প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, December 30, 2011

নাসির উদ্দিন হোজ্জার কৌতুক | ৩ |

রেসিপি তো আমার কাছে
একদিন হোজ্জা বাজার থেকে কলিজা কিনে বাসায় যাচ্ছিলেন।এদিকে তাঁর এক বন্ধু তাঁকে কলিজার পাই বানানোর রেসিপি দিয়েছিলেন, যাতে বাসায় গিয়ে কলিজার পাই রান্না করতে পারেন।কিন্তু হঠাৎ একটি বাজপাখি উড়ে এসে কলিজা ছিনিয়ে নিয়ে একেবারে নাগালের বাইরে উড়ে চলে গেল।
বোকা কোথাকার!চেঁচিয়ে হোজ্জা বললেন, কলিজা নিয়ে গেছ ঠিক আছে, কিন্তু প্রস্তুত প্রণালী (রেসিপি) তো আমার কাছে!

কে শুভ !
রাজার মেজাজ খারাপ।রাজপ্রাসাদ থেকে বেরিয়ে শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জা সামনে পড়ে গেলেন।
শিকারে যাওয়ার পথে হোজ্জার সামনে পড়ে যাওয়াটা আমার ভাগ্যের জন্য খারাপ, প্রহরীদের রাগত গলায় বললেন রাজা।আমার দিকে ওকে তাকাতে দিয়ো না-চাবুকপেটা করে ওকে পথ থেকে সরিয়ে দাও।
প্রহরীরা তা-ই করল।
শিকার কিন্তু ভালোই হলো।
রাজা হোজ্জাকে ডেকে পাঠালেন।
আমি সত্যি দুঃখিত, হোজ্জা।ভেবেছিলাম তুমি অশুভ।কিন্তু তুমি তা নও।
আপনি ভেবেছিলেন আমি অশুভ!হোজ্জা বললেন।আপনি আমাকে দেখার পর ভালো শিকার করেছেন।আর আমি আপনাকে দেখে চাবুকপেটা খেয়েছি।কে যে কার অশুভ, বুঝলাম না।

Thursday, December 29, 2011

রাসুলের ওপর ধর্মনিরপেক্ষতা আরোপ এবংকিছু কথা || খন্দকার মুহাম্মদ হামিদুল্লাহ্

বিখ্যাত সাহাবী, শীর্ষ মুফাসসিরে কোরআন হজরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, ওলীদ ইবিন মুগীরা, আস ইবনে ওয়ায়েল, আসওয়াদ ইবনে আবদুল মোত্তালিব ও উমাইয়া ইবনে খাল্ফ প্রমুখ মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা একবার রাসুলের কাছে এসে বলল, আসুন আমরা পরস্পরের মধ্যে এই শান্তিচুক্তি করি যে, এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যদের ইবাদত করবেন এবং এক বছর আমরা আপনার উপাস্যের ইবাদত করব (কুরতুবী)। তিবরানির সূত্রে ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, কাফিররা প্রথমে পারস্পরিক শান্তিচুক্তির স্বার্থে রাসুলুল্লাহর সামনে এই প্রস্তাব রাখল যে, আমরা আপনাকে বিপুল পরিমাণে ধন-ঐশ্বর্য দেব, ফলে আপনি মক্কার সর্বাধিক ধনাঢ্য ব্যক্তি হয়ে যাবেন। আপনি যে মহিলাকে ইচ্ছে বিয়ে করতে পারবেন। বিনিময়ে আপনি শুধু আমাদের উপাস্যদের মন্দ বলবেন না। যদি আপনি এটাও মেনে না নেন, তবে এক বছর আমরা আপনার উপাস্যের ইবাদত করব এবং এক বছর আপনি আমাদের উপাস্যের ইবাদত করবেন (তাফসিরে মাযহারি)। এমন পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহর দূত জিবরাঈল সুরা কাফিরুন নিয়ে আগমন করলেন। এতে কাফিরদের ক্রিয়াকর্মের সঙ্গে সম্পর্কোচ্ছেদ এবং আল্লাহতায়ালার অকৃত্রিম ইবাদতের আদেশ আছে। বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, সুরাটিতে ‘আমি ইবাদত করি না যার ইবাদত তোমরা করো’—কথাটির পৌনঃপুনিক উল্লেখ রয়েছে। তাফসিরবিদরা বর্ণনা করেছেন, একই বাক্য একবার বর্তমানের জন্য এবং একবার ভবিষ্যত্কালের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে। অর্থাত্ বর্তমানে যেমন আমি তোমাদের উপাস্যের ইবাদত করি না, ভবিষ্যতেও এরূপ হবে না। মজার ব্যাপার হলো, এই একটি সুরা যার একটি আয়াত—‘তোমাদের জন্য তোমাদের কর্মফল এবং আমার জন্য আমার কর্মফল’ নিয়ে কিছু লোক কোরআন থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ (যদিও সেক্যুলারিজম মতবাদের বাংলা তরজমা হলো—ইহজাগতিকতা) এর প্রমাণ পেশ করতে চেষ্টা করেন—প্রকৃতপক্ষে পুরো সুরাটিই কথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের বিপক্ষে ইসলামের দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ও জোরালো অবস্থানের ঋজু অভিব্যক্তি।
ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি উদার দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে ইসলামের জুড়ি নেই। ভিন্নধর্মের অনুসারীর ওপর জোর-জবরদস্তি তো দূরের কথা, নির্বিঘ্নে তাদের ধর্ম পালনের পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ যাবতীয় নাগরিক অধিকার প্রদানে ইসলাম অকুণ্ঠচিত্ত। তবে এর অর্থ এমন ভাবা ঠিক নয় যে, ইসলামের জন্য স্বাতন্ত্র্যের সীমারেখা বলতে কিছু থাকবে না। ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভুল ব্যাখ্যা সমাজে সমপ্রীতি ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য নয়, বিশৃঙ্খলা ও বিভ্রান্তি উত্পাদন করবে। বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের মাঝে সামাজিক সৌহার্দের পরিবর্তে নির্মূল ভাবনাকেই উসকে দেবে। এতে আমাদের উদারমুসলিম চরিত্র যেমন ম্লান হতে পারে, তেমনি মধ্যপন্থী গণতান্ত্রিক মূল্যবোধেরও ভিত নড়ে উঠতে বাধ্য।
বিষয়টির অবতারণা প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠার কারণ হলো, ১১ ডিসেম্বর ২০১১ শনিবার বায়তুল মোকাররমের ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিলনায়তনে মসজিদের ইমাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান প্রতিনিধি এবং ইফার কর্মকর্তাদের নিয়ে আয়োজিত এক সভায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি ও ধর্মপ্রতিমন্ত্রীর এ সম্পর্কিত একটি বক্তব্য। ‘মানব সম্পদ উন্নয়নে ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্তকরণ প্রকল্পের দুই দিনব্যাপী বার্ষিক সভা ও কর্মশালা’ শিরোনামে অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিল ইসলামিক ফাউন্ডেশন। ধর্মপ্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট শাহজাহান মিয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের লোকদের সঙ্গে সমপ্রীতি বজায় রাখতে দেশের ইমামদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘রাসুল (সা). মসজিদের অর্ধেক হিন্দুদের পুজার জন্য ছেড়ে দিয়েছিলেন। বর্তমান সরকারও ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সব ধর্মের লোকদের মধ্যে সেই ধরনের সমপ্রীতির সম্পর্ক গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।’ অন্যদিকে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ডিজি সামীম মুহাম্মদ আফজাল বলেন, রাসুল ইহুদিদের ইবাদতের জন্য মসজিদের অর্ধেক দিয়ে দিয়েছিলেন। আমরা সেই নবীর উম্মত (দেখুন, দৈনিক নয়া দিগন্ত, দৈনিক আমার দেশ, ১২.১২.২০১১ খ্রি. রবিবার)।’ প্রতিবাদকারী উপস্থিত ইমামদের মধ্যে অনেকেই প্রতিমন্ত্রী এবং ডিজিকে তাদের দাবির সপক্ষে কোরআন-হাদিসের কিংবা নির্ভরযোগ্য কোনো ধর্মীয় গ্রন্থের প্রমাণ পেশ করতে বললে একজন অপারগতা প্রকাশ ও অন্যজন প্রসঙ্গান্তরে চলে যান। এতে করে তাত্ক্ষণিকভাবে পরিস্থিতি শান্ত হলেও এ ধরনের অসত্য, বিভ্রান্তিকর ও উসকানিমূলক কথাবার্তা সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টের ইন্ধন জোগাবে।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসলামিক ফাউন্ডেশন মৌলিক গবেষণাকর্ম, ধর্মীয় গ্রন্থাদি মুদ্রণ ও ইসলামী প্রকাশনার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে। সমপ্রতি প্রতিষ্ঠানটির কিছু কর্মকাণ্ড ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতসহ জনমনে ব্যাপক বিভ্রান্তি ছড়ানোর কারণে বিতর্কিত ও নিন্দিত হচ্ছে। কোনো বিশেষজ্ঞ আলিম এমনকি ইসলাম সম্পর্কে যাদের অল্প-বিস্তর পড়াশোনা রয়েছে তাদের পক্ষে ধর্মীয় উদারতার এমন সরলীকরণ মেনে নেয়ার সুযোগ নেই। অন্যদিকে একই অনুষ্ঠানে বক্তব্যের একপর্যায়ে প্রতিমন্ত্রী ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাসুলের আদর্শ বলে অভিমত দিয়ে রীতিমত ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। বিদায় হজের ভাষণে রাসুলের কণ্ঠে ইসলামী ভ্রাতৃত্ব ও মানবাধিকারের সনদ ঘোষিত হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার দলিল নয়। প্রকৃত বাস্তবতা হলো, ইসলামে ধর্মনিরপেক্ষতারূপী কোনো গোঁজামিল বিশ্বাসের স্থান নেই। ইসলাম সম্পূর্ণ স্বচ্ছ, সর্বজনীন, বৈষম্যহীন ও প্রকৃতিসম্মত পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান।
মুসলিমপ্রধান সমাজে মুসলমানরা যেমন সংখ্যালঘু ভিন্নধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়ে নিজেদের স্বত্ব দাবি করে না, তেমনি কোনো সুস্থ বুদ্ধির হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ধর্মের অনুসারী ইসলামের উদারতার দোহাই দিয়ে তাঁদের পুজা-পার্বণের জন্য মসজিদের অর্ধেক জায়গা ছেড়ে দেয়ার মতো উদ্ভট আবদার কখনও করবেন বলে মনে হয় না।
সূত্র : আমার দেশ

Monday, December 19, 2011

আমিও ছিলাম, আমিও থাকব || আল মাহমুদ

বিজয়ের চল্লিশ বছর অতিক্রম করছি। এর মধ্যে কত ঘটনাই ছবির মতো চোখের সামনে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি অবশ্য অতীত নিয়ে চর্চা করতে অভ্যস্ত নই। কারণ অতীত প্রকৃতপক্ষে কবির মনে একপলক স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। একাকী বসে থাকলে মানুষ স্বভাবতই একটু অতীতাশ্রয়ী হয়ে পড়ে। আর আমি যেহেতু একজন কবি এবং কবি ছাড়া আর কিছুই নই, সে কারণে কবিতা নির্মাণের অনেক স্মৃতি, বিস্তৃতি এবং বিবরণ আমার মনে উদিত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। যদিও আমি কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ লিখেছি অনেক, তবুও আমার সামান্য খ্যাতি ও প্রতিপত্তি কাব্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠা আমাকে মনে মনে পুলকিত করে।
জীবন কাটিয়েছি লিখে, যদিও শুধু কবিতা লিখে একজন কবির জীবন অতিবাহিত হয় না। গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধাদিও আমি লিখে গেছি। বর্তমানে আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কাছের মানুষকেও আর চিনতে পারি না। কিন্তু কী করে ভুলি যে আমার যৌবনে আমি কবিতাকেই উচ্চকিত করে তুলেছিলাম। কত স্বপ্ন দেখেছি। বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতে, কঠোর বাস্তবে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়েছে। আমাদের দেশের মাটি আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ তোলে, লেগে আছে, আমি সেটা অনুভব করি। দেশ ও জাতির প্রতি যদিও আমার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না, তবু অলিখিত অনেক প্রতিশ্রুতি কবির থেকেই যায়। তবে একথা আমি বলতে পারি, আমি যা কিছু লিখেছি তা আমার দেশের মানুষ, মাটি, প্রকৃতি এবং পরিবেশের কাহিনীতে কলরবমুখর হয়ে আছে।
যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তখন আপনা থেকেই মনে অনুভব করি একটি সুন্দর, সুস্থ ও শান্ত বাংলাদেশ। সৃষ্টির আয়োজন আপনা থেকেই অনিবার্য হয়ে ধরা দেবে। দেশপ্রেম কবিদের হৃদয়ে একটি সাধারণ সত্য হিসেবে অনুভূত হয়। আমি আমার দেশ ও জাতির জন্য যৌবনে অবিশ্রান্তভাবে লিখে গেছি। আমার লেখার পরিমাণ একেবারে সামান্য নয়। তবে সব কথা, কল্পনা এবং স্বপ্নকে ভাষায় রূপ দিতে হয়তো ঠিকমত পারিনি। কিন্তু আমার সযত্ন প্রয়াস সব বিষয়ের ওপর ছড়িয়ে আছে। আজ দেখতে পাচ্ছি, বৃহদাকারের কাব্যসমগ্র, গল্পসমগ্র, এবং উপন্যাস ইত্যাদি তাকে উপচে পড়ছে। দেখি আর ভাবি আমি কখন, কীভাবে এত কাজ করতে সমর্থ হয়েছিলাম।
মানুষের যৌবন একটা পরিশ্রমের সময়। আমি সেটা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে করেছিলাম বলেই কত মানুষের
সঙ্গে আমার হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়েছিল। আমি এজন্য মনে মনে অত্যন্ত পুলক অনুভব করি। আমি লিখেছি আমার সাধ্যমত। জমে উঠেছে ক্রমে ক্রমে। বেড়ে গেছে লেখার পরিধি। আগেই বলেছি তাক উপচে পড়ছে। অনেক জিনিস আছে, যা ভাঁজ করে রাখা যায় না। তার মধ্যে কাব্যই সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমি মনে মনে অনুভব করি আমি কবি ছাড়া আর কীই-বা হতে পারতাম, না, কিছুই হতাম না।
দুই চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্নের এক চলচ্চিত্র যেন চলতে থাকে। বাংলাদেশে লিখে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ নয়। কারণ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যারা কাজ করেছেন, তাদের কাজের পরিধি এবং মান আকাশকে স্পর্শ করে আছে। সহজে এসেই কেউ এই মেঘস্পর্শী কৃতিত্বের পাশে নতুন কোনো স্তম্ভ নির্মাণ করে সার্থকতার অর্জন করে, এটা সহজ কাজ নয়। অনাদিকাল থেকেই সেই চর্যাপদের সময় থেকেই বাঙালি কবিরা সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন, তা একেবারে সামান্য নয়। এক কথায় আমি অবশ্যই বলব যে, এক সামান্য উচ্চতায় বাংলা ভাষা ও কাব্যকে তারা নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আমি একজন সামান্য কবি। আমারও অতি সামান্য কিছু অবদান আছে বলে মনে করি। হয়তো এ কথার সহজ স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমার পরিশ্রম নিয়ে যদি আমি পরাক্রম প্রকাশ করি, তাতে দোষ বর্তায় না। কারণ আমি তো কবি, স্বপ্নচারী এবং সৃষ্টিশীল মানুষ। কোনো সময়ই আমার কোনো ক্লান্তি আমাকে বশে রাখতে পারেনি। ক্রমাগত লিখেছি। অবশ্য কাব্যচর্চা সব সময় স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারেনি।
দেশের নানা দুর্যোগ, দুর্ঘটনায়, বিপ্লবে, অন্তর্বিপ্লবে যেহেতু আমি কবি, আমিও শিহরিত হয়েছি। এবং আমার এতে অংশগ্রহণ আছে। আজ যখন দেখি, বৃহদাকার অনেক পুস্তক আমারই নামাঙ্কিত হয়ে শোভা পাচ্ছে, তখন হৃদয়ে এক ধরনের শান্তি অনুভব করি। আর সাহসের সঙ্গে বলতে চাই যে, আধুনিক বাংলা সাহিত্য বহু কীর্তিমান কবি, লেখকদের অবদানে অনতিক্রম্য উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। আমিও আমার সামান্য শক্তি নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করেছি। চর্যাপদ থেকে শুধু ধরলে এই সাম্প্রতিককালের বাংলা কবিতা পর্যন্ত একটি সুন্দর ধারাবাহিকতা নির্মিত হয়েছে। কত কবির অশ্রু, হাসি, ক্রন্দন, আনন্দ, কলরব এর মধ্যেই মিশ্রিত হয়েছে। আমার আনন্দ হলো আমি আছি, আমিও ছিলাম, আমিও থাকব। এর জন্যে কারও কোনো স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। হ

