প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Thursday, May 31, 2012

কাজলা দিদি | যতীন্দ্র মোহন বাগচী

বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই,
মাগো আমার শোলক-বলা কাজলা দিদি কই?
পুকুর ধারে লেবুর তলে
থোকায় থোকায় জোনাই জ্বলে
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না একলা জেগে রই-
মাগো আমার কোলের কাছে কাজলা দিদি কই?

সেদিন হতে কেন মা আর দিদিরে না ডাকো;-
দিদির কথায় আঁচল দিয়ে মুখটি কেন ঢাকো?
খাবার খেতে আসি যখন,
দিদি বলে ডাকি তখন,
ওঘর থেকে কেন মা আর দিদি আসে নাকো?
আমি ডাকি তুমি কেন চুপটি করে থাকো?

বল মা দিদি কোথায় গেছে, আসবে আবার কবে?
কাল যে আমার নতুন ঘরে পুতুল-বিয়ে হবে!
দিদির মত ফাঁকি দিয়ে,
আমিও যদি লুকাই গিয়ে
তুমি তখন একলা ঘরে কেমন করে রবে,
আমিও নাই-দিদিও নাই- কেমন মজা হবে।

ভুঁই চাপাতে ভরে গেছে শিউলি গাছের তল,
মাড়াস্ নে মা পুকুর থেকে আনবি যখন জল।
ডালিম গাছের ফাঁকে ফাঁকে
বুলবুলিটি লুকিয়ে থাকে,
উড়িয়ে তুমি দিও না মা, ছিঁড়তে গিয়ে ফল,-
দিদি এসে শুনবে যখন, বলবি কি মা বল!

বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ওই-
এমন সময় মাগো আমার কাজলা দিদি কই?
লেবুর ধারে পুকুর পাড়ে
ঝিঁঝিঁ ডাকে ঝোপে ঝাড়ে’
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না, তাইতে জেগে রই
রাত্রি হলো মাগো আমার কাজলা দিদি কই?

পণ্ডশ্রম | শামসুর রহমান


এই নিয়েছে ঐ নিল যাঃ! কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে মরছি ঘুরে আমরা সবাই মিলে।
কানের খোঁজে ছুটছি মাঠে, কাটছি সাঁতার বিলে,
আকাশ থেকে চিলটাকে আজ ফেলব পেড়ে ঢিলে।

দিন-দুপুরে জ্যান্ত আহা, কানটা গেল উড়ে,
কান না পেলে চার দেয়ালে মরব মাথা খুঁড়ে।
কান গেলে আর মুখের পাড়ায় থাকল কি-হে বল?
কানের শোকে আজকে সবাই মিটিং করি চল।

যাচ্ছে, গেল সবই গেল, জাত মেরেছে চিলে,
পাঁজি চিলের ভূত ছাড়াব লাথি-জুতো কিলে।
সুধী সমাজ! শুনুন বলি, এই রেখেছি বাজি,
যে-জন সাধের কান নিয়েছে জান নেব তার আজই।

মিটিং হল ফিটিং হল, কান মেলে না তবু,
ডানে-বাঁয়ে ছুটে বেড়াই মেলান যদি প্রভু!
ছটতে দেখে ছোট ছেলে বলল, কেন মিছে
কানের খোঁজে মরছ ঘুরে সোনার চিলের পিছে?

নেইকো খালে, নেইকো বিলে, নেইকো মাঠে গাছে;
কান যেখানে ছিল আগে সেখানটাতেই আছে।
ঠিক বলেছে, চিল তবে কি নয়কো কানের যম?
বৃথাই মাথার ঘাম ফেলেছি, পণ্ড হল শ্রম।

