—‘এরোপ্লেন অর্থ উড়োজাহাজ, এরোপ্লেন অর্থ উড়োজাহাজ, এরোপ্লেন অর্থ উড়োজাহাজ’
—‘শিখর, শিখর’।
— জ্বী মা, বলে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় আনন্দের আভা ছড়িয়ে মুখমণ্ডলময়।
—‘তুমি সারাক্ষণ ঐ একটা শব্দ মুখস্থ করছ কেন, বইয়ে কী আর কোনো শব্দ নাই?’
— আছে মা, আরও অনেক শব্দ আছে—বলেই মায়ের কাছ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে বসে একবার বলল, বেড মানে বিছানা। তারপর থেকে আগের মতো বলতে লাগল এরোপ্লেন মানে উড়োজাহাজ। মুখে পড়া চোখে অনাগত স্বপ্ন। সে উড়োজাহাজে করে বাবার কাছে বেড়াতে যাবে। কী মজা হবে, অনেক স্বাদের খাবারগুলো সে প্রাণভরে খেতে পারবে। চোখ বন্ধ করে ঝুলছে আর পড়ছে। পাশের বাড়ির হীরা কয়েকদিন হলো আমেরিকা থেকে এসেছে। কি যে মজার দুইটা চকলেট দিয়েছিল। হীরা বলছিল, এই চকলেট নাকি এরোপ্লেনে অনেক দেয়। যে যত খেতে পারে। কোনো নিষেধ নাই। থাকবেই কেন। ওখানে একটা বড় গোডাউন আছে যেখানে ভরা শুধু চকলেট, জুস আর টক-মিষ্টি আমের আচার।
মা সালমা হাতে ফুলতোলার পিলো কভার আর সুঁই-সুতা নিয়ে তার নয় বছরের ছেলের সামনে দাঁড়ায়। ছেলে মুখে পড়ার শব্দ করে হৃদয়ের বাসনা দু-চোখে ছড়িয়ে বিভোর হয়ে আছে, মায়ের সে কথা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। তাই মা আর শিশুপুত্রকে কল্পনার রাজ্য থেকে বিচ্যুত না করে মৃদু হেসে সরে পড়ে। হাতের নকশি ফুলতোলা অর্ধেকের বেশি করা হয়ে গেছে। ওটা বিছানার ওপর রেখে ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে শেখরের বাবা শামীমের গত পরশু আসা চিঠিটি আবার পড়তে থাকে।
শামীম লিখেছে, সে এ মাসের শেষের দিকে এসে সালমা এবং শেখরকে সৌদি আরবে নিয়ে যাবে। এ কথা শোনার পর থেকে শিশুটি সারাক্ষণ শুধু আরব দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। রাতে ঘুমিয়ে আর দিনের বেলা জেগে জেগে চলে তার স্বপ্ন দেখা। মা সালমার মনেও আলোড়ন জাগে, প্লেনে চড়ে মিষ্টি খেজুরের দেশে যাচ্ছে ভাবলেই মন কেমন পুলকিত হয়ে ওঠে। সেখানে তার মনের মতো স্বামী-সন্তানকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার হবে। যে ঘরটি হবে শুধুই ওদের তিনজনের। স্বামীর সঙ্গে পাগড়ী-জোব্বা পরা এরাবিয়ানদের দেশ ঘুরে দেখবে আর নিজের দেশের সঙ্গে মিলিয়ে আশ্চর্য হয়ে যাবে। ছেলেটার খুবই শখ। সে শখ যে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই পূরণ হতে যাচ্ছে, সেটা ভাবলে বিশেষ এক আনন্দ অনুভব করে অন্তরের মাঝে সে। অসম্পূর্ণ পিলো কভারটি আবার হাতে নিয়ে বসল। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। ওখানে গিয়ে হাতে কাজ করা উপকরণ দিয়ে সোফা, খাট এবং অন্যান্য শৌখিন জিনিস সাজাবে।
দশ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে খুব বেশিদিন কাছে পায়নি সালমা। বিয়ের একমাস পরে আর মাঝে এসে একমাস ছিল, যখন শেখরের বয়স ছিল পাঁচ বছর। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া তাই অপূর্ণই রয়ে গেছে সালমার। সে কারণেই মা-ছেলে উভয়ের সময় পার হয় অনেক আগ্রহের মাঝে। এতদিন এখানে শ্বশুর-শাশুড়ি আর এক ননদকে নিয়ে ছিল তার সংসার। কর্তৃত্ব শাশুড়ির হাতে থাকায় তার সংসারের সুখ বোঝা সম্ভব হয়নি। এতদিন পর সে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। সে আনন্দের বন্যায় ভাসছে দু’জনে।
—‘মা, মা, (স্বপ্ন ভঙ্গ হয় সালমার)—এই খেলনাগুলো ভালো করে ছুটকেসে ঢুকিয়ে রাখ। যত্ন কইরা রাইখো, খুব দামি কিন্তু।’
ছেলের কথা শুনে মা হাসে। এগুলো সেই তাকে কিনে দিয়েছে। আর অবুঝ ছেলে তাকেই দামি বলে যত্ন করতে বলছে। শিশুর আচরণ তো শিশুসুলভই হবে। ছেলেকে আর কী বলবে, সব সময় উত্তেজনায় টানটান হয়ে থাকে সে নিজেই। রাতের খাবার খেয়ে সেদিনের মতো তারা ঘুমিয়ে পড়ে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার পরও মা-ছেলে আলাদা আলাদা রঙিন কল্পনার জাল বুনতে থাকে। শিশু শেখর শত চেষ্টা করেও তার চোখজোড়া মেলে রাখতে পারে না। কিন্তু সালমার চোখের পাতায় যেন ঘুমকুমারী এসে বসতেই চায় না। ঘুমকুমারী যেন শুরু থেকে বলছে, স্বামীর গুরুত্বে বিরহিনী রমণী আরও কিছুক্ষণ নিজেকে ভাবনার বর্ণিল জগতে ভাসিয়ে বেড়াও। এভাবে তন্ময় হয়ে ভাবনার সুযোগ জীবনে আর পাবে না। আরব দেশে গেলে তার কত কাজ, পুরো একটা সংসারের কর্ত্রী সে। স্বামী-সন্তানের দেখভাল খাতির-যত্ন সবই তো নিজের হাতে করতে হবে তাকে।
এমনি ভাবতে ভাবতে অলক্ষ্যে ঘুমকুমারী এসে তাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিল। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘুমের মাঝে স্বপনদ্বারে স্বামী শামীমকে সে খুঁজে পেল না। কারণ, মানুষের ঘুম যখন গভীর হয়, স্বপ্নরানী তখন তার বিচিত্রতার ডালা সাজিয়ে বসতে পারে না।
সকালে ফুরফুরে মেজাজে ঘুম থেকে জাগল সালমা ও শিশুপুত্র শেখর। শেখর মাকে প্রশ্ন করে—
—‘মা আজকে কয় তারিখ? এরোপ্লেনে উঠতে আমাদের আর কয়দিন বাকি?’
