প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, September 9, 2011

ফিরোজা বেগম ।। সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী

প্রথম পরিচ্ছেদ

শারদীয় পৌর্ণমাসী শশধরের ন্যায় নির্মল কৌমুদীজাল বিতরণ করিয়া মোসলেম-প্রতিভা-শশী কালের অলঙ্ঘনীয় নিয়মে রাহুগ্রস্ত হইয়া পড়িয়েছে। অতুলীয় কীর্তি কিরীটিনী নগরীকুল শিরোমণি দিল্লীর প্রতাপ ও গৌরব খর্ব হইয়া পড়িয়াছে। ভুবনবিখ্যাত তৈমুরবংশে বীরচূড়মণি বাবর, বিচিত্রকর্মা হুমায়ুন, প্রতিভাশালী আকবর, তীক্ষ্ণবুদ্ধি জাহাঁঙ্গীর, কীর্তিমান শাহ্‌জাহান এবং তাপসসম্রাট আওরঙ্গজেবের পরে ক্রমশঃ হীনবীর্য অদূরদর্শী বাদশাহগণ দিল্লীর তখ্‌তে বসিতে লাগিলেন। তাঁহাদের ব্যসন-বিলাস, অবিমৃষ্যকারিতা এবং উজির ও সেনাপতিগণের বিশ্বাসঘাতকতার ভুবনবিখ্যাত দিল্লী সাম্রাজ্য ক্রমশঃ খণ্ড বিখণ্ড হইয়া হীনবল এবং হীনপ্রভ হইতে লাগিল।

অযোধ্যা, রোহিলাখণ্ড, সিন্ধু, কাশ্মীর, বাঙ্গাল, হায়দ্রাবাদ, কর্নাট, মালব প্রভৃতি বহু স্বাধীন রাজ্যের পত্তন হইল। এই সমস্ত রাজ্যের মধ্যে সর্বদাই যুদ্ধবিগ্রহ সংঘটিত হওযায় সমগ্র ভারতবর্ষ বিচ্ছিন্ন হইয়া পড়িল। এই সুবণৃ সুযোগে মারাঠীয়রা দলবদ্ধ হইয়া শিরোত্তোলন করিল। তরবারি এবং অগ্নিমুখে তাহারা হিন্দুস্থানে এক মহাপ্রলয়কাণ্ডের সূচনা করিয়া দিল। শান্তিময় ভারত সাম্রাজৌ মারাঠীয়রা বিধাতার অভিসম্পাত স্বরূপ আবির্ভূত হইয়াছিল। হত্যা, লুণ্ঠন, গৃহদাহ, বৃক্ষচ্ছেদন, শস্যদাহ, সতীত্বনাশ প্রভৃতি যত প্রকারের অত্যাচার এবং অবিচার শয়তানের মস্তিষ্কে থাকিতে পারে, তাহা সম্পূণৃভাবেই মারাঠীদিগকে আশ্রয় করিয়াছিল। মারাঠীদিগরে অত্যাচারে ভারতের সর্বত্রই ‘ত্রাহি’ আর্তনাদ উত্থিত হইয়াছিল। মারাঠী দস্যুদিগের নিকট ধনী-দরিদ্র, স্ত্রী-পুরুষ, বালক-বৃদ্ধ, হিন্দ-মুসলমান কোন প্রভেদ ছিল না।

সর্বত্রই তাহারা ভূমি-রাজস্বের চতুর্থাংশ (চৌথ) পাইবার জন্য ভীষণ জুলুম এবং অত্যাচার করিতে লাগিল। জগদ্বিখ্যাত দিগ্বিজয়ী চেঙ্গিজ খাঁর নৃশংস আক্রমণে এবং নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডে যেমন একদিন পশ্চিম-এশিয়ার মুসলমানগণ উৎপীড়িত, নিহত, লুণ্ঠিত এবং ছিন্নভিন্ন হইয়া পড়িয়াছিলে, আরব ও ইরান-তুরানের বিপুল বিশাল সভ্যতার আলোক-ভাণ্ডার যেমন নির্বাপিত হইয়া গিয়াছিল, ধূর্তচূড়ামণি নির্মমপ্রকৃতি মারাঠী দস্যুদলের অত্যাচার, উৎপীড়ন এবং হত্যা ও লুণ্ঠনে ভারতের বক্ষে তেমনি ঘরে ঘরে দারুণ হাহাকার উঠিয়া গগন-পবন আলোড়িত করিতে লাগির। এই অত্যাচার, হত্যা এবং লুণ্ঠনের মুখে হিন্দু ও মুসলামানের কোন পার্থক্য ছিল না। লুণ্ঠন করিতে করিতে মারাঠীরা তাহাদের গুরু শিবাজীর সময় হতেই সাহসী, কৌশলী, ধূর্ত এবং নিষ্ঠুর হইয়া পড়িয়াছিল।

এইরূপ যখন মারাঠীদিগের অত্যাচারে মন্দির ও মসজিদ চূর্ণীকৃত এবং হিন্দু ও মসুলমান উভয়ই লুণ্ঠিত এবং নিহত হইতেছিল, সেই সমযে দিল্লী লুণ্ঠনকারী মারাঠীদিগের বিক্রান্ত এবং রণনিপুন সেনাপতি সদাশিব রাও এবং তাহার অধিনস্থ নায়ক, ভাস্কর পণ্ডিতের মধ্য দিল্লীর প্রান্তবর্তী একটি শিবিরে নিম্নলিখিত কথোপকথন হইতেছিল।

সদশিবঃ কি অপরিসীম রূপ! ছবিতে যা’ দেখলাম, তাতেই অবাক্‌ হয়েছি। রূপের সহিত এখন তেজের প্রভা দৃঢ়তার গাম্ভীর্য কখনও দেখা যায় না!

ভাস্করঃ তা’ আর বলতে কি? বিধাতা নির্জনে বসে একটু একটু করে বোধ হয় যুগযুগান্তর ধরে সৃষ্টি করেছেন। বিশ্বের যে পদার্থে যতুটুক সৌন্দর্যের বিশেষত্ব এবং মাধুরী ছিল, তা’ তিল তিল করে কুড়িয়ে ললনাকুল-ললামভূতা এই ত্রিলোকমোহিনী বীরাঙ্গনাকে সৃষ্টি করেছেন। বিদ্যুতের সহিত চাঁদের হাসি, গোলাপের সহিত কমর, কোমলতার সহিত কঠোরতা, শান্তির সহিত তেজঃ, শুভ্রতার সহিত বর্ণের, লাবণ্যের সহিত রূপের, মধুর সহিত সৌরভের, গাম্ভীর্যের সঙ্গে সারল্যের, প্রেমের সহিত প্রভুত্বের একত্র সম্মিলন করে অপরূপ প্রেমপ্রতিমা এই বিশ্বমোহীনি নারীসত্তাকে সৃষ্টি করেছেন। যে দেশে এমন নারীরত্ন জন্মগ্রহণ করে, সে দেশ ধন্য! যে জাতিতে প্রতিভা ও সৌন্দর্যের এমন অপরূপ জীবন্ত নিরুপম প্রতিমা জন্মগ্রহণ করে, সে জাতিও ধন্য! এমন নারীর পিতা, ভ্রাতা, আত্মীয় হতে পারলেও গৌরব!

সদাঃ আর স্বামী হতে পারলে?

ভাস্করঃ হায়! স্বর্গপ্রাপ্তি কোন্‌ ছার!

সদাঃ স্বর্গ! ছি! তার চরণ-তলেই শত স্বর্গ। এই স্বর্গপ্রাপ্তির জন্যই ত এত সাধ্যসাধনা। এই পরম স্বর্গকে লুণ্ঠন করতে না পারলে, আমাদের “বর্গী” বা “লুঠেরা” নামটাই বৃথা।

ভাস্করঃ এ যে পরম রত্ন! কত নির্জীব রত্ন লুণ্ঠন করেছি, আর এই সজীব রত্নকে কি লুণ্ঠন করতে পারবনা?

সদাঃ কই, কোথায় পারলে? এত দিন হয়ে গেল, তবুও ত কিছু কূল-কিনারা করতে পারলে না। তার বিবাহের কথাও ত হচ্ছে। বিবাহের পরেই উচ্ছিষ্ট হলে কি আমার ভোগে লাগবে?

ভাস্করঃ আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। উচ্ছিষ্ট হবার পূর্বেই ভোগে লাগাব। আমার দেবতাকে কখনও উচ্ছিষ্ট ভোগ দিব না।

সদাঃ রোহিলাখণ্ডের পরাক্রান্ত সিংহ নজীব-উদ্দৌলার সঙ্গেই নাকি বিবাহ নির্ধারিত হয়েছে?

ভাস্করঃ তাই বটে! তা’ হলে সিংহের সহিতই সিংহিনীর সংযোগ! নজীব-উদ্দৌলাও পরম সুশ্রী এবং তেজীয়ান পুরুষ।

সদাঃ তার সঙ্গে ত আমাদের সন্ধি আছে। সুতারং ফিরোজা বানুকে হরণ করলে বা ছিনিয়ে নিলে, তার সহিত যুদ্ধ অনিবার্য।

ভাস্করঃ আমরাও ত চাই চাই। সন্ধিতে আমাদের ক্ষতি। সন্ধি আছে আছে বলেই ত রোহিলাদিগের ধনসম্পত্তিও লুণ্ঠন করতে পাচ্ছি না।

সদাঃ কিন্তু রোহিলাদিগকে ঘাঁটান আর ভীমরুরের চাকে আঘাত করা সমান কথা। রোহিলাদিগকে ঘাঁটালে আমাদিগকে বিষম বেগ পেতে হয়।

ভাস্করঃ তেমন কিছু নয়, মহারাজ। রোহিলারা মহাতেজী এবং বীরপুরুষ বটে; সম্মুখযুদ্ধে তারা চির জয়শীল। কিন্তু আমরা ত আর যুদ্ধ করব না। গভীর অন্ধকারে হঠাৎ তাদের উপর আপতিত হয়ে তাদিগকে বিপর্যস্ত করে ফেলব। আর আসল কথা হচ্ছে, আমরা রোহিলাখণ্ডে না গেলে, তারাই বা কেমন করে এখানে এসে আক্রমণ করেব?

সদাঃ রমণী হরণ করলে, মুসলমান তার প্রতিশোধ না নিয়ে ছাড়বে না। সে প্রতিশোধে যতই প্রাণ বলি দিতে হোক না কেন, মুসলমান কখনই তা’তে কুণ্ঠিত হবে না। এমন কি, সমস্ত ভারতেও এই অগ্নি প্রোজ্জ্বলিত হতে পারে। রমনীর ইজ্জতকে ওরা নিজের প্রাণ হতেও সহস্র গুণে শ্রেয়ঃ বোধ করে।

ভাস্করঃ এত আশঙ্কা করলে এ ভোগে লালসা না করাই সঙ্গত। কি প্রয়োজন? মারাঠীদিগের মধ্যে না হয়, হিন্দুস্থানী ব্রহ্মণদিগের মধ্য হতে শত শত সুন্দরী বিনা কেশে বিনা ঝঞ্ঝাটে সংগৃহীত হতে পারে।

সদাঃ অমৃতের পিপসা কি জলে মিটে? ফিরোজাকে না পেলে ত জীবনই বৃথা। ফিরোজার ন্যায় সুন্দীর গুণবতী আর কে?