Tuesday, May 29, 2012

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। ক্যান্সারের সঙ্গে নয় মাসের প্রথম পর্বের যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরেছেন। আগামী ১ জুন দ্বিতীয় পর্বের যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে আবার যাচ্ছেন মার্কিন মুল্লুকে। গত শুক্রবার (26262622222asdfasdfasdfasdfasdfasdfasdfsdfsd22226 নিজের প্রিয় জগৎ নুহাশ পল্লীতে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে বসেছিলেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। সকাল থেকে সন্ধ্যা- বিশ্রাম নিয়ে তিন দফায় তিনি কথা বলেন। মানসিক শক্তি, মৃত্যুচিন্তা, লেখালেখি, ভালো লাগা, মন্দ লাগাসহ অনেক বিষয়েই মুখ খুলেছেন। সঙ্গে ছিলেন- জাকারিয়া সৌখিন ও রণক ইকরাম
এক.
গাজীপুরে হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লী। ঢাকা থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ। লালরঙা মাটির পাহাড়িয়া ঢঙে বনের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। গেট পেড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই হুমায়ূনীয় স্বাদের বিশাল এক জগৎ। চলি্লশ বিঘাজুড়ে বৃক্ষ আর বৃক্ষ। মাঝে মাঝে স্কাল্পচার, থাকার ঘর, বসার ঘর, বৃষ্টি বিলাস, ভূত বিলাস...। শেষ মাথায় দিঘি- দিঘি লীলাবতী। প্রতিদিন সকালে প্রথম থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত হাঁটেন হুমায়ূন আহমেদ। আজও হাঁটতে বেরিয়েছেন।
সকাল সাড়ে ৯টা। হাত-পা তুলে শিশুর মতো জড়োসড়ো হয়ে হুমায়ূন আহমেদ বসে আছেন দিঘি লীলাবতীর পুরনো ঘাটে। ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটটিতে সবুজ শেওলার গালিচা বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। চারদিকে বটবৃক্ষের ঝরা পাতা ছড়ানো-ছিটানো- ঘাটের উপরও। সবমিলিয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য। কুশলবিনিময়ের পর ইশারায় বসতে বললেন 'আমাদের কলম জাদুকর'। কেমন আছেন- জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলেন, 'খুব ভালো'। শরীরে রোগ থাকলেও কণ্ঠে কোনো ছাপ নেই। খুব দৃঢ় আত্দবিশ্বাস। এরপর এক-দুই কথায় বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সঙ্গে গল্প জমতে শুরু করে-
স্যার, প্রতিদিন সকালেই হাঁটেন। হাঁটার জন্য হাঁটেন, নাকি সৌন্দর্য উপভোগের জন্য?
দুটোই।
নুহাশ পল্লীর সঙ্গে নয় মাসের বিচ্ছেদ শেষে ফিরলেন। পৃথিবীর নানা দেশের নানা জায়গা ঘুরেছেন। কিন্তু নুহাশ পল্লীই আপনার কাছে আলাদা। কেন?
কারণ গাছপালা। এখানকার প্রতিটি গাছপালার সঙ্গে আমি জড়িত। এখানে শত শত গাছ আছে। সবগুলোই আমার হাতে বা আমার উপস্থিতিতে রোপিত হয়েছে। আমি এদেরকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি। এরা আমার সন্তানের মতো। আর এতগুলো সন্তানের মায়া অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে আলাদা হবে না?
কি চিন্তা থেকে এই অরণ্যে 'নুহাশ পল্লী' গড়েছিলেন?
আসল কারণ হচ্ছে গাছ। গাছের প্রতি আমার মমতা আছে। আর আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে গাছের কাছে আমরা অসম্ভব ঋণী। আমরা এই ঋণটা কখনো স্বীকার করছি না। আমরা তাকে জ্বালাচ্ছি- আগুনে পোড়াচ্ছি অথচ প্রতিনিয়ত আমরা গাছের কাছেই হাত পাতছি। সেখানে থেকেই নুহাশ পল্লী।
গাছ-গাছালি সন্তানের মতো ভালোবাসছেন। ওদের সঙ্গে কি আপনার কথা হয়?
আমি কথা বলি। ওরা বুঝতে পারে কি-না, জানি না। একটা গাছকে যদি দেখি খুবই দুর্বল, আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জিজ্ঞেস করি- 'কিরে ব্যাটা, এই অবস্থা কী জন্যে? সমস্যাটা কী বল আমারে।' মেবি ওরা আমাকে অ্যান্সার করে, বাট আমি ধরতে পারি না।
নুহাশ পল্লী-যশখ্যাতি সব হয়তো একদিন থাকবে। আপনিই থাকবেন না। এই ভেবে আফসোস হয়?
