প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Thursday, May 26, 2011

রাতের রানী নাইট কুইন ।। বিন্দু এনায়েত


রানীর মতো সৌন্দর্য নিয়ে রাতের বেলা যে ফুল ফোটে, সে ফুলের নাম ‘রাতের রানী’ বা নাইট কুইন । রাত বেড়ে চলার সঙ্গে সঙ্গে কলি থেকে একটি একটি করে পাপড়ি মেলতে থাকে। সে সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছড়াতে থাকে মৃদু অথচ মন কেড়ে নেয়া সুগন্ধ। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ নাইট কুইন ফুলের সুগন্ধ ও সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ব্যাকুল হয়ে প্রতীক্ষা করে।
কোনো এক সময় ছিল যখন সাধারণত ইউরোপের কয়েকটি দেশে এ ফুল দেখা যেত। এখন অবশ্য আমাদের দেশেও নাইট কুইন দেখতে পাওয়া যায়।
নাইট কুইন ফুলের অদ্ভুত একটি বৈশিষ্ট্য হলো এ ফুলের গাছ পাথরকুচি গাছের মতো পাতা থেকে অঙ্কুরিত হয়। একটি পাতা নরম মাটিতে রেখে দিলে ধীরে ধীরে সে পাতা থেকে অঙ্কুর বের হয় এবং পরে তা গাছে পরিণত হয়। একটি পাতা থেকে একাধিক গাছ জন্মাতে পারে।
পাতা থেকে শুধু নাইট কুইন ফুলের গাছই জন্মায় না, ফুলও জন্মায়। প্রথম পাতার যে কোনো দিকে ছোট একটি গুটির মতো বের হয়। এই গুটি আস্তে আস্তে বড় হয়। ১৪ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সেই ফুলের গুটি থেকে কলি রূপান্তরিত হয়। আর কলিপুষ্ট হওয়ার পর রাত যত বাড়তে থাকে তার পাপড়ি তত মেলতে থাকে। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গন্ধ ছড়াতে থাকে। আর রাত শেষের দিকে যত এগোতে থাকে এই ফুলের পাপড়ি ততই ম্লান হতে থাকে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। কারণ রাতের রানী দিনের আলো সইতে পারে না। এও আল্লাহতায়ালার এক সুন্দরতম সৃষ্টি রহস্য—এ আমাদের স্বীকার করতেই হবে।
একটি তথ্য জানানো হয়নি, নাইট কুইন ফুল ফোটে বর্ষাকালে।
—বিন্দু এনায়েত
সূত্র : আমার দেশ

Wednesday, May 25, 2011

পড়শির সাথে শেষ দেখা ।। জহির রহমান

পড়শির সাথে শেষ যেদিন দেখা হয়েছিল সেদিন
আমি বসে গভীর মনোযোগে কাজ করছিলাম
কখন যে তুমি এসে আমার সামনে দাঁড়িছো
আমি খেয়ালই করিনি
কত সময় সামনে ছিলে তাও জানিনা।
সেদিন নীরবতা ভেঙ্গে তুমিই প্রথম জিজ্ঞেস করেছিলে-
কেমন আছো ?
আমি অবাক নয়নে তাকালাম তোমার দিকে
তোমারতো আসার কথা ছিলোনা!
কোন রকম বললাম-
ভালো আছি, তুমি ?
তুমি কোন কথা বলোনি
কিছু সময়ের নীরবতা ভেঙ্গে তুমি আবার বললে-
সত্যিই তুমি ভালো আছো ?
হ্যাঁ, তাইতো !
আমি থতমত খেয়ে গেলাম
সত্যিইতো আমার ভালো থাকার কথা না
সেদিনের সে প্রশ্নের জবাব আমি দিতে পারিনি।

২৪ মে, ২০১১

Wednesday, May 18, 2011

জাভাস্ক্রিপ্টের একটি কোডের জাদু ।। মেহেদী হাসান শিশির

HTML-এর কাজ পারলেও জাভাস্ক্রিপ্ট এর কাজ পারি না। তবে কোড সম্পর্কে মৌলিক ধারনা থাকায় একটু আধটু বুঝতে পারি।

নিচের কোডটি জাভাস্ক্রিপ্টে লেখা হয়েছে। খুব মজার কোড। এক জায়গায় পেলাম, তাই ভাবলাম শেয়ার করি। নিচের কোডটি আপনার ব্রাউজারের এড্রেসবার এ লিখে এন্টার চাপুন, তারপর দেখুন মজা। তবে যে পেইজে করবেন, সে পেইজে অবশ্যই কোন ছবি থাকতে হবে। আপনি চাইলে এই পেইজেই পরীক্ষা করে দেখতে পারেন।

javascript:R=0; x1=.1; y1=.05; x2=.25; y2=.24; x3=1.6; y3=.24; x4=300; y4=200; x5=300; y5=200; DI=document.images; DIL=DI.length; function A(){for(i=0; i-DIL; i++){DIS=DI[ i ].style; DIS.position='absolute'; DIS.left=(Math.sin(R*x1+i*x2+x3)*x4+x5)+"px"; DIS.top=(Math.cos(R*y1+i*y2+y3)*y4+y5)+"px"}R++}setInterval('A()',5); void(0);

মজাই মজা :)

নোটপ্যাডের মাধ্যমে নিজেই বানান ক্যালকুলেটর ।। মেহেদি হাসান শিশির

হিসাব নিকাশ করতে গেলে ক্যালকুলেটর লাগেই। আর সে ক্যালকুলেটরটি যদি হয় নিজের বানানো তাহলে কেমন হয় ? আসুন জেনে নিই কিভাবে ক্যালকুলেটর বানানো যায়। উইন্ডোজ ব্যবহারকারীরা ইচ্ছে করলে নোটপ্যাডের সাহায্যে নিজেই ক্যালকুলেটর
বানাতে পারেন। এজন্য নোটপ্যাড
ওপেন করে নিচের কোডটি হুবহ নোটপ্যাডে লিখুন অথবা কপি করুন-

@echo off
color 1F
title MY CALCULATOR
:loop
cls
echo Created by "Your Name Here"
echo Assist by Mahedi Hasan Ccr

echo Presente by Jaher Rahman
echo www.jonaaki.tk
echo.
echo My Calculator
echo -----------------------------------------------
echo * = MULTIPLY
echo + = ADD
echo - = SUBTRACT
echo 2 = SQUARED
echo / = DIVIDE
echo After an equation, type CLEAR to clear the screen of your equations, type KEEP to leave them there, or type EXIT to leave.
echo -----------------------------------------------
:noclear
set /p UDefine=
set /a UDefine=%UDefine%
echo.
echo =
echo.
echo %UDefine%
echo KEEP, CLEAR, OR EXIT?
set /p clearexitkeep=
if %clearexitkeep%==CLEAR goto loop
if %clearexitkeep%==clear goto loop
if %clearexitkeep%==KEEP echo. && goto noclear
if %clearexitkeep%==keep echo. && goto noclear
if %clearexitkeep%==EXIT (exit)
if %clearexitkeep%==exit (exit)
:misspell
echo.
echo -----------------------------------------------
echo You misspelled your command. Please try again (make sure you are typing in all caps o smalls).
echo Commands:
echo CLEAR Clear all previous equations and continue calculating.
echo KEEP Keep all previous equations and continue calculating.
echo EXIT Leave your calculating session
echo Enter in a command now.
set /p clearexitkeep=
if %clearexitkeep%==CLEAR goto loop
if %clearexitkeep%==clear goto loop
if %clearexitkeep%==EXIT (exit)
if %clearexitkeep%==exit (exit)
if %clearexitkeep%==KEEP goto noclear
if %clearexitkeep%==keep goto noclear
goto misspell


এখন file/save as এ গিয়ে save as type হিসেবে all files নির্বাচন করে my calculator.bat নামে এটি সেভ করুন। ফাইলটিতে ওপেন এবং হিসাব নিকাশের কাজে এটি ব্যবহার করুন।

Tuesday, May 17, 2011

এক পশলা বৃষ্টিতে ।। জহির রহমান


এক পশলা বৃষ্টিতে
ভিজিয়ে দিলো শহর
ক্লান্তিময়তা যত
কাটিয়ে প্রহর।
গ্রীষ্মের খরতাপের
তপ্তময় দুপুরে
মেঘের আড়ালে সূর্য হারায়
বৃষ্টি নামে ঝুপুরে।
এক পশলা বৃষ্টি
হয়ে গেল হৃদয়ে
মনেরি আঙ্গিনায় আছো তুমি
নীরালায় গোপনে।
ধরা ছোঁয়ার বাইরে
রাখবো তোমায়
সাজানো বাগানে
এ মনের আঙ্গিনায়।

মে ১৬, ২০১১

Sunday, May 8, 2011

মা আমার ভালোবাসা ।। জহির রহমান

মা যে আমার ভালোবাসা
মা যে আমার প্রাণ
মায়ের প্রতি রইল আমার
হাজারো সালাম।

আমি যখন বাহিরে থাকি
মা থাকে পথ চেয়ে
মা যে অনেক সুখি হয়
আমি ফিরলে ঘরে।

আমি যখন সফল হই
মা হয় খুব খুশি
মায়ের দোয়া সাথেই থাকে
এই যে আমার পুঁজি।

আমার যখন অসুখ করে
মা থাকে পাশে বসে
রাত জেগে মা পাহারা দেয়
ঘুম থাকেনা তার চোখে।

মায়ের কাছে শিখেছি আমি
প্রথম বর্ণমালা
মা যে আমার অমূল্য ধন
হিরা-মতির মালা।

মায়ের দামী ভালোবাসা
ভুলিবার নয় কভু
মাকে তুমি ভালো রেখো
ওগো মোর প্রভূ।

মে ৮, ২০১১

আমার মা ।। আমিনুল ইসলাম মামুন

আমার মায়ের হাসির কাছে
ফুলের হাসি তুচ্ছ
মনের মাঝে তাঁর আসনই
সবার চেয়ে উচ্চ।

তাঁরই আচল ছেড়ে আমি
কোথাও কখন গেলে
পথটা আমার চেয়ে তিনি
থাকেন দু’চোখ মেলে।

ফিরলে ঘরে মা যে আমার
স্বস্তি খুঁজে পায়
কপালেরই ঘামটি মুছি
মায়ের আঁচলটায়।

তখন মায়ের ঠোঁটের কোণে
মিষ্টি হাসি ফোটে
আমার মায়ের মতো মা আর
কার কপালে জোটে।

বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল ।। আহমেদ খালিদ

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল (ডিসেম্বর ১৬, ১৯৪৭- এপ্রিল ১৭, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।


সংক্ষিপ্ত জীবনী

মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ১৯৪৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর ভোলা জেলার দৌলতখান থানার পশ্চিম হাজীপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা হাবিবুর রহমান সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত হাবিলদার ছিলেন। শৈশব থেকেই দুঃসাহসী হিসেবে খ্যাত ছিলেন। পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পর উচচ বিদ্যালয়ে দু-এক বছর অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৭-র ১৬ ডিসেম্বর বাড়ী থেকে পালিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীতে চাকরি গ্রহন করেন। তিনি ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক। ১৯৭১-এর প্রথম দিকে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে কুমিল্লা সেনানিবাস থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঠানো হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে ঘিরে তিনটি প্রতিরক্ষা ঘাঁটি গড়ে তোলে এন্ডারসন খালের পাঁড়ে। আখাউড়ায় অবস্থিত চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দক্ষিন দিক থেকে নিরাপত্তার জন্য দরুইন গ্রামের দুই নম্বর প্লাটুনকে নির্দেশ দেয়। সিপাহী মোস্তফা কামাল ছিলেন দুই নম্বর প্লাটুনে। কর্মতৎপরতার জন্য যুদ্ধের সময় মৌখিকভাবে তাঁকে ল্যান্স নায়েকের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়।

যেভাবে শহীদ হলেন

১৬ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কুমিল্লা-আখাউড়া রেললাইন ধরে উত্তর দিকে এগুতে থাকে। ১৭ই এপ্রিল পরদিন ভোরবেলা পাকিস্তান সেনাবাহিনী দরুইন গ্রামে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর মর্টার ও আর্টিলারীর গোলাবর্ষণ শুরু করলে মেজর শাফায়াত জামিল ১১ নম্বর প্লাটুনকে দরুইন গ্রামে আগের প্লাটুনের সাথে যোগ দেয়ার নির্দেশ দেন। ১১ নম্বর প্লাটুন নিয়ে হাবিলদার মুনির দরুইনে পৌছেন। সিপাহী মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল তার নিকট থেকে গুলি নিয়ে নিজ পরিখায় অবস্থান গ্রহন করেন। বেলা ১১ টার দিকে শুরু হয় শত্রুর গোলাবর্ষণ। সেই সময়ে শুরু হয় মুষলধারে বৃষ্টি। সাড়ে ১১টার দিকে মোগরা বাজার ও গঙ্গা সাগরের শত্রু অবস্থান থেকে গুলি বর্ষিত হয়।
১২ টার দিকে আসে পশ্চিম দিক থেকে সরাসরি আক্রমণ। প্রতিরক্ষার সৈন্যরা আক্রমণের তীব্রতায় বিহ্বল হয়ে পড়ে। কয়েক জন শহীদ হন। মোস্তফা কামাল মরিয়া হয়ে পাল্টা গুলি চালাতে থাকেন। তাঁর পূর্ব দিকের সৈন্যরা পেছনে সরে নতুন অবস্থানে সরে যেতে থাকে এবং মোস্তফাকে যাবার জন্য অনুরোধ করে। কিন্তু তাদের সবাইকে নিরাপদে সরে যাওয়ার সুযোগের জন্য মোস্তফা পূর্ণোদ্যমে এল.এম.জি থেকে গুলি চালাতে থাকেন। তাঁর ৭০ গজের মধ্যে শত্রুপক্ষ চলে এলেও তিনি থামেননি। এতে করে শত্রু রা তাঁর সঙ্গীদের পিছু ধাওয়া করতে সাহস পায়নি। এক সময় গুলি শেষ হয়ে গেলে, শত্রুর আঘাতে তিনিও লুটিয়ে পড়েন। 

সূত্র : http://www.opest.net/9436.post

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ ।। আহমেদ খালিদ

নূর মোহাম্মদ শেখ(ফেব্রুয়ারি ২৬, ১৯৩৬- সেপ্টেম্বর ৫, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

১৯৩৬ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি নড়াইল জেলার মহিষখোলা গ্রামের এক দরিদ্র পরিবারে নূর মোহাম্মদ শেখ জন্মগ্রহন করেন। তাঁর পিতা মোহাম্মদ আমানত শেখ, মাতা জেন্নাতুন্নেসা। স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের লেখাপড়া শেষ করে উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানকার লেখাপড়া শেষ না করে ১৯৫৯-এর ১৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এ যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে নূর মোহাম্মদকে দিনাজপুর থেকে যশোরে বদলি করা হয়। বদলি স্থানে যোগ দানের আগেই স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।

যেভাবে শহীদ হলেন

১৯৭১- এর ৫ সেপ্টেম্বর সুতিপুরে নিজস্ব প্রতিরক্ষার সামনে গোয়ালহাটি গ্রামে নূর মোহাম্মদকে অধিনায়ক করে পাঁচ জনের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্ট্যান্ডিং পেট্রোল পাঠানো হয়। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হঠাৎ পাকিস্থানি সেনাবাহিনী পেট্রোলটি তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে গুলিবর্ষন করতে থাকে। পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিজস্ব প্রতিরক্ষা থেকে পাল্টা গুলিবর্ষন করা হয়। তবু পেট্রোলটি উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। এক সময়ে সিপাহী নান্নু মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লে নূর মোহাম্মদ নান্নু মিয়াকে কাঁধে তুলে নেন এবং হাতের এল.এম.জি দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে শুরু করলে শত্রুপক্ষ পশ্চাৎপসরণ করতে বাধ্য হয়। হঠাৎ করেই শত্রুর মর্টারের একটি গোলা এসে লাগে তাঁর ডান কাঁধে।
ধরাশয়ী হওয়া মাত্র আহত নান্নু মিয়াকে বাঁচানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেন। হাতের এল.এম.জি সিপাহী মোস্তফাকে দিয়ে নান্নু মিয়াকে নিয়ে যেতে বললেন এবং মোস্তফার রাইফেল চেয়ে নিলেন যতক্ষণ না তাঁরা নিরাপদ দূরুত্বে সরে যেতে সক্ষম হন ততক্ষণে ঐ রাইফেল দিয়ে শত্রুসৈন্য ঠেকিয়ে রাখবেন এবং শত্রুর মনোযোগ তাঁর দিকেই কেন্দ্রীভুত করে রাখবেন। অন্য সঙ্গীরা তাদের সাথে অনুরোধ করলেন যাওয়ার জন্যে। কিন্তু তাঁকে বহন করে নিয়ে যেতে গেলে সবাই মারা পড়বে এই আশঙ্কায় তিনি রণক্ষেত্র ত্যাগ করতে রাজি হলেন না। বাকিদের অধিনায়োকোচিত আদেশ দিলেন তাঁকে রেখে চলে যেতে। তাঁকে রেখে সন্তর্পণে সরে যেতে পারলেন বাকিরা। এদিকে সমানে গুলি ছুড়তে লাগলেন রক্তাক্ত নূর মোহাম্মদ। একদিকে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী, সঙ্গে অত্যাধুনিক স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রশস্ত্র, অন্যদিকে মাত্র অর্ধমৃত সৈনিক (ই.পি.আর.) সম্বল একটি রাইফেল ও সীমিত গুলি। এই অসম অবিশ্বাস্য যুদ্ধে তিনি শত্রুপক্ষের এমন ক্ষতিসাধন করেন যে তারা এই মৃত্যুপথযাত্রী যোদ্ধাকে বেয়নেট দিয়ে বিকৃত করে চোখ দুটো উপড়ে ফেলে। পরে প্রতিরক্ষার সৈনিকরা এসে পাশের একটি ঝাড় থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করে।

সূত্র : http://www.opest.net/9436.post

বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ।। আহমেদ খালিদ

মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর (১৯৪৮- ডিসেম্বর ১৪, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর ১৯৪৮ সালে বাবুগঞ্জ থানার রহিমগঞ্জ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল মোতালেব হাওলাদার। জাহাঙ্গীর ১৯৬৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন এবং ১৯৬৬ তে আই.এস.সি পাশ করার পর বিমান বাহিনীতে যোগদানের চেষ্টা করেন, কিন্তু চোখের অসুবিধা থাকায় ব্যর্থ হন। ১৯৬৭ সালে তিনি পাকিস্তান সামরিক একাডেমীতে ক্যাডেট হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬৮-র ২ জুন তিনি ইঞ্জিনিয়ার্স কোরে কমিশন লাভ করেন। ১৯৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার সময় তিনি পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটেলিয়ানে কর্তব্যরত ছিলেন। মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য তিনি ছুটে এসেছিলেন পাকিস্তানের দুর্গম এলাকা অতিক্রম করে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে। ৩ জুলাই পাকিস্তানে আটকে পড়া আরো তিনজন অফিসারসহ তিনি পালিয়ে যান ও পরে পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলার মেহেদীপুরে মুক্তিবাহিনীর ৭নং সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসাবে যোগ দেন। বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে তাঁকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ দখলের দ্বায়িত্ব দেয়া হয়। স্বাধীনতার ঊষালগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই তিনি শহীদ হয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরকে চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহাসিক সোনা মসজিদ আঙিনায় সমাহিত করা হয়।

যেভাবে শহীদ হলেন

১০ ডিসেম্বর ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর, লেফটেন্যান্ট কাইয়ুম, লেফটেন্যান্ট আউয়াল ও ৫০ জনের মতো মুক্তিযোদ্ধা চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়া এলাকায় অবস্থান গ্রহন করেন। ১৪ ডিসেম্বর ভোরে মাত্র ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বারঘরিয়া এলাকা থেকে ৩/৪ টি দেশী নৌকায় করে রেহাইচর এলাকা থেকে মহানন্দা নদী অতিক্রম করেন। নদী অতিক্রম করার পর উত্তর দিক থেকে একটি একটি করে প্রত্যেকটি শত্রু অবস্থানের দখল নিয়ে দক্ষিণে এগোতে থাকেন।
তিনি এমনভাবে আক্রমণ পরিকল্পনা করেছিলেন যেন উত্তর দিক থেকে শত্রু নিপাত করার সময় দক্ষিণ দিক থেকে শত্রু কোনকিছু আঁচ করতে না পারে। এভাবে এগুতে থাকার সময় জয় যখন প্রায় সুনিশ্চিত তখন ঘটে বিপর্যয়। হঠাৎ বাঁধের উপর থেকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সের ৮/১০ জন সৈনিক দৌড়ে চর এলাকায় এসে যোগ দেয়। এরপরই শুরু হয় পাকিস্তান বাহিনীর অবিরাম ধারায় গুলিবর্ষন। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর জীবনের পরোয়া না করে সামনে এগিয়ে যান। ঠিক সেই সময়ে শত্রুর একটি গুলি এসে বিদ্ধ হয় জাহাঙ্গীরের কপালে। শহীদ হন তিনি।

সূত্র :  http://www.opest.net/9436.post

বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ ।। আহমেদ খালিদ

মুন্সি আব্দুর রউফ (১৯৪৩ - এপ্রিল ৮, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

মুন্সি আব্দুর রউফ ১৯৪৩ সালের মে মাসে ফরিদপুর জেলার মধুখালী উপজেলার (পূর্বে বোয়ালমারী উপজেলার অন্তরগত) সালামতপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুন্সি মেহেদী হোসেন এবং মাতার নাম মকিদুন্নেসা। কিশোর বয়সে রউফ-এর পিতা মারা যান। ফলে তিনি উচচশিক্ষা লাভের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। তিনি অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন। ১৯৬৩-র ৮ মে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ ভর্তি হন। তাঁর রেজিষ্ট্রেশন নম্বর ১৩১৮৭। ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রামে ১১ নম্বর উইং এ কর্মরত ছিলেন। সে সময় তিনি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগদান করেন।