ভাস্করঃ মহারাজ! গুড়, মধু, চিনি, মিশ্রী সবই মিষ্টি।

সদাঃ মিষ্ট ত সবই বটে! কিন্তু তাই বলে গুড় ও মধুর মিষ্টতা ত এক নয়।

ভাস্করঃ এক ত নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, মধু খেতে গেলেই মৌমাছির হুলও খেতে হবে।

সদাঃ সেইটা যা’তে খেতে না হয়, অথচ মধুর চাক ভাঙ্গা যায়, এইরূপ বন্দোবস্ত করাই হচ্ছে বুদ্ধিমানের কার্য।

ভাস্করঃ সেই বুদ্ধি খাটাবার জনইত এত মাথাব্যথা।

সদাঃ মাথাব্যথা ত বটে, কিন্তু জিজ্ঞেস করি, মাথামুণ্ডু করলে কি?

ভাস্করঃ নিশ্চিন্ত হউন। সে ফন্দি এঁটেই বসে আছি।

সদাঃ ফন্দিটা একবার শুনিই না কেন?

ভাস্করঃ ফন্টিা হচ্ছে এই যে, আপনি সেদিন নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য নজীব-উদ্দৌলার বরযাত্রীর এবং বন্ধু ও হিতৈষীরূপে বিবাহে উপস্থিত থেকে আপনার হিতৈষণা এবং সৌজন্য প্রদর্শন করবেন। আমরা জাঠদিগের ছদ্মবেশে ফিরোজাকে হরণ করে নিব। এ জন্য আমি একদল জাঠ দস্যুরও বন্দোবস্ত করেছি। আপনি বরং আপনার মারাঠী দেহরক্ষী সেনা নিয়ে আমাদিগকে বাধা দিবেন। দুই একটা জাঠকে কৌশলে গ্রেফ্‌তারও করে নিব। তাদিগকে পূর্ব হ’তেই মন্ত্র পড়ায় কারসাজী বলে ব্যক্ত করবে।

সদাঃ বাহবা ভাস্কর! বাহবা তোমার বুদ্ধি! তুমি যে শুধু সেনাপতি নও, পণ্ডিতও, তা’যথার্থই বটে! এক ঢিলে দুই পাখী শিকার!

ভাস্করঃ মহারাজ! রথ দেখা এবং কলা বেচা দুটোই হবে। এই ব্যাপারে ভরতপুরের মহারাজের সঙ্গে সফদরজঙ্গের এবং তৎসঙ্গে নজীব-উদ্দৌলার স্বয়ং বাদশাহের পর্যন্ত বিরোধ লেগে যাবে। ভরতপুরের আমাদের যেরূপ বিরুদ্ধে আচরণ করছে, তাতে এই রূপ উপয়েই তাকে জব্দ করতে হয়। রোহিলার খড়গেই তার বলি হবে।

সদাঃ কেন? আমরাও ত সফদরজঙ্গ এবং নজীব-উদ্দৌলার সঙ্গে যোগ দিয়েই ভরতপুর লুন্ঠন করবো। তাতে রোহিলাদের সঙ্গে আমাদের আরও সদ্‌ভাব বেড়ে যাবে।

ভাস্করঃ তা’কি আর বলতে হবে? ধন্য তোমার উদ্‌ভাবনী শক্তি। যাও, এখন কাজে যাও। কার্যসিদ্ধির পরে আশাতীত খেলাত! 

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ

দিল্লীর হেরেমের নিভৃত করে বাদশাহ্‌ শাহ্‌ আলম, শেখুল-ইসলাম মওলানা আমিনার রহমান, উজীর সফদরজঙ্গ, মালবের শাসনকর্তা আফ্‌তাব আহ্‌মদ খান এবং মোসাহেব মালেক আনোয়ার উপস্থিত। বাদশাহ্‌ একখানি সোফায় উপবিষ্ট, আর সকলেই দ্বিরদ-রদ-নির্মিত পুরু গদিবিশিষ্ট কুর্সীতে সমাসীন।

এইটি অন্তঃপুরের সম্মিলন কক্ষ। একটি ১০১ ডালের স্বর্ণখচিত ঝাড়ে কর্পূরমিশ্রিত মোমবাতি জ্বলিয়া জ্বলিয়া শুভ্র ও সুগন্ধি আলোক বিকীর্ণ করিতেছে। দেওয়ালে দুগ্ধফেননিভ শ্বেত মর্মরের উপরের সুবর্ণের নানাবিধ চিত্র ও নক্‌শা অঙ্কিত। সে কারুকার্য একদিকে যেমন সূক্ষ্ম কৌশলের অভিব্যক্তি, অন্যদিকে তেমনই গঠনপারিপাট্যের চরম গৌরবের পরিচায়ক! মধ্যখানে একটি হস্তিদন্ত এবং আবলুস কাষ্ঠনিনির্মত মেজ। সে মেজের উপরে সমস্ত পৃথিবীর বিস্তৃত চিত্র সুবর্ণে অঙ্কিত। মেজের একপার্শ্বের কতকগুলি সচিত্র গ্রন্থ। দক্ষিণর দেওয়ালে জগদ্বিজয়ী বীরকুলের গৌরবকেতন মহাতেজী তাইমুরের আশ্বারোহী কৃপাণ-পাণি মূর্তি! তাইমুরের চক্ষু হইতে প্রভাত-তারকার ন্যায় বিশ্ববিজয়িনী প্রভা নির্গত হইতেছে। মুখমণ্ডলে প্রখর বীর্যভাতির সঙ্গে নিবিড় গাম্বীর্য! হঠাৎ দেখিলে চিত্রখানিকা সজীব বলিয়া বোধ হয়।

তাইমুরের সম্মুখে চীন, মঙ্গোলিয়া, মাঞ্চুরিয়া, রুশিয়া, পারস্য, ভারতবর্ষ, আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, জর্জিয়া, ক্রিমিয়া, আষ্টোকান, নরওয়ে সুইডেন, ডেনমার্ক তিব্বত, নেপাল, ভোটান এবং খোরসান প্রভৃতি দেশের সোলাতান, সম্রাট, আমীর, মহারাজা এবং রাজগণ উপঢৌকন হস্তে দণ্ডায়মান। তাইমুরের অশ্বের পদতলস্থ নাল হইতে প্রস্তরাঘাতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ নির্গত হইতেছে। ছবিখানি দেখিলেই কাপুরুষের ভীতি এবং বীরপুরুষের মনে আনন্দ ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। আওরঙ্গজেব এই ছবির চিত্রকর চীনকিচ খানকে সস্তুষ্ট হইয়া লক্ষ টাকা দান করিয়াছিলেন। এই চিত্রের পার্শ্বেই তাইমুরের জ্ঞানপিপাসু বিদ্যানুরাগিণী প্রাতঃস্মরনীয়া বেগম-বিবি খানমের প্রশান্ত মুর্তি! মরি মরি! কি শোভনীয় এবং শ্রদ্ধা-আকর্ষিণী মূর্তি! বেগম বালারুণ-কিরণ-রাগ-রঞ্জিত গগনতলে একটি পর্বর্তের ক্ষুদ্র শৃঙ্গের শ্যামল সানুদেশে সমাসীনা।

সম্মূখের একটি ক্ষুদ্র নির্ঝরিণী কুলুকুলু নাদে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঢেউ তুলিয়া বহিয়া যাইতেছে। জলের উপরে অরুণের স্বর্ণকান্তি পড়ায় গলিত সুবর্ণধারা বলিয়া বোধ হইতেছে। বেগমের হস্তে কোরান শরিফ। তিনি বিরাট ও বিশাল জ্ঞানমন্দির সমরকন্দের বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে পরম প্রীতিপূর্ণ নেত্রে চাহিয়া রহিয়াছেন। বেগমের দক্ষিণ পার্শ্বে সুসজ্জিত স্তূপাকার গ্রন্থশ্রেণী। বামপার্শ্বে পুষ্পোদ্যান। তাহাতে নানাজাতীয় ফুল ফুটিয়াছে। কয়েকটি গোলাপের উপর বুলবুল বসিয়া মধুর রাগালাপ করিতেছে। একস্থানে তিনটি হরিণ-শিশু এবং পাঁচটি ময়ূর পরস্পরের দিকে প্রীতিপূর্ণ আঁখিতে চাহিয়া রহিয়াছে! মধ্যে কমল সরোবরে কয়েক বর্ণের কমল ফুটিয়াছে, সেই ফুল্ল কমলদলে বিচিত্র চন্দ্রক-ভূষিত নায়নানন্দকর প্রজাপতিগুলি কেহ বসিয়া বসিয়া, কেহ উড়িয়া মধুপান করিতেছেন।

একধারে বহুসংখ্যক সুন্দরকান্তি ছাত্র ও ছাত্রী অধ্যয়নে লিপ্ত রহিয়াছে। মহারাজ্ঞীর চক্ষুর দৃষ্টিতে প্রতিভা এবং শান্তির পরম বিকাশ হইয়াছে। বিবি খানমের মূর্তিটি বিশ্বপ্রহাদিনী ঊষার ন্যায় মনোহারিণী, অথচ পবিত্র এবং গম্ভীর। মূর্তিটি এমনি সুকৌশলে অঙ্কিত যে দর্শন মাত্রই রাজ্ঞীর জ্ঞান-পিপাসা, সৌন্দর্যপ্রীতি এবং বিদ্যাচর্চা মহান ভাবে দর্শকের হৃদয় বিহ্বল হইয়া পড়ে। এই চিত্রে জ্ঞানপিপাসা এবং প্রতিভার যে প্রভাম ও প্রশান্ত মহিমা দেখা যাইতেছে, তাহার সামান্য অংশও হিন্দুরা সরস্বতী মূর্তিতে এবং গ্রীকরা “মিউজে” ফুটাইতে পারে নাই।

এই মহারাজ্ঞীর কোটী কোটী মুদ্রা ব্যয় করিয়া সমরকন্দের পৃথিবী-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ছাত্রাবাস নির্মাণ করিয়ছিলেনে। নারী কর্তৃক পৃথিবীতে এরূপ বিরাট বিদ্যামন্দির আর কখনও স্থাপতি হয় নাই।

চিত্র দুইটা পাশাপাশি থাকায় বীরত্ব ও জ্ঞানের প্রভাব ও পার্থক্য সুস্পষ্ট বুঝিতে পারা যাইতেছে। আবার উভয়ের সম্মিলন কেমন প্রীতিপূর্ণ আনন্দজনক এবং অপার্থিব শক্তি ও সৌন্দর্যের প্রকাশকর, তাহাও অনায়াসে বুঝিতে পারা যায়। এ চিত্র প্রসিদ্ধ চিত্রকর আরসালমান খানের রচিত। আওরঙ্গজেব এ চিত্রের জন্যও লক্ষ্য টাকা দান করিয়াছিলেন। ফলতঃ, এই দুইখানি চিত্র এমনি সুন্দর স্বাভাবিক এবং শিক্ষাপ্রদ যে, দেখা মাত্রই সকলে মুগ্ধ হয়। ইউরোপের মাইকেল আঞ্জোলা বা র‌্যাফেলের পক্ষে ভাবপূর্ণ মহান চিত্র অঙ্কিত করা সম্ভবপর ছিল না। এই চিত্র ব্যতীত দিল্লীর অন্যান্য বহু সম্রাট ও সম্রাজ্ঞীর এবং বীরপুরুষের চিত্র শোভা পাইতেছে।

