প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Sunday, September 2, 2012

নেশাখোর | তৈয়ব খান

ধরণীর বুকে বিস্ময়কর মানুষের রূপ লয়ে
এসেছি আমি সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ; মহাগৌরব হয়ে।
কী সে স্বপ্ন-সম্ভাবনা কী সে আশার আলো
দেখেছেন প্রভু আমার ভেতর তিনিই জানেন ভালো।
মানব জমিনে কোন প্রয়োজনে এসেছি জানি না তা
শুধু জানি এই, আর কেউ নেই তিনি ছাড়া বিধাতা।
আমি আল্লাহর প্রতিনিধি-
শ্রেষ্ঠত্বের এ ঋণ আমি কেমন করে শুধি?
জানি তা হবে না শোধা-
আমার ভেতরের এ আকূলতা জানেন কেবল খোদা।
উপভোগের যতো উপকরণ তাঁর দেয়া উপহার
তাপ-আলো-বায়ু-জল-অন্ন ভোগ করে বেশুমার-
আজ প্রাণ ভরি’ শুকরিয়া করি আর ঝরে আঁখি লোর।
শূন্য হাতে একা ফিরে যাবো ! আমি তাই নেশাখোর।।

কোটি শুকরিয়া জানাই তোমায় হে মালিকুল মুলক
সৃষ্টি জগৎ দেখে গো তোমার এ বুকে জাগে যে পুলক!
বর্ণালী রঙ মাখা সবখানে!
কখনো প্রকাশে কখনো গোপনে-
আপনা প্রকাশ হয়েছো তুমি স্রষ্টা হে সু-চতুর।
আমি দেখে হাসি নেশার পিয়াসী  অনন্ত নেশাখোর।

সব কি গো জানি কোনখানে আমি দেহ হৃদে কার বাস
আপনারে চষি আর জিজ্ঞাসি ; এ কার মাঝে কারাবাস?
সহসা সহসা কে যে ভেতরে-, প্রশ্ন করে আর গুতো মারে
তারে থামাতে সে আর আমাতে বাঁধে সংঘাত জোর।
আর পারি না আপনা ভোলাতে, আমি তাই নেশাখোর।।

হৃদয়ে বসানো দর্পণে দেখি আলো ছায়া মাখামাখি
যতন করে কে যে ভেতরে কারে যেন রাখে ঢাকি’
ঢাকনা সরায়ে আৎকে উঠি আপন আর্শিতে আলো হয়ে ফুটি
আধেক আলো আধেক আঁধার তাড়া করে খুব জোর।
আমাকে আমি ছাড়াতে পারি না, আমি তাই নেশাখোর।।

মহাসাগরের মহাজলরাশি মহানাদে মহাব্যাপে-
মহা আক্রোশে আছড়ে পড়ে নিজের ‘পরেই ক্ষেপে
কী যেন ছিলো, কী যেন নেই! পেয়ে হারানোর সে ব্যথাতেই
হাহাকার করে, আর খোঁজে ফেরে হৃদয়ের মণি চোর।
আমি তার সাথে দাঁড়িয়ে তফাতে সতীর্থ নেশাখোর।।

গহীন সাগর কী আছে ধরায়? প্রশান্ত.....! দূর ছাই
মনের সাগরে মহাগভীরতা, তার চেয়ে বড়ো নাই
হৃদি সমুদ্র চষে ফিরি তাই, মুক্তা মাণিক যদি কিছু পাই
এ কোন গহনে লীন হয়ে থাকি নিজ থেকে বহুদূর...।
আপনারে খুঁজি আপনার মাঝে, আমি এক নেশাখোর।।

বিশ্ব নিখিলে সৃষ্টি জুড়ে একী ভারি বিস্ময়!
সোনালী পাতার নির্বাক তেজ করেছে সকল জয়।
জেগে থেকে শুধু পেয়েছি ব্যথা, তাই আড়াল করে খাই ঘুমের পাতা,
সব ভুলে আছি তারে পেয়ে আজ, কাটেনি সে ঘুম ঘোর।
আয় ভাই কাছে, কে ঘুমাবি বল? ডাকে এক নেশাখোর।।

