প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, March 9, 2012

সোনালি আলোর ভুবন, কবি জসীম উদ্দীন | আসমা আব্বাসী

এই খানে তোর দাদীর কবর ডালিম গাছের তলে
তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে
এতোটুকু তারে ঘরে এনেছিনু পরীর মতোন মুখ
পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেলো বলে কেঁদে ভাসাইতো বুক

সেই ডালিম গাছের রক্তিম ফুলগুলো পাপড়ি ছড়ায় আজও সবুজ দূর্বাদলের ওপর শান্তিতে নিদ্রারত কবির কবরে। আমার অতি প্রিয়জন কবি জসীম উদ্দীন, যাঁকে আমি ডাকি চাচা বলে। আব্বাসউদ্দীনের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বন্ধুর, ভাইয়ের, অতি নিকট আত্মীয়ের।
সিলেটে হজরত শাহজালাল রাহমতুল্লাহ আলাইহির দরগায় টিলার সবুজ ঘাসে শুয়ে আছেন আমার আব্বা, খেজুর গাছ থেকে টুপটাপ করে ঝরে পড়ে কমলা রঙের খেজুর, ঝরে পড়ে তার পাতা। কাছে যাওয়ার সুযোগ হয়নি, ছবিতেও দেখিনি তাঁকে। দরগার সম্মান রক্ষার্থে মহিলারা কবরের পাশে যেতে পারেন না। সাদা প্রাচীরের বাইরে দাঁড়িয়ে যখন দূর থেকে দেখি আব্বার কবর, মোনাজাতের হাত তুলি, তখন অম্বিকাপুরের ডালিম গাছের নিচের কবরগুলোর ছবি মনে ভেসে ওঠে।
উনিশশ’ তেষট্টি সালে বিয়ে হয়ে এসেছি পুরানা পল্টনে ‘হিরামন মঞ্জিলে’, সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আমার নবীন সঙ্গী আব্বাসীর সঙ্গে ঘুরতে বেরুতাম কখনও শান্তিনগর, কখনও কমলাপুর, কখনও নয়াপল্টন। শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, কবি জসীম উদ্দীন, শিল্পী কামরুল হাসান, শিল্পী কলিম শরাফী, কবি মুহাম্মদ মঈনুদ্দীন, কবি গোলাম মোস্তফা—এঁদের বাড়িগুলোতে আমাদের নিত্য আনাগোনা। গোসল নাস্তা পর্ব শেষে একটি রিকশাতে চড়ে দু’জনে দশ মিনিটেই পৌঁছে যেতাম গন্তব্যে। এই গুণীজনেরা যেন সোনার মানুষ। এত সহজ স্বাচ্ছন্দ্যে তাঁদের সান্নিধ্য উপভোগ করতাম, বাড়িতে ফেরার তাগিদ থাকত না।
সবচেয়ে বেশি যাওয়া হতো কমলাপুরে জসীম উদ্দীন ও মমতাজ জসীম উদ্দীনের বাড়িতে। আমাদের দু’জনারই অতি প্রিয় এই চাচা ও চাচি, কবিতা ও সুখাদ্য, আকর্ষণ তো কম নয়। কী যে আনন্দের খনিতে অবগাহন! অতি সহজ সরল পরিবেশ, একতলা বাড়ির চারপাশে সুপুরি নারকেল কলা আম জাম কাঁঠালের গাছ ছায়া বিস্তার করে আছে, এক পাশে বেলী চামেলী গন্ধরাজ কামিনী মাধবীলতা জুঁইয়ের সুগন্ধি ঝাড়।
কবি জসীম উদ্দীন চাচা ও চাচি মমতাজ (যাঁকে আদর করে ডাকেন মণিমালা) স্নেহের চাদর বিছিয়ে ডেকে নিতেন কাছে। শীতের সকালে রোদ্দুরে পাটি পেতে বসে চাচি পরিবেশন করতেন নকশি পিঠা, মুড়ির মোয়া, নারকেলের নাড়ু, ঘন দুধের ক্ষীর। কত যে সুস্বাদু খাদ্য তাঁর ভাণ্ডারে, রাঁধতে ভীষণ ভালোবাসতেন, আরও ভালোবাসতেন লোকজনকে ডেকে খাওয়াতে। কবি চাচা তাঁর নতুন লেখা কবিতা পড়ে শোনাতেন মৃদু স্বরে, মুগ্ধ হয়ে শুনতাম আমরা। অনেক সময় আমরাই প্রথম শ্রোতা অথবা প্রথম পাঠক।
কবিতাপ্রীতি তো আমার জন্মসূত্রে পাওয়া উত্তরাধিকার। যখন শৈশবে পিতাকে হারিয়ে মায়ের হাত ধরে এসেছি মনু নদীর তীরে মৌলভীবাজার শহরে, যেখানে প্রকৃতি ও সাহিত্য এক হয়ে গেছে আমাদের জীবনে। হুরু মামু সৈয়দ মুজতবা আলীর ছোট বোন সৈয়দা হিফজুন্নেসা খানম গৌর বর্ণের রূপসী মহিলা আমার আম্মা। সবসময়ই সাদা রঙের শাড়িতে তাঁকে দেখেছি, রঙের কোনো ছিটেফোঁটা নেই, তবু কী অপরূপ, বিধাতা যেন তাঁর সৌন্দর্যের ভাণ্ডার উজাড় করে দিয়েছেন আমার মায়ের চেহারায় ও চরিত্রে।

তুমি যাবে ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
গাছের ছায়ায় লতায় পাতায় উদাসী বনের বায়
মায়ামমতায় জড়াজড়ি করি মোর গৃহখানি রহিয়াছে ভরি
মায়ের আদরে ভাইয়ের স্নেহে বোনের মায়ার ছায়
যাবে তুমি ভাই যাবে মোর সাথে আমাদের ছোট গাঁয়
তুমি যদি যাও আমাদের গাঁয়ে তোমারে সঙ্গে করি
নদীর ওপারে চলে যাব তবে লইয়া ঘাটের তরী

মায়ের মুখে শুনতাম কবিতাগুলো বিছানায় ঘুমুতে যাওয়ার ক্ষণে। আরও কত কবিতা, যেন স্বপ্নের জগতে চলে যাওয়া।

আয় ছেলেরা আয় মেয়েরা
ফুল তুলিতে যাই
ফুলের মালা গলায় দিয়ে
মামার বাড়ি যাই
মামার বাড়ি পুণ্যিপুকুর
গলায় গলায় জল
এপার হতে ওপার গিয়ে
নাচে ঢেউয়ের দল
দিনে সেথায় ঘুমিয়ে থাকে
লাল শালুকের ফুল
রাতের বেলা চাঁদের সনে
হেসে না পায় কূল
আম কাঁঠালের বনের ধারে
মামা বাড়ির ঘর
আকাশ হতে জ্যোত্স্না কুসুম
ঝরে মাথার পর

রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও,
বাঁকা গাঁয়ের পথটি বেয়ে কোথায় চলে যাও?
ওই যে দেখ নীল-নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ,
কলার পাতা দোলায় চামর শিশির ধোয়ায় পা,
সেথায় আছে ছোট্ট কুটির সোনার পাতায় ছাওয়া,
সাঁঝ-আকাশের ছড়িয়ে-পড়া আবীর-রঙে নাওয়া;
সেই ঘরেতে এক্লা বসে ডাকছে আমার মা—
সেথায় যাব, ও ভাই এবার আমায় ছাড় না।

রাখাল ছেলে রাখাল ছেলে আবার কোথা ধাও,
পুব আকাশে ছাড়ল সবে রঙিন মেঘের নাও।

ঘুম হতে আজ জেগেই দেখি শিশির-ঝরা ঘাসে,
সারা রাতের স্বপন আমার মিঠেল রোদে হাসে।
আমার সাথে করতে খেলা প্রভাত হাওয়া, ভাই,
সরষে ফুলের পাপড়ি নাড়ি ডাকছে মোরে তাই।
চলতে পথে মটরশুঁটি জড়িয়ে দু’খান পা,
বলছে ডেকে, ‘গাঁয়ের রাখাল একটু খেলে যা’।
সারা মাঠের ডাক এসেছে, খেলতে হবে ভাই।
সাঁঝের বেলা কইব কথা এখন তবে যাই।

‘নীল নোয়ান সবুজ ঘেরা গাঁ, কলার পাতা দোলায় চাপা শিশির ধোয়ায় পা’—এমন শ্যামলিমা ভরা গাঁ পৃথিবীর আর কোনো দেশে বোধ করি অবস্থান করে না। বাংলাদেশ এই হাজার হাজার গ্রামের প্রতিচ্ছবি ও প্রতিবিম্ব। মনে বড় সাধ জাগে এমন শ্যামল উদ্ভিদ লতাপাতা গুল্মময় গ্রামে ঘুরে বেড়াতে। আমার জন্মভূমিতে অনায়াসেই খুঁজে পাই কবির সেই ভালোবাসার গ্রাম। আমার অন্তরে তারা স্থায়ী ছবি এঁকে নেয় তাঁদের মাধুরিমায়।
যখন বড় হয়ে নিজে নিজে পড়তে শিখলাম ‘নকশী কাঁথার মাঠ’, ‘সোজন বাদিয়ার ঘাট’—কী বিস্ময় কী বিস্ময়। এত সহজ ছন্দে সহজ বাক্যে কবি সৃষ্টি করলেন অসাধারণ কাব্য।
আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে ধ্বনিত হলো কবির অপূর্ব সৃষ্টি।

নদীর কূল নাই কিনার নাই রে
আমি কোন্ কূল হতে কোন্ কূলে যাব কাহারে শুধাই রে \

ও পারে মেঘের ঘটা
কণক বিজলি ছটা
মাঝে নদী বহে শাঁই শাঁই রে।
আমি এই দেখিলাম সোনার ছবি আবার দেখি নাই রে \
বিষম নদীর পানি
ঢেউ করে হানাহানি
ভাঙ্গা এ তরণী তবু বাই রে।
আমার অকূলের কূল দয়াল বন্ধুর যদি দেখা পাই রে \

আমার গহীন গাঙ্গের নাইয়া
তুমি অপর বেলায় নাও বায়া যাও রে
ও দরদী কার বা পানে চাইয়া \

ভাটির দ্যাশের কাজল মায়ায়
পরাণডা মোর কাইন্দা বেড়ায় রে
ওরে আবছা মেঘে হাতছানি দেয়
কে জানি মোর সয়া-রে \

ঐ না গাঙ্গের আগের বাঁকে
আমার বন্ধুর দ্যাশ
কলাবনের বাউরি বাতাস দোলায় মাথার ক্যাশ;
কইও খবর তাহার লাইগা
কাইন্দা মরে এই অভাইগা রে
ও তার ব্যথার দেওয়া থাইক্যা থাইক্যা
ঝরে নয়ন বায়া রে \

জসীম উদ্দীন ও আব্বাসউদ্দীন যেন এক বৃন্তের দু’টি কুসুম। তাঁদের সেই অমর সৃষ্টি আজও স্পন্দিত হয় বাংলার লোকে-লোকান্তরে।
জসীম উদ্দীনের বাড়ির আবহে গ্রামবাংলার ছবি কী সুন্দর মমতায় চিত্রিত। বাঁশ ঝাড় কলাগাছ লাউয়ের মাচার ঐশ্বর্য, গোয়াল ঘরে গরু, আরও আছে হাঁস মুরগি ছাগল কবুতর। পাখিদের কিচিরমিচির তার সঙ্গে যুক্ত হয় কাকের কা-কা রব। কবি নিজ হাতে গাছপালার যত্ন করতেন। গাছের গোড়ায় পানি দেয়া, মাটি দেয়া, শুকনো ডাল কেটে ফেলা, পোকামাকড় সাফ করা সব নিজ হাতে করতেন। ফুল ও পাখি দুটোই ছিল তাঁর প্রিয়। কবিপত্নী শরত্কালের ভোরে উঠে প্রথমে শিউলি ফুল কুড়াতেন, তারপর সংসারের নানা কাজ। একবার কবি বাজার থেকে পঞ্চাশটি মাটির কলসী কিনে আনলেন, কবিপত্নী অবাক হয়ে দেখছেন, কবি বললেন, বাড়িতে অনেক গাছ আছে পাখিদের বাসার খোঁজে যাতে ঘুরাঘুরি করতে না হয়, তাই কলসীগুলো কিনে এনেছি। এগুলো রশি দিয়ে গাছে গাছে ঝুলিয়ে দেব। কলসীগুলোর গলার কাছে ফুটো করে আম গাছ জাম গাছ বেল গাছ কাঁঠাল গাছ চালতা গাছ সব গাছে ঝুলিয়ে দেয়া হলো। বাগানের দক্ষিণ কোণে ঝড়ে ভাঙা একটি সফেদা গাছ ও বকফুল গাছ ছিল। এই দুই গাছে নারকেল পাতা খড়বিচালী ঝুলিয়ে দেয়া হলো শালিক ও বুলবুলির জন্য, তারা বাসা বাঁধল সেখানে। আস্তে আস্তে কলসীগুলোতেও নীড় বাঁধল পাখিরা, যেন এক পক্ষীসাম্রাজ্য।

যে কবি এত ভালোবাসেন ফুল পাখি লতাপাতা, তিনি নিজ হাতে পাখিদের জন্য খৈ মুড়ি গুড় মেখে গাছের তলায় ছড়িয়ে দিতেন আর ঘুরে ঘুরে গান গাইতেন। পাড়ার ছোট ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে এসে বসত কবির পাশে, তিনি উজাড় করে স্নেহ বিলিয়েছেন তাদের, যেমন তাঁর নয়নের মণি কন্যা হাসনা ও আসমা, পুত্র হাসু, বাসু, রাসু—তেমনি তাঁর স্নেহের পরশ পেয়েছে কত না শিশু।
আমাদের শিক্ষা জীবনে নতুন করে পেয়েছি কবি জসীম উদ্দীনকে, তাঁর কবিতা পাঠ্যবইতে ছিল, ছিল অনার্স ক্লাসে। তখন থেকেই শ্যামল বরণ মায়াবী চেহারা কোমল হৃদয় কবিকে আপন ভাবতে শিখেছি। আমার মতো ক্লাসের সব শিক্ষার্থীর মনেই ছিল তাঁর জন্য গভীর মমতা। এত সহজে যে কবিতা মনের তারে তারে সেতারের সুর জাগিয়ে তোলে, তিনি আমাদের বাংলা সাহিত্যের গৌরব। কবিদের শ্রেণীভাগ করা যায় না, কাব্যের যে ক্ষেত্রেই তাদের সৃজন হোক না কেন, তাঁদের একমাত্র পরিচয় তাঁরা কবি। গীতিকবি, পল্লীকবি, মহাকাব্য কবি, বিদ্রোহী কবি, বিশ্বকবি যে নামেই ডাকা হোক না কেন তাঁরা হলেন সর্বজনীন, প্রত্যেকেই নিজস্ব ক্ষেত্রে প্রতিভার দীপ্তিতে ভাস্বর। রূপ রস বর্ণ গন্ধহীন বিবর্ণ পৃথিবীকে অপরূপ করে তোলাই তাঁদের কাজ। কবি জসীম উদদ্ীনের কাছে জাতির ঋণ সবসময়ই থাকবে, আমরা তাঁরই কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে নিবেদন করব আমাদের নিঃশর্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নৈবেদ্য।
সূত্র : আমার দেশ