মা লাজুক হাসি হেসে বলে—
—‘পাগল ছেলে, ঘুম থেকে জেগেই এই প্রশ্ন। এই তো আর মাত্র ক’টা দিন তারপর আমরা তোমার স্বপ্নের উড়োজাহাজে চড়ে আরব দেশে চলে যাব। এবার বিছানা ছেড়ে ওঠো। দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ইংরেজি বইটি নিয়ে পড়তে বস।’
বাধ্য ছেলের মতো এক লাফে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে মায়ের নির্দেশ পালন করতে লেগে গেল। সালমা ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে। সত্যি আমি ভাগ্যবতী, শেখরের মতো সন্তান আর শামীমের মতো স্বামী পেয়েছি। তার শ্বশুরবাড়ির ভাগ্য অত্যন্ত অনুকূল। একমাত্র ননদ সুরী আর শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে মফস্বলে শামীমের পৈতৃক ভিটায়ই তার শান্ত, স্নিগ্ধ দীঘির মতো একটি সংসার। তারপরও এ সংসারটি ছেড়ে সে আপন ভুবনে যেতে চায়। হাজার চেষ্টা করেও এটাকে তার নিজের সংসার মনে হয় না। সর্বত্র শাশুড়ির কর্তৃত্ব বিরাজমান। রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো, সাজ-গোজ ঘর সাজানো, কোনো কিছুই নিজের মতো করে হয় না। যেটা এখন আরব দেশে গিয়ে বাস্তবায়িত হবে।
ইদানীং কি যে হয়েছে বোঝে না সে, শামীমের কথা মনে হলেই তার শরীরের পঞ্চইন্দ্রিয় জেগে প্রতিটি লোমকূপের গোড়ায় শিহরণ লেগে, ওগুলো সতেজ হয়ে ওঠে। মনে হয় এখনই যেন শামীমের মধুর স্পর্শ ওর সারা শরীরে মেখে দিয়ে শান্ত দীঘিতে হঠাত্ অশান্ত তরঙ্গ উঠিয়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে নিবৃত্ত করে। চঞ্চল-চপলা দুষ্টু কিশোরীর মতো তার নিজের শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছে। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে সে একান্ত আপন করে কাছে পেয়েছে ৪০/৪৫ দিনের বেশি হবে না। সে কারণেই তার হৃদয় ও মন বড়ই অস্থির, অশান্ত। কিন্তু বাইরে তার কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই। অপরূপ সুন্দরী সালমা তার মায়াবী মুখমণ্ডলে এমনি একটা স্নিগ্ধতা মিশিয়ে রাখে যেন মনে হবে ও কিছুই বোঝে না। হঠাত্ গগন কাঁপিয়ে একটি উড়োজাহাজ সাঁই করে উড়ে গেল। উড়োজাহাজের সঙ্গে সঙ্গে শেখরও ছুটে আসে, ‘দ্যাখো মা, ওই যে উড়োজাহাজ যাচ্ছে। আমরা ওই জাহাজে করেই বাবার কাছে যাব। কী মজা হবে।’
আনন্দ-উত্তেজনায় বুঝতেই পারে না যে তার দাদী এসে দাঁড়িয়েছে খুব নিকটে—‘কি রে কবে তোর বাবার কাছে যাবি এই খুশিতে অহন থাইক্কাই লাফাইতাছ। তগোতো মজাই হবে। গিয়া তর বাপেরে কইস আমাগোও যেন বিদেশে লইয়া যায়। আমরা নাইলে চলমু কেমনে।’ —‘এই যে বউমা, তোমার দশাও দেখতাছি শেখরের মতো হইছে। হাতে-পায়ে মেন্দি দিয়া বইয়া রইলা ক্যা। সকালের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে হইব না? নাকি শুধু মা-ব্যাটা মিল্লা খুশিতে লাফাইলেই চলব?’ শাশুড়ি সালমার পাশে বসে গলার স্বর নরম-মোলায়েম করে বউয়ের মাথায় একটি হাত রেখে বলল,—‘না যাও আমার নাতিরে ভালো কইরা এরোপ্লেন দেখাইও। ওর এরোপ্লেনে চড়তে খুব বেশি শখ। ছোটবেলা থাইক্কা হেই ২ বছর বয়স যখন, প্লেন উইড়া গেলেই সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইত আর খট খট কইরা হাসত। তোমার মনে নাই বউমা। হেইলইগ্গাই কই ওরে ঘুরাইয়া-ঘুরাইয়া ভালো কইরা উড়োজাহাজের ঘরগুলান দেখাইও।
—‘আচ্ছা আম্মা আপনে চিন্তা করবেন না। আমার সব মনে আছে।’
