মানুষের জীবনে মৃত্যুর আগমন সুনিশ্চিত। ‘মৃত্যু অবশ্যই আসবে’ এই চিরসত্য বিষয়ে কেউ দ্বিমত প্রকাশ করেনি বা মৃত্যুকে কেউ অস্বীকার করেনি। এমনকি কাফের সম্প্রদায় আল্লাহর একত্ববাদ অস্বীকার করেছে, আল্লাহর প্রেরিত নবী-রাসুলদের অমান্য করেছে। আসমানি কিতাবকে মিথ্যা সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু মৃত্যু যে সবার জন্য অবধারিত তা অস্বীকার করতে পারেনি। তাই বিশ্বাসী-অবিশ্বাসী প্রত্যেকেই এ কথায় বিশ্বাসী যে, দুনিয়ায় যে ব্যক্তির আগমন হয়েছে, একদিন না একদিন সে মৃত্যুমুখে পতিত হবে। মৃত্যু-বিশ্বাসী প্রত্যেকেই এ বিষয়েও একমত। এই মৃত্যু কখন কোথায় কীভাবে আসবে তা কেউ জানে না। যে কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর ডাক এসে যেতে পারে। শিশু- যুবক-বৃদ্ধ সবার তরে এ বাস্তবতা চিরসত্য, মৃত্যুর সমন কোনো অনুমতি চেয়ে এবং সময়সূচি বলে দিয়ে আসবে না। বরং মৃত্যুর খোদায়ি হুকুম সুনির্ধারিত সময়ে অতর্কিতে এসে যাবে। সুতরাং কার মৃত্যু কখন হবে, এ সম্পর্কে কোনো সঙ্কেত বা সতর্কবাণী কোনো অত্যাধুনিক প্রযুক্তি দিতে পারেনি এবং কোনো অভিজ্ঞ বিজ্ঞানীও বলতে পারেনি।
মানুষ কত মৃত্যু সংবাদ পড়ে ও শোনে। কত মানুষের লাশ দেখে, কতজনকে চোখের সামনে দিয়ে কবরে নিয়ে যেতে দেখে। তবুও মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে নিজের করণীয় সম্পর্কে, ভালো-মন্দ পরিণতি সম্পর্কে চরম উদাসীন ও বেখবর থাকে। হজরত উসমান (রা.) বলেন, মানুষ প্রতিদিন তার মতো মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে কিন্তু নিজের মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। হজরত ঈসা (আ.) বলেন, দুনিয়াদারের পরিণতি দেখলে আমার কষ্ট লাগে। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, না খেয়ে না পরে সম্পদ জমা করে অথচ একসময় সবকিছু ফেলে খালি হাতে চলে যায়। দুনিয়া মানুষকে একের পর এক ধোঁকা দিতেই থাকে। অথচ মানুষ তাকে আপন থেকে আপন মনে করে। যারা দুনিয়ার ধোঁকার শিকার, তাদের জন্য শত আফসোস। ধ্বংস সে ব্যক্তির জন্য অনিবার্য, দুনিয়া হয় যার চিন্তা-চেতনা, গুনাহ এবং বদ আমল হয় যার পুঁজি। এমন ব্যক্তি কিয়ামতের ময়দানে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হবে।
পৃথিবীতে মানুষ যেসব জুলুম-অত্যাচার, নাফরমানি ও সীমালঙ্ঘন করে, বেপরোয়াভাবে গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়, তার কারণ হলো মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। মৃত্যুপরবর্তী জীবনের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা-ফিকির করে না।
শরীরে যতক্ষণ সুস্থতা ও শক্তি থাকে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গও সচল থাকে ততক্ষণ মানুষ ভাবে—আমি তো দুর্বার মহাক্ষমতাশালী, কোনোকিছুই আমার সামনে বাধা নয়, নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে আনন্দ-ফুর্তির ভোগ-বিলাসিতার শ্রেষ্ঠ উপজীব্য সময় এখন। তখন মানুষ আল্লাহর নিষিদ্ধ সব শাখা-প্রশাখায়, অনৈতিক ও গর্হিত সব অলি-গলিতে ঘুরে বেড়ায়। অন্যের হক লুণ্ঠন করে। অহঙ্কার ও ক্ষমতার দাপটে অন্যের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়। মোট কথা, অন্যায়-অপরাধের সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
