে পারছিলো এসব থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া। তাই সে কিছুদিন হন্যে হয়ে চাকরী খুঁজল।

সৌভাগ্যক্রমে সে অন্য একটি শহরে চাকুরী পেয়েছে। এখন অনায়াসে সে চাকুরীর কথা বলে এখান থেকে দূরে থাকতে পারবে। যদিও একা বাসা নিয়ে থাকা কিংবা চাকুরী করা কোনটাই তার পছন্দ নয়, তবুও বাব-মা’র সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক না পর্যন্ত সে এভাবেই থাকতে চায়। অন্তত, এখন নামাজ পড়ার সময় তাকে আর তটস্থ থাকতে হবে না যে কখন মা ঘরে এসে পড়ে, কিংবা নীচ থেকে ডাকাডাকি শুরু করে। প্রথম যেদিন সে নামাজ পড়ে সেদিন সে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল। নামাজের নিয়ম কানুন সদ্য শিখে সে সবে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, অমনি কি জন্য যেন মা তাকে নীচ তলা থেকে ডাকতে শুরু করলেন। তার সাড়া না পেয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলেন। তাদের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের এই বাড়িটির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে বড্ড শব্দ হয়। শব্দ শুনে ক্যাথি মনে মনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ভাগ্যিস তখনি নীচ তলার লিভিংরুম থেকে ফোনটা বেজে উঠল। মা ফোনে কথা শেষ করে যখন ক্যাথির রুমে আসলেন তখন দেখা গেলো সে ঘুমুচ্ছে; আসলে সে ঘুমোচ্ছিলো না।
তবে তার জন্য সবচেয়ে কৌতুহল আর আনন্দের সময় ছিল রমজান মাসটা। রমজান মাসে রোজা রাখার বিষয়টা সে শিখেছিল ছিল ইন্টারনেট থেকে। তার ধর্মান্তরের দেড় মাস পরেই ছিল রমজান মাস। রোজা রাখার বিষয়টি অবশ্য তার বাসার কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু সেই সময়টা সে উৎকন্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিল, মা কোন কারনে ডাকলেই মনের ভিতর একটা আশংকা ভর করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশংকাজনক কিছু হয়নি। না খেয়ে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে তার মধ্যে সামান্য ভয়ও ছিল, সে বুঝতে পারছিলো না এতোটা সময় সে না খেয়ে থাকতে পারবে কি-না। তবে এটা নিয়েও তার কোন সমস্যা হয়নি। বরং স্বেচ্ছায় সারাদিন না খেয়ে থাকার মধ্যে যে এমন পবিত্র অনুভূতি থাকতে পারে সে এটা আগে কল্পনাও করতে পারেনি। প্রথমদিন রোজা রাখার পর তার মনে মুক্তির যে অনুভূতি জেগে উঠল সেটা এর আগে সে কখনো অনুভব করেনি। তার মনে হয়েছে এখন সে নির্দ্ধিধায় তার নতুন ধর্মের কথা সবাইকে জানাতে পারে। যেন সে এতোদিনের সকল ভয়, সংকোচ, আড়ষ্টতার উর্দ্ধে চলে গেছে।
তবু সে তার সংকোচ পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। সে জানে তার জন্য মুখমন্ডল এবং হাতের কিছু অংশ ছাড়া আর কিছু জনসন্মুখে অনাবৃত রাখা বৈধ নয়। কিন্তু এই কাজটি সে করতে পারছে না। সে লং স্লিভ জামা পড়ে এখন, শুধু টাইটস পড়ে সে এখন আর বাইরে বের হয় না, যতটা মেনে চললে তার মা-বাবা বুঝতে পারবে না ততটা সে মেনে চলছে। বেশ কয়েকবার সে ভেবেছিল স্কার্ফ পড়া শুরু করবে। কিন্তু সেটা এমন একটা কাজ যেটা গোপনে বা সবার অলক্ষ্যে করা যায় না। সে কি করবে বুঝতে পারে না। এমন দ্বৈত আচরণ সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। একদিন মার্কেটে গিয়ে সে একটি স্কার্ফ কিনেও নিয়ে আসল। কিন্তু পরার সাহস পায়নি। সেটা তার হ্যান্ড ব্যাগের মধ্যেই পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে বের করে দেখে, কিন্তু পরা হয় না।

অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় সে স্কার্ফটি পরবে। যেদিন সে তার চাকুরী হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হলো সেদিনই সে ঠিক করে তার প্রথম অফিসে যাওয়ার দিন থেকেই সে স্কার্ফ পড়বে। এতো সহজ অথচ এতো কঠিন সিদ্ধান্তটি নেয়ার পরপর সে শিহরন অনুভব করে, সে বুঝতে পারে সেটা তার জীবনকে বদলে দেবে, তার নতুনত্বকে সম্পুর্ন করবে। সে অপেক্ষা করতে থাকে দিনটির জন্য। আজ সেইদিন।

বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে ক্যাথি বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বাস আসতে এখনো তিন মিনিট বাকী। বাসে করে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত যেতে ১৫ মিনিট লাগবে, ট্রেন ছাড়ার ৪/৫ মিনিট আগে আগে হয়তো সে স্টেশনে পৌঁছাবে। বাসা থেকে বের হতেই দেরী হয়ে গেলো। বাবা সম্ভবত তার স্বেচ্ছায় দূরে থাকার বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছেন, তাই শেষ মুহুর্তে অনেক উপদেশ, পরামর্শ দিলেন। মা বলেছেন একটা বিদেশী ধর্মের জন্য নিজের ইচ্ছা, নিজের স্বাধীনতাকে নিজেই নষ্ট করার কোন কারনই তিনি দেখতে পাননা। কিন্তু ক্যাথি বুঝে উঠতে পারে না সে কিভাবে বাবা-মা কে বোঝাবে যে সে আগের চেয়ে অনেক বেশী মুক্ত। এতোদিন সে অনেকের খেয়াল খুশি মতো চলেছে, অনেকের আঁকা ছকে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। এখন সে কেবল একজনের ইচ্ছামতো চলার চেষ্টা করছে।

ট্রেন স্টেশনে পৌঁছেই দ্রুত টিকেট দেখিয়ে ক্যাথি স্টেশনে ঢুকে পরে। ট্রেন খুঁজে নিয়ে কামরায় উঠতে উঠতেই ট্রেন ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে গেলো। কামরায় যত যাত্রী থাকবে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশীই আছে। প্রায় সব সিটই ভর্তি। তাকে তাড়াহুড়ো করে উঠতে দেখে তার আশেপাশের সীটের যাত্রীরা তার দিকে তাকালো। ক্যাথি দ্রুততার সাথে তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে স্কার্ফটি বের করল। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল, সে তো স্কার্ফ বাঁধতে পারে না, সে আগে কখনো চেষ্টা করে দেখেনি, অন্য কাউকেও স্বচক্ষে বাঁধতে দেখেনি যদিও স্কার্ফ পরা অবস্থায় অনেককে দেখেছে। এটা নিশ্চয় খুব কঠিন কাজ হবে না, একটু চেষ্টা করলেই হয়ত পারবে। কিন্তু এরপর দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল। নিজে নিজে পরতে গেলেতো অন্তত একটা আয়না লাগবে যেখানে দেখে দেখে সে পড়বে। সে একই সাথে উদ্বেলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে স্কার্ফ হাতে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল। কামরার প্রায় মাঝখানে যেখানে ব্যাগ, লাগেজ রাখার জন্য একপাশে তাকের মতো আছে সেখানে তাকের এক পাশেই একটা স্টিলের ডাস্টবিন তার চোখে পড়ল। মুহুর্তেই তার মনে হলো ডাস্টবিনটির চকচকে আবরনকে আয়না হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রায় সাথে সাথেই সে বিনটার সামনে চলে গেলো। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে।

উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। নিতান্তই অনভিজ্ঞ হাতে বিনের অবয়বের দিকে তাকিয়ে ক্যাথি বার বার স্কার্ফটি বাঁধার চেষ্টা করছে। ট্রেনের বেশীর ভাগ যাত্রী এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অধিকাংশই অবজ্ঞা ভরে তাকাচ্ছে, কেউ কেউ কৌতুহলী চোখে দেখছে মেয়েটার কর্মকান্ড। কিন্তু সে দিকে ক্যাথির বিশেষ নজর নেই। সে আপ্রান চেষ্টা করছে স্কার্ফটা যথাসম্ভব সুন্দরভাবে পরতে। শেষ পর্যন্ত সে বাঁধতে সফল হলো। বাঁধাটা খুব বেশী সুন্দর হয়নি, কিন্তু সে বিনটার দেয়ালের ঝাপসা অবয়বে নিজেকে দেখে পুরোপুরি অভিভুত হলো। নিজের সত্তাকে সে নতুনভাবে অনুভব করল এবং এই প্রথম সে নিজেকে সম্পুর্ন মুক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল।।

বিঃ দ্রঃ- ঘটনাটি অনেকটাই বাস্তব।

http://www.sonarbangladesh.com/articles/SubehSadiq

মে দিবস : ইসলামী দৃষ্টিকোণ ও আজকের ভাবনা | জহির উদ্দিন বাবর

এক.
সুন্দর এই পৃথিবী উপকরণ সম্ভারে ভরপুর। সুখ-সমৃদ্ধির কোনো কমতি নেই। সভ্যতার চাকা ঘুরছে অবিরত। চোখ ধাঁধানো নির্মাণ, কারুকার্যময় শিল্প, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষ সাধিত হচ্ছে আমাদের চোখের সামনেই। সবকিছুর স্রষ্টা ও নিয়ন্তা মহান রাব্বুল আলামীন এতে কোনো সন্দেহ নেই। এসব তাঁর অফুরন্ত নেয়ামত। কিন্তু এগুলো ততক্ষণ পর্যন্ত উপযোগ ও ব্যবহারযোগ্য হয় না, যে পর্যন্ত কোনো কৌশল, কোনো শ্রম বা প্রযুক্তির প্রয়োগ তাতে না ঘটে। ভূমিতে ফসল ফলত না যদি মানুষ উদয়াস্ত পরিশ্রম করে তাতে ফসল না ফলাত। আল্লাহ তাআলা মাটির নিচে হিরক, পিতল, তামা, লোহা ও জানা-অজানা অসংখ্য রত্ন ভাণ্ডার লুকায়িত রেখেছেন। কিন্তু যদি খনি খননকারীর সুতীক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, সুনিপুণ কর্মকৌশল তাতে প্রয়োগ না হতো, তবে অলংকারের স্বর্ণালী রূপময়তা দেখে কারো চোখ জুড়াতো না। ডুবুরীরা যদি তার অমিত সাহসে সমুদ্র সেচে হীরা-মুক্তা-রত্ন আহরণ না করত তবে অনুসন্ধিৎসু দল বঞ্চিত হতো। সবকিছুর মূলে রয়েছে একদল শ্রমিকের হাড়ভাঙ্গা খাটুনি, ঘাম ঝরানো ক্লেশ, একনিষ্ঠ শ্রম। শ্রমিকের শ্রম না থাকলে কালের চাকা থেমে যেতো, সভ্যতা থমকে দাঁড়াতো, পৃথিবী তার বাসযোগ্যতা হারিয়ে ফেলত।
এজন্য শ্রমিকদের বলা হয় সভ্যতার কারিগর। শ্রমিকের শ্রমই হচ্ছে সভ্যতার প্রধান নিয়ামক। শ্রমিকদের ওপর একটি দেশের উন্নতি ও অগ্রগতি বহুলাংশে নির্ভরশীল। কিন্তু বাস্তব সত্য হলো, এরা সব ক্ষেত্রেই অবহেলিত ও নির্যাতিত। প্রায় প্রতিটি দেশেই এদেরকে নিজেদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করা হয়। মালিক শ্রেণীর স্বেচ্ছাচারিতা তাদেরকে বাধ্য করে নিজ অধিকার আদায়ে আন্দোলন করতে। এ ধরনের শ্রমিক আন্দোলনের একটি ঐতিহাসিক ট্রাজেডির নাম ‘মে দিবস’।