প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় দুইবার ফোন করে শামীম, আজ সকালে আর ফোন এলো না। ভীষণ অভিমান হয় সরলা-সুন্দরী স্বামী সোহাগী এই রমণীর। ও জানে ফোন না পেলে আমার জগত্ বিষাদময় হয়ে যায়, তারপরও ব্যস্ততা দেখাল। আগে গিয়ে নেই তারপর দেখব কী এতো ব্যস্ততা। মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকেই কষ্ট দেয় সবচেয়ে বেশি। অথবা যে বেশি ভালোবাসা দেয়, সংসারে তাকেই বঞ্চিত করে সবচেয়ে বেশি। তারপরও সর্বাঙ্গে তার সোহাগ মাখার প্রত্যাশার পুলক হৃদয় ছেড়ে যায় না। সারাদিন কাজের মাঝে ডুবে থেকে সন্ধ্যার ফোনের অপেক্ষা করে। অবশেষে ফোন এলো নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে একটু পরে। সে কষ্ট পুষিয়ে দিয়েছে শামীম হাজার মাইল দূর থেকে মধুর ভালোবাসা আর আদরে ভরে দিয়েছে সালমাকে। হাওয়ার তরঙ্গ থেকে নয়, বাস্তবে ওই রক্ত-মাংসের মানুষটিকে স্পর্শ করার তীব্র বাসনা জাগে তার।
শামীমের দীর্ঘদিনের মালিকটি হঠাত্ মারা গেল। সংসারে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। ভদ্রলোকের তিন স্ত্রী আর সন্তানাদি সহায়-সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়েও কাড়াকাড়ি করে। নেই প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, বেতনভাতার ধারাবাহিকতা। দীর্ঘ পাঁচটি বছর ধরে আবরার নামক এ শিল্পপতির ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে নিয়োজিত আছে। মালিকই বলেছিলেন, সুযোগ-সুবিধাও সব করে দিয়েছেন যে, তোমার বউ-ছেলেকে এ দেশে নিয়া আস। নারীঘটিত ত্রুটি ছাড়া আর সবদিক দিয়েই ভালো ছিল মালিকটা। সমস্যা হয়েছে, তিন নম্বর স্ত্রীকে বিয়ে করেছে মাত্র ২ বছর হলো। বিয়ের দিন থেকে মালিকের তৃতীয় স্ত্রীর দৃষ্টি পড়ে ছিল বাংলাদেশী ছেলে শামীমের প্রতি। এ বিষয়টিতে সে খুবই অস্বস্তির মধ্যে থাকত। সে সব সময় চাইত নতুন স্ত্রী লায়লাকে এড়িয়ে চলতে, কিন্তু সম্ভব হতো না। চাকরি করলে মালিকের সোহাগী স্ত্রীর অন্যায়-আবদার তাকে মেটাতেই হবে। এবার যখন স্বয়ং গৃহকর্তাই পরপারে চলে গেছেন, এখন আর লায়লাকে কিছুতেই দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে সঙ্গে আবরার প্রথম দুই স্ত্রীও শামীমের প্রতি নিষিদ্ধ দৃষ্টি বিদ্ধ করেছে।
এক পুরুষের প্রতি তিন বিধবার যৌন লালসায় অস্থির ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে শামীম। এদিকে সালমা ও শেখর অপেক্ষায় আছে এ মাসের শেষে তার কাছে এসে সুখের ঘর সাজাবে। সবই ঠিক ছিল, শুধু মধ্যখান থেকে বৃদ্ধ মালিকটার প্রাণ বিয়োগই সব লালিত স্বপ্নের অবসান ঘটাল। তার এত দুরবস্থার কথা নিজ দেশে অপেক্ষমাণ স্ত্রী-পুত্রকে জানাতে তার মোটেই ইচ্ছা হয় না। বিশেষত সে তার স্ত্রী-সন্তানকে খুবই ভালোবাসে। হাজার মাইল দূরে অবস্থিত তার ছোট ছেলেটি যে এরোপ্লেনে ওঠার স্বপ্নে বিভোর, এ কথাও তার জানা। মৃত আবরারের প্রথম স্ত্রী শপিংমলে কোনোকিছু কেনার নাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কফি হাউজে, মেঝ গিন্নি বিয়ে বাড়িতে নেয়ার জন্য বায়না ধরে। আর লায়লা অপেক্ষা করে বাসাটি কখন নিরিবিলি হবে। কখন শামীমকে হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়া যাবে, নিজের ইচ্ছা পূরণের নিমিত্তে।
—‘শামীম চল বাইরে যাব’—বলল লায়লা।
—‘কোথায় যাব ম্যাডাম?’