আমি দেখেছি দুনিয়ার মানুষে মানুষে বিস্তর ব্যবধান,
কেউ কারো নয়, নিজেই নিজের গাহে স্বার্থের গান।
বহু ব্যাভিচারী প্রাসাদে নগরে, লোভের মোহে কাড়াকাড়ি করে,
সুর ফেলে দিয়ে মত্ত্ব হয়েছে মানুষের দেহে অসুর।
দেখে শুনে সব ক্ষেপে গেছি আর হয়েছি গো নেশাখোর।।

আমি দেখেছি এখানে মানুষের বনে একা হয়ে বহুকিছু
অমানুষ যারা তাদের দম্ভে মানুষের মাথা নিচু
ফেরারী হয়ে বিপ্লবী ফেরে ডাকাতেরা নিরাপদ
শান্তিবাণী মুখে ফেরি করে অন্তরে কু-বদ।
অধার্মিক সব একতাবদ্ধ, ধার্মিকেরা ছাড়া
ধর্ম এখানে বর্মে মোড়া, বাইবেল-আমপাড়া।
কোরআন ভগবতে আসে নাই পথে মৌলবী-ঠাকুরে
পারে নি ফেরাতে লোভ পাপ হতে নির্দোষ আমিরে।
ধর্মযুদ্ধে দুনিয়াটা আজও বেদনায় ভারাতুর
পৃথিবীর সে ব্যথা সয়েছি; ছুঁয়েছি, আমি সেই নেশাখোর।।

আমি দেখেছি অনেক মানবদেহ শুয়ে আছে ফুটপাতে,
কাঁদে মানবতা চটে মুড়ি দিয়ে দেহ লয়ে দুনিয়াতে।
যৌতুক মাখা বিয়ে শাদি দিনে কাঁদে বাবা-মা মেয়ের কারণে,
সত্যিকারের নিষেধ-বারণে কবে হবে নিশিভোর?
বড়ো ব্যথা পাই সইতে পারি না, আমি তাই নেশাখোর।।

সবলেরা দেখি ডামাডোল করে দুর্বল ঘাড়ে চেপে,
দুর্জন আজ ঐক্যবদ্ধ, সুজনেরা ভয়ে কাঁপে।
শতধা হয়েছে যারা নাগরিক, পিশাচ হাসে লোভী রাজনীতিক,
মানুষ মানুষে ব্যবধান রচে, আজ মানবতা বহুদূর।
দেখি একতাবিহীন ঐক্যে ফাটল, আমি তাই নেশাখোর।।

মদে ডুবে আছে সমগ্র জাতি দেয় কষে গাঁজা দম,
অন্যায় পথে অর্থ উড়ায় অবিরাম-হর্দম।
বেশ্যা পাড়ায় যায় পুরুষে বেশ করে সিনা টান
পতিতা নারী গন্ধ বিলায়, করে’ নারীত্ব কোরবান।
মানবতা, তুমি একী খেলা খেলো!
অবিরাম কাঁদিয়ে কেন কাঁদো বলো?
মানুষ মানুষের খুনি হয়ে ফেরে অনন্ত লোভাতুর!
শত ধিক দিই, এই বেশ আছি হর্দম নেশাখোর।।

আমি শুনেছি অনেক বেকার মানুষের করুণ দীর্ঘশ্বাস,
কেউ বুঝেনি ওদের বেদনা, করেছে গো উপহাস।
হাতে ঝুড়ি, কাঁধে কোদাল-শাবল,
অনাহারী ওরা ঘুরেছে কেবল!
পারি নাই হাতে ভাত তুলে দিতে কব্জিতে নাই জোর।
অসহায় আমি নিরালা কেঁদেছি, আর তাই নেশাখোর।।

আমি দেখেছি অনেক রাজপথপাশে কোরান পঠনকারী,
সম্মুখে শিশুর লাশ ঢাকা আছে, ভিক্ষা মাগিছে তার-ই।
কাফনের টাকা জুটিয়ে এভাবে,
সন্তান তার কবরে যাবে!
দেশের নেতা চাপাবাজি করে,‘অভাব করবো দূর..’।
আমি আঁখিল নিযাসে শরাব বানাই, তাই পিয়ে নেশাখোর।।