যেভাবে শহীদ হলেন

মুন্সি আবদুর রউফ ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পনীর সাথে বুড়িঘাটে অবস্থান নেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙ্গামাটি-মহালছড়ি জলপথ প্রতিরোধ করার জন্য ৮ এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডো ব্যাটেলিয়নের দুই কোম্পানী সৈন্য, সাতটি স্পীড বোট এবং দুটি লঞ্চে করে বুড়িঘাট দখলের জন্য অগ্রসর হয়। তারা প্রতিরক্ষি বূহ্যের সামনে এসে ৩" মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র দিয়ে হঠাৎ অবিরাম গোলা বর্ষন শুরু করে। গোলাবৃষ্টির তীব্রতায় প্রতিরক্ষার সৈন্যরা পেছনে সরে বাধ্য হয়। কিন্তু ল্যান্সনায়েক মুন্সি আব্দুর রউফ পেছনে হটতে অস্বীকৃতি জানান। নিজ পরিখা থেকে মেশিনগানের গুলিবর্ষণ শুরু করেন। মেশিনগানের এই পাল্টা আক্রমনের ফলে শত্রুদের স্পীড বোট গুলো ডুবে যায়।
হতাহত হয় এর আরোহীরা। পেছনের দুটো লঞ্চ দ্রুত পেছনে গিয়ে নিরাপদ দুরত্বে অবস্থান নেয়। সেখান থেকে শুরু করে দুরপাল্লার ভারী গোলাবর্ষণ। মর্টারের ভারী গোলা এসে পরে আব্দুর রউফের উপর। লুটিয়ে পড়েন তিনি, নীরব হয়ে যায় তাঁর মেশিনগান। ততক্ষণে নিরাপদ দূরুত্বে সরে যেতে সক্ষম হন তাঁর সহযোদ্ধারা।

শহীদ ল্যান্স নায়েক বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সি আব্দুর রউফের সমাধি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির নানিয়ার চড়ে। তাঁর অপরিসীম বীরত্ব,সাহসীকতা ও দেশপ্রেমের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে সর্ব্বোচ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করে।

সূত্র :  http://www.opest.net/9436.post

বীরশ্রেষ্ঠ ইঞ্জিন আর্টিফিসার মোহাম্মদ রুহুল আমিন।। আহমেদ খালিদ

মোহাম্মদ রুহুল আমিন (১৯৩৫ - ডিসেম্বর ১০, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

সংক্ষিপ্ত জীবনী

মোহাম্মদ রুহুল আমিন ১৯৩৫ সালে নোয়াখালী জেলার বাঘচাপড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা আজহার পাটোয়ারী, মাতা জোলখা খাতুন। রুহুল আমিন বাঘচাপড়া প্রাইমারী স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে আমিষাপাড়া হাই স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৫৩-তে জুনিয়র মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসাবে পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে যোগদান করেন। আরব সাগরে অবস্থিত মানোরা দ্বীপে পি.এন.এস বাহাদুর-এ প্রাথমিক প্রশিক্ষণ নেন। প্রাথমিক প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর পি.এন.এস. কারসাজে যোগদান করেন। ১৯৫৮-তে পেশাগত প্রশিক্ষণ শেষ করেন। ১৯৬৫ -তে মেকানিসিয়ান কোর্সের জন্য নির্বাচিত হন। পি.এন.এস. কারসাজে কোর্স সমাপ্ত করার পর আর্টিফিসার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৬৮ -তে চট্টগ্রাম পি.এন.এস. বখতিয়ার নৌ-ঘাটিঁতে বদলি হয়ে যান। ১৯৭১-এর এপ্রিলে ঘাটিঁ থেকে পালিয়ে যান। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্ত অতিক্রম করে ২ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে থেকে বিভিন্ন স্থলযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। বাংলাদেশ নৌ বাহিনী গঠিত হলে কলকাতায় চলে আসেন। ভারত সরকার বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী কে দুটি গানবোট উপহার দেয়। গানবোটের নামকরণ করা হয় 'পদ্মা' ও 'পলাশ'। রুহুল আমিন পলাশের প্রধান ইঞ্জিনরুমে আর্টিফিসার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

যেভাবে শহীদ হলেন

৬ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী যশোর সেনানিবাস দখলের পর পদ্মা, পলাশ' এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর একটি গানবোট পানভেল খুলনার মংলা বন্দরে পাকিস্তানি নৌ-ঘাটিঁ পি.এন.এস. তিতুমীর দখলের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ-এ প্রবেশ করে। ১০ ডিসেম্বর দুপুর ১২ টার দিকে গানবোটগুলো খুলনা শিপইয়ার্ডের কাছে এলে অনেক উচুঁতে তিনটি জঙ্গি বিমানকে উড়তে দেখা যায়। শত্রুর বিমান অনুধাবন করে পদ্মা ও পলাশ থেকে গুলি করার অনুমতি চাওয়া হয়। কিন্তু অভিযানের সর্বাধিনায়ক ক্যাপ্টেন মনেন্দ্রনাথ ভারতীয় বিমান মনে করে গুলিবর্ষণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। এর কিছুক্ষণ পরে বিমানগুলো অপ্রত্যাশিত ভাবে নিচে নেমে আসে এবং আচমকা গুলিবর্ষণ শুরু করে। গোলা সরাসরি 'পদ্মা' এর ইঞ্জিন রুমে আঘাত করে ইঞ্জিন বিধ্বস্ত করে। হতাহত হয় অনেক নাবিক। 'পদ্মা-র পরিণতিতে পলাশের অধিনায়ক লে. কমান্ডার রায় চৌধুরী নাবিকদের জাহাজ ত্যাগের নির্দেশ দেন। রুহুল আমিন এই আদেশে ক্ষিপ্ত হন। তিনি উপস্থিত সবাইকে যুদ্ধ বন্ধ না করার আহ্বান করেন। কামানের ক্রুদের বিমানের দিকে গুলি ছুড়ঁতে বলে ইঞ্জিন রুমে ফিরে আসেন। কিন্তু অধিনায়কের আদেশ অমান্য করে বিমানগুলোকে চ্যালেঞ্জ করা হয়নি। বিমানগুলো উপূর্যপুরি বোমাবর্ষণ করে পলাশের ইঞ্জিনরুম ধ্বংস করে দেয়। শহীদ হন রুহুল আমিন। রূপসা নদীর পারে তাঁকে সমাহিত করা হয়।

সূত্র  : http://www.opest.net/9436.post

বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহী মোহাম্মদ হামিদুর রহমান ।। আহমেদ খালিদ

মোহাম্মদ হামিদুর রহমান (ফেব্রুয়ারি ২, ১৯৫৩- অক্টোবর ২৮, ১৯৭১) বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধে অসামান্য বীরত্বের জন্য তাঁকে বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। মাত্র ১৮ বছর বয়সে শহীদ হওয়া হামিদুর রহমান সাত জন বীর শ্রেষ্ঠ পদকপ্রাপ্ত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে সর্বকনিষ্ঠ।


সংক্ষিপ্ত জীবনী

মোহাম্মদ হামিদুর রহমান ১৯৫৩ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যশোরের মহেশপুর উপজেলার খোরদা খালিশপুর গ্রামে জন্ম গ্রহন করেন। (১) তাঁর পিতা আব্বাস আলী মন্ডল, মাতা মোসাম্মাৎ কায়সুন্নেসা। খালিশপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং পরবর্তীকালে স্থানীয় নাইট স্কুলে সামান্য লেখাপড়া করেন। ১৯৭১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যোগদান করেন। যোগদানের পরই চট্টগ্রামের সেনানিবাসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে প্রশিক্ষণের জন্য যান। ২৫শে মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমনের মুখে চাকরীস্থল থেকে নিজ গ্রামে চলে আসেন। বাড়ীতে একদিন থেকে পরদিনই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য চলে যান সিলেট জেলার শ্রীমঙ্গল থানার ধলই চা বাগানের পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত ধলই বর্ডার আউটপোস্টে।


২ যেভাবে শহীদ হলেন

১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষভাগে হামিদুর রহমান ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সি কোম্পানির হয়ে ধলই সীমান্তের ফাঁড়ি দখল করার অভিযানে অংশ নেন। ভোর চারটায় মুক্তিবাহিনী লক্ষ্যস্থলের কাছে পৌছে অবস্থান নেয়। সামনে দু প্লাটুন ও পেছনে এক প্লাটুন সৈন্য অবস্থান নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে শত্রু অভিমুখে। শত্রু অবস্থানের কাছাকাছি এলে একটি মাইন বিস্ফোরিত হয়। মুক্তিবাহিনী সীমান্ত ফাঁড়ির খুব কাছে পৌছে গেলেও ফাঁড়ির দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্ত হতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মেশিনগানের গুলিবর্ষণের জন্য আর অগ্রসর হতে পারছিলো না। অক্টোবরের ২৮ তারিখে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পাকিস্তান বাহিনীর ৩০এ ফ্রন্টিয়ার রেজিমেন্টের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ বাধে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নেয়। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তান বাহিনীর মেশিনগান পোস্টে গ্রেনেড হামলার সিদ্ধান্ত নেয়। গ্রেনেড ছোড়ার দায়িত্ব দেয়া হয় হামিদুর রহমানকে। তিনি পাহাড়ি খালের মধ্য দিয়ে বুকে হেঁটে গ্রেনেড নিয়ে আক্রমণ শুরু করেন। দুটি গ্রেনেড সফল ভাবে মেশিনগান পোস্টে আঘাত হানে, কিন্তু তার পরপরই হামিদুর রহমান গুলিবিদ্ধ হন। (২) সে অবস্থাতেই তিনি মেশিনগান পোস্টে গিয়ে সেখানকার দুই জন পাকিস্তানী সৈন্যের সাথে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু করেন। এভাবে আক্রণের মাধ্যমে হামিদুর রহমান এক সময় মেশিনগান পোস্টকে অকার্যকর করে দিতে সক্ষম হন। এই সুযোগে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মুক্তিযোদ্ধারা বিপুল উদ্যমে এগিয়ে যান, এবং শত্রু পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করে সীমানা ফাঁড়িটি দখল করতে সমর্থ হন। কিন্তু হামিদুর রহমান বিজয়ের স্বাদ আস্বাদন করতে পারেননি, ফাঁড়ি দখলের পরে মুক্তিযোদ্ধারা শহীদ হামিদুর রহমানের লাশ উদ্ধার করে। (২)

হামিদুর রহমানের মৃতদেহ সীমান্তের অল্প দূরে ভারতীয় ভূখন্ডে ত্রিপুরা রাজ্যের হাতিমেরছড়া গ্রামের স্থানীয় এক পরিবারের পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করা হয়। (৩) নীচু স্থানে অবস্থিত কবরটি এক সময় পানির তলায় তলিয়ে যায়।
২০০৭ সালের ২৭শে অক্টোবর বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকার হামিদুর রহমানের দেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়। (৪)। সেই অনুযায়ী ২০০৭ সালের ১০ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাইফেলসের একটি দল ত্রিপুরা সীমান্তে হামিদুর রহমানের দেহাবশেষ গ্রহন করে, এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সাথে কুমিল্লার বিবিরহাট সীমান্ত দিয়ে শহীদের দেহাবশেষ বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। ১১ই ডিসেম্বর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানকে ঢাকার বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। (৫)।

৩ তথ্যসূত্র

১. "Birshreshtha Hamidur Rahman Laid To Rest", The Daily Star, ১২ই ডিসেম্বর, ২০০৭।

২. "বীর হামিদুরের ঘরে ফেরা", ছুটির দিনে, প্রথম আলো, ১৫ই ডিসেম্বর ২০০৭ ।

৩."Bangladesh takes home teenage war hero", রয়টার্স, Dec 10 2007।

৪. "বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুরের দেহাবশেষ দেশে এনে সমাহিত করা হবে", প্রথম আলো, ২৮শে অক্টোবর, ২০০৭।

৫. "Home they brought warrior dead: Bir Shreshtha Hamidur to be buried at Martyred Intellectuals Graveyard today", The New Nation, ১১ই ডিসেম্বর, ২০০৭।

বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান ।। আহমেদ খালিদ


বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান (২৯শে অক্টোবর, ১৯৪১—২০শে আগস্ট, ১৯৭১) একজন বাংলাদেশী মুক্তিযোদ্ধা। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নিহত হন। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতা আর বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ যে সাতজন বীরকে সর্বোচ্চ সম্মান বীরশ্রেষ্ঠ খেতাবে ভূষিত করা হয় ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম।

জীবনী

মতিউর ১৯৪১ সালের ২৯শে অক্টোবর পুরান ঢাকার ১০৯ আগা সাদেক রোডের পৈত্রিক বাড়ি "মোবারক লজ"-এ জন্মগ্রহণ করেন। ৯ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে মতিউর ৬ষ্ঠ। তাঁর বাবা মৌলভী আবদুস সামাদ, মা সৈয়দা মোবারকুন্নেসা খাতুন।


ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেনী পাস করার পর সারগোদায় পাকিস্তান বিমান বাহিনী পাবলিক স্কুলে ভর্তি হন। ডিস্টিংকসহ মেট্রিক পরীক্ষায় সাফল্যের সাথে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৬১ সালে বিমান বাহিনীতে যোগ দেন।

১৯৬৩ সালের জুন মাসে রিসালপুর পি,এ,এফ কলেজ থেকে কমিশন লাভ করেন এবং জেনারেল ডিউটি পাইলট হিসাবে নিযুক্ত হন। এরপর করাচির মৌরীপুরে জেট কনভার্সন কোর্স সমাপ্তি করে পেশোয়ারে গিয়ে জেটপাইলট হন। ১৯৬৫তে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় ফ্লাইং অফিসার অবস্থায় কর্মরত ছিলেন। এরপর মিগ কনভার্সন কোর্সের জন্য পুনরায় সারগোদায় যান। সেখানে ১৯৬৭ সালের ২১ জুলাই তারিখে একটি মিগ-১৯ বিমান চালানোর সময় আকাশে সেটা হঠাৎ বিকল হয়ে গেলে দক্ষতার সাথে প্যারাসুট যোগে মাটিতে অবতরণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ইরানের রানী ফারাহ দিবার সম্মানে পেশোয়ারে অনুষ্ঠিত বিমান মহড়ায় তিনি ছিলেন একমাত্র বাঙালি পাইলট। রিসালপুরে দু'বছর ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হিসাবে কাজ করার পর ১৯৭০ এ বদলি হয়ে আসেন জেট ফ্লাইং ইন্সট্রাক্টর হয়ে।১৯৭১ এর ফেব্রুয়ারী মাসে ঢাকায় ছুটিতে আসেন।


২ যেভাবে শহীদ হলেন

২৫ মার্চের ঘটনায় তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হন। পরে তিনি দৌলতকান্দিতে জনসভা করেন এবং বিরাট মিছিল নিয়ে ভৈরব বাজারে যান। পাক-সৈন্যরা ভৈরব আক্রমণ করলে বেঙ্গল রেজিমেন্টে ই,পি,আর-এর সঙ্গে থেকে প্রতিরোধ বুহ্য তৈরি করেন। এর পরই কর্মস্থলে ফিরে গিয়ে জঙ্গি বিমান দখল এবং সেটা নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন। ২০ই আগস্ট সকালে করাচির মৌরিপুর বিমান ঘাঁটিতে তারই এক ছাত্র রশীদ মিনহাজের কাছ থেকে একটি জঙ্গি বিমান ছিনতাই করেন। কিন্তু রাশেদ এ ঘটনা কন্ট্রোল টাওয়ারে জানিয়ে দিলে, অপর চারটি জঙ্গি বিমান মতিউরের বিমানকে ধাওয়া করে। এ সময় রশিদের সাথে মতিউরের ধ্বস্তাধস্তি চলতে থাকে এবং এক পর্যায়ে রশিদ ইজেক্ট সুইচ চাপলে মতিউর বিমান থেকে ছিটকে পরেন এবং বিমান উড্ডয়নের উচ্চতা কম থাকায় রাশেদ সহ বিমানটি ভারতীয় সীমান্ত থেকে মাত্র ৩৫ মাইল দূরে থাট্টা এলাকায় বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। মতিউরের সাথে প্যারাসুট না থাকাতে তিনি নিহত হন। তাঁর মৃতদেহ ঘটনাস্থল হতে প্রায় আধ মাইল দূরে পাওয়া যায়। রশিদ মিনহাজকে পাকিস্তান সরকার সম্মানসূচক খেতাব দান করে এবং মতিউরকে করাচির মাসর"র বেসের চতুর্থ শ্রেনীর কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের স্ত্রী মিলি রহমান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন, ফ্লাইট ল্যাফটেনেন্ট মতিউর রহমান শহীদ হবার সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। পাকিস্তানিরা তাঁকে এক অন্ধকার কক্ষে তাঁর শিশু বাচ্চা ও কাজের পরিচারিকাসহ দীর্ঘদিন বন্দী করে রাখে ও অত্যাচার করে। মুক্তি পাবার পর তিনি বাংলাদেশে ফিরে এসে মুক্তিযুদ্ধের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন।

২০০৬ সালের ২৩ জুন মতিউর রহমানের দেহাবশেষ পাকিস্তান হতে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাঁকে পূর্ণ মর্যাদায় ২৫শে জুন শহীদ বুদ্ধিজীবী গোরস্থানে পুনরায় দাফন করা হয়। 

Wednesday, May 4, 2011

এক তুষার ঝড়ের রাতে

বাবা মা র আদরের একমাত্র সন্তান অপরূপা রূপসী মারিয়া গাভ্রিলোভনা ছিল এক ষোড়শী জমিদার কন্যা যার বর্ননা কলম দিয়ে লেখার নয়, রূপকথাতেও বলার নয়। বাস করতো সে বাবা মা র সাথে রাশিয়ার গ প্রদেশে।

তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী মারিয়া বেড়ে উঠেছিল ফরাসী উপন্যাস পড়ে। যার ফলে অবধারিত ভাবে সে প্রেমে পড়লো, আর পড়লো কি না ভ্লাদিমির নামে এক সামান্য লেফটেনেন্টের।
কিন্ত মারিয়ার অভিজাত বাবা মা কিছুতেই তাদের এ সম্পর্ক মেনে নিতে রাজী নন, কারণ দুজনের মধ্যে সামাজিক মর্যাদার এক দুস্তর ব্যাবধান !

ফলে যা হবার তাই হলো। নানা রকম চিন্তা ভাবনার পর শেষ পর্যন্ত এই প্রেমিক যুগল পালিয়ে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিল। মারিয়াকে এ ব্যাপারে সর্বাত্মক সাহায্য করছিল তারই বয়সী এক দাসী, তার একান্ত সহচরী, যার মাধ্যমে চলছিল দুজনের চিঠির আদান প্রদান।

মাঝ রাতে পালাতে হবে তাই মাথা ধরার অজুহাতে তাড়াতাড়ি ঘুমাবে বলে বাবা মা র কাছ থেকে বিদায় নিল মারিয়া, যাকে বাবা মা আদর করে ডাকে মাশা।
এরপর ঘরে এসে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে অনেক আবেগ আর দুঃখ মিশিয়ে বাবা মার উদ্দেশ্যে এক বিশাল চিঠি লিখে টেবিলের উপর রেখে দিল।
তাতে লেখা তাদের ছেড়ে যেতে তাদের আদরের মাশার কি দুঃখই না হচ্ছে এবং তার স্বর্গীয় প্রেমের কাছে বাকী সব ভালোবাসা কি ভাবে পরাজিত হয়েছে এসবের করুন বিবরণ!

ভ্লাদিমির তাদের জন্য একটি ঘোড়ার গাড়ী ঠিক করে রেখেছিল। মাঝরাতে দুই অপরাধিনী সবার অগোচরে পিছনের পথ দিয়ে বাড়ী থেকে বের হলো।
সাথে কাপড়ের ছোট্ট একটা পুটুলি ।
গাড়ীতে উঠার সাথে সাথে হঠাৎ প্রচন্ড এক তুষার ঝড় শুরু হলো, মনে হচ্ছিল ঝড় ও যেন তাদের এ কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে চাইছে। যা হোক এরই মধ্যে অনেক কস্টে পরিকল্পনা মত তারা গ্রামের শেষ প্রান্তে এক পুরোনো গীর্জায় এসে হাজির হলো।

কিন্ত সেই ঝাপসা অন্ধকার পুরোনো কাঠের গীর্জা ঘরে শুধু পুরোহিত আর টাকার বিনিময়ে জোগাড় করা সাক্ষী ছাড়া আর কেউ নেই। অনেক রাত, বাইরে প্রচন্ড তুষার ঝড়, বর আসছেনা, পাদ্রী বার বার দরজার দিকে উকি দিচ্ছে । মারিয়া তার সখী সহ একটি বেন্চে বসে আছে আর সখী একটু পর পর ওডিকোলোন ভেজা রুমাল দিয়ে তার কপাল মুছে দিচ্ছে।

ভ্লাদিমির কোথায়! দেখা যাক সে কি করছে ! সে আসছে, কিন্ত রওনা দেয়ার সাথে সাথেই প্রচন্ড এক তুষার ঝড় শুরু হলো এবং মুহুর্তের মধ্যে রাস্তা ঘাট গভীর তুষারে ঢেকে গেল। পথের কোনো চিন্হ না থাকায় গাড়োয়ান আন্দাজে ঝড়ের মধ্যে গাড়ি চালিয়ে অনেক দুরে আরেক গ্রামে গিয়ে হাজির হলো।
অনেক কষ্টে এবং টাকার বিনিময়ে গ্রামের এক চাষীর ছেলের সহায়তায় সে যখন পুর্ব নির্ধারিত গীর্জায় পৌছালো তখন ভোর হয় হয়। চারিদিকে শুনশান, গীর্জা বন্ধ। অনেক খোজ খবর করে শেষে কি সংবাদটাই না সে শুনলো!

