১
বিংশ শতাব্দী বাংলার মুসলমানের রেনেসাঁর যুগ। একালে যে সকল মনীষী মুসলিম জাগরণের জন্য নানাভাবে সাধনা করে গেছেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অন্যতম অগ্রগণ্য। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সে কালে মুসলিম রক্ষণশীল ও সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পড়তে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়েন। সংস্কৃতের এমএ পাঠক্রমে বেদ-শাস্ত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেদ পড়াতেন বিখ্যাত বৈদিক পণ্ডিত সত্যব্রত শামশ্রমী। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান প্রাচীনপন্থী গোঁড়া পণ্ডিত ছিলেন। মুসলমান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছাত্র হবেন এবং তিনি তাঁকে বেদ পড়াবেন—এ হয় না। এ সম্বন্ধে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন যে, ‘বিধর্মী’কে তিনি বেদ পড়াবেন না। ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধেও তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না; বরং তিনি পদত্যাগের হুমকি দিলেন। এ ব্যাপারে সে সময় কলকাতায় বিশেষ আন্দোলন হয়। বিশেষ করে তখনকার দিনের বিখ্যাত মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী, যিনি সে সময় উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁর সুপরিচিত ইংরেজি পত্রিকা কমরেড (ঈড়সত্ধফব) প্রকাশ করতেন, তিনি ঞযব ঝযধযরফঁষষধয অভভধরত্ শীর্ষক কতকগুলো জোরালো প্রবন্ধ লেখেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এভাবে লোকের চোখের সামনে এসে পড়েন। এ নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার, বিলেতে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা ইত্যাদি কারণে তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নাম বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষিত মহলে বহুল আলোচিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এ ব্যাপারে বিব্রতবোধ করেন এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে ঈড়সঢ়ধত্ধঃরাব চযরষড়ষড়মু বা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে এমএ পড়ার পরামর্শ দেন। তখন বিভাগটি সবেমাত্র খোলা হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার পরামর্শ মেনে নেন। তিনি ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে যথারীতি এমএ পাস করেন। এ সঙ্গে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে তিনি আইন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। এরও প্রায় এক যুগ পরে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি ডি-লিট এবং ধ্বনি-বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ডিপ্লোফোন লাভ করেন।
এরপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাতক্ষীরায় ওকালতি আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল বিদ্যাচর্চার দিকে, পঠন-পাঠন ও গবেষণার দিকে। ওকালতিতে তিনি মন বসাতে পারেননি। স্যার আশুতোষ তাঁর গুণগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিজের হিতৈষী গুরুর মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন। স্যার আশুতোষ তাঁকে আইন ব্যবসা ছেড়ে বিদ্যার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে উপদেশ দেন। মূলত তাঁরই উত্সাহে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লক্ষ্মীর রত্নভাণ্ডার ত্যাগ করে সরস্বতীর পুষ্পোদ্যানে স্থান লাভ করেন এবং তাঁর কালে বাংলা তথা ভারতবাসী হিন্দু-মুসলমানের মানসিক উত্কর্ষের পক্ষে বিশেষ লাভ ও উপকার হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঐঁসধহরঃরবং বা ‘মানবিকী’ বিদ্যায়, অর্থাত্ ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস-সমাজনীতি-অর্থনীতি-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-আধ্যাত্মিকতার সাধন এবং রস অর্থাত্ শাশ্বত সত্তার মধ্যে নিহিত যে আনন্দের অনুভূতি—এসব বিষয়ে তিনি একজন ‘সর্বন্ধর’ আচার্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।
২
পণ্ডিতমহলে অনেকেই বলে থাকেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন গড়ারহম ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ—চলন্ত বিশ্বকোষ বা জীবন্ত অভিধান। অনেকের ধারণা যে, তিনি প্রায় দুই কুড়ি ভাষা জানতেন। একবার কারো কোনো লেখায় ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঊনচল্লিশটি ভাষা জানেন’ বলে উল্লিখিত হয়। আমরা কয়েকজন এদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : তারা অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলেন। আসলে তিনি খুব ভালো করে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারতেন বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ট, উর্দু, হিন্দি, সিংহলি, কাশ্মীরি, নেপালি, অহমিয়া, ওড়িয়া, পোশতু এবং আরো কয়েকটি ভাষা। আর পড়তে ও বুঝতে পারতেন আরো দু’ডজনের মতো ভাষা। এক কথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন ইংরেজিতে যাকে বলে চড়ষুমষড়ঃ—বহুভাষিক। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ও ভাষা বিশ্লেষণে বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান, বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার তাত্পর্য ব্যাখ্যায় তাঁর তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছিল—যা তাঁর তাত্ত্বিকতার মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বস্তুত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞানপরিধির বিস্তার আমাদের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত বলতে পারি, এ এলাকায় যে ক’জন ভাষাতত্ত্বের অনুশীলনে নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে ঋণী। তাঁরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণায় তারা ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় আত্মনিয়োগে সমর্থ হয়েছেন। আমার নিজেরও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র উত্সাহ ও প্রেরণায়ই হয়েছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমাদের দেশ-জাতি-ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। গবেষণা ছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে তাঁর অগাধ জ্ঞান, কোরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ক তাঁর সুবিজ্ঞ আলোচনা সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তিনি ফরাসি, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ইত্যাদি নানা ভাষায় বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র অবদান সম্বন্ধে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব।
৩
ভাষাতত্ত্বমূলক আলোচনা আমাদের দেশে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব তিন-চার শতকে যাস্ক, পাণিনি প্রভৃতি ভাষাবিজ্ঞানী বিবৃতিমূলক ভাষাতত্ত্বের প্রথম সূত্রপাত করেন। পাণিনি ছিলেন পাকিস্তানি। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে কালাতুর গ্রামে তিনি বাস করতেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মী ও উত্তরসূরিরা সে অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন কথা আর্য ও সংস্কৃত ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাদের আলোচনার পদ্ধতি ও ধারা আজও বিবৃতিমূলক ভাষাবিজ্ঞানের আদর্শস্থানীয় হয়ে রয়েছে। বর্তমানের ইউরোপ ও আমেরিকার আধুনিক ভাষাতত্ত্বেও আলোচনা তাঁরই আদর্শ অনুসরণ করে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ যুগেও পাশ্চাত্য দেশে পাণিনির ব্যাকরণকে মানুষের জ্ঞানের চরম নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।
পাণিনির পরেও অনেক দিন পর্যন্ত পাক-ভারতে এই ধারায় ভাষা-বিষয়ের আলোচনা অব্যাহত ছিল। পাণিনির মতো পতঞ্জলি প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী এই উপমহাদেশে বর্ণনাভিত্তিক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। এরপর কিছুকাল আমরা আমাদের নিজেদের ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বোধকরি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতোই ভাষাতত্ত্বের আলোচনায়ও ভাটা পড়ে। ইউরোপ তথা পশ্চিম গোলার্ধ ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অনুশীলনীতে হাত দেয় আরো অনেক পরে। পশ্চিমের চোখে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলির আবিষ্কার এক মহাবিস্ময়। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের মূল সূত্রটি এখান থেকেই নিয়ে তারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিজেদের ভাষার বিশ্লেষণ শুরু করলেন।
কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভাষাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই দেখা হতো। সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার শব্দসম্ভারে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্য, মিল-গরমিল বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের ভাষাগুলোর স্বরূপ নির্ণয়ই ছিল তখনকার দিনের মোটামুটি ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা।
আজ আবার পুরনো ধারার নবজাগৃতির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের দিকেই আবার সবার নজর ফিরেছে। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় দেশি ও বিদেশি মনীষীর অবদানের ইতিহাস বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু তাদের বিচার-বিশ্লেষণের স্বরূপ বোঝার জন্য তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিঞ্চিত্ আলোচনার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক বুঝতে হলেও এদের সামগ্রিক
আলোচনার একটি মোটামুটি আভাস জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন। এর আগে ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলে নিলে আমাদের আলোচনার সুবিধা হবে।
ভাষাতত্ত্বে তিন ধারার ভাষা সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে—প্রথমত, বর্ণনামূলক ধারা। একে ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ও বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব।
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বে ভাষাতাত্ত্বিক কোনো বিশেষ ভাষার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আলোচনার সুবিধার জন্য এই কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন : ১. ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) ২. ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology) ৩. রূপতত্ত্ব (Morphology) ৪. পদক্রম বা বাক্যরীতি (ঝুহঃধী) ৫. বাগর্থ বিজ্ঞান (Semantics) এবং ৬. অভিধান বিজ্ঞান (Lexicography)|
