প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Wednesday, February 29, 2012

অগ্নিঝরা মার্চ -১ : শুরু হলো স্বাধীনতার মাস বিদ্রোহী মার্চ (১মার্চ)

‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা আমরা তোমাদের ভুলব না...।’ বছর ঘুরে আবার ফিরে এলো রক্তঝরা মার্চ, স্বাধীনতার মাস। গত শতাব্দীর ১৯৭১ সালের মার্চে শুরু হয় স্বাধীনতা অর্জনের চূড়ান্ত লড়াই—সশস্ত্র সংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর লাল-সবুজ পতাকার দেশ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বিশ্ব মানচিত্রে নতুন একটি দেশের অভ্যুদয় ঘটে অগণিত প্রাণের বিনিময়ে।
এদেশের শোষিত, নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত মানুষ স্বাধিকারের জন্য লড়াই করে আসছিলেন দীর্ঘদিন ধরে। মহান ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন ও ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ছিল জাতিসত্তার স্বরূপ অন্বেষার এক একটি মাইলফলক। সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও তত্কালীন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী ক্ষমতা হস্তান্তরে নানা ষড়যন্ত্র ও টালবাহানা করছিল।
আজ থেকে ৪১ বছর আগে মার্চ মাসের এই দিনে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে কোনো স্বাধীন দেশের অস্তিত্ব ছিল না। তত্কালীন পাকিস্তানের পূর্ব অংশ অর্থাত্ পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনে লালিত একটি স্বপ্ন, একটিমাত্র আকাঙ্ক্ষাই জাগ্রত ছিল—তা হলো পরিপূর্ণ স্বাধীনতা। দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকা নিগ্রহ, শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের নাগপাশ ছিঁড়ে সগর্বে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর দুর্মর আকাঙ্ক্ষা ছিল প্রবল।
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানি স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের নির্ধারিত অধিবেশন বাতিল করেন। এ অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল ৩ মার্চ। ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ গোটা পাকিস্তানেই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করার হীন, কূট ষড়যন্ত্র হিসেবে অধিবেশন বাতিলের ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রোধে, ক্ষোভে ফুঁসে ওঠে। বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, অধিকারহীন মানুষ ফেটে পড়ে বিক্ষোভে। অফিস-আদালত থেকে সব মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে এই ষড়যন্ত্রের তীব্র প্রতিবাদ করেন। স্লোগান ওঠে—বীর বাঙালি অস্ত্র ধর/বাংলাদেশ স্বাধীন কর।
ঐতিহাসিক ১ মার্চ থেকেই পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে অঘোষিত অসহযোগ শুরু হয়ে যায়। প্রতিবাদ-প্রতিরোধে ও লড়াইয়ের ইস্পাতকঠিন প্রত্যয়ে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠতে থাকে দেশ। একাত্তরের আগুনঝরা মার্চে বীর বাঙালি সেই যে ঘর থেকে বেরিয়েছিল, বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত আর ঘরে ফেরেনি। মুক্তিযুদ্ধে অগণিত প্রাণ উত্সর্গ করতে হয়েছে, অগণিত মা-বোনকে হারাতে হয়েছে সম্ভ্রম। আহত ও পঙ্গু হতে হয়েছে এদেশের অগণিত মানুষকে। লাখো মানুষের অপরিসীম ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন হয়েছে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
সূত্র : আমার দেশ

Monday, February 20, 2012

২১ ফেব্রুয়ারীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস

 
[বাংলা ও বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে এদেশের ছাত্রসমাজ যে এত বড় বড় ঘটনার জন্ম দিয়েছে ঐতিহাসিকদের মতে সেই ছাত্র রাজনীতির সূত্রপাত ১৮৩০ সালে। রাজনীতির উত্থান-পতনের রেখা ধরেই অদ্যবধি প্রবহমান ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসে ১৯৫২ সাল স্বর্ণাক্ষরে লেখা নাম, যা নিজ মহিমায় এতই উজ্জ্বল যে বুদ্ধিজীবীদের মতে ২১ ফেব্রুয়ারী আমাদের অঘোষিত স্বাধীনতা দিবস। ২১ ফেব্রুয়ারীর ‘ভাষা আন্দোলন’ এর আবেদন এতই ব্যাপক যে এখনও প্রতিক্রিয়াশীলগোষ্ঠী সোচ্চার এর বিরুদ্ধে। আর আমরা বর্তমান প্রজন্মের ছাত্র-ছাত্রীরা যারা ঘুমিয়ে আছি এই অন্ধকার সময়ের ভিতর কিংবা যারা অর্ধসচেতন বা সচেতনভবে খুঁজে ফিরি মুক্তির পথ তাদেরকে অবশ্যই জানতে হবে ভাষা আন্দোলনের সেই ঐতিহাসিক গৌরবগাঁথা। ভবিষ্যতের কর্মপন্থা নির্ধারণে প্রয়োজন সঠিক ইতিহাস জানা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস তথা যে কোন আন্দোলনের ইতিহাস জানার জন্য অবশ্যই জানার প্রয়োজন পড়ে আন্দোলনের সময়কার পরিস্থিতি, আর্থসামাজিক অবস্থা এবং সমসাময়িক অন্যান্য রাজনীতি যা এই ক্ষুদ্র পরিসরে তুলে ধরা সম্ভব নয। তথাপি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানার মাধ্যমে আমরা জানার চেষ্টা করবো ভাষা আন্দোলনের বিশাল ইতিহাসকে; সে লক্ষ্যেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সংক্ষিপ্তভাবে উপস্থানের চেষ্টা। ]

ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাতঃ
পাকিস্তানের জন্মের তিন মাস পর করাচীতে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা গণ্য করার এক সর্বসম্মত প্রস্তাব গৃহীত হয়। এই সংবাদ পরদিন ঢাকার ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে ঢাকা শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে তীব্র বিক্ষোভ সঞ্চারিত হয়। ঐদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে সাধারণ ছাত্রসভা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ আশেপাশের অন্যান্য কলেজের ছাত্রছাত্রী। সমাবেশের পর এক বিরাট মিছিল সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ববাংলার অন্যতম প্রতিনিধি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা বিষয়ে একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন সেখানে বলা হয় উর্দু ও ইংরেজীর সঙ্গে বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণ করা হোক। ২৫ ফেব্রুয়ারী আলোচনা শেষে গণপরিষদের মুসলিম লীগের বাঙালি সদস্যরা বাংলাকে পরিষদের রাষ্ট্রভাষা করার বিরুদ্ধে ভোট দেয়। সেই খবরে ঢাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ২৬ ফেব্র“য়ারী ঢাকায় ধর্মঘট পালন হয়। ২ মার্চ ঢাকায় সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কর্মীদের এক সভায় গঠিত হয় ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’। পরিষদের ডাকে ১১ মার্চ হরতাল পালন হয?। ১১ মার্চে ছাত্র জনতার উপর প্রশাসনিক গুন্ডা বাহিনীর নির্যাতন ও গ্রেপ্তারের প্রতিবাদের ১২ মার্চ বিচ্ছিন্নভাবে প্রতিবাদ এবং ১৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালন হয়। ১৪ মার্চ সারা পূর্বপাকিস্তানে ধর্মঘট পালন হয়। ১৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর সাথে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে নাজিম উদ্দীন ৮ দফা চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করেন।

ঢাকার বাইরে প্রতিক্রিয়াঃ
২৬ ফেব্রুয়ারী ঢাকায় ধর্মঘট পালনের খবর ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে সারা দেশে ভাষা আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র ফেডারেশন, মুসলিম ছাত্রলীগ, ছাত্র এসোসিয়েশন, ছাত্র সংঘ, যুবলীগ প্রভৃতি সংগঠনের উদ্যোগে জেলায় জেলায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হতে লাগল।

* ২৮ তারিখ পাবনায় ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্ররা রাস্তায় মিছিল করে এবং পুলিশের বেয়নেট চার্জে প্রথমবারের মত রঞ্জিত হয় পাবনার রাজপথ।
* ২ মার্চ যশোরে ধর্মঘট পালিত হয়। ১০ মার্চ শহরে ১৪৪ ধারা জারি করে জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট। ১১ মার্চ যশোরে বিশাল মিছিল হয়। ১২ মার্চ কলেজ ছাত্র ধর্মঘট, ১৩ তারিখে মিছিলে পুলিশ প্রথমে লাঠি চার্জ ও পরে গুলি বর্ষণ করে। ঘটনার প্রতিবাদে ১৪ মার্চ আবার হরতাল পালন করা হয়।
* রাজশাহীর নওগাঁতে ২৭ ফেব্রুয়ারী ব্যাপক ছাত্র সমাবেশ ঘটে। কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ১১ মার্চ বিক্ষোভ চলাকালে মিছিলের উপর হামলা হয়।
* চাঁদপুরে ধর্মঘট ডাকা না হলেও স্বতস্ফূর্তভাবে পালিত হয়।
* মুন্সিগঞ্জে২৮ ফেব্রুয়ারী বিক্ষোভ মিছিল হয়।
* ১১ মার্চ বগুড়ায় বগুড়ায় কলেজ থেকে মিছিল বের হয়।
* খুলনায় ২৮ ফেব্রুয়ারী বি.এল কলেজে প্রতিবাদ সভা হয়। ১১ মার্চ আন্দোলন তীব্র আকার ধারন করে।
* ২৭ ফেব্রুয়ারী বরিশালে বিশাল জনসভা হয়।