ওদিকে মারিয়া ফিরে এসে দেখে তার বাবা মা তখনো ঘুমিয়ে। সে তাড়াতাড়ি চিঠিটা ছিড়ে ফেলে কাপড় বদলে ঘুমিয়ে পড়লো। সুতরাং তাদের এই গোপন অভিসার এই গুটিকতক লোকই জানতো এবং যে কারনেই হোক তা গোপনই রইলো।
কিন্ত সকালে মারিয়ার এমন জ্বর আসলো যে সে ভুল বকতে লাগলো। তার মধ্যে গত রাতের ঘটনাও বাদ ছিলনা। মেয়ের অবস্থা দেখে বাবা মা সিদ্ধান্ত নিলেন ভ্লাদিমিরের সাথেই মেয়ের বিয়ে দেবেন
'জাত পাত কোনো বড় কথা না, জাত ধুয়ে পানি খাবে নাকি ! 'আর পাড়া পড়শী কে কি বল্লো সেটা নিয়ে মাথা না ঘামালেই হলো' ইত্যাদি চালু কথাগুলো আওড়াতে আওড়াতে তারা বিয়েতে রাজী বলে ভ্লাদিমিরকে ডেকে পাঠালো।
এর উত্তরে ভ্লাদিমির যা লিখলো তা পড়ে তারা তো হতবাক। লিখেছে 'সে আর বাচতে চায়না, মৃত্যু ছাড়া তার আর কোনো পথ নেই, তারা যেন তাকে ভুলে যায়, সে এক হতভাগ্য' ইত্যাদি।মারিয়ার বাবা মা এর অর্থ কিছুই বুঝলো না।

যাই হোক বেশ টানা হেচড়ার পর মারিয়াও আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে উঠলো। কিছু দিন পর খবর আসলো ভ্লাদিমির বোরদিনোর এক যুদ্ধে মারা গেছে। মারিয়াকে খবরটা জানানো হলোনা।
এর কিছুদিন পরে মারিয়ার বাবা মা মেয়েকে নিয়ে গ্রামে নিজেদের জমিদার বাড়ীতে ফিরে গেল। সেখানে অনেক উচ্চ বংশের অনেক রূপবান গুনবান পানি প্রার্থী এসে নিরাশ হলো। মারিয়া কিছুতেই বিয়ে করবেনা কারণ সে যে ভ্লাদিমিরকে ভালোবাসে।

এর মধ্যে মারিয়ার বাবা মারা গেলে মারিয়ার মা মেয়ের ভবিষ্যত ভেবে ভীষন চিন্তায় পড়ে গেল।
ঠিক এসময়ই ঐ গ্রামে বুরমিন নামে আহত এক হুশার যোদ্ধার আগমন সেই এলাকার মেয়ে মহলে প্রচন্ড এক আলোড়নের সৃস্টি করলো।বিশেষ করে মেয়েদের প্রতি তার উদাসীনতাই ছিল এর কারণ !

সেই আহত যোদ্ধা বুরমিন একদিন মারিয়ার দুর্ভেদ্য দুর্গে ঢোকার সুযোগ পেল। তার সেই করুন বিষাদ ক্লিস্ট মুখ দেখে এতদিন পর মারিয়ার ও মন টলে উঠলো। সে প্রায় প্রতিদিনই মারিয়ার বাসায় আসে, মারিয়া বুঝতে পারলো সেও তাকে ভালোবাসে, কিন্ত কি যেন একটা বাধা তার মধ্যে। বলতে গিয়েও যেন বলে উঠতে পারছেনা।

সেদিন বিকেলে মারিয়া সাদা একটা গাউন পড়ে বাগানে লেকের ধারে বসে আছে এক ফরাসী উপন্যাস নিয়ে । তার মন বলছিল আজ বুরমিন কিছু বলবে। ঠিক সে সময়ই সেখানে বুরমিনের প্রবেশ।
মারিয়ার সেই ব্যাথাতুর মুখের দিকে চেয়ে বুরমিন আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলোনা।আস্তে করে তার পাশে বসে বল্লো, 'মারিয়া আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি কিন্ত আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারবোনা'।

'কেন'?চমকে উঠলো মারিয়া।
'কারণ আমি বিবাহিত!'
'কি বলছেন ! বিবাহিত'!
'হ্যা শোনো তাহলে আজ আমার জীবনের সেই দুর্ভাগ্যের কাহীনি।
আজ থেকে বছর দুয়েক আগে এক ঝড়ের রাতে আমি ঘোড়ার গাড়ি করে এক সামরিক চৌকি থেকে আরেক চৌকিতে যাচ্ছিলাম'
'তারপর'!
'একটু পরেই শুরু হলো প্রচন্ড তুষার ঝড়। কোথা দিয়ে যাচ্ছিলাম কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। হঠাৎ চেয়ে দেখি দুরে একটা টিমটিমে বাতি । গাড়োয়ান কে বল্লাম "চলো ওখানে"।
কাছে গিয়ে দেখি পুরোনো একটা গীর্জা, দরজায় ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। প্রায় অন্ধকার সেই ঘরে এক পাদ্রি এগিয়ে এসে বল্লো 'কি ব্যাপার এত দেরী! কনে তো অজ্ঞান হবার অবস্থা। তাড়াতাড়ি আসুন বিয়েটা সেরে ফেলুন'।
ব্যাপারটা আমার কাছে তখন খুবই মজার এবং হাস্যস্কর ধরে নিয়ে বল্লাম, 'হ্যা হ্যা শুরু করুন ফাদার, দেরী করার দরকার কি'।
মোমের ক্ষীন আলোয় বেন্চে বসে থাকা মেয়েটাকে তার সখী ধরে আমার পাশে এনে দাড় করালো। ঝড় বেড়েই চলেছে , পাদ্রিও তাড়াহুড়া করে বিয়ে পড়িয়ে বল্লো 'এবার আপনাদের স্বামী স্ত্রী হিসেবে ঘোষনা করা হলো' ।
'তারপর' ! মারিয়ার আকুল প্রশ্ন ।
'সখী মেয়েটার মুখ উচু করে ধরলে আমি যখন রীতি অনুযায়ী তাকে চুমু খেতে যাবো তখনই মেয়েটা চোখ মেলে চিৎকার করে বল্লো " এ নয়, এ নয়" বলে অজ্ঞান হয়ে ঢলে পড়লো সখীর গায়ের উপর।
"তারপর" বুরমিনের জামার আস্তিন খামচে ধরে বল্লো মারিয়া।

'তারপর দেখি বাকী সবাই অবাক হয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে । পাদ্রী মশাইয়ের চেহারাটাও কেমন ফ্যাকাশে। আমি ভাবলাম যথেস্ট শয়তানি হয়েছে আর না। কোনো দিকে না তাকিয়ে একলাফে গীর্জা থেকে বের হয়ে গাড়োয়ানকে বল্লাম, 'হাকাও গাড়ী'। এরপর গাড়ীতে উঠেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম ভাংলো পরদিন আরেক সেনা চৌকিতে।

'তারপর সেই মেয়েটার কি হলো? তুমি কি তার আর কোনো খোজই নাওনি'! বিস্ফারিত চোখে মারিয়ার প্রশ্ন।

'আমি জানিনা মেয়েটার কি হলো মারিয়া, সেই ঝড়ের রাতে কোন গ্রামে কোথায় যে ঘটনাটা ঘটেছিল কিছুই আজ আর আমার মনে নেই।সেই গাড়োয়ানটাও মারা গেছে। সুতরাং তাকে খুজে পাওয়ার কোনো আশাই আর আমার নেই, যাকে নিয়ে ঠাট্টা করেছিলাম সেই এখন এত বড় এক প্রতিশোধ নিচ্ছে'।

ফ্যাকাশে মুখে মারিয়া তার মুখ তুলে বল্লো 'তুমি কি আমাকে চিনতে পারোনি '! আমিই তো সেই মেয়ে ' ।

ঘর থেকেই বুরমিনের খুশীর চিৎকার শুনে মারিয়ার মা বুকে বারবার ক্রস চিন্হ একে বিধাতাকে ধন্যবাদ জানাতে লাগলেন ।

***
রাশিয়ার বিখ্যাত লেখক নাট্যকার কবি আলেকজান্ডার পুশকিন এর নাম শুনেনি এমন মানুষ খুব কমই আছে । তার বিখ্যাত নাটক 'ইয়েভেগেনি ওনেগিন, গল্প 'ক্যাপ্টেনের মেয়ে' ইত্যাদি কালজয়ী সাহিত্য।

গল্পটি পুশকিন ইভান পেত্রোভিচ বেলকিনের লেখা বলে উল্লেখ করেছেন।
তবে গল্প বলার ধরণ দেখে মনে হয় স্বয়ং পুশকিনই এর রচয়িতা।

<সংগ্রহ করা>

নীতিহীন রাজা ।। রাজিবুল আলম

গরম গরম শেয়ারবাজার
হঠাত্ নামে ধস
হাজার হাজার বিনিয়োগকারী
দিচ্ছে শুধুই লস।


ছাগল যদি হতাম তবে
খেতাম লতাপাতা
মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে
খাচ্ছি লাথিগুঁতা।

দাম বেড়েছে সিন্ডিকেটে
রাজনীতিবিদ কয়
বিরোধী দল দায়ীরে ভাই
সরকারি দল নয়।

রাজা আছে ঠিকঠাক
নীতি গেছে হারিয়ে
নীতিহীন রাজা আজ
চলে হামাগড়িয়ে।

সূত্র: আমার দেশ

গরমের গরম ছড়া ।। আমানত উল্লাহ সোহান

গরমের বেহাল দশা
ঝরছে গায়ের ঘাম,
আরো গরম হচ্ছেরে ভাই
জিনসপাতির দাম।


শেয়াবাজার গরমেতে
চান্দি গরম হয়,
এতো গরম সইবো কেমনে
লাগছে ভীষণ ভয়।

গরম! গরম লাগছেরে ভাই
ডিজিটালের হাওয়া,
আরো গরম হচ্ছে মানুষ
খেয়ে পুলিশের ধাওয়া

সূত্র : আমার দেশ

ঠেলা সামলা ।। ইয়াসির মারুফ

পড়ছে গরম
বৈশাখী ঝাঁঝ
ওলটপালট
সমস্ত কাজ।
রাজনীতিও


উঠছে তেঁতে
ঘূর্ণি গতি
চায় সে পেতে।
আম জনতা
কোথায় যাবে?
স্বস্তি আরাম
আদৌ পাবে?

পড়ছে গরম
বাজার গরম
ভোগান্তি চোট
মাত্রা চরম।
এমন ঠেলা
সামলাবে কে?
তার ঠিকানা
এক্ষুনি দে।

সূত্র : আমার দেশ

ডিজিটাল ।। সাকিব হাসান

গাঁও-গেরামে বসত করে
দেখছি কি যে হায়,
যখন তখন নানান ছুতোয়
কারেন্ট চলে যায়।
ঝড়-বৃষ্টি আসতে দেখে
নামে আঁধার কালো,
ইচ্ছে করে কোরাস ধরি
বেশ করেছো ভাল।
সাঁঝের আগেই আঁধার নামে
ডাকে ঝিঁঝি পোকা,
টেবিলেতে বইটা নিয়ে
বসে না আর খোকা।
মনের মাঝে প্রশ্ন জাগে
এই যদি হয় হাল,
কেমন করে দেশটা আমার
হবে ডিজিটাল?

সূত্র : আমার দেশ

গরমের মশারি ।। সিফাত

গরম এলেই ঝামেলা বাড়ে, সেটা আমরা সবাই জানি। ঝামেলা বাড়ে সেটা বড় কথা নয়, গরম আছে বলেই আজ আমার লেখা ভিমরুলে। আসল কথায় আসা যাক। সেদিন স্কুলের ছাদে বসে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আড্ডার বিষয় ছিল কে, কখন, কীভাবে খাট থেকে পড়ে গেছি। সবাই মজার মজার কথাই বলল, আসলে আমি অপেক্ষা করছিলাম তুষারের কথার অপেক্ষায়। কারণ ওর কথা বলার স্টাইলটা অন্যরকম। যে কথাই বলুক না কেন, সেটার সঙ্গে অভিনয় করে দেখানোর চেষ্টা করে।
আমরা ছাদের এমন একটা জায়গায় বসেছিলাম, যেখান থেকে অভিনয় করে দেখালে যে অনেক সুন্দর এক ঘটনার অবতারণা অবশ্যই ঘটবে, সেটা আমার জানা। সবার শেষে বসার কারণে তুষার শুরুও করল শেষে। গরমকাল বুঝতেই পারছেন, মশারি ছাড়া তো ঘুম হারাম। একই বিছানায় মশারি টানিয়ে ঘুমাতে গেল তুষারের মেজো কাকা। তুষার আর তার একমাত্র কাজিন শুভ্র। শুভ্র বেশি নড়াচড়া করে বলেই তুষার তার মেজো কাকাকে মাঝখানে রাখল। রাত গভীর হতে না হতেই শুরু হলো শুভ্রর নড়াচড়া আর হাত-পা ছোড়াছুড়ি। আর এর সবকিছু অভিনয় করে দেখিয়ে দিচ্ছে তুষার। ওর কাজিনটা অর্থাত্ শুভ্র নড়াচড়া করতে করতে ঘুমের ঘোরে এমন ধাক্কা লাগাল ওর মেজো কাকাকে। আর নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুযায়ী ওর মেজো কাকা গিয়ে ধাক্কা দিল তুষারের গায়। আর সঙ্গে সঙ্গে মশারি শুদ্ধ একেবারে খাট থেকে নিচে। তুষার কিন্তু এসব বলছে অভিনয়ের সঙ্গে। যখন সে অভিনয় করে দেখাচ্ছে কীভাবে সে মশারিসহ খাট থেকে নিচে পড়েছে, তখনই সে পেছন দিকে একেবারে নর্দমায় গিয়ে পড়ল। ছাদের ওপর থেকে। তখন আমাদের সে কী হাসি! নিচে নেমে দেখি নর্দমার পচা পানিতে হাবুডুবু খাচ্ছে সাঁতার না জানা আমাদের তুষার। কারণ একটাই, গরমের মশারি!

অভিশাপ ।। কাজী নজরুল ইসলাম

যেদিন আমি হারিয়ে যাব,
বুঝবে সেদিন বুঝবে,
অস্তপারের সন্ধ্যাতারায়
আমার খবর পুছবে-
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

ছবি আমার বুকে বেঁধে
পাগল হয়ে কেঁদে কেঁদে
ফিরবে মরু কানন গিরি,
সাগর আকাশ বাতাস চিরি'
যেদিন আমায় খুঁজবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

স্বপন ভেঙে নিশুত্ রাতে
জাগবে হঠাৎ চমকে,
কাহার যেন চেনা-ছোওয়ায়
উঠবে ও-বুক ছমকে,
জাগবে হঠাৎ চমকে!
ভাববে বুঝি আমিই এসে
ব'সনু বুকের
কোলটি ঘেঁষে,
ধরতে গিয়ে দেখবে যখন
শূন্য শয্যা! মিথ্যা স্বপন!
বেদনাতে চোখ বুজবে
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

গাইতে ব'সে কন্ঠ ছিড়ে
আসবে যখন কান্না,
ব'লবে সবাই -
"সেই যে পথিক,
তার শেখানো গান না?"
আসবে ভেঙে কান্না!
প'ড়বে মনে আমার সোহাগ,
কন্ঠে তোমার কাঁদবে বেহাগ!
প'ড়বে মনে অনেক ফাঁকি
অশ্রু-হারা কঠিন আঁখি
ঘন ঘন মুছবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

আবার যেদিন শিউলি ফুটে
ভ'রবে তোমার অঙ্গন,
তুলতে সে-ফুল গাঁথতে মালা
কাঁপবে তোমার কঙ্কণ -
কাঁদবে কুটীর-অঙ্গন!
শিউলি ঢাকা মোর সমাধি
প'ড়বে মনে, উঠবে কাঁদি'!
বুকের মালা ক'রবে জ্বালা
চোখের জলে সেদিন বালা
মুখের হাসি ঘুচবে -
বুঝবে সেদিন বুঝবে!

Tuesday, May 3, 2011

আকাশলীনা ।। জীবনানন্দ দাশ

সুরন্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি,
বোলো নাকো কথা অই যুবকের সাথে
ফিরে এসো সুরন্জনা :
নক্ষত্রের রূপালি আগুন ভরা রাতে ;

ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে ;
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার ;
দূর থেকে দূরে-----আরো দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়ো নাকো আর ।
কী কথা তাহার সাথে? তার সথে!
আকাশের আড়ালে আকাশ
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ :
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে ।

সুরন্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস
আকাশের ওপারে আকাশ ।

তুই কি আমার দুঃখ হবি? --আনিসুল হক

তুই কি আমার দুঃখ হবি?
এই আমি এক উড়নচন্ডী আউলা বাউল
রুখো চুলে পথের ধুলো
চোখের নীচে কালো ছায়া
সেইখানে তুই রাত বিরেতে স্পর্শ দিবি।

তুই কি আমার দুঃখ হবি?
তুই কি আমার শুষ্ক চোখে অশ্রু হবি?
মধ্যরাতে বেজে ওঠা টেলিফোনের ধ্বনি হবি?
তুই কি আমার খাঁ খাঁ দুপুর
নির্জনতা ভেঙে দিয়ে
ডাকপিয়নের নিষ্ঠ হাতে
ক্রমাগত নড়তে থাকা দরজাময় কড়া হবি?
একটি নীলাভ এনভেলাপে পুরে রাখা
কেমন যেন বিষাদ হবি?

তুই কি আমার শুন্য বুকে
দীর্ঘশ্বাসের বকুল হবি?
নরম হাতের ছোঁয়া হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি,
নীচের ঠোট কামড়ে ধরা রোদন হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি
প্রতীক্ষার এই দীর্ঘ হলুদ বিকেল বেলায়
কথা দিয়েও না রাখা এক কথা হবি?
একটুখানি কষ্ট দিবি

তুই কি একা আমার হবি?

পালের নাও ।। জসীম উদ্দিন

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও---
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও |
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে'
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে'!
গুয়ার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘসে' ঘসে',
মামা-বাড়ীর বলব কথা শুনো বসে বসে!
কে যাওরে পাল ভরে' কোন্ দেশে ঘর
পাছা নায়ে বসে আছে কোন্ সওদাগর?
কোন্ দেশে কোন্ গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে |
কোন্ দেশে হিরামন পাখী বাস করে!
কোন্ দেশে রাজ-কনে খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম্-সিম্ বায় |
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে যদি সাথে পাই!

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
তোমার যে পাল নাচে ফুলঝুরি বাও |
তোমার যে না'র ছই আবের ঢাকনী
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধনী |
সোনার না বাঁধন্ রে তার গোড়ে গোড়ে
হিরামন পঙ্খীর লাল পাখা ওড়ে |
তারপর ওড়েরে ঝালরের ছাতি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের বাতি |
এই নাও বেয়ে যায় কোন্ সদাগর,
কয়ে যাও---কয়ে যাও কোন্ দেশে ঘর?

