প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Saturday, September 17, 2011

জসীম উদ্দীনের কবিতায় পল্লী বংলার রূপ || ডক্টর সন্দীপক মল্লিক

১.

ধ্যানসিদ্ধ সাহিত্যবিশেস্নষকের উচ্চারণঃ
‘প্রত্যেক সভ্যজাতির মধ্যেই সাহিত্য সংস্কৃতির দুইটি ধারা আছে-একটি লৌকিক আর একটি শিৰাগত৷ ইহাদের মধ্যে আদান-প্রদান চলিতে থাকে৷ (১)
বস্তুতঃ
ঋড়ষশ সধঃবত্‍রধ রং নবরহম ধনংড়ত্‍নবফ নু ঢ়ড়বঃং ধহফ ধত্‍ঃরংঃং (২)
এমন সত্যানুসরণে আধুনিক যুগে জন্মে আধুনিক শিৰাদীৰাপ্রাপ্ত হয়েও জসীমউদ্দীন লোকসাহিত্যের আকর্ষণে লোককাব্যের ভান্ডার থেকে রস সংগ্রহ করে, লোকজীবন নিয়ে কাব্য সাধনায় অগ্রসর হয়েছেন৷ (৩) আর তার এমন শৈল্পিক আয়োজন সম্পর্কে স্বয়ং কবীন্দ্র রবীন্দ্রনাথ উচ্চারণ করেছেনঃ
‘জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস সম্পূর্ণ নূতন ধরনের৷
প্রকৃত কবির হৃদয় এই লেখকের আছে৷ (৪)
চেক সাহিত্যসমালোচক উঁংধহ তনধাঃবষ জসীমউদ্দীনের কাব্যপ্রতিভার তিনটি উত্‍সের কথা উলেস্নখ করেছেনঃ
ক. বাংলা সাহিত্যের প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাহিনী ও সঙ্গীতাশ্রয়ী বিচিত্র কাব্য ঐতিহ্য
খ. বাংলাদেশের গ্রাম্যসাহিত্য ও গ্রাম্যগানের ধারা
গ. জনসাধারণের প্রতি অপরিসীম দরদ যাকে সাহিত্যের ভাষায় বলা হয় ঢ়ড়বঃরপ যঁসধহরংস. (৫)
জসীমউদ্দীনের বাংলা সাহিত্যে পলস্নীরই প্রতিনিধিত্ব করেছেন৷ তার কবিতার আবহে স্বতঃস্ফূর্ততা৷ আনত্মরিকতা, স্পষ্টতা ও অকৃত্রিম সরলতা (ঁহংঃঁফরবফ ংরসঢ়ষরপরঃু) ঋদ্ধ হয়ে আছে৷ এ বিষয়ে তিনি স্কচ কবি জড়নবত্‍ঃ জঁত্‍হং এর সঙ্গে তুলনীয়৷ বস্তুতঃ পলস্নীবাংলার মাটিতেই তার শিল্প মনস্বিতার মূলটি প্রোথিত থেকে গেছে৷ (৬) তিনি পূর্ববাংলার প্রাণকেন্দ্র গ্রামগুলোর নিঝুম অনত্মঃপুরে আপনাকে স্থাপন করতে পেরেছিলেন৷ (৭) তার কাব্যশরীরে পলস্নীর রূপ সৌন্দর্যের অপরূপ মায়ালোকই সৃজিত হয়েছে৷ (৮) তিনি সুন্দরকে পলস্নীরাখালের হাসিতে গ্রাম্যবালিকার চঞ্চলগতি ভঙ্গিমায় কিংবা প্রকৃতির সনাতন প্রসাধনে সজ্জিত অবস্থায় প্রত্যৰ করেছেন (৯)

জসীমউদ্দীনের স্বকীয় সংলাপঃ
আমাকে সকলে পলস্নী কবি বলেন৷ আমি এজন্য নিজেকে ধন্য মনে করি৷ (১০)
২.
