প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Monday, December 12, 2011

একাত্তরে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ || একরামুল হক শামীম

১৯৭১ সালে নারীর বিরুদ্ধে যে বীভৎস নির্যাতন চালানো হয়েছিল তা মানব ইতিহাসে বিরল। নারীর প্রতি অত্যাচারে সেই বিষয়গুলো কখনোই পুরোপুরি উঠে আসেনি। অনেকের জীবনের করুন ঘটনাগুলো তাই আড়ালেই থেকে গেছে। কখনোই উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি সেই নারীদের দুঃখগুলোকে; যারা রাতের পর রাত নির্মম যৌন নির্যাতন সহ্য করে গেছে, পরনে কাপড় ছিলনা , মাথার চুল প্যাচিয়ে আত্মহত্যা করতে পারে এই ভেবে যাদের মাথা চুল কেটে ফেলা হয়েছিল, নিজের পরিবারের সদস্যদের সামনে যাদের ধর্ষণের শিকার হতে হয়েছে। নারীর বিরুদ্ধে যে বীভৎসতম নির্যাতন চালানো হয়েছিল ১৯৭১ সালে তার বিচার হয় নি। এমনকি এই বিষয়টি যে অন্য অপরাধগুলো থেকে আলাদা মাত্রার সেটিও আলোচিত হয় নি। এমনকি নির্যাতিত নারীর সঠিক সংখ্যাও জানা সম্ভব হয় নি। বরঞ্চ নির্ভর করতে হয়েছে বিভিন্ন সংখ্যার ওপর।
কয়েকটি পরিসংখ্যান
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম জনসভায় বলেছিলেন, দুই থেকে আড়াই লাখ নারী যুদ্ধে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। পরবর্তীতে এ সংখ্যাটিকেই সরকারি পরিসংখ্যান হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত দৈনিক বাংলার বানী’র গনহত্যা বিষয়ক বিশেষ সংখ্যা থেকে জানা যায়, দুই থেকে আড়াই লাখের পরিসংখ্যানটি সে সময়ের সরকারি কর্মকর্তারা অনুমানের ভিত্তিতে তৈরি করেছেন। তাদের হিসাব অনুযায়ী সারা দেশের ৪৮০টি থানার ২৭০টিই পাকিস্তানী সেনাদের দখলে ছিল। প্রতিদিন গড়ে ২ জন করে নিখোঁজ মহিলার হিসাব অনুযায়ী লাঞ্ছিত মহিলার সংখ্যা দাঁড়ায় ২ লাখ। [১]
অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ডা. জিওফ্রে ডেভিস দেশজুড়ে তার চিকিৎসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতায় এবং উত্তরাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় চালানো নমুনা জরিপের মাধ্যমে পরিসংখ্যান তৈরি করে জানান, ৪ থেকে ৪ লাখ ৩০ হাজার নারী মুক্তিযুদ্ধে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তিনি আরো জানান, অন্তঃসত্ত্বা মহিলার সংখ্যাই ২ লাখ।
সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালিত গবেষণায় দু’লাখ, তিন লাখ ও চার লাখ- এরকম তিনটি পরিসংখ্যানের উল্লেখ রয়েছে।
সুসান ব্রাউনমিলার এ সংখ্যাটিকে প্রায় চার লাখ বলে উল্লেখ করেছেন।[২] তিনি লিখেছেন-
During the nine-month terror, terminated by the two week armed intervention of India, a possible three million people lost their lives, ten millions fled across the border to India and 200,000, 300,000 or possible 400,000 women (three sets of statistics have been variously quoted) were raped. Eighty percent of the raped women were Moslems, reflecting the population of Bangladesh, but Hindu and Christian women were not exempt.
