আমার দেশ-এর নির্ভীক সাহসী সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের অনুরোধে তার পত্রিকায় লেখা দেয়ার কথা ক’দিন থেকেই ভাবছিলাম। কী লিখি কী লিখি ভাবতে ভাবতে আমার পিতৃপ্রতিম বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর ২০ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠে চতুরঙ্গ পাতায় ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ লেখাটি দিয়েই আমার দেশ-এ লেখার সূচনা করছি। পরম করুণাময় আল্লাহ যেন আমার সহায় হোন।
গত ২০ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠে চতুরঙ্গ পাতায় ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ শিরোনামে একটি মহামূল্যবান লেখা বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাকে উপহার দিয়েছেন। নটী বিনোদিনী নাটকে একদিন এক দর্শক গিরিশ ঘোষের অভিনয় দেখে মঞ্চে জুতা ছুড়ে মেরেছিল। তিনি তা মাথায় তুলে তার নাট্যাভিনয়ের সার্থকতা খুঁজেছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবও তার নটী বিনোদিনী দেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর এ লেখা আমার কাছে গিরিশ ঘোষের মঞ্চে ছুড়ে দেয়া দর্শকের আশীর্বাদের মতোই মনে হয়েছে। লেখাটার শিরোনাম দিতে চেয়েছিলাম ‘সে যে আমার বড় ভাই’, সাহস পেলাম না। কারণ তিনি আমার শব্দে শব্দে দাড়ি-কমায় ভুল ধরতে পারেন। তাই নির্বাসনের সময় শোনা মান্না দে’র কণ্ঠে ‘সে যে আমার ছোট বোন’—বুকের ভেতর তোলপাড় করা গানটির অনুকরণেই বলতে চেয়েছিলাম ‘সে যে আমার বড় ভাই’। কিন্তু তিনি যদি ব্যাকরণগত ভুল ধরেন, যদি আবার বলে বসেন, ‘দেখেছেন ছেলেটা কত বেয়াদব। বড় ভাইকে তিনি না বলে সে বলেছে।’ তাই শিরোনাম দিলাম ‘তিনি আমার বড় ভাই’ যদিও লয়-তালে জোর হলো না। কিন্তু সত্যিই তিনি বড় ভাই, পিতার সমান। তার এ লেখা পড়েও মনে হলো তিনি আমাকে শক্তপোক্ত করতেই অমন গালাগাল করেছেন, মোটেই দুর্বল করতে নয়। আরও সবল, সাহসী ও যোগ্য করতেই হয়তো এ লেখা লিখেছেন। লেখাটি পড়ে আমার স্ত্রী কেঁদেছে। ছেলেমেয়েদের মন খারাপ হয়েছে। দু’দিন ধরে শাহানা-দুলাল ছটফট করছে, ওরা ভাবছে পরিবারের মধ্যে নিজেরা একজন আরেকজন সম্পর্কে এমন বললে কেমন হয়? আমার কিন্তু তেমন মনে হয়নি। ২০-২১ তারিখ দুটো লেখা তৈরি করছিলাম, তাই বড় ভাই’র ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ পড়িনি। ২২ তারিখ লেখাটি পড়ে মোটামুটি ২০টি ভাগে ভাগ করে লেখার অন্তর বা মর্মবাণী খুঁজতে চেষ্টা করছি। আমার এ লেখা লতিফ ভাই’র লেখার অস্বীকৃতি নয়, শুধু কিছু ভাবনা। আর ওনার ৭৩-এর ওপর বয়স। তাই যদি আগে-পিছে কিছু ভুলে গিয়ে থাকেন তা অনুগত সন্তানের মতো ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা মাত্র। বড় ভাই তো বড় ভাই-ই। তিনি কোনোদিন আমার থেকে ছোট হবেন না। বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা, যশ-খ্যাতি সবই তার বেশি। আমার ছায়ায় তিনি থাকুন এটা কখনও চাইনি। তার ছায়ায় নিরাপদে থাকি, এটাই আজীবন কামনা করেছি। ছায়া যদি না পেয়ে থাকি সেটা তার নয়, সব দোষই আমার। সব ছায়ারই তো একটা সীমা থাকে। আমি পৌঁছার আগেই যদি তার ছায়ার সীমা ভরে গিয়ে থাকে, সেখানে তার কী করার থাকতে পারে? সেটা তো আমারই ব্যর্থতা।
’৬৬-৬৭তে ছাত্রনেতা হিসেবে লতিফ সিদ্দিকী কুমিল্লা শহরে একদিন আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর সামনে বক্তৃতা করে সারা জেলা মাতিয়ে এসেছিলেন। সেদিন আমার বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। সম্ভবত একই বছর ভৈরব কলেজে ছাত্রদের নবীনবরণে লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন প্রধান অতিথি। আর আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ছিলেন সাধারণ বক্তা। সে সময় লতিফ সিদ্দিকীর ভাই হিসেবে যেমন গর্ব করতাম, আজও তেমনি গর্ববোধ করি। লন্ডনে তার এবং সাজেদা চৌধুরীর উপস্থিতিতে যেদিন আমাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল, সেদিন আজকের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন সাধারণ শ্রোতা। তাকে মঞ্চে এনে বক্তৃতা করার সুযোগ সেদিন এই নালায়েক আমিই করে দিয়েছিলাম। সেই সময় আমার বাবা ছিলেন, মা ছিলেন। আজ তারা কেউ নেই, আমি এতিম। মুরুব্বি হিসেবে মাথার ওপর একমাত্র বড় ভাই আছেন, তাকে কী বলি। পিতা সন্তানকে শাসন করে, সে তো তার ভালোর জন্যই। তিনিও হয়তো তাই করেছেন। এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে বা লিখতে চাইনি। কিন্তু চারদিক থেকে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে—আপনাকে এসবের জবাব দিতেই হবে। কী জবাব দেব, সবকিছুর কি জবাব থাকে? সব ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে আমি কী বলব? আর সত্য না হলেও আমার কোনো মুরুব্বি যদি অসত্যও বলে থাকেন, প্রতিবাদ করে তার সম্মান নষ্ট করব? তা তো করতে পারি না। সেদিন বিকালে এক পত্রিকা অফিসে আমার ছেলেবেলার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বসতে না বসতেই সে বলে বসল, ‘আরজু ভাই বাচ্চাকাল থেকেই তোকে দেখতে পারে না, তোর ওপর জুলুম করে। হুকুম চালায়, মারধর করে। খেলার মাঠ থেকে তোর কান ধরে নিয়ে যেত। এখনও তেমন করছে। তোর এর জবাব দেয়া উচিত।’ বললাম, ‘বন্ধু কী জবাব দেব? খালি তুই তোর আরজু ভাই মানে লতিফ সিদ্দিকীর আমাকে বকাঝকা, বন্ধুদের সামনে কান ধরে নেয়ার অপমানই দেখলি? আমার অসুখ হলে মাথায় পানি দিতে, হাত-পা টিপতে দেখলি না? বড় ভাই পিতার সমান। তিনি আমার মাথা-বুক-পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কখন পা কোলে নিয়ে পরম যত্নে আমার যন্ত্রণা কমাতে চেষ্টা করতেন তা কি দেখেছিস? তিনি একটু জেদি মানুষ, আইয়ুব- মোনোয়েমের সময় সারা জেলা তার নামে পাগল ছিল। দেশে চার-পাঁচজন ছাত্রনেতার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কিন্তু কী এমন নয় মাসের যুদ্ধ হলো, যুদ্ধ শেষে বজ্রকে লতিফ সিদ্দিকীর ভাই না বলে লতিফ সিদ্দিকীকে যদি কাদের সিদ্দিকীর ভাই বলে তাহলে তো তার রাগ হওয়ারই কথা। তাই রাগ হয়ে ক্ষোভে বা কোনো হতাশায় যদি দু’কথা লিখেই থাকেন তবুও তো তিনি আমার বড় ভাই।’ তবু সে বলল, ‘না, তোর সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা তাতে তার লেখাটার প্রতিটি শব্দের জবাব দেয়া দরকার। ধরে নে, আরজু ভাই মাস্টার হয়ে তোকে প্রশ্ন করেছে, তুই প্রশ্নের জবাব দে।’ আজ ক’দিন ধরে এমনি কথা আরও অনেকেই বলছেন। তাই ভাবলাম, সত্যিই তো যে অভিযোগ-অনুযোগ আমার নামে উল্লেখ করেছেন, এটাই যদি অন্যের নামে হতো এবং আমাকে মতামত বা উত্তরের জন্য তিনি পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে গুরুজনের নির্দেশ পালনে উত্তর তো কিছু দিতেই হতো। ঠিক সেরকমই এই বিশটা প্রশ্নের উত্তর লিখে খাতাটা তার কাছে জমা দেই, দেখি তিনি কত নাম্বার দেন। সারা জীবনই তো ফেল না করলেও তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না কোনোদিন। তাই সুযোগ যখন এসেছে বদর বদর বলে পরীক্ষাটা তো দিয়ে দেই। ফেল করি করলাম। কিন্তু কোনো রকমে যদি পাস করে ফেলি তখন কতই না ভালো হবে। নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনে ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে শুধু গালি আর গালি ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই পেলাম না। তাই বড় ভাই, ক্ষমা করবেন।
এক. ‘অবশেষে বঙ্গবীর খোলসমুক্ত হলেন। ঘোষণা দিলেন, জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক, শেখ মুজিব নয়। যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি?’ পত্রিকার এক কলামের চার লাইন। মূল জিজ্ঞাস্য মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক, শেখ মুজিব নয়।
(ক) আমি কখনও বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব বলি না। তিনি আমার পিতা, নেতা ও ভালোবাসা। আপনি যদি পত্রিকায় এ ধরনের দেখে থাকেন তাহলে ওটা পত্রিকার কৃতিত্ব। পত্রিকার লেখকের কৃতিত্ব, আমার নয়। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।
(খ) জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক—ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতার জনক। এই তিনটি বিশেষণের পর বঙ্গবন্ধুকে আমি কোনোক্রমেই স্বাধীনতার ঘোষক মনে করি না বা করতে পারি না।
ঘোষকের চাইতে স্বাধীনতার মর্যাদা, বাংলাদেশের মর্যাদা, স্বাধীনতার জনকের মর্যাদা অনেক বেশি। আমি যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জনক মনে করি, তেমনি স্বাধীনতার জনকও মনে করি। তাহলে এখানে স্বাধীনতার ঘোষক কে? বাংলাদেশের একজন জনক থাকলে যদি একজন ঘোষকের দরকার হয় তাহলে খুঁজে দেখি স্বাধীনতার ঘোষক কে? বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা কমবেশি সবার জানা। কেউ কেউ বলছে সেই সময় ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চিটাগাং পাঠানো হয়েছিল, কেউ বলছে নৌবাহিনীর কোনো বেতারে সে ঘোষণা ধরা পড়েছে। আমি নিজেও ‘স্বাধীনতা ৭১’-এ লিখেছি, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আমরা কাগমারী ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে পেয়েছিলাম যা টাঙ্গাইল জেলা সংগ্রাম পরিষদের হাতে দেয়া হয়েছিল। সেই ঘোষণাটি কার? অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তাহলে তিনিই ঘোষক। আলহামদুলিল্লাহ। তবে ওই ঘোষণা তো অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর, কিন্তু তিনি ঘোষক নন। বঙ্গবন্ধুকে কেউ ঘোষক বলে না, মনেও করে না। সবাই জনক মনে করে। ওই ঘোষণার জন্য আমি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার জনক মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণাটি যদি আমি পাঠ করতাম বা করতে পারতাম এবং জাতি স্বীকৃতি দিত যে আমি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছি, তাহলে আমিই হতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক অথবা ঘোষক। কোনো চলচ্চিত্র বা নাটকে যে প্রধান পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করে, সে হয় নায়ক। মহিলা প্রধান চরিত্রে যে অভিনয় করে সে হয় নায়িকা। কিন্তু নায়ক-নায়িকা কেউ কাহিনীটি তৈরি করে না। কাহিনীটি তৈরি করে একজন দক্ষ কাহিনীকার বা লেখক। নায়ক-নায়িকা শুধু অভিনয় করে। আমিও এক্ষেত্রে মনে করি, আমরা ছিলাম অভিনেতা-অভিনেত্রী। দক্ষ কাহিনীকার, প্রযোজক, পরিচালক সবই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এখন আসুন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদৌ ঘোষক কিনা। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার নির্দেশের পর আমরা বহু জন আমাদের যার যার অবস্থানে থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও যে দেননি তাও নয়। জিয়াউর রহমানের আগে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন বেতার কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তার মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, এমআর সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে। তখন ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহের সময়। তাই অনেক কষ্ট করে জিয়াউর রহমানকে এনে তাকে দিয়েও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে ঘোষণার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো রেকর্ডও নেই। কিন্তু যেটার অস্তিত্ব আছে এবং যেটার অস্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ছিল সেটা কী? সেটা হলো— ‘I Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman.’ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধের সময় সেটা বার বার বাজানো হয়েছে। শুধু যুদ্ধের সময় নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে ৭ মার্চের ভাষণ যেমন বাজানো হয়েছে, তীর হারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে; তেমনি এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্রে ‘কাদেরিয়া বাহিনীর গাবুর মাইর’ এবং মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে তার ওই ঘোষণায় যদি তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়, আমি ফেরাব কী করে? তাহলে কি আওয়ামী লীগাররা চান রাষ্ট্রের জনকের পদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রের ঘোষকের পদে নামিয়ে আনতে? পৃথিবীর সর্বত্র সব ঘটনার ঘোষক থাকে। আমার তো মনে হয় ঘোষকের চাইতে ঘোষণার মালিক অনেক বড়। জিয়ার কণ্ঠে, ‘I Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman" কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষণাটি হলে কেমন হতো, 'I Seikh Mujibur Rahman do hereby declare indepedence of Bangladesh on behalf of our great Major Ziaur Rahman.' ধরে নিলাম মেজর জিয়াউর রহমানের নামে বিষ। মেজর জিয়ার নাম বলা হলো না। বলার দরকারও ছিল না। তারপরও একটা কিছু তো বলতে হতো, সেটা কী হতো— 'I Seikh Mujibur Rahman do hereby declare indepedence of Bangladesh.' কোথাও কি তার কণ্ঠে এমন কথা আছে? বঙ্গবন্ধুর হাজারো বক্তৃতা-বিবৃতি আছে, তার কণ্ঠে হাজারো ঘোষণা আছে। কিন্তু ওরকম বাংলা-ইংরেজিতে কোনো কিছু আছে কি? নেই। বলা যেতে পারে, লিখিত ঘোষণা তো আছে, ৭ মার্চের ভাষণ আছে। কোটি কোটি বার সেটা স্বীকার করি। তাই বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণার মালিক। ওটি যদি তিনি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করতেন তাহলেও হয়তো আভিধানিক অর্থে তাকে ঘোষকও বলা যেত; কিন্তু তিনি তা না করায় তার ওই নির্দেশ, হুকুম বা ঘোষণা যিনি পাঠ করেছেন আভিধানিক অর্থে তিনিই ঘোষক। এরপরও যদি মুক্তিযুদ্ধের সময়ই কোনো আদেশের দ্বারা বলা হতো যে যেভাবেই যত ঘোষণাই দিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। সেখানেই ল্যাঠা চুকে যেত। আজ এতদিন পর রাজনৈতিক কারণে স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাধীনতার জনককে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে গিয়ে তাকে বড় বেশি ছোট করার চেষ্টা চলছে। আমার এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে যে ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত হয়েছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে শুনেছি, তাতে যদি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক হয়, তারা লাভবান হয়, আমার কিছু করার নেই। আমি যা শুনেছি তা অস্বীকার করতে পারব না; যারা আওয়ামী লীগ করেন, তারা অস্বীকার করতেই পারেন। যেমন অধ্যাপক ইউনূসের বদলে সন্তু লারমা আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত্ এ কথা বলে প্রধানমন্ত্রীকে সন্তু লারমার সমান করেছেন। আমি ছেলেবেলায়ই কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় করতাম না, আর এই বয়সে কোনো ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এ নিয়ে আল্লাহর কাছে গোনাহগার হতে রাজি নই। জনাব বীর উত্তম জিয়ার ভক্তরা এবার বঙ্গবন্ধুকে তাদের দলে নিয়ে নিয়েছে, তারা যদি বোঝে বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য, তাহলে আপনাদের সর্বনাশ।
দুই. ’৭৫-এ ভারত সীমান্তে বসে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ পুত্র এখন জীবিত। প্রতিজ্ঞা-প্রত্যয় ঘোষণা করে যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারব ততক্ষণ মাংস খাব না। সে প্রত্যয়দৃপ্ত ঘোষণাও কিন্তু রক্ষা করেননি বঙ্গবীর।’
(ক) আমি এখনও জীবিত কিনা। এই লেখাতেই প্রমাণ করে আমি জীবিত। কারণ কোনো কবরবাসী লিখতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর আমি চতুর্থ সন্তান কিনা, এর স্বীকৃতি বর্তমান কোনো আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে নিতে চাই না। দেশবাসী অনেক আগেই আমাকে সে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। মানুষ হিসেবে ভুলত্রুটি, সফলতা-ব্যর্থতা অনেক কিছুই আমার আছে। কিন্তু আমি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের বরপুত্র, এতে আওয়ামী লীগ ছাড়া সমগ্র দেশবাসীর কারও কোনো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
(খ) ‘যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারবো ততক্ষণ মাংস খাবো না।’ সে সত্যদীপ্ত ঘোষণাও নাকি আমি রক্ষা করিনি। লতিফ ভাই’র শক্তিশালী কলম প্রতিরোধ করবে কে? তিনি মরাকে তাজা করতে পারেন। কিন্তু তার দুর্বলতা তিনি যখন কোনো কিছু বলেন বা লিখেন তখন আগে-পিছে বিবেচনা করেন না, কোনো কাগজপত্র রাখেন না। ইদানীং রাখেন কিনা বলতে পারব না। কিন্তু আমি যখনকার কথা বলছি তখন তিনি রাখতেন না। তার সফলতা তিনি খুব উচ্চশিক্ষিত। আমার সফলতা আমি একেবারে অশিক্ষিত, বেশি লিখতে পারি না। কেউ কিছু লিখলে তা যত্ন করে রেখে দেই। স্বাধীনতার আগে তেমন বোধশক্তি ছিল না। স্বাধীনতার অনেক পরে বিশেষ করে ’৭৫-এর পর বোধটি খুবই চনমনে হয়েছে। বড় ভাই সিগারেটের খাপে যা লিখে পাঠিয়েছেন তাও আমার কাছে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুকরো কাগজে ‘ভাই বজ্র’ বলে যা লিখেছেন তাও আছে। তাই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সুবিধামত শব্দ বসিয়ে নিজের পক্ষে রায় নিতে চাইলেই পারবেন, তা হবে না। যদি বিচারালয় থাকে তাহলে সেখানে সাক্ষী সাবুদও থাকবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার লিখিত-অলিখিত আমার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার যতদিন প্রতিশোধ ও প্রতিকার করতে না পারব ততদিন মাংস খাব না। আমি তখন ছোট ছিলাম। হাদিস-কোরআন, বই-পুস্তক তেমন পড়া ছিল না। পড়ালেখা থাকলে অমন প্রতিজ্ঞা করতাম না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও জন্য ওই ধরনের কোনো প্রতিজ্ঞা করলে আল্লাহ নারাজ হন, সেটা আমি মোটেই জানতাম না। তারপরও কোনো প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করিনি। কথাটা যখন তুলেছেন তখন অবশ্যই খোলাসা করা দরকার।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন, আমি তখন টাঙ্গাইল জেলার গভর্নর। ২০/৩০ বাবর রোডের যে ঘরে বসে লিখছি, আমি সেই ঘরেই থাকতাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়েছিলাম ছোট বোন রহিমা ও শুশুমার কাছ থেকে। আমি জীবনে খুব একটা পালাইনি। প্রথম প্রথম আপনার মারের ভয়ে কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়েছি, অন্য সব সময়ই প্রকাশ্যে থেকেছি। মুক্তিযুদ্ধেও আমাকে আত্মগোপন করতে হয়নি। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত এই পাঁচ দিন ঢাকা শহরে আত্মগোপন করে থেকেছি। বিশদভাবে সেটা আর একটা লেখায় লিখেছি। ছাপা হলে সবাই জানতে পারবেন। সে রাতে আমি যেমন বাবর রোডের বাড়িতে ছিলাম, আপনিও এমপি হোস্টেলে ছিলেন। টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে খুব সকালে বাবর রোডে এসেছিলেন। কারণ ভাবী লায়লা সিদ্দিকী এবং আপনার কন্যা রিয়া তখন পরম যত্নে বাবর রোডেই থাকত। আমি জানতাম না যে আপনি এসেছিলেন। তার একটু পরেই রহিমার ফোনে বুঝেছিলাম, সেনাবাহিনী ক্যু করেছে। আমিও বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে গজনবী রোডে প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের বাসায়, দুপুরের পর খিলজী রোডে জনাব আবদুস সবুর দারোগার বাড়িতে। সেখানেই সারাদিন ছিলাম। মন ছিল খুবই ভারাক্রান্ত। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় যখন খাবার দেয়া হয় তখন বাংলাদেশ টিভিতে মোশতাক মন্ত্রিসভার শপথ এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ হচ্ছিল। আনুগত্য প্রকাশের প্রথমে ছিল রক্ষীবাহিনী, তার নেতা আনোয়ারুল আলম শহীদ, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, পুলিশের আইজি নুরুল ইসলাম, বিডিআরের মে. জে. খলিলুর রহমান। মন্ত্রিসভার অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান বাদে বঙ্গবন্ধুর সব মন্ত্রীই ছিলেন।
সেই সময় আমাকে মাংস খেতে দেয়া হয়েছিল। দু’এক টুকরা বোধ হয় খেয়েছিলাম। কিন্তু যখন টিভির পর্দায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভাকে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় দেখলাম, তখন মাংসে চিবুনি দিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি যেন বঙ্গবন্ধুর মাংস খাচ্ছি। মুখ থেকে খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। চোখ থেকে টপটপ করে খাবার থালাতে কয়েক ফোঁটা পানি পড়েছিল। আমার জানামতে আল্লাহার নেয়ামত খাবারের দানা আমি মুখ থেকে ফেলিনি। এখনও এদিক-ওদিক ভাত পড়লে খুটে খাই। মা-বাবা গুরুজনের কাছে শুনেছি, ভাতের থালায় চোখের পানি পড়লে তার কপালে ভীষণ দুঃখ হয়। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছিলাম বলে বুকের ব্যথা সইতে না পারায় মনের অজান্তে ক’ফোঁটা চোখের পানি না হয় সেদিন ভাতের থালায় পড়েছিল। সেই চরম দুঃখের সময় বঙ্গবন্ধুর মাংস কামড় দিচ্ছি ভেবে ভুল করে এক গ্রাস খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। সেই অপরাধের ৪০ বছর শাস্তির পরও কি আল্লাহর দরবারে আমি মাফ পেতে পারি না? বড় ভাই, আমি কীভাবে প্রতিজ্ঞা ভাঙলাম। প্রতিজ্ঞা করাই অন্যায় হয়েছিল। তারপরও আমি তো সেই অন্যায় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে আল্লাহর দরবারে পাপী গোনাহগার হয়েছি। আপনারাই তো বলছেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। মাংসের লোভ আমার ছিল তা কিন্তু নয়। আমি কি ভারতে নির্বাসিত জীবনে কখনও মাংস খেয়েছি? কখনও না। দেশে এসেই খেয়েছি? তাও না। আমার প্রিয়তমা ভগ্নী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর যেদিন গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তা কি মনে আছে? আমি তখন ভারতের আজমীরে ছিলাম। আমি মাংস খাই না শুনে খাজা বাবার মাজারের এক বয়সী মুয়াল্লিম আমার দুটি হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা, প্রতিজ্ঞা করে আল্লাহর দেয়া কোনো হালাল নিয়ামক না খাওয়া ভালো নয়। অজান্তে মানুষের দ্বারা কত অন্যায় কাজ হয়, কত হারাম জিনিসও খেয়ে ফেলে। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন হালাল মাংস হালাল করেছেন মানুষের প্রতি, আর আপনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য সে মাংস খান না? ঠিক আছে, না খেলেন। তবু কোরবানির মাংস খাবেন।’
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৩ সালে কবে কোরবানি হয়েছিল। আমি সেদিন ’৭৫-এর পর প্রথম কোরবানির মাংস মুখে দিয়েছিলাম। অতগুলো বছর মাংস না খাওয়ায় এখন খুব একটা ভালো লাগে না। তাই তেমন খাই না। আপনি বলছেন, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ তো সেদিনই হয়েছে যেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই অসহায় কন্যার মধ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরি। সেটাও বঙ্গবন্ধু হত্যার একটা প্রতিকার। ’৯১ সালে না হোক, ২১ বছর পর ’৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জননেত্রী হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন— সেটাও তো একটা প্রতিকার। সর্বোপরি ’৯৭ সালে বিচার করে যারা প্রত্যক্ষ হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের কয়েকজনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। আমি যেখানে পিতা হত্যার বিচারের জন্য জীবন-যৌবন খুইয়েছি, অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় হওয়ার পর ’৯৭-এর ৮ নভেম্বর সংসদে একটি ধন্যবাদ আলোচনা হয়েছিল। অনেকেই সেই আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ করতাম না বলে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়ের ওপর সংসদে আলোচনায় আমাকে সুযোগ পর্যন্ত দেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার যারা পরিকল্পনা করেছিল তাদের বিচার করতে না পারলেও প্রত্যক্ষ খুনিদের কয়েকজনের বিচার তো আপনারা করেছেন। তাই আমাকে মাংস না খাইয়ে শুঁটকি বানিয়ে লাভ কী? আমার কি ক্ষমতা আছে আজ প্রতিশোধ নেয়ার, প্রতিকার করার? ঢাল-তলোয়ার সবই তো আপনাদের হাতে। যে প্রতিজ্ঞা করা যায় সে প্রতিজ্ঞা ভাঙার মানুষ আমি নই। অতীতেও ভাঙিনি, ভবিষ্যতেও ভাঙব না। আপনি কেন যে প্রতিজ্ঞা ভাঙার প্রশ্নটা তুললেন, আমি একেবারেই বুঝতে পারলাম না। শর্টকাট না করে ব্যাখ্যা করলে আমার মতো দেশবাসীরও তো ভালো হতো। আর আমি তো এখন আওয়ামী লীগ করি না। বঙ্গবন্ুব্দকে তো আর আমাদের থাকতে দেননি। আপনারা সব ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাই আমি মাংস খাই আর না খাই, বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রতিজ্ঞা রক্ষা করি না করি এজন্য অত ছটফটানি কেন? বঙ্গবন্ধু তো আজ আর জাতীয় সম্পদ নন, তিনি সম্পূর্ণই আপনাদের পৈতৃক সম্পদ। বঙ্গবন্ধুকে সবার জন্য ছেড়ে দিন। সব দেশবাসীর জনক হতে দিন। তখন তার মান-মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব হবে সবার। কথাগুলো আমার জায়গায় আপনি হলেও এমনি করেই বলতেন—যা আমি বলছি। আমার চাইতে ভালো লেখাপড়া জানেন বলে আরও ভালো করে বলতেন।
