প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Monday, August 27, 2012

নিল আর্মস্ট্রং



নিল আর্মস্ট্রং
(জন্ম আগস্ট ৫, ১৯৩০-মৃত্যু: আগস্ট ২৫, ২০১২)
একজন মার্কিন নভোচারী ও বৈমানিক। তিনি চাঁদে অবতরণকারী প্রথম মানুষ হিসাবে পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।  তাঁর প্রথম মহাকাশ অভিযান হয় ১৯৬৬ খ্রীস্টাব্দে, জেমিনি ৮ নভোযানের চালক হিসাবে। এই অভিযানে তিনি ও ডেভিড স্কট মিলে সর্ব প্রথম দুইটি ভিন্ন নভোযানকে মহাকাশে একত্রে যুক্ত করেন।
আর্মস্ট্রং-এর দ্বিতীয় মহাকাশ মিশন ছিল এপোলো-১১ এর মিশন কমান্ডার হিসাবে। ১৯৬৯ সালের জুলাই মাসে এডউইন অলড্রিনকে সঙ্গে নিয়ে নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেন এবং প্রায় আড়াই ঘন্টা সেখানে অবস্থান করেন। সে সময়ে মাইকেল কলিন্স মূল নভোযানে অবস্থান করেন। তাঁরা তিনজনই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সময়ে "প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম" পদকে ভূষিত হোন।

২০১২ সালের ২৫ আগস্ট নিল আর্মস্ট্রং ওহাইও-এর সিনসিনাটিতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। 

প্রাথমিক জীবনঃ
নিল আর্মস্ট্রং ১৯৩০ সালের ৫ আগষ্ট জন্মগ্রহন করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর স্টেফান কনিগ আর্মস্ট্র ও ভায়োলা লুইসা দম্পতির প্রথম সন্তান নিল আর্মস্ট্রং। তিনি বংশানুক্রিমক ভাবে স্কটিশ ও জার্মান। নিল আমস্ট্রংয়ের আরও দুজন সহোদর ছিল। ছেলেবেলা থেকে নিল আর্মস্ট্রংয়ের আমেরিকার ২০ টি ভিন্ন শহরে থাকার অভিজ্ঞতা ছিল। মাত্র দুবছর বয়সে তিনি তার পিতার সাথে ক্লীভল্যান্ড এয়ার রেস দেখতে গিয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালের ২০ জুলাই তিনি প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেন।[

পড়াশুনাঃ
আর্মস্টং পড়াশোনা করেন পার্ডু বিশ্ববিদ্যালয় এ, এবং পরে ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়াতে। নভোচারী হওয়ার আগে আর্মস্ট্রং মার্কিন নৌবাহিনীর বৈমানিক ছিলেন। তিনি কোরীয় যুদ্ধে অংশ নেন। এর পর তিনি ড্রাইডেন ফ্লাইট রিসার্চ সেন্টারের পরীক্ষামূলক বিমান চালক হিসাবে যোগ দেন। বিভিন্ন পরীক্ষামূলক বিমান নিয়ে তিনি ৯০০ এর ও অধিক বার উড্ডয়ন করেন।

চন্দ্র অভিযানঃ
আর্মস্ট্রং এর পরবর্তী ও শেষ অভিযান হয় এপোলো ১১ নভোযানের অভিযান নেতা হিসাবে। [৭] [৮]এই অভিযানে তিনি ১৯৬৯ খ্রীস্টাব্দের জুলাই ২৬ তারিখের গ্রীনউইচ মান সময় ১২:৩৬ পিএম এ চাঁদে অবতরণ করেন। প্রথম মানুষ হিসাবে চাঁদে পা রাখার সময় তিনি মন্তব্য করেন:
This is a small step for (a) man, but a giant leap for mankind
অর্থাৎ, এটি একজন মানুষের জন্য ক্ষুদ্র একটি পদক্ষেপ, কিন্তু মানবজাতির জন্য এক বিশাল অগ্রযাত্রা।

চাঁদে আর্মস্ট্রং ও এডুইন অল্ড্রিন জুনিয়র অবতরণ করেন, ও ২.৫ ঘণ্টা কাটান।

জীবনঃ
অ্যাপোলো ১১ এর পরে আর্মস্ট্রং আর মহাকাশ অভিযানে যান নাই। তিনি ১৯৭৯ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত ইউনিভার্সিটি অফ সিনসিনাটির ঊড্ডয়ন প্রকৌশলের অধ্যাপক হিসাবে কাজ করেন।

মৃত্যুঃ
৮২ বছরে বাইপাস সার্জারির কিছুদিন পর ২০১২ সালের ২৫ আগষ্ট তিনি মৃত্যুবরন করেন।

সম্মাননাঃ
নভেম্বর ২০১১ তে আরো তিন নভোচারীর সঙ্গে নিল আর্মস্ট্রং যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক কংগ্রেসনাল গোল্ড মেডেল অর্জন করেছেন।

একনজরে নিল আর্মস্ট
জাতীয়তা : মার্কিনি
জন্ম: আগস্ট ৫, ১৯৩০ ওয়াপাকোনেটা, ওহাইও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
মৃত্যু : আগস্ট ২৫, ২০১২ (৮২ বছর) কলম্বাস, ওহাইও, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র
পূর্বতন পেশা : বৈমানিক
মহাকাশে অবস্থানকাল: ৮ দিন, ১৪ ঘন্টা, ১২ মিনিট, ৩১ সেকেন্ড
মনোনয়ক : 1958 Man In Space Soonest
1960 Dyna-Soar
1962 NASA Group 2
সর্বমোট অভিযান : ১
সর্বমোট অভিযানের সময়কাল : ২ ঘন্টা ৩১ মিনিট
অভিযান : জেমিনি ৮, Apollo 11 

সূত্র : উইকিপিডিয়া

Saturday, August 18, 2012

হাসতে নাকি জানেনা কেহ | ৫ |

ডাক্তার : আপনাকে কতবার বলেছি, চর্বিজাতীয় খাবার খাবেন না।
রোগী : খেতে তো চাই না। কিন্ত জিহ্বা যে মানে না।
ডাক্তার : এত বড় একটা শরীর নিয়ে এতটুকুন একটা জিহ্বার সাথে পারেন না, এ কেমন কথা!
রোগী : জিহ্বা তো একা নয়, পেটও যে তাকে সাপোর্ট করে!

লিটন : তোর গরম লাগলে তুই কী করিস?
বাবলু : কী আবার করব? এসির পাশে গিয়ে বসি।
লিটন : তাতেও যদি তোর গরম না কমে?
বাবলু : তখন এসি অন করি
সংগ্রহে : নিশাত নাবিলা বুশরা
গলাচিপা, পটুয়াখালী
ক্রেতা : সবাই এই ঈদে কিছু না কিছু ছাড় দিচ্ছে, আপনারা দিচ্ছেন না কেন?
বিক্রেতা : আমরা এবার এই ‘ছাড়’ শব্দটাকেই ছাড় দিয়েছি!
সংগ্রহে : হোমায়রা হিমু
বাংড়া, শেরপুর, বগুড়া
ক্রেতা : এই ঈদে আপনাদের বিশেষ কোনো অফার আছে?
বিক্রেতা : অবশ্যই। এই ঈদে আমাদের মার্কেট থেকে আপনি যে পরিমাণ শপিং করবেন, পরের ঈদে তার দ্বিগুণ করলেই, তার পরের ঈদে পাবেন আকর্ষণীয় পুরস্কার।
সংগ্রহে : রেজাউল করীম মাসরুর
গাছবাড়ী জে. ইউ কামিল মাদ্রাসা
অফিসের বড় সাহেব বলছেন কর্মচারীকে, করিম সাহেব, আপনি নাকি অফিসে এসে সারাদিন ইন্টারনেটে শেয়ার বাজারের ওয়েব সাইটে বসে থাকেন?
করিম সাহেব : দুঃখিত স্যার, আমাকে ক্ষমা করুন।
বড় সাহেব : না না, আমি আপনার উপর খুবই সন্তুষ্ট।
করিম সাহেব (অবাক হয়ে) : কেন স্যার?
বড় সাহেব : আপনার অন্তত অফিসে এসে ঘুমিয়ে পড়ার কোনো সম্ভাবনা নেই!
সংগ্রহে : কামারুল ইসলাম
বিজয়নগর, বি-বাড়িয়া
বাগানে কাজ করছে দুই মালি। একজন গর্ত খুঁড়ছে, অন্যজন তা ভরাট করছে। তা দেখে রাহাত সাহেব বললেন, কী ব্যাপার, তোমরা গর্ত খুঁড়ছো আর ভরাট করছো কেন?
শুনে যে মালি গর্ত খুঁড়ছিল সে ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, আমরা আসলে বাগানে কাজ করি তিনজন। আমি গর্ত খুঁড়ি, আরেকজন তাতে গাছ লাগায়, আর ও গর্ত ভরাট করে। কিন্তু আজকে যে মালি গাছ লাগায় ও আসেনি। তাই বলে তো আর আমরা কাজ না করে বসে থাকতে পারি না! তাই আমরা আমাদের কাজ করে যাচ্ছি।
সংগ্রহে : আব্দুল্যাহ আল মাহমুদ
সিপাহীবাগ, খিলগাঁও, ঢাকা
এক বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে।
প্রতিবেশীর বাড়িতে অনুসন্ধানের কাজে গেছেন গোয়েন্দা।
গোয়েন্দা : গত রাতে পাশের বাসা থেকে আপনারা কোনো শব্দ শুনতে পেয়েছেন?
প্রতিবেশী : নাহ্! গোলাগুলি, চিৎকার আর ওদের কুকুরটার চেঁচামেচির যন্ত্রণায় কিছু শোনাই যাচ্ছিল না।
সংগ্রহে : নিশাদুল ইসলাম নিশাত
চকরিয়া কোরক বিদ্যাপীঠ, কক্সবাজার
ছোট্ট রানু গেছে গোয়েন্দাদের অফিসে। দেয়ালে ‘ওয়ান্টেড’-এর তালিকায় টাঙানো অপরাধীদের ছবি দেখে সে গোয়েন্দা অফিসারকে প্রশ্ন করল, তোমরা কি সত্যিই ওদের গ্রেফতার করতে চাও?
গোয়েন্দা : অবশ্যই।
রানু : তাহলে ছবি তোলার সময়ই আটকে রাখলে না কেন?
সংগ্রহে : মোস্তফা ওয়াদুদ
আড়ংবাজার, মতলব, চাঁদপুর
ভিখারি : সাহেব, একটা টাকা দিন।
ভদ্রলোক : কাল এসো।
ভিখারি : এই কালকের চক্করে আমার প্রায় লাখখানেক টাকা আটকে আছে এই পাড়ায়।
সংগ্রহে : রাকিবুল ইসলাম
নলডাংগা, কালিগঞ্জ, ঝিনাইদহ
ঈদের দিন একেবারে ভোরবেলা শপিং কমপ্লেক্সের দারোয়ানের কাছে ফোন এলোÑ ভাই, আপনাদের শপিং কমপ্লেক্স কখন খুলবেন?
দারোয়ান : স্যার আজ তো ঈদের দিন। আজ আর খোলা হবে না। একেবারে ঈদের তিন দিন পর খুলব।
প্লিজ ভাই, আজকে কি একটু খোলা যায় না, মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য? ফোনের ওপাশ থেকে করুণ মিনতি ভেসে এলো।
দারোয়ান বলে, কেন ভাই, আপনার কী এমন জরুরি দরকার? এই ঈদের দিনে আবার কী কিনবেন?
ফোনের ওপাশ থেকে উত্তর আসে, না ভাই, কিছু কিনব না। শপিং কমপ্লেক্স থেকে বের হবো। কাল রাতে বউ-বাচ্চা নিয়ে শপিং করতে এসে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
সংগ্রহে : ওবায়দুল্লাহ
গফরগাঁও, ময়মনসিংহ
ঈদে ট্রেনে করে বাসায় ফিরেছে রাজীব মামা। ভাগনেদের সঙ্গে গল্প করছে রাস্তায় কত কষ্ট হয়েছে তা নিয়েÑ আর বলিস না, সারা রাত ঘুমাতে পারিনি।
ভাগনেরা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চায়, কেন কেন? ঘুমাতে পারোনি কেন, মামা?
আর বলিস না। আমাকে সিট দিয়েছে ওপরের বার্থে। আর তোরা তো জানিসই আমি আরামপ্রিয় মানুষ, ওপরের বার্থে আমার কিছুতেই ঘুম আসে না।
ভাগনে সোহেল বলে, নিচের বার্থের যাত্রীর সঙ্গে বার্থ চেঞ্জ করে নিলেই পারতে, মামা।
রাজীব মামার নি®প্রভ উত্তর, আরে আমার কি আর সে বুদ্ধি-শুদ্ধি নেই! আমিও তো বার্থ চেঞ্জ করে নেয়ার কথাই ঠিক করে রেখেছিলাম। কিন্তু ট্রেনে উঠে দেখি, নিচের বার্থের যাত্রী ট্রেন মিস করেছে। এখন বল, আমি কার সঙ্গে বার্থ চেঞ্জ করব?
সংগ্রহে : ইমরান হোসেন
দক্ষিণ হালিশহর কেজি স্কুল, চট্টগ্রাম
প্রথমবারের মত সমুদ্র দর্শনে বের হয়েছেন পদার্থবিদ, জীববিদ এবং রসায়নবিদ।
পদার্থবিদ সমুদ্রের বড় বড় ঢেউ দেখে মোহিত হয়ে ঢেউয়ের ফ্লুইড ডাইনামিক্সের উপর গবেষণা করার কথা চিন্তা করে সাগরে চলে গেলেন। যথারীতি তিনি ডুবে গিয়ে আর ফিরলেন না।
জীববিজ্ঞানী সমুদ্রের ফ্লোরা-ফনার উপর গবেষণা করার জন্য সমুদ্রে গেলেন, কিন্তু তিনিও ঐ পদার্থবিদের মত সাগরে গিয়ে আর ফিরলেন না।
বহুক্ষণ ধরে বাকি দুইজনের জন্য অপেক্ষা করে রসায়নবিদ শেষে পর্যবেক্ষণ লিখলেন, ‘পদার্থবিজ্ঞানী এবং জীববিজ্ঞানী উভয়ই সমুদ্রের পানিতে দ্রবনীয়।’
সংগ্রহে : আরিফুল ইসলাম রাতুল
ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চবিদ্যালয়