আমার কবি | বেগম মমতাজ জসীম উদ্দীন

আমাদের পূর্বপুরুষেরা ব্রিটিশ ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মার্দান শহরের অধিবাসী ছিলেন। ছোটবেলায় বাবার মুখে শুনছিলাম আমার দাদা মোহাম্মদ আমিনউদ্দীন খান; তার পিতা মোহাম্মদ মেহের খান এবং তার ভাই মোহাম্মদ লাল খান ১৮৫৭ সালে ব্রিটিশবিরোধী সিপাহী বিদ্রোহে সরাসরি অংশগ্রহণ করছিলেন। সিপাহী বিদ্রোহের পরাজয়ের পর তারা দুই ভাই পালাইয়া কলকাতা হইয়া বরিশালে আসেন এবং এখান থেইকা ফরিদপুরের বাহাদুরপুরের পাশে নলগড়া গ্রামে বসবাস করেন। ফারায়জী আন্দোলনের নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর এলাকা বাহাদুরপুর নানা কারণে তখন নিরাপদ ছিল। তাছাড়া ওই এলাকায় ব্রিটিশদের হাতে ধরা পড়ার ভয়ও কম ছিল। ব্রিটিশদের এই দেশ থেকে তাড়াবার জন্য হাজী শরীয়তুল্লাহর বংশধররা ছিলেন সক্রিয়।
আমার জন্মের আগে বাবা মোহাম্মদ মোহসেন উদ্দীন খান বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯২০ সালে বিএ পাস করার পর বরিশালে স্কুল মাস্টারি শুরু করেন। আমার নানা মৌলভী মোহাম্মদ ইদ্রিস মিয়া বিক্রমপুরের অধিবাসী ছিলেন। পরে ব্যবসা-বাণিজ্যের খাতিরে নারায়ণগঞ্জে বাড়ি-ঘর করেন। আমার মা আঞ্জুমান আরা তার একমাত্র মেয়ে। মায়ের বড় ভাই ছিল। উনি মারা যাওয়ার পর নানা মাকে শ্বশুর বাড়ি যেতে দেয়নি। আমি নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ার বাড়িতে ইংরেজি ১৯২৩ সালের ৩রা এপ্রিল জন্মগ্রহণ করি। আমার নানার ব্রিটিশ জাহাজ কোম্পানির সাথে চুক্তি ছিল। তার ব্যবসা ছিল। নারায়ণগঞ্জ ডক ইয়ার্ড থেইকা তার মালামাল জাহাজে গোয়ালন্দ ঘাটে যাইত। নারায়ণগঞ্জে তার একটা বড় জুতার দোকান ছিল।...
আমার বড় মামা আবুল ফজল মাত্র বাইশ বছর বয়সে মারা গেলে নানা একেবারে ভাইঙ্গা পড়েন। তিনি একমাত্র মেয়ে মাকে বাবার কাছে যাইতে দিতে চাইতেন না। তাছাড়া বাবা সরকারি স্কুল মাস্টার, বদলির চাকরি ছিল। নানা ইদ্রিস মিয়ার সাথে আমার ভালো ভাব ছিল। শিশুকালে নানার হাত ধইরা রোজ সকাল বিকাল ঘুরতে বাইরাইতাম। জিমখানার মাঠে সাহেবরা গলফ খেলত। ব্রিটিশ আমলতো। সাইজা গুইজা নানার সাথে সকাল বিকাল সেই মাঠে যাইতাম। হাতে একটা ছরা বা লাঠি নিতাম। নানার যারা বন্ধু-বান্ধব, তারা আমারে দেইখা কত ঠাট্টা করত। শীতলক্ষ্যা নদীর পাড়ে বেড়াইতাম। নানার যেখানে ব্যবসা, সেই স্টিমার ঘাটেও মাঝে মধ্যে যাইতাম। তারপর যাইতাম নানার সঙ্গে সিনেমায়। আট বছর বয়সে প্রথম সিনেমা দেখি হংস থিয়েটারে নানার সঙ্গে। টারজান দা এ্যাপ ম্যান। সিনেমাটা কয়েকবার দেখছি। সিনেমা হলটা এখনও আছে।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান গার্লস স্কুলে সাত বছর বয়সে ভর্তি হই ক্লাস ওয়ানে। বিক্রমপুরের আরব আলী নামে একটা লোক ছিল কাজের, সে স্কুলে নিয়া যাইত ও নিয়া আসত। নানার পূর্বপুরুষরা বিক্রমপুরের, তবে নোয়াখালীর সুধারাম তাদের আদি নিবাস এবং ব্যবসার জন্য নানা নারায়ণগঞ্জে বসবাস করছিলেন। নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায় আমার নানা ১৯২৯ সালে যে দালান তৈরি করছিলেন তার নাম মৌলভী বাড়ি, সেখানেই আমার বিয়া হয়। পুকুর ঘাট অলা বিরাট বাড়ি। ভাগাভাগি হওয়ার পরেও মূল বাড়িটা এখনও জ্যান্ত আছে। জসীম উদ্দীনের কবিতা পড়ছি ক্লাস নাইনে উইঠা। কি কবিতা ছিল? নাইনে থাকতে ম্যাট্রিক সিলেবাসে ছিল রাখাল ছেলে। দুই চার লাইন মনে আছে? রাখাল ছেলে, রাখাল ছেলে বারেক ফিরে চাও, বাঁকা গাঁয়ের পথটি ধরে কোথায় চলে যাও...। আমার মুখস্থ ছিল, এখন মনে নাই। আমি যখন ক্লাস টেনে, তখন মা ফরিদপুরে। বাবা ফরিদপুর জিলা হাই স্কুলের মাস্টার। আমার ছোট ভাই মিন্টু বাবা-মায়ের সাথে টেপাখোলার বাড়িতে থাকে। স্কুলের ছুটিতে আমি ফরিদপুরে যাই, ওরাও আসে। আদরে আদরে দিনগুলি কাটতেছিল। তখন মনে হইত এইভাবেই বুঝি সারাজীবন কাটতে থাকবে।
আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। দেখতেও বেশ ভালো ছিলাম। সবাই আদর করত। সোনা ভাই সোনা মা (নানী) একটু চোখের আড়াল হইলেই অস্থির হইয়া পড়ত। আমার নানীর বাবা হাজী ইব্রাহীম নারায়ণগঞ্জের প্রথম হাজী। শফিউল্লাহ সাহেবের সাথে আমার খালার আত্মীয়তা ছিল। উনি তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্সের লেকচারার। তার সঙ্গে কবি সাহেব আসলেন আমাদের বাড়িতে। জসীম উদ্দীন সেই সময় ঢাকা ইউনিভার্সিটির বাংলার লেকচারার। শফিউল্লাহ সাহেব একদিন আমার নানা ভাইকে বললেন, আপনার বাড়িতে আগামীকাল একজন গুণী মানুষ আনব। যদি অনুমতি দেন। সোনা ভাই বললেন, লোকটি কে? উনি বললেন, ভদ্রলোক একজন কবি। সোনা ভাই খুব খুশি হইছিলেন। তিনি তো নিজেও কবিতার প্রতি দুর্বল ছিলেন। ফার্সি ও বাংলায় খুব সুন্দর আবৃত্তি করতে পারতেন আমার নানা। গুণী মানুষ পাইলে আপ্যায়ন করতেন নিজে। তিনি অনুমতি দিলেন। পরের দিন কবি সাহেব আসলেন পাইকপাড়ায় আমার নানার বাড়িতে। সোনা ভাই কবির জন্য সম্মানজনক মেহমানদারীর ব্যবস্থা করলেন।
ঐদিন কবি জসীম উদ্দীনকে ঝাপসা দেখছি। আমার ঘরের সামনে দিয়া তো সোনাভাইয়ের ঘরে যাইতে হয়। আমি ঘরের ভিতর থেইকা জানালা দিয়া দেখলাম—শফিউল্লাহ আর কবি সাহেব ছিলেন লম্বা। এক ঝলক দেখলাম একজন নতুন লম্বা মেহমান আমার ঘরের সামনে দিয়া হাইটা গেলেন। আমি তখন আলাদা রুমে থাকতাম। একপাশে আমার বিছানা আরেক পাশে নানীর বিছানা থাকত।
পনের ষোলদিন পরে শফিউল্লাহ সাহেবকে নিয়ে কবি আবার আসছিল। আমাকে জানানো হয়নি। পড়ার টেবিলে বইসা আছি। কিছুক্ষণ আগে আমার স্কুলের মাস্টার কুমুদরঞ্জন বাবু পড়াইয়া গেলেন। আমি খাতা টাতা গুছাই এদিক ওদিক তাকাই, এমন সময় দেখি এক ভদ্রলোক ওই ঘরের সামনে দিয়া আমার দিকে চাইতে চাইতে বারান্দা পার হইল। আমিও চাইয়া রইলাম। দেখলাম ভদ্রলোক গলায় চাদর প্যাঁচানো, মানে সাহেবি পোশাক না। ধুতি পরা পাঞ্জাবি পরা সাদা চাদর গলায়। চশমা ছিল না। জসীম উদ্দীন তখন মাঝে মধ্যে ধুতি পরতেন। তিনি আমার নানা ভাইয়ের ঘরে গেলেন। সন্ধ্যার একটু আগে। কিছুক্ষণ থাকার পর উনি চইলা গেলেন। যাওয়ার সময় আমি দেখি নাই। তারপরে কতদিন পরে আমাদের বাড়িতে আসছিলেন আমার ঠিক মনে নাই। প্রায় একমাস কি বিশ পঁচিশ দিন হবে। ঐ শফিউল্লাহ সাহেবের সাথেই আবার আসলেন। আসার সাথে সাথেই দেখলাম একটা চঞ্চল অবস্থা। খুব খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা। আমি কিন্তু আগে থেইকা কিছুই জানি না।
আমি কি যেন একটা খাতা নাড়াচাড়া করতেছিলাম। হঠাত্ দেখি সেই ভদ্রলোক টপ কইরা আমার পড়ার টেবিলের সামনে যে চেয়ারে আমার মাস্টার মশাই বসেন সামনাসামনি, সেই চেয়ারটায় একাই বইসা পড়লেন। আমি একটু অবাকই হইয়া পড়লাম। হঠাত্ কোন জানান না দিয়া আমার ঘরের ভিতরে অচেনা মানুষ! আত্মীয়-স্বজন না। আশ্চর্য ব্যাপার। আমার একটা খাতা টান দিয়া নিয়া বলল, খুকী তুমি এই খাতাটা আমাকে দিবা, আমি তোমাকে একটা কবিতা লেইখা দেই? আমি মাথা ঝুলাইলাম। কিছুক্ষণ বেশ কাটাকুটি কইরা এক পৃষ্ঠায় কবিতা আর এক পৃষ্ঠায় গান লিখলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন খুকী তুমি কবিতা ভালোবাস? আমি একটু ঠাট্টাচ্ছলে বললাম, না। কথাটা বলার পর আমি একটু হাইসা দিছি। তারপর আর কোন কথা হয় নাই। তখন তো আমি জানি যে কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা আমাদের সিলেবাসে আছে। রাখাল ছেলেটা। আমার খাতায় লেখা কবিতাটা ছিল—
আমারে করিও ক্ষমা
সুন্দরী অনুপমা
তোমার শান্ত নিভৃত আলয়ে
হয়তো তোমার খেলার বাসরে
অপরাধ রবে জমা
আমারে করিও ক্ষমা।
নারায়ণগঞ্জের মর্গান স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ি। ওটা শুধু মেয়েদের স্কুল ছিল, প্রাইভেট স্কুল। এখনও গেলে দেখি সেই গেইট, সেই ভবন। ও এখন মনে পড়ছে। ভদ্রলোকের সামনে আরও কিছু সময় ছিলাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, খুকী তুমি কি গান গাইতে পার? আমি বললাম, না। আসলে গান জানতাম।
ভদ্রলোক তো আমারে দেখার পর নানা দিক থেইকা আমার নানা ভাইরে হাত করার জন্য লাইগা গেল। অনেককে দিয়া সুপারিশ করতে লাগল। ওই যে আমারে দেখল, আমার রূপ তার মনে ধইরা নিল, কবি তো!
কবি সাহেব আরেকদিন যখন আসলো, আমাকে গান গাওয়ার জন্য পনের বিশ মিনিটের মত অনুরোধ। আমি আর হারমোনিয়ামে হাত দেই না। আমার নানী ধমক দিল খুব জোরে। নামকরা লোকের সাথে বেয়াদবি করতেছ। গান শিখছ তো মানুষরে শুনানোর জন্যই। শুনাও। তারপর আমি তখন গাইছিলাম নিশীথে যাইও ফুলবনে...। এটা জসীম উদ্দীনের লেখা গান। কিন্তু আমি তখন জানতাম না। আমার গানের মাস্টার শিখাইছিল রবীন্দ্রনাথের গান, নজরুলের গান এবং এই গানও। তারপরও আরও গান গাইতে খুব অনুরোধ করছিল। আমি আর গাই নাই।
কবি সাহেব আমাকে প্রথম দেখার পর তলে তলে অনেক ঘটনা ঘটতেছিল। আমি কিছুই জানি না। আমার মনে হইতে লাগল ভদ্রলোক যে ঘন ঘন এই বাড়িতে আসতেছে ব্যাপারটা কি! তারপরে আমার খালারা হাসি মস্করা কানা-ঘুষা তাতে একটা আলামত পাওয়া গেল। একদিন আমার এক আত্মীয় ঠাস কইরা বইলা ফালাইল, তোমাদের বাড়িতে যে কবি জসীম উদ্দীন আসে তার সাথে তোমার বিয়া ঠিক করতে চায় তোমার নানা। তুমি রাজি আছ কি না? তিনি আমার মাধ্যমে জানতে চান। আমি ছেলেমানুষী ছলে বইলা ফালাইলাম, আমার মত আছে। তারপর দৌড় দিয়া দিদির সামনে থেইকা পালাইয়া গেলাম। আমার আনন্দ হইতে লাগল যে একটা বিয়া হইতে যাইতেছে। হৈচৈ কত মজা হবে। কিন্তু ব্যাপারটা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তখন তা বুঝি নাই।
তারপর তো আর কি চাই! নাতিন বিয়ায় রাজি হইয়া গেছে। সোনা মা মনে করছিল রাজি হব না। কবি হিসেবে তাকে তো জানতামই। তখন মনে হয় নাই একটা কালো লম্বা মানুষ, আবার কবি, তার সাথে আমার বিয়া হইতে যাইতেছে। আমার মা অবশ্য বিয়া দিতে চায় নাই। কালো, এ জন্য আমার কোন অসুবিধা ছিল না। তারে দেইখা আমারও পছন্দ হইছিল। বয়সটাও আমার কাছে কোন বাধা মনে হয় নাই। সবচেয়ে পছন্দ হইছিল কি—তিনি হাইসা যখন কথা বলছিলেন একদিন দেখলাম সোনার দুইটা দাঁত চকচক কইরা উঠল। তাঁর সোনার বান্ধানো দাঁত ছিল দুইটা সামনের দিকে। সোনার দাঁত দেখার জন্য তার দিকে বারে বারে চাইছি। সোনার দাঁত পরে ছিল না। প্লাস্টিকের দাঁত লাগাইছিল।
কবি সাহেব যখন বিয়ার প্রস্তাব দিল, তখন প্রথম দিকে আমার নানা-নানী রাজি হয় নাই। ওরা দুই বছর ঘোরাঘুরির পর নানা-নানী নরম হইছে। নানান কারণে তারা রাজি হয় নাই। হয়তো তাদের ধারণা ছিল, বয়সের এতো তফাত্, অ্যাডজাস্ট হইব কি না। এত আদর আহ্লাদ কইরা অচেনা অজানা এক ছেলের সাথে...। তারপর বাবার কাছে নানা চিঠি দিলেন। বাবা তখন ফরিদপুরে জিলা হাই স্কুলের মাস্টার। অনেক ছাত্র তার। শহরে নাম-ধাম আছে। বাবা তো সেই চিঠি পাইয়া সাত পৃষ্ঠা চিঠি দিলেন নানার কাছে। বাবা লিখছিলেন, আপনি কি পাগল হইয়া গেলেন। এই লোকটা পাগল। চরে চরে ঘুইরা বেড়ায়। গান গাইয়া বেড়ায়। ভাবের গান, আধ্যাত্মিক গান, মুর্শীদি গান। গানের মজলিসে সারারাত কাইন্দা কাইটা মাটিতে গড়াগড়ি খায়। এইরকম ছেলের কাছে বিয়া দিবেন? তার চাইতে আপনি নাতিনরে পদ্মায় ফালাইয়া দেন।
নানা তো চিঠি পাইয়া হতভম্ব হইয়া গেল। একটু রাগও হইল। নানাভাই বলল, ছেলেটাকে আমি প্রায় দুই বছর যাবত্ দেখতাছি। ভালোই তো। সোনাভাই তখন মহসিন হলে যাইতেন এবং পরে কবি সাহেব থাকতেন নিউ মার্কেট এলাকায়, মানে ঠিক উত্তরে ঢাকা কলেজের কাছে হইলদা রঙের একতলা বাড়ি, বাড়িটা নাকি এখনও ঐরকমই আছে। সোনাভাই না বইলা খুব সকালে যাইয়া উঠলেন। দেখার জন্য, আসলে ছেলেটা কেমন। একদিন একটা মজার ঘটনা সেই বাড়িতে হইছিল। আমার সোনাভাই ভোরে যাইয়া কবি সাহেবকে উঠাইয়া বিদায় নিতেছিল। কবি তাকে নাস্তা খাওয়াইয়া খাতির কইরা তারপর রুমে আটকাইছে। কবি সাহেব বলছিলেন, আমার কাছে নাতিন বিয়া দিবেন কি না কথা দিয়া যাইতে হইব। নইলে আইজকা আপনারে ছাড়মু না। নানা ভাইতো মুস্কিলে পড়লেন। শেষ পর্যন্ত কথা দিয়া ছাড়া পাইতে হইছিল।
আমার কাছে ব্যাপারটা এখনও বিস্ময়। এত বড় কবির সাথে বিয়া হইতে যাইতেছে, তখন যার কবিতা পাঠ্য বইয়ের অন্তর্গত। খুব একটা অন্যরকম ভাব আমার আসছিল। মানে স্বপ্নের মতো অবস্থা। আমি তখন বিয়ার কথা চিন্তা করতাম না। ছিলাম স্কুলের ছাত্রী। সোনা মা আমারে সাধারণত কারো সাথে মিশতে দিত না। আমি ছিলাম খুব একা। মাঝে মধ্যে ছুটির সময় আমার ছোট ভাই মিন্টু আসতো। ওর সাথে খেলা করতে করতে মনে হইত আমি বুঝি বন্দি অবস্থা থেইকা মুক্তি পাইলাম।
আমার বিয়ার কথাবার্তা চলতেছে। তারিখ-টারিখও ঠিক হইল। ৩ মাস পরে বিয়া হবে ইউনিভার্সিটির গ্রীষ্মের ছুটিতে। নানা ঠিক করলেন ছেলের বাড়ি দেখতে হয় তিনি ফরিদপুরের অম্বিকাপুরে তার এক ভাইগ্না এবং মিলনদাকে পাঠাইলেন। মিলনদা আমার খালাতো ভাই।
ঐ দুই যুবক সব খোঁজ খবর নিয়া আসলেন। কবি সাহেব তিনদিন তাদের এমন আপ্যায়ন করলেন যে, তারা মহা খুশিতে নারায়ণগঞ্জে ফিরা আসলেন। ওদের যখন বাড়িঘর দেইখা পছন্দ হইছেন তখন নানাও খুশি। তিনি বিয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। সোনাভাই আমার বিয়ার ঠিক আগের দিনগুলোতে রাতে কানতেন। এত আদর কইরা নাতিন পালছেন, তারে বিদায় দিতে তার কষ্ট হইতেছিল। তার মুখে হাসি, কিন্তু চোখ দেখলে বুঝা যাইত অন্তর কানতেছে। বিয়ার জিনিসপত্র কেনাকাটা শুরু হইল। কলকাতা গেল বিয়ার মার্কেটিং করতে। সাথে মিলনদাও গেছিল। তাকে নেয়া হইছিল আধুনিক জিনিসপত্র চিনবার জন্য, কারণ নানাভাই আগের দিনের মানুষ। তারা বহু জিনিসপত্র আনলো—খুব সুন্দর বেনারসী, আকাশী নীল রঙের। আমি মনে মনে ভাবলাম আমারে লাল শাড়ি দিল না কেন। সে সময় শাড়িটার দাম ছিল একশ’ সত্তর টাকা। আর বরের জন্য কলকাতা থেইকা খুব দামি সেলোয়ারের কাপড়, তারপর শেরওয়ানী, টুপি ও পাগড়ি এবং কাপড় আনছিল। কাপড় নিয়া অম্বিকাপুর পাঠানো হইছিল। সেগুলি নারায়ণগঞ্জের ভালো টেইলারিং থেইকা বানানো হইল। কবি সাহেব তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে অম্বিকাপুরে।
ঘটনাটা ১৯৩৯ সালের। গায়ে হলুদ যখন হইছিল, তখন আমি ঘরের জানালা দিয়া উঁকি মাইরা দেখলাম অনেক জিনিসপত্র, ডালা-ডুলা আর সাত-আটটা ঘোড়ার গাড়ি বাড়ির সামনে। প্রত্যেকটা ঘোড়া নানা রঙের ফুল দিয়া সাজানো হইছে। ঐভাবে গায়ে হলুদের জিনিস দিয়া সারা শহর ঘুইরা আইছে সবাই। খুব ফুর্তি হইছিল। গায়ে হলুদেই লোক হইছিল এক হাজারের মতো। আমার মা-বাবা’র বিয়াতে মত ছিল না। তারা ক্ষুব্ধ। তাই বিয়ার কোন অনুষ্ঠানে তারা আসেন নাই। শুধু ফরিদপুর থেইকা অনেক কান্নাকাটি করার পর মিন্টুরে পাঠাইছিল।
হলুদের মালপত্র নিয়া আমাদের ঘাটে যাওয়া হয়, যেখানে ফরিদপুরের স্টিমার আসে। ওই ঘাটে কবিকে সমস্ত কাপড়-চোপড় পরাইয়া আনা হইল নারায়ণগঞ্জের পাইকপাড়ায়। বরযাত্রী পঁচিশ ত্রিশজন, এর বেশি হবে না। সাথে ছিল তার বড় ভাই, বোনের জামাই, চাচাতো ভাইরাও ছিল। বিয়াতে গেইট ধরা হইছিল। শালীদের সঙ্গে এক ঘণ্টা যুদ্ধ। খালাতো বোনদের সাথে কথা কাটাকাটি হইল। এক টাকাও দেয় নাই। আমার বোনরা বলছিল, যাইতে দিব না। কবি বলছিল, ঠিক আছে দাঁড়াইয়া থাক। তারপর সময় নষ্ট হইতেছে দেইখা আমার নানা সবাইকে গেইট ছাইড়া দিতে বললেন। বিয়ার তারিখটা ছিল, আমার ইংরেজি মনে নাই, বাংলা মনে আছে— ১০ই আষাঢ়, ১৯৩৯ সাল। মনে হয় পঁচিশ তারিখ ছিল। তখন কিন্তু বিশ্বযুদ্ধ শুরু হইয়া গেছে।
বিয়ার দিনের ঘটনা আমি তো সবকিছু নিজে দেখি নাই। পরে শুনছি। আমারে খুব সাজাইছিল। ঢাকা থেইকা ফুল কিনছিল কয়েক মণ। বিয়ার দিনে আমার মন খারাপ ছিল না। যখন আমারে বিদায় দেয়, সবাই কানতেছিল। দেখলাম সোনা মা হাইসা বাঁচে না। কি যেন আমার মনে হইছে। আমি তো চইলা যাইতেছি না। আমার মনে হইতেছিল বেড়াইতে যাইতেছি, আবার বাড়িতে চইলা আসমু। সেই সবকিছু বুঝবার মতো বুদ্ধি হয় নাই আমার তখন।
আমরা পরের দিন নারায়ণগঞ্জ ছাড়ছিলাম। বিয়ার আসরে নামকরা অনেক লোক আসছিল। আমার স্পষ্ট সবার নাম মনে নাই। অনেক চিঠিপত্র আসছিল কলকাতা থেইকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজ হাতে শুভেচ্ছা জানাইয়া চিঠি দিছিল। আর অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, খুব বড় শিল্পী, তিনি খুব সুন্দর একটা চিঠি এবং তার হাতে আঁকা একটা ছবি পাঠাইছিলেন দুইজনের নামে। ডক্টর দীনেশ চন্দ্র সেন শুভেচ্ছা জানাইছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবিটায় ছিল সুন্দর গোলাপী রঙের দুইটা কবুতর একটা ডালে বসা। ছবিটা এখনও আমার কাছে আছে। দীনেশচন্দ্র সেন লিখছিলেন, তিন পৃষ্ঠার এক চিঠি। চিঠিটা এখনও পড়ি। জীবনের যে এত ধাপ তার প্রত্যেকটির বিবরণসহ উপদেশ দিয়ে চিঠিটা লেখা। কে যেন ডাকযোগে কলকাতা থেইকা লাল টকটকা একটা মটকা শাড়ি পাঠাইছিল। যে মৌলভী বিয়া পড়াইতে আসছিল, সে বিয়ার আসরে একটু আপত্তি জানাইছিল। বিয়ার আসরে হুজুর নানা ভাইয়ের কাছে আপত্তি কইরা বলল, আপনার নাতিনরে তো নাচ শিখাইছেন, গান শিখাইছেন, হিন্দু খ্রিস্টানগো মতোন চালচলন শিখাইছেন। এখন ওর কলেমা পড়া লাগব। আমার নানা মহা ক্ষেইপা গিয়া হুজুররে বাদ দিয়া নিজেই দোয়া পড়লেন।
আমি কিন্তু বিয়ার আগে তিনবার কোরআন শরীফ খতম করছি। স্কুলে নাচ, গান, নাটক সবই করছি। কিন্তু সুন্দর জীবনযাপন করছি। ভদ্রভাবে চলার চেষ্টা করছি। বিয়াতে কবি জসীম উদ্দীন কোন যৌতুক নেন নাই। তবে আমার নানাভাই ঘরের প্রায় সমস্ত ফার্নিচার বানাইয়া দিছিল কবিকে।
বিয়ার সময় তিন দিন আলোকসজ্জা করা হইছিল এবং ব্যান্ড পার্টি বাদ্যযন্ত্র বাজাইছে। বাসর ঘর কাঠ গোলাপ, রজনীগন্ধা এবং চামেলী ফুল দিয়া অপরূপ কইরা সাজানো হইছিল। এরোন ফকিরের গল্পটা বলা হইল না। ফরিদপুরের সেই আমলের বিখ্যাত গায়েন এরোন ফকির কবি সাহেবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। তিনি আসছিলেন বিয়াতে। আমি তো ঘোমটা দিয়া বইসা আছি। অনেকেই ঘোমটা উঠাইয়া নতুন বউয়ের মুখ দেইখা যায়। তখন হঠাত্ সামনে তাকাইয়া দেখি দাড়িঅলা এক বয়স্ক লোক। অদ্ভুত পোশাক, সবার চাইতে আলাদা। আমার মুখের দিকে তাকাইয়া আছেন। আমি দেখলাম স্ফটিকের মালা গলায় বাউল গোছের লোক, ফকিরী পোশাক। আমাকে দোয়া-টোয়া করল। এরোন ফকিরের বাড়ি চর ভদ্রাসনে।
বিয়ার আসরে খুব হাসাহাসি ধাক্কাধাক্কি চলছিল। আমার খালাতো ও চাচাতো বোনরা কবি সাহেবকে জব্দ করতে চাইলে তিনি সমানে ওদের সাথে তর্ক করতে লাগল। নতুন জামাইয়ের মতো চুপ থাকে নাই। ওরা তো কবির কাছে হার মাইনা গেল। অনেক রাইত পর্যন্ত বিয়ার অনুষ্ঠান চলল। প্রায় ভোর রাতের দিকে সব অনুষ্ঠান শেষে আমাদেরকে বাসর ঘরে আনা হয়। আমি খুব ক্লান্ত হইয়া পড়লে আমার নানী পাঙ্খা দিয়া বাতাস করতেছিল। তখন কবি সাহেব বললেন, সোনামা, আপনি চইলা যান। আমি ঘুমাবো। আমি তো ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ছি। সোনামা চইলা গেলে কবি সাহেব বলেন, আসো আমরা একটু নামাজ পড়ি। আমি মনে মনে বলি ঘুমের মধ্যে কিসের নামাজ-টামাজ। আমি কথা কমু কি, উনি লজ্জা ভাইঙ্গা নিজেই কথা কইতে থাকলেন। তারপর গণকের মতো আমার হাতটা দেখল। তারপর আমি তো ঘুমাইয়া গেছি।
পরের দিন স্টিমারে নারায়ণগঞ্জ ঘাট থেইকা চাঁদপুর হইয়া গোয়ালন্দ ঘাটে পৌঁছাই। তখন দুপুর। সেখান থেইকা ট্রেনে অম্বিকাপুর রেল স্টেশন। স্টেশন থেইকা ঘোড়ার গাড়িতে কবি সাহেবের বাড়িতে আসি। আমার জন্য একটা ভিন্ন প্রকৃতি, নতুন পরিবেশ। সবার সহযোগিতায় মানায় নিছিলাম। ফরিদপুরে আসার পরেও আমার মা রাগে ছিলেন। তিনি চাইছিলেন জামাই হবে টুকটুকা রাজপুত্রের মতো, কবি-টবি না। পরে অবশ্য কবি তার ব্যবহার দিয়া সবার মন জয় করছিলেন।
আমি নিজেও এখন জীবন সায়াহ্নে। জীবিত কালেই আমার প্রথম সন্তান হাসু মৃত্যুবরণ করছে। আমার নাতি আসিফের অকাল মৃত্যু, সবই আমাকে দেখতে হইছে। অনেক স্মৃতি আছে লিখতে ইচ্ছা হয়। কিন্তু শরীর বাধা হইয়া দাঁড়ায়। দেশের মানুষ কবিকে এত ভালোবাসেন, শ্রদ্ধা করেন দেইখা আমার মনটা ভইরা যায়। তখন আমার মনে হয়, উনি মরেন নাই। আমার কবি এখনও জীবিত আছেন। নাসির আলী মামুন সম্পাদিত ‘শতবর্ষে জসীম উদ্দীন’ (প্রকাশক ফরিদপুর সাহিত্য পরিষদ) গ্রন্থ থেকে পুনর্মুদ্রিত।