কবি জসীমউদ্দীনের আবির্ভাব ০১ জানুয়ারি ১৯০৩ খ্রিঃ এ ফরিদপুরের তাম্বুলখানা পলস্নীতে তার মামার বাড়িতে৷ তিরোভাব ১৪ মার্চ, ১৯৭৬ খ্রি এ ঢাকায়৷
বিশেষভাবে উলেস্নখ্য যে, কবির পিতা মৌলবী আনসারউদ্দীন ছিলেন স্বভাবজ কবিত্বশক্তির ধারক৷ তিনি ছিলেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি বিশেষভাবে অনুরাগী৷ গ্রামেরই স্কুল শিৰক ছিলেন তিনি৷ মাতা মোসাম্মাত্‍ আমিনা খাতুন ছিলেন সরল স্নেহদাতা৷ তার পলস্নীসৌন্দর্যময় মাতৃহৃদয়ের স্নেহধারায় নিষিক্ত হয়েই জসীমউদ্দীনের কবিপ্রাণ প্রতিভাপ্রদীপ্ত হয়ে উঠেছিলো৷ (১১)
জসীমউদ্দীনের প্রাথমিক শিৰার হাতে খড়ি পাশর্্ববতর্ী গ্রাম শোভারামপুরের অম্বিকা মাস্টারের পাঠশালায়৷ কিন্তু সাঁকো পারাপারের জন্য তার পিতা তাকে নিজের প্রতিষ্ঠা করা ফরিদপুর হিতৈষী এম ই স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন৷ তৃতীয় শ্রেণীতে উঠলে এসডিও বিশ্বেকর ভট্টাচার্যের ছেলে মনোরঞ্জন ভট্টাচার্যের সঙ্গে জসীমউদ্দীনের বন্ধুত্ব গড়ে উঠে৷ মনোরঞ্জনের বাড়িতে শিশুতোষ গ্রন্থের সংখ্যা কম ছিলো না৷ জসীমউদ্দীনের বই পড়ার সখ তখন থেকেই উপ্ত হয়৷ তার শিল্পীসত্তার উন্মেষ ও বিকাশে এ সময়টি গুরম্নত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলো৷ (১২)
নিকটতম আত্মীয় অন্ধ চাচা দানু মোলস্নার কেচ্ছা, শেস্নাক, রূপকথা, গ্রাম্যগান ইত্যাদি শুনে শুনেও শিশু জসীমউদ্দীনের প্রাণ পলস্নীকৃষ্টিসমৃদ্ধ হয়েছিলো৷ (১৩)
ফরিদপুর হিতৈষী স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলে জসীমউদ্দীনের পিতা তাকে ফরিদপুর জিলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন৷ এই সময় তিনি ও তার বন্ধু ধীরেন্দ্র মিলিত হয়ে ঊষা নামক একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধানত্ম নেন৷ পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় জসীমউদ্দীনের নায়ের মাঝি সম্পর্কিত এই কবিতাটি স্থান পায়৷
নায়ের মাঝি নায়ের মাঝি
এখনো কেন শুয়ে?
বেয়ে চল তোর না খানি ভাই
পাল তুলিয়া দিয়ে৷ (১৪)
জসীমউদ্দীন যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখন অসহযোগ আন্দোলন উন্মাতাল হয়ে ওঠে মাতৃভূমি৷ স্কুল ছেড়ে তিনি কলকাতায় পাড়ি জমান৷ এই সময়ে তিনি ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকা’র সম্পাদক মোজাম্মেল হক (জন্ম ১৮৮৩ খ্রিঃ-মৃতু্যঃ ১৯৭৬ খ্রি) এর সংস্পর্শে আসেন এবং তার পরামর্শে কবি নজরম্নলের সঙ্গে পরিচিত হন৷ কবির ব্যক্তিত্ব, স্নেহ আর মধুর ব্যবহার জসীম উদ্দীনের কবিসত্তাকে সঞ্জীবিত করে৷(১৫) ১৯২১ খ্রি. ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকায় তাঁর মিলনগান’ নামক একটি কবিতা প্রকাশিত হয়৷ উলেস্নখ্য, পত্রিকাটির একই সংখ্যায় নজরম্নলের জনমননন্দিত কবিতা ‘বিদ্রোহী’ও প্রকাশিত হয়৷(১৬)