মাসিক কিশোরকন্ঠ আগস্ট, ২০১২ ঈদ সংখ্যায় প্রকাশিত

Sunday, August 12, 2012

নিয়ামতের অবারিত বারিধারা লায়লাতুল ক্বদর | এম. মুহাম্মদ আব্দুল গাফফার

মু’মিনদের জন্য লায়লাতুল কদর একটি অতি মর্যাদাময় রজনী। শেষ নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর উম্মতদের জন্য আল্লাহ তায়ালা তাঁর অফুরন্ত নিয়াআমতের ভাণ্ডার থেকে খাতিমুন্নবী (সা.)-এর মিল্লাতকে অত্যাধিক সওয়াব অর্জনের সুযোগ দেয়ার লক্ষ্যেই মহান স্রষ্টা এ ব্যবস্থা করেছেন বলে মনে করা যেতে পারে। এর কারণ হিসেবে যেসব ঘটনা বর্ণনা করা হয়েছে সেগুলো অকাট্য দলিল হিসেবে গ্রহণে অনেকের আপত্তি থাকলেও এর যৌক্তিকতাকে একেবারে অস্বীকার করা যায় না। যেমন বলা হয়েছে পূর্বকালের আম্বিয়ায়ে কেরামের উম্মতগণ দীর্ঘ হায়াত লাভ করতেন। তারা তাদের দীর্ঘ জীবনব্যাপী সালাত, সাওম, জিহাদসহ অন্য ইবাদতে আল্লাহর নৈকট্য লাভের প্রচেষ্টা চালাতেন। মহানবী (সা.)-এর সাহাবীগণ এসব বর্ণনা শুনে নিজেদের স্বল্পকালীন আয়ুষ্কালে পূর্ববর্তীদের ন্যায় বেশি ইবাদত ও পুণ্য লাভে অপরাগতার  বিষয় চিন্তা করে আফসোস করতেছিলেন তখনই মহান রাব্বুল আলামীন লাইলাতুল ক্বদরের মত মহা মর্যাদাময় রাতের সুসংবাদ আল্লাহর রাসূল (সা.) এর মাধ্যমে মুসলিম উম্মাহকে জানিয়ে দেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনুল কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ইরশাদ করেন, ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিল ক্বাদরি, অমা আদরাকা মা লাইলাতুল ক্বাদরি। লাইলাতুল ক্বাদরি খায়রুম মিন আলফি শাহরি। অর্থাৎ আমি ইহা (কুরআন) ক্বাদরের রাতে নাযিল করেছি। (হে রাসূল) তুমি কি জান ক্বদরের রজনী কি? ক্বদরের রজনী হাজার মাস থেকেও অধিক উত্তম। (সূরা আল ক্বাদর, আয়াত ১, ২, ৩)। এর রাতের মর্যাদা শুধু এ পর্যন্ত বর্ণনা করেই আল্লাহ তায়ালা শেষ করেননি। এ রজনীর কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আরো ঘেষণা করেনÑ তানাযযালুল মালায়িকাতু ওয়াররূহ ফিহা বিজনি রাব্বিহিম মিন কুল্লি আমরি। সালামুন হিয়া হাত্তা মাতুলায়্যিল ফাজর। অর্থাৎ ফিরিশতা ও রূহ এ (রজনীতে) তাদের রবের অণুমতিক্রমে সব আদেশ নিয়ে অবতীর্ণ হয়। সে রাত পুরোপুরি শান্তি ও নিরাপত্তার ফরজ উদয় হওয়া পর্যন্ত (সূরা আল ক্বাদর আয়াত ৪,৫)।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে লাইলাতুল ক্বাদরের এ বর্ণনা খুবই তাৎপর্যমণ্ডিত। মহানবী (সা.)কে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন রিসালাতের শেষ নবী হিসেবে ঘোষণা দিয়ে পৃথিবীতে আম্বিয়ায়েগণের আগমনের ধারাবাহিকতার সমাপ্তি টেনেছেন। এ মর্মে মহানবী (সা.)-এর হাদিস এভাবে বর্ণিত হয়েছে, ক্বয়ালা রাসূলুল্লাহ (সা.) লানাবিয়্যা বাআদী ওয়ালা উম্মাতা বাআদা উম্মাতি অর্থাৎ আল্লাহর রাসূল (সা.) বলেছেন আমার পর আর কোনো নবী নেই আর আমার উম্মতের পর আর কোনো উম্মত নেই। (বায়হাকি)। স্বভাবতই সর্বশেষ নেতা ও তাঁর অনুসারীদের জন্য পৃথক মর্যাদা তথা পুরস্কার ও অতুলনীয় হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ্বনবী (সা.) সম্পর্কে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন, অমা আরসালনাকা ইল্লা কাফফাতাললিন্নাছি বাশীরাও ওয়া নাযীরাও অলাকিন্না আকছারান্নাছিলা ইয়ালামুন অর্থাৎ হে নবী, আমি সমগ্র মানব জাতির জন্য তোমাকে সুসংবাদ দানকারী ও ভীতি প্রদর্শনকারী হিসেবে পাঠিয়েছি, কিন্তু অনেক লোক জানে না (সূরা সাবা ২৮)। একমাত্র মহানবী (সা.)কে শেষ নবী হিসেবে গোটা মানব জাতির রাসূল রূপে প্রেরণ করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে এভাবে বর্ণনা এসেছে কানান্নাবী (আ.) বাআছাইলা কাউমিহি খাসসাতাওয়া বুয়িসতু ইলান্নাছি আম্মাতা অর্থাৎ প্রথমে প্রত্যেক নবীকে বিশেষ জাতির কাছে তাদের জন্য পাঠানো হয়েছে আর আমি প্রেরিত হয়েছি সমগ্র মানবজাতির কাছে (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)। বিশ্ব নবী (সা.) রিসালাতের সিলমহর হিসেবে ক্বিয়ামত পর্যন্ত তাঁর প্রচলিত শরিআহ তথা নিয়ম পদ্ধতিই বলবত থাকবে এবং সমগ্র মানব জাতির জন্য মহানবী (সা.)র শরিআতের আইনই মেনে চলা অবধারিত। আল্লাহ রাসূর (সা.) এর শরিয়াতের বিধিবিধানের মূল উৎস পবিত্র কুরআনুল কারিম। যেটা মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবন বিধান। এ কুরআনুল কারিম অপরিবর্তিনীয়। কুরআনুল কারিম সর্বশেষ আসমানি কিতাব হিসেবে এর মর্যাদা সর্বোচ্চে। দ্বীন ইসলামকে কুরআন নাযিলের মাধ্যমেই পূর্ণতা দান করা হয়েছে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা মহানবী (সা.)-এর উদ্দেশ্যে ঘোষণা করেন, আল ইয়াওমা আকমালতুলাকুম দ্বীনাকুম ওয়া আতমামতু আলাকুম নিমাতি ওয়া রাদিতুলাকুমুল ইসলামা দ্বীনান। অর্থাৎ আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং আমার নিয়ামত তোমাদের প্রতি পূর্ণ করে দিলাম আর  তোমাদের জন্য ইসলামকে তোমাদের দ্বীন হিসেবে কবুল করে নিলাম (সূরা মায়েদা, আয়াত ৩)।
মূল কথা হলো, দ্বীন ইসলাম ও মানব জাতির গাইড বুক তথা পথ প্রদর্শক। পবিত্র কুরআনুল কারিমের নাযিলের সূচনা হয় এই বরকতময় লাইলাতুল ক্বদরে। মহাগ্রন্থ আল কুরআনের অপরিসীম মর্যাদার কারণেই ক্বদরের রজনীর এ অফুরন্ত ফজিলত। এ মর্মে মহান রাব্বুল আলামীন ঘোষণা করেনÑ ইন্না আনযালনাহু ফি লাইলাতিম মুবারাকাতিন ইন্না কুন্না মুনজিবীন। অর্থাৎ আমি উহাকে এক বড় কল্যাণময় ও বরকতপূর্ণ রাতে অবতীর্ণ করেছি। কেননা আমি মানুষদেরকে সাবধান করবার ইচ্ছা করেছিলাম (সূরা দুখান, আয়াত ৩)। মূলত পবিত্র কুরআনুল কারিম নাযিলের এ রজনী বিশ্বাসীদের জন্য বিশাল প্রাপ্তির একটা মাধ্যম তৈরি করে দিয়েছেন মহান রাব্বুল আ’লামীন। লাইলাতুল ক্বদরের  নে’আমতে পূর্ণ রজনী যে রমজান মাসেই রয়েছে তা জোর দিয়েই বলা যেতে পারে, কারণ পবিত্র কুরআনুল কারিম এ মাসেই নাজিল হয়। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন শাহরু রামাদানাল্লাজী উনযিলা ফীহিল কুরআনু, হুদাল লিন্নাছি, অবাইয়েনাতি মিনাল হুদা ওয়াল ফুরক্বান। অর্থাৎ রমজান মাস, এ মাসেই কুরআন মাজিদ নাজিল হয়েছে, তা গোটা মানব জাতির জন্য জীবন যাপনের বিধান এবং তা এমন সুস্পষ্ট উপদেশ সমূহে পরিপূর্ণ যা সঠিক ও সত্যপথ প্রদর্শন করে এবং হক ও বাতিলের পার্থক্য পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে (সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৮৫)। পবিত্র কুরআনুল কারিমের এ ভাষণে সুস্পষ্টভাবে বুঝা যাচ্ছে যে, কুরআন নাজিলের এ মাসেই লাইলাতুল ক্বদর রয়েছে। লাইলাতুল ক্বদর হাজার মাস থেকেও যে উত্তম তা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনই ঘোষণা করেছেন। মহানবী (সা.)