প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Saturday, February 5, 2011

ট্র্যাজেডি যখন কমেডি by আবুল হায়াত

আজ একটু রসাল আলাপ করতে চাই।
না না, ঠিক রসাল নয়, বলতে চাইছিলাম, ‘রস’ নিয়ে আলাপ করতে চাইছি। রস শব্দটার প্রকৃত অর্থ বোধ করি স্বাদ। সেটা খাদ্যের ক্ষেত্রেও হতে পারে, আবার হতে পারে আমোদ-প্রমোদের ব্যাপারেও।

আমরা যারা অভিনয় পেশার সঙ্গে জড়িত, তাদের কাছেও রস একটি জরুরি বিষয়। নাটক, সিনেমা ইত্যাদিতে রস সৃষ্টি করা অভিনয়শিল্পীর অন্যতম দায়িত্ব। অন্যভাবে বললে নাট্যকার তাঁর লেখায় যে রস সংশ্লিষ্ট করেছেন, তাকে যথাযথ রূপদান করে দর্শক-সমক্ষে উপস্থাপন করতে হবে অভিনয়শিল্পীকে।
গল্প, কবিতা, উপন্যাস, নাটকে লেখক বিভিন্ন রস সৃষ্টি করে তার বর্ণনা-বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করেন। সাহিত্যে এই রসের নয় রকম প্রকারভেদ আছে। শৃঙ্গার (আদি) রস, বীর রস, করুণ রস, অদ্ভুত রস, রৌদ্ররস, ভয়ানক রস, হাস্যরস, বীভৎস রস, শান্ত রস। এই রসগুলোই সাহিত্যের পাতা থেকে চয়ন করে আনি আমরা মঞ্চে, টিভিতে, সিনেমার পর্দায়, রেডিওতে এবং কোথায় নয়!

তবে আমরা বলতে পারি, সাহিত্যিক রসের সন্ধান পান বাস্তব জীবন থেকে। জীবনের রস নিংড়েই তো সাহিত্য সৃষ্টি হয়। যিনি যত গভীরভাবে জীবনকে পর্যবেক্ষণ করবেন, তিনি তত চমৎকার রসোত্তীর্ণ সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারবেন। অভিনেতার ক্ষেত্রে সেটাই প্রযোজ্য। তিনি যত পর্যবেক্ষণ করবেন, অর্থাৎ জীবন-ঘনিষ্ঠ মানুষ হবেন, ততই তাঁর পক্ষে যথার্থভাবে সাহিত্যের রসকে অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের কাছে পৌঁছানো সম্ভব।
এত সব রসের কথা বাদ দিয়ে আমরা এখন কথা বলব শুধু দুটো রস নিয়ে—করুণ রস ও হাস্যরস। আমরা আজ প্রকৃতপক্ষে এ দুটো রসের মধ্যেই ভেসে রয়েছি, নাকি রয়েছি ডুবে। যেটাই হোক, আমাদের জীবনে এ দুটো রসের আধিক্য লক্ষিত হচ্ছে সর্বক্ষেত্রে। অন্যান্য রস লুকিয়ে গেছে এ দুটোর অভ্যন্তরে। মাঝেমধ্যে বীর রস, রৌদ্ররসের সাক্ষাৎও পাচ্ছি বটে, তবে তার ফল হচ্ছে ওই—করুণ রস, কখনো বা হাস্যরস।
সে কথায় পরে আসি।

কেন জানি না, ওই দুই রসই প্রাধান্য পেয়েছে আমাদের নাটক-সিনেমাজগতেও। আমরা যখন নাটক নির্মাণের কোনো প্রস্তাব প্রযোজকের কাছে উত্থাপন করি, প্রথম প্রশ্নটাই হলো: ‘ট্র্যাজেডি, না কমেডি?’
অর্থাৎ করুণ রসের, নাকি হাস্যরসের নাটক? বিয়োগান্তক, নাকি হাস্যরসাত্মক?
তাহলে দেখছি, অন্য সব রস পুঁথিপত্রেই আটকে আছে। জীবনের প্রবাহে ব্যবহূত হচ্ছে দুটো মাত্র রস—করুণ ও হাস্যরস। এ বিষয়টিও কিন্তু করুণ রসেরই বহিঃপ্রকাশ।

