প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, July 15, 2011

লোক ঐতিহ্যের বর্তমান তা লোক লোকান্তর থেকে সোনালি কাবিন ।। ড. ফজলুল হক তুহিন

লোকঐতিহ্য একটি জনপদের আবহমান কালের বস্তুগত (গধঃবত্রধষ) ও অবস্তুগত বা ভাবগত (ঘড়হ-সধঃবত্রধষ বা ঝঢ়রত্রঃঁধষ) সম্পদ ও সংস্কৃতির অংশ। আদিম বর্বর স্তরের মানবসমাজ, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিকতার প্রতিঘাতে বহু যুগ ধরে রূপান্তরিত হয়ে চলেছে। লোকঐতিহ্য সে কারণে শুধু প্রাচীন সমাজের দর্পণই নয়, বরং চলতিকালে বস্তু ও মানবসংস্কৃতি সম্পদের প্রাণবন্ত কোষ, এই ঐতিহ্যকে প্রাণরস জোগান দেয় বিশেষ দেশের ভৌগোলিক, ঐতিহাসিক ও জাতিগত ঐতিহ্য। ঐতিহ্যই লোকসংস্কৃতির প্রাণশক্তি, আর সমাজবদ্ধ মানুষের অনন্ত সৃজনশীলতাই এর চালিকাশক্তি। তাই লোকঐতিহ্য একই সঙ্গে দেশজাত আঁচল ধরা, আবার বিশ্বগত ও সর্বজনীন। প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কবিতা লোকঐতিহ্যের বিপুল সম্ভারে লোকজীবন ও সংস্কৃতিলগ্ন। গ্রামকেন্দ্রিক জীবন-প্রকৃতি, কৌমপ্রধান সমাজব্যবস্থা, নানা শ্রেণীর পেশাজীবী গোষ্ঠী, ধনোত্পাদন পদ্ধতি, লৌকিক বিশ্বাস-আচার-প্রথা-সংস্কার-অনুষ্ঠান প্রভৃতি এবং কৃষিনির্ভর জীবন-জীবিকার বৈশিষ্ট্য লোকঐতিহ্যের বিশাল জগত্ সৃষ্টি করেছে। আধুনিক যুগে এসে সমাজ-রাষ্ট্র-জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির বিপ্লবে বাংলার লোকঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্থানে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শ-সাহিত্যাদর্শ-জ্ঞান-বুদ্ধি-প্রযুক্তির প্রভাব-বলয় তৈরি হয়। তবু নতুন আঙ্গিকে ও রূপে লোকঐতিহ্য বর্তমানতার সঙ্গে সেতুবন্ধ রচনা করে টিকে আছে, সাহিত্যেও তার ছায়া বিস্তৃত।
আল মাহমুদ বাংলা ভাষা-সাহিত্য ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বশীল কবি । উত্তর-ঔপনিবেশিক যুগে তথাকথিত বৈশ্বিক আধুনিকতার বিপরীতে স্থানিক ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির রূপায়ণে তাঁর শিল্পকর্ম আবহমানকালের সঙ্গে শেকড় স্থাপন করেছে। স্বভাবতই তাঁর কবিতায় লোকঐতিহ্য একটা বড় জায়গা করে নিয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় জীবনানন্দ দাশ ও জসীমউদ্দীনের পথে কবি হাঁটেননি; বিষয়গত কিছু মিল থাকলেও আঙ্গিকশৈলীতে একান্ত নিজস্বতা উপার্জন করে নিয়েছেন। বায়ান্নোত্তর বাংলাদেশের অধিকাংশ কবি বাঙালি জাতীয়তায় উজ্জীবিত হয়ে আত্মআবিষ্কার ও আত্মপরিচয়ের সন্ধানে মনোনিবেশ করেন। জাতির শেকড়ের খোঁজে তারা লোকঐতিহ্যের বিস্তৃত জমিনে কর্ষণ চালান। আল মাহমুদ সেসব কবির অন্তর্ভুক্ত, যাঁরা জাতির আবহমান ঐতিহ্যের প্রতি দায়বদ্ধ ও লালনে আন্তরিক। স্বভাবতই তাঁর কবিতায় প্রথম থেকেই প্রাধান্য পেতে থাকে লোকঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদান। বিশেষভাবে লোকজ শব্দের ব্যবহারে শিল্পনৈপুণ্য তাঁর কবিতাকে করেছে স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত ও লোকসমাজলগ্ন। তাঁর বিভিন্ন পর্যায়ের কবিতায় লোকঐতিহ্যের রূপায়ণ হয়েছে বিভিন্ন মাত্রায়।
প্রথম পর্যায়ে আল মাহমুদের কবিতায় লোকঐতিহ্যের প্রয়োগ হয়েছে বিচিত্রভাবে এবং পরিমাণের দিক থেকেও তা অসামান্য। লোক লোকান্তর কাব্যেই আল মাহমুদের লোকঐতিহ্য রূপায়ণের সূচনা। তিনি বিচ্ছিন্ন ও সংক্ষিপ্ত আকারে এই ঐতিহ্যের ব্যবহার করেন। এই গ্রন্থের ‘তিতাস’ ও ‘নৌকোয়’ কবিতা দু’টিতে নদীকেন্দ্রিক ও তীরবর্তী প্রাকৃতিক আবহে লালিত মাঝিমাল্লা ও লোকজীবনের বিচিত্র বিষয়াবলী প্রকাশিত। বাংলাদেশের মানুষের যে জীবন, তার বৃহত্তম অংশই হলো লোকজীবন। লোকজীবনের যাবতীয় দিকসমূহকে নিয়েই লোকঐতিহ্যের কাঠামো নির্মিত হয়। সেজন্যে লোকঐতিহ্য ও লোকজীবন অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। কেননা আমরা লোকজীবনের কথা যখন বলি তখন সেই সাধারণ মানুষের সামগ্রিক জীবনের কথাই আসে, অর্থাত্ তাদের ধর্ম-কর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস, সংস্কার, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জীবন ও জীবিকা; এক কথায়, সাধারণ মানুষের সমগ্র জীবন চিত্রই এর আলোচ্য বিষয়। সাধারণ এই মানুষ জীবনচর্চায় নানান পেশায় নিয়োজিত থাকে। গ্রামবাংলার লোকজীবন বলতে কামার, কুমার, তাঁতি, বেদে, চাষী, মাঝি, সাপুড়ে ও পাড়া গাঁয়ের সমন্বিত প্রকাশকে বোঝানো হয়। প্রকৃতপক্ষে, আবহমানকাল ধরে গ্রামীণ জনপদে বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত মানুষের জীবনধারাকেই লোকজীবন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
কবির শৈশবের নদী তিতাস; যৌবনে জীবিকার সন্ধানে শহরবাসী হলেও শান্তির জন্য বার বার ফিরে আসেন এ নদীর কাছে। তাই কবি অনুভব করেন নদীর ঢেউ, ঘোলা স্রোত, পালতোলা নৌকা, গ্রাম্য বউয়ের মাটির কলসে জল ভরে বাড়ি ফেরা, নদীনির্ভর পাখিদের কলরব ইত্যাদি আবহমান বাঙালি জীবনের চলচ্ছবি।
