প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Tuesday, May 29, 2012

আধুনিক বাংলা সাহিত্যের কলম জাদুকর হুমায়ূন আহমেদ। ক্যান্সারের সঙ্গে নয় মাসের প্রথম পর্বের যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরেছেন। আগামী ১ জুন দ্বিতীয় পর্বের যুদ্ধ প্রস্তুতি নিয়ে আবার যাচ্ছেন মার্কিন মুল্লুকে। গত শুক্রবার (26262622222asdfasdfasdfasdfasdfasdfasdfsdfsd22226 নিজের প্রিয় জগৎ নুহাশ পল্লীতে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনের সঙ্গে বসেছিলেন দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে। সকাল থেকে সন্ধ্যা- বিশ্রাম নিয়ে তিন দফায় তিনি কথা বলেন। মানসিক শক্তি, মৃত্যুচিন্তা, লেখালেখি, ভালো লাগা, মন্দ লাগাসহ অনেক বিষয়েই মুখ খুলেছেন। সঙ্গে ছিলেন- জাকারিয়া সৌখিন ও রণক ইকরাম
এক.
গাজীপুরে হুমায়ূন আহমেদের নুহাশ পল্লী। ঢাকা থেকে আড়াই ঘণ্টার পথ। লালরঙা মাটির পাহাড়িয়া ঢঙে বনের মধ্যে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। গেট পেড়িয়ে ভেতরে ঢুকতেই হুমায়ূনীয় স্বাদের বিশাল এক জগৎ। চলি্লশ বিঘাজুড়ে বৃক্ষ আর বৃক্ষ। মাঝে মাঝে স্কাল্পচার, থাকার ঘর, বসার ঘর, বৃষ্টি বিলাস, ভূত বিলাস...। শেষ মাথায় দিঘি- দিঘি লীলাবতী। প্রতিদিন সকালে প্রথম থেকে শেষ মাথা পর্যন্ত হাঁটেন হুমায়ূন আহমেদ। আজও হাঁটতে বেরিয়েছেন।
সকাল সাড়ে ৯টা। হাত-পা তুলে শিশুর মতো জড়োসড়ো হয়ে হুমায়ূন আহমেদ বসে আছেন দিঘি লীলাবতীর পুরনো ঘাটে। ক্ষয়ে-ক্ষয়ে যাওয়া ঘাটটিতে সবুজ শেওলার গালিচা বিছিয়ে রেখেছে প্রকৃতি। চারদিকে বটবৃক্ষের ঝরা পাতা ছড়ানো-ছিটানো- ঘাটের উপরও। সবমিলিয়ে অদ্ভুত এক সৌন্দর্য। কুশলবিনিময়ের পর ইশারায় বসতে বললেন 'আমাদের কলম জাদুকর'। কেমন আছেন- জানতে চাইলে মৃদু হেসে বলেন, 'খুব ভালো'। শরীরে রোগ থাকলেও কণ্ঠে কোনো ছাপ নেই। খুব দৃঢ় আত্দবিশ্বাস। এরপর এক-দুই কথায় বাংলাদেশ প্রতিদিন-এর সঙ্গে গল্প জমতে শুরু করে-
স্যার, প্রতিদিন সকালেই হাঁটেন। হাঁটার জন্য হাঁটেন, নাকি সৌন্দর্য উপভোগের জন্য?
দুটোই।
নুহাশ পল্লীর সঙ্গে নয় মাসের বিচ্ছেদ শেষে ফিরলেন। পৃথিবীর নানা দেশের নানা জায়গা ঘুরেছেন। কিন্তু নুহাশ পল্লীই আপনার কাছে আলাদা। কেন?
কারণ গাছপালা। এখানকার প্রতিটি গাছপালার সঙ্গে আমি জড়িত। এখানে শত শত গাছ আছে। সবগুলোই আমার হাতে বা আমার উপস্থিতিতে রোপিত হয়েছে। আমি এদেরকে ছোট থেকে বড় হতে দেখেছি। এরা আমার সন্তানের মতো। আর এতগুলো সন্তানের মায়া অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে আলাদা হবে না?
কি চিন্তা থেকে এই অরণ্যে 'নুহাশ পল্লী' গড়েছিলেন?
আসল কারণ হচ্ছে গাছ। গাছের প্রতি আমার মমতা আছে। আর আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে গাছের কাছে আমরা অসম্ভব ঋণী। আমরা এই ঋণটা কখনো স্বীকার করছি না। আমরা তাকে জ্বালাচ্ছি- আগুনে পোড়াচ্ছি অথচ প্রতিনিয়ত আমরা গাছের কাছেই হাত পাতছি। সেখানে থেকেই নুহাশ পল্লী।
গাছ-গাছালি সন্তানের মতো ভালোবাসছেন। ওদের সঙ্গে কি আপনার কথা হয়?
আমি কথা বলি। ওরা বুঝতে পারে কি-না, জানি না। একটা গাছকে যদি দেখি খুবই দুর্বল, আমি পাশে গিয়ে দাঁড়াই। জিজ্ঞেস করি- 'কিরে ব্যাটা, এই অবস্থা কী জন্যে? সমস্যাটা কী বল আমারে।' মেবি ওরা আমাকে অ্যান্সার করে, বাট আমি ধরতে পারি না।
নুহাশ পল্লী-যশখ্যাতি সব হয়তো একদিন থাকবে। আপনিই থাকবেন না। এই ভেবে আফসোস হয়?
