প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, September 30, 2011

বাংলা ব্লগের লিংক

বাংলা ব্লগ
আপনার/ পরিচিত ব্লগের লিংক যুক্ত করার জন্য কমেন্ট / ইমেইল করুন 

ছড়ার মেলা সারাবেলা || আনিসা ফজলে লিসি

ছড়ার মেলা সারাবেলা
ছড়ার গান গাই,
ছড়ার মাঝে বেঁচে থাকার
অপার সুখ পাই।

ছড়া আমায় স্বপ্ন দেখায়
বাঁচতে শেখায় ছড়া,
কান্না হাসি সুখে-দুখে
আমার জীবন গড়া।

ছড়া আমার ভাই-বন্ধু
ছড়া সুখের হাসি,
ছড়া যেনো হীরে-মানিক
মুকেতা রাশি রাশি।

ছড়া তো এক ঝরনাধারা
সুখের নদী বাঁধন হারা,
সেই নদীতে সিনান করি
ভাসিয়ে দেবো সুখের তরী।

তাইতো ছড়া লিখি আমি
সাজাই ছড়ার মেলা,
ছড়ায় ছন্দে যায় কেটে যায়
আমার সারাবেলা।

হাত বাড়ালেই || মোশাররফ হোসেন খান

হাত বাড়ালেই ঝুমকো লতা
হাত বাড়ালেই ফুল
হাত বাড়ালেই ছলাত্ছল
হাত বাড়ালেই কূল।

হাত বাড়ালেই প্রজাপতি
হাত বাড়ালেই বন
হাত বাড়ালেই পাখির বাসা
শালিক অগণন।

হাত বাড়ালেই টিয়ার ছানা
হাত বাড়ালেই ফিঙে
হাত বাড়ালেই কলমি ডগা
হাত বাড়ালেই ঝিঙে।

হাত বাড়ালেই গাছের ছায়া
হাত বাড়ালেই ফল
হাত বাড়ালেই পদ্মদিঘি
ঢেউয়ে টলোমল।

হাত বাড়ালেই কলার কাদি
পান সুপারি তাল
হাত বাড়ালেই কদম-কেয়া
হাত বাড়ালেই পাল।

হাত বাড়ালেই মায়ের মুখ
হাত বাড়ালেই মন
হাত বাড়ালেই চতুর্পাশে
অনেক আপনজন।

ভুতের ছানা || সানজানা রহমান

গ্রীষ্মের ছুটিতে টগর নানুবাড়ি বেড়াতে যাবে ঠিক হওয়ার পর থেকেই খুব আনন্দ লাগছে তার। বারবার মন চাইছে আজই যদি সে নানুর কাছে ছুটে যেতে পারত, তবে খুব মজা হতো। এবার নানুবাড়ি থেকে আসার সময় নানু টগরকে ভূতের ছানা দিতে চেয়েছেন। কিন্তু টগর জানে ভূতের ছানা শুধু গল্পেই থাকে, বাস্তবে থাকে না। তারপরও টগরের ভূতের গল্প খুব পছন্দ। নানু ছাড়া এত মজার গল্প আর কেউ বলতে পারে না।
টগর এবার মামার সঙ্গে নানুবাড়ি যাবে। বাবা-মা যেতে পারবেন না, কারণ তাদের অফিস ছুটি হয়নি। এই প্রথম টগর বাবা-মাকে ছাড়া একা যাচ্ছে। ভাবতেই তার দারুণ লাগছে। সে এখন আর সেই ছোট্ট টগর নেই। সে ক্লাস ফোরে পড়ে। মামা টগরের খুব পছন্দের। মা’র মতো মামা টগরকে ছোটাছুটি করতে নিষেধ করেন না।
মামা আর টগর সন্ধ্যার ট্রেনে নানুবাড়ি যাবে। এর আগে টগর কখনও ট্রেনে ওঠেনি। মা টগরের সঙ্গে যেতে পারবেন না ভেবে একটু কষ্টও হচ্ছে। এসব ভাবতে ভাবতে কখন টগর ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে ওঠে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে টগর ওর ব্যাগ গুছিয়ে নিল। মামাও বিকালে এসে তার ব্যাগ গুছিয়ে নিলেন। টগর মামার ঘরে উঁকি দিয়ে দেখল মামার বিছানায় ক্যামেরা রাখা। এবার মামা গ্রামের অনেক ছবি তুলে আনবেন। মামা বলেছেন টগরকেও তিনি কীভাবে ছবি তুলতে হয় শিখিয়ে দেবেন।
সন্ধ্যার আগেই টগররা স্টেশনের উদ্দেশে রওনা হলো। ট্রেনে ওঠে এত লোক দেখে টগর অবাক হয়ে গেল। ওরা বসল একটি জানালার পাশে। বাংলার সবুজ-শ্যামল মাঠ টগর মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগল। টগরের মনে হলো স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে আনতে পারলে আরও মজা হতো। এদিকে মামা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেক রাত হয়ে গেছে, তবুও টগরের ঘুম নেই চোখে। সে মুগ্ধ হয়ে অন্য যাত্রীদের দিকে তাকিয়ে আছে। হঠাত্ খুব জোরের সঙ্গে ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল। মামার ঘুমটাও ভেঙে গেল। সামনের রাস্তায় গাছ ভেঙে পড়ায় ট্রেন আর সামনে যেতে পারবে না জেনে যাত্রীরা হইচই শুরু করেছিল। এর মাঝেই শুরু হলো প্রচণ্ড বৃষ্টি। ততক্ষণে সব যাত্রী ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করেছে। মামা কাছে এসে বললেন, টগর চল আমরা হেঁটে নবীনগর যাব। এখান থেকে ৩ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে গেলেই নবীনগর।
টগর ও রাজি হয়ে গেল। বলল, বেশ, তাই চলো।
কাদা মাটির পথ ধরে বৃষ্টিতে ভিজে যখন ওরা বাড়ি পৌঁছাল ওদের দেখে চেনার উপায় নেই। সারা শরীর কাদায় মাখা। ভোরের আগেই ওরা বাড়ি পৌঁছে গেল। তখনও আলো ফোটেনি। এ আঁধারে ওদের দু’জনকে নানুর গল্পের ভূতের মতো দেখাচ্ছে। নানু ভোরের আলো ফোটার আগেই জেগে ওঠেন। নানুকে দেখে টগর ছুটে এলো তার কাছে, কিন্তু নানু তাকে দেখে ভূত, ভূত বলে চেঁচাতে লাগলেন। টগর তো অবাক। এদিকে নানু জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। জ্ঞান ফেরার পর যখন নানু টগরকে দেখলেন আর সব কথা শুনলেন, তখন তার হাসি আর থামেই না।
নানু টগরকে কাছে ডেকে বললেন, তাহলে তুই ছিলি সেই ভূতের ছানা?
এত বড় হলেও যে নানু ভূতে ভয় পান, এটা ভেবে টগরেরও হাসি পেয়ে গেল।
সূত্র: আমার দেশ

১১ বছরে পায়ে হেঁটে বিশ্ব ভ্রমণ

১১ বছর হেঁটে বিশ্ব প্রদক্ষিণ করে দেশে ফিরেছেন কানাডার মন্ট্রিলের জঁ বেলিভো। বয়স তখন ৪৫। বেশ অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। তার ভাষ্য, মনে হচ্ছিল, আর বেঁচে থেকে কী লাভ? সবে বিয়ে বিচ্ছেদ হয়েছে। দুই সন্তান থাকে মায়ের কাছে। নিজের ছোট একটা ব্যবসা ছিল, তাও লাটে উঠেছে। তাই পিছুটান নেই।
২০০০ সালের ১৮ আগস্ট নিজের ৪৫তম জন্মদিনেই তিনি হাঁটতে বেরিয়ে পড়লেন। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ থেকে পায়ে হেঁটে গোটাবিশ্ব প্রদক্ষিণ করে আবার নিজের শহর মন্ট্রিলে ফেরার গোঁ ধরে বেরিয়ে পড়লেন তিনি। সঙ্গে ৩ চাকার একটা ট্রলি সুটকেস। তার মধ্যে স্লিপিং ব্যাগ, কিছু জামা-কাপড়, প্রাথমিক চিকিত্সার কিছু সরঞ্জাম, সঙ্গে মাত্র ৪ হাজার কানাডীয় ডলার। কোথায় রাত কাটাবেন, কখন কী খাবেন, কিছুই জানা নেই। শুধু হেঁটে চলেছেন। রওনা হওয়ার পর প্রায় ১১ বছর কেটে গেছে। সত্যি বিশ্ব প্রদক্ষিণ করে তিনি মন্ট্রিলের কাছাকাছি এসে পড়েছেন। এবার সামান্য যে পথ বাকি রয়েছে, তা অতিক্রম করে ১৬ অক্টোবর তার আবার নিজের শহরে পৌঁছনোর কথা। ৬৪টি দেশ ঘুরে প্রায় ৭৫ হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে তিনি সম্ভবত দীর্ঘতম পদযাত্রার রেকর্ড গড়তে চলেছেন।
এতদিন পর কার কাছে ফিরবেন বেলিভো? তার জন্য অপেক্ষা করছেন দীর্ঘদিনের বান্ধবী লুস আর্শাম্বো। তিনি ও তার দুই সন্তানও বেলিভোকে বাধা দেননি। ঘরে থেকেই তিনি বেলিভোর এ অভিযানে মদত দিয়ে চলেছেন। তৈরি করেছেন বিশেষ ওয়েবসাইট, যার ঠিকানা ‘ওয়াক ডট অর্গ’। তবে ‘ওয়াক’ শব্দে একটার বদলে তিনটে ডব্লিউ রয়েছে। অসাধারণ এ পদযাত্রাকে কাজে লাগিয়ে শান্তি ও অহিংসার বাণী প্রচার করার জন্য বেলিভোকে উত্সাহ দিয়েছেন তিনি। জাতিসংঘের শিশু কল্যাণ সংস্থা ইউনেস্কোর এক ঘোষণাই হয়ে উঠল এ পদযাত্রার মূলমন্ত্র। অবসাদগ্রস্ত এক মানুষের অভিযান যে এত অর্থবহ হয়ে উঠতে পারে, বেলিভো তা ভাবতে পারেননি।
এ ১১ বছর কীভাবে কাটালেন বেলিভো? কীভাবে তিনি অক্ষত অবস্থায় দেশে ফিরতে পারলেন? আশ্চর্যের বিষয়, যাত্রাপথে তেমন কোনো অপ্রিয় ঘটনা ঘটেনি। শুধু আলজেরিয়ায় তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, ইথিওপিয়ায় অকারণে তাকে একরাত হাজতবাস করতে হয়েছিল এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় দুই মাতাল তার ওপর চড়াও হয়েছিল। তিনি মেক্সিকোয় ৯ দিনের জন্য এক নারীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন, সুদানে থাকতে পাগড়ি পরে লম্বা দাড়ি রেখেছিলেন। আফ্রিকায় পোকামাকড়, দক্ষিণ কোরিয়ায় কুকুর ও চীনে সাপ খেয়েছেন। ইথিওপিয়ায় থাকতে বেলিভোর একবার মনে হয়েছিল, মাঝপথে পদযাত্রা ছেড়ে দেশে ফিরে যাবেন। কিন্তু বান্ধবীর উত্সাহে তিনি হাল ছাড়েননি। সূত্র : ডিডব্লিউ

পরিবেশ সংরক্ষণে বিশ্ব নবীর (সা.) আদর্শ || ড. মুহা. বিলাল হুসাইন

মানুষের বেঁচে থাকার অন্যতম উপাদান হলো পরিবেশ। মানুষসহ সব প্রাণীকুলের জন্য সুস্থ পরিবেশ আবশ্যক। মানুষের মৌলিক প্রয়োজন অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, বাসস্থান ও চিকিত্সা—সবই কোনো না কোনো পরিবেশের ওপর নির্ভর করে। পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভাষায়, পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে ওজোনস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমণ্ডলে বিদ্যমান আলো, বাতাস, পানি, মাটি, বন, পাহাড়, নদী, সাগর মোটকথা উদ্ভিদ ও জীবজগত সমন্বয়ে যা সৃষ্টি তাই পরিবেশ। পরিবেশের সব উপাদান মহান আল্লাহতায়ালার অপার অনুগ্রহ। মানুষের কল্যাণ ও স্বাভাবিক প্রয়োজনের তাগিদে এগুলো তৈরি করেছেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহতায়ালা এভাবে বর্ণনা করেছেন—‘তোমরা কি দেখ না, নিশ্চয়ই আসমান ও জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহতায়ালা তোমাদের কলাণে নিয়োজিত রেখেছেন এবং তোমাদের প্রতি তার প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য নিয়ামতগুলো পরিপূর্ণ করে দিয়েছেন’ (সূরা-লোকমান : আয়াত-২০)। নিশ্চয় আমি সব জিনিস সৃষ্টি করেছি সুস্পষ্টভাবে ও সুনির্দিষ্ট পরিমাপ অনুযায়ী (আল-কামার : আয়াত-৪৯)। আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, তাদের জন্য একটি নির্দশন মৃতভূমি। আমি একে সঞ্জীবিত করি এবং তা থেকে উত্পন্ন করি শস্য, তা তারা ভক্ষণ করে। আমি তাতে সৃষ্টি করি খেজুর এবং প্রবাহিত করি ঝরনা, যাতে তারা ফল পায় (সূরা-ইয়সিন : আয়াত-৩৩)।
এ থেকে বোঝা যায়, পরিবেশের যথাযথ সংরক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা যদি পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক না রাখি তাহলে বিপর্যয় অনিবার্য। এ থেকে পরিত্রাণের জন্য মহানবী (সা.) কর্তৃক পরিবেশ সংরক্ষণ নীতি ও ব্যবস্থা আমাদের দৃঢ়ভাবে ধারণ করা উচিত।
পরিবেশ আল্লাহর সৃষ্ট রহস্যাবৃত নেয়ামতগুলোর অন্যতম। জীব ও জড় উপাদানগুলোর পারস্পরিক ক্রিয়া-বিক্রিয়ার ফলই হলো পরিবেশ। এ উপাদানগুলোর মধ্যে প্রাণী, উদ্ভিদ, আলো, বাতাস, মাটি, উত্তাপ প্রভৃতি অন্যতম। পরিবেশ হলো পৃথিবীর ভূপৃষ্ঠ থেকে ওজোনস্তর পর্যন্ত বিস্তৃত পরিমণ্ডলে বিদ্যমান আলো, বাতাস, পানি, মাটি, বন-পাহাড়, নদী, সাগরসহ গোটা উদ্ভিদ ও জীবজগত সমন্বয়ে যা সৃষ্টি তাই পরিবেশ।
পরিবেশ আল্লাহর অস্তিত্ব বহন করে। সত্যান্বেষী ও অনুসন্ধানকারীদের জন্য হেদায়াতের দিকনির্দেশনা দেয়। যেমন আল্লাহ যদি সূর্যের আলো কমিয়ে দিতেন তাহলে পৃথিবী হয়ে উঠত বরফে আচ্ছাদিত। আর যদি সূর্যের আলো তীব্র করে দিতেন, তাহলে পৃথিবী হয়ে উঠত উত্তপ্তময় ও অগ্নিকুণ্ডের মতো, যা কোনোক্রমেই জীবজগতের অস্তিত্বের উপযোগী নয়। কিন্তু আল্লাহতায়ালা পরিবশেকে সব জীবের উপযোগী করে সুষম ভারসাম্যে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, আমি প্রত্যেক বস্তুকে, সুষমভাবে ও পরিমিতরূপে সৃষ্টি করেছি (সূরা-আল কাসার : আয়াত-৪৯)। পরিবেশ দু’ধরনের। একটি প্রাকৃতিক পরিবেশ, অন্যটি সামাজিক পরিবেশ।
প্রাকৃতিক পরিবেশ : প্রাকৃতিক পরিবেশ রক্ষার দাবিতে পৃথিবীব্যাপী সব শ্রেণীর মানুষ খুবই সোচ্চার। মানুষের খেয়ালিপনা ও অদূরদর্শিতার কারণে প্রাকৃতিক যে ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয়েছে তা বিশ্ববাসীর ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। ফলে বায়ুতে বেড়েছে দূষণ, বেড়েছে তাপমাত্রা, আরও বৃদ্ধি পেয়েছে রোগ-শোক ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তাই এসব বিপর্যয় থেকে বাঁচার জন্য বিজ্ঞানীরা বন রক্ষা এবং বৃক্ষরোপণকে অন্যতম উপায় বলে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কারণ গাছপালা, লতাপাতা, মানুষ ও জীবজন্তুর জন্য খাদ্য সরবরাহ করে, মানুষ ও জীবের জন্য অক্সিজেন সরবরাহ করে এবং পরিবেশ দূষণমুক্ত করে। এই বাস্তবতা বা বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) চৌদ্দশ’ বছর আগেই অনুভব করেছিলেন এবং সাহাবিদের সেই আলোকে দিকনির্দেশনাও দিয়েছিলেন। পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখার জন্য মলমূত্র, পচা-গন্ধ, নোংরা ও ময়লা-আবর্জনা ইত্যাদি এগুলোকে নাজাসাত বা নাপাকি বলে আখ্যায়িত করে ঘোষণা করেছেন পবিত্রতা ঈমানের অঙ্গ (আল-হাদিস)। এ প্রসঙ্গে আল্লাহতায়ালা বলেন, যারা পবিত্র আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন (সূরা-আত তওবাহ : আয়াত-১০৮)। এছাড়া হজরত আয়িশা (রা.) থেকে বর্ণিত, নবী করিম (সা.) বলেছেন, যদি নিশ্চিতভাবে জানো যে কেয়ামত এসে গেছে, তখন হাতে যদি একটি গাছের চারা থাকে, যা রোপণ করা যায় তবে সে চারাটি লাগাবে (আল-হাদিস)।
সামাজিক পরিবেশ : মানুষ সামাজিকভাবে বসবাস করবে—এটা পৃথিবীর একটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এটা সম্ভব হবে সমাজের প্রতিটি মানুষের মধ্যে সমতা, সাম্য, দয়ামায়া, ভালোবাসার সুষ্ঠু পরিবেশ বিরাজ করার ফলে। অন্যায়, অবিচার, জুলুম, মিথ্যা ও হানাহানিমুক্ত পরিবেশই সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার জন্য সহায়ক। সমাজের নানা অসঙ্গতি, জুলুম, রাহাজানি, চুরি, ডাকাতি, সুদ, জুয়া, মিথ্যাচার সুন্দর সমাজ বিনির্মাণের ক্ষেত্রে খুবই ক্ষতিকর। এসবের বিরুদ্ধে রাসুল (সা.) মানবজাতিকে সতর্ক করেছেন। কখনও আবার কঠোর ভাষায় হুশিয়ার করেছেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, মুমিনরা যখন দোজখের আগুন থেকে নাজাত পাবে, তখন দুনিয়াতে একে অপরের প্রতি যে জুলুম করেছিল তার প্রতিশোধ নেয়া হবে। তিনি আরও বলেছেন, মজুলমের বদ দোয়াকে ভয় কর। কেননা তার বদ দোয়াও আল্লাহর মধ্যে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই।
পরিশেষে বলা যায়, পৃথিবীকে মানুষের বসবাসের উপযোগী করে রাখতে হলে পরিবেশকে অবশ্যই সংরক্ষণ করতে হবে। মহান আল্লাহতায়ালা ও প্রিয় নবী (সা.) এ ব্যাপারে কখনও সতর্কবার্তা আবার কঠোর ভাষায় বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। পরিবেশ সংরক্ষণ ও তার হেফাজত যেহেতু মুসলমানদের ঈমান-আকিদার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিধায় ঈমান রক্ষার তাগিদে প্রতিটি মুসলমান সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য সব শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। এ পৃথিবী সামাজিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে মুক্ত হয়ে মানুষের শান্তিপূর্ণ আবাসস্থল হয়ে উঠুক—এ কামনা করছি। 