শ্রুতিলিখন : আহমদ বাসির
সূত্র : আমার দেশ

উনিশ শ’ একাত্তর || হুমায়ূন আহমেদ

তারা এসে পড়ল সন্ধ্যার আগে আগে। বিরাট একটা দল। মার্চ-টার্চ কিছু না। এলোমেলোভাবে হেঁটে আসা। সম্ভবত বহুদূর থেকে আসছে। ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে একেক জন। ঘামে মুখ ভেজা। ধূলি ধূসরিত খাকি পোশাক।
গ্রামের লোকজন প্রায় সবাই লুকিয়ে পড়ল। শুধু বদি পাগলা হাসিমুখে এগিয়ে গেল। মহানন্দে চেঁচিয়ে উঠল, বিষয় কি গো?
পুরো দল থমকে দাঁড়াল মুহূর্তে। বদি পাগলার হাতে একটা লাল গামছা। সে গামছা নিশানের মত উড়িয়ে চেঁচাল, কই যান গো আপনেরা? এমন অদ্ভুত ব্যাপার সে আগে কখনো দেখেনি।
মেজর সাহেবের চোখে সানগ্লাস। তিনি সানগ্লাস খুলে ফেলে ইংরেজিতে বললেন, লোকটা কি বলছে? রফিকউদ্দীন সঙ্গে সঙ্গে বলল, লোকটা মনে হচ্ছে পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে পাগল থাকে।
তাই নাকি?
জ্বি স্যার।
বুঝলে কি করে এ পাগল?
রফিকউদ্দীন চুপ করে গেল। মেজর সাহেবের খুব পেঁচানো স্বভাব। একটি কথার দশটি অর্থ করেন। বদি পাগলাকে দেখা গেল ছুটতে ছুটতে আসছে। তার মুখ ভর্তি হাসি। রফিক ধমকে উঠল, ‘এ্যাই, কি চাস তুই?’ বদি পাগলার হাসি আরো বিস্তৃত হল। রফিক কপালের ঘাম মুছল। সরু গলায় বলল, লোকটা স্যার পাগল। আমাদের সব গ্রামে একটা করে... ।
এই কথা তুমি আগে একবার বলেছ। একই কথা দু’তিনবার বলার প্রয়োজন নেই।
রফিক ঢোঁক গিলল। মেজর সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এ জায়গাটা আমার পছন্দ হচ্ছে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করা যাক। সবাই টায়ার্ড।
মাইল পাঁচেক গেলেই স্যার নবীনগর। খুব বড় বাজার, পুলিশ ফাঁড়ি আছে। সন্ধ্যা নামার আগে আগে স্যার নবীনগর চলে যাওয়া ভাল।
কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছ?
জ্বি না স্যার, ভয় পাব কেন?
মেজর সাহেব দলটির দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বললেন। মৃদু সাড়া জাগল। নিমেষের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড়ল সবাই। মাথা থেকে ভারী হেলমেট খুলে ফেলতে লাগল। মেজর সাহেব নিচু সুরে বললেন, পাগলটাকে বেঁধে ফেলতে হবে।
তিনি কাঠের একটি বাক্সের ওপর বসে পাইপ ধরালেন। খাকি পোশাক পরা কারো মুখে পাইপ মানায় না। কিন্তু মেজর সাহেব অসম্ভব সুপুরুষ। তাঁর মুখে সবকিছুই মানায়।
পাগলটাকে আম গাছের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হল। তার কোনো আপত্তি দেখা গেল না। বরং কাছাকাছি থাকতে পারার সৌভাগ্যে তাকে আনন্দিত মনে হল। কেউ তার দিকে তেমন নজর দিল না। এরা অসম্ভব ক্লান্ত। এদের দৃষ্টি নিরাসক্ত ও ভাবলেশহীন।
মেজর সাহেব পানির বোতল থেকে কয়েক চুমুক পানি খেলেন। বুটজুতা জোড়া খুলে ফেললেন। তার বাঁ পায়ের গোড়ালিতে ফোসকা পড়েছে। রফিক বলল, ডাব খাবেন স্যার? মেজর সাহেব সে কথার জবাব না দিয়ে শান্ত স্বরে বললেন, আগে আমরা কোনো গ্রামে গেলেই ছোটখাটো একটা দল পাকিস্তানি পতাকা হাতে নিয়ে আসত। এখন আর আসে না। এর কারণ কি জান?
জানি না স্যার।
ভয়ে আসে না। এই গ্রামের সব ক’টি লোক এখন জঙ্গলে লুকিয়ে আছে। ঠিক না?
রফিক জবাব দিল না। বদি পাগলা বলল, এট্টু বোতলের পানি খাইতে মন চায়।
ও কি চায়?
ওয়াটার বটল থেকে পানি খেতে চায় স্যার।
গ্রামের সবাই পালিয়ে গেলেও আজীজ মাস্টার যেতে পারেনি। কারণ সোনাপোতা থেকে তার ছোট বোন এসেছিল। আজ সকাল থেকেই তার প্রসব ব্যথা শুরু হয়েছে। এ রকম একজন মানুষকে নিয়ে টানাটানি করা যায় না। তবু আজীজ মাস্টার দু’বার বলল, ধরাধরি কইরা নাওডাত তুললে শ্যামগঞ্জ লইয়া যাওন যায়। তার জবাবে আজীজ মাস্টারের মা তার কাপুরুষতা নিয়ে কুিসত একটা গাল দিয়েছেন। পা ভাঙা বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আজীজ মাস্টার প্রতিবাদ করেনি। কারণ কথাটি সত্যি। সে বড়ই ভীতু। গ্রামে মিলিটারি ঢুকেছে শোনার পর থেকে তার ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হচ্ছে। সে বসে আছে উঠোনে এবং সামান্য শব্দেও দারুণভাবে চমকে উঠছে।
মাস্টার বাড়িতে আছে?
কেডা?
আমরা। খবর হুনছ? বদি পাগলারে বাইন্দা রাখছে আম গাছে।
হুনছি।
নীলগঞ্জের মুরব্বিদের কয়েকজন শংকিত ভঙ্গিতে উঠে এল উঠোনে।
তোমার তো একটু যাওন লাগে মাস্টার।
কই যাওন লাগে?
দবীর মিয়া তার উত্তর না দিয়ে নিচু গলায় বলল, তুমি ছাড়া কে যাইব? তুমি ইংরেজি জান। শুদ্ধ ভাষা জান।
মিলিটারির কাছে যাইতে কন?
হ।
আমি গিয়া কি করতাম?
গিয়া কইবা এই গেরামে কোনো অসুবিধা নাই। পাকিস্তানের নিশানটা হাতে লইয়া যাইবা। ভয়ের কিছু নাই।
মাস্টার অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না। দবীর মিয়া বিরক্ত হয়ে বলল, কথা কও না যে?
আমি যাই ক্যামনে? বাড়িতে অত বড় বিপদ। পুতির বাচ্চা অইব।
তোমার তো কিছু করনের নাই মাস্টার। তুমি ডাক্তারও না, কবিরাজও না।
মাস্টার ক্ষীণস্বরে বলল, পাকিস্তানের পতাকা পাইয়াম কই?
ক্যান ইস্কুলের পতাকা কি করলা?
ফালাইয়া দিছি।
ফালাইয়া দিছ? ক্যান?
মাস্টার জবাব দেয় না। দবীর মিয়া রাগী গলায় বলে, আইএ পাশ করলে কি হইব মাস্টার, তোমার জ্ঞান-বুদ্ধি অয় নাই। পতাকাটি তুমি ফালাইলা কোন আক্কেলে? অখন কি আর করবা? যাও খালি হাতে।
আমার ডর লাগে চাচাজী।
ডরের কিছু নাই। এরা বাঘও না, ভল্লুকও না। তুমি গিয়া খাতির-যত্ন কইরা দুইটা কথা কইবা। এক মিনিটের মামলা। কি কও আসমত?
নেয্য কথা।
দেরি কইরো না। আন্ধাইর হওনের আগেই যাও।
একলা?
একলা যাওনই বালা। একলাই যাও। তিনবার কুলহু আল্লাহ কইয়া ডাইন পাওডা আগে ফেলবা। পাঁচবার মনে মনে কইবা ‘ইয়া মুকাদ্দেমু’ ভয়-ডরের কিছুই নাই মাস্টার। আল্লাহর পাক কালাম। এর মরতবাই অন্যরকম।
আজীজ মাস্টার মাথা নিচু করে বসে রইল। তার আবার প্রস্রাবের বেগ হয়েছে। ঘরের ভেতর থেকে পুতি কুঁ কুঁ করছে। প্রথম পোয়াতি, খুব ভোগাবে।
ভইনটারে এমুন অবস্থায় ফালাইয়া ক্যামনে যাই?
এইটা কি কথা? তুমি ঘরে থাইক্যা করবাটা কি? বেকুবের মত কথা কও খালি। উঠ দেহি।
আজীজ মাস্টার উঠল।
মেজর সাহেব দীর্ঘ সময় তার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন। অন্ধকার হয়ে আসছে। তার মুখের ভাব ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনি বসে আছেন কাঠের একটি বড় বাক্সের ওপর। পা দু’টি ছড়ানো। মেজর সাহেব পরিষ্কার বাংলায় বললেন, কি চাও?
আজীজ মাস্টার থতমত খেয়ে গেল। এ বাংলা জানে নাকি? কি আশ্চর্য!
কি চাও তুমি?
জ্বি, কিছু চাই না।
মেজর সাহেব এবার ইংরেজিতে বললেন, কিছু না চাইলে এসেছ কেন?
তামাশা দেখতে? সার্কাস হচ্ছে?
আজীজ মাস্টার ঘামতে শুরু করল। মেজর সাহেবের পরবর্তী সমস্ত কথোপকথন হল ইংরেজিতে। আজীজ মাস্টার বেশিরভাগ জবাবই দিল বাংলায়। তাতে অসুবিধা হল না। মেজর সাহেব বাংলা বুঝতে পারেন।
তুমি কি কর?
আমি এখানকার প্রাইমারি স্কুলের টিচার।
এখানে আবার স্কুলও আছে নাকি?
জ্বি স্যার।
আর কি আছে?
একটা মসজিদ আছে।
শুধু মসজিদ? মন্দির নেই? পূজা হয় যেখানে?
জ্বি না স্যার।
ঠিক করে বল মন্দির আছে কিনা?
নাই স্যার।
মেজর সাহেব পাইপ ধরালেন। ঠাণ্ডা গলায় কাকে যেন পাঞ্জাবি বা অন্য কোনো ভাষায় কি বললেন। সেই লোকটি উঠে এসে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিল আজীজ মাস্টারের গালে। আজীজ মাস্টার চিত্ হয়ে পড়ে গেল। আম গাছের সঙ্গে বাঁধা বদি পাগলা দারুণ অবাক হয়ে বলল, ও মাস্টার উঠ উঠ। যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে মেজর সাহেব বললেন, তোমার নাম কি?
আজীজুর রহমান।
আজীজুর রহমান, তোমাদের এদিকে মুক্তিবাহিনী আছে?
জ্বি না।
সবাই পাকিস্তানি?
জ্বি।
বাহ, খুব ভাল। তুমি নিজেও একজন খাঁটি পাকিস্তানি, ঠিক?
জ্বি স্যার।
সবাই পাকিস্তানি হলে এত ভয় কিসের? আমার তো মনে হয়, এ গ্রামের সবাই ভয়ে পালিয়েছে। মেয়েগুলি লুকিয়ে আছে জঙ্গলে, ঠিক না?
আজীজ মাস্টার জবাব দিল না। তার মাথা ঘুরছে। বমি আসছে। বহু কষ্টে সে বমির বেগ সামলাতে লাগল।
তোমাদের কি ধারণা, আমরা তোমাদের মেয়েদের ধরে নিয়ে যাব?
আজীজ মাস্টার চুপ করে রইল।
কি, কথা বলছ না যে? তোমার স্ত্রীও কি জঙ্গলে লুকিয়েছে?
স্যার আমি বিয়ে করিনি।
বিয়ে করনি? বয়স কত তোমার?
চল্লিশ।
চল্লিশ, এখনো বিয়ে করনি? তাহলে চালাও কিভাবে? মাস্টারবেট কর?
আজীজ মাস্টার কপালের ঘাম মুছল। মেজর সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন, কথার জবাব দাও। রফিকউদ্দীন ক্ষীণ সুরে বলল, স্যার জানতে চাচ্ছেন আপনি হস্তমৈথুন করেন কিনা? বলে ফেলেন ভাই। স্যার রেগে যাচ্ছেন।
করি না।
বল কি? তোমার যন্ত্রপাতি ঠিক আছে? দেখি, পায়জামা খুলে সবাইকে দেখাও তো।
স্যার কি বললেন?
পায়জামা খুলে তোমার যন্ত্রটা সবাইকে দেখাতে বললাম। ঝটপট কর। দেরি করবে না। আমার হাতে বেশি সময় নেই।
আজীজ মাস্টার অবাক হয়ে তাকাল রফিকের দিকে। রফিকউদ্দীন অস্পষ্ট স্বরে বলল, খুলে ফেলেন ভাই। ব্যাটা ছেলেদের মধ্যে আবার লজ্জা কি? খুলে ফেলেন, স্যার রাগ করছেন। মেজর সাহেব নিচু গলায় কি একটা বললেন, একজন এসে হ্যাঁচকা টানে আজীজ মাস্টারের পায়জামা নামিয়ে ফেলল। মেজর সাহেব বললেন, জামাটাও খুলে নাও।
আজীজ মাস্টার দু’হাতে তার লজ্জা ঢাকার চেষ্টা করতে লাগল। একটা মৃদু হাসির গুঞ্জন উঠল চারদিকে। একজন কে যেন কাগজের দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে মারল আজীজ মাস্টারের দিকে। মেজর সাহেব বললেন, তুমি পাকিস্তানিদের ভালবাস?
জ্বি স্যার।
ভেরি গুড। আমাকেও নিশ্চয়ই ভালবাস। বাস না? বল, বলে ফেল।
বাসি স্যার।
যে তোমাকে নেংটা করে দাঁড়া করিয়ে রেখেছে, তাকেও তুমি ভালবাসছ। তুমি তো বিশ্বপ্রেমিক দেখছি।
মেজর সাহেব অনুচ্চ স্বরে কি একটা বলতেই চারদিকে হাসির বান ডেকে গেল। বদি পাগলা চোখ বড় করে বলল, মাস্টার, তোমার কাপড় কই? এ্যাই মাস্টার।
আজীজ মাস্টার ঘোলা চোখে তাকাল তার দিকে। তার বমি বমি ভাবটা কেটে গেছে। শুধু মাথার পিছন দিকটায় তীব্র ও তীক্ষষ্ট একটি যন্ত্রণা। মেজর সাহেব বললেন, আজীজুর রহমান, তুমি ভয়ে মিথ্যা কথা বলছ প্রাণে বাঁচবার জন্যে। সত্যি কথা বল তোমাকে ছেড়ে দেব, তুমি কি আমাকে পছন্দ কর?
না।
এই তো আসল কথা বেরুচ্ছে। তুমি কি চাও এটা বাংলাদেশ হোক?
জ্বি স্যার।
তুমি তাহলে একজন দেশদ্রোহী। দেশদ্রোহীর মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। আমি সেই ব্যবস্থাই করতে চাই। নাকি তুমি বাঁচতে চাও?
আজীজ মাস্টার জবাব দিল না।
দেরি করবে না। বলে ফেল বাঁচতে চাও কি-না।
রফিকউদ্দীন ভয়-পাওয়া গলায় বলল, বলেন ভাই বাঁচতে চাই। এ রকম করছেন কেন? শুধু শুধু নিজের বিপদ ডেকে আনছেন।
বদি পাগলা আবার কথা বলে উঠল, ও মাস্টার কাপড় পিন্দ! তুমি নেংটা।
আজীজ মাস্টার নড়ল না। মেজর সাহেব বললেন, কাপড় পর। কাপড় পরে আমার সামনে থেকে বিদেয় হয়ে যাও। ক্লিয়ার আউট।
আজীজ মাস্টার কাপড় পরল না। হঠাত্ একদলা থুথু ফেলল। সেই থুথু মেজর সাহেবের ডান হাঁটুর কাছে এসে পড়ল। মেজর সাহেব চোখ তুলে তাকালেন। চারদিকে কোনো শব্দ নেই। আজীজ মাস্টার এগিয়ে এসে আরেক দলা থুথু ফেলল। সেই থুথু মেজর সাহেবের শার্টে এসে পড়ল। তিনি শান্ত স্বরে বললেন, যথেষ্ট বিশ্রাম হয়েছে। এবার আমরা রওয়ানা হব।
সৈন্যদল মার্চ করে এগুচ্ছে। মেজর সাহেবের মুখ অসম্ভব বিবর্ণ। পেছনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে একজন নগ্ন মানুষ।
সূত্র : আমার দেশ

নাসির উদ্দিন হোজ্জার কৌতুক | ২ |

গায়ের জামা
হোজ্জার বাড়িতে এক বন্ধু এসেছেন বেড়াতে। সন্ধ্যায় প্রতিবেশীদের সাথে পরিচয় করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় হোজ্জা নিজের একটি ভাল পোশাক ধার দিলেন। প্রথম বাড়িতে হোজ্জাকে বন্ধুকে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় এও জানালেনঃ "এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, তা আসলে আমার।"
সেখান থেকে বেরিয়ে বন্ধু মহা ক্ষ্যাপা। "কী দরকার ছিল ওটা বলে আমাকে অপমান করার?" হোজ্জা ক্ষমা চাইলেন।
দ্বিতীয় বাড়িতে গিয়ে বললেন, "এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, তা আসলে এঁরই।" এবার তো বন্ধু আরো ক্ষ্যাপলেন। "পোশাকটি নিয়ে তুমি কিছু না বলাই ভাল"
তৃতীয় বাড়িতে গিয়ে তাই হোজ্জা বললেন, "ইনি আমার ঘনিষ্ট বন্ধু আর এঁর গায়ে যে পোশাকটি দেখছেন, সে সম্পর্কে কিছু না বলাই ভাল!"

আঙুর বিক্রেতা হোজ্জা
হোজ্জা বাজারে বসেছেন আঙুর বিক্রেতা হিসেবে। এক বন্ধুকে দেখে তার কাছেই আঙুর বেচতে চাইলেন। কিন্তু, বন্ধু বললেন যে, তার কাছে টাকা নেই। হোজ্জা উদার মানুষ। বললেন, "আপনি বন্ধু মানুষ। টাকা পরে দিলেও চলবে। দুটো আঙুর মুখে দিয়ে দেখুন, মধুর মত মিষ্টি।" বন্ধু অপারগতা জানিয়ে বললেন যে, তিনি রোজাদার। হোজ্জার জিজ্ঞাস্য, রোজার মাস আসতে এখনো দুই মাস বাকি। এখনই রোজা? বন্ধু বিগত বছরের ভাঙা রোজাগুলো পূরণ করার কথা জানালেন। সাথে সাথে হজ্জা বললেন, " ভাই আমি তোমার কাছে আঙুর বেচব না, যে লোক খোদার বাকি পূরণ করতে দশ মাস লাগায়, সে আমার বাকি টাকা দিতে ক'বছর লাগাবে?"

জোনাকীরা || আহসান হাবীব

তারা- একটি দু'টি তিনটি করে এলো
তখন- বৃষ্টি-ভেজা শীতের হাওয়া
বইছে এলোমেলো,
তারা- একটি দু'টি তিনটি করে এলো।

থই থই থই অন্ধকারে
ঝাউয়ের শাখা দোলে
সেই- অন্ধকারে শন শন শন
আওয়াজ শুধু তোলে।
ভয়েতে বুক চেপে
ঝাউয়ের শাখা , পাখির পাখা
উঠছে কেঁপে কেঁপে ।
তখন- একটি দু'টি তিনটি করে এসে
এক শো দু শো তিন শো করে
ঝাঁক বেঁধে যায় শেষে!

তারা- বললে ও ভাই, ঝাউয়ের শাখা,
বললে ও ভাই পাখি,
অন্ধকারে ভয় পেয়েছো নাকি ?
যখন- বললে, তখন পাতার ফাঁকে
কী যেন চমকালো।
অবাক অবাক চোখের চাওয়ায়
একটুখানি আলো।

যখন- ছড়িয়ে গেলো ডালপালাতে
সবাই দলে দলে
তখন- ঝাউয়ের শাখায়- পাখির পাখায়
হীরে-মানিক জ্বলে।
যখন- হীরে-মানিক জ্বলে
তখন- থমকে দাঁড়াঁয় শীতের হাওয়া
চমকে গিয়ে বলে-
খুশি খুশি মুখটি নিয়ে
তোমরা এলে কারা?
তোমরা কি ভাই নীল আকাশের তারা ?

আলোর পাখি নাম জোনাকি
জাগি রাতের বেলা,
নিজকে জ্বেলে এই আমাদের
ভালোবাসার খেলা।
তারা নইকো- নইকো তারা
নই আকাশের চাঁদ
ছোট বুকে আছে শুধুই
ভালোবাসার সাধ।

কৃতজ্ঞতা : প্রিয় বই

ভাঙ্গা ও গড়া || সাইয়্যেদ আবুল আ'লা মওদূদী

প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা সবই আল্লাহর জন্য। তিনি আমাদেরকে সূষ্টি করেছেন। আমাদেরকে জ্ঞান, বুদ্ধি ও বুঝবার শক্তি এবং ভাল-মন্দের মধ্যে পার্থক্য করার ক্ষমতাও দিয়েছেন। আমাদের সঠিক পথ প্রদর্শন ও নেতৃত্ব দানের জন্য তিনি তাঁর সর্বোত্তম বান্দাদেরকে পাঠিয়েছেন। তাঁরা মানুষকে মানবতা শিক্ষা দিয়েছেন, সৎলোকের মতো জীবনযাপন করা শিখিয়েছেন এবং মানব জীবনের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত করেছেন। যে সমস্ত নিয়ম-নীতি অনুযায়ী জীবন যাপন করলে মানুষ দুনিয়ায় সুখ-শান্তি ও পরকালে মুক্তি লাভ করতে পারে তাও তারা বলে এবং করে দেখিয়ে দিয়েছেন। তাঁদের সবার উপর শান্তি বর্ষিত হোক।

সমবেত ভদ্রমন্ডলী ও মহিলাবৃন্দ!