সৌজন্যঃ দৈনিক আমার দেশ

দেশ আর কত প্রতিভা অকালে হারাবে | আরিফুর রহমান খাদেম

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির খুনের সংবাদ তত্ক্ষণাত্ ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে জানার পর বেশ কয়েকদিন কয় ঘণ্টা ঘুমিয়েছি জানি না। অনেকটা দুঃস্বপ্নের মধ্য দিয়েই তিন-চার রাত পার করেছি। ওই দম্পতির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই, তবু তাদের চেহারা অতি কাছের মানুষের মতোই মনে হচ্ছে। বারবারই তাদের নিষ্পাপ দুটি মুখ আমার চোখের সামনে ভাসছে। একই সঙ্গে মনে হচ্ছে তাদের শিশুপত্র মেঘের কথাও। কারণ প্রায় ওই বয়সের আমাদেরও একটি ছেলে রয়েছে। আমাদের অতি আদরের ছেলেকে দিয়ে অনুভব করতে পারছি শিশু মেঘের কথা। সে আমাদের কয়েক ঘণ্টা না দেখলে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে কীভাবে দৌড়ে এসে আমাদের কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে! মেঘ ওই অনুভূতি নিয়ে এখন থেকে কার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়বে? এ ক্ষতি অপূরণীয়। গত কয়েকদিনে বিভিন্ন মাধ্যমে নিহত সাগর ও রুনির বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীর বিভিন্ন মন্তব্য পড়ে জানতে পারলাম, তাদের কোনো শত্রু নেই বা থাকার কথা নয়। অত্যন্ত সুন্দর মনের মানুষ ছিলেন সর্বদাই হাসিখুশি এ দম্পতি। ফেসবুকেও তাদের প্রোফাইলে বিভিন্ন ছবি দেখে মনে হলো, তাদের একটি সোনার সংসার ছিল। তারপরও দুনিয়ার মায়া ছেড়ে বাধ্য হয়েই লাখ লাখ মানুষকে কাঁদিয়ে অকালে চলে যেতে হলো। কোনো এককালে শুনতাম দীর্ঘ শত্রুতার জের ধরেই কেউ খুন হয়েছে। কিন্তু এখন কাউকে নৃশংসভাবে খুন হতে তেমন কোনো কারণেরই দরকার পড়ে না। কেউ ভালো চললে বা দ্রুত জীবনে সফলতা পেলে আশপাশের অনেকেরই গা জ্বলে। আবার কেউ কেউ নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশনের ফলে নির্মম হত্যার শিকার হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে একজন আরেকজনকে হত্যার মতো জঘন্য কাজ করে বসে।
দেখতে দেখতে প্রায় তিন সপ্তাহ হয়ে গেল সাগর সরওয়ার ও মেহেরুন রুনির মর্মান্তিক মৃত্যু হয়েছে। এভাবে পিলখানার হত্যাযজ্ঞের মতোই একদিন শুনব, আজ সাংবাদিক দম্পতির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। গত কয়েক বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হচ্ছে, দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে অপমৃত্যুই বেশি হচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই খুনিদের শনাক্ত করা হলেও নিরপেক্ষভাবে বিচার হচ্ছে না। ফলে দেশের সর্বত্রই খুন, গুম, গুপ্তহত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। সম্প্রতি খুনের ধরনে যে পরিবর্তন এসেছে, তা নিঃসন্দেহে অতীতের যে কোনো বর্বর যুগ বা এক পশু অন্য পশুকে হত্যার ঘটনাকেও হার মানাবে। অপরাধ করলে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে বা শাস্তি পেতে হবে বলে যে রেওয়াজ অতীতে ছিল তা এখন দেশ থেকে প্রায় উঠে গেছে বলেই সাধারণ মানুষের মধ্যে অপরাধপ্রবণতা মহামারী আকার ধারণ করেছে। কোনো দেশের সরকারকেই বেডরুমে গিয়ে তার দেশের জনগণকে পাহারা দেয়ার বিধান নেই; কিন্তু দেশের মানুষ আইন না মানলে মানতে বাধ্য করার গুরুদায়িত্ব সরকারের এবং মানুষের মনে আইনের শাসনের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস সৃষ্টি করার দায়িত্বও সরকারের। কোনো এককালে মানুষ গরমের দিনে বাড়ির উঠানে বা ছাদে ঘুমাত। তখন তো কোনোদিন শুনিনি কেউ উঠান বা ছাদ থেকে গায়েব হয়েছে বা খুন হয়েছে। আমার মনে হয় না এ মুহূর্তে কেউ স্বপ্নেও ভাবতে পারবে ওই সব জায়গায় ঘুমানোর কথা। উদাহরণস্বরূপ এসিড নিক্ষেপের কথাও বলা যেতে পারে। বহু বছর আগে দেশে এসিড নিক্ষেপের ঘটনা সামাজিক জীবনে মহামারি আকার ধারণ করলেও তত্কালীন সরকারের কঠোর পদক্ষেপে এসিড নিক্ষেপকারীদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা হয়েছিল। তারপর প্রায় এক যুগের অধিক সময় এসিড নিক্ষেপের ঘটনা শুনিনি।
জানি না গত এক থেকে দুই বছরে দেশে কতজন খুন হয়েছে। যতজন খুন হয়েছে ওই সংখ্যার দ্বিগুণ বা ততোধিক ব্যক্তি এ ঘৃণ্য কাজের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়েছে। খুনিদের অনেকেই হতে পারে আমাদের মতোই সাধারণ পরিবারের সদস্য। তাদেরও বাবা-মা, ভাই-বোন আছে। আছে বন্ধু-বান্ধবসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী। তাদের ঘরেও থাকতে পারে শিশু মেঘের মতোই এক বা একের অধিক নিষ্পাপ শিশু। কারও বাবা, মা, ভাই বা বোন হতে পারে সমাজের সত্ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিত্ব। একজনের অসত্ কর্মকাণ্ডের ভার কেন অন্যদের আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে? মানুষ খুন করার মতো এমন জঘন্য কাজে জড়ানোর আগে এ বিষয়গুলো বারবার ভাবা উচিত। ভাবা উচিত নিজেদের পরিবারের কথা। কারণ একজন খুন হওয়ার ফলে একটি সুন্দর সংসার যেভাবে তছনছ হয়ে যায়, ঠিক সেভাবেই যে বা যারা এ খুনের সঙ্গে জড়িত তাদের পরিবারেও নেমে আসতে পারে কালো ছায়া। বরং হত্যাকারীর পরিবারের সদস্যদের ভর্তুকি দিতে হয় দ্বিগুণ। কারণ খুন হওয়া ব্যক্তির স্বজনরা দীর্ঘদিন মানসিকভাবে অসুস্থ থাকলেও খুনির পরিবারের সদস্যদের এ ঘানি টানতে হয় সারা জীবন। এ মুহূর্তে আইন তার স্বাভাবিক গতিতে না চললেও এ অব্যবস্থা আজীবন স্থায়ী হবে, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। কারণ এভাবে একটা স্বাধীন দেশ আজীবন চলতে পারে না। একবার ভাবা উচিত, খুনি যদি কোনো কারণে চিহ্নিত হয় তাহলে তার পরিবারের কেউ শুধু মানসিকভাবেই নয়, সামাজিকভাবেও কোনোদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। মানুষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের এড়িয়ে চলবে। খুনির শাস্তি কোনো কারণে মৃত্যুদণ্ড না হলেও এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে! একই সঙ্গে ভাবা উচিত খুনি যদি নিজে খুন হতো, তাহলে তার সংসারের কী হাল হতে পারত? তার যদি ফুটফুটে শিশু থাকে, সে কাকে বাবা বলে ডাকবে?
অনেকের মতো আমিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেয়া খুনিদের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে বের করে শাস্তির আওতায় আনার নির্দেশনাকে ধন্যবাদ ও সাধুবাদ জানিয়েছিলাম। আশাবাদী ছিলাম, নিরপেক্ষ তদন্তে খুনিরা ওই সময়ের মধ্যে গ্রেফতার না হলেও অন্তত শনাক্ত হবে। ৪৮ ঘণ্টার পরও তিনি সবাইকে জোর গলায় বলেছিলেন, শিগগিরই আমরা সুখবর শুনতে পাব। কথা প্রসঙ্গে অনেককে বলেছিলাম, বিলম্বে হলেও এ ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে দেশে হত্যা ও সন্ত্রাস হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। তিনি যদি মন্ত্রিত্ব লাভের পর থেকেই এভাবে ঘটে যাওয়া প্রতিটি খুনের রহস্য উদঘাটনে ও দোষীদের নিরপেক্ষভাবে বা দলমত নির্বিশেষে যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তাদের দায়িত্ব পালনে কঠোর ভূমিকা নিতে বাধ্য করতেন এবং জবাবদিহিতার নজির সৃষ্টি করতেন, মানুষ এ ধরনের নৃশংস হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে বারবার ভাবত। হয়তো সাগর-রুনিসহ অনেকেই প্রাণে বেঁচে যেত। আমাদেরও প্রতিদিন পত্রিকা খুলেই মানুষ হত্যার করুণ সংবাদ হজম করতে হতো না। দেশে-বিদেশে অবস্থানরত কোটি কোটি মানুষকেও সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দিকে আঙুল তুলে বিভিন্ন কটূক্তি ও উপহাস করতে হতো না। জানি না সাংবাদিক দম্পতিসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অন্য সব খুনের সঠিক বিচার আদৌ হবে কিনা। কারণ এরই মধ্যে বিভিন্ন পত্রিকায় অতীতে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনার মতোই সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডও প্রাণ হারাতে বসেছে। কয়েকদিনের মধ্যে হয়তো অন্য কোনো ঘটনা প্রাধান্য পাবে এবং এ বিষয়টি পুরোপুরি নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। মানুষ স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়, আর এটা ক্ষমতাসীনদেরই নিশ্চিত করতে হবে।
মানুষের জীবনের নিরাপত্তা বিধানে সরকারের নিরপেক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষীদের আরও যুগোপযোগী ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে টেলিযোগাযোগ সংস্থাগুলোকেও। কেউ বিপদে পড়লে যাতে বিশেষ নম্বরে ফোন করে তত্ক্ষণাত্ আইনের সাহায্য নেয়া যায়, সে ব্যাপারে সরকারকে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেমন বিভিন্ন উন্নত দেশের মতো অস্ট্রেলিয়ায়ও ফ্রি নম্বর ০০০ এ ডায়ালের মাধ্যমে ৩ থেকে ৭ মিনিটের ব্যবধানে সমস্যার ধরনের ওপর ভিত্তি করে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্সসহ বিভিন্ন সেবা পাওয়া যায়। বিশেষ কারণে ভিকটিম ফোনে ডায়াল করে কথা বলতে না পারলেও পুলিশ ঘটনাস্থল শনাক্ত করে ভিকটিমের কাছ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। পৃথিবীব্যাপী মোবাইল প্রযুক্তি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের সর্বত্র এর দ্রুত বিস্তার নিঃসন্দেহে প্রমাণ করে, আমাদের দেশেও অসম্ভব বলে কিছুই নেই। নিহত সাগর ও রুনির হত্যা রহস্যে মনে হচ্ছে দীর্ঘক্ষণ নির্যাতনের পর তাদের মৃত্যু হয়েছে। বাংলাদেশে এজাতীয় ব্যবস্থা থাকলে তারাও হয়তো আইনের সাহায্যে নিজেদের বাঁচাতে পারত। অন্তত প্রাণে মারা যেত না। অন্যদিকে, আমি অনুরোধ করব এ লেখার বিষয়বস্তু দেশে থাকা স্বজনরাও তাদের প্রবাসী সন্তানদের সঙ্গে শেয়ার করবেন। কারণ ইদানীং বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশীদের হাতে নিজ দেশিসহ ভিনদেশি নাগরিক হত্যার প্রবণতা বেশ বেড়ে গেছে। এদের অধিকাংশই শিরশ্ছেদের মতো ভয়ানক সাজায় দণ্ডিত হয়েছে। আবারও বলছি, মানুষ হত্যার মতো জঘন্য কাজে লিপ্ত হওয়ার আগে ভাবা উচিত, সে শুধু প্রতিপক্ষকেই খুন করছে না, হত্যা করছে সে নিজেকে এবং দুই পরিবারের সবাইকে।
লেখক : সিডনিতে ফাইন্যান্স ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত ও বিশ্ববিদ্যালয়ের খণ্ডকালীন শিক্ষক
arifurk2004@yahoo.com.au

Thursday, March 8, 2012

নারী নিয়ে বলিউডের নারীরা | বাদশা মিন্টু

৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করছেন বলিউডের সফল নারীরাও। বলিউডের নারীরা তাঁদের অধিকার, প্রেরণা, কাজের ক্ষেত্রসহ বিভিন্ন বিষয়ে মতামত দিয়েছেন। শাবানা আজমি, তামিল অভিনেত্রী খুশবু, নিতু চন্দ্রা, অদিতি রাই হায়দারি, পূজা বেদি, আলিসা চিনাই, রাইমা সেন ও কোয়েনা মিত্র তাঁদের ভাবনার কথা জানিয়েছেন।

মাঠে বা শিল্পকারখানার যেসব নারীরা কাজ করেন তারাই আমার প্রেরণার উত্স: শাবানা আজমি
বর্ষীয়ান অভিনেত্রী শাবানা আজমি বলেন, ‘নারী-পুরুষের যতই পার্থক্য থাক, তাদের অধিকার সমান। নারী-পুরুষের মধ্যে ভালো-মন্দের বিষয়টা নয়, বরং পার্থক্যটাকেই আজকের দিনে উদযাপন করতে হবে। সমস্যার সমাধানের ক্ষেত্রে পুরুষেরাই দীর্ঘদিন ধরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। পৃথিবীর অর্ধেকই নারী। তাই নারীকেও বৈশ্বিক রাজনীতি, সংস্কৃতি বা ব্যবসা ক্ষেত্রের আলোচনার কেন্দ্রে যেতে হবে। আমাদের সুযোগ করে দিতে যেসব নারী কাজ করেছেন বা যাঁদের পথ ধরে আমরা বর্তমান পর্যায়ে আসতে পেরেছি, তাঁদের সালাম জানাই। আমি আমার মা শওকত খায়িফিকে সবচেয়ে বেশি সম্মান জানাই। কারণ তিনি একাধারে একজন গৃহিণী, মা ও একজন সংস্কৃতিকর্মী ছিলেন। আমি আমাদের বাড়ির বাইয়ের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাই। কারণ আমাদের বাড়ির বাসন মেজে তিনি তাঁর মেয়েদের ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। মাঠে বা শিল্পকারখানার যেসব নারী কাজ করেন, তাঁরাই আমার প্রেরণার উত্স।