না। আফসোস হবে কেন? আমার এক জীবনে আমি নুহাশ পল্লী দেখেছি। ভালোবাসা পেয়েছি। তাই মরার আগেও আমার আফসোস থাকার কথা নয়। যখন মরতে হবে মরে যাব, তাই না?
এত মানসিক শক্তি আপনার। মানসিক শক্তিই কি আপনাকে সুস্থ করে তুলছে?
না। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি নিয়ে অনেক মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু তাদেরকে শেষ পর্যন্ত ডিজিজ-এর কাছে হার মানতে হয়েছে। অ্যাপলোর স্বপ্নদ্রষ্টা স্টিভ জনবস, তাঁর কী মানসিক শক্তি কম ছিল? তারপর জ্যো ফ্রেজিয়ে, তার কী মানসিক শক্তি কম ছিল?
হুগো শ্যাভেজ কিন্তু ফিরেছেন!
বলা হয়েছে তিনি সুস্থ। কিন্তু নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। আরও আগে একবার বলা হয়েছিল তিনি সুস্থ। পরে আবার চিকিৎসা হলো। আবার এলো, আবার গেল। উনি পলিটিক্যাল লোক। পলিটিক্যাল লোকদের কোনো বিশ্বাস করতে নেই।
মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
ধর্মীয়ভাবে একটা ধারণা সবার মধ্যে আছে। কিন্তু আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, দ্যা মোমেন্ট আই উইল ডাই- আমি মাটির সঙ্গে মিশে যাব।
তাহলে মৃত্যুটা আপনার কাছে কেমন?
মৃত্যুটা আমার কাছে খুবই পেইনফুল। একটা মানুষ এত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে, ৭০-৮০ বছর বাঁচে সে। অথচ একটা কচ্ছপ সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে, হোয়াই? কচ্ছপের মতো একটা প্রাণী কেন সাড়ে তিনশ বছর বাঁচবে? আমরা কেন নই?
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে'। আপনি কি বলবেন?
আবার একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, 'মরণরে তুহু মম শামও সমান'। [মৃদু হেসে] উল্টা দুই রকম কথা বলে গেছেন। শোন, কবি-সাহিত্যিকরা অনেক কথা বলে। এগুলা নিয়া ঘামাও ক্যান?
আপনার কষ্ট, আপনার সুখ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আমার কোনো কষ্ট নেই। আর সুখের কথা বললে বলব, অবশ্যই আমি অন্যদের চেয়ে বেশি সুখী। কারণ আমি জানি, কি করে সুখ আহরণ করতে হয়।
তাহলে স্বপ্ন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি...
আমি নিজেকে নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা কখনোই করি না। আমি খুবই একটা সুখী মানুষ ছিলাম। এখনো সুখী। কাজেই বলা যেতে পারে, আমি তৃপ্ত। আর কী পেয়েছি, কী না পেয়েছি, ভাবি না। যা পাইছি ভালো, না পাইলে নাই। হা-হুতাশ করে লাভ নেই।
পথ চলতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এতটা পথ পেরিয়ে এসে, জীবনের শেষ উপলব্ধি মানে রিয়েলাইজেশনটা কী?
শেষ রিয়েলাইজেশন হচ্ছে 'জীবন অনেক, অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার'। তারা শঙ্করের কবির মতন মাঝে-মধ্যে আমার বলার ইচ্ছা করে, 'জীবন এত ছোট ক্যানে?' ওই যে একটু আগে বললাম, একটা কচ্ছপ কেন সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে, মানুষ কেন বাঁচে না! জীবনটা আমার খুব ছোট মনে হয়। তোমাদের মনে হয় না? নাকি এখনো টের পাও নাই? টের পাইবা...
সকালের শিশু সূর্যটা যুবক হয়ে উঠছে। খুব তেজ ছড়াচ্ছে। ঘামছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাই উঠবেন। কিন্তু ফটোসেশন! হুমায়ূন আহমেদ খুব একটা ফটোসেশনে অংশ নেন না। তবুও ফটোসেশনের অনুরোধ। হ্যাঁ, তিনি গিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন সিঁড়ির একপাশে। কিছু ছবি তোলা হলো। কিন্তু তার মুখে হাসি নেই। হাসার অনুরোধ করতেই বললেন, 'আমি হাসতে পারি না বাবা...'।
ছবি তোলা শেষ। ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেবেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্রাম শেষে আবার কথা বলবেন জানিয়ে সোজা হাঁটা শুরু করলেন। ধীর গতিতে হেঁটে চলে গেলেন নিজের কুটিরে। ছেলে নিশাদ দাঁড়িয়েছিল। বাবাকে দেখে কি বলে যেন উচ্ছ্বাস দেখালো। সম্ভবত কোনো আবদারের উচ্ছ্বাস। হুমায়ূন আহমেদও নিশাদের হাত ধরে আবদার পূরণের আশ্বাস দিতে দিতে ভেতরে ঢুকলেন।