যে আল্লাহ্ এই দুনিয়াকে সৃষ্টি করে পৃথিবী পৃষ্ঠকে বিছানার মতো করে তৈরী করেছেন এবং তার উপর মানুষের বসবাস করার সুব্যবস্থা করেছেন, তিনি অন্ধের মতো আন্দাজ-অনুমানের ভিত্তিতে কোন কাজ করেন না। কোন কিছু না দেখেশুনে অন্ধকারে হাতড়িয়ে সব কিছু লন্ডভন্ড করে দেবার মতো বাদশাহ তিনি নন। তাঁর নিজস্ব আইন-কানুন, বলিষ্ঠ নিয়ম-নীতি, সুদৃঢ় ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু কর্মপদ্ধতি রয়েছে। তদনুযায়ী তিনি সমগ্র বিশ্ব জাহানের উপর একচ্ছত্র কর্তৃত্ব করছেন। পৃথিবী, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, পানি, বাতাস, বৃক্ষ, পশু-পাখি ইত্যাদির মতো আমরা গোটা মানব জাতিও তাঁর প্রাকৃতিক আইন ও নিয়মের অধীনে সুসংবদ্ধ। আমাদের জন্ম ও মৃতু্য, আমাদের শৈশব, আমাদের যৌবন ও বার্ধক্য, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাস, আমাদের পাকস্থলী ও রক্ত চলাচল, আমাদের সুস্থতা ও অসুস্থা ইত্যাদি সব কিছুর উপরই তাঁর চিরন্তন প্রাকৃতিক আইন ও নিয়মের কর্তৃত্ব একটানাভাবে রীতিমত চলছে। এছাড়া তাঁর আর একটা আইনও রয়েছে। সেটা তাঁর প্রাকৃতিক আইনের মতই আমাদের ইতিহাসে উঠা-নামা, আমাদের উত্থান-পতন, আমাদের উন্নতি-অবনতি এবং ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত -তথা দেশ ও জাতির ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের উপর কর্তৃত্ব করছে। আল্লাহর প্রাকৃতিক আইন অনুযায়ী নাকের বদলে চোখের সাহয্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করা এবং পেটের বদলে হৃদয়ে খাদ্য হজম করা যদি মানুষের পক্ষে সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে যে পথে চললে আল্লাহর আইন অনুযায়ী কোন জাতির অধপতন হওয়া উচিত, সেই পথে তার উন্নতি হওয়া সম্বব নয়। আগুন যেমন একজনের জন্য গরম এবং আরেক জনের জন্য ঠান্ডা নয়, তেমনি আল্লাহর আইন অনুযায়ী যে সমস্ত কাজ খারাপ তা একজনকে অবনত এবং অন্য জনকে উন্নত করতে পারে না। মানুষের ভাল-মন্দের জন্য আল্লাহ্ যে নিয়ম-নীতি নির্ধারিত করেছেন, তা কারোর চেষ্টায় পরিবর্তিত ও বাতিল হতে পারে না। তার ভেতর কারো সঙ্গে শত্রুতা এবং কারো সঙ্গে স্বজনপ্রীতিও নেই। আল্লাহর এই আইনের সর্বপ্রথম ও সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ধারা হচ্ছে এই যে, তিনি গড়া পছন্দ করেন এবং ভাঙ্গা পছন্দ করেন না। সব কিছুর মালিক হিসেবে তিনি তাঁর দুনিয়াকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে চান। একে অতিমাত্রায় সুসজ্জিত করতে চান। তাঁর যাবতীয় উপায় উপাদান এবং শক্তি ও যোগ্যতাকে সুষ্ঠু পন্থায় সদ্ব্যবহার করতে চান। তিনি কখনও তাঁর দুনিয়ার ধ্বংস ও অনিষ্ট সাধন করেন না। বিশৃংখলা, কুকর্ম, অত্যাচার ও অনাচার করে তাঁর দুনিয়াকে শ্রীহীন সৃষ্টিতে পরিণত করাকে তিনি কোনদিন পছন্দ করবেন বলে আশাও করা যেতে পারে না। যে সমস্ত লোক দুনিয়া পরিচালনার ক্ষমতা লাভ করতে চায় তাদের ভেতর থেকে কেবলমাত্র তারাই আল্লাহর দৃষ্টিতে যোগ্যতাসম্পন্ন হয়; যারা এ দুনিয়াকে গড়বার যোগ্যতা অন্যদের চেয়ে বেশী রাখে। এরূপ যোগ্যতাসম্পন্ন লোকদেরকেই তিনি দুনিয়া পরিচালার দায়িত্ব অর্পণ করে থাকেন।

অতঃপর এসব ক্ষমতাসীন লোকেরা কতটুকু ভাঙ্গে এবং কতটুকু গড়ে -সেদিকে তিনি তীক্ষ্ন দৃষ্টি রাখেন। যতক্ষণ পর্যন্ত তারা ভাঙ্গার চেয়ে গড়তে থাকে বেশী এবং তাদের চেয়ে বেশী গড়ে কম ভাঙ্গে -এমন কেউ কর্মক্ষেত্রে থাকে না, ততক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ্ তাদের সমস্ত দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও দুনিয়া পরিচালনার ক্ষমতা তাদের হাতেই রাখেন। কিন্তু যখন তারা গড়ে কম এবং ভাঙ্গে বেশী, তখন আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমতাচু্যত করে অন্য লোকদেরকে ঐ একই শর্তে ক্ষমতা দিয়ে থাকেন।

এটা একটা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক আইন। আপনাদের বিচার বুদ্ধিও প্রমাণ করবে যে, আইনটি এমনই হওয়া উচিত। যদি আপনাদের কারোর একটি বাগান থাকে এবং তিনি একজন মালীকে তার রক্ষণাবেক্ষণে নিযুক্ত করেন, তাহলে আপনি নিজেই বলুন, তিনি ঐ মালীর নিকট সর্বাগ্রে কি আশা করতে পারেন? তিনি অবশ্যি নিজের বাগানের ক্রমোন্নতি চাইবেন। তার শ্রীবৃদ্ধি ও উন্নতি, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, শোভা-সৌন্দর্য এবং উৎপাদন বৃদ্ধিই হবে তার কাম্য। যে মালীকে তিনি দেখবেন অত্যন্ত প্ররিশ্রম, যোগ্যতা ও মনোযোগ সহকারে সুনিপুণভাবে বাগানের সেবা যত্ন করছে, বাগানের সাজসজ্জার দিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখছে, তার চেষ্টা ও যত্নে ভাল দরকারী গাছগুলো বেশ সতেজ ও সুন্দর হচ্ছে, সে আগাছা, আবর্জনা ও বন-জঙ্গল পরিষ্কার করছে তার সুরুচি ও শিল্প শক্তি দিয়ে উৎকৃষ্ট ও নতুন ফল-মূল এবং ফুলের উৎপাদন বৃদ্ধি করছে- তার উপর তিনি অবশ্যই সন্তুষ্ট হবেন। তিনি তাকে ভালবাসবেন এবং উচ্চ মর্যাদা দেবেন। এমন উপযুক্ত, কর্তব্যপরায়ণ, পরিশ্রমী, অনুগত ও সুযোগ্য মালীকে তাড়িয়ে দেয়া তিনি কোন দিনই পছন্দ করবেন না। কিন্তু এ না হয়ে যদি ঠিক এর উল্টোঁাই হয় অর্থাৎ, যদি তিনি দেখেন যে, মালী অযোগ্য-অপদার্থ, আলসে ও ফাঁকিবাজ, সে সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে বাগানের ক্ষতি করছে, গোটা বাগানটা আবর্জনা ও বন-জঙ্গলে ভরে গিয়েছে, গাছের পাতা ও ডালগুলো ভেঙে পড়েছে, কোথাও বিনা প্রয়োজনে পানি বয়ে যাচ্ছে, আবার কোথাও পানির অভাবে মাটি ও গাছপালা সব শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘাস, আগাছা, বনজঙ্গল ও আবর্জনা দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, ফুল ও ফলবান গাছগুলোকে অকাতরে কেটে কেটে ফেলে দেয়া হচ্ছে, ভাল ভাল গাছগুলো মরে গিয়ে আগাছায় বাগান ভরে যাচ্ছে, তাহলে বলুন, বাগানের মালিক এমনতর মালীকে কি করে পছন্দ করতে পারে? কোন সুপারিশ, কাকুতি-মিনতি, সবিনয় নিবেদন ও প্রার্থনা এবং উত্তরাধিকার ও মনগড়া অধিকারের দরুন মালিক তার বাগানের দায়িত্বভার এমন অযোগ্য মালীর উপরই ন্যস্ত রাখবে? বড় জোর এতটুকু হতে পারে যে, সে মালীকে শাসিয়ে দিয়ে আর একবার তাকে দায়িত্ব পালনের সুযোগ দেবে। কিন্তু যে মালীর কোন শাসনেই চৈতন্য হয় না এবং ক্রমাগত বাগানের ক্ষতিই করতে থাকে, তাকে কান ধরে বের করে দিয়ে অন্য কোনো ভাল মালী নিযুক্ত করা ছাড়া মালিকের পক্ষে এ সমস্যার আর কি সমাধান হতে পারে?

যদি নিজের সামান্য একটা বাগান পরিচালনার ব্যাপারেও আপনি অনুরূপ পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। তাহলে চিন্তা করে দেখুন যে, আল্লাহ্ তাঁর এতবড় ভূমন্ডলটা এত সব উপায়-উপকরণসহ মানুষের কর্তৃত্বাধীনে রেখে দুনিয়া ও তার সমস্ত বস্তুর উপর তাকে এত ক্ষমতা ও অধিকার দিয়েছেন, এক্ষেত্রে মানুষ তাঁর দুনিয়াকে সুন্দর করে গড়ে তুলছে, না ধ্বংস করছে, এ বিষয়টা তিনি কি করে উপেক্ষা করতে পারেন? আপনি যদি তাঁর দুনিয়াকে সুন্দর করে গড়তে থাকেন তবুও তিনি আপনাকে ক্ষমতা থেকে অযথা সরিয়ে দেবেন- এমনতর হওয়ার কোন কারণ নেই। কিন্তু যদি আপনি গঠনমূলক কোন কিছু না করেন এবং আল্লাহর এ বিরাট বাগানখানাকে একেবারে উজাড় ধ্বংস করতেই থাকেন তাহলে আপনার দাবীকে নিজের বুদ্ধি-বিবেক অনুযায়ী যতই জোরদার মনে করুন না কেন তিনি তাঁর বাগানে আপনার কোন অধিকারই স্বীকার করবেন না। প্রথমে তিনি আপনাকে শাসিয়ে হুঁশিয়ার করে দেবেন এবং সংশোধনের দু'চারটে সুযোগ দেবেন। পরিশেষে আপানাকে পরিচালকের মর্যাদা থেকে পদচু্যত করেই ছাড়বেন।
এ ব্যাপারে একটা বাগানের মালিকের দৃষ্টিকোণ ও মালীর দৃষ্টিকোণ যেমন বিভিন্ন তেমনি আল্লাহর দৃষ্টিকোণ ও মানুষের দৃষ্টিকোণের মধ্যেও বিভিন্নতা রয়েছে। ধরুন, মালীদের এক পরিবার বংশানুক্রমে একজন লোকের বাগানে কাজ করে আসছে। তাদের পূর্ব পুরুষের কাউকে হয়তো তার যোগ্যতা ও জ্ঞান বুদ্ধির দরুন বাগানে নিযুক্ত করা হয়েছিল। তার সন্তান-সন্ততিও বাগানের কাজ সুন্দরভাবে করেছিল, তাই বাগানের মালিক চিন্তাকরে দেখলো যে, অযথা এদেরেকে সরিয়ে অন্য মালী নিযুক্ত করার কি দরকার? এরা ও যখন ভালভাবেই কাজ করছে, তখন এদের অধিকার অন্যের চেয়ে বেশী। এভাবে মালীদের এই বংশ স্থায়ীভাবে বাগানে কাজ করতে লাগলো। কিন্তু কিছু কাল পরে এই বংশের মালীরা একেবারে অযোগ্য, অপদার্থ, ফাঁকিবাজ, আলসে, কুঁড়ে ও অবাধ্য হয়ে পড়ল। বাগান পরিচালনার কোন যোগ্যতাই তাদের রইল না। এখন তারা গোটা বাগানটার সর্বনাশ করতে শুরু করেছে, তবুও তদের দাবী এই যে তারা তাদের বাপদাদার আমল থেকে পুরুষানুক্রমে এ বাগানে বাস করে আসছে, তাদের পূর্ব পুরুষদের কারুর দ্বারা এ বাগান গড়ে উঠেছিল, কাজেই এতে তাদের জন্মগত অধিকার রয়েছে এবং তাদেরকে সরিয়ে অন্য কাউকে এ বাগানের পরিচালনার জন্য মালী নিযুক্ত করা কোনক্রমেই সংগত হতে পারে না। এটিই ঐ অযোগ্য ও অপদার্থ মালীদের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু বাগানের মালিকের দৃষ্টিকোণও কি অনুরূপ হতে পারে? সে কি একথাই বলবে না_ আমার কাছে তো বাগানের সুন্দর ও সুষ্ঠ পরিচালনাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আমি তো মালীদের কোন পূর্ব পুরুষের জন্য এ বাগান করিনি। বরং তাদের পূর্ব পুরুষের কাউকে আমার বাগানের কাজের জন্য চাকর রেখেছিলাম। বাগানে তাদের যা কিছু অধিকার আছে তা যোগ্যতা ও কাজের শর্তাধীন। তারা বাগানকে ঠিকমত গড়ে তুললে তাদের সমস্ত অধিকার বিবেচনা করা হবে। নিজের পুরানো মালীদের সংগে আমার এমন কি শক্রতা থাকতে পারে যে, তারা ভালভাবে কাজ করলেও আমি অযথা তাদেরকে তাড়িয়ে অন্য মালীদেরকে নিযুক্ত করবো? কিন্তু যে বাগানের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তোমাদেরকে নিযুক্ত করা হয়েছিল সেটিকেই যদি তোমরা নষ্ট ও উজাড় করে ফেল, তাহলে তোমাদের কোন অধিকারই আমি স্বীকার করবো না। অন্য যারা এ কাজ ঠিকমত করতে চায় আমি তাদেরকে বাগান পরিচালনার দায়িত্ব ও ক্ষমতা দান করবো এবং তাদের অধীনে তোমাদের চাকুরি করতে হবে। এতেও যদি তোমরা ঠিক না হও এবং অধীনস্ত হিসেবেও যদি তোমরা অকেজো প্রমাণিত হও; বরং শুধু নষ্ট করতেই থাক, তাহলে আমি তোমাদেরকে এ বাগান থেকে তাড়িয়ে দিয়ে অন্য মালীদেরকে এখানে নিযুক্ত করবো।

দৃষ্টিকোণের এই পার্থক্য যেমন একটা বাগানের মালিক ও মালীর মধ্যে রয়েছে, তেমনি রয়েছে দুনিয়ার মালিক ও দুনিয়াবাসীদের মধ্যেও। দুনিয়ার বিভিন্ন এলাকার বিভিন্ন জাতি তাদের আপন আপন এলাকাকে স্বদেশ ভূমি বলে দাবী করে। বংশানুক্রমে তারা এবং তাদের পূর্ব-পুরুষগণ সেখানে বসবাস করে আসছে। তাদের দেশের উপর তাদের কর্তৃত্ব করার জন্মগত অধিকার রয়েছে বলে তারা বিশ্বাস করে। কাজেই তাদের মতে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা একমাত্র তাদেরই প্রাপ্য। বাইরের আর কারুর সেখানে কর্তৃত্ব করার কোন অধিকার নেই। এ হচ্ছে দুনিয়াবাসীদের দৃষ্টিকোণ। কিন্তু দুনিয়ার আসল মালিক আল্লাহর দৃষ্টকোণ এটা নয়। তিনি কখনো এ সব জাতীয় অধিকার স্বীকার করেননি। প্রত্যেক দেশের উপর তার অধিবাসীদের জন্মগত অধিকার রয়েছে এবং সে অধিকার থেকে তাদেরকে কোনক্রমেই বঞ্চিত করা চলবে না- এমন কোন কথা তিনি স্বীকার করেন না। তিনি তো দেখেন, কোন্ দেশে কোন্ জাতি কি কাজ করছে। যদি কোন জাতি তার দেশে গঠনমূলক কাজে লিপ্ত থাকে, তার সমস্ত শক্তিসামর্থ দুনিয়ার সংশোধন ও উন্নতির জন্য নিয়োগ করে থাকে, সব রকমের মন্দ কাজ প্রতিরোধ করে এবং ভাল কাজের ক্ষেত্র প্রশস্ত করতে ব্যস্ত থাকে, তাহলে দুনিয়ার মালিক বলেন, অবশ্য তোমরা দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার অধিকারী। তোমরা পূর্ব থেকেই এ দেশে বসবাস করে আসছো এবং দেশ পরিচালনারও যোগ্যতা রাখ। কাজেই অন্যান্য জাতির চেয়ে তোমাদের অধিকারই অগ্রগণ্য। কিন্তু যদি ব্যাপারটা উল্টো হয় অর্থাৎ, যদি গড়ার পরিবর্তে শুধু ভাঙ্গার কাজই হতে থাকে, সৎ কাজের বদলে দেশ জুড়ে কেবল অসৎ ও অবৈধ কাজই সংঘটিত হয় এবং আল্লাহ্ দুনিয়ায় যা সৃষ্টি করেছেন তাকে কোন ভাল কাজে না লাগিয়ে বেপরোয়া ভাবে নষ্ট করা হয়- এক কথায় দেশকে গড়ার বদলে ভেঙ্গে ফেলা হয়- তাহলে আল্লাহ্ এহেন জাতিকে প্রথমে কিছুটা হালকা এবং কিছুটা কঠিন আঘাত দেন, যাতে করে তারা সতর্ক হয়ে সঠিক পথ অবলম্বন করতে পারে। এতেও যে জাতি ঠিক না হয়, তার কাছ থেকে দেশের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্তত এর চেয়ে যোগ্যতর জাতিকে দেয়া হয়।

এখানেই শেষ নয়। যদি পূর্ববর্তী জাতির লোকেরা পরাধীন হওয়ার পরও কোন যোগ্যতা ও গুণবৈশিষ্ট্যের প্রমাণ না দেয় এবং কার্যকলাপের মাধ্যমে এ কথাই প্রমাণ করে যে, বিকৃতি করা ছাড়া তাদের দ্বারা আর কোন কাজই হবে না, তাহলে এহেন জাতিকে আল্লাহ্ নিশ্চিহ্ন করে দেন। তারপর তাদের স্থানে অন্য কোন জাতিকে আনেন। এ ব্যাপারে সব সময়ই মালিকের যে দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত, আল্লাহরও তাই হয়ে থাকে। তিনি তাঁর দুনিয়া পরিচালনার ক্ষেত্রে দাবীদার ও প্রার্থীদের উত্তরাধিকার অথবা জন্মগত অধিকার দেখেন না। তিনি দেখেন কার গড়ার যোগ্যতা বেশী এবং ভাঙ্গার দিকে ঝোঁক প্রবনতা কম রয়েছে। একই সময়ের প্রার্থীদের মধ্যে যারা এ দিক দিয়ে যোগ্যতর বলে প্রমাণিত হয়, তাদেরকেই দেশ পরিচালনার জন্য নির্বাচন করা হয়। যতদিন এদের ধ্বংসাত্মক কাজের চেয়ে গঠনমূলক কাজ বেশী হতে থাকে অথবা এদের তুলনায় বেশী ভাল করে গঠনমূলক কাজ করে এবং ধ্বংসাত্মক কাজও কম করে- এমন কেউ এগিয়ে না আসে- ততদিন দেশ পরিচালনার ক্ষমতা এদের হাতেই রাখা হয়।
এসব যা কিছু আমি বলছি, ইতিহাসে এর জ্বলন্ত প্রমাণ রয়েছে। আল্লাহ্ চিরকালই এ নীতি অনুযায়ী তাঁর দুনিয়া পরিচালনার ব্যবস্থা করছেন। দূর দেশের কথা না হয় ছেড়েই দিন। নিজেদের এ দেশের ইতিহাসটাই পর্যালোচনা করুন। এ দেশে যে সব জাতি প্রথমে বাস করতো, তাদের গঠনমূলক যোগ্যতা ও কর্ম ক্ষমতা যখন শেষ হয়ে গেল, তখন আল্লাহ্ আর্য জাতিকে এ দেশ পরিচালনার সুযোগ দিলেন। সে সময় অন্যান্য জাতি গুলোর মধ্যে যোগ্যতম ছিল আর্যজাতি। তারা এখানে এসে এক উন্নত তামাদ্দুন ও সভ্যতা গড়ে তুললো। বহু জ্ঞান ও শিল্প আবিস্কার করল। ভূগর্ভের গোপন সম্পদ উদ্ধার করে তাকে ভাল কাজে ব্যবহার করল। ধ্বংসাত্মক কাজের তুলনায় গঠনমূলক কাজই তারা বেশী করেছিল। এসব যোগ্যতা যতদিন পর্যন্ত তাদের মধ্যে ছিল ততদিন ইতিহাসের সমস্ত উত্থান-পতন সত্ত্বেও তারাই ছিল এদেশের পরিচালক। অন্যান্য জাতি ক্ষমতা দখলের জন্য বার বার এগিয়ে এসেছে কিন্তু তাদেরকে হটিয়ে দেয়া হয়েছে। কারণ, আর্যদের মতো যোগ্য জাতি ক্ষমতাসীন থাকা কালে অন্যকোন পরিচালকের প্রয়োজন ছিল না। আর্যরা যখন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে বিপথে চলা শুরু করে, তখন তাদের উপর যেসব বৈদেশিক আক্রমন হয়, সেগুলোকে তাদের জন্য আল্লাহর তরফ থেকে সতর্ককারী দূত স্বরূপ বলা যায়। কিন্তু তারা সতর্ক না হয়ে ধ্বংসাত্মক কাজেই লিপ্ত থাকে। গঠনমূলক কাজের তুলনায় তারা ধ্বংসাত্মক কাজ করতে থাকে অনেক বেশী। তাদের নৈতিক অধঃপতন এমন চরমে পৌঁছে যে, বামমার্গ আন্দোলনে আজো তার চিহ্ন আপনারা সুস্পষ্ট প্রত্যক্ষ করতে পারেন। মানবতাকে বিভক্ত করে তারা নিজেদেরই সমাজকে বর্ণ ও গোত্রে খণ্ডিত করল। সমাজ জীবনকে একটি সিঁড়ির মতো করে গঠন করল। এ সিঁড়ির প্রত্যেক ধাপের লোকেরা তাদের উপরের ধাপের লোকদের বান্দা বা দাস এবং নীচু ধাপের লোকদের খোদা বনে বসল। তারা আল্লাহর লাখো লাখো বান্দার উপর নির্মম যুলুম নির্যাতন চালাতে লাগল। এ যুলুম আজো অচ্ছুত শ্রেণীর আকারে বিদ্যমান রয়েছে।