বাদশাহ্‌ শাহ্‌ আরম আলবোলা টানিতে টানিতে গৃহমধ্যে সুগন্ধি তাম্রকুটের ধূসর ধূমের কুণ্ডলী ত্যাগ করিয়া তাইমুরের চিত্রের দিকে তাকাইয়া একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। তারপর একটু থামিয়া বলিলেন, “হায়! কি ভয়াবহ অধঃপতন! কি বীরত্বব্যঞ্জক প্রতিভামণ্ডিত মূর্তি! কিবা সাহস! পদভরে পৃথিবী কম্পিত! তরবারি-মুখে রক্তধারা পরিদৃশ্যমান! অশ্ব-পদাঘাতে অগ্নিস্ফূলিঙ্গ বিকীর্ণ হইতেছে! পৃথিবীর রাজন্যবৃন্দ ভয়ে কম্পিত এবং করজোড়ে নজরহস্তে দণ্ডায়মান। আর আমরা?-এই ভুবনবিখ্যাত বীরবংশের সন্তান আমরা। আমাদের তেজঃ-বীর্য, সাহস-শৌর্য কালের গর্ভে বিলীন! বিলাসব্যসনে দেহ ক্ষীণ ও দুর্বল। মনের ভিতরে কেবলই আশঙ্কা ও ভীতি! মনুষ্যত্বহীন-চরিত্রহীন-অধ্যবসায়হীন-ধন মান রাজত্ব প্রত্যহ লুপ্ত হইতেছে। কিঙ্করেরাও মাথা তুলিতেছে। হা অদৃষ্ট! হয় বিধি! তোমার মনে কি ইহাই ছিল! আহো! সিংহের বংশে শৃগাল, বনস্পতির বংশ তৃণ এবং সম্রাটের বংশে ভিখারী হইলাম। এমনি দুর্দশা যে, নিজের শরীরটা পর্যন্ত রক্ষা করিতে অক্ষম। যুদ্ধের দুন্দু নিনাদে পূর্বপুরুষেরা একিদিন নাচিয়া উঠিতেন। আর আমরা বাঈজীদিগের নূপুরের রুনুঝুনু ধ্বনিতে নাচিয়া উঠি। আমরা অগ্নিতে জন্মিয়া ছাই! দাহিকা-শক্তিহীন।

“অদৃষ্টের কি বিচিত্র গতি! যে মারাঠীরা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চরণতলে পতিত ছিল, আজ তাহারাই আমাদের দণ্ডমুণ্ডের প্রভু হইয়া পড়িতেছে! হায়! যে দিল্লীর নামে জগৎ কম্পিত ছিল, আজ সেই দিল্লী দস্যুপদতলে দলিত, মথিত এবং লুণ্ঠিত! হা খোদা! এ লাঞ্ছনা, এ যন্ত্রণা তা আর সহ্য হয় না” এই বলিয়া শাহ্‌ অশ্রুপ্লুত নেত্রে আরও একটি দীর্ঘঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন।

আফতাবঃ মুসলমানের প্রভাব ও প্রতিপত্তি ভারতবর্ষ হতে একেবারেই লুপ্ত হবে। এখনও যা’আছে তা’ও থাকবে না। হা খোদা! অবশেষে কি না বর্গীরা দিল্লীর ধনভাণ্ডারও লুণ্ঠন করল, বর্গীর পদ চিহ্নে দিল্লী অপবিত্র হ’ল। বাদশাহের সম্মানটুকুও রইল না! তাইমুর-খান্দানের এ অবমানানা একেবারেই অসহ্য!

সফদরজঙ্গঃ আপনি বলছেন, অসহ্য? কিন্তু ভারতীয় অন্যান্য রাজা নবাবদের ত এতটুকুও টনক নড়ল না! আজ দিল্লীর অসম্মান হ’ল, কালই অযোধ্যা, হায়দ্রাবাদ, সিন্ধু, বাঙ্গালা এবং কাশ্মীরের হবে। মারাঠীর অত্যাচার হ’তে কেউই রক্ষা পাবে না। কিন্তু এই সমস্ত নিমকহারামের দল যদি অন্ততঃ আপনাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যও দিল্লীর তখ্‌তের সম্মান রক্ষা করতে প্রস্তুত হ’ত, তা’হলে মারাঠীদিগকে দমন করা কঠিন হ’ত না।

মালেকঃ এরা একত্র হবে কি? এরা ত পরস্পর নিজেরাই যুদ্ধ-বিগ্রহে মত্ত। কে কা’কে মেরে বড় হবে সেই চেষ্টায়ই রত! ফলে সকলেই মারা যাবে। জাতীয়তার ভাব একেবারেই বিলুপ্ত হয়েছে। খোদার কি মর্জী বোঝা যায় না।

শেখুল ইসলামঃ খোদার মর্জী বুঝা যাবে না কেন? খোদাতা’লা ত তাঁর মর্জী সুস্পষ্ট করেই তাঁর কালামে বুঝিয়ে দিয়েছেন। চরিত্রহীন জাতির অধঃপতন অনিবার্য। ইহা ত খোদার মর্জী। খোদা ত স্পষ্টই বলেছেন যে, ‘যতদিন পর্যন্ত কোনও জাতি চরিত্রকে বিকৃত না করে, ততদিন তাদের সৌভাগ্য নষ্ট হয় না।’ এরূপ স্পষ্ট ঘোষণার পরেও যদি আমরা চরিত্র রক্ষা করতে না পারি, তা’ হরে তার জন্য কে দায়ী হবে?

“চরিত্রবান হবার জন্যই ধর্মের আবশ্যক। কিন্তু আমরা তা’ ভুলে গিয়েছি। সত্যবাদিতা, জিতেন্দ্রিয়তা, স্বার্থত্যাগ, ঐক্য, সখ্য, সহানুভূতি ও পরস্পরের প্রতি প্রেম, যে জাতির ভূষণ এবং নিত্যধর্ম ছিল; আজ তাদের ভিতরে কেবল অনৈক্য, হিংসা, ইন্দ্রিয়পরায়ণতা এবং স্বার্থপরতাই একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। কি ভয়ানক অধঃপতন! বাইরের অধঃপতন আপনারা যা’ দেখছেন, ভিতরের অধঃপতন অর্থাৎ মনের অধঃপতন তার অনেক বেশী হচ্ছে-সর্বাগ্রে হয়েছে।

“মনের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের অধঃপতন, আর চরিত্রের অধঃপতনের সঙ্গে সঙ্গে বাইরের অধঃপতন হয়। মনের ভিতরের যেমন ভাবের, যেমন কল্পনার প্রদীপ জ্বলে, বাইরে তারই আলো পড়ে। চরিত্রের কেন্দ্র হচ্ছে মন, অথবা মনের বহির্বিকাশ হচ্ছে চরিত্র্‌। আমরা সেই চরিত্রের বিকাশ হারিয়েছী। খোদার ইচ্ছা এবং আদেশের বিরুদ্ধে চলেছি। সুতরাং আমাদের অধঃপতন এবং দুর্গতি অনিবার্য। আমরা ধর্মকে রক্ষা করি নাইঃ সুতরাং ধর্মও আমাদিগকে রক্ষা করবে না।

মালেকঃ কেন, আমরা ধর্ম রক্ষা না করলে ধর্ম কি আমাদিগকে রক্ষা করতে পারে না?

শেখঃ কখনই নয়। নদীতে নৌকা বাইবার সময় যেমন মানুষই নৌকাকে বহন করায় মানুষ নিজেও তৎসহ বাহিত হয়; ধর্মও ঠিক তাই। ধর্মকে রক্ষা করলে আমরাও রক্ষা পাই। নৌকা ডুবিয়ে দিলে আরোহী এবং মাঝী-মাল্লা যেমন ডুবে মরে, ধর্ম ডুবালে আমরাও তেমনি ডুবে মরি।

মালেকঃ কিন্তু ধর্মকে ত আমরা খুবই মানি। কোরআন ও হাদিসকে ত পূর্বের ন্যায়ই সম্মান করি। নামাজ রোজা ও আমরা ছেড়ে দেই নাই।

শেখঃ কোরআন হাদিসকে মানেন, ইহা মিথ্যা কথা। কোরান হাদিসকে মানরে ব্যসন-বিলাস, কামুকতা, মিথ্যাবাদিতা, কাপুরুষতা এবং অনৈক্য কখনও আমাদের ভিতরে প্রবেশ করত না।

“কোরআনকে মানার অর্থ নয় যে, ভক্তির সহিত কোরআন শরীফকে মস্তকে রাখা বা চুম্বন করা। কোরআনকে মানার অর্থ এই যে, কোরআনের উপদেশ অনুসারে নিজের চরিত্রকে রক্ষা করা। নামাজ রোজার কথা যা' বললেন তা' অনেকটা ঠিক। এখনো বহু লোক নামাজ পড়ে ও রোজা রাখে বটে। কিন্তু তারা নামাজ রোজার কোনও উদ্দেশ্য বুঝে না।

"তৌহিদের তেজে তেজীয়ান্‌ করাই নামাজের উদ্দেশ্য। অর্থাৎ নামাজী ব্যক্তি অটুট বিশ্বাসী, সুতারং অতুল বীর্যশালী হবে। তাঁরা অন্যান্য অসত্যের প্রতি বজ্রাদপি কঠোর এবং সত্য ও ন্যায়ের প্রতি কুসুমাদপি কোমল হবেন। চরিত্রে বল ও তেজ লাভ করাই নামাজের উদ্দেশ্য। রসান দিলে স্বর্ণের বর্ণ যেমন উজ্জ্বল হয় নামাজও মুসলমানের চরিত্রকে তেমনি উজ্জ্বল এবং প্রভামণ্ডিত করবে। কিন্তু আজকার দেখা যায়, অনেক মুসল্লী নীচমনা, স্বার্থপর, হিংসুক ও কাপুরষ। তা’রা নামাজের অর্থ বা উদ্দেশ্য কিছুই অবগত নয়। অনেকে শুধু লোক দেখাবার জন্য নামাজ পড়ে।

“রোজা মসুলমানকে সংযম ও সহানুভূতি শিক্ষা দেয়। কিন্তু দুঃখের বিষয, আমাদের চরিত্রে সংযম ও লোকহিতৈষণা বা সহানুভূতির একান্তই অভাব হয়েছে। রোজা ও নামাজ আমাদের একটি ফ্যাসান এবং পদ্ধতি হয়ে পড়েছে। রোজা নামাজের দ্বারা চরিত্রে সংযম ও পরাক্রম লাভ করতে হবে, তা’আমরা ভুলে গিয়েছি। নৌকায় বা যানে উঠে কেউ যদি নিজের গন্তব্য পথ ভুলে যায়, তা’হলে সে যেমন আরও বিপাকে পড়ে, রোজা নামাজের উদ্দেশ্যের দিকে লক্ষ্য না রাখায় আমাদেরও তেমনি সর্বনাশ হচ্ছে। চরিত্রের উন্নতিই হচ্ছে যে একমাত্র ধর্ম, তা’ যেন আমরা ভুলে না যাই। এর উপরেও আরও একটি পরম ও চরম কর্তব্য আছে। তা’ই হচ্ছে ইসলামের বিশেষত্ব।

মালেকঃ তা’ কি?

শেখঃ তা’ হচ্ছে সর্বদা সঙ্ঘবদ্ধ থেকে সকল বিষযে ইসলামের প্রধান্য রক্ষা করা।

সফদরঃ তবে ত আমরা ইসলাম হ’তে বহু দূর সরে পড়েছি!