ওয়ারক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটি একাত্তরের নারী নির্যাতনের একটি সামগ্রিক পরিসংখ্যান প্রকাশ করে।[৩] এর মাধ্যমে জানা যায়-
১. স্পট ধর্ষণ,স্পট গণধর্ষণ ও বন্দী নির্যাতিতার সম্মিলিত সংখ্যা চার লাখ আটষট্টি হাজার (স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার তিন লাখ সাতা হাজার ছশ এবং বিভিন্নভাবে পাকিস্তানীদের নিকট বন্দী নির্যাতিত নারী এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’ নারী)।
২. চিহ্নিত স্থানে নির্যাতিতা নিহত ও অপহৃতসহ স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার- তিন লাখ ষাট হাজার। এঁদের মধ্যে শুধুমাত্র স্পট ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার প্রায় তিন লাখ সাতাশ হাজার যা মোট নির্যাতিতার সত্তরভাগ। এঁদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন প্রায় ত্রিশভাগ অর্থাৎ এক লাখ আট হাজার নারী।
৩. নির্যাতিত বন্দী নারী প্রায় এক লাখ চল্লিশ হাজার (এক লাখ চল্লিশ হাজার চারশ’) যা মোট নির্যাতিতার প্রায় ত্রিশভাগ। এরমধ্যে কারাগার, ক্যাম্প, বাঙ্কার প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিতার সংখ্যা মোট নির্যাতিদের প্রায় আঠারভাগ।
এছাড়াও বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্ট, মার্শাল ল’ আদালত এবং শহর ও গ্রামাঞ্চলের বাড়িঘর, অফিস আদালত, হোটেল, বিনোদন কেন্দ্র প্রভৃতি স্থানে নির্যাতিত হন বারোভাগ (ক্যাটাগরি দুই-শতকরা পাঁচভাগ এবং ক্যাটাগরি তিন-সাতভাগ)।
৪. বন্দী নির্যাতিত নারীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা আশিভাগ অর্থাৎ প্রায় সাড়ে ছিয়াশি হাজার। এঁদের মধ্যে চল্লিশভাগকে হত্যা করা হয়েছে অথবা তাঁরা নিজেরাই আত্মহত্যা করেছেন।
যৌন নির্যাতন
অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ড. জিওফে ডেভিস বলেছেন, পৌনঃপুনিক লালসা চরিতার্থ করবার জন্য হানাদারবাহিনী অনেক তরুণীকে ধরে তাদের শিবিরে নিয়ে যায়। এসব তরুণীদের মধ্যে অন্তঃসত্ত্বা হবার লক্ষণ কিংবা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিলে হয় তাঁদেরকে পরিত্যাগ করা হয়েছে নয়তো হত্যা করা হয়েছে। কোন কোন এলাকায় বারো ও তেরো বছরের বালিকাদের শাড়ি খুলে নগ্ন অবস্থায় রেখে ধর্ষণ করা হয়েছে যাতে তারা পালিয়ে যেতে অথবা আত্মহত্যা করতে না পারে।[৪]
সুসান ব্রাউনমিলার তার Against Our Will: Men, Women and Rape বইয়ে লিখেছেন-[৫]
Rape in Bangladesh had hardly been restricted to beauty. Girls of eight and grandmothers of seventy-five had been sexually assaulted during the nine-month repression. Pakistani soldiers had not only violated Bengali women on the spot; they abducted tens of hundreds and held them by force in their military barracks for nightly use. The women were kept naked to prevent their escape.
যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার
১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দীর্ঘ ৯ মাস সময়ে নারীদের যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। পাকিস্তানী সৈনিকরা নারীদের বন্দি করে নিয়ে গেছে নিজস্ব ক্যাম্পে এবং বাঙ্কারে। দিনের পর দিন সেখানে তাদের আটকে রেখে যৌন নির্যাতন করা হয়েছে। ক্যাম্প পরিবর্তনের সাথে সাথে সেইসব নারীদেরও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে অন্য ক্যাম্পে।
ডা. এম এ হাসান লিখিত “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে এমনই একজনের কাহিনী।[৬]
“একাত্তরের মে মাসে হবিগঞ্জের লস্করপুরে চা বাগান থেকে পাকি আর্মিরা যখন সুপ্রিয়া নায়েককে ধরে নিয়ে যায় তখনও তাঁর বয়স ষোল পেরোয়নি। প্রথম দিন চা বাগানের এক ক্যাম্পে নিয়ে কয়েকজন পাকি আর্মি তাঁর ওপর বীভৎস যৌন নির্যাতন চালায়। সেই ছিল শুরু। তারপর পাকিরা তাঁকে নিয়ে গেছে এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে, এক বাগান থেকে অন্য বাগানে। দিনের পর দিন ঐসব ক্যাম্পের আর্মি অফিসাররা তাঁর ওপর নির্দয় নির্যাতন চালিয়েছে। দীর্ঘ আট মাসের প্রতি রাতে চারজন পাঁচজন করে পাকি তাঁকে ধর্ষণ করেছে। একটি রাতের জন্যও নিষ্কৃতি দেয়নি তাঁকে। তাদেরকে বাঁধা দেবার কোন উপায় ছিল না, মুখ বুজে সব সহ্য করে গেছেন তিনি। এরমধ্যে একবার ক্যাম্প থেকে পালিয়ে এলেও পাকিরা আবার তাঁকে ধরে নিয়ে যায়। তারপর স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত সুপ্রিয়া নায়েক সহ্য করেছেন পাকিদের সীমাহীন নির্যাতন। যুদ্ধের ক’মাসে অন্তত পঞ্চাশজন পাকি আর্মি অফিসার তাঁকে নিয়মিত ধর্ষণ করেছে। তাঁকে ঠিকমতো খাবার দেয়নি, অসুস্থ হলেও চিকিৎসা করায়নি। দিনের পর দিন কেবল চালিয়ে গেছে বীভৎস ধর্ষণ।”
১৯৭২ সালে মার্চ থেকে ছয় মাস বাংলাদেশের হয়ে কাজ করেছেন অস্ট্রেলিয়ার চিকিৎসক ড. জেফ্রি ডেভিস। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান-[৭] “ধনী ও সুন্দরী মেয়েদেরকে অফিসারদের জন্য রেখে দেয়া হতো আর বাকিদের অন্যান্য র্যাংঙ্কের সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দেয়া হতো। আর মেয়েদেরকে দারুণ কষ্টে ফেলে দেয়া হতো। তাদেরকে পর্যাপ্ত খেতে দেয়া হতো না। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাদের চিকিৎসা দেয়া হতো না। অনেকেই ক্যাম্পের মধ্যে মারা গেছে।”
অপহরণ
যুদ্ধকালীন সময়ে শুধু যৌন নির্যাতন করেই ক্ষান্ত হয় নি পাকবাহিনী। বেশ কিছু সংখ্যক নারীকে ‘কমফোর্ট গার্ল’ হিসেবে ধরে নিয়ে গিয়েছিল তারা। ১৯৭২ সালের ২০ জুন দৈনিক ইত্তেফাকের তৃতীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ হইতে অপহৃতা সাড়ে ৭০০ তরুণীর মর্মবেদনার কাহিনী’ শীর্ষক খবরে লেখা হয়, ‘দখলদার পাক বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা হইতে অপহরণ করিয়া নেওয়া ৭ শত ৫৫ জন বাঙালি তরুণী করাচি ও কোয়েটার বন্দী শিবিরগুলিতে অমানুষিক দৈহিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকারে পরিণত হইয়াছে।’
জোরপূর্বক গর্ভধারণে বাধ্য করা (forced pregnancy)
অফিসিয়াল ডকুমেন্ট অনুযায়ী যুদ্ধকালীন সময়ে ফোর্সড প্যাগন্যান্সীর (forced pregnancy) শিকার হন কমপক্ষে ২৫০০০ জন।[৮]
অন্যদিকে সুসান ব্রাউনমিলারের লিখেছেন ধর্ষণের পরও বেঁচে থাকা নারীদের মধ্যে ২৫ হাজার জন গর্ভধারন করেছিলেন (ব্রাউনমিলার, ১৯৭৫ : ৮৪)। তিনি লিখেছেন-
The most serious crisis was pregnancy. Accurate statistics on the number of raped women who found themselves with a child were difficult to determine but 25,000 is the generally accepted figure.