এ আমার শৈশবের নদী এই জলের প্রহার সারাদিন তীর ভাঙে, পাক খায়, ঘোলা স্রোত টানে যৌবনের প্রতীকের মতো অসংখ্য নৌকার পালে গতির প্রবাহ হানে। মাটির কলসে জল ভরে ঘরে ফিরে সলিমের বউ তার ভিজে দুটি পায়। [তিতাস : লোক লোকান্তর]
নদীনির্ভর জনপদ ও প্রকৃতির যে চালচিত্র কবি এঁকেছেন, তা বাংলাদেশের লোকজীবনের এক মৌল অংশ। ‘নৌকোয়’ কবিতায়ও নদী, ঢেউ, নৌকা, নৌকায় যাত্রা, গান ও যাত্রার আবহ কবি নিপুণ চিত্রকল্পে ধরেছেন। সম্পূর্ণ কবিতাটিই গ্রামীণ বাংলার মধ্যে বয়ে যাওয়া এক নদীতে নৌকা যাত্রার অনুপুঙ্খ বর্ণিত। নদীকেন্দ্রিক লোকজীবনের প্রাণবন্ত গতিচিত্র কবি এঁকেছেন নিজ কাব্যভাষায়। লোক লোকান্তরের ‘রাস্তা’ কবিতায় কৃষি জমি ও নদীভিত্তিক লোকজীবনের কথা উল্লিখিত। কৃষক, জমিন, কর্ষণ, হাল, বলদ, ঘরবাড়ি, বহমান নদী, সবুজ প্রান্তর, লাউয়ের মাচা, কৃষাণীর ভেজা নীল শাড়ি, শুঁটকির গন্ধ ও মাছির আওয়াজ এবং নারীর প্রতীক্ষিত প্রেমের দৃশ্যাবলী গ্রামবাংলার চিরকালীন জীবনের প্রতিবিম্ব।
যদি যান,
কাউতলী রেলব্রিজ পেরুলেই দেখবেন
মানুষের সাধ্যমত
ঘর-বাড়ি।
চাষা হাল বলদের গন্ধে থমথমে
হাওয়া। কিষাণের ললাটরেখার মতো নদী,
সবুজে বিস্তীর্ণ দুঃখের সাম্রাজ্য।
দেখবেন, লাউয়ের মাচায় ঝোলে
সিক্তনীল শাড়ির নিশেন।
শুঁটকির গন্ধে পরিতৃপ্ত মাছির আওয়াজ।
দেখবেন ভাদুগড়ের শেষ প্রান্তে
এক নির্জন বাড়ির উঠোনে ফুটে আছে
আমার মিথ্যা আশ্বাসে বিশ্বাসবতী
এক ম্লান দুঃখের করবী।
আধুনিক এবং আপন এক কাব্যশৈলীতে কবি গ্রামজনপদের বিশ্বস্ত দৃশ্যকল্প এঁকেছেন। লোকঐতিহ্যের এই রূপায়ণ তাঁর কবিতাকে গণমানুষের মানসলগ্ন করেছে।
লোকঐতিহ্যের ক্ষেত্রে আল মাহমুদ আরও একধাপ এগিয়েছেন কালের কলস কাব্যগ্রন্থে। আশৈশব ও আকৈশোর এই ঐতিহ্যে বেড়ে ওঠা কবি নাগরিক খাঁচায় আটকে পড়েন জাগতিক প্রয়োজনে। কিন্তু সেখানে ফেরার তৃষ্ণা রক্তে ও মনে জেগে ওঠে, সেখানেই আপন মুক্তির ঠিকানা হিসেবে নির্ণয় করেন। অবশেষে অনুতপ্ত হয়ে ফিরে আসেন নিজ আশ্রয়ে। ‘ফেরার পিপাসা’ ও ‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতাদ্বয়ে এই সুরই শোনা যায়।
নদীকেন্দ্রিক জনপদের ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তনের পিপাসা তাই ব্যক্ত হয়েছে কবির আকুতি নিয়ে।
ফিরে যেতে সাধ জাগে, যেন ফিরে যাওয়ার পিপাসা
জাগায় সুদূর স্মৃতি: মায়ের আঁচল ধরে টেনে
দেখায় দূরের নদী, ওইতো হাটের নাও মাগো
দখিনা বাতাসে দ্যাখ ভেসে গেল সমস্ত সোয়ারি;