আমি দেখেছি এখানে ঠগ ধোকাবাজি দুর্নীতি পলে পলে,
এখানে ভদ্রবেশে মুখোশধারী আর শয়তান কথা বলে।
দিনে সাধু সেজে রাতে লুট করে,
তাই নাগরিক না খেয়ে মরে।
করের বোঝা কাঁধে চেপে কেউ কেঁদে করে রাত ভোর।
সইতে পারি না এই জ্বালাতন, আমি তাই নেশাখোর।।

সুনীল গগণে ডানা মেলে দিয়ে পাখিদের উড়াউড়ি,
শ্বেতশাড়ি মেঘ-পরী মেয়ে করে উল্লাসে জড়াজড়ি।
ধুলির ধরায় তুচ্ছ আমি, চির মুক্তি স্বাধীনতাকামী,
দু’চোখ মেলে দেখেছি চেয়ে স্বাধীন স্বর্গদোর।
 যে স্বাধীন আশা জাগিয়েছে নেশা, তাই আমি নেশাখোর।।

আমি দেখেছি কখনো আসমানে ঘন এলোকেশী মেঘপরী,
মুচকি হাসি বিদ্যুতে তার, ডাকে ইঙ্গিতে মনোহরী।
ছুঁয়ে দিতে বলে আবেশে আবেশী, বিদ্যুৎ নারী মেঘ-কালোকেশী,
স্বর্ণাদেহী সে উর্বসী, পায়ে বজ্রের ঘুঙুর।
নেচে গেয়ে যায়, শরাব বিলায়, তাই পিয়ে নেশাখোর।।

আমি চাতুরি সয়েছি প্রেমের বাজারে প্রেমের সওদা চেয়ে,
খুব ভাল প্রেম দেবে বলে ওরা ঘুরিয়েছে পায়ে পায়ে।
কান্ত হয়েছি পিপাসা পেয়েছে....
ওরা শূন্য পেয়ালা হাজির করেছে।
পানির খোঁজে পথহারা আমি দুই চোখে লাগা ঘোর।
সে ঘোর কাটাতে পথ হাঁটি আর নেশাচূর নেশাখোর।।

ভরা মধুতে মৌ-রাণী ওরা, হুরী নাকি বলে এরে!
রাত দুপুরে এ কী জ্বালাতন! ঘরের ভেতর কে রে?
আমার ঘরে সিঁদ কেটে ঢুকে
সংকোচে মরে, লাজ নাকে মুখে।
অযথাই আসা রূপ পাল্টিয়ে, নবরূপা, সেজে চোর।
ঠকাও কারে! এসে বারে বারে! আমি সবদর্শী নেশাখোর।।

পিরামিড চূড়ার পরশে আমি শিহরিত হয়ে ফের
কী আছে ভেতরে! মরা মমি দেখে আৎকে উঠেছি ঢের
পিছল পথে ধীর গতি খুব
ফেনার সাগরে দিয়ে গেছি ডুব
প্রাণ মেলেনি সাগরের তলে জাগেনিকো অঙ্কুর
পীড়ন কেবলই সে ব্যথা ভোলা আমি তাই নেশাখোর।।

আমি দেখেছি এখানে কামনা কাতর উভয়-ই নর-নারী
কাম যাতনায় ভেঙেছে এখানে সংসার ঘর-বাড়ি
কী ব্যাভিচার! কোনটা আচার! না বুঝে কেঁদেছি শুধু
ঝাঁপসা নয়নে পার হয়ে গেছি সাগর মরু ধু ধু
আমারও অনেক পিপাসা ছিল কোথায় জলের ক্রোড়?
সুপেয় জলের অভাবে আমি হয়েছি গো নেশাখোর।।

তীব্র খরায় উড়ে গেছে কী গো সু-মধুর নদীজল
এতটুকু জল চাইতে গেলেই তারই এত কোলাহল
বেশ, তবে বেশÑ, দারুণ তিয়াসে ফিরে যাবে পথচারী
মরুদ্যানের প্রয়োজন নেই, নেই কোন আহাজারি
ধরণী কুমারীÑ, জেনে রেখো শুধু পিপাসাও সু-মধুর।
তাই আছে বলে চির যাযাবর হয়েছি গো নেশাখোর।।