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও,
ঘরে আছে ছোট বোন্ তারে নিয়ে যাও,---
চেনা গাঙে সাত ধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কেহেলার---লোকে গেছে বলি |
পারাপার দুই নদী---মাঝে বালুচর
সেইখানে বাস করে চাঁদ সওদাগর |

এ পারে ধুতুমের বাসা ও পারেতে টিয়া---
সেখানেতে যেও না রে নাও খানি নিয়া |
ভাইটাল গাঙ্ দোলে ভাটা গেঁয়ো সোতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোন মতে |

অপেক্ষা ।। শিশিরার্দ্র মামুন

টিটিট-টিটিট করে ঘড়িটি আওয়াজ দিচেছ জানিয়ে দিলো এখন ৬ টা বাজে, আর ঘুম নয় উঠ্ উঠ্! ঘড়িটির এলার্ম বন্ধ করে লেপ থেকে অনিচছা সত্ত্বেও শরীর বের করলাম। ইস্ এ দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গন্ডগোল, ধর্মঘট করেনা কেন? ধর্মঘট হলে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকত, শীতে আরাম করে ঘুমাতে পারতাম। বিছানা ছেড়ে হাত-মুখ ধুয়ে জামা কাপড় পড়ে ক্লাশে যাওয়ার জন্য তৈরি হচিছ এমন সময় টেলিফোনের চিৎকার,
আমাকে ধর আমাকে ধর। বুকটা কেঁেপ উঠলো। এতো সকালে সাধারণত জার্মানির কোথাও হতে কোন ফোন আসে না। অবশ্য সকাল বেলা মাঝে মাধ্যে ফোন আসে আমার প্রিয় বাংলাদেশ থেকে। তাহলে দেশে কি কারো কিছু হলো? গত সপ্তাহে দেশে কথা বলেছি। বাবার শরীর ভাল নেই, হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। তাহলে বাবার কিছু হলো নাকি? এক ধরণের চাপাভয়ে, উত্তেজনায় রিসিভারটি তুললাম, ওপার থেকে ভেসে এলো ‘হ্যালো অপু, ঈদ মোবারক!
গলা শুনে বুঝে গেছি এটা রোমানের ফোন।
কিছুটা বিস্ময় প্রকাশ করে বললাম, আজ ঈদ নাকি?
হ্যাঁ স্যার, আজ ঈদ। তা কখন আসছিস্ নামাজ পড়তে বাঙ্গালি মসজিদে?
দোস্ত  ঈদ মোবারক। না-রে আসতে পারবো না, আজ হোম টিউটোরিয়াল পরীক্ষা আছে।
বলিস কী, আজও কলেজে যাবি?
হ্যাঁ-দো¯ত, না গিয়ে উপায় নেই। আজকের পরীক্ষার জন্য গতকাল অনেক রাত পর্যšত পড়াশুনা করে প্রস্তুতি
নিয়েছি, তাছাড়া শালার প্রফেসর বড় বদমাশ, পরে আর নিতে চাইবে না, ঝামেলা পাকাবে।
ঈদের নামাজের চেয়ে তোর পরীক্ষা বড় হয়ে গেল?
এর উত্তর আমি দিতে পারলাম না। মনে মনে বললাম, প্রবাসে এসে ঈদের সঙ্গা কি, ঈদ কাকে বলে, ভুলে গেছি। ঈদ নামের আনন্দময় শব্দটির সাথে আমার যেন আঁড়ি সম্পর্ক!
তা হলে ক্লাশ শেষে বাসায় চলে আসিস ! ইকবাল, রাজু, লাবলু, আরিফ, জালাল ওরা সবাই নামাজের পর বাসায় আসবে। খুব মজা হবে, তাড়াতাড়ি এসে পরিস্।
নামগুলো শুনে আমার এখনই ফ্রাঙ্কফুর্টে রোমানের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে। নিশ্চয়ই ইকবাল আজ স্পেশাল রান্না করবে। আহা! কতদিন দেশী খাবার খাই না, কতদিন ওদের সাথে আড্ডা দেই না, তাস খেলতে বসে হৈ চৈ করি না, কতকাল বারে বসে সবাই মিলে মাতাল হই না! আমি ওদের কাছ থেকে তিরিশ কিলোমিটার দুরে থাকি, অথচ বছরে মাত্র তিন চার বার আমাদের সাথে দেখা হয়।
না দোস্ত , বিকালেও আসতে পারবো না, বিকালে আমার কাজ, কাজ শেষ করে ঘরে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে ।
আমার কথায় রোমান রাগ করে রিসিভারটি খট্ করে রেখে দিল। মনটা প্রচন্ড খারাপ হয়ে গেল। শালার এই এক চুতিয়া জীবন! আজ ঈদ, রোমানরা ও অন্যান্য প্রবাসী বাঙালিরা সব কষ্ট ভুলে আজ সবাই ক্ষণিকের জন্য সব কষ্ট ভুলে গিয়ে আনন্দফুর্তী করবে, আর আমি...? আমি যন্ত্রের মত ছুঁটতে থাকবো সারাদিন, উদ্ভ্রাস্তের মতো একা থাকবো সারাদিন, এখানে এই তো জীবন!
      প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে বাসা থেকে বেরলাম হতে। পথে পা দিতেই দেখি তুষার বৃষ্টি। তা দেখেই মনটা ভাল হয়ে গেল। ইউরোপের এই একটি জিনিষই আমার খুবভাল লাগে। ভয়ঙ্কর ভাল লাগে! আমি হেঁটে বাসষ্টেশনের দিকে যাচ্ছি আর সাদা কুঁচি কুঁচি তুষার পাপড়ি আমাকে ঢেকে দিচ্ছে। আচ্ছা প্রকৃতি মাতা কি আমাকে ঈদের জামা উপহার দিল? বাসে বসে দেশের কথা মনে পড়লো। ঈদের এক সপ্তাহ আগে আব্বা আমাদের ঈদের নুতন জামা কাপড় কিনে দিতেন। আমার ভাই বোনেরা কিংবা আমার বন্ধুরা তাঁদের জামা কাপড় কাউকে দেখাতো না। দেখালে নাকি পুরাতন হয়ে যাবে। অথচ আমি নতুন জামা আনার পরপরই পরে ঘুরে বেড়াতাম। একবার গায়ে চাপালে আর খুলতাম না। সুতরাং ঈদের দিন সকালে আবার নতুন জামার জন্য কান্নাকাটি, কান্নায় লাভ হতো। আম্মা আলমারী থেকে আমার জন্যে এনে রাখা নতুন আর একটি সার্র্ট বের করে দিতেন। তারপর ঘুরতাম সব আÍীয়স্বজনের বাড়িতে। পকেট ভরে যেত নতুন এক টাকার নোটে। আহাঃ কত মজা ছিল সেই দিনগুলো। এসব কথা ভাবছি আর তখনই বাস এসে থামলো আমাদের কলেজের সামনে।
করিডোর দিয়ে হাঁটছি, পেছন থেকে অপু ডাক শুনে ফিরে তাকালাম, দেখি সান্ড্রা। এই মেয়েটিকে দেখলেই আমার বুঁকটা যেন কেমন করে উঠে, আমি তীব্র এক আকর্ষণ অনুভব করি। কিন্তু কখনোই তাকে বলা হয়নি। আমি কোন মেয়ের সাথে কথা বলি না, এ নিয়ে মেয়ে মহলে আমাকে সমকামী বলে অনেক নষ্ঠকথা হয়! কারণ আমি শুধুই ছেলেদের সাথে কথা বলি, ছেলেদের সঙ্গ পছন্দ করি। আসলে মেয়েদের সাথে কথা বলতে কেন জানি আমার একটা জড়তা আছে। দেশে আমি ঠিক ওভাবে বেড়ে উঠিনি, একটা দরুত্ব ছিল।
গুটেন মরগেন অপু, সান্ড্রা বলল।
মরগেন সান্ড্রা।
সান্ড্রা আমার শরীর ঘেষে দাঁড়ালো। ওর শরীর থেকে ভেসে আসছে মিষ্টিগন্ধ, আহা এই সুগন্ধীর গন্ধে নেশা লেগে যাচ্ছে। যদি ওর বন্ধু থাকতো তাহলে এক্ষুণি জড়িয়ে ধরে চুমু খেত! আচ্ছা ওভাবে মুখের ভিতর মুখ গুজে চুমু খেতে কেমন লাগে? আমারও খেতে খুব লোভ হয় । পিপাসিত চোখ আমার উড়ে যায় সান্ড্রার গোলাপি  ঠোঁটে..!
তখনই ও বলল, তোমার প্রস্তুতি কেমন?
মোটামুটি।
অপু, তোমার চোখ লাল কেন ? গতকাল বুঝি অনেক রাত পর্যন্ত পড়েছ ? বলে চলল সান্ড্রা...
এর উত্তর না দিয়ে আমি হাসলাম ওর দিকে তাকিয়ে। অতঃপর আমরা তিনশো এক নম্বর রুমের দিকে
হেঁটে যাচ্ছি, দেখি ওখানে দাঁড়িয়ে আছে ডেভিড, নিনা, ইউখেন ও অন্যান্য সহপাঠী বন্ধুরা।
প্রফেসর হেলমুট ডুস প্রশ্নপত্র নিয়ে এলেন। আমরা যে যার নিজ জায়গায় বসলাম। ছোট বেলা হতেই আমার একটি জঘন্য অভ্যাস, হলে ঢুকেই আমার হাত-পা কাঁপতে থাকে। প্রশ্ন পাওয়ার আগ পর্যন্ত চোখ বুজে আলাহ্র নাম জপতে থাকি। প্রশ্ন পেয়ে খুব খুশী, খুশী মনে লিখতে যাচ্ছি, তখন দেখি কিছই লিখতে পারছি না। সব ভুলে গেছি। কষ্টে কান্না পাচ্ছে। লেখা বন্ধ করে বসে আছি। চুপচাপ কিছুক্ষণ বসে থাকি, বোতল থেকে পানি পান করি, অতঃপর আবার লেখা শুরু করি। দেখি ভালভাবেই সব উত্তর লিখতে পেরেছি। খাতা জমা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। ক্যাম্পাসের কেন্টিনের দিকে যাচ্ছি। ঠান্ডায় শরীর জমে যাচ্ছে, কফি খেতে হবে। কফি হাতে কেন্টিনের কোনার টেবিলে বসি। আবার আমাদের ক্লাশ শুরু হবে দেড়টায়। কেন্টিনে বসে আমি, ডেভিড, ইউখেন, বেনি, নিনা, মার্কোস আড্ডা দিচ্ছি, এমন সময় সান্ড্রা এসে বলল, অপু, ঈদ মোবারক!
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। জার্মান মেয়ে আমাকে বলছে ঈদ মোবারক। কিছুক্ষণ কথা আসে না মুখ দিয়ে। হতভম্ভ ভাব কাটিয়ে আমি হেসে জিজ্ঞাসা করলাম তুমি জানলে কোথা থেকে ?
সান্ড্রা বলল, আলীর কাছ থেকে।
ডেভিড বলল, ঈদ মোবারক কি?
আমি বললাম, এটি একটি খাবারের জিনিষ, একটু তেতোঁ, তুই কি খেতে চাস?
না, কেক কিংবা রুটি বা তোদের কারি হলে একটু খেয়ে দেখতাম।
ডেভিড আবার বলল,  প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে, কিন্তু টাকা নেই ।
আমি ডেভিডকে বিশ মার্ক দিলাম কেক আনার জন্য, শত হলেও আজ ঈদের দিন, একটু মিষ্টি মুখ করি। ডেভিড খুশী হয়ে কেক আনার জন্য উঠে গেল, তখনই আলী হেলেদুলে আসছে আমাদের টেবিলের দিকে। ও দুর থেকে চিৎকার করছে- দোস্ত, ঈদ মোবারক! ও এসে কোলাকুলির জন্য জড়িয়ে ধরেছে, আমিও খুশীতে আলীকে জড়িয়ে ধরলাম।
তারপর আলীকে জিজ্ঞেস করলাম, তুই আজ পরীক্ষা দিলি না কেন?
আলী বলল, আরে শালা রাখ তোর পরীক্ষা! চাদু তোমার মত আমি ভাল ছাত্র না যে, বই ছাড়া  আমার আর অন্য কোন জীবন থাকবে না। পরীক্ষা গেলে পরীক্ষা পামু, মাগার ঈদ গেলে আর ঈদ পামু না, বলে হাসতে লাগলো আলী।
তা এতক্ষণ কোথায় ছিলি?
সকালে গিয়েছিলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট মস্জিদে নামাজ পড়তে, নামাজ শেষ করে মামার বাসায়, তারপর সেখান থেকে এখানে তোর সাথে দেখা করতে এলাম।
আজ ঈদ  তুই আমাকে গতকাল বলিসনি কেন?
চাদু তোমাকে গতকাল কয়েকবার ফোন করছিলাম, তুমি বাসায় ছিলে না। তারপর চাঁন রাইত বানাইবার গেলাম বারে, আমি, হানেস, মিশাইল ..। মদ গিলতে গিলতে সে কী রঙীন অবস্থা হয়েছিলাম দোস্ত! তারপর ভোর চারটায় বার থেকে বেরিয়ে ....
থাক, আর বলতে হবেনা, বুঝতে পেরেছি। এই বলে আলীকে থামিয়ে দিলাম।
সান্ড্রা বলল, আচ্ছা অপু তোমরা এই দিনে কি কর?
আলী ঝটপট এর উত্তর দিয়ে দিল। মনে হলো আলী জার্মানির কোন তথ্য বিভাগীয় কর্মকর্তা, সব কিছুর তথ্য দেওয়াই যেন তার প্রধান কাজ। আলী তা ভাল মতই পালন করলো ।
ইস্ আলীর জীবনটা কত মজার। ও চার বছর যাবৎ জার্মানিতে আছে। কিছুদিনের মধ্যে নিনাকে বিয়ে করবে। আলী সেমিষ্টারের পর সেমিষ্টার ড্রপ দিচ্ছে। দেশ থেকে, আমেরিকা  থেকে টাকা আনাচ্ছে আর ইচ্ছে মত তা উড়াচ্ছে । আমার দেখা মতে ও-ই একমাত্র বিদেশী ছাত্র, কাজ করে না। আর আমি জীবনের আনন্দকে তালাক বিসর্জন দিয়ে লক্ষী ছেলের মত ঠিকমত ক্লাশ করছি। ক্লাশের পর কাজ করচ্ছি। ছুটির দিনগুলো আড্ডা না মেরে রেষ্টুরেন্টের বাসন মাজি, হাতে দাগ পড়ে গেছে।
আমার উপর নির্ভর করে আছে গোটা পরিবার ভাই-বোন, মা-বাবা। বাবা আর ক’দিন পর রিটায়ার্ড করবেন। মা তাকিয়ে আছেন আমার দিকে, কবে পড়ালেখা শেষ করে সংসারের হাল ধরবো। ছোট ভাই-বোনেরা খুব আশা নিয়ে বেসে আছে পড়াশুনা শেষ হলে ভাইয়া  চাকুরী পাব, তখন সংসারের চেহারা বদলে যাবে। আর চৈতী অপেক্ষা করছে কবে আমি দেশে ফিরবো, কবে ওকে বউ করে ঘরে তুলবো? প্রতিটি চিঠির একই কথা, একই ভাষা, আমি যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা কোন ব্যবস্থা করি। ওর পরিবার ওর বিয়ের জন্য  উঠে পড়ে লেগেছে। কিন্তু আমি স্বান্তনা দিয়ে চিঠি লিখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছি না চৈতীর জন্য। জানিনা চৈতীকে আদৌ বউ করে ঘরে তুলতে পারবো কি না। আমার উপর আশা করে আছেন বৃদ্ধ বাবা। তাঁর চার মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। ছোট ভাইটার একটা ব্যবস্থা করতে হবে, বাজে ছেলেদের সাথে মিশে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বাবা-মা প্রতিটি চিঠিতে লিখেন ওকে নেয়ার একটা ব্যবস্থা করার জন্য। কিন্তু তাঁদের বুঝাতে পারি না আমি কাজ করে কত টাকা পাই? তা থেকে দেশে পাঠাই, এখানে আমার চলতে হয়। এদিকে আলী আমাকে প্রতিদিন সবক দিচ্ছে, বড় ছেলে হিসেবে তোর অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং সবক দিচ্ছে ঐ সব চৈত্রী ফৈত্রী ভুলে এখনো সময় আছে সাদা গাভীর গলায় ঝুলে পড় ....!
ঐ শালা কি ভাবছিস ? আলী বলল।
আলীর কথায় হুস্ ফিরে এলো আমার, আমি ওখানে ছিলামই না, তারপরও বললাম, কিচ্ছু না।
কিন্তু কিছুতো একটা ভাবছিস, তোর কি দেশের কথা মনে পড়ছে অপু?
এ প্রশ্নের আমি কোন উত্তর করলাম না, শুধু ওর মুখের দিক থেকে আমার চোখ সরিয়ে নিলাম।
অপু, তুই একটা আজব প্রাণী! এতদিন হলো এখনো তুই দেশের কিছুই ভুলতে পারলি না।
আ-রে আমি যে, বাঙ্গাল- কথাটা বলেই আমি হেসে ফেললাম। আমার কথায় আলীও হাসলো।
আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে ডেভিড বলল, চল্ ক্লাশের সময় হয়ে যাচ্ছে
আমরা উঠতে যাচ্ছি তখনই সান্ড্রা বলল, অপু আজ সন্ধ্যায় আমরা এক সাথে খেতে যাব, তোমার সময় আছে তো?
আমার আগেই আলী উত্তর করলো, সময় থাকবে না মানে! আলবৎ সময় আছে। অপুর সবতো ..  ..
আমি বললাম, ধন্যবাদ নিমন্ত্রণের জন্য। কিন্তু আমি দুঃখিত তোমার সাথে যেতে পারবো না বলে, কারণ বিকালে আমার কাজ।
তুমি কোথায় কাজ কর?
ক্যাফে কোয়ানতোতে।
কটা পর্যন্ত কাজ?
রাত দশটা পর্যন্ত।
ঠিক আছে আমরা না হয় রাত সাড়ে দশটায় যাব।
কাজ শেষ করে তাজমহল রেষ্টুরেন্টে চলে এসো, আমি তোমার জন্য ওখানে অপেক্ষা করবো।
উত্তরের অপেক্ষা না করেই সান্ড্রা চলে গেল বৃষ্টির মতন এক ঝলক হাসি ছিটিয়ে ....
আলী তড়িৎ বললো, দোস্ত, ঈদের দাওয়াত খেয়ে আয়, তাছাড়া চমৎকার মাল, দেখলেই শরীর গরম হয়ে যায়!
দেখলে যখন তোর এরকম অবস্থা তা, তুই-ই ঝুলে পড় আলী।
না দোস্ত, সেই চান্স আমার ভাগ্যে নেই! দেখ সব কথা বললাম আমি আর দাওয়াত করলো তোকে। কমিনের পিছে অনেক ঘুরছি, একদিন ক্যফেও নিছিলাম, মাগার চুমা খাইতে পারি নাই এটা একটা দুঃখ দোস্ত! সে তোর দিকে পেখম মেলেই আছে। দোস্ত, কাজের থেকে আজ একটু আগে ছুটি নিস্। বিটে দোস্ত, মিস্ করিস না।
মনে মনে বলি, না, মিস্ করবো না মোটেও!
সান্ড্রার চলে যাওয়া পথের দিকে
চলে যাওয়া পায়ের দিকে
অনাবৃত জঙ্ঘা
গম্ভীর উরুর দিকে
চওড়া পিঠের উপর
লুটিয়ে পড়া সোনালি চুল
সর্বনাশী নিতম্বের দিকে তাকালো অপু,
ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসছে তার চোখ,
অস্তিত্বের মধ্যে দুরের ঘন সবুজ বন থেকে
গল গল করে নামতে লাগলো রাত
এখন শুধু অপেক্ষা ....

সূত্র: নতুনদেশ

ক্লিওপেট্রার প্রেম ।। দর্পণ কবীর

বৃটিশ মিউজিয়ামে প্রবেশ করতেই সেই অদ্ভূত সুগন্ধীর ঘ্রাণ পেল শাকিব। এই ঘ্রাণ ওর ভীষণ চেনা। এই অদ্ভূত ঘ্রাণ ও টের পায় শুধু সামিয়া ওর সামনে এলে। মিষ্টি ও মাদকতাপূর্ণ ঘ্রাণ। এর যেন সম্মোহনী শক্তি আছে। সামিয়া ওর সামনে এলেই ও সব সময় কেমন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যায়। সম্মোহিত হয়ে পড়ে। অপরূপা সামিয়ার ধাঁধানো সৌন্দর্যের সামনে যে কেউ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু শাকিব ওর শারীরিক সৌন্দর্যের জন্য মন্ত্রমুগ্ধ হয় না। ও মুগ্ধ হয় ওর শরীর থেকে বের হয়ে আসা ঐ অদ্ভূত ঘ্রাণের জন্য।
এই ঘ্রাণ শাকিবকে বুঁদ করে ফেলে। মাতাল করা গন্ধটা কিসের এই প্রশ্ন ও অনেকবার সামিয়াকে করেছিল। শুধু একদিন এর জবাবে সামিয়া দুচোখে রহস্য ছড়িয়ে বলেছিল, আমার শানিত যৌবনের অপার সৌন্দর্যই হচ্ছে এই ঘ্রাণ। বলতো পারো এটাই আমার সৌন্দর্যের ফাঁদ।’
ফাঁদ! এই ফাঁদ কেন? কখন পাতো এই ফাঁদ?
এর জবাবে অনেকক্ষণ হেসেছিল সামিয়া। বলেছিল,
বিশেষ একটা দিনে আমার শরীরের লোমকূপ থেকে এই মিষ্টি গন্ধটা বের হয়ে আসে। আর ঠিক এই দিনটিতেই আমি তোমার কাছে ছুটে আসি। এই গন্ধ ঐশ্বরিক।
এ পর্যন্ত বলে সামিয়া হাসির উচ্ছ্বাসে ভেঙে পড়েছিল। সামিয়া প্রায় সব কথাতেই রহস্য থাকে। কিংবা বলা যায় ও রহস্য তৈরি করে কথা বলে। একটু গভীর চিন্তা করে বললে বলতে হয়, সামিয়া নিজেই বড় একটা রহস্য। গভীর রহস্য। ওর কোন রহস্যই উদঘাটন করতে পারে না শাকিব। আর শাকিবকে রহস্য থেকে আরো গভীর রহস্যে ঠেলে দিয়ে সামিয়ারও খুব যেন আনন্দ। এই যে শাকিব আজ বৃটিশ মিউজিয়ামে এসেছে, সেটাও সামিয়ার তৈরি করা এক বড় রহস্য উদঘাটনের জন্য। এক অবিশ্বাস্য গল্পের ফাঁদে পড়ে ও নিউইয়র্ক থেকে লন্ডন চলে এসেছে। এই গল্পের শুরু কিংবা শেষ অথবা সামিয়ার সৃষ্টি রহস্য উন্মোচনে যে কোন সূত্রের সন্ধান পেতে চায় ও। অন্তত একটি সূত্র ও চায়।