সমাজ পরিবর্তনের আগে আমাদের মানসিক পরিবর্তনটা দরকার: খুশবু সুন্দর
একজন নারী হিসেবে যেভাবে প্রতিটি দিনকে উপভোগ করি আমি, সেভাবে নারী দিবসকে আলাদাভাবে উদযাপন করি না। সমাজ পরিবর্তনের আগে আমাদের মানসিক পরিবর্তনটা দরকার। কারণ আমরাই সমাজের কারিগর। আমি কি পরিবর্তন চাই? আমি আমার পরিবারে যতটুকু দিতে পারি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি কোনো নারীর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পাইনি। তবে হেমা মালিনীকে আমি সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা করি। এ ছাড়া আমার হেয়ারড্রেসার মিসেস ইউবিন ফার্নান্দেজ আমার কাছে আমার অভিভাবকের মতো, যিনি আমার সঙ্গে দীর্ঘ ২৮ বছর কাটিয়ে গত বছর ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তিনি আমাকে বড় করে তুলেছিলেন।

একজন নারী সবদিক থেকে পূর্ণ: নিতু চন্দ্রা
আমার কাছে নারী হওয়ার মর্যাদা অনেক। একজন নারী হিসেবে শক্তি ও আবেগের সংমিশ্রণের শক্তি থাকে। তাই একজন নারী সবদিক থেকে পূর্ণ। আর আমার সঙ্গে তাই অনেকেই একমত হবেন। নারী দিবস পালন উপলক্ষে আমি নিজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন চাই না। একজন নারী হিসেবে আমার যা কর্তব্য আমি, তা-ই করে যেতে চাই। এর ফলে জীবন আরও সহজ হয়। যেসব নারী নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে সঠিক ভারসাম্য নিয়ে চলতে পারে, তারাই আমার অনুপ্রেরণার উত্স।

নারী মানে প্রতিটি নেতিবাচকতাকে ইতিবাচকতায় রূপান্তর করা: অদিতি রাও হায়দারি
নারী মানে প্রতিটি নেতিবাচকতাকে ইতিবাচকতায় রূপান্তর করা। এর জন্য কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়েও ভালোবাসা, যত্ন দিয়ে সব ঠিকঠাক করে নিয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপন করা। নারীর ভেতরের সত্তা জাগ্রত করে তাঁর সৌন্দর্যকে বিকশিত করা। যে নারী নিজের মনোযোগ দিয়ে কাজ করে এবং নিজের মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখে, সে-ই আমার আদর্শ।

নারী মানে জীবনের সম্পূর্ণ এক অভিজ্ঞতা: পূজা বেদি
নারী মানে জীবনের সম্পূর্ণ এক অভিজ্ঞতা। অনেক গুণাবলির সমন্বয়েই আমরা নারী। আমাদের মধ্যেই দেবীর সব রূপ। আমি নারী দিবসে আলাদা করে কোনো পরিবর্তনের প্রয়োজন দেখি না। আমার কাছে মনে হয়, জীবনে ভারসাম্যটাই আসল কথা। আমার অনুপ্রেরণার উত্স অ্যাঞ্জেলিনা জোলি। তাঁর মানবিক কাজগুলো আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়।

নারী ছাড়া কোনো পুরুষই কল্পনা করা যায় না: আলিসা চিনাই
শক্তি অর্জনের বড় পথ হলো শক্তির বিসর্জন। এটা নারী মাত্রই ভালো জানে। নারী ছাড়া কোনো পুরুষই কল্পনা করা যায় না। আমার কাছে নারী দিবসে কোনো পরিবর্তন করার কিছু প্রয়োজন পড়ে না। আমার অনুপ্রেরণার উত্স সোনিয়া গান্ধী, ইভা পেরন ও ম্যাডোনা।

স্বাধীনতা, শক্তি, ঔদার্য আর একাগ্রতার প্রতিমূর্তি নারী: রাইমা সেন
নারী হওয়া মানে আমার কাছে অনেক কিছু হওয়া। স্বাধীনতা, শক্তি, ঔদার্য আর একাগ্রতার প্রতিমূর্তি নারী। ঘরে-বাইরে নারী নিজেকে মেলে ধরবে—এটাই আমার চাওয়া। আমার অনুপ্রেরণা আমার দাদি, সুচিত্রা সেন।

জীবনের প্রতিটি দিনই নারী দিবস: কোয়েনা মিত্র
আমি জীবনের প্রতিটি দিনই নারী দিবস হিসেবে পালন করি। নিজেকে নতুন করে চেনা আর তৈরি করার মাধ্যমে আমি নারী। নারীর মধ্যে যেসব গুণাবলি রয়েছে, তার বিকাশই নারীত্ব। নারী হিসেবে সীমাবদ্ধতার মধ্যে আটকে থাকা নয়, বরং ছড়িয়ে দেওয়াই লক্ষ্য হওয়া উচিত। প্রত্যেক গৃহিণী আর নারীকর্মী আমার প্রেরণাদাত্রী।
(টাইমস অব ইন্ডিয়া অবলম্বনে)
সূত্র : প্রথম আলো

তিনি আমার বড় ভাই-২ | বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীর উত্তম

