মঙ্গলবার, এপ্রিল 15, 2025

প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Tuesday, June 14, 2011

শিশু-কিশোরদের কবি ফররুখ আহমদ ও প্রাসঙ্গিক স্মৃতি ।। আহমদ - উজ - জামান

১০ জুন। বাংলা সাহিত্যের মুসলিম ঐতিহ্যানুরাগী শ্রেষ্ঠতম কবি ফররুখ আহমদের জন্মদিন। ১৯১৮ ঈসায়ী সালে যশোর জেলার মাঝআইল গ্রামে সম্ভ্রান্ত এক সৈয়দ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বেঁচে থাকলে আজ ৯৩ বছরে পা দিতেন। তাঁর বাবার নাম ছিল খান সাহেব সৈয়দ হাতেম আলী। সে হিসেবে ফররুখ আহমদের পুরো নাম হবে সৈয়দ ফররুখ আহমদ। তাঁর মাতা সাহেবার নাম ছিল বেগম রওশন আখতার। কবি ফররুখ আহমদ তাঁর নামের সঙ্গে সৈয়দ লিখতেন না। কেন লিখতেন না, তা জানা যায়নি। তাঁর পূর্ণ জীবনীগ্রন্থ এখনও লেখা হয়নি। তাঁর আত্মজীবনীর কথা ভাবাই যায় না। তিনি আতশী কবি ছিলেন। নিজ জীবন কথা তো দূরের কথা, তাঁর জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্মৃতিকথা জানতেও অনুসন্ধিত্সুদের সাহস হতো না। দুই চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকানো যেত না। দুই চোখ দিয়ে আতশী আত্মার আগুন ঝলকাতো।
কবি ফররুখ আহমদ শিশুদের জন্য অনেক কবিতা রচনা করেছেন। শিশুদের হাসি পৃথিবীতে একমাত্র পাক-পবিত্র রয়েছে, এটা তাঁর বিশ্বাস ছিল। শিশুদের নিয়ে লেখা তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয়েছিল ‘লায়লাতুল বরাত, হিজরি ১৩৮৯ সনে। ঈসায়ী সন ১৯৬৮। আজ থেকে ৪৩ বছর আগে, বাংলা সাল হবে ১৩৭৫, প্রকাশক ছিলেন মহিউদ্দীন আহমদ, আহমদ পাবলিশিং হাউস, ৭নং জিন্দাবাহার প্রথম লেন, ঢাকা-১। মূল্য ছিল তিন টাকা পঞ্চাশ পয়সা। বইটির শিশুতোষ ইলাসট্রেশান করেছিলেন রফিকুন নবী। বইটি কবি তাঁর পাঁচ শিশু সন্তান আখতার, বাচ্চু, মন্নু, তিতু ও টিপুকে উপহার দিয়েছিলেন, আব্বা বলে। এরা এখন শিশু নয়। শিশুদের আব্বা কিংবা দাদাজান হয়ে গেছে। বেদনাময় দুনিয়া থেকে দু’জন তারুণ্যের প্রভাতেই ঝরে গিয়েছিল। বইটিতে সূচিপত্র অনুযায়ী পাঁচটি বিভাগে যথা : নতুন লেখা (১৩), রং তামাশা (১৪), সবুজ নিশান (৮), কিসসা শোনার সন্ধ্যা (৩), রাসুলে খোদা (৯) মোট ৪৭টি কবিতা ও ছড়া রয়েছে। ঘন নীল কালিতে ছাপা। নতুন লেখার তেরোটি কবিতায় বাংলাদেশের প্রকৃতির মিষ্টিমধুর জলরঙের বর্ণনা রয়েছে। রং-তামাশায় শিশুমনের বিচিত্র কৌতূহল-উদ্রেককর কথা আছে। সবুজ নিশানে-নৈতিক পবিত্র আদর্শের অনুপ্রেরণা রয়েছে। কিসসা শোনার সন্ধ্যায় আছে রূপ কথার মায়াজালি। আরব্যরজনীর আদলে রাসুলে খোদা অংশে আছে—রাসুল্লাহ (সা.)-এর মক্কা-মদিনার পবিত্র পুষ্পসুবাস, নূর নবীর শৈশবের কথা। বিশ্বাস ও ঈমানের চেরাগ।
