প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Tuesday, July 31, 2012

দক্ষিণ এশিয়া, ভারতবর্ষ এবং বাংলায় ক্যালিগ্রাফির বিকাশ | আসাদ সায়েম

ক্যালিগ্রাফি মূলত বিবাহের নিমন্ত্রণপত্র, বিভিন্ন নিমন্ত্রণপত্র, ফন্ট ডিজাইন, মুদ্রণশৈলী, লোগো, অরিজিনাল হস্তলিখিত লোগো, ধর্মীয় আর্ট, গ্রাফিক ডিজাইন, পাথর খোদাই এবং স্মরণিকাতে ব্যবহার করা হয়। এছাড়া সৌন্দর্য, প্রশংসাপত্র, জন্ম ও মৃত্যু সনদ, ফিল্ম ও টিভিতে ছবির গতিশীলতা বা স্থিরতা, মানচিত্র এবং আরও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। ক্যালিগ্রাফি শব্দটি গ্রিক শব্দ ক্যালোস (সুন্দর) ও গ্রাফ (লিখন) শব্দদ্বয়ের সমন্বয়ে গঠিত। সুতরাং ক্যালিগ্রাফি শব্দের অর্থ দাঁড়ায় সুন্দর লিখন।
প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন এলাকায় তালপাতায় ক্যালিগ্রাফি করা হতো। প্রায় ২ হাজার বছর আগে ভারতবর্ষে এই হস্তলিপি বিদ্যমান ছিল। এমনকি কাগজের প্রচলনের পরও প্রায় ৪০০ বছর পর্যন্ত কাগজের সঙ্গে সঙ্গে তালপাতাকে ক্যালিগ্রাফির অন্যতম উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পাতার উভয় পার্শ্বকে হস্তলিপির জন্য ব্যবহার করা হতো। দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে এই শিল্পের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যেত। তালপাতা ছিল ক্যালিগ্রাফির একটি চমত্কার জমিন, যা এশিয়ার বিভিন্ন দেশের শিল্পীরা ব্যবহার করতেন।
এছাড়া পোড়ামাটি এবং তামাও ছিল প্রাচীন ভারতের ক্যালিগ্রাফির জনপ্রিয় উপকরণ। দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথমদিকে ভারতের উত্তরাঞ্চলে বার্চ গাছের ছালকে ক্যালিগ্রাফির জমিন হিসেবে ব্যবহার করা হতো।
নেপালি ক্যালিগ্রাফিতে বৌদ্ধধর্মের মহায়না এবং ভজরায়ানা শাখার ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যেত। রঞ্জনা হস্তলিপি ছিল এই ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক রূপ। নেপাল, তিব্বত, ভুটান, মঙ্গোলিয়া, চীনের উপকূলীয় অঞ্চল, জাপান এবং কোরিয়াতে বৌদ্ধধর্মের পবিত্র বাণীকে ক্যালিগ্রাফি আকারে সংরক্ষণ করা হতো। এসব ক্যালিগ্রাফির ভাষা ছিল মূলত সংস্কৃত এবং পালি।
ক্যালিগ্রাফি তিব্বতীয় সংস্কৃতির একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম। তিব্বতীয় হস্তলিপি ভারতীয় হস্তলিপি থেকে বিকাশ লাভ করে। তিব্বতের উচ্চপদস্থ শ্রেণীর লোক, বিশেষ করে উচ্চ লামা এবং পোটালি সম্প্রদায়ের অধিবাসীরা ছিলেন দক্ষ ক্যালিগ্রাফার। তিব্বত কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত বৌদ্ধধর্মের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। শব্দের লিখিত রূপ প্রচলনে এই ধর্মের অনেক অবদান রয়েছে। ধর্মের প্রায় সব ধরনের পবিত্র বাণী এবং দালাইলামা ও অন্যান্য ধর্মযাজক এবং পণ্ডিতদের বাণী হস্তশিল্প আকারে সংরক্ষিত হতো। বৌদ্ধধর্মের জপচক্রকে ক্যালিগ্রাফি অনেকটা সহজবোধ্য করে দিত। তখনকার দিনে তিব্বতের সুরম্য ভবনগুলোতে আরব এবং রোমান ক্যালিগ্রাফি শোভা পেত। আগেকার দিনে তিব্বতীয় ক্যালিগ্রাফি নলখাগড়া বা এ জাতীয় উপকরণ দিয়ে অঙ্কিত হতো, কিন্তু বর্তমানে ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনে বাটালি টিপ কলম এবং মার্কার ব্যবহার করা হয়।
বাংলা মুলুকে ক্যালিগ্রাফি
ক্যালিগ্রাফি বা হস্তলিখন শিল্পের বিকাশ এবং উন্নয়নে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের রয়েছে গৌরবময় অবদান। তখনকার সময়ে ক্যালিগ্রাফি স্মৃতিসৌধ বা জাদুঘরের দেয়াল, মসজিদ, মাদরাসা এবং সমাধিসৌধের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া এবং রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের বিবর্তনে এসব ক্যালিগ্রাফি বেশি দিন স্থায়ী হতে পারেনি। বাংলায় আগেকার দিনে ক্যালিগ্রাফি আঁকা হতো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং মাধুর্যপূর্ণভাবে। এক সময়ের বাংলাদেশের অংশ বিহারের বারী দরগায় প্রাচীন হস্তলিপির সন্ধান পাওয়া যায়। দিল্লির কুতুব মিনার এবং কুয়াতুল ইসলাম মসজিদের ক্যালিগ্রাফির সঙ্গে এর সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। ১২৪৯ খ্রিস্টাব্দের দিকে পশ্চিম দিনাজপুরের একটি মসজিদে ক্যালিগ্রাফির সন্ধান পাওয়া যায়, যা পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত তুঘরি স্টাইল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৩০১ সালে বিহারে সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে অসাধারণ শিল্পশৈলীর ‘নাসখ’ ক্যালিগ্রাফির উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
এসব ক্যালিগ্রাফিতে শিল্পীরা উল্লম্ব লাইন এবং তির্যকতার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতেন, যেগুলো অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং নিপুণভাবে অঙ্কন করা হতো। এসব ক্যালিগ্রাফি ছিল গতানুগতিকতার সম্পূর্ণ বাইরে। দিল্লির আলাই দরগায় পাওয়া সমসাময়িক ক্যালিগ্রাফি ছিল ছোট আঁচে আঁকা, অন্যদিকে বাংলা ক্যালিগ্রাফির মূল বৈশিষ্ট্য ছিল মোটা আঁচে আঁকা।
আরও কিছু ক্যালিগ্রাফি ১৩১৩ সালে বাংলার সুলতান ফিরোজ শাহের সময়ে ত্রিবেণির জাফর খানের সমাধিসৌধের উত্তর দিকের দেয়ালে পাওয়া যায়, যা তুঘরা হস্তলিপির উত্কৃষ্ট রূপ হিসেবে বিবেচিত হয়। এসব ক্যালিগ্রাফি কলমের বড় বড় টানে আঁকা এবং অনুভূমিক অক্ষরগুলো গুচ্ছ ভিত্তিতে আঁকা হতো। ত্রিবেণির ফিরোজ শাহী হস্তলিপির প্রক্রিয়ায় শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের ক্যালিগ্রাফির পূর্ণতার ছাপ লক্ষ্য করা যায়, যা কলকাতার পূর্ব উপকণ্ঠের একটি মসজিদে শোভা পেত। এই ক্যালিগ্রাফির অক্ষরগুলো ছিল অত্যন্ত সূক্ষ্ম এবং পরস্পর গ্রন্থিত। এগুলোকে তুঘরা ক্যালিগ্রাফির ভিন্ন রূপ হিসেবে বিবেচনা করা হতো। ১৩৭৪-৭৫ সালে পাণ্ডুয়ার আদিনা মসজিদে অঙ্কিত হস্তলিখন শিল্পকে বাংলার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের ল্যান্ডমার্ক হিসেবে অভিহিত করা হয়। এগুলো ছিল অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এবং চিত্তাকর্ষক। এগুলো যে কারও চোখ শীতল করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এই মসজিদের আরেকটি ক্যালিগ্রাফি ছিল এই শিল্পের আভিজাত্যের নিদর্শন। এর ঊর্ধ্ব লাইন অত্যন্ত মনোরম ‘কুফিক’ স্টাইলে আঁকা হয়, যা থেকে প্রতীয়মান হয়, বাংলার ক্যালিগ্রাফাররা কার্যকরীভাবে কুফিক স্টাইলেও সমান পারদর্শী ছিলেন। কিন্তু এটা ছিল বাংলার কুফিক ক্যালিগ্রাফির একমাত্র নিদর্শন। ১৪৪৩ সালে ইলিয়াস হোসেন শাহী বংশের দ্বিতীয় সুলতান নাসির উদ্দিন মাহমুদ শাহের সময়ে বালিয়াঘাটায় অত্যন্ত মনোরম একটি ক্যালিগ্রাফির পেটেম্লট পাওয়া যায়। এটি ওই সময়ের ক্যালিগ্রাফিকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। ১৪৭৪ সালে সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের আমলে ‘বো এবং অ্যারো’ টাইপের ক্যালিগ্রাফির সন্ধান পাওয়া যায়। এটা ১৪৮৭ সালে সাইফুদ্দিন ফিরোজ শাহের আমলে উত্কৃষ্ট রূপ লাভ করে।
মালদার কাছে কাটরা মসজিদে অঙ্কিত ক্যালিগ্রাফি ‘বো এবং অ্যারো’ টাইপের ক্যালিগ্রাফির উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সংক্ষেপে বলা যায়, প্রাচীন বাংলায় পাঁচ ধরনের ‘তুঘরা’ ক্যালিগ্রাফি বিকাশ সাধিত হয়। এগুলো হলো—‘প্লেইন তুঘরা’, ‘কাফ এবং ইয়া’ তুঘরা, আরবি হা হরফের আদলে হা তুঘরা, ‘উলম্ব ইয়া হু’ তুঘরা, ‘সোয়ান’ তুঘরা এবং সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ‘বো অ্যান্ড অ্যারো’ তুঘরা। এসব তুঘরার স্টাইল ছিল অত্যন্ত সাধারণ, কিন্তু মনোরম আভিজাত্যের প্রতীক। বাংলায় তুঘরা স্টাইলের দর্শনীয় ও মনোমুগ্ধকর ক্যালিগ্রাফি সব মুসলিম বিশ্বের ক্যালিগ্রাফি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল।
তুঘরা ছাড়াও বাংলার ক্যালিগ্রাফাররা সাধারণ কিন্তু নিপুণ তুলিতে ‘নাসখ’ এবং ‘তুলুথ’ ক্যালিগ্রাফি অঙ্কনে ছিলেন সিদ্ধহস্ত। ১৪৮৪ সালে গৌড়ের গানম্যান্ট মসজিদে প্রাপ্ত ‘নাসখ’ ক্যালিগ্রাফি এই ধরনের শিল্পের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৫০০ সালে সুলতান শাহের পুত্র প্রিন্স দানিয়েলের আমলে পশ্চিমবঙ্গের একটি মসজিদে কুফিক অক্ষরে তুঘরা হস্তলিপি অঙ্কন করা হয়। এগুলো ছিল ইন্দো-মুসলিম এপিগ্রাফির একটি চমত্কার নিদর্শন।
বাংলায় হোসেন শাহী আমলের পতনে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক বিশৃঙ্খলার সঙ্গে সঙ্গে ক্যালিগ্রাফি শিল্পেরও অস্তিত্ব বিলোপ হয়ে যায়। তবে ১৫৫৯ সালে আফগান শাসনামলে গিয়াসউদ্দিন বাহাদুরের আমলে ক্যালিগ্রাফি শিল্প কিছুদিন স্থায়িত্ব লাভ করে। পরে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে বাংলার চিরায়ত ক্যালিগ্রাফির স্থলে মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানীর ক্যালিগ্রাফির আদলে বাংলায় ক্যালিগ্রাফি চর্চা শুরু হয়, যার ফলে বাংলার ক্যালিগ্রাফি শিল্প আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যায়।
১৭০৭ সালে সর্বশেষ মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের মৃত্যুর পরপরই মোগল সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে এর শিল্পেরও পতন শুরু হয়। এরপর ১৭৩০ সালের আভাদ, দাক্ষিণাত্য এবং বাংলা স্বাধীন রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। তারপর লক্ষ্মৌ, হায়দারাবাদ এবং মুর্শিদাবাদে আস্তে আস্তে শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ লাভ শুরু হয়। ১৭১৩ সালে মোগল মুর্শিদাবাদ মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী স্থাপিত হওয়ার পর বিহার ও উড়িষ্যা আস্তে আস্তে বাণিজ্যিক এবং শিল্প-সংস্কৃতির কেন্দ্রে রূপান্তরিত হতে থাকে। এর সম্পদ এবং সমৃদ্ধিতে আকৃষ্ট হয়ে চিত্রকররা মুর্শিদাবাদে জড়ো হতে থাকেন। ১৭৪০ থেকে ১৭৫৬ সালের মধ্যে আলিবর্দী খাঁর শাসনামলে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের ব্যাপক উন্নতি সাধিত হয়। কেননা তিনি ছিলেন অত্যন্ত পরিপাটি এবং শিল্প-সংস্কৃতিমনা। তারপর তার পৌত্র সিরাজদ্দৌলার শাসনামলে ক্যালিগ্রাফি শিল্প নবজীবন লাভ করে। এভাবে সময়ের বিবর্তনে বাংলা মুলুকে ক্যালিগ্রাফি শিল্প বিকাশ ও উন্নতি লাভ করে। তবে বাংলা ক্যালিগ্রাফিতে ইসলামী ক্যালিগ্রাফির ব্যাপক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়।
ঐতিহাসিক তথ্যমতে, প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক্সের নান্দনিক শিলালিপি হচ্ছে ক্যালিগ্রাফির প্রাথমিক প্রচেষ্টা। ইসলামী লিপিকলার উন্মেষ ও এর প্রসার ঘটেছিল ইসলাম ধর্মের প্রচারের পাশাপাশি। আরবি ভাষায় লিখিত পবিত্র ধর্মগ্রন্থ আল কোরআনের অনুলুপি তৈরি ও প্রচারের প্রয়োজনেই বিকশিত হয়েছিল ইসলামী লিপিকলা। পরবর্তী সময়ে এই চর্চা ধর্মীয় প্রচারণার সঙ্গে কাঁচ ও মৃিশল্প, ধাতুশিল্প, বয়নশিল্প, স্থাপত্য, সিরামিকসহ বিভিন্ন শিল্প মাধ্যমে ছড়িয়ে পরে। অতীতে বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি শিল্পের তেমন প্রসার ঘটেনি। দেশের মূল ধারার শিল্পচর্চায় যুক্ত হতে পারেনি এই ক্যালিগ্রাফি। তবে আশার দিক হচ্ছে, ধীরে ধীরে এই ক্যালিগ্রাফি চর্চায় এগুচ্ছে বাংলাদেশ। প্রাতিষ্ঠানিক এবং ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এই শিল্প দিন দিন বিকাশ লাভ করবে।
 