সূত্র : দৈনিক আমার দেশ এ প্রকাশিত।
গত ২০ মার্চ দৈনিক জনকণ্ঠে চতুরঙ্গ পাতায় ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ শিরোনামে একটি মহামূল্যবান লেখা বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী আমাকে উপহার দিয়েছেন। নটী বিনোদিনী নাটকে একদিন এক দর্শক গিরিশ ঘোষের অভিনয় দেখে মঞ্চে জুতা ছুড়ে মেরেছিল। তিনি তা মাথায় তুলে তার নাট্যাভিনয়ের সার্থকতা খুঁজেছিলেন। রামকৃষ্ণ পরমহংস দেবও তার নটী বিনোদিনী দেখে আশীর্বাদ করেছিলেন। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর এ লেখা আমার কাছে গিরিশ ঘোষের মঞ্চে ছুড়ে দেয়া দর্শকের আশীর্বাদের মতোই মনে হয়েছে। লেখাটার শিরোনাম দিতে চেয়েছিলাম ‘সে যে আমার বড় ভাই’, সাহস পেলাম না। কারণ তিনি আমার শব্দে শব্দে দাড়ি-কমায় ভুল ধরতে পারেন। তাই নির্বাসনের সময় শোনা মান্না দে’র কণ্ঠে ‘সে যে আমার ছোট বোন’—বুকের ভেতর তোলপাড় করা গানটির অনুকরণেই বলতে চেয়েছিলাম ‘সে যে আমার বড় ভাই’। কিন্তু তিনি যদি ব্যাকরণগত ভুল ধরেন, যদি আবার বলে বসেন, ‘দেখেছেন ছেলেটা কত বেয়াদব। বড় ভাইকে তিনি না বলে সে বলেছে।’ তাই শিরোনাম দিলাম ‘তিনি আমার বড় ভাই’ যদিও লয়-তালে জোর হলো না। কিন্তু সত্যিই তিনি বড় ভাই, পিতার সমান। তার এ লেখা পড়েও মনে হলো তিনি আমাকে শক্তপোক্ত করতেই অমন গালাগাল করেছেন, মোটেই দুর্বল করতে নয়। আরও সবল, সাহসী ও যোগ্য করতেই হয়তো এ লেখা লিখেছেন। লেখাটি পড়ে আমার স্ত্রী কেঁদেছে। ছেলেমেয়েদের মন খারাপ হয়েছে। দু’দিন ধরে শাহানা-দুলাল ছটফট করছে, ওরা ভাবছে পরিবারের মধ্যে নিজেরা একজন আরেকজন সম্পর্কে এমন বললে কেমন হয়? আমার কিন্তু তেমন মনে হয়নি। ২০-২১ তারিখ দুটো লেখা তৈরি করছিলাম, তাই বড় ভাই’র ‘যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি’ পড়িনি। ২২ তারিখ লেখাটি পড়ে মোটামুটি ২০টি ভাগে ভাগ করে লেখার অন্তর বা মর্মবাণী খুঁজতে চেষ্টা করছি। আমার এ লেখা লতিফ ভাই’র লেখার অস্বীকৃতি নয়, শুধু কিছু ভাবনা। আর ওনার ৭৩-এর ওপর বয়স। তাই যদি আগে-পিছে কিছু ভুলে গিয়ে থাকেন তা অনুগত সন্তানের মতো ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা মাত্র। বড় ভাই তো বড় ভাই-ই। তিনি কোনোদিন আমার থেকে ছোট হবেন না। বিদ্যা-বুদ্ধি, জ্ঞান-গরিমা, যশ-খ্যাতি সবই তার বেশি। আমার ছায়ায় তিনি থাকুন এটা কখনও চাইনি। তার ছায়ায় নিরাপদে থাকি, এটাই আজীবন কামনা করেছি। ছায়া যদি না পেয়ে থাকি সেটা তার নয়, সব দোষই আমার। সব ছায়ারই তো একটা সীমা থাকে। আমি পৌঁছার আগেই যদি তার ছায়ার সীমা ভরে গিয়ে থাকে, সেখানে তার কী করার থাকতে পারে? সেটা তো আমারই ব্যর্থতা।
’৬৬-৬৭তে ছাত্রনেতা হিসেবে লতিফ সিদ্দিকী কুমিল্লা শহরে একদিন আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর সামনে বক্তৃতা করে সারা জেলা মাতিয়ে এসেছিলেন। সেদিন আমার বুক গর্বে ভরে গিয়েছিল। সম্ভবত একই বছর ভৈরব কলেজে ছাত্রদের নবীনবরণে লতিফ সিদ্দিকী ছিলেন প্রধান অতিথি। আর আজকের মহামান্য রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ছিলেন সাধারণ বক্তা। সে সময় লতিফ সিদ্দিকীর ভাই হিসেবে যেমন গর্ব করতাম, আজও তেমনি গর্ববোধ করি। লন্ডনে তার এবং সাজেদা চৌধুরীর উপস্থিতিতে যেদিন আমাকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল, সেদিন আজকের স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ছিলেন সাধারণ শ্রোতা। তাকে মঞ্চে এনে বক্তৃতা করার সুযোগ সেদিন এই নালায়েক আমিই করে দিয়েছিলাম। সেই সময় আমার বাবা ছিলেন, মা ছিলেন। আজ তারা কেউ নেই, আমি এতিম। মুরুব্বি হিসেবে মাথার ওপর একমাত্র বড় ভাই আছেন, তাকে কী বলি। পিতা সন্তানকে শাসন করে, সে তো তার ভালোর জন্যই। তিনিও হয়তো তাই করেছেন। এ ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে বা লিখতে চাইনি। কিন্তু চারদিক থেকে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে—আপনাকে এসবের জবাব দিতেই হবে। কী জবাব দেব, সবকিছুর কি জবাব থাকে? সব ঘটনা যদি সত্য হয় তাহলে আমি কী বলব? আর সত্য না হলেও আমার কোনো মুরুব্বি যদি অসত্যও বলে থাকেন, প্রতিবাদ করে তার সম্মান নষ্ট করব? তা তো করতে পারি না। সেদিন বিকালে এক পত্রিকা অফিসে আমার ছেলেবেলার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা। বসতে না বসতেই সে বলে বসল, ‘আরজু ভাই বাচ্চাকাল থেকেই তোকে দেখতে পারে না, তোর ওপর জুলুম করে। হুকুম চালায়, মারধর করে। খেলার মাঠ থেকে তোর কান ধরে নিয়ে যেত। এখনও তেমন করছে। তোর এর জবাব দেয়া উচিত।’ বললাম, ‘বন্ধু কী জবাব দেব? খালি তুই তোর আরজু ভাই মানে লতিফ সিদ্দিকীর আমাকে বকাঝকা, বন্ধুদের সামনে কান ধরে নেয়ার অপমানই দেখলি? আমার অসুখ হলে মাথায় পানি দিতে, হাত-পা টিপতে দেখলি না? বড় ভাই পিতার সমান। তিনি আমার মাথা-বুক-পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে কখন পা কোলে নিয়ে পরম যত্নে আমার যন্ত্রণা কমাতে চেষ্টা করতেন তা কি দেখেছিস? তিনি একটু জেদি মানুষ, আইয়ুব- মোনোয়েমের সময় সারা জেলা তার নামে পাগল ছিল। দেশে চার-পাঁচজন ছাত্রনেতার মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। কিন্তু কী এমন নয় মাসের যুদ্ধ হলো, যুদ্ধ শেষে বজ্রকে লতিফ সিদ্দিকীর ভাই না বলে লতিফ সিদ্দিকীকে যদি কাদের সিদ্দিকীর ভাই বলে তাহলে তো তার রাগ হওয়ারই কথা। তাই রাগ হয়ে ক্ষোভে বা কোনো হতাশায় যদি দু’কথা লিখেই থাকেন তবুও তো তিনি আমার বড় ভাই।’ তবু সে বলল, ‘না, তোর সম্পর্কে মানুষের যে ধারণা তাতে তার লেখাটার প্রতিটি শব্দের জবাব দেয়া দরকার। ধরে নে, আরজু ভাই মাস্টার হয়ে তোকে প্রশ্ন করেছে, তুই প্রশ্নের জবাব দে।’ আজ ক’দিন ধরে এমনি কথা আরও অনেকেই বলছেন। তাই ভাবলাম, সত্যিই তো যে অভিযোগ-অনুযোগ আমার নামে উল্লেখ করেছেন, এটাই যদি অন্যের নামে হতো এবং আমাকে মতামত বা উত্তরের জন্য তিনি পাঠিয়ে দিতেন, তাহলে গুরুজনের নির্দেশ পালনে উত্তর তো কিছু দিতেই হতো। ঠিক সেরকমই এই বিশটা প্রশ্নের উত্তর লিখে খাতাটা তার কাছে জমা দেই, দেখি তিনি কত নাম্বার দেন। সারা জীবনই তো ফেল না করলেও তেমন ভালো ছাত্র ছিলাম না কোনোদিন। তাই সুযোগ যখন এসেছে বদর বদর বলে পরীক্ষাটা তো দিয়ে দেই। ফেল করি করলাম। কিন্তু কোনো রকমে যদি পাস করে ফেলি তখন কতই না ভালো হবে। নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনে ক্ষমতাবানদের কাছ থেকে শুধু গালি আর গালি ছাড়া এখন পর্যন্ত কিছুই পেলাম না। তাই বড় ভাই, ক্ষমা করবেন।