Thursday, May 24, 2012

মুখোশের আড়ালে | এস এম শহীদুল আলম

মুখোশের আড়ালে
চেহারাটা ভিন্ন,
সুদ-ঘুষ অপরাধে
পাওয়া যায় চিহ্ন।

ভেঙে গেলে হাটে হাঁড়ি
সব লোক চমকায়,
কথাগুলো ফাঁস হলে
অপরাধী ধমকায়!

শাক দিয়ে মাছ ঢেকে
লাভ কিছু হয় না,
চুনকালি মাখা দেখে
কেউ কথা কয় না!



সূত্র : সমকাল

Wednesday, May 9, 2012

ধনুক কাহিনী

সৃষ্টির সেরা জীব মানুষ। তবে সৃষ্টির আদিতে এমন শ্রেষ্ঠত্ব ছিল না মানুষের। ভয়ঙ্কর পৃথিবীতে বিশালাকারের সব হিংস্র প্রাণীর রাজত্ব ছিল একসময়। কিন্তু মেধা-মনন আর বুদ্ধির জোরে সেসব হিংস্র প্রাণীকে হারিয়ে মানুষ ঠিকই তার শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে নেয়। প্রথমদিকে বিশাল সব প্রাণীর চেয়ে শারীরিক দিক থেকে দুর্বল মানুষ নিজেকে বাঁচাতে তুলে নেয় ভারী ভারী পাথরের টুকরো। সেই পাথরের টুকরো ছুঁড়ে তাকে বাঁচতে হয়েছে বিশালাকার প্রাণীদের হাত থেকে। তখনই অস্ত্রের ধারণা আসে মানুষের। একসময় বাঁচার তাগিদে মানুষ আবিষ্কার করে তীর-ধনুক। হয়তো কোনো বেঁকে যাওয়া গাছের ডালে নিজেদেরই শিকার করা প্রাণীর অস্ত্র দিয়ে তৈরি ছিল, আর ভেঙে যাওয়া বর্শার সামনের অংশটুকু দিয়ে কোনো একজনের আবিষ্কৃত তীর-ধনুক মানুষ ব্যবহার করতে শিখল। সেদিন থেকেই মানুষ সভ্যতার আরেক ধাপে এগিয়ে গেল।
ধনুবিদ্যা অর্থাৎ ধনুক দিয়ে তীর ছোঁড়া হলো মানুষের প্রাচীন কলাকৌশলের অন্যতম। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই ধনুক ছিল যুদ্ধ ও শিকারের প্রধান অস্ত্র। যদিও ১৫ শতাব্দীতে যুদ্ধক্ষেত্রে ধনুকের ব্যবহার লুপ্ত হয়, তবুও শিকারের অস্ত্র হিসেবে এর ব্যবহার অক্ষুণ্ন থাকে। শুরুতে ধনুক তৈরি হতো সাধারণত কাঠ দিয়ে কিন্তু পরবর্তী সময়ে কাঠসহ অন্যান্য অনেক বস্তুর ব্যবহার শুরু হয়। এগুলোকে বলা হয় কম্পোজিট বা যৌগিক ধনুক। ১৯৫০-এর দশকের পর ক্রীড়াযন্ত্র হিসেবে ক্রসবো অর্থাৎ আড় ধনুকের ব্যবহার শুরু হয়। ঠিক তখন থেকেই ধনুকের ছিলারও (দড়ি) অনেক পরিবর্তন ঘটে। ধনুকের ছিলার উপকরণগুলোর মধ্যে রয়েছে পশুর গায়ের লোম, শাকসবজির অাঁশ, শন, রেশম, লিনেন পাক দেওয়া তন্ত্র এবং পশুর চামড়া, বাঁশ বা বেতের ফালি। তখন থেকেই ধীরে ধীরে বিকাশের মাধ্যমে তীরের উদ্ভব হয়। আগে যে তীর ব্যবহার করা হতো তা সম্ভবত কোনো ধরনের নলখাগড়া বা ক্রেন দিয়ে তৈরি হতো। তীর দিয়ে বিদ্ধ করার জন্যও তীরের অগ্রভাগে ধাতু বা পাথরের ফলার ব্যবহার করা হতো। লৌহ ও ইস্পাত আবির্ভাবের পর তীরের বিভিন্ন রকম ডিজাইন বিকাশ লাভ করে। দীর্ঘ ধনুকের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সংগঠিত আধুনিক ক্রীড়া হিসেবে ধনুবিদ্যা ক্রীড়ার সূত্রপাত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে লাটুকেটে ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মধ্যে যে প্রতিযোগিতা হয় তখন থেকেই আন্তর্জাতিক ধনুবিদ্যা প্রতিযোগিতার সূত্রপাত ঘটে। প্রতিযোগিতা পরিচালনার জন্য আন্তর্জাতিক আরচারি ফেডারেশন গঠিত হয়। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পুরুষদের জন্য দীর্ঘতম দূরত্ব হলো ৯০ মি. (৯৮.৪ গজ) এবং স্ত্রীলোকদের জন্য ৭০ মি. (৭৬.৫ গজ)। এ ক্রীড়ার প্রতি পৃথিবীব্যাপী আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার ফলে ১৯৬৯ সালে ফিল্ম আরচারিকে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত করা হয় এবং দীর্ঘতম তীর ছোঁড়ার দূরত্ব স্থির করা হয় ৬০ মি. (৬৫.৬ গজ) এবং চারটি লক্ষ্যস্থলের বৃহত্তমটির আকৃতি স্থির করা হয় ৬০ সে. মি.। বিংশ শতাব্দীর প্রথম-তৃতীয়াংশে ইউরোপে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে টার্গেট আরচারি একটি জনপ্রিয় ক্রীড়া হিসেবে প্রচলিত হয়। ১৯৩১ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীরা আসত ফ্রান্স, বেলজিয়াম, সুইডেন, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও চেকোস্লোভাকিয়া থেকে। ১৯০০, ১৯০৪, ১৯০৮, ১৯২০ সালে আরচারি অলিম্পিক প্রতিযোগিতার অন্তর্ভুক্ত ছিল। তারপর আবার ১৯৭২ সালের অলিম্পিক ক্রীড়ায় আবার এটি প্রচলিত হয়। 