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
প্রকাশ সূত্র : আমার দেশ

বেদনা বিধুর || মাহমুদা ডলি

মা, মাগো একবার তাকাও নিজেকে দেখো
বলেছিলে—অভিমানী সুরে; গায়ের রঙটা তোমার কালো
মা, এই তুমি, সেই তুমি, যেন একটুকরো চাঁদের আলো!
বলেছিলে—বিয়েতে পরেছিলে জড়োয়া গহনা আর মসলিন
বাবা কিন্তু পাল্টায়নি, কিনেছেন দামি কাফন, মিটিয়ে পেনশনের সব বিল।
মা, মাগো একবার তাকাও নিজেকে দেখো
দেখতে তুমি কেমন; মায়াময় স্নিগ্ধ শ্যামল!
কথা হয়েছিল তোমার সাথে গতকাল,
বললে না তো? ফুটেছে হেনা, কামিনী, শিউলি
গন্ধ নিতে আয়, ছুটে আয়রে আমার স্বর্ণকমল।
তুমি নেই বলে; গন্ধরা লুকিয়েছে
রিক্ত, সিক্ত পাপড়ির ভাঁজে ভাঁজে!
তুমি নেই বলে আজ বর্ষারা আসেনি, বিরক্ত হবে ভেবে পালিয়েছে
সূর্যটা কেমন উঁকি মেরে, হাসি-হাসি
রাশি-রাশি রোদ্দুর ছুঁড়ছে!
সেদিন জীবন নদীর বাঁকে দাঁড়িয়েছিলে,
নিজের ছায়া দেখবে বলে—
ভেঙে গেল তা অবারিত ঢিলে!
বেদনা-বিধুর জীবনে চিড় ধরিয়ে চলে গেলে
নীল অসীম দিগন্তে।

মোনাজাত || মাহবুব হাসানাত

নিরুদ্দেশ কাব্যিক হলেও
পুঁজিবাদী বিভ্রান্তি
সয়ে ওঠা লক্ষ্যহীন

সকল আনন্দ থেকে
নিজেকে বঞ্চিত রাখি
লালন করি কষ্ট
পুঞ্জীভূত করি ক্ষোভ

হে ঈশ্বর
ফেটে পড়ার শক্তি দাও
যেন গড়তে পারি সমাজ সংঘ

কাফকার মতো || তমিজ উদদীন লোদী

চোখের সামনে একটি কালো পর্দা ঝুলে আছে। মায়োপিক চোখ প্রায়ান্ধ।
দোলে নিরাবয়ব ছায়া। শানানো ছুরির ঝিলিক হেনে যায় শুধু। মর্মদহন অসহায়
হাঁটু গেড়ে বসে থাকে দোরগোড়ায়। মনে হয় কাফকার মতো অ্যাবসার্ড কিছু
লিখবার এখনই সময়।

স্বাভাবিকতা যখন গোধূলি হয়ে থাকে তখন সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় থেকে কি লাভ?
স্বপ্নোত্সুক জীবনে এখন যে রক্তঝলক, আতীব্র রক্তপাত। খুব সস্তা হয়ে যাওয়া
হন্তারক। তার চেয়ে বরং এখন ডাংগুলি খেলা যাক।

পূর্বসূরিদের গ্লানিময় অভিসম্পাত ঝরে পড়ছে ফোঁটায় ফোঁটায়। নিবিড় কাতরানি
আর ঝলক-ঝলক আর্তনাদ নিরালম্ব অনুষঙ্গে প্রতিদিন। আকাঙ্ক্ষাজর্জর কেউ নয়,
বিষণ্ন মানুষের ততোধিক বিষণ্ন চোখ চেয়ে থাকে একাকী মৃত্যুর মতো নীলিমায়—

একটি বিবর শুধু অপেক্ষায় থাকে কাফকার মতো কিংবা গ্রেগর সামসার মতো
অসহায়।

সাবালিয়া || আইউব সৈয়দ

ক.
পূর্ণিমার সহজাত আলো অভুক্ত বাউলের গল্প শুনে
কানামাছি খেলে
সমস্ত প্রত্যাশার একতারাতে অনুজ্জ্বল চাহনি বিছিয়ে
বাহুতে মাদুলি বাঁধে কেন?
তবে হৃদয় ঘেঁষে রূপের হাওয়া কাব্যপাপী;
নাকি মখমল মনের রাত জাগা শরতের কৌতূহলী হাসি...?
বর্ণনার বর্ণিল ভাষায় প্রজ্ঞাপিত পূর্ণিমা কুড়িয়ে নাও
নিঃসঙ্গতার হু হু আয়োজনে থাকা মোটেই ভালো নয়
পূর্ণিমাহীন জোছনাহীন সাবালিয়া—কখনো কী
কবিতা হয়?

খ.
পূর্ণিমার জন্য জোছনা
জোছনার জন্য পূর্ণিমা
কাঠামো গুঁড়িয়ে স্বপ্ন ছড়ায় সাবালিয়াতে...!

এরোপ্লেন || মর্জিনা আফসার রোজী

—‘এরোপ্লেন অর্থ উড়োজাহাজ, এরোপ্লেন অর্থ উড়োজাহাজ, এরোপ্লেন অর্থ উড়োজাহাজ’
—‘শিখর, শিখর’।
— জ্বী মা, বলে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় আনন্দের আভা ছড়িয়ে মুখমণ্ডলময়।
—‘তুমি সারাক্ষণ ঐ একটা শব্দ মুখস্থ করছ কেন, বইয়ে কী আর কোনো শব্দ নাই?’
— আছে মা, আরও অনেক শব্দ আছে—বলেই মায়ের কাছ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে বসে একবার বলল, বেড মানে বিছানা। তারপর থেকে আগের মতো বলতে লাগল এরোপ্লেন মানে উড়োজাহাজ। মুখে পড়া চোখে অনাগত স্বপ্ন। সে উড়োজাহাজে করে বাবার কাছে বেড়াতে যাবে। কী মজা হবে, অনেক স্বাদের খাবারগুলো সে প্রাণভরে খেতে পারবে। চোখ বন্ধ করে ঝুলছে আর পড়ছে। পাশের বাড়ির হীরা কয়েকদিন হলো আমেরিকা থেকে এসেছে। কি যে মজার দুইটা চকলেট দিয়েছিল। হীরা বলছিল, এই চকলেট নাকি এরোপ্লেনে অনেক দেয়। যে যত খেতে পারে। কোনো নিষেধ নাই। থাকবেই কেন। ওখানে একটা বড় গোডাউন আছে যেখানে ভরা শুধু চকলেট, জুস আর টক-মিষ্টি আমের আচার।
মা সালমা হাতে ফুলতোলার পিলো কভার আর সুঁই-সুতা নিয়ে তার নয় বছরের ছেলের সামনে দাঁড়ায়। ছেলে মুখে পড়ার শব্দ করে হৃদয়ের বাসনা দু-চোখে ছড়িয়ে বিভোর হয়ে আছে, মায়ের সে কথা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। তাই মা আর শিশুপুত্রকে কল্পনার রাজ্য থেকে বিচ্যুত না করে মৃদু হেসে সরে পড়ে। হাতের নকশি ফুলতোলা অর্ধেকের বেশি করা হয়ে গেছে। ওটা বিছানার ওপর রেখে ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে শেখরের বাবা শামীমের গত পরশু আসা চিঠিটি আবার পড়তে থাকে।
শামীম লিখেছে, সে এ মাসের শেষের দিকে এসে সালমা এবং শেখরকে সৌদি আরবে নিয়ে যাবে। এ কথা শোনার পর থেকে শিশুটি সারাক্ষণ শুধু আরব দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। রাতে ঘুমিয়ে আর দিনের বেলা জেগে জেগে চলে তার স্বপ্ন দেখা। মা সালমার মনেও আলোড়ন জাগে, প্লেনে চড়ে মিষ্টি খেজুরের দেশে যাচ্ছে ভাবলেই মন কেমন পুলকিত হয়ে ওঠে। সেখানে তার মনের মতো স্বামী-সন্তানকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার হবে। যে ঘরটি হবে শুধুই ওদের তিনজনের। স্বামীর সঙ্গে পাগড়ী-জোব্বা পরা এরাবিয়ানদের দেশ ঘুরে দেখবে আর নিজের দেশের সঙ্গে মিলিয়ে আশ্চর্য হয়ে যাবে। ছেলেটার খুবই শখ। সে শখ যে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই পূরণ হতে যাচ্ছে, সেটা ভাবলে বিশেষ এক আনন্দ অনুভব করে অন্তরের মাঝে সে। অসম্পূর্ণ পিলো কভারটি আবার হাতে নিয়ে বসল। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। ওখানে গিয়ে হাতে কাজ করা উপকরণ দিয়ে সোফা, খাট এবং অন্যান্য শৌখিন জিনিস সাজাবে।
দশ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে খুব বেশিদিন কাছে পায়নি সালমা। বিয়ের একমাস পরে আর মাঝে এসে একমাস ছিল, যখন শেখরের বয়স ছিল পাঁচ বছর। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া তাই অপূর্ণই রয়ে গেছে সালমার। সে কারণেই মা-ছেলে উভয়ের সময় পার হয় অনেক আগ্রহের মাঝে। এতদিন এখানে শ্বশুর-শাশুড়ি আর এক ননদকে নিয়ে ছিল তার সংসার। কর্তৃত্ব শাশুড়ির হাতে থাকায় তার সংসারের সুখ বোঝা সম্ভব হয়নি। এতদিন পর সে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। সে আনন্দের বন্যায় ভাসছে দু’জনে।
—‘মা, মা, (স্বপ্ন ভঙ্গ হয় সালমার)—এই খেলনাগুলো ভালো করে ছুটকেসে ঢুকিয়ে রাখ। যত্ন কইরা রাইখো, খুব দামি কিন্তু।’
ছেলের কথা শুনে মা হাসে। এগুলো সেই তাকে কিনে দিয়েছে। আর অবুঝ ছেলে তাকেই দামি বলে যত্ন করতে বলছে। শিশুর আচরণ তো শিশুসুলভই হবে। ছেলেকে আর কী বলবে, সব সময় উত্তেজনায় টানটান হয়ে থাকে সে নিজেই। রাতের খাবার খেয়ে সেদিনের মতো তারা ঘুমিয়ে পড়ে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার পরও মা-ছেলে আলাদা আলাদা রঙিন কল্পনার জাল বুনতে থাকে। শিশু শেখর শত চেষ্টা করেও তার চোখজোড়া মেলে রাখতে পারে না। কিন্তু সালমার চোখের পাতায় যেন ঘুমকুমারী এসে বসতেই চায় না। ঘুমকুমারী যেন শুরু থেকে বলছে, স্বামীর গুরুত্বে বিরহিনী রমণী আরও কিছুক্ষণ নিজেকে ভাবনার বর্ণিল জগতে ভাসিয়ে বেড়াও। এভাবে তন্ময় হয়ে ভাবনার সুযোগ জীবনে আর পাবে না। আরব দেশে গেলে তার কত কাজ, পুরো একটা সংসারের কর্ত্রী সে। স্বামী-সন্তানের দেখভাল খাতির-যত্ন সবই তো নিজের হাতে করতে হবে তাকে।
এমনি ভাবতে ভাবতে অলক্ষ্যে ঘুমকুমারী এসে তাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিল। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘুমের মাঝে স্বপনদ্বারে স্বামী শামীমকে সে খুঁজে পেল না। কারণ, মানুষের ঘুম যখন গভীর হয়, স্বপ্নরানী তখন তার বিচিত্রতার ডালা সাজিয়ে বসতে পারে না।
সকালে ফুরফুরে মেজাজে ঘুম থেকে জাগল সালমা ও শিশুপুত্র শেখর। শেখর মাকে প্রশ্ন করে—
—‘মা আজকে কয় তারিখ? এরোপ্লেনে উঠতে আমাদের আর কয়দিন বাকি?’
মা লাজুক হাসি হেসে বলে—
—‘পাগল ছেলে, ঘুম থেকে জেগেই এই প্রশ্ন। এই তো আর মাত্র ক’টা দিন তারপর আমরা তোমার স্বপ্নের উড়োজাহাজে চড়ে আরব দেশে চলে যাব। এবার বিছানা ছেড়ে ওঠো। দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ইংরেজি বইটি নিয়ে পড়তে বস।’
বাধ্য ছেলের মতো এক লাফে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে মায়ের নির্দেশ পালন করতে লেগে গেল। সালমা ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে। সত্যি আমি ভাগ্যবতী, শেখরের মতো সন্তান আর শামীমের মতো স্বামী পেয়েছি। তার শ্বশুরবাড়ির ভাগ্য অত্যন্ত অনুকূল। একমাত্র ননদ সুরী আর শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে মফস্বলে শামীমের পৈতৃক ভিটায়ই তার শান্ত, স্নিগ্ধ দীঘির মতো একটি সংসার। তারপরও এ সংসারটি ছেড়ে সে আপন ভুবনে যেতে চায়। হাজার চেষ্টা করেও এটাকে তার নিজের সংসার মনে হয় না। সর্বত্র শাশুড়ির কর্তৃত্ব বিরাজমান। রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো, সাজ-গোজ ঘর সাজানো, কোনো কিছুই নিজের মতো করে হয় না। যেটা এখন আরব দেশে গিয়ে বাস্তবায়িত হবে।
ইদানীং কি যে হয়েছে বোঝে না সে, শামীমের কথা মনে হলেই তার শরীরের পঞ্চইন্দ্রিয় জেগে প্রতিটি লোমকূপের গোড়ায় শিহরণ লেগে, ওগুলো সতেজ হয়ে ওঠে। মনে হয় এখনই যেন শামীমের মধুর স্পর্শ ওর সারা শরীরে মেখে দিয়ে শান্ত দীঘিতে হঠাত্ অশান্ত তরঙ্গ উঠিয়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে নিবৃত্ত করে। চঞ্চল-চপলা দুষ্টু কিশোরীর মতো তার নিজের শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছে। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে সে একান্ত আপন করে কাছে পেয়েছে ৪০/৪৫ দিনের বেশি হবে না। সে কারণেই তার হৃদয় ও মন বড়ই অস্থির, অশান্ত। কিন্তু বাইরে তার কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই। অপরূপ সুন্দরী সালমা তার মায়াবী মুখমণ্ডলে এমনি একটা স্নিগ্ধতা মিশিয়ে রাখে যেন মনে হবে ও কিছুই বোঝে না। হঠাত্ গগন কাঁপিয়ে একটি উড়োজাহাজ সাঁই করে উড়ে গেল। উড়োজাহাজের সঙ্গে সঙ্গে শেখরও ছুটে আসে, ‘দ্যাখো মা, ওই যে উড়োজাহাজ যাচ্ছে। আমরা ওই জাহাজে করেই বাবার কাছে যাব। কী মজা হবে।’
আনন্দ-উত্তেজনায় বুঝতেই পারে না যে তার দাদী এসে দাঁড়িয়েছে খুব নিকটে—‘কি রে কবে তোর বাবার কাছে যাবি এই খুশিতে অহন থাইক্কাই লাফাইতাছ। তগোতো মজাই হবে। গিয়া তর বাপেরে কইস আমাগোও যেন বিদেশে লইয়া যায়। আমরা নাইলে চলমু কেমনে।’ —‘এই যে বউমা, তোমার দশাও দেখতাছি শেখরের মতো হইছে। হাতে-পায়ে মেন্দি দিয়া বইয়া রইলা ক্যা। সকালের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে হইব না? নাকি শুধু মা-ব্যাটা মিল্লা খুশিতে লাফাইলেই চলব?’ শাশুড়ি সালমার পাশে বসে গলার স্বর নরম-মোলায়েম করে বউয়ের মাথায় একটি হাত রেখে বলল,—‘না যাও আমার নাতিরে ভালো কইরা এরোপ্লেন দেখাইও। ওর এরোপ্লেনে চড়তে খুব বেশি শখ। ছোটবেলা থাইক্কা হেই ২ বছর বয়স যখন, প্লেন উইড়া গেলেই সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইত আর খট খট কইরা হাসত। তোমার মনে নাই বউমা। হেইলইগ্গাই কই ওরে ঘুরাইয়া-ঘুরাইয়া ভালো কইরা উড়োজাহাজের ঘরগুলান দেখাইও।
—‘আচ্ছা আম্মা আপনে চিন্তা করবেন না। আমার সব মনে আছে।’
প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় দুইবার ফোন করে শামীম, আজ সকালে আর ফোন এলো না। ভীষণ অভিমান হয় সরলা-সুন্দরী স্বামী সোহাগী এই রমণীর। ও জানে ফোন না পেলে আমার জগত্ বিষাদময় হয়ে যায়, তারপরও ব্যস্ততা দেখাল। আগে গিয়ে নেই তারপর দেখব কী এতো ব্যস্ততা। মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকেই কষ্ট দেয় সবচেয়ে বেশি। অথবা যে বেশি ভালোবাসা দেয়, সংসারে তাকেই বঞ্চিত করে সবচেয়ে বেশি। তারপরও সর্বাঙ্গে তার সোহাগ মাখার প্রত্যাশার পুলক হৃদয় ছেড়ে যায় না। সারাদিন কাজের মাঝে ডুবে থেকে সন্ধ্যার ফোনের অপেক্ষা করে। অবশেষে ফোন এলো নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে একটু পরে। সে কষ্ট পুষিয়ে দিয়েছে শামীম হাজার মাইল দূর থেকে মধুর ভালোবাসা আর আদরে ভরে দিয়েছে সালমাকে। হাওয়ার তরঙ্গ থেকে নয়, বাস্তবে ওই রক্ত-মাংসের মানুষটিকে স্পর্শ করার তীব্র বাসনা জাগে তার।
শামীমের দীর্ঘদিনের মালিকটি হঠাত্ মারা গেল। সংসারে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। ভদ্রলোকের তিন স্ত্রী আর সন্তানাদি সহায়-সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়েও কাড়াকাড়ি করে। নেই প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, বেতনভাতার ধারাবাহিকতা। দীর্ঘ পাঁচটি বছর ধরে আবরার নামক এ শিল্পপতির ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে নিয়োজিত আছে। মালিকই বলেছিলেন, সুযোগ-সুবিধাও সব করে দিয়েছেন যে, তোমার বউ-ছেলেকে এ দেশে নিয়া আস। নারীঘটিত ত্রুটি ছাড়া আর সবদিক দিয়েই ভালো ছিল মালিকটা। সমস্যা হয়েছে, তিন নম্বর স্ত্রীকে বিয়ে করেছে মাত্র ২ বছর হলো। বিয়ের দিন থেকে মালিকের তৃতীয় স্ত্রীর দৃষ্টি পড়ে ছিল বাংলাদেশী ছেলে শামীমের প্রতি। এ বিষয়টিতে সে খুবই অস্বস্তির মধ্যে থাকত। সে সব সময় চাইত নতুন স্ত্রী লায়লাকে এড়িয়ে চলতে, কিন্তু সম্ভব হতো না। চাকরি করলে মালিকের সোহাগী স্ত্রীর অন্যায়-আবদার তাকে মেটাতেই হবে। এবার যখন স্বয়ং গৃহকর্তাই পরপারে চলে গেছেন, এখন আর লায়লাকে কিছুতেই দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে সঙ্গে আবরার প্রথম দুই স্ত্রীও শামীমের প্রতি নিষিদ্ধ দৃষ্টি বিদ্ধ করেছে।
এক পুরুষের প্রতি তিন বিধবার যৌন লালসায় অস্থির ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে শামীম। এদিকে সালমা ও শেখর অপেক্ষায় আছে এ মাসের শেষে তার কাছে এসে সুখের ঘর সাজাবে। সবই ঠিক ছিল, শুধু মধ্যখান থেকে বৃদ্ধ মালিকটার প্রাণ বিয়োগই সব লালিত স্বপ্নের অবসান ঘটাল। তার এত দুরবস্থার কথা নিজ দেশে অপেক্ষমাণ স্ত্রী-পুত্রকে জানাতে তার মোটেই ইচ্ছা হয় না। বিশেষত সে তার স্ত্রী-সন্তানকে খুবই ভালোবাসে। হাজার মাইল দূরে অবস্থিত তার ছোট ছেলেটি যে এরোপ্লেনে ওঠার স্বপ্নে বিভোর, এ কথাও তার জানা। মৃত আবরারের প্রথম স্ত্রী শপিংমলে কোনোকিছু কেনার নাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কফি হাউজে, মেঝ গিন্নি বিয়ে বাড়িতে নেয়ার জন্য বায়না ধরে। আর লায়লা অপেক্ষা করে বাসাটি কখন নিরিবিলি হবে। কখন শামীমকে হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়া যাবে, নিজের ইচ্ছা পূরণের নিমিত্তে।
—‘শামীম চল বাইরে যাব’—বলল লায়লা।
—‘কোথায় যাব ম্যাডাম?’
—‘গাড়িতে ওঠো বলছি,’ বলেই গাড়ির পেছনের সিটের নির্ধারিত স্থানে বসে পড়ল লায়লা। গাড়িটি যখন চলা শুরু করল লায়লা বলল, ‘গিরাম পাহাড়ের কাছে যাও।’
সময় তখন মধ্যাহ্ন, চমকে উঠল শামীম, সে তো অনেক দূর, যেতে যেতেই রাত হয়ে যাবে, ফিরে আসতে অনেক রাত। একথা বলার পর লায়লা বলে, সে তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি তোমাকে যা বলেছি তাই কর। ভয়ে গা ছমছম করছে শামীমের, গিরাম পাহাড়ের পাদদেশ হচ্ছে জনমানবশূন্য একটি স্থান। অনৈতিক কাজ করার জন্য অনেকেই ওই স্থানটিকে বেছে নেয়। আবছা আলোয় গাড়ি থেকে নেমে লায়লা শামীমকে ইশারা করে ডাকল নিজের পাশে বসার জন্য। শামীম বসল তার পাশে। ভয়ে বুকের ভেতরটা দুরু দুরু কাঁপছে। যেদিকে তাকায় শুধু ধুলোর পাহাড় আর বিস্তীর্ণ বালুর প্রান্তর। লায়লা আরও একটু সরে এসে শামীমের গা-ঘেঁষে বসল। একহাত পেছনের দিক দিয়ে সজোরে চাপ দিচ্ছে নিজের কাছে নেয়ার জন্য। শামীম কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল। হঠাত্ তার শরীর আবৃত করা উপরের আবরণটি পুরোপুরি অনাবৃত করে ফেলে, ভেতরে খুবই সামান্য কিছু দিয়ে স্পর্শকাতর স্থানগুলো হাল্কাভাবে ঢাকা।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই শামীমকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বালির আস্তরে শুইয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। অনাবৃত দু’টি শরীরে হঠাত্ গাড়ির সার্চলাইটের আলোয় ঝলকিত হয়ে ওঠে এলাকা। গাড়ি থেকে নেমে আসে মালিকের বড় ছেলে। সেও গোপনীয় উদ্দেশ্য নিয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ফিলিপিনো সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে দৈহিক সুধা ভোগ করার বাসনায় এই নিরিবিলি স্থানে এসেছে। গাড়িতে বসা ফিলিপিনো নারী আর মালিক পুত্রের সামনে মাথা নত অবস্থায় লায়লা ও শামীম। আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো শামীম ও লায়লাকে। অবশেষে লায়লা নিজেকে রক্ষা করতে বলল, জোর করে শামীম তাকে ওই জনমানবশূন্য নিরিবিলি পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে তার শ্লীলতাহরণ করেছে। অবশেষে জেনা করার অপরাধে অ্যারাবিয়ান আইন অনুসারে এক শুক্রবার দেখে তার গর্দান কেটে নিল নিষ্ঠুর জল্লাদ। জল্লাদের এক কোপে তার দেহ থেকে শির বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঝেতে পড়ল রক্তাক্ত অবস্থায় কিছুক্ষণ কেঁপে কেঁপে চিরদিনের মতো অসাড় হয়ে গেল, শির ও দেহ।
মৃত্যুর আগে সে মালিক পুত্রের কাছে আবেদন করেছিল, তার লাশ যেন গ্রামে তার পরিবার-পরিজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যুর পর অন্তত নিজ দেশের মাটিতে পবিত্রতার সঙ্গে যেন একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারে। মৃত্যুর কারণ জানতে পারলে হয়তো সালমা তাকে ঘৃণা করবে, অভিশাপ দেবে। কিন্তু বিধাতা তো জানে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। যে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ ছিল না। সে নিজেও অন্তত টেলিফোনের মাধ্যমে সত্যি বিষয়টি সালমাকে জানাতে পারত। কিন্তু সাহস হয়নি। কারণ, অত দূর থেকে এমন একটি জটিল বিষয়ের খুঁটিনাটি বোঝানো সম্ভব ছিল না। আর ঘটনাগুলো এতটাই দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এটা বুঝতে পেরেছিল যে, স্ত্রী-পুত্র ও পরিবার-পরিজনদের দৈনন্দিন জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার জন্য সাত-সমুদ্র পার হয়ে যে নিষ্ঠুর দানবদের দেশে সে গেছে, তাদের কঠোর আইনের বলি হওয়া থেকে তার পরিত্রাণ নেই।
মাস শেষ হওয়ার দু’দিন আগে হঠাত্ সন্ধ্যায় একটি ফোন আসে সালমার কাছে। বলা হয়, আগামীকাল সন্ধ্যায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসার জন্য। তাকে একটি কফিন গ্রহণ করতে হবে। ছেলে শেখরকে সালমা কিছুই বলল না। ঢাকা এসেই দেখল, মা-দাদী-দাদা সবাই একটি নির্দিষ্ট এরোপ্লেনের অপেক্ষায় আছে। এয়ারপোর্টে আসার পর মূল ঘটনাটি জানার পর সালমা ও তার শাশুড়ি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। শোকে মুহ্যমান হয়ে দিশাহীন হয়ে পড়েন দু’জনেই। অগত্যা শামীমের হতভাগ্য পিতা সন্তানের লাশের গ্রহীতা হন।
সূত্র: আমার দেশ