কবি ফররুখ আহমদ শিশুসাহিত্যে এসব কবিতা ও ছড়ার সৃষ্টিতে এ দেশে ছিলেন অদ্বিতীয়। তাঁর কবিতায় যে বৈশিষ্ট্য তাঁকে অমর করে রেখেছে তা সৃষ্ট উপমা, মেঘডুম্বুর ছন্দ ধ্বনি, দীপ্তিময় শব্দ ও আত্মগত রূহানি নূর। শিশুদের কবিতায় তিনি ছাপ রেখেছেন শিশুতোষ হৃদয়ের সহজ-সরল কল্পনা রাজ্যের কথার ঝলমলে মণি-মাণিক্যে। ছড়া ও কবিতায় বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য ফুটেছে অপূর্ব সুগন্ধে—মেঘ বৃষ্টির ছড়া, বৃষ্টির ছড়া, পয়লা আষাঢ়, বর্ষার গান, ইলশে গুঁড়ি, শ্রাবণের বৃষ্টি, শরতের সকাল, হৈমন্তী সুর, পউষের কথা—প্রতিটি ছড়ায় বাংলা ঋতু ‘খোশবু ছড়ায় বনে বনে/ফুলের আতরদানী’, বর্ষা শেষে শরত্ এলে—‘ঝিলমিল, ঝিলমিল, নীল/পরীদের ঐ মনজিল।’ শরত্ শেষে হেমন্ত এলে—‘হিম শির শির হেমন্ত মাঠ/কাঠুরিয়া যায় কেটে কাঠ/রাত্রিশেষে ঝলমলে দিন/বেড়ায় মাঠে সোনার হরিণ’/হেমন্তের শেষে ‘উত্তরা বায় এলোমেলো পউষ এলো। পউষ এল/হিমেল হাওয়ায় শির শিরিয়ে, এল অচিন সড়ক দিয়ে...’ ছড়ার ছন্দ ও ধ্বনি সুমধুর, কল্পনার রাজ্য সুবিস্তৃত... পাখিদের ছড়ায় আছে শৌখিন পাখি, শ্রমিক পাখি, শীতের পাখি, পাখির ঝাঁক, পাখি শিশুদের প্রিয়, সেই কৌতূহলী শিশুমন নিয়ে এমন রূপালী ছড়া শিশুচিত্তকে নাড়া না দিয়ে পারে না—‘কাদা খোঁচা পাখি ভাই খায় কাদা খুঁচে/দিন শেষে পাখনার কাদা যায় মুছে/...’ পাখিদের ছড়া শেষে এসেছে; মাঘের শীতে, মাঘ আসে,—‘আবছায়া কুয়াশার পাখা/ঢেকে ফেলে আসমান কালি ঝুলি মাখা.../’আসে ফাল্গুন—‘ফাল্গুনে শুরু হয় গুন গুনানি/ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙ্গানি/...’ শেষে আসে চৈত্রের কবিতা : চৈত্র এল ফাগুন শেষে/ভয়ের সাড়া পড়ল দেশে/রঙিন পালক ধুলোয় ছুঁড়ে/দূরের পাখি পালায় উড়ে...।’
কবি ফররুখ আহমদ তাঁর ছড়া নির্মাণে অন্তমিল রেখেছেন শক্তিশালী ছন্দ জ্ঞানে। ছড়া বলে দুর্বল পাংশু বর্ণের এলোমেলো ভাবচিন্তা নেই। শব্দ যেমন কমনীয়, তেমনি দৃঢ়। তার নিজ পবিত্রগুণের ঋজুতা ও দৃঢ়তা রয়েছে ছড়া ও শিশু কবিতার ছন্দে ও ভাবে। সবচেয়ে বড় কথা তাঁর ছড়া, কবিতা, কৌতূহল, সবই উজ্জ্বল আল্লাহ রাসুলের বিশ্বাসে : ‘আমিনা মায়ের কোলে এলেন নবী/আঁধারে জাগলো যেন ভোরের রবি/আল্লাহর রহমত এল জাহানে/দুনিয়াটা পেল যেন ভরসা প্রাণে/...’