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

বিশ্বজুড়ে বিশ্বকবি | হাসান ভূইয়া

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মোট ১২ বার বিশ্বভ্রমণে বেরিয়ে ছিলেন। ১৮৭৮ থেকে ১৯৩২ সালের মধ্যে তিনি পাঁচটি মহাদেশের ৩০টিরও বেশি দেশ ভ্রমণ করেন। প্রথম জীবনে দুই বার (১৮৭৮ ও ১৮৯০ সালে) তিনি ইংল্যান্ডে গিয়েছিলেন। ১৯১২ সালে ব্যক্তিগত চিকিৎসার জন্য তৃতীয়বার ইংল্যান্ডে গিয়ে ইয়েটসসহ কয়েকজন ইংরেজ কবি ও বুদ্ধিজীবীর কাছে সদ্যরচিত গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ পাঠ করে শোনান। এই ভ্রমণের সময়ই দীনবন্ধু চার্লস ফ্রিয়ার অ্যান্ড্রুজের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের পরিচয় ঘটে। ১৯১৩ সালে সুইডিশ একাডেমী তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করে। ১৯১৬-১৭ সালে জাপান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ সাম্রাজ্যবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কয়েকটি বক্তৃতা দেন। এসব বক্তৃতাও সংকলিত হয় তার ন্যাশনালিজম (১৯১৭) গ্রন্থে। ১৯২০-২১ সাল নাগাদ আবার ইউরোপ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান কবি। ওই সফরে পাশ্চাত্য দেশগুলোতে তিনি সংবর্ধিত হয়েছিলেন। ১৯২৪ সালে রবীন্দ্রনাথ যান চীন সফরে। এরপর চীন থেকে জাপানে গিয়ে সেখানেও জাতীয়তাবাদবিরোধী বক্তৃতা দেন কবি। ১৯২৪ সালের শেষের দিকে পেরু সরকারের আমন্ত্রণে সে দেশে যাওয়ার পথে আর্জেন্টিনায় অসুস্থ হয়েছে কবি ভিক্টোরিয়া ও কাম্পোর আতিথ্যে তিন মাস কাটান। স্বাস্থ্যের কারণে পেরু ভ্রমণ তিনি স্থগিত করে দেন। ১৯২৬ সালে বেনিতো মুসোলিনির আমন্ত্রণে ইতালি সফরে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। প্রথমে মুসোলিনির আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলেও পরে লোকমুখে তার স্বৈরাচারের কথা জানতে পেরে মুসোলিনির কাজকর্মের সমালোচনা করেন কবি। ফলে উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে ছেদ পড়ে। পরে রবীন্দ্রনাথ গ্রিস, তুরস্ক ও মিসর ভ্রমণ করে ভারতে ফিরে আসেন। ১৯২৭ সালে চার সঙ্গীকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গিয়েছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া সফরে। ওই সময় তিনি ভ্রমণ করেন বালি, জাভা, কুয়ালালামপুর, মালাক্কা, পেনাং, সিয়াম ও সিঙ্গাপুর। ১৯৩০ সালে কবি শেষবার ইংল্যান্ডে যান অঙ্ফোর্ডে হিবার্ট বক্তৃতা দেওয়ার জন্য। এরপর তিনি ভ্রমণ করেন ফ্রান্স, জার্মানি, সুইজারল্যান্ড, সোভিয়েত রাশিয়া ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৩২ সালে ইরাক ও পারস্য ভ্রমণে গিয়েছিলেন কবি। এরপর ১৯৩৪ সালে সিংহলে যান রবীন্দ্রনাথ। এটিই ছিল তার সর্বশেষ বিদেশ সফর। রবীন্দ্রনাথ যেসব বইয়ে বিদেশ ভ্রমণে তার অভিজ্ঞতাগুলো লিপিবদ্ধ করে রাখেন সেগুলো হলো_ য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র (১৮৮১), য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়রি (১৮৯১, ১৮৯৩), জাপান-যাত্রী (১৯১৯), যাত্রী (পশ্চিম-যাত্রীর ডায়রি ও জাভা-যাত্রীর পত্র, ১৯২৯), রাশিয়ার চিঠি (১৯৩১), পারস্যে (১৯৩৬) ও পথের সঞ্চয় (১৯৩৯)। ব্যাপক বিশ্বভ্রমণের ফলে রবীন্দ্রনাথ তার সমসাময়িক অরিঁ বের্গসঁ, আলবার্ট আইনস্টাইন, রবার্ট ফ্রস্ট, টমাস মান, জর্জ বার্নার্ড শ, এইচ জি ওয়েলস, রোম্যাঁ রোলাঁ প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পেয়েছিলেন। জীবনের একেবারে শেষ পর্বে পারস্য, ইরাক ও সিংহল ভ্রমণের সময় মানুষের পারস্পরিক ভেদাভেদ ও জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তার বিতৃষ্ণা আরও তীব্র হয়েছিল। অন্যদিকে বিশ্বপরিক্রমার ফলে ভারতের বাইরে নিজের রচনাকে পরিচিত করে তোলার এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিনিময়ের সুযোগও পেয়েছিলেন তিনি

সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

রবীন্দ্রনাথ : বারে বারেই নতুন | রণক ইকরাম

আমাদের মনের ভেতর প্রায়ই ঝড় ওঠে। তখন আমরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে নিজের ভেতরের মানুষটাকে খুঁজে বেড়াই। আবিষ্কার করার চেষ্টা করি আয়নার পেছনের ভাবনাগুলোকে। আবার তেমনি চারপাশের হুটহাট ব্যস্ততার মধ্যেও অনায়াসে সবাই মন গলাই-মন বাড়াই। আসলে গতানুগতিকতা ও বৃত্তের বাইরের সঙ্গে নিজেকে টেনে নিতেই এই বোধ। যেমন একটি বোধ, চিন্তার নাম রবীন্দ্রনাথ। ঘটনা বহুদিন আগের। সৃষ্টিতে প্রতি মুহূর্তে প্রতিক্ষণ আছেন কাছাকাছি পাশাপাশি। এরপরও বৈশাখ এলেই তাকে নিয়ে বেশি মাতামাতি শুরু হয়। এ তো কেবল ভালোবাসা আর ভেতরের মানুষটার হঠাৎ জাগরণের জন্যই! রবীন্দ্রনাথ চলে গেছেন আজ থেকে প্রায় দেড়শ বছর আগে। অথচ আজও তিনি তরুণ, আজও তিনি নতুন। যতবার ফিরে তাকানো যায়, ততবারই নতুন মনে হয়। এই তো রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া কোনো কবি জাতির যাপনচিত্র কিংবা বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে এমন অমোঘ হয়ে জুড়ে থাকেননি কখনো। পৃথিবীর সাহিত্য ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথই প্রথম টেনেছেন বৈশ্বিক মেলবন্ধন। তিনিই পেরেছেন বাঙালির প্রতিদিনের প্রেম, অপ্রেম, যন্ত্রণা, বিরহের সঙ্গে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকতে। পেরেছেন সেই জড়িয়ে থাকা বোধের স্ফুলিঙ্গ-প্রেম-অপ্রেম বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে। শীত-গ্রীষ্ম রোদ-বৃষ্টির মতোই বাঙালির প্রতিদিনের জীবনযাপনে বারবার অনিবার্যভাবে চলে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ। কখনো কারও ইচ্ছায় আবার কখনো বা নেহায়েতই অনিচ্ছায়। গল্প-কবিতা-নাটক-গান-দর্শন রবীন্দ্রবলয়ের বাইরে নয় কোনো কিছুই। আর তাই ইচ্ছা-অনিচ্ছায় মননের মাধ্যাকর্ষণে বারবার প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছেন রবীন্দ্রনাথ। জনগোষ্ঠীর যাপনে এমন জড়িয়ে পড়া কবি কোথায় মিলবে?