—‘গাড়িতে ওঠো বলছি,’ বলেই গাড়ির পেছনের সিটের নির্ধারিত স্থানে বসে পড়ল লায়লা। গাড়িটি যখন চলা শুরু করল লায়লা বলল, ‘গিরাম পাহাড়ের কাছে যাও।’
সময় তখন মধ্যাহ্ন, চমকে উঠল শামীম, সে তো অনেক দূর, যেতে যেতেই রাত হয়ে যাবে, ফিরে আসতে অনেক রাত। একথা বলার পর লায়লা বলে, সে তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি তোমাকে যা বলেছি তাই কর। ভয়ে গা ছমছম করছে শামীমের, গিরাম পাহাড়ের পাদদেশ হচ্ছে জনমানবশূন্য একটি স্থান। অনৈতিক কাজ করার জন্য অনেকেই ওই স্থানটিকে বেছে নেয়। আবছা আলোয় গাড়ি থেকে নেমে লায়লা শামীমকে ইশারা করে ডাকল নিজের পাশে বসার জন্য। শামীম বসল তার পাশে। ভয়ে বুকের ভেতরটা দুরু দুরু কাঁপছে। যেদিকে তাকায় শুধু ধুলোর পাহাড় আর বিস্তীর্ণ বালুর প্রান্তর। লায়লা আরও একটু সরে এসে শামীমের গা-ঘেঁষে বসল। একহাত পেছনের দিক দিয়ে সজোরে চাপ দিচ্ছে নিজের কাছে নেয়ার জন্য। শামীম কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল। হঠাত্ তার শরীর আবৃত করা উপরের আবরণটি পুরোপুরি অনাবৃত করে ফেলে, ভেতরে খুবই সামান্য কিছু দিয়ে স্পর্শকাতর স্থানগুলো হাল্কাভাবে ঢাকা।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই শামীমকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বালির আস্তরে শুইয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। অনাবৃত দু’টি শরীরে হঠাত্ গাড়ির সার্চলাইটের আলোয় ঝলকিত হয়ে ওঠে এলাকা। গাড়ি থেকে নেমে আসে মালিকের বড় ছেলে। সেও গোপনীয় উদ্দেশ্য নিয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ফিলিপিনো সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে দৈহিক সুধা ভোগ করার বাসনায় এই নিরিবিলি স্থানে এসেছে। গাড়িতে বসা ফিলিপিনো নারী আর মালিক পুত্রের সামনে মাথা নত অবস্থায় লায়লা ও শামীম। আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো শামীম ও লায়লাকে। অবশেষে লায়লা নিজেকে রক্ষা করতে বলল, জোর করে শামীম তাকে ওই জনমানবশূন্য নিরিবিলি পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে তার শ্লীলতাহরণ করেছে। অবশেষে জেনা করার অপরাধে অ্যারাবিয়ান আইন অনুসারে এক শুক্রবার দেখে তার গর্দান কেটে নিল নিষ্ঠুর জল্লাদ। জল্লাদের এক কোপে তার দেহ থেকে শির বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঝেতে পড়ল রক্তাক্ত অবস্থায় কিছুক্ষণ কেঁপে কেঁপে চিরদিনের মতো অসাড় হয়ে গেল, শির ও দেহ।
মৃত্যুর আগে সে মালিক পুত্রের কাছে আবেদন করেছিল, তার লাশ যেন গ্রামে তার পরিবার-পরিজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যুর পর অন্তত নিজ দেশের মাটিতে পবিত্রতার সঙ্গে যেন একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারে। মৃত্যুর কারণ জানতে পারলে হয়তো সালমা তাকে ঘৃণা করবে, অভিশাপ দেবে। কিন্তু বিধাতা তো জানে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। যে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ ছিল না। সে নিজেও অন্তত টেলিফোনের মাধ্যমে সত্যি বিষয়টি সালমাকে জানাতে পারত। কিন্তু সাহস হয়নি। কারণ, অত দূর থেকে এমন একটি জটিল বিষয়ের খুঁটিনাটি বোঝানো সম্ভব ছিল না। আর ঘটনাগুলো এতটাই দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এটা বুঝতে পেরেছিল যে, স্ত্রী-পুত্র ও পরিবার-পরিজনদের দৈনন্দিন জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার জন্য সাত-সমুদ্র পার হয়ে যে নিষ্ঠুর দানবদের দেশে সে গেছে, তাদের কঠোর আইনের বলি হওয়া থেকে তার পরিত্রাণ নেই।
মাস শেষ হওয়ার দু’দিন আগে হঠাত্ সন্ধ্যায় একটি ফোন আসে সালমার কাছে। বলা হয়, আগামীকাল সন্ধ্যায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসার জন্য। তাকে একটি কফিন গ্রহণ করতে হবে। ছেলে শেখরকে সালমা কিছুই বলল না। ঢাকা এসেই দেখল, মা-দাদী-দাদা সবাই একটি নির্দিষ্ট এরোপ্লেনের অপেক্ষায় আছে। এয়ারপোর্টে আসার পর মূল ঘটনাটি জানার পর সালমা ও তার শাশুড়ি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। শোকে মুহ্যমান হয়ে দিশাহীন হয়ে পড়েন দু’জনেই। অগত্যা শামীমের হতভাগ্য পিতা সন্তানের লাশের গ্রহীতা হন।
—‘শিখর, শিখর’।
— জ্বী মা, বলে মায়ের সামনে এসে দাঁড়ায় আনন্দের আভা ছড়িয়ে মুখমণ্ডলময়।
—‘তুমি সারাক্ষণ ঐ একটা শব্দ মুখস্থ করছ কেন, বইয়ে কী আর কোনো শব্দ নাই?’