তারা জ্ঞান-বিজ্ঞানের পথ সাধারণ মানুষের জন্য বন্ধ করে দিল। তাদের পন্ডিত ও পুরোহিতরা সাপের মত জ্ঞান ভাণ্ডারের চারদিক বেষ্টন করে বসে রইল। তাদের উপরের তলার কর্তারা দেশের জনসাধারণের উপর নিজেদের বহু অন্যায় অধিকার চাপিয়ে দিল। এ অধিকার আদায় করা এবং আরাম কেদারায় বসে বসে অন্যের পরিশ্রমের উপর নির্ভর করে বিলাসী জীবন যাপন করা ছাড়া তাদের আর কোন কাজ রইলো না। এহেন পরিস্থিতিতে আল্লাহ্ তাদের কাছ থেকে দেশ পরিচালনার ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে মধ্য এশিয়ার কতিপয় জাতিকে এখানে পরিচালনার সুযোগ দিলেন। এ জাতিগুলো সে সময় ইসলামী আন্দালনের সংস্পর্শে এসে জীবন যুদ্ধের উন্নততর যোগ্যতা অর্জন করেছিল।

কয়েক'শ বছর তারা এদেশ পরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত ছিল। এ দেশেরও বহু লোক ইসলাম গ্রহণ করে তাদের সাথে মিশে গিয়েছিল। অবশ্যি তারাও অনেক কিছু ধ্বংস করেছে। কিন্তু যে পরিমাণ ধ্বংস করেছে, তার চেয়ে বেশী সৃষ্টি করেছে। কয়েক'শ বছর পর্যন্ত ভারতবর্ষে যত গঠনমূলক কাজ হয়েছে তা সবই তাদের দ্বারা অথবা তাদের প্রভাবে সম্পাদিত হয়েছে। তারা দেশে জ্ঞানের আলো বিতরন করেছে। চিন্তা ও ভাবধারা পরিশুদ্ধ করেছে। সমাজ, তামাদ্দুন ও সভ্যতার অনেক কিছু সংশোধন করেছে, দেশের উপায়-উপাদানকে সে যুগের উপযোগী করে কল্যাণের পথে ব্যবহার করেছে। সর্বোপরি তারা শান্তি ও সুবিচারের এমন সুষ্ঠু ব্যবস্থা কায়েম করেছিল যা ইসলামের সত্যিকার শান্তি ও সুবিচার থেকে অনেক নিন্মমানের হলেও ইতিপূর্বেকার এবং আশপাশের দেশগুলোর অবস্থার তুলনায় অনেক খানি ঊঁচুস্তরের ছিল। অতঃপর তারাও পূর্ববর্তীদের ন্যায় পথভ্রষ্ট হতে লাগল এবং তাদের মধ্যেও গঠনমূলক কাজের যোগ্যতা কমে যেতে লাগল এবং ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতি ঝোঁক প্রবণতা বেড়ে চলল। তারাও উঁচু-নীচু, বংশ মর্যাদার শ্রেণী বিভেদ সৃষ্টি করে নিজেদের সমাজ ও জাতিকে খণ্ড বিখণ্ড করে ফেলল। এজন্য চারিত্রিক, রাজনৈতিক, তামাদ্দুনিক ক্ষেত্রে সীমাহীন ক্ষতি হয়েছে। তারাও ইনসাফের তুলনায় যুলুম, নির্যাতন অনেক বেশী করতে লাগল। রাষ্ট্রের দায়িত্ব ও কর্তব্য ভুলে গিয়ে তারা শুধু তাত্থেকে স্বার্থসিদ্ধি এবং বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে অবৈধ স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টায় মেতে উঠল। উন্নতি ও সংস্কারমূলক কাজ ছেড়ে দিয়ে তারাও আল্লাহ্ প্রদত্ত শক্তি ও উপায় উপাদান নষ্ট করতে এবং সেগুলোকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপে ব্যবহার করতে লাগল। দৈহিক আরাম ও ভোগ লালসায় তারা এতই মত্ত হয়ে গেল যে, তাদের শাসন কর্তাদেরকে যখন দিল্লীর লাল কেল্লা থেকে পলায়ন করতে হয়েছিল, তখন তাদের শাহজাদারা-যারা গতকাল পর্যন্ত সিংহাসনের দাবীদার ছিল-নিজেদের জীবন রক্ষার জন্য পলায়ন করতেও পারেনি। কেননা মাটির উপর দিয়ে চলার অভ্যাস তারা পরিত্যাগ করেছিল। মুসলমানদের সাধারণ নৈতিক চরিত্রের চরম অধঃপতন হয়েছিল। একেবারে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বড় বড় হোমরা চোমরা দায়িত্বশীল লোকদের পর্যন্ত নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কিছুরই পরোয়া ছিল না। ফলে ধর্ম, জাতি ও দেশকে অন্যের হাতে বিকিয়ে দেয়ার পথে তাদেরকে বাধা দেয়ার মতো আর কিছুই রইল না। তাদের মধ্যে জন্ম নিলো লাখো লাখো পেশাদার সিপাই। এদের নৈতিক চরিত্র ছিল পোষা কুকুরের মতো। যে কেউ খাবার দিয়ে এদেরকে পুষতে পারত এবং তারপর এদের দিয়ে ইচ্ছামত শিকার করাতে পারত। এদের মধ্যে এই অনুভূতি ছিলনা যে, এই ঘৃণ্য পেশার বদৌলতেই শত্রুরা তাদের সাহায্যে তাদেরই জয় করেছে -এর একটি জঘন্যতম দিক আছে। গালিবের মতো কবিও এ সম্পর্কে গর্ব করে বলেছনঃ "শত পুরুষ থেকে বাপ দাদার পেশা হলো সৈনিক বৃত্তি।" এতবড় একজন কবি একথা বলার সময় এতটুকুও ভাবতে পারেননি যে, পেশাধারী সৈনিকবৃত্তি গর্বের বিষয় নয়; লজ্জায়মরে যাবার জিনিস।

মুসলমানেরা যখন এহেন অবস্থায় পৌঁছল, তখন আল্লাহ্ তাদেরকে ক্ষমতাচু্যত করার সিদ্ধান্ত করলেন এবং গোটা ভারতবর্ষের শাসন ক্ষমতা আবার নতুন প্রার্থীদের হাতে যাওয়ার সুযোগ এলো। এ সময় দেশে মারাঠা, শিখ, ইংরেজ ও কতিপয় মুসলমান নেতা এই চারজন প্রার্থীকে দেখা যাচ্ছিল। জাতীয়তাবাদের নেশা ও স্বজাতির প্রতি অন্যায় পক্ষপাতিত্ব থেকে মন ও মগযকে মুক্ত ও পবিত্র রেখে ন্যায়ভাবে তখনকার ইতিহাস ও পরবর্তী অবস্থা পর্যালোচনা করলে আপনার বিবেক একথা স্বীকার করবে যে, তখন গঠনমূলক কাজের যে যোগ্যতা ইংরেজদের ছিল তা অন্যকোন প্রার্থীর ছিল না এবং ইংরেজদের ভেতর যে পরিমাণ ধ্বংসাত্মক ক্ষমতা ছিল তার চেয়ে ঢের বেশী ছিল মারাঠা, শিখ ও মুসলমান প্রার্থীর ভেতর। ইংরেজরা যা কিছু গঠনমূলক কাজ করেছে তা অন্যান্য জাতিরা করত না। তারা যা কিছু নষ্ট করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশী অন্যেরা নষ্ট করত। সাধারণভাবে দেখলে ইংরেজদের ভেতর বহু দিক দিয়ে অগণিত দোষ ও অন্যায় পাওয়া যাবে। কিন্তু তুলনা মূলকভাবে বিচার করলে তাদের সমকালীন প্রতিদ্বন্দ্বীদের চেয়ে তাদের অন্যায় অত্যাচার অনেক কম এবং গুণ-গরিমা বেশী পাওয়া যাবে। এই জন্যই তো আল্লাহর আইন আরেকবার মানুষের মনগড়া নীতির মূলোচ্ছেদ করলো। মানুষ বিনা অধিকারে এই নীতি রচনা করেছিল যে- "প্রত্যেক দেশের অধিবাসীগণ সে দেশের মালিক, তারা তাদের ইচ্ছামত দেশকে গড়তেও পারে, ভাঙ্গতেও পারে।" আল্লাহর আইন ইতিহাসের এই চিরন্তন ফয়সালা থেকে প্রমাণ করেছে যে- না, দেশ এক মাত্র আল্লাহর, এর পরিচালনার ভার কাকে দেয়া হবে এ ফয়সালা তিনিই করবেন, এ ফয়সালা কোন বংশ, জাতি অথবা পিতা-প্রপিতার অধিকারের ভিত্তিতে হয় না। বরং কোন্ কোন্ পরিচালনায় সামগ্রিক কল্যাণ নিহিত রয়েছে, সে দিকে নজর রেখেই এ ফয়সালা গৃহীত হয়।

قُلِ اللَّهُمَّ مَالِكَ الْمُلْكِ تُؤْتِي الْمُلْكَ مَن تَشَاء وَتَنزِعُ الْمُلْكَ مِمَّن تَشَاء وَتُعِزُّ مَن تَشَاء وَتُذِلُّ مَن تَشَاء بِيَدِكَ الْخَيْرُ إِنَّكَ عَلَىَ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ. - سورة آل عمران26

"বলুন, হে আল্লাহ্! দেশের মালিক! তুমি যাকে ইচ্ছা তাকে রাজ্য দিয়ে থাক এবং যার কাছ থেকে ইচ্ছা রাজ্য ছিনিয়ে নিয়ে থাক এবং যাকে চাও তাকে সম্মান এবং যাকে চাও লাঞ্ছনা দিয়ে থাক। তোমারই হাতে রয়েছে সব মঙ্গল। তুমি নিঃসন্দেহে সব কিছু করার ক্ষমতা রাখ।" [সূরা আলে ইমরানঃ ২৬]

এভাবেই হাজার হাজার মাইল দূরে থেকে একটি জাতিকে আল্লাহ্ এ দেশে নিয়ে এলেন। এরা এ দেশে সংখ্যায় তিন চার লাখের বেশী কোন সময়ই ছিল না। কিন্তু এরা এখানকার উপায়-উপাদান ও মানুষ দিয়ে এ দেশের হিন্দু, মুসলমান, শিখ ইত্যাদি সমস্ত শক্তিকে পরাজিত করে দেশের শাসন ক্ষমতা দখল করল। এ দেশের কোটি কোটি অধিবাসী এ মুষ্টিমেয় ইংরেজদের অধীন হয়ে রইল। একজন ইংরেজ একাই একটি জেলা শাসন করেছে। তাও এমন অবস্থায় যে, এ কাজে তার হাত শক্তিশালী করার মতো তার জাতির কোন লোক এখানে ছিল না। এসময় এ দেশের লোকেরা যা কিছু করেছে তা সবই চাকর হিসেবে করেছে- কার্যকারক হিসেবে নয়। ইংরেজদের শাসনামলে এ দেশে যেসব গঠনমূলক ও উন্নয়ণমূলক কাজ হয়েছে, তা তাদের দ্বারা এবং তাদের প্রভাবেই হয়েছে- এ কথা আমাদের সবাইকে স্বীকার করতে হবে। অস্বীকার করলে সত্যকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা হবে। তারা যে অবস্থায় এদেশের শাসন ক্ষমতা হাতে নিয়েছিল, তার তুলনায় আজকের অবস্থা দেখলে এ কথা স্বীকার করার জো নেই যে, তাদের অনিষ্টকারিতা সত্ত্বেও অনেক গঠনমূলক ও উন্নয়ণমূলক কাজ হয়েছে। এসব কাজ এদেশবাসীর দ্বারা সম্পন্ন হওয়ার কোন আশাই ছিল না। এ জন্যই তো আল্লাহ্ আঠার'শ শতাব্দীর মাঝখানে এ দেশের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ব্যাপারে যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন, তা মোটেই ভুল ছিল না।

এখন দেখুন, ইংরেজরা যা কিছু গড়তে পারত তা গড়েছে আর বিশেষ কিছু তাদের দ্বারা গড়ে উঠতে পারে না। এখন তারা যা গড়তে পারে তা অন্যের দ্বারাও সম্ভব। ওদিকে তাদের ধ্বংসকারিতার বহর খুব বেড়ে গেছে। আর যতদিন তারা এ দেশের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকবে, ততদিন গড়ার চেয়ে ভাঙ্গবেই বেশী। তাদের অন্যায় ও অপরাধের ফিরিস্তি এত দীর্ঘ হয়েছে যে, তা এক বৈঠকে বর্ণনা করা মুশকিল। আর সেগুলো বর্ণনা করার কোন প্রয়োজনও নেই। কারণ, সেসব সবার চোখের সামনেই রয়েছে। তাদেরকে এখন এ দেশের শাসন ক্ষমতা থেকে বেদখল করাই আল্লাহর সিদ্ধান্ত। তারা নিজেরাই সোজাভাবে এ দেশ থেকে বিদায় নিতে প্রস্তুত হয়ে বেশ বুদ্ধিমানের কাজ করেছে।

সোজাভাবে না গেলে বাঁকাভাবে তাড়িয়ে দেয়া হতো। কারণ, আল্লাহর চিরন্তন আইন এখন আর তাদের হাতে এ দেশের শাসন ক্ষমতা রাখার পক্ষপাতি নয়।

দুনিয়ার প্রকৃত মালিক কোন দেশে এক প্রকার পরিচালনা ব্যবস্থা খতম করে অন্য প্রকার ব্যবস্থা কায়েম করার ব্যবস্থা করলে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, আমরা এখন তারই দ্বারদেশে দাঁড়িয়ে আছি। এটা ইতিহাসের একটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাহ্যদৃষ্টিতে এ দেশে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হতে দেখা যাচ্ছে তাতে কেউ যেন এ প্রতারণায় না পড়েন যে, দেশের শাসনক্ষমতা দেশবাসীর হাতে দেয়ার এই যে সিদ্ধান্ত হচ্ছে তা একেবারে চূড়ান্ত ও চিরন্তন। বর্তমান পরিস্থিতির একটা সহজসাধ্য রূপ হয়তো আপনারা অনায়াসেই অনুধাবন করতে পারছেন যে, বিদেশ থেকে এসে যারা এ দেশ শাসন করছিল, এখন তারা নিজ দেশে ফিরে যাচ্ছে। কাজেই এখন স্বাভাবিকভাবেই দেশের ক্ষমতা দেশবাসীর হাতে আসাই উচিত। আসলে কিন্তু তা নয়। আল্লাহর সিদ্ধান্ত এরূপ হয় না। তিনি এই বিদেশীদেরকে পূর্বেও অকারণে আনেননি, আবার এখনো বিনা কারণে সরিয়ে দিচ্ছেন না। পূর্বে যেমন তিনি আপনাদের কাছ থেকে খামখেয়ালীভাবে শাসনক্ষমতা কেড়ে নেননি, তেমনি এখনো আপনাদেরকে খামখেয়ালীভাবে এ ক্ষমতা দেবেন না। আসল ব্যাপার এই যে, বর্তমানে ভারতবাসীরা ক্ষমতার প্রার্থী হিসেবে দাঁড়িয়েছে; হিন্দু, মুসলমান, শিখ সবাই প্রার্থী। যেহেতু এরাই দেশে প্রথম থেকে বসবাস করে আসছে, কাজেই তাদেরকেই প্রথম ক্ষমতা লাভের সুযোগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এটা স্থায়ী নিযুক্তি নয়, বরং তাদের পরীক্ষার জন্যই এ সুযোগ দেয়া হচ্ছে। যদি তারা নিজেদের কার্যকলাপে প্রমাণ করে যে, ভাঙ্গার চেয়ে গড়ার যোগ্যতাই বেশী, তাহলে তাদেরকে এ দেশের শাসন ক্ষমতায় স্থায়ীভাবে নিযুক্ত করা হবে। আর যদি তারা গঠনমূলক কাজের চেয়ে ধ্বংসাত্মক কাজই বেশী করে, তবে তার পরিণাম খুব শিগগিরই ভোগ করবে। এ অবস্থায় তাদের কাছ থেকে এ দেশের শাসনক্ষমতা কেড়ে নিয়ে অন্য কোন জাতিকে এ কাজের জন্য নির্বাচিত করা হবে। অতঃপর আর তারা এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগই করতে পারবে না। সমগ্র দুনিয়ার সম্মুখে নিজেদের অযোগ্যতার স্পষ্ট প্রমাণ দেয়ার পর তারা কোন মুখে অভিযোগ করবে ? নাছোড়বান্দা হয়ে অনুনয় বিনয় করলেও তা শুনবেই বা কে ?

এখন আপনারা একটু পর্যালোচনা করে দেখুন যে, এ দেশের হিন্দু-মুসলমান ও শিখ এ পরীক্ষায় আল্লাহর সামনে নিজেদের এমন কি যোগ্যতা, কর্মদক্ষতা, গুণ-গরিমা এবং কার্যকলাপ পেশ করেছেন যে, তার ফলে আল্লাহ্ তাঁর দেশের শাসন ক্ষমতা আবার তাদের হাতে সোপর্দ করবেন বলে তারা আশা করতে পারেন। হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের অপরাধগুলো নৈতিকতার আদালতে পেশ করলে তারা সবাই দোষী সাব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি যদি এখন নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সুস্পষ্টভাবে সেগুলো বলে দেই, তাহলে আশা করি আপনারা খারাপ মনে করবেন না। নিজের জাতি ও স্বদেশী ভাইদের দোষ বর্ণনা করা আমারও ভাল লাগে না। আসলে আমার হৃদয় এতে কাঁদে। কারণ, আমি তাদের এ সমস্ত দোষ ও অপরাধের মারাত্নক পরিণাম যেন স্বচক্ষে দেখতে পাচ্ছি। তাদেরকে শিগ্গিরই এ পরিণামের সম্মুখীণ হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হবে। এসব দোষ ও অপরাধ তাদেরকে ধ্বংস করবে বলে আমার আশংকা হচ্ছে। আমি, আপনি কেউই এ মারাত্মক পরিণাম থেকে বাঁচতে পারবো না। এজন্য আমি অন্তরের বেদনা নিয়ে এগুলো বিবৃত করছি। এর ফলে যার কান আছে সে শুনে সংশোধনের কিছুটা চিন্তা করতে পারবে।

আমাদের দেশবাসীর সাধারণ নৈতিক চরিত্রের অবস্থা যে রকম হয়েছে তা আপনারা নিজেদের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান অনুযায়ী অনুমান করে দেখুন। আমাদের ভেতর শতকরা ক'জন সত্যিকার চরিত্রবান লোক আছে ? কারোর অধিকার হরণ করা, কোন অবৈধ স্বার্থসিদ্ধি, কোন 'লাভজনক' মিথ্যা বলা এবং কোন 'লাভজনক' বিশ্বাস-ঘাতকতা করা নৈতিক দৃষ্টিতে খারাপ -শুধু এই কারণে আমাদের ক'জন এসব কাজ করতে ইতস্তত করে থাকে? যেখানে আইনের বাঁধন নেই অথবা যেখানে আইনের আওতা থেকে বাঁচবার আশা ও পথ আছে, সেখানে শতকরা ক'জন শুধু নিজের নৈতিক অনুভূতির বলে অন্যায় ও অপরাধ থেকে বিরত থাকে? যেখানে নিজের ব্যক্তিগত স্বার্থের আশা না থাকে, সেখানে ক'জন অন্যের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে। এরূপ ক্ষেত্রে ক'জন অপরের দুঃখে-দৈন্যে মনে ব্যাথা পায় এবং স্বার্থ ত্যাগ করে? নিস্বার্থভাবে ক'জন অপরের হক আদায় করে? ক' জন ব্যবসায়ী ধোঁকা-ফাঁকি, মিথ্যা, মুনাফাখোরী, অন্যায়ভাবে উপার্জন করা থেকে বিরত থাকে? ক'জন শিল্পপতি নিজের স্বার্থের সঙ্গে ক্রেতাদের স্বার্থ এবং নিজের জাতি ও দেশের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রাখে? খাদ্যশস্য মজুদ রেখে অত্যাধিক চড়া দরে বিক্রি করতে গিয়ে ক'জন জমিদার একটু ভেবে দেখে যে, তারা এ মুনাফাকারীর দ্বারা লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষকে ভূখা রেখে অসহ্য যন্ত্রনা দিচ্ছে? ক'জন ধনী ব্যক্তি ধন উপার্জনে অন্যায়, অত্যাচার, অধিকার হরণ ও বিশ্বাস ঘাতকতা থেকে মুক্ত রয়েছে? আমাদের দেশের শ্রমজীবি দের মধ্যে ক'জন সঠিকভাবে কর্তব্য পালন করে তাদের বেতন ও পারিশ্রমিক গ্রহণ করে? ক'জন সরকারী কর্মচারী ঘুষ, আমানত খেয়ানত, অত্যাচার, উৎপীড়ন, কর্তব্যে অবহেলা, হারাম খাওয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি থেকে বিরত থাকে? উকিল, চিকিৎসক, সাংবাদিক, গ্রন্থকার, প্রকাশক, জাতীয় স্বেচ্ছাসেবক ও নেতৃবৃন্দের ক'জন নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য অসৎ ও ঘৃন্য পন্থা অবলম্বন করে না? এদের ক'জন মানুষের শারীরিক, মানসিক, নৈতিক ও আর্থিক ক্ষতি সাধনে কিছু মাত্র লজ্জা বোধ করে? বড় জোর দেশের শতকরা মাত্র পাঁচজন এসব নৈতিক রোগ থেকে মুক্ত রয়েছে, আমার মনে হয় একথা মোটেই অতু্যক্তি নয়। বাকী পঁচানব্বই জনই এই সংক্রামক রোগে আক্রান্ত। এ ব্যাপারে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খৃষ্টান প্রভৃতির ভেতর কোন পার্থক্য নেই। সবাই সমানভাবে রোগাক্রান্ত। সবারই নৈতিক অবস্থার চরম ও ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। কোন জাতির অবস্থাই অন্য জাতির চেয়ে ভাল নয়।