মৃত্যুর চিন্তা ও স্মরণ থেকে মানুষের চরম উদাসীনতার মূল কারণ হলো দুনিয়ার ভালোবাসা ও পার্থিব জীবনের আসক্তি, দুনিয়া ও দুনিয়াবি বিষয়াবলী, পার্থিব বস্তুসামগ্রীকে মানুষের সম্মুখে মুগ্ধকর ও সুশোভিত করে দেয়া হয়েছে। জীবনোপকরণ হিসেবে পার্থিব বস্তুসামগ্রীর চাহিদা থাকা শরিয়তসম্মত, কিন্তু দুনিয়া ও ভোগের সামগ্রীর আসক্ত হওয়া, পার্থিব জগত্ ও আকর্ষণীয় বিষয়ে মোহগ্রস্ত হওয়া খুবই নিন্দনীয় এবং ধ্বংসের মূল কারণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দুনিয়ার ভালোবাসা সব পাপের মূল। দুনিয়ার আসক্তি মানুষকে কুপ্রবৃত্তির পূজারী বানায়, কামনা-বাসনার অনুগামী করে। পরিশেষে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা ও ভোগবাদী মানসিকতা মানুষকে বহুমুখী কর্মতত্পরতায় নিমগ্ন করে এবং তার পার্থিব চাহিদার পরিধি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। ফলে সীমাহীন লোভ-লালসা ও সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মেটানোর অনবরত সাধনার মধ্য দিযে মৃত্যুভাবনাহীনভাবে দিন-রাত অতিবাহিত করে। একপর্যায়ে হালাল ও বৈধ আয়-উপার্জনের গণ্ডি পেরিয়ে অবৈধ-অন্যায় পথেও অতিরিক্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে করতে আরও নানামুখী তত্পরতায় লিপ্ত হয় এবং নির্ভাবনায় কেবল অর্থবিত্তের নেশায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, কলকারখানা, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা, অন্যায়-অনাচারের যে মহোত্সব চলছে তার মৌলিক কারণ হলো দুনিয়া লাভের তীব্র প্রতিযোগিতা ও মৃত্যুচিন্তা থেকে চরম উদাসীনতা। এক হাদিসে রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দরিদ্রতার ভয় করি না কিন্তু আমি ভয় করি যে, তোমাদের ওপর দুনিয়াকে প্রশস্ত করে দেয়া হবে। যেমনি প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, তোমরা তা লাভ করার জন্য এরূপ প্রতিযোগিতা করবে। যেরূপ তারা করেছিল। ফলে তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেরূপ তাদের ধ্বংস করেছিল। (বুখারি-মুসলিম)
তাহলে ইসলাম কি মানুষকে দুনিয়াবি কর্মকাণ্ড থেকে বিমুখ হতে বলেছে? আয়-উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি করতে নিষেধ করেছে? না, এক্ষেত্রে ইসলামের মূল বক্তব্য হলো, দুনিয়ার ভালোবাসা যেন তোমাদের অন্তরে প্রবিষ্ট না হয়, দুনিয়ার অর্থবিত্ত, ধন-সম্পদ, ভোগ-বিলাস, আনন্দ-সুখই যেন তোমাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু না হয়। ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবন ও তার সব চাওয়া-পাওয়াই যেন মূল উদ্দেশ্য না হয়, দুনিয়াবি কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, আয়-উপার্জন সবই কর। তবে তা যেন ইসলামসম্মত উপায়ে হয়। দুনিয়াবি জীবনযাপন, যাবতীয় কর্মকাণ্ড যেন পরকাল থেকে গাফেল ও উদাসীন করে না দেয়। দুনিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন আখেরাত থাকে। এর প্রকৃষ্ট নিয়ামক হলো মৃত্যুচিন্তা, মৃত্যুস্মরণ।