সামিয়া কে, কোথায় থাকে? এই প্রশ্নের জবাব ও কখনো শাকিবকে দেয়নি। অথচ গত তিন বছরে তিনবার সামিয়া ওর সঙ্গে দেখা করেছে এবং সারাদিন ও শাকিবের সঙ্গে থেকেছে। বছরের বিশেষ একটা দিনে সামিয়া চলে আসে শাকিবের কাছে। এই দিনটি হচ্ছে ১৪ই ফেব্রুয়ারি ভ্যালাইনটাইন ডে। অন্য আর কোনদিন সামিয়া ওর সঙ্গে দেখা করে না। পুরো বছর ওদের মধ্যে কথা বার্তা চলতে থাকে ই-মেইলে। কখনো কখনো চ্যাট করে সময় কাটায় ওরা। চ্যাটরুম থেকেই ওদের পরিচয় এবং বিশেষ সম্পর্ক তৈরি। তিনবছর আগে ভেলেনটাইন ডেতে সামিয়া হঠাৎ শাকিবের সামনে এসে দাঁড়ায়। পরের বছরগুলোতেও এই দিবসে সামিয়া চলে এসেছিল শাকিবের কাছে। প্রথম বছর শাকিব কিছু না বললেও গত দু বছরে বিভিন্ন সময়ে ও অনেকবার সামিয়ার সঙ্গে দেখা করার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু সামিয়া রাজী হয়নি। চ্যাটরুমে অনেকবার প্রশ্ন করেছে শাকিব। জবাবে শুধু একদিন বলেছে, আমি শুধু একদিনই দৃশ্যমান হতে পারি। আর সেই দিনটি হচ্ছে ১৪ ফেব্রুয়ারি
এ কেমন রসিকতা!
রসিকতা নয়,সত্যি
অন্যদিনগুলোতে তুমি কী করো?
আমি মমি হয়ে থাকি।
কি!
মমি! মমি হয়ে থাকি।
তাহলে এই যে আমার সঙ্গে চ্যাট করছো!
তোমার সঙ্গে চ্যাট করছে আমার আত্মা। দৃশ্যমানে আমি মমি হয়ে আছি।
ওফ্! সবসময় তোমার রহস্য!
সামিয়া খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে। ওর রহস্যময় কথার অর্থ খুঁজে পায় না শাকিব। এবার ভেলেইনটাইন ডে এগিয়ে আসতেই সামিয়ার ই-মেইল পেয়ে চমকে যায় শাকিব। সামিয়া জানায় এবার ভেলইনটাইন ডেতে শাকিবকে আসতে হবে লন্ডনে। বৃটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত ক্লিওপেট্রার মমির সামনে ওকে অপেক্ষা করতে হবে। এখানে সামিয়া দেখা করবে ওর সঙ্গে। এই ই-মেইল পেয়ে শাকিব অবাক হলেও একটা বিষয় ও নিশ্চত হয় যে, সামিয়া লন্ডনে থাকে। ও ভাবে, রহস্যময় সামিয়ার পরিচয়ের একটা সূত্র হয়তো পাওয়া গেল।

শাকিব বরাবরই অনুসন্ধানী। রহস্যের বেড়াজালে ও আটকে থাকতে চায় না। বৃটিশ মিউজিয়ামের বিশালত্ব কিংবা বিষয় বৈচিত্রের অহংকার এতোই দ্যুতিময় যে, মহাকাল যেন এখানে এসে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। মিউজিয়ামে ঘুরতে ঘুরতে শাকিবের তা-ই মনে হয়। সামিয়ার শরীরের ঐশ্বরিক ঘ্রাণ ওকে মাতাল করে টেনে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। শাকিব টালমাটাল হয়ে হাঁটছে। ও এক সময় চলে আসে ক্লিওপেট্রার মমির সামনে। কিংবা বলা যায় ঐ ঘ্রাণ ওকে টেনে নিয়ে আসে ক্লিওপেট্রার মমির সামনে। এখানে দাঁড়িয়ে ক্লিওপেট্রার নাম অংকিত মমির মধ্যে সামিয়াকে দেখে ভীষণ চমকে ওঠে শাকিব। কাচের দেয়ালে ক্লিওপেট্রার মমি শায়িত। দর্শনৈচ্ছিুকরা ক্লিওপেট্রোর মমি দেখে চলে যাচ্ছে। তারা হয়তো সামিয়াকে দেখছে না। কিন্তু শাকিব স্পষ্ট দেখছে সামিয়াকে। ওর পা নড়ছে না। ও হতভম্ব। বিস্ময়ে চোখ ফেটে যেতে চাইছে। ওর কণ্ঠ খুলছে না। ওর এই বেহাল অবস্থা দেখে হেসে সামিয়া বললো,
তুমি নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছো না, তাইনা?
হ্যাঁ, আমি, আমি..!
আমি জানি, বিস্ময়ের তুমুল ঢেউ তোমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
হ্যাঁ, কিন্তু!
জানতে চাচ্ছো, ক্লিওপেট্রার মমিতে আমি কেন?
হ্যাঁ, হ্যাঁ..!
আমিই ক্লিওপেট্রা। আমিই সেই ঐতিহাসিক সুন্দরী রমণী। শ শবছর যাবত বন্দি হয়ে আছি মমির বেড়াজালে। আবার আমিই তোমার ভালোবাসার সামিয়া।
এ সব কী বলছো!
ঠিকই বলছি, শাকিব।
তুমি আমার কাছে কী চাও?
আমি মুক্তি চাই। মমির দাসত্ব থেকে বেরিয়ে আসতে চাই। আমি তোমার ভালোবাসা চাই। সত্যিকারের প্রেম তোমাকে দিয়ে নিজেকে অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে চাই। আমি ক্লিওপেট্রা নই, আমি সামিয়া হতে চাই!
তাহলে তুমি সামিয়া নও! মানে, তুমি আত্মা! ক্লিওপেট্রার আত্মা!
হ্যাঁ। সামিয়া হচ্ছে আমার কল্পনার নিজের স্বরূপ। আমি যে জীবনটা কামনা করি, সেটাই সামিয়ার জীবন।
কিন্তু..!
শাকিব, আমি সামিয়া হতে চাই। সম্রাজ্ঞী নয়, সাধারণ হতে চাই। আমাকে মুক্ত করো।
এ সময় দু হাতের তালুতে নিজের কান চেপে ধরলো শাকিব। ওর বোধ শক্তি যেন লোপ পেয়ে যাচ্ছে। ওর মাথা ভনভন করে ঘুরছে। ক্লিওপেট্রোর মমি যেন অদ্ভূত শক্তিতে ওকে টেনে জড়িয়ে ধরতে চাইছে। সামিয়া! বলে চিৎকার করে ও সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললো।

শাকিব চোখ মেলে দেখলো ও একটি বিছানায় শুয়ে আছে। ওর সামনে একটি চেয়ারে বসে আছে এক নার্স। নার্স ওর দিকে তাকিয়ে বললো,
গুড ইভিনিং স্যার! আই এম নার্স জেসিকা। হাউ ফিল ইউ, নাউ?
থ্যাংকস। বাট হয়ার এম আই?
ইউ আর ইন লিভারপুল হসপিটাল।
ইজ ইট ইন লন্ডন?
হয়েস, স্যার। টেক রেষ্ট। আই হেভ টু গো। জাষ্ট এ মিনিট, ডাক্তর ইজ কামিং।
ওকে। থ্যাকংস এ লট।
ওয়েলকাম। হ্যাভ এ গ্রেট ডে!
ইউ টু।
ভুবন ভুলানো হাসি বিলিয়ে জেসিকা চলে গেল। শাকিব ভাবতে লাগলো ওর কী হয়েছিল। কেন ও হাসপাতালে। ওর মনে পড়তে লাগলো ক্লিওপেট্রার কথা। এ সময় দরোজা ঠেলে ডাক্তারের পোষাক পরিহিতা সামিয়া ওর রুমে প্রবেশ করলো। সেই মিষ্টি এবং মাদকতাপূর্ণ ঐশ্বরিক গন্ধটা এসে তীব্রভাবে স্পর্শ করলো ওর ঈন্দ্রীয়কে। বিস্ময়ের আরেক ধাক্কা এসে লাগলো। ওর ছানাবড়া চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি হাসি বিলিয়ে সামিয়া বললো,
তোমার নার্ভ এতো দূর্বল, তা জানা ছিল না।
তুমি, তুমি!
সামিয়া। তোমার সামিয়া। বিশ্বাস হচ্ছে না?
সত্যিই তুমি আবার ক্লিওপেট্রা!
হ্যাঁ, বছরের ৩৬৪ দিনই আমি ক্লিওপেট্রা। অর্থাৎ ক্লিওপেট্রার মমি। শুধু একদিন সামিয়া হতে পারি। এই ভেলেনটাইন ডেতে। আজই তো সেইদিন।
তুমি কেন আমার সঙ্গে এই রহস্য করছো? কে তুমি? তুমি কি মানবী? না অপ্সরী? নাকি ক্লিওপেট্রার অতৃপ্ত আত্মা?
এ কথা বলেই চাপা কান্নার মত ককিয়ে ওঠলো শাকিব। সামিয়া আহত কণ্ঠে বললো,
তুমি অমন করো না শাকিব। আর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নামবে। তখন আমাকে চলে যেতে হবে মমির অভ্যন্তরে। এই কয়েকটা মুহুর্ত আমি তোমার পাশে থাকতে চাই।
এ কথা বলে সামিয়া শাকিবের বিছানায় এসে বসলো। ওকে বেপরোয়া মনে হলো। শাকিব কিছু বলতে পারলো না। সামিয়ার গায়ের মিষ্টি গন্ধটা ওকে মাতাল করে ফেলছে। এ অন্য রকম মদিরতা। সামিয়া শাকিবের ডান হাতের কব্জি নিজের দু হাতের মুঠোতে বন্দি করলো। শাকিব মন্ত্রমুগ্ধ। ওর শরীর আজ কাঁপছে। অন্য রকম কাঁপন। সামিয়ার শরীরের ঘ্রাণ তীব্র হতে লাগলো। সামিয়ার চোখে মুখে রহস্যময় হাসি রঙধনুর মত ছড়িয়ে পড়ছে। ওর ঠোঁট প্রবল আবেগে কিংবা অতৃপ্তিতে কাঁপছে। কয়েক মুহুর্ত কাটলো মাত্র। সামিয়া হঠাৎ করে শাকিবের দিকে ঝুঁকে পড়লো। ও ঠোঁট এগিয়ে দিল শাকিবের ঠোঁটের দিকে। একটা ঝড় যেন এগিয়ে আসছে। অসহায় শাকিব ওর ভয়ার্ত চোখ বন্ধ করে ফেললো। 

এক বৃষ্টি ভেজা রাতে ।। সিকদার মনজিলুর রহমান

এক ঝাপটা বৃষ্টি এসে ঘুমটা ভেঙে দিল। বৃষ্টির হাওয়ায় ভেসে আসছে কান্নার এক করুণ সুর। সুরটা আসছিল বড় ভাবীর ঘরের ওদিক থেকে। পরিষ্কার মেয়েলী কণ্ঠের কান্না। গভীর কষ্টে বুকের অনেক ভেতর থেকে উঠে আসা কান্না। এত রাতে এ বাড়ি কাঁদবে কে? ভাবীর বাপের বাড়িতে কোনো দুঃসংবাদ? তাই ভাবী কাঁদছে। না, তাহলে তো দিনের বেলায় শুনতাম!
বেশ একটা কৌতুহলী ভাবনায় পড়ে গেলাম।