লৌকিক জীবন ও সংস্কারের মধ্য দিয়ে এখানে ফিরে যাবার প্রবল ইচ্ছা প্রকাশিত। নৌকায় বাড়ি ফেরা, যাত্রাপথে প্রাকৃতিক বিপদের আশঙ্কা এবং গ্রামীণ নারীর স্বামীর কবরে মোম জ্বেলে প্রার্থনা, স্বপ্ন না দেখার জন্য রূপোর মাদুলি বাজুতে বেঁধে দেয়া ইত্যাদি প্রসঙ্গ একান্ত গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্তর্গত। কবি এই ঐতিহ্যচ্যুত হয়ে ঢাকার মতো মহানগরীতে বন্দি। দেয়ালে টাঙানো ফ্রেমে আবদ্ধ মায়ের ছবি কবির কাছে তাই মনে হয় বাংলার মানচিত্র। অর্থাত্ মা-ই হয়ে যান লোকবাংলার প্রতিকৃতি। সেই প্রতিকৃতির কাছে সশরীরে ফিরে যাবার তীব্র আকাঙ্ক্ষা এই কবিতায় প্রকাশিত।
‘প্রত্যাবর্তন’ কবিতায় কবির তৃষ্ণা ও ইচ্ছা গ্রামসমাজে ফিরে আসায় রূপান্তরিত। খাল-বিল-নদীময় নিজের জনপদ ছেড়ে যাওয়া পলাতক যুবকেরা আবার ফিরে এসে গতিমান মানুষের প্রতীক—মাছ-পাখি-নাও-নদী-মাটির পুতুল ইত্যাদির কাছে। আপন ঠিকানায় ফিরে এই ক’জন তরুণ প্রকৃতি ও জীবনে নতুন প্রাণের আয়োজন প্রত্যক্ষ করেন।
দ্যাখো, জয়নুলের ছবির মতো ঘরবাড়ি, নারী
উঠোনে ঝাড়ছে ধান, ধানের ধুলোয় ম্লান শাড়ি;
গতর উদোম করে হাতে লেপা মাটির চত্বরে
লাঞ্ছিত নিশেন হয়ে পড়ে আছে যেন অনাদরে।
কবি বহমান লোকঐতিহ্যে ফিরে তাকেই অবলম্বন ও আশ্রয় করতে চান। কৃষিনির্ভর লোকজীবনের উপাদানগুলোকে আবারও উজ্জীবিত করতে চান নিজেদের জন্য। আবার পূর্ব-পুরুষের উত্তরাধিকার আত্মস্থ করে জাতির লাঞ্ছিত পতাকার যথার্থ সম্মান অর্জনে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। অর্থাত্ কবি বিরাজমান গ্রামীণ ঐতিহ্যে প্রত্যাবর্তন ও ঐশ্বর্যময় হারানো ঐতিহ্য পুনরুদ্ধারে সংকল্পবদ্ধ। বাঙালির আত্মআবিষ্কারের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কালে (১৯৫২-৭১) কবির লোকঐতিহ্যে তথা স্বদেশ প্রত্যাবর্তন অত্যন্ত তাত্পর্যপূর্ণ।
লোকঐতিহ্য রূপায়ণের ক্ষেত্রে আল মাহমুদ সবচেয়ে বেশি সফলতা অর্জন করেন সোনালি কাবিনে। বিস্তৃত, গভীর ও অপরিহার্যভাবে তা ব্যবহৃত হয়েছে সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছসহ বিভিন্ন কবিতায়। সমগ্র কাব্যের মধ্যে তাই এই গ্রন্থের অনন্যতা ও স্বাদেশিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের আয়তনটি বৃহত্তম। তাঁর কাব্যাদর্শের সঙ্গে মিশে আছে লোকঐতিহ্যের নানা অনুষঙ্গ। গ্রামীণ জনপদের লৌকিক জীবনে কবি তাই ফিরে আসেন ‘খড়ের গম্বুজ’ কবিতায়।
কে জানে ফিরলো কেনো, তাকে দেখে কিষাণেরা অবাক সবাই
তাড়াতাড়ি নিড়ানির স্তূপাকার জঞ্জাল সরিয়ে
শস্যের শিল্পীরা এসে আলের ওপরে কড়া তামাক সাজালো।
একগাদা বিচালি বিছিয়ে দিতে দিতে
কে যেনো ডাকলো তাকে; সস্নেহে বললো, বসে যাও,
লজ্জার কি আছে বাপু, তুমি তো গাঁয়েরই ছেলে বটে,
