প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Thursday, September 13, 2012

কবর থেকে চুরি হল হুমায়ূনের লাশ! | মোঃ রাশেদুল কবির আজাদ

রাতটি ছিল একমাসে দুটো পূর্ণিমার ঘটার রাত। হোসেন আলী রাতের খাবার খেয়ে বাইরে বের হয়েছে। চারদিক জোছনায় ভরে আছে। হোসেন আলী জানে এই বিরল ঘটনা আবার তিন বছর পর দেখা যাবে। তাই পারত পক্ষে আকাশের বুকে ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা দেখতে সে ভুল করে না। পূর্ণিমা, ধূমকেতু, কিংবা আকাশের বুকে তারাগুলোকে সে প্রতিদিন দেখে নেয়। যুগের পরিবর্তন হয়েছে। সভ্যতার চাদর মানুষকে দিয়েছে ঘরবন্দী পৃথিবী। তরুণ প্রজন্ম কম্পিউটার নিয়ে সারারাত কাটিয়ে দেয়। ফেইজবুক, টুইটারসহ নানা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো নতুন প্রজন্মকে করছে গৃহপালিত। তাদের বাবা মা আশা নিরাশার মাঝে জীবন কাঁটায়। অনেকে অজ্ঞতার কারণে সন্তানের কাছে জানতেও চায় না সারা রাত সে কম্পিউটারে কী করে? কিন্তু স্কুল-কলেজের পরীক্ষার ফলাফল বের হলে অনেক বাবা-মার চোখের জলে দুঃখ ঝরে। কিন্তু এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না! মনের মাঝে অব্যক্ত কষ্ট নিয়ে প্রতিরাতেই হোসেন আলী প্রায় ঘন্টা খানেক খোলা আকাশের নিচে মেঠো পথ দিয়ে হাঁটতে থাকে। এই সময় সে কাউকে সঙ্গী করে না। তার স্ত্রী ঘুমানোর আগে হোসেন আলীর অভ্যাসের কথা ভেবে কাচের জগটি ভরে রাখে পানি দিয়ে। পাশে একটি গ্লাসও ঢেকে রাখে। তার স্ত্রী জানে, ঘরে ফিরেই সে হাত মুখ ধুয়ে প্রায় এক জগ পানি পান করবে। এই অভ্যাস হোসেন আলীর ছাত্র জীবন থেকে। তাই শরীরের প্রচুর ঘাম হয়। কিন্তু রোগ হয় কম। যখন হাঁটতে বের হয় রাতে, সে গ্রামের মানুষের খোঁজ খবরও নিতে যায়। বাঁশ বনের মাঝ দিয়ে দ্বিতীয় রাতের পূর্ণিমার চাঁদকে হোসেন আলী লক্ষ্য করে। সাদা মেঘগুলো কেমন জানি পাগলা ঘোড়ার মত চাঁদের পাশ দিয়ে ছুটে চলেছে। বাঁশ বনের ফাঁক গড়িয়ে নীলাভে চাঁদের কিরণ গ্রামের মেঠো পথে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে এক অন্যরকম আলোকসজ্জ্বা। এমন আলোকসজ্জ্বায় ভুবণ রঙানো কোনো মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। হোসেন আলী এর বিস্তর বর্ণনা দিতে পারবে না তবে মনের মাঝে যে আনন্দ ও সুখের সৃষ্টি তা দেখে, তার পূর্ণতায় সে ভরপুর। বাঁশ বনের সামনেই নিশিপল্লীর গোরস্থান। কিছুদিন আগে এই গ্রামের নামকরা এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। তা মাস খানেক হবে। দেশের দূর দূরান্ত থেকে মানুষ প্রতিদিন আসে তার কবর দেখতে। শুধু মৃত ব্যক্তির ফুফু অসুস্থ থাকার কারণে তাকে দেখতে আসতে পারে নি। হোসেন আলী হাঁটতে হাঁটতে কাঠ বাদাম তলায় চলে আসে। সেখানে চারটি রিকসা কাপড় দিয়ে সামনে মোড়ানো। হোসেন আলী মনে কৌতুহল সৃষ্টি হয়। এত রাতে সবুর মিয়ার বাড়িতে কারা এলো? সে রিকসা চালকদের কাছে জানতে চায়। বৃদ্ধ বয়সি এক রিকসাচালক হোসেন আলীর সামনে এগিয়ে আসে। সে হোসেন আলীকে বলে, ‘আপনাদের গ্রামে সবুর মিয়ার যে আত্মীয় মাস খানেক আগে বজ্রপাতে মারা গেছেন এরা সেই বাড়ির মেহমান। রিকসার মধ্যে আলাপচারিতায় যা বুঝেছি তাতে মনে মৃত ব্যক্তির ফুফু এসেছেন’। হোসেন আলীর কাছে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যায়। হোসেন আলী একবার রাতের আকাশের দিকে তাঁকায় আবার ডানদিকে গোরস্থানের দিকে নজর দেয়। তাদের গ্রামটি অজো পাড়া গা হলেও বিদ্যুতের বাতি চারদিকে আনন্দে আত্মহারা। যদিও মাঝে মাঝে লোডশেডিং হয়। এখন আবার বিদ্যুৎ আসাতে রাতের আকাশটাকে কেমন যেন অন্ধকার লাগছে। তবুও নীলাভে চাঁদ তার জোছনার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে নিশিপল্লীতে। হোসেন আলীর হঠাৎ করেই তার মেয়ে মিথিলার কথা মনে পড়ে। কেন মনে পড়ে তা সে জানে না। মেয়ের জন্য তার বুকের ভিতর সে অব্যক্ত বেদনা ছিল, সৃষ্টিকর্তা তা অনেকটাই লাগব করেছেন। তার বিশ্বাস, তার মিথিলা একদিন বাবার হাত ধরে রাতের আকাশ দেখার জন্য ঠিকই বের হবে। হাতের বাম পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া খালটিকে জোড়াতালি দিয়ে রেখেছে একটি সেতু। আজ থেকে বিশ বছর আগে সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছিল। রাত ন’টার পর কোথা থেকে এসে কিছু মোটর সাইকেল আরোহী এই সেতুর ওপর বসে আড্ডা দেয়। গত সাত দিন আগে তাদের আলাপচারিতা হোসেন আলী শুনে ফেলে। আলাপচারিতা শুনে হোসেন আলীর মনে ভয় ধরে যায়। সে কাউকে সে কথা বলে না। তবুও সে রাতে হাঁটা বন্ধ করে নি।
সেদিন সেতু ওপর বসে কয়েকজন লোক আলাপ করতে ছিল মৃত মানুষের শরীর নিয়ে। বজ্রপাতে যারা মারা যায় তাদের শরীরের নাকি অনেক দাম। বিশেষ করে মৃত ব্যক্তি মাথা। বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তির মাথাটি নাকি ম্যাগনেটে পরিণত হয়। সেই মাথার মূল্য তারা যা বলছে তাতে হোসেন আলী বিস্মিত হয়। কী করে একটি মৃত মানুষের মাথা প্রায় কোটি টাকা মূল্য হতে পারে? যারা এ আলাপ করতে ছিল তারা অবশ্যই কোন সংঘবদ্ধ অপরাধ জগতের মানুষ। ইদানিং হোসেন আলী পত্র পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পারে নিত্য নতুন চুরি ডাকাতির নানা কৌশল। মানুষের মধ্য থেকে মানবিকতা ওঠে যাচ্ছে। কিছুদিন আগে পাশের গ্রাম নগরকান্দা থেকে একরাতে সতেরটি লাশ চুরি গেছে।
অন্যদিকে শহরের অবস্থা আরো করুণ। ঢাকা শহরে ব্যস্ত কোন রাস্তার মোড়ে আপনি যদি ছোট্ট কোনো ছেলে মেয়ের হাতে কোনো ঠিকানা লেখা দেখতে পান এবং সেই মোতাবেক তাকে পৌছে দিতে যান, তাহলেই ধরা খেলেন। আপনাকে পণবন্দি হিসেবে তারা রেখে দিবে এবং আপনার পরিবারের কাছে কয়েক লক্ষ টাকা পণ দাবী করবে। না দিতে পারলে হয়ত আপনার প্রস্থান হবে পৃথিবী থেকে! হোসেন আলী ভাবে জীবন্ত মানুষকে নিয়ে না এমন করা গেল, কিন্তু মৃত মানুষের লাশ কারা কবর থেকে তুলে নিয়ে যায়? মৃত মানুষের