প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Sunday, September 9, 2012

আবদুল মান্নান সৈয়দ সৎ ও বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনার কারিগর | মুহাম্মাদ হাবীবুল্লাহ

১.
আবদুল মান্নান সৈয়দ ছিলেন আমাদের সমালোচনা-সাহিত্যের একজন দক্ষ কারিগর। কারিগর শুধুই নির্মাণ বা প্রতিনির্মাণ করেন না; অনেক সময় আবিষ্কারও করেন- যদি তিনি প্রতিভার ঘোড়ায় সওয়ার হতে পারেন। মান্নান সৈয়দ ছিলেন প্রতিভার দুর্দান্ত ঘোড়ার পিঠে সদাসওয়ার। তাই তিনি নির্মাণ বা প্রতিনির্মাণ ছাড়াও আবিষ্কার করেছেন অনেক কিছু। সমালোচক হিসেবে তিনি ছিলেন সৎ, নিষ্ঠাবান, উদার ও গ্রহিষ্ণু। সমালোচনা সম্পর্কে তাঁর শাণিত, সাহসী ও ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গী স্মরণীয় ও অনুসরণীয়। সমালোচনা তিনি এতো বেশি করেছেন এবং সমালোচনা সম্পর্কে এতো বেশি লিখেছেন যে, যার পরে আমাদের পক্ষ থেকে তাঁর দৃকভঙ্গি সম্পর্কে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না-ব্যাখ্যা তো দেওয়ার প্রয়োজন নেই-ই। সমালোচনা সম্পর্কে তাঁর মত ও পথ অনুধাবনের জন্যে আমরা তাঁর ‘বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা' গ্রন্থের প্রথম তিনটি রচনা (যথাক্রমে : সমালোচনা, সমালোচনার সামাজিক দায়, সমালোচনার সমালোচনা) থেকে কিছু উদ্ধৃতি পেশ করছি,
‘‘নিহিতার্থ সন্ধান সমালোচনার প্রধান কাজ। রূপকে সমালোচনা অগ্রাহ্য করে না, কিন্তু তার অন্তিম গন্তব্য আত্মা। যে-সমালোচনা রচনার আত্মাকে আবিষ্কার করতে পারলো না, তা বৃথা। আজকালকার দেহাত্মবাদী সমালোচনারও তীর্থ আত্মাই। আধুনিক সমালোচকের কাছে আধার ও আধেয় তুল্যমূল্য। ... খারাপ লেখাকে সবসময় চিহ্নিত করার দরকার নেই সমালোচকের, কিন্তু উত্তীর্ণ রচনা মাত্রকেই শনাক্ত করা প্রয়োজন। খারাপ লেখা আপনিই ঝরে যায়। কিন্তু ভালো লেখার তারিফ সাহিত্যের উন্নয়নের জন্যে, দিকনির্দেশের জন্যে দরকার। ভালো লেখা অপ্রশংসিত অবস্থায় পড়ে থাকা মানে সেই সাহিত্যের একটি সম্পদ থেকে বঞ্চিত হওয়া নয় কেবল-পরবর্তী সাহিত্যের অগ্রসরণও তাতে বাধাগ্রস্ত হয়। ভালো লেখা চিহ্নিত করা মানে রুচির নির্মাণ, রুচির উন্নয়ন, রুচির গুঞ্জরণ। ... স্পষ্টতার জন্যে সমালোচনার ভাষায় স্বচ্ছতা অনিবার্য। স্বচ্ছতার মানে অবশ্য তরলতা, রম্যতা বা সাংবাদিকতা নয়। সাধারণত এই তিন দোষ জুড়ে থাকে সমালোচনায়। সমালোচনা শেষ পর্যন্ত সাহিত্য। কাজেই তাকে স্বচ্ছ কিন্তু নির্বহুল হতে হয়, সাহিত্যগুণে ঋদ্ধ হতে হয়। ... শুক্ল, স্বগত, সংযত সমালোচনাই শ্রেষ্ঠ সমালোচনা। ... রুচিই হচ্ছে সমালোচনার আদি উৎস। রুচিই নির্বাচনের শক্তি দ্যায়। বাজে সমালোচকের রুচি খারাপ, এবং নির্বাচনের শক্তি নেই। ... সমালোচনায় নৈর্ব্যক্তিকতার কথা বলা হয়ে থাকে। কিন্তু আসলে নৈর্ব্যক্তিকতা একটা অসম্ভব