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের মূল কথা হলো, যে কোনো একটি ভাষার বিশেষ কালের বিশেষ রূপের বর্ণনা করা। তা করতে হলে সেই বিশেষ ভাষাভাষী লোকের মধ্য থেকে নির্বাচিত যে কোনো একজনের মুখের ভাষাই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এভাবে একেকটি উপভাষার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে সেই ভাষার সামগ্রিক বর্ণনা সম্ভব হয়। মানুষের মুখের ভাষা যেমন ব্যবহৃত হয়, তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে সূত্র নির্ণয় করতে হয়। এই ধরনের বর্ণনায় ভাষার কোন নিয়ম আছে আর কোন নিয়ম নেই, তারই উল্লেখ থাকে; ভাষায় কী হওয়া উচিত আর কী হওয়া উচিত নয়, সে ধরনের বিধি-নিষেধের স্থান সেখানে নেই। এমনকি কেন এমন হয়, কেন এমন হয় না, তারও বিশ্লেষণ সেখানে অসঙ্গত। ভাষায় ব্যবহৃত নানা উপাদানকে একটা বিশেষ সংজ্ঞার মাধ্যমে একটা পদ্ধতির বন্ধনে আবদ্ধ করে যে বিশ্লেষণ শাস্ত্র গড়ে ওঠে, তাকেই তখন বলা হয় সেই ভাষার ব্যাকরণ।
এভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য ভাষাবিজ্ঞানী তার আলোচনাকে উল্লিখিত কয়েক ভাগে ভাগ করে থাকেন। ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) শাখায় ভাষার ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ পদ্ধতি, তাদের ব্যবহার ও স্থানভেদে তাদের উচ্চারণে তারতম্য, উচ্চারণের ব্যবহার-সঙ্গতি, সন্ধি ও বণ্টন, যতি ও ছন্দোবিন্যাস, এমনকি লিখনপদ্ধতিতে তাদের রূপায়ণ ইত্যাদির যথাযথ আলোচনা হয়। উচ্চারণের স্থান ও রকম, এমনকি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও বিশদ আলোচনা সাধারণ ধ্বনিতত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত।
ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোচনায় বিশ্লিষ্ট বর্ণনাকে যখন গাণিতিক সংকেতে আবদ্ধ করা হয়, তখনই একে ধ্বনিতত্ত্ব নাম দেয়া হয়। অর্থাত্ ধ্বনিবিজ্ঞানে যা ছিল বস্তুসম্পৃক্ত (পড়হপত্বঃব), ধ্বনিতত্ত্বে তা হয়ে ওঠে নির্বস্তুক (ধনংঃত্ধপঃ)। বিজ্ঞানের আলোচনায় এই জগতের নানা পদার্থেরই স্বভাব, গতি, শক্তি ও গুণ নানা সংকেতে ধরা যায়। যেমন অংকশাস্ত্রে—১ (এক), ২ (দুই) অথবা (বর্গমূলক), . (দশমিক বিন্দু), + (যোগ চিহ্ন), - (বিয়োগ চিহ্ন), – (পূরণ চিহ্ন), % (ভাগ চিহ্ন) ইত্যাদি মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝানো হয়। ধ্বনিবিজ্ঞানের (Phonetics) বিশিষ্ট রূপও সেইরূপ নানা সংকেত ও চিহ্নের সাহায্যের ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) বিধৃত হয়। এক কথায় ধ্বনিবিজ্ঞানে (Phonetics), যার বিশ্লেষণ, ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) তারই গাণিতিক প্রকাশ। তাই ধ্বনিবিজ্ঞানে যাকে নানা কথায় বিশ্লেষণ করা হয়, ধ্বনিতত্ত্বে তাই হয় সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত কতকগুলো সংকেত বা সূত্রের (Formula) সমষ্টি। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের এই দুটি শাখাকে একই বিভাগের দুটি স্তর বা পর্যায় মনে করা যেতে পারে।
রূপতত্ত্ব (Morhphology) বিভাগে পদ ও শব্দসাধন পদ্ধতি অর্থাত্ পদ ও শব্দগঠন সম্পর্কিত নিয়মাবলি আলোচিত হয়। এতে সাধিত শব্দ বা পদের ধাতু, প্রত্যয়, অনুসর্গ, বিভক্তি প্রভৃতি ক্ষুদ্রতম অংশ নির্ণীত হয়। সমাস, অব্যয়, নিপাত ইত্যাদির আলোচনাও রূপতত্ত্বের প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্র। পদক্রম ও বাক্যরীতি (Syntax) বিভাগে আলোচিত হয় বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ ও পদগুলোর ক্রম আর বাক্য-বিশ্লেষণ পদ্ধতি।
মূলত রূপতত্ত্ব (Morphology) ও পদক্রম (Syntax) একই বিভাগের দু’টি স্তর বা পর্যায়। কেননা, শব্দ ও পদের অংশ নিরূপণ বাক্য মধ্যে শব্দের অবস্থান ও কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। তাই কেউ কেউ এই দু’টি শাখাকে মিলিতভাবে ব্যাকরণও বলে থাকেন। কিন্তু ব্যাকরণের কার্যবিধির ধারায় ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম—এই সমুদয়ের পর্যায়ক্রমে পৃথক পৃথক ও সম্মিলিত এবং সামগ্রিক আলোচনা ও বিশ্লেষণই বাঞ্ছনীয়; তাই একটিকে ছেড়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। চারটি বিভাগের বিশ্লেষণই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারো কারো ধারণা এই যে, যেহেতু ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম যথাক্রমে পরপর আলোচিত হয়, তাই এদের আলোচনার ধারাক্রমে এদের স্থান নির্ণীত হবে; যেমন ধ্বনিবিজ্ঞান নিম্নস্তরের, ধ্বনিতত্ত্ব তার পরের, রূপতত্ত্ব তারও পরের এবং পদক্রম সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু এরূপ ধারণা ভুল। আসলে এটি আলোচনার সুবিধার্থে এক ধরনের বিভাগ মাত্র, এতে স্তরের উচ্চতা-নিম্নতার প্রশ্ন নেই।
বাগর্থ বা শব্দার্থ-বিজ্ঞানে (Semantics) বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত শব্দ, শব্দসমষ্টি, বাক্যাংশের ও বাক্যের অর্থ নির্ধারণ ও তার প্রক্রিয়া নিরূপণ করা হয়। কালের ও স্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দার্থ কীরূপ বিকৃত, পরিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়, তার বিস্তারিত আলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত।