হাজার লোকের ভীড়ে আমি খুঁজি সেই প্রিয় মুখ
হঠাৎ দেখায় আৎকে উঠি ভরে যায় সারা বুক
.....রচনা করি কবিতা যে তার
দেখা দিয়ে সে পালায় আবার
কাছে এসে নীবিড় জড়িয়ে বুকে করে না এ ব্যথা দূর
ফের তারে খুঁজে একাকী নিতি আমি এক নেশাখোর।।

আমি লিখে যাই নেশার কলমে নেশা মাখা কাগজে
চির নেশা নিয়ে সারা দেহ-মনে, নেশাভরা মগজে
আমার লেখায় নেশা ভরা থাকে
চির সত্য যে, তারে শুধু ডাকে
মহা আঁধারে যে জ্বেলে যায় বর্ণীল কোহিনুর।
যে আলো তৃষা জাগিয়েছে নেশা আমি তাই নেশাখোর।।

যে জন নিল না কোনদিন তুলে নেশার পেয়ালা হাতে
সে কী বুঝবে নেশার জ্বালা! ভরপুর মৌতাতে!
এ যে মুছে দেয় হৃদয়ের যতো রক্তক্ষরণ ব্যথা
আঁকুপাকু করা বুকের ভেতরে ফুটায় মুখে কথা।
মৌতাত কী শুধুই আনন্দ! আর কিছু নয় ভাই?
চির নেশাখোর তার সে কথা মুখ বুজে লিখে যাই।
না-ই বা জুটুক ফুলের মালা না-ই বা জুটুক ঘর
তবু লিখে যাবো আমি নেশাখোর আজীবন যাযাবর।
আমার বেদনায় নেশা, আনন্দে নেশা, নেশা করে কাটে দিন
নেশাতুর চোখে আজও চেয়ে দেখি রয়ে গেছি অমলিন।
আমার চলার সবটুকু পথ কাঁটাঘেরা বন্ধুর।
আমি সয়েছি পথের দারুণ বেদনা আমি তাই নেশাখোর।।

আমার স্নায়ুর প্রতি তারে আজ ভরপুর নেশা ভাই
নেশামাখা মনে মানব জমিনে পদচ্ছাপ রেখে যাই।
দেখি চোখ মেলে অনিলে সলিলে উৎসব উৎসব
মহা উচ্ছ্বাসে সবখানে হাসে জীবনের কলরব।
এখানের ঘাসে শিশির নারীরা মুক্তা হয়েছে আজ
অরুণালোকের ছোঁয়া পেয়ে ওরা সেজেছে অরূপ সাজ
ভোরের পাখিরা প্রভাতীয়া গানে কলরবে মেতে আছে
প্রেম মালা নিয়ে ঘুরছে মলয় মেঘ ললনার পাছে।
সবখানে আজ বিস্ময়কর মধুমাখা বাজে সুর
সে সুধা সুরে নেশা যায় বেড়ে করে তোলে নেশাখোর।।

বোম ভোলানাথ হয়ে ফিরি আমি পৃথিবীর পথে পথে
চির মুসাফির হৃদয় আমার চলি অসীমের সাথে
হতবাক হই বিস্ময়ে মরি আহ! এ কী সুন্দর!
এতো রূপ-রস পৃথিবীর মাঝে জীবনের পাতা ঘর
ধন্য হে প্রভূ, সৃষ্টি তোমার রঙে রঙে কথা কয়
শব্দ গন্ধ সবই অপরূপ! সুরে সুরে হাওয়া বয়!
নোনা সাগরের ঝর্ণা ধারায় নদীভরা মিঠে জল
চারিদিকে এ কী জয়ধ্বনী তোলা জীবনের কোলাহল
যতো দেখি আরো তৃষা জাগে মনে বিন্দুর সিন্ধুর
আরো ‘ভুত্তানা’ পেতে চায় মন, আমি তাই নেশাখোর।।
কলমের শেষ আঁচড় ঃ ৩০ অক্টোবর ২০০৫, পাঠানটোলা, ধামরাই, ঢাকা।

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