ব্যাপার। সমালোচকও তো আদর্শবান, যে-আদর্শ তাঁর পাঠ, প্রস্তুতি, অনুভূতি, অভিজ্ঞতার একটি কেলাসিত রূপ। প্রত্যেক সমালোচক তো অনন্য হয়ে ওঠেন তাঁর এই আদর্শ থেকেই। সম্পূর্ণ নৈর্ব্যক্তিক যিনি, তিনি সমালোচক নন। ... মন্তব্য সমালোচনা নয়, সমালোচনা মানে বিশ্লেষণ। সে-বিশ্লেষণে রচয়িতার অন্তঃপ্রকৃতি কেবল বিশ্লেষিত হয় না, হয় তাঁর সমকালীন দেশ-কালও, তাঁর ধারাবাহিকতাও। সেজন্যে সমালোচনায় একটি সামাজিক দায়িত্ব উদযাপিত হয়। সাহিত্যের সত্য কোনোদিন কোনো চলিষ্ণু সামাজিক সত্যের বিরোধী হতে পারে না-অন্তর্গত অর্থে। হতে পারে আপাত-বিরোধী, কিন্তু স্থায়ী সত্যের উপাদান তার মধ্যে থাকেই থাকে। সমালোচনা তো কোনো জীবনবিচ্যুত জীবনবিদ্বেষী অতি তাত্ত্বিক রূপ মাত্র নয়। সমালোচনা জীবনশ্লিষ্ট এক ব্যাপার। সুতরাং সমালোচনা ব্যাপারটিই সামাজিক ব্যাপার। সমালোচনা সামাজিক।’’ (বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪।)
সাহিত্য-সমালোচনার ক্ষেত্রে তাঁর এমন সাম্যশীতল অথচ সাহসশাণিত দৃষ্টিভঙ্গি না হলে কি তিনি সৈয়দ আলী আহসানকে-যাঁর নাম-গন্ধও আজ পাওয়া যায় না আমাদের সাহিত্যাঙ্গনে-এদেশের আধুনিক সমালোচনা-সাহিত্যের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ আখ্যা দিতে পারতেন? তিনি সৈয়দ আলী আহসান সম্পর্কে লিখেছেন,
‘‘বস্তুত সৈয়দ আলী আহসানই এদেশের আধুনিক সমালোচনা-সাহিত্যের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা পুরুষ। তিনিই প্রথম এদেশে এলিয়ট-কথিত সমালোচনার দুই কুশলতা, তুলনা ও বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেন। বিষয়বিচারী সনাতন সমালোচনা-পদ্ধতি তাঁর আগে, এবং পরেও, আমাদের সমালোচনাকে বিপর্যস্ত করেছে-এবং সেজন্যে তাঁর সমালোচনা-পদ্ধতি অনুধাবনযোগ্য। পান্ডিত্য কখনো ভার হয়ে দেখা দেয়নি তাঁর রচনায়-একটি লঘু সচ্ছল ক্রীড়াশীল ভূমিকা উদযাপন করেছে। (বাংলা সাহিত্যে মুসলমান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, পৃ. ২৫৯, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৯৮।) এবং এই একই কারণে তিনি সুসমালোচনার অভাব, সমালোচনায় সহিষ্ণুতা ও নিরপেক্ষতার অভাবকে সাহিত্যজগতের জন্য মনে করতেন এক চূড়াস্পর্শী নৈরাজ্য -সাহিত্যের ক্রান্তিকাল :
‘‘ভালো সাহিত্যপত্র, সুসমালোচনা, সহিষ্ণুতা, নিরপেক্ষ তা প্রভৃতির অভাবে সাহিত্যজগতে নৈরাজ্য এখন চূড়াস্পর্শী। লিখতে শেখার আগেই গ্রন্থ প্রকাশ করা, প্রকাশনা-উৎসবের ব্যবস্থা করা, পত্রিকায় কাগজী সমালোচনার আয়োজন করা- এ সবই হয়ে দাঁড়িয়েছে সাহিত্যের নিয়ামক শক্তি। হ্যাঁ, যাকে একসময় হেসে উড়িয়ে দিয়েছিলাম, সেই ক্রান্তিকাল সাহিত্যে এখন সত্যি এসে উপস্থিত হয়েছে।’’ (মাসিক অগ্রপথিক, ফেব্রুয়ারি ২০০৮, পৃ. ১৫, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।)
২.