সূত্র : আমার দেশ

ইসলামী শিল্পকলা ও ক্যালিগ্রাফি | ইব্রাহীম মণ্ডল

আইয়্যামে জাহেলিয়াতের এক চরম সময়ে রাসুল (সা.)-এর আবির্ভাব ঘটে। তিনি মানবজাতিকে ডাক দিয়েছিলেন অগ্নি, পাথর, মূর্তিপূজা, হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানি ও অন্যান্য পাপাচার ছেড়ে এক আল্লাহর পথে আসার জন্য। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে অনেকেই শান্তির পতাকাতলে হাজির হলেন। একত্ববাদে বিশ্বাসী এই জনসমষ্টিই মুসলমান। শান্তির ছায়াতলে ইসলামে দীক্ষিত এই জনসমষ্টির মাধ্যমে নতুন এক সভ্যতার জন্ম হয়, যা পৃথিবীর আশীর্বাদস্বরূপ। এই একত্ববাদে বিশ্বাসীদের মধ্যে যে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তাই ইসলামী সংস্কৃতি। জাহেলিয়াতের যুগে সাহিত্য, সংস্কৃতি দ্বারা গোত্রে গোত্রে হিংসার আগুন জ্বালানো, পরস্পর শত্রুতা সৃষ্টি, প্রতিশোধের স্পৃহা, হানাহানি, কাটাকাটি করতে উদ্বুদ্ধ করত। অপরাধীকে ক্ষমা করা ছিল তখনকার সময়ে কল্পনাতীত। একত্ববাদে বিশ্বাসীদের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ক্রোধ সংযত করা অপরাধীদের ক্ষমা করতে শেখায়। মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব, ভালোবাসা ও সদ্ব্যবহার সম্প্রীতি শিক্ষা দেয়, জীবনকে সম্মানিত করে তোলে, অনাদর্শকে আদর্শবাদী, অজ্ঞ মূর্খকে নির্ভুল জ্ঞান এবং সাহসহীন মানুষকে সাহসী ও নির্ভীক করে তোলে।
আমরা জানি, মুসলিম শিল্পকলা ও ইসলামী শিল্পকলার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে।
মুসলিম শিল্পকলা : মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মুসলমান শাসক, বিত্তশালী ব্যক্তিবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় যে শিল্প উত্কর্ষ ও বিকাশ লাভ করে, তা-ই মুসলিম শিল্পকলা।
খোলাফায়ে রাশেদার পর উমাইয়া, আব্বাসীয়, ফাতেমি, সেলজুক, মামলুক, উসমানীয় খেলাফতের আমলে তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ভারতবর্ষে মোগল আমলে মুসলিম শিল্পকলা ব্যাপক বিকাশ লাভ করে।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় যুগে তাদের প্রাসাদে হাম্মাম খানায়, রংমহল, দরবারগৃহ ও হেরেম নৃত্যরত নারী, নারীর শরাব পরিবেশন ও বিভিন্ন প্রাণীর চিত্র, দেয়ালচিত্র ফ্রেস্কো মাধ্যমে মুসলিম শিল্পীরা অঙ্কন করছে।
বাদশা হুমায়ুন ছিলেন সংস্কৃতিমান ও শিল্পরসিক। রাজ্য হারিয়ে পারস্যে কুড়িটি বছর কাটিয়ে দেশে ফেরার সময় তাব্রিজ থেকে মীর সাঈদ আলী ও খাজা আবদুস সামাদ শিরাজী নামক দু’জন খ্যাতিমান শিল্পীকে দিল্লিতে নিয়ে আসেন এবং এরা স্কুল স্থাপন করে এক শিল্পী তৈরি করে। এদের মাধ্যমে ভারত এবং ইরানি রীতির সংমিশ্রণে ইন্দু-মুসলিম রীতি গড়ে ওঠে। শিল্পীরা রাজদরবারে চিত্র, যুদ্ধচিত্র, রাজাদের প্রতিকৃতি, জীবজন্তু, পশুপাখি ইত্যাদিকে বিষয়বস্তু করে প্রচুর মিনিয়েচার ছবি অঙ্কন করে। মোগল আমলেই কাগজের ওপর ছবি আঁকা শুরু হয়। কাগজ বানাতে শেখা, ছবি আঁকা থেকে বই লেখা বিশেষভাবে প্রচলিত হয় মোগল আমলেই, তার আগে এ দেশে তালপাতার ওপর লেখা হতো এবং ছোট ছোট ছবিও আঁকা হতো।
বাদশা আকবর শিল্প অনুরাগী ছিলেন। তার সময়ও বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি চিত্রে শোভিত হয়।
জাহাঙ্গীর নিজেই শিল্পী এবং শিল্প সমালোচক ছিলেন। তার সময়ই ইংরেজ রাষ্ট্রদূত স্যার টমাস রো এদেশে আসেন। এই সময় প্রতিকৃতি ও মিনিয়েচার পেইন্টিং করা হয়। ছবিতে আলোছায়া ও পরিপ্রেক্ষিত বোঝাতে সমর্থ হয়। ছবিগুলো খুব বাস্তবধর্মী হয়ে ওঠে। তারা প্রাণীর চিত্র বাস্তবভাবে আঁকতে থাকে, যা বিস্ময়কর। এই সময় স্থাপত্য শিল্পের অসাধারণ নিদর্শন তৈরি করা হয়। বিকাশ ঘটে ইসলামী শিল্প ও ক্যালিগ্রাফির। এখানে আমরা ইসলামী শিল্প নিয়েই আলোচনা করব।
ইসলামী শিল্প : ‘আল্লাহ সুন্দর তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন’ (আল হাদিস)। যে শিল্পে আল্লাহর মনোনীত ধর্মের অনুশাসনের মাধ্যমে মহান আল্লাহ ও তার সৃষ্টির সৌন্দর্য, মহিমা, আবেগ-অনুভূতি প্রকাশ পায়, তা-ই ইসলামী শিল্পকলা। এ শিল্প মানুষকে সত্য ও সুন্দরের পথ দেখায়, আহ্বান করে। অন্ধকার থেকে আলোর দিকে নির্দেশনা দেয়।
ইসলামের প্রথম যুগেই প্রাণীর চিত্রাঙ্কন নিষিদ্ধ করে হাদিস।
এর মধ্যে কয়েকটি হাদিস তুলে ধরা হলো :
‘হজরত হুজাইফা (রা.) আবু তালহা থেকে নবী করিম (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ফেরেস্তারা এমন ঘরে প্রবেশ করেন না, যেখানে কুকুর বা ছবি (প্রতিকৃতি) রয়েছে।’
‘হজরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, কেয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে সবচেয়ে কঠিন শাস্তি পাবে ছবি (প্রতিকৃতি) অঙ্কনকারী লোক।’
‘হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) নবী করীম (সা) থেকে বর্ণনা করেছেন, আর যে ব্যক্তি ছবি (প্রতিকৃতি) বানালো, তাকে আজাব দেয়া হবে এবং তাকে প্রাণ দেয়ার জন্য বাধ্য করা হবে, অথচ সে তা দিতে পারবে না।’
‘হজরত ওমর (রা.) বলেছেন, আমরা তোমাদের গির্জায় প্রবেশ করি না এ কারণে যে, সেখানে ছবি রক্ষিত রয়েছে। হজরত ইবনে আব্বাস গির্জায় নামাজ পড়তেন, কিন্তু যে গির্জায় ছবি রক্ষিত রয়েছে, সেখানে নামাজ পড়তেন না।’
হজরত মালেক ইবনে আবদুল্লাহর বর্ণনা এই যে, নিষেধ করা হয়েছে সেই ছবি সম্পর্কে, যা প্রকাশ্য স্থানে সংস্থাপন করা হয়। বিছানায় বিছানো ছবির ব্যাপারে কোনো নিষেধ নেই।
তখন শিল্পীরা রাসুল (সা.)-এর কাছে গিয়ে আরজ করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমরা এখন কী করব? রাসুল (সা.) তাদের নিষ্প্রাণ বস্তু , ফুল, লতা-পাতা আঁকার নির্দেশ দিলেন। মরুভূমিতে খেজুর আর আঙুর গাছ হচ্ছে প্রধান উদ্ভিদ। শিল্পীরা আঙুর, লতা-পাতা দিয়েই ডিজাইন করা শুরু করল। তারা প্রাণিচিত্র আঁকা বর্জন করল। তারা প্রাণিচিত্র বর্জন করে ৪টি উপাদান দিয়ে কাজ শুরু করল :
১. উদ্ভিদীয় পরিকল্পনা বা ফুল-লতা-পাতা।
২. জ্যামিতিক আকার, আকৃতি ও রেখা।
৩. আরবি বর্ণমালা বা ক্যালিগ্রাফি।
৪. বিশুদ্ধ বা অবিমিশ্র রঙের ব্যবহার।
এ বিষয়ে উপমহাদেশের প্রখ্যাত পণ্ডিত শিল্প সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান লিখেছেন, ‘ইসলামী শিল্প পূর্ণ বিকাশ লাভ করে ৮০০ থেকে ১৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে।’ এই শতাব্দী যে দীপ্তি এবং ঔজ্জ্বল্য এই আধুনিক সভ্য পৃথিবীর কাছে উপস্থিত করেছে, তা পাশ্চাত্য সভ্যতা এবং পৃথিবীর যে কোনো সভ্যতার সঙ্গে বিচার করলে অতুলনীয় বিবেচিত হয়। মধ্যযুগে পশ্চিম ইউরোপে যখন সংস্কৃতি এবং সভ্যতার আড়ষ্ট সীমা বন্ধন ছিল, একটি দুরন্ত নির্জনতায় পৃথিবীর সর্বত্র ছড়িয়ে ছিল তখন ইসলামী সভ্যতা একটি স্বতন্ত্র উন্মুক্ততায় পৃথিবীর সর্বত্র বিস্তার লাভ করেছে। মূলত মুসলমানদের কারণেই পাশ্চাত্য শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে পুনর্জাগরণ সম্ভব হয়েছিল। অর্থাত্ বর্তমানে যা ইউরোপীয় রেনেসাঁ নামে অভিহিত। ইসলামের সংস্পর্শে না এলে তা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। মুসলমানরা স্পেন বিজয় করার ফলেই ইউরোপীয় সংস্কৃতিতে নতুন সাড়া পড়েছিল। শিল্প সংস্কৃতির জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভূত উন্নতি ঘটেছিল।
স্থাপত্য শিল্পে রাসূল (সা.)-এর তৈরি ঐতিহাসিক নিদর্শন ‘মদিনা মসজিদ’ আজ আধুনিক স্থাপত্যবিদদের কাছে বিস্ময়। বিংশ শতাব্দীর আধুনিক স্থাপত্যবিদরা গবেষণা করে মদিনা মসজিদকে আধুনিক স্থাপত্যের মডেল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। (চলবে)
ইসলামের সঙ্গে যেমন অন্যান্য ধর্মের পার্থক্য আছে, তেমনি পার্থক্য আছে শিল্প ও সংস্কৃতিরও। হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের মন্দির সবার জন্য উন্মুক্ত নয়, যারা ধর্ম প্রচার করেন শুধু তাদের অধিকার রয়েছে সেখানে উপাসনা করার। তাই মন্দিরের অভ্যন্তরে প্রকোষ্ঠ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যেখানে বাইরের আলো-বাতাসের শব্দ প্রবেশ করতে না পারে। পৃথিবীর কর্ম-কোলাহল থেকে মুক্ত হয়ে উপাসনার স্থান হিসেবে নির্জন পাহাড় অজান্তেই বেছে নিয়েছে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা, যেখানে পৃথিবীর কোলাহল স্পর্শ করতে পারেনি।
ইসলামে সম্পূর্ণ ভূখণ্ড আল্লাহর। একজন মুসলমান যে কোনো স্থানে নামাজ আদায় করতে পারেন। ইবাদতের কোনো অন্তরায় নেই। উন্মুক্ততা ইসলামের একটি অংশ। যে কোনো অমুসলিম অতি সহজে কালেমা পড়েই মুসলমান হতে পারেন। মসজিদ নির্মাণ কাঠামোর ও প্রশস্ততায় সহজেই আলো-বাতাস প্রবাহিত হতে পারে। ভেতরের স্পেসের সঙ্গে বাইরের স্পেসের একটা সঙ্গতি আছে। সহজেই প্রবেশ করা যায়। কোথাও কোনো বাধা নেই। সবার জন্য উন্মুক্ত। ইসলামের এই উদারতা তার স্থাপত্যে ব্যক্ত হয়েছে।
রাসূল (সা.)-এর যুগে আরব উপদ্বীপে দুই ধরনের লোক বাস করত। এক দলকে বলা হতো বেদুঈন—এরা নিছক মরুচারী যাযাবর ছিল। আর অন্য দলের লোকরা থাকত শহরে। এই শহরের লোকসংখ্যা ছিল ১৫ থেকে ২০ হাজারের মতো। দেশে দেশে ব্যবসা করত এরা। ইসলামী শিল্পকলা প্রথম বিস্তার লাভ করে মরুময় অঞ্চলে—তাঁবুতে থাকা মানুষের মধ্যে। তাঁবুতে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে আসবাবপত্র বেশি থাকে না। যাযাবর জীবনে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে বেশি জিনিসপত্র নিয়ে চলাফেরা কষ্টকর। তাঁবুতে বসবাসকারী মানুষ প্রধানত তার শিল্পবোধের তৃপ্তি খুঁজছে বয়ন শিল্পের মধ্যে। তাঁবুতে মানুষ গোড়া থেকেই সুন্দর গালিচা বুনতে চেয়েছে। এইসব গালিচা তাঁবুর মধ্যে বিছিয়ে পূরণ করতে চেয়েছে চাদরের অভাব। মরুভূমিতে পানির অভাব থাকায় পানি জোগাড় করে হিসাব করে খরচ করতে না পারলে জীবন চলত না। এই প্রয়োজনে মৃত্পাত্র গড়ার দিকেও তাদের ঝোঁক ছিল। গালিচা, কাপড় ও মৃত্পাত্রের ওপর ফুল, লতাপাতা, জ্যামিতিক নকশা এঁকেছে এরা। আল্লাহর শাস্তির ভয়ে তারা প্রাণীর ছবি অঙ্কন পুরোপুরি বর্জন করেন। আঙুর, লতাপাতা-ফুল দিয়ে নকশা করে মনের সৌন্দর্যবোধকে প্রকাশ করে তৃপ্তি খুঁজেছেন। ইসলামী শিল্পকলা বিকাশ লাভ করেছে মরুচারী যাযাবর জীবনের বাস্তবতাকে কেন্দ্র করেই। আরবদের আঙুর লতার নকশাকলা বিশেষ জটিল হয়ে ওঠে। ফুল, লতা- পাতা ও জ্যামিতিক আকার আকৃতি দিয়ে করা ইসলামী বিশ্বের বৈশিষ্ট্যসূচক নকশা সাধারণভাবে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন শিল্পকলা।
ইসলামে মানুষ ও জীব-জন্তুর ছবি আঁকা নিষিদ্ধ। তাই কোরআনে উল্লিখিত কোনো ঘটনাবলীকে চিত্রিত অথবা মূর্তি নির্মাণের চেষ্টা করা হয়নি। খ্রিস্টীয় চিত্রকলা ও ভাস্কর্য সম্যকভাবে বুঝতে হলে পড়তে হয় অথবা জানতে হয় ইঞ্জিল কিতাবে (বাইবেল) বর্ণিত ঘটনাবলী। বৌদ্ধ ধর্মকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিল্পকে বুঝতে হলে জানতে হয় বুদ্ধের জীবনকথা, পড়তে হয় বৌদ্ধ জাতকের কাহিনী। হিন্দু ধর্মকে কেন্দ্র করে যে শিল্পকলা গড়ে উঠেছে তাকে যথাযথভাবে বুঝতে পৌরাণিক উপাখ্যান জানতে হয়।
উদ্ভিদীয় পরিকল্পনায় বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে ফুল ও লতাপাতা। জ্যামিতিক আকার-আকৃতির মধ্যে বৃত্ত, ঘনক, সরল ও বক্র রেখা বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। উদ্ভিদীয় ও জ্যামিতিক পরিকল্পনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখা আরবি লিপি দিয়ে যে কোনোভাবে নকশা করা যায়। আরবি অক্ষরের সংখ্যা ২৯টি। এই অক্ষরগুলো আঁকাবাঁকা, খাড়া ও সমান্তরাল। এই অক্ষরগুলো সহজেই ফুল-লতাপাতা ও জ্যামিতিক নকশার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অলঙ্করণের কাজে ব্যবহার করা যায়।
হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কাছে জিবরাঈল (আ) প্রথম বাণী নিয়ে এসেছিলেন—‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক।’ ‘পড় তোমার প্রভুর নামে যিনি (মানুষকে) সৃষ্টি করেছেন; ঘনীভূত রক্তপিণ্ড থেকে। পড় তাঁর নামে, যিনি পরম করুণাময় ও দয়ালু। যিনি মানুষকে শিখিয়েছেন কলমের ব্যবহার, আর দান করেছেন সেই জ্ঞান যা ছিল মানুষের অজানা।’ (সূরা আলাক : আয়াত ১,২,৩,৪)
রাসুল (সা,) লিখতে পারতেন না, সাহাবীরা আল্লাহর বাণী পাথরের গায়ে, দেয়ালে, গাছের ছালে লিখে রাখতেন। যারা এই আল্লাহর বাণী সুন্দর মনোরম করে লিখতেন, তারাই কাতিব। কাতিবদের মর্যাদা ছিল অনেক ঊর্ধ্বে। রাসুল (সা.) কাতিবদের ভালোবাসতেন। তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করতেন। রাসুল (সা.)-এর জামাতা হজরত আলী (রা.) স্বয়ং ক্যালিগ্রাফার ছিলেন। তিনি কোরআনের আয়াতকে চমত্কার করে লিখে রাখতেন। তিনি বলতেন, ‘সুন্দর হস্তাক্ষর সত্যকে স্বচ্ছ করে তোলে।’ আল্লাহ নিজে সুন্দর এবং তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। যারা সুন্দরের চর্চা করেন তাদেরকেও পছন্দ করেন।
রাসুল (সা.) ক্যালিগ্রাফি শিল্প এবং শিল্পীদের পছন্দ করতেন ও এই শিল্পের প্রচার প্রসারে কাজ করেছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, বদরের যুদ্ধে যেসব বন্দি মুক্তিপণ দিতে অক্ষম ছিল তাদের প্রত্যেককে দশজন মুসলমানকে লেখাপড়া শিক্ষা দেয়ার শর্তে মুক্তি দেয়া হয়। এই শিক্ষাদানের মধ্যে ক্যালিগ্রাফিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এ থেকেই ক্যালিগ্রাফির প্রতি মুসলমানদের প্রতি রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসার গভীরতা নিরূপণ করা যায়। সে সময়ে শুধু রাসুল (সা.)-এর কাছে নয়, মুসলমান সমাজে সর্বস্তরে ক্যালিগ্রাফি এবং ক্যালিগ্রাফি শিল্পীদের কদর ছিল। মুসলিম শাসকরা শিল্পীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান ছাড়াও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা দান করতেন। আব্বাসীয় আমলে রাষ্ট্রনায়করা ক্যালিগ্রাফি চর্চা ও প্রসারে সহায়তা করেছেন। অক্ষরকে বিশেষভাবে বিন্যাসের মাধ্যমে সুন্দর আকর্ষণীয় রূপ দেয়া এবং ইসলামী আদর্শকে সামনে রেখেই অতীতে সমগ্র বিশ্বের মুসলিম রাষ্ট্রগুলোতে ক্যালিগ্রাফি চর্চা হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সুরা আল বাকারার ৩১ নং আয়াতের আলোকেই বিশ্বাস করা হয়। যেহেতু প্রত্যেক বস্তু সম্পর্কে আদম (আ)-কে অবহিত করা হয়েছে সেহেতু তাঁকে আরবি সম্পর্কেও অবগত করানো হয়েছে। এই বিশ্বাসের আলোকেই বিভিন্ন তথ্যে বলা হয়েছে যে আদম (আ) এরপর তার পুত্র শীষ (আ) আরবি বর্ণ ও বিন্যাসের উত্কর্ষ সাধন করেন। এমনিভাবেই বংশানুক্রমে তাঁরাই আরবি ভাষার বিকাশ সাধন করেছেন। আব্বাসীয় আমলে মুসলিম সভ্যতার যখন স্বর্ণযুগ, তখন আরবি ভাষা আন্তর্জাতিক ভাষা হিসেবে সারা বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করেছিল বলে জানা যায়।
গ্রিক কধষষড়ং এবং এত্ধঢ়যবরহ শব্দ দু’টির মিলিত রূপ ‘ক্যালিগ্রাফিয়া’ থেকে ইংরেজি ‘ক্যালিগ্রাফি’ যার অর্থ ‘সুন্দর লেখা’ হস্তলিখন শিল্প।
পৃথিবীর আরও অনেক ভাষায় ক্যালিগ্রাফি হয়েছে। যেমন- চীন, জাপানে ছবি আঁকা শুরু করতে হয় ক্যালিগ্রাফি দিয়েই। অন্য কোনো দেশের বর্ণমালা এত সুন্দর করে আঁকা সম্ভব হয় না। তাই আরবি ক্যালিগ্রাফি ব্যাপক বিকাশ লাভ করেছে। মানব মুখে প্রথম উচ্চারিত ভাষা আরবি, বেহেশতের ভাষা আরবি পৃথিবীর প্রথম ভাষা আরবি, পবিত্র গ্রন্থ আল কোরআনের ভাষা আরবি। আরবি অক্ষর ইসলামী শিল্পকলাকে দিয়েছে বিশিষ্ট রূপ ও শিল্পগত ঐক্য। আরবি লিপিকলা ইসলামে বিশেষ মর্যাদা পেয়েছে। চিত্রের স্থান দখল করে রয়েছে আরবি ক্যালিগ্রাফি। সুন্দর লিপিই হচ্ছে শিল্পের মাধ্যমে ইসলামের বাণী প্রচারের উপায়। কোরআনের বাণী হচ্ছে আল্লাহর বাণী, যা মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত হচ্ছে। আল্লাহকে আমরা দেখি না, কিন্তু তাঁর বাণী তিলাওয়াতের সময় আমরা দেখি। কাজেই শিল্পীরা অক্ষরগুলোকে হৃদয়গ্রাহী করার জন্য বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেছেন এবং তারা এ কাজকে আল্লাহর ইবাদত মনে করেছেন। এ জন্যই ক্যালিগ্রাফি সুন্দর, পরিচ্ছন্ন এবং পবিত্র। কোরআনের এই ভাষাকে অবলম্বন করে যে লিখন শিল্প মুসলিম দেশগুলোতে গড়ে উঠেছিল, তা সারা বিশ্বের জন্য অতুলনীয় শিল্প সম্পদ। কোরআনের বিভিন্ন আয়াত সুন্দর হস্তাক্ষরের মাধ্যমে বিশেষভাবে গেঁথে দেয়ার চেষ্টা হয়েছে। কাজেই এ ভাষার একটা অলৌকিকতা আছে। তাই যুগ যুগ ধরে কোরআনের বাণীকে সুন্দর লিখন পদ্ধতিতে ধারণ করে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। সুতরাং এক অর্থে হস্তলিখিত কোরআন অলৌকিকতা ধারণ করে রাখার চেষ্টা করেছে। হস্তলিখিত কোরআনের বাণী হচ্ছে অলৌকিক বাণী শৈল্পিক রূপব্যঞ্জনা। মুসলমানরা একে উচ্চাঙ্গ শিল্পে পরিণত করেছে। এই লিখন পদ্ধতির প্রকৃতি একক নয়, বহুবিধ। কিন্তু সর্বক্ষেত্রে একটি শৈল্পিক রূপ লক্ষ করা যায়। তা হচ্ছে অক্ষরগুলো লম্বা এবং সমান্তরাল স্বভাবের। এই দুই বৈপরীত্যের মাধ্যমে শিল্পীরা লিপিকর্মে সৌন্দর্য নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। যেমন আল্লাহ শব্দটিতে যে কয়টি অক্ষর আছে, সে কয়টি লম্বা স্বভাবের। এই লম্বা স্বভাবটি সমান্তরাল স্বভাবের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে যে বিচিত্র রূপ-দ্যোতনা সৃষ্টি করেছে, তা লিপিকর্মে অতুলনীয়। ফুল, লতাপাতা ও জিওমেট্রিক্যাল ফর্মের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে কোনোভাবে এই লিপিকে উপস্থাপন করা যায়, যা অন্য কোনো ভাষার লিপি দ্বারা সম্ভবপর নয়। তাই আরবি ক্যালিগ্রাফি এত ব্যাপকভাবে বিকাশ লাভ করেছে।