জীবনযাপনে প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রনাথ নিজেই একটা জাতি-একটা বোধ আর জীবন। আর তাই রবীন্দ্রনাথকে না জানলে জানা হয় না কিছুই। অজ্ঞাত থেকে যায় জীবনের অনেক ভাবনা অনেক রঙ-রস। মজার ব্যাপার হলো, দুরদর্শী কবি বেঁচে থাকতেই এমন কথা বলে গেছেন। অমোঘ ভবিষ্যদ্বাণীর কবিগুরুর সেই বিখ্যাত লাইন_ 'আজি হতে শতবর্ষ পরে, কে তুমি পড়িছ বসি আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে'। ভাবা যায়, কাব্য জীবন আর ভাবনার সঙ্গে কবি কতটা সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছিলেন? কতটা সম্পৃক্ত থাকলে একজন কবি তার চলে যাওয়ার শত বছর পরের ঘটনাক্রম কিংবা চিন্তার এমন সুস্পষ্ট প্রকাশ ঘটাতে পারেন? কিন্তু রবীন্দ্রনাথ পেরেছেন। দেখিয়েছেন তার প্রিয় পাঠকের প্রতি কোমল 'স্পর্ধা' দেখানোর দুঃসাহস। আর এ কারণেই তিনি চিরঞ্জীব, বিশ্বকবি।

২৫ বৈশাখ কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। আর কবির জন্মদিনে বাঙালি ফুল, মালা, গান আর অনুষ্ঠানের হিড়িক পড়ে যায়। এ তো রবীন্দ্রভক্তদের দৌড়ঝাঁপ আর প্রেম-প্রণয়। কিন্তু এর বাইরেও আছেন রবীন্দ্রনাথ। ভিন্নভাবে তাকালেই দেখা যাবে অন্যদের মতো লাখ লাখ সাধারণ মানুষও প্রতি বছর দিনটিকে মনে রাখে। কেউ কেউ হয়তো নিজের বা তার স্ত্রীর জন্মদিন ভুলে গিয়ে থাকলেও কবির জন্মদিন ভুলেন না। ভুলেন না কবিকে অসীম শ্রদ্ধায় ভাসিয়ে দিতে। এ কিন্তু কোনো অনুষ্ঠান-রীতি বা হিড়িকের কথা নয়, এ শুধুই ভালোবাসার গল্প। হয়তো বহু বছরের অভ্যাসের সংস্কার। অথবা মনের ভেতরের মানুষটার কোনো একটা দায়বদ্ধতা? নাকি কোথাও ঠিক কোনো একটি জায়গায় তার বোধ ও বোধোদয়ের তলদেশে অন্তর্লীন হয়ে আছেন রবীন্দ্রনাথ?

আসলে রবীন্দ্র সংস্কৃতির একটি গোপন চোরা স্রোত দিনের কোনো এক সময় তাকে নিজের কাছে নিজেকে নিবেদন করার সংস্কৃতি শেখায়। সে শুধু সেই মানুষটিই জানে অত্যন্ত অমোঘভাবে, আসলে বাঙালি কোনো অবচেতনেই রবীন্দ্রনাথকে ভুলতে চান না। অথবা চাইলেও পারেন না। রবীন্দ্রনাথ তার যাবতীয় নিয়ে আজও দেড়শ বছর পর এমন অমোঘ, এমন অনিবার্য, এমন প্রাসঙ্গিক_ যা বলে শেষ করা যাবে না। তাই বারে বারে প্রতিদিনের যাপনের যাবতীয় গ্লানি, আলো, অন্ধকার, সুখ, অসুখ নিয়ে তাকে মনে হয় তিনিই সেই অনির্বাণ শিখা, যে আসলে মৃত্যুর থেকেও বড়। আর তিনি পুরনো হওয়ার নন। তিনি সব সময়ই নতুন আজ-কাল-পরশু কিংবা হাজার বছর পরও ওই নতুনই!