অভিধান-বিজ্ঞান বা অভিধানতত্ত্ব (Lexicography) বিভাগে বিশেষ ভাষার শব্দসম্ভার আর তার বিভিন্ন রূপ ও আকৃতি অনুযায়ী শৃঙ্খলা ও তার সঙ্গে অর্থের বিভিন্নতা ও প্রয়োগবিধি ইত্যাদি আলোচিত হয়। দেশি ও বিদেশি শব্দবিভাগ এবং কথায় ও সাহিত্যে এদের ব্যবহারবিধি—এসব এ বিভাগের আলোচ্য। দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক অভিধানে শব্দ ও বাক্যাংশের প্রতিশব্দ ও অনুবাদ উল্লিখিত হয়।
কেউ কেউ মনে করে, ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) হলো ভাষা বিশ্লেষণের পূর্ববর্তী স্তর (Prelinguistics) আর বাগর্থ-বিজ্ঞান (Semantics)-এর পরবর্তী স্তর। তাদের মতে যে কোনো ভাষা বিশ্লেষণে ধ্বনিতত্ত্বও বাগর্থ-বিজ্ঞান ভাষা বিশ্লেষণের স্তরবহির্ভূত। কিন্তু এসব আলোচনার স্থান এটি নয়।
যে কোনো ভাষার বর্ণনামূলক আলোচনায় এই নিয়মে বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়। এই আলোচনায় বিভিন্ন ভাষার আকৃতি ও প্রকৃতি এমন নিখুঁতভাবে বিবৃত হয় যে, প্রত্যেকটি ভাষার স্বাতন্ত্র্য কেবল ভাষাবিজ্ঞানী কেন, সাধারণের কাছেও স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। ভাষার এই আশ্চর্য ক্ষমতা ও সমাজ-জীবনে তার অদ্ভুত প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অন্যতম উদ্দেশ্য।
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে একই ভাষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কালের ধ্বনি, উচ্চারণ, শব্দরূপ, পদক্রম, শব্দসম্ভার ও অর্থ কী ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে, তার বর্ণনা থাকে। একই ভাষার বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাষার একই সময়ে অথবা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন সময়ে যে মিল-গরমিল ধরা পড়ে, তারও বিশদ বর্ণনা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। আগে গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে তুলনা করাই ছিল ভাষাবিদদের কাজ। এখন একই ভাষার বিভিন্ন উপভাষাও তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষিত হতে দেখা যায়।
ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের মাধ্যমে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের সহায়তায় বিশেষ কোনো ভাষার উচ্চারণ, ধ্বনি, শব্দ, পদক্রম ও বাক্যের ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব—এ দুই শাখার আলোচনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে। আর যেহেতু প্রাচীন ভাষাগুলোর ধ্বনি হুবহু রক্ষিত হয়নি, তাই সেসব ভাষার আলোচনাও বেশিরভাগই অনুমানভিত্তিক, কাজেই দুর্বল। সেই কারণে অধুনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর সবার নজর পড়েছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি—এদের পরও কিছুদিন পর্যন্ত ভাষাতত্ত্বের আলোচনা এ উপমহাদেশে অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস প্রায় শূন্য। বিংশ শতাব্দীতে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ইউরোপ ও আমেরিকা উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে। এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা আলোচনা সেখানে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। আমাদের দেশেও বিগত শতাব্দীতে কিছু ভাষাবিদ ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের প্রায় সব আলোচনাই প্রধানত তুলনামূলক ও ইতিহাসভিত্তিক। এদের মধ্যে বিমসের তত্ত্বের ÔComparative Grammar of Modern Indian Language’, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকারের ÔWilson Phonological Lectures’, nibwji ÔComparative Grammar of the Indian Languages’, গ্রিয়ারসনের ‘Linguistic Survey of India’, কেলগের ‘Hindi Dialects’, Ges ট্রামপের ‘Sindhi Grammer’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা সম্বন্ধে যেসব কাজ হয়েছে তার মধ্যে বিজয় চন্দ্র মজুমদারের The History of the Bengali Language, ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের Origin and Development of Bengali Language (vol. I & II)Õ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ এবং ডক্টর সুকুমার সেনের ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ই প্রধান। এছাড়া দেশি ও বিদেশি নানা পত্র-পত্রিকায় এদের এবং আরো অনেকের আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এদের প্রায় সব আলোচনাই ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আওতায় পড়ে।
আমাদের দেশের আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার সূচনা হয় এই শতাব্দীতে গ্রিয়ারসন সাহেবের খরহমঁরংঃরপ ঝঁত্াবু ড়ভ ওহফরধ-এর াড়ষ. ঠ-এ ‘শব্দকথা’ (১৭১০ খ্রি.), প্রবন্ধ সংগ্রহে সংকলিত এবং সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় (১০০৭-১৯০৭ খ্রি.) প্রকাশিত ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ‘বাঙ্গালা কৃত্ ও তদ্ধিত্’, ‘না’, ‘কারক প্রকরণ’ এবং ‘ধ্বনি বিচার’—এই বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোচনা। এরপর ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'Bengali Phonetic Reader' (1928) Ges 'A Brief Sketch of Bengali Phonetics (1928), W. Sutton Page-Gi 'Introduction of Colloquial Bengali' (1934) প্রকাশিত হয়। এসবই বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বর্ণনাত্মক আলোচনার এক রকম দিকদর্শন। আমরা মূল আলোচনা থেকে একটু দূরে চলে এসেছি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় কী কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা-ই আমাদের দ্রষ্টব্য। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে ভাষাতত্ত্বের মূলতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় যেসব মনীষী আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের কথা এসে পড়েছে। হ (সংক্ষেপিত)