কবি ফররুখ আহমদ তত্কালীন ভারত ভাগ হয়ে গেলে পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসার পর ঢাকা বেতারে স্টাফ আর্টিস্ট হিসেবে চুক্তিবদ্ধ কর্মে নিয়োগপ্রাপ্ত হোন। যে আজাদীর জন্য জান কোরবান করে সংগ্রাম করলেন, বাস্তবায়নের পর নিকটজন বৈরী হলেন, তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের কাছে ব্রাত্য হলেন, জিন্দেগির কাব্যিক রৌশন চলে গেল। দারিদ্র্যকে গ্রহণ করা যায় আল্লাহর নিয়ামত হিসেবে, কিন্তু উপেক্ষা? রেডিও পাকিস্তান তথা ব্রিটিশ অল ইন্ডিয়া রেডিও’র স্থপতি মহাপরিচালক (ডিজি) এসএ বোখারী পাক-ভারত উপমহাদেশের ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের কিংবদন্তি পুরুষ কী পাস, অর্থাত্ তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতা কী ছিল? জীবন শুরু করেছিলেন ভারতের ইংরেজ ফৌজবাহিনীর শিবিরে সৈন্যদের উর্দু ভাষা শিক্ষাদানের মাধ্যমে, তিনি ছিলেন নন-ম্যাট্রিক। ঢাকা বেতার কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালক, পরে দেশ স্বাধীন হলে হলেন মহাপরিচালক (বাংলাদেশ বেতারের অর্গানোগ্রামে সর্ব উচ্চপদ রাখা হয়েছিল ‘পরিচালক’-ডাইরেক্টর) অর্থাত্ ডাইরেক্টর হলেন আশরাফ-উজ-জামান খান। তিনি নন-ম্যাট্রিক ছিলেন। কবি ফররুখ আহমদ তত্কালীন ক্যালকাটা রিপন কলেজ থেকে আইএ পাস করেছিলেন। স্কটিশ চার্চ কলেজ ও সিটি কলেজে উচ্চ শিক্ষা লাভ করেছেন, তবে ডিগ্রি (গ্রাজুয়েশন) নেননি। তাঁর ইংরেজি ভাষা স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রখরতায় নির্মিত ছিল। ডিজি (অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে...) থেকে আ.ডি (রিজিওনাল ডিরেক্টর—তথা মহাপরিচালক) পর্যন্ত বেতারে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন কলাবিদ্যার শক্তিতে। তাহলে ফররুখ আহমদ আইএ উত্তীর্ণ প্রখ্যাত কবি হয়ে ঢাকা কেন্দ্রে প্রথমে ক্যাজ্যুয়াল চুক্তিতে আর্টিস্ট-শিল্পীকর্মী, পরে বার্ষিক স্টাফ আর্টিস্ট নিযুক্ত হোন কোন যুক্তিতে! তিনি কি বাংলা, ইংরেজি, ফার্সি, আরবি, উর্দু জানতেন না? তিনি যে ইংরেজি জানতেন তা তখনকার ঢাকা কেন্দ্রের উচ্চপদের আধিকারিক জানতেন না। সবাই জানত পাতলা শ্মশ্রুমণ্ডিত মুখের, কালো শেরওয়ানি পরা ব্যক্তিটি বড়জোর আরবি পর্যন্ত জানে।