দুই.
আমাদের জীবনে শ্রম একটি অপরিহার্য বিষয়। আল্লাহর এই সৃষ্টিকুলের অফুরন্ত নেয়ামতরাজিকে মানুষের ব্যবহার উপযোগী করার পেছনে শ্রমের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। সভ্যতার চোখ ধাঁধানো অগ্রগতির নেপথ্যে কাজ করছে শ্রম। আমরা দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে শ্রমের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে থাকি। মানুষ সুউচ্চ মনোরম অট্টালিকায় বাস করে আয়েশ করার পেছনে রয়েছে একদল শ্রমিকের ঘামঝরানো ক্লেশ। কিন্তু তারা এই আরামের বিন্দুমাত্রও উপভোগ করতে পারে না। রাসূল সা. শ্রমিক ও শ্রমজীবী মানুষদেরকে অত্যন্ত সম্মানের দৃষ্টিতে দেখতেন। কারণ যারা সৃষ্টির কল্যাণের জন্য নিজেদেরকে তিলে তিলে নিঃশেষ করে দেয়, তারা আল্লাহর কাছেও মর্যাদার অধিকারী। রাসূল সা. বলেছেন, ‘এর চেয়ে উত্তম খাদ্য আর নেই যা মানুষ স্বহস্তে উপার্জনের মাধ্যমে করে। হযরত দাউদ আ. নিজ হাতে উপার্জন দ্বারা জীবিকা নির করতেন।’

রাসূল সা. সাহাবায়ে কেরামের উদ্দেশে বলেন, আল্লাহ তাআলা যাকেই নবী বানিয়ে পাঠিয়েছেন তিনিই ছাগল চরিয়েছেন। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনিও কি ছাগল চরিয়েছেন? রাসূল সা. বললেন, হ্যাঁ আমিও সামান্য কিছু পয়সার বিনিময়ে মক্কাবাসীদের ছাগল চরাতাম।’ হালাল উপার্জনকে ইসলামের অন্যতম ফরজ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। উল্লিখিত হাদীসসমূহ থেকে একথা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম শ্রমের যথাযোগ্য সম্মান ও মর্যাদা দিয়েছে।

ইসলাম শ্রমকে যেমন মর্যাদা ও সম্মান দিয়েছে, তেমনি শ্রমিকের অধিকার আদায়ের ব্যাপারেও ইসলামে রয়েছে অপরিসীম গুরুত্ব। পৃথিবীতে যত ধর্ম ও মতবাদ রয়েছে, তার মধ্যে ইসলাম শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার আদায়ে সবচেয়ে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমাদের অধীনস্ত ব্যক্তিদেরকে আপন সন্তানদের মতো স্নেহ-সমীহ করো। আর নিজেরা যা খাও তাদেরকেও তাই খাওয়াও।’ অন্যত্র বলেন, তোমরা শ্রমিককে তার শরীরের ঘাম শুকানোর পূর্বেই পারিশ্রমিক দিয়ে দাও।’ শ্রমিকের মজুরী যথাযথ আদায় না আদায় না করার পরিণতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ কেয়ামতের দিন আমার মমতাময়ী আশ্রয় থেকে সেই ব্যক্তি বঞ্চিত হবে যে কোনো শ্রমিককে নির্ধারিত পারিশ্রমিক দেয়ার চুক্তিতে নিয়োগ করে, অতঃপর তার কাছ থেকে পূর্ণ শ্রম ও কাজ আদায় করে নেয়, কিন্তু তাকে (পূর্ণ) পারিশ্রমিক দেয় না।’ শ্রমিকের অধিকার আদায়ে ইসলাম নিম্নোক্ত নীতিমালা গ্রহণ করেছে-

(ক) শ্রমজীবী মানুষদেরকে রাসূল সা. মালিক-পুঁজিপতিদের ভাই বলে আখ্যা দিয়েছেন। তাই সমাজে সে ততটুকু পদমর্যাদা ও সম্মান পাবে, যা সমাজের অন্য সদস্যরা পেয়ে থাকে। পেশার কারণে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা যাবে না।
(খ) শ্রমিক যে প্রতিষ্ঠান বা মালিকের কাজ করবে তার ওপর দায়িত্ব হচ্ছে উক্ত শ্রমিকের মৌলিক প্রয়োজনসমূহ পূরণ করা।
(গ) কোনো শ্রমিকের ওপর তার সাধ্যের অতিরিক্ত কাজ চাপিয়ে দেয়া যাবে না।
(ঘ) কাজ শেষ হলে পারিশ্রমিক আদায়ে কোনো ধরনের গড়িমসি করা চলবে না।
(ঙ) শ্রমজীবীদের সহায়তার জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সহজ কিস্তিতে ঋণ দিতে হবে।
(চ) একজন শ্রমিক ইচ্চা করলে মালিকের সঙ্গে মূলধনে শরীক হতে পারবে।
উল্লিখিত নীতিমালাসমূহের আলোকে একথা সুস্পষ্ট যে, ইসলাম শ্রমিকের সর্বোচ্চ ও যথাযথ অধিকার দিয়েছে, যা অন্য কোনো ধর্ম বা মতবাদে কল্পনাও করা যায় না।

তিন.
বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে চলছে বিরোধ ও সংঘাত। মালিক শ্রেণী চায় কিভাবে শ্রমিকদেরকে বেশি কাজ করিয়ে কম পারিশ্রমিক দেয়া যায়। পক্ষান্তরে শ্রমিকেরা চায় ঠিক মতো কাজ না করেই পূর্ণ মজুরী আদায় করে নিতে। উভয় শ্রেণীর স্বার্থান্বেষী মনোভাবের ফলে তাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে দূরত্বের। বর্তমান বিশ্বে প্রচলিত পুঁজিবাদী মতাদর্শে শ্রমিক শ্রেণী গোলামের সমতুল্য। তাদের সঙ্গে খুব ভালো আচরণের প্রয়োজন নেই। অপরদিকে সমাজতন্ত্র শ্রমিকদেরকে একটি কলের সঙ্গে তুলনা করে থাকে। তাদের মতে শ্রমিকের দায়িত্ব শুধু কাজ করে যাওয়া। লাভ-ক্ষতি নিয়ে মাথা ঘামানো শ্রমিকের দায়িত্ব নয়। কিন্তু ইসলাম এ দু’ শ্রেণীর মধ্যকার সম্পর্ক উন্নয়নে সুন্দর পদ্ধতি অবলম্বন করেছে। একদিকে মালিকপক্ষকে বলা হয়েছে, শ্রমজীবী মানুষেরা তোমাদের ভাই, সুতরাং তোমরা তাদের সঙ্গে ভাইসুলভ আচরণ কর। অন্যদিকে শ্রমিকদেরকে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ঠিক মতো পালন করতে উদ্বুদ্ধ করেছে। ফলে উভয়ের মাঝে সুমধুর সম্পর্ক বিরাজ করে।

বর্তমান বিশ্বে চলছে মালিকদের স্বেচ্ছাচারিতা আর শ্রমিকদের হঠকারিতা। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও প্রাইভেট কোম্পানীগুলোতে চাকরিরত শ্রমিকদের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা নেই। এ সুযোগে মালিক শ্রেণী ইচ্ছেমতো খাটাচ্ছে তার অধীনস্ত শ্রমিকদের। তাদেরকে ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করছে বিভিন্ন টালবাহানা করে। কোনো ন্যায়-নীতির তোয়াক্কা করে না তারা। অপরদিকে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়নের মাধ্যমে মালিকদেরকে জিম্মি করে তাদের অধিকার আদায়ে ব্যস্ত। অধিকার আদায়ের তারা যে কোন হঠকারী সিদ্ধান্ত নিতেও পিছপা হচ্ছে না। আন্দোলনের নামে দিনের পর দিন কল-কারখানার চাকা বন্ধ রেখে দেশের অর্থনীতির বারোটা বাজাচ্ছে। ফলে শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে তিক্ততা বাড়ছে বৈ কমছে না।

বর্তমানে শ্রমিকরা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, এটা সর্বজন স্বীকৃত। পুঁজিবাদী বিশ্বে আজ শ্রমিকদের ওপর চলছে অধিকার হরণের খড়গ। উন্নত বিশ্বের দেশসমূহে পর্যন্ত শোষিত হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষেরা। আমাদের বাংলাদেশের শ্রমিকরাও এর ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে এদেশের গার্মেন্টস সেক্টরের মহিলা শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। নানান পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তারা এ কাজে যোগ দেয়। অথচ তাদের সঙ্গে করা হচ্ছে অমানবিক আচরণ। দৈনিক বার-চৌদ্দ ঘন্টা কাজ করেও তাদের বেতন মাত্র এক থেকে দু হাজারের মধ্যে। দ্রব্যমূল্যের চরম ঊর্ধ্বগতির এই বাজারে সামান্য বেতন দিয়ে নাগরিক জীবনে কোনো রকম বেঁচে আছে তারা। অথচ তাদের তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ আজ বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে।

চার.
প্রতি বছর মে দিবসে শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়। সকল নির্যাতনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার প্রত্যয় ব্যক্ত করে। নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সংগ্রাম চলছেও অব্যাহতভাবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, কোনো মতবাদই শ্রমিকের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে সক্ষম নয়। শ্রমিকদের হারানো অধিকার ফিরে পেতে হলে প্রয়োজন ইসলামী শ্রমনীতির পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন। একমাত্র ইসলামই পারবে তাদের সেই অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ইসলামের সোনালী যুগে মালিক-শ্রমিক পরস্পরে ভাইয়ে পরিণত হয়েছিল। তাদের মধ্যে স্থাপিত হয়েছিল মিষ্টি-মধুর সম্পর্ক। আন্দোলন বা সংগ্রাম করে নয় বরং ইসলামের আদর্শে উজ্জীবিত মালিকরাই প্রাপ্যের চেয়ে বেশি অধিকার দিয়েছিল শ্রমিকদেরকে। হযরত আবু যর গিফারী রা. তার গোলামের সঙ্গে ভাগাভাগি করে একই পোশাক পরিধান এবং হযরত ওমর রা. তার গোলামের সঙ্গে পালাক্রমে উটের পিটে চড়ে মরুভূমি অতিক্রম সে কথাই প্রমাণ করে। প্রতি বছর মে দিবস আসে, গতানুগতিক ধারায় পালিত হয়। শ্রমিকদের অধিকার নিয়ে এ দিনে মাতামাতি হয় অনেক। কিন্তু দিনটি চলে গেলে হতভাগ্য শ্রমিকদের নিয়ে আর গরজ বোধ করে না কেউই। এভাবে হাজারো মে দিবস অতিবাহিত হলেও আদায় হবে না এ দিবসের প্রকৃত দাবি। তাই শ্রমিকদের অধিকার স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সম্মিলিতভাবে ইসলামী শ্রমনীতি অনুসরণ করতে হবে। এতেই রয়েছে মালিক-শ্রকিমক উভয়ের সাফল্যের হাতছানি।

zahirbabor@yahoo.com
http://www.sonarbangladesh.com/articles/ZahirUddinBabar

আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার | জহির উদ্দিন বাবর

একটি মাসিক পত্রিকায় মাঝে মাঝে কিছু লেখা লিখেছি যেগুলো একটু ভিন্ন চিন্তার। এক কথায় সংস্কারমূলক চিন্তা থেকে লেখা। আমি লিখেছি সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত চিন্তা থেকে। কিন্তু বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ্য করেছি, এ চিন্তার সমর্থক রয়েছেন বিশাল একটি শ্রেণী। আমাকে এ বিষয়গুলো নিয়ে লিখতে তারা নানাভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন, সমর্থন যুগিয়েছেন। উল্লিখিত সে শ্রেণীটির বেশির ভাগই তরুণ। তরুণ মানে বয়সে নয়, চিন্তা-চেতনায় যাদের তারুণ্যের স্ফুরণ আছে। তাদের মনের গভীরে অগ্রসর চিন্তার যে বীজগুলো প্রোথিত তা আমার কলমে অঙ্কুরিত হচ্ছে দেখে কেউ কেউ উচ্ছ্বসিত হয়েছেন। তবে দু’একজনের কাছ থেকে এ সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তার প্রকাশও ঘটেছে বলে আমি লক্ষ্য করেছি এবং অন্যের কাছে শুনেছি। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আজ পর্যন্ত কেউ সরাসরি আমাকে এ সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলেননি। এর কারণ হলো, আমি এমন কিছু অসঙ্গতি ও দুর্বলতার ওপর আলোকপাত করেছি যা দিবালোকের মতো স্পষ্ট। তারা নিজেরাও তা অনুধাবন করেন। কিন্তু বিষয়টি ভিন্নভাবে চিন্তা করার কারণে এভাবে বলাটা সমর্থন করেন না। তাদের যুক্তি হলো, কওমী মাদরাসা এবং আলেম-ওলামার বিরুদ্ধে তো প্রচুর লেখালেখি এমনিতেই হয়। আমরা কেন ঘরের কথা পরকে বলে শুধুই নিজেদেরকে খাটো করব?