পুঁথিসম্রাট আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ || মাহমুদুল বাসার

আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের মৃত্যুদিন ৩০ সেপ্টেম্বর। ১৯৫৩ সালের এই দিনে তিনি ১০টা ৪৭ মিনিটে ইন্তেকাল করেন। লিখতে বসেছিলেন ‘চট্টগ্রামের অজানা কাহিনী’। লিখতে বসে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। বাংলাদেশেই শুধু নয়, ভারত উপমহাদেশের জ্ঞানসাধকদের মধ্যে তিনি একজন। তাঁর নাম ড. সুনীতি কুমার, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর নামের সঙ্গে কৃতী গবেষক হিসেবে শ্রদ্ধার সঙ্গে উচ্চারিত হয়। গবেষকরা বলেন, মৃত্যুর পরে ড. দীনেশচন্দ্রের ডান হাতের আঙুলে কালির দাগ পাওয়া গেছে। আর সাহিত্যবিশারদ লিখতে বসে মৃত্যুর নীরবতায় শয়ন করেন। তার হাতেও কালির দাগ ছিল।
আজীবন দরিদ্র ছিলেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ। সামান্য কেরানিগিরি করতেন। স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বও পালন করেছেন। তত্কালীন সময়ের প্রেক্ষাপটে ম্যাট্রিক পাস অবশ্য কম কথা নয়। কিন্তু দারিদ্র্যের কারণেই আর অগ্রসর হতে পারেননি একাডেমিক শিক্ষায়। তার পরও স্বীয় সাধনার বলে, নিষ্ঠার জোরে বাঙালির শ্রেষ্ঠ সাংস্কৃতিক মনীষীদের কাতারে তাঁর নাম স্থান পেয়েছে।
তিনি যে কাজটি করে খ্যাতির শিখরে আরোহণ করেছিলেন, তা ছিল নিদারুণ কষ্টসাধ্য, এমনকি ব্যয়সাপেক্ষও। এর সঙ্গে প্রতিভা ও মেধার প্রশ্নও জড়িত ছিল, আর ছিল মাতৃভাষার প্রতি গভীর গাঢ় ভালোবাসা। তিনি প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের হাতেলেখা পাণ্ডুলিপি, যাকে বলে পুঁথি, তার আবিষ্কারক। নিজ খরচে, অদম্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে পল্লীগ্রামে ঘুরে ঘুরে অনুসন্ধান করে করে অবহেলায় পড়ে থাকা পুঁথি উদ্ধার করেছেন। সেখানেই ক্ষান্ত হননি, পুঁথির হস্তলিপি পর্বে বিশেষজ্ঞ হয়েছেন, তার সম্পাদনা করেছেন, তার পর ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ’ পত্রিকায় তা পাঠাতেন। সসম্মানে ছাপা হতো।
একথা ভাবতে বিস্ময় লাগে যে, সুরেশচন্দ্র সমাজপতির মতো বিদগ্ধ পত্রিকা সম্পাদকের ‘সাহিত্য’ পত্রিকায় সাহিত্যবিশারদের প্রবন্ধ ছাপা হতো।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ উনিশ-বিশ শতকের রেনেসাঁর মানসপুত্রদের একজন। তার সময়ে খাঁটি বাঙালির সংখ্যা কমই ছিল। ইচ্ছায় হোক, অনিচ্ছায় হোক, তাঁর সময়ে উপমহাদেশের রাজনীতি ও সংস্কৃতি সাম্প্রদায়িক চেতনায় কণ্টকিত হয়েছিল। কিন্তু আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে ওই পঙ্কিল স্রোত কলুষিত করতে পারেনি। তাই দেখি যে, তিনি পুঁথি অনুসন্ধানে নেমে জাত-পাত মানেননি। হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সৃজনশীল কবিদের পুঁথি উদ্ধারে ব্রতী হয়েছেন।
মানতেই হবে, সাহিত্যবিশারদের আগে যারা পুঁথি উদ্ধারে নেমেছিলেন তারা খণ্ডিত মনোভাবে সীমাবদ্ধ ছিলেন। তাই বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সাহিত্যবিশারদ প্রথম পূর্ণাঙ্গ, আদর্শবান পুঁথির আবিষ্কারক।
এ কারণে একটি পুঁথি আবিষ্কার করে, তা সুসম্পাদনা করে, টীকাটিপ্পনীসহ সর্বশ্রেষ্ঠ পত্রিকায় পাঠানো মাত্র ছাপা হতো। শুধু তাই নয়, উভয় সম্প্রদায়ের মনীষীদের প্রশংসা পেতেন। তাঁর লেখা পাওয়ার জন্য তারা সাগ্রহে অপেক্ষা করতেন।
এ কথা পরিষ্কার বলা দরকার, সাহিত্যবিশারদ কেবল পুঁথি সংগ্রাহক ছিলেন না, সৃজনশীল, চিন্তাশীল লেখকও ছিলেন। অসংখ্য প্রবন্ধ লিখেছেন বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ, পরিচিত, অপরিচিত সবগুলো পত্রিকায়। তাঁর লেখা যুক্তিপূর্ণ, তথ্যবহুল। তাঁর মানস আধুনিক, অগ্রসর ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তার দ্বারা পরিপুষ্ট। বাঙালির সেক্যুলার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠায় তিনি একজন পথিকৃত্।
সাহিত্যবিশারদকে শ্রদ্ধা করতেন, ভালোবাসতেন স্যার আশুতোষ মুখার্জী, ড. দীনেশচন্দ্র সেন, ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, সুরেশচন্দ্র সমাজপতি, ব্যোমকেশ মুস্তফী এবং জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সৈয়দ এমদাদ আলী প্রমুখ।
তিনি ছিলেন বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সম্মানিত সদস্য। একসময় তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সহসভাপতিও হয়েছিলেন। এই প্রতিষ্ঠানের উন্নতির জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন। কবি নবীনচন্দ্র সেন তাঁকে ভালোবেসে একটি চাকরি দিয়েছিলেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ভালোবেসে তাঁকে প্রবেশিকা ও এফএ পরীক্ষার পরীক্ষক হিসেবে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি বিএ ক্লাসের বাংলা বিষয়ের পরীক্ষার খাতা দেখতেন।
সাহিত্যবিশারদ প্রায় সব পত্রিকা পড়তেন, তা সংগ্রহ করতেন, তাতে লিখতেন। তিনি পত্রিকা সম্পাদনাও করতেন। সম্পাদনা করেছেন ‘নবনূর’, ‘কোহিনূর’, ‘সওগাত,’ ‘পূজারী’ ও ‘সাধনা’ পত্রিকা।
তিনি তাঁর বাড়িতে তাঁর পিতামহ কর্তৃক সংগৃহীত কিছু পুঁথির সঙ্গে পরিচিত হন। এই পুঁথিগুলো পড়ে তিনি পুঁথি সংগ্রহে ও এ নিয়ে লিখতে আগ্রহী হন। এ পুঁথিগুলোর মধ্যেই পেয়ে যান ‘চণ্ডীদাসের পদাবলী’। সেসময় তিনি ছিলেন এফএ ক্লাসের ছাত্র। এ সময় তিনি আচার্য অক্ষয় সরকার সম্পাদিত ‘পূর্ণিমা’ পত্রিকায় ‘প্রাচীন পদাবলী’ নামে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এই প্রবন্ধ পাঠ করেই মহাকবি নবীন চন্দ্রসেন সাহিত্যবিশারদের প্রতি আকৃষ্ট হন।
তিনি যখন কলেজে পড়েন, তখন নলিনী কান্ত সেন ‘আলো’ নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সাহিত্যবিশারদ এ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। এ পত্রিকায় তিনি ‘আলাওল গ্রন্থাবলীর কালনির্ণয়’ নামে একটি তথ্যবহুল প্রবন্ধ লেখেন। এ প্রবন্ধ পড়ে একজন বিদ্বান মন্তব্য করেন, ‘কালে এই বালক যশস্বী লেখক হইতে পারিবে।’ (আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিবেদিত প্রবন্ধ সংকলন, বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪, পৃ. ১২৮)।
হ্যাঁ, যশস্বী হয়েছিলেন। বিদ্বত্সমাজ তাকে সাহিত্যবিশারদ উপাধি দিয়েছিলেন। সাহিত্য সাগর উপাধিও পেয়েছিলেন। বাঙালি সমাজে বিদ্যাসাগর বলতে যেমন ঈশ্বরচন্দ্রকে বোঝায়, তেমনি সাহিত্যবিশারদ বলতে আবদুল করিমকেই বোঝায়। আমরা কিন্তু মাইকেল, বিদ্যাসাগর, সাহিত্যবিশারদ বলতেই ভালোবাসি।
একজন গবেষকের লেখা থেকে জানা যায়, তিনি যখন নবম শ্রেণীর ছাত্র, তখন কলকাতা থেকে দুর্গাদাস লাহিড়ী সম্পাদিত পাক্ষিক ‘অনুসন্ধান’ পত্রিকা তাঁর হাতে আসে। এই পত্রিকা পড়ে প্রাচীন ও মধ্যযুগের সাহিত্য সংগ্রহে অনুপ্রাণিত হন।
চণ্ডীদাসের পদাবলী পড়ে, গ্রামের বাড়িতে বাড়িতে পুঁথি পাঠ শুনে, পূর্বপুরুষের সংগৃহীত পুঁথি পাঠ করে সাহিত্যবিশারদ মাতৃভাষার প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন।
সাহিত্যবিশারদ সম্পাদিত প্রথম বই ‘রাধিকার মান ভঙ্গ’। এই বইয়ের ভূমিকা লেখেন ড. হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বলেন, “শ্রী আবদুল করিম চট্টগ্রামের একটি বাঙ্গালা বিদ্যালয়ের পণ্ডিত। তাহার অবস্থা ভাল নহে। তথাপি তিনি সাহিত্যসেবায় অকাতরে পরিশ্রম করিয়া থাকেন। বাঙ্গালা সহিত্যের প্রতি তাহার অনুরাগের প্রশংসা না করিয়া থাকা যায় না। তিনি এই দুর্লভ গ্রন্থের সম্পাদনা কার্যে যেরূপ পরিশ্রম, যেরূপ কৌশল, যেরূপ সহায়তা ও যেরূপ সূক্ষ্মদর্শিতা প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা সমস্ত বাঙ্গালায় কেন—সমস্ত ভারতেও বোধ হয় সচরাচর মিলে না। এক একবার মনে হয় যেন কোন ‘জার্মান এডিটর’ এই গ্রন্থ সম্পাদনা করিয়াছেন।” (ঐ-পৃ. ১৬)
‘ইসলামাবাদ’ সাহিত্যবিশারদের একটি মৌলিক গ্রন্থ। চট্টগ্রামকেই তিনি ইসলামাবাদ বলেছেন। কারণ, প্রাচীন ও মধ্যযুগে আউলিয়া, পীর, বুজর্গানেরা চট্টগ্রামে এসে, সেখান থেকে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। উল্লিখিত গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন তিনি, “আমাদের এই দেশ ধর্মজগতে একটা পরম শ্লাঘ্য স্থান অধিকার করিবার দাবি করিয়া আছে। পৃথিবীর চারিটি মহাধর্ম শক্তি আসিয়া এখানে সম্মিলিত হইয়াছে। ইহা হিন্দু, মুসলমান ও বৌদ্ধ—এই তিন মহাজাতিরই একটা পরম পবিত্র তীর্থরূপে পরিগণিত।... হিন্দুর হিন্দুত্ব ও মুসলমানের মুসলমানত্ব একমাত্র এই দেশেই আজও সম্পূর্ণ বজায় আছে। এক গ্রামে পাশাপাশি বাড়িতে বাস করিয়া এক পুকুরের জল খাইয়া আমরা হিন্দু-মুসলমান দুইটি জাতি স্মরণাতীত কাল হইতেই স্ব-স্ব ধর্মের স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করিয়া পরম প্রীতিতে চলিয়া আসিতেছি, জাতি-ধর্ম লইয়া এ পর্যন্ত আমাদের দেশে কোনোদিন একটা টুঁ শব্দ পর্যন্তও হয় নাই, ইহা আমাদের চট্টগ্রামের একটা বিশিষ্ট গুণ।” (ঐ-পৃ. ২০)
তার অসাম্প্রদায়িক-উদার মানসের পরিচয় এ উদ্ধৃতিতে বিদ্যমান।
১৯৩৯ সালে সাহিত্য বিশারদ কলকাতা বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সম্মেলনে মূল সভাপতির ভাষণে বলেন, “সাহিত্যে জাতি-ধর্মের গণ্ডী আমি কখনও স্বীকার করি নাই, এখনও স্বীকার করি না, কিন্তু ইহার বৈচিত্র্য স্বীকার করি। সাহিত্য হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান যে জাতিরই হউক, ইহা সাহিত্য পদবাচ্য হইলেই সর্বজনীন হইয়া থাকে। ...মুসলমানের সাহিত্য সর্বজনীন সাহিত্যিক সৌন্দর্য্যের বিচিত্র ভঙ্গীর একদিক মাত্র। হিন্দুর সাহিত্যও তদ্রূপ একদিক। এই জন্যই আধুনিক বঙ্গের সাহিত্যিক জাগরণকে আমি ভীতির চক্ষে দেখি না, বরং প্রীতির নয়নেই নিরীক্ষণ করিয়া থাকি। কারণ অখণ্ড বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রতি আমার শ্রদ্ধা সুগভীর এবং পরিচয় প্রাচীন।” (ঐ-পৃ. ৩৩)
আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ কি কেবল মধ্যযুগের পুঁথিই মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করেছিলেন? অবশ্য পুঁথিগুলো অজানা অন্ধকার থেকে আলোতে বের করে না আনলে বাংলা সাহিত্য থাকত আধখানা চাঁদের মতো অসম্পূর্ণ। কিন্তু তিনি মূলত পুরো বাঙালি জাতির মননের ইতিহাস পুনরুদ্ধার করেছেন। আবিষ্কৃত উদ্ধারকৃত পুঁথিগুলোতে যেহেতু ইংরেজের কূটপ্রভাব স্পর্শ করেনি, সেহেতু সেসবে আছে ধর্মনিরপেক্ষতার সজীবতা, হিন্দু-মুসলিম মিলনের কথা।
জীবনসায়াহ্নে মানুষ হয় প্রতিক্রিয়াশীল। সাহিত্যবিশারদ হয়েছিলেন প্রগতিশীল। তাঁর সায়াহ্নকালীন অভিভাষণগুলো বিচ্ছিন্নতা, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডূকতাবিরোধী খরদীপ্ত উচ্চারণে বলিষ্ঠ। এজন্যই তিনি মনীষী, মহাপুরুষ।
সাম্প্রদায়িক চিন্তা তো অনাধুনিক চিন্তা। আর অনাধুনিক চিন্তা দিয়ে সাহিত্য বিশারদ এবং ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতো মনীষী হওয়া যায় না।
সূত্র : আমার দেশ