আমাদেরই লোক তুমি।
আবহমানকালের কৃষি ব্যবস্থার ধারক যে কৃষক সমাজ, তারাই উত্পাদন করে মানুষের মৌলিক চাহিদা। এ দেশে লোকঐতিহ্যের স্রষ্টা, লালনকর্তা ও উত্তরাধিকারীদের মধ্যে তারাই প্রধান। এই লোকসমাজে বেড়ে ওঠা কোনো মানুষ নাগরিক সংস্কৃতিতে বেমানান হতে বাধ্য। এই কবিতায় এমন এক তরুণের কথা উচ্চারিত, যে পৌরসংস্কৃতির জগতে গিয়ে আপন ঐতিহ্যচ্যুত হয়েছে। তবে শেকড়ের টানে যখন ভিন্নরূপে পিতৃপুরুষের সমাজে ফিরেছে, তখন সে আর সহজে তাদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হতে পারছে না। ‘শস্যের শিল্পীরা’ তাই তাকে সস্নেহে কাছে ডেকে পূর্বপুরুষের ঐতিহ্য লোকসঙ্গীত, মারফতির সুর স্মরণ করিয়ে দিয়েছে; আবার জবাবদিহি চেয়েছে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিণতির। অর্থাত্ তিনি বিপরীতধর্মী দুই ঐতিহ্যের দ্বন্দ্বকে সামনে এনে লোকজতাকে গ্রহণ করেন অন্তর দিয়ে।
আল মাহমুদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাব্যকৃতি সোনালি কাবিন কাব্যের সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ। কবিতাগুলো লৌকিক জীবনের চিরায়ত সুখ-দুঃখের জমিনের উপর স্থাপিত। কাব্যভাষায় ও বাক্যবন্ধে গ্রামীণ জীবনের নানান সৌরভ; বিবাহ অনুষ্ঠানের বিভিন্ন ব্রত বা জরঃঁধষ আবহমান বাংলার লোকসংস্কারের স্মৃতিকে স্মরণ করিয়ে দেয়; সঙ্গে সঙ্গে বাংলার লৌকিক ও নৃতাত্ত্বিক প্রসঙ্গের মাঝে যুক্ত করে। আল মাহমুদের কবিতায় বাংলার লোককাহিনীর প্রয়োগ হয়েছে নানাভাবে। লোককথার মধ্য দিয়ে যে সর্বজনীন আবেদনই প্রকাশ পাক না কেন, এর সম্পর্কে এ কথাও সত্য, এর মধ্য দিয়ে জাতির বিশিষ্ট চরিত্রের রূপটিও প্রকাশ পায় আর লোককাহিনীগুলোর মধ্যে ‘বিশ্বব্যাপী যোগসূত্র’ বজায় থাকে। লোককাহিনী বা লোককথার যেমন কোনো জাতি নেই, অর্থাত্ বিশেষ জাতির লোককথা বলে যেমন কোনো রচনা চিহ্নিত করা যায় না, তেমনই লোককথার কোনো ধর্মও নাই, অর্থাত্ বিশেষ কোনো লোককথা বিশেষ কোনো ধর্মাবলম্বীর সৃষ্টি কিংবা তার নিজস্ব সম্পত্তি একথা বলার উপায় নেই। ফ্রেজারের ঞযব এড়ষফবহ ইড়ঁময-এ বর্ণিত আদিবাসী জীবনের চিত্র চকিতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। বাংলার লোককাহিনীর সারাত্সার নিয়ে কবি আল মাহমুদ দ্রোহী মনোভাব সৃষ্টি করেন, যা সমকালীন প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ।
অঘোর ঘুমের মধ্যে ছুঁয়ে গেছে মনসার কাল
লোহার বাসরে সতী কোন ফাঁকে ঢুকেছে নাগিনী,
আর কোনদিন বলো দেখবো কি নতুন সকাল?