তাদের যুক্তি চমৎকার! কিন্তু আমাদের কথা হলো, নিজের শরীরের অদর্শনীয় কোনো স্থানে বিষ ফোড়া হলে সেটা গোপন করে রাখা যায় কতদিন? কাউকে না কাউকে তো বলতেই হয়। অন্তত চিকিৎসার স্বার্থে তো নিজের আপনজন অথবা ডাক্তারকে তা খুলে বলতেই হয়। প্রয়োজনে দেখাতেও হয়। কোনো কোনো সময় অস্ত্রোপাচারও করা লাগে। এই অস্ত্রোপাচার চিকিৎসার স্বার্থে, আরোগ্য লাভের জন্য। এখন যদি নিজের গোপন অংশ দেখে ফেলার বা এ সম্পর্কে জেনে যাওয়ার ভয়ে কেউ বিষাক্ত ফোড়ার অসহনীয় যন্ত্রণা নিয়ে বসে থাকে তাহলে তো তাতে পঁচন ধরবেই। এই পঁচন এক সময় তার প্রাণহানিরও কারণ হয়ে যেতে পারে। কওমী মাদরাসা কিংবা আলেম-ওলামা সম্পর্কে কিছু বলা স্পর্শকাতর বিষয়। এখানে বিবেচনার বিষয় হলো, বলার ঢং ও উদ্দেশ্য। একজন সন্ত্রাসীও ছুরি দিয়ে আঘাত করে আবার একজন ডাক্তারও ধারালো ছুরি দিয়ে অপারেশন করে। বাহ্যত দু’জনের ক্রিয়াতেই ব্যথা পাওয়া যায়। কিন্তু দু’জনের উদ্দেশ্য ভিন্ন, ছুরি চালানোর ঢংও ভিন্ন। এজন্য একজন পায় শাস্তি, আরেকজনের জন্য থাকে পুরস্কার।

মাদরাসা শিক্ষা কিংবা আলেম-ওলামার দুর্বল দিকগুলো নিয়ে নেতিবাচক আলোচনা যারা করে তাদের উদ্দেশ্য যে হীন সে কথা সবার জানা। কিন্তু আমরা যদি নিজেরা নিজেদের অসঙ্গতি ও দুর্বলতাগুলো নিয়ে আত্মসমালোচনা করি তাতে তো আমাদের উত্তরণের পথটা ত্বরান্বিত হয়। আমাদের দুর্বলতাগুলো গায়ে ঠেলে অস্বীকার করে ফেলার মতো গুয়ার্তুমি কেউ করবেন বলে আমার মনে হয় না। আমরা সবাই জানি কোথায় আমাদের দুর্বলতা। আর এগুলো কাটিয়ে ওঠা এক দুদিনের কাজ নয়। একক কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর পক্ষেও সম্ভব নয় এর কোনো বিহিত করা। এটা সুদূরপ্রসারী একটা কাজ। চিন্তা-চেতনায় বড় ধরনের ধাক্কা না দিতে পারলে কস্মিনকালেও উত্তরণ সম্ভব নয়। মূলত আত্মসমালোচনার ও দুর্বলতার সম্পর্কে নিজের মধ্যে যখন সচেতনতা এসে যায় তখন সে এগুলো কাটিয়ে ওঠার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। এ প্রচেষ্টাই তাকে একদিন উত্তরণের পথ দেখায়। আর নিজের ত্রুটিযুক্ত কাজ কিংবা ভুল পথে চলেও যদি কেউ আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে সে কখনও উত্তরণের পথ খুঁজে পায় না।
আমাদের উদ্দেশ্য আত্মসমালোচনা। সম্ভাবনার দিগন্ত খোলা থাকা সত্ত্বেও চিন্তা-চেতনার পশ্চাদপদতার কারণে নিজেদের পিছিয়ে থাকার কথা যারা অনুভব করেন তারাই কেবল দরদের সঙ্গে কিছুটা আত্মসমালোচনা করেন। এতে কোনো ক্ষতি আছে বলে আমরা মনে করি না। বিষয়গুলো নিজেদের মধ্যে চর্চিত না হলে আমাদের চিন্তাধারায় কোনো পরিচর্তন আসবে না। গতানুগতিক চিন্তা থেকে সরে আসার জন্য চাই ভিন্ন কিছু চিন্তার লালন ও বিকাশ।

দুই.
আসছে কুরবানী ঈদ। কওমী মাদরাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে এ ঈদের গুরুত্ব একটু বেশি। গুরুত্বটা অন্য কারণে। ওইদিন কুরবানীর পশুর চামড়া কালেকশন করা হয় দেশের ছোট বড় প্রায় সব মাদরাসায়। গোরাবা তহবিলের বড় একটা আয় আসে এ খাত থেকে। ঈদুল আযহার আগে পরে মিলিয়ে প্রায় ১০/১৫ দিন মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকরা এ কাজে নিয়োজিত থাকেন। বার বার মানুষের দুয়ারে দুয়ারে গিয়ে বিনীত ও কাতর হয়ে চামড়া কালেকশন করেন। ভেতরের খবর হলো, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অধিকাংশই এ কাজটাতে স্বাচ্ছন্দবোধ করেন না। মনে মনে সবাই এটাকে ঘৃণা করেন। কিন্তু তারপরও করতে হয় বাধ্য হয়ে। মাদরাসার উস্তাদ-স্টাফরা চাকরি টিকানোর জন্য আর ছাত্ররা মাদরাসার আইন মানতে বাধ্য সে হিসেবে করে। কোনো কোনো মাদরাসার কর্তৃপক্ষও হয়ত তা পছন্দ করেন না, তবুও বাধ্য হয়ে করতে হয়। কারণ এ খাত থেকে বড় অংকের যে আয়টা আসে তা পূরণ করার মতো আপাত বিকল্প কোনো সোর্স নেই। ফলে কওমী মাদরাসাগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের কাছে কুরবানীর পশুর চামড়া কালেকশনটা এমন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে যে, এছাড়া কেউ মাদরাসা পরিচালনার কথা চিন্তাও করেন না। এমনকি এটাকে কেউ জিহাদের অংশ, দীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম কিংবা সওয়াব হাসিলের বিশেষ উপায় হিসেবে গণ্য করেন। ছাত্রদের মানসিকতা সেভাবেই গড়ে তোলা হয়। এই প্রেরণা ও জযবা সৃষ্টি না করলে ঈদের আনন্দ মাটি করে জিল্লতি ও অপদস্থতার এ কাজে ছাত্রদেরকে লাগানো যেতো না। মূলত মাদরাসার অর্থনৈতিক স্বার্থের দিকে লক্ষ্য করে ছাত্র-শিক্ষক সবাই তা স্বীকার করে নেন।

দ্বীনী মাদরাসাগুলো পরিচালিত হয় সাধারণত জনসাধারণের স্বতস্ফূর্ত দানের ভিত্তিতে। নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা এসব প্রতিষ্ঠানে বিনা খরচে কিংবা স্বল্প খরচে পড়াশুনার সুযোগ পায়। সমস্যাগ্রস্ত এসব মানুষের যে সহায়তা দ্বীনী মাদরাসাগুলো করে থাকে তা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। এ ধরনের সুযোগ সুবিধা না থাকলে হয়ত অনেকের পক্ষে দ্বীনের সহীহ ইলম হাসিল করা সম্ভব হতো না। কওমী মাদরাসার বৈশিষ্ট্য হলো, তাতে জনগণের দানের অংশ থাকে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় পরিচালিত হয়। জনগণ এটা তাদের দায়িত্ব হিসেবেই আঞ্জাম দিয়ে থাকেন। কিন্তু জনগণের এসব দান গ্রহণ করতে গিয়ে যদি জিল্লতি ভোগ করতে হয়, অপদস্থ-অপমানিত হতে হয়-তাহলে এর দ্বারা প্রকারান্তরে দ্বীনী শিক্ষাকে অপদস্থ করা। সম্পদশালীরা দ্বীনী প্রতিষ্ঠানে দান করবে-এটা তাদের করুণা নয়, ধর্মীয় দায়িত্ব। তাদের এ দায়িত্বটুকু যাতে সহজে পালন করতে পারেন এজন্যই মূলত সহযোগিতা করে থাকেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। এজন্য আমরা দেখি, মাদরাসার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা দানশীলদের কাছে গিয়ে দান গ্রহণ করেন। কিন্তু এর পদ্ধতিটা যদি হয় দৃষ্টিকটূ, অপমানকর, জিল্লতির তাহলে কখনোই এ দান গ্রহণ করা বাঞ্চনীয় নয়। শরীয়ত কাউকে এ অধিকার দেয়নি যে, এমন কাজ করবে যা প্রকারান্তরে দীনকে অপদস্থ করে।

কুরবানীর পশুর চামড়া কালেকশনের যে ধরনটা আমাদের মাদরাসাগুলোতে প্রচলিত সেটাকে কি সম্মানজনক বলা যাবে! কুরবানীর পশুর চামড়া কুরবানীদাতা ভোগ করেন না, এটা গরীব-দুঃখীর জন্যই বরাদ্দ থাকে। তার দায়িত্ব হলো, উপযুক্ত খাতে তা দান করা। যেহেতু ইয়াতীম-গরীবরা মাদরাসাগুলোতে বিনা খরচে পড়াশুনার সুযোগ পাচ্ছে এজন্য কুরবানীর পশুর চামড়া পাওয়ার বেশি হকদার মাদরাসাগুলোর গোরাবা ফান্ড। এ ফান্ডে দান করলে সওয়াব বেশি হবে তাতে কারো কোনো দ্বিমত নেই। এ বোধটুকু সতেজ থাকলে কুরবানীর পশুর চামড়াটি কুরবানীদাতা স্বউদ্যোগে মাদরাসায় পৌঁছে দেয়ার কথা। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো, আমাদের দেশের ধনিক শ্রেণীর মধ্যে এ বোধটুকু সক্রিয় নয়। এজন্যই তাদের কাছে গিয়ে গিয়ে, ফজিলত বয়ান করে মাদরাসার জন্য চামড়া কালেকশন করতে হয়। কিন্তু মাদরাসার অতি উৎসাহী কর্তৃপক্ষ এই কালেকশন করতে গিয়ে নিজেদের ব্যক্তিত্ব, আত্মমর্যাদাবোধ, অমুখাপেক্ষিতা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে বসে। ছাত্র-শিক্ষক সবাই একযোগে যেভাবে নিজেদের মনোযোগ ও শ্রম ব্যয় করেন তা দ্বীনের অন্য কোনো ক্ষেত্রে সাধারণত দেখা যায় না। কুরবানীর সারাদিন তাদেরকে এলাকা এলাকা ঘুরে যেভাবে চামড়া কালেকশন করতে হয় এবং মানুষের কটূক্তি, তীর্যক মন্তব্য ও হাসির পাত্র হতে হয় তা ন্যূনতম আত্মমর্যাদাবোধসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষেও মেনে নেয়া কঠিন। কুরবানীদাতা মনে করে হুজুররা চামড়ার ব্যবসায় নেমেছে। এজন্য পাইকারদের মতোই আচরণ করে তাদের সঙ্গে। আর চামড়ার পাইকাররা রীতিমত তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করতে থাকে। বিশেষত রাজধানী ঢাকা শহরে যারা কুরবানীর চামড়া কালেকশন করেন চরম অপামানজনক পরিস্থিতির শিকার হননি এমন দাবি কেউ করতে পারবেন না। লজ্জা ও অপমানের চরম গ্লানি মাথায় নিয়েই তাদেরকে চামড়া কালেকশনের তথাকথিত জিহাদ চালাতে হয়।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ঢাকা শহরের মাদরাসাগুলোর। মফস্বলের মাদরাসাগুলো সাধারণত এলাকায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে থাকে। অনেক দূর পর্যন্ত এর পরিচিতি ছড়িয়ে পড়ে। চামড়া কালেকশনের ক্ষেত্রে তারা বাড়তি একটা সুবিধা ভোগ করে থাকে। কিন্তু ঢাকা শহরের অলিতে গলিতে গজিয়ে উঠা নানা রকমের মাদরাসার পরিচয় পাশের ফ্ল্যাটেরও কেউ হয়ত জানে না। কোনো কোনো লাইনে বা সেকশনে একাধিক মাদরাসা হওয়ার কারণে চামড়া উসূলে রীতিমতো যুদ্ধে নামতে হয়। কুরবানীদাতাকে কে আগে প্রভাবিত করতে পারে, কে আগে চামড়াটি পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে তা নিয়ে মাদরাসাগুলো পরস্পরে মহাপ্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে যায়। এতে কখনও কখনও কুরবানীদাতা বিরক্ত হন, বিব্রতবোধ করেন। মাদরাসা ও আলেম-ওলামা সম্পর্কে তার মধ্যে একটা বাজে ধারণা জন্ম নেয়।