দাঁড়ের কবিতা || সুকুমার রায়

চুপ কর্, শোন, শোন, বেয়াকুল হোস্‌নে-
ঠেকে গেছি বাপ্‌রে কি ভয়ানক প্রশ্নে!
ভেবে ভেবে লিখে লিখে বসে বসে দাঁড়েতে
ঝিম্‌ঝিম্ টন্‌টন্ ব্যথা করে হাড়েতে।
এক ছিল দাঁড়িমাঝি- দাড়ি তার মস্ত,
দাড়ি দিয়ে দাঁড়ি তার দাঁড়ে খালি ঘষ্‌ত‌‌।
সেই দাঁড়ে একদিন দাঁড়কাক দাঁড়াল,
কাঁকড়ার দাঁড়া দিয়ে দাঁড়ি তারে তাড়াল।
কাক বলে রেগেমেগে, "বাড়াবাড়ি ঐ ত!
না দাঁড়াই দাঁড়ে তবু দাঁড়কাক হই ত?
ভারি তোর দাঁড়িগিরি শোন বলি তবে রে-
দাঁড় বিনা তুই ব্যাটা দাঁড়ি হোস কবে রে?
পাখা হলে পাখি হয় ব্যাকরণ বিশেষে-
কাঁকড়ার দাঁড় আছে, দাঁড়ি নয় কিসে সে?
দ্বারে বসে দারোয়ান, তারে যদি দ্বারী কয়,
দাঁড়ে-বসা যত পাখি সব তবে দাঁড়ি হয়!
দূর দূর! ছাই দাঁড়ি! দাড়ি নিয়ে পাড়ি দে!"
দাঁড়ি বলে, "ব্যাস্ ব্যাস্! ঐখেনে দাঁড়ি দে!"

আবোল তাবোল || সুকুমার রায়

মেঘ মুলুকে ঝাপ‌্সা রাতে,
রামধনুকের আব্ছায়াতে,
তাল বেতালে খেয়াল সুরে,
তান ধরেছি কন্ঠ পুরে।
হেথায় নিষেধ নাইরে দাদা,
নাইরে বাঁধন নাইরে বাধা।
হেথায় রঙিন্ আকাশতলে
স্বপন দোলা হাওয়ায় দোলে,
সুরের নেশায় ঝরনা ছোটে,
আকাশ কুসুম আপনি ফোটে,
রঙিয়ে আকাশ, রঙিয়ে মন
চমক জাগে ক্ষণে ক্ষণ।
আজকে দাদা যাবার আগে
বল্‌ব যা মোর চিত্তে লাগে-
নাই বা তাহার অর্থ হোক্
নাইবা বুঝুক বেবাক্ লোক।
আপনাকে আজ আপন হতে
ভাসিয়ে দিলাম খেয়াল স্রোতে।
ছুট‌লে কথা থামায় কে?
আজকে ঠেকায় আমায় কে?
আজকে আমার মনের মাঝে
ধাঁই ধপাধপ তব্‌লা বাজে-
রাম-খটাখট ঘ্যাচাং ঘ্যাঁচ্
কথায় কাটে কথায় প্যাঁচ্ ।
আলোয় ঢাকা অন্ধকার,
ঘন্টা বাজে গন্ধে তার।
গোপন প্রাণে স্বপন দূত,
মঞ্চে নাচেন পঞ্চ ভুত!
হ্যাংলা হাতী চ্যাং দোলা,
শূন্যে তাদের ঠ্যাং তোলা!
মক্ষিরাণী পক্ষীরাজ-
দস্যি ছেলে লক্ষ্মী আজ!
আদিম কালের চাঁদিম হিম
তোড়ায় বাঁধা ঘোড়ার ডিম।
ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর,
গানের পালা সাঙ্গ মোর।