থিয়েটারে আমরা করুণ রসের বহিঃপ্রকাশ শিখেছিলাম। কী রকম জানেন? পরিচালক বলেন, ক্লোজ ইয়োরসেলফ, অর্থাৎ নিজেকে লুকাও। তুমি পরাজিত, অপমানিত, লজ্জিত, নির্যাতিত ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে লুকাও অর্থাৎ চোখ নামাও, মাথা নত করো, শরীর ভেঙে ঝুঁকে পড়ো, ঝুলিয়ে দাও হাত, ধীরগতিতে চলো ইত্যাদি। আবার হাস্যরসের ক্ষেত্রে (রৌদ্র কিংবা বীর রসেও চলে) ওপেন ইয়োরসেলফ, অর্থাৎ চোখ ওঠাও, উঁচু করো মাথা, উদ্ধত বক্ষে দাঁড়াও, হাত-পা ছড়াও, চলাফেরা করো দাপিয়ে ইত্যাদি। এতে বোঝা যাবে, তুমি আনন্দিত, উল্লসিত, বিজয়ী ইত্যাদি। চার্লি চ্যাপলিনের নির্বাক সিনেমায় এগুলোর ব্যবহার আমরা সবাই দেখেছি।

এসব হচ্ছে অভিনয়ের ব্যাকরণ বইয়ের কথা। বাস্তবেও কিন্তু এসবই দেখছি। একই মুদ্রার দুই পিঠ যেমন দুই রকম দেখতে, তেমনি একই ঘটনার মধ্যেই দুটো রস ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। একই ঘটনায় কেউ মাথা নিচু করে চলে, কেউ চলে দাপিয়ে, উদ্ধত ভঙ্গিতে।

ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম তো আপনারা সবাই জানেন। উপমহাদেশের একজন প্রখ্যাত অভিনেতা। হাস্যরসাত্মক চরিত্রে অভিনয় করে জনপ্রিয় হয়েছিলেন তিনি। বাড়ি ছিল আমাদের বাংলাদেশেরই বিক্রমপুরে। তাঁকে একবার সেই ১৯৭৪ কি ’৭৫ সালে দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। তৎকালীন হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমান শেরাটন) এক পুরস্কার (সিকোয়েন্স অ্যাওয়ার্ড অব মেরিট) বিতরণ অনুষ্ঠানে বক্তৃতা দিয়েছিলেন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়।

আমার এখনো মনে পড়ে, যতক্ষণ তিনি কথা বললেন, সব দর্শক কিছুতেই পারেনি হাসি থামাতে। হাস্যরসের উৎপত্তি নিয়ে দুটো কথা বলেছিলেন তিনি: কমেডি বা হাস্যরসাত্মক ঘটনার সৃষ্টি হয় ট্র্যাজেডি বা করুণ (বিয়োগান্তক) ঘটনা থেকে। তার উদাহরণও তিনি দিয়েছিলেন এভাবে—মনে করুন, একজন বয়স্ক মানুষ কলার খোসায় পা পিছলে আছাড় খেলেন। এটা একটা ট্র্যাজেডি, কিন্তু আপনি দেখে হেসে ফেললেন। কারণ, আপনার কাছে এটা কমেডি। হাসির খোরাক। আবার ওই বয়স্ক ভদ্রলোক যদি আপনার বাবা হন, তাহলে আপনি হাসবেন না, দুঃখ পাবেন। কারণ এটা তখন আপনার জন্য ট্র্যাজেডি।

তাহলে আমরা দেখছি যে কমেডি থেকে ট্র্যাজেডি, ট্র্যাজেডি থেকে কমেডির উদ্ভব হচ্ছে।
বোঝা গেল না?
ঠিক আছে, একটা উদাহরণ দিই।

ধরুন, আপনার এলাকায় বন্যা হয়েছে। বন্যার পানিতে আপনি সর্বস্বান্ত, এটা একটা ট্র্যাজেডি। কিন্তু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, বন্যা হয়নি, সামান্য পানি বেড়েছে মাত্র। এটা হলো কমেডি।
এতেও পরিষ্কার হলো না? তাহলে আরেকটু খোলাসা করি।

ধরুন, আপনার নামে লাইসেন্স করা একটা আগ্নেয়াস্ত্র আছে। তা দিয়ে একজন মানুষ খুন হয়ে গেল। এটা হলো ট্র্যাজেডি। আর পুলিশ আপনাকে গ্রেপ্তার না করে সঙ্গে সঙ্গে মিডিয়ায় ঘোষণা করে দিল, এটা নিছক দুর্ঘটনা—এটা কমেডি।
আবুল হায়াত: নাট্যব্যক্তিত্ব।
[সূত্রঃ প্রথম আলো, ২৪/০৯/১০]

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