মুঘল লিপিকলা : মুঘল সম্রাটরা লিপিকলার মহান পৃষ্ঠপোষক এবং তাদের মধ্যে অনেকেই নিপুণ লিপিকারও ছিলেন। ১৫০৪ খ্রিস্টাব্দে ‘খত্তেতবই বাবুরি’ বা বাবুরি লিপি নামে একপ্রকার হস্তলিপি প্রচলন করেন। ঐতিহাসিক বাদায়ুনীর মতে, তিনি নিজ হাতে বাবুরি লিপিতে এক জিলদ কোরআন শরীফ নকল করে মক্কা শরীফে পাঠান। তাঁর পৌত্র সম্রাট আকবর ছিলেন শিল্পের পরম সমঝদার ও জ্ঞানের পৃষ্ঠপোষক। বহু চিত্রকর ও লিপিকার তার দরবার অলঙ্কৃত করতেন। তাদের তিনি গুণ ও নৈপুণ্যের জন্য অকাতরে পুরস্কৃত করতেন আর সম্মানজনক খেতাব দান করতেন। জায়গীর রূপে ভূ-সম্পত্তি এবং মাঝে মাঝে উচ্চ সরকারি পদও দান করতেন। আকবরের রাজত্বকালে যেসব বিখ্যাত লিপিকারের আবির্ভাব হয়েছিল (তাবকিয়া-ই-খুশ নবীশান বা লিপিকার স্মৃতি নামক পুস্তকে এদের প্রায় সবারই উল্লেখ আছে)। আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন, কাশ্মীরবাসী মুহাম্মদ হুমায়ুনের নাম (মৃত্যু ১০২০ হিজরি)। তিনি ‘বরবীন কলম’ বা ‘স্বর্ণ কলমধারী’ নামে পরিচিত। বাদশাহ আকবর তাকে এই সম্মানজনক খেতাবটি দিয়েছিলেন। মনোজ্ঞ লিপিকলায় আইন-ই-আকবরীর মনোরম চিত্রশোভিত এমন একটি চমত্কার পাণ্ডুলিপি উজ্জয়িনীতে ছিল। পরে লন্ডনে নিয়ে রাখা হয়। অন্য লিপি শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন মোল্লা মীর আলী ও তার শিষ্য মাওলানা বাকী মাশহাদের মুহাম্মদ আমীন মীর হুসাইনী কুলানকী, মাওলানা আবদুল হাই, মাওলানা দাত্তরী, সুলতান বায়যীদ (আকবর তাকে কাতিবুল মূলক বা রাজ্যের লিপিকার খেতাবে ভূষিত করেছিলেন)। মাওলানা আবদুর রহীম আমবরীন কলম। তিনি প্রসিদ্ধ নামতালীফ লেখক ছিলেন এবং পারস্য কবি নিযামীর খামসা (পঞ্চমী) নকল করেছিলেন। কাশ্মীরের আলী চমন, নূরুল্লাহ কাসিম আরমালান, শিরাজের খাজা আবদুস সামাদ মুয়াফ্ফর আলী, কান্দাহারের মীর মাসুদ (তিনি ফতেহপুর সিক্রির অট্টালিকার শিলালিপিগুলো নিজ হাতে লিখেছেন)। আশরাফ খান নামে পরিচিত মুহাম্মদ আসগর। তিনি নাসতালিফ লিপির বিশেষজ্ঞ এবং হস্তলিপিতে পারদর্শী ছিলেন। অর্থাত্ নসথ লিপির ছয় প্রকার রীতি নাসতালিফ লিপিতে বুত্পত্তিসম্পন্ন ছিলেন। (ওই ছয়টি রীতি সাধারণত ইবনমুকলা দ্বারা প্রচলিত হয়েছিল বলে কথিত হয়) সেই সময় কয়েকজন প্রসিদ্ধ হিন্দু লিপিকারও ছিলেন। যথা- রাও মনোহর, পণ্ডিত জগনাথ এবং লিপিকলার প্রতি সম্রাট জাহাঙ্গীরের আকর্ষণ তার কৃতী পিতার চেয়ে কম ছিল না। তার আত্মজীবনী থেকে প্রতীয়মান হয় যে তিনি ফরাসি ভাষায় সুলেখক ছিলেন। তার পূর্ববর্তীদের মতো তিনিও লিপিকারদের একজন বড় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
এই লিপিকারের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন তরবীয়ের মীর আবদুল্লাহ। তিনি মুশকীন কলম (কস্তুরী গন্ধী কলমধারী) নামে পরিচিত। আকবর তাকে এই খেতাব দিয়েছিলেন। তিনি হস্তলিপি রীতিতে পারদর্শী ছিলেন। অন্য লিপিকারদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সামাদ শিরিন কলমের পুত্র মুহাম্মদ শরীফ। শিকাসতা লিখনরীতিতে পারদর্শী মিরযা মুহাম্মদ হুমায়ুন। হিরাতের মুহাম্মদ ইবনে ইসহাক। তিনি মিরযা কামরানের দীওয়ান নকল করেছিলেন এবং সবশেষে তগরারীতি লেখক আহমদ আলী আরশাদ। তিনি ফতেহপুর সিক্রির বিরাট ফটকের পশ্চিম দিকের শিলালিপিগুলো লিখেছিলেন। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালের প্রথমদিকে তিনি ‘নাসতালীফ’ লিখনরীতির প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়েছিলেন যে যারা তার অনুসরণ করত তিনি তাদের পুরস্কৃত করতেন। তাযফিয়া-ই খুশনবীশান পুস্তকে লিখিত আছে যে সম্রাট এই অনুকরণকারীদের একশ’ ঘোড়সওয়ারের পরিচালনার পদে নিযুক্ত করতেন। তার সময়ে অনেক অভিজ্ঞ লিপিকার ছিলেন শিরাযের আবদুল হাই ওরফে আমানত খান মীর আবদুল্লাহ মুশকীন রকমের পুত্র তররীযের মীর সালিহ, নমখ লিপিতে পারদর্শী এবং শাহজাদা আওরঙ্গজেবের গৃহশিক্ষক আবদুল বাকী। তিনি তিরিশ পাতায় সম্পূর্ণ কোরআন শরীফ নকল করে সম্রাটকে উপহার দেয়ায় ‘য়াকুত রকম’ (রত্ন লেখনি ধারক) খেতাব পেয়েছিলেন।
সম্রাট আওরঙ্গজেব ছিলেন ঈমান আকিদার দিক দিয়ে প্রকৃত মুসলমান। প্রাণী চিত্রাঙ্কনের যে ধারা চলছিল, তিনি এগুলো বন্ধ করেছিলেন কিন্তু লিপিকলার একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি এই কলাটি শিখেছিলেন তার গ্রন্থাগারিক ও দরবারী লিপিকার মীর ইযাদের কাছ থেকে সাইদ আলী খান জওহর রকমের (হীরক লেখনী ধারক) কাছে। শাহানশাহ নমখ ও নাসতালীফ উভয় লিপিতেই পারদর্শী ছিলেন। তবু তিনি আর একজন সমসাময়িক লিপিকার ও দরবারী গ্রন্থানিক কমল হিদায়িতুল্লাহ খানের লিপির তারিফ করতেন। সম্রাটের পত্রাবলীতে এর উল্লেখ আছে। এই সময়ে আর একজন জওহর রকম ছিলেন শামছুদ্দীন আলী খান। আওরঙ্গজেবের সময়েও কয়েকজন হিন্দু লিপিকার ছিলেন, যথা পণ্ডিত লক্ষ্মীরাম লাল, সুখরাম মুনশী, মাহবুব রায়ম, মুনশী কমল রায়। মুঘল সাম্র্রাজ্যের অবনতির দিনেও লিপিকলার উন্নতি অব্যাহত থাকে। ফর্রুখ শিয়রের আমলে হাজী নামদার ও মিরযা খাতিম বেগ সুপরিচিত লিপিকার ছিলেন।
দ্বিতীয়ত : আকবরের সময় যে কয়জন লিপিকার খ্যাতিলাভ করেন, তাদের মধ্যে আছেন মীর মোহাম্মদ হুমায়ুন, গুলাম আলী খান, হাফিজ ইব্রাহিম, হাফিজ বরকতুল্লাহ, মীর আবুল হামায, মীর যয়নুল আবেদীন, মীর মাহদী এবং খাজা গুলাম নকশাবন্দ খান। শেষ মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহও একজন শিল্পী, কবি ও লিপিকার ছিলেন। দিল্লিতে যীনত মহলের এবং হামীম আহসানুল্লাহ খানের হামমামের শিলালিপিতে রক্ষিত আছে। এগুলো তার অপূর্ব নৈপুণ্যের স্বাক্ষর দিল্লির জাদুঘরেও তাঁর লিপির নিদর্শন রক্ষিত আছে। তার সময় নিপুণ লিপিকার ছিলেন মুহাম্মদ জান, মীর ইমাদ আলী ও তার পুত্র মীর জালালুদ্দীন।
মুসলিম কৃষ্টিধারায় লিপিবিদ্যার স্থান অতি উচ্চে। বিভিন্ন মুসলিম রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থায় লিপিকলা ছিল পাঠ্যসূচির একটি অপরিহার্য অঙ্গ। আরব ও পারস্যবাসী লিপিকলার উদ্ভাবন করেন।
লিপিকলার কিছু রূপ ও রীতির নাম—খততই আনিফা, খততই যুলফ, খততই পায়চান, খততই নাখুন, খততই তাওয়াম। এর অধিকাংশই লিপিকারের নৈপুণ্য প্রদর্শনে ও অলঙ্কারের উদ্দেশে ব্যবহৃত হতো।
একদানা চালের ওপর কোরআন শরীফের একটি সম্পূর্ণ আয়াত অঙ্কিত করতে পারা শিল্পের এবং লিপিকারের নৈপুণ্য প্রদর্শনের প্রকৃষ্ট পন্থা ছিল।
মুঘল সাম্রাজ্যের ভাঙনের পরে বহু বিখ্যাত আলিম ও গুণী কবি লখনৌতে চলে যান। তখন সেখানে সর্বপ্রকার শিল্প, সাহিত্য ও কৃষ্টি কেন্দ্রে পরিণত হয়। ১৭৯২ খ্রি. দিল্লিতে যে ওরিয়েন্টাল কলেজ স্থাপিত হয় এর পাঠ্যসূচির লিপিকলা অন্যতম শিক্ষনীয় বিষয় বলে নির্দিষ্ট হয়েছিল। সাঈদ মুহাম্মদ নামক একজন বিখ্যাত লিপিকারকে এই কলাবিদ্যার অধ্যাপক নিযুক্ত করা হয়েছিল।
আধুনিক কালেও আমরা দেখি ইরান, পাকিস্তান, সুদান ও নাইজেরিয়ার এই লিপিশিল্প অসাধারণ সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে প্রকাশ পেয়েছে।
ইরানের জলিল রাসুলী, সৌদি শিল্পী আহম্মদ মোস্তফা আরবি লিপিকলাগুলোকে ক্যানভাসে চমত্কার অনুজ্জ্বল রঙে নান্দনিকভাবে উপস্থাপন একান্তই নিজের। তার ছবিটির নাম ‘দি ওয়ারিয়র অব বদর’।
ইরাকের বিখ্যাত শিল্পী জামিল হামদি আরবি লিপিকে জ্যামিতিক ফর্মে উপস্থাপন করেছেন নিজস্ব রীতিতে। শিল্পী যুুদা মালাম তার ছবির বিষয়বস্তুর সঙ্গে লিপির সমন্বয় ঘটিয়েছেন। শিল্পী শাকের হাসান তার ফর্মের সঙ্গে ক্যালিগ্রাফি উপস্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনীতে স্বর্ণ পেয়েছিলেন ইরাকের বিখ্যাত শিল্পী ‘সাদী আল কাবী’। তার ছবির বিষয়বস্তু ছিল ক্যালিগ্রাফি ‘মরুভূমির শিলালিপি’। গত ১৯৯১ সালে এশিয়ান চারুকলা প্রদর্শনীতে পাকিস্তানের বিখ্যাত শিল্পী গুলজীর লিপিশৈলী-১,২,৩,৪ নামে ৪টি ছবি প্রদর্শিত হয় এবং দর্শকের দৃষ্টি কাড়ে। ক্যানভাসে স্পেচুলা ও কোথাও ব্রাশ দিয়ে মোটা তেল রঙে তাঁর যে ব্রাশিং, তা দর্শকদের মুগ্ধ করে। তার ছবি মনে হয় আরবি লেখা কিন্তু কি লেখা বোঝা দুরূহ অর্থাত্ একটা ইলিউশন তৈরি করেছেন। ২০০১ সালে জানুয়ারি মাসে রিয়াদে অনুষ্ঠিত হয় আধুনিক ক্যালিগ্রাফি শিরোনামে একটি প্রদর্শনী। মিসরের সাইয়েদ ইব্রাহীম মো. সাব্বির আল হিলালী, তিউনিসের মো. ছালেহ আল খুমসি, ইরাকের হাশেম বাগদাদে অংশগ্রহণ করেন। প্রদর্শিত ক্যালিগ্রাফিগুলো চিত্রায়ণ হয় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। চমত্কার কম্পোজিশন রঙ ও রেখায় বিমূর্ত শিল্পে উন্নীত করা হয়েছে।
এই লিখন পদ্ধতি পাশ্চাত্যের আধুনিক শিল্পকলায় প্রভাব বিস্তার করেছে। তার প্রমাণ আমরা পাই বিখ্যাত শিল্পী পল ক্লী’র বিভিন্ন চিত্রকর্মে। তার ‘ডকুমেন্ট’ বা দলিল নামে ছবিটির কতগুলো আরবি বর্ণমালা ছাড়া আর কিছু নয়। রেখাঙ্কনেও আমরা আরবি লিখন পদ্ধতির প্রভাব লক্ষ্য করি। আরবি ক্যালিগ্রাফি ইউরোপীয় শিল্পেও প্রভাব বিস্তার করেছে। আরবি না জেনেও ইউরোপীয়রা আরবি লেখার অনুকরণে নকশা করেছে। কাপড়ের বুননে ও নকশায় আরবি লিপিকলার অনুসরণ করার চেষ্ট করা হয়েছে।
আধুনিক শিল্প আন্দোলনের অন্যতম দিকপাল পাবলো পিকাসোর জন্ম স্পেনের আনদানুমিয়া অঞ্চলে। এই অঞ্চল আরবদের অধীন ছিল প্রায় ৭শ’ বছর। এখানকার নকশায় ইসলামী জ্যামিতিক মণ্ডনকলার প্রভাব খুবই স্পষ্ট। পিকাসোর ছবিতেও একসময় জ্যামিতিক নকশার প্রভাব দেখা যায়।
আধুনিক শিল্প আন্দোলনের বিখ্যাত শিল্পী আঁরি মাতিস তার ছবির অনুপ্রেরণা পান ইরানি গালিচা থেকে। তার ছবির রঙ ও ফর্ম গালিচা থেকে নেয়া। তিনি তার শিল্পে অবিমিশ্র রঙের পাশাপাশি সংস্থাপনের মাধ্যমে রঙের আবেদন ফুটিয়ে তুলেছেন।
বিংশ শতাব্দীর চিত্রশিল্পে ইসলামী শিল্পের বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রভাব পড়েছে। বিমূর্ত শিল্পের জনক মন্ডিয়ন ক্যালিগ্রাফি শিল্পে মুগ্ধ হয়ে বিমূর্ত শিল্পের জন্ম দিয়েছেন। বিমূর্ত শিল্পের ফিগার নেই, ফর্ম আছে। শিল্পীরা ক্যালিগ্রাফির আদলে ফর্ম ব্যবহার করেছেন তাদের চিত্রকর্মে। বলা যেতে পারে পৃথিবীর শিল্পের বিমূর্ততার উদ্ভব এখান থেকেই।
পৃথিবীর সব দেশেই আজ ইসলামী শিল্প নিয়ে নিরীক্ষা চলছে, ধর্মগত কারণে নয়, শিল্পের বৈশিষ্ট্যগত কারণে। কাজেই ইসলামী শিল্পধারা একটি স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী শিল্পধারা হিসেবে আজ পরিগণিত। অর্থাত্ কোরআনিক কালচারাল ক্যালিগ্রাফি নিয়ে বাংলাদেশেও ৭০ থেকে ৮০ দশক পর্যন্ত অনেক খ্যাতিমান শিল্পী কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে মুর্তজা বশীর, শামসুল ইসলাম নিজামী, খুরশিদ আলম, অধ্যাপক আবদুস সাত্তার, সাইফুল ইসলামসহ আরও অনেকেই। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তেমন বিকাশ ঘটেনি। ৯০’র দশক থেকে বাংলাদেশেও কোরআনিক কালচার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয় অবশ্য এর সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন শাখায়। দেশের একদল তরুণ এই ধারা পুনর্জাগরণের আন্দোলনে নিয়োজিত। তারা শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমে সংগঠিত হয়ে কাজ করতে থাকে। ঢাকা সাহিত্য সংস্কৃতি কেন্দ্র নামক সংগঠন গড়ে ওঠে, যার রয়েছে শিল্পের বিভিন্ন মাধ্যমের ১৭টি শাখা। তাদের উদ্দেশ্য ইসলামী কালচার তথা কোরআনিক কালচারকে সমৃদ্ধ করে ব্যাপকভাবে মানুষের কাছে তা গ্রহণযোগ্য করা।
দেশের ক্যালিগ্রাফারদের নিয়ে গঠিত হয় ‘ক্যালিগ্রাফি সোসাইটি বাংলাদেশ’। পবিত্র সিরাতুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ১০টি ক্যালিগ্রাফি প্রদর্শনী জাতীয় জাদুঘর গ্যালারিতে পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠিত হয়। প্রচুর দর্শক-সমালোচকের মধ্যে সাড়া জাগাতে সক্ষম হয়, দেশের শীর্ষ পর্যায়ের শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন, মিডিয়াগুলোতে সাড়া পড়ে। এর ফলে সামাজিকভাবেই পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। ক্যালেন্ডার, ভিউকার্ড, গৃহসজ্জাসহ মসজিদ ডেকোরেশনে ক্যালিগ্রাফির ব্যবহার বেড়ে যায়।
বাংলাদেশে এই শিল্পমাধ্যমটি নিয়ে এখন যারা কাজ করছেন তারা হচ্ছেন—মর্তু বশীর, ড. আবদুস সাত্তার, সৈয়দ এনায়েত হোসেন, বশীরউল্লাহ, রেজাউল করীম, ফরেজ আলী, সাইফুল ইসলাম, ইব্রাহীম মণ্ডল, আরিফুর রহমান, জাহাঙ্গীর হোসেন, আমিনুল ইসলাম, মনিরুল ইসলাম, শহীদুল এফ বারী, মাহবুব মোর্শেদ, কৃষান মুশাররফ, বশীর মেজবা, আবদুর রহীম, মুবাশ্বির মজুমদার, আমিনুল হক, মুস্তফা মারুফ, আবু দারদা, নিশার জামিল, ফেরদৌস আরা আহমদ ও ফেরদৌসী বেগম। প্রদর্শনীগুলোতে দর্শকের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীর সংখ্যাও। শিল্পীরা শুধুু দেশে নয়, বিদেশি প্রদর্শনী ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করছে, পুরস্কারও পাচ্ছে। এতে বাংলাদেশে একটা সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।
কোরআনিক কালচার এবং ইসলামী শিল্পের এই মাধ্যম ক্যালিগ্রাফি নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হচ্ছে।
দেশের সীমানা ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করে শিল্পীরা প্রচুর সুনাম কুড়িয়েছেন। বিভিন্ন দেশের আমন্ত্রণে প্রদর্শনী ও সেমিনারে অংশ নিচ্ছেন। এর মাধ্যমে মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে ইসলামিক কালচারের একটা সেতুবন্ধন তৈরি হচ্ছে।
আজ শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারাবিশ্বে সংস্কৃতির নামে চলছে অশ্লীলতা, বেহায়াপনা। চলছে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, মুসলমানরা হচ্ছে জুলুম নির্যাতনের শিকার। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে আমাদের কোরআনিক কালচারকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আমরা বিশ্বাস করি শিল্প শুধু শিল্পের জন্য নয়। শিল্প সত্যের জন্য, শিল্প সুন্দরের জন্য। ইসলামী শিল্প বিশেষ করে ‘ক্যালিগ্রাফি’ সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, সুনীতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে, শুভ চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে, মানব চরিত্র উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইসলাম মানুষকে শুদ্ধ করে এবং শুভ কাজে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং ইসলামের সঙ্গে যে শিল্পের সম্পর্ক সে শিল্প কল্যাণকর হবেই। সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
বর্তমান বিশ্বে ইসলামের পুনর্জাগরণ শুরু হয়েছে। এর সঙ্গে প্রয়োজনীয় উত্সাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা পেলে বাংলাদেশেও ইসলামী কালচার ক্যালিগ্রাফি শিল্পের পুনর্জাগরণ ঘটবে বলে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।
তথ্যপঞ্জি
১. Civilization Past and Present.
২. ইন্দো মুসলিম আর্ট—ড. এনামারী সিমেল
৩. শিল্প, সাহিত্য, সাংহমলধতি—মাওলানা আবদুর রহীম
৪. মুসলিম শিল্পকলা—সৈয়দ আলী আহসান
৫. ইসলাম ও শিল্পকলা—সৈয়দ আলী আহসান
৬. ইসলামী শিল্পকলা—এবনে গোলাম সামাদ

ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ | ড. কাজী দীন মুহম্মদ


বিংশ শতাব্দী বাংলার মুসলমানের রেনেসাঁর যুগ। একালে যে সকল মনীষী মুসলিম জাগরণের জন্য নানাভাবে সাধনা করে গেছেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অন্যতম অগ্রগণ্য। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সে কালে মুসলিম রক্ষণশীল ও সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পড়তে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়েন। সংস্কৃতের এমএ পাঠক্রমে বেদ-শাস্ত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেদ পড়াতেন বিখ্যাত বৈদিক পণ্ডিত সত্যব্রত শামশ্রমী। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান প্রাচীনপন্থী গোঁড়া পণ্ডিত ছিলেন। মুসলমান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছাত্র হবেন এবং তিনি তাঁকে বেদ পড়াবেন—এ হয় না। এ সম্বন্ধে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন যে, ‘বিধর্মী’কে তিনি বেদ পড়াবেন না। ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধেও তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না; বরং তিনি পদত্যাগের হুমকি দিলেন। এ ব্যাপারে সে সময় কলকাতায় বিশেষ আন্দোলন হয়। বিশেষ করে তখনকার দিনের বিখ্যাত মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী, যিনি সে সময় উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁর সুপরিচিত ইংরেজি পত্রিকা কমরেড (ঈড়সত্ধফব) প্রকাশ করতেন, তিনি ঞযব ঝযধযরফঁষষধয অভভধরত্ শীর্ষক কতকগুলো জোরালো প্রবন্ধ লেখেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এভাবে লোকের চোখের সামনে এসে পড়েন। এ নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার, বিলেতে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা ইত্যাদি কারণে তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নাম বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষিত মহলে বহুল আলোচিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এ ব্যাপারে বিব্রতবোধ করেন এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে ঈড়সঢ়ধত্ধঃরাব চযরষড়ষড়মু বা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে এমএ পড়ার পরামর্শ দেন। তখন বিভাগটি সবেমাত্র খোলা হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার পরামর্শ মেনে নেন। তিনি ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে যথারীতি এমএ পাস করেন। এ সঙ্গে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে তিনি আইন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। এরও প্রায় এক যুগ পরে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি ডি-লিট এবং ধ্বনি-বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ডিপ্লোফোন লাভ করেন।
এরপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাতক্ষীরায় ওকালতি আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল বিদ্যাচর্চার দিকে, পঠন-পাঠন ও গবেষণার দিকে। ওকালতিতে তিনি মন বসাতে পারেননি। স্যার আশুতোষ তাঁর গুণগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিজের হিতৈষী গুরুর মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন। স্যার আশুতোষ তাঁকে আইন ব্যবসা ছেড়ে বিদ্যার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে উপদেশ দেন। মূলত তাঁরই উত্সাহে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লক্ষ্মীর রত্নভাণ্ডার ত্যাগ করে সরস্বতীর পুষ্পোদ্যানে স্থান লাভ করেন এবং তাঁর কালে বাংলা তথা ভারতবাসী হিন্দু-মুসলমানের মানসিক উত্কর্ষের পক্ষে বিশেষ লাভ ও উপকার হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঐঁসধহরঃরবং বা ‘মানবিকী’ বিদ্যায়, অর্থাত্ ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস-সমাজনীতি-অর্থনীতি-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-আধ্যাত্মিকতার সাধন এবং রস অর্থাত্ শাশ্বত সত্তার মধ্যে নিহিত যে আনন্দের অনুভূতি—এসব বিষয়ে তিনি একজন ‘সর্বন্ধর’ আচার্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।

পণ্ডিতমহলে অনেকেই বলে থাকেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন গড়ারহম ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ—চলন্ত বিশ্বকোষ বা জীবন্ত অভিধান। অনেকের ধারণা যে, তিনি প্রায় দুই কুড়ি ভাষা জানতেন। একবার কারো কোনো লেখায় ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঊনচল্লিশটি ভাষা জানেন’ বলে উল্লিখিত হয়। আমরা কয়েকজন এদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : তারা অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলেন। আসলে তিনি খুব ভালো করে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারতেন বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ট, উর্দু, হিন্দি, সিংহলি, কাশ্মীরি, নেপালি, অহমিয়া, ওড়িয়া, পোশতু এবং আরো কয়েকটি ভাষা। আর পড়তে ও বুঝতে পারতেন আরো দু’ডজনের মতো ভাষা। এক কথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন ইংরেজিতে যাকে বলে চড়ষুমষড়ঃ—বহুভাষিক। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ও ভাষা বিশ্লেষণে বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান, বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার তাত্পর্য ব্যাখ্যায় তাঁর তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছিল—যা তাঁর তাত্ত্বিকতার মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বস্তুত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞানপরিধির বিস্তার আমাদের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত বলতে পারি, এ এলাকায় যে ক’জন ভাষাতত্ত্বের অনুশীলনে নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে ঋণী। তাঁরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণায় তারা ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় আত্মনিয়োগে সমর্থ হয়েছেন। আমার নিজেরও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র উত্সাহ ও প্রেরণায়ই হয়েছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমাদের দেশ-জাতি-ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। গবেষণা ছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে তাঁর অগাধ জ্ঞান, কোরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ক তাঁর সুবিজ্ঞ আলোচনা সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তিনি ফরাসি, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ইত্যাদি নানা ভাষায় বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র অবদান সম্বন্ধে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব।