তারাপ্রসন্নের কীর্তি || রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

লেখকজাতির প্রকৃতি অনুসারে তারাপ্রসন্ন কিছু লাজুক এবং মুখচোরা ছিলেন। লোকের কাছে বাহির হইতে গেলে তাঁহার সর্বনাশ উপস্থিত হইত। ঘরে বসিয়া কলম চালাইয়া তাঁহার দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ, পিঠ একটু কুঁজা, সংসারের অভিজ্ঞতা অতি অল্প। লৌকিকতার বাঁধি বোল-সকল সহজে তাঁহার মুখে আসিত না, এইজন্য গৃহদুর্গের বাহিরে তিনি আপনাকে কিছুতেই নিরাপদ মনে করিতেন না।
লোকেও তাঁহাকে একটা উজবুক-রকমের মনে করিত, এবং লোকেরও দোষ দেওয়া যায় না। মনে করো, প্রথম পরিচয়ে একটি পরম ভদ্রলোক উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে তারাপ্রসন্নকে বলিলেন, "মহাশয়ের সহিত সাক্ষাৎ হয়ে যে কী পর্যন্ত আনন্দ লাভ করা গেল তা একমুখে বলতে পারি নে" -তারাপ্রসন্ন নিরুত্তর হইয়া নিজের দক্ষিণ করতল বিশেষ মনোযোগপূর্বক নিরীণ করিতে লাগিলেন। হঠাৎ সে নীরবতার অর্থ এইরূপ মনে হয়, "তা তোমার আনন্দ হয়েছে সেটা খুব সম্ভব বটে, কিন্তু আমার যে আনন্দ হয়েছে এমন মিথ্যা কথাটা কী করে মুখে উচ্চারণ করব তাই ভাবছি।"
মধ্যাহ্নভোজে নিমন্ত্রণ করিয়া লক্ষপতি গৃহস্বামী যখন সায়াহ্নের প্রাক্কালে পরিবেশন করিতে আরম্ভ করেন এবং মধ্যে মধ্যে বিনীত কাকুতি-সহকারে ভোজ্যসামগ্রীর অকিঞ্চিৎকরত্ব সম্বন্ধে তারাপ্রসন্নকে সম্বোধনপূর্বক বলিতে থাকেন "এ কিছুই না। অতি যৎসামান্য। দরিদ্রের খুদকুঁড়া, বিদুরের আয়োজন। মহাশয়কে কেবলই কষ্ট দেওয়া"- তারাপ্রসন্ন চুপ করিয়া থাকেন, যেন কথাটা এমনই প্রামাণিক যে তাহার আর উত্তর সম্ভবে না।
মধ্যে মধ্যে এমনও হয়, কোনো সুশীল ব্যক্তি যখন তারাপ্রসন্নকে সংবাদ দেন যে, তাঁহার মতো অগাধ পাণ্ডিত্য বর্তমানকালে দুর্লভ এবং সরস্বতী নিজের পদ্মাসন পরিত্যাগপূর্বক তারাপ্রসন্নের কণ্ঠাগ্রে বাসস্থান গ্রহণ করিয়াছেন, তখন তারাপ্রসন্ন তাহার তিলমাত্র প্রতিবাদ করেন না, যেন সত্যসত্যই সরস্বতী তাঁহার কণ্ঠরোধ করিয়া বসিয়া আছেন। তারাপ্রসন্নের এইটে জানা উচিত যে, মুখের সামনে যাহারা প্রশংসা করে এবং পরের কাছে যাহারা আত্মনিন্দায় প্রবৃত্ত হয়, তাহারা অন্যের নিকট হইতে প্রতিবাদ প্রত্যাশা করিয়াই অনেকটা অসংকোচে অত্যুক্তি করিয়া থাকে-অপর প আগাগোড়া সমস্ত কথাটা যদি অম্লানবদনে গ্রহণ করে, তবে বক্তা আপনাকে প্রতারিত জ্ঞান করিয়া বিষম ক্ষুব্ধ হয়। এইরূপ স্থলে লোকে নিজের কথা মিথ্যা প্রতিপন্ন হইলে দুঃখিত হয় না।
ঘরের লোকের কাছে তারাপ্রসন্নের ভাব অন্যরূপ ; এমন-কি, তাঁহার নিজের স্ত্রী দাক্ষায়ণীও তাঁহার সহিত কথায় আঁটিয়া উঠিতে পারেন না। গৃহিণী কথায় কথায় বলেন, "নেও নেও, আমি হার মানলুম। আমার এখন অন্য কাজ আছে।" বাগ্‌যুদ্ধে স্ত্রীকে আত্মমুখে পরাজয় স্বীকার করাইতে পারে, এমন ক্ষমতা এবং এমন সৌভাগ্য কয়জন স্বামীর আছে।
তারাপ্রসন্নের দিন বেশ কাটিয়া যাইতেছে। দাক্ষায়ণীর দৃঢ় বিশ্বাস, বিদ্যাবুদ্ধি-ক্ষমতায় তাঁহার স্বামীর সমতুল্য কেহ নাই এবং সে কথা তিনি প্রকাশ করিয়া বলিতেও কুণ্ঠিত হইতেন না ; শুনিয়া তারাপ্রসন্ন বলিতেন, "তোমার একটি বৈ স্বামী নাই, তুলনা কাহার সহিত করিবে।" শুনিয়া দাক্ষায়ণী ভারি রাগ করিতেন।
দাক্ষায়ণীর কেবল একটা এই মনস্তাপ ছিল যে, তাঁহার স্বামীর অসাধারণ ক্ষমতা বাহিরে প্রকাশ হয় না - স্বামীর সে সম্বন্ধে কিছুমাত্র চেষ্টা নাই। তারাপ্রসন্ন যাহা লিখিতেন তাহা ছাপাইতেন না।
অনুরোধ করিয়া দাক্ষায়ণী মাঝে মাঝে স্বামীর লেখা শুনিতেন, যতই না বুঝিতেন ততই আশ্চর্য হইয়া যাইতেন। তিনি কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, কবিকঙ্কণ-চণ্ডী পড়িয়াছেন এবং কথকতাও শুনিয়াছেন। সে-সমস্তই জলের মতো বুঝা যায়, এমন-কি নিরক্ষর লোকেও অনায়াসে বুঝিতে পারে, কিন্তু তাঁহার স্বামীর মতো এমন সম্পূর্ণ দুর্বোধ হইবার আশ্চর্য মতা তিনি ইতিপূর্বে কোথাও দেখেন নাই।
তিনি মনে মনে কল্পনা করিতেন, এই বই যখন ছাপানো হইবে এবং কেহ এক অর বুঝিতে পারিবে না, তখন দেশসুদ্ধ লোক বিস্ময়ে কিরূপ অভিভূত হইয়া যাইবে। সহস্রবার করিয়া স্বামীকে বলিতেন, "এ-সব লেখা ছাপাও।"
স্বামী বলিতেন, "বই ছাপানো সম্বন্ধে ভগবান মনু স্বয়ং বলে গেছেন: প্রবৃত্তিরেষা ভূতানাং নিবৃত্তিস্তু মহাফলা।"
তারাপ্রসন্নের চারিটি সন্তান, চারই কন্যা। দাক্ষায়ণী মনে করিতেন, সেটা গর্ভধারিণীরই অক্ষমতা। এইজন্য তিনি আপনাকে প্রতিভাসম্পন্ন স্বামীর অত্যন্ত অযোগ্য স্ত্রী মনে করিতেন। যে স্বামী কথায় কথায় এমন-সকল দুরূহ গ্রন্থ রচনা করেন তাঁহার স্ত্রীর গর্ভে কন্যা বৈ আর সন্তান হয় না, স্ত্রীর পক্ষে এমন অপটুতার পরিচয় আর কী দিব।
প্রথম কন্যাটি যখন পিতার বক্ষের কাছ পর্যন্ত বাড়িয়া উঠিল তখন তারাপ্রসন্নের নিশ্চিন্তভাব ঘুচিয়া গেল। তখন তাঁহার স্মরণ হইল, একে একে চারিটি কন্যারই বিবাহ দিতে হইবে এবং সেজন্য বিস্তর অর্থের প্রয়োজন। গৃহিণী অত্যন্ত নিশ্চিন্তমুখে বলিলেন, "তুমি যদি একবার একটুখানি মন দাও তাহা হইলে ভাবনা কিছুই নাই।"
তারাপ্রসন্ন কিঞ্চিৎ ব্যগ্রভাবে বলিলেন, "সত্য নাকি। আচ্ছা, বলো দেখি কী করিতে হইবে।"
দাক্ষায়ণী সংশয়শূন্য নিরুদ্বিগ্নভাবে বলিলেন, "কলিকাতায় চলো, তোমার বইগুলো ছাপাও, পাঁচজন লোকে তোমাকে জানুক - তার পরে দেখো দেখি, টাকা আপনি আসে কি না।"
স্ত্রীর আশ্বাসে তারাপ্রসন্নও ক্রমে আশ্বাস লাভ করিতে লাগিলেন। এবং মনে প্রত্যয় হইল, তিনি ইস্তক-নাগাদ বসিয়া বসিয়া যত লিখিয়াছেন তাহাতে পাড়াসুদ্ধ লোকের কন্যাদায় মোচন হইয়া যায়।
এখন কলিকাতায় যাইবার সময় ভারি গোল পড়িয়া গেল। দাক্ষায়ণী তাঁহার নিরুপায় নিঃসহায় সযত্ন পালিত স্বামীটিকে কিছুতেই একলা ছাড়িয়া দিতে পারেন না। তাঁহাকে খাওয়াইয়া পরাইয়া নিত্যনৈমিত্তিক কর্তব্য স্মরণ করাইয়া সংসারের বিবিধ উপদ্রব হইতে কে রক্ষা করিবে।
কিন্তু অনভিজ্ঞ স্বামীও অপরিচিত বিদেশে স্ত্রীকন্যা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে অত্যন্ত ভীত ও অসম্মত। অবশেষে দাক্ষায়ণী পাড়ার একটি চতুর লোককে স্বামীর নিত্য-অভ্যাস সম্বন্ধে সহস্র উপদেশ দিয়া আপনার পদে নিযুক্ত করিয়া দিলেন। এবং স্বামীকে অনেক মাথার দিব্য ও অনেক মাদুলি-তাগায় আচ্ছন্ন করিয়া বিদেশে রওনা করিয়া দিলেন। এবং ঘরে আছাড় খাইয়া কাঁদিতে লাগিলেন।
কলিকাতায় আসিয়া তারাপ্রসন্ন তাঁহার চতুর সঙ্গীর সাহায্যে "বেদান্তপ্রভাকর" প্রকাশ করিলেন। দাক্ষায়ণীর গহনা বন্ধক রাখিয়া যে টাকা ক'টি পাইয়াছিলেন তাহার অধিকাংশই খরচ হইয়া গেল।
বিক্রয়ের জন্য বহির দোকানে এবং সমালোচনার জন্য দেশের ছোটো-বড়ো সমস্ত সম্পাদকের নিকট "বেদান্তপ্রভাকর" পাঠাইয়া দিলেন। ডাকযোগে গৃহিণীকেও একখানা বই রেজেস্টারি করিয়া পাঠাইলেন। আশঙ্কা ছিল, পাছে ডাকওয়ালারা পথের মধ্য হইতে চুরি করিয়া লয়।
গৃহিণী যেদিন ছাপার বইয়ের উপরের পৃষ্ঠায় ছাপার অরে তাঁহার স্বামীর নাম দেখিলেন সেদিন পাড়ার সকল মেয়েকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইলেন। যেখানে সকলে আসিয়া বসিবার কথা সেইখানে বইটা ফেলিয়া রাখিলেন।
সকলে আসিয়া বসিলে উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, "ওমা, বইটা ওখানে কে ফেলে রেখেছে। অন্নদা, বইটা দাও-না ভাই, তুলে রাখি।" উহাদের মধ্যে অন্নদা পড়িতে জানে। বইটা কুলঙ্গির উপর তুলিয়া রাখিলেন।
মুহূর্ত পরে একটা জিনিস পাড়িতে গিয়া ফেলিয়া দিলেন- তার পরে নিজের বড়োমেয়েকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, "শশী, বাবার বই পড়তে ইচ্ছে হয়েছে বুঝি? তা নে-না মা, পড়্-না। তাতে লজ্জা কী।" বাবার বহির প্রতি শশীর কিছুমাত্র আগ্রহ ছিল না।
কিছুণ পরেই তাহাকে ভর্ৎসনা করিয়া বলিলেন, "ছি মা, বাবার বই অমন করে নষ্ট করতে নেই, তোমার কমলাদিদির হাতে দাও, উনি ঐ আলমারির মাথায় তুলে রাখবেন।"
বহির যদি কিছুমাত্র চেতনা থাকিত তাহা হইলে সেই একদিনের উৎপীড়নে বেদান্তের প্রাণান্তপরিচ্ছেদ হইত।
একে একে কাগজে সমালোচনা বাহির হইতে লাগিল। গৃহিণী যাহা ঠাহরাইয়াছিলেন তাহা অনেকটা সত্য হইয়া দাঁড়াইল। গ্রন্থের এক অক্ষর বুঝিতে না পারিয়া দেশসুদ্ধ সমালোচক একেবারে বিহ্বল হইয়া উঠিল। সকলেই একবাক্যে কহিল, "এমন সারবান গ্রন্থ ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয় নাই।"
যে-সকল সমালোচক রেনল্ড্স্-এর লন্ডন-রহস্যের বাংলা অনুবাদ ছাড়া আর-কোনো বই স্পর্শ করিতে পারে না তাহারা অত্যন্ত উৎসাহের সহিত লিখিল, "দেশের ঝুড়ি ঝুড়ি নাটক-নবেলের পরিবর্তে যদি এমন দুই-একখানি গ্রন্থ মধ্যে মধ্যে বাহির হয় তবে বঙ্গসাহিত্য বাস্তবিকই পাঠ্য হয়।"
যে ব্যক্তি পুরুষানুক্রমে বেদান্তের নাম কখনো শুনে নাই সেই কেবল লিখিল, "তারাপ্রসন্নবাবুর সহিত সকল স্থানে আমাদের মতের মিল হয় নাই- স্থানাভাববশত এ স্থলে তাহার উল্লেখ করিলাম না। কিন্তু মোটের উপরে গ্রন্থকারের সহিত আমাদের মতের অনেক ঐক্যই লতি হয়।" কথাটা যদি সত্য হইত তাহা হইলে মোটের উপর গ্রন্থখানি পুড়াইয়া ফেলা উচিত ছিল।
দেশের যেখানে যত লাইব্রেরি ছিল এবং ছিল না তাহার সম্পাদকগণ মুদ্রার পরিবর্তে মুদ্রাঙ্কিত পত্রে তারাপ্রসন্নের গ্রন্থ ভিক্ষা চাহিয়া পাঠাইলেন। অনেকেই লিখিল, "আপনার এই চিন্তাশীল গ্রন্থে দেশের একটি মহৎ অভাব দূর হইয়াছে।" চিন্তাশীল গ্রন্থ কাহাকে বলে, তারাপ্রসন্ন ঠিক বুঝিতে পারিলেন না, কিন্তু পুলকিতচিত্তে ঘর হইতে মাসুল দিয়া প্রত্যেক লাইব্রেরিতে "বেদান্তপ্রভাকর" পাঠাইয়া দিলেন।
এইরূপে অজস্র স্তুতিবাক্যে তারাপ্রসন্ন যখন অতিমাত্র উৎফুল্ল হইয়া উঠিয়াছেন, এমন সময়ে পত্র পাইলেন, দাক্ষায়ণীর পঞ্চমসন্তান-সম্ভাবনা অতি নিকটবর্তী হইয়াছে। তখন রক্ষকটিকে সঙ্গে করিয়া অর্থসংগ্রহের জন্য দোকানে গিয়া উপস্থিত হইলেন।
সকল দোকানদার একবাক্যে বলিল, একখানি বইও বিক্রয় হয় নাই। কেবল এক জায়গায় শুনিলেন, মফস্বল হইতে কে-একজন তাঁহার এক বই চাহিয়া পাঠাইয়াছিল এবং তাহাকে ভ্যালুপেবেলে পাঠানোও হইয়াছিল, কিন্তু বই ফেরত আসিয়াছে, কেহ গ্রহণ করে নাই। দোকানদারকে তাহার মাসুল দণ্ড দিতে হইয়াছে, সেইজন্য সে বিষম আক্রোশে গ্রন্থকারের সমস্ত বহি তখনই তাঁহাকে প্রত্যর্পণ করিতে উদ্যত হইল।
গ্রন্থকার বাসায় ফিরিয়া আসিয়া অনেক ভাবিলেন কিন্তু কিছুই বুঝিয়া উঠিতে পারিলেন না। তাঁহার চিন্তাশীল গ্রন্থ সম্বন্ধে যতই চিন্তা করিলেন ততই অধিকতর উদ্বিগ্ন হইয়া উঠিতে লাগিলেন। অবশেষে যে কয়েকটি টাকা অবশিষ্ট ছিল তাহাই অবলম্বন করিয়া অবিলম্বে গৃহাভিমুখে যাত্রা করিলেন।
তারাপ্রসন্ন গৃহিণীর নিকট আসিয়া অত্যন্ত আড়ম্বরের সহিত প্রফুল্লতা প্রকাশ করিলেন। দাক্ষায়ণী শুভ সংবাদের জন্য সহাস্যমুখে প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন।
তখন তারাপ্রসন্ন একখানি "গৌড়বার্তাবহ" আনিয়া গৃহিণীর ক্রোড়ে মেলিয়া দিলেন। পাঠ করিয়া তিনি মনে মনে সম্পাদকের অক্ষয় ধনপুত্র কামনা করিলেন, এবং তাঁহার লেখনীর মুখে মানসিক পুষ্পচন্দন-অর্ঘ্য উপহার দিলেন। পাঠ সমাপন করিয়া আবার স্বামীর মুখের দিকে চাহিলেন।
স্বামী তখন "নবপ্রভাত" আনিয়া খুলিয়া দিলেন। পাঠ করিয়া আনন্দবিহ্বলা দাক্ষায়ণী আবার স্বামীর মুখের প্রতি প্রত্যাশাপূর্ণ øস্নিগ্ধনেত্র উত্থাপিত করিলেন।
তখন তারাপ্রসন্ন একখণ্ড "যুগান্তর" বাহির করিলেন। তাহার পর? তাহার পর "ভারতভাগ্যচক্র"। তাহার পর? তাহার পর "শুভজাগরণ"। তাহার পর "অরুণালোক"। তাহার পর "সংবাদতরঙ্গভঙ্গ"। তাহার পর - আশা, আগমনী, উচ্ছ্বাস, পুষ্পমঞ্জরী, সহচরী, সীতাগেজেট, অহল্যালাইব্রেরি-প্রকাশিকা, ললিত-সমাচার, কোটাল, বিশ্ব-বিচারক, লাবণ্যলতিকা। হাসিতে হাসিতে গৃহিণীর আনন্দাশ্রু পড়িতে লাগিল।
চোখ মুছিয়া আর-একবার স্বামীর কীর্তিরশ্মিসমুজ্জ্বল মুখের দিকে চাহিলেন ; স্বামী বলিলেন, "এখনো অনেক কাগজ বাকি আছে।"
দাক্ষায়ণী বলিলেন, "সে বিকালে দেখিব, এখন অন্য খবর কী বলো।"
তারাপ্রসন্ন বলিলেন, "এবার কলিকাতায় গিয়া শুনিয়া আসিলাম, লাটসাহেবের মেম একখানা বই বাহির করিয়াছে কিন্তু তাহাতে বেদান্তপ্রভাকরের কোনো উল্লেখ করে নাই।"
দাক্ষায়ণী বলিলেন, "আহা, ও-সব কথা নয় - আর কী আনলে বলো-না।"
তারাপ্রসন্ন বলিলেন, "কতকগুলো চিঠি আছে।"
তখন দাক্ষায়ণী স্পষ্ট করিয়া বলিলেন, "টাকা কত আনলে।"
তারাপ্রসন্ন বলিলেন, "বিধুভূষণের কাছে পাঁচ টাকা হাওলাত করে এনেছি।"
অবশেষে দাক্ষায়ণী যখন সমস্ত বৃত্তান্ত শুনিলেন তখন পৃথিবীর সাধুতা সম্বন্ধে তাঁহার সমস্ত বিশ্বাস বিপর্যস্ত হইয়া গেল। নিশ্চয় দোকানদারেরা তাঁহার স্বামীকে ঠকাইয়াছে এবং বাংলাদেশের সমস্ত ক্রেতা ষড়যন্ত্র করিয়া দোকানদারদের ঠকাইয়াছে।
অবশেষে সহসা মনে হইল, যাহাকে নিজের প্রতিনিধি করিয়া স্বামীর সহিত পাঠাইয়াছিলেন সেই বিধুভূষণ দোকানদারদের সহিত তলে তলে যোগ দিয়াছে- এবং যত বেলা যাইতে লাগিল ততই তিনি পরিষ্কার বুঝিতে পারিলেন, ও-পাড়ার বিশ্বম্ভর চাটুজ্যে তাঁহার স্বামীর পরম শত্রু ; নিশ্চয়ই এ-সমস্ত তাঁহারই চক্রান্তে ঘটিয়াছে। তাই বটে, যেদিন তাঁহার স্বামী কলিকাতায় যাত্রা করেন তাহার দুই দিন পরেই বিশ্বম্ভরকে বটতলায় দাঁড়াইয়া কানাই পালের সহিত কথা কহিতে দেখা গিয়াছিল - কিন্তু বিশ্বম্ভর মাঝে মাঝে প্রায়ই কানাই পালের সহিত কথাবার্তা কয় না কি, এইজন্য তখন কিছু মনে হয় নাই, এখন সমস্ত জলের মতো বুঝা যাইতেছে।
এ দিকে দাক্ষায়ণীর সাংসারিক দুর্ভাবনা ক্রমেই বাড়িতে লাগিল। যখন অর্থ-সংগ্রহের এই একমাত্র সহজ উপায় নিষ্ফল হইল তখন আপনার কন্যাপ্রসবের অপরাধ তাঁহাকে চতুর্গুণ দগ্ধ করিতে লাগিল। বিশ্বম্ভর বিধুভূষণ অথবা বাংলাদেশের অধিবাসীদিগকে এই অপরাধের জন্য দায়িক করিতে পারিলেন না - সমস্তই একলা নিজের স্কন্ধে তুলিয়া লইতে হইল, কেবল যে-মেয়েরা জন্মিয়াছে এবং জন্মিবে তাহাদিগকেও কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ অংশ দিলেন। অহোরাত্র মুহূর্তের জন্য তাঁহার মনে আর শান্তি রহিল না।
আসন্নপ্রসবকালে দাক্ষায়ণীর শারীরিক অবস্থা এমন হইল যে, সকলের বিশেষ আশঙ্কার কারণ হইয়া দাঁড়াইল। নিরুপায় তারাপ্রসন্ন পাগলের মতো হইয়া বিশ্বম্ভরের কাছে গিয়া বলিল, "দাদা আমার এই খানপঞ্চাশেক বই বাঁধা রাখিয়া যদি কিছু টাকা দাও তো আমি শহর হইতে ভালো দাই আনাই।"
বিশ্বম্ভর বলিল, "ভাই, সেজন্য ভাবনা নাই, টাকা যাহা লাগে আমি দিব, তুমি বই লইয়া যাও।" এই বলিয়া কানাই পালের সহিত অনেক বলাকহা করিয়া কিঞ্চিৎ টাকা সংগ্রহ করিয়া আনিল এবং বিধুভূষণ স্বয়ং গিয়া নিজে হইতে পাথেয় দিয়া কলিকাতা হইতে ধাত্রী আনিল।
দাক্ষায়ণী কী মনে করিয়া স্বামীকে ঘরে ডাকাইয়া আনিলেন এবং মাথার দিব্য দিয়া বলিলেন, "যখনই তোমার সেই বেদনার উপক্রম হইবে, স্বপ্নলব্ধ ঔষধটা খাইতে ভুলিয়ো না। আর, সেই সন্ন্যাসীর মাদুলিটা কখনোই খুলিয়া রাখিয়ো না।" আর, এমন ছোটোখাটো সহস্র বিষয়ে স্বামীর দুটি হাতে ধরিয়া অঙ্গীকার করাইয়া লইলেন। আর বলিলেন, বিধুভূষণের উপর কিছুই বিশ্বাস নাই, সেই তাঁহার স্বামীর সর্বনাশ করিয়াছে, নতুবা ঔষধ মাদুলি এবং মাথার দিব্য-সমেত তাঁহার সমস্ত স্বামীটিকে তাহার হস্তে দিয়া যাইতেন।
তার পরে মহাদেবের মতো তাঁহার বিশ্বাসপ্রবণ ভোলানাথ স্বামীটিকে পৃথিবীর নির্মম কুটিলবুদ্ধি চক্রান্তকারীদের সম্বন্ধে বার বার সতর্ক করিয়া দিলেন। অবশেষে চুপিচুপি বলিলেন, "দেখো, আমার যে মেয়েটি হইবে সে যদি বাঁচে তাহার নাম রাখিয়ো 'বেদান্তপ্রভা', তার পরে তাহাকে শুধু প্রভা বলিয়া ডাকিলেই চলিবে।"
এই বলিয়া স্বামীর পায়ের ধুলা মাথায় লইলেন। মনে মনে কহিলেন, "কেবল কন্যা জন্ম দিবার জন্যই স্বামীর ঘরে আসিয়াছিলাম। এবার বোধ হয় সে আপদ ঘুচিল।"
ধাত্রী যখন বলিল, "মা, একবার দেখো, মেয়েটি কী সুন্দর হয়েছে" - মা একবার চাহিয়া নেত্র নিমীলন করিলেন, মৃদুস্বরে বলিলেন, "বেদান্তপ্রভা"। তার পরে ইহসংসারে আর একটি কথা বলিবারও অবসর পাইলেন না।
(১২৯৮ বঃ)

তারাবাঈ || সৈয়দ ইসমাঈল হোসেন সিরাজী (১-৫ পরিচ্ছেদ)