জিন্নাহর ঢাকা আগমনঃ
১৬ মার্চ ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় পুলিশী হামলার প্রতিবাদে ১৭ মার্চ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
জিন্নাহর আগমনে ছাত্র জনতার ভিতর স্বতঃস্ফূর্ততা ছিল। তারা আশা করেছিল জিন্নাহ হয়তোবা পূর্ববাংলার সাম্প্রতিক ঘটনায় জনগণের পক্ষেই থাকবে। ১৯ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জিন্নাহ ঘোষণা করেলেন-
“..কিন্তু না আপনাদের পরিষ্কার ভাবে বলে দেয়া দরকার পাকিস্তানের রাষ্টভাষা হবে উর্দু, অন্যকোনো ভাষা নয় । এ ব্যাপারে কেউ যদি আপনাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে তাহলে বুঝতে হবে সে হচ্ছে রাষ্ট্রের শত্রু।”
এই বক্তৃতা তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করলেও বিক্ষোভ হয় বিচ্ছিন্নভাবে। এরপর ২৪ মার্চ সকালে জিন্নাহর সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ সমাবর্তনে জিন্নাহ যখন আবার বলেন “উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা”; তখন মিলনায়তনে উপস্থিত বেশ কিছু ছাত্র একসঙ্গে না, না বলে উঠে। এই দিনে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি দলের সাথে জিন্নাহর নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে তাকে অপমান করা হয় এবং আলোচনা আর এগোয়নি।
আরবী হরফে বাংলা লেখার একটি পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হলেও বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৪৯ সালে। ১৯৪৯ সালের ৭ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের শিক্ষা সচিব পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত শিক্ষা উপদেষ্টা বোর্ডে এক সভায় বলেন-
“সহজ ও দ্রুত যে হরফের মারফত ভাষা পড়া যায় সেই হরফই সবচাইতে ভাল। সুতরাং দ্রুত লিখন ও পঠনের পক্ষে সুবিধাজনক বলিয়া আরবীকেই পাকিস্তানের হরফ করা উচিত।”
এর বিরুদ্ধে পূর্ববাংলায় প্রথম প্রতিবাদ ওঠে। ১২ মার্চ পূর্ববাংলা ব্যবস্থাপনা পরিষদের বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় অধিবেশন চলাকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে একটি বিক্ষোভ মিছিল সংসদ ভবন অভিমুখে যাত্রা করে। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবী হরফ চাই না’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত ছাত্র মিছিল পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেখানে গ্র্রেপ্তার হয় বেশ কয়েকজন ছাত্রনেতা।
১৯৫০ সালের ১১ মার্চ দলমত নির্বিশেষে রাষ্ট্রভাষা বাংলা সমর্থক প্রতিটি সংগঠন থেকে দুজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সাদামাটা অনুষ্ঠানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্যভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ‘আরবী হরফে বাংলা ভাষা’ নিয়ে বিতর্ক, প্রতিবাদ চলতে থাকে অথচ সরকার তা উপেক্ষা করে ১৮ এপ্রিল ১৯৫০ সাল থেকে পূর্ববাংলার বিভিন্ন জেলায় ২০ টি কেন্দ্রে আরবী হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্তবয়ষ্কদের প্রাথমিক শিক্ষার কাজ শুরু করে দেয়। একদিকে শিক্ষাখাতে পূর্বপাকিস্তান ছিল বিশাল বৈষম্যের শিকার অন্যদিকে চলে ভাষা ও বর্ণমালা বিলুপ্তকরণ প্রক্রিয়া।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত প্রতিবছরই পালন করা হয় ১১ মার্চ ও ১২ মার্চ তারিখটি।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারী পল্টনে নিখিল পাকিস্তান মুসলিম লীগের এক জনসভায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীন ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, -” পাকিস্তানের ‘একমাত্র’ রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু”.
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের ডাকে ৩০ জানুয়ারী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এ প্রতিবাদ ধর্মঘটের আয়োজন করে। ৩১ জানয়ারী বিকেলে মাওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সমাবেশে সর্বসম্মতভাবে গঠিত হয় “সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ”। ৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহরের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মঘট, শোভাযাত্রা এবং জনসভার আয়োজন এবং অর্থ সংগ্রহের জন্য ১১ এবং ১৩ ফেব্রুয়ারী পতাকা দিবস পালনের কর্মসূচি ঘোষণা করে।
৪ ফেব্রুয়ারী ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে প্রায় ৪ হাজার ছাত্রছাত্রীর একটি দীর্ঘ বিক্ষোভ মিছিল। ২১ ফেব্রুয়ারী সারাদেশে সাধারণ ধর্মঘট পালনের ঘোষনা দিয়ে শেষ হয় মিছিল পরবর্তী জনসভা।
১১ ফেব্রুয়ারী পতাকা দিবস পালন হয়। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ লেখা পতাকা বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করা হয়। বের করা হয় দুটি পুস্তিকা, ‘আমাদের ভাষার লড়াই’-বদরুদ্দিন উমর এবং ‘রাষ্ট্রভাষা কি এবং কেন?”-আনিসুজ্জামন।
২১ ফেব্রুয়ারী হরতালের প্রস্তুতি চলতে থাকে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে। আর সরকার ২০ তারিখ সন্ধ্যা ৬টায় ক্রমাগত একমাসের জন্য ঢাকায় সকল প্রকার সভা, সমাবেশ, মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ২১ তারিখ ছিল পূর্ববাংলা সরকারের বাজেট অধিবেশন।
সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারী রাতে সর্বদলীং সংগ্রাম পরিষদ বৈঠকে মিলিত হয় সভায় তুমুল বাক-বিতণ্ডার সূত্রপাত ঘটে। অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ করেন এই কারণে যে, এর ফলে সরকার জরুরী অবস্থার অজুহাতে সাধারণ নির্বাচন বন্ধ করে দিতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আবুল হাশিমের সভাপতিত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ সিদ্ধান্তের জন্য ভোট দেন। মাত্র তিন জন বাদে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের সকল সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে ভোট দেয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ আরো সিদ্ধান্ত নেয় যে, পরিষদের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার যৌক্তিকতা বুঝানোর চেষ্টা করবেন। কিন্তু ছাত্ররা যদি মেনে না নেয় তবে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি তখন থেকেই বিলুপ্ত হবে।
২১ ফেব্রুয়ারী সকালে ১৪৪ ধারা ও পুলিশের মহড়া উপেক্ষা করে দলে দলে শহরের ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে থাকে। ছাত্ররা কেন্দ্রীয় সংগ্রাম পরিষদের সিদ্ধান্তে বিক্ষুদ্ধ হয়ে নানা রূপ ধ্বনি দিয়ে শামসুল হককে স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য করে। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সভায় ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করার সিদ্ধান্তে ৪ জন, ৭জন, ১০ জন করে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বের হয়ে জমায়েত হলো মেডিকেল কলেজের প্রাঙ্গণে। কমপক্ষে ১০ হাজারেরও বেশি ছাত্রছাত্রী গ্রেপ্তার, লাঠচার্জ, কাঁদুনে গ্যাস ইত্যাদির মধ্যদিয়ে পরিষদ ভবন ঘেরাও করার উদ্দেশ্যে জমায়েত হয় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে; বেলা ৩ টায় পরিষদ ভবনের অধিবেশনের পূর্বেই ছাত্র পুলিশ সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকবার ছাত্রদের উপর কাঁদুনে গ্যাস ছেড়ে তাড়া করতে করতে পুলিশ মেডিকেল কলেজে ছাত্রাবাসের ভিতর ঢুকে পড়ে। প্রতিরোধকল্পে ছাত্ররাও ইটপাটকেল সমেত ঝটিকা আক্রমন করে। আক্রমনের প্রচণ্ডতায় দিশেহারা হয়ে আনুমানিক বেলা চারটার দিকে পুলিশ মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের সামনে গুলি চালায়। এই গুলি জব্বার ও রফিকের প্রাণ কেড়ে নেয়। এই গুলির আওয়াজ শুনে মেডিকেল কলেজ ছাত্রবাসের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন বরকত, একটি বুলেট তার ঊরুদেশ বিদ্ধ করে প্রচুর রক্তপাতের পর রাত আটটায় বরকত মারা যায়।