কোরআন-হাদিসে বার বার মৃত্যুর কথা আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্যুচিন্তাকে অন্তরে জাগ্রত করতে বলা হয়েছে। অধিক হারে মৃত্যুকে স্মরণ করতে আদেশ করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সমস্ত স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ কর।’
মৃত্যুচিন্তার প্রথম স্তর বা একটা দিক হলো, মাঝে-মধ্যে বিশেষ রাতে নবীর নির্জনতায় মওতের মোরাকাবা করা, এ চিন্তা ও ধ্যান করা—আমাকে একদিন এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। মনের মাধুর্যতায় ভরা জীবন পরম সুখ-শান্তির অঙ্গন ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি দিতে হবে। ছেলে-সন্তান, আত্মীয়স্বজনের ভালোবাসা ছাড়তে হবে। সব মায়া-মমতার বন্ধন ছাড়তে হবে। চিরচেনা পরিবেশ, পরিচিত মানুষজন, পরিতৃপ্তির খাদ্য, আরামের সাজশয্যা, ধরিত্রীর আলো-বাতাস ছেড়ে অন্ধকার কবরে থাকতে হবে। সঞ্চিত সম্পদ, ঘর-বাড়ি সবকিছু ছেড়ে একাকী শূন্যহাতে বিদায় নিতে হবে। এরপর কঠিন জগতের সূচনা হবে। ফেরেশতা আসবে। সওয়াল জওয়াব হবে। হাশর-জান্নাত-জাহান্নামের অসহ্য যন্ত্রণা ও অন্তহীন দুর্ভোগের চিত্র অন্তরে বসানো ও কল্পনা করা।
মৃত্যুচিন্তার আরেকটি দিক বা দ্বিতীয় স্তর হলো—মানুষ যখন এভাবে মৃত্যুর কথা ভাবে, কবরের যিন্দেগীর কথা চিন্তা করে, হিসাব-নিকাশের কথা হাশর-ময়দানের অবস্থা অন্তরে জাগ্রত করে তখন তার অন্তর অতীত গুনাহের কথা ভেবে কেঁপে ওঠে। সে সচেতন হয়ে ওঠে। সে সবাইকে অন্ধকার জগত্ থেকে আলোর দিকে দৌড়াতে থাকে। অনুতাপ-অনুশোচনায় সে পুড়তে থাকে। এভাবেই আত্মশুদ্ধি ও সংশোধনের মহৌষধ সে পেয়ে গেল। ইসলাহের উত্তম ব্যবস্থা হয়ে গেল।
মৃত্যুচিন্তার এই প্রেসক্রিপশনের ফলে মানুষের অন্তরে সদা আল্লাহর ভয় এবং আখেরাতের ফিকির জাগ্রত থাকে। এখন কোনো ধরনের গুনাহর কাজ, হারাম ও অবৈধ আয়-উপার্জনের চিন্তা, আল্লাহ পাকের নাফরমানী এবং তার হুকুমের বিরোধী যেসব চাহিদা অন্তরে সৃষ্টি হতো তার চিন্তা ও কল্পনাও তার মনে আসে না। পাপের জগতে পা বাড়ায় না, দুনিয়াবী চাহিদার স্বাদ জাগে না। এজন্য উলামায়ে কেরাম বলেন, মৃত্যুচিন্তা হলো নফসের গোলামীর বিরুদ্ধে, কুপ্রবৃত্তির চাহিদার বিরুদ্ধে, দুষ্টু মন-মানসিকতার বিরুদ্ধে এবং শয়তানী ধোঁকা ও প্ররোচনার বিরুদ্ধে একটি বড় হাতিয়ার। কারণ মৃত্যুচিন্তা মানুষের অন্তরকে খোদামুখী করে এবং ইখলাস ও হিল্লাহিয়াত সৃষ্টি করে। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তুমি এমনভাবে নামাজ আদায় কর যেন এটাই তোমার জীবনের শেষ নামাজ। এভাবে যে নামাজ আদায় করা হবে তা সুন্দর হবে এবং একনিষ্ঠতায় পূর্ণ হবে। শুধু নামাজ নয়, প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, প্রতিটি অঙ্গন সৌকর্যমণ্ডিত হবে, সততা ও নিষ্ঠায় ভরে উঠবে প্রতিটি কর্মকাণ্ড। অন্তরে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত ব্যক্তির দ্বারা দুর্নীতি হবে না, সুদ-ঘুষের লেনদেন হবে না, মিথ্যা- প্রতারণামূলক আচরণ হবে না। অফিস-আদালতের কর্মকাণ্ডে ফাঁকি হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে চুরি বাটপারি হবে না। প্রতিটি কাজে দেখা যাবে যথাযথ কর্তব্যপরায়ণতা।