-এর উম্মতের জন্য এতবড় নেআমত কেন দান করা হয়েছে তা পূর্বে কিছুটা আলোচনা করা হয়েছে। হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর উম্মতদেরকে মধ্যমপন্থী জাতি বানিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছেন এবং তারা সত্যের সাক্ষ্যদাতা হবেন আর আল্লাহর রাসূল (সা.) ও সত্যের পতাকাবাহী উম্মতদের জন্য সাক্ষ্যদানকারী। হবেন। এ মর্মে পবিত্র কুরআনুল কারিমে আল্লাহতায়ালা ঘোষণা করেন, কাজালিকা জাআলনাকুম উম্মাতাউ ওসাতালিতাকুনু শূহাদাআ আলান্নাছি অইকুনার রাসূলু আলাইকুম শাহিদা অমা জাআলনাল ক্বিবলাতাল্লাতী কুনতা আলাইহা ইল্লালিনা’লামা মাই ইত্তাবিউর রাছূলা ... অর্থাৎ আর এভাবেই আমি তোমাদেরকে একটি মধ্যম পন্থা অনুসারী উম্মাৎ বানিয়েছি। যেন তোমরা দুনিয়ার লোকদের জন্য সাক্ষী হও আর রাসূল যেন সাক্ষ্য হয় তোমাদের ওপর (সূরা আল বাকারা, আয়াত ১৪৩)। পৃথিবীর সকল মানুষের ওপর মহানবী (সা.)-এর উম্মতদেরকে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা কর্তৃক সাক্ষ্য হিসেবে ঘোষণা দেয়া একটা শ্রেষ্ঠতম পুরস্কার ভিন্ন আর কি হতে পারে? এ মর্যাদার দাবিদার জাতিকে অবশ্যই গোটা মানবগোষ্ঠীকে সঠিক পথে আহ্বানের দায়িত্ব বহন করতে হবে। এ মর্মে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা ঘোষণা করেন কুনতুম খায়রা উম্মাতিন উখরিজাত লিন্নাছি তামুরুনা বিলমারুফি অতান হাওনা আনিল মুনকার অতুমিনুনা বিল্লাহি ... অর্থাৎ এখন পৃথিবীর সর্বোত্তম দল তোমরা, যাদেরকে মানুষের হেদায়াত ও সংস্কার বিধানের জন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত করা হয়েছে তোমরা ভালো কাজের আদেশ কর, অন্যায় ও পাপ কাজ থেকে লোকদের বিরত রাখ এবং আল্লাহর প্রতি ঈমান রক্ষা করে চলো ... (সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১১০)। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার এ ঘোষণার দ্বারা এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়ে গেছে যে, বিশ্বনবী (সা.) এর উম্মতদের শ্রেষ্ঠত্বের মূল বিষয় হলো তাদেরকে সারা দুনিয়ার মানুষের জন্য দৃষ্টান্তমূলক আদর্শের নমুনা হতে হবে। সমগ্র মানব জাতির পথ প্রদর্শন ও নেতৃত্বদানের যোগ্যতা মুসলমানদেরকেই অর্জন করতে হবে। এ জন্য তাদেরকে কঠোর পরিশ্রমী ও নিরলসভাবে কাজ করার প্রশিক্ষণ গ্রহণ জরুরি। পবিত্র মাহে রমজানের সিয়াম সাধনা মুসলমানদেরকে তাকওয়া অর্জনের সাথে সাথে ভোগবিলাস তথা অলসতা বর্জনের শিক্ষাও দান করে থাকে। পবিত্র লাইলাতুল ক্বদরের শিক্ষা ও এরই পরিপূরক। বরকতপূর্ণ ক্বদরের রজনীর সওয়াব লাভ করতে হলেও নিরলস প্রচেষ্টা একাগ্র সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার কাছে নিজকে সমর্পণ করে দিয়ে তাঁর দয়া ও রহমতের ভিখারি হতে হবে। লাইলাতুল ক্বদরের ফজিলত সম্পর্কে মহানবী (সা.)-এর একটি হাদিস এভাবে বর্ণিত আছে, আন আবিহুরাইরাতা অনিন্নাবী (সা.) ক্য়ালা মানক্বানা লাইলাতাল ক্বাদরে ঈমানা উ অইহতে সাবান গুফিরা লাহু মাতাক্বাদ্দামা মিন জান্বিহী অমান সামা রামাদানা ঈমানাউ অইহতে সাবান গুফিরালাহু মাতাক্বাদ্দামা মিন জান্বিহী অর্থাৎ আবু হুরাইরা (রা.) নবী (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন। নবী (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি শবে ক্বদরে ঈমানসহ সওয়াবের আশায় সালাত আদায় করল তার অতীতের গোনাহসমূহ ক্ষমা করে দেয়া হয়, আর যে ব্যক্তি সওয়াবের আশায় ঈমান সহ রমজানের সিয়াম পালন করে তারও অতীতের গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (সহিহ আল বুখারি, হাদিস ১৭৬৭)। লাইলাতুল ক্বদরে যে রকম অতি বরকতময় তেমনি এটাকে লাভ করাও শ্রমসাধ্য ব্যাপার। যে বিষয় অতি মূল্যবান বা মর্যাদাময় তা লাভ করাও কষ্টসাধ্য ব্যাপারও বটে। ক্বদরের এ পুণ্যময় রাতের তারিখ স্পষ্ট করে বলা হয়নি। এর উদ্দেশ্য একটাই যে, বান্দাহ মহান রাব্বুল আ’লামীনের সন্তুষ্টি লাভের আশায় তাঁর এ অবারিত নেআমতকে অর্জনের জন্য নিরলসভাবে ইবাদত করে যাবে। এর দ্বারা মুমিনগণ কষ্টসহিষ্ণু ও আল্লাহর দ্বীনের জন্য কাজের উদ্দেশ্যে কঠোর পরিশ্রমী হয়ে গড়ে উঠবে এটাই হলো এসব আনুষ্ঠানিক ইবাদতের লক্ষ্য। লাইলাতুল ক্বদরকে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন তাঁর রাসূল (সা.)কে জানিয়েও তার তারিখ ভুলিয়ে দিয়েছেন। এর দ্বারা আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা তাঁর একনিষ্ঠ তথা রিলস ইবাদতকারী বান্দাদেরকে পরীক্ষা করতে চান।
মাহে রমজানের শেষ দশকের ইতেকাফের উদ্দেশ্য লাইলাতুল ক্বদরের অফুরন্ত সওয়াব অর্জন করা। মহানবী (সা.) প্রাথমিক অবস্থায় সাহাবীয়ে কেরামসহ মধ্য রমজানের দশদিন দশরাত ইতেকাফ করতেন। মহানবী রাব্বুল আলামীন যখন তাকে অবহিত করলেন যে, লাইলাতুল ক্বদর রমজানুল মুবারকের শেষ দশকেই রয়েছে, তখন থেকে তিনি রমজানুল মুবারকের শেষ দশকে মসজিদে ইতেকাফ শুরু করেন। এ মর্মে একটি হাদিস এভাবে বর্ণিত আছেÑ আন সালামা বিন আব্দুর রহমান ক্বয়ালা সালতু আবা সাঈদিনিল খুদরী ক্বূলতুহাল সামীতা রাসূলুল্লাহ (সা.) ইয়াজকুরা লাইলাতাল ক্বাদরি ক্বয়ালা নাআম, ইতাকাফনা মাআ রাসূলুল্লাহ (সা.) আল আশরালআওসাতিমিন রামাদানা, ক্য়ালা ফাখাবাজনা সাবহাতা ইশরিনা ক্বয়ালা ফাখাতাবনা রাসূলুল্লাহ (সা.) সাবহাতা ইশরিনা ফাক্বয়ালা উরিতু লাইলাতাল ক্বাদরে অইন্নী নুসিতুহা ফালতা মিসুহাফিল আশরিল আওয়াখিরি ফিল বিতরি ... অর্থাৎ আবু সালামা ইবনে আব্দুর রহমান (রা.) বর্ণনা করেছেন, আমি আবু সাঈদ খুদরী (রা.)কে জিজ্ঞেস করলঅম, আপনি কি রাসূলুল্লাহ (সা.)কে লাইলাতুল ক্বদর সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করতে শুনেছেন? তিনি জবাব দিলেন হ্যাঁ, আমরা রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে রমজানের মধ্যের দশদিনে ইতেকাফে বসেছিলাম। আমরা বিশ তারিখের ভোরে বেরিয়ে আসলাম। রাসূলুল্লাহ (সা.) বিশ তারিখের ভোরেই আমাদের সামনে ভাষণ দান করলেন। তিনি ঘোষণা করলেন, আমাকে ক্বদরের রজনী দেখানো হয়েছে এবং আমাকে তা ভুলিয়েও দেয়া হয়েছে।  তাই তোমরা তা শেষ দশদিনের বেজোড় রাত্রে তালাশ কর (সহিহ আল বুখারি, হাদিস ১৮৯৩)। বর্ণিত হাদিস থেকে লাইলাতুল ক্বদরের বিষয়টি পরিষ্কারভাবে জানা গেল যে, মাহে রমজানের শেষ দশ রজনীর যে কোনো বেজোড় রাত্রে লাইলাতুল ক্বদর আল্লাহর নৈকট্য অর্জন প্রত্যাশী মুমিনগণের সামনে এসে হাজির হয়। এ রজনীতে আল্লাহপ্রেমিক বান্দাগণ নিজেদের অপরাধসমূহের জন্য অনুতাপ ও আত্মবিশ্লেষণের মাধ্যমে আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনের প্রচেষ্টা করে থাকেন।
মহান রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে এই অতুলনীয় মর্যাদাময় রজনীর ফায়দা লাভের তাওফিক দান করুন। আমীন।
লেখক : প্রভাষক, দারুল ইসলাম একাডেমি, সিরাজগঞ্জ।