না। আফসোস হবে কেন? আমার এক জীবনে আমি নুহাশ পল্লী দেখেছি। ভালোবাসা পেয়েছি। তাই মরার আগেও আমার আফসোস থাকার কথা নয়। যখন মরতে হবে মরে যাব, তাই না?
এত মানসিক শক্তি আপনার। মানসিক শক্তিই কি আপনাকে সুস্থ করে তুলছে?
না। প্রচণ্ড মানসিক শক্তি নিয়ে অনেক মানুষ পৃথিবীতে এসেছে। কিন্তু তাদেরকে শেষ পর্যন্ত ডিজিজ-এর কাছে হার মানতে হয়েছে। অ্যাপলোর স্বপ্নদ্রষ্টা স্টিভ জনবস, তাঁর কী মানসিক শক্তি কম ছিল? তারপর জ্যো ফ্রেজিয়ে, তার কী মানসিক শক্তি কম ছিল?
হুগো শ্যাভেজ কিন্তু ফিরেছেন!
বলা হয়েছে তিনি সুস্থ। কিন্তু নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই। আরও আগে একবার বলা হয়েছিল তিনি সুস্থ। পরে আবার চিকিৎসা হলো। আবার এলো, আবার গেল। উনি পলিটিক্যাল লোক। পলিটিক্যাল লোকদের কোনো বিশ্বাস করতে নেই।
মৃত্যুর পরের জীবন সম্পর্কে আপনার ধারণা কী?
ধর্মীয়ভাবে একটা ধারণা সবার মধ্যে আছে। কিন্তু আমার একান্ত ব্যক্তিগত ধারণা হচ্ছে, দ্যা মোমেন্ট আই উইল ডাই- আমি মাটির সঙ্গে মিশে যাব।
তাহলে মৃত্যুটা আপনার কাছে কেমন?
মৃত্যুটা আমার কাছে খুবই পেইনফুল। একটা মানুষ এত ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে, ৭০-৮০ বছর বাঁচে সে। অথচ একটা কচ্ছপ সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে, হোয়াই? কচ্ছপের মতো একটা প্রাণী কেন সাড়ে তিনশ বছর বাঁচবে? আমরা কেন নই?
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, 'মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে'। আপনি কি বলবেন?
আবার একই সঙ্গে তিনি বলেছেন, 'মরণরে তুহু মম শামও সমান'। [মৃদু হেসে] উল্টা দুই রকম কথা বলে গেছেন। শোন, কবি-সাহিত্যিকরা অনেক কথা বলে। এগুলা নিয়া ঘামাও ক্যান?
আপনার কষ্ট, আপনার সুখ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
আমার কোনো কষ্ট নেই। আর সুখের কথা বললে বলব, অবশ্যই আমি অন্যদের চেয়ে বেশি সুখী। কারণ আমি জানি, কি করে সুখ আহরণ করতে হয়।
তাহলে স্বপ্ন, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি...
আমি নিজেকে নিয়ে এত চিন্তা-ভাবনা কখনোই করি না। আমি খুবই একটা সুখী মানুষ ছিলাম। এখনো সুখী। কাজেই বলা যেতে পারে, আমি তৃপ্ত। আর কী পেয়েছি, কী না পেয়েছি, ভাবি না। যা পাইছি ভালো, না পাইলে নাই। হা-হুতাশ করে লাভ নেই।
পথ চলতে গিয়ে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। এতটা পথ পেরিয়ে এসে, জীবনের শেষ উপলব্ধি মানে রিয়েলাইজেশনটা কী?
শেষ রিয়েলাইজেশন হচ্ছে 'জীবন অনেক, অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাপার'। তারা শঙ্করের কবির মতন মাঝে-মধ্যে আমার বলার ইচ্ছা করে, 'জীবন এত ছোট ক্যানে?' ওই যে একটু আগে বললাম, একটা কচ্ছপ কেন সাড়ে তিনশ বছর বাঁচে, মানুষ কেন বাঁচে না! জীবনটা আমার খুব ছোট মনে হয়। তোমাদের মনে হয় না? নাকি এখনো টের পাও নাই? টের পাইবা...
সকালের শিশু সূর্যটা যুবক হয়ে উঠছে। খুব তেজ ছড়াচ্ছে। ঘামছেন হুমায়ূন আহমেদ। তাই উঠবেন। কিন্তু ফটোসেশন! হুমায়ূন আহমেদ খুব একটা ফটোসেশনে অংশ নেন না। তবুও ফটোসেশনের অনুরোধ। হ্যাঁ, তিনি গিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসলেন সিঁড়ির একপাশে। কিছু ছবি তোলা হলো। কিন্তু তার মুখে হাসি নেই। হাসার অনুরোধ করতেই বললেন, 'আমি হাসতে পারি না বাবা...'।
ছবি তোলা শেষ। ঘরে গিয়ে একটু বিশ্রাম নেবেন হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্রাম শেষে আবার কথা বলবেন জানিয়ে সোজা হাঁটা শুরু করলেন। ধীর গতিতে হেঁটে চলে গেলেন নিজের কুটিরে। ছেলে নিশাদ দাঁড়িয়েছিল। বাবাকে দেখে কি বলে যেন উচ্ছ্বাস দেখালো। সম্ভবত কোনো আবদারের উচ্ছ্বাস। হুমায়ূন আহমেদও নিশাদের হাত ধরে আবদার পূরণের আশ্বাস দিতে দিতে ভেতরে ঢুকলেন।

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