আজ ক’দিন থেকে নব্য আওয়ামী লীগাররা বিচার চাইছে। কিসের বিচার, কেন চাইছে, কার কাছে চাইছে ঠিক বুঝতে পারছি না। অভিযোগটা কী? তাও পরিষ্কার না। বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করেছিলাম সেই জন্য? বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর সাতাশ বছর মাংস খাইনি, তার জন্য? নিজের পয়সার কালো মুজিবকোট আজীবন পরি, এ কারণে? তাহলে এফআইআর করুন, একদিন কোর্টে দাঁড়াই। আপনাদের জারি-জুরি সব ফাঁস করে দিই।
বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার ঘোষক না বলে জনক বলেছি এর জন্য এত রাগের কী আছে? যা সত্য তাই বলেছি। আমি তো সব সময়ই বঙ্গবন্ধুকে জনক বলি। এখানে নতুন কী বললাম? জনককে জনক বলেছি, যা সবাই বলে। এত বছর সবাই তো বঙ্গবন্ধুকে জনক বলেই জেনে এসেছে, আমিও জেনেছি। এখানে অসুবিধার কী আছে? আপনারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার ভালোভাবে বিচার করতে পারেন নাই, যুদ্ধাপরাধের বিচার করতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধুকে জাতির জনক বলা, স্বাধীনতার ঘোষক না বলা বাংলাদেশ পেনাল কোড অনুসারে যদি অপরাধও হয় তাহলে কি শাস্তি হবে? ১০-১২ দিনের জেল, ৫০০ টাকা জরিমানা? নির্ভীক কলম সৈনিক জনাব মাহমুদুর রহমানের মতো জেল খাটতে রাজি আছি, তবু বঙ্গবন্ধুকে ঘোষক বলতে পারব না। বঙ্গবন্ধু জনক ছিলেন, জনক আছেন এবং যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন জনক থাকবেন। ’৯৩ সালে আমার বাবা মৌলভী মুহাম্মদ আবদুল আলী সিদ্দিকী টুঙ্গীপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর কবর ছুঁয়ে গিমাডাঙ্গা স্কুল মাঠে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘শেখ মুজিব আমার থেকে বয়সে ১০ বছরের ছোট। তারপরও সে আমার পিতা, আমার সন্তান-সন্ততিদের পিতা—তাদের সন্তানদেরও পিতা—তাই তো সে বঙ্গপিতা।’ বড় ভাই সরে সরুক আমি সেখান থেকে এক চুল সরতে পারব না।
যারা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করতে পারে না, খুনি মোশতাকের মন্ত্রিসভার সচিব এইচটি ইমামকে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা বানায়। যে মতিয়া চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর চামড়া দিয়ে জুতা বানাতো, ডুগডুগি বাজাতো সে যেখানে মন্ত্রী। যারা জাতির পিতাকে জুতার ফিতা বলেছে তারা যখন মন্ত্রী হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে যারা ফেরাউন বলেছে তাদের আত্মীয়-স্বজনরা সরকারের নানা উচ্চ পদে আসীন। যারা উঠতে বসতে নাহকভাবে সিরাজ সিকদারের খুনি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে গালাগাল করে, তাদের বিচার করার যাদের মুরোদ নেই, তাদের আমাকে নিয়ে কথা বলা শোভা পায় না। মাননীয় মন্ত্রী, আপনাদের চেলাদের দয়া করে বলে দিন, খুনিকেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর খুনের আসামিরাও কোর্টে দাঁড়িয়ে বহু কথা বলেছে। বেশি চিপবেন না, বেশি চিপলে সব কিছুই বিস্বাদ হয়। আপনাদের কারও বাড়া ভাতে ছাই দিইনি। তাই আর ভোঁতা অস্ত্র দিয়ে খোঁচাখুঁচি করে ছালকাটা করবেন না। যদি একেবারেই সহ্য না হয় তলোয়ার তো আছেই, পারলে আমার গর্দানটা নামিয়ে দিন।
তিন, ‘১৯৭১-এর আগস্টে আহত হয়ে উচ্চারণ করেছিলেন, যে কাদের সিদ্দিকী বেঁচে আছে সে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নির্দেশ মাত্র। বিস্মরণের বাজনায় অবশেষে বঙ্গবীরের মতিভ্রম ঘটল।’
১৯৭১ সালে ধলাপাড়ার মাকড়াইয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হয়েছিলাম। বাঁচবো তার আশাই ছিল না। হানাদাররাও প্রচার করেছিল কাদের সিদ্দিকী ধলাপাড়ার যুদ্ধে নিহত হয়েছে। তাই ১৪ ডিসেম্বর টাঙ্গাইলের বিন্দুবাসিনী স্কুল মাঠে এক বিশাল জনসমাবেশে মনের অজান্তেই বলেছিলাম, ‘কাদের সিদ্দিকী ধলাপাড়ার যুদ্ধে মারা গেছে। আপনারা আজ যাকে দেখছেন সে শুধু বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও নির্দেশ।’ আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না বিস্মরণের বাজনায় কোথায় আমার মতিভ্রম ঘটলো? যে ৯ মাসে একটা মানব সন্তানের জন্ম হয় না, মাত্র সেই ৯ মাসেই আঠারো হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও বাহাত্তর হাজার স্বেচ্ছাসেবকের এক বিশাল কাদেরিয়া বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানি হানাদারদের পরাজিত করেছিলাম। স্বাধীনতার মাত্র চল্লিশ দিনের মাথায় এক লাখ চার হাজার অস্ত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পদতলে বিনা প্রশ্নে জমা দিয়েছি। তাকে যখন হত্যা করা হয়েছিল, এক কাপড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে সেই হত্যার প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ করেছি। অন্য অনেকের মতো একবারের জন্যও জঘন্য ভাষায় বঙ্গবন্ধুকে গালাগাল করিনি, বঙ্গবন্ধু নামের ট্যাবলেট খেয়ে এত উত্থান-পতনের মধ্যেও এখনও তার নামের মালা জপছি। এখানে তিনি ব্যতিক্রম দেখলেন কোথায়, বুঝতে পারলাম না।
আমার চরম দুর্ভাগ্য, লেখাপড়া শিখতে ছেলেবেলায় কোনো গৃহ শিক্ষক ছিল না। ‘ক’ কোথা থেকে শুরু হয়, ‘অ’ কীভাবে লিখতে হয়—তার শুরুটা লেজ থেকে, পেট থেকে, না মাথা থেকে? তার কিছুই জানতাম না। আজ কতজনের কত গুরু, কত শিক্ষক। বঞ্চনা, বঞ্চনা আর বঞ্চনায় জীবন পার করে এলাম। তারপরও বুঝলাম না তিনি ব্যতিক্রম দেখলেন কোথায়? জনাব শাজাহান সিরাজ আমার বন্ধু বা কর্মী নন। আপনার বন্ধু এবং সহকর্মী। জীবনে কখনও ওরকম হতাশ হতে আমায় দেখেছেন কখনও? এমনিতেই বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষের ঘাড়ের রগ কিছুটা বাঁকা। তার মধ্যে আমার রগ যে সবচেয়ে বেশি বাঁকা তা তো আপনি ভালো করেই জানেন। জনাব শাজাহান সিরাজ আর আপনার যাত্রা একসঙ্গে শুরু হলেও ব্যবধান ছিল বিস্তর। আপনি ছিলেন বক্তৃতার যাদুকর। আমজনতার বিপুল সমর্থন ছিল আপনার দিকে। কিন্তু ’৬৩-৬৪ থেকে ছাত্র রাজনীতিতে আপনি পেছাতে পেছাতে একেবারে শূন্যের কোটায় নেমে এসেছিলেন। ’৬৩-৬৪ সালে টাঙ্গাইল মহকুমা ছাত্রলীগকে যেদিন জেলার মর্যাদা দিয়ে জনাব শওকত আলী তালুকদার সভাপতি ও আপনাকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করে সত্যিই সেদিন জনাব শাজাহান সিরাজের নাম জানতাম না। সে সময় টাঙ্গাইলে ছাত্র নেতাদের প্রবাদপুরুষ ছিলেন জনাব ফজলুল করিম মিঠু, ফজলুল রহমান খান ফারুক, জনাব আলী মুজাহিদী। কালী সিনেমা না রওশন টকিজের সেই সম্মেলনে একজন লাজুক ছাত্র হিসেবে আমিও হাজির ছিলাম। ছাত্রলীগ জিন্দাবাদ জনাব আলী মুজাহিদীর এরকম একটি কবিতা, ছাত্রলীগ সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। সেই সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন তখনকার ছাত্রদের প্রাণপুরুষ আইয়ুব-মোনায়েমের ত্রাস ছাত্রনেতা শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, শেখ ফজলুল হক মনি ও আরও অনেকে। সেই ’৬৩-৬৪ এর ওই সাধারণ সম্পাদকের পদের পরে আনুষ্ঠানিকভাবে দলে আর কোন পদ পাননি। জনাব শাজাহান সিরাজ পাকিস্তান আমলে একদিনের জন্যও জেলে যাননি। কিন্তু আপনি বারবার জেল খেটেছেন। এমনকি শেষবার ’৬৭-এর সেপ্টেম্বরে গ্রেফতার হয়ে ’৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তি পেয়েছিলেন। কিন্তু আপনি মুক্তি পান ময়মনসিংহ কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির একরাত পর ২৩ ফেব্রুয়ারি। সে সময় ময়মনসিংহ জেলে আপনার সঙ্গে কিশোরগঞ্জের নগেন সরকার, নেত্রকোনার অজয় রায়, মুক্তাগাছার খন্দকার শহীদুল্যাহ মালেক, ময়মনসিংহের জননেতা সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাগিনা ছাত্রনেতা সৈয়দ আনোয়ার ও আরও অনেকে ছিলেন। সে সময় আপনার সঙ্গে আমিও ক’দিন জেলে ছিলাম। আপনাকে ময়মনসিংহ থেকে ভাড়া করা গাড়িতে আনা হয়েছিল। এখন আমার মতো রাস্তাঘাটে তখন আপনার বিপুল জনপ্রিয়তা থাকলেও দলীয় পর্যায়ে ছিলেন সবার চক্ষুশূল। সামর্থ্যবানরা কেউ আপনার জন্য আমাদের একটা ঘষা পয়সার সাহায্যও করত না। অনেক ঝকমারি করে সেদিন বল্লার সাঈদ দারোগার গাড়ি নিয়েছিলাম।
’৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ’৭১-এর মার্চ এই দুই বছর এক মাস আমাদের খুব একটা ভালো যায়নি। আপনি থাকতেন ঢাকার এসএম হলে। আমরা টাঙ্গাইলে। আপনি জেলে থাকতে ’৬৮ সালে করটিয়া সা’দত মহাবিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে শুধু আমরা কয়েকজন উন্মাদ জীবনপণ করে আপনার সমর্থক সোহরাব আলী খান আরজুকে জিএস পদে জয়ী করেছিলাম। কিন্তু জেল থেকে বেরুবার পর ছাত্রলীগের কোনো পদে না আপনি স্বীকৃতি পেয়েছেন, না আপনার অনুসারী হিসেবে আমরা পেয়েছি। মুক্তিযুদ্ধে অত বিশাল ভূমিকা রাখার পরও আমি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের অনুমোদিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক হতে পারিনি।
’৭০-এ যখন ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ ছাত্রলীগের সভাপতি হন সেই কমিটিতে আপনার সাধারণ সম্পাদক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হতে পারেননি। গভীর রাতে ইকবাল হলের মাঠে যখন ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণা করা হলো তখন দেখা গেল সাধারণ সম্পাদক পদে আপনার স্থলে জনাব শাজাহান সিরাজ অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। কোথাও আপনার নাম নেই, এমনকি একজন কার্যকরী পরিষদের সদস্য হিসেবেও নয়। আমাদের কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটিতে স্বীকৃত ছিল না। আমাদের হাজার হাজার কর্মী থাকলেও জনাব শাজাহান সিরাজ সমর্থক কমিটি ছিল কেন্দ্রে স্বীকৃত। ময়মনসিংহ জেলা ছাত্রলীগের পুরো কমিটি আপনার পক্ষে স্লোগান দিচ্ছিল। তাদের সঙ্গে আমরাও শরিক হয়েছিলাম। সেই প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধে নেতৃত্ব করছিল কাপাসিয়ার খালেদ খুররম। ওর বাবা ময়মসিংহে চাকরি করতেন। সেই সুবাদে ওরা ময়মনসিংহে থাকত। সেই খালেদ খুররমকে একদিনের জন্যও মর্যাদা দেননি, কোন সম্মান করেননি। বঙ্গবন্ধু নিহত হলে সে আমার সঙ্গে প্রতিরোধ সংগ্রামে শরিক হয়েছিল। আপনার দলের কেউ তার খোঁজ নেয়নি বরং প্রতি পদে পদে আমার মতো অপমান অপদস্থ করেছেন। সেই জ্বালা সইতে না পেরে পূর্ণ বয়সের আগেই কয়েক বছর আগে বড় বেশি অবহেলা নিয়ে পরপারে চলে গেছে। সত্যিকার অর্থে বলতে কী পাকিস্তানে আমিই টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের অননুমোদিত শেষ সাধারণ সম্পাদক। কারণ আমার পর আর পাকিস্তান ছিল না। আর আপনি টাঙ্গাইল জেলা ছাত্রলীগের প্রথম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। আপনার হাতে শুরু আমার হাতে শেষ। এছাড়া ছাত্র রাজনীতিতে আমাদের কারোরই কোনো পদ ছিল না। এখানে আমরা ছিলাম ষড়যন্ত্রের শিকার। ষড়যন্ত্রের শুরুটা হয়েছিল আপনাকে ঘিরেই, আমাকে ঘিরে নয়। বঙ্গবন্ধু স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন আর সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল আপনার দারুণ প্রভাব। যে কারণে আমাদের কেউ ফেলে দিতে পারেনি। সারা জীবনে আপনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের একজন সদস্যও হতে পারেননি, আমিও পারিনি। কারণ আমি যে আপনার দলভুক্ত ছিলাম।
আমার প্রতি আপনার এত আক্রোশ কেন তা বুঝি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব আমার হাতে না এসে যদি জনাব শাজাহান সিরাজের কোনো ভক্ত-অনুরক্তের হাতে যেত, তাহলে কি তার বিরুদ্ধে অমন করে বলতে পারতেন? পারতেন না। ভারত থেকে ফিরতেই পারতেন না। আপনাদের গুণই হলো ঝড়-তুফান থেমে গেলে, বিপদ কেটে গেলে, বিপদের কাণ্ডারীদের নিষ্ঠুরভাবে ছুড়ে মারেন, আমার ক্ষেত্রে তেমন করবেন না কেন? নিশ্চয়ই করবেন। তা না হলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে না তুললে আবার ক্ষমতায় যান! অনেক নেতা যে কবরে থাকতেন তা আমার চেয়ে আপনি অনেক বেশি জানেন।
চার. ‘তবে আশংকা থেকেই যায় শাজাহান সিরাজের মতো আবার এক সময় হাহাকারে বিদীর্ণ হয়ে বলবেন নাতো, ‘বিএনপিতে যোগ দিয়ে ভুল করেছিলাম।’