শিল্পে-সৃজনে তেমন কোনো জবাবদিহির প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে একজন শিল্পী যখন অভ্যাসের অনুবর্তনে চর্চিত আপাতসৌন্দর্যাসক্তি থেকে বাঁক বদল করে বাস্তব সৌন্দর্য ও উচ্চাদর্শের দিকে ধাবিত হন, তখন তাঁকে নানা প্রশ্নের পিচ্ছিল কাদায় পড়তে হয়, তবে তিনি তাতে আটকে না পড়ে, সরল-স্বচ্ছ পথ বেয়ে মনজিলের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। তাই  এসব প্রশ্নের উত্তর, আমার মনে হয়, তিনি অনেকটা বাধ্য হয়ে দিয়েছেন। কারণ, ‘সৃজনের কোনো জবাবদিহি চলে না। কবি বা শিল্পীর স্বধর্মই চলিষ্ণুতা।' বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ‘সোনালি কাবিন'এর কবি কেন পরে বাস্তববোধ, বিশ্বাস ও লক্ষ্যভেদী ‘সরল পথ'-এ ক্রমঅগ্রসর হলেন, সেই প্রশ্ন অনেককে পিষ্ট করেছে। আবদুল মান্নান সৈয়দ তাঁর পক্ষ হয়ে উত্তর দিয়েছেন :
‘‘সোনালি কাবিন'এর কবি কেন ওরকম নয় এরকম, অর্থাৎ পাঠক বা সমালোচকের ইচ্ছাপূরক নয়- এসবের কোনো জবাব নেই। সৃজনের কোনো জবাবদিহি চলে না। কবি বা শিল্পীর স্বধর্মই চলিষ্ণুতা। তাঁর এই স্বাভাবিক পরিণামকে না-বুঝে যদি ‘‘ডাকঘরে’’র মাধব দত্তের মতো আমরা অস্থির হয়ে উঠি, তাহলে আল মাহমুদের অধিকার আছে ঐ নাটকের ঠাকুর্দার মতো কড়া ধমক দিয়ে উঠতে, ‘চুপ করো অবিশ্বাসী! কথা কয়ো না।'-’’ (আল মাহমুদের সাম্প্রতিক কবিতা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, প্রেক্ষণ (সাহিত্য ত্রৈমাসিক), আল মাহমুদ সংখ্যা, ২০০৭, পৃ. ১৬০।)
তাঁর একটি কাব্যগ্রন্থ মাছ সিরিজ (১৯৮৪)। প্রকাশের পর বেশ আলোড়ন সৃষ্টি করে। তাঁর সামগ্রিক কবিতাচর্চা থেকে এই গ্রন্থ বেশ ভিন্ন। এ-গ্রন্থের কবিতাগুলো বিশুদ্ধ প্রতীকী কবিতা। ভাবে-বিষয়ে তাঁর অন্যান্য কবিতা থেকে বেশ আলাদা। কবিতাগুলোতে রয়েছে আধ্যাত্মিকতা ও মরমিবাদ। মরমিবাদ মান্নান সৈয়দের জীবনে সবসময়েই ছিল। সে-কথা এক সাক্ষাৎকারে তিনি স্বীকার করেছেন। তবে তিনি ধার্মিকতা ও মরমিবাদকে আলাদা করে দেখেন। তাঁর মতে ‘ধার্মিকতা হলো ধর্মাচরণ আর মরমিবাদ হলো ঈশ্বরবোধ'।
মনে রাখতে হবে, কবিতা-বিচার শুধু আধেয় দিয়ে নয়। আধার ও আধেয় দুটোই বিচার্য্য। কী বলা হচ্ছে এবং কীভাবে বলা হচ্ছে- দেখার বিষয় দু'টোই। বিষয় ও শিল্পরীতি দু'টোরই গুণাগুণ শনাক্ত করতে হবে। কবিতার মতো নান্দনিক পরিচর্যার বিষয়টি শুধু বিষয় দিয়ে কলুষিত হতে পারে না। বিষয়ের কারণে কবিতা শুদ্ধ কিংবা অশুদ্ধ হয় কী করে? কবিতা-অকবিতা বিচারের প্রশ্নটি যদি এসেই যায়, তা হলে তা করতে হবে শৈল্পিক গুণাগুণের