কখন সকাল হবে? | সকাল রায়

০১.
সন্ধ্যেটা সবে আসতে শুরু করেছে;
আবছা হচ্ছে আলোটা। সূর্য এখন অনেকটা সময় নিয়ে আকাশটাকে মাতিয়ে রাখে; তাই সন্ধ্যেটা আসতে দেরি হয়। আর সন্ধ্যেটা পা ফেলতেই ঝুপঝাপ আধাঁর নামতে শুরু করে। আধাঁর নামতে যখন শুরু হয় তখন আবার পাশের নালাটায় ডাক শোনা যায় ঝি ঝি পোকার। একটানা ঝি পোকার শব্দে কান মাতায়।
সেই সাথে ডোবার ধারে করাত করাত করে ডেকে উঠে ব্যাঙ। আজ জোনাক গুলোও বড্ড ছন্নছাড়া হয়ে আছে; পাচঁ-দশটি এক জায়গাতে থাকেই না; বড়োজোর দু’চারটেকে দেখা যায় এদিক-ওদিক উড়ছে। কেন ওরা এমন তা ভাবতে বসে আছে জয়িতা।
সন্ধ্যের প্রদীপটা এখনো জ্বালেনি সে;
আলসেমিটা পেয়ে বসেছে আজ আবার; মা’র বকুনি নির্ঘাত। মেয়েটা যে বড় হয়েছে মায়ের সে খেয়াল থাকেই না; সেই ছোট্টটি কি আর আছে কাল বাদে পরশু যে তার বিয়ে; তাকে কি বকুনি দেয়া যায়? সন্ধ্যে ছেড়ে কিছুতেই মনটা তার উঠতে চায়না আরেকটু বসে থাকতে ইচ্ছে করে কিন্তু সে জো নেই এখুনি সন্ধ্যা ফুরোলো বলে।
ভাবনার তেপান্তর থেকে মনটাকে টেনে নিয়ে সোজা হয়ে দাড়ায় জয়িতা।
সন্ধ্যে প্রদীপ জ্বালতে হবে; বাবা চলে এলো বলে; সন্ধ্যে মরে যচ্ছে কিন্তু প্রদীপ জ্বলেনি দেখলে বাবা রাগ করবে।

০২.
ধ্রুব গেছে শাড়ী, গয়না, আর টোপর কিনতে।
কালকের পরদিন সাতাশ তারিখ জয়িতার বিয়ে। একটা মাত্র বোন। তাকে রাজরানীর মতো সাজিয়ে বিয়ে দেবে।
সুখ কষ্ট যাই হোক বাবার ঘরে; কিন্তু স্বামীর ঘরটা যেন দুঃখের না হয় যেন কষ্টটা ওকে আঁকড়ে ধরতে না পারে কখনো। একটা ভালো পাত্রের সন্ধানে কেটে গেছে তিনশত পয়ষট্টি দিন। চাট্টি খানি কথা। ভালো না হলে চলে।
সে রাতে ঘরে ফিরে ধ্রুব বলে বাইরের পরিবেশটা বেশ থমথেমে; দেখেছিস জয়িতা ?
জয়িতা বলে শুধু কি তাই আজ এই রাতেও কাক ডাকছে বিষাদ স্বরে খুব খারাপ লাগছে রে বুঝতে পারছিনা!! না জানি কোন বিপদ আসছে ধেয়ে কে জানে। বিষন্নতায় মনটা ভরে গেলেও মুখে সেটা ফোটাতে পারেনা; ভয় হয় ধ্র“ব’র যদি পাছে জয়িতার মনে জাগে সংশয়। না তেমন কিছু না এটা; চাপা হাসিতে বলে ধ্রুব।
জয়িতা বলে দাদা বিয়েটা শেষ হলেই চল আমরা এ দেশ ছেড়ে চলে যাবো ? এখানে শান্তি নেই। পাশ বালিশটা টেনে সোফায় বসতে বসতে ধ্র“ব বলে নাহ্ এটা আমার জন্মভূমি আমি ছাড়তে পারবোনা সোদা মাটির গন্ধ এই প্রকৃতি আমাকে ছাড়বেনা; তাছাড়া আমি ভালবাসি দেশকে একদিন দেশের এই হাল থাকবে না আমরা সেদিন সাজাবো নতুন করে; ভরে দেব আলোয় আলোয়।
জানিস এই প্রকৃতি এই হাওয়া আমাকে শক্তি দেয়। পথ চলার প্রেরণা পাই মানুষের ভালোবাসা থেকে। আমি ছাড়তে পারবো না।
জয়িতা বলে তাই বলে এভাবে কি থাকা যায়!!
না জানি কবে মারা পড়বো। সোফা থেকে উঠে দাড়িয়ে ধ্রুব বলে যাই হোক আমি আছি থাকবো।
বিয়ের পর তোর বরের সাথে ঘুড়বো। জয়িতা হেসে বলে তাই নাকি;
দাদা আমার একটা পুচকো থাকবে যেটা তোকে জ্বালাবে ভীষণ।
জয়িতার মা মেয়েকে বলে তারাতারি তোর বিয়েটা হয়ে গেলেই বাঁচি; দেশে যা শুরু হয়েছে কি যে হয় কে, জানে। আজকাল দিনগুলো ভালো যাচ্ছেনা সারাদেশ জুড়ে কিসের যেন পায়তারা চলছে।

০৩.
শব্দটা দেয়ালটাকে কাঁপাচ্ছে।
আধবোজা চোখ মেলে তাকাতেই জয়িতা শব্দের তরঙ্গে কেপে উঠে।
চরদিকে শুধু শব্দ আর শব্দ। মনে হচ্ছে সারা শহরে একনাগারে কেউ আতশ ফোটাচ্ছে।
সেই সাথে মিশেছে আর্ত হাহাকার। জয়িতা উঠে বসে জানালার ধারে তাকায় সামনের দিকে শুধু দেখা যায় আগুনের মেলা বসেছে পুরো মহল্লায়।
সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে আগুনের কোন গোলা এসে পড়েছে শহরে। ধোয়া উঠছে থেকে থেকে। কি হচ্ছে এসব কে যেন সারা শহরকে নরকপুরি করে তোলেছে এরই মাঝে।
দরজা খুলে বাইরে আসে। পুরো শহর যেন জ্বলছে। যেন আগুন তার রাজত্ব পেয়েছে আজ সব পুরিয়ে করবে ছাড়খার। গেটে এসে দাড়ালো জয়িতা। ধ্রুব দাড়িয়ে আছে মা’কে নিয়ে।
ধ্রুব বললো তুই আবার এসেছিস কেন যা ঘরে কিন্তু জয়িতা সেখানেই দাড়িয়ে আছে স্নায়ুবত হয়ে । পাশের মহল্লায় আগুন পড়েছে। বুলেটের আওয়াজে কান পাতা যাচ্ছেনা। বুকের ভেতরে ঢিব ঢিব শব্দটা একটানা হাতুরি পেটাচ্ছে। কালকের পরদিন বিয়ে জয়িতার। কিন্তু অর্তকিত এই নরপিশাচদের হামলায় কি টিকে থাকা যাবে। বিয়েটা বুঝি গেল !!
জয়িতা ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উছে দাদা ওরা যদি এদিকে আসে ?
না আসবে না অভয় দেয় ধ্রুব।
দাদা আমার ভয় করছে !! তোকে আমাকে সবাইকে মেরে ফেলবে না'তো ? আবারো অভয় দেয় ধ্রুব।
নরপিশাচরা শব্দশকট হাতে নিয়ে এদিকে আসছে ধীরে ধীরে।
ধ্রুব ভাবে বাড়ি ছেড়ে যে পালাবে সে উপায়টুকু তো নেই। যে হারে বৃষ্টির মতো বুলেট ফুটছে; নির্ঘাত কোন বুলেট এসে বিধঁবে বন্ধুর মতোন এই বুকে। ওদিকে জয়িতার মা বিলাপ শুরু করে দিয়েছে। ঈশ্বর এ যাত্রায় বাঁচিয়ে দাও ? বিপদ না পড়লে আমাদের ভগবানকে ডাকার তেমন একটা ইচ্ছে মনে জাগেনা আজ তাই এই ঘোর বিপদে তাকেই ভীষণ ভাবে প্রয়োজন।
গেটের পাশটায় জোড়ায় জোড়ায় বুটের আওয়াজ কারা যেন আসছে।