মোট কথা, মৃত্যুচিন্তা হলো প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব পাহারাদার, যা তাকে সব ধরনের অন্যায়-অনাচার থেকে রক্ষা করবে। তাই মানুষ যদি যথার্থভাবে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত করতে পারে, তবে তা তার জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধন করবে। তার নফসকে পরিশুদ্ধ করবে। তার কর্ম ও চিন্তা-চেতনাকে মহত্ ও শুদ্ধ করবে। তার চরিত্রকে সুন্দর করবে। আল্লাহতাআলা সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন।
মানুষ কত মৃত্যু সংবাদ পড়ে ও শোনে। কত মানুষের লাশ দেখে, কতজনকে চোখের সামনে দিয়ে কবরে নিয়ে যেতে দেখে। তবুও মৃত্যু ও মৃত্যুপরবর্তী জীবন সম্পর্কে নিজের করণীয় সম্পর্কে, ভালো-মন্দ পরিণতি সম্পর্কে চরম উদাসীন ও বেখবর থাকে। হজরত উসমান (রা.) বলেন, মানুষ প্রতিদিন তার মতো মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে কিন্তু নিজের মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। হজরত ঈসা (আ.) বলেন, দুনিয়াদারের পরিণতি দেখলে আমার কষ্ট লাগে। তারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে, না খেয়ে না পরে সম্পদ জমা করে অথচ একসময় সবকিছু ফেলে খালি হাতে চলে যায়। দুনিয়া মানুষকে একের পর এক ধোঁকা দিতেই থাকে। অথচ মানুষ তাকে আপন থেকে আপন মনে করে। যারা দুনিয়ার ধোঁকার শিকার, তাদের জন্য শত আফসোস। ধ্বংস সে ব্যক্তির জন্য অনিবার্য, দুনিয়া হয় যার চিন্তা-চেতনা, গুনাহ এবং বদ আমল হয় যার পুঁজি। এমন ব্যক্তি কিয়ামতের ময়দানে চরমভাবে লাঞ্ছিত ও অপদস্ত হবে।
পৃথিবীতে মানুষ যেসব জুলুম-অত্যাচার, নাফরমানি ও সীমালঙ্ঘন করে, বেপরোয়াভাবে গুনাহের কাজে লিপ্ত হয়, তার কারণ হলো মানুষ নিজের মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। মৃত্যুপরবর্তী জীবনের পরিণতি সম্পর্কে চিন্তা-ফিকির করে না।
শরীরে যতক্ষণ সুস্থতা ও শক্তি থাকে এবং অঙ্গপ্রত্যঙ্গও সচল থাকে ততক্ষণ মানুষ ভাবে—আমি তো দুর্বার মহাক্ষমতাশালী, কোনোকিছুই আমার সামনে বাধা নয়, নিশ্চিন্তে নির্বিঘ্নে আনন্দ-ফুর্তির ভোগ-বিলাসিতার শ্রেষ্ঠ উপজীব্য সময় এখন। তখন মানুষ আল্লাহর নিষিদ্ধ সব শাখা-প্রশাখায়, অনৈতিক ও গর্হিত সব অলি-গলিতে ঘুরে বেড়ায়। অন্যের হক লুণ্ঠন করে। অহঙ্কার ও ক্ষমতার দাপটে অন্যের ওপর জুলুম-নির্যাতন চালায়। মোট কথা, অন্যায়-অপরাধের সব কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে।
মৃত্যুর চিন্তা ও স্মরণ থেকে মানুষের চরম উদাসীনতার মূল কারণ হলো দুনিয়ার ভালোবাসা ও পার্থিব জীবনের আসক্তি, দুনিয়া ও দুনিয়াবি বিষয়াবলী, পার্থিব বস্তুসামগ্রীকে মানুষের সম্মুখে মুগ্ধকর ও সুশোভিত করে দেয়া হয়েছে। জীবনোপকরণ হিসেবে পার্থিব বস্তুসামগ্রীর চাহিদা থাকা শরিয়তসম্মত, কিন্তু দুনিয়া ও ভোগের সামগ্রীর আসক্ত হওয়া, পার্থিব জগত্ ও আকর্ষণীয় বিষয়ে মোহগ্রস্ত হওয়া খুবই নিন্দনীয় এবং ধ্বংসের মূল কারণ। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন : দুনিয়ার ভালোবাসা সব পাপের মূল। দুনিয়ার আসক্তি মানুষকে কুপ্রবৃত্তির পূজারী বানায়, কামনা-বাসনার অনুগামী করে। পরিশেষে কুপ্রবৃত্তির চাহিদা ও ভোগবাদী মানসিকতা মানুষকে বহুমুখী কর্মতত্পরতায় নিমগ্ন করে এবং তার পার্থিব চাহিদার পরিধি দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকে। ফলে সীমাহীন লোভ-লালসা ও সর্বগ্রাসী ক্ষুধা মেটানোর অনবরত সাধনার মধ্য দিযে মৃত্যুভাবনাহীনভাবে দিন-রাত অতিবাহিত করে। একপর্যায়ে হালাল ও বৈধ আয়-উপার্জনের গণ্ডি পেরিয়ে অবৈধ-অন্যায় পথেও অতিরিক্ত প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে করতে আরও নানামুখী তত্পরতায় লিপ্ত হয় এবং নির্ভাবনায় কেবল অর্থবিত্তের নেশায় মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। বর্তমানে ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, কলকারখানা, এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা, অন্যায়-অনাচারের যে মহোত্সব চলছে তার মৌলিক কারণ হলো দুনিয়া লাভের তীব্র প্রতিযোগিতা ও মৃত্যুচিন্তা থেকে চরম উদাসীনতা। এক হাদিসে রাসুলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহর কসম! আমি তোমাদের ব্যাপারে দরিদ্রতার ভয় করি না কিন্তু আমি ভয় করি যে, তোমাদের ওপর দুনিয়াকে প্রশস্ত করে দেয়া হবে। যেমনি প্রশস্ত করে দেয়া হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর, তোমরা তা লাভ করার জন্য এরূপ প্রতিযোগিতা করবে। যেরূপ তারা করেছিল। ফলে তা তোমাদের ধ্বংস করবে, যেরূপ তাদের ধ্বংস করেছিল। (বুখারি-মুসলিম)
তাহলে ইসলাম কি মানুষকে দুনিয়াবি কর্মকাণ্ড থেকে বিমুখ হতে বলেছে? আয়-উপার্জন, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি করতে নিষেধ করেছে? না, এক্ষেত্রে ইসলামের মূল বক্তব্য হলো, দুনিয়ার ভালোবাসা যেন তোমাদের অন্তরে প্রবিষ্ট না হয়, দুনিয়ার অর্থবিত্ত, ধন-সম্পদ, ভোগ-বিলাস, আনন্দ-সুখই যেন তোমাদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু না হয়। ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবন ও তার সব চাওয়া-পাওয়াই যেন মূল উদ্দেশ্য না হয়, দুনিয়াবি কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য, চাকরি, আয়-উপার্জন সবই কর। তবে তা যেন ইসলামসম্মত উপায়ে হয়। দুনিয়াবি জীবনযাপন, যাবতীয় কর্মকাণ্ড যেন পরকাল থেকে গাফেল ও উদাসীন করে না দেয়। দুনিয়ার প্রতিটি ক্ষেত্রে যেন আখেরাত থাকে। এর প্রকৃষ্ট নিয়ামক হলো মৃত্যুচিন্তা, মৃত্যুস্মরণ।
কোরআন-হাদিসে বার বার মৃত্যুর কথা আলোচনা করা হয়েছে। মৃত্যুচিন্তাকে অন্তরে জাগ্রত করতে বলা হয়েছে। অধিক হারে মৃত্যুকে স্মরণ করতে আদেশ করা হয়েছে। নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমরা সমস্ত স্বাদ বিনষ্টকারী মৃত্যুকে বেশি বেশি স্মরণ কর।’