১৯২১ খ্রি. এই জসীমউদ্দীন দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন৷ ১৯২৪ খি.-এ পাস করেন আই এ৷ বিশেষভাবে উলেস্নখ্য যে, ম্যাট্রিক পরীৰায় পাস করবার পূর্বেই তিনি তাঁর বিখ্যাত ‘কবর’ কবিতাটি রচনা করেন৷ ‘কলেস্নাল’ পত্রিকার পিছনের দিকে ছোটো অৰরে প্রায় ছয়মাস পরে কবিতাটি প্রকাশিত হয়৷(১৭) মহাত্মা দীনেশচন্দ্র সেন কবিতাটি পাঠ ক’রে বিমুগ্ধ হন৷

প্রায় এক মাস পরে ডক্টর দীনেশচন্দ্র ‘ফরওয়ার্ড’ পত্রিকার ‘তিলক’ সংখ্যায় ‘কবর’ কবিতার প্রশংসা ক’রে অহ ুড়ঁহম গড়যধসবফধহ ঢ়ড়বঃ নামে জসীমউদ্দীন-সম্পর্কে একটি প্রবন্ধ লেখেন তিনি এ প্রবন্ধে নজরম্নলের কবি-কৃতিত্বের পর মুসলমান কবিদের মধ্যে জসীমউদ্দীনের স্থানই নির্দেশ করেন৷(১৮) উলেস্নখ্য, জসীমউদ্দীন যখন বিএ ক্লাসের ছাত্র, তখনই দীনেশচন্দ্র সেন ‘কবর’ কবিতাটি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিক সিলেকশনে পাঠ্য করেন৷

জসীমউদ্দীনের ছাত্রাবস্থায় ১৯২৭ খ্রি-এ ‘রাখালী’ কাব্য প্রকাশিত হয়৷ ১৯২৯ খ্রি-এ তিনি বি.এ. পাস করেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ থেকে৷ ১৯৩১ খ্রি-এ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পাস করার পর ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের অধীনে ‘রামতনু লাহিড়ী গবেষক’ হিসেবে নিযুক্ত পান৷ ১৯৩৮ খ্রি. অব্দি তিনি এই পদে বহাল ছিলেন৷(১৯)
আমরা অনুধাবন করতে পারি- ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনই জসীমউদ্দীনের কবিসত্তার বিকাশে প্রধান সহায়কের ভূমিকা পালন করেন পরম যত্নে৷(২০)
দীনেশচন্দ্রের ব্যাকুল উচ্চারণঃ
‘তাঁর কবিতা আমার কাছে শেলী, কীটস, বায়রণ এমনকি
ওয়ার্ডসওযার্থের কবিতার চেয়েও ভালো লাগে৷ঃ তাঁর কবিতায়
ঃ ঃ আম-কাঁঠালের ছায়ায় ঘেরা সেই পলস্নীমায়ের শীতল
স্পর্শ পাই৷ মায়ের চেয়ে আপন বলতে আমি আর
কাউকে জানিনে৷ তার পদ্ম-শালুক ফোটা খালবিল, ভাটিয়ালী
গানে মুখর পদ্মা-যমুনা নদী, অতসী-অপরাজিতা, টগর-চামেলী
ফুলের সুবাস-ভরা আঙিনার কোল মায়ের এই অপরূপ
মূর্তি আমি পাই জসীমের কবিতায়৷(২১)

৩.