এক. ‘অবশেষে বঙ্গবীর খোলসমুক্ত হলেন। ঘোষণা দিলেন, জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক, শেখ মুজিব নয়। যদি সেই নথ খসালি, তবে ক্যান লোক হাসালি?’ পত্রিকার এক কলামের চার লাইন। মূল জিজ্ঞাস্য মেজর জিয়াই স্বাধীনতার ঘোষক, শেখ মুজিব নয়।
(ক) আমি কখনও বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিব বলি না। তিনি আমার পিতা, নেতা ও ভালোবাসা। আপনি যদি পত্রিকায় এ ধরনের দেখে থাকেন তাহলে ওটা পত্রিকার কৃতিত্ব। পত্রিকার লেখকের কৃতিত্ব, আমার নয়। এ নিয়ে আমার কিছু বলার নেই।
(খ) জিয়াউর রহমানই স্বাধীনতার ঘোষক—ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আমার কাছে বঙ্গবন্ধু মানে বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতা, বঙ্গবন্ধু মানে স্বাধীনতার জনক। এই তিনটি বিশেষণের পর বঙ্গবন্ধুকে আমি কোনোক্রমেই স্বাধীনতার ঘোষক মনে করি না বা করতে পারি না।
ঘোষকের চাইতে স্বাধীনতার মর্যাদা, বাংলাদেশের মর্যাদা, স্বাধীনতার জনকের মর্যাদা অনেক বেশি। আমি যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাংলাদেশের জনক মনে করি, তেমনি স্বাধীনতার জনকও মনে করি। তাহলে এখানে স্বাধীনতার ঘোষক কে? বাংলাদেশের একজন জনক থাকলে যদি একজন ঘোষকের দরকার হয় তাহলে খুঁজে দেখি স্বাধীনতার ঘোষক কে? বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার কথা কমবেশি সবার জানা। কেউ কেউ বলছে সেই সময় ইপিআরের ওয়্যারলেসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা চিটাগাং পাঠানো হয়েছিল, কেউ বলছে নৌবাহিনীর কোনো বেতারে সে ঘোষণা ধরা পড়েছে। আমি নিজেও ‘স্বাধীনতা ৭১’-এ লিখেছি, বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা আমরা কাগমারী ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে পেয়েছিলাম যা টাঙ্গাইল জেলা সংগ্রাম পরিষদের হাতে দেয়া হয়েছিল। সেই ঘোষণাটি কার? অবশ্যই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। তাহলে তিনিই ঘোষক। আলহামদুলিল্লাহ। তবে ওই ঘোষণা তো অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর, কিন্তু তিনি ঘোষক নন। বঙ্গবন্ধুকে কেউ ঘোষক বলে না, মনেও করে না। সবাই জনক মনে করে। ওই ঘোষণার জন্য আমি অবশ্যই বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার জনক মনে করি।
বঙ্গবন্ধুর সেই ঘোষণাটি যদি আমি পাঠ করতাম বা করতে পারতাম এবং জাতি স্বীকৃতি দিত যে আমি স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেছি, তাহলে আমিই হতাম বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠক অথবা ঘোষক। কোনো চলচ্চিত্র বা নাটকে যে প্রধান পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করে, সে হয় নায়ক। মহিলা প্রধান চরিত্রে যে অভিনয় করে সে হয় নায়িকা। কিন্তু নায়ক-নায়িকা কেউ কাহিনীটি তৈরি করে না। কাহিনীটি তৈরি করে একজন দক্ষ কাহিনীকার বা লেখক। নায়ক-নায়িকা শুধু অভিনয় করে। আমিও এক্ষেত্রে মনে করি, আমরা ছিলাম অভিনেতা-অভিনেত্রী। দক্ষ কাহিনীকার, প্রযোজক, পরিচালক সবই ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
এখন আসুন জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার আদৌ ঘোষক কিনা। ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার নির্দেশের পর আমরা বহু জন আমাদের যার যার অবস্থানে থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি। বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীও যে দেননি তাও নয়। জিয়াউর রহমানের আগে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের নিয়ন্ত্রণাধীন বেতার কেন্দ্রে আওয়ামী লীগের অনেক নেতা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তার মধ্যে ছিলেন জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএ হান্নান, এমআর সিদ্দিকীসহ আরও অনেকে। তখন ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহের সময়। তাই অনেক কষ্ট করে জিয়াউর রহমানকে এনে তাকে দিয়েও স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়া হয়। তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে প্রথম নিজেকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন, সে ঘোষণার এখন কোনো অস্তিত্ব নেই। কোনো রেকর্ডও নেই। কিন্তু যেটার অস্তিত্ব আছে এবং যেটার অস্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকেই ছিল সেটা কী? সেটা হলো— ‘I Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman.’ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র থেকে যুদ্ধের সময় সেটা বার বার বাজানো হয়েছে। শুধু যুদ্ধের সময় নয়, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র দিবস উপলক্ষে প্রতি বছর এক ঘণ্টার অনুষ্ঠানে ৭ মার্চের ভাষণ যেমন বাজানো হয়েছে, তীর হারা ওই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দেবো রে, মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি, সালাম সালাম হাজার সালাম, সকল শহীদ স্মরণে; তেমনি এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্রে ‘কাদেরিয়া বাহিনীর গাবুর মাইর’ এবং মেজর জিয়ার কণ্ঠে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করা হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে তার ওই ঘোষণায় যদি তাকে স্বাধীনতার ঘোষক বলা হয়, আমি ফেরাব কী করে? তাহলে কি আওয়ামী লীগাররা চান রাষ্ট্রের জনকের পদ থেকে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রের