নিরিখে-আধেয় ও আধার দু'টোকেই সামনে রেখে। যেটাই বলা হোক না কেন, শিল্পগুণে সমৃদ্ধ হলেই কবিতা হবে, এ যেমন একদিকে সত্য, তেমনিভাবে আরো জোরালো সত্য যে, কবি একজন মানুষ হিসেবে, সামাজিক জীব বলে এবং কবির সামাজিক দায়িত্ব আছে বলে, তাকে লক্ষ্য রাখতে হবে, তার সৃষ্টি যেন মানবজাতিকে চিরসুন্দর ও কল্যাণের শিবিরে আশ্রয় দেয়। আরেকটু এগিয়ে যদি বলি, ‘ঈশ্বরগুপ্তের কাছে কবিতা শুধু শিল্প নয়, সমাজ-সংস্কারের হাতিয়ার', তাহলে আমাদের কথাকে অনেকে ‘প্রেতকাহিনীর পুনরাবৃত্তি' বলে উড়িয়ে দিবে। কিন্তু ভুললে চলবে না, কাব্য ভাব বা বিষয়-নিরপেক্ষ কোনো রূপরচনা নয়। কাব্য ভাব বা বিষয়কে অবলম্বন করে, স্বপ্ন-কল্পনা ও সৌন্দর্যের পথ ধরে সৃজনশীলতার স্পর্শে এক অপরূপ মোহনীয়তা সৃষ্টি করে। ফলে রাজনীতি-সমাজনীতি, ধর্ম-দর্শন, সবকিছুই কাব্যের বিষয় হতে পারে, তবে সবকিছুকে আসতে সৌন্দর্যের রূপে, যা কবি-পাঠকের কল্পনাকে তৃপ্তি দেয়। আর এই স্বপ্ন-কল্পনা ও সৌন্দর্যের পথ ধরে সৃজনশীলতার স্পর্শে এক অপরূপ মোহনীয়তা সৃষ্টি করতে পারলেই, কবিতার (এবং ব্যাপক অর্থে যে কোনো শিল্পকর্মের) অন্তর্গত ভাব বা বক্তব্যবিষয় চিরপুরাতন হয়েও চিরনবীন হতে পারে অভিব্যঞ্জনায়। আসলেই এই নতুনত্ব ও মনোহারিত্ব উপস্থাপনা ও প্রকাশকৌশলের কারণেই। অভিব্যঞ্জনায় অভিনবত্ব আসতে হয় সৌন্দর্যের রূপে, কল্পনার পথ ধরে। উপর্যুক্ত বিচারে মান্নানের ‘সকল প্রশংসা তাঁর' অসাধারণ শিল্পকোমল কাব্যগ্রন্থ। ধর্মের চিরাচরিত বিষয়গুলোকে তিনি কবি-কল্পনার মাধুরি মিশিয়ে, আশ্চর্য কুশলী ভাষায় উপস্থাপন করেছেন। দেখা যাক কিছু পঙক্তি :
তাঁরই মুক্তা প্রজ্জ্বলিত ঘন-নীল রাত্রির ভিতরে;
তাঁরই হীরা দীপ্যমান দিবসের পূর্ব ললাটে;
যুক্ত করে দেন তিনি তুচ্ছতাকে- অসীমে, বিরাটে;
সমস্ত সৌন্দর্য তাঁরই লোকোত্তর প্রতিভাস ধরে। (সকল প্রশংসা তাঁর, পৃ.০৯)

-তোমারই আদর্শ আজো আমাদের অবাধ্য শণিতে
খেলা করে। তাই আজো মৃত্তিকার পৃথিবী রঙিন;
প্রবল বন্যারাও শেষে শস্য জাগে উর্বর পলিতে। (হজরত উমর (রা.) গোলাপে-ইস্পাতে, পৃ. ২১)

যতোদূর চোখ যায় নীলাকাশ সুদূরবিস্তৃত,
রৌদ্রের প্লাবনে ওই ভেসে যাচ্ছে মাঘের আকাশ।
দীপ্ত দিনের শহরে এদিকে জনতা উর্দ্ধশ্বাস
যে যার নিজের কর্মে ধাবমান -আত্মসমাহিত। (মধ্যদিন, পৃ. ৩১)

পৌষের দুপুরবেলা। বসে আছি ছাদের উপর।
নীলাকাশে ভেসে আছে পেঁজা-পেঁজা শাদা মেঘদল-
আসছে, যাচ্ছে। যতোদূর দৃষ্টি যায়, রৌদ্রকরোজ্জ্বল।
পাখির ডাকের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে হাতুড়ির স্বর। (স্কেচ, পৃ. ৩৫)
৩.