ভাষাতত্ত্বমূলক আলোচনা আমাদের দেশে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব তিন-চার শতকে যাস্ক, পাণিনি প্রভৃতি ভাষাবিজ্ঞানী বিবৃতিমূলক ভাষাতত্ত্বের প্রথম সূত্রপাত করেন। পাণিনি ছিলেন পাকিস্তানি। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে কালাতুর গ্রামে তিনি বাস করতেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মী ও উত্তরসূরিরা সে অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন কথা আর্য ও সংস্কৃত ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাদের আলোচনার পদ্ধতি ও ধারা আজও বিবৃতিমূলক ভাষাবিজ্ঞানের আদর্শস্থানীয় হয়ে রয়েছে। বর্তমানের ইউরোপ ও আমেরিকার আধুনিক ভাষাতত্ত্বেও আলোচনা তাঁরই আদর্শ অনুসরণ করে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ যুগেও পাশ্চাত্য দেশে পাণিনির ব্যাকরণকে মানুষের জ্ঞানের চরম নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।
পাণিনির পরেও অনেক দিন পর্যন্ত পাক-ভারতে এই ধারায় ভাষা-বিষয়ের আলোচনা অব্যাহত ছিল। পাণিনির মতো পতঞ্জলি প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী এই উপমহাদেশে বর্ণনাভিত্তিক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। এরপর কিছুকাল আমরা আমাদের নিজেদের ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বোধকরি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতোই ভাষাতত্ত্বের আলোচনায়ও ভাটা পড়ে। ইউরোপ তথা পশ্চিম গোলার্ধ ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অনুশীলনীতে হাত দেয় আরো অনেক পরে। পশ্চিমের চোখে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলির আবিষ্কার এক মহাবিস্ময়। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের মূল সূত্রটি এখান থেকেই নিয়ে তারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিজেদের ভাষার বিশ্লেষণ শুরু করলেন।
কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভাষাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই দেখা হতো। সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার শব্দসম্ভারে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্য, মিল-গরমিল বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের ভাষাগুলোর স্বরূপ নির্ণয়ই ছিল তখনকার দিনের মোটামুটি ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা।
আজ আবার পুরনো ধারার নবজাগৃতির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের দিকেই আবার সবার নজর ফিরেছে। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় দেশি ও বিদেশি মনীষীর অবদানের ইতিহাস বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু তাদের বিচার-বিশ্লেষণের স্বরূপ বোঝার জন্য তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিঞ্চিত্ আলোচনার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক বুঝতে হলেও এদের সামগ্রিক
আলোচনার একটি মোটামুটি আভাস জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন। এর আগে ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলে নিলে আমাদের আলোচনার সুবিধা হবে।
ভাষাতত্ত্বে তিন ধারার ভাষা সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে—প্রথমত, বর্ণনামূলক ধারা। একে ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ও বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব।
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বে ভাষাতাত্ত্বিক কোনো বিশেষ ভাষার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আলোচনার সুবিধার জন্য এই কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন : ১. ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) ২. ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology) ৩. রূপতত্ত্ব (Morphology) ৪. পদক্রম বা বাক্যরীতি (ঝুহঃধী) ৫. বাগর্থ বিজ্ঞান (Semantics) এবং ৬. অভিধান বিজ্ঞান (Lexicography)|
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের মূল কথা হলো, যে কোনো একটি ভাষার বিশেষ কালের বিশেষ রূপের বর্ণনা করা। তা করতে হলে সেই বিশেষ ভাষাভাষী লোকের মধ্য থেকে নির্বাচিত যে কোনো একজনের মুখের ভাষাই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এভাবে একেকটি উপভাষার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে সেই ভাষার সামগ্রিক বর্ণনা সম্ভব হয়। মানুষের মুখের ভাষা যেমন ব্যবহৃত হয়, তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে সূত্র নির্ণয় করতে হয়। এই ধরনের বর্ণনায় ভাষার কোন নিয়ম আছে আর কোন নিয়ম নেই, তারই উল্লেখ থাকে; ভাষায় কী হওয়া উচিত আর কী হওয়া উচিত নয়, সে ধরনের বিধি-নিষেধের স্থান সেখানে নেই। এমনকি কেন এমন হয়, কেন এমন হয় না, তারও বিশ্লেষণ সেখানে অসঙ্গত। ভাষায় ব্যবহৃত নানা উপাদানকে একটা বিশেষ সংজ্ঞার মাধ্যমে একটা পদ্ধতির বন্ধনে আবদ্ধ করে যে বিশ্লেষণ শাস্ত্র গড়ে ওঠে, তাকেই তখন বলা হয় সেই ভাষার ব্যাকরণ।
এভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য ভাষাবিজ্ঞানী তার আলোচনাকে উল্লিখিত কয়েক ভাগে ভাগ করে থাকেন। ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) শাখায় ভাষার ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ পদ্ধতি, তাদের ব্যবহার ও স্থানভেদে তাদের উচ্চারণে তারতম্য, উচ্চারণের ব্যবহার-সঙ্গতি, সন্ধি ও বণ্টন, যতি ও ছন্দোবিন্যাস, এমনকি লিখনপদ্ধতিতে তাদের রূপায়ণ ইত্যাদির যথাযথ আলোচনা হয়। উচ্চারণের স্থান ও রকম, এমনকি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও বিশদ আলোচনা সাধারণ ধ্বনিতত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত।
ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোচনায় বিশ্লিষ্ট বর্ণনাকে যখন গাণিতিক সংকেতে আবদ্ধ করা হয়, তখনই একে ধ্বনিতত্ত্ব নাম দেয়া হয়। অর্থাত্ ধ্বনিবিজ্ঞানে যা ছিল বস্তুসম্পৃক্ত (পড়হপত্বঃব), ধ্বনিতত্ত্বে তা হয়ে ওঠে নির্বস্তুক (ধনংঃত্ধপঃ)। বিজ্ঞানের আলোচনায় এই জগতের নানা পদার্থেরই স্বভাব, গতি, শক্তি ও গুণ নানা সংকেতে ধরা যায়। যেমন অংকশাস্ত্রে—১ (এক), ২ (দুই) অথবা (বর্গমূলক), . (দশমিক বিন্দু), + (যোগ চিহ্ন), - (বিয়োগ চিহ্ন), – (পূরণ চিহ্ন), % (ভাগ চিহ্ন) ইত্যাদি মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝানো হয়। ধ্বনিবিজ্ঞানের (Phonetics) বিশিষ্ট রূপও সেইরূপ নানা সংকেত ও চিহ্নের সাহায্যের ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) বিধৃত হয়। এক কথায় ধ্বনিবিজ্ঞানে (Phonetics), যার বিশ্লেষণ, ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) তারই গাণিতিক প্রকাশ। তাই ধ্বনিবিজ্ঞানে যাকে নানা কথায় বিশ্লেষণ করা হয়, ধ্বনিতত্ত্বে তাই হয় সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত কতকগুলো সংকেত বা সূত্রের (Formula) সমষ্টি। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের এই দুটি শাখাকে একই বিভাগের দুটি স্তর বা পর্যায় মনে করা যেতে পারে।
রূপতত্ত্ব (Morhphology) বিভাগে পদ ও শব্দসাধন পদ্ধতি অর্থাত্ পদ ও শব্দগঠন সম্পর্কিত নিয়মাবলি আলোচিত হয়। এতে সাধিত শব্দ বা পদের ধাতু, প্রত্যয়, অনুসর্গ, বিভক্তি প্রভৃতি ক্ষুদ্রতম অংশ নির্ণীত হয়। সমাস, অব্যয়, নিপাত ইত্যাদির আলোচনাও রূপতত্ত্বের প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্র। পদক্রম ও বাক্যরীতি (Syntax) বিভাগে আলোচিত হয় বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ ও পদগুলোর ক্রম আর বাক্য-বিশ্লেষণ পদ্ধতি।
মূলত রূপতত্ত্ব (Morphology) ও পদক্রম (Syntax) একই বিভাগের দু’টি স্তর বা পর্যায়। কেননা, শব্দ ও পদের অংশ নিরূপণ বাক্য মধ্যে শব্দের অবস্থান ও কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। তাই কেউ কেউ এই দু’টি শাখাকে মিলিতভাবে ব্যাকরণও বলে থাকেন। কিন্তু ব্যাকরণের কার্যবিধির ধারায় ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম—এই সমুদয়ের পর্যায়ক্রমে পৃথক পৃথক ও সম্মিলিত এবং সামগ্রিক আলোচনা ও বিশ্লেষণই বাঞ্ছনীয়; তাই একটিকে ছেড়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। চারটি বিভাগের বিশ্লেষণই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারো কারো ধারণা এই যে, যেহেতু ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম যথাক্রমে পরপর আলোচিত হয়, তাই এদের আলোচনার ধারাক্রমে এদের স্থান নির্ণীত হবে; যেমন ধ্বনিবিজ্ঞান নিম্নস্তরের, ধ্বনিতত্ত্ব তার পরের, রূপতত্ত্ব তারও পরের এবং পদক্রম সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু এরূপ ধারণা ভুল। আসলে এটি আলোচনার সুবিধার্থে এক ধরনের বিভাগ মাত্র, এতে স্তরের উচ্চতা-নিম্নতার প্রশ্ন নেই।
বাগর্থ বা শব্দার্থ-বিজ্ঞানে (Semantics) বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত শব্দ, শব্দসমষ্টি, বাক্যাংশের ও বাক্যের অর্থ নির্ধারণ ও তার প্রক্রিয়া নিরূপণ করা হয়। কালের ও স্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দার্থ কীরূপ বিকৃত, পরিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়, তার বিস্তারিত আলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত।
অভিধান-বিজ্ঞান বা অভিধানতত্ত্ব (Lexicography) বিভাগে বিশেষ ভাষার শব্দসম্ভার আর তার বিভিন্ন রূপ ও আকৃতি অনুযায়ী শৃঙ্খলা ও তার সঙ্গে অর্থের বিভিন্নতা ও প্রয়োগবিধি ইত্যাদি আলোচিত হয়। দেশি ও বিদেশি শব্দবিভাগ এবং কথায় ও সাহিত্যে এদের ব্যবহারবিধি—এসব এ বিভাগের আলোচ্য। দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক অভিধানে শব্দ ও বাক্যাংশের প্রতিশব্দ ও অনুবাদ উল্লিখিত হয়।
কেউ কেউ মনে করে, ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) হলো ভাষা বিশ্লেষণের পূর্ববর্তী স্তর (Prelinguistics) আর বাগর্থ-বিজ্ঞান (Semantics)-এর পরবর্তী স্তর। তাদের মতে যে কোনো ভাষা বিশ্লেষণে ধ্বনিতত্ত্বও বাগর্থ-বিজ্ঞান ভাষা বিশ্লেষণের স্তরবহির্ভূত। কিন্তু এসব আলোচনার স্থান এটি নয়।
যে কোনো ভাষার বর্ণনামূলক আলোচনায় এই নিয়মে বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়। এই আলোচনায় বিভিন্ন ভাষার আকৃতি ও প্রকৃতি এমন নিখুঁতভাবে বিবৃত হয় যে, প্রত্যেকটি ভাষার স্বাতন্ত্র্য কেবল ভাষাবিজ্ঞানী কেন, সাধারণের কাছেও স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। ভাষার এই আশ্চর্য ক্ষমতা ও সমাজ-জীবনে তার অদ্ভুত প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অন্যতম উদ্দেশ্য।
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে একই ভাষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কালের ধ্বনি, উচ্চারণ, শব্দরূপ, পদক্রম, শব্দসম্ভার ও অর্থ কী ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে, তার বর্ণনা থাকে। একই ভাষার বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাষার একই সময়ে অথবা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন সময়ে যে মিল-গরমিল ধরা পড়ে, তারও বিশদ বর্ণনা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। আগে গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে তুলনা করাই ছিল ভাষাবিদদের কাজ। এখন একই ভাষার বিভিন্ন উপভাষাও তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষিত হতে দেখা যায়।
ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের মাধ্যমে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের সহায়তায় বিশেষ কোনো ভাষার উচ্চারণ, ধ্বনি, শব্দ, পদক্রম ও বাক্যের ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব—এ দুই শাখার আলোচনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে। আর যেহেতু প্রাচীন ভাষাগুলোর ধ্বনি হুবহু রক্ষিত হয়নি, তাই সেসব ভাষার আলোচনাও বেশিরভাগই অনুমানভিত্তিক, কাজেই দুর্বল। সেই কারণে অধুনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর সবার নজর পড়েছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি—এদের পরও কিছুদিন পর্যন্ত ভাষাতত্ত্বের আলোচনা এ উপমহাদেশে অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস প্রায় শূন্য। বিংশ শতাব্দীতে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ইউরোপ ও আমেরিকা উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে। এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা আলোচনা সেখানে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। আমাদের দেশেও বিগত শতাব্দীতে কিছু ভাষাবিদ ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের প্রায় সব আলোচনাই প্রধানত তুলনামূলক ও ইতিহাসভিত্তিক। এদের মধ্যে বিমসের তত্ত্বের ÔComparative Grammar of Modern Indian Language’, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকারের ÔWilson Phonological Lectures’, nibwji ÔComparative Grammar of the Indian Languages’, গ্রিয়ারসনের ‘Linguistic Survey of India’, কেলগের ‘Hindi Dialects’, Ges ট্রামপের ‘Sindhi Grammer’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা সম্বন্ধে যেসব কাজ হয়েছে তার মধ্যে বিজয় চন্দ্র মজুমদারের The History of the Bengali Language, ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের Origin and Development of Bengali Language (vol. I & II)Õ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ এবং ডক্টর সুকুমার সেনের ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ই প্রধান। এছাড়া দেশি ও বিদেশি নানা পত্র-পত্রিকায় এদের এবং আরো অনেকের আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এদের প্রায় সব আলোচনাই ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আওতায় পড়ে।
আমাদের দেশের আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার সূচনা হয় এই শতাব্দীতে গ্রিয়ারসন সাহেবের খরহমঁরংঃরপ ঝঁত্াবু ড়ভ ওহফরধ-এর াড়ষ. ঠ-এ ‘শব্দকথা’ (১৭১০ খ্রি.), প্রবন্ধ সংগ্রহে সংকলিত এবং সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় (১০০৭-১৯০৭ খ্রি.) প্রকাশিত ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ‘বাঙ্গালা কৃত্ ও তদ্ধিত্’, ‘না’, ‘কারক প্রকরণ’ এবং ‘ধ্বনি বিচার’—এই বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোচনা। এরপর ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'Bengali Phonetic Reader' (1928) Ges 'A Brief Sketch of Bengali Phonetics (1928), W. Sutton Page-Gi 'Introduction of Colloquial Bengali' (1934) প্রকাশিত হয়। এসবই বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বর্ণনাত্মক আলোচনার এক রকম দিকদর্শন। আমরা মূল আলোচনা থেকে একটু দূরে চলে এসেছি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় কী কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা-ই আমাদের দ্রষ্টব্য। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে ভাষাতত্ত্বের মূলতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় যেসব মনীষী আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের কথা এসে পড়েছে। হ (সংক্ষেপিত)

কালের ডানায় সোনালি রোদ্দুর | মোহাম্মদ নূরুল হক

আধুনিক কবি কালের ঘটনা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন; কিঞ্চিত্ প্রভাবিত। সমকালের বিভিন্ন প্রপঞ্চ আধুনিক মন ও মননকে বিমোহিত করে সত্য; কিন্তু তাতেই শৃঙ্খলিত করে না। বিশেষত কবি ঘটনার ফল নন; ঘটনার দ্রষ্টামাত্র। শব্দের অর্থ কবির হাতে পড়ে বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করে। মানবমন বস্তুনিরপেক্ষ নয়। ফলে নিষ্প্রাণ বস্তুরাশিও সময়ে প্রাণবন্ত ও সজীব হয়ে ওঠে। সচেতন প্রয়াসেই কবি তার প্রতিবেশ নির্মাণ করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষের ক্ষোভ, প্রত্যাশা, স্বপ্ন ও স্বপ্ন ভঙ্গের বেদনা, ব্যক্তির মনস্তত্ত্বের বহুরৈখিক রূপ অঙ্কন করেন। আধুনিক কবি সমাজ নয়; ব্যক্তির নিঃসঙ্গতা, মনোবিকার ও তাত্ক্ষণিক অনুভূতির বহুমাত্রিক চিত্র আঁকার চেষ্টা করেন গভীর মনোনিবেশে। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে আধুনিক বাংলা কবিতা উত্কর্ষে ও প্রাচুর্যে অনন্য।
নিসর্গ চেতনা ও মানবজাতির হার্দিক টানাপড়েন, যৌনচেতনা, ক্ষুধা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ আল মাহমুদের কবিতার অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ। প্রকৃতি ও নারী আল মাহমুদের চেতনায় একই প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করে। সেখান থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিতে পারেন না। অথবা সরিয়ে নেয়ার জন্য ব্যর্থ চেষ্টাও করেন না। পৃথিবীব্যাপী সমাজতন্ত্রের পুনর্জীবনের কোনো সম্ভাবনা না থাকা সত্ত্বেও সাম্যবাদের বিকিরণ ছড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করেন সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের প্রাত্যহিক কর্মযজ্ঞ, বুদ্ধিবৃত্তিক প্রজাতির জ্ঞানকাণ্ডে সিঞ্চনের জন্য শীতল জলের যে আধার তা কতটা নির্বিঘ্ন এবং নিরাপদ, তার যৌক্তিক স্বপ্নকল্প নির্মাণ করার দায় একা কবির? তা হলে সে দায় এবং স্বাপ্নিক বিরোধে তর্কলিপ্ত হতে তার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিঃশঙ্ক। জীবনানন্দ দাশে দেখি ইতিহাস চেতনা, ভৌগোলিক ধারণার সঙ্গে মানুষের মনোবিকার একই সমতলে অঙ্কন করতে। জীবনানন্দ দাশ চিত্রকল্প নির্মাণে নৈসর্গিক আবহকে প্রাধান্য দিয়েছেন; ফলে তার কবিতা চিত্রকল্পপ্রধান এবং গ্রামীণ অনুষঙ্গে বিভাসিত হতে দেখা যায়। তবে তার কণ্ঠে জটিল সারল্য ছিল। এক ধরনের কমনীয়তাও লক্ষ করা যায় দাশকাব্যে।
অন্যদিকে একেবারেই গ্রামীণ জীবনে উচ্চারিত শব্দ সমবায়ে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারার চিত্র অঙ্কন করেছেন জসীমউদ্দীন। জসীমউদ্দীন ও জীবনানন্দ দাশ দু’জনই আধুনিক চিত্রকলার দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। জসীমউদ্দীনকে অনুপ্রাণিত করেছে আবহমান বাংলার জীবনযাত্রা নিয়ে অঙ্কিত চিত্রকর্ম আর জীবনানন্দ অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন আধুনিক চিত্রকলার ইঙ্গিতময়তার দ্বারা। আর তাদের দু’জনের মিশ্র প্রভাব লক্ষ করি আল মাহমুদে। মাত্র উপমা নির্মাণ কিংবা চিত্রকল্প নির্মাণের নৈপুণ্যই কবিতা নয়, তা হলে কলাকৈবল্যবাদীরাই কবি অভিধায় অভিষিক্ত হতেন। বাকিরা থাকতেন চির উপেক্ষিত। তবু কবিমাত্রই ছন্দে সিদ্ধহস্ত। ছন্দমাত্রাজ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে আর যাই হোক, কবিতা লেখা সম্ভব নয়। প্রকৃত কবিতার শরীরের কোষে কোষে ছুটে চলা রক্তকণিকার মতো ছন্দের প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি বিদ্যমান। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছ কবি শুরু করেছেন শঙ্কাহীন পৌরুষ এবং শর্তহীন আত্মনিবেদনের ভাবাবেগ দ্বারা।
আত্মনিবেদনের এমন বিলোড়িত ও শৈল্পিক ভঙ্গি এর আগে বাংলা কবিতার পাঠক প্রত্যক্ষ করেছেন মর্মে কোনো সাক্ষ্য পাওয়া যায় না। নতজানু পুরুষ তার চিরকাঙ্ক্ষিত রমণীর সামনে, এরকম দৃশ্য আর কেউ আঁকেননি। এখানে রমণীর কোনো গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কোনোরূপ উল্লেখ করা হয়নি। তবু কবি কী কারণে কাঙ্ক্ষিত রমণীর কোনো বিশেষ গুণটির জন্য নিজেকে এভাবে সমর্পণ করলেন, তার সদুত্তর পাওয়া মুশকিল। তা হলে রমণীর কোনো রূপ জ্ঞান কিংবা সৌন্দর্য ব্যতিরেকেও অন্য কোনো অনুল্লেখ্য সাধারণ কিংবা অব্যাখ্যেয় চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রতিও কবিপুরুষ বিমোহিত হন কখনও-কখনও?
সোনার দিনার নেই দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও দিতে পারি কাবিনবিহীন হাত দুটি।
[১নং সনেট]
কবিতা জ্ঞানের বস্তু নয়; অনুভবের এবং পরিচ্ছন্ন জীবনযাপনের অবশ্যম্ভাবী অনুষঙ্গমাত্র। কবিতা ইতিহাস নয়; ইতিহাসের নির্যাস কবিতায় প্রচ্ছন্ন। আল মাহমুদ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দকে এসব অভিজ্ঞতার স্মারক হিসেবে গ্রহণ করে শব্দ ব্যবহারের একটি স্বতঃসিদ্ধ প্রকরণের প্রচলন করেছেন। এটি তার নিজস্ব ঢং, যা তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে। তার শব্দ নির্বাচন, নতুন শব্দ গঠন এবং উপমা প্রয়োগে যথেষ্ট যুক্তিগ্রাহ্য পরিশ্রমের স্বাক্ষর মেলে। ভাবালুতা-সর্বস্ব চিত্রকল্প কিংবা তরল বাক্য বিন্যাসের বিলসিত আকাঙ্ক্ষার প্রমাণ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে মেলে না। গ্রামীণ জনপদের সাধারণ মানুষের যাপিত জীবনের আটপৌরে শব্দরাজির সঙ্গে আধুনিক মননজাত শব্দ সমবায়ের সামঞ্জস্যপূর্ণ অন্বয়সাধন তার কবিতাকে বিশিষ্ট করেছে, জীবনানন্দ দাশের ইউরোপীয় আধুনিক চেতনা এবং জসীমউদ্দীনের পল্লীর সাদামাঠা ভাবালুতাময় শব্দ থেকে। সম্ভবত এ কারণে আধুনিক বাংলা কবিতার পাঠক আল মাহমুদকে গভীর মনোযোগ সহকারে পাঠকালে জসীমউদ্দীন পল্লীর সাধারণ মানুষের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা নিয়ে এবং জীবনানন্দ দাশ তার অন্তহীন বিগলিত ইউরোপীয় আধুনিকতার তাত্পর্যময় অনন্ত বিষণ্নতাসহ উপস্থিত হন।
আবহমান বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজব্যবস্থা, প্রথাগত ধারণাকে গভীরভাবে আত্মস্থ করে আধুনিক জীবনের, যুগযন্ত্রণার অভিজ্ঞতাকে নির্মম বাস্তবতার আলোকে স্বীকার করেছেন। কামহীন প্রেমকে কবি সন্দেহের চোখে দেখেছেন এবং প্রেমহীন কামকে কবি ঘৃণার্হ করে তুলেছেন শব্দের পর শব্দ নির্বাচন, গঠন ও প্রয়োগের মাধ্যমে।
তার পর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
ক্ষেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
[১০নং সনেট]
মিথ এবং উপকথার প্রতি কবির অমোঘ আকর্ষণ লক্ষণীয়। পুরাণের বিভিন্ন চরিত্র এবং ঘটনা, ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ কালখণ্ড তার মন ও মননে গভীর রেখাপাত করেছে; নয়তো পুরুষ তার নারীকে প্রলুব্ধ করার জন্য বিভিন্ন চরিত্রের উদাহরণ টেনে আনবেন কেন! তার কাছে শাস্ত্রীয় ধর্মের চেয়ে মানবধর্ম বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। মানুষের ধর্ম মানেই ফসলের সুষম বণ্টন হবে—এই প্রত্যয় নিয়ে কবি তার দয়িতাকে আলিঙ্গনে আহ্বান করেন। কোনো সংঘ কবির আরাধ্য নয়। কারণ কবিমাত্রই বাঁধনহারা, দৃঢ়চেতা এবং সত্ সাহসী। কবিরা কোনো সংঘের শরণ নেয়ার চেয়ে দরিদ্র বাউলের বাউণ্ডুলেপনাকে শ্রেয় বোধে লালন করেন।
পূর্বপুরুষরা কবে ছিল কোন সম্রাটের দাস
বিবেক বিক্রয় করে বানাতেন বাক্যের খোঁয়াড়
সেই অপবাদে আজও ফুঁসে উঠে বঙ্গের বাতাস
মুখ ঢাকে আলাউল রোসাঙ্গের অশ্বের সোয়ার
এর চেয়ে ভাল নয় হয়ে যাওয়া দরিদ্র বাউল?
[৬নং সনেট]
শব্দকে একটি শান্ত ও গম্ভীর প্রবহমান নদীর মতো প্রয়োগ করতে পারার মধ্যে শিল্পীর নান্দনিক ও তাত্পর্যময় ভূমিকা রয়েছে, যার মাধ্যমে কবি নিজের ব্যক্তিত্ব, মনন ও রুচিকে সংক্রমিত করেন তার পাঠক ও সমালোচকদের মধ্যেও। সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে শব্দের যুক্তিগ্রাহ্য ও নান্দনিক চিত্ররূপ আঁকতে গিয়ে পুরাণ ও মিথকে আশ্রয় করেছেন। এই প্রবণতা তাকে বিশিষ্ট এবং বিশ্লিষ্ট করেছে তার পূর্ববর্তী এবং সমসাময়িক অন্য কবিদের কাব্যভাষা থেকে। ফলে তার কণ্ঠস্বরটি স্বতন্ত্র মর্যাদা পেয়েছে—যথার্থ ও অনিবার্য কারণেই।
ছন্দ নির্বাচনে কবি আঠারো মাত্রার সমিল অক্ষরবৃত্তকে বেছে নিয়েছেন—বোধ হয় এই ছন্দের প্রবল গাম্ভীর্যময় চারিত্র্যের জন্যই। নিরূপিত ছন্দোপযোগী শব্দ নির্বাচনে আধুনিক কবির স্বাধীনতা সামান্যতম হলেও ক্ষুণ্ন হয় বলে মনে করি। কারণ যথেচ্ছ শব্দ নির্বাচন ও গঠনের সুযোগ নিরূপিত ছন্দে নেই বললেই চলে। এর কারণ বাক্যস্থিত শব্দ সমবায়ের বিন্যাস হতে হয়—অবশ্যম্ভাবী ও অনিবার্য পরম্পরায়। এর ব্যতিক্রমে ছন্দপতন ও বিষয়ের বোধগম্যতায় জটিলতা দেখা দিতে পারে। ফলত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
প্রস্তর যুগের এই সর্বশেষ উলাসের মাঝে
কোথায় পালাবে বলো কোন ঝোপে লুকাবে বিহ্বলা?
স্বাধীন মৃগের বর্ণ তোমারও যে শরীরে বিরাজে
আমাদের কলা কেন্দ্রে আমাদের সর্ব কারুকাজে
অস্তিবাদী জিরাফেরা বাড়িয়েছে ব্যক্তিগত গলা।
[১১নং সনেট]
এই অস্তিবাদী জিরাফেরা তাদের ব্যক্তিগত গলা অহরহ বাড়ায়। আজকের অশান্ত বিশ্বের প্রতিটি অশুভ কর্মযজ্ঞের নেপথ্যে রয়েছে এই অস্তিবাদী জিরাফেরা। এই যে বিষয়ের সঙ্গে ছন্দোপযোগী শব্দ ও পর্ববিন্যাস এবং উপমার যে অভিনবত্ব দেখি, তা অনস্বীকার্যভাবে উজ্জ্বল। বাংলার কৃষকসমাজের উত্থান-পতন যেমন জসীমউদ্দীন এঁকেছেন তার স্বভাব সারল্যে; আবহমান বাংলার মানুষের মনস্তত্ত্বের জটিল রূপ যেমন এঁকেছেন জীবনানন্দ দাশ তার দীর্ঘ বিষণ্নতার ঘোর রহস্যময় সম্মোহনে; তেমনি আল মাহমুদ এঁকেছেন তার মননশীলতার সঙ্গে হৃদয়বৃত্তির অন্বয়সাধনের মাধ্যমে। সোনালি কাবিন বিষয় নির্বাচন, শব্দ প্রয়োগ, উপমা-চিত্রকল্প নির্মাণ, ছন্দের প্রয়োগ, পদবিন্যাসের স্বতন্ত্র কৌশলের কারণে বিশিষ্ট। সুলুক সন্ধানী পাঠকমাত্রই আবিষ্কার করবেন এই সনেটগুচ্ছে প্রকৃতি ও মানুষের এক ঘোর রহস্যময় সারল্যের ভাষাচিত্র। স্বাপ্নিক বিরোধ সোনালি কাবিন সনেটগুচ্ছে নেই সত্য; কিন্তু অন্তহীন রহস্যময় দিগন্তরেখার মোহনীয় উদ্ভাস লক্ষণীয় হয়ে ওঠে। দুর্বোধ্যতা ভর করেনি, সারল্যও নেই; আছে বিমূর্ত আবহের চেতনা।
আধুনিক বাংলা কবিতা অনুভবের জন্য শিক্ষিত পাঠকমন প্রয়োজন। কবিতা শুধু বুদ্ধিপ্রধান বাক্যবন্ধের সমষ্টি নয়; ভাবালুতাসর্বস্ব তরল শব্দ সমবায়ে রচিত বাক্যাবলিও কবিতা নয়। কবিতা যদি মানবজীবনের যাপিত অংশের শৈল্পিক ধারাভাষ্য কিংবা নান্দনিক প্রতিচ্ছবি না হয়, তাহলে পাঠক সেটাকে গ্রহণ করে না। আবার গতানুগতিক বিষয়ের প্রথাগত বুননও কবিকণ্ঠের স্বাতন্ত্র্যের পথে প্রতিবন্ধক বলে মনে করি। কাব্য-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে কবির দীর্ঘদিনের অভ্যাস, অর্জিত জ্ঞান, মনীষা, আত্মোপলব্ধিজাত অন্তর্নিহিত তাত্পর্যময় চিত্রকল্প, উপমা, উেপ্রক্ষা ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে সোনালি কাবিন একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে শৈল্পিক প্রতিবাদ। সোনালি কাবিনে ব্যবহৃত শব্দরাজি বাঙালির যাপিত জীবনের প্রতিদিন উচ্চারিত শব্দরাজি থেকে আহরিত। সোনালি কাবিন নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও।