মৃত্যুচিন্তার প্রথম স্তর বা একটা দিক হলো, মাঝে-মধ্যে বিশেষ রাতে নবীর নির্জনতায় মওতের মোরাকাবা করা, এ চিন্তা ও ধ্যান করা—আমাকে একদিন এ দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। মনের মাধুর্যতায় ভরা জীবন পরম সুখ-শান্তির অঙ্গন ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি দিতে হবে। ছেলে-সন্তান, আত্মীয়স্বজনের ভালোবাসা ছাড়তে হবে। সব মায়া-মমতার বন্ধন ছাড়তে হবে। চিরচেনা পরিবেশ, পরিচিত মানুষজন, পরিতৃপ্তির খাদ্য, আরামের সাজশয্যা, ধরিত্রীর আলো-বাতাস ছেড়ে অন্ধকার কবরে থাকতে হবে। সঞ্চিত সম্পদ, ঘর-বাড়ি সবকিছু ছেড়ে একাকী শূন্যহাতে বিদায় নিতে হবে। এরপর কঠিন জগতের সূচনা হবে। ফেরেশতা আসবে। সওয়াল জওয়াব হবে। হাশর-জান্নাত-জাহান্নামের অসহ্য যন্ত্রণা ও অন্তহীন দুর্ভোগের চিত্র অন্তরে বসানো ও কল্পনা করা।
মৃত্যুচিন্তার আরেকটি দিক বা দ্বিতীয় স্তর হলো—মানুষ যখন এভাবে মৃত্যুর কথা ভাবে, কবরের যিন্দেগীর কথা চিন্তা করে, হিসাব-নিকাশের কথা হাশর-ময়দানের অবস্থা অন্তরে জাগ্রত করে তখন তার অন্তর অতীত গুনাহের কথা ভেবে কেঁপে ওঠে। সে সচেতন হয়ে ওঠে। সে সবাইকে অন্ধকার জগত্ থেকে আলোর দিকে দৌড়াতে থাকে। অনুতাপ-অনুশোচনায় সে পুড়তে থাকে। এভাবেই আত্মশুদ্ধি ও সংশোধনের মহৌষধ সে পেয়ে গেল। ইসলাহের উত্তম ব্যবস্থা হয়ে গেল।
মৃত্যুচিন্তার এই প্রেসক্রিপশনের ফলে মানুষের অন্তরে সদা আল্লাহর ভয় এবং আখেরাতের ফিকির জাগ্রত থাকে। এখন কোনো ধরনের গুনাহর কাজ, হারাম ও অবৈধ আয়-উপার্জনের চিন্তা, আল্লাহ পাকের নাফরমানী এবং তার হুকুমের বিরোধী যেসব চাহিদা অন্তরে সৃষ্টি হতো তার চিন্তা ও কল্পনাও তার মনে আসে না। পাপের জগতে পা বাড়ায় না, দুনিয়াবী চাহিদার স্বাদ জাগে না। এজন্য উলামায়ে কেরাম বলেন, মৃত্যুচিন্তা হলো নফসের গোলামীর বিরুদ্ধে, কুপ্রবৃত্তির চাহিদার বিরুদ্ধে, দুষ্টু মন-মানসিকতার বিরুদ্ধে এবং শয়তানী ধোঁকা ও প্ররোচনার বিরুদ্ধে একটি বড় হাতিয়ার। কারণ মৃত্যুচিন্তা মানুষের অন্তরকে খোদামুখী করে এবং ইখলাস ও হিল্লাহিয়াত সৃষ্টি করে। এক হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, তুমি এমনভাবে নামাজ আদায় কর যেন এটাই তোমার জীবনের শেষ নামাজ। এভাবে যে নামাজ আদায় করা হবে তা সুন্দর হবে এবং একনিষ্ঠতায় পূর্ণ হবে। শুধু নামাজ নয়, প্রাত্যহিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্র, প্রতিটি অঙ্গন সৌকর্যমণ্ডিত হবে, সততা ও নিষ্ঠায় ভরে উঠবে প্রতিটি কর্মকাণ্ড। অন্তরে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত ব্যক্তির দ্বারা দুর্নীতি হবে না, সুদ-ঘুষের লেনদেন হবে না, মিথ্যা- প্রতারণামূলক আচরণ হবে না। অফিস-আদালতের কর্মকাণ্ডে ফাঁকি হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে চুরি বাটপারি হবে না। প্রতিটি কাজে দেখা যাবে যথাযথ কর্তব্যপরায়ণতা।
মোট কথা, মৃত্যুচিন্তা হলো প্রত্যেক ব্যক্তির নিজস্ব পাহারাদার, যা তাকে সব ধরনের অন্যায়-অনাচার থেকে রক্ষা করবে। তাই মানুষ যদি যথার্থভাবে মৃত্যুচিন্তা জাগ্রত করতে পারে, তবে তা তার জীবনে আমূল পরিবর্তন সাধন করবে। তার নফসকে পরিশুদ্ধ করবে। তার কর্ম ও চিন্তা-চেতনাকে মহত্ ও শুদ্ধ করবে। তার চরিত্রকে সুন্দর করবে। আল্লাহতাআলা সবাইকে আমল করার তাওফিক দান করুন।
No comments:
Post a Comment