তাঁর ছড়ার বইয়ে ‘অদ্ভুত সংলাপ’ নামে একটি ছড়া আছে : ‘একটা মানুষ ছিল শুধু করত যে সাজসজ্জা,/ অন্য কোনো কাজে সে ভাই পেত যে খুব লজ্জা,/ লেবাসটাকে ভাবত সে তার শরাফতের অঙ্গ/মানুষ কেন তাকে নিয়ে করছে এমন রঙ্গ?/...অন্য এক ছড়া শেখ সাদীর অনুসরণে লেখা, নাম ‘বিচিত্র অভিজ্ঞতা’ : ‘কায়দা আদব শেখার কথা/ভেবে যারা হয়রান/পাচ্ছে না ঠিক পথের দিশা/দেখছে ফাঁকা ময়দান/এর পরের পঙিক্ততে জ্ঞানী লোকমানের কথায় বলেছেন—‘বে-আদবের কাছে আদব/শিখি আদম-সন্তান/কয় যে কথা, করে যে কাজ/ আদব-হারা অজ্ঞান/বুঝেসুজে সেসব আমি/বাদ দিয়ে যাই সজ্ঞান/... কমজোর দিলের এই শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদনকারীকে এক সাদা কাগজে লিখেছিলেন : ওয়া তাম্মাত কালেমাতু রাব্বেকা- ছেদকাও ওয়া আদলা লা মুরাদ্দেলা লে কালেমাতিহি ওয়া হুওয়াছ ছামিয়োল আলীম (সুরা : আনয়াম, ৮ম পারা, ১১৫ আয়াত)। তারপর লিখে দিলেন এর তরজমা ইংরেজিতে : ঞঐঊ ডঙজউ ঙঋ ঞঐণ খঙজউ/ উঙঞঐ ঋওঘউ ওঞঝ ঋটখঋওখগঊঘঞ/ওঘ ঞজটঞঐ অঘউ ওঘ ঔটঝঞওঈঊ/ঘঙঘ ঈঅঘ ঈঐঅঘএঊ ঐওঝ ডঙজউঝ/ঋঙজ ঐঊ ওঝ ঞঐঊ ঙঘঊ ডঐঙ/ঐঊঅজঊঞঐ অঘউ কঘঙডঊঞঐ অখখ/... যখন এই পবিত্র কথাগুলো লিখে দিয়েছিলেন তখন তাঁর ওপরে জালিমের জুলুম ঝঞ্ঝার মতো বয়ে যাচ্ছিল (১৯৭২ সাল : বাংলাদেশ বেতার বাণিজ্যিক কার্যক্রম অফিস, ১১৬ বেইলি রোড, ঢাকা)। বেতন বন্ধ ছিল, স্টাফ আর্টিস্টের আর্থিকভাবে পাওয়া টাকাকে ‘বেতন’ বলে না। বলে রিমিউন্যারেশন (জঊগটঘঊজঅঞওঙঘ) বা পারিশ্রমিক। তিলে তিলে ক্ষয় হচ্ছিলেন পূর্ণিমার চাঁদ।...কবি ফররুখ আহমদ তত্সময়ের মাসিক দিশারী সাহিত্যপত্রে (১ম বর্ষ ১ম সংখ্যা আষাঢ়-১৯৬০, শ্রাবণ-১৩৬৭, ছফর-১৩৮০)। আল্লামা ইকবালের ‘কর্ডোভার মসজিদ’ পরিমার্জিত করে ছাপছিলেন। তাঁর নিজ হাতে প্রুফ কপি ওই পত্রিকার ৪ পৃষ্ঠার পরে ৮–৫.৫ সাইজের নিউজপ্রিন্টে সংযুক্ত ছিল। এই লেখককে তিনি কী মনে করে তা দিয়েছিলেন, মনে নেই। তাঁর নিজ হাতে কবিতার যে পরিমার্জন করছিলেন সেই মূল পাণ্ডুলিপিটিও দিয়েছিলেন। তবে ওই পাণ্ডুলিপিতে সম্পূর্ণ কবিতার পুনমার্জন ছিল না। দীর্ঘ তিন স্তবকের পর চতুর্থ স্তবকের ছ’লাইন পর্যন্ত ছিল। খুব সম্ভব পত্রিকাটির অক্ষর পরীক্ষা (প্রুফ রিডিং) করে দেয়ার জন্য দিয়েছিলেন। তাঁর বিশ্বাস লাভ করা আমার রুগ্ণ জ্ঞানের দ্বারা সম্ভব ছিল না। তবু পেলাম। কিন্তু তাঁকে ফেরত দিতে পারিনি... (তার ওয়ারিশ চাইলেই সবিনয়ে তাঁর হাতে ফেরত দিয়ে আমি দায়িত্ব মুক্তির অপেক্ষায় থাকলাম) : পৃথিবীর তিনজন খ্যাতনামা