অধিকাংশ লোক এরূপ নৈতিক অধঃপতনের কবলে পড়ায় সমষ্টিগত ভাবে এই নৈতিক রোগের ব্যাপক প্রসার হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। গত মহাযুদ্ধের কারণে যখন রেল গাড়ীতে যাত্রীদের ভীড় হতে লাগলো তখন এই সম্ভাব্য তুফানের প্রথম লক্ষণ দেখা দিল। সেখানে একই জাতির ও একই দেশের লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে যে স্বার্থপরতা, নিষ্ঠুরতা ও কঠোরতামূলক ব্যবহার করেছে, তা থেকেই টের পাওয়া গিয়েছিল যে, কেবল দ্রুতগতিতে আমাদের সাধারণ নৈতিক চরিত্রের অবনতি ঘটেছে। এরপর প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রের অভাব ও উচ্চমূল্যের সময় মাল মজুদ রাখা এবং চোরাবাজারী ব্যাপক ভাবে শুরু হয়। অতঃপর দেখা দিল বাংলাদেশের সেই ভয়াবহ কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। এই দুরাবস্থার সময় দেশের এক সমপ্রদায় নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের জন্য নিজেদের দেশের লাখো লাখো মানুষকে ভূখা রেখে তিলে তিলে মৃতু্যর দিকে এগিয়ে দিয়েছে। এসব ছিল প্রাথমিক লক্ষণ, এরপর নোংরামি, বর্বরতা, নীচতা, পশুসুলভ আচরণ ইত্যাদির অগি্নকাণ্ড হঠাৎ ফেটে পড়লো। এগুলো এখানকার গভীরে বহুদিন হতে উত্তপ্ত হচ্ছিল। বর্তমানে একটি সামপ্রদায়িক দাঙ্গারূপে দেশের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত সবকিছু জ্বালিয়ে ছাই করে দিচ্ছে। কলকাতার গোলযোগের পর থেকে হিন্দু, মুসলমান ও শিখদের জাতীয় বিরোধের নতুন অধ্যায় সূচিত হয়েছে। এর মাধ্যমে তিনটি জাতিই তাদের জঘন্য চরিত্রের প্রদর্শনী করে বেড়াচ্ছে।

যে সমস্ত কাজ কোন মানুষ করতে পারে বলে ধারণাও করা যেত না, তা আজ আমাদের দেশবাসীরা প্রকাশ্যে করে যাচ্ছে। বড় বড় অঞ্চলের প্রায় সমস্ত লোক গুন্ডায় পরিণত হয়েছে। গুন্ডারা যে কাজ করার ধারণাও কোন দিন করেনি তাও এখন তারা করছে। দুগ্ধ-পোষ্য শিশুদের মায়ের বুকের উপর রেখে জবাই করা হয়েছে, জীবন্ত মানুষদেরকে আগুনে জ্বালানো হয়েছে। ভদ্র মহিলাদের হাজার হাজার লোকের সামনে উলঙ্গ করে তাদের উপর প্রকাশ্যে পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। পিতা, ভাই ও স্বামীর সামনে তাদের মেয়ে, বোন ও স্ত্রীর শ্লীলতা হানি করা হয়েছে। মসজিদ, মন্দির ও ধর্মীয় গ্রন্থরাজির উপর ক্রোধ প্রকাশ করতে গিয়ে অত্যন্ত পৈশাচিক উপায় অবলম্বন করা হয়েছে। রুগ্ন, আহত ও বৃদ্ধাদেরকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে। পথিক যাত্রীদেরকে চলন্ত গাড়ী থেকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। জীবন্ত মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কর্তন করা হয়েছে। নিরীহ ও অক্ষম লোকদেরকে জন্তু-জানোয়ারের মতো শিকার করা হয়েছে। প্রতিবেশী ও প্রতিবেশীর গৃহ লুট-তরায করেছে। বন্ধুর প্রতি বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আশ্রয় দাতা আশ্রয় দিয়ে নিরাশ্রয় করেছে। শান্তি ও নিরাপত্তার রক্ষকগণ (পুলিশ, সৈন্য ও ম্যাজিষ্ট্রেটগণ) প্রকাশ্যে দাঙ্গায় অংশ গ্রহণ করেছে এমনকি তারা নিজেরাই দাঙ্গা করেছে এবং নিজেদের সাহায্য সহানুভূতি ও তত্ত্বাবধানে দাঙ্গা বাধিয়েছে। মোটকথা, অত্যাচার, অনাচার, নিষ্ঠুর ও নির্দয় ব্যবহার, বর্বরতা ও জঘন্য কার্যকলাপ ইত্যাদির কোন কিছু আর বাকী নেই, যা এ কয়েক মাসের ভেতর আমাদের দেশের লোকেরা সমষ্টিগতভাবে করেনি। তবুও মনের জ্বালা মেটেনি। আলামত যা দেখা যাচ্ছে, মনে হয় এর চেয়ে অনেক বেশী ভয়াবহ ও বিরাট আকারে দাংগা এখন দেখা দেবে।

আপনারা কি মনে করেন, এসব কিছুই একটা আকস্মিক উত্তেজনার ফল মাত্র। এরূপ ধারনা করে থাকলে আপনারা বিরাট ভুলের মধ্যে আছেন বলতে হবে। এই মাত্র আমি আপনাদের বলেছি যে, এ দেশের শতকরা পঁচানব্বই জন নৈতিক চরিত্রের দিক দিয়ে রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। দেশের জন সমষ্টির এত বিরাট অংশ যদি অসৎ চরিত্রের হয়ে পড়ে তা হলে জাতির সমষ্টিগত স্বভাব চরিত্র কেমন করে ঠিক থাকতে পারে? এই জন্যই তো হিন্দু-মুসলমান ও শিখ জাতির কাছে সত্যবাদিতা, সুবিচার ও সততার কোন দামই এখন নেই। সত্যপন্থী, সৎ এবং ভদ্রস্বভাব বিশিষ্ট লোকেরা তাদের ভিতর কোনঠাসা ও দুর্বল হয়ে রয়েছে। মন্দ কাজে বাধা দান এবং ভাল কাজ করার জন্য উপদেশ দেয়া তাদের সমাজে অসহনীয় অপরাধে পরিণত হয়েছে, সত্য ও ন্যায় কথা শুনতে তারা প্রস্তুত নয়।

তাদের মধ্যে একটি জাতিই এমন লোকদেরকে পছন্দ করে যারা তার সীমাহীন লোভ লালসা ও স্বার্থের পক্ষে ওকালতি করে এবং অন্যের বিরুদ্ধে তাকে উত্তেজিত করে তার ন্যায় ও অন্যায় সবরকম স্বার্থোদ্ধারের জন্য সংগ্রাম করতে প্রস্তুত হয়। এজন্যই এরা নিজেদের ভিতর থেকে বেছে বেছে সবচেয়ে দুষ্ট প্রকৃতির লোকদেরকে নিজেদের নেতা নির্বাচন করেছে। তারা নিজেদের জঘন্যতম অপরাধীদেরকে খুঁজে বের করে তাদেরকে নিজেদের নেতৃত্ব পদে বরণ করে নিয়েছে। তাদের সমাজে সবচেয়ে দুশ্চরিত্র, দূর্নীতিবাজ, বিবেকহীন লোকেরা তাদের মুখপাত্র সেজে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে অত্যাধিক বরণীয় হয়েছে। অতঃপর এসব লোকেরা নিজ নিজ পথভ্রষ্ট জাতিকে নিয়ে ধ্বংসের পথে দ্রুত গতিতে অগ্রসর হচ্ছে। তারা জাতির পরস্পর বিরোধী আশা-আকাংখাকে কোন ইনসাফের কেন্দ্রবিন্দুতে একত্রিত না করে তাকে এতখানি বাড়িয়ে দিয়েছে যে, তা অবশেষে সংঘর্ষের সীমান্তে পৌঁছেছে। তারা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের সংঘর্ষে ক্রোধ, ঘৃণা, শত্রুতার বিষ মিশিয়ে একে নিত্য অগ্রবর্তী করেছে। বহু বছর ধরে নিজেদের প্রভাবাধীন জাতিগুলোকে উত্তেজনামূলক বক্তৃতা ও রচনার ইনজেকশন দিয়ে এতখানি উত্তেজিত করে তুলেছে যে, এখন উত্তেৎনাবশতঃ কুকুর ও হিংস্র পশুর মত লড়াই করবার জন্য খড়গ উঁচিয়ে দাঁড়িয়েছে। জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজের মনকে পৈশাচিক আবেগ ও উচ্ছাসে দূর্গন্ধময় এবং অন্ধ শত্রুতার চুল্লীবানিয়ে ফেলেছে। আপনাদের সামনে এখন যে তুফান প্রবাহিত হচ্ছে তা মোটেই সাময়িক ও আকস্মিক নয়। বহুদিন থেকে বিকৃতির যেসব বেশুমার কার্যকারণ আমাদের মধ্যে সক্রিয় রয়েছে এ হলো তারই স্বাভাবিক পরণতি। এটা একবার দেখা দিয়েই ক্ষান্ত হবে না; বরং যতদিন পর্যন্ত এসব কার্যকারণ সক্রিয় থাকবে, ততদিন এ বিকৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকবে। এটা একটা শস্যপূর্ণ ক্ষেতের মত। বহু বছরের বীজ বপন ও জল সেচের পর এ ফসল খাবার উপযুক্ত হয়েছে। এখন আপনাকে এবং আপনার বংশধরদেরকে কতদিন পর্যন্ত এ ফসল কাটতে হবে তা বলা যায় না।

Sunday, December 18, 2011

প্রতিদান || জসীম উদ্দিন

আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তার ঘর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর
যে মোরে করিল পথের বিবাগি_
পথে পথে আমি ফিরি তার লাগি
দিঘল রজনী তার তরে জাগি ঘুম যে হরেছে মোর
আমার এ ঘর ভাঙিয়াছে যে বা আমি বাঁধি তার ঘর

আমার্ এ কূল ভাঙিয়াছে যে বা আমি তার কুল বাঁধি
যে গেছে বুকেতে আঘাত করিয়া তার লাগি আমি কাঁদি
যে মোরে দিয়েছে বিষে ভরা বাণ
আমি দেই তারে বুক ভরা গান
কাঁটা পেয়ে তারে ফুল করি দান সারাটি জনম ভর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

মোর বুকে যে বা কবর বেঁধেছে আমি তার বুক ভরি
রঙিন ফুলের সোহাগ জড়ানো ফুল মালঞ্চ ধরি
যে মুখে কহে সে নিঠুরিয়া বাণী
আমি লয়ে করে তারি মুখখানি
কত ঠাঁই হতে কত কী যে আনি সাঁজাই নিরন্তর
আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।