যে-শিল্প -সাহিত্য/কবিতা- মানুষের আত্মিক প্রয়োজন পূরণ করে না এবং যে-কবিতা আত্মার খিদে মেটায় না; আত্মার খিদে জাগায়ও না, তাকে কবিতা নয় বলে তিনি ঘোষণা দিয়েছেন। চিন্তাহীন ও নিশ্চিন্ত, অনর্গল ও অমল উৎসারণকে কবিতা নয় বলে তিনি আখ্যা দিয়েছেন। এবং তিনি বলেছেন, চিন্তাই একজন কবিকে বিশ্বাসের দুয়ারে উপনীত করে। এই যে বিশ্বাসের কথা, এবং আরো গভীর অর্থে আদর্শের কারণে শিল্প ব্যাহত হয় না, ধূসরতায় ম্লান হয় না-সেকথা কায়কোবাদ থেকে শুরু করে আজকের আল মাহমুদের শিল্প সম্পর্কেও জোর দিয়ে বলেছেন বারবার। এমনকি অপেক্ষাকৃত ‘কমখ্যাত'-অথচ প্রতিশ্রুতিশীল-সম্ভাবনাময়- সমসাময়িক অনুজ কবিদের সপ্রশংস স্বীকৃতি দিয়েছেন। মতিউর রহমান মল্লিক, সাজজাদ হোসাইন খান, জাকির আবু জাফর, খায়রুল হাবীব, আহমদ আখতার, মোশাররফ হোসেন খান, হাসান আলীম, আসাদ বিন হাফিজ, সোলায়মান আহসান, মোহাম্মদ শাকেরউল্লাহ প্রমুখের কবিতাকীর্তির আলোচনা করে তিনি সমালোচনায় সততা ও নিরপেক্ষতার স্বাক্ষর স্থাপন করেছেন।
ধর্মবিশ্বাস আর সত্য-সুন্দরের বিশ্বাসই উপরোক্ত কবিদের কবিতাকে মহিমান্বিত করেছে- প্রকৃত কবিতা করে তুলেছে। তিনি অনেক কবিদের সম্পর্কে বলেছেন, ‘বিশ্বাসী হয়েও তিনি কবি, বিশ্বাসী হয়েই তিনি কবি'। বাক্যদ্বয়ের ‘আধুনিক' ব্যাখ্যা কী দিবেন আজকের ‘আধুনিক কবিরা'?- জানতে বেশ ইচ্ছে করে। আমাদের মতো আধুনিক ‘কাব্য-খদ্দরদের' জিভ থেকে লালা ঝরে ‘আধুনিক সমালোচনা'র স্বাদ নেয়ার জন্যে। সুতরাং তাঁরই কথা ধার নিয়েই বলি, মান্নান সৈয়দ কবি বলেই বিশ্বাসী, বিশ্বাসী বলেই তিনি প্রকৃত কবি। সেই বিশ্বাসের ‘মেরাজ' তথা সমুন্নতি ঘটেছে ‘সকল প্রশংসা তাঁর', ‘মাছ সিরিজ' ও ‘আমার সনেট' ইত্যাদি গ্রন্থে।
কোনো সচেতন পাঠক এবং সন্ধানী সমালোচকের অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আবদুল মান্নান সৈয়দ আকৈশোর ফররুখ-অনুরাগী, এবং কবিতায় বহুদিক দিয়ে তিনি ফররুখ-প্রভাবিত। তবে অন্য-অনেক ফররুখ-অনুসারীদের মতো তাঁর কাব্যচেতনায়ও মিশ্রভাব পরিলক্ষিত হয়। মান্নান সৈয়দের ফররুখ-অনুরাগ এবং তাঁর কবিতায় ফররুখ-প্রভাব প্রসঙ্গে আমি শামসুল ইসলাম সাঈদের বক্তব্য হাজির করছি। তিনি বলেন,
‘‘ফররুখের অনুসারী অন্য কবিদের ভেতর কাব্যচেতনায় মিশ্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আল মাহমুদের কবিতার প্রাথমিক স্তরে ফররুখের প্রভাব না থাকলেও পরবর্তীকালে আল মাহমুদ ফররুখের কাব্য দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। ... অন্য উল্লেখযোগ্য কবি হচ্ছে আবদুল মান্নান সৈয়দ, তিনি আকৈশোর ফররুখ-অনুরাগী। ... তাঁর জ্যোৎস্না