০৪.
টেনে হিচরে নিয়ে যাচ্ছে জয়িতাকে নরপিশাচ গুলো।
বাধাঁ দেবার কেউ নেই। ছোপ ছোপ রক্তে আঙ্গিনা রাঙানো। এই মহল্লার কেউ মনে বাচঁতে পারবেনা আজ এই রাতে; সে সংকল্পে নেমেছে ওরা।
দাদা ওরা আমাকে নিয়ে গেলো ওদের ফেরা ? আকুতিটা খুব করুন ভাবে দেয়াল গুলোকেও কাপাচ্ছে। উপর থেকে কি সুন্দর কলকাঠি নেড়ে যাচ্ছেন তিনি দেখছেন কিভাবে অসহায় হয়ে পড়ে থাকে তার সৃষ্টিরা। জয়িতার চিৎকারটা বাড়ছে ক্রমশই;
কিন্তু ধ্রুব সেটা শুনতে পাচ্ছেনা; বুকটা ঝাঝরা করে দিয়ে গেছে বুলেট সোদা মাটির গন্ধে পাগল ছেলেটা পড়ে আছে; সে। ঘরের ভেতর লাশ হয়ে পড়ে আছে জয়িতার বাবা আর মা; ওরা বাচঁতে চায় নি; শুধু বলেছিলো আমাদের মেরে ফেলো কিন্তু আমাদের প্রিয় সন্তানদের মেরো না।
কিন্তু ওরা শুনবে কেন সে কথা; ওরা আজ নরপিশাচ হয়ে এসেছে।
যেমন সারি বেধে ওরা এসেছিলো, তেমনি চলে গেল লাশ ডিঙ্গিয়ে সাথে নিয়ে গেল জয়িতাকে।

জয়িতার লালপেড়ে শাড়ি পরে কপালে সিদূঁর দিয়ে হাতে শাখা ভরে আর বধূ হওয়া হলোনা। হলোনা পূরণ স্বামীর সোহাগ কিংবা মা ডাক শোনার অদম্য ইচ্ছেটা।
এ রাতে শুধু রক্তে ভরে উঠেছে রাজপথ আর আঙ্গিনা। নরপিশাচরা সেই রক্তে পা ফেলে প্রান নিধন করেই চলেছে ভয়ঙ্কর রাতটা কিছুতেই ফুরাচ্ছে না। রাত যতো বাড়ছে বাতাসে বাড়ছে বারুদের গন্ধ; আর রক্তে রক্তে ঢেকে যাচ্ছে শত শত প্রানের স্বপ্নরা। রাতটা যেমন করে শুরু হয়েছিলো তেমন করে শেষ হচ্ছেনা। জোনাকিরা নেই এখন আর। নালার পাশের ব্যাঙ গুলো আর ডাকছে না থমকে আছে ওরা। এ রাতে কাক আর ডাকবার সুযোগ পায়নি ভয়ে চলে গেছে দুরে কোথাও।
ঘরে পড়ে আছে টোপর আর লাল শাড়ি আর সব তছনছ করে দিয়ে গেছে নরপিশাচেরা কি ভেবে যেন আগুন জ্বালেনি এ বাড়িতে। চারপাশটা কাপছে হয়তো সকাল না হলে আর থামবে না।
রাতটা শেষ হচ্ছেনা সূর্যটা বসে আছে রক্তে আকাঁ সকাল দেখবে বলে;
কখন সকাল হবে ?

Thursday, August 2, 2012

প্রিয় কবি মতিউর রহমান মল্লিক | শরীফ আবদুল গোফরান

তোমরা কবি মতিউর রহমান মল্লিকের নাম অবশ্যই শুনেছ। আর শুনবেই না কেন! তিনি তো তোমাদের এই পাতাবাহারেরই পরিচালক ছিলেন। ছিলেন তোমাদের মতো ছোট্ট কুঁড়িদের প্রিয় বন্ধু। তিনি তোমাদেরকে কতই না ভালোবাসতেন। তাছাড়া পত্রিকার পাতায় পাতায় ছন্দে ছন্দে তোমাদের জন্য কতো গান-কবিতাই না লিখেছেন। শিশু সাহিত্যের বাঁকে বাঁকে ছিলো তাঁর বিচরণ। তিনি তাঁর লেখায় ছোট্ট কুঁড়িদের কি বলেছেন একবার দেখোই নাÑ

‘ফুলকুঁড়িদের মাঝে আমার
থাকতে লাগে ভালো
ফুলকুঁড়িরাই জ্বালছে দেশে
জ্ঞান-গরীমার আলো।

তারাতো নয় কাগজের ফুল
মেকী ফুলের কুঁড়ি
আসল ফুলের মেলা বসায়
সারাটা দেশ জুড়ি।’

তাহলে বুঝতেই পারছ তিনি তোমাদেরকে কতো ভালোবাসতেন। কতোই না কাছের বন্ধু ছিলেন। সেই প্রিয় মানুষটির কথাই তোমাদেরকে বলছিলাম।
কবি মতিউর রহমান মল্লিক কোথায় জন্মগ্রহণ করেছেন জানো? বলছি শোন। ১৯৫৬ সালের ১লা মার্চ বাগেরহাট জেলার রায়পাড়ার বারোইপাড়া গ্রামে কবি মতিউর রহমান মল্লিক জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইন্তেকাল করেছেন ১২ আগস্ট ২০১০ সালের ১ রমজান। তাঁর পিতার নাম মুন্সী কায়েস উদ্দীন মল্লিক আর মা আছিয়া খাতুন। গ্রামের পাঠশালা থেকেই কবি মল্লিকের প্রাথমিক শিক্ষা  শুরু হয়। তিনি মাদরাসা থেকে ফাজিল, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ (সাবসিডিয়ারি) পাস করেন।

কর্মজীবনে  কবি মল্লিক সাপ্তাহিক সোনার বাংলা পত্রিকার সাহিত্য সম্পাদক, মাসিক কলম পত্রিকার সম্পাদক এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত বাংলাদেশ সংস্কৃতি কেন্দ্রের  সদস্য সচিব ছিলেন। তাছাড়া তিনি একাধারে ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, গান লিখে বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন করেছেন।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন একজন হাস্যরসিক। তাঁর মন ছিলো নরম। গাল্পিক মন। তিনি সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলতেন। শিশু মনের অধিকারী এই কবি ছোট্ট বন্ধুদের হাসির জগতে আকর্ষণ করেছেন। তিনি কখনো নির্মল আনন্দ বিতরণ করেছেন, কখনো বা নীতি উপদেশপূর্ণ ভালো ভালো কথা-গীতি কাব্যের মাধ্যমে তুলে ধরে তোমাদের মতো ছোট্ট বন্ধুদের তৃপ্ত করেছেন।

যেমন ধরো-
‘এইতো সেদিন রাত বারোটায় দেখি
হায়! হায়! হায়! চৌরাস্তায় একি
পিচ্চি ম্যালা, পনরো ষোল আর
যুবকতো নয় নাঙ্গা তলোওয়ার
সমান তালে মারছে রঙের গোলা
ঠাঁয় দাঁড়িয়ে হাসছে ক’জন ভোলা।’

অসাধারণ সৃষ্টিশীল প্রতিভার অধিকারী কবি মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম গীতি কবি। তাঁর কবিতায় গানে রয়েছে ছন্দ, শিল্প, সুষমা, ভাবের সুঠাম বিন্যাস আর নিখুঁত কারুকাজ। তাঁর রচিত প্রতিটি লেখায় ধ্বনিত হয় একটি ম্যাসেজ যা বড় মাপের একজন কবির প্রধান বৈশিষ্ট্য।

কবি মতিউর রহমান মল্লিকের লেখা পড়লেই বুঝতে পারবেÑ তিনি ছোট্ট শিশু-কিশোরদের কতো আনন্দ দিয়েছেন। তিনি নতুন নতুন শব্দ ও ভাষার ঝংকারে রস-রচনা লিখেছেন অনেক। মন ও মেজাজে চঞ্চল এই লেখক সমাজ বা জাতির জন্য মূলত লেখনি ধারণ করলেও তাঁর শিশুতোষ রচনাবলী স্পন্দিত হয়েছে। শিশু সাহিত্যে তিনি ছিলেন আলোর অভিসারী, রঙিন সকাল প্রত্যাশী মানবতাবাদী। যেমন কবি ফররুখ আহমদকে নিয়ে তাঁর শিশুতোষ একটি লেখা-
‘বুকে তার সাহস ছিল বাঘের মত
প্রাণে তার ফুটতো গোলাপ ডাগর ডাগর
মনে তার লক্ষনিযুত তারা জ্বলতো
চোখে তার স্বপ্ন ছিল সাগর সাগর।’
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন অপূর্ব প্রাণশক্তির প্রতীক। তিনি ছিলেন প্রেমের কবি। সে প্রেম প্রকৃতির জন্যে, মানুষের জন্যে, দেশের জন্যে, দেশবাসীর জন্যে, মানবতার জন্যে। তাঁর লেখায় ছিলো আল্লাহর প্রেম, রাসূল (সা.) এর প্রেম। তিনি ছোট বড় সবাইকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসের সাথে লড়ে যেতে উৎসাহিত করতেন। বলেন-
‘নামবে আঁধার তাই বলে কি
আলোর আশা করবো না?
বিপদ-বাধায় পড়বো বলে
ন্যায়ের পথে লড়বো না?’
শিশু রচনায় কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন শিশু মনস্তত্ত্ববিদ এবং শিশু বন্ধু। তিনি শিশুদের পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বলতেন-
‘পড় এবং পড়, যে পড়ে সে বড়ো
লেখার জন্য পড়ো, শেখার জন্য পড়ো।’
কবি মতিউর রহমান মল্লিক গ্রামেই লালিত পালিত এবং গ্রাম্য সৌন্দর্যময়ী প্রকৃতি তাঁকে মুগ্ধ কবি আত্মার অধিকারী করেছে। বাংলার প্রাকৃতিক রূপ, গাঁয়ের সরল মানুষের প্রেম-প্রীতি, ঝগড়া-বিসংবাদ, আনন্দ-বিলাপ, স্ফূর্তি সবকিছুকে তিনি মমতার দৃষ্টি নিয়ে বাংলাসাহিত্যে চুষ্মান করেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন এই ঐতিহ্য ধারার অনুসারী। কবি মতিউর রহমানের শিশুতোষ রচনায় তিনি এসব অনুসরণ-অনুকরণ করলেও স্বীয় কর্মের প্রভাবে তিনি উত্তরসুরী হয়েও এ পথে এক নবদিগন্তের দ্বার উন্মোচন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শিশু সাহিত্য সাধনায় তিনি লোকজীবনের উপাদান ও ঐতিহ্যের যথার্থ প্রয়োগে ছিলেন কুশলী। পল্লীর প্রচলিত গান, গজল ও লোক সাহিত্য সংগ্রহ করতে করতে তিনি অলক্ষ্যে বাংলা সাহিত্যে ইসলামী ধারার গান, কবিতা ইত্যাদি সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। তাঁর লেখা ছড়া-কবিতা যেমনি তোমাদেরকে আনন্দ দেয় তেমনি তাঁর লেখা অসংখ্য হামদ, নাত এবং আধুনিক ইসলামী গান শ্রোতাদের মন জয় করেছে। কবি মতিউর রহমান মল্লিক বাংলা সাহিত্যে ইসলামী সঙ্গীতকে আধুনিক ভাবধারায় উজ্জীবিত করেছেন। যেমনÑ