উষ্ণতার অধীশ্বর যে গোলক ওঠে প্রতিদিনই।
বিষের আতপে নীল প্রাণাধার করে থরো থরো
আমারে উঠিয়ে নাও হে বেহুলা, শরীরে তোমার [সোনালি কাবিন: ৮]
বেহুলা-লক্ষিন্দরের কাহিনীকে আধুনিক মনোভাব ও ভঙ্গিতে রূপান্তরের অনন্য দৃষ্টান্ত্ত এই সনেট। ‘মনসা মঙ্গল’ কাব্যের দেবীস্তুতির বিপরীতে দ্রোহীচেতনাকে প্রকাশ করেন এখানে। ‘জীবনের স্পর্ধা’ মৃত্যুর বিস্তার ও শক্তিকে লঙ্ঘন করে চিরায়ত ‘বাঁচার নিয়ম’-এ পরিবর্তন আনবে মানুষী বেহুলা—এই প্রত্যাশা কবির। বাংলার অতি পরিচিত একটি লোককাহিনীর অন্তসারকে সমকালীন দেশ ও কালের প্রেক্ষিতে স্থাপনের মাধ্যমে কবি একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাদী ও আধুনিক শিল্পরীতির পরিচয় দিয়েছেন।
আল মাহমুদ ‘সোনালি কাবিন : ৮’-এ বাংলার অপাপবিদ্ধ গ্রামীণ কুমারী এবং এক কুমারের মিলনের অভিপ্রায় ও মধুরতাকে অসাধারণ ভাব-ব্যঞ্জনায় প্রকাশ করেছেন। গ্রামের সাধারণ যুবক ও যুবতী তাদের কামনাকে যেসব উপমায় প্রত্যক্ষ করে, তিনি সেইসব উপমা ব্যবহার করেন। এক্ষেত্রে আল মাহমুদের ভঙ্গি জীবনানন্দ দাশের চেয়ে অনেক বেশি বাস্তব ও আকর্ষণীয়। গ্রামের সাধারণ জীবন, জীবনের মমতার আশ্রয়-আকুলতা-উদ্ভাসন এবং নতুন এক জীবনের দুয়ার উন্মোচনকে তিনি অসাধারণ ভাষায় প্রকাশ করেন।
শুভ এই ধানদূর্বা শিরোধার্য করে মহীয়সী
আবরু আলগা করে বাঁধো ফের চুলের স্তবক,
চৌকাঠ ধরেছে এসে ননদীরা তোমার বয়সী
সমানত হয়ে শোনো সংসারের প্রথম সবক
বধূবরণের নামে দাঁড়িয়েছে মহামাতৃকূল
গাঙের ঢেউয়ের মতো বলো কন্যা কবুল, কবুল।
এই দৃশ্যটি একজন নারীর জন্য সলজ্জ, আন্তরিক ও মমতার; যা লোকজ বাংলার গ্রামীণ জীবনের একটি মধুর অভিপ্রায়কে ব্যক্ত করেছে। একটি যুবতী যৌবনের অধিকার পেতে চলেছে এবং বিবাহের মধ্য দিয়ে সংসারে প্রথম সবক নিচ্ছে। এই দৃশ্যটাকে কবি আমাদের সামনে এমনভাবে উপস্থিত করেছেন, যেন একই সঙ্গে মানুষের পরিচয়, আবার মুসলমান জীবনের পরিচয়ও পাওয়া যায়। ‘মঙ্গলকুলোয় ধান্য’, ‘বিন্নির খই’, ‘বিছানায় আতর, ‘অগুরু’, ‘ধানদূর্বা’, ‘কবুল, কবুল’ শব্দবন্ধে কবি আবহমান গ্রামীণ বাংলার জরঃঁধষ বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান-রীতিকে প্রকাশ করেন।
‘সোনালি কাবিন: ১৪’ কবিতায় কবি কিছু সাক্ষ্য উপস্থাপন করেছেন। এ সাক্ষ্যগুলো একান্তভাবে গ্রামীণ বাংলার লোকঐতিহ্য থেকে গৃহীত। তিনি বৃষ্টি, তিলবর্ণ, মাছ-মাংস, হালাল পশু, লাঙল, জোয়াল, কাস্তে ও বায়ুভরা পালের অর্থাত্ লৌকিক জীবনের প্রতীকগুলোকে সাক্ষ্য মেনেছেন। গ্রামীণ বৃষ্টি ও ধানক্ষেতের ঐশ্বর্যের মধ্যে, ক্ষেতে লাঙল-জোয়াল এবং নদীতে পালতোলা নৌকায় একটা শান্ত বরাভয়ের চিত্র পাওয়া যায়; যেখানে অলঙ্কার ও বিত্ত নেই, কিন্তু অনুভূতি, কর্ম ও আনন্দের ঐশ্বর্য আছে। এক কথায়, কবি নাগরিক বৃত্তের বাইরে প্রকৃতির অধিকারের মধ্যে একটি গ্রামকে পেয়েছেন, যে গ্রামে প্রাণের অঙ্গীকার আছে। পূর্বপুরুষের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার লোকঐতিহ্যের প্রকাশ আছে কাব্যিক অভিব্যক্তিতে।