সবচেয়ে বাজে দৃশ্য লক্ষ্য করা যায় কুরবানীর দিন। প্রতিটি পশু জবাই করার জন্য কয়েকটি মাদরাসার ছাত্র ভীড় জমায়। কার আগে কে চামড়াটি নিজের দখলে নিতে পারবে তা নিয়ে রীতিমতো মহড়া শুরু হয়ে যায়। তাদের এই মহড়া দেখে সাধারণ মানুষ ভাবতে থাকে, না জানি এখানে মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকের কত বড় ইন্টারেস্ট! অথচ প্রকৃত বিষয় হলো, এর পুরোটাই গোরাবা ফান্ডের। এতে মাদরাসা ছাত্র-শিক্ষকের বাহ্যত কোনো ইন্টারেস্ট নেই। যে ছাত্রটি সারা বছর বোর্ডিংয়ে টাকার বিনিময়ে খানা খায়, এ কাজে সে নিজেকেও উৎসর্গ করে। তার এখানে প্রাপ্তির কী আছে! তাকে এ কাজ করতে হয় বাধ্য হয়ে, মাদরাসার আইন মনে করে। এভাবে চরম অপমান, লজ্জা ও গ্লানিকর অবস্থায় চলছে মাদরাসাগুলোর চামড়া কালেকশন।

কুরবানীর পশুর চামড়া মাদরাসার জন্য কালেকশন করার বিষয়ে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। মাদরাসা পরিচালনার স্বার্থে এর প্রয়োজন আছে। কিন্তু আমাদের আক্ষেপ হলো, এ কাজে নিজেদের সব সম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ বিলিয়ে দেয়ার আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে কি! কালেকশনটা কি সম্মানজনকভাবে হতে পারে না! আর দিন দিন তা মাদরাসাগুলোর অনিবার্য বিষয়ে পরিণত হচ্ছে কেন? যতদূর জানা যায়, আজ থেকে ৩০/৪০ বছর আগে এদেশে কুরবানীর পশুর চামড়া কালেকশনের কোনো রেওয়াজই ছিল না। সম্ভবত লালবাগ মাদরাসার কোনো উস্তাদের মাথায় এ আইডিয়াটা প্রথমে আসে। এরপর থেকে প্রায় সব মাদরাসায় তা চালু হয়। কিন্তু সহায়ক একটি খাতকে আজ অপরিহার্য ও বিকল্পহীন খাতে পরিণত করার কারণটা কী! আজ কি কোনো মাদরাসার কর্তৃপক্ষ চামড়া কালেকশন ছাড়া মাদরাসা পরিচালনার কথা ভাবতে পারে! ঢাকাসহ দেশের বড় বড় কয়েকটি মাদরাসার কথা জানি, তাদের গোরাবা ফান্ডে পর্যাপ্ত টাকা জমা থাকা সত্ত্বেও সেই একই কায়দায় কুরবানীর চামড়া কালেকশনের মহড়ায় নামে। এটা যেন আজ মাদরাসাগুলোর অপরিহার্য রুটিনে পরিণত হয়ে গেছে। প্রায় মাসখানেক পড়াশুনা বন্ধ রেখে শুধুই এ কাজে লেগে থাকে।

একটু সাহস করে এ সিদ্ধান্তটুকু কি নেয়া যায় না যে, চামড়া কালেকশনের ব্যাপারে আমরা মরিয়া হয়ে উঠব না। সম্মানজনক পদ্ধতিতে যা আসে তাতেই সন্তুষ্ট থাকব। আমরা যাদেরকে আমাদের আকাবির মানি, দারুল উলূম দেওবন্দসহ ভারত-পাকিস্তানের মাদরাসাগুলো কুরবানীর পশুর চামড়া কালেকশনের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতিটাই অবলম্বন করে আসছে। তারাও কালেকশন করে, কিন্তু আমাদের মতো জিল্লতি ও অপদস্থতার সঙ্গে নয়। খবর নিয়ে জানা গেছে, এসব মাদরাসায় পশু কুরবানীর ব্যাপক ব্যবস্থা আছে। এলাকার লোকেরা এখানে এসে কুরবানী করে চামড়াটা দিয়ে যায়। কোথাও বাড়ি বাড়ি গিয়ে কালেকশনের ব্যবস্থা থাকলেও তা সীমিত পর্যায়ে সম্মানজনকভাবে। তাদের মাদরাসাগুলো কি চলছে না! যখন আমাদের দেশে এ রেওয়াজটা ছিল না তখন মাদরাসাগুলো কিভাবে চলত? দ্বীনের ইলম হাসিলরত ইয়াতীম-গরীবদের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা আল্লাহ কোনো না কোনোভাবে করবেন-এ বিশ্বাস ও তাওয়াক্কুলটুকু কি আমরা নিজেদের মধ্যে আনতে পারি না!

আমরা মনে করি, কুরবানীর চামড়া কালেকশনের ব্যাপারে মাদরাসাগুলো অতি বাড়াবাড়ি ও মরিয়া হয়ে না উঠলেও অর্থনৈতিক বড় কোনো ক্ষতি হয়ে যাবে না। দু বছর আগে পরিকল্পিতভাবে হঠাৎ করে চামড়ার দর কমিয়ে দিয়ে দ্বীনী মাদরাসাগুলোর লিল্লাহ বোর্ডিংয়ের ওপর একটা ধাক্কা দেয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু তাতে কি দেশের কোনো মাদরাসা বা লিল্লাহ বোর্ডিং বন্ধ হয়ে গেছে! মাদরাসা কর্তৃপক্ষকে আগে নিজ নিজ এলাকায় অবস্থান সুদৃঢ় করতে হবে। মানুষের মনে তাদের অপরিহার্যতার কথা বদ্ধমূল করতে হবে। তা করতে পারলে কুরবানীর পশুর চামড়া কালেকশনের মতো তুচ্ছ বিষয়ে দুয়ারে দুয়ারে আত্মমর্যাদাবোধ বিলাতে হবে না। লোকেরা স্বউদ্যোগে এসে মাদরাসায় তাদের কুরবানীর চামড়াটি দিয়ে যাবে। এটাকেই তারা নিজেদের সৌভাগ্যের কারণ বলে মনে করবে।

প্রকৃত বিষয় হলো, আমাদের মানসিকতাটা হীনতা ও নীচুতায় নিস্প্রভ হয়ে পড়েছে। কারণে অকারণে আমরা আমাদের সম্মান ও আত্মমর্যাদাবোধ হারাচ্ছি। এজন্য সবার আগে দরকার মানসিকতার পরিবর্তন। মানসিকতার পরিবর্তন ছাড়া মাদরাসা ও আলেম-ওলামার সঙ্গে যুক্ত হওয়া অযাচিত বিষয়গুলো থেকে উত্তরণ সম্ভব নয়। এজন্য অগ্রসর মানসিকতার সম্ভাবনাময় তরুণ শ্রেণীটিকে বিষয়গুলো সম্পর্কে নতুন করে ভাবতে হবে। তাদের মধ্যে ভাবনাগুলো সক্রিয় থাকলে আশা করা যায় একদিন অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে।

zahirbabor@yahoo.com
http://www.sonarbangladesh.com/articles/ZahirUddinBabar

দাও ফিরিয়ে মাকে | সাইফ মাহাদী

আয়না খোকন কাছে
আমার হাতে কদমা আছে
নাড়– মালাই সিরণী আছে
খেলনা কত আছে

হঠাৎ করে উড়াল দিলাম
অনেক অনেক দূরে
ভাল্লাগেনা তোকে ছাড়া
সেইসে অচিন পুরে

খোকা-
তুই কি যাবি সঙ্গে আমার
অনেক আদর পাবি
সঙ্গে কি তুই যাবি?

মায়ের বুকে মুখ লুকিয়ে
ঘুমের ঘোরে পাচ্ছে আদর
কাঁদছে খোকন সোনা

মাকে নিয়ে স্বপ্ন হাজার
নিত্য দিনই বোনা

ভোর না হতেই ঘুম ভেঙ্গে যায়
পায়নাতো সে
মায়ের দেখা কভূ

খোকন সোনার এই আকুতি
আমার মাকে দাও ফিরিয়ে
আমার কাছে প্রভু

লেখক: কবি, ছড়াকার ও সাংবাদিক
http://www.sonarbangladesh.com/articles/Saif Mahadi

এতিমের অশ্রু | সাইফ চৌধুরী

এতিমের লুকানো ব্যথা কে দেখে হায়,
কেঁদে, কেঁদে শূন্যতায় দিন বয়ে যায়।
বাচার তাগিদে বাচতে হয় জীবন বড় দান,
দুঃখ-যন্ত্রনায় চালিত নিঃশ্বাসে এতিমের প্রাণ।
তবু মানুষের বাচতে হয় হোক যত সংশয়,
বেচে থাকা প্রাণ যে জীবন্ত নাহী হয় তার ক্ষয়।
একদা এক রাতে মা জননী তার কেঁদে ওঠে,
কোলের শিশুটি ডেকে বলে কেন কাঁদছ তুমি মা?
অবুঝ শিশু বয়স মাত্র হল সবে পাঁচ,
সেই দিন সেই রাতে তার বাবা হলেন পর-পার। পর-পার
পড়ের দিন অপরাহ্ণে জননী কে ডেকে বলে,
মা, বাবা কোথায়, বাবা কি খায়নি খাবার?
হঠাৎ স্তব্ধতায়স্ত জেগে ওঠে মায়ের অশ্রু ভরা আর্তনাদ।
ওরে বুকের ধন আয়রে বুকে আয়, কি করে বুঝাই,
তোর বাবা যে এ পৃথিবী হতে নিয়েছেন চির-বিদায়।
বুকের বন্ধনে বাঁধা দু-হাতে জড়ায়ে শিশু,
কেঁদে ওঠে ওঝোর দেখে মায়ের কান্না-কাতর।
বিদায়ের বেদনায় জননী আজ বড় অসহায়,
ওরে খোকা তোর বাবা যে আর ফিরিবেনা ঘরে,
ওই সমাধির তরে শুয়ে আছেন প্রভুর হয়েছে আপন।
খোকা দৌরে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পরে বাবার কবরের তরে,
অবুঝ আর্তনাদ করে বলে ওঠে, বাবা ওঠো,
জেগে ওঠো, দেখো করোনা তুমি এমন অভিমান।
আমি চাইবোনা আর কোন খেলার পুতুল,
তোমার সব নির্দেশ করিবো সদা সম্মান।
খোদার দরবারে যে হয়েছেন একবার পর-পার,
অবুঝ কি বোঝে সেথা হতে কেউ আসেনা ফিরে আর?
গরিবের অভাবের সংসার ঠেকা বড় দায়,
পিতৃহীন সন্তান কত যে নিরুপায়।
নিষ্ঠুর নিয়তি আর দুঃখ ভরা স্মৃতি নিয়ে,
গড়ে ওঠা শিশু আজ কিশোরে হলো পরিণত।
অভাব-অনটনে ঘেরা জীবনের সবকূল,
করে তুলে মানুষের মন বড় অশান্ত।
জীবনের কিছু প্রথা দেয় শুধু ব্যথা,
ভীষণ বেদনায় ভরে ওঠে মন।
বছর দশেক পর একদিন হঠাৎ ,
মমতাময়ী জননীও হলেন যে পরলোকগমন।
মায়ের মমতা ভরা কচি কিশোরের হৃদয়,
মর্মাহত শুধু ভেবে তা জীবনে কেন এতো পরাজয়?
শোকের ছোয়ায় ঝরছে কিশোরের লোনা জল,
কেউ রইলনা আর এই এতিমের আপন।
হায়রে পৃথিবী কেমন তোর এ রীতিনীতি,
এ বাল্য বয়সে পিতামাতাহীন করলে মোরে এতিম।
কোথায় পাব ঠাই আপন যে কেউ নাই,
নদীর পাঁড়ে কুঁড়ের নীর ভেঙ্গে নিল বন্যায়।
কে বুঝবে আর কত এই মনে কত ক্ষত,
কে মুছবে ঝরা অশ্রু মোর বিধাতা ?
নিঃশ্ব জীবনে দুঃখ বিহনে কি পেলাম বলনা?
আদর করে আচঁল তরে কে দিবে মায়ের মমতা?
এতিম আমি, আমিতো বন্দি দুঃখের সঙ্গী,
খুজে পাইনি কভূও জীবন সুখের ঠিকানা।