বাদশাহঃ সরে পড়েছি বলেই ত আজ দূর্দশা। কাঠ পচে গেলেই তা’তে পোকা ধরে। তাজা কাটে পোকা ধরে না। পানি পচে গেলই তা’হতে দুর্গন্ধ নির্গত হয় এবং শৈবাল জন্মে। নির্মল বিশুদ্ধ জলে গন্ধেও হয় না এবং শেবাল জন্মে না। তেমনি চরিত্রবান জাতিতে কখনও অধঃপতনের ঘুণ ধরে না, তাদের মধ্যে দুর্গতির শৈবাল জন্মগ্রহণ করে না।

এমন সময় বাদশাহ্‌ আলমের শ্যালক আফসার-উদ্দৌলা সেখানে আসিয়া উপস্থিত ইহলেন। সালাম এবং সাদর সম্ভাষণের পরে সকলেই সোৎসুক চিত্তে তাঁহার কথা শুনিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করিতে লাগিলেন।

বাদশাহঃ কতদূর কি হ’ল? কেমন বুঝলেন?

আফসারঃ কি আর বুঝব, সকলই পণ্ডশ্রম। বাঙ্গলার নবাব আলীবদী খাঁ পীড়িত- উদরী রোগে আক্রান্ত। তিন গভীর দুঃখ ও সহানুভূতি প্রকাশ করলেন। কিন্তু বেচারা দীর্ঘকাল পীড়িত্ত - কি করে মহাসমরের আয়োজন করেন। অযোধ্যার সুজা-উদ্দৌলা মারাঠীদিগের সহিত সন্ধিসূত্রে আবদ্ধ। তিনি যুদ্ধবিগ্রহের নামে ভীত এবং সঙ্কুচিত। কিছুইতেই তাঁকে সম্মত করাতে পারলাম না। হায়দ্রাবাদের নিজামও অসম্মত।

বাদশাহঃ তিনিও সম্পুর্ণ উদাসীন। তিনি কেবল নিজ রাজ্য রক্ষার জন্যই ব্যস্ত। রোহিলাদিগের অর্থাভাব সত্ত্বেও তারা জেহাদ যোগ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এই বিরাট ব্যাপারে শুধু রোহিলাদের সাহায্যে কি হবে?

বাদশাহঃ হায় ইস্‌লাম! তোমার আজ এই অসম্মান! মুসলমানের আজ কি ভীষণ পরিণতি!

শেখঃ আমাদের কল্পনা ও আশা বর্তমান অবস্থায় অসম্ভব।

সফদরঃ দেখছি মরাঠীরাই ভারতের সার্বভৌম প্রভু হবে।

বাদশাহঃ বৃথা পরিশ্রম! বৃথা পরিশ্রম! অদৃষ্টের ভীষণ পরিহাস!!
তৃতীয় পরিচ্ছেদ

উজীর সফদরজঙ্গের বাড়ীখানি আজ নয়নমোহন সাজে সজ্জিত। পত্রেপুষ্পে, আলোকে এবং ধ্বজপতাকায় শ্বেতমর্মরনির্মিত বিরাট প্রাসাদ, প্রাঙ্গণ ও রাস্তা সুশোভিত ও সজ্জিত। ফটকের উপরে নহবতে মধুর শাহানা সুরে রওশনচৌকি বাজিতেছে। সেরূপ মধুর বাজনা দিল্লী ব্যতীত আর কোথায়ও সহজে সম্ভবপর নহে। লাল, নীল, সবুজ হলুদ, বেগুনে, শ্বেত প্রভৃতি নানাবর্ণের অর্ধচন্দ্রখচিত রেশমী পতাকা, সহস্রে সহস্রে উড্ডীয়মান হইয়া চমৎকার শোভার সৃষ্টি করিতেছে।

পথের মধ্যে মধ্রে নানা শ্রেণীর পুষ্প-পত্রেসংবৃত তোরণাবলী রচিত হইয়া পরম শোভা বিস্তার করিতেছে। হাজার নানাবর্ণের ফানুস এবং কন্দিল জ্বালাইয়া বাটী এবং পথ-ঘাট আলো করা হইয়াছে। রাজপথের দুই পার্শ্বে দশ দশটি করিয়া হিন্দু এবং মুসলমানদিগের জন্য সুসজ্জিত সুন্দর রমণীয় আহার-আশ্রম খোলা হইয়াছে। বহুসংখ্যক লোক দিবারাত্র উৎকৃষ্ট পান ও ভোজনে রসনার পরিতৃপ্তি সাধন করিতেছে। আটটি পান ও আতরের আড্ডা বসান হইয়াছে। সপ্তাহ পর্যন্ত যাহার যত ইচ্ছা নানা প্রকারের মিঠাই মণ্ডা, রসকরা, গোল্লা, মোরব্বা, হালুয়া, ক্ষীর, রুটি, কাবাব, কোফ্‌তা, লাড্ডু, দোকানে বসিয়া বিনামূল্যে খাইতে পারে।

রাজপথগামী যে-কোনও লোককে আদর করিয়া ডাকিয়া বসাইবার জন্য কয়েকজন উচ্চশ্রেণীর কর্মচারী নিযুক্ত আছেন। বসিবার জন্য উৎকৃষ্ট মূল্যবান কার্পেট চৌকির উপর বিছাইয়া দেওয়া হইয়াছে। খাদেমগণ পরম যত্নে আগন্তকদিগকে উৎকৃষ্ট মিষ্টান্ন প্রদানে তাহাদের মুখ মিষ্ট এবং উদরপূর্তি করিতেছেন। পানওয়ালারা রাশি রাশি উৎকৃষ্ট সুগন্ধি পান তৈয়ার করিয়া সোনার তবকে মোড়াইয়া নানা আকারের খাঞ্চায় সাজাইয়া রাখিয়াছে।

'আত্তার'গণ প্রত্যেক লোকের জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফুক-শিশিতে উৎকৃষ্ট গোলাবী আতর ভরিয়া হাজার হাজার সাজাইয়া রাখিয়াছে। যাহার ইচ্ছা, সেই এক শিশি তুলিয়া লইয়া যাইতেছে।

যথাসময়ে রোহিলাখন্ডের সর্দার পুত্র তেজিয়ান ও পরম শ্রীমান যুবক নজীবউদ্দৌলা বহু বরযাত্রীসহ হস্তিপৃষ্ঠে সুবর্ণ হাওলায় চড়িয়া আগমন করিলেন। কতিপয় রোহিলা সামন্ত ও যুবক অত্যুৎকৃষ্ট আরবীয় অর্শ্বে আরোহণপূর্বক জাঁকজমকের সাথে আগমন করিলেন। ঘোড়াগুলির গঠনভঙ্গিমা এবং চলনের কায়দা দেখিয়া সকলেই প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

যাহা হউক, নওশাহ এর আগমনে বাদ্যকরগণ মহোৎসাহে বাদ্য বাজাইতে এবং মালাকরগণ সহস্র আতশবাজী পোড়াইতে লাগিল। তোপচিগণ ক্রমাগত একশত একটি তোপধ্বনি করিল।

সফদরজঙ্গ এবং তাঁহার আত্মীয় স্বজন পরম সমাদরে যথানিয়মে বর এবং বরযাত্রিগণকে লইয়া বিবাহসভায় বসাইলেন। অনন্তর নানা প্রকার চর্ব্য, চুষ্য, লেহ্য, পেয় প্রভৃতি লজিজ ও নফিস খানা দ্বারা সকলকে পরিতৃপ্তিপূর্বক ভোজন করাইলেন। ভোজনান্তে যথারীতি ইসলামী কায়দা অনুযায়ী উদ্বাহক্রিয়া সম্পন্ন করা হইল। বিবাহান্তে আবার বাদ্যধ্বনির উচ্চ শব্দে এবং অবিরাম তোপ ও বোমের গর্জনে দিগ্বলয় কম্পিত হইতে লাগিল। নানা শ্রেণীর বিচিত্র আতশবাজীর অগ্নিক্রীড়ায় নভোমণ্ডল আলোকিত এবং সমবেত জনমণ্ডলী পরম পুলকিত হইলেন।

বিবাহান্তে দিল্লীর প্রসিদ্ধ বাঈজীদিগের নাচের বন্দোবস্তের উপক্রমেই মওলানা আমিনুর রহমান এবং আরও কয়েকজন ধর্মভীরু বৃদ্ধ লোক উঠিয়া যাইবার উপক্রম করিলেন। কেহই তাঁহাদিগকে উঠিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিরেন না।‌ তখন নজীব-উদ্দৌলা নিজেই তাঁহাদিগকে উঠিবার কারণ জিজ্ঞাসা করিরৈন। মওলানা বলিলেন, বাবা! দেখছ না বাঈজীরা সব এসে হাজীর। এমন ঘৃণিত ও হারাম দৃশ্য কেমন করে দেখব?

নজীবঃ আপনি একেলা উঠে গেলে আপনি মাত্র পাপ হতে বাঁচলেন, কিন্তু অবিশষ্ট লোকের এই মহাপাপ দৃশ্য দর্শন হতে বাঁচবার কি উপায় করলেন? তাদের পাপের জন্য আপনি কি দায়ী হবে না?

মওলানাঃ আমি আর কি করব?

নজীবঃ কেন, আপনি নিষেধ করুন। সকলকে হেদায়েত করুন। বুঝিয়ে দিন যে, এরূপ নৃত্যগীতেই আমাদিগকে ইহলোকে ধ্বংসের আবর্তে এবং পরলোকে জাহান্নামে নিয়ে যাচ্ছে।

মওলানাঃ আমার কথা কে শুনবে?

নজীবঃ সকলেই শুনবে। এমন কোন পাষণ্ড আছে যে, ধর্মের উপদেশ অন্ততঃ কিছুকালের জন্যও প্রতিপালন করবে না? আপনি এবং আপনার সঙ্গীয় আলেমগণ আল্লাহর প্রতি তওয়াক্কা রেখে একবার তেজস্বিনী রসনায় অনলময়ী বাণীতে সকলের মনোযোগ আকর্ষণ করুন, দেখবেন সকলেই এর অপকারিতা স্বীকার করবেন। আমি আপনার সাহায্য করতে সর্বদা প্রস্তুত আছি, আপনি মেহেরবানি করে ওয়াজ ফরমাতে আরম্ভ করুন।

নজীব-উদ্দৌলার অনুরোধ এবং প্ররোচনায় শেখুল ইসলাম মওলানা আমিনর রহমান সাহেব সভায় দণ্ডায়মান হইয়া গুরু-গম্ভীর স্বরে বলিতে লাগিলেন, "ভ্রাতৃবৃন্দ! আমাদের কতদূর অধঃপতন হয়েছে চিন্তা করুন! আল্লাহ্‌ এবং রসুলের আদেশ এবং উপদেশকে আগ্রহ্য করে অদ্য আমরা পবিত্র উদ্বাহক্রিয়ায় ঘৃণিত-চরিত্রা নর্তকীদিগের অশ্লীল নৃত্য দেখবার নিমিত্ত সোৎসাহে বসে আছি! এই অশ্লীল নৃত্য-গীতে আমাদের যুবকদিগের মনে উত্তেজনা এসে প্রথমতঃ, তাদের মস্তিস্ক বিকৃতি এবং দেহের ক্ষয় সাধন করে। দ্বিতীয়তঃ, তাদের মনে চাঞ্চল্য এবং তারল্য জন্মিয়ে দেয়। তৃতীয়তঃ, যারা পরস্পর একত্র হয়ে এই প্রকার ঘৃণিত গীতবাদ্য শ্রবণ করে, তারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি ভক্তিহীন এবং বেহায়া বা নির্লজ্জ হয়ে ওঠে। চতুর্থতঃ, যারা দেখে তা’দের মধ্যে অল্পবিস্তর এই সমস্ত কুৎসিত সঙ্গীত এবং নৃত্যের অশ্লীর ভঙ্গিমার আলোচনা হয়, তার ফলে অনেকের চরিত্র একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়।

“ফলতঃ এই শ্রেণীর গানবাজনা, বিলসিতা ও ব্যসনের প্রধান অঙ্গ। এই শ্রেণীর পাপের পরাক্রমেই আমাদের জাতির ভিতর হতে সহিষ্ণুতা, তেজস্বিতা, বীর্যস্বিতা একেবারে লোপ পেয়েছে। যদি আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই সমস্ত বিষয দেখেতেন, তা’হলে তাঁরা নিশ্চয়ই আমাদের মৃত্যুকামনা করতেন।

“ভ্রাতৃবৃন্দ! আপনার এখন সাবধান হউন! তওবা করে এই পাপের প্রায়চিশ্চত্ত করুন। এরূপ পাপের ফলে আমাদের আর ধ্বংস এবং অধঃপতন হওয়া স্বাভাবিক। যারা একদিন পৃথিবী হতে এই শ্রেণীর সমস্ত কদাচার, পাপাচার ও অশ্লীলাচারকে নির্মূল করেছিলেন, আজ তাঁদেরই বংশধরদিগের মধ্যে এই রূপ পাপকার্যাদি বর্ষাসমাগমে তৃণের ন্যায় বেড়ে উঠছে। কি শোচনীয় অধঃপতন! কি ভয়াবহ ব্যাপার! কি ঘৃণিত পরিণতি!”