বৃষ্টির দোহাই বিবি, তিলবর্ণ ধানের দোহাই
দোহাই মাছ-মাংস দুগ্ধবতী হালাল পশুর,
লাঙল জোয়াল কাস্তে বায়ুভরা পালের দোহাই
হৃদয়ের ধর্ম নিয়ে কোন কবি করে না কসুর।
কবি লোকজীবনের প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহ বাংলার গ্রামীণ পটভূমি থেকে সংগ্রহ করেন। প্রিয়তমার উদ্দেশে উচ্চারিত এই প্রতীক বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতিকে প্রতিনিধিত্ব করে। আর লোকজ শব্দপুঞ্জের নিপুণ বুনন ও সজ্জা লোকঐতিহ্যের প্রকাশে অপরিহার্য দাবি পূরণ করেছে।
‘সোনালি কাবিন’ সনেটগুচ্ছে বাঙালির ধারাবাহিক ইতিহাস রেখা, জীবন সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সূত্র, পলিময় বাংলার প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে। কাব্য পরম্পরায় লক্ষ্য করা যায় তাঁর জীবনঘনিষ্ঠ লোকজ সংস্কৃতি ও আবহমান বাংলার রূপকলার সঙ্গে কবি ধর্ম ও ঐতিহ্যকে রক্তধারার মতোই ব্যবহার করেছেন। আবার সেই চলমান জীবনেই খুঁজে নিয়েছেন আত্মআবিষ্কারের সারাত্সার। সেখানেই তিনি ফিরে যান প্রতিনিয়ত। এই জীবনের সারাত্সার তাঁর জীবনযাপনের অভিজ্ঞতাস্রোত। একটা জাতির সাংস্কৃতিক স্থিতি নির্ভর করে তার ঐতিহ্য পরম্পরায়; তার আন্তঃসাংস্কৃতিক প্রবাহের অন্তর্নিহিত স্রোতোধারার আশ্রয়ে গড়ে ওঠে সে জাতির অভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রত্যয়। আল মাহমুদের ‘সোনালি কাবিন’এর সনেটগুচ্ছ অভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রত্যয়ের দ্যোতক।
লোকঐতিহ্যের এসব রূপায়ণ ছাড়াও অসংখ্য লোক উপাদানের মিশ্রণ হয়েছে সোনালি কাবিনে। বিশেষভাবে লোকজ শব্দ এই কাব্যে একটা বড় জায়গাজুড়ে আছে, সেগুলো লোকঐতিহ্যের স্মারক। যেমন : দিনার, দেনমোহর, কাবিন, পানোখী, ছলকে, শোলক, খোঁয়াড়, কাতরা, কানেট, ছিনাল, দরদ, মরদ, দেখনহাসি, কবুল, বিবি, হালাল, কসুর, খেলাপ, জবান, নাপাক ইত্যাদি। বিদগ্ধ সমালোচক শিবনারায়ণ রায়ের মতে : আঞ্চলিক ভাষা, অভিজ্ঞতা, রূপাবলীকে তিনি নাগরিক চেতনায় সন্নিবিষ্ট করে প্রাকৃত অথচ ব্যঞ্জনাসমৃদ্ধ এক কাব্যজগত্ গড়ে তুলেছেন। জসীমউদ্দীন এবং জীবনানন্দ—উভয় থেকেই তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারও প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাঁকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। অর্থাত্ লোকঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদানের আধুনিক উপস্থাপনা তাকে এই ধারার অগ্রজ কবিদের থেকে স্বতন্ত্র করেছে।
সোনালি কাবিনের পরবর্তী বাঁকফেরা ও গন্তব্যের পথেও বাংলার লোকঐতিহ্যকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করেছেন আল মাহমুদ। বড় কবি হয়ে ওঠার পেছনে তাঁর লোকঐতিহ্যের স্বাতন্ত্রিক রূপায়ণ অনেকাংশে দায়ী। কারণ, সমকালীন উপনিবেশবাদী বাংলা সাহিত্যে স্বাধীন ও মুক্ত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য অর্থাত্ লোকঐতিহ্য নির্মাণে তাঁর কাব্যকৃতি অনন্যতায় ভাস্বর।

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