প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Showing posts with label অয়ন খান. Show all posts
Showing posts with label অয়ন খান. Show all posts

Friday, January 7, 2011

অসুখ by অয়ন খান

অনেকদিন পর মাসুদের সাথে আমার দেখা - অফিসপাড়ায়। ডাক্তার মাসুদ আমার স্ড়্গুলের সময়ের খুব ভালো বন্ধু, কিন্তু অনেকদিন কোন যোগাযোগ ছিল না। আমি ভাষা হারিয়ে ফেললাম, কাছের একটা হোটেলে গিয়ে বসলাম, আর মনে করতে চেষ্টা করলাম সেসব বিষয় আর ঘটনা যেগুলো একসময় আমরা ভুলে যেতে চেষ্টা করেছি।
তার নিজের কথা জিজ্ঞেস করলাম - সে বিয়ে করেছে বছর সাতেক, এক কন্যা নিয়ে ভালোই আছে। মেয়ে স্ড়্গুলে যাওয়া শুরু করেছে।

আমিও নিজের কথা বললাম - সোমা আর রায়ানকে নিয়ে আমার চমৎকার দিন কেটে যাচ্ছে। সোমার সাথে আমার প্রেমের বিয়ে, বিয়ের পর যে প্রেম নষ্ট হয়ে যায়নি। আর রায়ানকে আমি ভালোবাসি নিজের জীবনের চেয়েও বেশি, অফিস থেকে ফেরার পর সে যখন দৌঁড়ে আসে ব্যাগ নেয়ার জন্য - আমার আনন্দের সীমা থাকেনা। তখন বুঝতে পারি - অর্থ-বিত্ত বড় কথা নয়, সামাজিক সম্পর্কগুলোই পরিপূর্ণতা দেয় একজন মানুষের জীবনকে।

স্বাভাবিকভাবেই একপর্যায়ে রাকিবের কথা উঠল। রাকিব, মাসুদ, আর আমি - আমরা তিনজন সবসময় একসাথে চলাফেরা করতাম। রাকিবের সাথেও বহুদিন আমার কোন যোগাযোগ নেই। তবে মাসুদের সাথে নাকি তার প্রায়ই দেখা হয়।

রাকিব বিষয়ে কথায় কথায় অনেক আলাপ হল। কাপের পর কাপ চা শেষ হচ্ছিল আমাদের। ওর সম্পর্কে এমন কিছু ঘটনা শুনলাম, যা সম্পর্কে না আমার জানা ছিল, না কোন ধারণা ছিল। সে যে এতোটা মানসিক বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে গেছে সে কথা আমি জানতামই না।

তার বিয়ের খবরও আমি পাই নি - বলেছিলাম।

সেও তো প্রায় বছর চারেক হল।

ও, তাহলে তো সে বেশ বয়সেই বিয়ে করেছে।

হ্যাঁ, ও যখন বিয়ে করে - পয়ত্রিশ তো হবেই।

দেরীর কারণ কি? চাকরী-বাকরীর কোন ঝামেলা?

না, আরে, তার তো বিচিত্র এক সমস্যা ছিল।

তারপর মাসুদ পুরো ঘটনা খুলে বলল।

ও মেয়ে দেখতে গিয়ে মেয়ের মায়ের দিকে খেয়াল করে বোঝার চেষ্টা করত, মেয়ে আসলে কি রকম। মেয়েরা নাকি দেখাদেখির সময় এতো সেজে থাকে যে তাদের সত্যিকার চেহারা বা স্বভাব বোঝা সম্্‌ভব হয় না। তো এতে করে সবকিছু আরো জটিল আকারই ধারণ করেছিল। এক মেয়ের মায়ের অরুচিকরভাবে পান চিবানো দেখে সেই মেয়েকে সে বাতিল করেছিল। আরেক মহিলার স্থূল শরীর দেখে সে নাকি ভদ্রমহিলার মধ্যে ঐ মেয়ের ভবিষ্যতকেই দেখতে পাচ্ছিল - ফলে যথারীতি ওটাও বাদ। এভাবে মেয়ের পর মেয়ে বাতিল হতে থাকল, ওদিকে বাড়তে থাকল তার বয়স।

আমি একদিন বললাম - মেয়ে বুড়ী হবে, তুই বুড়া হবি না! তুইও তো বুড়া হবি। নিজের দিকটা চিন্তা করিস না কেন?

এরপর তার খঁুতখঁুতে ভাব হয়তো কিছুটা কমেছিল। পরে ঢাকার এক মেয়ের সাথেই তার বিয়ে হয়। মেয়েটা সুন্দরই ছিল, একটা ব্যাংকে চাকরী করত। মেয়েটারও বয়স একটু বেশীই ছিল, কিন্তু চেহারার মধ্যে নিষ্পাপ একটা ভাব ছিল।

কিন্তু বিয়ের পর বাঁধল আরেক সমস্যা। আমি তার ডাক্তার বলেই কিনা জানিনা, সে আমাকে অনেক গোপন কথা বলত। আরে, তার এই সমস্যা তো দেখা গেল আরো ভয়াবহ। আমি শেষপর্যন্ত তাকে একজন সায়কায়াট্রিস্টের কাছেও পাঠিয়েছিলাম।

এবার কি সমস্যা? আমাকে বলা যায়? - অনভিপ্রেত হবে জেনেও জিজ্ঞেস করি আমি।

সমস্যা মানে কি - যতবার সে মেয়েটার কাছে যেত, মনে মনে ভাবার চেষ্টা করত - এই মেয়েটা ছোটবেলা দেখতে কেমন ছিল। মেয়েটার ছোটবেলার অ্যালবামের ছবিগুলো সে খঁুটিয়ে খঁুটিয়ে দেখত। সে একরকম অবসেস্‌ড হয়ে গিয়েছিল। সে বলত, সম্পর্ককে পূর্ণতার দিকে নিতে গেলে শুরু করতে হবে একেবারে ছেলেবেলার সব বিষয়গুলো সম্বন্ধে জানার মাধ্যমে। সম্পর্ক সঠিক পথে পূর্ণতা পাবার আগেই শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেলে তা আত্মার সম্পর্ককে চিরদিনের মত নষ্ট করে দিবে - এটাই ছিল তার ধারণা।

তা ছেলেবেলা থেকে শুরু করতে গেলে তো অনেক সময় লেগে যাবে, এমনিতেই দেরীর বিয়ে - আমি হাসতে হাসতে বলেছিলাম।

তো সাইকায়াট্রিস্ট তাকে লম্বা থেরাপী দিতে থাকল। এদিকে ঘরের অশান্তি তো আর মেটে না। শেষপর্যন্ত এক পীরের কাছে নেয়া হল তাকে। সেই লোক একসময় স্ড়্গুলশিক্ষক ছিল, পরে কোন কারণে মাথা খারাপ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে তিনি পীর হন, এখন বহু মানুষ তার কাছে উপদেশ নিতে আসে।

তো সেই পীরের কাছে গিয়ে তার উপকার হয়েছিল?

তার ধর্ম-কর্ম একটু বেড়েছিল, কিন্তু সমস্যা সমস্যাই থেকে গেছে।

তাহলে?

শেষে আমি নিজেও একদিন বসলাম তার সাথে। তাকে ফুলের পরাগায়নের উদাহরণ দিলাম। সেই যে আমরা স্ড়্গুলে পড়েছিলাম - উদি্‌ভদবিজ্ঞান। ফুল নিজেকে রঙিন করে সাজায়, যেন পতংগ এসে ভীড় করে তার চারদিকে। পতংগকে আকর্ষণ করার এ ব্যাপারটা কেন? কারণ হল - পতংগের সাথে পরাগরেণু চলে যায় ফুলের গর্ভে, সেখানে জন্ম নেয় ফল। এই ফলই হল গাছের ভবিষ্যত প্রজন্ম। প্রকৃতি ফুলকে সাজায় আসলে পোকাগুলিকে আকৃষ্ট করার মাধ্যমে গাছের বংশধারাকে বাঁচিয়ে রাখতে। মানুষের জন্যও একই সত্য। প্রকৃতি যুবক-যুবতীকে সুন্দর করে সাজায় যেন তারা একে অন্যের দিকে ছুটে যায়, নতুন মানুষ জন্ম নেয়। এসবও প্রকৃতিরই খেলা, যেন মানুষ বংশবিস্তার করতে পারে। আসলে এরমধ্যে মহৎ প্রেম খঁুজতে যাওয়া একেবারেই অবৈজ্ঞানিক ধরণের চিন্তা, প্রেমের ধারণাকে সে অর্থে একরকম কুসংস্ড়্গারও বলা যায়।

কিন্তু তোর এই তত্ত্বে মনে হচ্ছে ঈশ্বর একেবারেই অনুপস্থিত - অল্প হেসে বলি আমি - আমার তো ধারণা ছিল, ঈশ্বর ভালোবাসা সৃষ্টি করে তা ছড়িয়ে দিয়েছেন জীবজগতের মধ্যে।

এসব তো বায়বীয় কথা, কিছুটা ভিত্তিহীনও। তাছাড়া ঈশ্বরের আইডিয়া এখানে একেবারে যে অনুপস্থিত, তাও নয় - সে একটু থামে।

ঐ যে প্রকৃতির কথা বললাম, সেটা তো ঈশ্বরই, তাই না? উদি্‌ভদ আর প্রানীর যেমন বৈজ্ঞানিক নাম আছে, ঈশ্বরেরও বৈজ্ঞানিক নাম আছে - সে বৈজ্ঞানিক নামটা হল প্রকৃতি। বিজ্ঞানীরা যখন কিছু ব্যাখ্যা করতে পারে না, তখন তার কারণ হিসেবে প্রকৃতির কথা বলে - এটাই সাম্প্রতিক ফ্যাশান।

তারপর সে আবার আগের প্রসংগ শুরু করল - আমি রাকিবকে বলেছিলাম, তুই তো দেখি প্রেমকে একেবারে পূজা করা শুরু করেছিস। মনে হয় সিনেমায় দেখেছিস যে দুইজনের প্রেম হল, আর অমনি প্রেমিক-প্রেমিকা দৌড়-ঝাঁপ শুরু করল। নাটক-সিনেমা দেখে বিভ্রান্ত হওয়ার কোন কারণ নেই, প্রেম সেরকম অমোঘ কিছু না।

তা এগুলি শুনে তার লাভ হয়েছিল?