“আওরঙ্গজেবের সময়ে যে দিল্লীতে একটিমাত্র বাঈজী বা রূপজীবিনী ছিল না, আজ তথায় সার্ধ চারশত রূপজীবিনী নগরবাসীদিগের ধর্ম, মনুষ্যত্ব, নীতি একেবারে চর্বণ করছে। আজ এই পবিত্র বিবাহ-সভায় যেখানে বর ও পাত্রীর সম্মুখে অশ্লীলতার কি বিরাট উলঙ্গ অভিনয়!”

মাওলানা সাহেব এই পর্যন্ত বলা মাত্রই অনেকেই তওবা পড়িতে লাগিলেন। অনেকেই দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিলেন। অনেকেই বলিয়া উঠিলেন, “এইরূপ পাপাচারেই ত ধ্বংস হলাম।”

উজীর সফদরজঙ্গ লজ্জায় নতবদন হইলেন। বাঈজীর দল তখন তখনই বিদায় লাভ করিল। স্থির হইল, পর দিবস বিবাহের উৎসব সম্পন্ন করিবার জন্য সৈন্যদিগের কৃত্রিম যুদ্ধ এবং প্রসিদ্ধ পাহ্‌লোয়ানদিগের কুস্তি হইবে। আমাদের এই নির্দোষ ব্যবস্থায় মাওলানা সাহেব সন্তুষ্ট হইলেন। অন্যন্য সম্ভ্রান্তমণ্ডলী এবং রোহিলা প্রধান ও সর্দারবর্গ আনন্দ প্রকাশ করিলেন। রাত্রি প্রভাতেই কৃত্রিম যুদ্ধ এবং মল্লযুদ্ধের বন্দোবস্ত ঠিক হইয়া গেল। তখন নজীবউদ্দৌলা স্মিতহাস্যে মাওলানা সাহেবের দিকে তাকাইয়া বলিলেন, “দেখলেন হজরত! আপনাদের সামান্য উপদেশ এবং সামান্য দৃঢ়তায় কত বড় বড় পাপ এবং কদাচার কত শীঘ্র বিলুপ্ত হতে পারে! চাই একটু মনের বল এবং হেদায়েত করবার ইচ্ছা।”

মওলানা সাহেব বলিলেন, “বাবা! আপনার মঙ্গল হোক! খোদা আপনার ইমান এবং হিম্মতকে মজবুত করুন।”

চতুর্থ পরিচ্ছেদ

বরযাত্রীর দল বিবাহের পর-দিবস আহারান্তে ফিরোজা বেগমকে রোহিলাদের দিকে রওয়ানা হইলেন সফদরজঙ্গে বন্ধুবর্গ, বাদশাহ্‌ শাহ আরম, মারাঠী সেনাপতি সদাশিব রাও এবং দিল্লীর অন্যান্য আমীর রইসগণ যে-সমস্ত বহুমূল্য উপঢৌকন দান করিয়াছিলেন, তৎসমস্ত এবং তদ্ব্যতীত সফদরজঙ্গের নিজ প্রদত্ত অনেক মূল্যবান আসবাবপত্র, যথা-হস্তিদন্তনির্মিত ৪ খানি কুর্সী, সুবর্ণনির্মিত আতরদান, গোলাবপাশ, স্বর্ণ ও রৌপ্যনির্মিত নান শ্রেণীর রেকাব, পেয়ালা, জাম, তশ্‌তরী, পানদান, আবলুস কাষ্ঠের বাক্স, চন্দন কাষ্ঠের পালঙ্ক, কাশ্মীরে নির্মিত জরীজড়োয়া পাগড়ী, বোখারায় নির্মিত সুবৃহৎ দর্পণ, বৃহৎ মুক্তার হার, লাহোরে নির্মিত সুবর্ণখচিত কার্পেট, দামেস্কে নিমিত হীরকের বাঁটবিশিষ্ট তরবারি এবং একটি বিচিত্র কৌশলময় বৃহৎ ঘটিকাযন্ত্র প্রভৃতি মূল্যবান উপহার এবং তাহার হেফাজতের জন্য একদল সৈন্যসহ নজীব-উদ্দৌলা আনন্দ উৎফুল্লচিত্তে স্বদেশাভিমুখে চলিলেন।

সদাশিব রাও প্রত্যুদ্‌গনের জন্য নজীব-উদ্দৌলার সঙ্গে সঙ্গেই গমন করিলেন। সন্ধ্যার পর বরযাত্রীর মিছির আরামপুর অতিক্রম করিয়া একটি বিশাল প্রান্তরের মধ্যে দিয়া চলিতে লাগিল। কিয়দ্দূর মাঠ অতিক্রম করিবার পরই নিবিড় বন। শুক্লপক্ষের তৃতীয়ার ক্ষীণ জোৎস্না বনের অন্ধকার দূর করিতে সমর্থ নহে দেখিয়া, মশালচীরা বৃহৎ বৃহৎ মশার প্রজ্জ্বলিত করিয়া বনভূমি আলোকিত করিয়া ফেলিল। সাবধানে সকলেই সেই বনভূমি অতিক্রম করল। বন অতিক্রম করিয়া সকলেই হর্ষোৎফুল্ল মনে গমন করিতে লাগিল।

জঙ্গল অতিক্রম করিয়াই একটি প্রকাণ্ড দীঘি। দীঘির পাড়ে নীচ দিয়াই শাহী রাস্তা। দীঘির ধারে উপস্থিত হওয়া মাত্রই একদল অশ্বারোহী জাঠ দস্যু ভীষণবেগে অতর্কিত অবস্থায় বরযাত্রীদলের উপরে যাইয়া মার মার করিতে পতিত হইল। সহস্রাধিক দস্যুর সহিত একশত সৈন্য ভীষন বিক্রমে যুদ্ধ করিতে লাগিল।

বরযাত্রীর দল গাফেল ছিল বলিয়া অনেকেই বিত্রস্ত এবং হতভম্ব হইয়া পড়িল। সর্দারগণ অস্ত্রপাণি ছিলেন বলিয়া বেগমের পাল্কী রক্ষার জন্য দ্রুতবেগে তথায় ধাবিত হইলেন।

নজীব-উদ্দৌলা হস্তিপৃষ্ঠে থাকিয়া তরবারিযোগে যুদ্ধ করা অসম্ভব বলিয়া লম্ফ প্রদানপূর্বক একটি দস্যুর উপরে পতিত হইয়া মুর্হর্তমধ্যে তাহার শিরচ্ছেদন করতঃ তাহার অশ্বে আরোহণ করিয়া দস্যুদলকে ছিন্ন ভিন্ন করিতে লাগিলেন। নজীব-উদ্দৌলা এবং তাঁহার সঙ্গীয় কয়েকটি যুবক ভীষন পরাক্রম প্রদর্শন করিয়া দস্যুদিগকে নিহত করিতে লাগিলেন।

নজীব-উদ্দৌলা এবং তার সঙ্গিগণ কেহই বর্মমণ্ডিত ছিলেন না, সুতরাং সকলেই গুরুতররূপে আহত হইলেন। অনেকে বিপাকে বিঘোরে পড়িয়া নিহত হইলেন। জিনিসপত্র সমস্তই লুণ্ঠিত হইল। দস্যুদিগের মধ্যে প্রায় ৩০ জন নিহিত হইয়া লুণ্ঠনক্ষেত্রেই পতিত হইল। নজীব-উদ্দৌলা গুরুতররূপে আঘাত প্রাপ্ত ইয়াছিলেন। আঘাত পাইয়া তিনি মূর্ছিত হইয়া পড়েন।

দস্যুগণ চলিয়া যাইবার পরে যাহারা জীবিত এবং সচেতন ছিল, তাহারা মশাল জ্বালাইয়া সকলের অনুসনন্ধান করিতে লাগিল। সকলকেই মৃত বা জীবিত অবস্থায় পাওয়া গেল। কিন্তু হায়! ফিরোজা বেগমের কোনই সন্ধান হইল না। তাঁহাকে পাল্কীরবাহকেরা বলিল যে, দস্যুরা তাহাকে পাল্কীসহ বহনকরিয়া লইয়া গিয়াছে। অল্প সময় মধ্যেই এ সংবাদ সর্বত্র প্রচারিত হইয়া পড়িল। দিল্লী এবং রোহিলাখণ্ডে হাহাকার পড়িয়া গেল। নজীব- উদ্দৌলা পৃথিবী অন্ধকার দেখিতে লাগিলেন! হিন্দুস্থানের মুসলমানদিগের মধ্যে ভীষণ আতঙ্ক ও উত্তেজনার সঞ্চার হইল।

ফিরোজা বেগম তৎকালে সৌন্দর্যের জন্য সর্বত্রই বিখ্যাত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তিনি যেমন রূপবতী, তেমনি বিদূষী ছিলেন। পারস্য ভাষায় তিনি বিশেষ ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। তাঁহাকে সকলেই ‘মুনশী ফাজেলা‘ বলিয়া অভিহিত করিতেন। শাহ আলম তাঁহাকে নিজের কণ্যার মত ভালোবাসিতেন। তাঁহার মধুর চরিত্র, নিমৃল রুপ, অপুর্ব গঠনভঙ্গিমা, প্রগাঢ় ধর্মভাব এবং তাঁহার সরস কবিতা পাঠে দিল্লীর সকলেই মুগ্ধ ছিলেন।

চতুর্দিক ফিরোজা বিগমের অনুসন্ধান হইতে লাগিল। অনেকেই সিদ্ধান্ত করিল যে, এই লূণ্ঠন ও হরণ ব্যাপারটা মারাঠীদিগের দ্বারাই সম্পাদিত হইয়াভে। কিন্তু সকলেই বলিলেন যে আক্রমণকারীরা জাঠ ছিল। সদাশিব রাও যে কয়েকটি দস্যুকে দন্দী করিয়াছিল, তাহারা জাঠ ছিল। তাহাদিগকে মুক্তি দিবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় তাহারা প্রকাশ করিল যে, ভরতপুরের রাজাই এই লুণ্ঠনের কারণ। তাঁহার আদেশেই তাঁহার সৈনিকেরা রাতহানা দিয়া অতর্কিত অবস্থায় ফিরোজা বেগমই লুঠিয়া লইয়াছে।

ইতিপূর্বে যখন মারাঠীরা ভরতপুর আক্রমণ করিয়াছিল, তখন ভরতপুরের রাজা ছত্রসিংহ রোহিলাদিগের নিকট এবং বাদশাহ শাহ আলমের নিকট সাহায্য করিয়াছিলেন না সেই রাগেই ছত্রসিংহ রোহিলাদিগকে জব্দ করিবার জন্য ফিরোজা বেগমকে হরণ করিয়া লইয়াছে। সদাশিব রাও বিশেষ সহানুভূতি দেখাইয়া বলিলেন, ইহা‌ নিশ্চয়ই জাঠদিগের কার্য। মারাঠীরা কখনও রোহিলা সর্দারের পুত্রবধূ হরণ করিবেন না। মারাঠীদিগের কোনও দলই সেদিন কোথাও লুণ্ঠনে বহির্গত হয় নাই।

সফদরজঙ্গ, নজীব- উদ্দৌলা এবং বাদশাহ স্বয়ং নানা স্থানে সুদ সন্ধানীদিগকে প্রেরণ করিলেন। কিন্তুকোথায়ও কোনও সন্ধান পাওয়া গেল না। ভরতপুরেও অনেক গুপ্তচর পাঠান হইল। কিন্তু হায়! কেহই কোনও খবর আনিতে পারিল না। ভরতপুররাজ লোকমুখে এবং জনশ্রুতি- পরস্পরা হাঁহার সন্বন্ধে ফিরোজা বেগমের হরণের কলঙ্কারোপ শুনিয়া দিল্লীশ্বরকে এক পত্র লিখিলেন।

[[ পত্র ]]

মহামহিমান্বিত দিল্লীশ্বর!