ঘোষকের পদে নামিয়ে আনতে? পৃথিবীর সর্বত্র সব ঘটনার ঘোষক থাকে। আমার তো মনে হয় ঘোষকের চাইতে ঘোষণার মালিক অনেক বড়। জিয়ার কণ্ঠে, ‘I Major Zia do hereby declare independence of Bangladesh on behalf of our great national leader Bangobandhu Sheikh Mujibur Rahman" কিন্তু বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে ঘোষণাটি হলে কেমন হতো, 'I Seikh Mujibur Rahman do hereby declare indepedence of Bangladesh on behalf of our great Major Ziaur Rahman.' ধরে নিলাম মেজর জিয়াউর রহমানের নামে বিষ। মেজর জিয়ার নাম বলা হলো না। বলার দরকারও ছিল না। তারপরও একটা কিছু তো বলতে হতো, সেটা কী হতো— 'I Seikh Mujibur Rahman do hereby declare indepedence of Bangladesh.' কোথাও কি তার কণ্ঠে এমন কথা আছে? বঙ্গবন্ধুর হাজারো বক্তৃতা-বিবৃতি আছে, তার কণ্ঠে হাজারো ঘোষণা আছে। কিন্তু ওরকম বাংলা-ইংরেজিতে কোনো কিছু আছে কি? নেই। বলা যেতে পারে, লিখিত ঘোষণা তো আছে, ৭ মার্চের ভাষণ আছে। কোটি কোটি বার সেটা স্বীকার করি। তাই বঙ্গবন্ধুই স্বাধীনতার ঘোষণার মালিক। ওটি যদি তিনি স্বকণ্ঠে উচ্চারণ করতেন তাহলেও হয়তো আভিধানিক অর্থে তাকে ঘোষকও বলা যেত; কিন্তু তিনি তা না করায় তার ওই নির্দেশ, হুকুম বা ঘোষণা যিনি পাঠ করেছেন আভিধানিক অর্থে তিনিই ঘোষক। এরপরও যদি মুক্তিযুদ্ধের সময়ই কোনো আদেশের দ্বারা বলা হতো যে যেভাবেই যত ঘোষণাই দিন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক। সেখানেই ল্যাঠা চুকে যেত। আজ এতদিন পর রাজনৈতিক কারণে স্বার্থসিদ্ধির জন্য স্বাধীনতার জনককে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে গিয়ে তাকে বড় বেশি ছোট করার চেষ্টা চলছে। আমার এ নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে যে ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রচারিত হয়েছে, স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে শুনেছি, তাতে যদি জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষক হয়, তারা লাভবান হয়, আমার কিছু করার নেই। আমি যা শুনেছি তা অস্বীকার করতে পারব না; যারা আওয়ামী লীগ করেন, তারা অস্বীকার করতেই পারেন। যেমন অধ্যাপক ইউনূসের বদলে সন্তু লারমা আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে নোবেল পুরস্কার দেয়া উচিত্ এ কথা বলে প্রধানমন্ত্রীকে সন্তু লারমার সমান করেছেন। আমি ছেলেবেলায়ই কোনো রক্তচক্ষুকে ভয় করতাম না, আর এই বয়সে কোনো ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। এ নিয়ে আল্লাহর কাছে গোনাহগার হতে রাজি নই। জনাব বীর উত্তম জিয়ার ভক্তরা এবার বঙ্গবন্ধুকে তাদের দলে নিয়ে নিয়েছে, তারা যদি বোঝে বঙ্গবন্ধু তাদের জন্য, তাহলে আপনাদের সর্বনাশ।
দুই. ’৭৫-এ ভারত সীমান্তে বসে দৃঢ়কণ্ঠে বলেছিলেন, বঙ্গবন্ধুর চতুর্থ পুত্র এখন জীবিত। প্রতিজ্ঞা-প্রত্যয় ঘোষণা করে যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারব ততক্ষণ মাংস খাব না। সে প্রত্যয়দৃপ্ত ঘোষণাও কিন্তু রক্ষা করেননি বঙ্গবীর।’
(ক) আমি এখনও জীবিত কিনা। এই লেখাতেই প্রমাণ করে আমি জীবিত। কারণ কোনো কবরবাসী লিখতে পারে না। বঙ্গবন্ধুর আমি চতুর্থ সন্তান কিনা, এর স্বীকৃতি বর্তমান কোনো আওয়ামী লীগ নেতার কাছ থেকে নিতে চাই না। দেশবাসী অনেক আগেই আমাকে সে স্বীকৃতি দিয়ে দিয়েছে। মানুষ হিসেবে ভুলত্রুটি, সফলতা-ব্যর্থতা অনেক কিছুই আমার আছে। কিন্তু আমি যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শ ও কর্মকাণ্ডের বরপুত্র, এতে আওয়ামী লীগ ছাড়া সমগ্র দেশবাসীর কারও কোনো বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।
(খ) ‘যতক্ষণ বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ নিতে না পারবো ততক্ষণ মাংস খাবো না।’ সে সত্যদীপ্ত ঘোষণাও নাকি আমি রক্ষা করিনি। লতিফ ভাই’র শক্তিশালী কলম প্রতিরোধ করবে কে? তিনি মরাকে তাজা করতে পারেন। কিন্তু তার দুর্বলতা তিনি যখন কোনো কিছু বলেন বা লিখেন তখন আগে-পিছে বিবেচনা করেন না, কোনো কাগজপত্র রাখেন না। ইদানীং রাখেন কিনা বলতে পারব না। কিন্তু আমি যখনকার কথা বলছি তখন তিনি রাখতেন না। তার সফলতা তিনি খুব উচ্চশিক্ষিত। আমার সফলতা আমি একেবারে অশিক্ষিত, বেশি লিখতে পারি না। কেউ কিছু লিখলে তা যত্ন করে রেখে দেই। স্বাধীনতার আগে তেমন বোধশক্তি ছিল না। স্বাধীনতার অনেক পরে বিশেষ করে ’৭৫-এর পর বোধটি খুবই চনমনে হয়েছে। বড় ভাই সিগারেটের খাপে যা লিখে পাঠিয়েছেন তাও আমার কাছে আছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা টুকরো কাগজে ‘ভাই বজ্র’ বলে যা লিখেছেন তাও আছে। তাই নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে সুবিধামত শব্দ বসিয়ে নিজের পক্ষে রায় নিতে চাইলেই পারবেন, তা হবে না। যদি বিচারালয় থাকে তাহলে সেখানে সাক্ষী সাবুদও থাকবে। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে গিয়ে বহুবার লিখিত-অলিখিত আমার বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার যতদিন প্রতিশোধ ও প্রতিকার করতে না পারব ততদিন মাংস খাব না। আমি তখন ছোট ছিলাম। হাদিস-কোরআন, বই-পুস্তক তেমন পড়া ছিল না। পড়ালেখা থাকলে অমন প্রতিজ্ঞা করতাম না। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কারও জন্য ওই ধরনের কোনো প্রতিজ্ঞা করলে আল্লাহ নারাজ হন, সেটা আমি মোটেই জানতাম না। তারপরও কোনো প্রতিজ্ঞা আমি ভঙ্গ করিনি। কথাটা যখন তুলেছেন তখন অবশ্যই খোলাসা করা দরকার।