— আছে মা, আরও অনেক শব্দ আছে—বলেই মায়ের কাছ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে বসে একবার বলল, বেড মানে বিছানা। তারপর থেকে আগের মতো বলতে লাগল এরোপ্লেন মানে উড়োজাহাজ। মুখে পড়া চোখে অনাগত স্বপ্ন। সে উড়োজাহাজে করে বাবার কাছে বেড়াতে যাবে। কী মজা হবে, অনেক স্বাদের খাবারগুলো সে প্রাণভরে খেতে পারবে। চোখ বন্ধ করে ঝুলছে আর পড়ছে। পাশের বাড়ির হীরা কয়েকদিন হলো আমেরিকা থেকে এসেছে। কি যে মজার দুইটা চকলেট দিয়েছিল। হীরা বলছিল, এই চকলেট নাকি এরোপ্লেনে অনেক দেয়। যে যত খেতে পারে। কোনো নিষেধ নাই। থাকবেই কেন। ওখানে একটা বড় গোডাউন আছে যেখানে ভরা শুধু চকলেট, জুস আর টক-মিষ্টি আমের আচার।
মা সালমা হাতে ফুলতোলার পিলো কভার আর সুঁই-সুতা নিয়ে তার নয় বছরের ছেলের সামনে দাঁড়ায়। ছেলে মুখে পড়ার শব্দ করে হৃদয়ের বাসনা দু-চোখে ছড়িয়ে বিভোর হয়ে আছে, মায়ের সে কথা বুঝতে মোটেই কষ্ট হয় না। তাই মা আর শিশুপুত্রকে কল্পনার রাজ্য থেকে বিচ্যুত না করে মৃদু হেসে সরে পড়ে। হাতের নকশি ফুলতোলা অর্ধেকের বেশি করা হয়ে গেছে। ওটা বিছানার ওপর রেখে ওয়ারড্রবের ড্রয়ার খুলে শেখরের বাবা শামীমের গত পরশু আসা চিঠিটি আবার পড়তে থাকে।
শামীম লিখেছে, সে এ মাসের শেষের দিকে এসে সালমা এবং শেখরকে সৌদি আরবে নিয়ে যাবে। এ কথা শোনার পর থেকে শিশুটি সারাক্ষণ শুধু আরব দেশে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে। রাতে ঘুমিয়ে আর দিনের বেলা জেগে জেগে চলে তার স্বপ্ন দেখা। মা সালমার মনেও আলোড়ন জাগে, প্লেনে চড়ে মিষ্টি খেজুরের দেশে যাচ্ছে ভাবলেই মন কেমন পুলকিত হয়ে ওঠে। সেখানে তার মনের মতো স্বামী-সন্তানকে নিয়ে ছোট্ট একটি সংসার হবে। যে ঘরটি হবে শুধুই ওদের তিনজনের। স্বামীর সঙ্গে পাগড়ী-জোব্বা পরা এরাবিয়ানদের দেশ ঘুরে দেখবে আর নিজের দেশের সঙ্গে মিলিয়ে আশ্চর্য হয়ে যাবে। ছেলেটার খুবই শখ। সে শখ যে মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই পূরণ হতে যাচ্ছে, সেটা ভাবলে বিশেষ এক আনন্দ অনুভব করে অন্তরের মাঝে সে। অসম্পূর্ণ পিলো কভারটি আবার হাতে নিয়ে বসল। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে। ওখানে গিয়ে হাতে কাজ করা উপকরণ দিয়ে সোফা, খাট এবং অন্যান্য শৌখিন জিনিস সাজাবে।
দশ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে খুব বেশিদিন কাছে পায়নি সালমা। বিয়ের একমাস পরে আর মাঝে এসে একমাস ছিল, যখন শেখরের বয়স ছিল পাঁচ বছর। জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া তাই অপূর্ণই রয়ে গেছে সালমার। সে কারণেই মা-ছেলে উভয়ের সময় পার হয় অনেক আগ্রহের মাঝে। এতদিন এখানে শ্বশুর-শাশুড়ি আর এক ননদকে নিয়ে ছিল তার সংসার। কর্তৃত্ব শাশুড়ির হাতে থাকায় তার সংসারের সুখ বোঝা সম্ভব হয়নি। এতদিন পর সে দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে। সে আনন্দের বন্যায় ভাসছে দু’জনে।
—‘মা, মা, (স্বপ্ন ভঙ্গ হয় সালমার)—এই খেলনাগুলো ভালো করে ছুটকেসে ঢুকিয়ে রাখ। যত্ন কইরা রাইখো, খুব দামি কিন্তু।’
ছেলের কথা শুনে মা হাসে। এগুলো সেই তাকে কিনে দিয়েছে। আর অবুঝ ছেলে তাকেই দামি বলে যত্ন করতে বলছে। শিশুর আচরণ তো শিশুসুলভই হবে। ছেলেকে আর কী বলবে, সব সময় উত্তেজনায় টানটান হয়ে থাকে সে নিজেই। রাতের খাবার খেয়ে সেদিনের মতো তারা ঘুমিয়ে পড়ে। বিছানায় গা এলিয়ে দেয়ার পরও মা-ছেলে আলাদা আলাদা রঙিন কল্পনার জাল বুনতে থাকে। শিশু শেখর শত চেষ্টা করেও তার চোখজোড়া মেলে রাখতে পারে না। কিন্তু সালমার চোখের পাতায় যেন ঘুমকুমারী এসে বসতেই চায় না। ঘুমকুমারী যেন শুরু থেকে বলছে, স্বামীর গুরুত্বে বিরহিনী রমণী আরও কিছুক্ষণ নিজেকে ভাবনার বর্ণিল জগতে ভাসিয়ে বেড়াও। এভাবে তন্ময় হয়ে ভাবনার সুযোগ জীবনে আর পাবে না। আরব দেশে গেলে তার কত কাজ, পুরো একটা সংসারের কর্ত্রী সে। স্বামী-সন্তানের দেখভাল খাতির-যত্ন সবই তো নিজের হাতে করতে হবে তাকে।
এমনি ভাবতে ভাবতে অলক্ষ্যে ঘুমকুমারী এসে তাকে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন করে দিল। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঘুমের মাঝে স্বপনদ্বারে স্বামী শামীমকে সে খুঁজে পেল না। কারণ, মানুষের ঘুম যখন গভীর হয়, স্বপ্নরানী তখন তার বিচিত্রতার ডালা সাজিয়ে বসতে পারে না।
সকালে ফুরফুরে মেজাজে ঘুম থেকে জাগল সালমা ও শিশুপুত্র শেখর। শেখর মাকে প্রশ্ন করে—
—‘মা আজকে কয় তারিখ? এরোপ্লেনে উঠতে আমাদের আর কয়দিন বাকি?’