সহস্র সহস্র সালাম এবং কুর্ণিশ পর কৃতাজ্ঞলিপুটে বিনীত নিবেদন এই যে, অকারণে আমার প্রতি ফিরোজা বেগমের হরণের কথা বিশ্বাস করিতেছেন। আমার শক্ররাই এই অলীক কলঙ্ককালিমা আমার মস্তকে নিক্ষেপ করিবার চেষ্টা করিতেছে। এ অধীন দ্বারা এমন পাপকার্য কদাপি অনুষ্ঠিত হইতে পারে না। আমি এই ঘটনার বিন্দুবিসর্গ পর্যন্ত অবগত নহি। অধুনা লোকমুখে শুনিতে পাইয়া মর্মান্তিক কেশ ভোগা করিতেছি। দাসকে আর বৃথা সন্দেহ করিবেন না। দাস এখনও দিল্লীপতিকেই ভরতপতি বলিয়াই মনে করে পত্রের অপরাধ মার্জনা করিতে মর্জি হয়।

শাহানশাহের কৃপাভিখারী
ছত্রসিংহ
ভরতপুর।

এই পত্র পাইয়া নজীব- উদ্দৌলা এবং শাহ্‌ আলম বলিলেন, ”ইহা কদাপি ভরতপুরের কার্য নহে। ছত্রসিংহ চরিত্রবান এবং ধার্মিক। ইহা নিশ্চয়ই কোনও না কোনও মারাহীদলেরই কার্য। তাহারা ব্যতীত এমন কার্য কাহারও দ্বারা সম্ভব না।

কিন্তু সদাশিব রাও বলিলেন, ”ইহা নিশ্চয়ই জাঠদিগের কার্য। তাহা না হইলে” মাচার উপরে কে রে? তার উত্তর আমি কলা খাই না। এরূপ ঘটনা ঘটিবার কোনও কারণ নাই। ভরতপুরপতি ছত্রসিংহ গায়ে পড়িয়া নিজেই নিজের দোষ ক্ষালন করিয়াছেন। আমরা ত তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করি নাই যে, তিনি পত্র লিখিয়া নিজের সাফাই গাহিবেন। অযাচিতভাবে এই পত্র লেখাতেই তাঁহার অপরাধ প্রতিপন্ন হইতেছে।"

অতঃপর সফদরজঙ্গ এবং বাদশাহের প্রেরিত কয়েকজন গুপ্ত-সন্ধানীকে অর্থ দ্বারা বশীভূত করিয়া, সদাশিব রাও সন্ধান দেওয়াইলেন যে, ফিরোজা বেগম ভরতপুর-প্রাসাদেই আছে। এইরূপ ষড়যন্ত্রের ফলে বাদশাহ্‌ এবং সফদরজঙ্গ ক্রমশঃ বিশ্বাস করিলেন যে, ইহা ভরতপুর-রাজেরই কার্য। কিন্তু নজীব-উদ্দৌলা কিছুতেই তাহা বিশ্বাস করিলেন না। তবে কঠোরভাবে প্রতিবাদও করিলেন না।

পরামর্শ ঠিক হইল যে, ভরতপুর আক্রমণ করিয়া ফিরোজাকে উদ্ধার করিতে এবং ছত্রসিংহকে কঠোর শাস্তি প্রদান করিতে হইবে ‌ সদাশিব রাও সর্বপ্রকারে সাহায্য করিতে প্রস্তুত হইলেন। সুতরাং ভরতপুর আক্রমণে ”সাজ সাজ” রব পড়িয়া গেল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

সেতারার সুসজ্জিত একটি প্রাসাদে ফিরোজা বেগমের বাসের বন্দোবস্ত হইয়াছে। ফিরোজা বেগমের নাম লক্ষ্মীবাঈ রাখা হইয়াছে। তাহার সেবার জন্য বন্দোনস্ত হইয়াছে। দাসদাসীর বন্দোবস্ত করা হইয়াছে। সুখ-সুবিধার জন্য কোনও ক্রটি নাই। কিন্তু হায়! বন্দীর মনে আবার সুখ কবে? স্বাধীন বনবিহারী বিহঙ্গকে বহু যত্নে সুবর্ণ পিঞ্জরে আবদ্ধ রাখিলেন এবং পৃথিবীর নানা দেশের সুরসাল ও সুললিত ফলমূল দান করিলেও, তাহার প্রানে অশান্তি এবং আত্মগ্লানি কখনও বিন্দুমাত্রও দূর হয় না।

আর মানুষ-জীবশ্রেষ্ঠ মানুষ, তাহার মধ্যে কোমলপ্রাণা রসবতী চরিত্রবতী যুবতী-যাহার জীবনের উচ্ছ্বাসিত প্রেম-প্রবাহ যাহা শুধু উদ্দেশ্য মাত্র সঞ্চিত হইয়াছিল, কিন্তু প্রবাহিত হইবার সময় পায় নাই, তাহার অন্তর্বেদনার কে ইয়াত্ত করিবে? একে বিরহবেদনা, তাহার উপর বন্দীদশায় হীনতার জ্বালা, তদুপরি ধর্মনাশের আশঙ্কা। দারুণ দুশ্চিন্তা এবং উদ্বেগে ফিরোজা বেগম বসন্তের কীটদষ্ট নধর লতিকার ন্যায় দিন দিন মলিন হইতে লাগিলেন। কর্দমে পতিত পদ্মের ন্যায়, রাহুগ্রস্ত চন্দ্রের ন্যায়, ধূমাচ্ছন্ন বহ্নির ন্যায় একান্ত বিমানয়মানচিত্ত হইয়া পড়িলেন।

মুরলা নামক একটি পরিচারিকা নিতান্ত চতুর এবং সুন্দরী ছিল। ফিরোজার সদ্ব্যবহারে সে ক্রমশঃ ফিরোজার প্রতি একান্ত ভক্তিমতী এবং সহানুভূতিসম্পন্না হইয়া পড়িল। মারাঠীরা তাহাকে মালব দেশ হইতে বন্দী করিয়া আনিয়াছিল; আনিবার পরে একটি ভৃত্যের সহিত বিবাহ দিয়াছিল। কিন্তু সে বিবাহের পরেই অল্পদিন মধ্যেই বিধাবা হইয়াছে। ফিরোজার মনোমোহিনী দেবীদুর্লভ পরমা শ্রী, মধুর ভাষা এবং সস্নেহ ব্যবহারে মুরলা এমনি মুগ্ধ হইয়া পড়িল যে ফিরোজার সেবা করিতে পারিলেই পরমানন্দ লাভ করিত। ক্রমে সে প্রাণ ঢালিয়া ভালবাসিতে বাসিতে ফিরোজা-গত-চিত্ত হইয়া পড়িল।

সে আনন্দের সহিত ফিরোজার রক্তকমলনিন্দিত হস্তপদ টিপিয়া দিত। ফিরোজার দুঃখে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করিত। ফিরোজার মুক্তির অনুসন্ধান করিত। সেই যমদূতের ন্যায় প্রহরী-প্রহরিত বাটী হইতে নির্গত হইয়া কিরূপে দিল্লী গমন করিতে পারে, সে-বিষয়ে কত রজনী বিনিদ্র অবস্থায় পরামর্শ করিল। মুক্তির জন্য কতরূপ কল্পনা-জল্পনা করা হইল। কিন্তু কিছুই কুল-কিনারা হইল না। কোনও উপায় উদ্‌ভাবিত ও নির্দিষ্টি হইল না।

ইহার মধ্যে ঘোষিত হইল যে, সদাশিব রাও আর কয়েক দিনের মধ্যেই দিল্লী হইতে সেতারায় আসিবেন। দালান-কোঠায় চূণকাম হইতে লাগিল। বাগান ও বৃক্ষবাটিকা সকল পরিষ্কৃত হইতে লাগিল। রাজবাটীর সকলেই প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। এ-সংবাদ অবশেষে মুরলা কর্তৃক ফিরোজা বেগমেরও গোচরীভূত হইল। ফিরোজা শিহরিয়া উঠিলেন। ভূমিতে মস্তক লুটাইয়া আল্লাহ্‌র দরগায় সেজদা করিলেন। তাহার পর অশ্রুপূর্ণ আঁখিতে মোনাজাত করিলেনঃ

“হে আল্লাহ্‌! হে আমার প্রভু! তুমিই ধর্ম ও ন্যায়ের রক্ষাকর্তা। হে এলাহি! কাফেরের হস্ত হ’তে আমাকে উদ্ধার করা। আমার ধর্ম ও সতীত্ব রক্ষা কর। হে প্রভু! তোমার অসাধ্য কর্ম কিছুই নাই। তুমি হজরত ইউনুসকে মৎস্যের উদর হ’তে, ইব্‌রাহমিকে অগ্নিকুণ্ড হ’তে, হযরত মুসাকে দরিয়া হ'তে রক্ষা করেছ। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে তুমি অনন্ত কোটি জীবজন্তুকে লক্ষ লক্ষ বিপদ, মছিবত এবং লক্ষ প্রকারের অধঃপতন ও পাপ হতে রক্ষা করছ। তোমার মহিমা ও কৌশল অপরিসীম।

“হে মালেক! তোমার এই ক্ষুদ্র ও অধম বান্দীকে বন্দিত্ব হতে মুক্ত কর। তুমি পরমপিতা, পরমবন্ধু এবং পরমহিতৈষী! কীটানুকীট আমি হীনতম দাসী আমি, অধমাদপি অধম আমি, আমি তোমার দয়ার ভিখারী!