এখানে-সেখানে আজ দিন রাত বয়ে চলে,
আশ্রয়হীন একা পথের পথিক আমি আজ এ ধরায়।
কভূতো করিনি ভুল তবে কেন জীবনের এ ভাঙ্গা কূল,
পথে-ঘাটে মানুষের শুধু অবহেলা-অনিহা,
এতিম বলেতো আমি অভিশপ্ত নই প্রভু,
কেন নির্দয় মানুষের মাঝে ফোটেনা দয়ার ছোট্ট ফুল?
যে আগুঁন জ্বালায় দ্বিগুণ জ্বলাতোকনা এ দেহে,
জ্বলতে, জ্বলতে ঝর হয়ে ঝরোকনা এই মনে।
এতিমের নিঃশ্বাসের ভার ভীষণ দহন,
কেউতো বুঝেনা প্রভু শোনেনা এ এতিমের কহন,
দিন দিন মানুষ হচ্ছে পাথর কে করবে কারে আপন।
কেউ আর আসেনা এগিয়ে দু-হাত বাড়িয়ে,
অসহায় এতিমের করিতে সহায়,
মানুষের মনে ভরে দাও সেই চেতনা প্রভু,
যে চেতনায়, মানুষ মানুষের মাঝে রাখে শ্রেষ্ঠ বন্ধন।
মানবকূলে সে মানব সদা সু-মহান,
যে মানুষ সদা মানুষেরে করেন সমান সম্মান।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/SaifChowdhury

যৌতুক | এস. এম. মতিউল হাসান

যৌতুক ছাড়া হয়না বিয়ে
এখন সমাজটাতে
মোদের এখন সমাজ এমন
যৌতুক ঘরে ঘরে।

গরীব দুখী যত আছে
এ সমাজে ভাই
যৌতুক ছাড়া হয়না বিয়ে
তারা কোথায় পাবে ঠাই।

বিয়ের আগে ও যদি কেহ
না চায় বাড়ি গাড়ি
বিয়ের পরে দাবি করে
সোনা দানা কড়ি।

যৌতুক এখন সমাজটাতে
ঘুরছে ঘুর্নিপাকে
যৌতুক ছাড়া হয়না সাধন
হয়না পূর্ণ সাধক।

হাসি খুশি সংসারটাতে
নামে দুখের ছায়া
যৌতুক যদি নাহি পারে
দিতে মেয়ের বাবা।

শাশুড়ি বলে ননদ বলে
বলে ঘরের সবাই
যৌতুক ছাড়া হয়না বিয়ে
যৌতুক ছেলের কোথায়।

মারে লাথি করে আঘাত
করে টর্চারিং
যৌতুক দিলে পাবি রেহাই
থাকবি ঘরে সুখে।

যৌতুক যেন সমাজটাতে
একটি জটিল অভিশাপ
আসুন আমারা সবাই মিলে
যৌতুক প্রতিবাদ জানাই।

জামাই বাবু হয় যে জল্লাদ
না পেয়ে মটর সাইকেল
ঘুমের ঘোরে এসিড মারে
হযনা তবু বিচার তাদের।

আসুন সবাই প্রতিবাদ জানাই
একটি শ্লোগান তুলে
যৌতুক মোরা নেব না কেহ
পাল্টে দেব সমাজ এখন।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/SMMotiulHasan

নেতা | এস. এম. মতিউল হাসান

তুমি নেতা
আমি নেতা
সবাই দেশের নেতা
বুক ফুলিয়ে সবাই বলি
করবো এটা করবো সেটা
নেতা আমি নেতা।

তুমি নেতা
আমি নেতা
গায়ে ছেড়া জামা
মঞ্চে গিয়ে দু হাত তুলে
বলি সবাই নেতা
দেশের জন্য প্রাণ দেব
আমি মহারাজা।

মন্ত্রী নেতা এমপি নেতা
সবাই বলে নেতা
সাক্ষী রাখে গরীব দুখী
গায়ে ছেড়া জামা
ভাত দেব অন্ন দেব
হই যদি নেতা।

আহাজারি রাহাজানি
করছে বলো কারা
যারা আছে নেতা
রক্ত নিয়ে খেলা করে
আমার তোমার নেতা।

মরছে বলো কারা
গরীব দুখী মরছে তবু
নাই যে তাদের ব্যথা
তবু তারা নেতা।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/SMMotiulHasan

আজ স্বাধীনতার চল্লিশটি বছর | এস. এম. মতিউল হাসান

আজ স্বাধীনতার চল্লিশটি বছর
অথচ আজ ও কেউ পাইনি
স্বাধীনতার স্বাদ,
সবাই শোনে স্বাধীনতার এইদেশ
মুক্ত আকাশ মুক্ত বাতাস
স্বাধীন করেছে কে এই দেশ।

স্বাধীন মানে তো নয়
এখনো মুখ বুজে সইবে বারবার
বন্দি ছিল দেশের মানুষ
শোষণ আর জুলুমের কাছে
দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ করে
স্বাধীন করেছিলাম দেশ।

আজ স্বাধীনতার চল্লিশটি বছর
এক মুঠো অন্নের আশায়
এখনো ঘুমাই রাতে উপোস থেকে
তাহলে কোথায় আমার স্বাধীনতা
আর কেনই বা স্বাধীন
হয়েছিল এই দেশ।

ভেঙেছি দাবানল এনেছি স্বাধীনতা
তবু ও মোরা কি পেলাম
করেছে যুদ্ধ দিয়েছে প্রাণ
তার পর হয়েছে স্বাধীনতা
তাইতো আজ গাই মোরা
স্বাধীনতার গান।

মরেছে মানুষ কত যে লাখে লাখ
হিংস্র হায়েনার থাবায়
চেয়েছিল সব নেবে লুটেপুটে
ধংস করে দেবে এক নিমিষে
আমরা বাংলার দামাল ছেলে
রুখতে পেরেছি সব
ঘর থেকে বেরিয়েছি রুখতে তাদের
নির্ভয়ে মোরা নও জোয়ান
তবু মোরা কি পেলাম
এতটা বছর পর।

মা বোনের ইজ্জত নিয়েছিলো কেড়ে
তবু ও করেছি স্বাধীন এদেশ
দু হাত পেতে পাইনি স্বাধীনতা
রক্তের বিনিময় মোদের স্বাধীনতা
করেছে যারা স্বাধীন এদেশ
কারো কি আছে জানা।

যারা জীবন যুদ্ধে বাজি রেখে
ঝাপিয়ে পড়েছিল অস্ত্র হাতে
আজ কেউ রাখে না খবর তাদের
তাহলে কি পেলাম স্বাধীন করে এদেশ
এখনো তারা ঘুমায় ফুটপাতে
একবেলা খায় দু বেলা উপোস থাকে
নেইতো তাদের দাম।

করেছি স্বাধীন তবু এই দেশ
কোথায় স্বাধীনতার মান
আজ স্বাধীনতার চল্লিশটি বছর
অথচ আজ ও কেউ পাইনি
স্বাধীনতার স্বাদ।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/SMMotiulHasan

লিখতে চাই | এস. এম. মতিউল হাসান

আমি লিখতে চাই অনেক কিছু
লিখতে চাই এ দেশের মানুষের কথা
লিখতে চাই সমাজের দুঃশাসনের কথা
অথচ একদল দল লোক আমাকে বাধা দেয়
আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে চায় কাগজ কলম।

ওরা কারা এই জঘন্য মানুষের দল
আমাকে স্তব্ধ করে দিতে চায়
আমি প্রতিটি কথা লিখে থাকি
অত্যাচারীর বিরুদ্ধে তাই।

আমার প্রতিটি কলমের খোচায়
আর প্রতিটি কাগজের পাতায়
লেখা হয় অসম্ভাবনার সব কথা
সমাজের সব নোংরা বেহায়াপনা
অসভ্যতার সব কথা।

রাজনীতি নিয়ে যারা ব্যবসা করে
রাজনীতি দিয়ে যারা লুটেপুটে খায়
মুখোশ পড়া সব নেতাদের কথা
লিখতে চাই আমার কবিতায়
অথচ আমাকে বাধা দেয়া হয়
আমাকে শাসিয়ে রাখা হয়।

আমার প্রতিটি অক্ষরকে ওরা
নিরক্ষর বানিয়ে দেয়
আমি লিখতে চাই প্রতিটি স্পস্টতায়
সেই ধর্ষণকারীর কথা,
যারা ধর্ষণ শেষে গুম করে রাখে
আবার তারা পার পেয়ে যায়
তারা কারা তাদের মদদ দাতা।

তাদের বিরুদ্ধে আমার কবিতায় হুশিয়ারি
অপারক নই লিখতে আমি পারি
লিখে যাব আরো বেশী বেশী
দেশদ্রোহী যারা তারা সাবধান।

বুলেট আর কামানের ভয়ে
আমি থেমে রব না লিখে যাব
পাপাচারি আর অকর্মের সব কথা
কেউ আমাকে রুখতে পারবে না
আমার লেখার প্রতিটি অক্ষরে থাকবে
সেই তাদের কথা।

যারা মুখোশ পড়ে ঘুরছে ভবঘুরে
কেউ চেনে না এরা কারা কি বা তাদের কাজ
সবাই ভাবে এরাই বুঝি দেশের আসল জন
নয়তো তারা দেশের নেতা আছে কিবা দাম
চুপিসারে দেশটা তারা করছে রসাতল
তাদের কথা লিখে যাব আমি আজীবন।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/SMMotiulHasan