২১ ফেব্রুয়ারী যাঁরা শহীদ হলেন-
* সালাউদ্দীন (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)
* আব্দুর রাজ্জাক (বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)
* আবুল বরকত(বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র)
* রফিক উদ্দীন (বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের পুত্র)

ইতোমধ্যে গুলি চালানোর খবর শহরের আনাচে কানাচে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন অফিস আদালত সচিবালয় এমনকি ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীরা পর্যন্ত অফিস বর্জন করে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। ১৪৪ ধারার লেশমাত্র খুঁজে পাওয়া গেল না। আইন পরিষদের অধিবেশনে ঝড় ওঠে। আন্দোলনের নেতৃত্বে চলে আসে মেডিকেল কলেজ। ২১ ফেব্রুয়ারী রাতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ পুনঃগঠিত হয?। ২২ তারিখ হরতাল ও গায়েবানা জানাযার কর্মসূচী ঘোষিত হয়।
মেডিকেল কলেজের ছাত্রাবাসের ভিতরে গায়েবি জানাযা পড়া হয়। সমস্ত শহর থেকে পুলিশ উঠিয়ে সেনাবাহিনী তলব করা হয়। রেল কর্মচারীরা ধর্মঘট করে, সচিবালয়ের কর্মচারীরা দলে দলে মিছিল নিয়ে বেরিয়ে আসে। জানাযা শেষে সর্বস্তরের মানুষ শোভাযাত্রায় অংশ নিলে সেনাবাহিনী বাধা দেয়। বাধা ডিঙ্গিয়ে মিছিল এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে হাইকোটের সামনে আবার গুলি হয়। এতে মিছিলে অংশগ্রহনকারী সরকারি কর্মচারী শফিকুর রহমান নিহত হন (তিনি আইনেরও ছাত্র ছিলেন)। জনতা বংশালের দিকে অগ্রসর হলে আবারও গুলি চালানো হয়; এতে একজন নিরীহ রিক্সাওয়ালা নিহত হন। ২৩ ফেব্রুয়ারী সংবাদ পত্রে ৫জন নিহত, ১২৫ জন আহত, ৩০ জন গ্রেফতার সহ লাশ গায়েব করার নিন্দা করা হয় ঐদিনই সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের এক সভায় ২৫ ফেব্রুয়ারী প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
২৫ ফেব্রুয়ারী সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করে। সারাদেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে, ছাত্র জনতার ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদে সরকার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনে বাধ্য হয়।
১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী পাকিস্তানের ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সংবিধান গৃহীত হয়। এই সংবিধানের রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত ২১৪ নং অনুচ্ছেদ ছিল-
২১৪-(১) the state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali.


যাঁদের কাছে কৃতজ্ঞঃ
ডঃ মোহাম্মদ হাননান-বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী-নির্বাচিত রাজনৈতিক প্রবন্ধ।
আসাদুজ্জামান আসাদ-স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি।
জহির রায়হান-একুশে ফেব্রুয়ারী।
পোস্ট আকারে সাজিয়েছেনঃ
ইশতিয়াক।
পোস্টটি সাহিত্য.কম এ প্রকাশিত।