“হে বিশ্বপ্রভু! তোমার ইচ্ছায় সকলই সম্ভবপর। তুমি পর্বতকে সমুদ্র ও সমুদ্রকে পর্বতে পরিণত করতে পার। তুমি রাত্রিকে দিবস এবং দিবসকে রাত্রিতে পরিণত করতে পার। তুমি রাত্রিকে দিবস এবং দিবসকে রাত্রিত পরিণত সমর্থ। তোমার ইচ্ছায় মৃত জীবিত এবং জীবিত মৃতে পরিণত হয়। তুমি ইচ্ছা করলে অসম্ভব সম্ভব এবং সম্ভব অসম্ভব হয়। করুণাময় স্বামিন্‌! এ দাসীকে কাফেরের হস্ত হ’তে মুক্ত কর।”

এইরূপে উদ্বেগ- অশান্তি এবং ধ্যান ও প্রার্থনায় আরও কিয়দ্দিন অতিবাহিত হইয়া গেল্‌ মুরলা বেগমের মুক্তির জন্য অবশেষে এক কৌশল খেলিল; দ্বারের প্রহরীকে হাত করিবার জন্য ফন্দি আঁটিল। মুরলা প্রহরীর সহিত ক্রমশঃ খুব ভাবের পশার জাঁকাইয়া তুলিল। মুরলার যৌবনের প্রভাব, রঙ্গ-রস ও ভাব- কৌতুকপুর্ণ বাক্য এবং লোলকটাক্ষে প্রহরী হরি ক্রমে ক্রমে দৃঢ় বদ্ধমুল হইল।

ফাল্‌গুন মাসের ১২ই তারিখ বুধবারে শ্রীকৃষ্ণের দোলযাত্রা উপলক্ষে সদাশিব রাওয়ের বাড়তি মহা মহোৎসব ব্যাপার। সন্ধ্যার পরেও বহু নর-নারী বালক-বালিকা রাজপুরীতে যাতায়াত করিতেছে মুরলা তাহাদের সঙ্গে মিশিয়া উৎসবের বাসন্তী বেশে সজ্জিত হইয়া অপরাহ্নেই বাহির হইয়া গিয়া সেতারা হইতে পলায়নের সমন্ত উদ্যোগ-আয়োজনে লিপ্ত রহিল। প্রহরী ঘূণাক্ষরেও কিচু টের পাইল না।

এদিকে মুরলাকথিত নির্দিষ্ট সময়ে ফিরোজাবানু মুরলার পরিত্যক্ত আটপৌরে কাপড়খানি মুরলার ভঙ্গীতে পরিয়া জনতার সহিত মিশিয়া ব্যস্তভাবে দ্বারা পার হইয়া নিকটবর্তী উদ্যানের দক্ষিন দিকে যাইতেই দেখিলেন মুরলা তাঁহার জন্য ব্যস্তভাবে অপেক্ষা করিতেছে।

ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ

মারাঠী শিবির

সদাশিবঃ নজীব-উদ্দৌলা বোধ হয় আমাদিগকেই সন্দেহ করছে ?

ভাস্করঃ ভাব-ভঙ্গীতে ত তাই বোধ হয় নজীব বড় ধূর্ত এবং চতুর।

সদাশিবঃ তেজস্বীও খুব। জাতীয় টানও খুব আছে। মারাঠীদিগকে বিষচক্ষে দেখে।

ভাস্করঃ তা ত দেখবেই। আমরা দিল্লী পর্যন্ত দস্তদারাজী করছি, এতে আর কি মুসলমানের চিত্ত স্থির থাকতে পারে?

সদাশিবঃ হিন্দুর চিত্তই বা কোথায় প্রফুল্ল? গুপ্তচরেরাই সবাই বলে যে, হিন্দু-মুসলমান সকলেই দিল্লীপতির মঙ্গল কামনা করেন। দিল্লীর অধঃপতনে সকলেই মর্মান্তিক দুঃখিত।

ভাস্করঃ দিল্লীশ্বরের প্রায় কিছুই নাই কিন্তু কি আশ্চর্য ব্যাপার, এখনও দিল্লীপতির সম্মান ও প্রতিপত্তি নকি অপরিসীম! দিল্লীপতি এবং তাঁর উজীর ও আমীরগণ তেজস্বী, কর্মঠ এবং উদ্যোগী পুরুষ হলে, এখনও আবার সমগ্র ভারতে দিল্লীর আধিপত্য স্থাপিত হতে পারে।

ভাস্কর পন্ডিতের কথা শুনিয়া সদাশিবের সহাকারী তুলাজী দেশপাণ্ডে বলিলেন, ” তাহার জন্য যে ভিতরে ভিতরে চেষ্টা-হচ্ছে চরিত্র হচ্ছে না, তা কে বলবে? অগ্নি, শত্রু এবং সর্পকে কদপি তুচ্ছ ভাবতে নাই। আমার মতে বাদশাহকে পদচ্যুত করে পেশোয়া স্বয়ং দিল্লীর তখতে বার দিন। দিল্লীর তখতে বসতে না পারলে, পেশোয়াকে কদাপি ভারতের বাদশাহ বা সম্রাট বলে কেউই মান্য করবে না। এখনও ভারতবর্সে মুসলমানের যে শক্তি আছে, তা একত্র হলে মারাঠীদিগকে চূর্ন- বিচূর্ণ করে উড়িয়ে দিতে পারে।

ভাস্করঃ তা বটে। কিন্তু তা আর হচ্ছে না। অতি শীঘ্রই বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শক্তিগুলিকে আক্রমণ করে উৎপাটিত করবার বন্দোবস্ত করছি। বাঙ্গলা, অযোধ্যা ও সিন্ধু, আর্যাবর্তের এই তিনটি রাজ্যকে আশু ধ্বংস করা আবশ্যক। দিল্লীর তখতে পেশোয়াকে না বসালে এবং দিল্লীর জামে মসজিদে ভবানী-মূর্তি স্থাপিত করতে না পারলে রাজ্যধিকারের পূর্ণ আনন্দলাভ হচ্ছে না।

তুলাজীঃ কিন্তু নিতান্ত দুঃখের বিষয়, আমরা হিন্দুদিগের সহানুভুতি পাবার জন্য কোনও চেষ্টা করছি না। আমরা ভারতবর্সে হিন্দুপ্রাধান্য ও রাজত্ব স্থাপনের চেস্টা না করে কেবল হত্যা ও লুণ্ঠন করায় ভারতের প্রত্যেক লোকই আমাদের নাম শুনলেই ভয়ে শিউরে উঠে। বাঙ্গলা ও হিন্দুস্থানে আমাদের নামে যেসব ছড়া ও কবিতা রচিত হয়েছে তা'তে আমাদের জুলুমের কথাটা লোকের মনে একেবারে মুদ্রিত হয়ে গেছে। আমাদের অত্যাচারে নিরীহ এবং দরিদ্র কৃষক- পল্লীতে পযৃন্ত হাহাকার উঠেছে।

সদাশিবঃ কিন্তু এরূপ অত্যাচার ও কঠোরতা প্রদর্শন না করলে কেউ আমাদের ন্যায় নগণ্য জাতিকে গ্রাহ্য করত কি? আজ যে সমগ্র ভারতে আমাদের নামে আতঙ্ক পড়ে গিয়েছে, ভারতের সমস্ত রাজা, নবাব এবং বাদাশাহ পর্যন্ত যে আমাদের করুণাভিখাররী তা' এই কঠোরতা এবং নৃশংসতারই সুফল। আমাদিগকে আরও কঠোর ও নৃশংস হতে হবে। রাজপুত এবং জাঠগণ যদি আমাদের সহায় হত, তা হলে ভারতময় একচ্ছত্র হিন্দুরাজত্ব স্থাপন করা সহজসাধ্য হ'ত্। কিন্তু রাজপুতেরা আমাদিগকে প্রানের সহিত ঘৃনা করে থাকে আমরা সমূলে উৎসাদিত হই, এটাই তাদের আন্তরিক কামনা। তাদের ধারনা যে, রাজপুত ব্যতীত ভারতবর্ষে হিন্দুদিগের মধ্যে শাসনদণ্ড পরিচালনা করবার জন্য আর কোনও জাতি উপযুক্ত নয়। রাজপুতের অধিকাংশই এখনও দিল্লী সাম্রাজ্যের অভ্যুত্থানকামী।

তুলাজীঃ ওরা ত বলতে গেলে, অর্ধ-মুসলমান। এমন কোনও রাজপুত নাই, যে মুসলমানকে কন্যাদান করে নাই। শিশোদীষ, গিহ্লোট, রাঠোর ও কনোজ- গোত্রীয় সকল বাজা, রাণা ও সর্দারই মুসলমানের সঙ্গে বৈবাহিক সন্মন্ধে আবদ্ধ। যে উদয়পুরের রানা প্রতাপসিংহ মুসলমানকে কন্যাদি দিবেন না বরে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করেছিলেন - যিনি, মানসিংহ আকবরকে ভগ্নীদান করেছিলেন বলে তাঁর সঙ্গে একত্রে আহার করতেও সম্মত হন বাই, পরে তাঁরই কন্যা অশ্রুমতী যুবরাজ সেলিমের প্রেমের বানে বিদ্ধ হয়ে উম্মাদিনী হয়ে গেল। সত্য কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, রাজপুতেরা মুসলমানের মাতুলকুল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং তারা যে দিল্লীর বাদশাহী প্রভাব বৃদ্ধিকল্পে বিশেষ চেষ্টা করবে, তা ত স্বাভাবিক। রাজপুতেরা এই মাতুলত্বের দাবীর জন্যই অন্যান্য সর্বজাতীয় হিন্দু অপেক্ষা বেশী প্রতিষ্ঠা এবং প্রতিপত্তি লাভ করেছে।

সদাশিবঃ ভরতপুরের রাজা ত রাজপুত নয়; কিন্তু সেও দল্লীর হিতৈষী। এই জাঠ বেটাকে সমুচিত শিক্ষা দিতে হবে।

ভাস্করঃ ফন্দী ত খুবই খাঠান হয়েছে। যার জন্য সে আমাদের সঙ্গে শক্রতা করতে কুণ্ঠিত নয়, এবার সেই বাদশাহকে দিয়েই সাপ খেলাব।

তুলাজীঃ এই ত যথার্থ রাজনীতি, - যাক শক্র পরে পরে। আমরা মজা করে তামাশা দেখব।

ভাস্করঃ তামাশা আর মজা ক'রে দেখতে হবে না। এ তামাশা দেখতে বহু সহস্র মারাঠীর মুণ্ড ধূলায় লুটবে। জাঠেরা সহজে হারবার পাত্র নয়।

তুলাজীঃ তা ত বটেই। পরিনাম কি হয় বলা কঠিন। ভিতরের কথা যদি ফেঁসে পড়ে, তা হলে সবই প্রশুশ্রম হবে। অধিকন্তু মুসলমানদের সঙ্গে ভীষন বিবাদ ও বিগ্রহ হবে।

সদাশিবঃ যতদূর সম্ভব সাবধানতা অবলম্বন করা গেছে।

তুলাজীঃ কিন্তু কথা হচ্ছে, পাপ কখনও লুক্কায়িত থাকে না।

সদাশিবঃ আরে! মুসলমানদের সঙ্গে বিরোধ যখন লেগেই আছে এবং আরও লাগবে, তখন আর ভাবনা-চিন্তা করারবার কি আছে? হায়! যার জন্য এত করলাম, এখনও তার ত মুখকমল দেখা দূরে থাক, পা’খানিও দেখতে পেলাম না। সে অলোকসুন্দর প্রফুল্ল কমলের ঘ্রাণ নেবার ভাগ্য আছে কিনা, কে বলবে!

ভাস্করঃ তা’ হবে, মহারাজ। কলস যখন তোলা গেছে, তখন ঘ্রাণ নেওয়া তা নিজেরই হাত। এদিকের বন্দোবস্ত করে ধাঁ করে সেতারায় চলে যান।

সদাশিবঃ পেশোয়া টের পেলেও যে বিপদ!