জয়গাছি চেয়ারম্যান বাড়ি। আমার ফুফু বাড়ি। আমার ফুপা সফদার তালুকদার আমরণ এই এলাকার চেয়ারম্যান ছিলেন। আমি যখন ক্লাশ এইটে পড়ি সেবার তিনি মারা গিয়েছেন। এলাকায় তার যথেষ্ট সুনাম ও খ্যাতি ছিল। এখনও এ বাড়িটি চেয়ারম্যান বাড়ি বলে পরিচিত। আমার বাপ চাচারা চার ভাই বোন। আমার বাবা সবার বড় তার পর আমার এ ফুফু। এর পরে রয়েছে আমার মেজো ও ছোট চাচা।
মেজো চাচা থাকেন রাজশাহী, তিনি বাংলাদেশ রেলওয়েতে বড় অফিসার ছিলেন রিটায়ার্ট হবার পরে রাজশাহীতে সেটেল হয়েছেন সেখানে স্বপরিবারে থাকেন আর ছোট চাচা থাকেন সৈয়দপুরে। তিনিও রেলওয়েতে চাকরি করছেন। আমরা থাকি গ্রামের বাড়ি টেংরাখালি।
আমার ফুফুর দুই ছেলে তিন মেয়ে। বড় ছেলে, মানে শাকিল ভাই আর্মি অফিসার। জাতিসংঘের আহবানে আšতর্জাতিক বাহিনীর সাথে তিনি আছেন আফ্রিকার লাইবেরিয়ায়। শামীম ছোট ছেলে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজের ডাক্তার, স্বস্ত্রীক থাকেন সেখানে। আর তিন ফুফাত বোন তাদের বিয়ে শাদী হয়ে গেছে। তারা সবাই আমার বড়। একমাত্র ছোট পারুল। তারও বিয়ে হলো বছর খানেক আগে। যে যার মত স্বামী সংসার নিয়ে ভালই আছে।
দু’টো দোতলা ঘরসহ চার পাঁচটে ঘর নিয়ে গ্রামের এই বিশাল বাড়িটায় একা থাকেন আমার ফুফু। একা ঠিক নয়। পৌত্র,পুত্রবধূ ও চার পাঁচজন কাজের লোক রয়েছে তার সাথে। পশ্চিম পাশের দোতালা ঘরটায় ভাবী অর্থাৎ শাকিলের স্ত্রী তার আঠার মাসের এক ছেলে নিয়ে থাকেন। ঠিক অপর দিকের দোতালায় আমি আর ফুফু। আমি মাধ্যমিক স্কুল পাশ করার পরে যখন কলেজের ভর্তি হব ঠিক তখন ফুফু যেয়ে আমার নাম নিয়ে বাবাকে বলল, সে এখন কলেজের পড়বে বাড়ির পাশের কচুয়া কলেজে ভর্তি না করায়ে ওকে নিয়ে আমি বাগেরহাট পিসি কলেজে ভর্তি করে দেই। আমার বাড়িতে আপনজন বলতে তো কেউ নেই ওয়ি থাকবে আমার পাশে।
সেই থেকে আমি ফুফুর কেয়ার টেকার প্লাস লজিং মাষ্টার। ছোট কোনো ফুফাত ভাই বোন নাই যে তাদের পড়াতে হয়। পাড়ার স্কুলগামী ছেলেমেয়েরা আসে মাঝে মধ্যে তাদের নিয়ে বসি। কেউ কোনো পয়সাকড়ি দেয় না। অবৈতনিক টিউটর। বেশ ভালোই আছি ফুফু বাড়ি। খাই-দাই কলেজ করি। বাবার শাসন আর মায়ের বকুনী এখানে অনুপস্থিত। ফুফু আমার ভীষণ আদর করেন। আমার চেহারার নাকি তিনি দাদার চেহারার ছাপ দেখতে পান। তাই তিনি আমায় ডাকেন বা’জান। আমার কলেজের বেতন, বই-পুস্তক, পকেট খরচ সবই বহন করেন ফুফু। বাবার কাছে পয়সা চাইলে উল্টো ধমক দেন তিনি।
ফুফুর বয়স ষাট সত্তরের কাছাকাছি। এই বৃদ্ধা বয়সে উপর নীচ ওঠা নামা করতে কষ্ট হয়। তাই তিনি নীচ তলায় তার এক ননদকে সাথে নিয়ে থাকেন। আমার থাকার রুমটি হয়েছে দোতালায়। ফুফুর ননদ ফুফু সেই মহিলা তিনিও বয়স্ক এবং বিধবা। ছেলেপেলে সব বড় হয়ে গেছে সংসারে কোনো ঝুট-ঝামেলা নেই। বছরের অধিকাংশ সময়ই এখানে থাকেন। মেয়েরা যতই ঘর সংসার করুক না কেন বাপের বাড়ি থাকতে সবাই ভালোবাসে। ফুফুও তাকে ভীষণ পছন্দ করেন। ননদ-ভাবী মিলে বেশ আছেন। এক মহিলা আছে ঘরদোর গোছানো রান্নাবান্না করেন। ফুফু আর শাকিল ভাইয়ের ছেলে দুধ খায়। বাজারে ভেজাল ছাড়া ভালো দুধ পাওয়া যায় না। তাই শাকিল ভাই বড় বড় দু’টো সিন্ধি গাই কিনে দিয়েছেন তাদের জন্য। এ গাই দু’টো দেখা শোনা করার জন্য আবুল হাসেম নামের এক ছেলে আছে। সে প্রায় আমার সমবয়সী।
হাসেম আমার খুব ভক্ত। সারাক্ষণ আমার কাছে কাছে থাকতে পছন্দ করে। আমার সব ফাই ফরমায়েস সে শোনে। আমি তাকে হাসু বলে ডাকি আর সে আমায় ডাকে মাষ্টার’ দা। তার কণ্ঠস্বর ভারী চমৎকার। বিকেলবেলা গরু চড়াতে মাঠে গেলে উদাস কণ্ঠে গান গায়। মাঝে মাঝে আমাকেও গেয়ে শোনায়। “পরের জায়গা পরের জমিন ঘর বানায়ে আমি রই, আমি তো সেই ঘরের মালিক নই।” গানটি সে ভারী দরদ দিয়ে গায়। গানটি যখন গায় তখন তার দু’চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে।
আরেক জন লোক আছে ফুপার দূর সম্পর্কের চাচাত ভাই। একটু হুজুর টাইপের লোক। বাড়ির পাশের মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ান আর বাজারঘাট থেকে শুরু করে সব কিছু দেখাশোনা করেন। খুবই তীক্ষ্ণ চোখের মানুষ। তার চোখ ফাঁকি দিয়ে এই বাড়িতে একটি কুটোও কেউ এদিক ওদিক করতে পারে না। ফুফু তাকে ডাকে বাজার সরকার, আর আমি মুনশী কাকা। শামীম ভাই চেয়েছিলেন ফুফু বরিশাল গিয়ে তার সাথে থাকুন। তিনি গেলেন না। স্বামীর ভিটে ছেড়ে কোথাও তিনি থাকতে রাজি না।
কিছুদিন হলো আরেকটি যুবতী মেয়ে এসে জুটেছে এ বাড়িতে। বড় ভাবীর বাপের দেশের মেয়ে। ভাবী ছেলেটাকে নিয়ে সামলিয়ে উঠতে পারে না। তাই তার মা পাঠিয়েছে মেয়েটাকে। ভাবীর কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাঝে মধ্যে সে ফুফুকেও বিভিন্ন কাজে সাহায্য করে, তার সাথে গল্প করে। ফলে মেয়েটিকে ফুফুও পছন্দ করতে শুরু করেছে।
মেয়েটির নাম মুনিয়া। এ বাড়িতে আসার পর তাকে আমি কয়েকবার দেখেছি। নিঃসংকোচে এদিক ওদিক ছুটছে। মুনিয়া পাখির নামে নাম। তার চাল চলনও পাখির মত। সে যেন হাঁটে না, উড়ে উড়ে চলে। এই এখানে দেখছি পরক্ষণে আরেক খানে। এক্ষণই দেখলাম ভাবীর ছেলেটার ময়লা প্যান্ট নিয়ে পুকুরে গেল পরক্ষণে দেখছি ফুফুর সাথে বসে গল্প করছে। ভারী মিষ্টি মেয়ে।
একদিন দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসু আর আমি গল্প করছি। এমন সময় দেখলাম মেয়েটি কলসি কাঁখে জল নিয়ে ভাবীর ঘরে ঢুকছে। কলসি কাঁখে মাজা দুলিয়ে দুলিয়ে যখন হাঁটছে দারুণ লাগছে তাকে। হাসুকে জিজ্ঞেস করলাম, সুন্দরী মেয়েটি কে রে?
আমার মুখে এমন কথা শুনে হাসু কেমন যেন লজ্জা পেল। গম্ভীর গলায় বলল, ভাবী তো ছেলেটাকে নিয়ে একা একা সামলাতে পারে না, তাই তার মা মেয়েটিকে পাঠিয়েছেন ভাবীর সাহায্যের জন্যে।
হাসুর গলার স্বরটা শুনে বিষয়টা আমার যেন কেমন কেমন মনে হলো। সে কি মেয়েটার প্রতি দুর্বল। নাকি অন্য কিছু? তাই কথাটা আর বাড়ালাম না।
চৈত্র মাস। কাঠ ফাটা রৌদ্দুর। মাট-ঘাঠ ফেটে চৌচির। ক’দিন ধরে আকাশ মেঘ জমে, কিন্তু বৃষ্টি হয় না। গরমে মানুষজন অস্থির। আজও আকাশে বেশ মেঘ জমেছে।
কলেজ থেকে ফিরে ঘাড়ে লুঙ্গি গামছা ও নারকেলের খৈল আর ভাত ভর্তি একটা গামলা নিয়ে পুকুর পাড়ে গেলাম। পুকুর তো না যেন পদ্ম দিঘি। সান বাধাঁনো ঘাট আর চার পাড়ে নানান রকম ফলফুলের গাছপালা। ঘাটলার পাশেই এক ঝাড় রক্তজবা ফুলের গাছ। অনেক জবা ফুটেছে তাতে ফুলের ভারে ডালগুলো নুয়ে পড়েছে পুকুরে। রুই, কাতলা, মৃগেলসহ নানান জাতের পোষা মাছে পুকুর ভর্তি।
কলেজ থেকে ফিরে গোসল করার আগে মাছগুলোকে খাবার দেওয়া আমার একটা রুটিন মাফিক অভ্যাস। আর মাছগুলোও ঠিক এ সময়ে ঘাটে এসে আমার প্রতীক্ষায় চেয়ে থাকে। খাবারগুলো ছুড়ে ছুড়ে দিচ্ছি ঝাঁকে ঝাঁকে মাছেরা এসে মনের আনন্দে খাচ্ছে আর পাখনা মেলে সাঁতার কাটছে। প্রতিদিন এ দৃশ্য আমার কাছে খুবই ভালো লাগে। এমন সময় জবা গাছের ঐদিক থেকে এক ঝাঁক রাঁজহাস এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল পুকুরে আর মাছগুলো সব পালিয়ে গেল।
বাগানের পূর্বদিক থেকে ভেসে আসছে হাসুর গানের সুর, “দোল দোল দোলনি, রাঙা মাথার চিরুনী, এনে দেব হাট থেকে, মান তুমি কর না।” আমি তাকে ডেকে বললাম, হাসু, ও হাসু তোর মনে যে রঙ লেগেছে। কার জন্যে রাঙা মাথার চিরুনী কিনছিস। মুনিয়া এ বাড়িতে আসার পর হাসুর চালচালনে বেশ একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। আগে সে মারফতি, মুশির্দী গান গেত। আর এখন সে প্রায়ই প্রেমের গান গায়। না, না মাষ্টার দা এমনি গাইছিলাম। কার জন্যে আবার কিনব, আমার কে আছে যে তার জন্যে কিনব? মাষ্টার দা আপনি কলেজ থেকে ফিরেছেন? আমি সেই কখন থেকে আপনার প্রতীক্ষায় আছি। একটা মজার খবর আছে।
ঠিক আছে। তুই এদিকে আয় কথা হবে। দেখতো গাছ থেকে ডাব পাড়তে পারিস কিনা। গরমে বুকটা শুকিয়ে গেছে একটা ডাব খেতে পারলে ভালো হতো। গোটা চারেক ডাব নিয়ে হাসু উপস্থিত হলো। দুইজনে ডাব খাচ্ছি। আর গল্প করছি।
হাসু বলল মাষ্টার দা, আজ সন্ধ্যায় হিন্দু পাড়ায় গাজী কালুর পালা গান হবে। আমি যাব, বড় ভাবীর সাথে কথা হয়েছে সেও যাবে। আপনি যাবে আমাদের সাথে?
মুনিয়া ! সেও যাবে?
ধ্যাৎ, মাষ্টার দা। আপনি শুধু মুনিয়া মুনিয়া করেন। আমি কি মাইয়াডারে ইয়ে মানে ভালপাই নাকি?
তা না হলে এত রঙ কিসের? সারাদিন গুণগুণিয়ে রসের গান! ঘন ঘন বড় ভাবীর ঘরে আসা যাওয়া, তারে পটায়ে গান শোনাতে নেওয়া। সে গেলে তো আর একা যাবে না। সাথে তো মুনিয়াকে যেতেই হবে। ঘটনাটি কি?
মাষ্টার দা.......?
সে যেন আরো কিছু বলতে চেয়েছিল। এমন এসয় ঐ দিকে ফুফুর গলা, ও বা’জান, তুই কি সারাদিন মাছের খেলা দেখবি? কলেজ থেকে ফিরেছিস সেই কখন, খাবি না। গোসল করে তাড়াতাড়ি আয়।
আমি আসছি ফুফু । বিকেল থেকে আকাশের মেঘগুলো যেন আজকে বেশ শক্তিশালী মনে হচ্ছে। রেডিওতে খবর দিয়েছে দমকা হাওয়াসহ ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা আছে।
সন্ধ্যার পর পরই হাসু এসে বলল, চলেন যাই। আকাশের অবস্থাটা বেশি ভালো মনে হচ্ছে না। ঝড়-বৃষ্টি আসতে পারে এ অবস্থায় যাবি? এ রকম আজ পনের দিন থেকে দেখা যাচ্ছে। বৃষ্টি বাদল তো হচ্ছে না, আজও হবে না, চলেন যাই। ওদিকে ভাবীদের রেডি হতে বলে এসেছি।
তা হলে যাবি?
হ্যাঁ।
চল।
যেয়ে দেখি বাড়ির উঠানে সামিয়ানা টানায়ে মাঝখানে দু’টো জলচৌকি জোড়া দিয়ে মঞ্চ তৈরী করেছে। হিন্দু মুসলমান অনেক মানুষের সমাগম। চারিদিকে শিশু কিশোরদের হৈ চৈ ছুটাছুটি। জারী-শাড়ি, যাত্রা-পালা, কবি-কিচ্ছা গ্রামের মানুষের কাছে আজও জনপ্রিয় বিশেষ করে বয়স্কদের কাছে। শহরের বড় পর্দায় যারা সিনেমা বায়স্কোপ দেখার সুযোগ পায় না তারা এসব দারুণভাবে উপভোগ করে।
মনে হলো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই পালা শুরু হবে। আয়োজক কর্মীদের দেখা গেল মহাব্যস্ত। দু’জনকে দেখলাম হ্যাজাক লাইটগুলো মাঝে মাঝে পরখ করে দেখছে তা ঠিক ঠাক আছে কি না? যাতে মূল অনুষ্ঠানের সময় কোনো বিঘ্ন না ঘটে। নারী পুরুষদের পৃথক পৃথক আসনের ব্যবস্থা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট এলাকায় তাদের আসন গ্রহণ করার জন্য বার বার মাইক্রোফোনে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে। আসন বলতে খড় বিচালীর উপর হোগলা পাতার চাটাই। কোনো চেয়ার-টেয়ার নেই। অনেকে আবার নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় ছোট ছোট মাদুর বা চাটাই নিয়ে এসেছে। আমাদের হাসু মিয়াও কয়েকটা ছোট ছোট মাদুর নিয়ে গেছে। সেখান থেকে একটা বের করে আমার জন্য আসন পেতে বসতে বলে দ্রুত চলে গেল ভাবী ও মুনিয়ার দিকে। যেহেতু সে আমাদের এখানে নিয়ে এসেছে আমাদের মেহমানদারি করাও যেন তারই দায়িত্ব। উঠানের আশ পাশে ছোট খাট কয়েকটা পান বিড়ির দোকানও বসেছে। হাসু সেখানে থেকে মসলাওয়ালা দু’টো পান কিনে ভাবীকে দিল। আমি পান বিড়ি খাই না সে জানে, তবুও একবার জিজ্ঞেস করল, আমি পান খাব কি না? ভাবীর ছেলেটাকে কোলে নিয়ে মুনিয়া ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসুকে দেখলাম মুনিয়ার কোল থেকে ছেলেটাকে একবার নিয়ে তার সাথে ভাব জমাতে চেষ্টা করছে।
রাত আটটা সাড়ে আটটার দিকে মঞ্চের পর্দা আস্তে আস্তে সরাতে লাগল। বাইরের কোলাহলও সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে এলো।
পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো এক সুদর্শন যুবক। মঞ্চের একেবারে সামনে এসে, শুভ সন্ধ্যা সুধী দর্শকমন্ডলী। এতক্ষণ ধৈর্য্য ও সহিষ্ণুতায় আমাদের সাথে থাকার জন্য সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মঞ্চায়ন করতে যাচ্ছি ঐতিহাসিক রূপকথার লোকগাথা গাজী কালুর অন্তর্গত শাহজাদা জামাল ও শাহজাদী কমলা সুন্দরীর প্রেম বিরহের জীবনালেখ্য “কমলার বনবাস”। মূল অনুষ্ঠানে যাবার পূর্বে এখনই পরিবেশিত হবে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। সঙ্গীতের সম্মানার্থে আশাকরি আপনারা দাঁড়িয়ে নীরবতা পালন করবেন। ধন্যবাদ।
জাতীয় সঙ্গীত শেষ না হতেই উত্তর আকাশ ভেঙ্গে শুরু হলো ঝড়ো হাওয়া সঙ্গে শীলা বৃষ্টি। বাতাসের তোড়ে ধুলা বালি এসে নাক মুখে লাগতে লাগল। ফৎ ফৎ করে সামিয়ানাটা উড়তে লাগল। পণ্ড হয়ে গেল যাত্রা পালা। লোকজন বিভিন্ন ঘরে আশ্রয় নিল। অনেকে সেই ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে যে যার বাড়ির দিকে ছুটল। বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমরাও ছুটলাম আমাদের বাড়ি। এত দিনের গুমোট গরমে পৃথিবী যেন শীতল হয়ে আসল।
বাড়িতে যখন ফিরলাম দেখি ফুফু তখনও ঘুমাননি। তিনি বললেন, হয়েছে তোমার গান শোনা! ঠিক আছে এখন হাত মুখ মুছে শুয়ে পড়। সকালে কলেজ আছে।
ভিজা কাপড়গুলো পাল্টে হাত মুখ মুছে একটা চেয়ার টেনে দোতালার ব্যালকনিতে বসে গভীরভাবে বৃষ্টি দেখছি। বৃষ্টি নিয়ে কত সৃষ্টি, কত গান কত কাব্য। আমি যদিও কোনো কবি সাহিত্যিক নই, তবুও তো আমার একটা মন আছে। তাকে একটু উপভোগ না করে শুতে যাই কি করে?
হয়তো এমনই এক পরিবেশে রবি ঠাকুর লিখেছিলেন, “এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘন ঘোর বরষায়।” আমারও যে মনে পড়ছে সেই মেয়েটিকে, কলেজের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আমি বারান্দার উত্তর দিক থেকে দ্রুত হেঁটে যাচ্ছি ঠিক সেই মুহূর্তে আরেকটি মেয়েও হেঁটে আসছিল অপরদিক থেকে। বারান্দার শেষ মাথায় মোড় নিতেই দু’জনে মুখোমুখি ধাক্কা লাগার উপক্রম। দু’জনেই সরি বলে চলে গেলাম দু’দিকে। পরে একদিন দেখলাম সে আমারই ক্লাশমেট। এরপর তার সাথে দেখা হলেই লজ্জা রাঙা মুখে অন্যদিকে তাকায়। আমিও তার মুখের দিকে তাকাতে লজ্জা পাই। অনেক দিন ভেবেছি, আরেকবার দেখা হলে বলব, সেদিনের ঐ ঘটনার জন্য আমি সত্যিই দুঃখিত। দেখা অনেকবারই হয়েছে কিন্তু আজও তা বলতে পারিনি। আজকের এই বৃষ্টি বাদলের দিনে সেও কি এমন ভাবছে? এমনই ভাবতে ভাবতে বৃষ্টির নৈসর্গিক দৃশ্য দেখছি। কখনও ঝড়ের বেগে কখনও আবার রিম ঝিমিয়ে বৃষ্টি আসে। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। তার ঝলকানিতে অনেক দূর দেখা যাচ্ছে। বাঁশঝাড়গুলো বাতাসের চাপে নুয়ে পড়ছে আবার জেগে উঠছে। এমনি দেখতে দেখতে বৃষ্টি মধুর ঠান্ডা বাতাসে কখন যে চেয়ারে বসে বসে ঘুমিয়ে পড়েছি নিজেও টের পাইনি। টের পেলাম তখন যখন এক ঝাপটা বৃষ্টি এসে ঘুম ভেঙে দিয়ে গেল।
হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত দু’টো। এত রাতে এ বাড়িতে কে কাঁদে! তাও মেয়েলী কণ্ঠে! আরো মনোযোগ দিয়ে শুনতে চেষ্টা করলাম। শব্দটা ভাবীর ঘরের ওদিক থেকে আসছিল।
একি ভাবী; না মুনিয়া? ভাবীর বাপের বাড়িতে কোনো অঘটন ঘটেছে? তাই সে কাঁদছে! তবে কি মুনিয়া? না, তারা তো আমাদের সাথে গান শুনতে গিয়েছিল। এমন হলে তো ভাবী যেত না। তা হলে ব্যাপারটা কি?
তখন অন্য একটা কথা ভেবে গা কাঁটা দিয়ে উঠল। গাঁও গেরামে নাকি রাত বিরাতে কত সব ভূতুরে কাণ্ড ঘটে। নিঝুম রাতে ভূত প্রেতরা নাকি নানা রূপ ধরে কেঁদে কেটে গান গেয়ে কিংবা নানা সুরে ডাক দিয়ে একাকী মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আমার বেলায়ও কি আজ তাহলে তাই ঘটেছে? এই নিঝুম রাতে খোলা বারান্দায় একাকী ঘুমিয়ে আছি দেখে কি তারা কেঁদে কেঁদে আমায় ডাকছে? আমার তাহলে এখন কি করা উচিৎ? ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে শুয়ে পড়ব; নাকি বেরিয়ে দেখে আসব আসল ব্যাপারটা কি? হাসুকে ডেকে নিব। দু’জন একসঙ্গে গেলে কি সে আমায় দেখা দেবে? এসব ক্ষেত্রে শুনেছি যার সঙ্গে দেখা দিতে চায় সে ছাড়া অন্য কেউ গেলে তারা হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। অতএব, হাসুকে নেওয়া চলবে না। যেতে হলে একাই যাব।
সঙ্গে সঙ্গে গা ছম ছম ভাবটা কেটে গেল। বুকের ভেতর জেগে উঠল একজন সাহসী পুরুষ। চেয়ার ছেড়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সন্তর্পণে রুমের দরজা খুলে টেবিলের ড্রয়ার থেকে ফ্লাস লাইটটা হাতে নিলাম। লাইট নিলাম কিন্তু তা জ্বালালাম না। অন্ধকারে পা টিপে টিপে দোতলা থেকে নিচে নেমে এলাম। হাসু থাকে আমাদের ঘরের নিচ তলার একটি রুমে। দেখলাম তার রুমের দরজা বন্ধ। নিশ্চয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সšতর্পণে তার রুমটি অতিক্রম করছি যাতে আমার পায়ের শব্দে সে জেগে না উঠে। তাহলে তো ভেস্তে যাবে আমার ভূত দেখার পরিকল্পনা।
বৃষ্টি তখনও থামেনি টিপ টিপিয়ে পড়ছে তবে ছাতা ছাড়া যাওয়া যাবে। আস্তে আস্তে বড় ভাবীর ঘরের দিকে এগুচ্ছি। দেখতে পেলাম ভাবীর বারান্দার পশ্চিম দিকে একটা শাড়ী নাড়া। শাড়ীটা মাঝে মাঝে বাতাসে উড়ছে তারই আড়ালে মেয়ে মানুষের ছায়ার মতো একটি ছায়া। মাথার চুল ছাড়া। চুলগুলো কোমর পর্যšত ঝুলে রয়েছে। সামনের দিকে এগুচ্ছি একটু একটু ভয়ও পাচ্ছি। কাছে গেলে আমার সাড়া পেয়ে যদি বড় বড় দাঁত বের করে ভেংচি দিয়ে উড়ে আসে আমার দিকে। ফ্লাস লাইটটা শক্ত করে ডান হাতে ধরে রেখেছি সঙ্গে সঙ্গে লাইট ফ্লাস করে দিব ওর মুখে। আলো নাকি তারা সহ্য করতে পারে না। তারপর আবার ফ্লাস লাইটের তীর্যক আলো।
এমন সময় আমার পিছন থেকে হাসুর ডাক, ‘মাষ্টারদা’। পরিচিত কণ্ঠ তবুও কেন যেন অপরিচিত মনে হলো।
ভয়ার্ত ভঙ্গিতে পেছনে ফিরছি, দেখি হাসু। কখন ঘুম ভাঙল তার! আর কখন এভাবে আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে সে!
সে আস্তে করে আমার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, এইদিকে আসেন। আমি ভয়ার্ত গলায় ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারটা কি?
হাসু পরিষ্কার গলায় বলল, কিছুই না। ও যখন কাঁদছে কান্দুক। এইভাবে কাঁদলে মনের দুঃখ হাল্কা হয়। আমাদের দেখলে লজ্জা পাবে। তাই আপনারে সরায়ে আনলাম, সে যাতে কিছু টের না পায়।
কিন্তু ওটা কে?
আপনি চেনেন নি?
নাতো! আমি কি করে চিনব? আগে কি কোনদিন এসব দেখেছি নাকি?
হাসু উদাস গলায় বলল, তাই! সে যে মাঝে মাঝে এভাবে কাঁদে আপনি তা কোনোদিন টের পান নাই। আপনি ভাবছেন ভূত প্রেত! না, সে তা নয়। ও আমাদের মুনিয়া।
মুনিয়া! মানে ভাবীর ঘরে যে মেয়েটা থাকে?
হ্যাঁ।
এইভাবে নিশীত রাতে কাঁদছে কেন?
হাসু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ঘটনাটা বড়ই দুঃখের। এই বৃষ্টিতে ভেজার কাজ নেই। চলেন উপরে যাই।
একটা বদমায়েশের সাথে বিয়ে হয়েছিল মুনিয়ার। মুনিয়ার বাপ গরিব মানুষ। নিজের দুই বিঘা জমি আর গোটা চারেক হালের বলদ দিয়ে নিজের ও অপরের জমি বর্গা চাষ করে। একেবারে স্বচ্ছল না হলেও অস্বচ্ছল পরিবার নয়, সংসার মোটামুটি চলে যায়। মুনিয়ারা পাঁচ ভাই বোন। সে সবার বড়। সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যক্তি একমাত্র তার বাবা। মুনিয়া যখন ক্লাশ ফাইভ থেকে সিক্সে ওঠে তখন তার বাবা অনেক টাকা খরচ করে তাকে বিয়ে দিয়ে দেয়। জামাইকে নগদ কিছু টাকা পয়সাও দেয়। বিয়ের খরচ পোষাতে দু’টো হালের বলদও বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। বছর না ঘুরতেই মুনিয়া এক ছেলে সšতানের মা হয়ে যায়। বদমায়েশ জামাইটা সময় অসময়ে বিভিন্ন অজুহাতে মুনিয়ার বাপের কাছ থেকে টাকা আনতে চাপ দেয়। টাকা না আনলে তার সাথে ঝগড়াঝাটি করে। মাঝেমধ্যে শারিরীক নির্যাতনও করে। একবার আঘাতের চোটে বাম হাতের একটা আঙুল ভেঙে যায়। বিনা চিকিৎসায় আঙুলটি ভাল হলেও বাঁকা হয়ে আছে চিরদিনের জন্য।
গেল মাস তিনেক আগে জামাই একটা রঙিন টিভি কেনার জন্য মুনিয়াকে তার বাবার কাছ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা আনতে বলে। বাপের কাছে সে টাকা চাইতে অপরাগ হলে প্রায়ই তাকে শারিরীকভাবে নির্যাতন করে। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে একদিন ছেলেটাকে নিয়ে বাপের বাড়ি পালিয়ে আসে। জামাই তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে এসে মুনিয়ার কোল থেকে ছেলেটাকে কেড়ে নিয়ে গেছে।
কি বেয়াদব ছেলেরে!
শুধু বেয়াদব নয়, মাষ্টারদা’। ডেঞ্জারাসও। টিভি কেনার ত্রিশ হাজার টাকা না নিয়ে গেলে তাকে তালাক দিবে এবং মুখে এসিড মেরে ঝলসায়ে দিবে হুমকিও দিয়েছে। বাপের বাড়ি থাকা নিরাপদ নয় ভেবে সে এ বাড়িতে পালিয়ে এসেছে। একদিকে সন্তানের মায়া ও অন্যদিকে নিজের জীবনের নিরাপত্তার কথা ভেবে সে মাঝে মাঝে এমন করে রাত বিরাতে কাঁদে।
হাসুর কথা শুনে আমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলাম।
আমি ভাবছি কি আর শুনছি কি? কি দুর্ভাগ্য নিয়ে জন্মেছে আমাদের মুনিয়ারা। দুর্বৃত্তরা তাদের মেরে হাড় গুঁড়ো করে দিচ্ছে, যৌতুকের লোভে লাথি মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে বাড়ি থেকে, কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে কোলের সন্তান, মুখ পুড়িয়ে দিচ্ছে এসিডে কিন্তু মুনিয়াদের পাশে দাঁড়াবার কেউ নেই। থাকলে এভাবে পার পেত না দুর্বৃত্তরা। রাত দুপুরে মনের দুঃখে কাঁদত না আমাদের মুনিয়ারা।
তোর তো মেয়েটাকে ভাল লাগে, তাই না? তাহলে এক কাজ কর তুই তাকে বিয়ে করে ফেল। আমার কথা শুনে সে হো হো করে হেসে উঠলো।
কিরে হাসলি যে?
আরে মাষ্টার দা! আমার ঘর নাই, বাড়ি নাই। পরের বাড়ি কাজ না করলে একবেলা খাবার জোটে না। এ পরিস্থিতিতে পরের একটা মেয়ের দায়িত্ব নিব কোন সাহসে।
সে সাহস আমি জোগাব। কেন তুই কাজ করবি বাহিরে আর সে কাজ করবে অন্দরে। যদি রাজী থাকিস তো ফুফুকে বলে তোদের এ বাড়িতে থাকার ব্যবস্থা করে দেব। তাছাড়া তুই তো মেয়েটাকে ভালোবাসিস।
কিন্তু তার তো তালাক হয়নি। সে যে এখনও আরেকজনের স্ত্রী।
ও নিয়ে তুই ভাবিস না। সে দায়িত্ব আমার হাতে ছেড়ে দে। আমি তার একটা সমাধান করে দেব।
ঠিক আছে তুমি যখন বলছ, তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে।
সাব্বাস হাসু, সাব্বাস! তোকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। তোর মুখ থেকে এমনই একটা কথা আসবে আমি আশা করেছিলাম।
আমি নিজেকেও নিজের কাছে ধন্য মনে করলাম যে, নির্যাতিতা একটি অসহায় মেয়েকে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে পারলাম। তাহলে ঐ কথাই ঠিক থাকল। ফুফুকে বলে একটা শুভ দিনক্ষণ দেখে তোদের বিয়ের ব্যবস্থা করব। যা এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। ঘুমে আমার চোখও ঢুলু ঢুলু। পরে কথা হবে। শুভ রাত্রি।
সূত্র : নতুন দেশ

ক ম লা ।। নাহার মনিকা

প্রজাপতির নদী পারাপার
তবুও কমলার অনেক কথা বলার ছিলো। যে বয়সে কথা কমে গিয়ে ভাবুক হবার পাঁয়তারা খোঁজে মেয়েরা সেই বয়েস তার, অথচ কথা কিন্তু সে বেশীই বলতো। খুব আবোল-তাবোল না, বরং খানিকটা গুছিয়ে, কিন্তু একটু দ্রুত, শব্দের শেষ দিকের উচ্চারণ কেমন মিইয়ে মিইয়ে যেতো ওর মুখের ভেতর। সবাই একরকম উপভোগ করে সেগুলো, কিছু কিছু শব্দ নকল করে হাসাহাসিও হতো খুব। কমলাও একচোট হেসে টেসে ওর চাঁদের মতো, অন্তত পাড়ার মহিলারা তাই বলতো, যেখানে ঠোঁটের বাঁদিকে ছোট তিল আর ডান গালে টোল রয়েছে সেই গোল মুখ লাল করে ফেলতো আর কখনো সখনো বলতো , - আচ্ছা, আমি কি এমন হাসির কথা বলেছি?