রৌদ্রের চিকিৎসা (১৯৬৯) কাব্যগ্রন্থের প্রথম কবিতাতেই ‘সূর্যাস্ত ফেলেছে নিঃশ্বাস ফেরেস্তাদের রঙচঙে কাপড় চোপড়... ফাজিল আলোয় বসে নিদ্রার অপর জামা পরে আমার আল্লার ধ্রুব... আকাশে বসেছে মাশায়রা ফিরোজ অত্যাচারে পোড়ে মধ্যরাত। তুলি ধরি বান্দার রেকাব... কবিতা হা আমার কবিতা' ইত্যাদিতে এ ভাব প্রকাশ করলেও তাঁর কবিতা অনেক ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদকে অনুসরণ করেনি। অবশ্য আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতায় সংশয়াচ্ছন্নতা স্পষ্ট, কখনো জীবনানন্দ দাশের কখনো ফররুখ আহমদের প্রভাবে তিনি উচ্চকিত।’’ (কাব্য বিশ্বাসের কবি ও কবিতা, শামসুল ইসলাম সাঈদ, পৃ. ১৪৪, ইউপিএল, ঢাকা, ১৯৯৫।)
যেখানে, শুধু বিশ্বাস ও ধর্মের কারণেই, প্রকৃত কবিতার মহিমা খর্ব করার চেষ্টা করা হয়েছে, সেখানেই তিনি ক্ষোভে-ক্রোধে ফুঁসে ওঠেছেন। ফররুখ আহমদের সমকালীন সতীর্থ কবি-বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়। ফররুখের কবিতা সম্পর্কে তাঁর মগজহীন মতলবী মন্তব্যের প্রতিবাদে মান্নান সৈয়দ লিখেন,
‘‘ফররুখ সম্পর্কেও এরকম দুরুক্তি করেছেন তিনি (সুভাষ মুখোপাধ্যায়) ‘আমার বন্ধু ফররুখ' নামক রচনায়। তিনি লিখছেন :
‘আমার কাছে চাপলেও নিশ্চয় গোঁড়া ইসলাম ধর্ম ওকে প্রবলভাবে টেনেছিল। তারই জোয়ারে লেখা ওর ‘সাত সাগরের মাঝি'। ধর্মীয় অনুপ্রেরণায় ভোল পাল্টে গিয়েছিল ওর লেখার। তার পাশে ওপর প্রথম যৌবনের প্রেমের কবিতাগুলো একেবারেই জলো মনে হয়।'
এই উক্তির প্রতিটি শব্দের পেছনে বদ-মতলব কাজ করেছে। প্রথমত, ইসলাম ধর্মই গোঁড়া, সুভাষ মুখোপাধ্যায় এই জ্ঞান কোত্থেকে পেলেন? দ্বিতীয়ত, ‘সাত সাগরের মাঝি'তে এককণা গোঁড়ামি নেই, আছে বিশুদ্ধ কবিতা। ইসলামী অনুপ্রেরণা এখানে কাজ করেছে-প্রেরণা এখানে কবিতায় রূপান্তরিত হয়েছে বলেই না ফররুখ আহমদকে নিয়ে আমাদের এতো গৌরব, তাঁকে নিয়ে অনেকের বিতর্ক-বিদ্বেষ, এমনকি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কূটভাষও ঐ কারণেই।'' (বিবেচনা-পুনর্বিবেচনা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, পৃ. ১২৯, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪।)
মান্নান সৈয়দের কাছে ‘ইসলামি বাংলা সাহিত্য বলে' স্বতন্ত্র কিছু ছিল না। তাঁর বিবেচনার একমাত্র মানদন্ড ছিল সাহিত্যিক বা শৈল্পিক গুরুত্ব। সেখানে হিন্দু-মুসলমান পরিচয়, কিংবা ধর্মীয়-অধর্মীয় সাহিত্য অভিধা কোনোভাবেই মুখ্য ছিল না। এ কারণেই তিনি নিজের উদার করতলে কেবল একটি দেশ নয়, একটি মহাদেশকে ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