লেখায় ব্যঙ্গ করার কারণেই ‘আপনি’ সম্বোধন করেছেন। আপনি বড় ভাই, যা খুশী করতে পারেন। জানেনই তো রাধাকৃষ্ণ করলে তা হয় লীলা খেলা আর গরিবের বেলায় নষ্টামি। আমার বিএনপিতে যোগদান করতে হবে কেন? আমাদেরও তো কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ নামে একটা দল আছে। তাই জনাব শাজাহান সিরাজের মতো হাহাকার করার সময় আসবে না। আপনারা অপেক্ষায় থাকেন, চাল, ডাল, আটা, ময়দা, আদা, তেল, নুনের যে দাম আর ঘরে ঘরে চাকরির যে অবস্থা তাতে দেখেন কী হয়। বড় ভাই হিসেবে আমার জন্য আপনার দুর্ভাবনা তো থাকতেই পারে। সেটা কোনো দোষের কথা নয়। আমি তো একেবারেই লেখাপড়া জানি না। তাই তেমন কিছু লিখে রাখার খুব একটা অভ্যাসও ছিল না। ভারতে নির্বাসিত থাকার সময় তেমন কাজ-কর্ম ছিল না বলে কিছুটা লেখালেখির অভ্যাস করেছি। আপনার আগাগোড়াই লেখার অভ্যাস ছিল। তাই ছাপার অক্ষরে না হলেও আপনার অনেক লেখা আছে। সে সবের অনেকটাই কিন্তু পরস্পর বিরোধী। আপনি যখন কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ মানে বাকশালে ছিলেন তখন আওয়ামী লীগকে এতো গালাগাল করেছেন যা নব্য আওয়ামী লীগার বেগম মতিয়া চৌধুরীর পক্ষেও সম্ভব হয়নি। এখন আবার নও মুসলিমের মতো ভীষণ গোড়া আওয়ামী লীগ হয়েছেন।
পাঁচ. ‘কাদের সিদ্দিকীর খোদ খাসলত সম্পর্কে জানি বলে তার কোনো কথা এবং কাজেই অবাক হই না। ’৭১-এর ডিসেম্বরেই তার হাতে যিনি অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন অবলীলায় তাকে যখন বলতে পারেন যুদ্ধের ডামাডোলে আপনাকে হত্যা না করাটা ভুল হয়েছে।’
সত্যিই আপনি আপনার নিজের জন্য অসম্ভব অসত্য বলতে পারেন। আমার খাসলত সম্পর্কে আপনি কি জানেন? আমার চালচলন, কাজ-কর্ম স্বাধীনতার পর থেকে একেবারে পরিষ্কার। কী করি না করি, কী খাই না খাই, কোথায় যাই—এসব দিবালোকের মতো ঝকঝকে তকতকে। স্বাধীনতার পর আমার কি পালিয়ে বেড়াবার কোনো সুযোগ ছিল? ছয় ফুট দুই ইঞ্চি লম্বা মানুষ আমি। এই চল্লিশ বছরে কোথাও একা যাইনি, একা হতে পারিনি। হাজার হাজার মানুষ রাস্তাঘাটে তো চিনেই, তারপর সরকারি টিকটিকি সদা পেছনে লেগেই আছে। আমাকে আপনার পছন্দ না তাই রাগারাগি করেন। অবাক তো হবেনই। সারাজীবন এত জোর-জুলুম-অত্যাচার করেও যাকে এক চুল নড়াতে পারেননি তার সম্পর্কে অবাক না হয়ে কি চলে?
’৭১-ই আপনার জন্য কাল হয়েছে। ’৭১-এর আগে ছিলেন নেতা, আমরা ছিলাম কর্মী। যদিও আমরা কয়েকজন ছাড়া অনেকেই আপনাকে ত্যাগ করেছে। ’৭১-এর মার্চে আপনি ভারতে পালিয়ে গেলে আমরা অথৈ সাগরে পড়ে যাই। জীবন উত্সর্গ করে পাকিস্তানিদের সঙ্গে মোকাবিলা করি। আপনি বলছেন, হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন। বলেন তো কী অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন? কোথায় পেয়েছিলেন সেই অস্ত্র? যদি তুলে দিয়েও থাকেন, আপনি পালিয়ে যাওয়ার পর সেই অস্ত্র কী কাজে লেগেছে? এত অহঙ্কার করেন কেন? পুলিশের ৪০-৫০টি ভাঙা অস্ত্র নিয়ে পাহাড়ের দিকে গিয়েছিলাম। আপনি তখন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হিসেবে নিশ্চয়ই আমাদের নেতা ছিলেন। নেতা হয়ে আমাদের এবং দেশবাসীকে রেখে ওভাবে পালিয়ে গেলেন কেন? দেশে থাকলে তো আপনিই নেতা হতেন। আর যুদ্ধে যেতে অপারগ হলে, পাকিস্তানি হানাদারদের মোকাবিলা না করতে পারলে নেতাগিরি ক’দিনেই শেষ হয়ে যেত। যুদ্ধের ডামাডোলে আপনাকে হত্যা না করে ভুল হয়েছে। কখন কোথায় বলেছি? আপনি যুদ্ধের সময় ছিলেন কোথায়? অনেক নেতার মতো আপনিও তো পলাতক পার্টি। ৪ অথবা ৫ এপ্রিল শেরপুরে গাড়ি ভর্তি টাকা আছে বলে খন্দকার আসাদুজ্জামান এমপি ও আপনাকে শেরপুরের জনাব নিজাম উদ্দিন ও আনিস মোক্তার এমপিরা বন্দি করেছিল। তারা তো আপনাদের আওয়ামী লীগই করত। আপনাকে দেশে আনা হয়েছিল ২৭ নভেম্বর। ভুয়াপুর থেকে কেদারপুরে আসেন ৩০ নভেম্বর। এরপরে নাগরপুরের যুদ্ধ হয় ১ এবং ২ ডিসেম্বর। বর্তমান খাদ্যমন্ত্রী তাকে এলাসিন ঘাটে একজন অতি সাধারণ যোদ্ধা হিসেবে প্রথম দেখি, যে একটি সম্মুখ যুদ্ধও করেনি। আরও কিছুদিন যুদ্ধ হলে হয়তো সেও যুদ্ধ করত। আপনিই নাকি ভারতের তুরা থেকে সঙ্গে এনেছিলেন। সেও তো আপনার কর্মী। এখন আপনাকে আছোলা বাঁশ দেয়। ৪ ডিসেম্বর আনোয়ারুল আলম শহীদের সঙ্গে আপনাকে সসম্মানে সখীপুর হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হয়। পায়ে হেঁটে সখীপুর পৌঁছতেই দু’দিন লেগেছিল। পথের ক্লান্তি দূর করতে দু’দিন বিছানাই ছাড়েননি। তারপর ১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল স্বাধীন হয়। এই ৩-৪ দিনে যুদ্ধের ডামাডোলে আপনি ছিলেন কোথায়? আপনার সঙ্গে তো শুধু একবার একদিনের জন্য আমার কেদারপুরে দেখা হয়েছিল।
স্বাধীনতার পর ৫ অথবা ৬ জানুয়ারি টাঙ্গাইল নিরালার মোড়ে যে জঘন্য ভাষায় ছাত্র ইউনিয়নের নেতা হামিদুল হক মোহনের জন্য আমাকে ও মুক্তি বাহিনীকে গালাগাল করেছিলেন তাতো আপনার ভুলে যাওয়ার কথা নয়। আমি আপনার ছোট ভাই না হয়ে সেদিন অন্য কেউ হলে বকাবকির ‘ব’ও করতে পারতেন না। নরম মাটি পেলে বিড়ালেও খামচায়—এটাই সত্য। লোক হাসাতে লিখছেন, লেখেন। কিন্তু একটু আগে-পিছে ভেবেচিন্তে লিখেন।
ছয়. ’৭৫-পরবর্তী ভারত সীমান্তে জীবন বাঁচাতে প্রতিরোধের মহড়াকালে প্রতিরোধী বাহিনীর বঙ্গবন্ধু-প্রেমীদের তার অনুগত থাকতে যে কঠোর নির্দেশ দিতে পারেন এবং কোন নীতি ও আদর্শের কথা উচ্চারণ করলে চরমতম দণ্ডের হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন, তারপরও প্রতিবাদ করায় আমাকে প্রতিরোধ সংগ্রাম থেকে বিযুক্ত করা, জাতীয় ছাত্রলীগের সদস্য নুরুল ইসলাম সৈয়দকে হত্যা করতে যার চৈতন্যে কোনো যন্ত্রণা হয়নি তার পরিণতি আজকের মতোই হবে তা বলাই বাহুল্য। বঙ্গবীর আবদুুল কাদের সিদ্দিকীর স্খলন বা পতন হলো তা কিন্তু ভাবা ঠিক হবে না। আসলরূপে তার আত্মপ্রকাশ ঘটল মাত্র।’
এইটুকু পড়ে পাঠক কিন্তু আমার কোনো নতুন রূপ খুঁজে পাবে না। যা ছিলাম তাই তারা দেখবে। কিন্তু আপনার এখানে কিছুটা নতুন ভূমিকা খুঁজে পাবে। আমি যদি জীবন বাঁচাতে প্রতিরোধের মহড়া দিয়ে থাকি সেখানে আপনিও কিন্তু ছিলেন। আর যদি এটা ধরে নেয়া হয় যে, আমরা বঙ্গবন্ধুর হত্যার প্রতিবাদ প্রতিরোধ করিনি। তাহলে দুশমনরা যে বলে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর ইন্নালিল্লাহ পাঠ করার লোক খুঁজে পাওয়া যায়নি, কোন প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হয়নি সেটাই সত্য প্রমাণিত হবে। আজকে মন বোঝাই বিক্ষোভ ও অসন্তোষ নিয়ে ফরমায়েশি যে লেখা লিখছেন—এর কিন্তু ওপিঠও আছে। মুক্তিযুদ্ধে যেমন এক পয়সার কোনো ভূমিকা রাখেননি, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিরোধ সংগ্রামেও আপনার তেমন ভূমিকা ছিল না। আমাদেরকে বিব্রত করা ছাড়া আপনার খুব একটা অবদানও খুঁজে পাওয়া যাবে না। দু’চার দিন যা প্রতিরোধ শিবিরে ছিলেন অন্তত একশ’জন যোদ্ধার একদিনের খাবার টাকা আপনার একদিন সিগারেট ফুঁকতে লাগত। শিলিগুঁড়ি আর কলকাতায়ই ছিলেন বেশি। আমাকে সহকর্মীদের খাওয়ার টাকা থেকে টাকা বাঁচিয়ে আপনার সিগারেট খাওয়ার খরচ পাঠাতে হতো। আপনি সব সময় বিপুল গালাগাল করতে পারেন, সে যোগ্যতা আপনার অসাধারণ। রেকর্ডপত্র নাই মনে করে অবলীলায় এখন যা খুশী তাই বলবেন না। ’৭৫-এর পরের আপনাদের অনেকের বক্তৃতার রেকর্ড আছে। ছবি, চিঠিপত্র তো আছেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রতিরোধ সংগ্রামের সময় থেকেই অনেক চিঠি দিয়েছেন। সর্বজনাব শেখ সেলিম, মোস্তফা মোহসীন মন্টু, মোজাহিদুল ইসলাম সেলিম, অধ্যাপক আবু সাঈদ, আওয়ামী লীগ নেতা আনোয়ার হোসেন, সামসুদ্দিন মোল্লা, রওশন আলী, ডা. এসএ মালেকসহ আরও অনেকে যারা শিবিরে ছিলেন তারা সর্বোতভাবে সাহায্য করতে চেয়েছেন—এসবই কী তাহলে ফাঁকি, মিথ্যা আশ্বাস, ফাঁকা বুলি ছিল?
শুধু সৈয়দ নুরুর কথা লিখেছেন। এতে মনে হয় আপনাদের একটু সুবিধা হয়। মৌলভী সৈয়দের কথা তো লেখেননি? আবদুল খালেক খসরু, সাখাওয়াত হোসেন মান্নান, আলী আজম আলমগীর (আলম), নজিবর রহমান নীহার, মোঃ ইবনে সউদ, রেজাউল করিম, নূরুল ইসলাম, নূরুল আমিন, রেজাউল করিম, মিজানুল হক মুকুল, মোহাম্মদ আলী, আবদুর রাজ্জাক, মোহাম্মদ বাবলু, মোহাম্মদ সোলায়মান, আবদুর রহিম আজাদ, সুশীল ভৌমিক বেলু, শ্রী বামুন সরকার, আবদুল খালেক, রাধারমন রায় ঝান্টু, দুলাল দে বিপ্লব, রজব আলী, বলরাম সরকার, আবদুল আজজ, নিরানন্দ দাস, সুশীল দত্ত, ফনেস সাংমা, তপন চাম্বগং, এ্যলিসন মারাক, সুধীন, গোবিনিক মারাক, আবুল কাশেম, দুলাল মিয়া, রঞ্জিত কুমার জেস, সম্রাট সাংমা শহীদ, জয়েশ্বর বর্মণ, সুদর্শন সাংমা, মফিজুর রহমান খাঁন, নিখিল দে, সুবোধ চন্দ্র ধর, আলকাস সরকার, দ্বিপাল চন্দ্র দাস, হামিদুল ইসলাম, ফজর আলী, হেনরী সাংমা, শান্তি বিকাশ সাহা পল্টু, মনোরঞ্জন বিশ্বাস, আগস্টিন চিসিম, আবদুুল হেকিম, হাবিবুর রহমান, মুসলিম উদ্দিন তালুকদার, রঞ্জিত সাংমা, অনন্ত বর্মণ, প্রাণবল্লব বর্মণ, সুশীল, সুদর্শন মানকিন, জোবেদ আলী, হারু সাংমা, নজরুল ইসলাম, মোজাম্মেল হক, আবু বক্কর সিদ্দিক, ধীরেন্দ্র চন্দ্র পাল, হযরত সাংমা, পল্টু সাহা, মতিলাল দাস, আখলমন মাঝি, সুব্রত, ইসহাক আলী, মোঃ আবদুল আজিজ, মোঃ আরব আলী তাদের কথা কেন বাদ দিলেন? তাদের বাপ-দাদার নাম-ঠিকানাসহ দিতে পারতাম লেখা বড় হয় তাই দিলাম না। তারা নিজের জীবন দিয়ে আপনাদের বাঁচিয়েছেন—তাই বাদ দিয়েছেন।
প্রতিরোধ সংগ্রামে শহীদ হলে তাদের অবদানকে খাটো করার জন্য অন্যভাবে চালিয়ে দেয়ার এ অপতত্পরতা আপনাদের চিরকালের। সময় থাকতে এসব বন্ধ করুন। আমার পরিণতি নিয়ে ভাববেন না। আপনাদের পরিণতি নিয়ে একটু ভাবুন। দেশের অবস্থা খুব একটা ভালো না। আর আপনি আপনার দল এবং সরকারের কোনোখানেই নীতি-নির্ধারক নন। চালের দাম পঞ্চাশ টাকা, ডালের দাম সোয়াশ’, তেল-চিনি-নুন আকাশছোঁয়া। ঘরে ঘরে চাকরি দিতে চেয়েছিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেছেন, এ পর্যন্ত একলাখ ত্রিশ হাজার লোকের চাকরি দিয়েছেন। তাহলে পাঁচ বছরে দুই লাখ ষাট হাজারের বেশি দিতে পারছেন না। ঘরে ঘরে চাকরি দিলে অনেক হয়ে যাবে। শুধু পরিবারপিছু একটি করে চাকরি দিতে হলে অন্তত দুই-আড়াই কোটি চাকরি দরকার, দিয়েছেন একলক্ষ ত্রিশ হাজার। এভাবে চাকরি দিলে একশ’ বছর লাগবে তখন দেশের লোকসংখ্যা হবে ৬০ কোটি। কথা এবং কাজের অসঙ্গতি দূর করুন। লিবিয়া থেকে প্রায় তিরিশ হাজার শ্রমিক এরই মধ্যে ফিরে এসেছে। লিবিয়ার পরে সিরিয়া তারপর জর্ডান, কুয়েত, কাতার, ইরান, ইরাক সব জায়গায় অশান্তি। সৌদি আরবও নিরাপদ নয়। তাই আমার পরিণতি নিয়ে ভাবছেন! আমি আপনাদের পরিণতি নিয়ে খুবই চিন্তিত। আপনারা আমায় ভাতে মারতে পারেন, পানিতে মারতে পারেন। কিন্তু আপনারা যে মানুষের পায়ে পিষ্ট হয়ে মারা যাবেন সেটা একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমার চরকায় তেল না ঢেলে যেটুকু তেল আছে তা নিজেদের চরকায় ঢালুন। চরকার আওয়াজ কিছুটা কমবে।
সাত. ‘আলাপচারিতায় এবং সভা-সমাবেশে সব সময়ই বলে আসছি বীরমাত্রই ঘটনাক্রমের জাতক। নেতা দীর্ঘ রাজনীতি প্রক্রিয়াজাত। কাদের সিদ্দিকী ’৭১-এর জনযুদ্ধের জাতক। জন উচ্ছ্বাস স্তিমিত এবং জনজাগরণ বিবশ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এবং স্বাধীনতার অভ্যুদয়ে ঘটনাক্রমে যারাই প্রচারের হাইটে এসেছেন সে জিয়া হোক, জলিল হোক, রব হোক, হউক সে কাদের সিদ্দিকী। সবাই যে আপন ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধির ডুবো সাঁতারে ক্লান্ত হয়ে তলিয়ে যাবে তা বলাই বাহুল্য। জিয়া, রব, জলিল, কাদের সিদ্দিকী একই স্মরণীয় যাত্রী মাত্র। সময়ে অনেকেই এই স্মরণীতে যুক্ত হবেন যে তাতে কোন সন্দেহ নেই। এটাই সমাজ বিকাশের অমোঘ নিয়ম।’
চমত্কার! এবার আসলরূপে আবির্ভূত হয়েছেন। যুদ্ধ করব আমরা, দেশ স্বাধীন করব আমরা আর দেশটাকে লুটেপুটে খাবেন আপনারা। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমরা যদি দেশ চালাতাম, যেমনি ফিদেল কাস্ট্রো চালিয়েছেন, হোচিমিন চালিয়েছেন, দেশ স্বাধীন করে তেমনি আমরা চালালে এই বিড়ম্বনার কথা শুনতে হতো না। আপনারা চাচ্ছেন যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে আমরা গোলামরা দেশটা স্বাধীন করে দিই, আপনারা পায়ের উপর পা তুলে রাজত্ব করেন। ঠিকই বলেছেন। কিন্তু যুদ্ধটা যদি দশ বছর চলতো তাহলে আপনার মতো বকধর্মী নেতারা অবশ্যই বুঝতে পারতেন কত ধানে কত চাল। যুদ্ধ বিগ্রহ, ঝড়-ঝাপটায় আমরা, আর ঝড় থামলে আপনারা। সত্য বলার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। দেখা যাক, দেশবাসী আপনাদের অভিসন্ধি ধরতে পারে কিনা। এখন আর জনসাধারণকে অত বোকা ভাবা উচিত নয়। দু’একটি কালা অক্ষর তাদের পেটেও আছে।