সূত্র : আমার দেশ

বাংলাভাষা বাংলাদেশেরই আত্মা, কলকাতায় সব হিন্দি আর ইংরেজি : আল মাহমুদ (সাক্ষাৎকার)

# ৭৭-এ পা দিচ্ছেন, কেমন বাংলাদেশ আপনি দেখতে চান?
— স্বাধীন, সার্বভৌম, শান্তিময় বাংলাদেশ দেখতে চাই, সুখী বাংলাদেশ।
# আপনার স্বপ্নের বাংলাদেশের সঙ্গে বাস্তবের বাংলাদেশের মধ্যে ফারাকটা কতখানি?
— বেশ ফারাক আছে। কারণ কবি যে কল্পনা করে, আমরা একটু বেশি আশা করি, সে রকম তো আর হয় না, আমরা যা আশা করি। তবু পায়ের নিচের মাটিটা তো বাংলাদেশ। তাই না? এক ভালোবাসার টান।
# একটা রক্তের প্লাবনের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। আপনি তো মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। আপনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ছিলেন আমরা জানি। সে সময়কার অনুভূতি সম্পর্কে কিছু বলেন।
— স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে আমরা প্রকাশ্যে ছিলাম না, কিন্তু আশপাশে ছিলাম, তাদের সঙ্গেই।
# এবং তারও আগে থেকেই বাংলাদেশের সত্তা যখন গঠিত হচ্ছিল, আপনার বিভিন্ন লেখার মধ্যে এসেছে। ঊনসত্তরের গণআন্দোলন এসেছে, ভাষা আন্দোলন এসেছে। বাংলাদেশের মাটিকে, এদেশের জলকে, হাওয়াকে, লোকজ জীবনকে তুলে এনেছেন—এসবের পেছনে আপনার কী দর্শনটা কাজ করেছিল?
— বাংলার মাটি! একটা কথা আছে না—‘বাংলার মাটি বাংলার জল/পুণ্য হউক পুণ্য হউক...’ এই।
# কবিতা ও নারী—কে বেশি রহস্যময়ী?
— সন্দেহ নেই, এ দু’জনের মধ্যে কোনো দ্বন্দ্ব নেই। দ্বন্দ্ব নেই, কারণ কবিরা যেখানে শুতে যায় সেই জায়গাটার একদিকে নারী, আরেক দিকে বই থাকে। এই দুটোকে সরিয়ে কবিকে বিশ্রাম নিতে হয়। আশা করি কথাটা বুঝেছ।
# আপনি তো একজন ঘোরতর আস্তিক মানুষ। এই বিশ্বাস, এই রহস্যময়তা আপনার বিপুল রচনাসম্ভারে নানা মাত্রিকতায়, নানা অবয়বে প্রতিফলিত। এই মরমিয়াবাদ সম্পর্কে পাঠকদের কিছু বলুন।
— আমি বিশ্বাসী। বিশ্বাসী মানুষ কী করে? বিশ্বাসী মানুষ সবসময় একটা কাজ করে। সেটা কী করে? সে সেজদা করে অদৃশ্যের দিকে এবং সে প্রার্থনা করে, অ্যান্ড হি প্রেজ, প্রার্থনা করতে থাকে। এটা আমার একটা ধারণা। ধারণা কী? এটা সত্য।
# আপনার লেখালেখির শুরুটা কেমন করে হয়েছে?
— আমি মফস্বল শহরে থাকতাম। খুব পড়তাম আমি। পড়তে পড়তে একদিন মনে হলো—আচ্ছা, আমিও তো এরকম লিখতে পারি। লেখা শুরু করলাম। আশ্চর্য যে, আমার লেখা তখন এদেশের শ্রেষ্ঠ কাগজগুলো খুবই অনায়াসে ছেপে দিল।
# সেটা তো বিস্ময়কর!
— আমার কাছেও বিস্ময়কর!
# এখনও?
— এখনও লাগে।
# আপনার জীবনে এমন কোনো স্বপ্ন বা আকাঙ্ক্ষা আছে কী, যেটা এখনও পূর্ণ হয়নি?
— এটা তো তুমি একটা খুব জটিল প্রশ্ন করলে। আমি তো পূর্ণতা এবং অপূর্ণতার মধ্যে বাস করি। কিছু পাই, কিছু পাই না। এই হাতড়ে বেড়াই। এটা হলো জীবন।
# ‘লোক লোকান্তর’ থেকে ‘পাখির কথায় পাখা মেললাম’ এই দীর্ঘ পরিক্রমায় আপনার যে বাঁকবদলগুলো হয়েছে, তার পেছনে কোন ফ্যাক্টরগুলো কাজ করেছে বলে আপনি মনে করেন?
— আমার জীবনই একটা আশ্চর্য জীবন। কত ঘাটে ভিড়তে হয়েছে। কত কিছু দেখলাম, জানলাম। সবকিছুর মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে, দেশে যা কিছু ঘটেছে। আমি তো এদেশ থেকে পালিয়ে যাইনি। আমি দেশে থেকে দেশের সব কিছুতে অংশগ্রহণ করেছি, দেখেছি, মুভ করেছি এবং আরেকটা কী ব্যাপার—কেঁদেছি। আই ওয়েপ্ট।
# নানা ধরনের লেখা আপনি লেখেন। কথাশিল্প, কলাম, কবিতা, আত্মজৈবনিক—কোন শাখায় লিখতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কেন?
— আসলে ওই অতীত নিয়ে লিখতে ভালোই লাগে। কিন্তু অতীত বেশিদিন দেখা যায় না। আমি ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে লিখতে চেষ্টা করি। কিন্তু বর্তমানটা যে এতই বাস্তব এবং এতই রূঢ় যে, এর মধ্যে বসবাস করতে হলে সাহস, শক্তি এবং কাব্যগুণ লাগে। সেটা মনে হয় আমারও কম-বিস্তর আছে।
# কেউ কেউ বলে, অদূর ভবিষ্যতে ‘বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হবে ঢাকা’।
— এটা কেউ কেউ নয়, আমিই বলেছি প্রথম।
# এ কথার বাস্তব ভিত্তি কতটা মজবুত হয়েছে?
— বাংলা ভাষাই বাংলাদেশের আত্মা। এই ভাষার সঙ্গে অন্য কিছুকে বাংলাদেশ মিশ্রিত করে না। এক দিগ্বিজয়ী ভাষা। শব্দের তরঙ্গ বাংলাদেশেই বইছে। বাংলাদেশ ছাড়া এটা আর কোথাও সম্ভবপর হয়নি। কলকাতা গেলে তুমি দেখবে, সব হিন্দি আর ইংরেজি।
# সেখানে বাংলা ভাষা মরে যাচ্ছে, ওরা টিকিয়ে রাখতে পারছে না।
— না, পারছে না।
# গদ্য কিংবা কবিতা লেখার পরবর্তী যে অনুভব কিংবা সাফল্যের শিহরণ—দুয়ের মধ্যে মৌল কোনো পার্থক্য আছে কি?
— আমি সব সময় ভাবি যে, আমার খাপে তো দুইটা তরবারি আছে—একটা গদ্যের, একটা পদ্যের। যখন যেটা আমার প্রয়োজন, সেটা ব্যবহার করেছি।
# তরুণ কবিদের জন্য আপনার কোনো উপদেশ আছে কি?
— কথা হলো যে, উপদেশ দেয়া আমার জন্য ঠিক না। তরুণরা ইচ্ছানুযায়ী চলবে—এটাই আমরা চাই। তবে একটা কথা বলব। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে। জ্ঞান না হলে কিছুই হয় না। বলা হয় না, জ্ঞানবৃক্ষের ফল না খেলে সে তো কিছুই জানে না? জ্ঞানবৃক্ষের ফল একবার যে খেয়েছে, তাকে পৃথিবীতে আসতে হয়েছে স্বর্গ ছেড়ে। স্বর্গ থেকে তাকে বের করে দেয়া হবে, সে পৃথিবীতেই চলে আসবে। পৃথিবীতে এসে নিজের পরিশ্রমের অন্ন নিজে খাবে।
# দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা প্রকৃত সাহিত্যচর্চায় কতটা অবদান রাখতে পারছে?
— আমাদের দেশে দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পৃষ্ঠা আমাদের সাহিত্যের জন্য সাহায্যকারী হয়েছে। অন্য দেশে এটা হয়নি, আমাদের দেশে হয়েছে।
# মানসম্পন্ন সাহিত্য কাগজের অভাবের কারণে হয়েছে?
— তাই, তাই তো দেখতে হবে। নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা নেই। লিটলম্যাগ আছে।
# বাংলা কবিতার ভবিষ্যত্ কী হতে পারে বলে আপনার মনে হয়?
— এটা বলা উচিত না। কারণ, আধুনিক বাংলা কবিতা হলো আধুনিক জাতীয় জীবনের একটা দৃষ্টান্ত। আধুনিক বাংলা কবিতা এতই পরিপকস্ফ এবং এতই ডালপালা মেলে দিয়েছে, যদিও গদ্যকে আমরা আধুনিক বলি, এটা অন্য কোনো সাহিত্যে ঘটেনি যে, কবিতাই বিজয়ী হয়েছে।
# সাধারণভাবে বলা হয়, বাংলাদেশে কবিতার পাঠক ক্রমেই কমে যাচ্ছে। এর কারণটা কী?
— আশ্চর্য কথা—বাংলাদেশে কবিতার পাঠক কমে যাচ্ছে। দল বেঁধে কেউ কবিতা
(৭-এর পৃষ্ঠার পর)
পড়ত নাকি? কোনো সময় পড়েনি। দলবদ্ধভাবে কাব্যচর্চা করেছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত নেই। কেউ কেউ করেছে—এরাই তো বাঁচিয়ে রাখে সব।
# আমাদের সাহিত্য, বিশেষ করে কবিতা বিশ্বমানের বিচারে কোন অবস্থায় আছে?
— আধুনিকতার দিক দিয়ে প্রায় জগতের সাহিত্যের সমকক্ষ। আমাদের কবিতা যদি ব্যাপক অনুবাদ হয় তাহলে বোঝা যাবে, কী আশ্চর্য কাজ হয়েছে বাংলা ভাষায়!
# স্বাধীনতার চল্লিশ বছর হয়ে গেল, অনুবাদের ক্ষেত্রে আমাদের সাফল্য কিন্তু সেভাবে আসেনি।
— না, অনুবাদ করার মতো লোক আসেনি। এটা ঠিকই কথা।
# বাংলা একাডেমীর একটা ভূমিকা, দায়িত্ব কি এক্ষেত্রে ছিল না?
— কার কার ভূমিকা বা দায়িত্ব ছিল এটা বলে কোনো লাভ নেই। এটা ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। একজন লোক যদি থাকে, তাহলে অনুবাদ করে ছড়িয়ে দেয়।
# কেউ যদি বলে, আপনার ইদানীং কালের লেখায় আগেকার সেই লাবণ্য ও মাধুর্য কিছুটা গরহাজির—এ অভিযোগের বিপরীতে আপনার বক্তব্য কী হবে?
— আমার পক্ষ থেকে এর কোনো জবাব নেই। তবে কী কারণে বলে, তা কিন্তু উল্লেখ করা হয় না। তারা ভ্রান্ত কিনা, নাকি আমি ভুল করছি সেটা বোঝার মতো ব্যাখ্যা হয়নি এখনও।
# বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গে সমকালীন কাব্যধারা কিংবা প্রবণতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যগুলো কী কী?
— আমি পশ্চিমবঙ্গের কবিতা সম্পর্কে কম জানি। আমার পড়া হয়ে উঠছে না। এ ব্যাপারে জ্ঞান অপেক্ষাকৃত কম আমার। কে লিখছে, কী লিখছে এটা আমি জানি না, তখন একটা আন্দাজি মন্তব্য আমি করতে পারি না। তবে একথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের কাব্যের শক্তি এবং ঐশ্বর্য অনেক বেশি। বিশেষ করে এর যে লোকজ গ্রাউন্ড, সেটা অনেক উর্বর বলে আমি মনে করি।
# আপনার মায়াবি কলমে শিশু-কিশোরদের জন্য বেশকিছু মূল্যবান ফসল ফলেছে। কারও কারও অভিযোগ, আপনি এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনোযোগ ও সময় দেননি। আত্মপক্ষ সমর্থনে আপনার বক্তব্য কী হবে?
— হয়তোবা। যারা আমার এ খুঁতটা ধরতে পেরেছে তারা আমার অনুরাগী। তাদের উচিত ছিল একটা পরামর্শ দেয়া, কিন্তু তারা তো সেটা করেননি। করা উচিত ছিল। এটা তারা যদি বলে দিতেন, তাহলে আমি সেভাবে চলতাম।
# বলা হয়, আমাদের কবিতাকে বিশ্বদরবারে তুলে ধরার জন্য তেমন কোনো উদ্যোগ কখনও নেয়া হয়নি। এই ক্ষতির জন্য কে বা কারা দায়ী?
— কেউ দায়ী নয়। ভালো ট্রান্সলেটরের অভাব— যে একই সঙ্গে বাংলা এবং ইংরেজি ভাষায় সমান পারদর্শী হবে। তাদের আবির্ভাব হয়নি। এটা একটা দুর্ভাগ্য বলা যেতে পারে।
# একজন খাঁটি কবি হওয়ার ক্ষেত্রে আস্তিকতা বা নাস্তিকতা কতটা জরুরি?
— আমি আস্তিকতাকে খুব মূল্য দিই। কারণ, বিশ্বাস হলো একটা হাতল। এটা ধরতে হয়। বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহু দূর। বিতণ্ডা করে কোনো লাভ নেই।
# মহাকালের বিচারে আপনার কবিতা কতটা টিকে থাকবে বলে আপনার ধারণা?
— আমি তো ভবিষ্যত্ বক্তা নই। যে কারণে বলতে পারব না। মহাকালের বিচারে টিকে থাকে না অনেক কিছুই। তুমি চর্যাপদ দেখ, চর্যাচর্যাবিনিশ্চয়। এটা কীভাবে আছে?
‘শাশুড়ী নিদ গাএ বউড়ি জাগত্র
কানেট চোরে নিল কাগই মাগত্র’
# প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ ওস্তাদ আলী আকবর খান একবার বলেছিলেন যে, নিবিড় সঙ্গীত সাধনার এক পর্যায়ে মহান স্রষ্টার সান্নিধ্য অনুভব করা যায়। কবিতা রচনার কোনো পর্যায়ে এমন ধরনের কোনো ঐশী বোধ কি কখনও আপনাকে আচ্ছন্ন করেছে?
— তিনি তো বলেছেন সঙ্গীত সম্পর্কে; কিন্তু আমি যে জিনিস চর্চা করি এটার নাম হলো আধুনিক কবিতা। কবিতার মধ্যেও সঙ্গীত আছে। আমি লিরিকটা পছন্দ করি। আমি একটু লিরিক্যাল লোক এবং লিরিক হলো সবকিছু পাওয়ার একটা পথ। এটাই অনুসন্ধান করতে হবে।
# বিভিন্ন সাহিত্যানুষ্ঠানে আপনি প্রায়ই বলতেন, চিত্রকল্পই কবিতা। ত্রিশের দশকের খ্যাতিমান এক কবি বলে গেছেন, উপমাই কবিতা। এ ব্যাপারে বিশদ বলবেন কি?
— আমি কেন যে চিত্রকল্পকেই কবিতা বলেছিলাম, সেটা একটু ভেবে দেখতে হবে। আমার কবিতায় তো আমি এটা ত্যাগ করিনি। চিত্রকল্প তো প্রায় কবিতারই সমার্থক। কবিতায় একটা চিত্রকল্প লাগে।
# আমরা জানি, কবিতা পড়তে গিয়ে ভালো লাগার ব্যাপারটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তারপর আসে উপমা, চিত্রকল্প, উেপ্রক্ষা, প্রতীকের দক্ষ শৈল্পিক প্রয়োগের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি ছন্দের ব্যাপারটিও জরুরি, তাই নয় কি?
— সবচেয়ে বড় কথা হলো ছন্দ। একজন কবিকে জানতে হয়—মিলটা কীভাবে সংঘটিত হয়। অনুপ্রাস জানতে হবে। এটা জানলেই তার মনে দারুণ উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। এটা না জানলে কিন্তু অনেক অসুবিধা।
# দীর্ঘ কাব্যযাত্রায় আপনার সৃজিত কবিতাগুচ্ছে বিধৃত হয়েছে সমকাল, বাংলাদেশের লোকজীবন, দেশ, সমাজ, জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্য, অহং, ঐতিহ্য ইত্যাদি। সফল সাহিত্য সৃষ্টির প্রশ্নে এসবের প্রতিফলন অত্যন্ত জরুরি। এগুলো কেন জরুরি বলবেন কি?
— তুমি নিজেই তো বললে জরুরি। জরুরি এজন্য যে, একটাকে বাদ দিলে খুঁত থেকে যায়। এই খুঁত ভরাট করার আর কে আছে, কিছু তো নেই। কবিতার জায়গাটা কবিতা দিয়েই ভরাট করা দরকার, অন্য কিছু দিয়ে হয় না।
# উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
— এটা হলো—দার্শনিকরা যেটা ঘাড় থেকে ফেলে দিয়েছে, সেটা ঘাড়ে তুলে নেয়া।
# উত্তর আধুনিকতা বলতে পশ্চিমে আধুনিকতা-পরবর্তী কালটাকে বোঝানো হয়। কিন্তু ভারতে বা বাংলাদেশে এটাকে প্রাচীন ঐতিহ্যে ফিরে যাওয়া বোঝাচ্ছে—এ ব্যাপারটিকে আপনি কীভাবে দেখেন?
— আধুনিক বাংলা কবিতার বিকাশটা প্রাচীন ঐতিহ্য ছাড়া ঘটেনি। কবিতা কিন্তু মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এ কারণেই, যেখানে পায়ের তলায় মাটি আছে সেখানে সবসময় প্রাচীন ঐতিহ্য আসা-যাওয়া করছে। কিন্তু পুরনো ঐতিহ্য নিয়ে তো থাকা যায় না। মানুষকে সামনের দিকে এগোতে হয়। পুরনো ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হতে পারে, কিন্তু কবিতা হয়ে উঠতে হলে আধুনিকতা দরকার।
# এবার একটু ম্যাজিক রিয়েলিজম সম্পর্কে আলাপ করতে চাই। রিয়েলিজম ও ড্রিমের মধ্যে সেতু তৈরি করাকেই আমরা ম্যাজিক রিয়েলিজম বলে বুঝি। এ নিয়ে লাতিন ও ক্যারিবিয়ান কথাশিল্পীরাই বেশি কাজ করে থাকেন। পরে এই জাদুবাস্তবতার ধারণা বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে। কবিতায়ও এর প্রতিফলন ঘটে। আপনার কবিতায়ও আমরা এর লক্ষণ দেখছি। ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’ কবিতার বইতে এই বিষয়টি বেশ ভালোভাবেই আছে। এ সম্পর্কে কিছু বলুন।
— এটার মধ্যে যা বক্তব্য সেটা ঠিক খোলাসা করা যায় না। তবে এটুকু বলতে পারি—সবগুলো জটিলতার জট খুলে যায় যখন মিল বোঝে কবি—ছন্দের দোলায় যখন পৌঁছে। ছন্দ, গন্ধ এবং স্পর্শের যে আনন্দ; এটা একজন কবিকে সামনে ঠেলে দেয়। ভবিষ্যতের দিকে দারুণভাবে ঠেলে দেয়। ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে যায়।
# আপনার কাব্য-সহযাত্রী কবি শামসুর রাহমান এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন—সেটাই কবিতা যা প্রথম পাঠে ভালো লাগে। এ বক্তব্য সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
— তিনি কী বলেছিলেন সেটা আমি বলতে পারব না। তবে প্রথম পাঠে অনেক কিছুই ভালো লাগে। এটা কি যুক্তিসঙ্গত কথা হলো? প্রথম পাঠে অনেক অকবিতাও ভালো লাগে, তাই না? প্রথম পাঠে আমার ভালো লাগে গদ্য। কারণ গদ্য আধুনিক। এটা তো বলা যায় না—আমার প্রথম পাঠে যেটা ভালো লাগে সেটাই কবিতা। এর সঙ্গে ঠিক আমি একমত হতে পারি না।
# আপনি কি বলতে চাচ্ছেন—একটা কবিতা প্রথম পাঠে ভালো লাগল, কিন্তু আপনি যখন কয়েকবার পাঠ করলেন তখন মনে হলো—না, ভালো লাগার আসলে কারণ নেই।
— হ্যাঁ, কোনো কারণ নেই দেখা যাচ্ছে।
# আনন্দ ও বেদনা—কবিতার কাছে আপনি কোনটা বেশি পেয়েছেন?
— আমার মনে হয়, আনন্দ-বেদনা—এই দুইটাই সমভাবে আমাকে অভিভূত করেছে।
# একজন লেখকের বিকাশের জন্য সংঘ বা সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো প্রয়োজনীয়তা আছে কি?
— কোনো কোনো ক্ষেত্রে আছে। কিন্তু দল বেঁধে কাব্য হয় না।
# এই যে জাতীয় কবিতা পরিষদ হয়েছে, কেউ বলেন এটা এখন খুব স্তিমিত হয়ে আছে—এগুলো কি চূড়ান্ত বিচারে আমাদের সাহিত্যের কোনো উপকার করেছে?
— কবিতার যে কোনো সংগঠন বা কবিতার জন্য যারা কাজ করে, তারা কিছু না কিছু কাজ তো করেই—এটুকু শুধু বলতে পারি।
# মৃত্যুচিন্তা কি আপনাকে কখনও আচ্ছন্ন করে? এ অনুভূতিটা কেমন?
— যেহেতু আমি জন্মেছি, মৃত্যু হবেই। এটা যখন আমি নিশ্চিতভাবে জানি, তখন মৃত্যুর ভয়টা হয়তো ঈষত্ কমে আছে—কিন্তু মৃত্যুর যে ভয়, বিস্ময়, মৃত্যুর যে একটা স্বাদ আছে এটা আমি কখনও গ্রহণ করিনি। এটা একবারই মানুষ গ্রহণ করে, যখন সে মরে যায়। ফিরে এসে আর কিছু বলতেও পারে না।
# বিশ্ব সমাজে সমাজতন্ত্র যে মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা আপনাকে ব্যথিত করে কি?
— সমাজতন্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে, এটা কিন্তু বলা যাবে না। আসলে সমাজতন্ত্রের কথা আজকাল আর কেউ বলে না। কারণ, পুঁজিবাদ এত প্রবল ও পরাক্রান্ত হয়েছে যে, সমাজতন্ত্রীরা মুখ খুলতে পারছে না। পুঁজিবাদ যতই বৃহদাকার ধারণ করুক—পুঁজিরও একটা পরিসমাপ্তি আছে।
# আপনার রাজনৈতিক চিন্তায় আমরা ব্যাপক পরিবর্তন দেখি। বামধারা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত ধারায় আপনি আস্থাশীল হয়েছেন সময়ের পরিক্রমায়। এই পরিবর্তনের অনিবার্যতা কী ছিল? আপনার সাহিত্যচিন্তা ও লেখালেখিতে এর কেমন প্রভাব পড়েছে বলে আপনি মনে করেন?
— আমি স্বাধীনতায় বিশ্বাসী। বাম ঘরানা, যতই বলে না কেন, মানুষের বিশেষ করে কবির স্বাধীনতা হরণ করে।
# বাংলাদেশে এখনও পর্যন্ত লেখালেখিকে পূর্ণাঙ্গ পেশা হিসেবে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এ ব্যপারে আপনার মন্তব্য জানতে চাই।
— এ কথাটা আংশিক সত্য। কিন্তু আমি তো লিখেই জীবন কাটিয়ে দিয়েছি—আয়-রোজগার যাই বলো, এই লেখা থেকেই।
# আপনি তো অন্যান্য চাকরিও করেছেন। সেগুলো যদি করতে না হতো...
— সেটা করেছি, কিন্তু লেখালেখি থেকেই আমাকে আয়-রোজগার বেশি করতে হয়েছে। তবে একটা কথা বলি—যেটা ঘটে না, সেটা ঘটবে না বলেই ঘটে না। এটা সত্য।
# কবিরা সত্যদ্রষ্টা হয়ে থাকেন বলে একটা কথা প্রচলিত আছে। বাংলাদেশে বর্তমান কবিদের কবিতায় তার কেমন প্রতিফলন আছে?
— সব কবি সত্যদ্রষ্টা কিনা জানি না। তবে আমি বলি—কবিরা দ্রষ্টা। সে দেখে।
# আপনি এক সময় সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। লেখালেখির ক্ষেত্রে সাংবাদিকতা বৃত্তি কতটা উপকারী কিংবা অপকারী বলে আপনার মনে হয়েছে?
— এটা নিজের ওপর নির্ভর করে। আমি সাংবাদিকতা করেছি। কেন করেছি? আমার পেটের জন্য করেছি। বেঁচে থাকার জন্য করেছি। সেটাও প্রয়োজন ছিল।
# কবিতার কাছে আপনার ঋণ কতখানি?
— যা কিছু নিয়েছি, কাব্যের কাছ থেকেই নিয়েছি। তবে দিয়েছিও, শোধ করার চেষ্টাও আমি করেছি।
# কেউ কেউ বলে, বাংলাদেশে সাম্প্রতিককালে শক্তিমান লেখক আর আসছেন না। আপনি কি এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত?
— আমি ঠিক একমত নই। তবে সব সময়ই দেখা যায় যে, প্রকৃত লেখক যারা, তারা বেশ একটু বিরতি দিয়ে দিয়ে আসেন, প্রতিদিন তো আর আসেন না।
# আপনার প্রথম প্রেমের অনুভূতি, রোমাঞ্চ—নারী প্রেম অর্থে, এ সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
— আমারও এমন একটা মুহূর্ত এসেছিল। কৈশোর উত্তীর্ণ সময় যেটা, যেটাকে আমরা যৌবন বলি, তার প্রারম্ভে। এ সম্পর্কে আর কিছু বলার নেই, বলা উচিতও নয়।
# কবিদের মধ্যে ক্ষুদ্র দলাদলির ব্যাপারটি কি আপনাকে পীড়িত করে? একজন খাঁটি কবি দলভুক্ত না হলে ন্যূনতম স্বীকৃতিও পান না। এ ব্যাপারে কী বলবেন আপনি?
— এটা আমি ঠিক মানি না, কারণ কবিতা একটি ইন্ডিভিজুয়াল কাজ। কবিতা নীরবে লিখতে হয় এবং কবি একা, কবি নীরব সব সময়।
# কিন্তু দল না করলে পুরস্কার পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমী পুরস্কার নিয়েও এটা হয়ে থাকে।
— এগুলো বাস্তবতা। এগুলো আমি অস্বীকার করে চলে এসেছি।
# ইদানীংকালে আপনার দিনগুলো কেমন করে কাটছে?
— আমি তো চোখে-টোখে দেখি না। দৃষ্টি তো ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মোটামুটি বসে থাকি। পড়তে খুব ইচ্ছা করে। আমার পড়ে শোনানোর লোকও আছে। নাতি-নাতনিরা আছে। তারা জরুরি বিষয় যেটা সেটা পড়ে শোনায়। পত্রিকা শোনায়। আমি মাঝে মাঝে গান শুনতে ভালোবাসি।
# আপনার প্রিয় শিল্পী কে? প্রিয় গান সম্পর্কে বলুন।
— আমি তো এদেশের শ্রেষ্ঠ যারা গায়ক-গায়িকা, তাদের সবারই গান শুনি।
# আপনি তো সঙ্গীত ব্যক্তিত্বদের নিয়ে লিখেছেনও। শিল্পকলা একাডেমী থেকে আপনার বইও হয়েছে।
— আছে। আব্বাসউদ্দীনকে নিয়েও আমি একটি গ্রন্থ সম্পাদনা করেছি।
# আপনার প্রিয় গান কোনটা—রবীন্দ্র, নজরুল?
— ক্লাসিক্যাল মিউজিক আমার প্রিয়। এছাড়া আমার একটা স্বতন্ত্র পড়াশোনা ছিল পশ্চিমা মিউজিকের ওপর। এটা খুবই আমার কাছে লেগেছিল। আমি এদেশীয় সঙ্গীত বুঝতে পেরেছি। যাকে বলে পশ্চিমা সঙ্গীত, সেটারও ধ্বনি তরঙ্গ আমি অনুভব করতে পারি। এর ওপর আমার কিছু বক্তৃতাও ছিল। আমি মাঝে মাঝে এ সম্পর্কে বলতাম। আমি প্রায়ই একটা কথা বলে থাকি—যদি আমি কবি না হতাম, তাহলে আমি অবশ্যই সঙ্গীতজ্ঞ হতাম।
# দেশে এবং বিদেশে আপনার প্রিয় লেখক কারা?
— অনেক নামই তাহলে বলতে হয়। আমাদের দেশে আমার প্রিয় লেখক কাকে বলব—সুধীন্দ্রনাথ দত্ত একজন, রবীন্দ্রনাথ...
# রবীন্দ্রনাথ নিয়ে তো আপনার অনেক লেখা আছে— গদ্য, পদ্য...
— আমি মনে করি, রবীন্দ্রনাথের মধ্যে বিশাল ভাণ্ডার। সেখান থেকে অনেক কিছু নেয়ার আছে। আর নজরুলকে আমি অনেক ভালোবাসি। তার কারণ হলো—তিনি নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন, বিদ্রোহ করেছিলেন এবং একটিমাত্র কবিতা তার আছে—‘বল বীর/ চির উন্নত মম শির’—যার সমতুল্য কাব্য বাংলা ভাষায় আর নেই।
# জীবনানন্দ দাশকে কীভাবে মূল্যায়ন করেন?
— জীবনানন্দ তো নির্জনতার কবি। তাঁর একটা কবিতায় আছে—উটের গ্রীবার মতো কোন এক নিস্তব্ধতা এসে—এটাই জীবনানন্দ সম্পর্কে আমি বলি।
# সাম্প্রতিককালে কী লিখছেন?
— কলাম-টলাম তো লিখছি। দু’একটা কবিতা হয়তো লিখছি। আরও কিছু লিখতে পারলে হয়তো ভালো হতো। আমার তো বয়স হয়ে গেছে আসলে আশি। এ বয়সে মানুষ আর লেখে না, ছেড়ে দেয়, কিন্তু আমি তো এখনও ছাড়িনি।
# বাংলাদেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা, এটা নিয়ে কি আপনি আশাবাদী? দেশটা কি সত্যিকার একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপনীত হবে?
— আমি অবশ্য আমাদের জনগণকে অধিক মূল্য দান করি। আমি শুধু বলব যে, আমাদের জনগণ নির্বোধ নয়। তারা সবই বুঝতে পারে।
# আপনার প্রিয় সুগন্ধি কী? আপনি তো সুগন্ধি ভালোবাসেন। আপনার গল্পও আছে—সৌরভের কাছে পরাজিত।
— আতর আমার প্রিয় সুগন্ধি। সবচেয়ে ভালো লাগে গোলাপি আতর। অসাধারণ। মানুষ আসল গোলাপি আতর পায় না। কিন্তু আসল গোলাপি আতর এক ধরনের পানির মধ্যে ভেসে ওঠা তেলের মতো। খুবই মধুর। একদিন লাগালে দু’তিন দিন থাকে।
# আপনার সংগ্রহে আছে?
— ছিল, এখন আর নেই।
# আপনার প্রিয় খাবার কী?
— আমার প্রিয় খাবার সাধারণত কোর্মা-পোলাও। এখনও এটা আমি ভালোবাসি, খেতেও পারি।
# আপনি একটা কথা বলেছেন, সমাজতন্ত্রের কথা এখন আর কেউ বলে না কারণ সাম্রাজ্যবাদের পরাক্রম বেড়ে গেছে। কিন্তু বর্তমানে যে আরব বিশ্বে ইসলামী গণজাগরণের ঢেউ উঠেছে, এটাকে আপনি কীভাবে দেখেন?
— এটা আমি একবার বলেছিলাম কিন্তু। একটা বিষয় আসছে, পৃথিবীতে যেটা সম্পূর্ণ নতুন এবং তার কোনো কামান-বন্দুক নেই। সে অস্ত্রশূন্য হাতে একটি পুস্তক নিয়ে আসছে—তার নাম হচ্ছে ইসলাম। এর হাতে হলো পবিত্র কোরআন শরীফ। এটা পুঁজিবাদের সঙ্গেও মিলে না, সমাজতন্ত্রের সঙ্গেও না। এটা হলো আধুনিক জগতের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ব্যাপার। এটা ব্যবসাকে হালাল করে, সুদকে হারাম করে দেয়। যে সমাজে সুদ আছে সে সমাজে সুখ নেই। সুদের সঙ্গে সুখের কোনো সম্পর্ক নেই। সুদ তো হারাম করে দিয়েছে। আমার মতে যারা সুদ খায়—আমাদের বইপত্রে আছে যে, যারা সুদ খায় তারা উঠে দাঁড়াতে পারে না।
# লেখালেখির ব্যাপারে আপনার সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা কে?
— এক সময় তো আমার স্ত্রীই ছিলেন এবং আমি তাকে খুব ভালোবাসতাম। এখন এই যে নিঃসঙ্গ আমি, এই ক্ষতি তো আর পূরণ হবে না, হয়ও না।
# এক সময় তো কবি হওয়ার জন্য লেখালেখি শুরু করেছেন। এখন কেন লিখছেন—এটা কি কোনো দায়বোধ?
— আমরা তো কোথাও পৌঁছতে চাই। ঠিক কোথায় পৌঁছতে চাই, সেটা আমি এখন বলছি না। তবে একটা কথা হচ্ছে—ইসলাম আসছে। ভবিষ্যত্ হলো ইসলামের হাতে।
# এখন যদি আপনার হাতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা দেয়া হয়, আপনার প্রথম কাজ কী হবে?
— প্রথম কথা হলো—এ দায়িত্ব আমি নিতে চাই না।
# আপনি চান না, কিন্তু যদি কোনোভাবে এমনটা হয়?
— তাহলে তো প্রথমে জনগণের ভাত-কাপড়ের নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। এটাই আমি করব।
# আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা জানাই সময় দেয়ার জন্য।

‘কবি ছাড়া আমি আর কিছুই নই’— এ কথা কবি আল মাহমুদের। যদিও তিনি ছোটগল্প, উপন্যাস, ব্যক্তিগত প্রবন্ধ ও শিশুসাহিত্য রচনায় বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, সাংবাদিক হিসেবে পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা, তথাপি তাঁর কবি পরিচয়ই তাকে বর্ণময় ঔজ্জ্বল্যে উদ্ভাসিত করেছে। দীর্ঘ ছয় দশক ধরে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যর সমৃদ্ধিসাধনে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূমিকার যথাযথ স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন অগুনতি পাঠকের কাছ থেকে। হাজার বছরের বাংলা কাব্যধারায় অবগাহন করে আল মাহমুদ বাংলাভাষী পাঠককে উপহার দিয়েছেন প্রায় তিনডজন কাব্যগ্রন্থ। কবিতায় তিনি বাঁকের পর বাঁক বদল করে ক্রমাগত ছুটেছেন সমুদ্রের দিকে। তাঁর অতৃপ্ত কবিপ্রাণ এখনও ধাবমান।
বয়স আশির কাছাকাছি হলেও প্রাণে তার তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। কবিতায় তিনি ধারণ করেছেন এই বাংলাদেশের আত্মা। ‘আজানের শব্দে কুপির শিখার পাশে অবগুণ্ঠিত কিষাণীর মুখ’ তিনি দেখেছেন। গ্রাম বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যে জারিত লোকজজীবনের অনুষঙ্গ তার কবিতাকে দিয়েছে বিশেষ মাত্রা, বিশেষ মহিমা। লোক লোকান্তর, সোনালি কাবিন, কালের কলস, মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো, আরব্য রজনীর রাজহাঁস, প্রহরান্তের পাশফেরা, বখতিয়ারের ঘোড়া, একচক্ষু হরিণ, আমি দূরগামী, দোয়েল ও দয়িতা, দ্বিতীয় ভাঙন, বিরামপুরের যাত্রী, উড়ালকাব্য, বরুদগন্ধী মানুষের দেশ কবির উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। কাবিলের বোন, উপমহাদেশ, ডাহুকী, পুরুষ সুন্দর, যে পারো ভুলিয়ে দাও, কবি ও কোলাহল, আগুনের মেয়ে, চেহারার চতুরঙ্গ তার আলোচিত উপন্যাস।
ছোট্টগল্প লিখেও চমকে দিয়েছেন তিনি পাঠকদের। পানকৌড়ির রক্ত, গন্ধবণিক, সৌরভের কাছে পরাজিত, ময়ূরীর মুখ, নদীর সতীন ইত্যাদি তার ছোট্টগল্প গ্রন্থ। যেভাবে বেড়ে উঠি, বিচূর্ণ আয়নার কবির মুখ—তার আত্মজৈবনিক উপন্যাস। শিশু-কিশোরদের জন্যও লিখেছেন বেশ ক’টি গ্রন্থ। লিখেছেন ভ্রমণ কাহিনী, সাহিত্য-সংস্কৃতি-ধর্ম বিষয়ক এবং আত্মগত অসংখ্য প্রবন্ধ ও কলাম।
গত ১১ জুলাই ছিল এই মহান কবির জন্মদিন। এ উপলক্ষে গত ১০ জুলাই সন্ধ্যায় কবির বাসায় হাজির হয়েছিলাম আমরা। মগবাজারের আয়শা-গোমতী ভিলায় কবির ফ্ল্যাটে যখন আমরা পৌঁছি তখন তিনি একটি পত্রিকার প্রতিনিধিকে সাক্ষাত্কার দিচ্ছিলেন। আমাদের ডাকলেন তাঁর শোয়ার ঘরে। কবিকে মনে হলো বেশ চঞ্চল ও উত্ফুল্ল। সাক্ষাত্কার দিলেন দীর্ঘ সময় ধরে। কথা বললেন বিভিন্ন বিষয়ে। তার এই সাক্ষাত্কারটি এখানে পত্রস্থ হলো।