প্রথম পরিচ্ছেদ
বিজাপুরের সোলতানের অধীনে কৃষ্ণনগর পরগণার জায়গীরদার সরফরাজ খান নিরুদ্বেগ জায়গীর ভোগ করিতেছিলেন। যুদ্ধকালে সোলতানকে দুই হাজার পদাতিক এবং পাঁচশত অশ্বারোহী সৈন্য দিয়ে সাহায্য করিতে হইত। আর সোলতানের সৈন্যদের রসদের জন্য প্রতি বৎসর পাঁচ শত গো এবং এক হাজার মেষ ও ছাগল প্রদান করিতে হইত। ইহা ছাড়া একটি পয়সাও খেরাজ বা খাজনা স্বরূপ দিতে হইত না। সরফরাজ খান প্রায় ছয়শত সত্তর বর্গ মাইল পরিমিত রাজ্যে সাড়ে দশ লক্ষ প্রজা লইয়া স্বাধীনভাবে বাস করিতেন। শাসন ও বিচারের সমস্ত বন্দোবস্তই তাঁহার নিজের অধীনে ছিল। কেবল মৃত্যুদন্ড দিতে হইলে বিজাপুরের দারোল-এন‌্ছাফের অর্থাৎ হাইকোর্টের কাজী-উল-কোজ্জাত অর্থাৎ প্রধান জজের হুকুম লইতে হইত। মারাঠা দস্যুপতি শিবাজী সরফরাজ খানের সঙ্গে বরাবরই সদ্ব্যবহার করিয়া উভয়ের মধ্যে সদ্‌ভাবের সৃষ্টি করিয়াছিলেন। কিন্ত সলিমগড়ের মীর্জা ওবায়দুল্লাহ্‌ বেগের সহিত সরফরাজ খান কন্যা আমিনা বানুর বিবাহের অসম্মতি জ্ঞাপন করায়, পরস্পরের মধ্যে যখন মনোমানিল্যের সঞ্চার হইল, সেই সময় ওবায়দুল্লাহ বেগের নিকট হইতে প্রচুর অর্থবল এবং সৈন্যবল লাভ করিয়া শিবাজী সহসা কৃষ্ণগড় আক্রমণ করিয়া বসিলেন।
সরফরাজ খান এই আক্রমণ সম্বন্ধে একেবারেই কিছু অবগত ছিলেন না। সুতরাং সহসা আক্রান্ত হইয়া প্রথমত নিতান্তই অপ্রতিভ এবং উদ্বিগ্ন হইলেন। পরে সত্বরতা সহ প্রস্তুত হইয়া কৃষ্ণগড়ের পার্বত্য দুর্গে আশ্রয় গ্রহণপূর্বক ভীষণভাবে সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলেন। দুর্গ হইতে মধ্যে মধ্যে ধাওয়া করিয়া শিবাজীর বহু সৈন্য হতাহত করিতে লাগিলেন। কিন্তু শিবাজীর সৈন্য-সংখ্যা অনেক বেশি থাকায়, সরফরাজ খান বিশেষ কিছু সুবিধা করিয়া উঠিতে পারিলেন না। দুর্গের রসদ ক্রমে ফুরাইয়া গেল। অথচ বিজাপুর সোলতানের কোনও সৈন্যদল সাহায্যের জন্য আগমন করিল না।
সরফরাজ খান ক্রমশ হতাশ হইয়া পার-পর-নাই ভীষণ হইয়া উঠিলেন। তিনি অনাহারে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়া অপেক্ষা সৈন্যদল ও একমাত্র বীরপুত্র আলী হায়দর খানকে সঙ্গে লইয়া শিবাজীর সৈন্যদলকে ভীষণভাবে, আক্রমণ করিলেন। প্রচন্ড আক্রমণে শিবাজীর সৈন্যদল রণক্ষেত্রে তিষ্ঠিতে না পারিয়া বহুদূরে হটিয়া গেল। শিবাজীর প্রচুর রসদ তোপ-বন্দুক এবং গোলাগুলী সরফরাজ খানের হস্তগত হইল। কিন্তু এই যুদ্ধে তাঁহার একমাত্র বীরপুত্র আলী হায়দর খান যুদ্ধ করিতে করিতে সমক্ষেত্রে পতিত হইলেন। এদিকে শিবাজী আরও মাওয়ালী ও মারাঠা সৈন্যদল সংগ্রহ করিয়া পুনরায় নবীন উদ্যম এবং বিপুল তেজে দুর্গ আক্রমণ করিলেন। আবার ভীষণ যুদ্ধ আরম্ভ হইল। দুর্গ-প্রাচীর ভগ্ন করিবার জন্য মারাঠা গোলন্দাজগণ অনবরত এক স্থান লক্ষ্য করিয়া গোলা নিপে করিতে লাগিল। সরফরাজ খান, তাঁহার সেনাপতি মোতামদ খান এবং কন্যা আমিনা বানু দুর্গের প্রচারের উপরে তোপ পাতিয়া শক্রসৈন্য সংহারের জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের জ্বলন্ত উৎসাহ এবং উত্তেজনাপূর্ণ সঞ্জীবণী বাণীতে কৃষ্ণগড়ের সৈন্যদলের মধ্যে প্রবল উৎসাহ ও বীরত্বের সঞ্চার হইল। কৃষ্ণগড়ের গোলন্দাজগণের অব্যর্থ লক্ষ্যে শিবাজীর সৈন্যদল যখন ছিন্ন-ভিন্ন হইয়া পড়িবার উপক্রম হইল, ঠিক সেই সময় একটি শেল আসিয়া বীরপুরুষ সরফরাজ খানের স্কন্ধদেশে পতিত হইল। সেই শেলের দারুণ আঘাতে তাঁহার দেহ একেবারে চূর্ণ-বিচূর্ণ হইয়া উড়িয়া গেল। সৈন্যদলে ভীষণ হাহাকার ধ্বনি উত্থিত হইল। শক্রগণ যাহাতে সরফরাজ খানের নিধনবার্তা অবগত না হইতে পারে, তজ্জন্য বিশেষ সতর্কতা অবলম্বিত হইল।
গভীর রজনীতে পরামর্শ-সভা আহুত হইল। মোতামদ খান এবং অন্যান্য প্রধান প্রধান ব্যক্তিগণ নিরাশ হইয়া শিবাজীর সহিত সন্ধি করিবার প্রস্তাব করিলেন। সরফরাজ খানের পত্নী হামিদা বানুও সন্ধির প্রস্তাবে সম্মত হইলেন, কিন্ত বীর্যবতী কুমারী আমিনা বানু বলিলেনঃ “বিধমী ও বেঈমান কাফেরের সহিত সন্ধি অপেক্ষা যুদ্ধ করাই ভালো। আমাদের প্রেরিত দূত বিজাপুরে পৌঁছে থাকলে, নিশ্চয়ই এতদিনে সোলতান-বাহিনী আমাদের সাহায্যের জন্য রওয়ানা হয়েছে। এ সময় হীন শর্তে সন্ধি করলে, পরে পস্তাতে হবে। শিবাজী যেমন, যখন ইচ্ছা সন্ধি উল্লঙ্ঘন করতে দ্বিধাবোধ করেন না, স্বাভাবিক ধর্মভীরুতার জন্য আমাদের পক্ষে সেরূপ করা সম্ভব হবে না। সুতরাং ভবিষ্যতে আমরা শক্তিশালী হলেও এই বেইমান ও অসভ্য কাফেরদিগের অধীনে বহু হীনতা ও নীচতা স্বীকার করতে হবে। সুতরাং কমবখত মারাঠা কাফেরের সঙ্গে যুদ্ধ করাই সর্বতোভাবে সঙ্গত।
“যুদ্ধে যদি জয়লাভ করি, শক্রর নিপাত হবে। আর যদি মৃত্যুমুখে পতিত হই, তাহাও মহাসৌভাগ্যের কারণ হবে। কারণ, মহাপুরুষ হযরত মোহাম্মদ (দঃ) বলেছেন, ‘যুদ্ধ করতে করতে যে মৃত্যু, তাহাই শ্রেষ্ঠ মৃত্যু। এরূপ মৃত্যু মানুষকে বিনা হিসাবে বেহেশতে লয়ে যাবে।’ সুতরাং সকলে যুদ্ধের জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত হউন। আমার বিশ্বাস, চরম বিক্রমে আক্রমণ করলে, শক্রগণ নিশ্চয় পর্যুদস্ত হয়ে পলায়ন করতে বাধ্য হবে।”
আমিনা বানুর উৎসাহ এবং যুদ্ধপ্রিয়তা সন্দর্শন করিয়া সকলেই যুদ্ধের জন্য আবার মাতিয়া উঠিলেন। সুতরাং দুর্গবাসী সকলেই প্রাণপণ যত্নে দুর্গ-প্রাচীরের ভগ্নস্থানগুলি রাতারাতি মেরামত করিয়া প্রভাতে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হইলেন। মোতমদ খান এবং কুমারী আমিনা বানু অশ্বারোহণে দুর্গের সর্বত্র পরিভ্রমণ করিয়া সকলকে উৎসাহিত এবং উদ্বোধিত করিতে লাগিলেন। সুর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই কুমারী আমিনা বানু বর্মমন্ডিত অবস্থায় অস্ত্রশস্ত্রে সজিজ্জত হইয়া স্বয়ং সেনাপতির পদ গ্রহণপূর্বক ভীম বিক্রম এবং অটল সঙ্কল্পে গৈরিক প্লাবনের ন্যায় শিবাজীর বাহিনীর উপরে যাইয়া আপতিত হইলেন। ভীষণ প্রতাপে শিবাজীর ব্যূহ বিদীর্ণ হইয়া গেল। আমিনা বানু অনেক দূর পর্যন্ত মাওয়ালী ও মারাঠা সৈন্যের পশ্চাদ্ধাবন করিয়া দুর্গে ফিরিয়া আসিলেন। শিবাজীর সৈন্যের প্রচুর রসদ-পত্র তোপ-বন্দুক ও গোলাগুলী হস্তগত করিয়া কুমারী আরও বিক্রমশালিনী হইয়া উঠিলেন। মধ্যে মধ্যে দুর্গ হইতে ধাওয়া করিয়া মারাঠাদিগের ভীষণ মার দিতে লাগিলেন। শিবাজীর সৈন্যদল বহু উৎসাহ এবং পুরস্কারের প্রলোভনে উদ্বুদ্ধ এবং প্রলুব্ধ হইয়াও কুমারীর সহিত সম্মুখ-সংগ্রামে ব্যূহ বাঁধিয়া দাঁড়াইতে সমর্থ হইল না।
কুমারী আমিনা বানু যেমন বীর্যশালিনী, তেমনি অসাধারণ রূপবতী ছিলেন। বাল্যকাল হইতে সমর-শাস্ত্রে তাঁহার গভীর অনুরাগ ছিল। অশ্বারোহণে, অস্ত্র-সঞ্চালনে, ব্যূহ-বিন্যাস কৌশলে, তোপ পরিচালনায়, তিনি অসাধারণ দক্ষতা লাভ করিয়াছিলেন। এক্ষণে সমরক্ষেত্রে সাক্ষাৎভাবে তাঁহার বীরত্ব, প্রতাপ, সাহস ও কৌশল দেখিয়া সকলেই বিমোহিত হইল।
শিবাজী এই কুমারীর প্রতাপ ও সাহস দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া পড়িলেন। রমণীর রূপলাবণ্যের সহিত এই প্রকার বিস্ময়কর বীর্যশৌর্যের অপূর্ব সমাবেশ দেখিয়া শিবাজী এই রমণীরত্বকে হস্তগত করিবার জন্য বিশেষ চেষ্টা করিতে লাগিলেন। কিছুদিনের জন্য যুদ্ধ লাভ করিবার জন্য উন্মক্ত হইয়া উঠিলেন। বলে পরাস্ত করিতে না পারিয়া কৌশল ও প্রলোভনে কুমারীকে বন্ধ রাখিয়া সন্ধির প্রস্তাব উত্থাপিত করা হইল। আমিনা বানুর অসাধারণ বীরত্ব ও কৌশলে শিবাজী নিতান্ত মুগ্ধ ও বিস্মিত হইয়াছেন, এইরূপ ভান করিয়া তাঁহার রাজ্য আক্রমণ করা সঙ্গত নহে বলিয়া প্রকাশ করিলেন। অতঃপর শিবাজী কৃষ্ণগড়ের অধিকারিণী আমিনা বানুর সহিত সন্ধি-বন্ধনে আবদ্ধ হইলেন। তিনি আর কখনও কৃষ্ণগড় আক্রমণ করা দূরে থাকুক, অন্য কেহ আক্রমণ করিলে, তিনি আততায়ীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করিবেন বলিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন।
অতঃপর উভয়পক্ষ হইতে মিত্রতা স্বরূপ উভয় পক্ষকেই বিপুল আড়ম্বরে ভোজ প্রদান করা হইল। ভোজ শেষ হইলে, শিবাজী বহুমূল্য নানাবিধ বিলাস দ্রব্য, করাচী হইতে লুণ্ঠিত একজোড়া হীরকের কঙ্কণ এবং লক্ষ টাকা মূল্যের পারস্যসাগর-জাত একটি মুক্তামালা আমিনা বানুকে উপহার প্রদান করিলেন। সঙ্গে সঙ্গে শিবাজীর রূপ-গুণ যশঃবিক্রম প্রভৃতি তিলে তাল করিয়া বর্ণনা করিবার জন্য উপযুক্তরূপে শিক্ষিতা কতিপয় ধূর্ত স্ত্রীলোক দাসী-স্বরূপ প্রেরিত হইল। ইহাদের কর্তব্য ছিল-ক্রমশ শিবাজীর গুণকীর্তন করিয়া আমিনা বানুকে শিবাজীর প্রতি অনুরক্ত ও মুগ্ধ করা।
শিবাজীর উদারতা এবং মহত্ব দেখিয়া সকলেই ধন্য করিতে লাগিল। বীরঙ্গনার প্রতি এই প্রকার সন্মান ও দয়া প্রকাশ করায় দাক্ষিণাত্যের মুসলমানগণও শিবাজীর প্রশংসা কীর্তন করিতে লাগিল। অতঃপর যথাসময়ে বিজাপুরের প্রধানমন্ত্রী এবং যুবরাজ যাইয়া নির্দিষ্ট সময়ে আমিনা বানুকে রাজ্যাভিষিক্ত করিয়া ‘মালেকা’ অর্থাৎ রাণী উপাধি প্রদান করিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং মুকুট পরাইয়া দিলেন। যুবরাজ বিজাপুরের হুকুমতের তরফ হইতে একখানি মূল্যবান তরবারি উপহার প্রদান করিলেন। শেখ-উল-ইসলাম জামে মসজিদে যাইয়া আল্লাহ তালার মঙ্গল আশীর্বাদ মালেকা আমিনার জন্য প্রার্থনা করিলেন। শিবাজীও তাঁহাকে অনেক ভেটঘাট প্রদান করিয়া যথেষ্ট সম্বর্ধনা করিলেন। মালেকা আমিনা বানু রাজ্যাভিষেকের পরে বিজাপুরের সোলতানের হুজুরী-নজর স্বরূপ পাঁচটি উৎকৃষ্ট হস্তী, এক হাজার স্বর্ণমুদ্রা এবং ২৫টি বৃহৎ মুক্তা প্রেরণ করিলেন।

দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
শীত ঋতুর অবসান হইয়াছে। মলয় সমীরণের মধুর সঞ্চরণে উদ্ভিদ এবং প্রাণীজগতের প্রাণে প্রাণে নব-জীবন এবং নব আনন্দের সঞ্চার হইয়াছে। নবীন পত্র-পল্লবে এবং মঞ্জরী-মৌলী-ভূষণে ভূষিত হইয়া নানা জাতীয় বৃলতা অপরূপ শোভা বিস্তার করিতেছে। অনন্ত আকাশের অনন্ত নীলিমা উজ্জ্বলতর হইয়া আল্লাহতালার অনন্ত মহিমা প্রকাশ করিতেছে! পাখীর কণ্ঠে ললিত ছন্দে নানাবিধ মধুর ও মনোহর কুজন স্ফুরিত হইয়া দিগদিগন্ত মুখরিত এবং পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। এমন মধুর ও মনোহরি বসন্তকালে শিবাজী দিগদিগন্ত মুখরিত এবং পুলকিত হইয়া উঠিয়াছে। এমন মধুর মনোহর বসন্তকালে শিজাবী আমিনা বানুকে বিশেষ সম্বর্ধনা পুর্বক রাজধানী রায়গড়ে বিশেষ পরামর্শের জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া পাঠাইলেন।
মালেকা প্রথমে নিমন্ত্রণে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করিলেন, নানা প্রকার ওজুহাত দেখাইতে লাগিলেন। অবশেষে বহু সাধ্য-সাধন এবং অনুনয়-বিনয়ে বাধ্য হইয়া জননী হামিনা বানু, দুইশত সিপাহী এবং স্বকীয় সহচরীগণ সহ রায়গড়ে শুভাগমন করিলেন।
শিবাজী বিপুল আড়ম্বর ও ধুমধামে মালেকাকে অভ্যর্থনা করিলেন। ফলত শিবাজী দ্বারা মালেকা আমেনা বানুর আদর-অভ্যর্থনা যতদূর হওয়া সম্ভবপর, তাহার কিছুই ক্রটি হইল না। আমিনা, তাঁহার মাতা এবং সঙ্গীয় লোকজন সকলে। শিবাজীর ভদ্রতা, সৌজন্য ও শিষ্ট ব্যবহারে পরম প্রীতি লাভ করিলেন।
শিবাজী এই সময়ে কৌশলে আমিনা বানুর রূপ-লাবণ্য বিশেষরূপে দর্শন করিয়া যার-পর-নাই লুদ্ধ এবং মুগ্ধ হইয়া পড়িলেন। আমেনা বানুর ভাসা ভাসা পটল-চেরা ভুবন-মোহন-অক্ষিযুগল এবং সর্বাঙ্গম সুঠাম ও সৌন্দর্য দেখিয়া সকলেই প্রশংসা করিতে লাগিল। শিবাজী আলোকসামান্য সুন্দরী, অগ্নিতুল্য তেজস্বিয়নী এবং প্রখর রাজনীতিজ্ঞা, এই রমণীরত্নকে পত্নীরূপে লাভ করিতে পারিলে, সমগ্র ভারতের অধিপতি হইয়া আশাও পোষণ করিতে লাগিলেন। মুসলমান কখনও কাফেরকে কন্যা দান করিতে পারে না, শিবাজী এই চিন্তাতেই অস্থির হইতে লাগিলেন। সুতরাং অসম্ভব কার্যকে সম্ভব করিবার জন্য শিবাজী কাল্পনিক পন্থা উদ্‌ভাবনে ব্যস্ত হইলেন। অনেক চিন্তা করিলেন, কিন্তু কিছুই নির্ধারিত হইল না। মন ক্রমেই মাতিয়া উঠিতে লাগিল। ক্রমেই লালসা বায়ু-প্রাপ্ত বহ্নির ন্যায় অতীব প্রচন্ড হইয়া উঠিল।
শিবাজী মালেকার সৌন্দর্য-সুধার এমনি পিপাসু হইয়াছিলেন যে, ক্রমশ তাঁহার হিতাহিত জ্ঞান ও পরিনামদর্শিতা একেবারেই লোপ পাইল। মালেকাই তাহার ধ্যান-জ্ঞান-চিন্তাকে আশ্রয় করিয়া ফেলিল। অবশেষে তাঁহার পরামর্শদাতা শুরু রামদাস স্বামীর পরামর্শে, ভানপূর্বক ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করিয়া মালেকা বানুর পাণিগ্রহণের জন্য চেষ্টা করিতে বলিলেন। বিবাহ করিবার পরে সুবর্ণ-নির্মিত কৃত্রিম গাভীর গর্ভে প্রবেশ করিয়া প্রসব-দ্বার দিয়া নির্গত হইয়া সেই গরু ব্রাহ্মণদিগকে দান করিলেই প্রায়শ্চিত্ত হইয়া যাইবে। আবার তিনি হিন্দুত্ব লাভ করিতে পারিবেন। রাজা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, মোসলেম-ললনা পাণিপীড়ন করিতে পারেন, রামদাস স্বামী এরূপ ব্যবস্থাও দিলেন।