তবে ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিংস কমিটির ডা. এম এ হাসান দাবি করেন, ‘এ ধরনের নারীর সংখ্যা ছিল কমপক্ষে ৮৮ হাজার ২ শ’। ’৭২ সালের মার্চ পর্যন্ত ১ লাখ ৬২ হাজার ধর্ষিত নারী এবং আরো ১ লাখ ৩১ হাজার হিন্দু নারী স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছিল। তারা বিলীন হয়ে গিয়েছিল বিশাল জনসমুদ্রে।’ এদের মধ্যে ৫ হাজার জনের গর্ভপাত সরকারিভাবে ঘটানো হয়েছিল বলে জানান ১৯৭২ সালে বাংলাদেশে চিকিৎসা সেবা দিতে আসা অস্ট্রেলিয়ান চিকিৎসক ড. জিওফ্রে ডেভিস। ১৯৭২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন দৈনিক বাংলায় তার কাজের ওপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল। তার মতে, সরকার উদ্যোগ নেওয়ার আগেই ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার নারীর ভ্রুণ স্থানীয় দাই, ক্লিনিকসহ যার পরিবার যেভাবে পেরেছে সেভাবে ‘নষ্ট’ করেছে।[৯]
জেনোসাইডাল রেইপ (গণহত্যা সম্পর্কিত ধর্ষণ) (Genocidal Rape)
জোনোসাইডাল রেইপের সাথে গণহত্যার সম্পর্ক রয়েছে। যুদ্ধকালীন সকল ধর্ষণই গণহত্যার সাথে সম্পর্কিত নয়। যদি ধর্ষণের সাথে কোন একটি গোষ্ঠীকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা থাকে অর্থাৎ গণহত্যার যেসব উপাদান জরুরী তা যদি ধর্ষণের মাধ্যমে করা হয় সেটাই জোনোসাইডাল রেইপ।
জেনোসাইডাল রেইপ বিষয়টি প্রথম আলোচিত হয় রুয়ান্ডায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়। আকায়েসু (Akayesu) মামলায় প্রথমবারের মতো গণহত্যার সাথে ধর্ষণের যোগসূত্র স্থাপিত হয়। আকায়েসু রুয়ান্ডার একটি কমিউনিটি টাবার মেয়র ছিলেন। তার বিরুদ্ধে গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের দায় প্রমাণিত হয়। ১৯৯৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর International Criminal Tribunal for Rwanda – ICTR আকায়েসুর বিরুদ্ধে রায় দেয়।[১০]
আকায়েসুর মামলাটি বিখ্যাত কারন এটিই প্রথম রায় যেখানে গণহত্যা বিচার হয়েছে, যে গণহত্যার সাথে যৌন নির্যাতনের সম্পর্ক আছে। পাশাপাশি এই মামলার রায়ে ধর্ষণ এবং যৌণ নির্যাতনের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে।[১১]
বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে জেনোসাইডাল রেইপ সংঘটিত হয়েছিল। এনবিসি নিউজ ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি একটি রিপোর্ট করে। যাতে জানা যায় ১৩ বছরের মেয়েরাও ধর্ষণের শিকার হয়েছে।
পাকিস্তানী সেনাদের স্থানীয় সহযোগী, রাজাকার এবং আল বদর বাহিনী বিশেষত হিন্দু জনগোষ্ঠীকে নির্যাতনের জন্য ধর্ষণ করতো। বীনা ডি কস্তা লিখেছেন-[১২]
The Pakistan Army’s local militia, known as the Razakaar and al-Badr, used rape to terrorise, in particular the Hindu population, and to gain access to its land and property.
আইনের আলোয় দেখা
ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের ১৭৯ পৃষ্টার রায়ে কোথাও ধর্ষণের বিচারের উল্লেখ নাই। তবে ইন্টারন্যাশনাল ট্রাইব্যুনাল ফর দ্য ফার ইস্ট চলার সময় ধর্ষণের কিছু অভিযোগ দায়ের করা হয়েছিল। টোকিও প্রসেডিং চলার সময় “রেপ অব নানকিং” আলোচিত হয়।
ন্যুরেমবার্গ ট্রায়াল থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে নতুন এক কনসেপ্ট এর উদ্ভব হয় আন্তর্জাতিক আইন পরিমন্ডলে। সেটি হলো মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। ন্যুরেমবার্গ ট্রায়ালের চার্টার অব দ্য ইন্টারন্যাশনাল মিলিটারি ট্রাইব্যুনাল (Charter of the International Military Tribunal) এর আর্টিকল 6(c) মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে সংজ্ঞায়িত করেছে। লক্ষ করি সেই সংজ্ঞাটি-
“(c) Crimes against humanity: namely, murder, extermination, enslavement, deportation, and other inhumane acts committed against any civilian population, before or during the war, or persecutions on political, racial or religious grounds in execution of or in connection with any crime within the jurisdiction of the Tribunal, whether or not in violation of the domestic law of the country where perpetrated.”