বিংশ শতাব্দী বাংলার মুসলমানের রেনেসাঁর যুগ। একালে যে সকল মনীষী মুসলিম জাগরণের জন্য নানাভাবে সাধনা করে গেছেন তাঁদের মধ্যে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ অন্যতম অগ্রগণ্য। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সে কালে মুসলিম রক্ষণশীল ও সুফি পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে সংস্কৃতে অনার্সসহ বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যে এমএ পড়তে গিয়ে তিনি অসুবিধায় পড়েন। সংস্কৃতের এমএ পাঠক্রমে বেদ-শাস্ত্রও অন্তর্ভুক্ত ছিল। বেদ পড়াতেন বিখ্যাত বৈদিক পণ্ডিত সত্যব্রত শামশ্রমী। তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠাবান প্রাচীনপন্থী গোঁড়া পণ্ডিত ছিলেন। মুসলমান মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত ছাত্র হবেন এবং তিনি তাঁকে বেদ পড়াবেন—এ হয় না। এ সম্বন্ধে তিনি স্পষ্ট বলে দিলেন যে, ‘বিধর্মী’কে তিনি বেদ পড়াবেন না। ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ অনুরোধেও তিনি তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন না; বরং তিনি পদত্যাগের হুমকি দিলেন। এ ব্যাপারে সে সময় কলকাতায় বিশেষ আন্দোলন হয়। বিশেষ করে তখনকার দিনের বিখ্যাত মুসলিম নেতা মুহম্মদ আলী, যিনি সে সময় উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার জন্য তাঁর সুপরিচিত ইংরেজি পত্রিকা কমরেড (ঈড়সত্ধফব) প্রকাশ করতেন, তিনি ঞযব ঝযধযরফঁষষধয অভভধরত্ শীর্ষক কতকগুলো জোরালো প্রবন্ধ লেখেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এভাবে লোকের চোখের সামনে এসে পড়েন। এ নিয়ে দেশব্যাপী প্রচার, বিলেতে গোলটেবিল বৈঠকে আলোচনা ইত্যাদি কারণে তরুণ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র নাম বাংলার ঘরে ঘরে শিক্ষিত মহলে বহুল আলোচিত হওয়ার সুযোগ পায়। ভাইস চ্যান্সেলর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় এ ব্যাপারে বিব্রতবোধ করেন এবং মুহম্মদ শহীদুল্লাহকে ডেকে পাঠান। তিনি তাঁকে ঈড়সঢ়ধত্ধঃরাব চযরষড়ষড়মু বা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে এমএ পড়ার পরামর্শ দেন। তখন বিভাগটি সবেমাত্র খোলা হয়েছে। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ তার পরামর্শ মেনে নেন। তিনি ১৯১২ সালে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে পরীক্ষা দিয়ে যথারীতি এমএ পাস করেন। এ সঙ্গে তিনি আইন বিষয়েও পড়াশোনা করেন এবং ১৯১৪ সালে তিনি আইন পরীক্ষায়ও উত্তীর্ণ হন। এরও প্রায় এক যুগ পরে তিনি ফ্রান্সের প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি ডি-লিট এবং ধ্বনি-বিজ্ঞানে ডিপ্লোমা ডিপ্লোফোন লাভ করেন।
এরপর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাতক্ষীরায় ওকালতি আরম্ভ করেন। কিন্তু তাঁর মন ছিল বিদ্যাচর্চার দিকে, পঠন-পাঠন ও গবেষণার দিকে। ওকালতিতে তিনি মন বসাতে পারেননি। স্যার আশুতোষ তাঁর গুণগ্রাহী ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ও আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিজের হিতৈষী গুরুর মতো ভক্তি-শ্রদ্ধা ও মান্য করতেন। স্যার আশুতোষ তাঁকে আইন ব্যবসা ছেড়ে বিদ্যার সাধনায় আত্মনিয়োগ করতে উপদেশ দেন। মূলত তাঁরই উত্সাহে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ লক্ষ্মীর রত্নভাণ্ডার ত্যাগ করে সরস্বতীর পুষ্পোদ্যানে স্থান লাভ করেন এবং তাঁর কালে বাংলা তথা ভারতবাসী হিন্দু-মুসলমানের মানসিক উত্কর্ষের পক্ষে বিশেষ লাভ ও উপকার হয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঐঁসধহরঃরবং বা ‘মানবিকী’ বিদ্যায়, অর্থাত্ ভাষা-সাহিত্য-ইতিহাস-সমাজনীতি-অর্থনীতি-রাজনীতি-ধর্ম-দর্শন-আধ্যাত্মিকতার সাধন এবং রস অর্থাত্ শাশ্বত সত্তার মধ্যে নিহিত যে আনন্দের অনুভূতি—এসব বিষয়ে তিনি একজন ‘সর্বন্ধর’ আচার্যের পর্যায়ে উন্নীত হয়েছিলেন।
২
পণ্ডিতমহলে অনেকেই বলে থাকেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ছিলেন গড়ারহম ঊহপুপষড়ঢ়ধবফরধ—চলন্ত বিশ্বকোষ বা জীবন্ত অভিধান। অনেকের ধারণা যে, তিনি প্রায় দুই কুড়ি ভাষা জানতেন। একবার কারো কোনো লেখায় ‘মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ঊনচল্লিশটি ভাষা জানেন’ বলে উল্লিখিত হয়। আমরা কয়েকজন এদিকে তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন : তারা অতিরিক্ত বাড়িয়ে বলেন। আসলে তিনি খুব ভালো করে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারতেন বাংলা, ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, ল্যাটিন, গ্রিক, হিব্রু, পালি, প্রাকৃত, অপভ্রংশ, অবহট্ট, উর্দু, হিন্দি, সিংহলি, কাশ্মীরি, নেপালি, অহমিয়া, ওড়িয়া, পোশতু এবং আরো কয়েকটি ভাষা। আর পড়তে ও বুঝতে পারতেন আরো দু’ডজনের মতো ভাষা। এক কথায় বলা যায়, তিনি ছিলেন ইংরেজিতে যাকে বলে চড়ষুমষড়ঃ—বহুভাষিক। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ও ভাষা বিশ্লেষণে বিভিন্ন ভাষার জ্ঞান, বিশেষ করে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষার তাত্পর্য ব্যাখ্যায় তাঁর তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক জ্ঞান সমৃদ্ধ করেছিল—যা তাঁর তাত্ত্বিকতার মূল্য বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