হাড়, কঙ্কালও নাকি অনেক দামী। বিগত ছয় মাস ধরে হোসেন আলীদের গোরস্থান থেকে প্রায় দুএকটি করে কবর খোড়া পাওয়া যায়। সেই কবরে কোন লাশের চিহ্ন থাকে না। গ্রামের সহজ সরল মানুষ বিষয়টির প্রতি তেমন আমল দেয় না। তারা মনে করে, হয়ত শিয়ালে পঁচা লাশ খেয়ে ফেলেছে। কিন্তু হোসেন আলীর মনে অন্য সন্দেহ ঢুকে যায়। আজো লোকগুলো সেতুর ওপর বসা। হোসেন আলী সেতুর ওপর বসতে যাবে এমন সময় ওদের মধ্য থেকে একজন বলে ওঠলো, ‘কাকা আমরা একটা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ করছি, আপনি এখানে না বসলে খুঁশি হবো’। হোসেন আলী জোছনার আলোতে দেখতে পায় একটি ছেলে হাতে পিস্তল। ছেলেটি হোসেন আলীকে দেখানোর জন্যেই পিস্তলটি বের করেছে। এমন সময় হোসেন আলীর পাশে একটি রিকসা এসে থামে। গ্রামের রাস্তা হওয়াতে রাত এগারোটার পর এই রাস্তায় কোনো মানুষের চলাচল নেই। রিকসাওয়ালা সোজা সেতুর ওপর ওঠে। ওদের মাঝ থেকে একজন রিকসাওয়ালাকে বলে, ‘কোদালটা এনেছিস?’ রিকসাওয়াল হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। আরেকজন জানতে চায়, বস এসেছে কি না? রিকসাওয়ালা জবাব দেয়, ‘তারা মাইক্রো নিয়ে দু’ঘন্টা আগেই বসে আছে পাঁকা রাস্তায়’। হোসেন আলী বিপদের আভাস পায়। সে আর দেরি করে না। দ্রুত বাড়ির দিকে রওয়ানা হয়। পিছন থেকে ওদের একজন একটি টর্চ লাইট জ্বেলে বলে, ‘কাকা আমরা লাইট ধরছি, আপনি বাড়ি যান’।
ঘরে ফিরে হোসেন আলী টেবিলের সামনে রাখা চেয়ারে বসে। তার স্ত্রী ও মেয়েটি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আজ রাতে হোসেন আলীর কিছুতেই ঘুম আসবে না। কেন আসবে না, তার কারণও কাউকে সে বলতে পারছে না। যদি তার স্ত্রী এই ঘটনা শুনে, তাহলে তাকে আর রাতে বের হতে দিবে না। হোসেন আলী আবারও ঘর থেকে বের হয়ে টিউবওয়েলে দিকে যেতে থাকে। পূর্ণিমার চাঁদটিকে ইতোমধ্যে কালো মেঘ প্রায় গ্রাস করতে যাচ্ছে। কেমন যেন অন্ধকার লাগছে চারদিক। চাঁদের দিকে তাকিয়ে হোসেন আলী বলতে থাকে, ‘তুইও কী ওদের দলে? তা’না হলে আলো নিভাচ্ছিস কেন?’ চাঁদ কোনো জবাব দেয় না। চিরকালের জন্য দেয়া ‘না দেখা কলঙ্ক’ মাথায় নিয়ে চাঁদের মত চাঁদ জোছনা ভাঁসায় আবার আঁধার নামায়। টিউবওয়েলের হাতলটা ধরে হোসেন আলী একটি চাপ দিয়ে সামনে তাঁকায়। তার মনে হয়, গোরস্থানের মধ্যে কারা যেন কাজ করছে। তাহলে আবার কোনো মানুষ মারা গেল নাকি যাকে দাফন করা হচ্ছে? নিশিপল্লীর এই গোরস্থানে শুধু নিশিপল্লীর মানুষরাই শুয়ে নেই, শুয়ে আছে বিশ পঁচিশটা গ্রামের মানুষ। ইদানিং নদীর ওপার থেকে মানুষ এনে এখানে দাফন করা হয়। নিশিপল্লীর মানুষ জানে না কাকে দাফন করা হল।