‘পাখি তুই কখন এসে বলে গেলি
মোহাম্মদের নাম
যে নাম শুনে পৃথিবীকে
ভালো বাসিলাম।’

কবি মতিউর রহমান মল্লিখ ছোট-বড় সবার প্রিয় কবি। তিনি সবার জন্য লিখেছেন। অনেক অনেক লেখা তাঁর। সে তুলনায় প্রকাশিত হয়েছে মাত্র সামান্য কিছু গান, কবিতা। তাঁর অসংখ্য লেখা এখনো অপ্রকাশিত রয়েছে। তাঁর লেখা প্রকাশিত কয়েকটি গ্রন্থের সাথে তোমাদের পরিচয় করে দিচ্ছি।

কাব্য : আবর্তিত তৃণলতা (১৯৮৭), অনবরত বৃক্ষের গান (২০০১), তোমাদের ভাষায় তিè ছায়া, চিত্রল প্রজাপতি, কিশোর কবিতা : রঙিন মেঘের পালকি (২০০২)। গান : ঝংকার (১৯৭৮), যত গান গেয়েছি ও নির্বাচিত প্রবন্ধ।

কবি মতিউর রহমান মল্লিক অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার পেয়েছেন। যেমন সবুজ মিতালী সংঘ সাহিত্য পুরস্কার, জাতীয় সাহিত্য সংসদ স্বর্ণপদক, কলম সেনা সাহিত্য পদক, লক্ষ্মীপুর সংসদ সাহিত্য পদক, রাঙ্গামাটি পরিষদ সাহিত্য পদক, খানজাহান আলী শিল্পী গোষ্ঠী সাহিত্য পদক, সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ সাহিত্য পুরস্কার (বাগেরহাট), আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস সাহিত্য পুরস্কার (বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি পরিষদ, প্যারিস, ফ্রান্স), বায়তুশ শরফ সাহিত্য পুরস্কার (চট্টগ্রাম), বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ পুরস্কার, কিশোর কণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার ও বাংলা সাহিত্য পরিষদ সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন।

এই বড় মানুষটি এখন আর আমাদের মাঝে নেই। তিনি আমাদের ছেড়ে চির বিদায় নিয়েছেন। তিনি তাঁর গানে কী বলেছেন জানো?
‘পৃথিবী আমার আসল ঠিকানা নয়
মরণ একদিন মুছে দেবে সকল রঙিন পরিচয়।’
তাই হলো! তিনি আর এই পৃথিবীতে নেই। তাঁকে শুধু মনে পড়ে। চলো না বন্ধুরা আমরা সবাই আল্লাহকে বলি ‘প্রভু তুমি প্রিয় কবি মল্লিককে বড় জান্নাতটায় প্রবেশের সুযোগ করে দাও। তিনি যেন ইসলামের কবিদের সাথে এক হয়ে তোমার জান্নাতের দিনগুলো উপভোগ করতে পারেন।’

কিশোর কাননে নজরুল | মোশাররফ হোসেন খান

আমাদের প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ১৩০৬ সালে।  তিনি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেছেন। কী অসাধারণ প্রতিভাবান এক উজ্জ্বল পুরুষ। কী কবিতায়, কী গদ্যে, কী শিশুতোষ রচনায়Ñ সকল েেত্রই তিনি ছিলেন সফল। নজরুলের তুলনা এই উপমহাদেশে কেন, গোটা বিশ্ব সাহিত্যে বিরল। আজকে আমরা এই মহান কবির কিছু শিশুতোষ কবিতার সাথে পরিচিত হব। দেখবো, তিনি কী অপরিসীম দরদ দিয়ে লিখে গেছেন আমাদের জন্য কত বিচিত্র ধরনের কবিতা। নজরুলের এ ধরনের কবিতার নাম করতে গেলেই প্রথমে মনে পড়বে তার ঝিঙে ফুল কবিতাটির কথা। কী চমৎকার শব্দ আর ছন্দে হেলে দুলে চলেছে কবিতাটি। ঠিক যেন নদীর ঢেউয়ের ওপর দিয়ে বয়ে চলা ফিরফিরে বাতাসের দোলা। কখনো মনে হয়, বহুরাঙা একটি আশ্চর্য ক্যানভাস। যেখানে সবুজ-শ্যামল প্রাকৃতিক দৃশ্য আছে, আছে আকাশ আর নানা বর্ণের ফুল ও পাখির মেলা। কী চমৎকার উচ্চারণে :

ঝিঙে ফুল! ঝিঙে ফুল!

সবুজ পাতার দেশে ফিরোজিয়া ফিঙে কুল

                                 ঝিঙে ফুল।
                    গুল্মে পর্ণে
                    লতিকার কর্ণে
                    ঢলঢল স্বর্ণে
                    ঝলমল দোলে দুল-
                                  ঝিঙে ফুল।


পাতার দেশের পাখি বাঁধা হিয়া বোঁটাতে,
গান তব শুনি সাঁঝে তব ফুটে ওঠাতে।

                     পউষের বেলা শেষ
                     পরি’ জাফরানী বেশ
                     মরা মাচানের দেশ
                     করে তোল মশগুল-
                                    ঝিঙে ফুল।

আবার নজরুল ইসলামের খুকি ও কাঠবেরালি কবিতায় দেখি অন্য রকম মজা। এ যেন কবিতা নয়, নাটকের খেলা। এর প্রতিটি পঙক্তিতে ছড়িয়ে আছে শিশু মনের স্বপ্ন, আকাক্সা আর সংলাপ। আনন্দ, বেদনা, চাওয়া আর শিশু সুলভ খুনসুটিও আছে এখানে। ওই যেÑ

ডাইনী তুমি হোঁৎকা পেটুক,
খাও একা পাও যেথায় যেটুক।
বাতাবি লেবু সকলগুলো
একলা খেলে ডুবিয়ে নুলো!
কিংবা-
পেয়ারা দেবে? যা তুই ওঁচা!
তাইতে তোর নাকটি বোঁচা!
হুতমো-চোখী! গাপুস গুপুস
একলাই খাও হাপুস হুপুস!

পেটে তোমার পিলে হবে! কুড়ি-কুষ্টি মুখে!
হেই ভগবান! একটা পোকা যাস পেটে ওর ঢুকে!
ইস! খেয়োনা মস্তপানা ঐ সে পাকাটাও!
আমিও খুবই পেয়ারা খাই যে! একটি আমায় দাও।

প্রথম, এই প্রথমই আমরা কেবল নজরুলের কবিতাতেই এ ধরনের নতুন শব্দ, উপমা আর নাটকীয় দৃশ্য উপভোগ করলাম। শিশুতোষ কবিতাÑতাও যে কত বিচিত্র ধরনের, বিচিত্র ঢঙ-এর হতে পারে, তা নজরুলের কবিতা পড়লেই কেবল বুঝা যায়। তার কবিতায় রসিকতাও আছে। ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপও আছে। দুষ্টুমিও আছে বৈকি! খোকার খুশিটা সামনে রাখি একটু!-
সত্যি, কও না মামা,
আমাদের অমনি জামা
অমনি মাধায় ধামা
               দেবে না বিয়ে দিয়ে?
মামী মা আসলে এ ঘর
মোদেরও করবে আদর?
বাস, কি মজার খবর!
              আমি রোজ করব বিয়ে।
মায়ের সাথেও তার দুষ্টুমির শেষ নেই। যেমন-
 অ মা! তোমার বাবার নাকে কে মেরেছে ল্যাং?
খ্যাঁদা নাকে নাচছে ন্যাদা-নাক ডেঙাডেং ড্যাং।

 ওঁর নাকটাকে কে কবল খ্যাঁদা র‌্যাঁদা বুলিয়ে?
চামচিকে-ছা বসে যেন ন্যাজুড় ঝুলিয়ে!
বুড়ো গরুর টিকে যেন শুয়ে কোলা ব্যাং!
অ মা! আমি হেসে মরি, ন্যাক ডেঙাডেং ড্যাং!
               [ খাদু-দাদু]
আবার এই নজরুলই দিদির বে’তে খোকার চোখের পানি আর বুকের কষ্টকে বাড়িয়ে তুলেছেন শতগুণে। কী অভূতপূর্ব এক হৃদয়স্পর্শী উচ্চারণ :
মনে হয়, মণ্ডা মেঠাই
খেয়ে জোর আয়েশ মেটাই!-
ভাল ছাই লাগছে না ভাই,
           যাবি তুই একেলাটি!

দিদি, তুই সেথায় গিয়ে
যদি ভাই যাস ঘুমিয়ে,
জাগাব পরশ দিয়ে
         রেখে যাস সোনার কাঠি।

যে নজরুল মায়ের সাথে দুষ্টুমি করলেন, সেই নজরুলই আবার মাকে নিয়ে লিখলেন হৃদয় কাঁপানো এক বিখ্যাত কবিতা। নজরুলে ছাড়া এমন উচ্চারণ আর কোথায় আছে?Ñ

যেখানেতে দেখি যাহা
মা-এর মতন আহা
একটি কথায় এত সুধা মেশা নাই,
মায়ের মতন এত
আদর সোহাগ সে তো
আর কোনখানে কেহ পাইবে না ভাই!