লক্ষ্য করা যাক সংজ্ঞাতে হত্যা, দাসত্ব ছাড়াও আরো বেশ কিছু বিষয়ের অবতারনা করা হয়েছে, কিন্তু ধর্ষণের বিষয়টির উল্লেখ নেই। পরবর্তীতে বাংলাদেশ যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালে আইন প্রণয়ন করে [The International Crimes (Tribunals) Act, 1973] তখন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করে। লক্ষ করি সেই সংজ্ঞায়ন-
দ্য ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট ১৯৭৩ এর ধারা 3 (2) (a) অনুযায়ী-
(a) Crimes against Humanity: namely, murder, extermination, enslavement, deportation, imprisonment, abduction, confinement, torture, rape or other inhumane acts committed against any civilian population or persecutions on political, racial, ethnic or religious grounds, whether or not in violation of the domestic law of the country where perpetrated;
“মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ : যথা, হত্যা, নিশ্চিহ্ন করণ, দাসকরণ, নির্বাসিত করা, কারারুদ্ধ করণ, অপহরণ, অবরোধ, নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা বেসামরিক নাগরিকদের উপর অন্যান্য অমানবিক কাজ পরিচালনা করা অথবা সংগঠিত হওয়ার স্থানের অভ্যন্তরীন আইন ভঙ্গ করে বা না করে রাজনৈতিক, গোত্রগত, জাতিগত অথবা ধর্মীয় কারনে অভিশংসন করা।”
লক্ষ্য করি বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’কে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে ধর্ষণকে যুক্ত করে। আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে সেটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ একটি সংযোজন। এ বিষয়টি পরিষ্কার হয় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পরবর্তী কিছু সিদ্ধান্তে।
১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ কর্তৃক গঠিত হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল ফর রুয়ান্ডা (International Criminal Tribunal for Rwanda – ICTR) । আইসিটিআর এর স্ট্যাটুট-এর ৩ অনুচ্ছেদে “মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’কে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
Article 3
The International Tribunal for Rwanda shall have the power to prosecute persons responsible for the following crimes when committed as part of a widespread or systematic attack against any civilian population on national, political, ethnic, racial or religious grounds:
(a) Murder; (b) Extermination; (c) Enslavement; (d) Deportation; (e) Imprisonment; (f) Torture;
(g) Rape; (h) Persecutions on political, racial and religious grounds; (i) Other inhumane acts.
এই অনুচ্ছেদের 3(g) তে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে ধর্ষণকে অন্তর্ভূক্ত করা হয়েছে। যদিও Dr. Frances T. Pilch তার “Rape as Genocide : The Legal Response to Sexual Voilence” শীর্ষক রচনায় দাবি করেছেন আইসিটিআর এর স্ট্যাটুটে প্রথমবারের মতো ধর্ষণকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ হিসেবে সংযুক্ত করা হয়; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তারও অনেক আগে ১৯৭৩ সালেই বাংলাদেশ ধর্ষণকে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে সংযুক্ত করে।
পরবর্তীতে রোম স্ট্যাটুটে (Rome Statute of the International Criminal Court) ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’কে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে আরো ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গি নেওয়া হয়। লক্ষ্য করি সেই সংজ্ঞায়নটি-
Article 7 : Crimes against humanity
1. For the purpose of this Statute, “crime against humanity” means any of the following acts when committed as part of a widespread or systematic attack directed against any civilian population, with knowledge of the attack:
(a) Murder; (b) Extermination; (c) Enslavement; (d) Deportation or forcible transfer of population; (e) Imprisonment or other severe deprivation of physical liberty in violation of fundamental rules of international law; (f) Torture; (g) Rape, sexual slavery, enforced prostitution, forced pregnancy, enforced sterilization, or any other form of sexual violence of comparable gravity; (h) Persecution against any identifiable group or collectivity on political, racial, national, ethnic, cultural, religious, gender as defined in paragraph 3, or other grounds that are universally recognized as impermissible under international law, in connection with any act referred to in this paragraph or any crime within the jurisdiction of the Court; (i) Enforced disappearance of persons; (j) The crime of apartheid; (k) Other inhumane acts of a similar character intentionally causing great suffering, or serious injury to body or to mental or physical health.