ভাস্করঃ পেশোয়া বড় কিছু মনে করবেন না। বরং কথা আছে যে, চোরে চোরে মাসতুত ভাই। তবে চুরির এই অমুল্য রত্মটি পাছে চেয়ে না বসেন।

সদাশিবঃ ওরে বাপরে! তবেই ত গেছি। মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া! এমন অধর্ম কখন করবেন না।

তুলাজীঃ ও সব কথার প্রয়োজন নাই। এখন এ যুদ্ধে আপনি স্বয়ং যাবেন, কি পণ্ডিতবরকে পাঠাবেন, তাই নির্ধারন করে সৈন্যদলকে সজ্জিত হবার আদেশ প্রদান করুন।

সদাশিবঃ নজীব-উদ্দৌলার ত খোঁজ খবর নাই। মাত্র দু’হাজার রোহিলা সৈন্যকে সর্দার আহমদ খান পাঠিয়েছেন।

তুলাজীঃ নজীব-উদ্দৌলা নাকি স্ত্রীর শোকে নিতান্ত উন্মাদ হয়ে পড়েছেন।

সদাশিবঃ বেশ কথা, বড় ভুল হয়ে গেছে। তাকে সে রাত্রে সাবাড় করে ফেলাই উচিত ছিল।

তুলাজীঃ সফদরজঙ্গ যুদ্ধে যেতে প্রস্তুত। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস যে ফিরোজা বেগম ভরতপুরেই আছেন।

সদাশিবঃ যথা লাভ। সফদরজঙ্গ ভালো যোদ্ধা। দিল্লীর সেনাপতি শমশেরজঙ্গও ব্যুহ রচনায় বেশ পণ্ডিত। তা’হলে আপনি কাল সকালে ভরতপুরে কুচ করবার জন্য প্রস্তুত হোন। ভাস্করজী আমার পরিবর্তে দিল্লী থাকবেন। আমি দু’চার দিনের মধ্যেই সেতারায় রওয়ানা হব।

সপ্তম পরিচ্ছেদ

বেগমকে লইয়া মুরলা দ্রুতপদে অক্রবক্র রাস্তা অবলম্বন করিয়া একটি পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিল। এই পল্লীতে একটি প্রাচীন শিব-মন্দির ছিল। শিব-মন্দিরের চতুর্দিকে নানাজাতীয় বৃহৎ বৃহৎ বৃক্ষাদি থাকায় স্থানটি অন্ধকারপূর্ণ ছিল। রাত্রিতে ভয়ে এ মন্দিরে কেহই প্রবেশ করিত না। মুরলা এবং ফিরোজা দুইজনে মন্দিরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া প্রদীপ জ্বালাইল। প্রদীপ জ্বালাইয়া দুইজনে পরামর্শ করিতে লাগিল যে, কিরূপ বেশে সেতারা হইতে বাহির হওয়া আবশ্যক।

ফিরোজা বলিলেন, "আমরা উভয়েই যুবতী। সুতরাং নারীবেশে দূর দূরান্তরে গমন করা অসঙ্গত।"

মুরলাঃ ঠিকই বলেছেন। নারীবেশে বের হলেই আবার বিপদে পড়তে হবে। আপনার কমনীয় কান্তি, রমনীয় শ্রী এবং ললিত লাবণ্য যে দেখবে সেই বিমোহিত হবে। আপনি যে মারাঠি মহিলা নন, তা' স্পষ্টতই ধরা পড়বে। অন্যদিকে পুরুষ বেশেও মহাবিপদের সম্ভাবনা। এ জন্য আমি মনে করি, আমরা দু'জনেই সন্ন্যাসিনী বেশে বহিগর্ত হ'লে আর বিপদের আশঙ্কা থাকে না। আমি তার বন্দোবস্ত করে রেখেছি। আমরা মারাঠি রাজ্য ত্যাগ করে নিজাম-রাজ্যে পৌঁছলে সেখানে আপনি রাজ সরকারেও অনেক সাহায্য পেতে পারবেন। অথবা তথা হতে দিল্লী বা রোহিলাখণ্ডে সংবাদ প্রেরণও বেশী কিছু কঠিন হবে না। আপনি ত বলেছেন যে, নিজাম-দরবারে আপনার উচ্চ পদস্থ আত্মীয় আছেন।

ফিরোজাঃ আমি ত সন্ন্যাসিনীর আচার-ব্যবহার কিছুই জানি না। কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলেই বা কি বলব?

মুরলাঃ আপনি নিশ্চিত থাকুন। আমি ঠিক করে দিব। সন্ন্যাসিনীর নামধাম, ধর্মমত কেউ জিজ্ঞাসা করবে না। এরূপ জিজ্ঞেস করা নিয়মবিরুদ্ধ। জিজ্ঞেস করলেও নিরুত্তর থাকবেন। তা’তে কেউই দোষ ধরবে না।

ফিরোজাঃ সঙ্গে অস্ত্র থাকা আবশ্যক।

মুরলাঃ একটি একটি করে আমাদের দু'টি ত্রিশূল ত থাকবেই।

ফিরোজাঃ তরবারি হলেই ভালো হয়। আমি তরবারি ভালো চালাতে জানি।

মুলাঃ তরবারি থাকলে লোকে সন্দেহ করবে। আমরা যে যথার্থ সন্ন্যাসিনী নই, তাই বুঝাবে। লোকের সন্দেহের উদ্রেক হবে।

ফিরোজাঃ তা’ হলে তরবারির আর প্রয়োজন নাই।

অতঃপর মুরলা বেগমকে ভৈরবী সাজাইতে আরম্ভ করিল। গিরিমাটি ঘষিয়া চুলগুলির তৈলাক্ত ভাব দূর করিয়া ললাটোপরি শিব-চূড়া বাঁধিয়া ধিল। বস্ত্র পরিবর্তন করিয়া রক্তবর্ণ চেলী পরাইয়া দিল। হস্তে এবং গলে রুদ্রাক্ষের মালা, ললাটে রক্তচন্দ্রনের ত্রিপুণ্ড্রক।

ফিরোজার বর্ণ কিছু মলিন করিবার জন্য প্রথমে মুখে কিছু ছাই মাখিয়া পরে গৈরিক আমর্শন করিয়া দিল। এইরূপভাবে পিরোজাকে সাজাইয়া দর্পণে মুখ দেখিতে বলিল। ফিরোজা আপনার মূর্তি দেখিয়া আনন্দে স্মিতহাস্য করিলেন।

মুরলা বলিল "এবার এ ভৈরবীর রূপ দেখলে তেত্রিশ কোটি দেবতা স্বর্গ ছেড়ে মর্ত্যে এসে শ্রীচরণতলে গড়াগড়ি দিবে। দেবাদিদেব মহাদেব ভৈরব পর্যন্ত ত্রিলোকমোহিনী চির উদ্বিন্নযৌবনা কমলাননা পার্বতীকে পর্বতে ত্যাগ করে তোমার নীলোৎপলনিন্দিত নয়নের সন্মোহন বাণে বিদ্ধ হয়ে ঐ লোলিতাব্জ-সঙ্কাশ প্রেমিকজন-শরণ চরণতলে লুণ্ঠিত হবেন।"

মুরলার কথা শুনিয়া ফিরোজা স্মিতহাস্য করিয়া বলিলেন, "এখন রঙ্গরস রাখ। পলায়নের উপায় দেখ। নিজে শীঘ্র সজ্জিত হও।"

"আমার শহরের বাইরে বের হয়ে পড়েছি। সুতরাং রাত্রিতে রওয়ানা হলে আর কোন আশঙ্কা নাই।" - এই বলিয়া মুরলা নিজেও ভৈরবীর বেশে সত্বর সজ্জিত হইয়া ফিরোজার হস্তে একখানি ত্রিশূল ও তাঁহার স্কন্ধে গৈরিক একটি ঝুলি ঝুলাইয়া দিয়া তদনুরূপ নিজেও ত্রিশূল এবং ঝুলি ধারণ করতঃ নির্গত হইয়া পড়িল।

সমস্ত রাত্রি গমনের পরে প্রভাতে তাঁহারা ত্র্যন্বকনাথ নামক গ্রামে "বাবা একলিঙ্গের" মন্দিরে যাইয়া উপস্থিত হইলেন। ভৈরবীযুগলকে দেখিয়া মন্দিরের সেবাইতরা পরম যত্নে আহারের বন্দোবস্ত করিয়া দিলেন। উভয় ভৈরবীর একত্র সম্মিলন এবং তন্মধ্যে একজনের বিস্ময়কর রমনীয় কান্তি ও তেজস্বিনী প্রকৃতি দেখিয়া সকলেই ভয়, বিষ্ময় এবং ভক্তিতে গড় করিতে লাগিল।

সমস্ত দিন বিশ্রাম করিয়া অপরাহ্নে আবার দুইজনে পথাতিক্রমে বাহির হইয়া পড়িলেন। আমাদের ভৈরবীযুগল যে পথ দিয়া যাইতে লাগিলেন, সেই পথের দুইপাশে বহু নরনারীর ভীড় হইতে লাগিল। অনেকেই বলিল, "স্বয়ং মা পার্বতী ভৈরবী মূর্তি ধারণ করে সখীসহ দাক্ষিণাত্য-ভ্রমণে বের হয়েছেন।"

রমণীর তপ্তাকাঞ্চন-সন্নিভ বর্ণের কথা অনেকেই শুনিয়াছে, কিন্তু কেহ কখনও চোখে দেখে নাই। কিন্তু আজ সকলে রক্ত চেলী পরিহিতা ভৈরবীর প্রতপ্ত স্বর্ণ-সিন্নভ বর্ণ দর্শনে বিস্ময় মানিল। এমন টানা টানা বাঁকা বাঁকা জোড়া ভুরু, ভাসা ভাসা উজ্জ্বল অথচ প্রশান্ত চক্ষু, এমন প্রভাত প্রস্ফুটিত কমলের ন্যায় প্রফুল্ল বদনমন্ডল, এমন ঊষার সিন্দু রসুবর্ণরাগমিশ্রিত রক্তিমা মাখা পেলবগও তাহারা কখনও দেখে নাই। দেখামাত্র মনে হয়ঃ

বিরলে বসিয়া       ভাবিয়া ভাবিয়া
একেলা গড়েছে বিধি
কামলার ধন        ত্রিলোকমোহন
অতুল রূপের নিধি!
বাছনি করিয়া       সুষমা লইয়া
সারাজি জগৎ হ'তে,
শতবার করি        ভাঙ্গি আর গড়ি
গড়িলা মনের মতে।
সে রূপমাধুরী       আহা! মরি! মরি!
দেখিয়া মেটে না আশা,
রূপের প্রতিমা       প্রেমের মহিমা
কহিতে নাহি ক ভাষা।
চরণ-পরশে       ধরণীর অঙ্গে
থরে থরে ফুল ফুটে,
নয়ন-কটাক্ষে        কাদম্বিনী-অঙ্গে
শতেক দামিনী ছুটে।
গগনেরি গায়       চারু নীলীমায়
অয়ুত তারকা জ্বলে।
প্রেমিক সুজন        পেলে দরশন
ভাসে প্রেমরস-জলে।
যুগ যুগ ধরি        সে রূপমাধূরী
দরশে না মিটে আশা;
দেখে তারে যত        রূপ বাড়ে তত
সৃজিয়া অসীম তৃষা।
হেন রূপবতী        হেন রসবতী
হেন গুনাবলী বালা,
দেখিল যে জন        মজিল সে জন
হইয়ে আপন ভোলা।

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