       হেরিলে মায়ের সুখ
      দূরে যায় সব দুখ,
মায়ের কোলেতে শুয়ে জুড়ায় পরান,
       মায়ের শীতল কোলে
       সকল যাতনা ভোলে
 কতনা সোহাগে মাতা বুকটি ভরান।
             [মা]

মাকে আমরা প্রচণ্ড ভালোবাসি। ভালোবাসতেন নজরুলও। তাইতো তার কবিতায় ঘুরে-ফিরে মা এসেছেন-একেকভাবে, বিচিত্র অথচ বর্ণাঢ্য ভঙ্গিতে। খোকার বুদ্ধিতে মা আছেন। মা আছেন খোকার গপ্প বলাতেও। কিন্তু লণীয় বিষয় বটে, শিশুতোষ কবিতায় নজরুল যে পরিমাণ নতুন শব্দ, উপমা, সংলাপ আর নটাকীয়তা সার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, আর কোনো কবির মধ্যে তেমনটি নেই। তার লিচুচোর, হোঁদল-কুঁৎকুঁতের বিজ্ঞাপন, ব্যাংফুলী, পিলে পটকা, চিঠি, প্রভৃতি কবিতাতেও এর স্বার রয়ে গেছে।

কাজী নজরুল ইসলাম ছোটদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তার ছিল ভালোবাসার মত একটি বিশাল হৃদয়। সাগরের মত। উদার আকাশের মত। সেই হৃদয়ে ছোটরা বাস করতো, হাসতো, খেলতো, মজা করতো আর দুলে উঠতো স্বপ্নদোলায়।

হ্যাঁ, নজরুলই তো ছোটদেরকে স্বপ্ন দেখাতে শিখিয়েছেন এভাবে :
থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে,-
কেমন করে ঘুরছে মানুষ যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে!
আমার সীমার বাঁধন টুটে
দশ দিকেতে পড়ব লুটে,
পাতাল ফেড়ে নামব নীচে, ওঠব আবার আকাশ ফুঁড়ে,
বিশ্ব-জগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।
কিংবা-
আমরা শক্তি আমরা বল
             আমরা ছাত্রদল,
মোদের পায়ের তলায় মূর্ছে তুফান
          ঊর্ধ্বে বিমান ঝড়-বাদল।
                 আমরা ছাত্রদল ॥

মোদের আঁধার রাতে বাধার পথে
                    যাত্রা নাঙ্গা পায়,
আমরা শক্ত মাটি রক্তে রাঙাই
                বিষম চলার ঘায়।
যুগে যুগে রক্তে মোদের
          সিক্ত হল পৃথ্বিতল ॥
          আমরা ছাত্রদল ॥

নজরুল, কবি নজরুল ইসলাম ছোটদেরকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন, সামনে চলার সাহস দেখিয়েছেন। তাদেরকে বুকে টেনে নিয়েছেন বড় মমতায়। কিশোর কাননে নজরুলের উপস্থিতি আর অবস্থান একজন প্রকৃত দরদী অভিভাবকের মতই। এজন্য তিনিও আমাদের হৃদয়ে মিশে আছেন গভীর শ্রদ্ধায় ও ভালোবাসায়। তিনি যে আমাদের কাছের কবি, হৃদয়ের কবি, আপন কবি পরম প্রিয়।

সীমাহীন বন্ধুত্ব | ইব্রাহিম নোমান

স্কুলে তো তোমাদের অনেক বন্ধু। বাবা-মার মতো বাসায়ও আছে কাছের কিছু বন্ধু। এদের সঙ্গে তোমরা প্রায় নিয়মিতই মেলামেশা কর। তারপরও তোমার প্রিয় বন্ধুদের জন্য ৩৬৫ দিনের মধ্যে আছে আলাদা একটি দিন। আলাদা এই দিনটি হচ্ছে ‘বন্ধু দিবস’। যে দিনে বন্ধুদের সঙ্গে তোমরা মিশে যেতে পার আপন মনে।
প্রিয় বন্ধুকে নিয়ে ঘুরতে পার সুন্দর সব জায়গায়। খেতে পার মজার মজার খাবার। আসছে রোববার অর্থাত্ ৫ আগস্ট হচ্ছে ‘আন্তর্জাতিক বন্ধু দিবস’। তাই দিনটিকে তোমরা রাঙিয়ে নিতে পার মনের মতো করে। কিন্তু যে দিবসে তোমরা এত মজা করবে, সে দিবসটি কীভাবে এলো, তা কি জান?
বন্ধু ও বন্ধুত্বের প্রান্তর এত বেশি প্রসারিত যে, সেখানে চষে বেড়ানো যায় আজীবন। বন্ধুত্ব মানে প্রশান্তির অবিরাম ছায়া। সেখানে বন্ধু আছে, সেখানে দুজনে মিলে তৃতীয় একটা পৃথিবী গড়ার স্বপ্ন থাকে। মানুষে মানুষে যেমন বন্ধুত্ব হতে পারে, ঠিক তেমনি সৃষ্টি জগতের অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গেও মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে।
বন্ধুত্ব যুগে যুগে : সৃষ্টির আদি যুগ থেকেই বন্ধুত্ব রয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবীর মধ্যে বন্ধুত্ব ছিল। প্রাচীন ব্যাবিলন সভ্যতায় বন্ধুত্বের যে পরিসর ছিল, তার পরিচয় পাওয়া যায় ব্যাবিলনীয়দের কাব্যগ্রন্থ ‘দি এপিক অব গিলগামেশে’র মাধ্যমে। বন্ধুত্বের ইতিহাসে প্রথম দিকের সাহিত্যকর্ম মনে করা হয় এটিকে। গিলগামেশ আর এনকিডোর মধ্যে চমত্কার বন্ধুত্ব ছিল। বন্ধুত্বের গ্রিক রোমান মিথের নির্ভরযোগ্য উদাহরণ হলো অরেস্টেস এবং পাইলেডস।
বন্ধু দিবস উদযাপন রীতি : সভ্যতার শুরু থেকেই বন্ধু এবং বন্ধুত্বের মূল্য রয়েছে। যে সমাজে মানুষ তার বন্ধুদের প্রতি এত আন্তরিক সেই উপলব্ধি থেকেই কেউ কেউ বন্ধুত্বের জন্য আলাদা একটা দিবস রাখার চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। বর্তমান সময়ে আমরা যেভাবে বন্ধুত্ব দিবস পালিত হতে দেখছি, তার শুরু আমেরিকায়। ১৯৩৫ সালে আমেরিকার কংগ্রেস আগস্ট মাসের প্রথম রোববারকে জাতীয় বন্ধুত্ব দিবস ঘোষণা করে। তারপর প্রতি বছরই আমেরিকায় বন্ধুত্ব দিবস পালিত হতে থাকে। এ মহত্ উদ্যোগটি একসময় আমেরিকার জনপ্রিয় উত্সব হয়ে ওঠে। তখন বেশকিছু দেশ বন্ধুত্ব দিবসের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করে নেয়। এভাবেই বন্ধুত্ব দিবস পালনের আয়তন বাড়তে থাকে। বর্তমানে সারাবিশ্বেই আগ্রহ নিয়ে বন্ধুত্ব দিবস পালিত হচ্ছে। ১৯৯৭ সালে জাতিসংঘ বিশ্বময় বন্ধুত্বের আলাদা অবস্থানে নিজেদের নিয়ে যায়। সে বছরটিতে জাতিসংঘ উইনিকে বন্ধুত্বের বিশ্বদূত হিসেবে নির্বাচিত করে। এতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক বন্ধুত্বের ধারণাটি আরও বেশি প্রসারিত হয়েছে।
সাহিত্যে বন্ধুত্ব : পৃথিবীর সব ভাষার সাহিত্যে বন্ধুত্বের প্রসঙ্গ এসেছে। অনেক জনপ্রিয় সাহিত্যিক একে অপরের বন্ধু ছিলেন। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের মধ্যেও ছিল চমত্কার বন্ধুত্ব। আমাদের সাহিত্যের প্রেক্ষাপটের দিকে তাকালে কাজী নজরুল ইসলাম এবং মোতাহার হোসেনের বন্ধুত্বের বিষয়টি চলে আসবে। ইংরেজ কবি কোলরিজ এবং উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থ একে অপরের খুবই ভালো বন্ধু ছিলেন। আবার টিএস এলিয়ট এবং এজরা পাউন্ড পরস্পরের বন্ধু ছিলেন। আমাদের দেশে এমন অনেক উদাহরণ রয়েছে—যেখানে কবি-সাহিত্যিকরা একে অপরের ভালো বন্ধু।
বাংলাদেশে বন্ধু দিবস উদযাপন : আমাদের দেশে বন্ধু দিবসে সাধারণত ফ্রেন্ডশিপ ব্যান্ড, কার্ড আর ফুল দিয়ে বন্ধুকে বরণ করা হয়। এছাড়া অনেকেই কেক কেটেও বন্ধু দিবস উদযাপন করে। ফুলের মধ্যে হলুদ গোলাপ বন্ধুত্বের তাত্পর্য বহন করে। এখন যেহেতু রমজান মাস চলছে, তাই অনেকে ইফতার পার্টি দিয়েও বন্ধু দিবস পালন করবে।
বন্ধুত্ব বলতে অনেকেই পরিবারের বাইরের কারও সঙ্গে আন্তরিক সম্পর্ককে বোঝায়। কিন্তু পরিবারের সদস্যদের মধ্যেও যে আন্তরিক বন্ধুত্ব হতে পারে, এটা অনেকে ধারণাতেই রাখেন না। বাবা-মা, ভাই-বোন কিংবা পরিবারের অন্যান্য সদস্য এক অপরের ভালো বন্ধু হতে পারে। মানুষের বয়স বাড়ে, কিন্তু বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে না। তবে ভালো বন্ধু পাওয়াটা অনেক সময়ই ভাগ্যের ব্যাপার।
‘হাত বাড়ালেই বন্ধু পাওয়া যায় না/বাড়ালেই হাত বন্ধু সবাই হয় না’ গানটির কথাগুলো সত্যিই মনে হয়। বন্ধুত্বের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন মানসিকতা; বয়সের নির্দিষ্ট কোনো বাধা নেই। মানসিকতায় মিল থাকলে বন্ধুত্ব হয় সহজেই। বন্ধু সহযোগী হিসেবে পাশে দাঁড়াবে, হাত বাড়াবে, বন্ধু প্রয়োজনটাই হবে প্রধান বিষয়। থাকতে হবে আত্মত্যাগ বা নিজেকে উত্সর্গ করার মানসিকতা। নইলে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে পবিত্র করে তোলা যাবে না।