সবুর মিয়ার ছেলে হুমায়ূন। লেখাপড়া শেষ করে সাংবাদিকতায় ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। সারা বাংলাদেশ তাঁকে চেনে স্পষ্টভাষী হিসেবে। ঢাকায় বাড়ি-গাড়ির মালিক যে সময়ে হওয়ার কথাছিল তার চেয়ে আরো দশ বছর পরে হুমায়ূনের গাড়ি বাড়ি হয়। কিন্তু পেশা জীবনে তার সৃষ্টি হয় অনেক শক্রু। কিছুদিন আগে হুমায়ূন বৌ-বাচ্চাসহ নিজের গাড়ি নিয়ে বাড়িতে বেড়াতে আসে। বাড়িতে আসলে এক মিনিটও হুমায়ূন স্থির থাকে না। সারাক্ষণ ছুটে বেড়ায় গ্রামের বন, বাদার, মাঠ, ঝিল, নদীনালা, খালবিলে। যারা বৃদ্ধ হয়ে গেছেন হুমায়ূন তাদের দেখতে যায়। কুশল বিনিময় করে। নিশিপল্লীর সেই গৌরব হুমায়ূন কিছুদিন আগে বিকালে বৃষ্টিতে গোসল করতে ছিল। হঠাৎ বজ্রপাতে সে কদম গাছে তলায় মরে দাড়িয়ে থাকে। বজ্রপাতে মৃত ব্যক্তিকে স্পর্শ না করা পর্যন্ত সে যে অবস্থায় ছিল ঐ অবস্থায় থাকে। চারদিকে চিৎকার চেঁচামেচিতে লোকে লোকারণ্য। বজ্রপাত যে নিশিপল্লীতেই হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। মানুষ খুঁজে বেড়াচ্ছে কার বাড়িতে বজ্রপাতটি হলো? এক সময় হুমায়ূনের লাশ দেখে নিশিপল্লীর মানুষ হতবিহবল হয়ে যায়। তারা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না, হুমায়ূন মারা গেছে। তবুও সত্য চিরদিন সত্য। হুমায়ূন আর ফিরে আসবে না। তার মৃত্যুর সময় দেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি উপস্থিত থাকলেও তার একমাত্র ফুফু অসুস্থতার কারণে সেদিন হুমায়ূনের দাফন কাফনে শরিক হতে পারে নি। ৮৫ বছর বয়সি হুমায়ূনের ফুফুর শরীরটা মাস খানেক পরে একটু সুস্থ হলেই তিনি ছুটে আসেন সবুর মিয়ার বাড়িতে হুমায়ূনের কবর জিয়ারত করতে।
হোসেন আলী ভাবে হয়ত হুমায়ূনের ফুফুরা তার কবর জিয়ারত করছে। টিউবওয়েরের ঠান্ডা পানি চোখে মুখে দিয়ে হোসেন আলী আরো ভালো ভাবে লক্ষ্য করে গোরস্থানের দিকে। কিন্তু এখনও কিছু দেখা যাচ্ছে না। কার প্রয়োজনে কে এসেছিল গোরস্থানে এই ভেবে আর রাত জেগে লাভ নেই। যা হবার তাই হবে, আর যা করার তারা তাই করবে। এভাবেই তো চলছে দেশ। তাহলে আমার মত হোসেন আলীর এত মাথা ঘামিয়ে লাভ কী? মাথায় কয়েক ফোটা বৃষ্টির পানি পড়তেই হোসেন আলী দ্রুত নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা হয়। টেবিলের সামনে এসে তাওয়ালটা নিয়ে মাথা মুছতে থাকে। জগে ভরা পানিটুকু জগ ধরে পান করতে থাকে। তার আজ অনেক পিপাসা পেয়েছে। কেন জানি বুকটা আর মুখটা বার বার শুখিয়ে যাচ্ছে। মেয়ে মিথিলার পাশে বালিশটা নিয়ে হোসেন আলী শুয়ে পড়ে। মেয়ে মাথায় একটি হাত বুলিয়ে দেয়। আয়তাল কুরছি পাঠ করে মেয়ের মাথায় ফু দেয়। এই কাজটা করতে সে কখনই ভুল করে না। বিছানায় গা এলাতেই রাজ্যের চিন্তা তার মাথায় ভর করে। আজকাল দেশের একি হল! মরা মানুষের লাশ নিয়ে যাচ্ছে কারা? তারা এই লাশ দিয়ে কী করে? সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা ইতোমধ্যে লাশ চোর কয়েকটি সংঘবদ্ধ দলকে ধরেছে। মিডিয়াতে অপরাধী চক্রের বিস্তার শুনে এবং লাশগুলো কী করা হয় তা শুনে হোসেন আলী চোখ কপালে ওঠে যায়। কী করে এক শ্রেণির ডাক্তার নামধারী পশু এই সব লাশ চুরির ঘটনায় জড়িত থাকে!