১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু যখন নিহত হন, আমি তখন টাঙ্গাইল জেলার গভর্নর। ২০/৩০ বাবর রোডের যে ঘরে বসে লিখছি, আমি সেই ঘরেই থাকতাম। বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর পেয়েছিলাম ছোট বোন রহিমা ও শুশুমার কাছ থেকে। আমি জীবনে খুব একটা পালাইনি। প্রথম প্রথম আপনার মারের ভয়ে কয়েকবার বাড়ি থেকে পালিয়েছি, অন্য সব সময়ই প্রকাশ্যে থেকেছি। মুক্তিযুদ্ধেও আমাকে আত্মগোপন করতে হয়নি। কিন্তু ’৭৫-এর ১৫ আগস্ট থেকে ১৯ আগস্ট পর্যন্ত এই পাঁচ দিন ঢাকা শহরে আত্মগোপন করে থেকেছি। বিশদভাবে সেটা আর একটা লেখায় লিখেছি। ছাপা হলে সবাই জানতে পারবেন। সে রাতে আমি যেমন বাবর রোডের বাড়িতে ছিলাম, আপনিও এমপি হোস্টেলে ছিলেন। টাঙ্গাইল যাওয়ার পথে খুব সকালে বাবর রোডে এসেছিলেন। কারণ ভাবী লায়লা সিদ্দিকী এবং আপনার কন্যা রিয়া তখন পরম যত্নে বাবর রোডেই থাকত। আমি জানতাম না যে আপনি এসেছিলেন। তার একটু পরেই রহিমার ফোনে বুঝেছিলাম, সেনাবাহিনী ক্যু করেছে। আমিও বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। প্রথমে গজনবী রোডে প্রখ্যাত সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বেরের বাসায়, দুপুরের পর খিলজী রোডে জনাব আবদুস সবুর দারোগার বাড়িতে। সেখানেই সারাদিন ছিলাম। মন ছিল খুবই ভারাক্রান্ত। সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। সন্ধ্যায় যখন খাবার দেয়া হয় তখন বাংলাদেশ টিভিতে মোশতাক মন্ত্রিসভার শপথ এবং তার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ হচ্ছিল। আনুগত্য প্রকাশের প্রথমে ছিল রক্ষীবাহিনী, তার নেতা আনোয়ারুল আলম শহীদ, সেনাপ্রধান শফিউল্লাহ, পুলিশের আইজি নুরুল ইসলাম, বিডিআরের মে. জে. খলিলুর রহমান। মন্ত্রিসভার অনুষ্ঠানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এম মনসুর আলী, কামরুজ্জামান বাদে বঙ্গবন্ধুর সব মন্ত্রীই ছিলেন।
সেই সময় আমাকে মাংস খেতে দেয়া হয়েছিল। দু’এক টুকরা বোধ হয় খেয়েছিলাম। কিন্তু যখন টিভির পর্দায় বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভাকে মোশতাকের মন্ত্রিসভায় দেখলাম, তখন মাংসে চিবুনি দিয়ে মনে হচ্ছিল, আমি যেন বঙ্গবন্ধুর মাংস খাচ্ছি। মুখ থেকে খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। চোখ থেকে টপটপ করে খাবার থালাতে কয়েক ফোঁটা পানি পড়েছিল। আমার জানামতে আল্লাহার নেয়ামত খাবারের দানা আমি মুখ থেকে ফেলিনি। এখনও এদিক-ওদিক ভাত পড়লে খুটে খাই। মা-বাবা গুরুজনের কাছে শুনেছি, ভাতের থালায় চোখের পানি পড়লে তার কপালে ভীষণ দুঃখ হয়। বঙ্গবন্ধুকে ভালোবেসেছিলাম বলে বুকের ব্যথা সইতে না পারায় মনের অজান্তে ক’ফোঁটা চোখের পানি না হয় সেদিন ভাতের থালায় পড়েছিল। সেই চরম দুঃখের সময় বঙ্গবন্ধুর মাংস কামড় দিচ্ছি ভেবে ভুল করে এক গ্রাস খাবার ফেলে দিয়েছিলাম। সেই অপরাধের ৪০ বছর শাস্তির পরও কি আল্লাহর দরবারে আমি মাফ পেতে পারি না? বড় ভাই, আমি কীভাবে প্রতিজ্ঞা ভাঙলাম। প্রতিজ্ঞা করাই অন্যায় হয়েছিল। তারপরও আমি তো সেই অন্যায় প্রতিজ্ঞা রক্ষা করে আল্লাহর দরবারে পাপী গোনাহগার হয়েছি। আপনারাই তো বলছেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়েছে। মাংসের লোভ আমার ছিল তা কিন্তু নয়। আমি কি ভারতে নির্বাসিত জীবনে কখনও মাংস খেয়েছি? কখনও না। দেশে এসেই খেয়েছি? তাও না। আমার প্রিয়তমা ভগ্নী মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর যেদিন গ্রেনেড হামলা হয়েছিল তা কি মনে আছে? আমি তখন ভারতের আজমীরে ছিলাম। আমি মাংস খাই না শুনে খাজা বাবার মাজারের এক বয়সী মুয়াল্লিম আমার দুটি হাত চেপে ধরে বলেছিলেন, ‘বাবা, প্রতিজ্ঞা করে আল্লাহর দেয়া কোনো হালাল নিয়ামক না খাওয়া ভালো নয়। অজান্তে মানুষের দ্বারা কত অন্যায় কাজ হয়, কত হারাম জিনিসও খেয়ে ফেলে। আল্লাহ রাব্বুল আল আমিন হালাল মাংস হালাল করেছেন মানুষের প্রতি, আর আপনি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের জন্য সে মাংস খান না? ঠিক আছে, না খেলেন। তবু কোরবানির মাংস খাবেন।’
আপনার নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৩ সালে কবে কোরবানি হয়েছিল। আমি সেদিন ’৭৫-এর পর প্রথম কোরবানির মাংস মুখে দিয়েছিলাম। অতগুলো বছর মাংস না খাওয়ায় এখন খুব একটা ভালো লাগে না। তাই তেমন খাই না। আপনি বলছেন, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছি। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিশোধ তো সেদিনই হয়েছে যেদিন বঙ্গবন্ধুর দুই অসহায় কন্যার মধ্যে জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সভানেত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। ’৯০-এর ১৬ ডিসেম্বর আমি দেশে ফিরি। সেটাও বঙ্গবন্ধু হত্যার একটা প্রতিকার। ’৯১ সালে না হোক, ২১ বছর পর ’৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে জননেত্রী হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন— সেটাও তো একটা প্রতিকার। সর্বোপরি ’৯৭ সালে বিচার করে যারা প্রত্যক্ষ হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের কয়েকজনকে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন। আমি যেখানে পিতা হত্যার বিচারের জন্য জীবন-যৌবন খুইয়েছি, অথচ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের রায় হওয়ার পর ’৯৭-এর ৮ নভেম্বর সংসদে একটি ধন্যবাদ আলোচনা হয়েছিল। অনেকেই সেই আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। আওয়ামী লীগ করতাম না বলে বঙ্গবন্ধু হত্যার রায়ের ওপর সংসদে আলোচনায় আমাকে সুযোগ পর্যন্ত দেননি। বঙ্গবন্ধু হত্যার যারা পরিকল্পনা করেছিল তাদের বিচার করতে না পারলেও প্রত্যক্ষ খুনিদের কয়েকজনের বিচার তো আপনারা করেছেন। তাই আমাকে মাংস না খাইয়ে শুঁটকি বানিয়ে লাভ কী? আমার কি ক্ষমতা আছে আজ প্রতিশোধ নেয়ার, প্রতিকার করার? ঢাল-তলোয়ার সবই তো আপনাদের হাতে। যে প্রতিজ্ঞা করা যায় সে প্রতিজ্ঞা ভাঙার মানুষ আমি নই। অতীতেও ভাঙিনি, ভবিষ্যতেও ভাঙব না। আপনি কেন যে প্রতিজ্ঞা ভাঙার প্রশ্নটা তুললেন, আমি একেবারেই বুঝতে পারলাম না। শর্টকাট না করে ব্যাখ্যা করলে আমার মতো দেশবাসীরও তো ভালো হতো। আর আমি তো এখন আওয়ামী লীগ করি না। বঙ্গবন্ুব্দকে তো আর আমাদের থাকতে দেননি। আপনারা সব ছিনিয়ে নিয়েছেন। তাই আমি মাংস খাই আর না খাই, বঙ্গবন্ধুর জন্য প্রতিজ্ঞা রক্ষা করি না করি এজন্য অত ছটফটানি কেন? বঙ্গবন্ধু তো আজ আর জাতীয় সম্পদ নন, তিনি সম্পূর্ণই আপনাদের পৈতৃক সম্পদ। বঙ্গবন্ধুকে সবার জন্য ছেড়ে দিন। সব দেশবাসীর জনক হতে দিন। তখন তার মান-মর্যাদা রক্ষার দায়িত্ব হবে সবার। কথাগুলো আমার জায়গায় আপনি হলেও এমনি করেই বলতেন—যা আমি বলছি। আমার চাইতে ভালো লেখাপড়া জানেন বলে আরও ভালো করে বলতেন।
সূত্র : দৈনিক আমার দেশ এ প্রকাশিত।
No comments:
Post a Comment