কবির শেষকাল মানুষকে আজও ভাবায়। পারস্যের বিখ্যাত মহাকাব্য শাহনামা রচয়িতা ফেরদৌসী রাজরোষ এড়াতে আফগান সীমান্তের এক পল্লীতে গিয়ে লুকিয়েছিলেন। বেঈমান বাদশা তাকে প্রতারিত করেছিল। ভগ্ন হৃদয়ে অজ্ঞাত গ্রামে মৃত্যুবরণ করেন। হিন্দুস্থানের শেষ মুঘল বাদশা নিজ দেশে দাফনের জন্য সাড়ে তিনহাত জায়গা পাননি। নির্বাসিত অবস্থায় মগের দেশে সমাধিস্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের সাত সাগরের কবি ঢাকায় তাঁর অকাল মৃত্যুর পর সাড়ে তিন হাত ভূমি পাননি দাফনের জন্য। কবি বেনজীর তাঁর এস্টেটের মসজিদ প্রাঙ্গণে সাড়ে তিন হাত জায়গা দিয়েছিলেন কবি ফররুখ আহমদকে দাফন করতে। এক কবি আরেক কবিকে এটুকু দয়া প্রদর্শন করে জাতির কাছে চিরস্মণীয় হয়ে থাকলেন। শাজাহানপুরে রেলওয়ে কলোনি ছাড়িয়ে বাইলেনের (এখন বাইলেন নয়) এক রাস্তা ধরে সেই মসজিদ পরিসীমার মধ্যে গিয়ে পৌঁছালে ইমাম সাহেব একটি কবরের আকৃতি দেখিয়ে দেবেন। এঁটেল মাটি। ২০০৮ সালে ওই কবর জিয়ারত করতে গিয়ে দেখা গেল কবরটির চিহ্ন খুব স্পষ্ট নয়। বিলীয়মান। আরও দুটো কবর আছে। কবি বেনজীর ও তাঁর স্ত্রীর। ওখানে আর একটি কবর আছে। কেউ জানে না কার। সে কবর বিশিষ্ট লেখক, কবি ও সাংবাদিক ফজলুল হক সেলবর্ষীর (১৮৯৩-১৯৬৮)। সুনামগঞ্জ জেলার প্রতিভাবান লোক ছিলেন। কবি বেনজীর তাঁকেও তার নিঃস্ব অবস্থায় সেখানে সমাহিত করার ব্যবস্থা করেছিলেন। কবরগুলোর ওপরে তৃণ লতাগুল্ম নেই। মাটি বেশ শক্ত রুক্ষ। কবরগুলোর ওপরে গাছের ডালে পাখির বাসা আছে। ওই শক্ত ভূমির ওপরে তাদের মলত্যাগের চিহ্ন আছে। মনে হয় সাদা রং দিয়ে কারা যেন কড়ি ফুল এঁকে রেখেছে। না, কবি ফররুখ আহমদের কবর পাকা করে মাজার নির্মাণ হোক, তা তিনি নিজে জীবিত থাকাকালে যেরূপ চাইতেন না, আমরা তাঁর গুণমুগ্ধরাও চাই না। তবে ওই শক্ত মাটি যেটি ফাটল ধরেছে তা ঘাস-মসৃণ, দুর্বাঘাসে ঢেকে রাখতে আপত্তি কি? ওই প্লটটা একটু শ্রীমণ্ডিত করে রাখলে মন্দ হতো না। ছোট্ট পাথরের ফলকে কবির নামটা খোদিত করে রাখলে আগামী প্রজন্ম দর্শন করতে গিয়ে দোয়া করতে পারত।
মুঘল সম্রাট শাহজাহানের কবি দুহিতা জাহানারা বেগমের স্বরচিত একটি কবিতা তাঁর কবরে উত্কীর্ণ হয়ে আছে : ‘একমাত্র ঘাস ছাড়া আর যেন কিছু না থাকে আমার সমাধির ওপরে, আমার মতো দীন অভাজনের সেই তো শ্রেষ্ঠ আচ্ছাদন’ (দৃষ্টিপাত : যাযাবর)। ঠিক তেমনি এক ফালি সবুজ ঘাসের আচ্ছাদন!!