আসলে কথাটা যে হাসির নয়, বলাটা, কমলার বাবা রেলের ষ্টেশনমাষ্টার বলেই একটা আপাত ভদ্রতা, কেউ সাহস বা বিনয় করে বলতো না যে, ওর কথা বলার ধরণে হাসাহাসি হচ্ছে। শুধু ওর মা চশমা আর সিঁদুর পরা মাস্টারনী নামধারী দিব্বি সুন্দরী মহিলাটি সারাক্ষণ ধমকাতো। উচ্চারণ নিয়ে, হাঁটাচলা নিয়ে, বুক উঁচিয়ে ঘুরে বেড়ানো নিয়ে, খোলা চুল নিয়ে। অথচ কমলা, টান টান সবুজ সাটিনের কামিজের ওপর লাল ওড়নাটাকে শুধু গলার কাছটাতে কোন রকম লটকে, আসলে ওড়না জিনিষটাকেই একটা বাহুল্য ভেবে খোলা চুলে রেললাইন ধরে হেঁটে যেতে বেশী পছন্দ করতো, ফুরফুরে ভাব আসতো তার মনে।
একদিন বৈশাখের বিকাল বেলা, বিরক্তির চুড়ান্ত রকম হাওয়ার মধ্যে কমলারা দুইবোন যখন হেঁটে আসছিলো, শুধু কমলার ওড়নাটাই তখন ধাঁ করে বুকের আলিঙ্গন ছেড়ে উড়ে গেল। কমলা দু হাত তুলে ঢেউ-খেলানো ওড়নার পেছনে দৌড়াতে দৌড়াতে মোস্তফাদের মাছের আড়তে। ততক্ষণে মোস্তফা মাছ মাপ-জোকের তদারকি ছেড়ে লাল জর্জেট দুহাতে আটকে ফেলেছে। দুহাত দিয়ে ধরতে হয়েছে বলে ওর পরনের চেক লুঙ্গি পায়ের গোড়ালি ছেড়ে হাঁটু ছুঁয়ে ফেলেছে। ফর্সা লোমশ পায়ের হাঁটু অবধি, যা কমলারা প্রায়ই দেখে, আসতে, যেতে, যেহেতু রেলষ্টেশনের লাগোয়া মোস্তফাদের মাছের আড়ত। ওদের বংশানুক্রম চালান মাছের ব্যবসা, মাল ট্রেনে চালান আসে। কখনো জলে না নামলেও লোকে নাম দিয়েছে – মাছুয়া। মোস্তফা ওর বাবার প্রক্সি দিয়ে, বাঁ হাতে হাঁটুর ওপর লুঙ্গি উঁচিয়ে কর্মচারীদের নির্দেশ-টির্দেশ দেয়। যখনতখন কর কর শব্দ তুলে ফর্সা মুখ সান গ্লাসে ঢেকে হোন্ডা চালায়। তখনো অবশ্য ওর পা হাঁটু পর্যন্ত অনাবৃত থাকে। কমলারা দুই বোন প্রায়ই যুতসই নাম খোঁজে মোস্তফাকে দেবার জন্য। যেহেতু ষ্টেশনমাষ্টারের সংগে ব্যবসাগত সম্পর্কটিকে মোস্তফারা বেশ দক্ষতার সাথে পারিবারিক করে ফেলেছে, সে বিবাহযোগ্য, সুতরাং কমলারা মায়েদের সংগে দু একবার তার জন্য পাত্রী দেখতেও গেছে।
তো লাল জর্জেট যখন মাছের ফুলকোর মত মোস্তফার হাতে মৃতপ্রায়, কমলার মনে হয়, ওড়না বস্তুটি যদি পরতেই হয়, তা হলে এভাবে কালবৈশাখী বাতাসের কাছে হাতছাড়া করা উচিত না। কমলার বোনের সেই সমস্যা নাই, আঁচলতো ধরাতেই অভ্যস্ত।
কমলার আরো মনে হয়, তার কথাবার্তা নিয়ে মোস্তফা কোনদিন হাসিতে যোগ দেয়নি। ব্যবসায়ীর অতিরিক্ত ব্যস্ততা কিংবা এসব রোজকার হাসিঠাট্টার মত তুচ্ছ অথচ প্রয়োজনীয় বিষয়ে এ যুবকটির মনযোগের যোগ্যতা নাও থাকতে পারে, এ ভাবনা তার মাথায় আসে না।
অবশ্য আরো একদিন, পাড়ার সবার কাছে কমলা কৃতজ্ঞ, সবাই ওর গল্পটি শুনে বিষন্ন হয়ে গিয়েছিল। অন্তত কমলা মনে প্রাণে চাইছিলো তাই হোক, কেননা, সে নিজেই যারপরনাই বিষণ্ণ ছিল। সে তার সদ্য দেখা ঘটনাটি বেশ বিস্তারিত বলেছিল। একটা বিচিত্র রং প্রজাপতি, যে কিনা, কমলা বুঝতেই পারেনা, কোন আত্মবিশ্বাসে ভর করে বর্ষার প্রায় আধমাইলটাক চওড়া নদীর ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল। কোন একটা উপন্যাসে পড়া বর্ণনার সঙ্গে প্রায় মিলে যায় বলে ওর আরো বেশী অবাক হওয়ার যোগাড়। নৌকায় থাকা অন্যকয়েকজনের অলক্ষ্যে কমলার নিজের বুকের দুরু দুরু আর প্রজাপতিটির হৃদস্পন্দন এক হয়ে গিয়েছিল। কমলা তার সমস্ত অস্তিত্ব দিয়ে এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির পাখার ক্লান্তি, ব্যথা আর পথ না ফুরানোর অসহায়তা অনুভব করেছিল।
শেষমেষ নৌকা বাঁক নিলে প্রজাপতি তো আর তার সড়ক বদলালো না,  কমলার মন পড়ে থাকলো ওর নীল, সবুজ আর সোনালীর ঠিকরানোর মধ্যে। বেশ তীব্র রোদ, প্রজাপতিরা তৃষ্ণার্ত হয় কিনা, এ প্রশ্ন কমলাকে আত্মমগ্ন করেছিল সঙ্গত কারণেই। মোস্তফা কিংবা তার অন্য মনযোগী শ্রোতারা কেউ উত্তর দিতে পারেনি। ওর বাবা অবশ্য অনিশ্চিতভাবে বলেছিল-“ওরা তো ফুলে ফুলে মধু খেয়ে বেড়ায়, ওতেই পিপাসা মেটার কথা, কতটুকুই বা তৃষ্ণা হবে একটা প্রজাপতির!”
কিন্ত কমলার প্রায়ই মনে পড়ে, তীব্র গনগনে রোদের মধ্যে ছোট্ট প্রজাপতির নদী পারাপারের দৃশ্য আর তখন সে নিজেই প্রচন্ড তৃষ্ণা অনুভব করে।
মৃত মাছের চোখ
কেউই নিশ্চিত হতে পারেনা, কমলার কি হতে পারে, যাতে করে তার জ্বলজ্বলে চোখের তারা যেখানে যখন তখন পনেরো বর্ষীয় কৌতুহল আর অভিমান খেলা করতো, তা কিরকম মাছের মত হয়ে গেলো। কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে আঙ্গুল তুলে মাছের আড়ত দেখায়, কিন্ত ঠোঁটে আঙ্গুল চেপে সরেও আসে যখন মোস্তফাকে আগের ভঙ্গিতে কমলাদের ফুলের বেড়া দেয়া বাগানের গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, কমলার মায়ের সঙ্গে আগের মতই কিংবা আরো একটু বেশী, বিনয়ী বাক্যালাপরত দেখে।
একজন আরেকজনকে কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। কমলার তাবত কর্মকান্ডে মোস্তফার প্রাণপণ খাটুনি, এমন কি তারও আগে, বিচিত্র অসুখে কাতর মেয়েটিকে জেলাশহরে ভালো ডাক্তারের কাছে পৌঁছানোর জন্য গাড়ী জোগাড় ইত্যাদি, এমন কি তার আগেও – কমলার সবকটি ভাইবোনের সঙ্গে প্রাণোচ্ছল আন্তরিকতার সম্পর্ক, সবাই মিলে মোস্তফার নেতৃত্বে, তারই বেবীট্যাক্সীগুলোর মধ্যে থেকে একটি দখল করে সিনেমা দেখতে যাওয়া, জোস্নারাত্রে রেললাইনের ওপর দিয়ে না পড়ে গিয়ে হাঁটার কম্পিটিশান ইত্যকার কারণে, নিরুদ্বিগ্ন ষ্টেশনমাষ্টারের বাড়িতে যে হাসি গল্পের জমজমাটি, সে ও তো মোস্তফারই কারণে। অবশ্য ছেলেটি কথা বলতো কম, শুনতো বেশী, কমলারা যেন ওকে মুগ্ধ করতে, ওর সবচে রঙ্গিন ঝালর লাগানো বেবীট্যাক্সীতে চড়ে সিনেমায় যাবার কৃতজ্ঞতায়, বেশী বেশী চঞ্চল হয়ে উঠতো। আর তা ছাড়া- মাছ, ট্রেন, রেলের হিসাব নিকাশ তো ছিলই , তাই কি পরিবারের সবাইকে মোস্তফাকেন্দ্রিক করে তুলেছিল?
মামাতো বোনের বিয়ে, কমলার বোনটির জ্বর। মা না হয় নাই গেল, প্রতিবাদমূখর কমলাদের সমাধান মোস্তফা। ট্রেনের যাত্রা, ব্যবসার আনুসঙ্গিক সমস্যা রেখেও সে যখন রাজী, কমলারা তখন সত্যিই কৃতজ্ঞ।
ফেরার পথে সমস্যা। ট্রেন বন্ধ, আর তা জানা গেল মামার বাড়ি থেকে বাসের পথটুকু পার হবার পরে। সন্ধ্যার ট্রেন ভোরে ছাড়বে। মোস্তফার তড়িৎ বুদ্ধি আর কমলাদের পরিচয় কাজে লাগালে ষ্টেশনমাষ্টার রেলের বোর্ডিং- এ থাকার ব্যবস্থা করলেন। ধবধবে শাদা চাদর পাতা দুটো বিছানা, কমলার জীবনে প্রথম বাড়ির বাইরে রাত্রিবাস। ভাইবোনেরা ঘুমিয়ে পড়লেও, জানালাতে গড়িয়ে নামা চাঁদের আলোর দিকে কমলা নির্ঘুম তাকিয়েছিল। হোটেলে রাত্রিবাসে নিষিদ্ধ আনন্দ আছে।
কমলার যে আরো কথা বলার ছিল, তা তার বসে থাকার ভংগিতে বোঝা যেত, কিন্তু মনে হতো খনার জন্মের সংগে নিজেকে একাত্ম করে কষ্ট পাচ্ছিল সে। যার পর নাই কষ্ট, জ্বলজ্বলে কালো চোখের তারায় ধীরে ধীরে বাসা বাধছিলো ফ্যাকাশে দুঃখ যা ওর রংগিন জামাকাপড়গুলোকে ম্লান করে দিচ্ছিল। সারাদিনই প্রায় হাত কোলে করে ওদের বাগানে বা জানালায়, চোখ কখনো মাছের আড়তে, কখনো বা রেল লাইনের শেষ বিন্দুতে, কেন যেন আকাশের দিকে চাইতো না কমলা। কয়েক দিন রেলষ্টেশনের পুরানো দূরবীণ থাকতো কোলে, চোখে উঠতো না।ওর ব্যথা বেদনা কি, উতস কোথায় তা জানার উপায় ছিল কম , কেননা কমলা তখন কথা ভুলেছে। চাঁদপনা মুখ চৌকো, খোলা চুলে মা ব্যান্ড আটকে দেয় সকালে, কখনো ছিটে ফোটা ক্রিম, পাউডার।
এ দৃশ্য যখন স্বাভাবিক দৃশ্যে পরিণত হওয়া শুরু হলো তার দু এক দিনের মধ্যেই কমলাকে চিতায় শোয়ানো হলো। আবারো শোকের গম্ভীর হাওয়া। সকলের সমীহভরা চাহনি কমলাদের ফুলেল গেটঅলা বাড়ির দিকে। আহা, সবার যেন শোক বইবার শক্তি হয়। এমন চাঁদের মত সুন্দরী বাচ্চা মেয়েটি। ওর কথার শেষের অক্ষরগুলো বাতাসে নুয়ে নুয়ে হাঁটে, কেউ তা নিয়ে হাসাহাসি করে না।
অতলের মীন
শ্রাবণের বৃষ্টি যখন নিভু নিভু, মোস্তফার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক, সে সময় কেউ একজন বাতাসে কথাটা ছড়ায়- কমলা আসলে খুন হয়েছে। একদিন হঠাত করে মৃত্যু নয়, বেঁচে থাকতেই একদিন নিহত হয়েছিল সে, তারপর মৃতপ্রায় আরো কিছুদিন বেঁচেছিল। লোকটি ওর বাবামায়ের অধৈর্য্য সংলাপ শুনেছে, এই দেশে এই খুনের বিচার সম্ভব না ইত্যাদি, এসবই শুনেছে। কমলার আত্মঘাতী হবার কাহিনী পিপীলিকার ছয় পায়ে পাড়াময় হেঁটে বেড়ায়, তার মৃত্যু রহস্যোপোন্যাস হয়ে যায়, আর তা দিয়ে ওর প্রজাপতির গল্পটা, যেটি কমলার প্রিয় গল্প ছিল, পুড়ে যেতে থাকে।
এখন সবাই সাহস করেই আঙ্গুল উঁচিয়ে মোস্তফার মাছের আড়ত দেখায়, কেননা কমলার সেদিনের রাত্রিবাসের গল্প এখন সবার জানা। কমলা যখন নির্জীব বসে থাকতো, ওর ঘনিষ্ঠ দু চারজন- কখনো কখনো ওর ভেতর থেকে ছায়ার মত অন্য এক কমলার উঠে আসা দেখেছে, এই কমলার
সংগে আগের কমলার মিল আছে, পাশাপাশি সুক্ষ বদল ও চোখে পড়ে। বুকে ওড়না নেই, জুতো স্যান্ডেলের বালাই নেই, ফর্সা পা ধুলোয় ঢেকে আছে। সবচে বড় পরিবর্তন – যা সবাই একবাক্যে স্বীকার করে যে এই কমলার মুখ থেকে কমনীয়তা সরে গিয়ে কী এক কঠিন সন্ধিগ্ধতা ঝুলছে, সব কিছু আগের মত চোখ বড় করে বিশ্বাস করে ফেলছে না, বরং রাগী বেড়ালের মত উঠানের মাটি খুটতে খুটতে চোখ সরু করে সন্দেহ প্রকাশ করছে।
সবাই মুখ চাওয়া চাওয়ি করে, অতি সংগত কারণে, কেননা এই কমলা নিজের অতি গোপন কথাগুলি ও অব লীলায়, দৃঢ়তার সাথে বলে ফেলছে। আগের মত হাসি কান্না সবাইকে বাধভাংগা ধাক্কা না দিলেও ওর স্থিত, প্রত্যয়ী স্বভাবে বলা তো বটেই, সেই বিষয়ের গুরুত্ব ও ভয়াবহতায় সবাই দীর্ঘক্ষন বেশ আচ্ছন্ন থেকেছে।
তারপর যখন খেয়াল হয়, কমলার ছায়া এই কমলা, আর আগেকার, না মধ্যেকার কমলাতে আবার আত্মগোপন করে ফেলেছে, আঁচ করার চেষ্টা করে বুঝতে পারে, কমলার কানে তাদের কোন কথাই আর পৌঁছুবে না, তখন সবাই – সেই কমলা কি বলে গেল, ঝালাই করে নিতে উদ্গ্রীব হয়।  কমলা কি বলে গেল, একটি ধাতব বিবমিষাময় কন্ঠস্বর থেকে ওর বাক্যগুলো, কতটা তো এরকমই যে ওর আর মনুষ্য জাতিতে প্রত্যয় নেই। মানুষ কে ভালোবাসায় তার মন উঠে গেছে। এরা ছলনাময়তায় কোথাও কম যায় না। মোস্তফা তাকে আদম হাওয়ার যে কাহিনীটি শুনিয়েছিল, সেখানে বিবি হাওয়ার উপর ক্রমশ রাগ আর আদমের জন্য  মমতার উপক্রম হয় কিন্ত কমলার এখন আর এই আদমের বংশধরদের জন্য কোন বাতসল্য হয় না।
সবাই মনে করার চেষ্টা করে, প্রকারান্তরে কমলা কি এই বলে গেল না যে মোস্তফাকে সে আর বিশ্বাস করে না, অথচ ভালোবাসে। এই দোটানায় সে ভেতরে ভেতরে মরছে। মরতে ও রাজী কিন্ত অন্যায় সন্ধি কোন রকম বুদ্ধিবৃত্তিক অনুশীলন ছাড়াই – কমলার ভালোরকম অপছন্দ। কেন এই মনোজাগতিক বদল? কমলা তখনই বোধকরি, তার মামাবাড়ি ফেরত রেল-বোর্ডিং এ রাত্রিবাসের কাহিনীটি বলে দিয়েছিল।
চাঁদ দেখারত কমলাকে মোস্তফা জানালার ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে তার রোমান্টিক প্রেমের কথা জানায়। সেই সংগ এও ব লে যে তার মা যতই পাত্রী দেখুক, তার মন উঠবে না। সব সমস্যার গন্ডী ডিঙ্গিয়ে সে কমলাকেই বিয়ে করবে। দরকার হলে বাড়ি ছেড়ে অন্য শহরে গিয়ে মাছুয়া নাম ঘোচাবে। বাইরের চেয়ে ঘরের ভেতরের পরিবেশ তখন কমলাকে বেশী নাজুক করে ফেলে। ছোটখাট প্রসঙ্গ বাদ দিলে যা দাঁড়ায় তা হলো সেই রাতে তাদের দুজনের কেউই ঘুমায়নি, কিন্ত তাই বলে পরিপাটি শাদা বিছানাটি ও অস্পৃশ্য থাকেনি। পরবর্তী যে অধ্যায়টুকুতে সবাই কমলার চোখের তারা নিস্প্রভ হতে দেখেছে, ঐ রাতটাই তার অন্যতম কারণ নয়। মোস্তফার ব্যবহার অন্য মাত্রা নিতে সময় নেয় নি, কারণ হিসেবে সবার চোখে ধরা পরার ভয়, কমলার কাছে ও যুক্তিযুক্ত মনে হয়েছে, যা তার কাছে মোস্তফাকে  চওড়া নদীর বিশালতায় মুগ্ধ করতে পারেনি। যদিও প্রথম দু চার দিন সে ও মনে প্রাণে সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে কিন্ত তারপর স্থানে, অস্থানে, বোন টিউশনিতে, মা পাড়ায় উল বুনতে গেলে, শীতের সন্ধ্যাবেলা ট্রেনের অপেক্ষায় থেকে থেকে মাছের আড়ত ফাঁকা হয়ে গেলে, এমন কি বাবার ভীষন আলসারের অপারেশনের সময় কমলার পাহারায় বাড়ি রেখে অন্যরা জেলা শহরে গেলে- মোস্তফার মূর্তি ক্রমে ক্রমে কমলাকে সন্দেহের ভাবনা ভাবতে বাধ্য করেছিল। ওকে সেসব সময়ে রোষ ওঠা ঘাড় ফোলানো পাড়ার সবার চেনা লাল মোরগটার মত মনে হতে শুরু হলো, যে কিনা যেখানে সেখানে আগপাশ তলা বিবেচনাহীন, নিজের দেয়া যাবতীয় প্রতিশ্রুতি ভুলে কমলাকে কেবলই পেড়ে ফেলতে চায়। আর তখন থেকেই, মোটামুটিভাবে যে সারাংশটা সবার বোধগম্য হয় – তা হচ্ছে, কমলার অসুখের সুত্রপাত। কমলা আসলে মরছিলো তখন থেকেই।
অতঃপর প্রজাপতির সাঁতার
প্রজাপতির সঙ্গে সাঁতরে চওড়া নদীটা পার হবার স্বপ্ন কমলাকে ছাড়ার আগে, কমলাই স্বপ্নটাকে ত্যাগ করলো। প্রজাপতির পাখনার রঙ্গের একটা ওড়না কেনার সাধ ছিল ওর। কিনতে না পেলে ঘরেই বানাবে, রং গুলে গুলে। কল্পনায়, কাঁধের কাছে আটকানো সেফটিপিন থেকে ওড়নার দুপাশ কিভাবে ছড়ালে নিজেকে প্রজাপতির মত দেখাবে, সে মহড়া বহুবার দিয়েছে সে। পাখার ওপর লেপ্টে থাকা তীব্র রোদ যেভাবে শুড়ের দিকে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসে, আর ব্যথাবোধ তীব্র থেকে তীব্রতর করে তোলে- কমলা তার হাত, নাভীমূল দিয়ে, বাথরুমে একা ঊন্মুক্ত উরুদ্বয়ে, পায়ের পাতায় ক্রমাগত সেই রোদেলা ব্যথার অস্তিত্ব অনুভব করেছিল। ওড়নার স্বপ্নটা বেমালুম ভুলে যাওয়ার আগে, ব্যথায় অন্ধ চোখ কোন রং বুঝতে পারেনা, তারপরও কমলার মনে হয়, প্রজাপতির মত ঝাঝর রং কতটা দরকার এক জীবনে? কোনটার বেশী দরকার, রংয়ের নাকি ওড়নার? উত্তরে, ব্যথায় ভাসতে ভাসতে, কখনো দুটোকেই সমান গুরুত্ব দিয়ে দেয়। আর তখনই কমলার অবয়ব জুড়ে নিষ্প্রভ সন্ধ্যা নামে।