তৃতীয় পরিচ্ছেদ
চৈত্র মাসের পূর্ণিমা তিথি। পূর্ণকলা শশধরের অমল-ধবল জ্যোৎস্না-লহরীতে গগন-ভবন সুখ-তরঙ্গে ভাসিতেছে। কৃষ্ণগড়ের দুর্গ-মধ্যস্থ মনোহর উদ্যানে নানা জাতীয় ফুল ফুটিয়া কৌমুদী-স্নাত হইয়া মৃদু মন্দ পবনে মধুর গন্ধ বিতরণ করিয়া হাসিতেছে, নাচিতেছে এবং খেলিতেছে। সরোবরে জলজ পস্পদাম প্রস্ফুটিত হইয়া মনোহারিণী শোভার সৃষ্টি করিয়াছে। নবপত্রপল্লাবসনে সুখে সমাসীন হইয়া কোকিল ও পাপিয়া সুধামাখা কুজনে অনন্ত শূণ্যবক্ষে যেন কি এক পীযূষ-স্রোত প্রবাহিত করিতেছে! জলে-স্থলে শূন্যে সর্বত্র জ্যোৎস্নার মধুর ও শান্তোজ্জ্বল বিকাশ! মলয়া হওয়ার অবিরাম সুখ-স্পর্শ মৃদু সঞ্চরণ। ফুলে ফুলে হাসির ঢলাঢলি! নীলিম গগন-পটে তারকাবলীর স্নিগ্ধোজ্জ্বল সমাবেশ! এ হেন মধু-যামিনীতে মালেকা আমিনা বানু প্রিয় সহচরী রোকিয়াকে সঙ্গে লইয়া উদ্যান মধ্যস্থ সরোবরে ঘাটে গালিচা পাতিয়া বসিয়া প্রকৃতির চিত্তবিনোদন দৃশ্য উপভোগ করিতেছিলেন। মালেকা এবং রোকিয়া উভয়ে নীরব। কিছুণ পরে নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া রোকিয়া বলিল, “মালেকা! এ মধু-যামিনী এমন করে একেলা ভোগে সুখ কি? হৃদয়-রাজ্যে প্রেমের জ্যোৎস্না না ফুটলে বাইরের জ্যোৎস্নায় কেবল অন্ধকারই বৃদ্ধি করে!”
মালেকাঃ কেন? এই ত তুমি আছ! তোমার সঙ্গেই মধু-যামিনীর জ্যোৎস্না-লহরী পান করছি।
রোকিয়াঃ ঠাট্টা রাখ। দুধের সাধ কি ঘোলে মিটে? এমন ক’রে যৌবন-জীবন যাপন করায় পল কি? বিবাহ করাই সঙ্গত।
মালেকাঃ কথা ত ঠিক্! কিন্তু যাকে-তাকে ত আর স্বামীত্বে বরণ করতে পারি না। বীরপুরুষ না হলে, কা’কেও বিবাহ করব না, এই সংকল্পই ত এখন বাধা হয়ে পড়ছে।
রোকিয়াঃ কেন, মোতামদ খান কি উপযুক্ত নন?
মাঃ মোতামদ খান একজন উপযুক্ত সেনাপতি ব্যতীত আর কিছুই নন। তাঁকে বীরপুরুষ বললে অন্যায় হয় না বটে, কিন্তু আমি যে শ্রেণীর বীরপুরুষ চাই, সে শ্রেণীর নহেন। মোতামদ খান যদি বাহুবলে রাজ্য সংস্থাপন করতে পারতেন অথবা কৃষ্ণগড়কে স্বাধীন করতে পারতেন, তা’ হ’লে তাঁকে বীরপুরুষ বলে স্বীকার করতাম।
রোঃ তবে শিবাজী?
মাঃ বটে! শিবাজী সাহসী পুরুষ এবং রাজ্য সংস্থাপনেরও চেষ্টা করছেন। কিন্তু অতি নীচ প্রকৃতি বিশিষ্ট। শিবাজীকে বীরপুরুষ বলা কিছুতেই সঙ্গত নহে, দস্যু বল। বীরপুরুষের মহত্ব ও বীরত্ব তাঁতে নাই। ‘পার্বত্যমূষিক’ উপাধিই তাঁর পক্ষে যথার্থ।
রোঃ কেন, আপনার প্রতি ত খুবই উদার ও সদয় ব্যবহার করেছেন।
মাঃ নিশ্চয়ই। কিন্তু তাঁর ভিতরে তাঁর মৎলব আছে।
মাঃ মৎলব ছাড়া দুনিয়ার কে কি ক’রে থাকে?
মাঃ তা’ বটে! কিন্তু মৎলবের মধ্যেও পার্থক্য আছে। নিজের স্বার্থসিদ্ধিই যার একমাত্র উদ্দেশ্য, সে মৎলব অতীব ঘৃণিত।
রোঃ শিবাজীর মৎলব ঘৃণিত কিসে?
তাঃ তাঁল এই সদয় ও উদার ব্যবহারের উদ্দেশ্য হচ্ছে, আমাকে লুব্ধ ক’রে বিবাহ করা। কিন্তু তাঁর জানা উচিত যে, মুসলমান কখনও কাফেরকে পাণিদান করতে পারেন না।
রোঃ তিনি ত আপনার জন্য ইসলাম ধর্ম পর্যন্ত অবলম্বন করতে প্রস্তুত আছেন। আপনি বিবাহে স্থির-নিশ্চয় সম্মতি দিলে তিনি পৈতৃক হিন্দু ধর্ম ত্যাগ ক’রে পবিত্র ইসলাম ধর্ম অবলম্বন করবেন। এতে তাঁকে নানাবিধ অসুবিধা ও কষ্ট ভোগ করতে হবে বটে; কিন্তু তুবও তিনি আপনার জন্য সে সমস্ত সহ্য এবং বহন করতে প্রস্তুত আছেন। প্রেমের এমন আদর্শ এবং প্রেমের জন্য এরূপ স্বার্থত্যাগ নিতান্তই বিরল নহে কি?
মাঃ নিশ্চয়ই। এরূপ ভন্ডামী এবং এরূপ শয়তানী নিশ্চয়ই নিতান্ত বিরল!
রোঃ ভন্ডামী কিরূপ? হায়! একেই বলে ‘যার কি চুরি সেই বলে চোর!’
মাঃ ভন্ডামী না হয়ত, ষন্ডামী ত বটেই। সাত সাতটি স্ত্রী এবং কয়েক গন্ডা উপপত্নী থাকলেও যাঁর আমার জন্য ঘুম হয় না, সে যদি আদর্শ প্রেমিক হয়, তবে আদর্শ লম্পট এবং পিশাচ আর কে?
রোঃ যে ব্যক্তি যাকে তনুমন সমর্পণ করেছে, সে যদি তা’কে না পায়, তা’ হলে তার ঘুম না হওয়াই ত স্বাভাবিক। এ অবস্থায় ত বেচারা শিবাজীর প্রতি দয়া হওয়াই স্বাভাবিক।
মাঃ বটে, বলিস কি? তুই পাগল নাকি! এরূপ লোকের প্রতি যদি দয়া হয়, তা’ হলে, বাম পদাঘাত করবার প্রবৃত্তি হবে আর কা’কে?
রোঃ ছিঃ! ছিঃ! এমন কথা বলা কি সঙ্গত?
মাঃ যে ব্যক্তি নারী লাভের জন্য পৈতৃক ধর্ম ত্যাগ করতে প্রস্তুত তা’র প্রতি ইহা অপেক্ষা সদুক্তি আর কি হ’তে পারে? যদি শিবাজী আজ ধর্মের জন্যই ধর্ম পরিগ্রহ করতেন, তা’ হলে নিশ্চয়ই মুক্তকণ্ঠে তাঁর প্রশংসা কীর্তন করতাম। শিবাজী ইসলাম ধর্ম পরিগ্রহ করলেও কদাপি তাতে স্থিরতর থাকবেন না। কোনও রূপে আমার রাজ্য এবং আমাকে হস্তগত করবার জন্যই ইসলাম গ্রহণের ভাণ করা হচ্ছে। শিবাজী ইসলামের পরম শক্রু। তিনি মসজিদগুলি চূর্ণ এবং তাহা শূকর-রক্তে অপবিত্র ক’রে পরম আনন্দ লাভ করছেন। শিবাজীর ন্যায় নৃশংস দস্যু যদি দমিত না হয়, তা’ হলে ইসলামের সমূহ অমঙ্গল বুঝতে হবে। আমি এহেন অস্পৃশ্য পাষন্ড কাফেরের পাণিগ্রহণ করব, এরূপ আশা করা বাতুলের পক্ষেই শোভা পায়। বরং শিবাজী এবিষয়ে যতই চেষ্টা করবেন, আমার ঘৃণা ও অশ্রদ্ধা ততই বৃদ্ধি পাবে। আমি প্রাণান্তেও এমন ঘৃণিত দস্যু ও জাহান্নামী কাফেরকে কিছুতেই স্বামীত্বে বরণ করতে স্বীকৃত নহি। এমনকি, এ বিষয়ের আলোচনা করতেও আমি ঘৃণা এবং বিরক্তি বোধ ক’রে থাকি।

চতুর্থ পরিচ্ছেদ
ঊষা তাহার অরুণিমা-জালের চাঁপা আঙ্গুলের কোমল স্পর্শে ঘন আঁধাররাশিকে তরল করিয়া নিদ্রিত বিশ্ববক্ষে নব চেতনার সঞ্চার করিতেছে। প্রভাতবায়ু কুসুম-গন্ধ হরণ করিয়া মৃদুমন্দ গতিতে স্বাস্থ্য ও স্নিগ্ধতা বিতরণ করিয়া প্রবাহিত হইতেছে। মধুরকণ্ঠে নানা ছন্দে সুললিত তানে বিশ্বপিতার মহিমা কীর্তন করিতেছে। ধীরে ধীরে মৃতবৎ জগৎবক্ষে কেন মনোহর ও মধুরভাবে নবজীবনে আবির্ভাব সূচিত হইতেছে।
এ হেন মধুর প্রভাতকালে অতি প্রত্যুষেই রায়গড়ের রাজপথের পার্শ্বে লোক সমাগম পরিদৃষ্ট হইতেছে। আমরা যে সময়ের কথা বলিতেছি, রায়গড় তখন অতি ক্ষুদ্র শহর।
এই ক্ষুদ্র শহর আজ বিজাপুরের সেনাপতি মহাবীর আফজাল খাঁর অভ্যর্থনাহেতু পরম রমণীয়ভাবে সজ্জিত হইয়াছে। পথের মধ্যে মধ্যে নানাস্থানে বিচিত্র তোরণসমূহ নির্মিত হইয়াছে! পতাকা, পুস্প এবং কদলী বৃক্ষে সমস্ত রাস্তা গোলজার করা হইয়াছে। মহারাষ্ট্রগণ যথাসম্ভব উৎকৃষ্ট বেশ-ভূষার সজ্জিত হইয়া সোৎসুকচিত্তে অপেক্ষা করিতেছে! মহারাষ্ট্র রমণীগণ পুস্পগুচ্ছে কুন্তল সাজাইয়া বিচিত্র ভঙ্গীতে কোঁচা ও কাছা দিয়া শাটী পরিয়া অট্টহ্স্যে এবং কোলাহলের গগণ-পবন মুখরিত করিয়া রাস্তার এক এক স্থানে জটলা পাকাইতেছে। বহু সংখ্যক বালক ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিতেছে।
এদিকে বাদ্যোদ্যমসহ মহারাষ্ট্রদিগের রাজা শিবাজী সহস্র সংখ্যক অশ্বারোহী সৈন্যসহ মুসলমান-পোষাকে উৎকৃষ্টরূপে সজ্জিত হইয়া সপারিষদ আসিয়া নগর তোরণের মূলে শ্রেণীবন্ধভাবে দন্ডায়মান হইলেন।
সহসা দূরে একটি তোপ গর্জন করিয়া উঠিল। সেই তোন গর্জনের সঙ্গেই সর্বত্র একটি অস্ফুট কলরব উত্থিত হইল। শিবাজী অশ্বারোহী সৈন্য এবং পারিষদগণকে সঙ্গে লইয়া বেগে অশ্ব ছুটাইলেন। নহবতে নহবতে শাহানার সুরে শানাই বাজিয়া উঠিল। রাস্তার পার্শ্বেই বাটী হইতে শঙ্খধ্বনি হইতে লাগিল। দেখিতে দেখিতে শিবাজী, বিজাপুরের সেনাপতি বীরবর আফজাল খাঁকে পরম সমাদরে এবং বিপুল আড়ম্বরে অভ্যর্থনা করিয়া রাজপ্রসাদের দিকে অগ্রসর হইলেন। শিবাজীর সৈন্যগণ পতাকা উড়াইয়া এবং বিগল বাজাইয়া অগ্রে অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। পশ্চাতে আফজাল খাঁ সহস্র সংখ্যক বীর পুরুষগণ বিপুল উৎসাহে নানাবিধ শ্রুতিমধুর বাদ্য বাজাইতে বাজাইতে অগ্রসর হইল। তৎপশ্চাতে বিপুল জনতা ও পদাতিক সৈন্যগণ চলিতে লাগিল। মারাঠা রমণীরা চতুর্দিক হইতে হুলুধ্বনি দিতে লাগিল।
আকাশে সূর্য উঠিয়াছে! তরুণ অরুণের লোহিত কিরণরাগে গগণ-ভুবন মনোমোহন সৌন্দর্যে ভূষিত হইতেছে। কিন্তু বিশ্বলোচন সবিতা-দেবের প্রতি আজ কাহারো দৃষ্টি নাই। যে সমস্ত হিন্দু সূর্যোদয় “জবা কুসুম সঙ্কাশ” প্রভৃতি স্তব আওড়াইয়া প্রত্যহ সূর্যের উপাসনা করিত, তাহাদেরও আজ সেই উপাস্য সূর্য-দেবতার দিকে নজর নাই। আজ সকলের দৃষ্টিই বিজাপুরের বীর সেনানী রূপবান ও তেজীয়ান আফজাল খাঁর প্রতি! আফজাল খাঁ অশ্বারোহণে চলিয়াছেন! তেজীয়ান অশ্ব নৃত্যশীল গতিতে ধীরে ধীরে কি বাঁকা ভঙ্গিমাতেই চলিয়াছে! আফজাল খাঁ রূপের ছটায় এবং বীর্যগরিমায় চারিদিক যেন আলো করিয়া চলিয়াছেন। কিবা কমনীয় কান্তি! কিবা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিব্যঞ্জন আয়ত লোচনযুগন! কিবা অঙ্কিত ভ্র! কিবা প্রশস্ত ললাট! কেমন বলিষ্ঠ ও পুষ্ট দেহ! মরি! মরি! কি তেজঃপুঞ্জ মূর্তি! কি বীরত্বব্যঞ্জক গোঁফ। যে দেখিল, সেই মুগ্ধ হইল। রমণীমহলে এই অপরূপ রূপের অস্ফুট স্বরে সমালোচনা উঠিল। সকলেই আফজাল খাঁর কোনও-না-কোনও অঙ্গের প্রশংসা করিতে লাগিল! তাঁহার সঙ্গীয় অশ্বারোহী সৈন্য এবং দেহরগিণেরই বা কি মনোরম গঠন-পারিপাট্য! কি বাঁকা ঠাম?
আফজাল খাঁর বাম পার্শ্বে শিবাজী চলিয়াছেন। শিবাজী মারাঠাদিগের মধ্যে সুশ্রী এবং সাহসী বীরপুরুষ বলিয়া প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন। কিন্তু আজ মারাঠারা দেখিল-শিবাজীর শ্রী, চেহারার তেজঃ, গঠন-পারিপাট্য এবং পুষ্টি, আফজাল খাঁর তুলনায় কত নগন্য! চন্দ্রের নিকট তারকা তেমন, পদ্মের নিকট শাপলা যেমন, কর্পূর আলোর নিকট মৃৎপ্রদীপের আলো যেমন, ময়ূরের নিকটে পাতিহংস যেমন, আফজাল খাঁর নিকটে শিবাজীও সেইরূপ প্রতিভাত, হইতেছেন। শিবাজীও বিস্মিত দৃষ্টিতে এক একবার নেত্রকোণে আফজাল খাঁর কমনীয় কান্তি, রমণীয় গঠন এবং তেজঃপুঞ্জ মূর্তি দর্শন করিতেছেন, আর হৃদয়ে ঈর্ষার সর্প দংশনে জ্বলিয়া উঠিতেছেন! হায়! শক্রর এত রূপ! এত বীর্য! একি কখনও সহ্য হয়! তাঁহার স্বজাতীয় মারাঠাদিগের নিকট আজ যে তাঁহার সর্বপ্রকার হীনতাই সূচিত হইতেছে।
যাহা হউক, নগরের দৃশ্য দেখিতে দেখিতে অল্প সময়ের মধ্যেই শিবাজী আফজাল খাঁকে লইয়া রাজপ্রাসাদের সিংহদ্বারে উপনীত হইলেন।
এইখানে শিবাজীর আত্নীয়-স্বজন এবং তাঁহার গুরু রামদাস স্বামী অভ্যর্থনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আফজাল খাঁর উপস্থিতি মাত্রেই একশত এক তোপ সন্মখস্থ প্রান্তরে গর্জন করিয়া উঠিল! এই তোপ গর্জনের সঙ্গে সঙ্গেই সহসা এক মহাবিপদের সঞ্চার হইল! শিবাজীর একটি প্রকান্ড হস্তী ভয়ে চঞ্চল হইয়া জনতার মধ্যে বেগে ছুটিতে লাগিল! মাহুত প্রাণপণে হস্তীটাকে থামাইবার চেষ্টা করিয়াও কিছুতেই কৃতকার্য হইতে না পারিয়া ভীষণে প্রহার করিতে লাগিল! ভীষণ ডাঙ্গশের প্রহারে হস্তীটি উন্মত্ত প্রায় হইয়া মাহুতকে সবলে স্কন্ধ দেশ হইতে আকর্ষণপূর্বক পদতলে নিষ্পেষিত করিয়া ফেলিল। ভীষণ পদাঘাতে এবং গুরুভারে মাহুত মুহূর্ত মধ্যেই মৃত্যুমুখে পতিত হইল।
মাহুতকে নিহত করিয়া আরও উন্মত্ত এবং ভীষণ হইয়া পড়িল। তাহার উন্মত্ততা এবং ভীষণতায় সেই সুসজ্জিত এবং সুশৃঙ্খল অগ্রভাগ একেবারেই বিশৃঙ্খল ও বিপর্যস্ত হইয়া পড়িল। সর্বত্র ভীতির কোলাহল পড়িয়া গেল। হস্তীর সম্মুখ হইতে সকলেই বেগে পলায়ন করিতে লাগিল। হস্তীটি বেগে ছুটিতে তাহার দক্ষিণ পার্শ্বের এক স্থানে, যেখানে মারাঠা স্ত্রীলোকেরা দাঁড়াইয়া মিছিল দেখিতেছিল, সেই দিকে ধাবিত হইল। স্ত্রীলোকেরা ভয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন করিতে লাগিল।
কিন্তু রত্নখচিত কৌষেয়বস্ত্র-সুসজ্জিত রাজকুমারী তারা পলায়ন করিতে যাইয়া মঞ্চে কাপড় আটকাইয়া পড়িয়া গেল। হস্তীটি এমন সময়ে বিকট চীৎকার করিয়া উঠায়, তারার দাসীগণ তারাকে ফেলিয়াই পলায়ন করিল। চতুর্দিকে ভীষণ আতঙ্কজনক উচ্চ কোলাহল উত্থিত হইল! এক পলকের মধ্যে হস্তী তারাকে পদ-বিমর্দিত করিবে! সকলেই হাহাকার করিয়া উঠিল।
শিবাজী-তনয়া তারার কোমল-দেহ-কুসুম কুঞ্জরপদতলে দলিত আর বেশি বিলম্ব নাই। হস্তী এক পা উঠাইয়াছে। সর্বনাশ! সর্বনাশ! সকলেই তারার মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হইয়া গেল।
কিন্তু আশ্চর্য ব্যাপার! সহসা কেন হস্তীটি ভীষণ আর্ত-চীৎকার করিয়া উঠিল। সকলেই বিস্ময়বিস্ফোরিত নেত্রে অবাক হইয়া দেখিল যে, উন্মত্ত হস্তীটি কপালে তীর বিদ্ধ হইয়া তারাকে ত্যাগ করিয়া অন্যদিকে ছুটিয়া যাইতেছে। তীর একহস্ত পরিমিত মস্তিস্কের মধ্যে বিদ্ধ হইয়াছিল। সুতরাং হস্তীটি কিয়দ্দুর যাইয়া ভূপতিত হইল। রক্তধারা প্রবাহিত হইয়া জমিন সিক্ত হইয়া গেল। দেখিতে দেখিতে হস্তীটি প্রাণ ত্যাগ করিল!
কে এই আসন্নবিপদ হইতে তারাকে রক্ষা করিল? কে এমন অব্যর্থ লক্ষ্যে ভীষণ তেজে তীর নিক্ষেপ করিয়া এই মহাবিপদের অবসান করিল? কাহার বাহুতে এমন দুর্জন শক্তি যে, হস্তীর মস্তকের মস্তিস্ক পর্যন্ত তীরে বিদ্ধ করিয়াছে?
সকলেই দেখিতে পাইল যে, বীরকুল-চূড়ামণি আফজাল খাঁই মুহুর্ত মধ্যে ধনুকে জ্যা আরোপণ করিয়া সবল ও নিপুণ হস্তের অব্যর্থ লক্ষ্যে রাজকুমারী তারাবাঈকে আকস্মিক মৃত্যুর হস্ত হইতে রক্ষা করিয়াছেন। চতুর্দিকে আফজাল খাঁর নামে জয়ধ্বনি হইতে লাগিল। সকলেই মুক্তকণ্ঠে আফজাল খাঁর সাহস এবং তেজের কথা আলোচনা করিতে লাগিল।
অতঃপর বিচ্ছিন্ন মিছিল আবার সুশৃঙ্খল করা হইল। শ্রেণীবদ্ধ হইয়া সৈনিকগণ তিনবার করিয়া কুর্ণিস করত আফজাল খাঁ এবং তাঁহার প্রভু বিজাপুরের সোলতানের দীর্ঘজীবন উচ্চকণ্ঠে কামনা করিল।
আফজাল খাঁ অশ্ব হইতে অবতরল করিলে সর্বপ্রথমে রামদাস স্বামী ধান্যদূর্বা দ্বারা আফজাল খাঁর মঙ্গলচর্না করিলেন। অতঃপর পুরুষ ও রমণীরা মিলিয়া আফজাল খাঁর শিরে ও সর্বাঙ্গে রাশি রাশি পূস্পবর্ষণ করিতে লাগিল। এত পুস্প বর্ষণ হইতে লাগিল যে, আফজাল খাঁ নিঃশ্বাস রুদ্ধ হইবার উপক্রম হইল। উপদ্রব দেখিয়া রামদাস স্বামী সকলকে ধমক দিলেন। কিন্তু যুবতীদিগের মধ্যে একটি রমণী নিষেধের পরও গোলাপের পাঁপড়ী আফজাল খাঁর মুখে বর্ষন করিতে লাগিল। রামদাস স্বামী তখন বিরক্তভাবে বলিয়া উঠিলেন, “কি তারা, কি ক’রছ! তোমার কি হুঁস নাই?” কিন্তু তারা তবুও আর এক মুষ্টি পুস্প বর্ষণ করিয়া ক্ষান্ত হইল তারার ভঙ্গী ও পুস্প বর্ষণ মত্ততা দেখিয়া আফজাল খাঁ ঈষৎ স্মিতহাস্য করিলেন।
অতঃপর পরম যত্নে সুসজ্জিত প্রাসাদ্যভ্যন্তরে আফজাল খাঁকে লইয়া রামদাস স্বামী এবং শিবাজীর পিতা শাহজী তাঁহার সেবায় ও পরিতোষ-বিধানে নিযুক্ত হইলেন। সৈনিক পুরুষদিগকেও যথাযোগ্য বাসস্থান এবং আহার প্রদান করা হইল। আদর-অভ্যর্থনা এবং সন্মান-সম্বর্ধনা পুরামাত্রায় চলিতে লাগিল।