Sunday, February 19, 2012

তিনি আমার বড় ভাই-১ | বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

আমার দেশ-এর নির্ভীক সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের অনুরোধে তার পত্রিকায় লেখা দেয়ার কথা ক’দিন থেকেই ভাবছিলাম। কী লিখি কী লিখি ভাবতে ভাবতে আমার পিতৃপ্রতিম বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ২০ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠে চতুরঙ্গ পাতায় ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ লেখাটি দিয়েই আমার দেশ-এ লেখার সূচনা করছি। পরম করুণাময় আল্লাহ যেন আমার সহায় হোন।
গত ২০ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠে চতুরঙ্গ পাতায় ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ শিরোনামে একটি মহামূল্যবান লেখা বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাকে উপহার দিয়েছেন। নটী বিনোদিনী নাটকে একদিন এক দর্শক গিরিশ ঘোষের অভিনয় দেখে মঞ্চে জুতা ছুড়ে মেরেছিল। তিনি তা মাথায় তুলে তার নাট্যাভিনয়ের সার্থকতা খুঁজেছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবও তার নটী বিনোদিনী দেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর এ লেখা আমার কাছে গিরিশ ঘোষের মঞ্চে ছুড়ে দেয়া দর্শকের আশীর্বাদের মতোই মনে হয়েছে। লেখাটার শিরোনাম দিতে চেয়েছিলাম ‘সে যে আমার বড় ভাই’, সাহস পেলাম না। কারণ তিনি আমার শব্দে শব্দে দাড়ি-কমায় ভুল ধরতে পারেন। তাই নির্বাসনের সময় শোনা মান্না দে’র কণ্ঠে ‘সে যে আমার ছোট বোন’—বুকের ভেতর তোলপাড় করা গানটির অনুকরণেই বলতে চেয়েছিলাম ‘সে যে আমার বড় ভাই’। কিন্তু তিনি যদি ব্যাকরণগত ভুল ধরেন, যদি আবার বলে বসেন, ‘দেখেছেন ছেলেটা কত বেয়াদব। বড় ভাইকে তিনি না বলে সে বলেছে।’ তাই শিরোনাম দিলাম ‘তিনি আমার বড় ভাই’ যদিও লয়-তালে জোর হলো না। কিন্তু সত্যিই তিনি বড় ভাই, পিতার সমান। তার এ লেখা পড়েও মনে হলো তিনি আমাকে শক্তপোক্ত করতেই অমন গালাগাল করেছেন, মোটেই দুর্বল করতে নয়। আরও সবল, সাহসী ও যোগ্য করতেই হয়তো এ লেখা লিখেছেন। লেখাটি পড়ে আমার স্ত্রী কেঁদেছে। ছেলেমেয়েদের মন খারাপ হয়েছে। দু’দিন ধরে শাহানা-দুলাল ছটফট করছে, ওরা ভাবছে পরিবারের মধ্যে নিজেরা একজন আরেকজন সম্পর্কে এমন বললে কেমন হয়? আমার কিন্তু তেমন মনে হয়নি। ২০-২১ তারিখ দুটো লেখা তৈরি করছিলাম, তাই বড় ভাই’র ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ পড়িনি। ২২ তারিখ লেখাটি পড়ে মোটামুটি ২০টি ভাগে ভাগ করে লেখার অন্তর বা মর্মবাণী খুঁজতে চেষ্টা করছি। আমার এ লেখা লতিফ ভাই’র লেখার অস্বীকৃতি নয়, শুধু কিছু ভাবনা। আর ওনার ৭৩-এর ওপর বয়স। তাই যদি আগে-পিছে কিছু ভুলে গিয়ে থাকেন তা অনুগত সন্তানের মতো ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা মাত্র। বড় ভাই তো বড় ভাই-ই। তিনি কোনোদিন আমার থেকে ছোট হবেন না। বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা, যশ-খ্যাতি সবই তার বেশি। আমার ছায়ায় তিনি থাকুন এটা কখনও চাইনি। তার ছায়ায় নিরাপদে থাকি, এটাই আজীবন কামনা করেছি। ছায়া যদি না পেয়ে থাকি সেটা তার নয়, সব দোষই আমার। সব ছায়ারই তো একটা সীমা থাকে। আমি পৌঁছার আগেই যদি তার ছায়ার সীমা ভরে গিয়ে থাকে, সেখানে তার কী করার থাকতে পারে? সেটা তো আমারই ব্যর্থতা।
’৬৬-৬৭তে ছাত্রনেতা হিসেবে লতিফ সিদ্দিকী কুমিল্লা শহরে একদিন আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর সামনে বক্তৃতা করে সারা জেলা মাতিয়ে এসেছিলেন। সেদিন আমার বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। সম্ভবত একই বছর ভৈরব কলেজে ছাত্রদের নবীনবরণে লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন প্রধান অতিথি। আর আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ছিলেন সাধারণ বক্তা। সে সময় লতিফ সিদ্দিকীর ভাই হিসেবে যেমন গর্ব করতাম, আজও তেমনি গর্ববোধ করি। লন্ডনে তার এবং সাজেদা চৌধুরীর উপস্থিতিতে যেদিন আমাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল, সেদিন আজকের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন সাধারণ শ্রোতা। তাকে মঞ্চে এনে বক্তৃতা করার সুযোগ সেদিন এই নালায়েক আমিই করে দিয়েছিলাম। সেই সময় আমার বাবা ছিলেন, মা ছিলেন। আজ তারা কেউ নেই, আমি এতিম। মুরুব্বি হিসেবে মাথার ওপর একমাত্র বড় ভাই আছেন, তাকে কী বলি। পিতা সন্তানকে শাসন করে, সে তো তার ভালোর জন্যই। তিনিও হয়তো তাই করেছেন। এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে বা লিখতে চাইনি। কিন্তু চারদিক থেকে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে—আপনাকে এসবের জবাব দিতেই হবে। কী জবাব দেব, সবকিছুর কি জবাব থাকে? সব ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে আমি কী বলব? আর সত্য না হলেও আমার কোনো মুরুব্বি যদি অসত্যও বলে থাকেন, প্রতিবাদ করে তার সম্মান নষ্ট করব? তা তো করতে পারি না। সেদিন বিকালে এক পত্রিকা অফিসে আমার ছেলেবেলার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বসতে না বসতেই সে বলে বসল, ‘আরজু ভাই বাচ্চাকাল থেকেই তোকে দেখতে পারে না, তোর ওপর জুলুম করে। হুকুম চালায়, মারধর করে। খেলার মাঠ থেকে তোর কান ধরে নিয়ে যেত। এখনও তেমন করছে। তোর এর জবাব দেয়া উচিত।’ বললাম, ‘বন্ধু কী জবাব দেব? খালি তুই তোর আরজু ভাই মানে লতিফ সিদ্দিকীর আমাকে বকাঝকা, বন্ধুদের সামনে কান ধরে নেয়ার অপমানই দেখলি? আমার অসুখ হলে মাথায় পানি দিতে, হাত-পা টিপতে দেখলি না? বড় ভাই পিতার সমান। তিনি আমার মাথা-বুক-পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কখন পা কোলে নিয়ে পরম যত্নে আমার যন্ত্রণা কমাতে চেষ্টা করতেন তা কি দেখেছিস? তিনি একটু জেদি মানুষ, আইয়ুব- মোনোয়েমের সময় সারা জেলা তার নামে পাগল ছিল। দেশে চার-পাঁচজন ছাত্রনেতার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কিন্তু কী এমন নয় মাসের যুদ্ধ হলো, যুদ্ধ শেষে বজ্রকে লতিফ সিদ্দিকীর ভাই না বলে লতিফ সিদ্দিকীকে যদি কাদের সিদ্দিকীর ভাই বলে তাহলে তো তার রাগ হওয়ারই কথা। তাই রাগ হয়ে ক্ষোভে বা কোনো হতাশায় যদি দু’কথা লিখেই থাকেন তবুও তো তিনি আমার বড় ভাই।’ তবু সে বলল, ‘না, তোর সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা তাতে তার লেখাটার প্রতিটি শব্দের জবাব দেয়া দরকার। ধরে নে, আরজু ভাই মাস্টার হয়ে তোকে প্রশ্ন করেছে, তুই প্রশ্নের জবাব দে।’ আজ ক’দিন ধরে এমনি কথা আরও অনেকেই বলছেন। তাই ভাবলাম, সত্যিই তো যে অভিযোগ-অনুযোগ আমার নামে উল্লেখ করেছেন, এটাই যদি অন্যের নামে হতো এবং আমাকে মতামত বা উত্তরের জন্য তিনি পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে গুরুজনের নির্দেশ পালনে উত্তর তো কিছু দিতেই হতো। ঠিক সেরকমই এই বিশটা প্রশ্নের উত্তর লিখে খাতাটা তার কাছে জমা দেই, দেখি তিনি কত নাম্বার দেন। সারা জীবনই তো ফেল না করলেও তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না কোনোদিন। তাই সুযোগ যখন এসেছে বদর বদর বলে পরীক্ষাটা তো দিয়ে দেই। ফেল করি করলাম। কিন্তু কোনো রকমে যদি পাস করে ফেলি তখন কতই না ভালো হবে। নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনে ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে শুধু গালি আর গালি ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই পেলাম না। তাই বড় ভাই, ক্ষমা করবেন।
এক. ‘অবশেষে বঙ্গবীর খোলসমুক্ত হলেন। ঘোষণা দিলেন, জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক, শেখ মুজিব নয়। যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি?’ পত্রিকার এক কলামের চার লাইন। মূল জিজ্ঞাস্য মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক, শেখ মুজিব নয়।
(ক) আমি কখনও বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব বলি না। তিনি আমার পিতা, নেতা ও ভালোবাসা। আপনি যদি পত্রিকায় এ ধরনের দেখে থাকেন তাহলে ওটা পত্রিকার কৃতিত্ব। পত্রিকার লেখকের কৃতিত্ব, আমার নয়। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।
(খ) জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক—ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতার জনক। এই তিনটি বিশেষণের পর বঙ্গবন্ধুকে আমি কোনোক্রমেই স্বাধীনতার ঘোষক মনে করি না বা করতে পারি না।
ঘোষকের চাইতে স্বাধীনতার মর্যাদা, বাংলাদেশের মর্যাদা, স্বাধীনতার জনকের মর্যাদা অনেক বেশি। আমি যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জনক মনে করি, তেমনি স্বাধীনতার জনকও মনে করি। তাহলে এখানে স্বাধীনতার ঘোষক কে? বাংলাদেশের একজন জনক থাকলে যদি একজন ঘোষকের দরকার হয় তাহলে খুঁজে দেখি স্বাধীনতার ঘোষক কে? বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা কমবেশি সবার জানা। কেউ কেউ বলছে সেই সময় ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চিটাগাং পাঠানো হয়েছিল, কেউ বলছে নৌবাহিনীর কোনো বেতারে সে ঘোষণা ধরা পড়েছে। আমি নিজেও ‘স্বাধীনতা ৭১’-এ লিখেছি, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আমরা কাগমারী ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে পেয়েছিলাম যা টাঙ্গাইল জেলা সংগ্রাম পরিষদের হাতে দেয়া হয়েছিল। সেই ঘোষণাটি কার? অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তাহলে তিনিই ঘোষক। আলহামদুলিল্লাহ। তবে ওই ঘোষণা তো অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর, কিন্তু তিনি ঘোষক নন। বঙ্গবন্ধুকে কেউ ঘোষক বলে না, মনেও করে না। সবাই জনক মনে করে। ওই ঘোষণার জন্য আমি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার জনক মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণাটি যদি আমি পাঠ করতাম বা করতে পারতাম এবং জাতি স্বীকৃতি দিত যে আমি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছি, তাহলে আমিই হতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক অথবা ঘোষক। কোনো চলচ্চিত্র বা নাটকে যে প্রধান পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করে, সে হয় নায়ক। মহিলা প্রধান চরিত্রে যে অভিনয় করে সে হয় নায়িকা। কিন্তু নায়ক-নায়িকা কেউ কাহিনীটি তৈরি করে না। কাহিনীটি তৈরি করে একজন দক্ষ কাহিনীকার বা লেখক। নায়ক-নায়িকা শুধু অভিনয় করে। আমিও এক্ষেত্রে মনে করি, আমরা ছিলাম অভিনেতা-অভিনেত্রী। দক্ষ কাহিনীকার, প্রযোজক, পরিচালক সবই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এখন আসুন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদৌ ঘোষক কিনা। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার নির্দেশের পর আমরা বহু জন আমাদের যার যার অবস্থানে থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও যে দেননি তাও নয়। জিয়াউর রহমানের আগে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন বেতার কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তার মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, এমআর সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে। তখন ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহের সময়। তাই অনেক কষ্ট করে জিয়াউর রহমানকে এনে তাকে দিয়েও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে ঘোষণার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো রেকর্ডও নেই। কিন্তু যেটার অস্তিত্ব আছে এবং যেটার অস্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ছিল সেটা কী? সেটা হলো— ‘I Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman.’ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধের সময় সেটা বার বার বাজানো হয়েছে। শুধু যুদ্ধের সময় নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে ৭ মার্চের ভাষণ যেমন বাজানো হয়েছে, তীর হারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে; তেমনি এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্রে ‘কাদেরিয়া বাহিনীর গাবুর মাইর’ এবং মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে তার ওই ঘোষণায় যদি তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়, আমি ফেরাব কী করে? তাহলে কি আওয়ামী লীগাররা চান রাষ্ট্রের জনকের পদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রের ঘোষকের পদে নামিয়ে আনতে? পৃথিবীর সর্বত্র সব ঘটনার ঘোষক থাকে। আমার তো মনে হয় ঘোষকের চাইতে ঘোষণার মালিক অনেক বড়। জিয়ার কণ্ঠে, ‘I Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman" কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষণাটি হলে কেমন হতো, 'I Seikh Mujibur Rahman do hereby declare indepedence of Bangladesh on behalf of our great Major Ziaur Rahman.' ধরে নিলাম মেজর জিয়াউর রহমানের নামে বিষ। মেজর জিয়ার নাম বলা হলো না। বলার দরকারও ছিল না। তারপরও একটা কিছু তো বলতে হতো, সেটা কী হতো— 'I Seikh Mujibur Rahman do hereby declare indepedence of Bangladesh.' কোথাও কি তার কণ্ঠে এমন কথা আছে? বঙ্গবন্ধুর হাজারো বক্তৃতা-বিবৃতি আছে, তার কণ্ঠে হাজারো ঘোষণা আছে। কিন্তু ওরকম বাংলা-ইংরেজিতে কোনো কিছু আছে কি? নেই। বলা যেতে পারে, লিখিত ঘোষণা তো আছে, ৭ মার্চের ভাষণ আছে। কোটি কোটি বার সেটা স্বীকার করি। তাই বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণার মালিক। ওটি যদি তিনি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করতেন তাহলেও হয়তো আভিধানিক অর্থে তাকে ঘোষকও বলা যেত; কিন্তু তিনি তা না করায় তার ওই নির্দেশ, হুকুম বা ঘোষণা যিনি পাঠ করেছেন আভিধানিক অর্থে তিনিই ঘোষক। এরপরও যদি মুক্তিযুদ্ধের সময়ই কোনো আদেশের দ্বারা বলা হতো যে যেভাবেই যত ঘোষণাই দিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। সেখানেই ল্যাঠা চুকে যেত। আজ এতদিন পর রাজনৈতিক কারণে স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাধীনতার জনককে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে গিয়ে তাকে বড় বেশি ছোট করার চেষ্টা চলছে। আমার এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে যে ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত হয়েছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে শুনেছি, তাতে যদি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক হয়, তারা লাভবান হয়, আমার কিছু করার নেই। আমি যা শুনেছি তা অস্বীকার করতে পারব না; যারা আওয়ামী লীগ করেন, তারা অস্বীকার করতেই পারেন। যেমন অধ্যাপক ইউনূসের বদলে সন্তু লারমা আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত্ এ কথা বলে প্রধানমন্ত্রীকে সন্তু লারমার সমান করেছেন। আমি ছেলেবেলায়ই কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় করতাম না, আর এই বয়সে কোনো ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এ নিয়ে আল্লাহর কাছে গোনাহগার হতে রাজি নই। জনাব বীর উত্তম জিয়ার ভক্তরা এবার বঙ্গবন্ধুকে তাদের দলে নিয়ে নিয়েছে, তারা যদি বোঝে বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য, তাহলে আপনাদের সর্বনাশ।
দুই. ’৭৫-এ ভারত সীমান্তে বসে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ পুত্র এখন জীবিত। প্রতিজ্ঞা-প্রত্যয় ঘোষণা করে যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারব ততক্ষণ মাংস খাব না। সে প্রত্যয়দৃপ্ত ঘোষণাও কিন্তু রক্ষা করেননি বঙ্গবীর।’
(ক) আমি এখনও জীবিত কিনা। এই লেখাতেই প্রমাণ করে আমি জীবিত। কারণ কোনো কবরবাসী লিখতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর আমি চতুর্থ সন্তান কিনা, এর স্বীকৃতি বর্তমান কোনো আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে নিতে চাই না। দেশবাসী অনেক আগেই আমাকে সে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। মানুষ হিসেবে ভুলত্রুটি, সফলতা-ব্যর্থতা অনেক কিছুই আমার আছে। কিন্তু আমি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের বরপুত্র, এতে আওয়ামী লীগ ছাড়া সমগ্র দেশবাসীর কারও কোনো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
(খ) ‘যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারবো ততক্ষণ মাংস খাবো না।’ সে সত্যদীপ্ত ঘোষণাও নাকি আমি রক্ষা করিনি। লতিফ ভাই’র শক্তিশালী কলম প্রতিরোধ করবে কে? তিনি মরাকে তাজা করতে পারেন। কিন্তু তার দুর্বলতা তিনি যখন কোনো কিছু বলেন বা লিখেন তখন আগে-পিছে বিবেচনা করেন না, কোনো কাগজপত্র রাখেন না। ইদানীং রাখেন কিনা বলতে পারব না। কিন্তু আমি যখনকার কথা বলছি তখন তিনি রাখতেন না। তার সফলতা তিনি খুব উচ্চশিক্ষিত। আমার সফলতা আমি একেবারে অশিক্ষিত, বেশি লিখতে পারি না। কেউ কিছু লিখলে তা যত্ন করে রেখে দেই। স্বাধীনতার আগে তেমন বোধশক্তি ছিল না। স্বাধীনতার অনেক পরে বিশেষ করে ’৭৫-এর পর বোধটি খুবই চনমনে হয়েছে। বড় ভাই সিগারেটের খাপে যা লিখে পাঠিয়েছেন তাও আমার কাছে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুকরো কাগজে ‘ভাই বজ্র’ বলে যা লিখেছেন তাও আছে। তাই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সুবিধামত শব্দ বসিয়ে নিজের পক্ষে রায় নিতে চাইলেই পারবেন, তা হবে না। যদি বিচারালয় থাকে তাহলে সেখানে সাক্ষী সাবুদও থাকবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার লিখিত-অলিখিত আমার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার যতদিন প্রতিশোধ ও প্রতিকার করতে না পারব ততদিন মাংস খাব না। আমি তখন ছোট ছিলাম। হাদিস-কোরআন, বই-পুস্তক তেমন পড়া ছিল না। পড়ালেখা থাকলে অমন প্রতিজ্ঞা করতাম না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও জন্য ওই ধরনের কোনো প্রতিজ্ঞা করলে আল্লাহ নারাজ হন, সেটা আমি মোটেই জানতাম না। তারপরও কোনো প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করিনি। কথাটা যখন তুলেছেন তখন অবশ্যই খোলাসা করা দরকার।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন, আমি তখন টাঙ্গাইল জেলার গভর্নর। ২০/৩০ বাবর রোডের যে ঘরে বসে লিখছি, আমি সেই ঘরেই থাকতাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়েছিলাম ছোট বোন রহিমা ও শুশুমার কাছ থেকে। আমি জীবনে খুব একটা পালাইনি। প্রথম প্রথম আপনার মারের ভয়ে কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়েছি, অন্য সব সময়ই প্রকাশ্যে থেকেছি। মুক্তিযুদ্ধেও আমাকে আত্মগোপন করতে হয়নি। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত এই পাঁচ দিন ঢাকা শহরে আত্মগোপন করে থেকেছি। বিশদভাবে সেটা আর একটা লেখায় লিখেছি। ছাপা হলে সবাই জানতে পারবেন। সে রাতে আমি যেমন বাবর রোডের বাড়িতে ছিলাম, আপনিও এমপি হোস্টেলে ছিলেন। টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে খুব সকালে বাবর রোডে এসেছিলেন। কারণ ভাবী লায়লা সিদ্দিকী এবং আপনার কন্যা রিয়া তখন পরম যত্নে বাবর রোডেই থাকত। আমি জানতাম না যে আপনি এসেছিলেন। তার একটু পরেই রহিমার ফোনে বুঝেছিলাম, সেনাবাহিনী ক্যু করেছে। আমিও বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে গজনবী রোডে প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের বাসায়, দুপুরের পর খিলজী রোডে জনাব আবদুস সবুর দারোগার বাড়িতে। সেখানেই সারাদিন ছিলাম। মন ছিল খুবই ভারাক্রান্ত। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় যখন খাবার দেয়া হয় তখন বাংলাদেশ টিভিতে মোশতাক মন্ত্রিসভার শপথ এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ হচ্ছিল। আনুগত্য প্রকাশের প্রথমে ছিল রক্ষীবাহিনী, তার নেতা আনোয়ারুল আলম শহীদ, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, পুলিশের আইজি নুরুল ইসলাম, বিডিআরের মে. জে. খলিলুর রহমান। মন্ত্রিসভার অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান বাদে বঙ্গবন্ধুর সব মন্ত্রীই ছিলেন।
সেই সময় আমাকে মাংস খেতে দেয়া হয়েছিল। দু’এক টুকরা বোধ হয় খেয়েছিলাম। কিন্তু যখন টিভির পর্দায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভাকে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় দেখলাম, তখন মাংসে চিবুনি দিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি যেন বঙ্গবন্ধুর মাংস খাচ্ছি। মুখ থেকে খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। চোখ থেকে টপটপ করে খাবার থালাতে কয়েক ফোঁটা পানি পড়েছিল। আমার জানামতে আল্লাহার নেয়ামত খাবারের দানা আমি মুখ থেকে ফেলিনি। এখনও এদিক-ওদিক ভাত পড়লে খুটে খাই। মা-বাবা গুরুজনের কাছে শুনেছি, ভাতের থালায় চোখের পানি পড়লে তার কপালে ভীষণ দুঃখ হয়। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছিলাম বলে বুকের ব্যথা সইতে না পারায় মনের অজান্তে ক’ফোঁটা চোখের পানি না হয় সেদিন ভাতের থালায় পড়েছিল। সেই চরম দুঃখের সময় বঙ্গবন্ধুর মাংস কামড় দিচ্ছি ভেবে ভুল করে এক গ্রাস খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। সেই অপরাধের ৪০ বছর শাস্তির পরও কি আল্লাহর দরবারে আমি মাফ পেতে পারি না? বড় ভাই, আমি কীভাবে প্রতিজ্ঞা ভাঙলাম। প্রতিজ্ঞা করাই অন্যায় হয়েছিল। তারপরও আমি তো সেই অন্যায় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে আল্লাহর দরবারে পাপী গোনাহগার হয়েছি। আপনারাই তো বলছেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। মাংসের লোভ আমার ছিল তা কিন্তু নয়। আমি কি ভারতে নির্বাসিত জীবনে কখনও মাংস খেয়েছি? কখনও না। দেশে এসেই খেয়েছি? তাও না। আমার প্রিয়তমা ভগ্নী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর যেদিন গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তা কি মনে আছে? আমি তখন ভারতের আজমীরে ছিলাম। আমি মাংস খাই না শুনে খাজা বাবার মাজারের এক বয়সী মুয়াল্লিম আমার দুটি হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা, প্রতিজ্ঞা করে আল্লাহর দেয়া কোনো হালাল নিয়ামক না খাওয়া ভালো নয়। অজান্তে মানুষের দ্বারা কত অন্যায় কাজ হয়, কত হারাম জিনিসও খেয়ে ফেলে। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন হালাল মাংস হালাল করেছেন মানুষের প্রতি, আর আপনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য সে মাংস খান না? ঠিক আছে, না খেলেন। তবু কোরবানির মাংস খাবেন।’
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৩ সালে কবে কোরবানি হয়েছিল। আমি সেদিন ’৭৫-এর পর প্রথম কোরবানির মাংস মুখে দিয়েছিলাম। অতগুলো বছর মাংস না খাওয়ায় এখন খুব একটা ভালো লাগে না। তাই তেমন খাই না। আপনি বলছেন, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ তো সেদিনই হয়েছে যেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই অসহায় কন্যার মধ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরি। সেটাও বঙ্গবন্ধু হত্যার একটা প্রতিকার। ’৯১ সালে না হোক, ২১ বছর পর ’৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জননেত্রী হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন— সেটাও তো একটা প্রতিকার। সর্বোপরি ’৯৭ সালে বিচার করে যারা প্রত্যক্ষ হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের কয়েকজনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। আমি যেখানে পিতা হত্যার বিচারের জন্য জীবন-যৌবন খুইয়েছি, অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় হওয়ার পর ’৯৭-এর ৮ নভেম্বর সংসদে একটি ধন্যবাদ আলোচনা হয়েছিল। অনেকেই সেই আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ করতাম না বলে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়ের ওপর সংসদে আলোচনায় আমাকে সুযোগ পর্যন্ত দেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার যারা পরিকল্পনা করেছিল তাদের বিচার করতে না পারলেও প্রত্যক্ষ খুনিদের কয়েকজনের বিচার তো আপনারা করেছেন। তাই আমাকে মাংস না খাইয়ে শুঁটকি বানিয়ে লাভ কী? আমার কি ক্ষমতা আছে আজ প্রতিশোধ নেয়ার, প্রতিকার করার? ঢাল-তলোয়ার সবই তো আপনাদের হাতে। যে প্রতিজ্ঞা করা যায় সে প্রতিজ্ঞা ভাঙার মানুষ আমি নই। অতীতেও ভাঙিনি, ভবিষ্যতেও ভাঙব না। আপনি কেন যে প্রতিজ্ঞা ভাঙার প্রশ্নটা তুললেন, আমি একেবারেই বুঝতে পারলাম না। শর্টকাট না করে ব্যাখ্যা করলে আমার মতো দেশবাসীরও তো ভালো হতো। আর আমি তো এখন আওয়ামী লীগ করি না। বঙ্গবন্ুব্দকে তো আর আমাদের থাকতে দেননি। আপনারা সব ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাই আমি মাংস খাই আর না খাই, বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রতিজ্ঞা রক্ষা করি না করি এজন্য অত ছটফটানি কেন? বঙ্গবন্ধু তো আজ আর জাতীয় সম্পদ নন, তিনি সম্পূর্ণই আপনাদের পৈতৃক সম্পদ। বঙ্গবন্ধুকে সবার জন্য ছেড়ে দিন। সব দেশবাসীর জনক হতে দিন। তখন তার মান-মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব হবে সবার। কথাগুলো আমার জায়গায় আপনি হলেও এমনি করেই বলতেন—যা আমি বলছি। আমার চাইতে ভালো লেখাপড়া জানেন বলে আরও ভালো করে বলতেন।
সূত্র : দৈনিক আমার দেশ এ প্রকাশিত।

Monday, February 13, 2012

ভালবাসা দিবস ; কিছু কথা

পশ্চিমা বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে এখন বাংলাদেশেও ১৪ই ফেব্রুয়ারী "ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালবাসা দিবস" পালন করা হচ্ছে। তথাকথিত প্রেম পিয়াসী তরুণ তরুণীরা নানা ধরনের অশ্লীলতা বেহায়াপনা ও নোংরামির মাধ্যমে দিবসটি পালন করে থাকে।

ভ্যালেন্টাইনস ডে বা ভালবাসা দিবসের ইতিহাস নিয়ে ইতিহাসবিদদের মাঝে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে যে দুটি মত বেশী গ্রহণযোগ্য তা হল-
১) সেন্ট ভ্যালেন্টাইন একজন রোমান পাদ্রীর নাম। এই পাদ্রী চিকিৎসকও ছিলেন। রোমের সম্রাট দ্বিতীয় কাডিয়াসের আদেশে ভ্যালেন্টাইনকে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। তিনি যখন জেলে বন্দি ছিলেন তখন ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কাগজে ভালবাসার কথা লিখে জানালা দিয়ে ছুড়ে মারত। তিনি জেলে বন্দি থাকা অবস্থায় একজন অন্ধ মেয়ের চিকিৎসা করে দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দেন। ফলে মেয়েটির সাথে তার যোগাযোগ ঘটে ও তার প্রতি ভালবাসা হয়। এই পাদ্রী তার মৃত্যুর পূর্বে মেয়েটিকে লেখা একটি চিঠিতে লিখে যান Form your valentine.
এই সেন্ট ভ্যালেন্টাইন এর নামানুসারে পোপ প্রথম জুলিয়াস ৪৯৬ খৃষ্টাব্দে ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে সেন্ট ভ্যালেইন্টানস ডে ঘোষণা করে।

২) ১৪১৫ সালে তাজিন কোর্টের যুদ্ধে ইংরেজদের কাছে ফরাসী বাহিনী পরাজিত হয় এবং ফরাসী প্রিন্স ও কবি শাল ইংরেজদের হাতে বন্দি হন। ইংরেজদের জেলে দীর্ঘ ২৫ বছর বন্দি ছিলেন প্রিন্স শাল। বন্দি থাকা অবস্থায় সেখানে তিনি দেখতে পেলেন প্রতি বছর ১৪ই ফেব্রুয়ারী কিছু তরুণ তরুণী একত্রিত হয়ে আনন্দ ফুর্তি করত এবং লটারীর মাধ্যমে পরবর্তী এক বছরের জন্য সঙ্গী নিবার্চন করত। বিষয়টি প্রিন্স শালের খুব পছন্দ হয়। তাই তিনি বন্দি থেতে মুক্ত হয়ে নিজ দেশে এসে ১৪ই ফেব্রুয়ারীকে আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে পালন করার উদ্যোগ নেন। এই থেকে অনেক ফরাসীর মতে ভালবাসা দিবসের সূচনা হয়।
সূচনালগ্ন থেকেই এই দিবসটি ভালবাসার আসল চেতনা থেকে দূরে সরে গিয়ে নানা ধরনের অশ্লীলতা আর নোংরামির মাধ্যমে পালন হতে থাকে। এই দিন ভালবাসায় মনের ছোঁয়া পাওয়ার চেয়ে দেহের ছোঁয়া পেতেই মরিয়া হয়ে উঠে তরুণ তরুণীরা। ধীরে ধীরে এই দিবসটিতে বেহায়াপনা বাড়তেই থাকে। তাই ফ্রান্স সরকার ১৭৭৬ ইং সালে দিবসটির উদযাপন বন্ধ ঘোষণা করে। ১৭ শতকে ইংল্যান্ডে ও নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় দিবসটি। সময়ের পরিক্রমায় ধীরে ধীরে জার্মানী, ইটালী, হাঙ্গেরী, অষ্ট্রিয়া, থেকেও বিলুপ্ত হয়ে যায়। চালু থাকে আমেরিকা আর ব্রিটেনে আর ধীরে ধীরে প্রসার লাভ করতে থাকে মুসলিম দেশগুলোতে।
এই দিবসটি বাংলাদেশে পালিত হয় নব্বই এর দশকের শেষের দিকে। প্রথমে শহরগুলোতে সীমাবদ্ধ থাকলে ও এখন এর প্রসার ঘটেছে গ্রামে গঞ্জে পাড়া মহল্লায়। এই দিবসটিতে স্কুল, কলেজ, পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে তরুণ-তরুণী, কিশোর-কিশোরীরা প্রেম বিনিময়ের নামে অবাধ মেলামেশা আর যেসব কর্মকান্ড করে তা কোন সভ্য মানুষ সমর্থন করতে পারে না। আর গুলশান, বারিধারায় কি সব আজে বাজে ঘটনা ঘটে তা ১৫ই ফেব্রুয়ারির পত্রিকা ও টিভি নিউজ দেখলেই বুঝা যায়। এই দিবসটি যদি এভাবে পালন হতে থাকে তবে অদুর ভবিষ্যতে আমাদের আগামী প্রজন্মের চরিত্র কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে তা ভেবে দেখার সময় হয়েছে। এখন থেকেই এর একটি ব্যবস্থা হওয়া প্রয়োজন।

পরিশেষে বলবো, ভালবাসা মানবতার জন্য একটি সর্বজননী শব্দ। এর জন্য বিশেষ কোন দিবসের প্রয়োজন হয় না। ভালবাসা শুধু তরুণ তরুণী, আর কিশোর কিশোরীদের অবাধ মেলামেশার নাম নয়। আমাদের ভালবাসা হোক মানবতার জন্য, স্রষ্টা আর স্রষ্টার সকল সৃষ্টির জন্য।

Sunday, February 5, 2012

কষ্ট || হানিফ মাহমুদ

কষ্ট কোথায় গেল?
আমি তো পাচ্ছিনা আর কষ্ট
আমার তো সব হারিয়ে গেছে
তবুও কেন পাচ্ছি না কষ্ট

কষ্টের রং নাকি নীল
কই আমি তো নীল দেখি না
চারিদিকে শুধু সাদা সাদা লাগে
আমি তো পাচ্ছি না আর কষ্ট

সবাই নিজের কাজে ব্যস্ত
আমাকে কেউ আর সময় দেয়না
তবু তো আমি পাইনা কষ্ট
আমি কেন কষ্ট পাচ্ছি না?

কষ্ট তো পাওয়ার কথা ছিল আমার
তবুও কেন পাচ্ছি না?
কষ্টের মাঝে তো ডুবে থাকব
কিন্তু নাহ, আমি তো কষ্ট পাচ্ছি না

কষ্ট সইতে সইতে আজ
কষ্ট কি তা বুঝি না
হৃদয়টা বুঝি পাথর হয়ে গেছে
কোন কষ্ট আর পাই না!

সূত্র : আমার বাংলা ব্লগ

Saturday, February 4, 2012

গ্রন্থালোচনা : শিকল ভাঙার ছড়া

গ্রন্থালোচনা : শিকল ভাঙার ছড়া
লেখক : আমিনুল ইসলাম মামুন
আলোচনায় : জহির রহমান

এ সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বিষয় টিপাইমুখ বাঁধ। শুধু বাংলাদেশেই নয়; ভারতেও এটি আলোচিত বিষয়। এই বাঁধের প্রভাব সম্পর্কে আমরা অবগত হয়েছি। অবগত হয়েছে বিশ্বের মানুষও। এ বিষয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা থেকে ওঠে এসেছে এর নানা দিক। এর প্রভাবে ভারতের কিছু অংশসহ বাংলাদেশের বিরাট একটি অংশ; বিশেষ করে সিলেট মরুভূমিতে পরিণত হবে বলে পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই জনগণকে স্পষ্ট করেছেন। তারা বলেছেন, এই বাঁধের ফলে ধ্বংশ হবে এ অঞ্চলের পরিবেশ, জীব বৈচিত্র্য, কৃষি উৎপাদনসহ অর্থনীতি। মানুষের স্বাভাবিক জীবনধারা হুমকির মুখে পড়বে। প্রতিবেশি বন্ধু দেশ বলছে এতে নাকি বাংলাদেশের কোন তিই হবে না। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে নদীমাতৃক এ দেশের পদ্মাসহ ছোট-বড় অনেক নদ-নদী বিলুপ্ত হয়েছে, আর কিছু এখন মৃত প্রায়।
এই ভয়াবহ তির মোকাবেলার জন্য আমাদের করণীয় কি? করণীয় হচ্ছে এই বাঁধের  বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানানো। কয়েকটি রাজনৈতিক দল আনুষ্ঠানিকভাবে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করেছে এবং করে যাচ্ছে। তাদের সাথে বসে নেই কবি-লেখকগণও। ছড়া-কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে তারা প্রতিবাদ করে যাচ্ছেন। তাদেরই মধ্যে একজন, সময়ের সাহসী ছড়াকার আমিনুল ইসলাম মামুন। টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে তিনি লিখেছেন অগ্নিঝরা ছড়া। সেই ছড়াগুলোরই গ্রন্থিত রূপ- ‘শিকল ভাঙার ছড়া’ নামক বইটি। ইতিমধ্যে এই গ্রন্থটি টিপাইমুখ বাঁধ বিরোধী আন্দোলনের ‘গোলা-বারুদ’ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে,  টিপাইমুখ বাঁধের প্রতিবাদে লিখিত (বাংলাদেশ ও ভারতে) এটিই প্রথম ছড়ার বই। বইটিতে ােভ আর প্রতিবাদের সুরে ছড়াকার আমিনুল ইসলাম মামুন লিখেছেন-

“নদীর বুকে বাঁধ দিলে
দেশের বুকে হাত দিলে
হাতও নিবো পা-ও নিবো
মুণ্ডু কেটে তা-ও নিবো।”

আবার ‘আমরা তিতুমীর’ শিরোনামের ছড়ায় লিখেছেন-
“করবি কি ভুল খুব?
চুপ হয়ে যা চুপ
নইলে তোদের দেখতে হবে
আগুন ঝরা রূপ।

রূপটা কেমন, বুঝতে পারিস?
বারুদ মাখা তীর
বাঁধ ঠেকাতে তৈরি আছি
আমরা তিতুমীর।”

ভারতের সমালোচনা করে ছড়াকার লিখেছেন-
“বন্ধু সেজে আজও তারা
চলছে এঁটে ফন্দি
করবে এবার টিপাইমুখের
জালের ফাঁকে বন্দি?

এই আমাদের চায় যে ওরা
রাখতে করে বান্দী
তা হবে না, আয় সকলে
দা'য়ের বুকে শান্ দি।’’

এই দেশেরই কিছু নেতা-বুদ্ধিজীবি বাঁধের পে সুর তুলেছেন। তাদেরকে তিনি সবুজ প্রাকৃতিক দেশের কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে বলেন-

‘‘নেতার কী-যে নীতি
গান যে বাঁধের গীতি
বাঁধ হলে আজ ‘হেন’ হবে
ভবিষ্যতে ‘তেন’ হবে
ভাবেন নেতা একটুও কি
সবুজ হবে ইতি?”

কয়েকটি রাজনৈতিক দল কয়েকদিন বাঁধ নির্মাণের বিরুদ্ধে আন্দোলনের হুমকি দিলেও এখন অনেকটা নীরব হয়ে গেছে। ছড়াকার তাদের ল্য করে ‘কথামালার রাজনীতি’ ছড়ায় লিখেছেন-

“কথামালার রাজনীতিতে
আমরা সবে হয়রান
হিসাব করুন আসল মাঠে
কে করেছি কয় রান।

রানের খাতা শূন্য দেখি
বোলার ওরা শক্ত!
আসলে কি তলে তলে
সবাই ওদের ভক্ত!’’

প্রতিবেশি দেশের উদ্দেশ্যে ‘আমরা বাংলাদেশী’ ছড়ায় সাহসী উচ্চারণ করেছেন-
“শোন্রে প্রতিবেশী
দেখাস্নে আর পেশী
একাত্তরে লড়াই করা
আমরা বাংলাদেশী।”

টিপাইমুখ বাঁধ প্রতিরোধে সকলকে উদ্দেশ্য করে ছড়াকার লিখেছেন-
“প্রতিরোধের
প্রাচীর গড়
নদীর ধারা
রা কর।”

আরো লিখেছেন-
“রণাঙ্গনে
লড়তে হবে
দেশ রা
করতে হবে।”

এরকম অনেকগুলো ছড়া নিয়ে তরুণ মানবাধিকার কর্মী এডভোকেট মনিরুল ইসলামকে উৎসর্গ করে প্রকাশিত ‘শিকল ভাঙার ছড়া’ বইটিতে প্রতিটি ছড়ার সাথে সামঞ্জস্য রেখে চিত্র অলংকরণ করা হয়েছে। অলংকরণ করেছেন- আরিফুর রহমান। নিয়াজ চৌধুরী তুলি’র প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছেন মঈন মুরসালিন। ‘প্রতিভা প্রকাশ’ এর প্রকাশনায় বইটির দাম রাখা হয়েছে পঞ্চাশ টাকা। বইটি প্রথম প্রকাশ করা হয়েছে ১ জানুয়ারি ২০১০-এ। বইটিতে যেমনি রয়েছে ছন্দের চমৎকার কাজ, তেমনি উঠে এসেছে টিপাইমুখ বাঁধের বিরুদ্ধে ােভ আর প্রতিবাদের সুর। বইটি এদেশের রাজনীতি-সাহিত্যে একটি ইতিহাস হয়ে থাকবে। আমি গ্রন্থটির আরো প্রচার ও প্রসার কামনা করছি। 

# জহির রহমান
সম্পাদক
মাসিক কিশোর সাহিত্য

Friday, February 3, 2012

সেন্টমার্টিনের পথে...

বার-বার পিছিয়ে যাচ্ছিলো ভ্রমণের তারিখ। সেন্টমার্টিন বেড়াতে যাওয়ার আয়োজন ঠিক করে বান্দরবান এমনকি ভারতের সিমলা-মানালীও বেড়িয়ে এসে পরেছে গ্রুপের কেউ কেউ, কিন্তু সেন্টমার্টিন আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত এই জানুয়ারির ২৬ তারিখ রাতের শ্যামলী পরিবহনের ঢাকা-টেকনাফের টিকেট কাটা হওয়ার পরেই নিশ্চিত হওয়া গেলো এবার যাচ্ছি সেন্টমার্টিন। ১৪ জনের বিশাল বাহিনী। দস্যু পরিবারের ২ জন, দস্যু-বন্ধু ইস্রাফীলরা ২ জন, দস্যু-বন্ধু সাইফুলরা ২ জন, সাইফুলের শ্বশুর পরিবারের ৪ জন, মামার পরিবারের ৩ জন। (ছবিতে মরুভূমির জলদস্যু অনুপস্থিত) রাত সাড়ে নটার গাড়ি, ঢাকার জ্যামের কথা মাথায় রেখে একটু তাড়াতাড়িই বেড়িয়ে পরেছিলাম সায়দাবাদের শ্যামলী বাস-কাউন্টারের উদ্দেশ্যে। (ঢাকার জ্যাম) সময় মতই ছাড়ে গাড়ি, রাতের যাত্রাবিরতী করে কুমিল্লার ১৪গ্রামের নুরজাহান হোটেলে। সকলে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাস্তা আর চা পান শেষে আবার শুরু হয় যাত্রা। (বাসে দস্যু পরিবারের দুজন) এরপর আরো একবার যাত্রাবিরতী হয় চট্টগ্রামে। চট্টগ্রামের পরে টেকনাফের পথে অবশ্য এক যায়গায় বিডিআর ভাইয়েরা বাস থামিয়ে বাসের সকল যাত্রীর ব্যাগ চেক করেছেন। আমাদের মামার ব্যাগ থেকে এক ক্যান বিয়ার পাওয়া গিয়েছিল, বিডিআর ভাইয়েরা কিছু না বলে শুধু ক্যানটাই রেখে দিয়েছেন। সকাল ৯টার দিকে পৌঁছে যাই টেকনাফের কুতুবদিয়ার যেটিতে। (গ্রুপের ব্যাগ-ব্যাগেজ) আমাদের জাহাজ কুতুবদিয়া ছাড়বে সকাল সাড়ে নটায়, হাতে অনেকটা সময় আছে তাই সকলে ফ্রেম হয়ে নিয়ে পাশের টং রেস্টুরেন্টে সকালের নাস্তা সেরে নেয়। (শীত আর জ্বরে কাবু কন্যকে কোলে মরুভূমির জলদস্যু) জাহাজে আমাদের টিকেট ছিলো উপরের ওপেন ডেকের। ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে সবাই চড়ে বসি কুতুবদিয়ায়, সময় মতই ছেড়ে দেয় জাহাজ, পৌছবে আড়াই ঘণ্টা পরে সেন্টমার্টিনে। এই আড়াই ঘণ্টার যাত্রায় দেখা দৃশ্যাবলী এবার আপনারও দেখুন আমার ক্যামেরার চোখে। (এমনই একটি জাহাজ কুতুবদিয়া) (কুতুবদিয়ার যেটি) (শুরু হল নাফ নদীতে ছুটে চলা) (দস্যু পরিবারের দুজন) (নাফ নদীর পূর্বপার) (সাইফুল ও মরুভূমির জলদস্যু) (নাফ নদী থেকে দেখা টেকনাফের পাহাড় সারি) (বাঁশ ব্যবসায়ীরা এভাবেই নদী পথে বাঁশ নিয়ে যায়) (দস্যু পরিবারের দুজন) (একা গাংচিল) (দস্যু কন্যা) (নৌকো ও গাংচিল) (জাল পেতে এভাবেই খালি নৌকো ফেলে রেখে চলে যায় জেলেরা) (জাহাজের শেষ কোনায় এই দুজন চুপচাপ বসে ছিলেন, ছবি তোলার লোভ সামলাতে পারলাম না। সরি বলছি ওনাদের কাছে, কারণ ছবি তোলার অনুমতি নেয়া হয়নি।) (দস্যু কন্যা) (কি বিচিত্র লীলা, সাগর আর নদীর পানির ভিন্ন দুই রং) (সাগরের নীল-জলে সাদা ফেনার খেলা) (সাগর আর নাফ নদীর মোহনায় জেলে নৌকা) (বয়া) (দূরে টেকনাফের শেষ সীমানার সাদা তটরেখা) আগামি পর্বে থাকবে সেন্টমার্টিনে তোলা কিছু ছবি আর ভ্রমণ কথা, ততো দিন সকলে ভালো থাকবেন। যাত্রাতথ্য : ঢাকা থেকে টেকনাফ শ্যামলী বাস ভাড়া জনপ্রতি ৮০০/= টাকা। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন কুতুবদিয়ার জাহাজ ভাড়া ওপেন ডেক জনপ্রতি ৭০০/= টাকা। (আপ-ডাউন) এখনো অনেক অজানা ভাষার অচেনা শব্দের মত এই পৃথিবীর অনেক কিছুই অজানা-অচেনা রয়ে গেছে!! পৃথিবীতে কত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে- যারা দেখতে চায় তাদের ঝিঁঝি পোকার বাগানে নিমন্ত্রণ।

Wednesday, February 1, 2012

গাংচিল - ১ | মরুভূমির জলদস্যু

সেন্টমার্টিনে বেড়াতে যাওয়ার সময় আমাদের জাহাজ কুতুবদিয়ার পেছন পেছন নাফ নদীর মহনা পর্যন্ত উড়ে আসে অনেক গুলি গাংচিল। প্রচুর ছবি তুলেছিলাম তাদের, সেখান থেকে বাছাই করা কয়েকটি একক গাংচিলের ছবি দেখুন। ১ ১০ এখনো অনেক অজানা ভাষার অচেনা শব্দের মত এই পৃথিবীর অনেক কিছুই অজানা-অচেনা রয়ে গেছে!! পৃথিবীতে কত অপূর্ব রহস্য লুকিয়ে আছে- যারা দেখতে চায় তাদের ঝিঁঝি পোকার বাগানে নিমন্ত্রণ।

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