বস্তুত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ভাষাতাত্ত্বিক জ্ঞানপরিধির বিস্তার আমাদের পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়। তবে এ কথা নিশ্চিত বলতে পারি, এ এলাকায় যে ক’জন ভাষাতত্ত্বের অনুশীলনে নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের সবাই কোনো না কোনোভাবে তাঁর কাছে ঋণী। তাঁরই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রেরণায় তারা ভাষাতত্ত্ব আলোচনায় আত্মনিয়োগে সমর্থ হয়েছেন। আমার নিজেরও ভাষাতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র উত্সাহ ও প্রেরণায়ই হয়েছে।
মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ আমাদের দেশ-জাতি-ধর্ম-সমাজ-সংস্কৃতি-ভাষা ও সাহিত্যের বিভিন্ন ক্ষেত্রে মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। গবেষণা ছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও ধর্ম বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধ দেশে ও বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। বিভিন্ন ধর্মে তাঁর অগাধ জ্ঞান, কোরআন, হাদিস ও ফিকহ বিষয়ক তাঁর সুবিজ্ঞ আলোচনা সুধী সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছে। তিনি ফরাসি, ইংরেজি, ফারসি, উর্দু, বাংলা ইত্যাদি নানা ভাষায় বহু গ্রন্থ ও প্রবন্ধ প্রণয়ন করেছেন। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধে আমরা ভাষাতত্ত্ব বিষয়ক আলোচনায় মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র অবদান সম্বন্ধে আলোকপাত করতে প্রয়াস পাব।
৩
ভাষাতত্ত্বমূলক আলোচনা আমাদের দেশে নতুন নয়। খ্রিস্টপূর্ব তিন-চার শতকে যাস্ক, পাণিনি প্রভৃতি ভাষাবিজ্ঞানী বিবৃতিমূলক ভাষাতত্ত্বের প্রথম সূত্রপাত করেন। পাণিনি ছিলেন পাকিস্তানি। পশ্চিম পাকিস্তানের সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে কালাতুর গ্রামে তিনি বাস করতেন। তিনি ও তাঁর সহকর্মী ও উত্তরসূরিরা সে অঞ্চলে প্রচলিত প্রাচীন কথা আর্য ও সংস্কৃত ভাষার চুলচেরা বিশ্লেষণ করেছিলেন। তাদের আলোচনার পদ্ধতি ও ধারা আজও বিবৃতিমূলক ভাষাবিজ্ঞানের আদর্শস্থানীয় হয়ে রয়েছে। বর্তমানের ইউরোপ ও আমেরিকার আধুনিক ভাষাতত্ত্বেও আলোচনা তাঁরই আদর্শ অনুসরণ করে উন্নতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। এ যুগেও পাশ্চাত্য দেশে পাণিনির ব্যাকরণকে মানুষের জ্ঞানের চরম নিদর্শন বলে গণ্য করা হয়ে থাকে।
পাণিনির পরেও অনেক দিন পর্যন্ত পাক-ভারতে এই ধারায় ভাষা-বিষয়ের আলোচনা অব্যাহত ছিল। পাণিনির মতো পতঞ্জলি প্রমুখ ভাষাবিজ্ঞানী এই উপমহাদেশে বর্ণনাভিত্তিক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার যথেষ্ট উন্নতি সাধন করেন। এরপর কিছুকাল আমরা আমাদের নিজেদের ভুলে গিয়েছিলাম। তাই বোধকরি, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অন্যান্য শাখার মতোই ভাষাতত্ত্বের আলোচনায়ও ভাটা পড়ে। ইউরোপ তথা পশ্চিম গোলার্ধ ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অনুশীলনীতে হাত দেয় আরো অনেক পরে। পশ্চিমের চোখে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলির আবিষ্কার এক মহাবিস্ময়। আধুনিক ভাষাতত্ত্বের মূল সূত্রটি এখান থেকেই নিয়ে তারা আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে নিজেদের ভাষার বিশ্লেষণ শুরু করলেন।
কিন্তু কিছুদিন আগ পর্যন্তও ভাষাকে তুলনামূলক বিশ্লেষণের ভিত্তিতেই দেখা হতো। সংস্কৃত, গ্রিক ও ল্যাটিন ভাষার শব্দসম্ভারে সামঞ্জস্য-অসামঞ্জস্য, মিল-গরমিল বিশ্লেষণ করে অপেক্ষাকৃত পরবর্তীকালের ভাষাগুলোর স্বরূপ নির্ণয়ই ছিল তখনকার দিনের মোটামুটি ভাষাতাত্ত্বিক আলোচনা।
আজ আবার পুরনো ধারার নবজাগৃতির প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। তাই বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের দিকেই আবার সবার নজর ফিরেছে। ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় দেশি ও বিদেশি মনীষীর অবদানের ইতিহাস বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধের আওতার বাইরে। কিন্তু তাদের বিচার-বিশ্লেষণের স্বরূপ বোঝার জন্য তাদের কৃতকর্ম সম্বন্ধে সংক্ষেপে কিঞ্চিত্ আলোচনার অবতারণা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। কেননা ভাষাতাত্ত্বিক মুহম্মদ শহীদুল্লাহেক বুঝতে হলেও এদের সামগ্রিক
আলোচনার একটি মোটামুটি আভাস জানা থাকা একান্ত প্রয়োজন। এর আগে ভাষাতত্ত্ব সম্বন্ধে দু-একটি কথা বলে নিলে আমাদের আলোচনার সুবিধা হবে।
ভাষাতত্ত্বে তিন ধারার ভাষা সম্বন্ধে আলোচনা করা চলে—প্রথমত, বর্ণনামূলক ধারা। একে ‘আধুনিক ভাষাতত্ত্ব’ও বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব এবং তৃতীয়ত, ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব।
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বে ভাষাতাত্ত্বিক কোনো বিশেষ ভাষার বিশ্লেষণ প্রসঙ্গে আলোচনার সুবিধার জন্য এই কয়েকটি প্রধান ভাগে ভাগ করে থাকেন : ১. ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) ২. ধ্বনিতত্ত্ব (Phonology) ৩. রূপতত্ত্ব (Morphology) ৪. পদক্রম বা বাক্যরীতি (ঝুহঃধী) ৫. বাগর্থ বিজ্ঞান (Semantics) এবং ৬. অভিধান বিজ্ঞান (Lexicography)|
বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের মূল কথা হলো, যে কোনো একটি ভাষার বিশেষ কালের বিশেষ রূপের বর্ণনা করা। তা করতে হলে সেই বিশেষ ভাষাভাষী লোকের মধ্য থেকে নির্বাচিত যে কোনো একজনের মুখের ভাষাই আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করতে হয়। এভাবে একেকটি উপভাষার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণের সাহায্যে সেই ভাষার সামগ্রিক বর্ণনা সম্ভব হয়। মানুষের মুখের ভাষা যেমন ব্যবহৃত হয়, তারই ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ করে সূত্র নির্ণয় করতে হয়। এই ধরনের বর্ণনায় ভাষার কোন নিয়ম আছে আর কোন নিয়ম নেই, তারই উল্লেখ থাকে; ভাষায় কী হওয়া উচিত আর কী হওয়া উচিত নয়, সে ধরনের বিধি-নিষেধের স্থান সেখানে নেই। এমনকি কেন এমন হয়, কেন এমন হয় না, তারও বিশ্লেষণ সেখানে অসঙ্গত। ভাষায় ব্যবহৃত নানা উপাদানকে একটা বিশেষ সংজ্ঞার মাধ্যমে একটা পদ্ধতির বন্ধনে আবদ্ধ করে যে বিশ্লেষণ শাস্ত্র গড়ে ওঠে, তাকেই তখন বলা হয় সেই ভাষার ব্যাকরণ।
এভাবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচার-বিশ্লেষণের সুবিধার জন্য ভাষাবিজ্ঞানী তার আলোচনাকে উল্লিখিত কয়েক ভাগে ভাগ করে থাকেন। ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) শাখায় ভাষার ধ্বনিগুলোর উচ্চারণ পদ্ধতি, তাদের ব্যবহার ও স্থানভেদে তাদের উচ্চারণে তারতম্য, উচ্চারণের ব্যবহার-সঙ্গতি, সন্ধি ও বণ্টন, যতি ও ছন্দোবিন্যাস, এমনকি লিখনপদ্ধতিতে তাদের রূপায়ণ ইত্যাদির যথাযথ আলোচনা হয়। উচ্চারণের স্থান ও রকম, এমনকি তাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গেরও বিশদ আলোচনা সাধারণ ধ্বনিতত্ত্বের পর্যায়ভুক্ত।
ধ্বনিবিজ্ঞানের আলোচনায় বিশ্লিষ্ট বর্ণনাকে যখন গাণিতিক সংকেতে আবদ্ধ করা হয়, তখনই একে ধ্বনিতত্ত্ব নাম দেয়া হয়। অর্থাত্ ধ্বনিবিজ্ঞানে যা ছিল বস্তুসম্পৃক্ত (পড়হপত্বঃব), ধ্বনিতত্ত্বে তা হয়ে ওঠে নির্বস্তুক (ধনংঃত্ধপঃ)। বিজ্ঞানের আলোচনায় এই জগতের নানা পদার্থেরই স্বভাব, গতি, শক্তি ও গুণ নানা সংকেতে ধরা যায়। যেমন অংকশাস্ত্রে—১ (এক), ২ (দুই) অথবা (বর্গমূলক), . (দশমিক বিন্দু), + (যোগ চিহ্ন), - (বিয়োগ চিহ্ন), – (পূরণ চিহ্ন), % (ভাগ চিহ্ন) ইত্যাদি মাধ্যমে অনেক কিছু বোঝানো হয়। ধ্বনিবিজ্ঞানের (Phonetics) বিশিষ্ট রূপও সেইরূপ নানা সংকেত ও চিহ্নের সাহায্যের ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) বিধৃত হয়। এক কথায় ধ্বনিবিজ্ঞানে (Phonetics), যার বিশ্লেষণ, ধ্বনিতত্ত্বে (Phonology) তারই গাণিতিক প্রকাশ। তাই ধ্বনিবিজ্ঞানে যাকে নানা কথায় বিশ্লেষণ করা হয়, ধ্বনিতত্ত্বে তাই হয় সীমিত ও নিয়ন্ত্রিত কতকগুলো সংকেত বা সূত্রের (Formula) সমষ্টি। বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের এই দুটি শাখাকে একই বিভাগের দুটি স্তর বা পর্যায় মনে করা যেতে পারে।
রূপতত্ত্ব (Morhphology) বিভাগে পদ ও শব্দসাধন পদ্ধতি অর্থাত্ পদ ও শব্দগঠন সম্পর্কিত নিয়মাবলি আলোচিত হয়। এতে সাধিত শব্দ বা পদের ধাতু, প্রত্যয়, অনুসর্গ, বিভক্তি প্রভৃতি ক্ষুদ্রতম অংশ নির্ণীত হয়। সমাস, অব্যয়, নিপাত ইত্যাদির আলোচনাও রূপতত্ত্বের প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্র। পদক্রম ও বাক্যরীতি (Syntax) বিভাগে আলোচিত হয় বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ ও পদগুলোর ক্রম আর বাক্য-বিশ্লেষণ পদ্ধতি।
মূলত রূপতত্ত্ব (Morphology) ও পদক্রম (Syntax) একই বিভাগের দু’টি স্তর বা পর্যায়। কেননা, শব্দ ও পদের অংশ নিরূপণ বাক্য মধ্যে শব্দের অবস্থান ও কার্যকারিতার ওপর নির্ভর করে। তাই কেউ কেউ এই দু’টি শাখাকে মিলিতভাবে ব্যাকরণও বলে থাকেন। কিন্তু ব্যাকরণের কার্যবিধির ধারায় ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম—এই সমুদয়ের পর্যায়ক্রমে পৃথক পৃথক ও সম্মিলিত এবং সামগ্রিক আলোচনা ও বিশ্লেষণই বাঞ্ছনীয়; তাই একটিকে ছেড়ে অপরটির অস্তিত্ব কল্পনা করা যায় না। চারটি বিভাগের বিশ্লেষণই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারো কারো ধারণা এই যে, যেহেতু ধ্বনিবিজ্ঞান, ধ্বনিতত্ত্ব, রূপতত্ত্ব এবং পদক্রম যথাক্রমে পরপর আলোচিত হয়, তাই এদের আলোচনার ধারাক্রমে এদের স্থান নির্ণীত হবে; যেমন ধ্বনিবিজ্ঞান নিম্নস্তরের, ধ্বনিতত্ত্ব তার পরের, রূপতত্ত্ব তারও পরের এবং পদক্রম সর্বোচ্চ মর্যাদার অধিকারী। কিন্তু এরূপ ধারণা ভুল। আসলে এটি আলোচনার সুবিধার্থে এক ধরনের বিভাগ মাত্র, এতে স্তরের উচ্চতা-নিম্নতার প্রশ্ন নেই।
বাগর্থ বা শব্দার্থ-বিজ্ঞানে (Semantics) বাক্যমধ্যে ব্যবহৃত শব্দ, শব্দসমষ্টি, বাক্যাংশের ও বাক্যের অর্থ নির্ধারণ ও তার প্রক্রিয়া নিরূপণ করা হয়। কালের ও স্থানের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দার্থ কীরূপ বিকৃত, পরিবর্তিত ও অভিযোজিত হয়, তার বিস্তারিত আলোচনাও এর অন্তর্ভুক্ত।
অভিধান-বিজ্ঞান বা অভিধানতত্ত্ব (Lexicography) বিভাগে বিশেষ ভাষার শব্দসম্ভার আর তার বিভিন্ন রূপ ও আকৃতি অনুযায়ী শৃঙ্খলা ও তার সঙ্গে অর্থের বিভিন্নতা ও প্রয়োগবিধি ইত্যাদি আলোচিত হয়। দেশি ও বিদেশি শব্দবিভাগ এবং কথায় ও সাহিত্যে এদের ব্যবহারবিধি—এসব এ বিভাগের আলোচ্য। দ্বিভাষিক বা ত্রিভাষিক অভিধানে শব্দ ও বাক্যাংশের প্রতিশব্দ ও অনুবাদ উল্লিখিত হয়।