নোটন নোটন পায়রাগুলি


প্রাচীর || জাফর তালুকদার

ওরা চার বন্ধু—অলক, মৃদুল, পিয়াল আর টুই আড্ডা মারছিল ভার্সিটি গেটের পাশের ফুটপাতে মতিনের চায়ের দোকানে। সামনের একটা বেঞ্চ আগেই দখল করে নিয়েছে দুই জোড়া ছেলেমেয়ে। ওরা জায়গা না পেয়ে অনেকের মতো ফুটপাতে পা লটকে বসল। ওখানে দুই প্রস্থ চা-সিঙ্গাড়া আর ক্রমাগত সিগারেটের ধোঁয়া গিলে পিয়ালের বোধহয় একটু বিরক্ত ধরে গেছল। সে খেদের গলায় বলল, ‘দুস শালা, চা তো নয়, ঘোড়ার পেচ্ছাব। চল, অন্য কোথাও যাই।’
মৃদুল কথাটা লুফে নিয়ে বলল, ‘দ্যাটস ফাইন, আমার ওখানে চল। জন্মদিনটা ইয়ে দিয়ে সেলিব্রেট করি!’
ইয়ের গন্ধ পেয়ে অলকের কপাল খুশিতে চওড়া হয়ে গেল, ‘আলবত যাব, কিন্তু বাসায় তোর বাবা-মা আছে না?’
‘ও নিয়ে চিন্তা করিস না। এক্কেবারে ফাঁকা ময়দান। মাম ন্যুইয়র্কে। ড্যাড সিঙ্গাপুরে গেছেন গত পরশু। অতএব বুঝতেই পারছ। চল, চল, কুইক।’
টুই কপালের ওপর ঝুঁকে পড়া চুলের গুচ্ছে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘সরি, এই ভরদুপুরে খালি পেটে ওসব ছাই-পাশ গিলতে পারব না। আমার ক্লাস আছে।’
‘খালি পেটে কে বলল! মালের সঙ্গে যথেষ্ট টালও থাকবে। কী খেতে চাও, জাস্ট বলে দেবে। লোক গিয়ে নিয়ে আসবে।’ জন্মদিনের কারণে কি না কে জানে, মৃদুল এখন বন্ধুদের জন্য উদার হাতেম তাই বনে গেছে।
খাদ্য আর পানীয়ের গন্ধ পেয়ে পিয়ালের পেট কুটকুট করে উঠল, ‘জরুর, জরুর, লেটস্ মুভ।’
অলক মুখ ভেংচে বলল, ‘তোর আর কি, যেখানে পাত, সেখানেই কাত। আমাদের সঙ্গে টুই কেন অ্যাকম্প্যানি করতে চাচ্ছে না বুঝতে পারছি না! হ্যাঁ, ও না গেলে, আমিও যাচ্ছি না।’
কথাটা শোনা মাত্র টুই জিভ বের করে একটা ভঙ্গি করল, ‘কেন, তোমার আবার কী হলো! আমার না-যাওয়ার সঙ্গে তোমার যাওয়ার সম্পর্ক কী? যত সব, ন্যাকা...।’
অলকও কম যায় না, ‘কেন চাঁদু, তুমি গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে! মজুমদারের দু-একটা ক্লাস ইগনোর করলেও তোমার ফার্স্ট ক্লাস হয়ে যাবে।’
‘থাক, থাক, তোমার অতো পাম্পু দিতে হবে না। যেতে চাও, যাও। বাট আমার আজকে মুড নেই। শরীরটা গুলোচ্ছে।’ টুই কথাটা বলে আড়চোখে অলকের মুখখানা দেখল।
ওরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর দুয়েক ধরে পড়ছে। আবাসিক এলাকার মধ্যে তাদের ফ্যাকালটিটা অতটা ছড়ানো-বিছানো না হলেও ভেতরটা বেশ ছিমছাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত! পড়াশোনার জন্য কোনো চাপাচাপি নেই। টিচারদের সঙ্গে হাই-হ্যালো সম্পর্ক। প্রকাশ্যে বারান্দায় জোড় বেঁধে বসে থাকে ছেলেমেয়েরা। আড়ালে আবডালে কিস করলে কেউ ফিরে তাকায় না। অলকরা অবশ্য ছুটির ফাঁকে ক্যান্টিনে না বসে সোজা চলে আসে ফুটপাতে মতিনের দোকানে। গাছপালার আড়ালে একটু নিরিবিলি হওয়ায় আড্ডাটা জমে ভালো। মতিনটা যতই খচ্চর হোক, চা-টা বানায় ভালো। পিয়াল অবশ্য এটা মানতে নারাজ। তার ভাষায়, চা না বলে এটাকে ঘোড়ার পেচ্ছাবের উন্নত সংস্করণ বলা ভালো। মুখে যাই বলুক, এই তরল কয়েক দফা না গিললে পিয়ালের ভাত হজম হয় না।
ওদের আড্ডায় টুই যেসব সময় থাকে, তা নয়। সে একটু অন্য ধাঁচের মেয়ে। খুব দামি গাড়িতে চড়ে। অনেকটা ডোন্ট কেয়ার টমবয় টাইপের। তার মুখে কিছু আটকায় না। জিন্স আর টি শার্টেই তাকে চমত্কার মানিয়ে যায়। অলক, পিয়ালদের সঙ্গে প্রকাশ্যে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে তার কোনো সংকোচ নেই। সে তুখোড় টেনিস খেলোয়াড়। জিম, বিলিয়্যার্ডজ, সুইমিং, ডান্স, মিউজিক, লংড্রাইভ আর শপিং নিয়ে মেতে থাকলেও বন্ধুদের সঙ্গ এড়াতে পারে না। এমনকি সামারে লন্ডনের বাড়িতে বসে লং ডিসট্যান্সে কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে। যে কারণে মৃদুলের জন্মদিনের পান-উত্সব টুই ছাড়া অচল হবে, এটাই স্বাভাবিক।
মৃদুলদের পেল্লায় বাড়িটা লেক ছুঁয়ে এমন মনোহর ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, যেন পানি সাঁতরে একটা রাজহাঁস কেবলই কূলে উঠে দাঁড়িয়েছে উড়ালের ভঙ্গিতে। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য রীতির সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে তৈরি বাড়িটা আদ্যোপান্ত আভিজাত্যের ছোঁয়ায় মোড়ানো। চারদিকে এন্তার গাছ-গাছালি। নির্জন ছায়া ছায়া। দুই খানা গাড়ি ভেতরে চলে আসার পরও নিদ্রা ভাঙল না বাড়িটার।
মৃদুলের সাড়া পেয়ে ভেতর থেকে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে একজন লোক এসে দাঁড়াল। কেয়ারটেকার গোছের কেউ হবে হয়তো। লোকটার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে কি-সব আনতে পাঠাল মৃদুল। তারপর টুইয়ের গাড়ির দরজা খুলে কুর্নিশের ভঙ্গিতে বলল, ‘ম্যায় আপকে লিয়ে ক্যায়া কর সকতা হুঁ।’
‘খুব ফাজলামো হচ্ছে, কিছু করতে হবে না তোমাকে।’ টুই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই মৃদুলের ঠোঁটে আবারও সেই দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল, ‘কৃপয়া অনদর আইয়ে।’
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ভেতরে এসে বোঝা গেল মৃদুল ছাড়া কাছের কেউ নেই বাড়িতে। বাবার সঙ্গে কি একটা খিটিমিটি হওয়ার পর মা চলে গেছেন ন্যুইয়র্কে। ছুটি-ছাটায় সে দু-একবার ঘুরে এসেছে মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু পালাই পালাই স্বভাব আর আড্ডার টানে সেখানে মন বসেনি বেশিদিন। তাছাড়া ড্যাডকে সে খুব মিস করে। একটু রাশভারি হলেও কাজ-পাগল মানুষ। ব্যবসার কাজে প্রায়ই উড়ে বেড়াতে হয় লন্ডন, পারি, সিঙ্গাপুর। বিশাল বাড়িটায় মৃদুল একা একা কী করবে, ভেবে পায় না।
বিশাল ড্রইংরুমে ওরা হাত-পা ছড়িয়ে বসল। ঘরটা ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক। দুই জোড়া ঢাউশ সোফা পরপর সাজানো। পুরু দামি কার্পেট। সেন্টার টেবিলে একজোড়া তাজা কদম। শোকেসে থরোথরো দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিকস। সামনের অ্যাকুয়ারিয়ামে একজোড়া পিরানহা মাছ চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে নতুন আগন্তুকের দিকে। এক কোণে পেল্লায় টেলিভিশন আর পিয়ানোর সঙ্গে করুণ দাঁড়িয়ে আছে ক্যাকটাস একটা। দেয়ালে নামি শিল্পীর দুটো তৈলচিত্র। শিল্পীর নামটা মনে পড়ল না।
সুরভিত হিমঠাণ্ডায় চোখ জুড়িয়ে আসছিল পিয়ালের। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। কড়া ট্যাবলেট নিয়েও নেশাটা ধরে না সহজে। অনেক রাত জেগে গোটা কয়েক নতুন লপ্পা লপ্পা দেখেছে। এটা নীল ছবির কোড নেম। বন্ধুদের ভেতর চালু আছে শব্দটি। মা রাত জাগা পছন্দ করেন না। কিন্তু তারপরও টুক টুক করে অনেক রাত জাগতে হয় তাকে। এর ভেতর পড়াশোনা যেমন থাকে, ইন্টারনেট চ্যাট করে কেটে যায় অনেকটা সময়। তবে মোবাইলে টুম্পার সঙ্গে একবার লেগে গেলে নিদেনপক্ষে একটা ঘণ্টা খেয়ে নেবে অনায়াসে। তবে জিসানের দেয়া তিনটা লপ্পা লপ্পা এমন হট আর বারুদে ঠাসা ছিল, যার বিস্ফোরণটা বাথরুমে না ঘটিয়ে আর উপায় ছিল না।
রাতের সেই ক্রিয়াকর্মের কারণে কিনা কে জানে, শরীরটা একটু জেরবার লাগছিল সকাল থেকে। মা অফিসে যাওয়ার আগে রোজ একটু উঁকি দেন তার ঘরে। আজও দিয়েছিলেন হয়তো, টের পায়নি। সচরাচর সে যখন ঘুম থেকে ওঠে, ততক্ষণে বাবা-মা দু’জনই বেরিয়ে যান অফিসে। ছেলেবেলা থেকে এমনটা দেখে আসছে মৃদুল। নানা কথায় ভুলিয়ে মা তাকে সঁপে দিয়ে যেতেন মিনু খালার কাছে। কিন্তু একটা কান্নাকাটির নাটক রোজই অভিনীত হতো সকালবেলা। মা বিব্রত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ছোট্ট হাতখানা ছাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠতেন। এখন অবশ্য সেই বোধটা আর হয় না।
ঘুম থেকে উঠেই সব তৈরি পেয়ে যায়। মতির মা-ই করে দেয় সবকিছু। কিন্তু ছেলেবেলার সেই অতিকায় ফর্সা, শীর্ণ, হাসি হাসি মুখের মিনু খালার মুখখানা কিছুতেই ভুলতে পারে না। এই খালার সঙ্গে বাবাকে জড়িয়ে একটা অশান্তি হয়েছিল সংসারে। মা খুব কান্নাকাটি করতেন। বাবাও অফিস থেকে ফিরতেন রাত করে। শেষে খালাই একদিন চোখের জলে ভেসে চলে গিয়েছিলেন এক বস্ত্রে। সেই ঝমঝমে বৃষ্টিমুখর রাতে মানুষটা কোথায় হারিয়ে গেল। কেন গেল, এই কষ্টের পীড়নটুকু এখনও রয়ে গেছে বুকে।
পিয়াল বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ল। পাশের ঘরে হাঁকডাক দিয়ে কাকে যেন কী বলছে মৃদুল। টুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে লেকের দৃশ্য দেখতে দেখতে কথা বলছে লন্ডনে। তার হাত নাড়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল কোনো ব্যাপারে ক্ষেপে উঠেছে সে।
অলক কী করি কী করি করে মোবাইলে দুটো মেসেজ পাঠাল জুঁই আর রুনিকে। দু’জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। জুঁই মডেলিং করে। প্রমিজিং। সেই তুলনায় রুনি কিছুটা এগিয়ে। চমত্কার নাচ করে। গানের গলাটিও বেশ। মডেলিং আর গানের সূত্র ধরে দু’জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। প্রথম প্রথম হৈ-হুল্লোড় আর চুমুটুমুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে দৈহিক ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে যায় সম্পর্কটা। জুঁইয়ের অবশ্য নাটকের একটা ছেলের সঙ্গে নতুন অ্যাফেয়ার শুরু হয়েছে। সেয়ানা ছেলে। সব জেনেও প্রেমের খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছে। একেকবার ইচ্ছে হয় রতনদের বলে লাশ ফেলে দেয়। দেবেও হয়তো কোনোদিন...।
রুনি অবশ্য এদিক থেকে যথেষ্ট উদার। তার কোনো ঢাক গুড়গুড় নেই। খুব অল্প বয়সে সে ভার্জিনিটি হারায়। আর এই অপকম্মটির জন্য দায়ী তার এক কাজিন। রুনি খুব আপসেট হয়ে গেছল এ ঘটনায়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটা ছিল আরও বেশি ভয়াবহ আর নিষ্ঠুর। দুপুরে খালি বাসায় হাউস টিউটর অত্যন্ত নির্মমভাবে চড়াও হয়েছিল তার ওপর। এটা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক আর লজ্জার। এ অপমানের জ্বালা ঘোচাতে সে সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই হঠাত্ ক্ষমা করে দিয়েছিল স্কাউনড্রেলটাকে। লাভ-ক্ষতির হিসাবটা এভাবে চুকে গেলেও একটু বেপরোয়া হয়ে গেল রুনি। নিত্যনতুন বন্ধুর আনাগোনা শুরু হলো তার জীবনে। এ যেন অনেকটা খেলার মতন। বড়শি গেঁথে তুলছে আর ছুঁড়ে ফেলছে। এ নিয়ে তার কোনো সংস্কার নেই। সে কিছুই জমিয়ে রাখতে নারাজ। খুচরো পয়সার মতন দেদার উড়িয়ে তার আনন্দ।
এই হলো রুনি। তার ওপরটা যতই উগ্র আর জৌলুসের চটকে বাঁধা, ভেতরটা একেবারে নরম কাদায় মোড়ানো। অলক তাকে কাব্যি করে কখনও কখনও মৃত্তিকা বলে ডাকে। রুনি উত্তরে চোখ মটকে বলে, ‘মৃত্তিকা না, ছাই।’
‘বাহ বেশতো, ছাই চাপা আগুন!’
অলকের ভালোবাসার বোধটা কম। যত সহজে টোপ ফেলে মাছটা তুলে আনতে পারে, রেঁধে-বেটে খাবার মতন সুখকর ধৈর্য তার নেই? রুনির চরিত্রেও এই ধাতটা আছে বলেই হয়তো সম্পর্কটা নেই নেই করেও ঝুলে আছে অদৃশ্য সুতোয়। কিন্তু এর বাইরে কি আরও কিছু সত্যি নেই, না হলে সেদিন রেকর্ডিং স্টুডিওতে সেই লম্বু গায়কটার সঙ্গে একান্তে বসে যখন ফুসুর ফুসুর করছিল, তখন অমন করে রক্ত চড়ে গেছল কেন মাথায়। দ্যাত শালা, গোল্লায় যাক দুনিয়া। চল মন বৃন্দাবন।
একেক সময় অলকের মনটা কেন জানি ফুঁসে ওঠে। বড় বেশি অভিশপ্ত আর খাপছাড়া মনে হয় জীবনটা। এক বিঘা জমির ওপর তাদের মস্ত লালচে বাড়িটা যেন প্রাণহীন এক কারাগার। নাকি ইটপাথরে গাঁথা প্রাচীন কোনো পরিত্যক্ত দুর্গ। এখানে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। অতি নির্জন, নির্বান্ধব, রুখু মরুভূমির কাঁকর বালিতে শিকড় আঁকড়ে পড়ে থাকা এক টুকরো শুকনো লতানো ঘাসের মতন যে জীবনটা লালচে বাড়ির ইট পাথরের ফাঁকে আটকে আছে, তাতে কি জীবন চলবে, না কি অন্য কিছু।
মা যতদিন বেঁচেছিলেন, অন্যরকম প্রাণ ছিল বাড়িটায়। সবকিছু নিয়ম করে চলত ঘড়ির কাঁটায়। মুক্তিযুদ্ধে দুই ভাই হারানো বাবা একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেও মা ছিলেন উচ্ছলতায় ভরপুর। সব সময় টগবগ করতেন প্রাণপ্রাচুর্যে। একবার বলা-কওয়া নেই, হঠাত্ দলবল নিয়ে বেড়াতে গেলেন বাগেরহাট ছোট ফুফুর বাড়িতে। স্কুল খোলা ছিল। টুলু আর তাকে রেখে গেলেন বাবার কাছে। কথা ছিল যতদিন মা না আসবেন, ড্রাইভার রহম চাচা তাদের গাড়িতে করে স্কুলে আনা-নেয়া করবেন। বাবা প্রস্তাবে মৌনভাবে মাথা হেলালেন। তিনি মাকে চিনতেন। কথা বলে লাভ হবে না।
সেই যে মা খুশিতে নাচতে নাচতে গেলেন, দুইদিন পর ফিরে এলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। ব্রেন হেমোরেজের কথাটা সেই প্রথম শুনল অলক। এ আবার কেমনতরো অসুখ রে বাবা। কোনো লক্ষণ নেই, শুয়ে থাকা নেই বিছানায়, হঠাত্ মনে হলো টুপ করে মরে গেলাম, বাহ!
মার ওপর তখন থেকে বড় বেশি অভিমান অলকের। বাবা দিন দিন আরও বেশি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অফিস-অন্তঃপ্রাণ মানুষ। মা চলে যাওয়ার পর অফিসটাই হয়ে উঠল তার আসল ঠিকানা। মস্ত লাল বাড়িটায় দুটো শিশু কেমন আছে, কেমন করে কাটছে তাদের সময়, সে খবর কে রাখে! টুলু আপুটা কেমন যেন বদলে গেল। পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় চুরমার হলো ডাক্তার হওয়ার সাধ। শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না হতেই প্রবাসী বরের হাত ধরে পাড়ি দিল সুইডেনে। আপু কারাগার থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু সে? সেই অন্ধকার ঘেঁটে এখন আর কী হবে? কী যে হয়েছে শালার আজকাল, মনের ভেতরটা কেবল টাকি মাছের মতন ঘাই মারে। কুলক্ষণ নিশ্চয়।
‘এই ব্যাটা, বোম্ মেরে আছিস কেন, মাল খেয়েছিস নাকি?’
মৃদুল রামচাঁটি মেরে তাকে সোফা থেকে ওঠাল। টলোমলো পায়ে অলক বিশাল হাই তুলে বলল, ‘আবে না, সে-সুযোগ আর পেলাম কই।’
‘তা দোস্, মালপত্তর কিছু এনেছিস?’
‘শুধু মাল নয়, টালও এনেছি। আয়, ওরা বসে আছে।’ মৃদুল কথার ফাঁকে দুই আঙুলের একটা বিশেষ ভঙ্গি করে চোখ মারল।
‘ওয়াও’ বলে শূন্যে একটা লাফ মারল অলক। উত্তেজনায় তার ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে উঠল। প্রাচীর ভাঙার আনন্দে নিষ্প্রভ চোখ দুটো চকচক করছে।
মৃদুলের ঘরখানা বেশ বড়। স্নিগ্ধ, আরামদায়ক। বিদেশি শৌখিন মালামালে ঠাসা। ঘরের মানুষটি যে পরম বিলাসী, তা এক নজরে ধরা পড়লেও অগোছালো চেহারাটিও সুস্পষ্ট।
বলতে গেলে আয়োজনের কোনো ঘাটতি রাখেনি মৃদুল। সে লোক পাঠিয়ে প্রচুর খাবার এনেছে দামি দোকান থেকে। কয়েক রকমের সুস্বাদু কাবাব, বার্গার, গ্রিলড চিকেন, তন্দুরি, সালাদ, কাজুবাদাম, ফল, কেক, সন্দেশ এবং চোখ-জুড়ানো চার বোতল অতি মূল্যবান হুইস্কি।
মৃদুল গ্লাসে বরফ কুচি তুলে দিতে দিতে কপট রাগের গলায় বলল, ‘এই যে নবাব পুত্তুরেরা, ঠুঁটো হয়ে বসে থাকলে হবে! দয়া করে এগুলো গিলে আমায় ধন্য করো।’
‘সিওর, সিওর...।’ অলক ব্যস্ততার ভঙ্গিতে টকাস করে চুমু খেল বোতলের গায়ে। তারপর ছিপিটিপি খুলে কিছুটা ঢেলে নিল নিজের গ্লাসে, অন্যদেরও ঢেলে দিল সমান মাপে। শেষে গ্লাসে গ্লাসে চিয়ার্স করে শুরু হলো বন্ধুর স্বাস্থ্যপান।
শূন্য পেটে দু’পেগ পড়তেই সবার মুখ ওয়াসার খোলা-ট্যাপ হয়ে গেল। কড়া মিউজিকের সঙ্গে ননস্টপ বকবকানিটা এখন আর কোনো নির্দিষ্টে থেমে নেই। আড্ডার রথ ক্রমেই আকাশে চড়তে শুরু করেছে। টুইয়ের অবশ্য কেন জানি ছন্দপতন হচ্ছিল। যদিও পানে তার বিরাগ নেই। তাদের বাড়িতে এটা নিয়মিত চলে। এসব ব্যাপারে কোনো সংস্কার নেই তাদের। মা নিয়মিত ক্লাবে যান। ড্যান্স করেন। বেশুমার পুরুষ বন্ধু আছে তার। একবার তো ডাক্তার মজুমদারকে জড়িয়ে একটা ভালোরকম স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েছিলেন মা। বাবা শক্ত হাতে সামাল দিয়েছিলেন বলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ায়নি।
বাবা বরাবর একটু নিরীহ আর শক্ত টাইপের। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশাল পসার সামলাতেই কেটে যায় প্রচুর সময়। নিজেকে তিনি যতই ব্যস্ততার রজ্জুতে জড়ান না কেন, ঘরের আগল বন্ধ রাখেননি কখনও। সেখানে ভরা আলো-হাওয়া খেলেছে সারাদিন। সেই খোলা আগল খুলে মা মুক্ত ডানায় উড়েছেন যত্রতত্র। যখন যা মন চেয়েছে, করেছেন। মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়েছেন নিজের শখ-আহ্লাদের পেছনে। শুধু ক্লাবেই নয়, বাড়িতেও নিয়মিত আসর জমেছে খানা-পিনা আর হৈ-হুল্লোড়ের। বাবা ইচ্ছে করেই রজ্জুটা টানেননি কখনও, বরং লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে দিয়েছেন যতদূর যায়। যেতে যেতে হঠাত্ একদিন একেবারেই আছড়ে পড়ল যখন, তখনই টেনে বাঁধলেন সুতোটা।
কিন্তু তাতে লাভটা হলো কী? বাবা-মায়ের সম্পর্কটা সেই ধোঁয়াটেই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের মতন সুখী দম্পতি আর হয় না। কিন্তু এই বিশ্বাস টলে যায় যখন মধ্যরাতে বেডরুম থেকে ভেসে আসে চিত্কার-চেঁচামেচির আওয়াজ। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে ছুড়ে মারা গ্লাসের শব্দ। আবার হয়তো সুনসান। শুধু রিনরিনে চিকন একটা কান্নার সুর বিলাপের মতো ভেসে থাকে মধ্যরাতের বাতাসে।
টুই এমনটাই দেখে আসছে ছেলেবেলা থেকে। ভয়ঙ্কর এক ভীতি আর জড়তার ছাপ সারাক্ষণ লেগে থাকে তার মুখে। প্রাচুর্য আর বন্ধনহীন উচ্ছলতার ভেতর বেড়ে উঠলেও সেই অজানা ভীতিটা সহসা কুঁকড়ে ধরে তাকে। রৌদ্র-ছায়ার এই খেলাটা এখন হয়ে গেছে তার চরিত্রের অংশ। যে কারণে কখন তার মন ভালো থাকবে, কখন রেগে কাঁই হবে, নয়তো তুচ্ছ কোনো কারণে ভয়ে ছটফট করবে মৃগী রোগীর মতন—এটা বলা শক্ত। তার এই অস্থিরতাকে অনেকে দাম্ভিকতা বলে অপবাদ দেয়, ভুল বুঝে এড়িয়ে থাকে দূরে দূরে, কিন্তু যারা তাকে কিছুটা হলেও চেনে, তারা ঠিকই আঠার মতন লেগে থাকে ছায়াসঙ্গী হয়ে। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কে এল, কে গেল, কেউ তার পাশে থাকল, কী থাকল না, সে থোড়াই কেয়ার করে। সে আছে আপন ভুবনের পাটেশ্বরী হয়ে। তার প্রাসাদ থেকে কেউ খালি হাতে ফেরত যায় না।
মদ, মাংস আর সিগারেটের লাগামহীন ধোঁয়ায় ঘরের ভেতরটা চুরিয়ে উঠছিল। খুব কড়া ডোজের লপ্পা লপ্পা চলছে। কয়েক পেগ পেটে পড়তেই পাগল হয়ে উঠল মৃদুল। সে জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে কোমর দুলিয়ে নাচছিল হিজড়াদের মতো। পিয়াল গ্লাসে চামচ ঠুকে দরাজ গলায় গাইছিল খুব কষ্টের একটা গান। অলক দুই দফা বাথরুম ঘুরে এলো। তার চোখ-মুখ রীতিমত উত্তেজিত। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে হঠাত্ সে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
টুইয়ের শরীর ভালো নেই। খুব চওড়া বমি হয়েছে তার। কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে মাথাটা। তার খুব ঠাণ্ডা ধরে গেল। আরে জ্বরটর এল নাকি? মৃদুল শেষ আবরণটুকু ছুড়ে ফেলে দিয়ে হঠাত্ দিগম্বর হয়ে গেল। অলক আর পিয়াল হাততালি দিয়ে উত্সাহ দিল বন্ধুকে। মৃদুলের উত্তেজনা তখন চরমে উঠেছে। এ যেন অন্য এক মানুষ। কাপালিকের মতন উলঙ্গ নাচতে নাচতে হঠাত্ হ্যাঁচকা টান মেরে তুলে নিল টুইকে। পালকের মতন নরম শরীরটা দুই বাহুর মাঝখানে ছটফট করছিল কেবলই। কিন্তু সেই উদ্দাম নৃত্যভঙ্গি হঠাত্ এমনই ক্রুদ্ধ আর ঝড়ো-হাওয়ার রূপ নিল যেখানে সমূলে আছড়ে পড়ল ফুলন্ত বৃষটা। চোখের পলকে সেই ভেঙে পড়া ফুলের শরীরে কাম-লালা-ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজন আদিম নর্তক।
অবশেষে ক্ষান্ত হলো ছায়া নৃত্যের ঝড়।
তিনজন শোকার্ত মানুষ শবযাত্রার শোক পালনের মতো ধীরে ধীরে নতজানু হলো সেই হেলেপড়া বিধ্বস্ত পুষ্পবৃক্ষের পাশে।
ভয়ঙ্কর লজ্জা আর হতাশায় তারা দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।
সুত্র : আমার দেশ

প্রতিবেশী || আহসান হাবীব

— পাঁচ ইঞ্চি দেয়াল ভেদ করে দেখা যায়, এমন এক প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছে একজন।
— কে সে? নিশ্চয়ই বড় বিজ্ঞানী?
— তা তো বটেই।
— তা জিনিসটা কি? মানে আবিষ্কারটা?
— কেন জানালা!
ছোটবেলায় এই জোকটা ছিল জালাল সাহেবের প্রিয় একটা জোক। আর বড় বেলায় এসে এই জোকই এখন যেন বিগ ট্র্যাজেডি হয়ে দাঁড়িয়েছে! বিষয়টা খুলেই বলা যাক...
জালাল সাহেব অবশেষে একটি ফ্ল্যাটের মালিক হলেন। জমিজমা বেচে, অফিসের গ্র্যাচুইটি, পেনশন, হাবি-জাবি সব মিলিয়ে সবেধন নীলমণি এই ফ্ল্যাট। আটশ’ স্কয়ার ফিটের ফারমের মুরগির খাঁচা বললেই ভালো হতো। কিন্তু যেহেতু মূল্য চল্লিশ লাখ সামথিং... নিয়েছে (বারো কিস্তিতে) কাজেই এটাকে ঠিক মুরগির খাঁচা বলা যাচ্ছে না। ফ্ল্যাটই বলতে হচ্ছে। ভার্সিটিতে পড়ুয়া মেয়ের একটা রুম হয়েছে, কলেজ গোয়িং ছেলের একটা রুম হয়েছে এতেই তিনি খুশি। তাদেরও একটা বেডরুম হয়েছে সঙ্গে এটাচড বাথ। স্ত্রীর ঐ একটাই শখ ছিল, এটাচড বাথ হবে। শেষ জীবনে এসে সে আশা পূর্ণ হলো, তাই বা মন্দ কি? ভালোই চলছিল তাদের। নতুন ফ্ল্যাটে নতুন জীবন। কিন্তু একটা সমস্যা আবিষ্কার করলেন তার স্ত্রী। সমস্যাই বটে, ভয়াবহ সমস্যা। তাদের বেডরুমের একমাত্র জানালাটি খুললেই পাশের ফ্ল্যাটে টয়লেটের একমাত্র জানালা ... দূরত্ব কত হবে, খুব বেশি হলেও দেড় ফিট... সেই যে বিজ্ঞাপনে বলে না দূরত্ব যতই হোক কাছে থাকুন... কিন্তু এই কাছে থাকা সত্যি কঠিন, জানালা খুললেই ... !!
— আমার মনে হয় কি জান? স্ত্রী নাক কুঁচকে বলে।
— কি?
— ওরা যেদিন তোমার মতো পচা বাজার করে আনে, সেদিনই বাজে গন্ধটা নাকে বেশি লাগে...
— কি, আমি পচা বাজার করি?
— এটা নিয়ে আমি তর্ক করতে চাই না। এখন বল এই সমস্যার সমাধান কি? জানালাই যদি খুলতে না পারি, তাহলে ফ্ল্যাট বাড়ির এত বড় জানালা দিয়ে হবেটা কি?
— জানালা আমরা খুলবই খুলব ...
— কিন্তু ঐ টয়লেটের গন্ধ...?
— ঐ যে তুমি বললে ওরা যেদিন পচা বাজার করে সেদিনই...
— হ্যাঁ সেদিনই গন্ধটা বেশি আসে। পচা জিনিস খেয়ে পেট নেমে যায় তখন...
— হ্যাঁ... ওরা যাতে পচা বাজার না করে সে ব্যবস্থাই করতে হবে...
— মানে??