পলস্নীপ্রাণ কবি জসীমউদ্দীন সর্বমোট ২০ খানি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা৷ সেগুলি হলোঃ
রাখালী (১৯২৭ খ্রি.), নক্সী কাঁথার মাঠ (১৯২৯ খ্রি.), বালুচর (১৯৩০ খ্রি.), ধানৰেত (১৯৩২ খ্রি.), সোজনবাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩ খ্রি.), রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫ খ্রি.), হাসু (১৯৩৮ খ্রি.), রূপবতর্ী (১৯৪৬ খ্রি.), এক পয়সার বাঁশী (১৯৪৯ খ্রি.), পদ্মাপার (১৯৫০ খ্রি.), মাটির কান্না (১৯৫১ খ্রি.), গাঙের পার (১৯৫৪ খ্রি.), সকিনা (১৯৫৯ খ্রি.), সুচয়নী (১৯৬১ খ্রি.), মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩ খ্রি.), হলুদবরণী (১৯৬৬ খ্রি.), জলের লেখন (১৯৬৯ খ্রি.), পদ্মানদীর দেশে (রিয়াজ আনোয়ার রচিত উদর্ুকাব্য ‘আওয়াজো কা তাঁওয়ার’-এর বঙ্গানুবাদ-১৯৬৯ খ্রি.), ভয়াবহ সেই দিনগুলিতে (১৯৭২ খ্রি.) ও মাগো জ্বালিয়ে রাখিস আলো (১৯৭৬ খ্রি.)৷ উলেস্নখ্য, প্রায় সকল কাব্যেরই ছন্দায়তনে পলস্নীবাংলার রূপ রূপমা, শ্যামলিম ঐশ্বর্য প্রাণসঞ্জীবনী প্রভা, পলস্নীমানব মানবীর দৈনন্দিন জীবনায়োজন, ঐহিক তৃষ্ণাবাহার- প্রীতিসমুজ্জ্বল চিত্রকল্পনা সদ্ধৃত হয়ে আছে বর্ণনাধারায় তা সুবিন্যসত্ম হোক প্রামাণ্য বিভায়ঃ
ক. ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবীরের রাগে৷
(‘কবর’, রাখালী)
খ. সন্ধ্যার পরে দাবায় বসিয়া রূপাই বাজায় বাঁশী,
মহাশূন্যের পথে সে ভাসায় শূন্যের সুররাশি!
(‘নক্সী কাঁথার মাঠ’)
গ. শীতের তাপসী কারে বা স্মরিছে আভরণ গার খুলি?
(‘কাল সে আসিবে’, বালুচর)
ঘ. তপস্যা-রত জল-ভরা মেঘ গগনে ঘোরে,
(‘কল্যাণী’, রূপবতী)
ঙ. শেষ রাত্রের পান্ডুর চাঁদ নামিছে চক্রপলে
রজনীগন্ধা রূপসীর আঁখি জড়াইছে ঘুমজালে৷
(‘রজনীগন্ধার বিদায়’, মাটির কান্না)
এসব ছন্দিত পঙ্ক্তিতে পলস্নীবাংলার রূপশ্রীর সত্যায়িত বর্ণায়োজনই বিধৃত৷ ষড়ঋতুর পরিক্রমায় পলস্নীবাংলা বিচিত্র শৈলীতে রূপমণ্ডিত হয়৷ কবির দৃষ্টিনন্দনায় তা সমুদ্ভাসিত৷
লোকজ বাকভঙ্গি অনুসরণে জসীমউদ্্দীনের কৃতিত্ব অবিসংবাদিত৷ পলস্নী মানব-মানবীর দৈনন্দিন প্রতিকৃতি- প্রীতিময় দিনযাপনা-আনুপূর্বিক সবুজ সৌন্দর্যময় জীবন সুঘ্রাণ জসীমউদ্্দীনের কাব্যায়তনে সঞ্চয়িত৷ সুরসম্পৃক্ত কথামালা উচ্চারণ করা যাক:
ক. রাখালভাবে কলসখানি না থাকলে তার সরম্ন কাঁখে
রূপের ভারেই হয়তো বালা পড়ত ভেঙে পথের বাঁকে৷
(রাখালী)
খ. সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ আকাশের ছড়িয়ে পড়া আবির রঙে নাওয়া৷
(‘রাখাল ছেলে’, রাখালী)
গ. নতুন চাষা ও নতুন চাষাণী পাতিল নতুন ঘর
বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর৷
(‘নকসি কাঁথার মাঠ’)
ঘ. কৃষাণী কি বসি সাঁঝের বেলায়
মিহি চাল ঝাড়ে মেঘের কুলায়
ফাগের মতন কুঁড়া উড়ে যায়
আলোক ধারেঃ.
(‘উড়ানীর চর’, বালুচর)
পলস্নীর বিশ্বসত্ম ছবির আবহ-সৃষ্টির নৈপুণ্য কবি জসীমউদ্্দীনের স্বভাবজ৷ মমতাপুণ্যের গরিমায় তাঁর হৃদয়পুর ছিলো পরিপূর্ণ৷ সে কারণেই তিনি গ্রাম্যশব্দের ‘চুমকি’ বসাতে হয়েছিলেন দ্বিধাহীন৷ (২২) উদ্ধৃত হোক ছন্দিত কথামালা:
ক. রাখিও ‘ঢঁ্যাপের মোয়া’ বেঁধে তুমি সাতনরি শিকা ভরে
খেজুড়ে গুড়ের নয়া পাটালিতে ‘হুড়ুমের কোলা ভরে৷’ (‘পলস্নীজননী’, রাখালী)
খ. দশ ‘খান্দা’ জমি রূপার, তিনটা গরম্ন হালে,
ধানের ‘বেড়ী’ ঠেকে তাহার বড় ঘরের চালে৷
(‘নকসী কাঁথার মাঠ’)
গ. শেয়াল চলে শ্বশুরবাড়ী ‘খালুই’ মাথায় দিয়ে৷
(‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’)
পলস্নীবাংলার মানব-মানবীর জীবনযাত্রার ছবি অঙ্কনে নিরেট পলস্নীবাসী কবি-গীতিকারদের আঞ্চলিক শব্দ, বাক্যাংশ তথা ভাবসম্পদকেও জসীমউদ্্দীন আত্ম:স্থ করেছেন৷ কিছু উদ্ধৃতি:
ক. ভাটির দ্যাশের কাজলমায়ায়
পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায় রে৷
(‘রঙিলা নায়ের মাঝি’)
খ. ও বাবু সেলাম বারে বারে
আমার নাম গয়া বাইদ্যা বাবু
বাড়ী পদ্মাপার৷
(‘পদ্মাপার’)
পলস্নীবাংলার মানব-মানবীর অধ্যাত্ম্য সাধনা সম্পর্কিত ভাবমূর্তিকেও জসীমউদ্্দীন ছন্দমণ্ডিত করেছেন৷ আরবী-ফাসর্ী শব্দ সহযোগে তিনি জীবন বাসত্মবতার ভূষণকেই সমুজ্জ্বল করেছেন৷
উদ্ধৃত হোক কিছু পঙ্ক্তি:
ক. মজিদ হইতে আজান হাঁকিছে বড় সকরম্নণ সুর,
মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কতদূর!
(‘কবর’, রাখালী)
খ. সামনে লইয়া কোরান শরীফ সুরে-ফাতেহার চরণ পড়ি
সারে জাহানের ক্রন্দনে যে চোখ দুটো্ তার আসিছে ভরি৷
(‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’)
জসীমউদ্্দীন কুশলী শব্দশিল্পী৷ পলস্নী সংবেদ্য অনুভবের সন্দীপনা তার শব্দচয়ন প্রক্রিয়ায় সুস্থিত৷
অলংকৃত কিছু পঙক্তি উচ্চারিত হোক:
ক. গাঙের জল ছল্্ ছল্্ বাহুর বাঁধন সে কি মানে?
(‘রাখালী’)
খ. বাহিরিতে নাচে জোনাকী আলোর থম্্থম্ কাল-রাত৷
(‘পলস্নীজননী’, রাখালী)
গ. আম-কাঁঠালের পিঁড়িখানি ভরি সরম্ন সরম্ন করে লতাফুল আঁকা,
(‘সোজনবাদিয়ার ঘাট’)
অনুপ্রাস অলঙ্কারের যথার্থ ব্যবহারে জসীমউদ্্দীন পলস্নীবাংলার রূপমাধুর্যের আল্পনা অঙ্কন করেছেন৷ যেমন:
ক. কলমীফুলের নোলক দেব, হিজল ফুলের দেব মালাঃ.
(‘রাখালী’)
খ. বধুর কোলেতে বধূয়া ঘুমায় খোলে না বাহুর বাঁধ৷
(‘তরম্নণ কিশোর’, রাখালী)
পলস্নীর মনোমোহন দৃশ্যপট বর্ণনায় জসীমউদ্দীন ধ্বনু্যক্তি-অলঙ্কারেরও ব্যবহার করেছেন সুকৌশলে৷ যেমনঃ
ক. তেপানত্মরের মাঠেরে ভাই, রোদ ঝিম ঝিম করে
(এক পয়সার বাঁশী)
খ. আরও দূরে সোঁ সোঁ নদী, মধ্যে বালুচর৷ (‘সকিনা’)
উপমা-অলঙ্কারকেও পলস্নীর রূপ-চিত্রণে ব্যবহার করেছেন জসীমউদ্দীন৷ উদ্ধৃতিঃ
ক. কাঁচা ধানের পাতার মতো কচিমুখের মায়া
(‘নকসী কাঁথার মাঠ’)
খ. জালি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দু’খান সরম্ন
(‘নকসী কাঁথার মাঠ’)
সমাসোক্তির ব্যবহারে জসীমউদ্দীন সার্থক৷ পলস্নীর রূপ বর্ণনায় তিনি এ অলঙ্কারের ব্যবহার দেখিয়েছেন এমনি ছন্দ সহযোগেঃ
ক. সরষে ফুলের পাঁপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই
(‘রাখাল ছেলে’, রাখালী)
খ. হেমনত্মের চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোত্‍স্নার জাল পাতি
(‘নকসী কাঁথার মাঠ’)
পলস্নীর শ্রীদীপ্তি চিরনত্মনী স্বরূপ্য লাভ করেছে জসীমউদ্দীনের অপহৃূতি-অলঙ্কারের ব্যবহারশৈলীতে৷ উদাহরণঃ
মেয়ে ত নয়, হলদে পাখীর ছা
(‘নকসী কাঁথার মাঠ’)
পলস্নীর সবুজ-সংস্থিতির বর্ণনাতে স্বভাবোক্তি অলঙ্কারের বিশুদ্ধ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন জসীমউদ্দীন৷ যেমনঃ
ক. এই এক গাঁও৷ ওই এক গাঁও-মধ্যে ধূ ধূ মাঠ
ধান-কাউনের লিখন লিখি করছে নিতুই পাঠ৷ (‘নকসী কাঁথার মাঠ’)
খ. ছোট গেঁয়ো নদী, দুই ধারে লিখি নতুন ধানের লেখা (‘বিদায়, বালুচর)
গ. জাগে বনপথে কাননকুমারী ফুলের কৌটা খুলি
(‘আজি পুষ্পের জনমের তিথি’, ধানৰেত)

বিশেষ দৃকপাত্‍
দ্বিধাহীন সংলাপঃ ছন্দ-স্রোত তথা ছন্দ-বিনোদন কবি জসীমউদ্দীনের মত্তাসৌকর্যের নামানত্মর৷ পলস্নীর শ্যামলিম রূপ-মাধুর্য পলস্নী মানব-মানবীর আত্যনত্মিক প্রাণভূষণ, তাদের অনুভবকানত্মি- সকল কিছুরই বিশ্বসত্ম চিত্রার্পিত জসীমউদ্দীনের কাব্যকলায় সংন্যসত্ম হয়েছে৷ তা যে আধুনিক আর্থদলনীক্লিষ্টতা, অস্থির-অব্যবস্থা সমাজক্লিন্নতা-বিদূরণের যত্নময় মাধ্যম, তা বোধ করতে অসুবিধে হয় না৷ জসীমউদ্দীনের কাব্য পলস্নীবাংলার সাত্ব ও শাশ্বত প্রাণ-প্রণোদনারই সংবাহিকাশক্তির অমৃত-অাঁধার৷

তথ্যসূত্রঃ
১. ডক্টর আশুতোষ ভট্টাচার্য, বাংলার লোকসাহিত্যঃ সংজ্ঞা ও প্রকৃতি, প্রথম সংস্করণ; কলিকাতাঃ ক্যালকাটা বুক হাউস, ১৯৫৪ খ্রিঃ পৃঃ ২৬৷
২. অ. ঐ. কত্‍ধঢ়ঢ়ব, ঝউঋগখ, চ-৪০৪ পুনঃউদ্ধৃতঃ সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, জসীমউদ্দীন, ঢাকাঃ সিটি লাইব্রেরী, ১৯৭৩ খ্রিঃ পৃঃ ৭৷
৩. সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত৷