Tuesday, March 6, 2012

অগ্নিঝরা মার্চ-৭ : আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ

আজ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ— একাত্তরের এই দিনে এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রত্যাশাকে ধারণ করে রমনার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লাখো জনতার সামনে দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেন তার ঐতিহাসিক ঘোষণা—‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’
একই সঙ্গে তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আহূত ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য চারটি দাবি উত্থাপন করেন। রেসকোর্স ময়দানে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণাটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা নয়। কিন্তু ওই সময় তার এই ভাষণই মুক্তিকামী মানুষকে উদ্দীপ্ত ও অনুপ্রাণিত করে।
একাত্তরের ৭ মার্চ দুপুরের পর রেসকোর্স ময়দানে ছিল শুধু মানুষ আর মানুষ। লাঠি হাতে প্রতিবাদী মানুষ, শহরের মানুষ, গ্রামের মানুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত, ধনী-গরিব, বৃদ্ধ-যুবা— সর্বস্তরের মানুষ। এর আগের ঘটনাপ্রবাহে সেদিনের জনসভাটি পরিণত হয় স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষের মিলন মোহনায়।
এই দিনে শেখ মুজিব মাত্র ২০ মিনিটের ভাষণে পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকার নির্দেশসহ এদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণের দাবি উত্থাপন করেন। সেদিন প্রতিটি মিছিলেরই গন্তব্য ছিল রেসকোর্স ময়দান। পরাধীনতার দীর্ঘ প্রহর শেষে এমন একটি মাহেন্দ্রক্ষণের জন্যই যেন অধীর অপেক্ষায় ছিল পুরো জাতি।
এই ঐতিহাসিক ভাষণ ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ সম্প্রচার না করায় বাঙালি কর্মচারীরা এ দিন কাজ বন্ধ করে দেন। ফলে সম্প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদিকে টেলিভিশনে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ সম্প্রচার করা হলেও এ প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে। ফলে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান সম্প্রচারও বন্ধ হয়ে যায়। গভীর রাতে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের কর্মচারীদের সঙ্গে সামরিক কর্তৃপক্ষের দীর্ঘ আলোচনার পর ৮ মার্চ (সোমবার) সকাল ৬টা হতে রেডিও সম্প্রচার শুরু এবং সাড়ে ৮টায় রেসকোর্সের বক্তৃতার পূর্ণ বিবরণী ঢাকাসহ দেশের সকল কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারের সিদ্ধান্ত হয়। অন্যদিকে ‘স্বাধীন বাংলার’ দাবিতে এদিন (৭ মার্চ ) ব্রিটেন প্রবাসী প্রায় ১০ হাজার বাঙালি লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীরা শত শত ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডসহ ‘ভুট্টোর বিচার চাই’ বলে সেম্লাগান দেয়।
দিনটি উপলক্ষে রাজধানীতে আজ আওয়ামী লীগের গণর্যালি অনুষ্ঠিত হবে। বিকাল ৩টায় রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানস্থ শিখা চিরন্তনের সামনে থেকে শুরু হয়ে এ গণর্যালিটি ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে গিয়ে শেষ হবে। বিরোধী দলের ১২ মার্চের ঢাকা চলো কর্মসূচির বিপরীতে শো-ডাউন করতে ক্ষমতাসীন দলের গুচ্ছ কর্মসূচির অংশ হিসেবে এ গণর্যালি অনুষ্ঠিত হবে। ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এ কর্মসূরি ডাক দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এ কর্মসূচি উদ্বোধনের কথা রয়েছে। বিএনপির ঢাকা চলো কর্মসূচির প্রেক্ষাপটে আজকের গণর্যালি ছাড়াও আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট আগামী ১১ মার্চ ঢাকায় মানববন্ধন ও ১৪ মার্চ জনসভা করবে। এছাড়া আগামী ৯ মার্চ জেলায় জেলায় ১৪ দলের উদ্যোগে মানববন্ধন কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক বিবৃতিতে দলের পক্ষ থেকে গৃহীত এ কর্মসূচি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করার জন্য সংগঠনের সকল শাখাসহ আওয়ামী লীগ, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনসমূহের নেতাকর্মী, সমর্থক, শুভানুধ্যায়ী, সর্বস্তরের জনগণ ও দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
এদিকে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান তার বাণীতে বলেন, “১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তত্কালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে রেসকোর্স ময়দানে লাখো জনতার উদ্দেশে বজ্রকন্ঠে যে ভাষণ প্রদান করেন তা বাঙালি জাতির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছে। এই ভাষণ ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। এ ভাষণে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলের ২৩ বছরের শোষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস তুলে ধরে ভবিষ্যত্ করণীয়, মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত আহ্বান জানান। ঐতিহাসিক সেই ভাষণ এদেশের জনগণকে বিপুল শক্তি ও সাহস যোগায় এবং মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করে। এই ভাষণের ধারাবাহিকতায় ২৬শে মার্চ ১৯৭১ জাতির পিতা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ মহান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ ন’মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করি বহু কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের স্বাধীনতা অর্জনে তাই ৭ই মার্চের ভাষণের গুরুত্ব ও তাত্পর্য অপরিসীম। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ কেবল বাঙালি জাতিকে নয়, পৃথিবীর স্বাধীনতাকামী নিপীড়িত ও বঞ্চিত জনগণের আশার দিশারী হিসেবে পথ দেখাবে। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ আমাদের প্রেরণার চিরন্তন উত্স হয়ে থাকবে বলে আমার দৃঢ়বিশ্বাস”।
প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, “বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১ মার্চ থেকে সূচিত অসহযোগ আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ২৫ মার্চের কালোরাতে পাক হানাদার বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়লে তিনি পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন”।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও জনগণের ভোটে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাত অশুভ জোটের অসাংবিধানিক ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করার দৃঢ় প্রত্যয়ে প্রতিবারের ন্যায় এবারও সমগ্র জাতির সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ যথাযোগ্য মর্যাদায় ঐতিহাসিক ৭ই মার্চ দিনটিকে স্মরণ ও পালন করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
সূত্র : আমার দেশ

