প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Tuesday, September 20, 2011

শুভ্র শরৎ || সুরবি প্রত্যয়ী

গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত_ এই ছয় ঋতুর এক অপরূপ সমন্বয় আমাদের এই মাতৃভূমি। কখনও রোদ, কখনও বৃষ্টি, কখনও বা আবার শিয়াল মামার বিয়ে দিতে রোদ-বৃষ্টি একসঙ্গেই! প্রকৃতির এই অদ্ভুত খেলার একটি অংশ শরৎকাল। বাংলা ভাদ্র-আশ্বিন মাস এবং ইংরেজি ক্যালেন্ডারে আগস্টের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত থাকে শরৎকাল। শরতের শুভ্রতা এই সময়টি জুড়েই আচ্ছন্ন করে রাখে আমাদের মনকে।
সকালবেলা ঘুম ভেঙেই জানালার পর্দার ফাঁক দিয়ে মারিয়ার চোখে পড়ল মেঘে ঢাকা আকাশ। আকাশ এত সুন্দর হয়! সাদা শুভ্র মেঘগুলোর ফাঁকে ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে হালকা নীল রঙের আকাশ। মনে হচ্ছে মেঘেরই রাজত্ব, আকাশটা কেবল একটি অংশ মাত্র! মারিয়া মুগ্ধ হয়ে দেখছিল আর ভাবছিল, এমন সুন্দরভাবে যদি দিনটা শুরু তবে সারাদিনটা ভালোই যাবে হয়তো! অন্যান্য দিনে ওর ঘুম ভাঙার পরও বিছানা ছাড়তে মিনিট বিশেক সময় লেগে যায়। তবে আজকে যেন দিনটাই অন্যরকম। মনে হচ্ছে, তাড়াতাড়ি না উঠলে সময় নষ্ট হবে। আর এত সুন্দর একটি দিন ঘুমিয়ে নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না!
ক্লাস শেষে বল্পুব্দদের সঙ্গে ক্যাম্পাসের সিঁড়িতে বসল আড্ডায় মারিয়া, নিপুণ, সোনিয়া, মুন আর আহাদ। উদ্দেশ্য ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা করা। ক্লাস, পরীক্ষা, অ্যাসাইনমেন্ট, লাইব্রেরি_ সব মিলিয়ে ওরা হাঁপিয়ে উঠেছে। একটা 'ব্রেক' না নিলেই নয়। গতবার গরমের ছুটিতে ওরা সবাই মিলে গিয়েছিল নীলগিরিতে। দারুণ মজা হয়েছিল সেবার। তবে মাথার ওপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের টেনশন। তাই এবার আর দূরে কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। সিদ্ধান্ত হলো, পুরো একটা দিন ওরা সময় দেবে শুধু ঘোরার জন্য। ওইদিন সব ক্লাস, পড়ালেখা বাদ। আর সেটা অবশ্যই ঢাকার ভেতরে হতে হবে। কারণ দিনে দিনে ফিরতেও তো হবে।
কিন্তু সেই জায়গাটা কোথায় হতে পারে? বুদ্ধিটা মারিয়াই দিল। ও সেই ছোটবেলা থেকে ঢাকায় বড় হয়েছে। গ্রামে তেমন যাওয়া হয় না বললেই চলে। কখনও কাশবন দেখেনি সে। সকালবেলা শরতের ওই শুভ্র আকাশটা দেখে শুভ্রতার আরেক প্রতীক কাশবন দেখার ইচ্ছাও হচ্ছিল ওর, বল্পুব্দদেরও তাই বলল। সবারই পছন্দ হলো এই আইডিয়া। তবে এই যান্ত্রিক শহরে এমন পরিবেশ কোথায় পাবে ওরা! সেই তো গ্রামের দিকেই যেতে হবে তাহলে। ভুলটা ভাঙাল আহাদ। ঢাকায় এবং এর কাছাকাছি বেশ কিছু জায়গা আছে যেখানে আছে কাশবন। আর কয়েক দিন খোঁজখবর নিয়ে ওরা জানতে পারল এমন কিছু জায়গার নাম। যেমন ঢাকার মিরপুরে মাজার রোড পেরিয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে আশুলিয়া যাওয়ার রাস্তার দু'ধারে চোখে পড়বে কাশবন। শুধুই যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তা নয়। এই সৌন্দর্য ঘিরেই এ অঞ্চলে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় বেশ কিছু কফি শপ, ভ্রাম্যমাণ রেস্তোরাঁ, খাবারের দোকান ও বিনোদন পার্ক। ভ্রমণ উপভোগ্য করে তোলার জন্য পানির ওপর বাঁশের মাচার মতো করে সেখানে বানানো হয়েছে টিনের ছাউনির ছোট ছোট ঘর। যাতায়াতের জন্য বাঁশের সাঁকো। আর বসার জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছে পানির ওপর সারি সারি সুদৃশ্য খুপরি ঘর। এখানে বসে অনায়াসেই দিনটি কাটিয়ে দেওয়া যায়। এ ছাড়াও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা, সাভার আর ডেমরার ওদিকেও রয়েছে কিছু কাশবন।