পঞ্চম পরিচ্ছেদ
গভীর রাত্রি। জন-প্রাণীর সাড়াশব্দ নাই। আকাশে কৃষ্ণা পঞ্চমীর চন্দ্র কিরণধারায় সমস্ত পৃথিবীকে পুলকিত করিয়া রাখিয়াছে। নানা জাতীয় নৈশ-কুসুমের গন্ধ বাহিয়া মৃদুমন্দ গতিতে বায়ু বাহিয়া যাইতেছে। এমন সময় রায়গড়ের একটি বৃহৎ উদ্যানমধ্যস্থ ক্ষুদ্র অট্রালিকায় শিবাজী, তাঁহার পিতা শাহজী, শুরু রামদাস স্বামী, বলবন্ত রাও, মালজী প্রভৃতি মারাঠাপ্রধানগণ গুপ্ত পরামর্শের জন্য নিভৃতে সমবেত হইয়াছেন। সকলেই গভীর চিন্তামুক্ত-সকলেই নীরব। এই নৈশ গুপ্ত সভাধিবেশনের কথা আর কেহই অবগত নহে। রাজপুরীর আর কোনও নরনারী এসভার কোনও সংবাদ রাখে না এবং রাখিবারও কোনও প্রয়োজন নাই।
সকলেই নীরবে গৃহতলে সমাসীন। সকলেই গম্ভীর চিন্তায় নির্বিষ্ট। মৌনতা ভঙ্গ করিয়া সহসা শাহজী বলিলেন, “বৎস শিবা! অকারণে রাজ-বিদ্রোহিতা মহাপাপ। আমরা বিজাপুরের সোলতানের অধীনে বেশ আরাম ও স্বচ্ছন্দে দিন গুজরান করছি। রাজ্যের সর্বত্র শান্তি বিশেষ রূপে প্রতিষ্ঠিত। চোর-দস্যুর উৎপাত একেবারেই নাই। ব্যবসায়-বাণিজ্য ও শিল্প-কৃষি অসাধারণ উন্নতি লাভ করেছে। জাতিবর্ণনির্বিশেষে সকলেই তুল্যভাবে শাসিত এবং পালিত হচ্ছে। মুসলমান শাসনে ব্রাহ্মণ শূদ্রের বিচারে কোনও পার্থক্য নাই। উচ্চ রাজকার্যে হিন্দু-মুসলমান সকলেরই সমান অধিকার। তারপর বিজাপুরের সোলতান, শুধু আমাদের রাজাই নহেন; আমাদের প্রভু এবং অন্নদাতা। আমি, যে রাজার একজন অমাত্যের মধ্যে গণ্য, সেই রাজার বিরুদ্ধাচরণ করা পাপ-মহাপাপ! ধর্ম এ পাপ কখনও সইবে না। এতে কেবল ধ্বংস ও অকীর্তিই আনয়ন করবে।
“প্রবলপ্রতাপ সোলতানের বিরুদ্ধাচরণ করা ছেলেমী এবং পাগলামী মাত্র। হঠাৎ আক্রমণ করে তাঁর দু'চারটি দুর্গ এবং দশ-বিশ খানা গ্রাম দখল করেছ বলে, সম্মূখ সমরে তার পরাক্রান্ত বাহিনীকে কোনও রূপে পরাজিত করতে পারবে, ও রূপ কল্পনা তুমি স্বপ্নেও পোশন করো না।
“সোলতান অত্যন্ত সরলচেতা এবং উদার প্রকৃতির লোক। তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ এবং রক্তপাতের পক্ষপাতী নহেন। তাই আমাকে বিনা যুদ্ধে গোলযোগ মিটাবার জন্য পাঠিয়েছেন। বৎস, যদি তোমার পিতার জীবনকে বিপন্ন না করতে-অধিকন্ত নিজেকেও রক্ষা করতে চাও, তা’ হ’লে সোলতানের বশ্যতা স্বীকার করে, রাজভক্ত প্রজারূপে বাস করাই সর্বদা যুক্তিসঙ্গত। তুমি যেসমস্ত দুর্গ অধিকার করেছ, তুমিই তার অধ্যক্ষ নিযুক্ত থাকবে। এ অপেক্ষা মহামাননীয় সোলতানের নিকট আর কি অনুগ্রহ পেতে চাও? ইহা বাস্তবিক লোকাতীত মহানুভবতা। দেবতারাও ইহার অধিক অনুগ্রহ করতে পারে না।
“প্রিয় শিবা! সোলতান আমার বিলম্ব দেখলে নিশ্চয়ই সন্দিগ্ধ হবেন। তুমি সেনাপতি আফজাল খাঁর নিকটে আগামীকল্য বশ্যতা স্বীকার করলেই, সমস্ত অশান্তি ও গোলযোগ মিটে যায়। এ শুভকার্যে আর বিলম্ব করা উচিত নহে। চিন্তা, করে দেখ-সামান্য অবস্থায় সামান্য বংশে জন্মগ্রহণ করে এবং সামান্য লোক হয়ে বিজাপুরের সম্মনিত সামন্তের মধ্যে গণ্য হওয়া ভাল, কি জনসমাজ কুক্কর তুল্য ঘৃণিত দস্যু অভিহিত হয়ে সর্বদা বন-জঙ্গলে উৎকণ্ঠিতভাবে জীবনযাপন করা ভাল।”
পিতার কথায় শিবাজী ক্ষণকাল নীরব রহিলেন। তারপরে বলিলেন, “বাবা! আপনি যা” বললেন, তা’ উচ্চাকাঙ্খাবিহীন হীনচেতা ব্যক্তিদিগের নিকট নিতান্তই যুক্তিসঙ্গত বটে, যশোলোলুপ রাজ-পদাকাঙ্খী ব্যক্তিদিগের পক্ষে এ উপদেশ গ্রাহ্য হতে পারে না। রাজ্য কাহারও পৈতৃক বা বিধি-নির্দিষ্ট নিজস্ব বস্তু নহে। যে বাহুবলে অধিকার করতে পারে, তারই হয়ে যায়। সুতরাং রাজবিদ্রোহিতা কথাটার কোন মূল্য নাই। বিশেষত, ইহা যে কোনও পাপ কার্যের মধ্যে গণ্য, তা’ আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না।
“পৃথিবীর রাজপদ যখন সর্বশ্রেষ্ঠ পদ, তখন ছলে-বলে কলে-কৌশলে যে কোনও প্রকারে হউক, তা’ লাভ করাই আমার মতে পরম ধর্ম। যখন আমি সেই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছি, তখন আর সোলতানের নিকট বশ্যতা স্বীকার করা আমার পক্ষে অসম্ভব।”
শাহজীঃ বৎস শিবা! তুমি যা’ বললে, তা’ অনেকটা সত্য বটে। কিন্তু তুমি কি বাহুবলে রাজ্য অধিকার করেছ? কিম্বা করতে সমর্থ? তুমি অত্যন্ত ভুল বুঝছ! তুমি যে বৃত্তি অবলম্বন করেছ, তা’ বীরপুরুষ বা রাজকর্মী ব্যক্তির বৃত্তি বলে কদাপি অভিহিত হতে পারে না, পূর্বেই বলেছি, ইহা অতি জঘন্য দস্যুবৃত্তি! দস্যু সকলেরই ঘৃণার পাত্র এবং শূল-দন্ডে বধ্য।
শিবাঃ কিন্তু এই দস্যুবৃত্তি ব্যতীত যখন অন্য কোনও উপায় অভীষ্ট সিদ্ধির সম্ভাবনা নাই, তখন এই দস্যুভাবেই আমাকে উদ্দেশ্য সিদ্ধির জন্য সাধনা করতে হবে। আমি এই কর্তব্য হতে কিছুতেই আর এখন বিচলিত হতে পারি না। আপনি আর বিজাপুরে ফিরে যাবেন না। পর্বত ও অরণ্যসঙ্কুল দুর্গম কঙ্কন প্রদেশের দুর্গে যেয়ে সুখে বাস করুন। আপনার কেহ কেশও স্পর্শ করতে পারবে না। আমি এদিকে ছলে-বলে কলে-কৌশলে যে রূপেই হউক, সোলতানের আধিপত্য নষ্ট করে রাজ্যস্থানের জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করব। যদি কোনও বিপদ ঘটে, তা’ আমার প্রতিই ঘটবে। যদি কিছু অধর্ম হয়, তা আমারই হবে। সে জন্য আপনার কোনও চিন্তা নাই। আপনি আমার আর কোনও কার্যেরই আলোচনা করবেন না।
শিবাজীর কথা শুনিয়া একটু রুষ্ট হইয়া রুক্ষ স্বরে বলিলেন, “কি আশ্চর্য, তোমার পাপ কার্য-মহাপাপ কার্যেরও সমালোচনা করতে পারব না। আমি এমন রাজদ্রোহী দস্যু পুত্রের মুখ দেখতেও ইচ্ছা করি না! তোমার যা’ ইচ্ছা, তাই করতে পার, কিন্তু পরিণামে এই ঔদ্ধতা এবং পাপের জন্য তোমাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে।” এই বলিয়া শাহজী নিতান্ত ক্রুদ্ধ ও বিরক্ত অবস্থায় সেই নির্ভৃত গৃহ ত্যাগ করিয়া চলিয়া গেলেন।
শাহজী নির্ভৃত গৃহ হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেলে, শিবাজী এবং রামদাস স্বামী প্রভৃতি মিলিয়া যে পরামর্শ করিলেন, তাহা যার-পর-নাই ঘৃণিত এবং পাপজনক! আফজাল খাঁকে সহসা আক্রমণ করিয়া বধ করাই তাঁহাদের একমাত্র উদ্দেশ্য! তাঁহাকে বধ করিতে পারিলে, বিজাপুরাধিপের দক্ষিণ হস্ত ভগ্ন হইবে বলিয়া শিবাজীর দৃঢ় বিশ্বাস। কারণ আফজাল খাঁর ন্যায় এরূপ তেজীয়ান এবং মহাবীর সেনাপতি লাভ বহু ভাগ্যের কথা। শিবাজী অনেকবার বলিলেন যে, ‘আফজাল খাঁর ন্যায় বীর পুরুষের সাহায্য পাইলে তিনি দশ বৎসরের মধ্যে সমস্ত দাক্ষিণাত্যে জয়পাতাকা’ উড্ডীন করিতে পারেন।’ এহেন আফজাল খাঁকে কোনও রূপ নিহত করিতে পারিলে, তাঁহার উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ যে অনেকটা নিস্পণ্টক হয়, তদ্বিষয়ে আর কোনও সন্দেহ নাই। সুতরাং আফজাল খাঁকে গুপ্তভাবে হত্যা করিবার জন্য আয়োজন চলিতে লাগিল।
বাকী অংশ পরের পর্বে দেখুন

Thursday, September 29, 2011

নিউজ পোর্টাল, জাতীয় ও আঞ্চলিক সব খবরের লিংক

অনলাইন পত্রিকা / নিউজ এজেন্সি
 বাংলা পত্রিকা
সাপ্তাহিক / পাক্ষিক / মাসিক
আঞ্চলিক সংবাদ
আপনার শহরের নিউজ লিংক যুক্ত করতে আমাদের সাহায্য করুন।

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