হয়তো, আমি নিশ্চিত না। তবে পরের বার যখন তার সাথে দেখা হল - তাকে কিছুটা স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। তার ফ্যামিলির লোকজনের কাছেও শুনেছিলাম, সে মোটামুটি স্বাভাবিক জীবনেই ফিরে গেছে। এমনকি পরে তাদের একটা ছেলেও হয়েছিল।

ছেলে হয়েছিল? তাহলে তো হ্যাপি এন্ডিং বলা যায়?

হয়তো। কিন্তু এবার অন্য একটা ব্যাপার ঘটেছিল, একেবারে ভিন্ন ধরণের একটা সমস্যা ।

আবার সমস্যা? বলে কি? এ লোক তো দেখি সমস্যা থেকে বেরোতেই পারছে না।

হঁ্যা, ঐ যে, যা মাথায় ঢোকে - তা আর বের করতে পারে না। তার মাথায় যে ঢুকেছিল, সবকিছু প্রকৃতির খেলা - সে সেটাই ধরে বসে ছিল। সে ভাবতে শুরু করেছিল - আবেগ বলে জগতে কিছু নেই, আবেগ মানেই প্রকৃতির খেলা। এমনকি শিশুর প্রতি মানুষের যে ভালোবাসা, সেটাও নাকি প্রকৃতির চালাকি। শিশুরা দুর্বল অসহায়, তাদের যাতে আমরা যত্ন করে বড় করে তুলি - সেজন্যই নাকি তাদেরকে মায়াময় করে বানানো হয়। শিশুর প্রতি ভালোবাসা তাই স্বর্গীয় কিছু নয়।

মোটকথা সবাই নিজের জন্যই বাঁচে, নিজের জন্যই সম্পর্কের জাল বুনে। ভালোবাসা বলে পৃথিবীতে কিছু নেই - আছে শুধু কর্তব্য, না হয় উদাসীনতা। সে মনে করত - সবাই একা, আর পার্থিব সম্পর্কগুলো হচ্ছে সাময়িক বিভ্রান্তি। হঁ্যা, বিভ্রান্তিই মনে করতে শুরু করেছিল সে এগুলোকে। সে ধর্ম থেকে উদাহরণ দিয়ে বলত - কেয়ামতের দিন কোন বিভ্রান্তি থাকবেনা, এজন্যই কেউ কাউকে চিনতে পারবে না - মা ছেলেকে চিনবে না, স্ত্রীও স্বামীকে চিনবে না, ইত্যাদি।

তাহলে শেষ কথা কি দাঁড়াল, পৃথিবীতে কেউই আপন নয়?

অনেকটা তাই। বন্ধু বা স্বজন এরা আপন নয়। আপনজন যদি কেউ থাকে সে আছে অন্য কোথাও।

অন্য কোথাও মানে? ঈশ্বরের কথা বোঝাচ্ছে নাকি?

সেটা হতে পারে, আমি নিশ্চিত নই। তাছাড়া এরপর থেকে তার সাথে ইদানীং আমার তেমন একটা যোগাযোগও হয় নি। তবে ঈশ্বর একটা সম্্‌ভাবনা বই কি !

সে যোগ করে - সত্যি কথা বলতে কি, আমার ধারণা, ঐ পীর না কিসের কাছে সে গিয়েছিল সে লোকই রাকিবের মাথায় এইসব হাবিজাবি ঢুকিয়ে তার সর্বনাশ করেছে। শূন্য থেকে তো আর এগুলো তার মাথায় আসেনি। ঐ লোকই তার মস্তিষ্ড়্গটা ধুয়ে দিয়েছিল কোন এক ফাঁকে - তার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে।

গল্প শেষে মামুন ঠান্ডা চায়ের কাপ একপাশে সরিয়ে রাখল।

আমি হাসলাম - ছেলেটা চিরদিনই তাহলে পাগলাটে থেকে গেল।

মামুন হেসে কাঁধ ঝাঁকাল।

সে বিকেলে সেই লম্বা আড্ডা শেষে আমরা রেস্টুরেন্টটা থেকে বেরিয়ে এলাম একসময়, তারপর দুজন দুদিকে চলে গেলাম।

কিন্তু হঠাৎ করেই কেন যেন এক অদ্‌ভুত অনুভূতি পেয়ে বসল আমাকে - সন্ধ্যার আধো অন্ধকারে রাস্তায় এলোমেলো হাটতে থাকলাম, বাসায় ফিরে যেতে ইচ্ছে হল না। সম্পর্কগুলো কি আসলেই বিভ্রান্তি! সোমা আর রায়ানকে আমি কি ভুলে যাব একসময়? মৃত্যু কি ওদের থেকে আমাকে আলাদা করে ফেলবে চিরতরে?

কিছু কিছু মানসিক অসুখও সম্্‌ভবত ভাইরাসজনিত জ্বরের মতই ছোঁয়াচে, সেগুলো ছড়িয়ে পড়ে মানুষ থেকে মানুষে গল্প-গুজব আর আড্ডার ভেতর দিয়ে। আর কিছু কিছু লোক সম্্‌ভবত মানসিক অসুখের বীজ বহন করে, যদিও নিজেরা আক্রান্ত হয়না। এসবই আমার ধারণা, কিন্তু সেদিন রাত গভীর হবার আগেই ব্ল্যাকহোলের মত অতল, সর্বগ্রাসী, অন্ধকার, কড়া এক বিষন্নতা দ্রুত গ্রাস করে নিল আমাকে।