কবি ফররুখ আহমদ যখন ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ‘কিশোর অনুষ্ঠান’ পরিচালনা করতেন, এই লেখক তখন অনুষ্ঠানের প্রযোজক ছিলেন। কবি ফররুখ আহমদ যে অনুষ্ঠান ১৯৪৮ সাল থেকে একাধারে পরিচালনা করে আসছিলেন, ১৯৭২ সালে তা থেকে সরিয়ে তাঁর চুক্তিপত্র বাতিল করে পারিশ্রমিক বন্ধ করা হয়। চুক্তিপত্র বাতিল সম্পর্কে তাঁকে লিখিতভাবে না জানিয়ে তার ইনক্রিমেন্টসহ রিমিউনারেশন বন্ধ করে দেয়া হয়। তাঁকে ঢাকা কেন্দ্রের অফিসে আসতে বারণ করা হয় এবং বেইলি রোডে কমার্শিয়াল সার্ভিসে হাজিরা দিতে হুকুম দেয়া হয়। কোনো কারণ না দর্শিয়ে তাঁর মানবিক অধিকার তথা নাগরিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়। লেখক তখন বেইলি রোডে কমার্শিয়াল সার্ভিসে সহকারী পরিচালক। কমার্শিয়াল সার্ভিসে কবির কোনো কাজ ছিল না। তিনি বিজ্ঞাপন লেখক ছিলেন না। ওই সময় তিনি অভুক্ত অবস্থায় লাঞ্ছিত, বঞ্চিত ও অপমানিত হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে নিবন্ধকার ঢাকা বেতার কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক পদে নিয়োজিত হলে কবি ফররুখ আহমদ কেন্দ্রের আঞ্চলিক পরিচালকের (ভারপ্রাপ্ত) মাধ্যমে তত্কালীন মহাপরিচালকের কাছে তাঁর দুর্দশার কথা জানিয়ে বেতন দানের আবেদন করেন। মহাপরিচালক তা মন্ত্রণালয়ে পাঠাননি। কবি দ্বিতীয় আবেদন করলে ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক তা সরাসরি তত্কালীন তথ্যমন্ত্রী মরহুম মিজানুর রহমান চৌধুরীর কাছে পাঠিয়ে দেন। কিছুদিন পর মন্ত্রী সেই আবেদন ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালকের বরাবরে পাঠিয়ে দেন। আবেদনের পার্শ্বে মন্ত্রীর নিজ হাতে মন্তব্য লিখেছিলেন —‘তার বেতন দেয়া হোক’। যেহেতু এই বেতন দেয়া হবে মহাপরিচালকের পরিদপ্তর কর্তৃক, সেহেতু ভারপ্রাপ্ত আঞ্চলিক পরিচালক মহাপরিচালককে মন্ত্রী মহোদয়ের মন্তব্যের কথা ফোনে জানানো হয়। মহাপরিচালক বললেন, এখনই ওই আবেদনপত্রটি আমার কাছে পাঠিয়ে দিন। তাই করা হলো। কিন্তু কবি ফররুখ আহমদের ভাগ্যে বেতন পাওয়া হয়নি। ১৯৭৩ সালের মে মাসে নিবন্ধকার সিলেট বেতার কেন্দ্রে নিজ থেকে ঢাকা কেন্দ্রের দায়িত্বভার ছেড়ে বদলি হয়ে চলে গেলে ওই আবেদনের ওপর স্বয়ং মন্ত্রীর আদেশ কার্যকর করা হয়েছিল কি না তা তার জানা হয়নি। ১৯৭৪ সালের ১৯ অক্টোবর কবি ফররুখ আহমদ এই দুনিয়া থেকে চিরতরে ছেড়ে চলে যান সাত সাগরের ওপারে। যদি তাঁর বকেয়া বেতন সেই সময়ের মহাপরিচালক দিয়েও থাকেন, তা হলে সেই প্রাচীন মহাকবি ফেরদৌসীর মৃত্যুর ঘটনাকে স্মরণ করায়—বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠতম কবি ফররুখ আহমদের মৃতদেহ ইস্কাটন গার্ডেনের এক গেট দিয়ে বের হচ্ছিল দাফনের জন্য। অন্যদিকে শাহবাগের ঢাকা বেতার কেন্দ্রের গেট দিয়ে মহাপরিচালকের হুকুমনামা প্রবেশ করছিল তার কোনো শাহী বাহকের মাধ্যমে।

সূত্র : আমার দেশ

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