খঞ্জনদীঘির মসজিদ

প্রাচীন গৌড়ের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সোনামসজিদ এলাকা এক সময় মসজিদের নগরীতে পরিণত হয়েছিল বললে খুব একটা ভুল হবে না। কারণ এ এলাকায় আজও রয়েছে একাধিক প্রাচীন মসজিদ। তবে সেগুলোর মধ্যে কিছু কিছু অক্ষত থাকলেও কালের আবর্তে অনেক মসজিদ আবার ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছে। আর এর মধ্যে খঞ্জনদীঘির মসজিদ অন্যতম। দারুসবাড়ি মসজিদের দক্ষিণদিকে অবস্থিত বল্লাল সেন খননকৃত বালিয়াদীঘির দক্ষিণ পাড় ঘেঁষে পুবদিকে কিছুদূর এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে খঞ্জনদীঘির মসজিদের ধ্বংসাবশেষ। একটি প্রাচীন জলাশয়ের পাশে এর ধ্বংসাবশেষ আজও রয়েছে। তবে সংস্কার করা হলে এখানে আবারও নামাজ আদায়সহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালন করা সম্ভব বলে অনেকেই মনে করেন। এলাকার প্রবীণ লোকদের কাছ থেকে জানা যায়, খঞ্জনদীঘির মসজিদটি অনেকের কাছে খনিয়াদীঘির মসজিদ নামেও পরিচিত। আবার অনেকে একে রাজবিবি মসজিদও বলে থাকেন। এই মসজিদের আয়তন ছিল ৬২৪২ ফুট। মসজিদটির নিচের ইমারত বর্গের আকারে তৈরি। এই বর্গের প্রত্যেক বাহু ২৮ ফুট লম্বা। এটির মাঝে একটি গম্বুজ ছিল। ইটের তৈরি এই মসজিদের বাইরে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ করা ছিল। যার সামান্য নমুনা আজও চোখে পড়ে। বহুকাল ধরে মসজিদটি জঙ্গলের ভেতর পড়েছিল। কিন্তু কয়েক দশক আগে এ এলাকায় জঙ্গল কমে গেলে মসজিদটি মানুষের নজরে পড়ে। কিন্তু ইতোমধ্যে মসজিদটি প্রায় বিলীনের অবস্থায় চলে এসেছে। তবে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ এখন এটিকে টিকিয়ে রাখতে এগিয়ে এসেছে। বর্তমানে খঞ্জনদীঘির মসজিদটির একটি মাত্র গম্বুজ ও দেয়ালের কিছু অংশ টিকে আছে। কিন্তু এগুলোর অবস্থাও খুব জীর্ণ আকার ধারণ করেছে। এই মসজিদটি কখন নির্মিত হয়েছিল এবং কে নির্মাণ করেছিলেন সে সম্পর্কে কিছুই জানা যায়নি। তবে মসজিদ তৈরির নমুনা দেখে পণ্ডিত ব্যক্তিরা মনে করেন পনের শতকে নির্মিত হয়েছিল খঞ্জনদীঘির মসজিদ ।



*মো. রফিকুল আলম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ
সূত্র : বাংলাদেশ প্রতিদিন