সোনার বাংলাদেশ

ফেরা by অয়ন খান

ছোট্ট মফস্বল শহরটা ধূলো ওড়া শীত দুপুরের রোদে নির্জন দাঁড়িয়ে আছে। দূরে বড় গাছটার ছায়ার ওপাশে লাল ইটের একটা পুরনো ভবন ছাড়া আর সবগুলো বাড়িই বৈচিত্র্যহীন। রাস্তাগুলো নিশ্চল ফটোগ্রাফের মত বোবা। দো’তলা একটা বাড়ির ছাদে কতগুলো কাপড় রোদে উড়ে উড়ে শুকাচ্ছে। একপাশ দিয়ে টুং টাং শব্দ করতে করতে একটা আইসক্রীমের ভ্যান চলে গেল।
আমি রাস্তার ওপাশের দোকানগুলোর দিকে একবার তাকালাম। মেরামতের অভাবে কিছু অংশ ধ্বসে যাওয়া ফুটপাত থেকে রাস্তায় নেমে আসতেই চোখে পড়ল একটা সেলুন - ‘মজনু হেয়ার ড্রেসার’। আমার মনে পড়ল, এরকম একটা নামের কথাই আমাকে বলা হয়েছিল। আমি এদিক-ওদিক তাকিয়ে রাস্তাটা পার হয়ে এলাম। দুপুরের আলস্যটা সেলুনের ভেতরেও বেশ জায়গা করে নিয়েছে। কয়েকজন নাপিত চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। আমি ঢুকতেই একজন নড়েচড়ে উঠল - চুল কাটাবেন? শেভ? এখানে ডাক্তার সাহেবের বাড়িটা কোথায়, বলতে পারেন? লোকটা আবার আরাম করে হেলান দিয়ে বসল - ডাইনের গলি ধরে সোজা চলে যান। তিন নাম্বার বাড়ি। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বেরিয়ে এলাম। রোদের মধ্যে এসে দাঁড়াতেই এক ঝাপটা ধূলোমেশানো বাতাস গায়ে পরশ বুলিয়ে দিল। আমি ডানের গলি খুঁজতে লাগলাম। বাড়িটা তিনতলা এবং পুরনো ধাঁচের। গাড়িবারান্দার উপর পুরনো টবে কতগুলো ছোট ছোট গাছ। বাউন্ডারীটা একেবারে নিচু, ইটগুলো শ্যাওলা ধরা। লালরঙা মরচেধরা গেটটার পরেই একটা ছোট্ট আঙিনা দেখা যাচ্ছে, বড়ই গাছের ছায়া আঙিনার ওপর কতগুলো ঘর কেটে রেখেছে। দো’তলা আর তিনতলায় একটা করে ছোট্ট ব্যালকনিও আছে। সবই বর্ণনার সাথে মিলে যাচ্ছে, কিন্তু বাড়ির নেমপ্লেটটা কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা। আমি তখন রাস্তায় দাঁড়িয়ে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। তিনতলার চারটা জানলা এখান থেকে দেখা যাচ্ছে, সবগুলোর পর্দা ফেলা। হলুদ, ময়লা এবং বিবর্ণ কাপড় সেগুলোর। গ্রীলগুলোতেও মরচে ধরেছে। দীর্ঘদিনের অযত্নের চিহ্ন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মলিদের বিল্ডিংটা। আমরা যখন পাঁচলাইশ থাকতাম, মলি প্রায়ই বিকেলবেলা আমাদের বাসায় আসত। হাতে সাদা চুরি পরত মেয়েটা। বহুবছর আগের কথা সেসব। মলি তখন ক্লাস নাইন কি টেনে পড়ে। তার মনটা ছিল খুব খোলামেলা। একটা চশমা পড়ত স্টিল ফ্রেমের, অদ্ভুত লাগত দেখতে। আমরা তিন ভাই ওর সাথে গল্প করতাম আর মাঝে মাঝে ক্যারম খেলতাম। কিন্তু সন্ধ্যার পর ওকে বাসায় পৌঁছে দেবার জন্য ও সবসময় আমাকেই নিয়ে যেত আর কথা বলার সময় মিটি মিটি হাসত। সন্ধ্যার রাস্তায় অনেকক্ষণ পাশাপাশি হাটার পর ওদের বারান্দার আলোটা দেখামাত্র ও খুব খুশী হয়ে উঠত। মলিদের চিটাগাঙের বাসাটা ছিল দো’তলা আর সাদা। ওরা বাড়িটার উপরের তলায় থাকত, সন্ধ্যার পর একটা ঝাঁড়বাতি জ্বালিয়ে রাখত বারান্দায়। ওর সবচেয়ে ছোটবোনটা বারান্দায় এসে দড়ি লাফাত, সে দেখতে ছিল হুবহু মলির মত। মলিরা তিন বোন ছিল। মিতালী আর রিমি তখন প্রাইমারীতে পড়ত। বাসায় কেউ গেলেই লুডু খেলার জন্য আটকে রাখতে চাইত ওরা। ঐসময়টা আমি কখনো কখনো ওদেরকে কলেজের কথা বলে তাক লাগিয়ে দিতে চাইতাম। অনেকসময় বানিয়ে বানিয়েও গল্প করতাম। মলি তখন দূরে বসে অল্প অল্প হাসত। অনেকদিন আগে কলেজ জীবনে আমরা সবাই নিজেদের বন্ধনহীন ভাবতেই ভালোবাসতাম। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময় খুব বলাবলি করতাম ‘সবধরণের পিছুটান থেকে মুক্ত হতে না পারলে জগতের মলিনতার ঊর্ধ্বে ওঠা যাবেনা’ জাতীয় উচ্চমার্গের কথাবার্তা, কিন্তু বৃষ্টির দিনগুলোতে জানলার পাশে একা বসে থেকে ভাবতে ভালোবাসতাম হারিয়ে যাওয়া দিনগুলোর কথা। মুখে অস্বীকার করলেও টিনের ওপর রাতের বৃষ্টির শব্দ শুনতে শুনতে প্রায়ই মলির কথা ভাবতাম আমি। ওরা চিটাগাঙ থেকে চলে যাবার পর কোন কোন দিন সন্ধ্যার সময় ওদের সেই সাদা বাসাটার বারান্দার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা অনুভূতি আচ্ছন্ন করে ফেলত মনটাকে। অবশ্য এসবই বহুদিন আগের কথা। কি একটা ভেতর থেকে খুব বাধা দিল বলে সেদিন সে বিকেলে বাড়িটা একবার দেখে নিয়েই চলে এলাম। পরদিন বিকেলে ঘড়ি ধরে ঠিক চারটার সময় নড়বড়ে একটা পুরনো রিক্সায় চড়ে আমি মলিদের বাসার দিকে রওনা হলাম। গলির ভেতর দেয়ালগুলোর ছায়া লম্বাটে দেখাচ্ছিল। লোকও ছিল খুব কম। আমি তিন নাম্বার বাড়ির লোহার গেটটার সামনে রিক্সা থামিয়ে নেমে পড়লাম। ওরা চিটাগাঙ থেকে চলে যাবার পর থেকে সবসময়ই কিন্তু আমি রিমিদের সাথে যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছি। ঈদে, জন্মদিনে নিয়মিত ভিউকার্ড পাঠাতাম, প্রথমদিকে অনেকগুলো চিঠিও লিখেছিলাম। তারপর একদিন হঠাৎ দেখি, লেখার কোন বিষয় খুঁজে পাচ্ছিনা। তারপর থেকে আমি ওদেরকে ছাপানো কার্ডই পাঠাতাম। সিড়িঘরটা বেশ অন্ধকার, বাইরের রোদে সাতার কেটে আসা একজোড়া চোখের সাপেক্ষে অন্ততঃ। আপেক্ষিক অন্ধকারটায় অভ্যস্ত হবার চেষ্টা করতে করতেই একসময় দেখি সিড়ি ডিংগিয়ে পৌঁছে গেছি তিনতলায়। চিটাগাঙে ওরা যে বাড়িটায় থাকত, সেটা এর চেয়ে অনেক সুন্দর ছিল। বাড়িটায় এক ঘূর্ণিঝড়ের রাত্রে আমি আর রবিন মেঝেতে শুধু একটা চাদর বিছিয়ে ছিলাম। মলিদের ঐ বাসাটায় এখন নতুন লোক এসেছে, কিন্তু আমি যখন মাঝে মাঝে অন্ধকারে একা হাটি - কেন যেন ঐ বাড়িটার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। কলিং বেল নেই, কড়া নাড়লাম। অনেকক্ষণ কোন সাড়া নেই। আবার কড়া নাড়লাম। সামান্য ধুপধাপ পায়ের শব্দ হয়ে দরোজা খুলে গেল। যে মেয়েটার মুখ দেখা গেল, আঠার-ঊনিশের মত বয়স, তাকে আমি প্রথমে চিনতে পারলাম না। এটা মিতালীদের বাসা না? সে উত্তর দিল না। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ করেই বলে উঠল - রাকিব ভাইয়া! সে আমাকে চিনতে পেরেছিল, কিন্তু সম্ভবতঃ বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছিল না। কয়েক মুহূর্তের বিহ্বলতার পর অবশ্য দ্রুতই নিজেকে সামলে নিল সে - কতোদিন পর! ভেতরে আসেন। দরজাটা খুলে দিল সে। সবাই ঘুমে? - আমিও ততক্ষণে মিতালীকে চিনতে পেরেছি। না, রিমি কলেজে। আপনি বসেন। আমি আম্মাকে বলে আসি। সে ভেতরে চলে গেল। আমি ড্রইংরুমটা দেখতে লাগলাম। সোফাটা, শোকেসটা সেই আগের মতই আছে। রাশান ধরণের পুতুলটাও সেই আগের দিনগুলির মত শোকেজের পুরো একটা পাশ দখল করে বসে আছে। মলি কিন্তু প্রথমেই আমাকে চিনতে পারল। সে যে কখন এসে দরজায় দাঁড়িয়েছে খেয়াল করিনি। একসময় সে ভেতরে এসে বসল। হেসে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছি। ওর পরনে ছিল একটা সবুজ পাঞ্জাবী। আমার মনে পড়ল, আগে সবুজ রঙটা একদম পছন্দ করতো না ও। ঐসময় সাদা রঙটাই পছন্দ ছিল ওর। বাসার বাইরে যেতে সবসময় সাদা রঙের চুড়ি পরত সে। হঠাৎ এদিকে? - সে জিজ্ঞেস করল। আমি বললাম। অডিটের কাজে শহরে শহরে ঘুরতে হয় শুনে ও খুব খুশী হয়ে উঠল, বলল এ ধরণের জীবনই ওর পছন্দ। সে নিজে অবশ্য একটা গোছানো জীবনই বেছে নিয়েছিল। অনেক লেখাপড়া করে স্বাবলম্বী হবার চেষ্টা না করে খুব কম বয়সেই বিয়ে করে ফেলেছিল। ওর পরিবেশ হয়তো মলিকে বাইরের জগতে এসে মুক্ত বাতাসে দাঁড়ানোর সাহস দেয়নি, কিন্তু এখন সে যেরকম আছে সেটাও মন্দ না। শাওনও বেশ ভালো আছে। শাওন এখন হামাগুড়ি দিতে পারে। - সে বলল। শাওন তার মেয়ের নাম। অনেক আগে আমাদের তিন ভাইয়ের কাছে মলিকে যখন ধরাছোঁয়ার বাইরের একটা সুন্দর স্বপ্ন বলেই শুধু মনে হতো, তখন আমরা নিশ্চিত ছিলাম যে - মলি জীবনে যেখানেই যাক, আশেপাশের সবার মধ্যে একটা প্রধান আকর্ষণ হয়েই থাকবে। ঐসময়টা মলি চুলে বেনী করত খুব সুন্দর করে, হাসিতেও কেমন করে যেন একটা মোহময়তা ছড়িয়ে রাখত সবসময়। ওর চাহনীতে একটা রহস্য ছিল, যেটাকে অনতিক্রম্য বলেই মনে হত আমাদের কাছে। এখন কৌতূহল নিয়ে আবার যখন ওর চোখের দিকে তাকালাম আর জিজ্ঞেস করলাম সে ঘুমাচ্ছিল কিনা, সে বলল যে দুপুরে একটু না ঘুমালে তার প্রচন্ড মাথাব্যথা হয়। ওর মুটিয়ে যাবার এটাও একটা কারণ। আমি একসময় লক্ষ্য করলাম, কথা বলার সময় ওর পিঠে বেনী দু’টো দুলে উঠলনা। অনেকদিন আগে বাসের বিরক্তিকর একটা ভ্রমণের সময় ‘রেড’ নামে সমারসেট মমের একটা গল্প পড়েছিলাম। সেই যে স্যালির উদাসীনতা আর সময়ের আগ্রাসন নীলসনের ভালোবাসাকে একসময় একটা বোধহীন বিপর্যয় করে তুলেছিল। শেষে সে বলেছিল (পুরোটা আমার মনে নেই), ‘ভালোবাসার সত্যিকার বিয়োগান্ত পরিণতি মৃত্যু বা বিচ্ছেদ নয়। ••• ••• যে নারীকে আপনি একদিন সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবেসেছেন, যাকে চোখের আড়াল করা আপনার কাছে অসহনীয় বলে মনে হত, তাকে আর কোনদিন না দেখলেও আপনার কিছু এসে যাবে না - এই উপলধ্বিটা কতটা ভয়ংকর, চিন্তা করা যায়! আসলে ভালোবাসার সত্যিকার বিয়োগান্ত পরিণতি হল উদাসীনতা।’ নীলসনের কথা ভেবেই কিনা জানি না, আমি খুব সাবধানে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললাম। ঘর থেকে হঠাৎ বাচ্চার কান্নার শব্দ ভেসে আসতেই আমাকে বলে মলি উঠে ভেতরে চলে গেল। তার কিছুক্ষণ পরই মিতা চা বানিয়ে নিয়ে এল, সাথে চানাচুর আর মিষ্টি। সে বলল, ওদের এলাকাটার এই মিষ্টিটা খুব ভালো। আমরা যারা সেই পুরাতন শহরটায় একসাথে বড় হয়েছি বহুদিন আগে, তাদের অনেকের সাথেই এখন আর আমার যোগাযোগ নেই -এমনকি মামুনের সাথেও না। ছোটকাল থেকেই খুব ভালো বন্ধু ছিল ও আমার। কিন্তু যেদিন এয়ারপোর্টে ওকে তুলে দিতে গেলাম, সেদিন কেন যেন আমার মনে হচ্ছিল - কিছু্ই আর আগের মত থাকবে না। হয়তো অনেক বছর পর রাস্তায় ওকে দেখে চিনতে পারব না। সে রাতে আমার মনে হয়েছিল, জীবনটা একটা চলমান দুঃস্বপ্ন ছাড়া আর কিছু না। জ্বালাতন - মলি ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল। আপনি এখন বুঝতে পারছেন না, আপনি কত ভালো আছেন। সে সামনে এসে বসল। আমি হাসলাম। সেদিন ওদের দু’জনের সামনে বসে থেমে থেমে চলতে থাকা প্রসংগগুলোর মাঝে আমি লক্ষ্য করলাম - প্রায়ই আমি কথা বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছি না। একবার মিতালী আরেকবার মলির মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কাছে এদের সাথে দেখা করতে আসা সহ পুরো ব্যাপারটাকেই কেন যেন খুব অর্থহীন মনে হতে লাগল। যা কাল থাকবে না, তার জন্য আমার অতি উচ্ছ্বাস আর বড় বড় কল্পনার কথা মনে হতেই নিজের ওপর সীমাহীন একটা বিরক্তিতে মনটা ছেয়ে গেল। অদ্ভুত একটা অবসন্নতা নিয়ে আমি বসে রইলাম ওদের দু’জনের সামনে। সেদিন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন গলিটা থেকে বেরিয়ে আসতে যাচ্ছি, পেছন ফিরে হঠাৎ ব্যালকনিটায় মিতালীকে চোখে পড়ল - বাতাসে ওর চুলগুলো উড়ছিল। বিকেলের শেষ রোদের ঝাপটায় আকাশটা ঝকমক করছিল, বারান্দায় ওরা দাঁড়িয়ে ছিল - দু’জন একসাথে, দু’জন একা। বিবর্ণ ব্যালকনিটায় ওদেরকে দেখে আমার অনেক আগের কথা মনে পড়ছিল, যখন ঈদের পরের দিনগুলি আমরা ছোটরা মন খারাপ করে কাটাতাম ‘ঈদটা চলে গেল’ ভেবে। আমরা অসহায়ের মত আনন্দের সময়গুলির চলে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছি, আবার একসময় এসে দাঁড়িয়েছি একটা পুরাতন শহরের রোদ কমে আসা গলিতে। একবার উপরে তাকিয়ে দেখলাম, আকাশের একটা বড় অংশ ইতিমধ্যে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। কোথা থেকে যেন ঠান্ডা একটা বাতাস আসছিল। দূরে কোথাও মাইকে সিনেমার গান বাজাচ্ছে। বিলীয়মান রৌদ্রের বিকেলে চটুল হিন্দী গানগুলোকে একসময় খুব বিষন্ন শোনাতে লাগল। আমি পুরনো গলিটা থেকে বেরিয়ে এলাম, একসময় আবার নেমে এলাম সেই ধূলো ওড়া শহুরে রাস্তায়। ফিরছিলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। সন্ধ্যার আগেই টিকেটটা করে ফেলার ইচ্ছে ছিল। রাস্তায় তখন কলেজ ফেরতা ছেলেমেয়েদের ভীড়। কলেজটা কাছে কোথাও, বিকেলে সম্ভবতঃ ব্যবহারিক ক্লাস হয়। আমি অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে হাটছি আর ভাবছি বিচিত্র সব কথা। যা থাকবে না, তা কেন আসে? যা আমাদের করতে ভালো লাগে, তা বেশিরভাগ সময়ই কেন ভুল কাজ? ঠিক কতদিন অপেক্ষার পর মানুষ তার অনুভূতির অপ্রয়োজনীয় এবং যন্ত্রণাদায়ক অংশগুলি থেকে মুক্তি পাবে? একরোখা নির্বোধ কতগুলি প্রশ্ন আমি বহন করি আর ফুটপাতের উপর হাটতে থাকি, কিন্তু হঠাৎই আবার থমকে দাঁড়াই। আমি একটা মেয়েকে দেখতে পাই - সে কলেজ থেকে ফিরছে। আমি বুঝতে পারিনা এটা আমার কল্পনাপ্রবণতাজনিত কোন বাস্তববিবর্জিত প্রকল্প কিনা, কিন্তু মেয়েটাকে আমার অনেকদিনের চেনা বলেই মনে হতে থাকে। এমনকি একসময় আমাকে একটা অযৌক্তিক প্রত্যয়ও পেয়ে বসে যে, এটা সত্যিই মলির ছোটবোন রিমি। আমি ভালো করে তাকাই, কিন্তু বিস্ময়টা কাটতে চায় না। বরং একসময় আমার মনে হতে থাকে, আমি আমার সুদূর কৈশোরের কোন এক মলিকে দেখছি, যে কখনো কখনো স্ট্রীটলাইটের আলোতে আমার পাশাপাশি হাটত। মেয়েটা আমার পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিল। যখন দেখলাম মেয়েটার চুলগুলো বেনী হয়ে সামনে এসে মাথার দু’পাশে দুলছে, তখন আমি যেন ওর বড় বড় চোখ দু’টোয় সামান্য রহস্যময়তাও দেখতে পেলাম। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, অনেকক্ষণ। দেখছিলাম, অনেকগুলো মানুষের ভেতর মেয়েটা ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। আমার বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিল না - মলিকে নয়, আমার জীবনের কিছু টুকরো স্মৃতিকে আমি এতোদিন মাথার ভেতর সযত্নে রক্ষা করে এসেছি। ফলে এতোদিন পরও একটা পুরাতন শহরের দালানে আর রাস্তায় আমি সেই মুখ আবিষ্কারের একটা নির্বোধ প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছি। আমার পুরো বিশ্লেষণটাই সম্ভবতঃ ভুল ছিল, কারণ সেদিন সেই সন্ধ্যার অন্য এক আলোয় দাঁড়িয়ে আমি লক্ষ্য করলাম - আমার অনেকদিনের পরিচিত সেই মুখটা অজস্র নতুন মুখের ভীড়ে একসময় খুব সহজেই হারিয়ে গেল।

সোনার বাংলাদেশ

পুনরুত্থান by অয়ন খান

যতদূর চোখ যায় - মানুষ আর সাদা চাদর, সাদা চাদর আর মানুষ। উত্তর দিকে, দক্ষিণ দিকে, পূর্ব ও পশ্চিম দিকে দিগন্ত পর্যন্ত খোলা প্রায়ান্ধকার মাঠে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি মানুষ শুয়ে আছে - সার বেঁধে শুয়ে আছে। এগুলো কি লাশ! না, কারণ মাঝে মধ্যেই নড়ে উঠছে এরা, কারো কারো মুখে হঠাৎ করে ঝিলিক দিয়ে যাচ্ছে হাসি - ঘুমের মধ্যেই।
এসবের মধ্যেই আস্তে আস্তে আড়মোড়া ভেংগে জেগে উঠল রাফিজ ইমতিয়াজ। অবাক হয়ে তাকালো সে চারদিকে। অসংখ্য নগ্ন মানুষের ঘুমন্ত সারির মধ্যে সে একাই জেগে উঠেছে। সে নিজেও নগ্ন, শরীরটাকে অনুভব করতে পারছেনা যদিও।

শরীরের অসাড় ভাবটা যখন কেবল দূর হয়ে এসেছে, তখন সে অনুভব করল - কেউ একজন তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। চমকে ফিরে তাকাল সে - যদিও একরাশ ধোঁয়ার মধ্যে অস্পষ্ট একটা অবয়ব ছাড়া কিছুই সে ওখানে দেখতে পেলনা। অবশ্য এ অবয়বটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট আর উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। রাফিজ সেটার দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।

এটা কোন অদ্ভুত হাসপাতাল নয়তো! যদ্দূর ওর মনে পড়ে, সে মোটর সাইকেল করে আসছিল আর অন্যদিক থেকে একটা বাস অন্য একটা বাসকে ওভারটেক করার চেষ্টা করছিল। কিন্তু এতো লোক কি একটা বাসে থাকে! আর একদিনে কি এতোগুলো দুর্ঘটনা ঘটা সম্ভব একটা এলাকায়!

আপনার যাবার সময় হয়েছে। - পাশ থেকে কেউ বলে উঠল। অবয়বটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এতোক্ষণে। রাফিজ লক্ষ্য করল, আপাদমস্তক সাদা পোশাকে মোড়া ওটা।

আপনি কি চিকিৎসক? - রাফিজ জানতে চাইল।

অবয়বটা কোন উত্তর দিল না। শুধু ওকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করল - নিঃশব্দে।

আমি কি জীবিত? - হঠাৎ জেগে ওঠা সন্দেহ নিয়ে রাফিজ জিজ্ঞেস করে অবয়বটিকে।

জীবিতরা ঘুমন্ত, একমাত্র মৃত্যুই জাগাতে পারে মানুষকে। - এই প্রথম অবয়বের গম্ভীর কন্ঠস্বরটি শুনতে পেল রাফিজ।

ঘুমন্তরা কি জীবিত? - সে উল্টো প্রশ্ন করে।

অবয়বকে নিরুত্তর দেখে সে একসাথে আরো কয়েকটি প্রশ্ন করে - আমি কি ঘুমন্ত ছিলাম? এখন কি আমি জেগে উঠেছি? আর আপনিই বা কে?

তখন অবয়বটির মুখ দেখতে পেল রাফিজ। খুব সুশ্রী মুখমন্ডল ওটার - মেয়েদের মত কোমল, শিশুদের মত পবিত্র, এবং একজন পুরুষের মতই প্রখর।

আমি আপনার জন্য নিযুক্ত একজন ফেরেশতা, আর আপনি এইমাত্র ঘুম থেকে জেগে উঠেছেন - মৃত্যুর মাধ্যমে।

রাফিজ তখন বুঝতে পারল, সে একটা স্বপ্ন দেখছে। তাহলে কি কোন অ্যািডেন্ট করে এখন কোমায় চলে গেছে সে! নাকি অ্যািডেন্টের চিন্তাও স্বপ্নের মধ্যেই ঘটেছে!