সাক্ষাৎকার গ্রহণে : হাসান হাফিজ / আহমদ বাসির
সূত্র : আমার দেশ

Friday, July 27, 2012

ফ্রাংকেনস্টাইন | হুমায়ূন আহমেদ

আমি কি করে এক দানব তৈরি করলাম, সেই গল্প আপনাদের বলি। অয়োময়ের পর দু’বছর কেটে গেছে। হাতে কিছু সময় আছে। ভাবলাম সময়টা কাজে লাগানো যাক। টিভির বরকতউল্লাহ সাহেব অনেক দিন থেকেই তাঁকে একটা নাটক দেয়ার কথা বলছেন। ভাবলাম ছয়-সাত এপিসোডের একটা সিরিজ নাটক তাঁকে দিয়ে আবার শুরু করা যাক। এক সকালবেলা তাঁর সঙ্গে চা খেতে খেতে সব ঠিক করে ফেললাম। নাটক লেখা হবে ভূতপ্রেত নিয়ে। নাম ছায়াসঙ্গী। দেখলাম নাটকের বিষয়বস্তু শুনে তিনি তেমন ভরসা পাচ্ছেন না। আমি বললাম, ভাই আপনি কিছু ভাববেন না। এই নাটক দিয়ে আমরা লোকজনদের এমন ভয় পাইয়ে দেব যে, তারা রাতে বাতি নিভিয়ে ঘুমুতে পারবে না।
বরকতউল্লাহ সাহেব বিরস গলায় বললেন, মানুষদের ভয় দেখিয়ে লাভ কি?
অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। যেভাবে তিনি প্রশ্ন করলেন, তাতে যে কেউ ঘাবড়ে যাবে। আমি অবশ্যি দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে তাঁকে বোঝাতে সক্ষম হলাম যে, ভয় পাবার মধ্যেও আনন্দ আছে। কে না জানে সুকুমার কলার মূল ব্যাপারটাই হলো আনন্দ। বরকতউল্লাহ সাহেব নিমরাজি হলেন। আমি পরদিনই গা ছমছমানো এক ভূতের নাটক নিয়ে তাঁর কাছে উপস্থিত। নাটক পড়ে শোনালাম। নিজের নাটক পড়ে আমার নিজেরই গা ছমছম করতে লাগলো। বরকতউল্লাহ সাহেব বললেন, অসম্ভব! এই নাটক বানানোর মতো টেকনিক্যাল সাপোর্ট আমাদের নেই। আপনি সহজ কোনো নাটক দিন।
আমার মনটাই গেল খারাপ হয়ে। আমি বললাম, দেখি।
‘দেখাদেখি না। আপনাকে আজই নাটকের নাম দিতে হবে। টিভি গাইডে নাম ছাপা হবে।’
আমি একটা কাগজ টেনে লিখলাম, কোথাও কেউ নেই।
বরকত সাহেব বললেন, কোথাও কেউ নেই মানে কি? আমি তো আপনার সামনেই বসে আছি।
আমি বললাম, এটাই আমার নাটকের নাম। এই নামে আমার একটা উপন্যাস আছে। উপন্যাসটাই আমি নাটকে রূপান্তরিত করে দেব।
বরকত সাহেব আঁেক উঠে বললেন, না না, নতুন কিছু দিন। উপন্যাস তো অনেকের পড়া থাকবে। গল্প আগেই পত্রিকায় ছাপা হয়ে যাবে।
আমি বললাম, এটা আমার খুব প্রিয় লেখার একটি। আপনি দেখুন সুবর্ণাকে পাওয়া যায় কি-না। সুবর্ণাকে যদি পাওয়া যায়, তাহলে কম পরিশ্রমে সুন্দর একটা নাটক দাঁড়া হবে।
‘সুবর্ণাকে যদি না পাওয়া যায়, তাহলে কি আপনি নতুন নাটক লিখবেন?’
‘হ্যাঁ লিখব।’
সুবর্ণাকে পাওয়া গেল। আসাদুজ্জামান নূর বললেন, তিনি বাকেরের চরিত্রটি করতে চান। বাকেরের চরিত্রটি তাঁকেই দেয়া হলো। ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’ তৈরির দিকে আমি খানিকটা এগিয়ে গেলাম। বিজ্ঞানী ভিক্টর ফ্রাংকেনস্টাইনের দানবটা তো মানুষ এক নামে চেনে। বাকের হলো সেই ‘ফ্রাংকেনস্টাইন’।
নাটকটির সপ্তম পর্ব প্রচারের পর থেকে আমি অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করলাম। সবাই জানতে চাচ্ছে, বাকেরের ফাঁসি হবে কি-না। রোজ গাদা-গাদা চিঠি। টেলিফোনের পর টেলিফোন। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এই ব্যাকুলতার মানেটা কি? আমি নাটক লিখতে গিয়ে মূল বই অনুসরণ করছি। বই-এ বাকেরের ফাঁসি আছে। নাটকেও তাই হবে। যারা আমাকে চিঠি লিখেছেন তাদের সবাইকেই আমি জানালাম, হ্যাঁ ফাঁসি হবে। আমার কিছু বক্তব্য আছে। বাকেরকে ফাঁসিতে না ঝুলালে সেই বক্তব্য আমি দিতে পারব না। তাছাড়া আমাকে মূল বই অনুসরণ করতে হবে।
এক অধ্যাপিকা আমাকে জানালেন- ‘শেক্সপিয়ারের রোমিও জুলিয়েট বিয়োগান্তক লেখা। কিন্তু যখন রোমিও জুলিয়েট ছবি করা হলো তখন নায়ক-নায়িকার মিল দেখানো হলো। আপনি কেন দেখাবেন না? আপনাকে দেখাতেই হবে’।
এ কি যন্ত্রণা!
তবে এটা যন্ত্রণার শুধু শুরু। তবলার ঠুকঠাক। মূল বাদ্য শুরু হলো নবম পর্ব প্রচারের পর। আমি দশ বছর ধরে টিভিতে নাটক লিখছি, এই ব্যাপার আগে দেখিনি। পোস্টার, মিটিং, মিছিল—‘হুমায়ূনের চামড়া তুলে নেব আমরা।’ রাতে ঘুমুতে পারি না, দু’টা তিনটায় টেলিফোন। কিছু টেলিফোন তো রীতিমতো ভয়াবহ— ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে রাস্তায় লাশ পড়ে যাবে।’ আপাতদৃষ্টিতে এইসব কাণ্ডকারখানা আমার খারাপ লাগার কথা নয়, বরং ভালো লাগাই স্বাভাবিক। আমার একটি নাটক নিয়ে এতসব হচ্ছে এতে অহংবোধ তৃপ্ত হওয়ারই কথা। আমার তেমন ভালো লাগলো না। আমার মনে হলো একটা কিছু ব্যাপার আমি ধরতে পারছি। দর্শক রূপকথা দেখতে চাচ্ছে কেন? তারা কেন তাদের মতামত আমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে? আমি কি লিখব বা না লিখব, সেটা তো আমি ঠিক করব। অন্য কেউ আমাকে বলে দেবে কেন?
বাকেরের মতো মানুষদের কি ফাঁসি হচ্ছে না?
এ দেশে কি সাজানো মামলা হয় না?
নিরপরাধ মানুষ কি ফাঁসির দড়িতে ঝোলে না?
ঐ তো সেদিনই পত্রিকায় দেখলাম ৯০ বছর পর প্রমাণিত হলো লোকটি নির্দোষ। অথচ হত্যার দায়ে ৪০ বছর আগেই তার ফাঁসি হয়ে গেছে।
সাহিত্যের একটি প্রচলিত ধারা আছে, যেখানে সত্যের জয় দেখানো হয়। অত্যাচারী মোড়ল শেষ পর্যায়ে এসে মৃত্যুবরণ করেন জাগ্রত জনতার কাছে। বাস্তব কিন্তু সেরকম নয়। বাস্তবে অধিকাংশ সময়েই মোড়লরা মৃত্যুবরণ করেন না। বরং বেশ সুখে-শান্তিতেই থাকেন। ’৭১-এর রাজাকাররা এখন কি খুব খারাপ আছেন? আমার তো মনে হয় না। কুত্তাওয়ালীরা মরেন না, তাদের কেউ মারতে পারে না। ক্ষমতাবান লোকদের নিয়ে তারা মচ্ছব বসান। দূর থেকে আমাদের তারা নিয়ন্ত্রণ করেন।
আমি আমার নাটকে কুত্তাওয়ালীর প্রতি ঘৃণা তৈরি করতে চেয়েছি। তৈরি করেছিও। কুত্তাওয়ালীকে মেরে ফেলে কিন্তু সেই ঘৃণা আবার কমিয়েও দিয়েছি। আমরা হাঁফ ছেড়ে ভেবেছি— যাক দুষ্ট শাস্তি পেয়েছে। কিন্তু কুত্তাওয়ালী যদি বেঁচে থাকতো, তাহলে আমাদের ঘৃণা থেমে যেত না, প্রবহমান থাকতো। দর্শকরা এক ধরনের চাপ নিয়ে ঘুমুতে যেতেন।
আমার মূল উপন্যাসে কুত্তাওয়ালীর মৃত্যু হয়নি, নাটকে হয়েছে। কেন হয়েছে? হয়েছে, কারণ মানুষের দাবির কাছে আমি মাথা নত করেছি। কেনইবা করব না? মানুষই তো সব, তাদের জন্যই তো আমার লেখালেখি। তাদের তীব্র আবেগকে আমি মূল্য দেব না, তা তো হয় না। তবে তাদের আবেগকে মূল্য দিতে গিয়ে আমার কষ্ট হয়েছে। কারণ আমি জানি, আমি যা করছি তা ভুল। আমার লক্ষ্য মানুষের বিবেকের ওপর চাপ সৃষ্টি করা। সেই চাপ সৃষ্টি করতে হলে দেখাতে হবে যে কুত্তাওয়ালীরা বেঁচে থাকে। মারা যায় বাকেররা।
যে কারণে নাটকে কুত্তাওয়ালীর বেঁচে থাকা প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই কারণেই বাকেরের মৃত্যুরও প্রয়োজন ছিল। বাকেরের মৃত্যু না হলে আমি কিছুতেই দেখাতে পারতাম না যে এই সমাজে কত ভয়াবহ অন্যায় হয়। আপনাদের কি মনে আছে যে একজন মানুষ (?) পনেরো বছর জেলে ছিল যার কোনো বিচারই হয়নি। কোর্টে তার মামলাই ওঠেনি। ভিন দেশের কোনো কথা না। আমাদের দেশেরই কথা।
ভয়াবহ অন্যায়গুলো আমরাই করি। আমাদের মতো মানুষরাই করে এবং করায়। কিছু কিছু মামলায় দেখা গেছে পুলিশ অন্যায় করে, পোস্টমর্টেম যে ডাক্তার করেন তিনি অন্যায় করেন, ধুরন্ধর উকিলরা করেন। রহিমের গামছা চলে যায় করিমের কাঁধে।
পত্রিকায় দেখলাম, ১৮০ জন আইনজীবী আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন আমি নাকি এই নাটকে খারাপ উকিল দেখিয়ে তাঁদের মর্যাদাহানি করেছি। আমি ক্ষমা প্রার্থনা না করলে তারা আদালতের আশ্রয় নেবেন। উকিল সাহেবদের অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলছি, এই নাটকে একজন অসম্ভব ভালো উকিলও ছিলেন। মুনার উকিল। যিনি প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন সত্য প্রতিষ্ঠার। একশত আশিজন আইনজীবী নিজেদের সেই উকিলের সঙ্গে সম্পর্কিত না করে বদ উকিলের সঙ্গে করলেন। কেন?
আমাদের সমাজে কি কুত্তাওয়ালীর উকিলের মতো উকিল নেই? এমন আইনজীবী কি একজনও নেই যারা দিনকে রাত করার চেষ্টা চালাচ্ছেন না? মিথ্যা সাক্ষী কি আইনজীবীদেরই কেউ কেউ তৈরি করে দেন না? যদি না দেন, তা হলে বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কেন কাঁদে?
অতি অল্পতেই দেখা যাচ্ছে সবার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আমরা কি করি না করি তাতে কিছু যায় আসে না। আমাদের ভাবমূর্তি বজায় থাকলেই হলো। হায়রে ভাবমূর্তি!
আমি মনে হয় মূল প্রসঙ্গ থেকে সরে যাচ্ছি। মূল প্রসঙ্গে ফিরে আসি। নাটকটির শেষ পর্যায়ে আমি টেলিভিশন কর্তৃপক্ষের কাছে একটি আবেদন করলাম। শেষ পর্বের জন্য আমি দু’ঘণ্টা সময় চাইলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল প্রথম এক ঘণ্টায় শুধু কোর্ট দেখাব, পরের এক ঘণ্টা যাবে বাকি নাটক। কোর্ট দৃশ্যের পর পনেরো দিন অপেক্ষা করা দর্শকের জন্য কষ্টকর, নাটকের জন্যও শুভ নয়। যে টেনশান কোর্ট দৃশ্যে তৈরি হবে, পনেরো দিনের বিরতিতে তা নিচে নেমে যাবে। টেনশান তৈরি করতে হবে আবার গোড়া থেকে। আমার বিশ্বাস ছিল টেলিভিশন আমার যুক্তি মেনে নেবে। অতীতে আমার ‘অয়োময়’ নাটকের শেষ পর্বের জন্য দু’ঘণ্টা সময় দেয়া হয়েছিল। তাছাড়া আমার সবসময় মনে হয়েছে, টেলিভিশনের ওপর আমার খানিকটা দাবি আছে। গত দশ বছরে টিভির জন্য কম সময় তো দেইনি। আবেদনে লাভ হলো না। টিভি জানিয়ে দিলো— এই নাটকের জন্য বাড়তি সময় দেয়া হবে না।
দর্শকদের জন্য টিভি, টিভির জন্য দর্শক নয়— এই কথাটা টিভির কর্তাব্যক্তিরা কবে বুঝবেন কে জানে। আমি ৭০ মিনিটে গল্পের শেষ অংশ বলার প্রস্তুতি নিলাম। কোর্টের দৃশ্য, কুত্তাওয়ালীর হত্যা দৃশ্য, বাকেরের ফাঁসি সব এর মধ্যেই দেখাতে হবে। শুধু দেখালেই হবে না— সুন্দর করে দেখাতে হবে। দর্শকদের মনে জাগিয়ে তুলতে হবে গভীর বেদনাবোধ।
সন্ধ্যাবেলা হাত-মুখ ধুয়ে লিখতে বসলাম, রাতে ভাত খেতে গেলাম না। পুরোটা এক বৈঠকে বসে শেষ করতে হবে। রাত তিনটায় লেখা শেষ হলো। আমি পড়তে দিলাম আমার স্ত্রী গুলতেকিনকে। সে বলল, তোমার কোনো একটা সমস্যা আছে। মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা। আমি লক্ষ্য করেছি, তুমি অনেকখানি মমতা দিয়ে একটি চরিত্র তৈরি কর, তারপর তাকে মেরে ফেল। তুমি এইসব দিনরাত্রি’তে টুনিকে মেরেছ। এবার মারলে বাকেরকে।
আমি তাকে কোনো যুক্তি দিলাম না। ক্লান্ত হয়ে ঘুমুতে গেলাম। ঘুম হলো না। আবার উঠে এসে বারান্দায় বসলাম। অনেকদিন পর ভোর হওয়া দেখলাম। ভোরের প্রথম আলো মনের অস্পষ্টতা কাটাতে সাহায্য করে। আমার বেলাতেও করলো। আমার মন বলল, আমি যা করেছি ঠিকই করেছি। এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বাকেরকে মরতেই হবে।
যেদিন নাটক প্রচারিত হবে তার আগের দিন রাতে দৈনিক বাংলার আমার সাংবাদিক বন্ধু হাসান হাফিজ ব্যস্ত হয়ে টেলিফোন করলেন। আমাকে বললেন, আগামীকাল প্রেস ক্লাবের সামনে বাকের ভাইয়ের মুক্তির দাবিতে সমাবেশ হবে। সেখান থেকে তারা আপনার এবং বরকতউল্লাহ সাহেবের বাড়ি ঘেরাও করবে। পরিস্থিতি খারাপ হতে পারে। আপনি সরে যান।
নিজের ঘরে বসে সবাইকে নিয়ে আমার নাটক দেখার অভ্যাস। এই প্রথমবার নাটক প্রচারের দিন বাড়িঘর ছেড়ে চলে যেতে হলো। খবর নিয়ে জানলাম, বাড়ির সামনের রাস্তায় কয়েকটা ককটেল ফাটানো হয়েছে। রাগী কিছু ছেলে ঘোরাফেরা করছে। পুলিশ চলে এসেছে। বাসায় ফিরলাম রাত একটায়। দরজার ফাঁক দিয়ে কারা যেন দু’টা চিঠি রেখে গেছে। একটা চিঠিতে লেখা, ‘বাকেরের যেভাবে মৃত্যু হলো আপনার মৃত্যুও ঠিক সেইভাবেই হবে। আমরা আপনাকে ক্ষমা করলেও আল্লাহ ক্ষমা করবেন না।’ রাত দু’টার সময় ধানমন্ডি থানার একজন সাব ইন্সপেক্টর সাহেব আমাকে জানালেন, আপনি কোনো ভয় পাবেন না। আমরা আছি।
প্রচণ্ড মাথার যন্ত্রণা নিয়ে রাতে ঘুমুতে গেলাম। এপাশ-ওপাশ করছি। কিছুতেই ঘুম আসছে না। আমার ছোট মেয়েটাও জেগে আছে। সেও ঘুমুতে পারছে না। তার নাকি বাকের ভাইয়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে। আমি মেয়েকে নিয়ে বারান্দায় এসে বসলাম। মেয়ে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, বাবা তুমি উনাকে কেন মেরে ফেললে? আমি মেয়ের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, গল্পের একজন বাকের মারা গেছে যাতে সত্যিকার বাকেররা কখনও না মারা যায়।
কথাটা হয়তো আমার ক্লাস ফোরে পড়া মেয়ের জন্য একটু ভারী হয়ে গেল। ভারী হলেও এটাই আমার কথা। এই কথা নাটকের ভেতর দিয়ে যদি বুঝাতে না পেরে থাকি তবে তা আমার ব্যর্থতা। আমি আমার সীমাবদ্ধ ক্ষমতা দিয়ে চেষ্টা করেছি। আমার চেষ্টায় কোনো খাদ ছিল না। এইটুকু আমি আপনাদের বলতে চাই। বাকেরের মৃত্যুতে আপনারা যেমন ব্যথিত, আমিও ব্যথিত। আমার ব্যথা আপনাদের ব্যথার চেয়েও অনেক অনেক তীব্র। বিজ্ঞানী ড. ফ্রাংকেনস্টাইন নিজের তৈরি দানবটাকে ধ্বংস করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার আগে নিজেই ধ্বংস হলেন নিজের সৃষ্টির হাতে। আমি বেঁচে আছি। কিন্তু বাকের নামের একটি চরিত্রও তৈরি করেছিলাম। আজ সে নেই। মুনা আছে, সে কোনোদিনই বাকেরকে নিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে পারবে না। মুনার এই কষ্ট আমি বুকে ধারণ করে আছি। আপনারা ভুলে যাবেন। আমি তো ভুলব না। আমাকে বেঁচে থাকতে হবে মুনার কষ্ট হৃদয়ে ধারণ করে।
* হুমায়ূন আহমেদের ‘আপনারে আমি খুঁজিয়া বেড়াই’ (কাকলী প্রকাশনী, প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ১৯৯৪) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত
সূত্র : আমার দেশ