অনুচ্ছেদ 7(1) (g) এর দিকে খেয়াল করি। বলা হয়েছে Rape, sexual slavery, enforced prostitution, forced pregnancy, enforced sterilization, or any other form of sexual violence of comparable gravity মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এটিকে পূর্বের চেয়ে বিস্তৃত সংজ্ঞায়ন। জোরপূর্বক গর্ভধারণে বাধ্য করা (forced pregnancy) বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে রোম স্ট্যাটুটের আর্টিকল 7(2) (f) এ। সেটি হলো-
(f) “Forced pregnancy” means the unlawful confinement of a woman forcibly made pregnant, with the intent of affecting the ethnic composition of any population or carrying out other grave violations of international law. This definition shall not in any way be interpreted as affecting national laws relating to pregnancy
সুতরাং দেখা যাচ্ছে ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক গর্ভধারণে বাধ্য করা’সহ অন্য বিষয়গুলোর বিচারের ক্ষেত্রে ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ’ কনসেপ্ট এর সাহায্য নেওয়া হচ্ছে।
একটি প্রস্তাবনা
বাংলাদেশ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে গিয়ে ১৯৭৩ সালে যে আইনটি করে তাতে প্রথমবারের মতো ধর্ষণকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু ১৯৭১ সালে নারীর ওপর ধর্ষণের বাইরেও আরো অনেক মাত্রার নির্যাতন চালানো হয়েছিল। এই ধরণের নির্মম নির্যাতনের বিচার হওয়া জরুরী। রোম স্ট্যাটুট অব ইন্টারন্যাশনাল ক্রিমিনাল কোর্ট –এ ধর্ষণ, জোরপূর্বক গর্ভধারণে বাধ্য করাসহ আরো কিছু বিষয় মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। তবে এর মাধ্যমে ১৯৭১ সালে নারীর বিরুদ্ধে যে ধরণের নির্যাতন চালানো হয়েছিল তার পুরোপুরি বিচারের আলোয় রাখা সম্ভব হয় না। তাই প্রাসঙ্গিকভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশের উচিত নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ (Crime against Women) নামের নতুন একটি কনসেপ্টকে সংজ্ঞায়িত করে তার অপরাধীদের বিচার করা। ধর্ষণ, অপহরণ, জোরপূর্বক গর্ভধারণে বাধ্যকরা সহ নারীকে যুদ্ধক্যাম্পে আটকে রাখা, শারীরিক এবং মানসিকভাবে আক্রান্ত করা, ঠিকমতো খাবার না দেওয়া, পরিধেয় কাপড়ের ব্যবস্থা না করা এসবই হতে পারে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ।
যুদ্ধক্যাম্পে আটকে রেখে দিনের পর দিন অনাহারে রেখে রেখে, পরিধেয় কাপড় কেড়ে নিয়ে নারীদের উপর মানসিকভাবে এবং শারীরিকভাবে যে অত্যাচার করা হয়েছে তার কঠিন বিচার নিশ্চিত করতে হবে। এর জন্য আইনগতভাবে “নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ” কনসেপ্টটাকে গ্রহণ করা উচিত।
তথ্যসূত্র :
১. মুক্তিযুদ্ধে নির্যাতিত নারীর সংখ্যা কতো?;শামীমা বিনতে রহমান, ভোরের কাগজ, ১৭ মে ২০০২
২. Against Our Will : Men, Women and Rape; Susan Brownmiller; Page 81
৩. একাত্তরের নারী নির্যাতন : ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায়; ডা. এম এ হাসান; প্রসঙ্গ ১৯৭১ : মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, পৃষ্টা ৩৯
৪. একাত্তরের নারী নির্যাতন : ইতিহাসের কৃষ্ণ অধ্যায়; ডা. এম এ হাসান; প্রসঙ্গ ১৯৭১ : মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, পৃ. ৩৩
৫. Against Our Will : Men, Women and Rape; Susan Brownmiller; Page 83
৬. যুদ্ধ ও নারী; ডা. এম এ হাসান, পৃ ২৭-২৮
৭. ড. জেফ্রি ডেভিস যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের স্বেচ্ছাসেবী একজন ডাক্তার, বীণা ডি কস্তা, যুদ্ধাপরাধ, আইন ও সালিশ কেন্দ্র, পৃষ্টা ৪৯-৫০
৮. Bangladesh’s erased past; Bina D’costa, find online
৯. সেইসব বীরাঙ্গনা ও তাদের না-পাক শরীর; ফারুক ওয়াসিফ
১০. Prosecutor vs. Jean-Paul Akayesu, Judgment, No. ICTR-96-4-T (September 2, 1998), hereinafter reffered to as Akayesu, Available online at .
১১. When Rapes Become Genocide, New York Times, September 5, 1998 10:1.
১২. Bangladesh’s erased past; Bina D’costa, find online
সূত্র : দ্রোহ

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