এরা সবাই তাহলে জীবিত, আর শুধু আমিই মৃত? - রাফিজ তীর্যকভাবে প্রশ্ন করল।

সবসময়ই কেউ না কেউ জেগে উঠছে, আমরা তাকে কেয়ামতের মাঠে নিয়ে যাই - মৃতকে ঐ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়াই আমার মত সৃষ্টির কাজ।

জীবিতরা এখানে কি করে? তাদের তো পৃথিবীতে ঘুরে-ফিরে বেড়ানোর কথা।

তারা পৃথিবীতেই ঘুরে-ফিরে বেড়াচ্ছে।

কিভাবে?

স্বপ্নে - তাদের সম্মিলিত স্বপ্নে।

এরা সবাই স্বপ্ন দেখছে? - রাফিজ অবাক হয়।

জগৎটা তো একটা স্বপ্ন, যেখানে এরা একজন আরেকজনের সাথে দেখা করে। - ফেরেশতাবেশী উত্তর দেয়।

রাফিজ উত্তর শুনে চুপ হয়ে যায়।

ওরা দু’জন হাটতে হাটতে একসময় লাখো কোটি ঘুমন্ত মানুষকে পার হয়ে আসে। দুই বিশাল পাহাড়ের মধ্য দিয়ে চলে গেছে এক সরু পায়ে হাটা পথ। তার ওপাশে যেতেই চোখে পড়ে বিশাল আরেকটি মাঠ। এ মাঠেরও কোন শেষ দেখা যায় না, আর সারা মাঠ জুড়ে গো-ধূলির বিষন্ন একটা আলো। সেই মাঠের মাঝামাঝি ওরা গিয়ে দাঁড়াল - রাফিজ, আর তার ডানপাশে ফেরেশতা। তারপর তারা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, অনেকক্ষণ - যেন হাজার বছর। শেষে রাফিজ অধৈর্য হয়ে প্রশ্ন করল - এখন আমরা কি করব?

সৃষ্টি করুন। - বলল ফেরেশতা।

রাফিজ কিছুই বুঝতে পারল না।

কি সৃষ্টি করব? - প্রশ্ন করে সে।

জগৎ।

আমি জগৎ সৃষ্টি করব কিভাবে? আমি তো স্রষ্টা নই।

আপনি যা চান, এখানে তাই হবে - আপনি যা ভাববেন, তাই এখানে সত্য।

কিভাবে এটা সম্ভব?

ফেরেশতা হাসল - এটা পৃথিবীর মত অন্যের তৈরী করা কোন স্বপ্ন নয়, ঐ স্বপ্ন শেষ হয়ে গেছে। এটা প্রকৃত বাস্তবতা। এখানে আপনার স্বপ্ন আপনি নিজেই তৈরী করে নেবেন, এবং সেই স্বপ্নের জগতে বাস করতে থাকবেন - অনন্তকাল।

মৃত্যু আপনাকে পৃথিবী থেকে মুক্ত করে দিয়েছে, স্বপ্নের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন আপনি - এখন শুধু সৃষ্টি আর সৃষ্টি।

রাফিজ হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল। অনেকক্ষণ এভাবে, তারপর সে একটু মাথা খাটাতে শুরু করল। জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে হয়তো এ রহস্যের কোন কিনারা করা যাবে।

যদি আমি স্বর্গ তৈরী করতে চাই, তাহলে আমাকে কি করতে হবে?

যারা বিশ্বাস করে তারাই কেবল স্বর্গ তৈরি করতে পারে। - ফেরেশতা বলে।

পৃথিবীকে যারা সুন্দরভাবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিল, এইখানে তাদের স্বপ্ন তারা বাস্তবায়িত করার সুযোগ পাবে।

আর যারা পৃথিবীতে কুৎসিৎ চিন্তা করেছে আর মানুষের ক্ষতি করেছে?

তারা চাইলেও স্বর্গ তৈরী করতে পারবে না। - বলে ফেরেশতাবেশী।

তারা পার্থিব জীবন কাটিয়েছে বিকৃতির ধ্যানে - এখানেও তারা যন্ত্রণাময় কুৎসিৎ একটা জগৎ ছাড়া আর কিছুই তৈরি করতে পারবে না। কারণ সুন্দর ভাবে চিন্তা করতে এমনকি স্বপ্ন দেখতেও তারা অভ্যস্ত নয়। এবং তাদের তৈরী করা যন্ত্রণাময় জগতে তারা থাকবে - চিরকাল।

আমি তো এদের কারো দলেই পড়ি না।

কিভাবে? - ফেরেশতা অবাক হয়, সম্ভবতঃ তার অপার্থিব জীবনে এই প্রথম।

আমি ছিলাম অবিশ্বাসী, স্বর্গ-নরকে বিশ্বাস ছিল না আমার, বিশ্বাস ছিল শুধু নিজের জ্ঞান ও বুদ্ধিতে। আমার বুদ্ধিতে যা আসে নি, তা বিশ্বাস করতে আমি প্রস্তুত ছিলাম না কোনদিন।

অর্থাৎ আপনি কোন স্বপ্নই দেখেন নি - না সুন্দর, না কুৎসিৎ!

পৃথিবীতে আমি বাস্তববাদী ছিলাম।

কিন্তু এটাই তো বাস্তব, আর পৃথিবীটাই তো স্বপ্ন।

তখন তো সেটা জানতাম না।

তাহলে তো আপনি কোন জগৎই তৈরি করতে পারবেন না। - ফেরেশতা তার আশংকা প্রকাশ করল।

কারণ কোন জগতের স্বপ্ন আপনি দেখেনই নি কোনদিন।

রাফিজ চুপ হয়ে গিয়ে আবার চিন্তা করতে লাগল। এভাবে কেটে গেল আরো এক হাজার বছর। রাফিজ লক্ষ্য করল, ওর আশে-পাশে কেউ নেই। ওকে এখানে পৌঁছে দেয়া পর্যন্তই ছিল ফেরেশতার দায়িত্ব। এখন সে নিজেই তার নিজের একমাত্র সহায়।

রাফিজ আবার খুব মন দিয়ে চেষ্টা করতে লাগল একটি জগৎ তৈরী করতে। কিন্তু সে যতবারই চেষ্টা করতে যায় - তার মনে হয়, এটা একটা স্বপ্ন ছাড়া আর কিছু হতেই পারে না - যা একটু পরই শেষ হয়ে যাবে। সে যতবারই চেষ্টা করে - তার মনে হয়, মৃত্যুর পর মানুষের অস্তিত্বই সম্ভব নয়।

সুতরাং প্রতিবারই সে ব্যর্থ হল একটি স্বপ্ন তৈরী করতে - যেন ব্যর্থ হতে থাকবে অনন্তকাল। আর ওর মনে হল, এভাবে হাজার হাজার বছর ধরে তার চারপাশে বিরাজ করতে থাকবে অদ্ভুত এই শূণ্যতা - সীমাহীন।


ডিউটি ডাক্তার ভিসিটিং প্রফেসরকে জিজ্ঞেস করল - কোমায় আর কতক্ষণ থাকবে বলে মনে হয়, স্যার?

প্রফেসর মলিন হাসলেন - এ অবস্থায় কি কোন মন্তব্য করা সম্ভব?

ডিউটি ডাক্তার এক্সীডেন্টে অজ্ঞান হয়ে থাকা রোগীটির রুটিন চার্ট পূরণ করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

কিন্তু সে জানে, এধরণের কেসগুলোতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শেষ ফলাফল মস্তিষ্কের মৃত্যুই হয়ে থাকে - আর সেক্ষেত্রে কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং একেবারেই ফলাফলশূণ্য একটি প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই হবে না।

লেখকঃ তরুন কথাশিল্পী, গবেষক, প্রকৌশলী

ছায়া by অয়ন খান


ছোট একটা পরিবার আর অ্যাকাউন্টেন্টের একটা চাকরী নিয়ে হামিদের দিনকাল ভালোই কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু প্রত্যেকের জীবনেই কখনো না কখনো কঠিন সময় আসে, হামিদের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হল না। অবশ্য এটা যে তার একেবারে নতুন সমস্যা তাও না, ছেলেবেলা থেকেই সে কিছুটা বদমেজাজী বলে পরিচিত ছিল। ইদানীং তার সেই খারাপ চেহারাটা একটু বেশি নিয়মিত দেখা যাচ্ছিল, এই যা।
কিন্তু সে যেদিন মেরে নিজের ছেলেটার মাথা ফাটিয়ে ফেলল, সেদিন থেকে সবাই বিষয়টাকে একটু আলাদাভাবেই দেখতে শুরু করল। রায়ানের ওপর সেদিন রাগের কারণটা কিন্তু ছিল সামান্য - ছেলেটা তার হিসাবের খাতায় আঁকাআঁকি করে খাতার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। সেটায় রেগে গিয়ে হামিদ বাচ্চাটাকে থাপ্পড় দেয় - কিন্তু সে থাপ্পড় এত জোরে ছিল যে রায়ানের মাথা গিয়ে দেয়ালে বাড়ি লাগে।

ছেলের রক্ত দেখে সাথে সাথে হামিদের সম্বিৎ ফিরে আসে, রাগ পানি হয়ে যায়। ভয়াবহ একটা আফসোস তখন থেকে তার বুকের ভেতরটাকে জাপটে ধরে থাকে। সে নিজেই বুঝে পায় না, কেন সে এরকম করল। তখন অবশ্য সবাই তাকে মনে করিয়ে দিল যে, সে আজকাল প্রায়ই এরকম ভুল করছে। সেসব শুনে হামিদের হতাশা আরো বেড়ে যায়।