Saturday, April 28, 2012

নিবাসবৃত্তি | সালেহা সুলতানা

চষবধংব ভড়ত্মরাব সব, ও ধস ংড়ত্ত্ু, ও ষড়াব ুড়ঁ, ঞযধহশ ুড়ঁ—বাক্য চারটি আওড়াতে আওড়াতে পথ চলে সুহিতা। মনের পাতে খুঁজে পেতে দেখে নেয় বৈরিতার ফাটল-ধরানো সম্পর্কগুলো। যাপিত সময় প্রবাহে কার সঙ্গে কখন, কেন বিরূপতার সৃষ্টি হয়েছে—তার একটা নিখুঁত নির্ঘণ্ট তৈরি করতে করতে স্মৃতিসায়রে নামে সুহিতা। স্মৃতির ঢেউ সরিয়ে যাদের খুঁজে পায় তাদের উদ্দেশে মন্ত্রের মতো বাক্যগুলো উচ্চারণ করে, যেন বিরাট হাঁ-করা ফাটল মেরামত করছে প্রাণপণে। ফাটল তো বটেই। সম্পর্কের ভিতগুলো খুব স্পর্শকাতর—সঠিকভাবে ব্যবহার না করলে অচিরেই ফাটল ধরে। অনেকগুলো আপন-সম্পর্ক অযত্নে প্রায় ভেঙে পড়েছে। কিছুটা সুহিতার অভিমান। অভিমানের তীব্রতা ক্রমেই দানবের মতো ফুঁসে উঠতে উঠতে সম্পর্কের বিন্দুমাত্র সৌহার্দ্যবোধকেও গ্রাস করে। আর এ দানবীয় ক্ষুধার কাছে সুহিতা নিঃশেষ হতে থাকে।
বিষয়টা ছিল জমি-জমা সংক্রান্ত। পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার সময় পারিবারিক বৈঠক বসে। সুহিতা বাড়ির ছোট হিসেবে সামনের অংশটা দাবি করে বসে। প্রস্তাবটা সবাই মেনে নিলেও এতে ভেটো প্রদান করে বড় বুজি। সুহিতা খুব আহত হয়। আদরের বোন হিসেবে কোনো আবদারই তার অগ্রাহ্য করেনি পরিবার, বিশেষত বুজির মতো সহজ-সরল মানুষ তো নয়ই। অথচ এ ব্যাপারটায় বুজির আপত্তি লক্ষ্য করে সুহিতা খুব অবাক হয় এবং অনুমান-নির্ভরতায় উপলব্ধি করে, এই ভেটো প্রদান বুজির নয়, নেপথ্যে ক্রিয়াশীল অন্য কেউ। তো অভিমানের জন্ম এখান থেকেই। কোলে-পিঠে করে যে তাকে মানুষ করেছে তাঁর প্রতি সুহিতার ঋণ যথেষ্ট, কিন্তু মাতৃ-স্নেহের ছায়াটুকুও বিনষ্ট হয়ে গেছে বুজির। জমি-জমার লালসা যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের ভিতগুলোও সমূলে উত্পাটন করে বিশুষ্ক-শ্রীহীন, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করে—এই প্রথম উপলব্ধি করল সুহিতা। ক’দিন-ক’রাত ঘুমাতে পারে না। বিছানায় ছটফট করে। চিরপরিচিত মুখগুলো অচেনা মনে হয়। পৈতৃক বাড়ির সম্মুখ অংশটিতে সে মনে মনে দখল বসায়। সেখানে কেউ উঁকি দেয়ার মতো সামান্য ফাঁক-ফোকরও অবশিষ্ট রাখে না। ক্রমেই সবাইকে তার শত্রু মনে হতে থাকে। আজন্ম ঘনিষ্ঠতায় নির্ভরশীল সম্পর্কগুলো গোষ্ঠীবদ্ধ মেঘের বিচ্ছিন্ন-খণ্ডতায় শিথিল হয়। তার ভাবনা সর্পিল গতিতে, অগ্নস্ফুিলিঙ্গ তোড়ে গতিময় হয়। চোখের পাতায় ঘুম বসে না, এপাশ-ওপাশ করে। মঈন বিরক্ত হয়।
: আহ্- এত নড়াচড়া করছো কেন? ঘুমুতে দাও।
মঈন ঘুমের ডিস্টার্ব সহ্য করতে পারে না। খুব ভোরে ওকে রওনা হতে হয়, সাভারে একটা ট্রেনিং কলেজে কাজ করছে।
ব্যাপারটা মঈনকে বলেনি। ও খুব পজিটিভ মানুষ, অনেকটাই প্রো-অ্যাকটিভ। ব্যাপারটা শুনে হয়তো সুহিতাকেই দোষারোপ করবে। সুহিতার কেন্দ্রীভূত মন ওই অংশটি ছাড়া অন্য কিছুতেই সায় দেয় না। যখন থেকেই নিজস্ব একটা বাড়ির তেষ্টা অনুভব করেছে, তখন থেকেই সে খুঁজে ফিরছে রাস্তার পাশে দক্ষিণমুখী একটি সুদৃশ্য দ্বিতল বাড়ি। বাড়িটির সম্মুখভাগ থাকবে খোলা; সেখানে থাকবে অজস্র ফুল, ফুলের বাগান। দেয়াল ঘেঁষে থাকবে দু’একটা নারকেল-সুপুরি গাছ কিংবা বিশাল গন্ধরাজ, টগর, মাধবীলতা। ফুলের সৌরভ সকাল-সাঁঝে সবাইকে আনমনা করে তুলবে। প্রাত্যহিক বাস্তবতার টানাপড়েন থেকে ক্ষণিকের ছুটি মিলবে। প্রশান্ত মন লাভ-ক্ষতির অংক ভুলে ভালোবাসায় নিমগ্ন হবে। কখনও খোলা ছাদে বসে উপভোগ করবে বিশাল বিশাল বৃক্ষের সগর্ব উত্থানচিত্র কিংবা চাঁদের আলোয় বসাবে চায়ের আসর, সেই সঙ্গে মৃদু স্বরে বাজবে রবীন্দ্রসঙ্গীত। হিম-কুয়াশায় ভেজা চাঁদ, ভেজা মেঘ দেখে দেখে স্নান করবে হিম-জোছনায়।
রাস্তার ওপারে অনতিদূরে বৃক্ষের চূড়ায় ফুটবে নানা ফুল। শালবৃক্ষের স্নিগ্ধ-আলোয় ধোয়া সাদাটে ফুল, রাধাচূড়ার হলদে রঙ কিংবা সোনালু ফুলের স্বর্গীয় আভা যখন মাতিয়ে তুলবে চারপাশ, দূর থেকে দেখে দেখে অ-জাগতিক আনন্দানুভূতিতে শিউরে উঠবে সুহিতা। তখন মনে এসে ভর করবে কবিতা—‘খুলে দাও দ্বার/নীলাকাশ করো অবারিত:/কৌতূহলী পুষ্পগন্ধ কক্ষে মোর করুক প্রবেশ/প্রথম রৌদ্রের আলো/সর্বদেহে হোক সঞ্চারিত শিরায় শিরায়।’ দক্ষিণমুখী বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে বৃক্ষ-ফুলের শ্যামলিমায় অবগাহন করতে করতে কাটবে সুখময় সময়। এমনটি না হলে জীবনের পূর্ণতার অনেকটাই অপূর্ণতার দাবি রাখে। এরকম স্বপ্ন সুহিতার মনের জমিনে নির্ভয়ে-নিরাপদে বসত গড়ে তুলেছে, একে বাস্তুহারা করে বিষাদদৃশ্য নির্মাণে সুহিতা অপারগ। স্বপ্নটার শেকড় এখন এত গভীরে প্রোথিত যে, একে উপড়ে ফেললে ওর পৃথিবী নীরস হয়ে উঠবে। স্বপ্ন-বীজ উপ্ত হয়ে অঙ্কুরোদগমনের পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে মঈন। মঈনকেই দায়ী করে সুহিতা। এমনি একটি বাড়ির মালিক উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্য ছিল ওরা। ইচ্ছে করলেই বাড়িটার মালিক ওরা হতে পারত। সবাই-ই জানত বাড়ির বড় ছেলে হিসেবে মঈন বাড়ি পাবে। মাত্র দু’ভাইয়ের পিতৃহীন সংসারে বড় ভাই সংসারের হাল ধরেছে। ক্ষুদ্র-ব্যবসায়ী পিতার আকস্মিক মৃত্যুতে মাথায় যখন আকাশ ভেঙে পড়ল, তখন মঈন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের পরীক্ষারত ছাত্র। দূরদর্শী মা ছেলেকে বাবার মৃত্যু সংবাদ না জানিয়ে পরীক্ষা-পর্ব শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলেন। ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে আর বাবার দেখা পেল না। শোক স্তিমিত হয়ে এলে ব্যবসার হাল ধরল। পাশাপাশি চলল চাকরির চেষ্টা। বিসিএস উত্তীর্ণ হয়ে একটা চাকরি জুটলে ধুঁকে চলা ব্যবসাটার পরিসমাপ্তি টেনে দিল। স্বচ্ছ-বেতনের গণ্ডিতে বাঁধা সংসারে প্রয়োজনটুকু স্বীকার করে উদ্বৃত্ত আর তেমন থাকে না। তবুও মিতব্যয়িতার কঠোর শাসনে সঞ্চিত অর্থের আনুকূল্যে ঘরে তোলে সুহিতাকে।
শ্বশুরবাড়ির পরিচ্ছন্ন নিরিবিলি সংসার সুহিতার ভালো লেগে যায়। একতলা বাড়ির সামনে লম্বা একটা বারান্দা। বারান্দার পিলার জড়িয়ে লতানো মানিপ্ল্যান্ট সজীব-মমতায় বাড়িটাকে জড়িয়ে ধরেছে। বারান্দার সামনে এক চিলতে বাগান। সেই বাগানে তেমন গাছ নেই, মাটি স্তূপ করে রাখা হয়েছে। সেখানে জন্মেছে বুনো ঘাস, ফুল আর পিঁপড়ের বাসা। এলোমেলো অগোছালো জায়গায় সুহিতা সুন্দর বাগান গড়ে তোলে। সামনের গেটে বাগান-বিলাস। শীতের শেষে আগুন রঙা ফুল ফুটে বাড়ি আলো হয়ে থাকে। গেটের পাশে পাকা রাস্তা। মফস্বল এলাকায় ব্যস্ততার আড়ম্বর নেই, রাস্তায় দু’একটা রিকশার টিং টিং শব্দ কিংবা কখন-সখনও হঠাত্ শহর থেকে আসা পাড়া-প্রতিবেশীর গাড়ির আওয়াজ। এছাড়া পুরো সময়ই নিস্তব্ধ-নীরবতায় রাস্তা এবং বাড়িগুলো ধ্যানমগ্ন থাকে। রাস্তার উল্টো পাশে তুলসিদের বাড়ির সুপুরি-নারকেল গাছের গর্ভধারণ, ফলন্ত হওয়ার প্রক্রিয়া দেখতে দেখতে ঋতু-চক্রের আবর্তন উপলব্ধি করা কিংবা পশ্চিম পাশের মাঠ পেরিয়ে হিন্দু-বাড়ির পারিপাট্য দেখতে দেখতে সময় কাটে সুহিতার। মমতার নিশ্ছিদ্র আবরণ নিঃশব্দে ছায়া ফেলে। লোডশেডিংয়ের সুযোগে মঈনকে নিয়ে খোলা ছাদে অভিসার, ছোট উঠোনে সবার সঙ্গে গল্পচারিতা, জোছনায় বিজন-পথে হাঁটা—এমনি মধুর সময় প্রবাহে স্বপ্নিল একটা জগত গড়ে উঠে ছোট বাড়িটিকে কেন্দ্র করে। মনের বৈভবে সাজিয়ে শ্রীময় করে অন্তঃপুর। ঝুল ঝেড়ে, টবে জল-ফুল সাজিয়ে নিপুণ শিল্পীর কারুকার্যে নান্দনিক-বিভায় পূর্ণ করে তোলে বাড়ির প্রতিটি কক্ষ। বহুমাত্রিক ছন্দোময় রৈখিকতায়, দ্যুতিময় জীবন-আলোয় ভাসতে থাকে সুহিতা।