পাখির জন্য ভালোবাসা | জাকির আহমেদ খান

মিঠু ও মোনা দুই বন্ধু। ফাঁদ নিয়ে এসেছে পাখি ধরতে। মিঠু ফাঁদটি নিয়ে এগিয়ে গিয়ে একটি জায়গা দেখে বললো, দেখো মোনা এই জায়গাটা খুব ভালো। আজ আমরা এখানেই ফাঁদ পাতি; কি বলিস?
মোনাও মিঠুর কথায় সায় দিয়ে বললো, হ্যাঁ জায়গাটা ভালো। আশপাশে অনেক পাখিও দেখা যাচ্ছে।
দু’জনে মিলে সুন্দর করে ফাঁদটি পাতলো। একটু দূরে গাছের নিচে গিয়ে বসলো দু’জনে। চারপাশে খুব সুন্দর প্রকৃতি। হাজার হাজার পাখি ঝাঁক বেঁধে এক বিল থেকে অন্য বিলে উড়ে যাচ্ছে। মৃদু বাতাসে ধানের পাতা হেলে-দুলে নাচছে। বিলের পানিতে ছোট ছোট ঢেউয়ের ওপর কাঁচা সোনা রোদ পড়ে বিলের পানি চকচক করছে। একটু দূরে দূরে একটি-দুটি বকপাখি দাঁড়িয়ে আছে। কোনোটা লম্বা পা ফেলে মাছ খুঁজছে।
ওদিকে দুই বন্ধু গাছের নিচে বসে আছে। একঝাঁক পাখি উড়ে এসে আস্তে আস্তে নিচে নামতে নামতে আবার উড়ে অন্যদিকে চলে গেলো। পাখিগুলো দেখে দু’জনেই খুব খুশি হয়েছিল। কিন্তু চলে যাওয়ায় আবার মনটা একটু খারাপ হয়ে গেল। পাখির ঝাঁকটা এখানে নামলে হয়তো দু-একটা পাখি অবশ্যই ফাঁদে আটকা পড়তো; কিন্তু তা আর হলো না।
একটু পরে আবার একঝাঁক পাখি এলো। পাখিগুলো নিচে নামলো। পাখি দেখে দু’জনে খুব খুশি হলো। দু’জনে চুপচাপ বসে রইলো। কারণ তাদের দেখে আবার যদি পাখিগুলো উড়ে যায়!
মোনা আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখছে আরো পাখির ঝাঁক আছে কি-না। হঠাত্ মিঠু আনন্দে লাফিয়ে উঠলো। মোনা আকাশের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে? অমন লাফাচ্ছিস কেনো?
মিঠু মোনার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ফাঁদের দিকে দৌড় দিলো। মোনার আর বোঝার বাকি নেই, সেও এক ভৌঁ দৌড়ে ফাঁদের কাছে গিয়ে হাজির। ওরা দেখলো, একটি পাখি আটকা পড়ে ছুটে যাওয়ার জন্য পাখা ঝাপটাচ্ছে। কিন্তু যতই পাখা ঝাপটাচ্ছে, ততই আরো ফাঁদে আটকে যাচ্ছে। খুশিতে দু’বন্ধুর চোখ ভোরের সূর্যের মতো জ্বলজ্বল করছে। জীবনে প্রথম ফাঁদ পেতে পাখি ধরতে এসে শতভাগ সফল। এ আনন্দ কি বলে বোঝানো যাবে?
দু’জনে মিলে পাখিটি ফাঁদ থেকে বের করলো। মিঠু পাখিটি তার বুকের সঙ্গে জাপটে ধরে রাখলো। মোনা খুব তাড়াতাড়ি ফাঁদটি গুটিয়ে নিলো। বিকাল প্রায় শেষ। গোধূলির রঙে চারদিক ভরে আছে। কিছুক্ষণের মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে আসবে। মিঠু বললো, চল বাড়ি ফিরে যাই।
মোনা মিঠুর কথায় রাজি হয়ে পাখিটি নিয়ে বাড়ির পথে হাঁটতে লাগলো। বাড়ি ফেরার পথে রাজীবের সঙ্গে দেখা। রাজীব বয়সে তাদের বড়। কলেজে পড়ে। খুবই ভালো সে। গাঁয়ের সবাই তাকে খুব ভালোবাসে। রাজীব ভাইও সবাইকে সম্মান করে। ছোটদের আদর-স্নেহ করে।
দূর থেকে রাজীব ভাইকে দেখে কাছে আসতে আসতে মোনা জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছেন রাজীব ভাই?
আমি ভালো আছি। তোমরা কেমন আছো?
আমরাও ভালো আছি। হঠাত্ রাজীবের চোখ পড়লো পাখিটির ওপর। সে জিজ্ঞেস করলো, তোমার হাতে ওটা কী পাখি মিঠু? কোথায় পেলে? অসুস্থ বুঝি?
মিঠু বলে, না ভাই, অসুস্থ না। আমরা দু’জনে মিলে বিলের পাড় থেকে ফাঁদ পেতে ধরেছি।
রাজীব ভাই একবার ভালো করে দেখলো পাখিটিকে। এখনো চারদিকে তেমন অন্ধকার নামেনি। মিঠু পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করছে। তোমারে একটি কথা জিজ্ঞেস করি?
মিঠু বললো, কী কথা রাজীব ভাই? রাজীব ভাই বললো, আচ্ছা এখন যদি কেউ তোমাদের মাকে ধরে নিয়ে যায়, তোমাদের কেমন লাগবে?
মিঠু প্রথমেই বলে উঠলো, আমি মাকে ছাড়া একদিনও থাকতে পারবো না।
মোনা বললো, মায়ের হাতে না খেলে আমার পেট-ই ভরে না।
রাজীব ভাই বললো, তবে তোমরা যে এই পাখিটি ধরে আনলে, এই পাখির বাচ্চাদের কী হবে?
মোনা ও মিঠু একে অপরের দিকে তাকালো। হ্যাঁ, তাই তো! এই পাখির বাচ্চাদের কী হবে? আমরা তো কখনো এমন করে ভাবিনি! আমাদের ভুল হয়ে গেছে রাজীব ভাই। এখন আমরা কী করবো?
তোমরা পাখিটি ছেড়ে দাও; রাজীব ভাই বললো।
একটু ভেবে দু’জনেই রাজি হলো।
রাজীব ভাই বললো, তবে আর দেরি কেন? এখনই ছেড়ে দাও!
মিঠু কয়েকবার পাখিটির মাথায় হাত বুলিয়ে ছেড়ে দিলো। পাখিটি পাখা জাপটে দূরে যেতে যেতে গাছের আড়ালে চলে গেল।

মোটর গাড়ির আবিষ্কারকহেনরি ফোর্ড | সিরহানা হক

মোটর গাড়ি আবিষ্কারের ক্ষেত্রে অনেকের অবদান থাকলেও হেনরি ফোর্ডের অবদান ছিলো সবচেয়ে বেশি। এ কারণে হেনরি ফোর্ডকে মোটর গাড়ির আবিষ্কারক বলা হয়। তিনি ছিলেন উইলিয়াম ফোর্ড নামে এক চাষীর সন্তান। আমেরিকার অঙ্গরাজ্য মিচিগানের রেডিয়ার বোনে জন্মগ্রহণ করেন ফোর্ড। সেই দিনটি ছিলো ১৮৬৩ সালের ৩০ জুলাই।
১৮৬৮ সালে স্কুলে ভর্তি করে দেয়া হলেও দুষ্টুমি করার কারণে স্কুল থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি বাড়িতে মা মেরি ফোর্ডের কাছে লেখাপড়া করেন। তবে ১৮৭৬ সালে মা মারা যাবার পর লেখাপড়া আর হয়নি।
ছেলেবেলা থেকেই যন্ত্রপাতির ওপর তীব্র আকর্ষণ ছিলো ফোর্ডের। তিনি ১৮৮৩ সালে একক প্রচেষ্টায় বাষ্পচালিত ট্রাক্টর বানিয়ে প্রথম তার উদ্ভাবনী শক্তির প্রমাণ দেন। ১৮৮৮ সালে ফোর্ড ক্লারা ব্রায়েন্টকে বিয়ে করেন। এ সময় তিনি জানতে পারেন বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা যান্ত্রিক গাড়ি বা মোটর চালিত গাড়ি আবিষ্কারের জন্য গবেষণা করে যাচ্ছেন। যন্ত্রের প্রতি ছেলেবেলা থেকেই আগ্রহী ছিলেন ফোর্ড। তিনি সিদ্ধান্ত নেন অবসর সময়ে মোটর গাড়ি উদ্ভাবনের জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবেন।
এ সময় ফোর্ড ডেট্রয়েটে বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস অ্যালভা এডিসনের এডিসন লাইটিং কোম্পানিতে কাজ করতেন। এখানে কাজ করতে হতো রাতের শিফটে—দিনে চালাতেন গাড়ি উদ্ভাবনের জন্য গবেষণা। একটানা দু’বছর কাজ করার পর মোটামুটি মোটর গাড়ি উদ্ভাবনে সক্ষম হন ফোর্ড। তিনি এডিসনের কোম্পানির কাজ ছেড়ে দিয়ে পুরো সময় মোটর গাড়ি আবিষ্কারের পেছনে ব্যয় করেন। ১৮৯৩ সালের প্রথম দিকে মোটর গাড়ি তৈরির ব্যাপারে অনেক দূর এগিয়ে যান ফোর্ড। সে বছরের কোনো এক রাতে প্রথম মোটর গাড়ি নিয়ে পথে বের হন হেনরি ফোর্ড। পরে এই গাড়ির আরো উন্নতি ঘটান। ডেট্রয়েটের শহরতলিতে প্রতিষ্ঠা করেন প্রথম কারখানা। ছয়শ’ পঁয়ষট্টি একর জমির ওপর নির্মিত এ কারখানা থেকে হেনরি ফোর্ডের সময় প্রতি বছর মোটর গাড়ি ছাড়াও নির্মিত হতো দশ লাখ ট্রাক্টর। একশ’টি রেলপথ দিয়ে সেগুলো বিভিন্ন দেশে পাঠানো হতো।
ফোর্ড নিজে ছিলেন কৃষকের সন্তান। তাই গরিব কর্মচারীদের ওপর তার ছিলো অসীম মমতা। তার ফোর্ড মোটর কোম্পানির সব শ্রেণীর কর্মচারীর জন্য তিনি চালু করেন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল, কল্যাণ ফান্ড, বৃত্তি ও অন্যান্য সেবাধর্মী কর্মকাণ্ড। তার প্রতিষ্ঠিত ফোর্ড ফাউন্ডেশন আজো বিশ্বের উন্নতিতে অর্থ সাহায্য করে যাচ্ছে। মহাপ্রাণ হেনরি ফোর্ড মারা যান ১৯৪০ সালের ৭ এপ্রিল।

সূত্র: আমার দেশ

ঝড়োবৃষ্টি | আবু সাইদ কামাল

একদিন আগেও ধূলির রাজ্যে ছিল বসবাস,
পথে নামলেই ধূলি লেগে হতো সর্বনাশ।
জামা-কাপড় ময়লা হতো, শ্বাসে টানতাম ধূলি
ওসব অত্যাচার কি বলো খুব সহজে ভুলি!
রাতেই যখন ঝড়ো-ঝাপটায় তুমুল বৃষ্টি নামে
সাথে সাথে চরাচরে ধূলির তাণ্ডব থামে।
সকাল বেলায় পথে নেমে স্বস্তিতে শ্বাস টানি,
ফসলি মাঠ সতেজ হলো পেয়ে বৃষ্টির পানি।

নিসরাত আক্তার সালমা | রমজান


রমজান এলো বছর ঘুরে
রোজা রাখ মুসলমান
রোজার মাসে রোজা রেখে
পোক্ত কর নিজ ইমান।
আদায় করো শুকরিয়া
নামাজ রোজা রেখে,
সাহরি খাও ইফতার করো
সঠিক সময় দেখে।
শান্তি সুখের দিনের আশায়
করো সবাই মোনাজাত
পরকালের কথা ভেবে
চাও সবাই মাগফিরাত।

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