হামিদের মামা মৌলানা ধরণের মানুষ, অনেক বুঝিয়ে-শুনিয়ে তাকে এক কবিরাজের কাছে নিয়ে গেলেন। কবিরাজ ভদ্রলোক একজন বৃদ্ধ মানুষ, বয়স প্রায় আশি - কথা বলার সময় বেশ কাশেন। হামিদের মামা জানালেন উনি খুবই আল্লাহওয়ালা লোক এবং মানুষের বিভিন্ন সমস্যার ব্যাপারে উনি সঠিক মারফতি সমাধান দিতে সক্ষম।

কবিরাজ কিছুক্ষণ দোয়া-দরূদ আর ঝাড়ফুঁক করে তাকে জিজ্ঞেস করলেন সে কোন ভৌতিক স্বপ্ন দেখে কিনা। ভয়ের স্বপ্ন কে না দেখে! হামিদ বলল যে - হ্যাঁ, সে মাঝেমধ্যে এরকম দু:স্বপ্ন দেখে। তিনি একজন খাদেমের কানে কি যেন বললেন। খাদেম জানাল - উনি বলেছেন হামিদের ওপর জীনের আসর আছে। কবে এবং কোথা থেকে সে জীন তার কাছে এলো সেটাও নাকি কবিরাজ বলে দিয়েছেন - বাইশ বছর সাত মাস সতর দিন আগে খানকান্দি নামে এক গ্রামে এই জীনটা নাকি তাকে নজর দিয়েছিল।

হামিদ অবাক হল - এতো বিস্তারিত বর্ণনা কবিরাজ দিতে পারবেন বলে তার ধারণা ছিল না। ফেরার পথে মামা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, খানকান্দি নামে কোন জায়গায় সে কখনো গিয়েছিল কিনা। হামিদ প্রথমে উত্তর না দেয়াতে মামা তাকে আবারো একই প্রশ্ন করেন। তখন হামিদ বলে যে - হ্যাঁ, ক্লাশ এইটে পড়ার সময় স্কুলের এক বধুর সাথে সে ওই নামে একটা গ্রামে গিয়েছিল, বিয়ে খেতে।

সেটা কি বাইশ বছর আগে? - মামা জানতে চান।

এরকমই হবে - হামিদ অন্যমনস্কভাবে বলে। কিন্তু সে মনে মনে এরমধ্যেই হিসাব করে ফেলেছে - ঠিক বাইশ বছর সাত মাস আগেই সে ওই জায়গাটায় গিয়েছিল।

মামা গম্ভীর হয়ে শুনলেন, হামিদ অবশ্য কিছুতেই স্বীকার করলনা যে এটা জীনের আসর হতে পারে। সে আধুনিক মানুষ, জীন-ভূতে বিশ্বাস করার প্রশ্নই ওঠে না - কবিরাজ সাহেবকে নিয়ে সে এককু হাসাহাসিও করল। মামা আরো গম্ভীর হয়ে গেলেন।

হামিদ অবশ্য তার সমস্যাটির ব্যাপারে নিশ্চেষ্ট বসে থাকল না। সে শহরের একজন নামকরা মনোচিকিৎসকের শরণাপন্ন হল। ডক্টর দেবেশ চন্দ্র রয় তাকে সমস্যাটির আগাগোড়া চমৎকারভাবে বুঝিয়ে বললেন।

মানুষের মনের ভেতর দুটি স্তর আছে - বাইরের মন যেটাকে বলা হয় সচেতন মন, আর ভেতরের মন যেটাকে বলা হয় অবচেতন মন। আমরা জেনে-বুঝে যা যা করি, সেসমস্ত কাজের দায়িত্ব সচেতন মনের - যেমন ভদ্রতা করা, হিসাব-নিকাশ, ইত্যাদি। সুতরাং সচেতন মনকে বলা যায় সভ্য মানুষের মন। অন্যদিকে আমরা নিজের অজান্তেই যেসব কাজ করে ফেলি, সেসব কাজের জন্য আমাদের অবচেতন মনকে দায়ী করা যায় - যেমন স্বপ্ন, ভালোবাসা, রাগ, ঘৃণা, ইত্যাদি। অবচেতন মন কোন যুক্তি বোঝে না, এটা শুধু বোঝে নিজের প্রয়োজন। সে অর্থে অবচেতন মনকে মানুষের পাশবিক স্বত্ত্বাও বলা যায়। আপনার ক্ষেত্রে সমস্যাটি যেহেতু রাগ, এটা অবচেতন মনের এলাকায় পড়ে - আর এজন্য আমাদের কাজ করতে হবে আপনার অবচেতন মনকে নিয়েই।

হামিদ কথাগুলো মন দিয়ে শুনল। এখন পর্যন্ত ভদ্রলোকের কথাগুলো তার কাছে সহজবোধ্যই মনে হয়েছে।

আপনার অবচেতন মন নিয়ে কাজ করার জন্য আমরা যে পদ্ধতিটা অনুসরণ করব, সেটা হচ্ছে সম্মোহন - হিপনোসিস। আমরা আপনার সচেতন মনের দরজা-জানালাগুলো কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ করে দেব যাতে করে আপনি অবচেতন মনের ভেতর ঢোকার পথটা খুঁজে পান।

মনের দরজা-জানলা মানে কি?

আপনার মনকে একটা ঘরের সাথে তুলনা করেছি আমি। কাজের জন্য এটা বেশ সুবিধাজনক - এক্ষেত্রে আপনার সচেতন মনটাকে বলা যায় বাইরের ঘর, আর অবচেতন মনটা মাটির নিচের লুকানো একটা ঘর। লুকানো ঘরটা কিন্তু বাইরের ঘরের চেয়ে অনেক বড়, আর এর কর্মকান্ডও বেশ জটিল।

তাহলে আমি কিভাবে ... - হামিদ বলতে গেল।

ভদ্রলোক হামিদকে মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন - সেটার জন্য তো আমরা আছিই, তাই না? তো যেটা বলছিলাম, আপনার সচেতন মনের সব দরজা-জানলা আমরা বন্ধ করে দেব প্রথমেই। সচেতন মনের দরজা-জানলা কোনগুলো? দরজা-জানলা মানে হচ্ছে ইন্দ্রিয়গুলো - মানুষের পঞ্চইন্দ্রিয়। তবে প্রধাণত চোখ আর কানের মাধ্যমেই আমাদের মন বাইরের জগতের তথ্যগুলো পেয়ে থাকে। আমরা মোটামুটি শব্দহীন একটা রুমে একদম অল্প আলোয় আপনার সাথে কিছু সেশন করব। আপনার মন বাইরের হট্টগোল থেকে থাকবে একদম মুক্ত। তখন আপনি নিজের ভেতরের দিকে তাকানোর সুযোগ পাবেন।

আপনাকে পর পর কয়েকটা সেশন আমাদের সাথে কাজ করতে হবে। আপনি সামনের ডেস্কে কথা বলুন, ওরা আপনাকে সুবিধামত অ্যাপয়েন্টমেন্ট শিডিউল করে দেবে।

হামিদ অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করে চেম্বার থেকে বের হয়ে এল - ভদ্রলোকের সাথে কথা বলে তার ভালো লেগেছে, সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে এখানে সে সেশনগুলো করবে।

এরমধ্যে একদিন মামা এলেন হামিদের বাসায়। সেই বৃদ্ধ কবিরাজ নাকি তার কথা জানতে চেয়েছে মামার কাছে। হামিদ বলল, সে ডাক্তার দেখাচ্ছে।

ডাক্তার দেখাও, বাবা। কিন্তু পাশাপাশি এই চিকিৎসাটাও কর, এতে ক্ষতির কিছু নেই।

হামিদ হাসল।

জানি, তুমি এগুলি মানতে চাও না। কিন্তু এগুলি আছে, আর উনি সেটা জানতে পেরেছেন। শোনো, তোমার ওপর যে নজরটা পড়েছে সেটা খুব খারাপ ধরণের। খারাপ না হলে উনি আলাদা করে তোমার কথা আমাকে জিজ্ঞেস করতেন না - কত লোক আসে উনার কাছে। তুমি এটা অবহেলা কোরো না।

হামিদ মাথা নাড়ল।

আমি এই দোয়াটা এনেছি। তুমি এটা সবসময় তোমার কাছে রাখবে। এটা কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, বুঝলে বাবা?

হামিদ কাগজটা নিল, তারপর মানিব্যাগে সেটা ভরে রাখল। মামা চলে গেলেন।

হামিদ আগে থেকে ঠিক করা শিডিউল অনুযায়ী রয় সাহেবের চেম্বারে গেল। ভদ্রলোক হাসিমুখে তাকে অভ্যর্থনা জানালেন, তার বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলেন। শেষে জিজ্ঞেস করলেন সে প্রস্তুত কিনা। হামিদের সম্মতি জানার পর উনি তাকে ভেতরের একটা ঘরে নিয়ে গেলেন।

ভেতরের এই ঘরটা একটু অন্যরকম, ঠিক ডাক্তারের চেম্বারের মত সেটিং নয় এখানে। পাশে নীলচে শেডের একটা ল্যাম্প জ্বলছে, সারা ঘরের আলোর একমাত্র উৎস এটাই - ফলে ঘরে আলো খুব অল্প। ঘরটায় শব্দ খুবই কম - সম্ভবত ভেতরের দিকের ঘর এটা, অথবা দরজা-জানালা বন্ধ রেখে শব্দ কম রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ঘরের মাঝখানে একটা ইজিচেয়ার। পাশে একটা সিঙ্গেল সোফা। রয় সাহেব ইঙ্গিত করতেই সে ইজিচেয়ারে গিয়ে বসল। রয় বসলেন পাশের সোফাটায়।

যেভাবে আরাম পান সেভাবে হেলান দিয়ে বসুন। হ্যাঁ, কমফোর্ট ফিল করলেই হবে। নিজের মনের ওপর চাপ দেবেন না, হালকা ভাবে নিন সময়টা। ভুলে যান না পৃথিবীর কথা - যা হবার তা তো হবেই, আমরা তার কতটুকুই বা বদলে ফেলতে পারব। সুতরাং নিজেকে দশ-পনর মিনিট সময় দিই, তাতে পৃথিবীতে আমাদের ভূমিকা আমরা আরো ভালো করে পালন করতে পারব। তাই না?