জালাল সাহেব মানে’র ব্যাখ্যায় আর গেলেন না। তিনি নিচে নেমে গেলেন। এই সময়টায় পাশের বাসার ভদ্রলোক সিগারেট খেতে বাইরে বের হোন। তার সঙ্গে একটু আলাপ জমানো দরকার। সিগারেট যারা খায়, তাদের মধ্যে আলাপ জমতে বেশি সময় লাগে না। এ আলাপ সে আলাপ করে খুব দ্রুতই তিনি আসল প্রশ্নে চলে এলেন।
— আচ্ছা আপনার বাসায় বাজার কার হাতে?
— কেন নিজেই করি। হঠাত্ এ প্রশ্ন করলেন যে?
— না, আমার বাসার বাজারও আমি করি কিনা! ভাবছি দু’জন এক সাথে গেলে... গল্পে গল্পে বেশ ... হে হে
— তা মন্দ বলেননি। আচ্ছা আপনি পচা মাছ ভালো মাছ বুঝতে পারেন?
জালাল সাহেব হাতের তালুর মধ্যে যেন চাঁদ পেলেন। এই সুযোগ।
— আমি মনে হয় বুঝতে পারি না। ভদ্রলোক বলতে থাকেন। ‘এইতো গতকাল শোল মাছ কিনলাম। আবার সন্দেহ হলো টাকি মাছও হতে পারে, বাসায় এনে স্ত্রীকে বললাম ‘দেখ তো এটা কি মাছ, শোল না টাকি?’ স্ত্রী কি বলল জানেন?
— কি বললেন ভাবী?
— বলল পচা মাছ!
— হা হা হা।
— আপনি হাসছেন?
— আরে ভাই বাদ দেন... কাল থেকে আমরা দুই ভাই মিলে বাজার করব, নো পচা মাছ...

পরদিন সত্যি সত্যি জালাল সাহেব আর তার টয়লেট জানালা প্রতিবেশী তরফদার সাহেব চললেন এক সঙ্গে বাজারে। জালাল সাহেবের একটাই উদ্দেশ্য তরফদার সাহেবের বাজার করার দিকে নজর রাখতে হবে, যাতে কোনো পচা জিনিস তার বাজারের ব্যাগে না ঢোকে... এ্যাট এনি কস্ট!
— জালাল সাহেব এ মাছটা মনে হচ্ছে তাজা—
— না না খবরদার... ওটা পচা, অবশ্যই পচা।
— কি করে বুঝলেন?
— দেখছেন না, ওটার গায়ে একটা মাছিও বসছে না। ফরমালিন দেয়া, স্রেফ ফরমালিন...
শেষমেষ তারা দেন-দরবার করে একটা মাছ কিনলেন তরফদার সাহেবের জন্য। ভ্যান ভ্যান করছে মাছি। বাজারের সব মাছি যেন এই মাছটার পেছনে লেগেছে। সেটাই কেনা হলো।
— ভাই জালাল সাহেব আপনি শিওর এটা তাজা মাছ?
— অবশ্যই, দেখছেন না এর পিছনে কত মাছি? মানে ফরমালিন দেয়া নেই...

অবশেষে দুই ভাই, মানে দুই প্রতিবেশী বাজার করে ফিরলেন। ভেতরে ভেতরে জালাল সাহেব পুলকিত। যাক শেষ পর্যন্ত বুদ্ধি করে তাজা মাছ গছানো গেছে প্রতিবেশীকে। আজ অন্তত জানালা খুলে ঘুমানো যাবে। স্ত্রীকে কীভাবে সুখবরটা দেবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না।
তবে সত্যি সত্যি সেদিন জানালা খোলার পরও কোনো গন্ধ এলো না, এ পারে। স্বামী-স্ত্রী আরামে চোখ বুজলেন সার্থক জানালা... কিন্তু একি? হঠাত্ ভ্যান ভ্যান করতে করতে শত শত মাছি ঢুকতে শুরু করল তাদের জানালা দিয়ে। স্ত্রী হতভম্ব হয়ে উঠে বসলেন।
—ওগো এত মাছি কোত্থেকে এলো?
— মনে হয়...
— কি মনে হয়?
মনে হয় ... তরফদার সাহেবের তাজা মাছের মাছিগুলো... এত বড় জানালা পেয়ে...!
সূত্র : আমার দেশ

বিজয় || আবু সালেহ

যে বিজয়ে উল্লসিত হই
যে বিজয়ে রোমাঞ্চিত হই
সে বিজয় কি ধ’রে আছি কেউ
সে বিজয় কি জাগায় মনে ঢেউ?
যে বিজয়ে স্বাধীনতা আনি
যে বিজয়ে মুছি চোখের পানি
সে বিজয় কি অনুভবে আছে
সে বিজয় কি ধানের শীষে নাচে?
যে বিজয়ে মাথা উঁচু রাখি
যে বিজয়ে ফুলের সুবাস মাখি
সে বিজয় কি স্বপ্ন দেখায় আর
সে বিজয় কি এখন তবে ‘তার’?
যে বিজয়ে পদ্মা নদী ছিল
যে বিজয়ে কষ্ট তুলে নিল
সে বিজয় কি প্রাণে সাড়া দেয়
সে বিজয় কি কোলে তুলে নেয়?
যে বিজয়ে হেসেছিল জাতি
যে বিজয়ে কাটে কালো রাতি
সে বিজয় কি ছড়ায় চাঁদের আলো
সে বিজয় কি এখন আছে ভালো?
যে বিজয়ে আবেগ ছিল ভরা
যে বিজয়ে দেশ ও জাতি গড়া
সে বিজয় কি দেশের কথা বলে
সে বিজয় কি বুক ফুলিয়ে চলে?
যে বিজয়ে সুর তুলেছি গানে
যে বিজয়ে নতুন জীবন আনে
সে বিজয় কি ভালোবাসা দেয়
সে বিজয় কি কাছে টেনে নেয়?
যে বিজয়ে আশা ছিল মনে
যে বিজয়ে ঘুরি সবুজ বনে
সে বিজয় কি দিচ্ছে শীতল ছায়া
সে বিজয় কি ধারণ করে মায়া?
যে বিজয়ে গণতন্ত্র আসে
যে বিজয়ে এই জনতা হাসে
সে বিজয় কি ম্লান ও মলিন নয়
সে বিজয় কি অর্থবহ হয়?
যে বিজয়ে হাজার বছর পর
যে বিজয়ে পেয়েছি এই ঘর
সে বিজয় কি ছিন্নভিন্ন হবে
সে বিজয় কি সমুন্নত রবে?
সূত্র : আমার দেশ

দিকহারা তুই || কেজি মোস্তফা

শিকড় রক্তাক্ত হয় হোক যাবো না বিভুঁই
সস্নেহ সুঘ্রাণে স্বদেশের স্বপ্নসুখ, আর সব
ডুবে যাক কপট বিশ্বাসে।
মায়ের মুখের বুলি অপূর্ব নিখাদে
স্পন্দিত নন্দিত আজ পৃথিবীর চোখে;
স্বপ্ন দিয়ে তৈরি স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
স্বদেশের আকাশ বাতাস মাটি জল
লেবুবনে জ্যোত্স্নার নীল কারুকাজ
নিমফুলের মদির গন্ধে দিকহারা তুই
ভ্রমর সন্ন্যাসী কী করে পথ হারাবি!

দিন চলে যায় পুরোনো বিষাদে
উঁকি মারে টুকরো টুকরো চেতনার চর
কবেকার হেলেপড়া ছেঁড়াখোঁড়া গাছ
কী আশ্চর্য আমাকেই নাম ধরে ডাকে—
কী যেন ফেলে এসেছি—শ্লেট না পেন্সিল।

বেবাক ভুলেছি—
গাঢ় হৃদয়ের টানে এতো মায়া
এমন মমত্বে ভালোবাসা উথলিয়া ওঠে,
ভালোবাসা হয়, ভালোবাসা ভেঙে যায়,
তবু অবিবেকী পাখি অলীক উদ্যানে বসে
গভীর আরামে আজও ডানা চুলকায়, ডানা চুলকায়!
সূত্র : আমার দেশ

অন্ধকার থেকে উঠে আসে || জাহাঙ্গীর ফিরোজ

স্মরণের ওপারে আঁধার
ঘন অন্ধকারে ঠাসা
তখন সে ভাবে মগজের কোষে কোষে
ঘুণপোকা বেঁধেছে কি বাসা
তবু প্রত্যাশা
চাঁদ নেই কি হয়েছে তাতে
তারারা উঠুক একান্ত আকাশে।
হঠাত্ দিগন্ত বেয়ে উঠে এলো চাঁদ
আরেক আকাশে অগণন তারা
মন ও মননে অন্তঃশীলা স্রোত
ভেসে চলে কারা?

শিউলি মালতী বেলী অগণিত ফুল
ভোরের শিশিরে দেখি একটি বকুল
একে-একে মনে তারা
গন্ধে স্পর্শে বিষাদ বেদনা নিয়ে
অন্ধকারে লুপ্ত ছিল যারা
চাঁদ ওঠে—তারাহীন আকাশের কোলে শুকতারা
একটি কোকিল ডাকে
কাকে ডাকে ভেবে ভেবে উদাসীন হলো কিছু পাখি
একটি কোকিলা এলো চোখ গেল চোখ গেল আঁখি।
স্মৃতির দিগন্তে ওঠে আধখানা চাঁদ
স্মরণের অন্ধকারে ফুটে ওঠে তারা
একে একে মনে পড়ে সেই সব মুখ
অন্ধকারে লুপ্ত ছিল যারা।
সূত্র : আমার দেশ

গার্হস্থ্য জীবন || মুজিবুল হক কবীর

যে যায়
সে আর ফেরে না কখনো,
ভাঙনের শব্দ শুনতে শুনতে
একদিন সে মধ্যরাতে তার হৃদস্পন্দনের শব্দ
অন্যরকম শুনতে পায়।

পুরনো বাড়ির আধখানা আকাশ ডুবে যায়,
ডুবে যায় একফালি চাঁদ এবং গার্হস্থ্য জীবন;
ডুবতে ডুবতে সে মাছেদের মহলে চলে যায়,
আর ফেরে না কখনো।

যে স্বপ্নবীজ বুনেছিল উঠোনের এককোণে
তাও বেড়ে ওঠেনি,
যে ছোট বারান্দা ছিল দুরন্ত শিশুর পায়ের দখলে
সেখানে আজ মাছেদের ভিড়,
নদীর তলানি থেকে যে বুদবুদ ওঠে
মানুষ ভাবে এ তার দীর্ঘশ্বাস।
সূত্র : আমার দেশ

শোধ হয় না ঋণ || হাসান হাফিজ

রক্তে লেখা নাম রক্তে ভেজা মাটি
প্রতিরোধে জিগীষায় লড়াই সাহসে
রক্তনদী পার হয়ে
লালসবুজের পাই দেখা
বাংলাদেশ শহীদের স্বপ্নমাখা দেশ
এখনো অপূর্ণ থাকা আকাঙ্ক্ষার কুঁড়ি
ফুটে উঠবে প্রশান্তি পূর্ণতা নিয়ে
শেষ হয় না অপেক্ষার কাল
মুক্তিযুদ্ধ কখনো সমাপ্ত নয়
যুগে যুগে চলছেই, চলবেও
এ প্রক্রিয়া কোনোদিনই
স্তিমিত হওয়ায় মতো নয়
ঋণ শোধ হয় না কখনো, তবু
ত্যাগের স্বপ্নালু ঋণ সেই দীপ্র দুঃসাহস
পুঁজি করে নতুন প্রত্যয়ে
প্রগতির পথ পাড়ি দিতে হবে
অভিযান কোনোদিনই ফুরানোর নয়।
সূত্র : আমার দেশ

অচল পয়সার গ্লানি || শাহাবুদ্দীন নাগরী

এতোদিন নিজেকে খুব দামি ভাবতাম সোনাদানার মতো,
প্লাটিনামের তৈরি মূর্তির মতো আসন ছিল সুউচ্চ বেদিতে,
আসলে আমার ভেতর জমা হয়েছে পরিত্যক্ত বর্জ্য,
ঘামতে ঘামতে ভঙ্গুর হয়েছে শরীর, হাড়ের মজ্জা কুরে খাচ্ছে শয়তান,
উদ্বাস্তু যৌবন হারিয়ে গেছে ড্রয়ারে কাগজের নিচে,
আমি যাকে সত্য বলে মেনেছি সে আসলে মূর্তিমান প্রতারক,
আমার ইন্টারনেট প্রদর্শন করে আধুনিক পাপাচার।
কী হবে শৈশব ঘেঁটে! নামতা এখন ঢুকে গেছে ক্যালকুলেটরে।
আসলে আমি একটা মূল্যহীন অচল পয়সা, ছেঁড়াফাটা বাতিল নোট,
ঠিকই করেছে ওরা, পাছায় লাত্থি দিয়ে ছুঁড়ে ফেলেছে রাস্তায়,
স্যুয়ারেজের দূষিত জলের ভেতর দিয়ে গড়িয়ে যাচ্ছি কোথাও।
আমার অনেক আগেই গড়িয়ে যাওয়া উচিত ছিল এই স্বর্গ থেকে।
সূত্র : আমার দেশ

খুঁড়ে যাচ্ছি || ইকবাল আজিজ

খুঁড়ে যাচ্ছি মানবজমিন
প্রেম ছিল কোথাও কি? স্মৃতি ছিল অবশিষ্ট
রাত ছিল নিভে, তবু হেঁটে গিয়েছিলো পূর্বপুরুষেরা
নদীটির দিকে—
নদী নদী নদী অফুরান নদী
বয়ে যায় নিরবধি
আমার এ বঙ্গদেশে—
খুঁড়ে যাই নদী, খুঁড়ে যাই ঘরবাড়ি
মানুষের মন—
মনের গভীরে থাকা ছবি
জল ছল ছল পিতামাতা আত্মীয়েরা
মেঘময় আকাশের নিচে
সবুজ জমির আল ধরে গান গায়

আমি খুঁড়ে যাই তাদের সঙ্গীত
রাখালিয়া গান—
ছুটে আসে বরষার বান
মাঝিদের স্পর্শ করে খুঁড়ে যাই
মাঝি আর মাল্লাদের সাথে বয়ে যাই—
যেখানে গভীর সমুদ্রের কণ্ঠস্বর
বঙ্গোপসাগর...

খুঁড়ে যাচ্ছি জল
ছল ছল ইতিহাস ডাকে
মায়াময় জীবনের বাঁকে—
খুঁড়ে যাচ্ছি জীবনের প্রত্নতত্ত্ব
সময়ের ইতিবৃত্ত
খুঁড়ে যাচ্ছি জীবনের সব তত্ত্ব—
খুঁড়ে যাচ্ছি... খুঁড়ে যাচ্ছি...

সূত্র : আমার দেশ

নাসির উদ্দিন হোজ্জার কৌতুক | ১ |

অভিযোগ নাই
বিবির পিড়াপিড়িতে নাসিরুদ্দিন একটা গরু কিনল। কিন্তু গরু ও গাধার জন্য গোয়াল ঘরে পর্যাপ্ত যায়গা না থাকায়, একটা ঘুমালে আরেকটাকে দাড়িয়ে থাকতে হতো।
প্রিয় গাধার এই দুরবস্থা দেখে হোজ্জা একদিন খোদার কাছে প্রার্থনা করছে, "হে আল্লাহ, দয়া করে গরুটাকে মেরে ফেল যাতে আমার গাধাটা একটু আরাম করে ঘুমাইতে পারে" ।
পরদিন সকালে সে গোয়াল ঘরে গিয়ে দেখে যে গাধাটা মরে পরে আছে।
প্রানপ্রিয় গাধার মৃত্যতুতে হতাশ হয়ে হোজ্জা বিরস বদনে আকাশের দিকে তাকায়ে বলল, "কোন অভিযোগ করবনা, খোদা, কিন্তু তুমি এতদিন ধরে সারা দুনিয়ার মালিক হয়েও, কোনটা গরু কোনটা গাধা এইটা চিনলানা!"

বিবি তোমার কথাই ঠিক
নাসিরুদ্দিন হোজ্জা তখন কাজী। বিচার আচার করেন। একদিন বিচারে বসেছেন। ফরিয়াদি আসামির সম্পর্কে তার অভিযোগের বয়ান দিতেছে। হোজ্জা মনযোগ দিয়া তার কথা শুনছেন। বাদীর বলা শেষ হয়ে মাথা ঝাকিয়ে বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক'।

এইবার আসামি বলে উঠল, 'হুজুর, আমার দুইটা কথা ছিল'। হোজ্জা বললেন, 'ঠিকাছে তুমি তোমার বক্তব্য বল'। আসামির বক্তব্যও মনযোগ দিয়া শোনার পর হোজ্জা বললেন, 'তোমার কথাই ঠিক'।

হোজ্জার স্ত্রী পর্দার আড়ালে এতক্ষণ সব কথা শুনছিলেন। বিরক্ত হয়ে স্বামীকে তিনি বললেন, 'দুইজনই ঠিক হয় কিভাবে? হয় আসামির কথা ঠিক অথবা ফরিয়াদির কথা ঠিক'।

হোজ্জা স্ত্রীর দিকে ফিরে সমর্থনসূচক হাসি দিয়ে বললেন, 'বিবি তোমার কথাই ঠিক'।

কোর্তার ভিতর আমিও ছিলাম
একদিন রাতে হোজ্জার প্রতিবেশি শুনল হোজ্জার সাথে তার স্ত্রীর ঝগড়া চলছে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর ভারী একটা কিছু পড়ার আওয়াজ হলো তারপর সব চুপচাপ।
পরদিন সকালে প্রতিবেশি হোজ্জা কে জিজ্ঞাস করে, 'কাল রাতে আপনার বাসায় ভারী কিছু একটা পড়ার শব্দ পেলাম'।
'আমার বিবি রাগ করে আমার কোর্তা জানালা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়', হোজ্জা জানায়।
'একটা কোর্তা পড়ায় এত শব্দ হয়', প্রতিবেশি অবাক।
'আরে কোর্তার ভিতর তো আমিও ছিলাম', হোজ্জা বিরস মুখে জানায়।

মহিলা বিচার চায়
একদিন একজন পুরুষ ও একজন মহিলা বিচারক হোজ্জার দরবারে এল।
মহিলাটি ফরিয়াদ জানায়, 'আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি, অপরিচিত এই লোকটা হঠাৎ এসে আমাকে চুমু দিয়েছে। আমি বিচার চাই'।
'আমিও মনে করি তোমার বিচার পাওয়া উচিত', হোজ্জা বলে। 'সুতরাং আমি নির্দেশ দিলাম, তুমি লোকটাকে চুমু দাও এবং তোমার প্রতিশোধ নাও'।

ভাগ্যিস আমি ছিলামনা
এক রাতে হোজ্জা দেখে বাগানে এক লোক দাড়ায় আছে। চোর ভেবে হোজ্জা ধনুক বের করে চোরের দিকে তীর ছুড়ল। পরদিন সকালে গিয়ে দেখে তারই জামা মেলে দেয়া ছিল। যেটাকে হোজ্জা চোর মনে করে তীর ছুড়েছিল এবং সেই তীর জামাতে বিদ্ধ হয়ে আছে।
সাথে সাথে হোজ্জা মোনাজাত করে আল্লার কাছে শুকরিয়া জানায়।
হোজ্জার বিবি অবাক হয়ে বলে, ' তুমি এখন মোনাজাত করছ কেন?'
'ভাগ্যিস জামার ভিতর আমি ছিলামনা', হোজ্জার উত্তর।

আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?
একদিন নাসিরউদ্দিন চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল।
তার শালা এসে জিজ্ঞাস করে, ' আপনি কি ঘুমাচ্ছেন?'
'কেন জিজ্ঞাস করছ', নাসিরুদ্দিন বলে।
'আমি ভাবছিলাম আপনি যদি আমাকে কিছু টাকা ধার দিতেন'।
'ওকে, তাইলে তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর, আমি ঘুমাচ্ছি', নাসিরউদ্দিন বলে। ' এখন আমাকে একা থাকতে দেও'