কেউ কেউ মনে করে, ধ্বনিবিজ্ঞান (Phonetics) হলো ভাষা বিশ্লেষণের পূর্ববর্তী স্তর (Prelinguistics) আর বাগর্থ-বিজ্ঞান (Semantics)-এর পরবর্তী স্তর। তাদের মতে যে কোনো ভাষা বিশ্লেষণে ধ্বনিতত্ত্বও বাগর্থ-বিজ্ঞান ভাষা বিশ্লেষণের স্তরবহির্ভূত। কিন্তু এসব আলোচনার স্থান এটি নয়।
যে কোনো ভাষার বর্ণনামূলক আলোচনায় এই নিয়মে বিভিন্ন দিক আলোচিত হয়। এই আলোচনায় বিভিন্ন ভাষার আকৃতি ও প্রকৃতি এমন নিখুঁতভাবে বিবৃত হয় যে, প্রত্যেকটি ভাষার স্বাতন্ত্র্য কেবল ভাষাবিজ্ঞানী কেন, সাধারণের কাছেও স্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়। ভাষার এই আশ্চর্য ক্ষমতা ও সমাজ-জীবনে তার অদ্ভুত প্রক্রিয়ার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণই ভাষাতত্ত্বের এই শাখার অন্যতম উদ্দেশ্য।
তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে একই ভাষার বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন কালের ধ্বনি, উচ্চারণ, শব্দরূপ, পদক্রম, শব্দসম্ভার ও অর্থ কী ধারায় পরিবর্তিত হয়েছে, তার বর্ণনা থাকে। একই ভাষার বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ভাষার একই সময়ে অথবা বিভিন্ন ভাষার বিভিন্ন সময়ে যে মিল-গরমিল ধরা পড়ে, তারও বিশদ বর্ণনা তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। আগে গ্রিক, ল্যাটিন ও সংস্কৃতের বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে তুলনা করাই ছিল ভাষাবিদদের কাজ। এখন একই ভাষার বিভিন্ন উপভাষাও তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষিত হতে দেখা যায়।
ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্বে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের মাধ্যমে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের সহায়তায় বিশেষ কোনো ভাষার উচ্চারণ, ধ্বনি, শব্দ, পদক্রম ও বাক্যের ইতিহাস প্রতিষ্ঠিত করা হয়।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, তুলনামূলক ও ঐতিহাসিক ভাষাতত্ত্ব—এ দুই শাখার আলোচনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর নির্ভর করে। আর যেহেতু প্রাচীন ভাষাগুলোর ধ্বনি হুবহু রক্ষিত হয়নি, তাই সেসব ভাষার আলোচনাও বেশিরভাগই অনুমানভিত্তিক, কাজেই দুর্বল। সেই কারণে অধুনা বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের ওপর সবার নজর পড়েছে।
আগেই উল্লেখ করেছি যে যাস্ক, পাণিনি, পতঞ্জলি—এদের পরও কিছুদিন পর্যন্ত ভাষাতত্ত্বের আলোচনা এ উপমহাদেশে অব্যাহত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে প্রায় দেড় হাজার বছরের ইতিহাস প্রায় শূন্য। বিংশ শতাব্দীতে বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় ইউরোপ ও আমেরিকা উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ করে। এতে বিজ্ঞানভিত্তিক ভাষা আলোচনা সেখানে দ্রুত বিস্তৃতি লাভ করে। আমাদের দেশেও বিগত শতাব্দীতে কিছু ভাষাবিদ ভাষা নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের প্রায় সব আলোচনাই প্রধানত তুলনামূলক ও ইতিহাসভিত্তিক। এদের মধ্যে বিমসের তত্ত্বের ÔComparative Grammar of Modern Indian Language’, রামকৃষ্ণ গোপাল ভাণ্ডারকারের ÔWilson Phonological Lectures’, nibwji ÔComparative Grammar of the Indian Languages’, গ্রিয়ারসনের ‘Linguistic Survey of India’, কেলগের ‘Hindi Dialects’, Ges ট্রামপের ‘Sindhi Grammer’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষা সম্বন্ধে যেসব কাজ হয়েছে তার মধ্যে বিজয় চন্দ্র মজুমদারের The History of the Bengali Language, ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের Origin and Development of Bengali Language (vol. I & II)Õ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ এবং ডক্টর সুকুমার সেনের ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’ই প্রধান। এছাড়া দেশি ও বিদেশি নানা পত্র-পত্রিকায় এদের এবং আরো অনেকের আলোচনা প্রকাশিত হয়েছে। এদের প্রায় সব আলোচনাই ঐতিহাসিক ও তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বের আওতায় পড়ে।
আমাদের দেশের আধুনিক বর্ণনামূলক ভাষাতত্ত্বের আলোচনার সূচনা হয় এই শতাব্দীতে গ্রিয়ারসন সাহেবের খরহমঁরংঃরপ ঝঁত্াবু ড়ভ ওহফরধ-এর াড়ষ. ঠ-এ ‘শব্দকথা’ (১৭১০ খ্রি.), প্রবন্ধ সংগ্রহে সংকলিত এবং সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় (১০০৭-১৯০৭ খ্রি.) প্রকাশিত ‘বাঙ্গালা ব্যাকরণ’, ‘বাঙ্গালা কৃত্ ও তদ্ধিত্’, ‘না’, ‘কারক প্রকরণ’ এবং ‘ধ্বনি বিচার’—এই বিষয়ে প্রথম উল্লেখযোগ্য আলোচনা। এরপর ডক্টর সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের 'Bengali Phonetic Reader' (1928) Ges 'A Brief Sketch of Bengali Phonetics (1928), W. Sutton Page-Gi 'Introduction of Colloquial Bengali' (1934) প্রকাশিত হয়। এসবই বাংলা ভাষা সংক্রান্ত বর্ণনাত্মক আলোচনার এক রকম দিকদর্শন। আমরা মূল আলোচনা থেকে একটু দূরে চলে এসেছি। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় কী কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন, তা-ই আমাদের দ্রষ্টব্য। কিন্তু প্রসঙ্গক্রমে ভাষাতত্ত্বের মূলতত্ত্ব এবং ভাষাতত্ত্বের আলোচনায় যেসব মনীষী আত্মনিয়োগ করেছেন তাদের কথা এসে পড়েছে। হ (সংক্ষেপিত)
No comments:
Post a Comment