উনার কণ্ঠ নরম হয়ে আসছিল।

ওকে, ফাইন, এখন ছাদের দিকে তাকান, হ্যাঁ, দেখুন একটা পয়েন্ট আছে - সিলিং ফ্যান ঝুলানোর পয়েন্ট। পেয়েছেন? হ্যাঁ, ওটার দিকে তাকিয়ে থাকুন, একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকুন। গুড, এখন আমার কথা শুনুন। শুধু আমার কথা শুনুন। শুনতে থাকুন . . . . .

ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে নামতে শুরু করেছে।

তন্দ্রা, তন্দ্রা, তন্দ্রা, আপনার তন্দ্রা এসে যাচ্ছে। তন্দ্রা, তন্দ্রা, তন্দ্রা . . . . .

উনি বলতেই থাকলেন। এ পর্যায়ে ভদ্রলোকের কণ্ঠস্বর নামতে নামতে প্রায় খাদে নেমে এলো। এদিকে সত্যি সত্যিই হামিদের চোখের পাতা দুটো যেন ভারী হয়ে আসছিল।

একসময় হামিদের চোখ বন্ধ হয়ে এলো। তখন রয় সাহেব প্রথমে শিথিলায়ন নামে একটি প্রক্রিয়ায় হামিদের তার পুরো শরীরটাকে ভারমুক্ত করে দিলেন, হামিদ অসাধারণ একটা শান্তি অনুভব করল পুরো শরীর জুড়ে। পুরো শরীরে এধরণের আরামদায়ক শৈথিল্যের অনুভূতি তার জীবনে এটাই প্রথম।

পুরো শরীর শিথিল হয়ে যাবার পর রয় মূল বিষয়ের অবতারণা করলেন - এখন একটা ঘর কল্পনা করুন, শূণ্য ঘর। এ পৃথিবীতে আছেন শুধু আপনি, আর আপনার এই ঘর। এটাই আপনার মনের ঘর। কল্পনা করতে পেরেছেন? পারলে আপনার ডান হাতটা অল্প নাড়ান। চেষ্টা করতে থাকুন . . . কল্পণা করতে . . .

বেশ কয়েকবার চেষ্টার পর হামিদ যখন সেটা কল্পণা করতে পারল, সে হাত তুলে রয় সাহেবকে ইঙ্গিতে জানাল সেটা।

গুড - রয় বললেন - আপনার মনের ঘরে আপনি স্বাধীন, ঘুরে বেড়ান এপাশ থেকে ওপাশে। দেখুন চারিদিক। কি সুন্দর ! কি শান্তি !

হামিদ তার মনের ঘর দেখে সত্যিই খুব শান্তি অনুভব করল।

ঘরের ডানপাশে একটা দরজা আছে।

হামিদ কল্পনার ভেতরই ডানদিকে তাকাল - সত্যিই তো একটা দরজা আছে এ পাশে !

দরজা খুললেই দেখতে পাবেন, বরাবর একটা সিড়ি নেমে গেছে নিচে। নিচে অন্ধকার, কিন্তু সিড়ির ওপরের ধাপগুলো দেখা যাচ্ছে।

দরজা খুলে হামিদ সত্যি সত্যিই সিড়ি দেখতে পেল - সিড়িটা নিচে নেমে গেছে, অন্ধকার একটা ঘরে।

নিচের ঘরটা অন্ধকার, কারণ ওটা আপনার অবচেতন মন। মনের এই ঘরের কাজকর্ম ঘটে আপনার অজান্তে . . . . . . ওই ঘরে কি হচ্ছে জানতে চান? তাহলে সিড়ি গুনে গুনে নেমে যান। চলুন না, ঘুরে আসি সেই ঘরে। আচ্ছা, চার্জার লাইটটা নিয়ে যাবেন সাথে করে, কারণ ও ঘরটা চির অন্ধকার।

হামিদ অনুভব করল, তার হাতে একটা চার্জার লাইট ধরা। রয় সাহেব যা যা বলছেন, তাই সত্য হয়ে যাচ্ছে। সম্মোাহিত মানুষের বোধ হয় এরকমই হয় !

কিন্তু সে তখন এসব নিয়ে চিন্তিত নয়। সে তীব্র কৌতূহল নিয়ে ধীরে ধীরে নামতে থাকল নিচের সে রহস্যময় ঘরটায়।

আপনি প্রথম সিড়িটা পার হলেন . . . . . দ্বিতীয়টা . . . . . তিন নম্বর . . . . . . . চার . . . . . . . . পাঁচ . . . . - এভাবে দশ পর্যন্ত গুনতে গুনতে হামিদ দেখল সে আসলেও নতুন একটা ঘরে চলে এসেছে। এ ঘরটা ওপরের ঘরটার মতই, কিন্তু চার্জার লাইটের আলোয় সে দেখল এ ঘরের দেয়ালের রংটা গোলাপী।

পকেট থেকে চকটা বের করুন। পেয়েছেন? গুড। এখন সামনের দেয়ালে লিখুন - রাগ। লিখেছেন? এখন ভালো করে পড়–ন শব্দটা - রাগ। পড়েছেন? ভালো। এবার সেই রাগ শব্দটার ওপর ক্রশ চিহ্ন দিন . . . ক্রশ চিহ্ন দিন। দিয়েছেন? আপনার কাজ শেষ, দ্রুত চলে আসুন ওপরের ঘরে . . . ওপরের ঘরে . . . সিড়ি . . . সিড়ি বেয়ে উঠুন . . . দশ . . . নয় . . . আট . . . - এভাবে এক পর্যন্ত পৌঁছে তিনি বললেন - এবার চোখ খুলুন।

হামিদ চোখ খুলল - সে রয়ের চেম্বারের সেই আধো-অন্ধকার ঘরটায় বসে আছে।

উঠে পড়–ন, আপনি তো বেশ সুন্দর সহযোগিতা করেছেন - রয় সাহেব খুব সুন্দর করে হাসলেন।

আশ্চর্য সুন্দর একটা অভিজ্ঞতা - হামিদ ভাবল।

কেমন লাগল, নিজের মনের ঘর দেখতে ?

ভালো, খুব ভালো - হামিদ এমনভাবে বলল, যেন এখনো সম্মোহনের ভেতরই আছে।

আপনার সমস্যাতো অর্ধেকটাই সমাধান হয়ে গেছে মনে হচ্ছে - ভদ্রলোককে খুব আনন্দিত মনে হল।

তাই? - হামিদ ঘোলাটে চোখে উনার দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, তাই। আচ্ছা, অবচেতন মনটা দেখতে কেমন লাগল? কেমন যেন রহস্যময়, তাই না? - উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন রয়।

হামিদ মাথা নাড়ল, তারপর কি মনে হতেই তাড়াতাড়ি বলল - আচ্ছা, অবচেতন মনের ভেতর আমি যেন একটা ছায়া দেখলাম। এটা কি, ডাক্তার সাহেব?

ছায়া?

হ্যাঁ, যেন অন্য কেউ আছে ওখানে, আমি বাদে অন্য কেউ?

রয় ভ্রুকুঞ্চিত করলেন - এরকম তো হবার কথা না।

মানে? এরকম হবার কথা না কেন?

কারণ - রয় বোঝানোর ভঙ্গিতে বললেন - আপনার মনের অবচেতনে আপনি ছাড়া আর কারো প্রবেশাধিকার নেই, এমনকি জাগ্রত অবস্থায় আপনার নিজেরও সেখানে প্রবেশ করার শক্তি থাকে না।

তাহলে ছায়াটা কার?

রয় চুপ করে কি যেন ভাবলেন, তারপর বললেন - আপনি ঠিক কি দেখেছেন সেটা জানতে হবে, অবচেতন মন রহস্যময় জায়গা তো, খুব ভালোভাবে না জেনে কিছু বলা সম্ভব না।

হামিদ চুপচাপ কথাটা শুনল।

যা হোক, চলুন উঠি, আমার অনেক সময় নিয়ে নিয়েছেন আপনি। বাসায় যাবো না? - রয় অমায়িক হেসে বললেন।

হামিদ উঠে দাঁড়াল - সম্মোহনের ঘোর যেন তার পুরোপুরি কাটেনি তখনো।

ঠিক একমাস পর আবার দেখা করবেন। আজকে চলে যান। আশা করি হাতে হাতেই ফল পাবেন।

হামিদ সেদিনের মত চলে এলো, কিন্তু তার মনে আশ্চর্য এক স্বপ্নের মত জেগে রইল সে সন্ধ্যার কথা।

এরপর দেখতে দেখতে দুই সপ্তাহ চলে গেছে। হামিদ এরমধ্যে মজার একটা জিনিস লক্ষ্য করেছে - যখনই কোন কারণে তার রাগ ওঠে, তখনই কোথা থেকে চোখের সামনে একটা ক্রশচিহ্ন ভেসে ওঠে, আর ওমনি তার রাগ পানি হয়ে যায়।

একদিন পাঁচশ টাকার একটা নোটের ভাংতি চাইতেই এক দোকানদার তার সাথে খুব বাজে একটা প্রতিক্রিয়া দেখাল। অন্য কোন সময় হলে তার মাথায় রক্ত উঠে যেত - সেদিন সে শান্তভাবে লোকটাকে শুধু বলল, এত কথা না বলে শুধু বলবেন - ভাংতি নেই, এতে আপনারই কষ্ট কম হবে। নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ দেখে সে নিজেই অবাক হল।

এরমধ্যে আরেকদিন মামার সাথে তার দেখা হল। উনি জানতে চাইলেন, সে দোয়ার কাগজটা ঠিকমত রেখেছে কিনা। হামিদ বলল - হ্যাঁ, সেটা সে সাথেই রেখেছে। মামা তাকে বললেন, তার ওপর খুব খারাপ একটা নজর আছে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে, সে যেন কাগজটা খুব সাবধানে রাখে। কিন্তু মামা চলে যাবার পরে হামিদ মানিব্যাগ ঘেটে দেখল, দোয়ার কাগজটা সেখানে নেই - সম্ভবত কখনো সেটা কোথাও পড়ে গেছে। তবে হামিদকে সেটা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত মনে হল না - সে সম্মোহন চিকিৎসার ভেতরই তার সমস্যাটার সমাধান পেয়ে গেছে। ফলে মামার কথা আর দোয়া পড়া কাগজের ব্যাপারটা সে একসময় ভুলেই গেল।

দ্বিতীয়বার হামিদ যখন রয়ের কাছে গেল, রয় তাকে একইভাবে সম্মোহিত করলেন। সম্মোহনের মাধ্যমে সে তার অবচেতন মনের ঘরে ঢুকল, তখন রয় তাকে সাজেশন দিলেন যে রাগের সময় সে শান্ত থাকবে। তারপর যথানিয়মে হামিদকে তিনি বের করে আনলেন মোহাবস্থা থেকে। হামিদ একসময় সম্মোহন থেকে জেগে উঠল বাস্তবতায়।

এভাবে আপনাকে নিয়মিত করতে হবে, যেন আপনার অবচেতনে সাজেশনটা স্থায়ী হয়ে যায়, বুঝলেন - রয় হাসি হাসি মুখে তার দিকে তাকালেন।

কিন্তু হামিদকে একটু অন্যমনস্ক মনে হল। সে চিন্তিত মুখে বলল - আজও দেখেছি।

কি দেখেছেন আজও?