মা লাজুক হাসি হেসে বলে—
—‘পাগল ছেলে, ঘুম থেকে জেগেই এই প্রশ্ন। এই তো আর মাত্র ক’টা দিন তারপর আমরা তোমার স্বপ্নের উড়োজাহাজে চড়ে আরব দেশে চলে যাব। এবার বিছানা ছেড়ে ওঠো। দাঁত মেজে মুখ ধুয়ে ইংরেজি বইটি নিয়ে পড়তে বস।’
বাধ্য ছেলের মতো এক লাফে বিছানা থেকে লাফিয়ে নেমে মায়ের নির্দেশ পালন করতে লেগে গেল। সালমা ছেলের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর ভাবে। সত্যি আমি ভাগ্যবতী, শেখরের মতো সন্তান আর শামীমের মতো স্বামী পেয়েছি। তার শ্বশুরবাড়ির ভাগ্য অত্যন্ত অনুকূল। একমাত্র ননদ সুরী আর শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে মফস্বলে শামীমের পৈতৃক ভিটায়ই তার শান্ত, স্নিগ্ধ দীঘির মতো একটি সংসার। তারপরও এ সংসারটি ছেড়ে সে আপন ভুবনে যেতে চায়। হাজার চেষ্টা করেও এটাকে তার নিজের সংসার মনে হয় না। সর্বত্র শাশুড়ির কর্তৃত্ব বিরাজমান। রান্নাবান্না খাওয়া-দাওয়া, বেড়ানো, সাজ-গোজ ঘর সাজানো, কোনো কিছুই নিজের মতো করে হয় না। যেটা এখন আরব দেশে গিয়ে বাস্তবায়িত হবে।
ইদানীং কি যে হয়েছে বোঝে না সে, শামীমের কথা মনে হলেই তার শরীরের পঞ্চইন্দ্রিয় জেগে প্রতিটি লোমকূপের গোড়ায় শিহরণ লেগে, ওগুলো সতেজ হয়ে ওঠে। মনে হয় এখনই যেন শামীমের মধুর স্পর্শ ওর সারা শরীরে মেখে দিয়ে শান্ত দীঘিতে হঠাত্ অশান্ত তরঙ্গ উঠিয়ে দিয়েছে। অনেক কষ্টে সে নিজেকে নিবৃত্ত করে। চঞ্চল-চপলা দুষ্টু কিশোরীর মতো তার নিজের শরীর ও মনকে নিয়ন্ত্রণ আনতে হয়েছে। দশ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে সে একান্ত আপন করে কাছে পেয়েছে ৪০/৪৫ দিনের বেশি হবে না। সে কারণেই তার হৃদয় ও মন বড়ই অস্থির, অশান্ত। কিন্তু বাইরে তার কোনো বহিঃপ্রকাশ নেই। অপরূপ সুন্দরী সালমা তার মায়াবী মুখমণ্ডলে এমনি একটা স্নিগ্ধতা মিশিয়ে রাখে যেন মনে হবে ও কিছুই বোঝে না। হঠাত্ গগন কাঁপিয়ে একটি উড়োজাহাজ সাঁই করে উড়ে গেল। উড়োজাহাজের সঙ্গে সঙ্গে শেখরও ছুটে আসে, ‘দ্যাখো মা, ওই যে উড়োজাহাজ যাচ্ছে। আমরা ওই জাহাজে করেই বাবার কাছে যাব। কী মজা হবে।’
আনন্দ-উত্তেজনায় বুঝতেই পারে না যে তার দাদী এসে দাঁড়িয়েছে খুব নিকটে—‘কি রে কবে তোর বাবার কাছে যাবি এই খুশিতে অহন থাইক্কাই লাফাইতাছ। তগোতো মজাই হবে। গিয়া তর বাপেরে কইস আমাগোও যেন বিদেশে লইয়া যায়। আমরা নাইলে চলমু কেমনে।’ —‘এই যে বউমা, তোমার দশাও দেখতাছি শেখরের মতো হইছে। হাতে-পায়ে মেন্দি দিয়া বইয়া রইলা ক্যা। সকালের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করতে হইব না? নাকি শুধু মা-ব্যাটা মিল্লা খুশিতে লাফাইলেই চলব?’ শাশুড়ি সালমার পাশে বসে গলার স্বর নরম-মোলায়েম করে বউয়ের মাথায় একটি হাত রেখে বলল,—‘না যাও আমার নাতিরে ভালো কইরা এরোপ্লেন দেখাইও। ওর এরোপ্লেনে চড়তে খুব বেশি শখ। ছোটবেলা থাইক্কা হেই ২ বছর বয়স যখন, প্লেন উইড়া গেলেই সঙ্গে সঙ্গে দৌড়াইত আর খট খট কইরা হাসত। তোমার মনে নাই বউমা। হেইলইগ্গাই কই ওরে ঘুরাইয়া-ঘুরাইয়া ভালো কইরা উড়োজাহাজের ঘরগুলান দেখাইও।
—‘আচ্ছা আম্মা আপনে চিন্তা করবেন না। আমার সব মনে আছে।’