পরী ।। জসিম মল্লিক

১.
ঘুম থেকে উঠে জানালার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল চক চকে রোদ। গত তিন চার দিন আকাশ এমন গোমরামুখো হয়ে ছিল। রোদের দেখাই পাওয়া যায় নি। টেবিল ঘরির দিকে তাকিয়ে দেখল সকাল দশটা। আজকে কোনো কাজ নেই। আজ রোববার। গতকাল একটু রাতেই ফিরেছে কাজ থেকে। শখে কাজ করা আর কি। টেলিভিশনের সুইচ অন করল। সিপি ২৪ চ্যানেল দেখল। ও মাই গড! বাইরেতো অনেক ঠান্ডা। উইন্ডচিলন্ড সহ মাইনাস ১৯। আগামী এক সপ্তাহ ওয়েদার এরকমই থাকবে। তবে এ দেশের ওয়েদারের কথা কিছুই বলা যায় না। টুক টাক কিছু কেনা কাটার দরকাল ছিল। ইচ্ছে করছে না কোথাও বের হতে। আগামী সপ্তাহে দেশে যাচ্ছে সাদি। বাবা জরুরী তলব করেছে।
সাদি বাবা মার একমাত্র সন্তান। সাদির বাবা কামাল আহমেদ একজন টাকার কুমির। ঢাকার গুলশানে দেড় বিঘা জায়গার উপর বাড়ি। দেখার মতো বাড়ি। দোতলা বাড়িটিতে সুইমিংপুল, এলিভেটর পর্যন্ত আছে। মতিঝিলে অফিস। নানা ধরনের ব্যবসা। কামাল সাহেব একজন ধুরন্দর লোক। হাইপ্রোফাইল স্মাগলার। অনেকেই সেটা জানে। কিন্তু পলিটিক্যাল কানেকশনের জন্য সে থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সরকাল বদল হলেও খুব অসুবিধা হয় না। কামাল সাহেব একজন প্রো পাকিস্তানীও বটে। সেটা সে বুক ফুলিয়ে প্রচারও করে। কিন্তু তাতে কিছু অসুবিধা নাই। ম্যানেজ হয়ে যায়। রাজনীতিবিদরা হচ্ছে এক ধরনের বেশ্যার মতো।  কামাল সাহেবদের মতো লোকরা তাদের কাছেই আশ্রয় প্রশ্রয় পায়। কারন ওদের চাঁদা দিয়েইতো রাজনীতিবিদদের চলতে হয়। রাজনীতির মতো ভাল ব্যবসা আর নেই।
কামাল সাহেব বছর পাঁচেক আগে কানাডাতে ঢাউস একটা বাড়ি কেনেন। এখন বাংলাদেশের পয়সাওয়ালাদের সবারই একটা করে সেকেন্ড হোম আছে। দেশে যখন সামাজিক বিপ্লব শুরু হবে তখন তাদের পালাবার জন্য একটা জায়গাতো থাকতে হবে। এজন্য বিভিন্ন দেশ ব্যবস্থা করেই রেখেছে। দুবাই, মালয়েশিয়া, কানাডা, আমেরিকা তাদের দরজা খোলা। যত খুশী পয়সা নিয়ে আসো। চোর বদমাশ ডকাত যাই হও অসুবিধা নাই। তোমাদের সাদরে বরণ করে নেয়া হবে। 
দেশে কী বিপ্লব আসন্ন! একটু খানি ঢাকা শহরে দেড় কোটি মানুষের বাস। সেই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। ষাট লাখ মানুষ থাকে বস্তিতে। আর লাখ লাখ মানুষ রাতে ঘুমায় ফুটপাতে। অথচ কামাল সাহেবের গুলশানের বাড়িতে দু’জন মাত্র মানুষ। আরো কায়েকটি বাড়ি আছে ঢাকায়। এছাড়া আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, কানাডাতেতো আছেই। এই বৈষম্য বেশীদন থাকবে না। যাদের ঢাকায় থাকার যায়গা নেই তারা একদিন এইসব অলস বাড়ি  দখল করে নেবে। নেবেই। কারণ সাধারন মানুষের ভাগ্য হরণ করেই এইসব বাড়ি গড়ে উঠেছে। ঢাকার অদূরের সব জমি জমাও কিনে নিয়েছে পয়সাওয়ালারা। চাষ বাস আর থাকার জায়গা নেই মানুষের। আরাম আয়েশ আর ফুর্তি করার জন্য সবারই একটা করে বাংলো বড়ি আছে। কামাল সাহেবও দেরশ বিঘা জায়গার উপর একটা বাড়ি করেছেন সাভারে। পনেরেশো টাকা করে শতাংশ কিনেছিলেন এখন একলাখ টাকা। অন্তত দুশ গরীব মানুষের কাছ থেকে এই জমি কিনেছেন। উইকএণ্ডে সেখানে গিয়ে থাকেন। লাখ লাখ টাকা উড়ে যায় এক রাতে। রাত যত গভীর হয় ততই অতিথিদের নিঃশ্বাস ঘন হতে থাকে। সেখানে আসেন রাজনীতিবিদ, সরকারী আমলা, ব্যবসায়ী আর পুলিশের কর্তারা।
২.
সাদির সাথে যখনই আহমেদের দেখা হয় নানা বিষয় নিয়ে কথা হয়। আহমেদ সামাজিক বৈষম্যের কথা বলে, ভালবাসার কথা বলে, সমাজ বদলের কথা বলে। প্রথম প্রথম সাদি সব বুঝতো না। এখন বেশ বোঝে। আহমেদকে ওর বেশ লাগে। নাটক, আবৃতি, লেখালেখি করে। সাদির একমাত্র বন্ধু আহমেদ। যদিও আহমেদ সাদির চেয়ে কমপক্ষে পাঁচ বছরের বড়। কিন্তু বন্ধু হতে কিছু আটকায়নি। আহমেদ এমন একটা মানুষ যে, সে যে কারো সাথে চালিয়ে নিতে পারে। আহমেদ ক্রমান্বয়ে সাদির ভিতর একটা বোধের জন্ম দিতে পারছে। সেটা হচ্ছে মানুষের প্রতি মানুষের ভালবাসার বোধ। আহমেদ কখনও কামাল আহমেদ সম্পর্কে কিছু বলেনা সাদিকে। কিন্তু এটা ওকে বোঝাতে পারছে যে এরা আসলে হিপোক্রাট।
সাদি আহমেদ বস্তুত খুউব সোজা সরল ছেলে। ওর বয়স এখন পঁচিশ হবে। ইয়র্ক ইউনিভার্সিটি থেকে বিসনেসে পড়াশুনা শেষ করেছে। চাকরীর চেষ্টা করছে। এখন একটা পিজা স্টোরে মেকলাইনে কাজ করে। পার্ট টাইম। আহমেদই কাজটা পাইয়ে দিয়েছে। বসে থাকার চেয়ে কিছু একটা করা। আহমেদ জানে সাদির একাউন্টে হাজার হাজার ডলার জমা আছে। প্রতি মাসে আসে ডলার। প্রথমে ওরা থাকতো বেভিউর পার্কলেনের একটা বাড়িতে। অবিশ্বাস্য দাম ছিল সেই বাড়ির। সতেরো মিলিয়ন ডলার! সেই বাড়ি মাত্র বছর খানেক ছিল। কারণ জামাল সাহেব এখানে থাকেন না। সামারে শুধু আসেন। এতবড় বাড়ি কে দেখবে! তাই সাদির জন্য একটা কন্ডোমোনিয়াম কিনে দিয়েছেন লেস্লি স্ট্রিটে। দামী কন্ডো। প্রায় হাফ মিলিয়ন ডলারের কন্ডো।
সাদি ফোন করলো আহমেদকে। আহমেদ ভাই কী করছেন!
এইতো একটা বই পড়ায় মন দেবার চেষ্ট করছি। খুব ইন্টারেস্টিং বই। মজা পাচ্ছি।
ওকে। তাহলেতো আপনার সাথে কথা বলা যাবে না।
আরে না বলো। এনিথিং রং!
না না সেরকম কিছু না। দেশে যাচ্ছি।
হঠাৎ!
হু, হঠাৎই। বাবা ফোন দিয়ে জরুরী তলব করেছে। আপনিও চলেন আমার সাথে।
আমি! কিজে বলো।
কেনো অসুবিধা কি! আপনিতো যান না অনেকদিন। ঘুরে আসবেন। ঢাকার পরিবর্তন দেখে আসবেন।
ধুর পাগল। আমার যাওয়ার উপায়ই নেই। অনেক অসুবিধা আছে।
কিচ্ছু অসুবিধা নেই আপনার। চলেন। মাত্র দু’সপ্তাহ মাত্র।
তুমি যাও।
এভোয়েড করছেন!
আরে না। এভোয়েড না। আচ্ছা ঠিক আছে আমি জানাবো।
ওকে আহমেদ ভাই, থ্যাংকস।
শোনো, আমাকে কোনো নিয়ে যেতে চাচ্ছো।
ঠিক জানি না কোনো। তবে মনে হয় আপনি আমার সাথে গেলে আমার জন্য ভাল হবে। আমি সব ব্যবস্থা করছি। আপনি ভাবিকেও নিয়ে যেতে পারেন।
ও যেতে পারবে কিনা জানি না।
আচ্ছা আমি ভাবির সাথে কথা বলব।
৩.
আহমেদ প্রায় পাঁচ ছয় বছর পর দেশে এলো। কানাডা প্রবাসী হওয়ার পর এটা দ্বিতীয়। অনেক বদলে গেছে শহর। মানুষে গীজ গীজ করছে। ট্রাফিক জ্যাম আগের মতোই। দামী দামী সব গাড়ি। কিন্তু চলার জায়গা নেই। সাদিকে নিতে এয়ারপের্টে বিএমডব্লিউ গাড়ি এসেছে। ভিতরটা ঠান্ডা। মন ভাল হয়ে যায়। দশ বছর আগে কী এইসব গাড়ি ছিল! ছোট ছোট বাড়ি ভেঙ্গে গড়ে উঠেছে এপার্টমেন্ট। চারিদিকে শুধু উচু উচু ভবন। মানুষ নিঃশাস নেয় কিভাবে! শেষ পর্যন্ত সাদি আর আহমেদই এসেছে। সাদির জেদের কাছে আহমেদের হার হয়েছে। বস্তুত আহমেদের ঢাকায় কোনো থাকার জায়গা নেই। সাদি চেয়েছিল ওদের বাড়িতেই উঠুক। এতবড় বাড়ি। কিন্তু আহমেদ তাতে রাজী হয়নি। আহমেদকে গুলশানের একটা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করা হলো। এখানেই ও আরামে থাকবে। দামী হোটেল। প্রতিদিন তিনশ উইএস ডলার রুম ভাড়া। স্যুইট  টাইপ। আহমেদের অনেক বন্ধু ঢাকায়। নাটকের বন্ধু, লেখালেখির বন্ধু. ইউনিভার্সিটির বন্ধু। যে ক’দিন থাকবে চুটিয়ে আড্ডা মারতে পারবে।
আহমেদের খারাপ লাগছে না। ফেব্রুয়ারি মাসটাই অন্যরকম। ভাল সময়ই আসা হয়েছে। চারিদিকে নানা অনুষ্ঠান হচ্ছে। বই মেলা শুরু হয়েছে। একদিন যাবে। ওখানে গেলে অনেকের সাথে দেখা হবে। কত বই বের হয় এখন। মানুষ যে এখনও বই কিনে পড়ে এটা ভেবে আশ্চর্য লাগে আহমেদের। অনেক বছর আগে ওরও দুটো বই বের হয়েছিল। প্রবাসী হওয়ার পর আর বের হয়নি। প্রবাসী লেখকদের অনেকেই নাকি নিজের খরচে বই বের করে। এই সুযোগটা নেয় কিছু ভুঁইফোর প্রকাশক। অনেকে পয়সা খরচ করে দেশে আসে বই মেলা উপলক্ষ্যে। বই বা লেখালেখির প্রতি এই আবেগকে আহমেদ শ্রদ্ধা করে। লেখকদের প্রবাসী হওয়া মানে তার সত্বার মৃত্যু।
আহমেদকে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে চলে গলো সাদি। আহমেদকে অনেক কষ্টে রাজী করিয়েছে আসার জন্য। এজন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞ। বাবা কিজন্য তলব করেছে সাদি তা অনুমান করতে পারছে। আগেও এসব নিয়ে কথা হয়েছে। কামাল সাহেব ধুরন্দর মানুষ। এমনিতে হাসি খুশী, সারাক্ষণ হাসি ঠাট্টা করেন মানুষের সাথে। কিন্তু তিনি একজন নিষ্ঠুর প্রকৃতির মানুষ। মানুষ খুন করে গাঙ্গে ভাসিয়ে দেওয়াও কোনো ব্যাপার না তার কাছে। তার কাজে বাধা হয়ে দাঁড়ালে তিনি ক্ষমা করেন না কাউকে। সাদি তার বাবাকে জানে। সে এবার প্রস্তুত হয়েই এসেছে। আহমেদ ভাইকে জোর করে নিয়ে এসেছে তার পরামর্শ পাওয়ার জন্য।
প্রথম কয়েকটা দিন বেশ ভাল ভাবেই কাটল। সাকালবেলা হোটেলের গেটে গাড়ি এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আহমেদ যেখানে খুশী যেতে পারে। মাঝে মাঝে সাদি এসে নিয়ে যায়। আহমেদের বন্ধুরা আসে। ঘুরে বেড়ায় প্রেসক্লাব, বেইলী রোড, ঢাকা ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস। তবে সবকিছু আগের মতো আর নেই টের পায় আহমেদ। মানুষ ব্যস্ত। কিসের যেনো একটা প্রতিযোগিতা। ছুটছে শুধু। আহমেদের বন্ধুরাও সময় দিতে পারে না। আগের সেই নির্মল আড্ডা যেনো আর হয়ে উঠে না। বন্ধুদের অনেকেই বেশ টাকা পয়সার মালিক হয়ে গেছে।
এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়া এক দুরহ ব্যপার। দিন পার। চারিদিকে গাড়ি আর মানুষের মাথা। আহমেদের হোটেল সাদির বাসা থেকে কাছেই।
আজ রাতে একটু আগেই ফিরেছেন কামাল সাহেব। জরুরী কথাটা আজই সেরে ফেলতে চান। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছেন কিছুতেই মেজাজ হারাবেন না ছেলের প্রতি। ছেলেরা বড় হয়ে গেলে তাদের  একটা মতামত তৈরী হয়। জোর করে সবকিছু চাপিয়ে দেয়া যায় না। তার ছেলেকে এমন কিছু অবাধ্য সন্তানও মনে হয়না।
আহমেদ হোসেন কে?
বাবার অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে সাদি একটু ভিমরি খেলো। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে শান্তভাবে বলল, আমার বন্ধু।
সে তোমার বন্ধু হয় কিভাবে! সে নাকি একজন লেখক, নাটক ফাটক করে।
কোনো লেখকরা কি আমার বন্ধু হতে পারে না?
সাদির উত্তরের ধরনে বেশ অবাক হলেন কামাল সাহেব। কিন্তু বুঝতে দিলেন না। হাসি হাসি মুখে বললেন, নিশ্চয়ই পারে। কেনো পারবে না। এজন্যই তুমি তাকে টরন্টো থেকে সব খরচ দিয়ে নিয়ে এসেছো! দামী হোটেলে রেখেছো! কেনো? সে তোমার কি উপকারে আসবে!
তুমি নিশ্চয়ই একথা বলার জন্যই আমাকে ডাকোনি! আর আমার বন্ধুর সম্পর্কে তোমার স্পাইং করার দরকারটা কি!
নিজের ছেলেকে অপরিচিত লাগছে। কথ শিখেছে ভালই। নিজেকে সংযত করে বলল, শোনো, তুমি আর ফিরছো না কানাডায়। এখন থেকে আমার ব্যবসা দেখবে।
আমি ব্যবসার কিছু বুঝি না বাবা। আমি চাকরী করতে চাই।
অন্যের দাসত্ব কেনো করবে! তোমাকে বিসনেস পড়িয়েছি ব্যবসা দেখবে সেজন্য। তাছাড়া বিদেশের কষ্টের জীবন। কে দেখে তোমাকে! টরন্টোর কন্ডো বিক্রি করে দেবো।
ওকে বিক্রি করে দাও।
তুমি বিসনেসে জয়েন করছো।
আমাকে একদিন সময় দাও বাবা।
ওকে। টেক ইওর টাইম।
৪.
সব শুনে আহমেদ বলল, এব্যাপারে আমার কিছু বলা ঠিক হবে না। তোমার ইচ্ছাটা কি বলো।
আমি কানাডায়ই ফিরে যাব। নিজের মতো থাকবো। একটা চাকরি আমি ঠিক পেয়ে যাব। বাবা আপনার সম্পর্কে সব জেনে গেছে। সে হয়ত মনে করে থাকতে পারে আপনি আমাকে বুদ্ধি পরামর্শ দেন।
কিছু বলেছে এ ব্যাপারে!
সরাসরি বলেনি।
আমার কথা বাদ দাও। এসব নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না।
বাবাকে চেনেন না। সব কিছুর জন্য হয়ত আপনাকেই দায়ী করতে পারে।
সবকিছু মানেটা কী?
আছে।
কি শুনি।
আমি একটা মেয়েকে পছন্দ করি অনেকদিন থেকেই। ওকে বিয়ে করতে চাই। ও আমার জন্য অপেক্ষা করছে। খুউব ভাল মেয়ে।
ফাইন। বিয়ে করতে চাইলে করে ফেলো।
ভয় পাচ্ছি। বাবা তুলকালাম করবে।
ভয় পেওনা।
আপনার এত জোর কোথা থেকে আসে!
আহমেদ হাসল শুধু কিছু বলল না।
সেদিন বিকেলেই ওরা গেলো বেইলী রোডে। হ্যালভ্যাশিয়াতে। সেখানে পরীর মতো সুন্দর একটা মেয়ে অপেক্ষা করছে। ওদের দেখে  মেয়েটি এত সুন্দর করে হাসলে যে আহমেদের মনে হলো এই মেয়ের জন্য আটলান্টিক পারি দেয়া যায় সাঁতার কেটে। সাদি পরিচয় করিয়ে দিল, ও তানজিয়া। ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এবার ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন্সে অনার্স শেষ করলো। তারপর ওরা অনেক গল্প করলো। তানজিয়াকে খুব ভাল লেগে গেলো আহমেদের। যেতে যেতে সাদি জিজ্ঞেস করলো, কেমন দেখলেন!
খুব চমৎকার মেয়ে। শুধু দেখতে সুন্দর বলেই নয় এই মেয়ের মধ্যে এমন এক সৌন্দর্য্য আছে যা ব্যখ্যা করার ক্ষমতা আমার নেই। একেই তোমার বিয়ে করা উচিত।
কিন্তু বাবা চাইছেন আমি তার পছন্দ করা কোনো ধনীর মেয়েকে বিয়ে করি।
না। 
‘না’ শব্দটা  আহমেদে এতটাই জোরালোভাবে বলল যে সাদি চমকে গেলো। সাদি আর কিছু বলল না।
রাত এগারোটা। দরজায় টুক টুক শব্দ। আহমেদ শুয়ে শুয়ে একটা বই পড়ছিল। টিভিতে অস্ট্রেলিয়া পাকিস্তানের টেষ্ট ম্যাচ হচ্ছে পার্থে।
দরজা খুলে কামাল সাহেবকে দেখে তেমন অবাক হলো না। যেনো জানাই ছিল তিনি আসবেন। পিছনে আরো কয়েকজন লোক।
আসতে পারি!
সিউর। তবে এপয়েনমেন্ট করে আসলে ভাল হতো।
সরি ডিস্টার্ব করার জন্য।
ইটস ওকে। বসুন।
সোফায় বসলেন কামাল সাহেব। কোনো ভনিতা না করে সরাসরি আলোচনায় ঢুকে গেলেন।
আপনি সাদিকে বোঝান। ও যেনো ওই মেয়েটিকে বিয়ে না করে।
ওতো বাচ্চা ছেলে না। ও মেয়েটিকে ভালবাসে। অনেক দিনের সম্পর্ক।
মেয়েটি একজন সামান্য ব্যাংক ম্যানেজারের মেয়ে।
তাতে কী!
আমাদের সাথে ওদের মানায় না।
ব্যাংক ম্যানেজার হলেও বেশ সৎ মানুষ শুনেছি। মেয়েটিও অসাধারণ। আপনার ছেলেকে যে সে ভালবাসে এটা অনেক বড় ব্যাপার।
সে দ্যাট এগেইন! মুহুর্তে জ্বলে উঠলেন কামাল আহমেদ।
আশাকরি আপনার কথা শেষ হয়েছে।
আহমেদের কথায় এমন কিছু ছিল যে কামাল সাহেব আর কিছু না বলে চলে গেলেন।
৫,
আজকের দিনটা খুব সুন্দর। সত্যি সুন্দর। হিমেল বাতাস বইছে। একটা উৎসব উৎসব ভাব। ওরা তিনজন। সাদি, আহমেদ, তানজিয়া। তানজিয়া আজ একটা শাড়ি পরেছে। কিযে সুন্দর লাগছে। কোনো মানুষ এত সুন্দর হতে পারে আহমেদের জানা ছিল না। সাদিকেও আজ অপূর্ব লাগছে। পাঞ্জাবীতে বেশ মানিয়েছে ওকে। পাবলিক লাইব্রেরীর সিঁড়িতে বসা তিনজন। মাঝখানে তানিজয়া। এখানেই তানজিয়ার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল সাদির।
আজ ভ্যালেইনটাইনস ডে। সাদি দুষ্টুমি করে করোজোরে বলল, উড ইউ ম্যারি মি! বলে পকেট থেকে একটা ডায়মন্ডের আংটি বের করে তানজিয়ার সুন্দর অনামিকায় পরিয়ে দিল। তানজিয়া ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকল সাদির দিকে। ওর চোখটা কি একটু ভিজে উঠল আনন্দে! আহমেদ একটা জোকস বলে পরিবেশটাকে হালকা করতে চাইছে। (সমাপ্ত)
জসিম মল্লিক, টরন্টো, ৩০ জানুয়ারি।
jasim.mallik@gmail.com

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