৪. নকসী কাঁথার মাঠ সম্পর্কে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৌহিত্র মোহনলাল গঙ্গোপাধ্যায়ের লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্র থেকে উদ্ধৃত৷ জসীমউদ্দীন, যাদের দেখেছি, ঢাকাঃ প্রেসিডেন্সী লাইব্রেরী, ১৯৫২ খ্রিঃ পৃঃ ৮৪৷ জসীমউদ্দীন, ঠাকুরবাড়ীর আঙিনায়, পঞ্চম সংস্করণ, ঢাকাঃ পলাশ প্রকাশনী, ১৯৭৮ খ্রিঃ পৃঃ ৭৷ পুনঃ উদ্ধৃতঃ সেলিমা খালেক, জসীমউদ্দীনের কবিতাঃ অলঙ্কার ও চিত্রকল্প, প্রথম প্রকাশ, ঢাকাঃ বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩ খ্রিঃ পৃঃ ১২৷
৫. উঁংধহ তনধরত্‍ঃবষ, সোজন বাদিয়ার ঘাট (৭ম সংস্করণ, ১৯৬০ খ্রিঃ) কাব্যের পরিশিষ্টে সংযোজিত জসীমউদ্দীনের কবি-প্রতিভা সম্পর্কিত বক্তব্য দ্রষ্টব্য, পৃঃ ১৫০-৫২৷ পুনঃউদ্ধৃতঃ সেলিমা খালেক, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১৮-১৯৷
৬. সুনীল, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫৩২৷
৭. মুহম্মদ আব্দুল হাই, কবি জসীমউদ্দীন, ভাষা ও সাহিত্য, ৪৩, ঢাকাঃ বেঙ্গল পাবলিশার্স, ১৩৬৬, বঙ্গাব্দ, পৃঃ ২১৬-১৭৷
৮. মুসত্মাফা নূরউল ইসলাম, ‘জসীমউদ্দীন ও তার কবিতা-একটি ভূমিকা’, মুসলিম বাংলা সাহিত্য, দ্বিতীয় সংস্করণ; ঢাকাঃ পাকিসত্মান বুক কর্পোরেশন, ১৯৬৯ খ্রিঃ পৃঃ ১৫১৷
৯. সুনীল, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫৩১৷
১০. কবি জসীমউদ্দীনের পত্র, সুনীলকুমার মুখোপাধ্যায়, স্মৃতিকথা, ঢাকা ডাইজেস্ট, ৫ম বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, জুন, ১৯৭৭ খ্রিঃ পৃৃঃ ৭১৷
১১. সুনীল, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৫৩৩৷
১২. জসীমউদ্দীন, জীবনকথা (১ম খণ্ড), তৃতীয় মুদ্রণ; ঢাকাঃ পলাশ প্রকাশনী, ১৯৭৬ খ্রিঃ পৃঃ ৪৯-৫০৷
১৩. জসীমউদ্দীন, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৪৷
১৪. এম, ইয়াসিন, ‘কবি জসীমউদ্দীন’৷ গ্রামের কথা (বিজয় সংখ্যা, ২য় বর্ষ, ১৬শ’ ও ১৭শ’ সংখ্যা, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, ১লা ফেব্রম্নয়ারি, ১৯৬৫ খ্রিঃ পৃঃ ৮৷ পুনঃউদ্ধৃতঃ সেলিমা খালেক, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৩৷
১৫. জসীমউদ্দীন, যাঁদের দেখেছি, পৃঃ ১৬-২০৷
১৬. জসীমউদ্দীন, ঐ, পৃঃ ২৪৷
১৭. এম, ইয়াসিন, পূর্বোক্ত, পৃঃ ১০৷
১৮. জসীমউদ্দীন, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৭২৷
১৯. সেলিমা খালেক, পূর্বোক্ত, পৃঃ ৪৮৷
২০. জসীমউদ্দীন, পূর্বোক্ত৷
২১. জসীমউদ্দীন, স্মরণের স্মৃতিবাহি, প্রথম প্রকাশ; ঢাকাঃ পলাশ প্রকাশনী, ১৯৭৮ খ্রিঃ পৃঃ ৫১৷

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