প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় দুইবার ফোন করে শামীম, আজ সকালে আর ফোন এলো না। ভীষণ অভিমান হয় সরলা-সুন্দরী স্বামী সোহাগী এই রমণীর। ও জানে ফোন না পেলে আমার জগত্ বিষাদময় হয়ে যায়, তারপরও ব্যস্ততা দেখাল। আগে গিয়ে নেই তারপর দেখব কী এতো ব্যস্ততা। মানুষ যাকে ভালোবাসে, তাকেই কষ্ট দেয় সবচেয়ে বেশি। অথবা যে বেশি ভালোবাসা দেয়, সংসারে তাকেই বঞ্চিত করে সবচেয়ে বেশি। তারপরও সর্বাঙ্গে তার সোহাগ মাখার প্রত্যাশার পুলক হৃদয় ছেড়ে যায় না। সারাদিন কাজের মাঝে ডুবে থেকে সন্ধ্যার ফোনের অপেক্ষা করে। অবশেষে ফোন এলো নির্দিষ্ট সময়ের চেয়ে একটু পরে। সে কষ্ট পুষিয়ে দিয়েছে শামীম হাজার মাইল দূর থেকে মধুর ভালোবাসা আর আদরে ভরে দিয়েছে সালমাকে। হাওয়ার তরঙ্গ থেকে নয়, বাস্তবে ওই রক্ত-মাংসের মানুষটিকে স্পর্শ করার তীব্র বাসনা জাগে তার।
শামীমের দীর্ঘদিনের মালিকটি হঠাত্ মারা গেল। সংসারে শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। ভদ্রলোকের তিন স্ত্রী আর সন্তানাদি সহায়-সম্পত্তির সঙ্গে সঙ্গে তাকে নিয়েও কাড়াকাড়ি করে। নেই প্রশাসনিক শৃঙ্খলা, বেতনভাতার ধারাবাহিকতা। দীর্ঘ পাঁচটি বছর ধরে আবরার নামক এ শিল্পপতির ব্যক্তিগত গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে নিয়োজিত আছে। মালিকই বলেছিলেন, সুযোগ-সুবিধাও সব করে দিয়েছেন যে, তোমার বউ-ছেলেকে এ দেশে নিয়া আস। নারীঘটিত ত্রুটি ছাড়া আর সবদিক দিয়েই ভালো ছিল মালিকটা। সমস্যা হয়েছে, তিন নম্বর স্ত্রীকে বিয়ে করেছে মাত্র ২ বছর হলো। বিয়ের দিন থেকে মালিকের তৃতীয় স্ত্রীর দৃষ্টি পড়ে ছিল বাংলাদেশী ছেলে শামীমের প্রতি। এ বিষয়টিতে সে খুবই অস্বস্তির মধ্যে থাকত। সে সব সময় চাইত নতুন স্ত্রী লায়লাকে এড়িয়ে চলতে, কিন্তু সম্ভব হতো না। চাকরি করলে মালিকের সোহাগী স্ত্রীর অন্যায়-আবদার তাকে মেটাতেই হবে। এবার যখন স্বয়ং গৃহকর্তাই পরপারে চলে গেছেন, এখন আর লায়লাকে কিছুতেই দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। এর সঙ্গে সঙ্গে আবরার প্রথম দুই স্ত্রীও শামীমের প্রতি নিষিদ্ধ দৃষ্টি বিদ্ধ করেছে।
এক পুরুষের প্রতি তিন বিধবার যৌন লালসায় অস্থির ঘোরপ্যাঁচের মধ্যে পড়ে শামীম। এদিকে সালমা ও শেখর অপেক্ষায় আছে এ মাসের শেষে তার কাছে এসে সুখের ঘর সাজাবে। সবই ঠিক ছিল, শুধু মধ্যখান থেকে বৃদ্ধ মালিকটার প্রাণ বিয়োগই সব লালিত স্বপ্নের অবসান ঘটাল। তার এত দুরবস্থার কথা নিজ দেশে অপেক্ষমাণ স্ত্রী-পুত্রকে জানাতে তার মোটেই ইচ্ছা হয় না। বিশেষত সে তার স্ত্রী-সন্তানকে খুবই ভালোবাসে। হাজার মাইল দূরে অবস্থিত তার ছোট ছেলেটি যে এরোপ্লেনে ওঠার স্বপ্নে বিভোর, এ কথাও তার জানা। মৃত আবরারের প্রথম স্ত্রী শপিংমলে কোনোকিছু কেনার নাম করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রাখে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কফি হাউজে, মেঝ গিন্নি বিয়ে বাড়িতে নেয়ার জন্য বায়না ধরে। আর লায়লা অপেক্ষা করে বাসাটি কখন নিরিবিলি হবে। কখন শামীমকে হাতের মুঠোর মধ্যে পাওয়া যাবে, নিজের ইচ্ছা পূরণের নিমিত্তে।
—‘শামীম চল বাইরে যাব’—বলল লায়লা।
—‘কোথায় যাব ম্যাডাম?’