ছায়া, আজকে মনে হয় ছায়ার মালিককেও দেখলাম - হামিদ বলে।

ছায়ার মালিক মানে?

সেদিন যার ছায়া দেখেছিলাম অবচেতন মনের ঘরটায়। এটা একটা মেয়ের ছায়া।

ইন্টারেস্টিং - রয় তার চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন - এরকম তো শুনিনি কখনো। আপনার পরিচিত কারো সাথে মিল আছে তার চেহারার? আপনার অতীত জীবনের কোন প্রেম?

না, আমি নিশ্চিত ডাক্তার সাহেব, এ চেহারা আমি কোনদিন কোথাও দেখিনি। অসম্ভব রূপসী মেয়েটা।

রয় একটা দীর্ঘনি:শ্বাস ফেললেন - সম্ভবত আপনার উইশফুল থিংকিং এটা, স্বপ্নের রাজকন্যা। তবে আপনাকে ফ্র্যাংলি বলি, হিপনোটিক সাজেশনের সময় এরকম কোন স্বতন্ত্র এনকাউন্টারের কথা এই প্রথম শুনলাম আমি। এটা হবার কথাও নয় - কারণ হিপনোটিক সাজেশন দেবার সময় পেশেন্ট থাকে পুরোপুরি ডাক্তারের নিয়ন্ত্রণে, ডাক্তার যা বলে তাই তার কাছে সত্য বলে মনে হয়, অন্যকিছুর কথা সে তখন ভাবতে পারে না - পারলে সাজেশন দেয়া সম্ভব হতোনা, আর মনও সে সাজেশন নিত না।

রয় চুপ করে বসে কি যেন ভাবছিলেন, হামিদ তাকে বিদায় জানিয়ে চলে এল।

পরবর্তী মাসে হামিদ চিকিৎসার ফল আরো ভালোভাবে অনুভব করল। সে লক্ষ্য করল - শুধু তার রাগ কমে গেছে তাই না, সে উত্তেজিতও হচ্ছে খুব কম। সম্ভবত মানসিক অনুশীলনটা তার মনের স্বাস্থ্যের ক্রমাগত উন্নতি ঘটাচ্ছে, ফলে সব ক্ষেত্রেই তার ভালো প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

এরমধ্যে একদিন হামিদের মামা তাকে ফোন দিলেন, বললেন সাবধানে থাকতে - তাকে নিয়ে নাকি খুব খারাপ একটা কি স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটার বর্ণনা অবশ্য তিনি তাকে দেননি, খারাপ স্বপ্নের কথা নাকি আলোচনা করতে হয় না।

তৃতীয় মাসে রয় সাহেবের চেম্বারে যখন হামিদ উপস্থিত হল হিপনোটিক সাজেশন নেবার জন্য, রয় তাকে বললেন যে - চিকিৎসায় খুব ভালো ফল দেখা যাচ্ছে, হামিদের ব্যাপারটা খুব আশাব্যঞ্জক। হামিদও মনে মনে মানল কথাটা - সে নিজেওতো কার্যক্ষেত্রে প্রমাণ পেয়েছে যে নিজের মনের ওপর তার বেশ ভালো নিয়ন্ত্রণ এসে গেছে। রয় আরো জানালেন যে - যত দিন যাবে তত তাকে সম্মোহিত করতে আরো কম সময় লাগবে। একসময় সে নিজেই নাকি নিজেকে সাজেশন দিতে পারবে। এটার নাম আত্মসম্মোহন, এটা রয় তাকে শিখিয়ে দেবেন বলে কথাও দিলেন - তখন তাকে আর সেশনের জন্য রয়ের কাছে আসতে হবে না, অবসর সময়ে নিজেই নিজেকে সম্মোহন করতে পারবে সে।

সেদিনও যথারীতি ওরা সেই রুমে গেল, তারপর হামিদ একদৃষ্টিতে ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকল, একসময় তার চোখের পাতা ভারী হয়ে এল, সে তারপর চলে গেল মোহাচ্ছন্ন একটা অবস্থায়। সে অবস্থায় সে তার মনের ঘরে ঢুকল, ঢুকে ডানদিকে দরজা দেখল। সে দরজা খুলে সিড়ি বেয়ে সহজেই নেমে গেল মাটির নিচের ঘরটায়, অর্থাৎ তার অবচেতন মনে। হাতের চার্জার লাইট দিয়ে স্পষ্ট দেখতে পেল ঘরের বিভিন্ন অংশ, বিশেষ করে সেই দেয়ালটা যেখানে রাগ কথাটা লিখে তার ওপর ক্রশচিহ্ন দিয়েছিল সে নিজে। সে দিন দিন অভ্যস্ত হয়ে উঠছে সম্মোহনের ব্যাপারটায়, ফলে এসব ঘটল খুব সহজে আর খুব দ্রুত। সবশেষে সে ঘরের মাঝখানে গিয়ে বসল, সেখানে সে অপেক্ষা করতে থাকল রয়ের সাজেশনের জন্য।

ঠিক তখনই ঘটল ঘটনাটা। সে মেয়েটাকে আবার দেখতে পেল - অনিন্দ্যসুন্দরী একটা মেয়ে। মেয়েটা তার দিকে তাকিয়ে হাসল - নি:শব্দ হাসি। মেয়েটাকে তার কাছে পরীর মত সুন্দর মনে হল, খুব পরিচিতও মনে হল - ফলে সেও মেয়েটার দিকে তাকিয়ে হাসল।

এরমধ্যে সে শুনতে পেল রয়ের কণ্ঠস্বর - উত্তেজনার সময় শান্ত থাকব, আকাশের মত শান্ত।

তখন মেয়েটা তাকে কাছে ডাকল, সে সম্মোহিতের মত এগিয়ে গেল। মেয়েটা দেয়ালে কি যেন লিখছে। রয়ের কণ্ঠস্বর তখনও দুর্বলভাবে তার কানে আসছে - যেন ওপর তলায় বসে রয় তাকে কথাগুলো বলছেন, আর এখানে সে শব্দগুলো ঠিকমত পৌছাচ্ছে না।

হামিদ দেয়ালের লেখাটা পড়তে শুরু করল, যেটা সেই মেয়েটা এইমাত্র লিখেছে ওর জন্য - আমাকে তুমি সারাজীবন ভালোবাসবে, তুমি আমার সাথে থাকবে চিরদিন।

লেখাটা পড়ে কেন যেন খুব ভালো লাগলো হামিদের - উত্তেজনাভরা একটা আনন্দ।

মেয়েটা তার হাত স্পর্শ করল, হামিদের তখন ভীষণ ভালো লাগল। অসাধারণ একটা অনুভূতি। মেয়েটা এবার ওকে টেনে নিয়ে চলল। হামিদ দেখল, মেয়েটা তাকে নিয়ে যাচ্ছে প্রথমে সিড়িটার দিকে - যে সিড়ি দিয়ে সে এঘরে নেমে এসেছে। তারপরই ওরা সিড়ি বেয়ে উঠে গেল দরজাটার দিকে - যে দরজা খুলে হামিদ এ ঘরে ঢুকেছিল।

মেয়েটা ওর হাতে একটা তালা এগিয়ে দিল। তারপর একবার ইংগিত করল দরজাটার দিকে, আরেকবার দেয়ালের লেখাটার দিকে। মেয়েটা তখন সুন্দর করে একটা চুমু একে দিল হামিদের ঠোঁটে। রয়ের কণ্ঠ হামিদ তখন বলতে গেলে শুনতেই পাচ্ছে না।

হামিদ দরজাটা বন্ধ করে দিলো - এপাশ থেকে, তারপর তালাটা লাগিয়ে দিল সেটায়।



রয় আবারো ডাকলেন - হামিদ, আপনি এখন জেগে উঠবেন।

কিন্তু এবারো কোন সাড়া-শব্দ পাওয়া গেল না হামিদের মধ্যে। রয় কপালের ঘাম মুছলেন - এরকম ঘটনা তার চিকিৎসক জীবনে আর কেনদিন ঘটেনি, অন্য কারো ক্ষেত্রে ঘটেছে বলেও তার জানা নেই।

রয় আবার চেষ্টা শুরু করলেন। প্রায় আধঘন্টা ডাকাডাকির পর হামিদের চোখ খুলল। রয় হেসে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেললেন - অবশ্য সাথে সাথে এও লক্ষ্য করলেন, হামিদের চোখ ভীষণ লাল হয়ে আছে - জ্বরগ্রস্থ মানুষের চোখের মত লাল।

হামিদ, আপনার এখন কেমন লাগছে? - রয় দুর্বলভাবে প্রশ্ন করলেন।

হামিদ? - অপরিচিত একটা কণ্ঠস্বর বলে উঠল - হামিদটা আবার কে?

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