Friday, December 16, 2011

স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়! কেন ওদের মাথায় খুনের নেশা আসে? || অধ্যাপক গাজী গিয়াস উদ্দিন

তরুণ-যুবকদের মাথায় শুধু মাত্র খুনের নেশা আসে কেন? মানুষে মানুষে এত দূরত্ব কেন? একজন মানুষ আরেকজন মানুষকে খুনের চিন্তা শুধু মাত্র তখনই করতে পারে যখনি জিঘাংশা বৃদ্ধি চরমে পৌঁছে। একজন আরেকজনকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করলেও তাতে তার মধ্যে সংুব্ধতা জেগে উঠতে পারে। শুধু আর্থিকভাবে বঞ্চনা নয়, সে বঞ্চনা প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পরামর্শ মায়া মমতা থেকে বঞ্চিত করলেও। মানবিক পারিবারিক ও সামাজিক ব্যবস্থায় এসবের গুরুত্বকে অবহেলা করা চলে না।
আমাদের চার পাশে বড় হওয়া আমাদেরই সন্তান যখন বখাটে হয়ে বড় হয়। নানা নেশায় আসক্ত হয়। খুনের মত ঘটনা ঘটায়-তাতে আজকের কলুষিত পরিবেশের পাশাপাশি অভিভাবক শ্রেণীরও দায় আছে।
সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি হত্যাকান্ড। ফরহাদ খাঁর আপন ভাগ্নে মামা-মামিকে নৃশংস ও পাষন্ড কায়দায় হত্যা করলো। পুলিশের কাছে খুনির জবানবন্দি মতে, বিষয়টি আর্থিক এবং আপন আত্মীয় থেকে প্রবঞ্চিত হওয়ার পুঞ্জীভূত ােভের বহিঃ প্রকাশ। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, একজন তরুণ যতই বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত হোক- সে কেন নেশা করবে? তার মাথায় কেন খুনের পরিকল্পনা আসবে? আমাদের দেশে অর্থ উপার্জনের নানা উপায়- অবলম্বন আছে। সেদিকে তারা না গিয়ে তারা বখাটে হয়, তারা নেশা গ্রস্ত হয়- এর জন্য দায়ী কারা?
কিছুদিন আগে ঢাকা ইন্দিরা রোডে খৃস্টান মা-ছেলেকে যে গাড়ীর ওয়ার্কশপের তরুণ কর্মচারী খুন করলো- তাও আর্থিক লেন-দেনের বিষয়কে কেন্দ্র করে বলে শুনা গেছে। কেউ কাউকে আর্থিকভাবে লেন-দেনে বঞ্চিত করলে অথবা পতারণা করলে তার জন্যে কোর্ট-কাচারী অথবা সামাজিক সংস্থা আছে। যে সব কতটুকু ফলদায়ক ভূক্তভোগীরাই জানেন। বছরের পর বছর কোর্ট-কাচারীতে ঘুরো, আর অর্থ দন্ড দাও- এ হচ্ছে আমাদের দেশের বৃটিশ প্রণীত মান্ধাতা আমলের অবয়মান য়িষ্ণু বিচার ব্যবস্থা। আর সামাজিক সালিশ বিচারে চাঁদাবাজ, ঘুশ খোর, বিচারের নামে প্রহশনের বড়-ছোট গডফাদাররা বসে আছে সালিশ বাণিজ্য নিয়ে। সেখানেও নানা প্রতারণার বিচিত্র জাল।
কিন্তু আমি ভাবছিলাম, খুনের দায় কাঁধে নিয়ে কারো পাওনা পরিশোধের সম্ভাবনা দূরের কথা। খুন না করে কৌশলে অর্থ সম্পদ লুট করে নিয়ে গেলেতো (যদিও আমি অন্যায় লুটের পে নয়) অপরাধীরা পাওনার চাইতেও বেশী লাভবান হয়। তার পরও কেন ওদের মাথায় খুনের নেশা আসে। চিন্তার এ জঘন্য ব্যভিচার কেন? যুগের এ জঘন্য প্রবণতা কেন? সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি হত্যা এবং ইন্দিরা রোডের মা-পুত্র হত্যার ঘটনার বেলায় এ প্রশ্নগুলো আসে।
এ প্রসঙ্গে মনে পড়ে এক বিজ্ঞানীর সাথে এক যুবকের কাহিনী। এক যুবক বিজ্ঞানীর কাছে গিয়েছিল তাকে কাজ দেওয়ার জন্য। বিনিময়ে সে যুবক সারা জীবন বিজ্ঞানীর চাকর হিসেবে গোলামী করবে। বিজ্ঞানী জানতেন, যুবকদের সুপ্ত সম্ভাবনার কথা। তিনি যুবকের চেতনা জাগ্রত করার মানসে প্রস্তাব করলেন। হে যুবক, তুমি সারা জীবন আমার গোলামী করা লাগবো না। তোমার একটি হাত আমাকে দাও, তার বিনিময়ে আমি তোমাকে অনেক অর্থ দেব। সে যুবক রাজী হয়নি। (কাহিনীটি সংেেপ বলা হল) বিজ্ঞানী যুবকটিকে বোঝাতে চাইলেন- তোমার মহা মূল্যবান হাত-পা-মাথা এরকম বহু মহামূল্যবান উপার্জনের হাতিয়ার জন্মগতভাবে অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও তুমি কেন অপরের গোলামীর বিনিময়ে দু’মুঠো ভাত যোগাড়ের চিন্তায় অস্থির? এই যে মানুষের সামর্থ, যোগ্যতা, সম্ভাবনা ও শ্রেষ্ঠত্ব। মানুষ মেধা ও শ্রমকে কাজে লাগিয়ে কি না করতে পারে? বিজ্ঞানী যুবকের মর্মমূলে সেদিন প্রচন্ড আঘাত হানলেন, তোমারও দু’টো অলস হাত হতে পারে মহা কর্মের হাত- ভিার হাত নয়।
ভিা বৃত্তিকে নিন্দা করতে উৎসাহিত করা হয়, কিন্তু আজ যে তরুণদের খুন বৃত্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে? এর প্রতিকার কি? এত অসাম্য-অসংগতি, প্রবঞ্চনা, প্রতারণা, অবিচার ও বিচারহীনতা এবং অধিকার দলন, এতটা দায়িত্বহীনতা ও নিষ্ঠুর ভোগবাদিতা এ সমাজকে এতটা নিষ্ঠুর নিয়তির পথে নিয়ে যাচ্ছে। যার উপসর্গ হচ্ছে তরুণদের মাঝে আজ খুনের গরল নেশা উম্মাদিত হয়ে উঠছে। যার করুণ পরিনতি নিদ্রার যে স্বাভাবিক নিরাপত্তা, তারই মাঝে বেঘোরে প্রাণ দিতে হয়; একান্ত স্বজনদের হাতে আমাদের সমাজের শিক, সাংবাদিক, উকিল, বৃদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, প্রবীণ গৃহবধুদের পর্যন্ত। এ সমাজে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি কোথায়?

যুদ্ধদংশিতা || মারুফ রায়হান

পিতা ভাই প্রেমিক কিংবা বন্ধু
কেউই সহমর্মীর আলিঙ্গনে জড়ায়নি তোমাকে
অগ্রজ পুরুষের পাপের জন্যে ক্ষমা চাই
ক্ষমা করো বিদগ্ধ নারী
যুদ্ধের জীবন্ত স্মারক

‘বীরাঙ্গনা’ শব্দকে যারা করে তুলেছে বারাঙ্গনা
যে সমাজ তোমাকে ছুঁড়ে দিয়েছে অন্ধকারে
যে-পুরুষসমাজ তোমাকে করেছে করুণা
কুকুরের মতো শুধু শুঁকেছে শরীর
তাদের পাপের কোনো ক্ষমা নেই জানি
তবু আজ অপরাধবোধে ন্যুব্জ আমি
তোমার মুখের দিকে তাকানোর সাহস পাই না
শুধু ক্ষমা চাই

শুরু হয়ে গেছে ডিসেম্বরের বাঁধা উত্সব
উত্সবের পেছনে সারি সারি শব
একেকটি তোপধ্বনির নেপথ্যে লক্ষ নারীর ক্রন্দন
একেকটি উড্ডীন পতাকার পেছনে নয় মাসের বস্ত্রহীনতা
একেকটি আলোকসজ্জার অন্তরালে অনপনেয় অন্ধকার
ক্ষমা চাই

হে সম্মানিতা, হে যুদ্ধদংশিতা অগ্নিশুদ্ধ
পুরুষজাতক এই পাপীকে ক্ষমা করো
ক্ষমা চাই
সূত্র : আমার দেশ

মুক্তবাজার || রেজা উদ্দিন স্টালিন

কোথাও কেউ নেই গভীর বনপথ
পথের মাঝখানে কে যেন চিতাবত্
অবুঝ ভঙ্গিতে চাটছে থাবা তার
হয়তো ভাবনায় আসছে বার বার
শিকার ফুরিয়েছে অভাবী সংসার

হঠাত্ দেখলো সে আমার ছায়াধার
উঠলো জ্বলে তার চোখের তলোয়ার
আমিও বহুদিন ঘুরছি বনে বনে
ক্ষুধায়-পিপাসায় হয়েছি গন্গনে
প্রতিটি আচরণে রয়েছে উল্লেখ
আমাকে দেখছে সে আমিও অনিমেখ
দু’জন দু’জনার বসেছি মুখোমুখি
পারলে এক্ষুনি কলজে ছিঁড়ে ঢুকি
এভাবে কেটে গেলো হাজার হিমযুগ
এখানে কেউ নই কারোরই কৃপাভুক

কে কাকে ছিঁড়ে খাবে জানে না কেউ কিছু
ক্ষুধার হার বাড়ে শুধুই মাথাপিছু।

সূত্র : আমার দেশ

স্বপ্নঘাট || পুলক হাসান

পু ল ক হা সা ন
গ্রহণলাগা এই সময়ে
নবীন নক্ষত্রের স্বপ্ন ঢেউ
যেন বয়ে নিয়ে আসে মরুঝড়;
ধূলির কুয়াশায় ডুবছে কি চরাচর?

অস্পষ্ট যে আজ তোমার মুখের রেখা
হৃদয়পাঠ বুঝি আরো এক দুরূহ কাজ
মহল তাই আছে পড়ে, নেই মাথার তাজ
সকলেই যেনবা স্বঘোষিত সম্রাট।

ফলে খরার মাঠে বৃষ্টির করুণা চেয়ে
বসে নেই আজ কেউ
কোথায় তবে ভেড়াব আজ স্বপ্নতরী
যদি না থাকে সেই ঘাট।
সূত্র : আমার দেশ

এ সবই সত্য কথা || শাহিন রিজভি

আমার কাঁচা বাজারে সন্তুষ্ট নয় বাবুর্চি
থলিতে উঁকি দিয়ে মুচকি হাসে
ফ্লোরে নিবিষ্ট ওর চোখ দুটো
দেখে না আমার বাঁকানো ঠোঁটের জয়,
থলের ভেতর নড়েচড়ে ওঠে
চৌত্রিশ বছরের সরীসৃপ পাঁজর
মটরশুঁটির ভেতর লুকিয়ে থাকা
তিনটি পরাজয় কিনে এনেছি সস্তা দামে।

আমার দারোয়ান স্যালুট করছে আমাকে
যে কয়বার দেখা হয় লনে
মাথা নাড়াই, কোনো প্রশ্ন করি না তাকে
তার নাখোস মেজাজ ভিখারী তাড়ায়
দেখে না আমার কুড়িটি আঙুলে
ভিক্ষুকদের কুড়িটি ঘরবাড়ি
নবাবী কায়দায় বেঁচেছি কমরেড
কিনেছি ভিক্ষার ঝুলি।

আমার কাজের বুয়া চুরি করে খায়
সত্য কখনো থাকে না চাপা, এমন মিথ্যে কথাটি
জানে না কাজের বুয়া
তার চোরামন মেনে নেয় অদৃষ্ট লিখন
আকুতি মিনতি করে অপরাধী চোখ।
বুক উঁচু করে আমি পথ হেঁটে চলি, মনে মনে বলি
কেউ তো জানে না চুরি করে আমি
সাতচল্লিশ খেয়েছি, বায়ান্ন খেয়েছি
খেয়েছি একাত্তর রুইয়ের মাথা।
সূত্র : আমার দেশ

বিজয়ের ভালোবাসা || মেজবাহ উদ্দিন

আমি যেদিকে তাকাই শুধু অন্ধকার
তোমাকে দেখার জন্যে
সেই প্রত্যুষে কিংবা গভীর রাতে
দু’চোখ হারাই।

আমি জীবনকে কখনো মৃত্যুর
কাছে ঠেলে দেইনি
জীবনের কাছে জীবনের গানকে
বড় ভালোবাসি, আপন ভাবি।

আমি অন্ধকার থেকে মুক্তি চাই—
মৃত্যুর কাছাকাছি সব একাকার হোক
তবু এ অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের
বিজয় আমার, ভালোবাসা আমার।
সূত্র : আমার দেশ

অন্য এক প্রধান পুরুষ || শাহ আহমদ রেজা

আওয়ামী লীগ সরকার দাপটের সঙ্গেই জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘সঠিক’ ইতিহাস শিখিয়ে চলেছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, সরকারের এই ‘সঠিক’ ইতিহাসের সবটুকু কৃতিত্ব চলে গেছে একজন মাত্র নেতার দখলে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে ‘সঠিক’ ইতিহাস কিন্তু সরকারের উদ্ভট এ চেষ্টাকে বাতিল করে দেয়। একটি উদাহরণ হিসেবে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। স্বায়ত্তশাসনের পর্যায়ক্রমিক যে আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রধান নির্মাতা। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাকও তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন (৩০ নভেম্বর, ১৯৭০)। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পর কোনো কোনো নামকরা নেতার মতো গ্রেফতার বরণের নিরাপদ পন্থা নেয়ার পরিবর্তে তিনি ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন (১৫ এপ্রিল, ১৯৭১)। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তাঁকে অঘোষিতভাবে নজরবন্দি রাখলেও বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে বংলাদেশকে সমর্থন করার ও স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন।
কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তত্কালীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাত্ করে দেয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাঁকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। অর্থাত্ ১৯৫০-এর দশকে সূচিত স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সঠিক’ ইতিহাসে তাঁর স্থান হয়নি।
মওলানা ভাসানীর পর দ্বিতীয় একজন প্রধান নেতা হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের কথা উল্লেখ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এত সুসংগঠিত হতে এবং এত অল্প সময়ে বিজয় অর্জন করতে পারতো না। স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার গঠন থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও ভারতের সহযোগিতা নিয়ে দেশকে স্বাধীন করা পর্যন্ত সমগ্র কর্মকাণ্ডে প্রধান এবং সফল নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার এবং অন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা আদায়ের ক্ষেত্রেও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযোদ্ধাদেরও তিনিই সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন। এই ভূমিকার জন্যই যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের অবদানের কথা স্মরণ করা দরকার। কারণ ‘সঠিক’ ইতিহাস হলো, স্বাধীনতা কারও ঘোষণা শুনে আসেনি। জনগণও কারও ঘোষণা শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল যে অস্থায়ী ‘মুজিবনগর’ সরকার, সে সরকারও হঠাত্ করে গঠিত হয়নি।
১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের একেবারে শেষ বাক্যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কোনো পর্যায়েও শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। তিনি বরং তার ৭ মার্চের চার দফা দাবি অনুযায়ী সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার সৃষ্টি হবে। এই পর্যায়ে শেখ মুজিবের প্রস্তাবে ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে লে. জেনারেল শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। প্রথম বৈঠকে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার প্রশ্নে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করতে পারেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৭ মার্চের একান্ত বৈঠকে নতুন এক প্রস্তাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে মিলিত হয়ে দুই অঞ্চলের জন্য দু’টি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে ওই দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে। প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিলেন, যে ঘোষণাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরি করার আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন। ১৯ মার্চ আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব নিজেও বলেছিলেন, কোনো ‘অগ্রগতি না হলে’ তিনি কি শুধু শুধু আলোচনা চালাচ্ছেন?
২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান নিজেদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণায় তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে—(১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
এবং (৩) পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (‘পূর্ব পাকিস্তান’) জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা। উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে সম্মত হন। পরদিনই এ কে ব্রোহী এক লিখিত অভিমতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।
২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল। খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দু’টি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছিল—(১) প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে; এবং (২) যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে, সেহেতু প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউসে আগের দিন ঢাকায় আগত জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাত্ হয়েছিল। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, তেমন কোনো আয়োজন বা সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া পৌঁছে দিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টাদের বৈঠক শেষ হয়েছিল কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া। ২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার নতুন এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বিষয়টি শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব তোলেন এবং ঘোষণার অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সান্ধ্য বৈঠকে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের জানানো হয়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে আওয়ামী লীগকে অবহিত করবেন। জেনারেল পীরজাদা জানিয়েছিলেন, তিনি পরদিন অর্থাত্ ২৫ মার্চ ‘কোনো এক সময়’ ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোনে জানাবেন, কখন তারা আবার বসবেন এবং কবে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি প্রচার করা হবে।
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়া এবং তাদের উপদেষ্টাদের মধ্যকার সমঝোতা অলোচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ২৫ মার্চ সারাদিন অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা কোনো টেলিফোন করেননি, প্রচারিত হয়নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণাটিও। অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি যখন (২৫ মার্চ) রাত ১০টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেই, তখনও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তেমন কোনো টেলিফোন আমি পেয়েছি কি না। আমি তাকে জানিয়েছি, আমি কোনো টেলিফোন পাইনি।’ (ড. কামাল হোসেনের বিবরণী, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খণ্ড, পৃ-২১০-২৭৮)। এখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণীও উল্লেখযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন না আসার কথা জেনে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অনুরোধ করলেও শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হননি। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ রাত ১০টার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত্ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। তারা যাওয়ার পরপর ইপিআরের একজন হাবিলদার এসে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ইপিআরের সব বাঙালি সদস্য পিলখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এ কথা শুনেই তাজউদ্দীন আহমদ তাদের দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পথে কামাল হোসেন ধানমন্ডির চার নাম্বার রোডের একটি বাসায় ঢুকেছিলেন দেয়াল টপকে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে। (দেখুন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খণ্ড)। লক্ষণীয়, রাত ১০টার মধ্যে ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার তথ্যটি কিন্তু পিলখানা থেকে ট্রান্সমিটারযোগে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের দাবিকে অসত্য প্রমাণ করে। তাছাড়া দৈনিক ইত্তেফাকসহ ২৬ মার্চের দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিব ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছেন।
প্রধান নেতা শেখ মুজিবের দিক থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকায় এর পরের প্রতিটি পদক্ষেপ তাজউদ্দীন আহমদ নিয়েছিলেন একক সিদ্ধান্তে। বিভিন্ন পর্যায়ে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিয়ে ভারতীয়দের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে তার একটি ভাষণও প্রচার করেছিল ভারত সরকার। ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। সেদিন থেকে বৈদ্যনাথতলার নাম হয়েছে মুজিবনগর।
‘সঠিক’ ইতিহাসের মূল্যায়নে সময়োচিত ও দিক-নির্ধারণী হিসেবে প্রমাণিত হলেও ভারতে চলে যাওয়া থেকে সরকার গঠন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়াটা তাজউদ্দীন আহমদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বরং বাধাগ্রস্ত, সমালোচিত এবং প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একক সিদ্ধান্তে তিনি এমন এক সময়ে সরকার গঠন করেছিলেন, যখন আওয়ামী লীগের সব নেতাই ছিলেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং পলায়নরত। শেখ মুজিবের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অনেকেই। শেখ ফজলুল হক মনি, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি তুলেছিলেন। তাদের সঙ্গে উস্কানিদাতার ভূমিকায় নেমেছিলেন সেকালের ‘মস্কোপন্থী’রা—মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রমুখ। কিন্তু একদিকে তাজউদ্দীন আহমদের নিজের নিষ্ঠা, সততা ও নিখাদ দেশপ্রেম এবং অন্যদিকে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সমর্থন তাকে রক্ষা করেছিল। এ জন্যই তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সঠিক’ ইতিহাসে স্থান না পেলেও দেশপ্রেমিক নেতা তাজউদ্দীন আহমদেরও ছিল দীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস। তাকে শেখ মুজিবের চাটুকারিতা করতে দেখা যায়নি, বাকশালেও যোগ দেননি তিনি। এটাই অবশ্য তাজউদ্দীন আহমদকে ‘সঠিক’ ইতিহাসে স্থান না দেয়ার একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আওয়ামী লীগের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোভাব—যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কারও অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার উপাদান নেই। 
সূত্র : আমার দেশ

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