Monday, March 5, 2012

অগ্নিঝরা মার্চ-৭ : ৭ মার্চের ভাষণের প্রতীক্ষা

৬ মার্চ মঙ্গলবার। একাত্তর সালের এদিনে সংগ্রামী বাংলা ছিল বিক্ষোভে উত্তাল জনসমুদ্র। অন্তহীন মিছিল-সমাবেশের দেশে পরিণত হয়েছিল সারা বাংলা। দিকে দিকে ছিল স্বাধিকারকামী জনতার দৃপ্ত পদচারণা। তাদের কণ্ঠে ছিল যেন সাগরের ক্ষুব্ধ গর্জন। এদিনেও দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ৬ মার্চে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর খবরেও বিক্ষুব্ধ জনতার ক্ষোভ আরও বাড়ে। বাংলাকে স্বাধীন করার সংকল্প তাদের মধ্যে দৃঢ় হয়ে ওঠে।
৬ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে রেডিও পাকিস্তানের জাতীয় অনুষ্ঠানে ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। ভাষণে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের উদ্বোধনী অধিবেশন আহ্বানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এ ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জরুরি সভায় দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পর্যালোচনা হয়।
৬ মার্চ ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে সেনাবাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারান ৭ কয়েদি আর আহত হন ৩০ জন। খুলনায় সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হন ১৮ জন আর আহত হন ৬৪ জন।
৬ মার্চে প্রকাশিত পত্রিকাগুলোর খবরের মধ্যে স্বাধীনতার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে নিহত হওয়ার খবরগুলোকে বেশি প্রাধান্য দেয়া হয়। বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় এসব বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত হয়। এদিন (৬ মার্চ) দৈনিক ইত্তেফাক ৫ মার্চের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের বিবৃতি ‘বাংলার বুকে এ গণহত্যা বন্ধ করো’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৬ কলামে প্রকাশ করে। এছাড়া ইত্তেফাক ‘টঙ্গীতে গুলিবর্ষণে ৪ জন নিহত, ২৫ জন আহত’, ‘শেখ মুজিব সকাশে আসগর খান’, ‘কল্পনার ফানুস-শেখ মুজিব, ‘শেখ মুজিবের ভাষণ রিলে করিতে হইবে-ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি তোফায়েল আহমদ’ শিরোনামে ৫ মার্চের ঘটনা গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করে। দৈনিক আজাদ এদিন ‘অন্যূন ৪ জন নিহত, ৩০ ব্যক্তি আহত : টঙ্গীতে গুলিবর্ষণ’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে। আজাদে গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশিত অন্য সংবাদগুলোর শিরোনাম ছিল—‘আওয়ামী লীগ নেতা তাজউদ্দীনের বিবৃতি : বাংলার মানুষ স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বাঁচিতে চায়’, ‘স্বাধিকার আন্দোলনের পঞ্চম দিবস : বাংলাদেশব্যাপী হরতাল’। আর সংবাদ এদিন ‘টঙ্গীতে শ্রমিকদের ওপর সেনাবাহিনীর গুলিতে ২ জন নিহত’ শিরোনামে প্রধান খবর হিসেবে ৮ কলামে প্রকাশ করে।
অন্যদিকে দিন যতই গড়াচ্ছিল, অসহযোগ আন্দোলনের গন্তব্যও তত স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ওপরও চাপ বাড়ছিল। ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে তিনি কী ভাষণ দেবেন তা শোনার জন্য সারাদেশ ও আন্তর্জাতিক মহল অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ৭ মার্চের জনসভায় শেখ মুজিব কী ঘোষণা দেবেন তা ঠিক করতে তিনি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। জনগণের আকাঙ্ক্ষা অনুসারে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা করা হবে কিনা সেটাই ছিল প্রশ্ন।
সূত্র : আমার দেশ

Sunday, March 4, 2012

অগ্নিঝরা মার্চ-৫ : দেশজুড়ে তীব্র আন্দোলন, চট্টগ্রামে শহীদ হন ২২২ জন

৫ মার্চ। একাত্তরের এদিন ছিল বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনে ডাকা লাগাতার হরতাল ও বিক্ষোভে উত্তাল আরেকটি দিন। ১ মার্চ যে আন্দোলন শুরু হয়, গত চারদিনে তা ক্রমান্বয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে আরও উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পাকিস্তানিদের শোষণ থেকে মুক্তি পেতে সব স্তরের মানুষ একাত্তরের ৫ মার্চ রাস্তায় নেমে আসেন। মার্চে আন্দোলন শুরুর পর থেকে প্রতিদিন পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ প্রাণ হারাতে থাকেন। কিন্তু কোনো মানুষ ভয়ে ঘরে ফিরে যাননি। বরং রাজপথে যত রক্ত ঝরেছে, আন্দোলন তত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। স্বাধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আন্দোলনে গত ক’দিনে নিহতদের জন্য ৫ মার্চ সারাদেশের মসজিদ ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা করা হয়। এর মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে আরও তীব্র হয়ে ওঠে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন পরিচালনা করার জন্য এদিন ঢাকায় একটি কন্ট্রোল রুম চালু হয়।
একাত্তরের এ দিনে হরতাল পালনকালে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে চট্টগ্রামে শহীদ হন ২২২ জন। টঙ্গীতে নিহত হন ৪ শ্রমিক, আহত হন আরও ১৮ জন। যশোরে মারা যান একজন। মুক্তির ঢেউ এদিন আছড়ে পড়েছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও। একদল স্বাধীনতাকামী মানুষ বেরিয়ে আসেন কারাগারের দেয়াল ভেঙে। দেয়াল ভাঙার সময় কারারক্ষীদের গুলিতে প্রাণ হারান ৭ জন; আহত হন আরও ৩০ জন। বেরিয়ে আসা ৩২৫ বন্দি চলে আসেন শহীদ মিনারে। যোগ দেন আন্দোলনরত জনতার সঙ্গে। টঙ্গীতে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে শ্রমিক নিহত হওয়ার প্রতিবাদে নিহত শ্রমিকদের লাশ নিয়ে রাজধানীতে মিছিল বের করা হয়। এদিন বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয় চট্টগ্রামেও। চট্টগ্রামের মিছিলেও গুলি চালায় পাকিস্তানি সেনারা। এতে আহত হন তিনজন। টঙ্গী, চট্টগ্রাম ছাড়াও গুলিতে খুলনায় দুই, রাজশাহীতে একজন মৃত্যুবরণ করেন।
সংহতির ঘটনা ঘটে এদিন পশ্চিম পাকিস্তানেও। পাঞ্জাবিদের দ্বারা নিগৃহীত বেলুচিস্তানের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্তকে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অগণতান্ত্রিক বলে ঘোষণা করে। আন্দোলনে নিহতদের গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের লাহোরে। সেখানের বিভিন্ন মসজিদে দেশের সঙ্কটময় মুহূর্তে সংহতি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়।
অন্যদিকে ঢাকা শহর থেকে এদিন সেনাবাহিনী প্রত্যাহার করা হয়। গণহত্যার প্রতিবাদে বিশ্বজনমত গঠনের লক্ষ্যে বিবৃতি দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। আর নিউমার্কেটে মোজাফফর আহমদের সভাপতিত্বে ন্যাপ ওয়ালীর জনসভায় আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। রাতে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তার ধানমন্ডির বাসভবনে দেখা করেন। পূর্বঘোষণা অনুযায়ী ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে যে ভাষণ দেবেন—তা সরাসরি সম্প্রচার করার জন্য ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রতি আহ্বান জানান তোফায়েল আহমেদ।
সূত্র : আমার দেশ

Saturday, March 3, 2012

অগ্নিঝরা মার্চ-৩ : বদলে গেল রেডিও পাকিস্তানের নাম

আজ রক্তঝরা মার্চ মাসের ৪ তারিখ। একাত্তর সালের এ দিন ছিল গণবিক্ষোভে টালমাটাল আর অস্থির। একাত্তরে মার্চের দিন গড়াবার সঙ্গে স্বাধীনতার জন্য ব্যাকুল আকাঙ্ক্ষার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অগ্নিঝরা মার্চের প্রতিটি দিনই নতুন ইতিহাসের জন্ম দেয়। সেই ইতিহাস প্রতিরোধের, প্রতিবাদের, অধিকার আদায়ে ইস্পাত দৃঢ়প্রত্যয়ের, প্রিয় মাতৃভূমিকে স্বাধীন দেশ হিসেবে পাওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতির ইতিহাস।
একাত্তরের ৪ মার্চ স্বাধিকার আন্দোলন জোরদার করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে হরতাল পালিত হয় দেশব্যাপী। সারাবাংলায় সেদিন হরতাল ছিল অর্ধদিবস, ভোর ছয়টা থেকে বেলা দুটো পর্যন্ত। দেশজুড়ে চলছিল প্রতিবাদ, বিক্ষোভ। পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিটি বাঙালি ছিলেন প্রতিবাদমুখর, সংগ্রামে-আন্দোলনে একাত্ম। একাত্তরের এ দিনে ঘটে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এদিন ‘রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা’র নাম বদলে রাখা হয় ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। সেদিনের সেই ঘটনা চলমান আন্দোলনে যোগ করে নতুনমাত্রা। বীর বাঙালি ক্রমেই এগিয়ে যেতে থাকে দেশমাতৃকাকে ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের নিগড় থেকে মুক্ত করার চূড়ান্ত লড়াইয়ের দিকে।

Friday, March 2, 2012

অগ্নিঝরা মার্চ-৩: এদিন স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করা হয়

আজ স্বাধীনতার মাস মার্চের ৩ তারিখ। একাত্তর সালে এদিনটি ছিল রক্তঝরা। পাক সেনাদের গুলিতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে একশ’ ব্যক্তির প্রাণহানি হয় এদিনে। ২ মার্চের গণহত্যার শোক ঘোষণা করা হয় এদিনে। গণহত্যার শোক দিবস আর অর্ধদিবস হরতালের মধ্য দিয়ে শুরু হয় ৩ মার্চের দিনটি। একদিকে পাক সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক বৈঠকের আমন্ত্রণ, অন্যদিকে জনতার বিক্ষোভ, হরতাল, উত্তাল মিছিলে পাক সেনাদের
গুলির মধ্য দিয়ে কাটে এদিন। মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী এদিনে নিন্দা ও ব্যঙ্গাত্মক টেলিগ্রাম পাঠান পাকিস্তানি শাসক ইয়াহিয়া খানের কাছে। এদিনে স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন তত্কালীন ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ।
একাত্তরের ১ মার্চ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণা দেয়ায় বড় ধরনের চক্রান্তের মুখোমুখি হয় পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ। মার্চের প্রথম দিন থেকেই খুব সতর্ক হয়ে ওঠে তারা। ২ মার্চ ওড়ানো হয় জাতীয় পতাকা। দেশজুড়ে উত্তাল বিক্ষোভ চলে।
এদিনে ঢাকার পল্টনের জনসভায় অহিংস আন্দোলনের ডাক দেন শেখ মুজিবুর রহমান। ছাত্রলীগ ও জাতীয় শ্রমিক লীগ আহূত এ সভায় স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন ছাত্রনেতা শাজাহান সিরাজ। এদিন সকাল থেকেই যথারীতি মিছিলের নগরী হয়ে ওঠে ঢাকা। শান্তিপূর্ণভাবে অর্ধদিবস হরতাল পালনের সঙ্গে সঙ্গে মিছিলে মিছিলে ঢেকে যায় পুরো নগরী। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে এদিন পার্লামেন্টারি গ্রুুপের ১২ জন নির্বাচিত নেতাকে ১০ মার্চ বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান ইয়াহিয়া খান। শেখ মুজিবুর রহমান এ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। একই দিনে মওলানা ভাসানীর তীব্র নিন্দাসূচক ও ব্যঙ্গাত্মক টেলিগ্রাম পৌঁছে ইয়াহিয়ার কাছে।
নেতাদের বৈঠকের আমন্ত্রণের পাশাপাশি পাকিস্তানি বাহিনী জনগণের ওপর আক্রমণ অব্যাহত রাখে এদিন। পাক সেনাদের গুলিতে এদিন ঢাকায় ২৫ আর চট্টগ্রামে ৭৫ জন নিহত হয়। দেশজুড়ে হতাহতের সংখ্যা ছিল দু’হাজারেরও বেশি। এ আক্রমণ স্বাধীনতার লক্ষ্যে আরও বড় ধরনের আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত করে তুলে ছিল গোটা জাতিকে। তারা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ডাকের অপেক্ষা করতে থাকে।
সূত্র : আমার দেশ

Thursday, March 1, 2012

অগ্নিঝরা মার্চ-২ : একাত্তরের এই দিনে প্রথম ওড়ে স্বাধীন বাংলার পতাকা

আজ ২ মার্চ। ১৯৭১ সালের এদিনে বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ঢাকা। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর কারফিউ ভঙ্গ করে দিন-রাত চলে আন্দোলন-বিক্ষোভ। বিক্ষোভে নির্বিচারে গুলি চালালে নিহত হন ২৩ জন দেশপ্রেমিক। এদিন প্রথম ওড়ানো হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা। ২ মার্চ সকাল থেকেই দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষ ঢাকার রাজপথে অবস্থান নেয়। জনসমুদ্র হয়ে ওঠে রাজপথ। আর সব মিছিলের একটিই
লক্ষ্য—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ডাকে এক বিশাল ছাত্রসমাবেশ ছিল সব আয়োজনের কেন্দ্র। সকাল ১০টার মধ্যে এ সমাবেশে উপস্থিত হয় হাজার হাজার মানুষ। নির্দিষ্ট সময়ের আগেই অনুষ্ঠান শুরু হয়। এখানেই বেলা ১১টায় প্রথম উত্তোলিত হয় গাঢ় সবুজ জমিনের মাঝখানে লাল বৃত্তে অঙ্কিত মানচিত্র ‘স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা’। ডাকসুর তত্কালীন সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব সংগ্রামী ছাত্রসমাজের পক্ষে প্রথম বাংলাদেশের মানচিত্রসহ স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
আর এরই মধ্যে রক্তাক্ত অবস্থায় ছুটে এসে একজন জানান, ফার্মগেট এলাকায় গোলাগুলির কথা। বিক্ষোভ মিছিল বের হয় ক্যাম্পাস থেকে। বিকালে জনসভা অনুষ্ঠিত হয় বায়তুল মোকাররম ও পল্টন ময়দানে।
১ মার্চ বেতার ভাষণে ৩ মার্চের গণপরিষদের অধিবেশন অপ্রত্যাশিতভাবেই স্থগিত ঘোষণা করেন পাকিস্তানের তত্কালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান। এতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ছাত্র-জনতা। ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যের প্রতিবাদেই মূলত ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ১১টায় জমায়েত হয়।
২ মার্চ সন্ধ্যার পর হঠাত্ করেই পুরো শহরে কারফিউ জারির ঘোষণা দেয়া হয়। রাত ৯টা থেকে পরদিন ৩ মার্চ সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি করে সামরিক জান্তা এবং অনির্দিষ্টকালের জন্য প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকবে বলে জানানো হয়।
বেতারে কারফিউ জারির ঘোষণা হওয়ার পর দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে লোকজন নেমে আসে রাস্তায়। ব্যারিকেড তৈরি করে কারফিউ ভেঙে গভীররাত পর্যন্ত মিছিল বের করে। হাজার মানুষের স্লোগান চূর্ণ করে দেয় রাতের নিস্তব্ধতা। বিক্ষোভকারীদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালায় পাকসেনারা এবং সে রাতেই হত্যা করা হয় ২৩ জনকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকসেনাদের এমন বর্বর আচরণকে গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করেন এবং ৩ মার্চ ‘জাতীয় শোক দিবস’ পালনের আহ্বান জানান।
সুত্র : আমার দেশ

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