রবীন্দ্র প্রতিভা ও সভ্যতার আকাঙ্ক্ষা | আল মাহমুদ

যারা সাহিত্য সম্পর্কে অনুসন্ধিত্সু, তারা রবীন্দ্র প্রতিভা নিয়ে আর আগের মতো কোলাহলমুখর নয়। তাছাড়া রবীন্দ্রনাথ উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত ইত্যাদির ব্যাপারে কথা বলতে চান। অথচ এই বিষয়গুলো বর্তমান বিশ্বে কারও মনোযোগ আকর্ষণ করে না। একটা পুরনো বিষয় হিসেবেই এর খানিকটা মূল্যায়ন করে মাত্র। এখন জগতে আধুনিকতম বিষয় হলো ‘ইসলাম’। কারণ, ইসলাম কারও মুখাপেক্ষী নয়। সে নিজের গৌরবে গরীয়ান এবং ধর্মের প্রশ্নে এক অসাধারণ দৃষ্টান্ত।
জগত ও জীবনের বাস্তবতা সম্পর্কে আমার মনে হয় রবীন্দ্র আকাঙ্ক্ষা খানিকটা মুখ ফিরিয়ে নেয়ার অবস্থায় ছিল। কিন্তু বিশ্ব, এমনকি ভারতীয় সভ্যতা অনুসন্ধিত্সু এবং আকাঙ্ক্ষায় উদ্দীপ্ত হয়ে আছে। কোনো উপনিষদীয় জ্ঞান এই আকাঙ্ক্ষাকে পরিতৃপ্ত করতে পারে না। আমি অবশ্য এখানে ধর্মের প্রসঙ্গ আনতে ইচ্ছুক নই; কিন্তু মর্মের প্রসঙ্গ অবশ্যই উত্থাপিত হতে পারে। মানুষের মন পুরনো, প্রাচীন এবং অতীতে তলিয়ে যাওয়া কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন বা মননশীল সাহিত্যের দিকে আগ্রহহীন নয়। জগত ঘুরছে। একটা কথা আছে না—‘গান্ধীজী যদি মরে যান/ জগত্ হবে না খান খান/ পৃথিবী ঘুরবে’। আমরা অনুভব করছি, পৃথিবী ঘুরেই চলেছে। আর পৃথিবীর গতি সঠিকভাবে নির্ণয় করতে গেলে সব রহস্যের উত্তর দিতে পারে এমন কোনো ধর্মীয় আদর্শের কাছেই মানব জাতিকে আশ্রয়ের আশায় ভিড় জমাতে হবে।
শোনা যায়, ‘বাবেল’ বলে একটি স্থান থেকে মানুষের বিচ্ছেদ ঘটেছিল। সেই বিচ্ছেদের কাহিনী হলো ‘বাইবেল’। ‘বাবেল’ থেকে ‘বাইবেল’। যাই হোক, বাবেল থেকেই মানুষের ভাষাও আলাদা হয়ে গেছে। এক গোত্রের ভাষা অন্য গোত্রের ভাষা থেকে একেবারে স্বতন্ত্র। কীভাবে সেটা ঘটেছিল, আজ আর সে কথা মানবজাতির মনে নেই। তবে মানুষের আকাঙ্ক্ষা হলো সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশে সিজদায় যাওয়া; এবং সমগ্র মানবজাতির মধ্যে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য এক গোপন ও নিগূঢ় আকাঙ্ক্ষা কাজ করে চলেছে।
এই আকাঙ্ক্ষার পরিণতি কোনো উপনিষদীয় জ্ঞানে আমরা খুঁজে পাই না। এটা খুঁজে পাওয়া যায় ইসলামের মধ্যে। কারণ, ইসলাম সর্বত্রগামী। ধর্মীয় এবং জাতিগত পার্থক্য বিদ্যমান থাকার পরও ইসলাম মানবজাতির ঐক্যের নির্দেশনা দিতে পারে। আর এই নির্দেশনার কথা আমরা শুনতে পাই কাজীর কবিতায়—“জাতিতে জাতিতে মানুষে মানুষে/ অন্ধকারের এ ভেদ-জ্ঞান/ অ-ভেদ ‘আহাদ’ মন্ত্রে টুটিবে/ সকলে হইবে এক সমান।” সব মানুষকে এক করার এই মন্ত্র রবীন্দ্রনাথ আয়ত্ত করতে পারেননি। তিনি ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির উত্তরসূরি হলেও ভারতীয় মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির দিগন্তে তাঁর বিচরণ খুবই সীমাবদ্ধ।
রবীন্দ্র প্রতিভার এটা এক রহস্যময় ব্যাপার যে, তিনি মূল ভাষায় গ্যাটের ‘ফাউস্ট’ পাঠ করার তাড়না থেকে আশি বছর বয়সে জর্মন ভাষা শেখার উদ্যোগ নিয়েছিলেন; কিন্তু তার জমিদারি এস্টেটের অধিকাংশ প্রজার ধর্মীয় গ্রন্থটি অনুধাবন করার চেষ্টা কখনও করেননি। সম্ভবত রবীন্দ্রনাথ এই গূঢ় রহস্যের কারণেই সর্বত্রগামী হতে পারেননি। যদিও তিনি লিখেছিলেন—‘দেখিতে গিয়াছি পর্বতমালা/ দেখিতে গিয়াছি সিন্ধু/ দেখা হয় নাই দু’চোখ মেলিয়া/ ঘর হতে শুধু দু’পা ফেলিয়া/ একটি ঘাসের শীষের ওপর/ একটি শিশির বিন্দু।’ রবীন্দ্রনাথের পরিবারে ফার্সি সাহিত্য এবং সেই সুবাদে হাদিস শাস্ত্র নিয়েও কিছুটা চর্চা ছিল বলে আমরা জানতে পেরেছি। অথচ এর উত্তরাধিকারিত্ব তিনি গ্রহণ করেননি। তার সৃজনে এর প্রভাব থাকলেও মননে ছিল না। যে ভাষায় তিনি আজীবন লিখে গেছেন, সে ভাষার অধিকাংশ মানুষের অন্তরের আকাঙ্ক্ষা কেন যে তাঁকে ছুঁতে পারেনি, সেটা এক রহস্যময় ব্যাপারই বটে। এ কারণেই একদা আমি আমার একটি কবিতায় লিখেছিলাম—
‘কে তুমি পড়িছ বসে আমার কবিতাখানি কৌতূহল ভরে?’
না, আমার কোনো কৌতূহল নেই।
আমার নাম, মাহমুদ। পিতা, আবদুর রব। জাতি মুসলমান। পেশা কৃষিকার্য।
ভবিষ্যতের জন্যে রেখে যাওয়া সর্বপ্রকাশ আনন্দ ও বিনোদে আমি উত্তরাধিকার খুঁজে নিরাশ।
কেউ আমার জন্যে রেখে যাননি কোনো অমৃত, কোনো আশা ও উদয়।
আমি দেখেছি কেবল অস্তগমনের জন্য প্রতীক্ষারত কিষাণ,
বলদ ও জোয়াল
কর্ষণের ঘাম শুষে নেয়ার জন্য একই সাথে গোধূলির দিকে
ফুরফুরে হাওয়ার প্রতীক্ষা।
আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ।
রুপোর পৈচিবাঁধা কর্মঠ নারীর নগ্ন বাহু।
শাড়ি ও শরীরে মাড়াইয়ের গন্ধ।
ধানভানা গতরে নৃত্যরত দু’টি বুকের আহ্বান।
ঐ দাড়িঅলা সন্তের ছবি আমার ঘরে টাঙিয়েছে আমারই ছেলেমেয়েরা!
আহা, তারা কি করে জানবে ঐ ছবি আমার কাছে
অনাদায়ী খাজনার সর্বশেষ নোটিশের কথাই বারবার মনে পড়িয়ে দ্যায়?

সূত্র : আমার দেশ

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