বাইরে কিছুটা ভারী বৃষ্টি হচ্ছে। নানা চিন্তার জগতে হোসেন আলী সাঁতরাতে সাঁতরাতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে যায়। কখন যে ঘুমের দেশের বাসিন্দা হয়ে ডুব দেয় মৃতপুরীর শান্ত ঘরে তা সে নিজেও জানে না।
সকালে মানুষের চিৎকার চেঁচামেচিতে তার ঘুম ভাঙে। হোসেন আলীদের বাড়িতে ত্রিশ চল্লিশজন মানুষ জড়ো হয়েছে। হোসেন আলীর পিতা গ্রামের মুরুব্বি। সকলেই এসেছে তাঁর কাছে। হোসেন আলী চেঁচামেচি শুনে দ্রুত বিছানা ছেড়ে ওঠে পড়ে। তখনও সূর্য ওঠে নি। বাইরে এসে দেখে পুরুষ মহিলা মিলে গোটা পঞ্চাশেক মানুষ জড়ো হয়েছে তাদের বাড়িতে। সবুর মিয়ার ভাই শহর মিয়া হোসেন আলীর বাবাকে বলতে থাকে, ‘কাকা হুমায়ূনের ফুফু অসুস্থ মানুষ। আধমরা অবস্থায় হুমায়ূনের কবর জিয়ারত করতে গত রাত এগারোটার সময় ভাইয়ের বাড়িতে এসেছে। রাতে বৃষ্টি হওয়ার কারণে আমরা তাকে নিয়ে আর গোরস্থানের দিকে যায় নি। ভাবলাম সকালে ফজর নামাজ শেষে তাঁকে নিয়ে কবর জিয়ারত করতে যাবো। সেই মোতাবেক সবাই সকালে নামাজ পড়ে গোরস্থানে এসে দেখি হুমায়ূনের কবরটা খুঁড়া। কবর থেকে কোন গন্ধ বের হচ্ছে না। ভাবলাম শিয়াল হয়ত কবরটা খুড়েছে। নতুন মাটি কবরে রদয়ার জন্য একটি কোদাল নিয়ে কবরের কাছে যাই। গিয়ে যা দেখলাম, বলেই শহর মিয়া কাঁদতে থাকে। হোসেন আলীর পিতা শহর মিয়াকে থামতে বলে। আগে ঘটনা বল। কাকা, গিয়ে দেখি আমাদের হুমায়ূনের লাশ কবরে নাই। কারা যেন তাঁর লাশ চুরি করে নিয়ে গেছে। হুমায়ূনের ফুফু নিজ চোখে কবরে লাশ দেখতে না পেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। তাঁকে ইতোমধ্যে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কাকা, কারা আমাদের হুমায়ূনের লাশ চুরি করলো? হোসেন আলীর পিতা পুরোনো দিনের মানুষ। শহর মিয়ার কথা সে বিশ্বাস করতে পারে না। মানুষ কী এতটা পশু হয়ে গেছে? হোসেন আলীর পিতা বলতে থাকে, ‘ভেবেছিলাম মারা গেলে গোরস্থানের রাখার কথা বলে যাবো। এখন দেখছি সেটা আর সম্ভব হবে না। কারণ জ্যান্ত মানুষের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছি এ বদমান শুনেও শান্ত ছিলাম। কিন্তু মৃত মানুষের নিরাপত্তা যখন আমরা দিতে পারছি না তাহলে আমি মরার পর আমার বাড়ির সামনেই কবর দিস। তবুও শান্তি পাবো এই ভেবে যে, আমার লাশটা অন্তত চুরি হবে না। যুগ পরিবর্তন হয়েছে সেটা জানি, কিন্তু পরিবর্তনের মাত্রায় পশুকে হার মানিয়েছে তা জানতাম না। আজ থেকে অন্য গ্রামের কোন লাশকে নিশিপল্লীতে দাফন করতে দিবি না।’

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