একদিন বাড়ি ছেড়ে চলে আসতে হলো। মঈনের চাকরির ট্রান্সফার। এভাবে অনেকদিন, অনেক জায়গায়—অবশেষে স্থিত হয় ঢাকায়। ছোট বাসা, ঘিঞ্জি, আলো নেই, বাতাস নেই—মধ্যাহ্নের প্রখর আলোতেও ঘরের ভেতর অন্ধকারাচ্ছন্ন, বৈদ্যুতিক বাতির কৃত্রিম আলোয় নিষ্প্রাণ উদ্ভাসন। প্রথম প্রথম মনে হতো কারাগার, তারপর খাঁচা আর এখন সুহিতার মনে হয় নাগরিক-অভিশাপ। আশা রূপ একবিন্দু আলো হিরক-বিভার প্রোজ্জ্বল ভূমিকায় প্রোথিত থাকে অন্তরে। সে আলো নির্ভরতা পায় বাড়িকে কেন্দ্র করে। সুহিতা জানে, নাগরিক জীবন প্রবাহে যতই আবাসন-ক্লেশ-গ্লানি থাকুক না কেন, এর থেকে রিলিফ পেয়ে একদিন সে পরিচ্ছন্ন বাড়ির আঙিনাতেই দাঁড়াবে। কিন্তু সে স্বপ্ন মঈন ভেঙে দেয়। মঈন ভেঙেছে না তাকে বাধ্য করা হয়েছে, সে রহস্যাবৃত কাহিনী কেবল সুহিতাই জানে। এর নেপথ্যে ক্রিয়াশীল ছিল মঈনের ছোট ভাইয়ের স্ত্রী। বৈষয়িক-বিষয়ে পারদর্শী কৌশলী শেলী হস্তগত করে বাড়িটা। মঈনের পেছনে শেলীর ব্যস্ততম সাধনা সফল-পরিণতি পায় যখন এ বিষয়টির ক্ষেত্রে সবাই একতরফাভাবে সায় না দিলেও মঈন সায় দেয়। নিজ পরিবার, নিজ সন্তান, পিতৃভূমি অধিকার—সবকিছু তুচ্ছ করে স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে মঈন এ কাজটি সমাধা করে। সুহিতার সরলতা, আবেগময়তা শেলীর কৌশলী-ভূমিকার কাছে অকাট-মূর্খতায় পর্যবসিত হয়। মঈন সুহিতার অনুপস্থিতিতে শেলীর স্বার্থে হাত মেলায়। বিষয়টা হওয়া উচিত ছিল ভাইয়ের স্বার্থে। তবে এক্ষেত্রে ভাই নিস্তেজ ও নীরব। মঈনের ঝোলায় তুলে দেয়া হয় অলস, নিষ্প্রাণ কিছু পতিত জমি। সুহিতার খারাপ লাগলেও মঈনের এতে সুখী-ভাব দেখে আর কোনো মন্তব্য করেনি। যে ছেলে নিজ অধিকার সহজেই ত্যাগ করে, সেখানে পরের মেয়ে হয়ে সুহিতা কী বলবে। তবে সুহিতার দূরদর্শী মন একটা বিষয় অনুমান করে কষ্ট পেল যে, তার সন্তানরা ভবিষ্যতে পিতামহের বাড়িতে আর ঠাঁই পাবে না। বাড়ির কিছুটা অংশ রেখে দিলেও মঈন বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিত।
শ্বশুর বাড়ির স্বপ্ন প্রদীপ নিভে যাওয়াতে সুহিতার ভাবনা ঠাঁই পায় বাবার বাড়ির আঙিনায়। সেখানেও ঘটে বিপত্তি। তিন বোনের জন্য রেখে যাওয়া সম্পত্তির পরিমাণ নেহাত কম নয়। সুহিতার পছন্দের জায়গা বেহাত হওয়ার ভাবনায় নিষ্প্রাণ সময় যাপন করে। বুজির সঙ্গে সম্পর্ক গভীর শীতলতায় পৌঁছেছে, আর সুহিতার আপাদমস্তক ক্রমাগত অগ্নিদাহের উষ্ণ-প্রস্রবণে তোলপাড় হচ্ছে। আহার-নিদ্রা-কর্ম শৃঙ্খলছিন্ন হয়ে এলোপাতাড়ি গড়াগড়ি খাচ্ছে। এদিকে বুজিও তার সিদ্ধান্তে অটল। মনের ক্লান্তি ঘোচে না সুহিতার। উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে বেড়ায়। একদিন কিছুটা রিলাক্স হওয়ার উদ্দেশ্যে যোগ দেয় এক আলোচনা সভায়। সভাটা অনুষ্ঠিত হয় পাবলিক লাইব্রেরিতে। আলোচনায় মন বসাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে। এদিক-ওদিক নজর দিতেই চোখে পড়ে পরিচিত একটি মুখ। সুশান্ত। ঠিক চিনতে পারে সুহিতা। ক্লাসমেট সুশান্ত। ওদের দু’জনের নামের আগে ‘সু’ উপসর্গ থাকায় ক্লাসের বন্ধুরা ‘সু-সু’ বলে প্রায়ই মজা করত। প্রায় বছর পাঁচেক পর দেখা। সুশান্ত পছন্দ করত সুহিতাকে। কলা ভবনের সবুজ চত্বরে স্মৃতিময় হয়ে আছে কত কথা। ক্লাসের দুষ্টুমিটা বেশ উপভোগ করত ওরা। তারপর এক সময় কিছু না জানিয়েই বিদেশ পাড়ি দেয়। সুহিতা সুশান্তকে বন্ধুত্বের সীমায় আবদ্ধ রাখতে চেয়েছিল। কিন্তু সুশান্তের অনুভূতি সে সীমা অতিক্রান্ত হয়ে যখন অন্যকিছু দাবি করে, তখন সুহিতা তাকে বাধা দেয়। অনেকটা অভিমানের ধার নিয়েই লাপাত্তা হয় সুশান্ত, আজ এতদিন পর ওকে দেখে খুব ভালো লাগে। সামনের চেয়ার ছেড়ে পেছনে এসে সুহিতার পাশে বসে সুশান্ত। অনেকটা বিস্ময়ভরা গলায় বলে :
: সু, তোমাকে দেখতে পাব এত সহজে ভাবতেই পারিনি।
: আমিও পারিনি, তো, কেমন আছো।
: ভেরি নাইস, তুমি কেমন?
: আমি ভালো আছি, দেশ ছেড়ে চলে গেলে আমাকে কিছু জানাওনি। কোথায় সেটেল হয়েছো?
: হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে।
: ওখানে কেন?
: বলতে পারো স্বেচ্ছা নির্বাসন।
: নির্বাসন কেন?
: সে তো তুমিই ভালো জানো।
: আমি কিছুই জানি না। বলেই হাসতে থাকে সুহিতা।
তুমি খুব ছেলেমানুষ সুশান্ত, চলো বাইরে কোথাও বসি। এই আলোচনায় তোমার সঙ্গে গল্প হবে না। দু’জন বেরিয়ে এসে লাইব্রেরি-চত্বরের রেস্টুরেন্টে বসে।
: সু, তুমি আমায় ক্ষমা করতে পেরেছো?
: ক্ষমার প্রশ্ন আসছে কেন?
: তোমাকে অনেক ডিস্টার্ব করেছি।
: বন্ধুরা তো মাঝে মাঝে ডিস্টার্ব করেই, তাতে কী?
: আমি তোমার সঙ্গে কেবল বন্ধু হয়ে থাকতে চাইনি।
: সে আমি জানি।
: জানো সু, আমি এখন ভাবি, আমি কী বোকামি করেছি তোমার সঙ্গে।
: বোকামি নয় সুশান্ত, সময়ের দাবি ছিল বলেই প্রত্যাশা রেখেছো।
: আমি যখন হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে বেড়াতে যাই, আমার মন খুব বিধ্বস্ত ছিল। কিন্তু কী অদ্ভুত ব্যাপার জানো, ওদের একটা মেথড আমাকে ভীষণ বদলে দেয়। আমি দারুণ ইন্সপায়ারড হই।
: কী মেথড?
: ফোর থাউজ্যান্ড ইয়ার’স এগোস মেথড। প্রায় চারশ’ বছরের পুরনো মেথড। ওরা বিশ্বাস করে যে, কারও মনে কোনো কষ্ট থাকলে তা দূর করা যায় একটি মন্ত্রের মাধ্যমে।
: মন্ত্র? কী আবোল তাবোল বকছো। এই সুপার-সায়েন্সের যুগে মন্ত্র কী কাজে আসবে?
: বিলিভ মি. এটাই মিরাক্কেল। আমি নিজে ট্রাই করে সাকসেস হয়েছি।
: তোমার কষ্ট দূর হয়েছে?
: ডেফিনিটিল, আই অ্যাম সাকসেসফুল।
: কীভাবে বুঝলে?
: তোমাকে দেখে, তুমি আমায় ক্ষমা করে দিয়েছো। আমার এখন আর কোনো কষ্ট নেই।
সুহিতা হাসতে থাকে। সত্যিই ও সুশান্তকে ক্ষমা করে দিয়েছে।
সুশান্তের উন্মাদনা ওকে ছুঁতে পারেনি। ধর্ম তো একটা বাধা ছিলই, তাছাড়া সুশান্তকে জীবনঙ্গী করার চিন্তাতীত ভাবনায় ছিল সুহিতা।
: শুধু তুমি নও, অন্যদের সম্পর্কেও আমার ট্রিটমেন্ট কার্যকর হয়েছে। সু, তুমি এই মেথড ট্রাই করতে পারো। ধরো তোমারও এমন হতে পারে যে, সম্পর্কের তিক্ততায় আচ্ছন্ন হয়ে আছো কারও সঙ্গে। এই মন্ত্রটা কয়েকবার জপলেই সাকসেস হবে।
: মন্ত্রটা কী? বিশল্যকরণী মহৌষধটা বলো তো!
: তুমি যাকে কষ্ট দিয়েছো, তাকে স্মরণ করে তার উদ্দেশে বলবে—ঐড়ড় ঢ়ড় হড় ঢ়ড় হড়.
: মানে?
: এর মানে হলো—চষবধংব ভড়ত্মরবাব সব. ও ধস ংড়ত্ত্ু. ও ষড়াব ুড়ঁ, ঃযধহশ ুড়ঁ. যখনই সময় পাবে, এই মন্ত্রটা বার বার পড়বে নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে। এতে তোমার মনের কষ্ট দূর হবে। সেও তোমাকে ক্ষমা করে দেবে।
সুহিতার মনোকষ্ট সম্পর্কের নিবিড়তাকে লাভাসম উত্তপ্ততায় নিশ্চিহ্ন করে দিচ্ছে। মন্ত্রটা তার আওড়ানো দরকার।
: হ্যাঁ সুশান্ত বলো, আর কী মেথড জানো?
: সু, প্লিজ ফান করো না।
: রিয়েলি, আমি ফান করছি না। আমি শুনতে চাইছি।
: হ্যাঁ, আরেকটি মেথডও তুমি মানতে পারো, ক্যানাডিয়ান, চধু রঃ ভড়িধত্ফ.
: এক্সপ্লেইন করো।
: এর মনে মানুষকে হেল্প করা, তুমি কারও দ্বারা উপকৃত হয়েছো, পরে তাকে হেল্প করা, সে ব্যক্তি জীবিত নেই। কিন্তু সামনে তুমি অন্য কাউকেও হেল্প করতে পারো।
: সুশান্ত, আমাদের প্রাচ্যে এসব ভূরি ভূরি মেথড আছে। এখন মানুষ মেডিটেশন করছে—এটিই তো যথেষ্ট, আর মেডিটেশন করে মানুষ নিজকে অ্যাকটিভ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু পারছে কি? এসব খুব জটিল মনস্তত্ত্ব। বাদ দাও, এতদিন পর দেখা, চলো বাসায় যাবে। মঈনের সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব। দুপুরে ভাত খেয়ে যাবে, কী গো—মাংস চলবে তো?
: অ্যাজ ইউ লাইক।
রাতে বিছানায় শুয়ে সুহিতা ঐড়ড় ঢ়ড় হড় ঢ়ড় হড় মন্ত্র জপে। কাকে উদ্দেশ করে জপবে? সম্পর্কের তিক্ততায় অনেকে আছে। বড় বুজির কথা মনে হয়। বুজি ওর সঙ্গে কথা বলে না। সুহিতা জন্মের পর ওর মা আঠারো মাস অসুস্থ হয়ে বিছানায় পড়ে ছিলেন। তখন বড় বুজিই সুহিতাকে লালন-পালন করেছে। এই গল্প কত্তো যে শুনেছে সুহিতা। আজ সেই বুজি মুখ ফিরিয়েছেন। সুশান্তের কানাডিয়ান মেথড মনে হয়। চধু রঃ ভড়িধত্ফ, সুহিতা গভীর ভাবনায় নিমজ্জিত হয়, বড় বুজির সঙ্গে সম্পর্ক তো মা-মেয়ের মতো। সুহিতাকে বুজি স্নেহ-মমতা দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন। সুহিতা কি ভুল করছে? চধু রঃ ভড়িধত্ফ বাক্যটি বার বার বলতে থাকে সুহিতা। উদ্ভ্রান্তের মতো সারারাত জেগে থাকে। ভাবনার অতলে ডুবে মুক্তোর খোঁজ পায় সুহিতা।
পরদিন ঘুম ঘুম চোখে ছোটে বুজির বাড়িতে। নামাজ শেষ করে বুজি সবে চায়ের কেটলি চাপিয়েছেন চুলায়। গেটে শব্দ হয়। এত সকালে কে আসবে, বুজি আন্দাজ করতে পারেন না। মালতির মা কাজে আসে রোদ যখন দোরগোড়ায় পৌঁছায়। মালতির মা তো নয়, তাহলে কে? এগিয়ে গিয়ে গেট খোলেন। সুহিতাকে দেখে বুজি চমকে যান। দু’পা পিছিয়ে আসেন। সুহিতা উদ্ভ্রান্তের মতো ভেতরে ঢুকে গেট আটকে দেয়। তারপর বসে পড়ে বুজির পায়ের কাছে। সুহিতা হু হু করে কেঁপে কেঁপে ওঠে। বুজিকে জড়িয়ে ধরে। বুজিও সুহিতাকে কোলে তুলে নেন—ঠিক ছেলেবেলার মতো। অবুঝ শিশু যেমন মায়ের কোলে পরম নির্ভরতা খুঁজে পায়, সুহিতাও অনেকদিন পর আপন কোলটি খুঁজে পায়। 