অনেক হিসাব-নিকাশ করে মারিয়ারা সিদ্ধান্ত নিল, মিরপুর হয়ে আশুলিয়ায় যাবে নিপুণের গাড়িতেই। ওরা পাঁচজন আর গাড়ির চালক। অবশ্য মিরপুর থেকে অনেক বাসও যায় ওদিকে। ওই বাসগুলোতে অনায়াসেই পেঁৗছে যেতে পারেন এমন সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে। অথবা মিরপুর বেড়িবাঁধ থেকে রিকশা অথবা সিএনজিচালিত যানে সহজেই চলে যেতে পারেন।
কাশবনে গিয়ে ওরা মুগ্ধ। প্রকৃতির এই অপার রূপ এত কাছে থেকে কখনও দেখেনি ওরা। ওপরে নীল আকাশ, সাদা মেঘ আর নিচে সাদা কাশফুল। পাঁচজন যেন ফিরে গেল তাদের ছেলেবেলার দুষ্টুমিতে। কেউ বনজুড়ে দৌড়ে বেড়াচ্ছে, আবার কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত। আহাদ তো কবিতা লিখতেই বসে গেল প্রকৃতির এই অপরূপ সৌন্দর্য দেখে!
ধীরে ধীরে সকাল গড়িয়ে দুপুর হলো, আর সঙ্গে সঙ্গে রোদের কী তেজ! এতক্ষণে ওদের উৎসাহে ভাটা পড়ল কিছুটা। এই গরম কি আর সহ্য হয়? তবে এই রোদের মাঝেই ওদের অবাক করে দিয়ে দেখতে দেখতে পুরো কাশবনটা ছেয়ে গেল মেঘের আঁধারে। নীল আকাশের ওই গাঢ় কালো মেঘমালা দেখলে যে কেউই ভয় পেয়ে যাবে। তবে ওই কালো মেঘই ওদের জন্য নিয়ে এলো বৃষ্টির বারতা। ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। ওরা একেকজন ভিজে কাকভেজা হয়ে গেল। তবে ক্ষণিকেরই ছিল যেন এই বৃষ্টি। থেমে গেল তাড়াতাড়ি। কিন্তু বৃষ্টির ফলে চারপাশের প্রকৃতি আরেক রূপ ধারণ করল। বৃষ্টির পানি ধুয়ে দিয়ে গেল চারপাশ! চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। গাছের পাতা, পায়ের নিচে ঘাসগুলো যেন একেবারে নতুন! আর কাশফুলগুলোর শুভ্রতা যেন বেড়ে গেছে আরও কয়েক গুণ। তবে এই শেষ নয়। প্রকৃতি যেন আজ মেলে ধরেছে তার অসীম রূপ ওদের দেখাবে বলেই। দূর আকাশে মেঘ সরে গিয়ে ওদের চোখে পড়ল সাত রঙের খেলা_ রংধনু! সেই স্কুলজীবন থেকে পড়ে আসা 'বেনীআসহকলা' আজ প্রথম প্রত্যক্ষ করল ওরা। প্রকৃতির এই অদ্ভুত রূপ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। তবে সুন্দর সময় যেন বেশিক্ষণ থাকার নয়। দেখতে দেখতেই ওদের ফেরার সময় হয়ে গেল। ফেরার পথেই সন্ধ্যা হয়ে এলো। আর আকাশে উঁকি দিল চাঁদটি। এত আলো হয় চাঁদের? ওদের মনে হচ্ছিল এ মুহূর্তে পুরো শহরের বিদ্যুৎ চলে গেলে বেশ হতো। চাঁদের আলোটা উপভোগ করা যেত প্রাণভরে! কাছেই কোথাও নিশ্চয়ই রয়েছে শিউলি গাছ। জোছনার সৌন্দর্যের সঙ্গে যোগ দিল শিউলি ফুলের মিষ্টি সুবাস। এর মাঝেই ওদের কেউ গেয়ে উঠল রবীন্দ্রসঙ্গীত। পুরো পরিবেশটাই যেন কেমন ঘোর লাগানো। এই নেশা থেকে বের হতে ইচ্ছে হচ্ছিল না ওদের।
প্রকৃতির এই রূপ শরতের পুরোটা জুড়েই থাকে। রোদ-বৃষ্টি, মেঘ, জোছনা, শিউলি_ এসব যেন আমাদের জন্য শরতের এক শর্তহীন উপহার! ইট-কাঠের এই খাঁচায়, ব্যস্ততার মাঝে যতই পড়ে থাকি না কেন, আমাদের মন কিন্তু এখনও শৈশবের সেই সারল্য খুঁজে বেড়ায় প্রতিটি মুহূর্তে। কখনও উড়ে যেতে চায় নীল আকাশে, আবার কখনও ছুটে বেড়াতে চায় শিশুর মতো। কিন্তু আজকাল শিশুরাও কি পাচ্ছে শৈশবের সেই স্বাদ, যেটি পেয়েছিলেন আপনি? তাদের কাঁধেও তো বোঝা কম নয়_ পড়ালেখার, প্রতিযোগিতার। শরতের এই প্রাকৃতিক রূপ দেখার অধিকার তো রয়েছে তাদেরও। তারা কি দেখেছে গ্রামের ঘরে ঘরে শরতের নবান্ন উৎসব? এই যান্ত্রিক নগরের ব্যস্ততা থেকে নিজেকে ছুটি দিয়ে ঘুরে আসুন না ঢাকার কাছাকাছি কাশবনের যে কোনো একটিতে। সঙ্গী করে নিন প্রিয় মানুষটিকে, প্রকৃতির এই অপার রূপে হারিয়ে যান কিছু সময়!

ছবি তুলেছেন: ফয়সাল মাসুম
সূত্র: সমকাল

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