হুমায়ূন তীর্থ, নুহাশ পল্লী বাংলাদেশ ডট কম | আবদুল হাই শিকদার

জীবনানন্দ দাশের কবিতার নায়িকা শঙ্খমালার শিয়রে হিজল কাঠের চিতা জ্বলে। সে আগুনে সব কিছু পুড়ে যাওয়ার পর কবিকণ্ঠে ধ্বনিত হয়—‘এ পৃথিবী একবার পায় তাকে পায় না কো আর।’ হুমায়ূন আহমেদের অনন্ত যাত্রার পরও এ কথাটিই ঘুরে ফিরে বারবার প্রাণে বাজছে আমার। হয়তো আমার মতো অনেকেই এ রকমভাবে ভেবেছেন। হয়তো ভাবেননি। কিন্তু কথা তো সত্য, হুমায়ূন আহমেদের মতো শিল্পীরা প্রতিদিন জন্মায় না। যুগে যুগেও জন্মায় না। এমনকি শতাব্দী পেরিয়ে গেলেও না।
বাংলা সাহিত্যের এক হাজার চারশ’ বছরের ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে, কথাসাহিত্যে হুমায়ূনের চেয়ে জনপ্রিয়তা নিয়ে আর কোনো লেখকের আবির্ভাব হয়নি। আবার একথাও ঠিক, জনপ্রিয়তার মাপকাঠি যা-ই হোক, বাংলা ভাষার সাহিত্যাকাশে প্রথম ‘তারকা’ বা সুপারস্টার নজরুল। নজরুলের আগে-পরে সুপারস্টার শব্দটি আর ব্যবহারের সুযোগ পাওয়া যায়নি— যতদিন না হুমায়ূন আহমেদের আবির্ভাব ঘটেছে।
নজরুলের সময় মিডিয়ার এত প্রকোপ ছিল না। থাকলে হয়তো আমাদের হাতে প্রত্যক্ষ ভিজ্যুয়াল নজির পৌঁছত। আমাদের নির্ভর করতে হয় বিভিন্ন স্মৃতিচারণের ওপর। এ রকম এক স্মৃতিচারণ আমরা পেয়েছি চট্টগ্রামের রাউজানের জলিলনগরের আবদুল কুদ্দুচ মাস্টার এবং দৈনিক পূর্বকোণের চেয়ারম্যান মরহুম ইউসুফ চৌধুরীর কাছ থেকে। তাদের বর্ণনামতে, ঘটনার সময় ১৯২৮ সাল। জলিলনগরের হাজীবাড়ীর সামনে আয়োজিত চট্টগ্রাম সাহিত্য সম্মেলনে প্রধান অতিথি হয়ে এসেছেন কবি নজরুল। আশপাশের গ্রামগঞ্জে সাড়া পড়ে গেছে। দলে দলে মানুষ ছুটছে সমাবেশস্থলের দিকে। হাজার হাজার মানুষ পাগলের মতো ছুটে এসেছে নজরুলকে একনজর দেখার জন্য। লক্ষাধিক মানুষের সেই চাপ সামলানোর জন্য শেষ পর্যন্ত টিকিটের ব্যবস্থা করা হলো। টিকিটের দাম, ৫০০, ১০০, ৫০, ১০ ও ১ টাকা। তা-ই সই। টিকিট কেটে প্যান্ডেলে ঢুকে কবিকে দেখার জন্য হুলুস্থুল পড়ে গেল। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেই প্রথম টিকিট কেটে কবিদর্শনের ব্যবস্থা।
নজরুল দলবল নিয়ে রাস্তায় নামলে অনেক সময় কলকাতার ট্রাফিক জ্যাম লেগে যেত।
নজরুলের আগে কিংবা পরে অনেকে এসেছেন। কিন্তু নজরুল জাতির অন্তরে যে জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিলেন, সেখানে আর কেউ যেতে পারেননি। যেতে পারেননি বলেই একজন কবিকে নিয়ে ধুন্ধুমার কাণ্ড আমাদের জেনারেশনের দেখা হয়নি। আমাদের সামনে প্রকৃতি সেজন্যই তার সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়ে পাঠালেন হুমায়ূন আহমেদকে। তা-ও আবার পশ্চিম বাংলার রুক্ষ ধূসরতার মধ্যে নয়; তিনি এলেন বাংলাদেশের সহজ সুন্দর সাবলীল শ্যামল কোমল নদীমাতৃক পাললিক মৃত্তিকায়। যে বাংলাদেশ রবীন্দ্রনাথকে বিশ্বকবি হওয়ার উপকরণ জুগিয়েছে, যে বাংলাদেশ নজরুলকে করেছে জাতীয় কবি, দিয়েছে ধূমকেতুর বিস্ময় নিয়ে উদিত হওয়ার প্রেরণা, দিয়েছে অগ্নিবীণা বাজানোর অফুরন্ত প্রাণপ্রাচুর্য, সেই বাংলাদেশ মধ্যবিত্ত জীবনের অব্যক্ত কথাকে বাণীময় করার অনন্যসাধারণ শিল্পশক্তি দিয়ে যেন নিজ হাতে গড়ে উপস্থাপন করেছে হুমায়ূন আহমেদকে।
তাঁর আবির্ভাব যেন হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। অসাধারণ তার মাদকতা এবং চুম্বক শক্তি। তাঁর আগমন যেন দক্ষিণ থেকে বয়ে আসা বাতাসের মতো পুষ্পল। তিনি ব্যক্তিজীবনে যেমন ছিলেন প্রো-অ্যাক্টিভ, তেমনি তাঁর সাহিত্যকর্মও সেই পজিটিভনেসের তরজমা। তিনি নিজের অজান্তেই বাংলাদেশের সাহিত্যের পক্ষে যেন দাঁড়িয়ে গেলেন বটবৃক্ষ হয়ে। ভারতের পশ্চিম বাংলার সাহিত্যকে বিদায় জানিয়ে তিনি যেন উদ্বোধন ঘটালেন ভিন্ন এক বাংলাদেশের—যে বাংলাদেশ স্নিগ্ধ, কোমল, মানবিক, মমতাময়, প্রেমময়, সহজ কিন্তু আন্তরিক। চালটা হালকা, কিন্তু ব্যঞ্জনা বড় গভীর। হয়তো ক্ষেত্রবিশেষে মধ্যবিত্তের দায়হীন দায়িত্বহীন আনন্দ বিতরণে পরিণত হয়েছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাঁর প্রতিটি কাজের অন্তরেই ছিল মঙ্গলবোধ এবং দেশপ্রেম। তিনি তাঁর নিজের প্রজন্ম এবং পরের প্রজন্মকে যে আবিষ্ট করে রেখেছেন, সে তো এই কারণে নয় যে তিনি ভালো গল্প বলতে পারেন; বরং সত্য হলো, তিনি মধ্যবিত্তের ছোট ছোট দুঃখ-ব্যথা, কান্না-হাসিকে বাঙ্ময় করেছেন অননুকরণীয় মাধুর্যে। তাঁকে তিনি ঘরে ফিরিয়ে এনেছেন অশিক্ষিত আবেগ দিয়ে নয়; যুক্তি ও সৌন্দর্য দিয়ে, নিরাভরণ সত্যের সহজ-সরল মমতা দিয়ে। একই রকমভাবে বলা যায় আধিপত্যবাদী থাবার নিচ থেকে বাংলাদেশের সাহিত্যকে উদ্ধার করে তাকে দান করে গেছেন প্রাণপ্রাচুর্য ও নিজস্বতা। আর আমাদের প্রকাশনা শিল্পকে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠা।
কলকাতাকেন্দ্রিক ভাষাভঙ্গিকে বাতিল করে দিয়ে বাংলাদেশের জনজীবনের ভাষাকে শিল্পরূপ দিয়ে যে অসামান্য কাজটি তিনি করে গেলেন, তার মূল্যায়ন হতে সময় লাগবে। তিনি নিজের জন্য নতুন ভাষাশৈলী নির্মাণ করে আমাদের আক্কেল-হুঁশ হারিয়ে ফেলা, কেঁচোর মতো ঘিনঘিনে, পরমুখাপেক্ষী লেখক-কবিদের আঁতলামির জ্বালা সয়েছেন বটে; কিন্তু তাদেরও খানিকটা মানুষ করে দিয়ে গেছেন। এ প্রজন্মের লেখক-কবিরা সেজন্য পরবর্তীকালে গর্ববোধ করবেন যে, আমরা হুমায়ূনযুগে বাস করতাম।
হুমায়ূন তাঁর বিষয়বৈচিত্র্যের মতোই বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিকেও সম্মান দান করে গেছেন। মধ্যবিত্ত নাগরিক, সাদামাঠা জীবনের কাহিনী বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে তিনি রোপণ করে গেছেন লোকসংস্কৃতির গৌরবোজ্জ্বল নানা দিক। তাঁর নাটক, উপন্যাস, চলচ্চিত্র, সঙ্গীত—সব কিছুই এর প্রমাণ হিসেবে আমাদের সামনে আছে। এর মাধ্যমে বিরাজমান হীনম্মন্যতার শিকড় তিনি উপড়ে ফেলেছেন। লজিক এবং অ্যান্টি-লজিক, ফ্যান্টাসি এবং সায়েন্স ফিকশন—এসবের পরতে পরতে তিনি গেঁথে দিয়েছেন বাংলাদেশকে।
হুমায়ূন আহমদের মিসির আলি, হিমু, শুভ্র, রূপা, বাকের ভাই এজন্যই হয়তো হয়ে উঠেছে আমাদের আত্মার আত্মীয়। বাংলা সাহিত্যে একসঙ্গে এতগুলো সফল এবং জনপ্রিয় চরিত্র নির্মাণের একক কৃতিত্ব আসলেই হুমায়ূনের।
হুমায়ূনের আরেকটি অস্ত্র তাঁর পরিচ্ছন্নতা। জীবনের ক্লেদ, গ্লানি, হিংসা, ঘৃণা—এসবের বাইরে গিয়ে মানুষকে তিনি বড় করে তুলেছেন সবসময়। একই পরিবারের মা, বাবা, ভাই, বোন, দাদা, দাদি—সবাই হুমায়ূনের অনুরক্ত হয়েছেন এ পরিচ্ছন্নতার জোছনায় অবগাহন করে। মানুষকে তিনি সুপারম্যান হিসেবে দেখেননি কখনও, দেখেছেন দোষে-গুণের ভেতরে সন্তরণশীল। এজন্যই শ্রাবণ মেঘের দিনের দাদা, বহুব্রীহির এমদাদ খোন্দকার কিংবা নান্দাইলের ইউনুসের জন্যও চোখে পানি আসে আমাদের। তাঁর মানুষ কেউই সম্পূর্ণ খারাপ মানুষ নয়, কেউ পরিপূর্ণ মানুষ নয়—সব মিলিয়ে বলা যায় অসাধারণ এক জীবনশিল্পী হুমায়ূন। হুমায়ূনের মৃত্যু নেই। তিনি আমাদের সাহিত্যের অজর-অমরদের তালিকায় নাম লিখিয়ে গেছেন জীবদ্দশায়ই।
দুই.
হুমায়ূন আহমেদকে সাহিত্যসম্রাট সামনাসামনি বললে হয়তো তিনি হেসে উঠতেন। কারণ এসব সম্রাট-রাজা, রায় বাহাদুর, মন্ত্রী, আমলা, শিল্পপতিদের লেখক তো ছিলেন না তিনি। তিনি ছিলেন সাধারণ মানুষের মনোনায়ক।
এই মনোনায়কদের ইতিহাসে আমাদের সাহিত্যে প্রথম নাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সাম্প্রদায়িকতার নোংরামিটুকু বাদ দিলে তিনি অসাধারণ। জনপ্রিয়তার কাতারে প্রথম নাম।
বঙ্কিমের পরে নাম আসে মীর মশাররফ হোসেনের। মীরের বিষাদ-সিন্ধু পাঠ করেননি, এমন মানুষ একসময় এদেশে বিরল ছিল। একটু বিরতি দিয়ে এর পরের নাম শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের। এরপর জনপ্রিয়তার কাতারে, বাঙালি মুসলমানদের ক্ষেত্রে নজিবর রহমান সাহিত্যরত্ন। একদা এমন ছিল— মেয়েদের বিয়ে হলে এদেশের মায়েরা, মেয়েদের শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার সময় স্যুটকেসে দু’টি বই দিয়ে দিতেন। এর একটি ছিল মকসুদুল মুমেনীন অন্যটি নজিবর রহমানের আনোয়ারা। আনোয়ারা দীর্ঘদিন বাংলার মুসলমান সংসারজীবনে অবশ্যপাঠ্য হয়ে ছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে আমাদের উপন্যাস, জনপ্রিয় ধারার উপন্যাস বলে আমরা মানতাম আকবর হোসেনকে। কিন্তু বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের সাহিত্যের লেখাকে পেশা হিসেবে নেয়ার সত্ সাহস প্রথম দেখিয়েছিলেন কাজী আনোয়ার হোসেন। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের যৌবনের বিরাট অংশ দখল করে ছিল কাজী আনোয়ার হোসেনের ‘মাসুদ রানা’ থ্রিলার সিরিজ। মাসুদ রানা ছিল দুর্ধর্ষ স্পাই। আমরা সে রকম হতে চাইতাম। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ, মধ্যবিত্ত শ্রেণী অপেক্ষায় ছিল এমন একজনের যে, তাদের প্রাণের পাশে আসন পেতে বসে তার সমস্যাজর্জরিত জীবনের দুঃখ-কষ্ট ভুলিয়ে তাকে নিয়ে যাবে আনন্দের অলকাপুরীতে—তার ভাঙা ঘরের জীর্ণ উঠানের জোছনা দিয়েও যে আলিফ লায়লার রোমান্টিক পৃথিবী নির্মাণ করবে—সেই কাঙ্ক্ষিত প্রতিভার নামই হুমায়ূন আহমেদ। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রথম এবং সফলতম প্রতিনিধি। সত্যিই তো, হুমায়ূনের লেখক জীবনের বয়স বাংলাদেশের সমান। সেদিক থেকেও তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের সত্যিকার নায়ক। তাঁর লেখালেখির শুরু এবং শেষ তো খাঁটি বাংলাদেশেই। আবার তিনিই বাংলাদেশের লেখালেখির জগতের প্রথম পেশাদার ও সার্বক্ষণিক লেখক। প্রথম এবং সুপারস্টার। তিনিই তো সেই লেখক, যাঁর বই বাংলা ভাষার সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে।
তিন.
নুহাশ পল্লীতে হুমায়ূন আহমেদের দাফন সব বিবেচনায়ই যথার্থ হয়েছে। সেদিক থেকে হুমায়ূনের ছেলেমেয়ে ও ভাইবোনদের প্রতি সহানুভূতি রেখেও বলব, শাওনের সিদ্ধান্তই সঠিক। এই সঠিকত্ব বুঝতে আরেকটু সময় লাগবে। সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই এর গুরুত্ব ও তাত্পর্য অনুধাবন করবে আশা করি।
বাংলা সাহিত্যের শেষ একশ’ বছরে দেখা যায়, মাত্র দু’জন লেখক ব্যাপকভিত্তিক স্বপ্ন ও পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেছেন। আগের জন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরের জন হুমায়ূন আহমেদ। মাঝে কাজী নজরুলও চেয়েছিলেন বড় ধরনের কিছু একটা করার। কিন্তু তিনি সময় পাননি।
রবীন্দ্রনাথ পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন বোলপুরের আশ্রম। সেখানেই তিনি তাঁর মেধা, শ্রম ও অর্থ ব্যয় করে বাস্তব রূপ দেন স্বপ্নের। গড়ে তোলেন শান্তিনিকেতন। যে শান্তিনিকেতন আজ যেমন কবিতীর্থ-রবিতীর্থ, তেমনি ভারতের সাংস্কৃতিক প্রাণকেন্দ্রও বটে। শান্তিনিকেতনের যে কনসেপ্ট, সেই কনসেপ্ট কলকাতার কোলাহলে রূপ দেয়া সম্ভব হতো না। এর জন্য দরকার ছিল কোলাহলবর্জিত, প্রকৃতিঘনিষ্ঠ পরিবেশ। আজকের শান্তিনিকেতন তাই শিক্ষা, জ্ঞান ও সংস্কৃতিচর্চার প্রধান পীঠস্থানই শুধু নয়, এর পর্যটন ভ্যালুও অনেক। শান্তিনিকেতনের পরতে পরতে, পাতায় পাতায়, তৃণে-স্থাপত্যে সর্বত্রই রবীন্দ্রনাথ। সেজন্য শান্তিনিকেতনে না গেলে রবীন্দ্রদর্শন ও চর্চা অসম্পূর্ণ হয়ে থাকে।
এ আলোকেই দেখতে অনুরোধ করি নুহাশ পল্লীকে। বাংলাদেশের আর কোনো লেখক হুমায়ূনের মতো ভাগ্য নিয়ে জন্মায়নি। শুধু বাংলাদেশ কেন, ভারতের পশ্চিম বাংলায়ও হুমায়ূনের মতো এত বিশাল জনপ্রিয়তা নিয়ে কেউ দাঁড়িয়ে নেই। এমন সুযোগও এদেশের আর লেখকের জীবনে আসেনি। রবীন্দ্রনাথ যেখানে পৈত্রিক সূত্রে পেয়েছিলেন, হুমায়ূন সেখানে নিজে অর্জন করেছেন। নিজস্ব অর্থ, ঘাম, মেধা আর স্বপ্ন দিয়ে গড়ে তুলেছেন নুহাশ পল্লী।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ লেখকই অতিসাধারণ মানের জীবনযাপন করেন। তাদের বেশিরভাগই জনপ্রিয়তা ও বিত্তের বিচারে ফকির। দিন এনে দিন খায়। এদের মধ্যেও স্বপ্নহীন সবাই, তা নয়। কিন্তু মুশকিলটা হলো, হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয়তা ও বিত্তশালী হওয়া তাদের একজীবনে সম্ভব নয়—তারা নুহাশ পল্লীর মতো স্বপ্নভূমি রচনা করবে, কীভাবে?
আবার যাদের সাধ্য ছিল, তাদের মধ্যে বড় কোনো স্বপ্ন নেই। এদের বেশিরভাগই পার্টটাইম লেখক। এরা অর্থ-বিত্তের দৌড়ে ব্যর্থ হয়ে লেখক হিসেবে নাম কামানোর ফিকিরে ঘুরছেন। কেউ সাবেক অতিচতুর আমলা, কেউবা ক্ষুদ্রবুদ্ধির সাংবাদিক। এদের স্বার্থপর জীবনের ক্যানভাসও অতিক্ষুদ্র। সবকিছু দেখেন নিজেদের আত্মার সাইজে। বড় স্বপ্ন বড় কল্পনা ধারণ করার মতো মাথাও এদের নেই। অনেকটা বন্য বরাহের মতো। আত্মপরতার যে কাদাটুকু এরা নাগরিক কোলাহলে পেয়েছেন, সেই কাদা ঘেঁটেই এরা জীবন ধন্য মনে করেন। এদের মাথায় কীভাবে আসবে নাগরিক কোলাহলের বাইরে গভীর নিবিড় প্রকৃতির মধ্যে মমতার রেণুমাখা একটি নুহাশ পল্লী সৃষ্টির।
চার.
শেক্সপিয়র দর্শনের জন্য যারা স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন গেছেন, তারা দেখে থাকবেন কীভাবে ছোট একটা শহরের পুরোটাই গড়ে উঠেছে শেক্সপিয়রকে নিয়ে। কী নেই সেখানে? আছে শেক্সপিয়রের স্মৃতিবিজড়িত বাড়ি, আছে সোয়ান থিয়েটার, আছে প্রেক্ষাগৃহ, আছে শপিংমল, আছে মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, পর্যটন অফিস, গাইড, আরও কত কি! সারাবছরই চলছে নানা উত্সব। সেয়ান থিয়েটারে চলছে বিরতিহীন শেক্সপিয়রের বিভিন্ন নাটকের বিরতিহীন পরিবেশনা, চলছে আবৃত্তির অনুষ্ঠান। মোট কথা, সে এক এলাহি কাণ্ড। চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না, কীভাবে শেক্সপিয়রকে নিয়ে মেতে আছে ব্রিটিশরা। দেশি পর্যটকের পাশাপাশি দেশ-দেশান্তর থেকে প্রতিদিন গাড়ি ভরে ভরে পর্যটক যাচ্ছে স্ট্র্র্র্র্যাটফোর্ডে।
শান্তিনিকেতন যারা দেখেছেন, তারা আমার কথার সারবত্তা কিছুটা আঁচ করতে পারবেন।
ভারত বা ব্রিটেনের মতো ইরানও তাদের বিভিন্ন শহরকে অনুপম করে সাজিয়ে রেখেছে বিভিন্ন কবির নামে। এক্ষেত্রে সিরাজনগরীর হাফিজ এভিনিউতে হাফিজ এবং সাদিয়ার শেখ সাদীকে নিয়ে যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, তা থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়ার আছে অনেক কিছু।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের আলোকে হুমায়ূন আহমেদের স্বপ্নের ও প্রিয় স্থান নুহাশ পল্লীকে গড়ে তোলার দারুণ একটা সুযোগ এসেছে আমাদের সামনে। এই সুযোগ কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে তার পরিবার যদি সহযোগিতা করে, তাহলে নুহাশ হয়ে উঠতে পারে ‘হুমায়ূন তীর্থ’; হয়ে উঠতে পারে বাংলাদেশের অন্যরকম এক স্ট্র্যাটফোর্ড আপন অ্যাভন; হয়ে উঠতে পারে একটা খাঁটি বাংলাদেশী শান্তিনিকেতন।
একটা চমত্কার মাস্টার প্ল্যানের আওতায় হুমায়ূনের এই প্রিয় নুহাশ পল্লীকে ঘিরে গড়ে উঠতে পারে হুমায়ূন আহমেদ মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, উন্মুক্ত থিয়েটার হল, প্রেক্ষাগৃহ, অ্যান্টিক শপ, গবেষণা কেন্দ্র, এমনকি একটি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত।
ঢাকা থেকে পর্যটকদের নিয়ে যাওয়ার জন্য থাকবে চমত্কার কোচ সার্ভিস। থাকবে পেশাদার গাইড। এই পর্যটকরা গিয়ে দেখবেন সেখানে দিনরাত চলছে নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড। অমাবস্যার রাতে যেখানে মঞ্চস্থ হবে মিসির আলি বিষয়ক নাটক অথবা চলচ্চিত্র। পূর্ণিমার রাতে বিশেষ ব্যবস্থায় চলবে হিমুকে নিয়ে নানা কাণ্ড। শরতে কিংবা চৈত্রের চন্দ্রিমা রাতে হবে সঙ্গীতের আসর। এভাবে মাসের প্রতিটি দিন কবে কী হবে, তার আগাম রুটিন জানিয়ে দেয়া হবে সবাইকে। সেই মোতাবেক ট্যুরিস্টরা যাবেন নুহাশ পল্লীতে। আবার এমনও হতে পারে নুহাশ পল্লীর হুমায়ূন তীর্থের প্রতিটি দিন হুমায়ূনের এক একটি বইয়ের নামে অথবা চরিত্রের নামে হবে। যেমন- শঙ্খনীল কারাগার দিবস, মিসির আলি দিবস ইত্যাদি। সেদিনের পল্লী সাজবে সংশ্লিষ্ট গ্রন্থ বা চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে। এতে পর্যটন ভ্যালুও বাড়বে অনেকখানি। ঢাকার কোলাহল থেকে ক্ষণিক নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য নানা বয়সের নরনারীরা ছুটে যাবে নুহাশ পল্লীর হুমায়ূন তীর্থে। নির্মল আনন্দের মধ্যে একটি দিন কাটিয়ে তারা ফিরে যাবেন কর্মজীবনে। বিদেশী ট্যুরিস্টরা ঢাকায় এসে বলবেন ‘হুমায়ূন তীর্থ নুহাশ পল্লী, বাংলাদেশ’ এ যাব।
একই সঙ্গে হুমায়ূনকে নিয়ে গবেষণার জন্য জমা হবেন গবেষকরা, গ্রন্থাগারে থাকবে হুমায়ূনের বই এবং হুমায়ূনকে নিয়ে লিখিত গ্রন্থাদি। বাংলাদেশের সমাজ জীবন ও সংস্কৃতির উপর গ্রন্থরাজি। অর্থাত্ হুমায়ূনকে ঘিরে শিক্ষা-সংস্কৃতির একটি পজিটিভ চর্চা যদি নুহাশ পল্লীতে শুরু হয়, তাহলে বাংলাদেশ যেমন পাবে ঘুরে দাঁড়ানো ও বেড়ানোর নতুন মাত্রা, তেমনি শান্তি পাবে হুমায়ূন আহমেদের আত্মাও।
শাওন, শীলা, নোভা, বিপাশা, নুহাশ, নিষাদ, নিনিতরা কি এই লেখাটি পড়বে—আমি জানি না। যদি পড়ে এবং ছিটেফোঁটাও যদি বাস্তাবায়ন হয়, ধন্য মানব নিজেকে। আর এই যে কথাগুলো বললাম, সে আলোকে যদি বিচার করা যায়, তাহলে দেখা যাবে হুমায়ূনকে দাফন করার জন্য নুহাশ পল্লীই যথার্থ স্থান। এখন স্বাপ্নিক ও স্বপ্ন আমাদের হাত ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবে ভবিষ্যতের দিকে।
সূত্র : আমার দেশ

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