সুত্র : আমার দেশ

Tuesday, April 24, 2012

পাহাড়ের মেয়ে | আবুল কাইয়ুম আহম্মেদ

আমি আদিবাসী মেয়ে। বয়স বাইশ। পাহাড় থেকে সমতল ভূমিতে আমি কখনও আসিনি। পরিবারের দুঃখ-কষ্টের দিকে তাকিয়ে একটা এনজিওতে শিক্ষা কার্যক্রমে চাকরি নিই। শৈশবে আমার দিনগুলো কেটেছে নাচ-গান আনন্দ-উৎসবে স্বতঃস্টম্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করে। পাহাড়ি মেয়ে তাই পাহাড়কে আমি মনপ্রাণ উজাড় করে প্রেমিক হিসেবে বুকে স্থান দিয়েছি। পাহাড়ের ঝর্ণায় অবাধ সাঁতার কেটেছি। অরণ্যের ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছি, সেই মালা খোঁপায় বেঁধে 'ছিমুই পাইংখইং তম্রইং ম্রইং অক্যোয়াইংরোহ থংমা হিয়াহলে' গান গেয়ে আনন্দে নেচেছি। সেই দিনগুলোর কথা স্মৃতিপটে মনে হলেই চোখ হয়ে যায় অশ্রুনদী, হৃদয় হয়ে যায় ক্ষতবিক্ষত, তখন সুখ ছিল আদিবাসী গ্রামে। অন্যরকম সুখ। ছোট ছোট গ্রাম ছোট ছোট সুখ। তখন সমাজে শোষণ-বঞ্চনা ছিল না। শোষণ-বঞ্চনার অর্থই আমরা জানতাম না; কিন্তু আজ অরণ্য নেই, আদিবাসীদের সে জীবনও নেই। পাহাড় ঠিকই আছে, কিন্তু পাহাড়ের ওপর আমাদের অধিকার নেই। সব হারিয়ে আজ আমরা অসহায়, বিপন্ন। হঠাৎ সমতল ভূমির হায়েনারা এসে আমার প্রেমিক পাহাড়কে ছিনতাই করে নিয়ে গেল। আমি খুব কষ্ট করে আইএ পাস করি। আমার পরিবারের সবাই অশিক্ষিত। আমরা খুবই গরিব। বাবা ভ্যানচালক। চাকরি নেওয়ার আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে লেখা ছিল আদিবাসী মেয়েদের অগ্রাধিকার ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে; কিন্তু চাকরি নিয়ে দেখি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির শর্তগুলোর একটাও মানা হচ্ছে না। চাকরিতে কত ট্রেনিং করেছি, ট্রেইনার কত ভালো ভালো কথা বলেছে; কিন্তু সেগুলো ছিল কথার ফুলঝুরি মাত্র।
চাকরি নিয়ে আমাদের সংসারের কিছু পরিবর্তন এসেছে বটে; কিন্তু আমার হৃদয় ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে তথাকথিত শিক্ষিত মুখোশধারীরা। অফিসে সুযোগ পেলেই বাঙালি বড়কর্তা, ছোটকর্তা এমনকি আমার সহকর্মীরাও শরীরের বিভিন্ন জায়গায় হাত দিত। ওরা মুখে মানবাধিকারের কথা বলত। নারীর ক্ষমতায়ন, আদিবাসীদের অধিকারের কথা বলত। কিন্তু মনেপ্রাণে ওরা ছিল ওসবের বিরুদ্ধে। একদিন শুনলাম ময়মনসিংগ্যা থেকে একজন বাঙালি মুসলমান আমাদের অফিসে বদলি হয়ে আসছেন। ভয়ে আরও আতঙ্কিত হলাম। যথাসময়ে সে এলো। তার কথাবার্তা চাল-চলনে আমি অবাক হলাম। একদিন অফিসে মিটিং হচ্ছে। বস আমাকে বললেন, তুমি বেলালকে নিয়ে স্টোর রুম থেকে বই নিয়ে এসো। আমি না বললাম। একে একে আরও কয়েক জনের নাম বলল, আমি না উত্তর দিলাম। বস হঠাৎ রাগে বললেন তাহলে ময়মনসিংগ্যা মদনটার সঙ্গে যাবে। আমি হ্যাঁ বললাম। দু'জনে স্টোর রুমে ঢুকলাম। প্রায় এক ঘণ্টা খুঁজে বই পেলাম। কিন্তু বসের সেই ময়মনসিংগ্যা মদনটার কাছ থেকে সেদিন যে ব্যবহার পেয়েছি, মনে হল ও যে দ্বিতীয় ভগবান বৌদ্ধ।
একদিন খবর এলো, আমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। বসের কাছে এসে ছুটি চাইলাম। বাবার অসুস্থার কথা বললাম, কিন্তু তিনি ছুটি দেননি। ময়মনসিংগ্যা দাদাটা অসুস্থতার কথা শুনে সঙ্গে সঙ্গেই বান্দরবান চলে গেল। নিজের টাকা খরচ করে আমার বাবাকে সুস্থ করে তুলল। আমি বিষয়টি হেড অফিসকে জানালাম। তার কিছুই হলো না। বরং হেড অফিস সেই বসকে প্রমোশন দিল। এবার আরেক নতুন বস এলেন। তার ব্যবহারে মনে হলো জলন্ত আগুন থেকে মুক্ত হয়ে ফুটন্ত কড়াইয়ের মধ্যে পড়ে গেলাম। আমার দিকে যখন চাইত তখন মনে হতো আমার সারা শরীর গিলে খেতে চায়? আমাকে অনেক উত্ত্যক্ত করতে লাগল। হেড অফিসের নিয়ম আছে মেয়েদের মাসিকের সময় ফিল্ডে কাজ নিষিদ্ধ। কিন্তু সে সময় আমাকে ফিল্ডে কাজ করতে হতো। অফিসে ৫টার পর কাজ নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু কাজ থাকুক কিংবা না থাকুক ১০টা পর্যন্ত অফিসে বসিয়ে রাখতেন।
ময়মনসিংগ্যা দাদা এসবের প্রতিবাদ করায় একদিন তার চাকরি চলে গেল। আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম। কী করব বুঝে উঠতে পারলাম না। দাদাকে মোবাইল করলাম দাদা চাকরি ছাড়তে নিষেধ করল। আমার বাবা আবার অসুস্থ হলো। ছুটি চাইলাম। বস আমার সঙ্গে পশুর মতো আচরণ করল। আমি রিজাইন লেটার লিখে বান্দরবান চলে এলাম। এসে দেখি বাবার লাশ উঠানে, সেখানে অনেক মানুষের ভিড়। অবাক চোখে চেয়ে দেখলাম ময়মনসিংগ্যা দাদাটা নির্বাক দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে বাবার লাশ পাহারা দিচ্ছে। 

সুত্র : সমকাল

আমেলা | ওমর আলী

যৌবনের মাংসে ভরপুর দুইগাল টল টলে
যৌবনের রসে ভরপুর দুই ঠোঁট আমেলার
আমেলা পুকুরে মুখ ধুতে যায় ছায়া পড়ে জলে
মসৃণ আয়না যেন মুখখানা ধরে রাখে তার
আমেলা যুবতী রাঙা জামা-পায়জামা পরে থাকে
সুস্বাস্থ্যে ভরা কোমর দৃষ্টিকে করে আকর্ষণ
রঙিন ওড়না দিয়ে সুউন্নত বুক ঢেকে রাখে
তবুও মানে না বাধা মুগ্ধ করে দর্শকের মন
আমেলা যৌবনের গর্বে অত্যন্ত গরবিনী
সে যেন মহুয়া স্বাস্থ্যবতী আর শক্তিমতী নারী
পুরুষকে কাঁধে নিয়ে চলে যায় এত সাহসিনী
সুলতানা রিজিয়ার সাথে তার তুলনা দিতে পারি
সাবিত্রী সে জানকী সে বীর যোদ্ধা চাঁদ সুলতানা
পুরুষের বেশে যোদ্ধা অশ্বারোহী সকিনা বেগানা...।

সুত্র : আমার দেশ

পূর্বরাগ | হেলাল মুহম্মদ আবু তাহের

স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে কাজ করার সময় লিমার ফোন নম্বর পেয়েছিলাম। সংক্ষিপ্ত জীবনবৃত্তান্ত ছিল : ‘তালাকপ্রাপ্তা, নিঃসন্তান, ধর্মভীরু...।’
ফোন ধরেই জিজ্ঞেস করল—আমার নম্বর পেলেন কীভাবে?
সত্যি কথাটাই বললাম, স্বেচ্ছাসেবকের ভূমিকায় ইসনা থেকে নিয়েছি।
—ইসনা কী?
—কেন? তুমি যে ম্যাট্রিমনিয়াল সার্চ দিয়েছ ইসলামিক সোসাইটি অব নর্থ আমেরিকায়—
—ও আচ্ছা।
—দেখ লিমা, জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে টরোন্টোর ভিসা পেয়েছি। বিমানবন্দরে আসতে পারো। তার আগে তোমার একটি ছবি আমাকে পাঠাও।
—অবশ্যই।
ছবির সঙ্গে একটা ছোট্ট চিঠিও পেলাম : বাঙালি মা কি বিদেশিনী পুত্রবধূ পছন্দ করবেন?
বিমানবন্দরে সহযাত্রী ড. মার্ক গ্রিন তাঁর হোটেলে চলে গেলেন। আমি লিমাকে ফোন করলাম : কী ব্যাপার? এলে না যে!
—কলেজে বিশেষ ক্লাস চলছে, তাই যেতে পারিনি বলে দুঃখিত।
—আমার মাও এসেছেন তোমাকে দেখতে। আমরা তোমার কলেজেই অপেক্ষা করি না হয়।
—ঠিক আছে।
ক্যাফেটারিয়ায় কফিতে চুমুক দিতে দিতে লিমা বলল—বাসায় চলেন আপনারা। আমার বড় ভাই আছেন অভিভাবক। বাবা মারা গেছেন আমার পাঁচ বছর বয়সে।
লিমার চোখের রং বাদামি। খুবই সুন্দর লাগছে হালকা নীল জামায়।
—তোমার প্রথম স্বামী কী করতেন?
—ও কোনো কাজ করত না।
খাওয়া-দাওয়া ও বিশ্রাম শেষে দীর্ঘক্ষণ আলাপ-আলোচনায় সিদ্ধান্ত হলো যে, লিমার পরীক্ষা শেষেই বিয়ে হবে। আমিও ভাবলাম, মাত্র কয়টা দিনই তো। কিন্তু পরীক্ষার ফল বের হওয়ার আগেই লিমার চাকরি হয়ে গেল সৌদি আরবে। এরই মধ্যে আমারও হজ ভিসা চলে এসেছে।
দু’জনেই এক সঙ্গে হজও করলাম। ওর মাও হজ করলেন। ওর কর্মস্থলে আমারও বায়োডাটা জমা দিলাম। ওর বস বেশ প্রীত হলেন। খুব তাড়াতাড়ি আমাকেও নিয়োগপত্র দেবেন বলে জানালেন।
সুসংবাদটি দিয়ে লিমাকে বললাম : চলো, সেলিব্রেট করি।
—পূর্বরাগে আমি বিশ্বাস করি না। লিমার সংক্ষিপ্ত জবাব।
ছোটগল্প : নিয়োগপত্র
হেলাল মুহম্মদ আবু তাহের
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আমার প্রতিবেশী। সৌজন্য সাক্ষাত্ শেষে আমার জীবনবৃত্তান্ত পেশ করার অনুমতি চাইলাম। সাদরে তিনি তা গ্রহণ করলেন এবং বেশ কিছুক্ষণ দেখার পর জানতে চাইলেন—তা আপনি কি পূর্ণকালীন না খণ্ডকালীন কাজ চান?
স্যার, এ আপনাদের ব্যাপার। এখনি যোগ দিতে হলে লিয়েন নেব দেড় বছর।
—থাক, মাত্র দেড় বছর লিয়েন না নিয়ে অপেক্ষা করুন।
—ঠিক আছে স্যার। ধন্যবাদ।
* * *
অবসর শুরু হওয়ার কয়েকদিন আগে দেখা করলাম। জানতে চাইলাম—এখন আমার কী করণীয়?
—অবসরের পরদিন যোগ দেবেন। আচ্ছা, প্রারম্ভিক বেতন কত চান?
—আপনারা কত দিতে চাচ্ছেন?
—দেখুন, আমাদের প্রতিষ্ঠান একটু সমস্যায় আছে এখন, তাই আমরা আপাতত চল্লিশ হাজার দেব, কিছুদিন পর বাড়বে।
—বেশ ভালো। যোগ দেব।
* * *
অবসরের পর দিন যোগ দিতে গেলে পরিচালক সাদরে বরণ করলেন। গ্রন্থাগারিকও অনেকক্ষণ আলাপ করার পর বললেন, আচ্ছা আপনার নিয়োগপত্রটি কই?
নিয়োগপত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মহাসচিবের কাছে গেলাম। তিনি পাঠালেন সভাপতির কাছে। সভাপতি হঠাত্ অসুস্থ হয়ে পড়ায় দায়িত্ব পেলেন সহ-সভাপতি। তিনিও আমার প্রতিবেশী এবং অত্যন্ত সহানুভূতিশীল। কিন্তু এই মুহূর্তে কোনো সহযোগিতা করতে পারবেন না বলে সবিনয়ে জানালেন । কারণ নাকি মন্দা।

সুত্র : আমার দেশ

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