—‘গাড়িতে ওঠো বলছি,’ বলেই গাড়ির পেছনের সিটের নির্ধারিত স্থানে বসে পড়ল লায়লা। গাড়িটি যখন চলা শুরু করল লায়লা বলল, ‘গিরাম পাহাড়ের কাছে যাও।’
সময় তখন মধ্যাহ্ন, চমকে উঠল শামীম, সে তো অনেক দূর, যেতে যেতেই রাত হয়ে যাবে, ফিরে আসতে অনেক রাত। একথা বলার পর লায়লা বলে, সে তোমাকে ভাবতে হবে না, আমি তোমাকে যা বলেছি তাই কর। ভয়ে গা ছমছম করছে শামীমের, গিরাম পাহাড়ের পাদদেশ হচ্ছে জনমানবশূন্য একটি স্থান। অনৈতিক কাজ করার জন্য অনেকেই ওই স্থানটিকে বেছে নেয়। আবছা আলোয় গাড়ি থেকে নেমে লায়লা শামীমকে ইশারা করে ডাকল নিজের পাশে বসার জন্য। শামীম বসল তার পাশে। ভয়ে বুকের ভেতরটা দুরু দুরু কাঁপছে। যেদিকে তাকায় শুধু ধুলোর পাহাড় আর বিস্তীর্ণ বালুর প্রান্তর। লায়লা আরও একটু সরে এসে শামীমের গা-ঘেঁষে বসল। একহাত পেছনের দিক দিয়ে সজোরে চাপ দিচ্ছে নিজের কাছে নেয়ার জন্য। শামীম কাঠের পুতুলের মতো শক্ত হয়ে বসে রইল। হঠাত্ তার শরীর আবৃত করা উপরের আবরণটি পুরোপুরি অনাবৃত করে ফেলে, ভেতরে খুবই সামান্য কিছু দিয়ে স্পর্শকাতর স্থানগুলো হাল্কাভাবে ঢাকা।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই শামীমকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে বালির আস্তরে শুইয়ে অনৈতিক কাজে বাধ্য করে। অনাবৃত দু’টি শরীরে হঠাত্ গাড়ির সার্চলাইটের আলোয় ঝলকিত হয়ে ওঠে এলাকা। গাড়ি থেকে নেমে আসে মালিকের বড় ছেলে। সেও গোপনীয় উদ্দেশ্য নিয়ে সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত ফিলিপিনো সুন্দরী যুবতীকে নিয়ে দৈহিক সুধা ভোগ করার বাসনায় এই নিরিবিলি স্থানে এসেছে। গাড়িতে বসা ফিলিপিনো নারী আর মালিক পুত্রের সামনে মাথা নত অবস্থায় লায়লা ও শামীম। আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হলো শামীম ও লায়লাকে। অবশেষে লায়লা নিজেকে রক্ষা করতে বলল, জোর করে শামীম তাকে ওই জনমানবশূন্য নিরিবিলি পাহাড়ের পাদদেশে নিয়ে তার শ্লীলতাহরণ করেছে। অবশেষে জেনা করার অপরাধে অ্যারাবিয়ান আইন অনুসারে এক শুক্রবার দেখে তার গর্দান কেটে নিল নিষ্ঠুর জল্লাদ। জল্লাদের এক কোপে তার দেহ থেকে শির বিচ্ছিন্ন হয়ে মেঝেতে পড়ল রক্তাক্ত অবস্থায় কিছুক্ষণ কেঁপে কেঁপে চিরদিনের মতো অসাড় হয়ে গেল, শির ও দেহ।
মৃত্যুর আগে সে মালিক পুত্রের কাছে আবেদন করেছিল, তার লাশ যেন গ্রামে তার পরিবার-পরিজনদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যুর পর অন্তত নিজ দেশের মাটিতে পবিত্রতার সঙ্গে যেন একটু শান্তিতে ঘুমাতে পারে। মৃত্যুর কারণ জানতে পারলে হয়তো সালমা তাকে ঘৃণা করবে, অভিশাপ দেবে। কিন্তু বিধাতা তো জানে তাকে বাধ্য করা হয়েছিল। যে অবস্থা থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ ছিল না। সে নিজেও অন্তত টেলিফোনের মাধ্যমে সত্যি বিষয়টি সালমাকে জানাতে পারত। কিন্তু সাহস হয়নি। কারণ, অত দূর থেকে এমন একটি জটিল বিষয়ের খুঁটিনাটি বোঝানো সম্ভব ছিল না। আর ঘটনাগুলো এতটাই দ্রুত ঘটে গিয়েছিল যে, সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। এটা বুঝতে পেরেছিল যে, স্ত্রী-পুত্র ও পরিবার-পরিজনদের দৈনন্দিন জীবন স্বাচ্ছন্দ্যময় করে তোলার জন্য সাত-সমুদ্র পার হয়ে যে নিষ্ঠুর দানবদের দেশে সে গেছে, তাদের কঠোর আইনের বলি হওয়া থেকে তার পরিত্রাণ নেই।
মাস শেষ হওয়ার দু’দিন আগে হঠাত্ সন্ধ্যায় একটি ফোন আসে সালমার কাছে। বলা হয়, আগামীকাল সন্ধ্যায় ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসার জন্য। তাকে একটি কফিন গ্রহণ করতে হবে। ছেলে শেখরকে সালমা কিছুই বলল না। ঢাকা এসেই দেখল, মা-দাদী-দাদা সবাই একটি নির্দিষ্ট এরোপ্লেনের অপেক্ষায় আছে। এয়ারপোর্টে আসার পর মূল ঘটনাটি জানার পর সালমা ও তার শাশুড়ি অজ্ঞান হয়ে মাটিতে পড়ে যান। শোকে মুহ্যমান হয়ে দিশাহীন হয়ে পড়েন দু’জনেই। অগত্যা শামীমের হতভাগ্য পিতা সন্তানের লাশের গ্রহীতা হন।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment