সন্ধ্যায় ছাদে বসে তন্ময় হয়ে দেখছিলাম অস্তমিত সূর্যের বিদায় ব্যথায় প্রকৃতির বিষণ্নতা। কেমন নীরব হয়ে আছে গাছপালা-তরুলতা। সেই নীরবতার মধ্যে আমিও মনের গভীরে খুঁজছিলাম ছেলেবেলার অস্পষ্ট একটি মুখ। হঠাত্ আমার ছোট বোন এসে বলল, ভাইয়া, তোমার বন্ধু এসেছে। আমি ভাবনা ছেড়ে নিচে গিয়ে দেখি, রনো। কিছু বলার আগেই রনো বাঘের থাবার মতো আমার হাতটা ধরে মিনতির সুরে বলল, তুই আমাকে কথা দে, আমার কথা তুই রাখবি।
হঠাত্ রনোর এমন ব্যবহারে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। কিছু না বলে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা হাসছেন। ভয়টা কেটে গেল ঠিকই, তবে একটা সন্দেহ উঁকি দিল মনের মধ্যে। কেননা আমার বিয়ের জন্য বেশ পীড়াপীড়ি চলছিল কিছুদিন ধরেই। আমি রনোকে বললাম, আগে হাত ছাড়। ও কিছুতেই হাত ছাড়ে না। শেষে বললাম, আচ্ছা, তুই যে এমন করছিস, বলতো, আমি তোর কোন কথাটা শুনিনি? রনো আমার হাত ছেড়ে বলল, আমার সঙ্গে তোকে যেতে হবে।
— কোথায়?
— আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
— হঠাত্ সেখানে আমি যাব কেন? সন্দেহটা এবার পুষ্ট হতে শুরু করল।
— বিয়ে।
— তোর?
— আরে না-না। আমার ছোট বোনের।
— বুঝলাম, কিন্তু আমি যাব কেন?
— কেন যাবি না? আমার একমাত্র ছোটবোনের বিয়ে, তুই যাবি না তো কে যাবে?
সন্দেহটা আরও জটিল আকার ধারণ করল। ভাবলাম তবে কি...। বললাম কবে বিয়ে? ও বলল, টরশু। আমরা কাল সকালেই রওনা হবো। মাঝে এক দিন রেস্ট। পরদিন বিয়ে। আমার সন্দেহটা দোল খেতে লাগল। বললাম, ছেলের বাড়ি কোথায়? কী করে?
— বাড়ি আমাদের উপজেলা সদরে। বড় লোকের ছেলে। বিয়ের পর বিদেশ চলে যাবে। দেখতে শুনতেও ভালো।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণ ধরেই নিয়েছিলাম যে, রনোর সঙ্গে হয়তো মায়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। আমাকে কৌশলে সেখানে নিয়ে গিয়ে জোর করে একটা কিছু ঘটাবে রনো। এসব মনে করে আমি হো -হো করে হেসে উঠলাম। মাকে বললাম, মা একটু চা দাও না! ওর পাল্লায় পড়ে গলাটা আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
চা খেতে খেতে রনো বলল, এখান থেকে আমার এক মামাতো ভাই যাবে। আর বন্ধুদের মধ্যে তুই। প্রাইভেট কার ঠিক করে রেখেছি। সোজা বাড়িতে পৌঁছে দেবে। তোকে এক কদমও হাঁটতে হবে না।
ওর কথা শুনে মায়ের সামনে আমার কেমন লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। আমি হাসতে হাসতে বললাম, শহরে তোর এত বন্ধু থাকতে তুই আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিস কেন?
এ কথার উত্তর খুঁজে না পেয়ে রনো মায়ের দিকে চেয়ে বলল, বলেন তো খালাম্মা, এই পিছলা বাইমটার কী উত্তর দেই। মা শুধু হাসলেন। রনো বলল, রেডি থাকবি, তোকে বাসা থেকে নিয়ে যাব।
আমি রনোর মতো শক্ত করে কিছু বলতে পারি না। ভাবছি কী বলব! রনো আমার রানের ওপর একটা চাটি মেরে বলল, কিরে, কিছুই তো বলছিস না।
— কী বলব?
— কী বলবি মানে? রেডি হয়ে থাকবি তো?
— প্রাইভেট কারে আমি যাব না।
— দেখ রঞ্জু, বগুড়ায় যদি এয়ারপোর্ট থাকত, তা হলে তোকে আমি প্লেনে করেই নিয়ে যেতাম। টাকাপয়সা কোনো ফ্যাক্টর নয়।
— আমি যেতে চাই খুব সাধারণ ভাবে। বাস, রিকশা, নৌকা এবং পায়ে হেঁটে।
রনো প্রশান্তির শ্বাস ফেলে কাদার মতো হয়ে বলল, তুই বাঁচালি আমাকে। আমি একটু রসিকতা করে বললাম, তোর অনেক টাকা বেঁচে গেল। আমার ধারণা ছিল, কথাটা শুনে ও চটে যাবে। কিন্তু রনো কণ্ঠটা আরও মোলায়েম করে বলল, আরে চান্দু, আসলে তা নয়। তুই যে যেতে চেয়েছিস, এতেই আমার শান্তি।
রনো চলে গেলে মা বললেন, যাবিই যখন তখন গাড়িতে যেতে চাইলি না কেন? আমি বললাম, মা, গ্রামে যাব কিন্তু গাড়ি কেন! গ্রামের ধুলোমাটি যদি পায়েই না লাগল তা হলে গ্রামে গিয়ে লাভ কী!
যা হোক, পরদিন তিনজন বগুড়ার উদ্দেশে রওনা করলাম। চেয়ার কোচে টিকিট কাটা হয়েছে। একটা বড় সিটে আমরা তিনজন। আমি জানালার পাশে। সাঁইসাঁই শব্দে ছুটে চলেছে বাস। হুড়পাড় করে বাতাস এসে ঢলে পড়ছে সারা শরীরে। ভালো লাগার ভেতর থেকে অকল্পিত কিছু মুখ মনের মধ্যে এই ভাসে, এই আবার মিলিয়ে যায়। আমার ভাবার মতো নিরূপিত কোনো মুখ নেই বলে আমার ভাবনার বিস্তার আছে। কখনও কখনও রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে মন ও শরীর। তখন সুর এসে ভর করে কণ্ঠে। কিন্তু বাসের মধ্যে গান গাইলে কিল একটাও মাটিতে পড়বে না। তবু গুনগুনিয়ে একটি গানের সুর তুললাম। রনো ফিসফিসিয়ে বলল, আর একটু গলা ছাড়। সামনের দুটো মেয়ে গান শুনে কেমন নড়াচড়া করছে। শুনেই আমি গুনগুনানি বন্ধ করলাম। রনো পড়িমড়ি করে বলে উঠল, থামলি কেন?
— কেউ মাইন্ড করতে পারে।
— ড্রাইভাররা যখন ক্যাসেট চালায়, তখন কি কেউ...।
ঠিক তখনই সামনের সিটের একটি মেয়ে অন্য মেয়েটিকে বলল, ভালোই তো লাগছিল, থামল কেন? অন্য মেয়েটি বলল, মনে হয় ব্যাটারিতে চার্জ নেই। বলেই ফিক করে হেসে উঠল। কথাটা শুনে আমিও হাসলাম। ভাগ্য ভালো, রনো শুনতে পায়নি। তারপর এ গল্প সে গল্প করতে করতে কত গ্রাম, কত মাঠ-ঘাট পার হয়ে একটা বড় নদীর ঘাটে পৌঁছলাম। নদীর ওপর বিশাল একটা ব্রিজ। রনো চেঁচিয়ে বলল, আমরা এখানেই নেমে যাব। বাস থামান। ওর মামাতো ভাই বলল, এখানে নামার কী দরকার? নদী পার হয়ে বটতলা নামলেই তো হতো। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে যেতাম।
রনো সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, লাগেজগুলো হাতে নিয়ে ডান দিকে হাঁটা শুরু করো। তারপর ও আমার হাত থেকে আমার ব্যাগটাও ছোঁ দিয়ে নিয়ে বলল, এবার চল। কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। মুন্সীপাড়ার ঘাটে গিয়ে নৌকায় যাব। আমি বললাম, আমার ব্যাগটা অন্তত আমার কাছে দে।
— অসুবিধা নেই। ব্যাগ নিয়ে ধুলোর মধ্যে তুই হাঁটতে পারবি না।
— তুই কি ভাবিস আমি দুর্বল? তোদের দু’জনের চেয়ে আমার গায়ে শক্তি বেশি। তা জানিস?
কে কার কথা শোনে। ওরা দু’জন আমাকে ফেলেই এগিয়ে চলল। ইট বিছানো রাস্তা—কোথাও গর্ত হয়ে আছে। পা ঠিকঠাক না পড়লে মচকানোর আশঙ্কা। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বাঁ হাতে আমবাগান, বাঁশঝাড়ের মাঝ দিয়ে ছায়া সুনিবিড় পথ নেমে গেছে নদীর চরে। সেই ঢালু পথে লাগেজ নিয়ে কখনও ধীরে কখনও দৌড়ে ওরা চরে গিয়ে দাঁড়াল। রনো বলল, রঞ্জু, একা নামতে পারবি, না ধরতে হবে? ওর কথা শুনে আমার খুব হাসি এলো। আমিও দৌড়ে নামতে গেলাম। দু-চার পা ফেলার পরই বালু ফসকে গড়াতে গড়াতে একেবারে নিচে। রনো দৌড়ে এসে বলল, হলো তো। আমি হো হো শব্দে হাসতে হাসতে বললাম, দারুণ! এ যেন মায়ের হাতের মিষ্টি চড়। রনো দাঁত খিঁচিয়ে উঠল।
— তুই বুঝিস কম, বলিস বেশি।
— এখন কী করতে হবে, তাই বল।
— এখান থেকে নৌকায় যাব, তার পর অন্য ব্যবস্থা। গাড়িতে এলে কখন ঘরের দরজায় গিয়ে নামতে পারতাম। শুধু তোর জন্য এত ঝামেলা করতে হচ্ছে।
বেশ বড় নৌকা। কাঠের পাটাতনের ওপর পাটি বিছানো। আমি বললাম, চমত্কার। সব পরিশ্রম এবার উশুল হয়ে যাবে। রনো একটা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। মাঝি বসে আছে হাল ধরে। পালতোলা নৌকা এগিয়ে চলল উজানে। একটু বিশ্রামের পরই ছইয়ের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। নদীর ঘাটে ঘাটে কিশোর-কিশোরীরা দল বেঁধে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। শরীর মাঞ্জনে ব্যস্ত গাঁয়ের বধূরা। কেউ বা কলস কাঁখে ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে। কোথাও কিশোর ছেলেরা দৌড়ে এসে লুঙ্গি খুলে উদোম গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পানিতে।
রনো বলল, এবার গলা ছেড়ে গান ধর। তোর কথাই ঠিক রে। আমারও ভালো লাগছে। কত দিন নৌকায় চড়িনি। আমি অবশ্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। তখনই গান ধরলাম, ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...। ঘাটে ঘাটে স্নানরত মেয়ে-পুরুষ সবাই মাজা পানিতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। গান শেষ হতেই রনো বলল, চালিয়ে যা। যতক্ষণ না আমরা ঘাটে পৌঁছাচ্ছি। আমি আবার ধরলাম—ও কেন এত সুন্দরী হলো...। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর নদীর পাড়েই একটা স্কুল দেখলাম। স্কুলের মাঠে কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে মনে হলো, ওরা হয়তো কোনো শহরের কলেজে পড়ালেখা করে। তখন বেলা পড়ে গেছে। বইছে মিষ্টি বিকেলের ঝিরঝির হাওয়া। আকাশে সাদা-কালো মেঘেরা একে অন্যের শরীর ছুঁয়ে ভাবে বিহ্বল। আমি আবার শুরু করলাম, ‘কতদিন দেখিনি তোমায়, মনে পড়ে তব মুখখানি।’ নৌকা এগিয়ে চলেছে। কোথাও নদীর একদিকে খাড়া পাড় অন্যদিকে বালুচর। তারপর গ্রাম। হঠাত্ লক্ষ্য করলাম, স্কুল মাঠের সেই ছেলেমেয়েরা নৌকার সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলেছে। গান শেষ হলে মেয়েরা হাত নাড়ল, আমিও নাড়লাম।
নদী বাঁক নিলো উত্তরে। নৌকা চলছে। রনো আগেই মোবাইলে আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছে দিয়েছে বাড়িতে। চরের ঘাটে যেন লোকজন উপস্থিত থাকে। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমেই গাঢ় হয়ে আসছে। হঠাত্ বাতাস পড়ে গেল। মাঝি কূল ঘেঁষে হাল ঠেলছে দু’হাতে। তখন চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে নদীর বুক। আমরাও ঘাটে পৌঁছলাম।
রতন নৌকা থেকে নেমে উপরে গেল। আমরাও নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন মাঝি একগাল হেসে বলল, বাবা একটা কথা কবার চাই। রনো বলল, বকশিশ তো? মাঝি বলল, না বাবা। বলছিলাম ওই বাবাজি কি রেডিও-টেলিভিশনে গান গায়? মনে হয় তারে আমি দেখছি।
— না, ও কোথাও গায় না।
— বড় মিষ্টি গলা। ফিরার দিন আমার নৌকায় যাবেন।
— কোন পথে ফিরব, এখন ঠিক বলা যাচ্ছে না।
তিন-চারটি ছেলে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো রতন। হাতে হাতে লাগেজগুলো নিয়ে উপরে চলে গেল ওরা। আমি আর রনো গিয়ে ভ্যানে বসলাম পা ঝুলিয়ে। অন্যরা ভ্যানের সঙ্গে তাল রেখে চলতে লাগল। চলতে চলতে একটা খালের সামনে এসে ভ্যান দাঁড়াল। পথটা ঢালু। রনোকে নামতে দেখে আমিও ভ্যান থেকে নামতে গেলাম। হায় হায় করে উঠল রনো।
তুই নামছিস কেন? তুই বসে থাক। অন্যরাও বলল, আপনি বসে থাকেন। ওরা দু’দিক থেকে ভ্যান ধরে নিচে নামিয়ে, আবার উপরে টেনে তুলল। এবার খুব বড় একটা আম বাগানের সামনে এলাম। বাইরে চাঁদের আলো বাগানের ভেতরে জমাট অন্ধকার। এই বাগানটার মাঝ দিয়েই পথ। হঠাত্ সামনে দিয়ে দু-তিনটা শিয়াল দৌড়ে রাস্তা পার হলো। দু-একটা বাদুড়ও উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। মনে পড়ল শরত্চন্দ্রের বিলাসী গল্পের কথা। এ যেন মৃত্যুঞ্জয়ের সেই আমবাগান। আমার সঙ্গে কেউ নেই। আমি অন্ধকার হাতড়ে সাপ বিচ্ছুর ভয় না করে বিলাসীর কাছে যাচ্ছি। বিলাসী মাটির প্রদীপ জ্বেলে আমার পথ চেয়ে বসে আছে। বাগানটা পার হয়ে ছোট্ট মাঠের মধ্যে গিয়ে বললাম, আর কত দূর?
রতন হাসতে হাসতে বলল, ওই যে সামনের গ্রাম। হ্যাজাক লাইট জ্বলছে, ওটাই রনো ভাইদের বাড়ি। ধুলো মাড়িয়ে বাড়ির সামনে ভ্যান পৌঁছাতেই এক পাল ছেলেমেয়ে ছুটে এলো আমাদের দেখতে। পথের ওপর ঠেলাঠেলি করে আমাকে দেখছে ওরা। হঠাত্ মনের মধ্যে সেই সন্দেহটা আবার নড়াচড়া করে উঠল। মনে মনে বললাম, এত জামাই আদরের অর্থ কী! ঢাকার মেহমান, সে কি চিড়িয়াখানার জীব? বিষ ভাঙা সাপের মতো মনটা যেন অসহায় হয়ে পড়ল। আপন মনেই বললাম, ওরে রনো, তোর মনে কি এই ছিল!
সুপারি গাছের মাঝ দিয়ে পথ চলে গেছে ওদের বাড়ির উঠোনে। প্রথমেই ওয়াল করা বড় একটা টিনের কাচারি। উঠোনের পরই থাকার ঘরগুলো। খোলা উঠোনে চেয়ার-টেবিল সাজানো। সেখানেই বসলাম আমরা। এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে লোকজন এলো আমাদের দেখতে। তারপর মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হতেই দেখি, টেবিল ভরে গেছে নানান পদের নাস্তায়। রনো বলল, নে একটু নাস্তা করে নে। রতনও বলল, রঞ্জু ভাই, নাস্তা করেন। তারপর চা খাওয়া যাবে। সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি শুরু করলে সবাই তখন হাত লাগাতে পারে। শেষে গরম চিতই পিঠা আর চিংড়ি মাছ দিয়ে শাক পিঠালু দেখে বড় লোভ হতে লাগল। রুটি, মাংস, সেমাই ছাড়াও মিষ্টি রয়েছে কয়েক পদের। আমি চিতই পিঠা খেতে শুরু করলাম। তখন অন্যরাও যার যার ইচ্ছেমত খেতে শুরু করল।
নাস্তা শেষ হলে রতন বলল, রঞ্জু ভাইয়া কাল একটা গেট তৈরি করতে হবে। আমরা এমন কিছু করতে চাই, যা দেখে বরযাত্রীরা অবাক হয়ে যায়।
— বেশ তো। আমি নিজে কখনও এসব কাজ না করলেও কিছু আইডিয়া আছে আমার মাথায়।
— আপনি যেভাবে বলবেন, আমরা সেভাবেই করতে পারব।
— রতন তুমি কি আমার সঙ্গে একটু যাবে?
— কোথায়?
— ওই রাস্তার দিকে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে সুপারি গাছগুলোর মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলোয় সুপারি গাছের ছায়া যেন মিষ্টি এক আলপনা আঁকা। রতনকে বললাম, ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখেছে?
— দেখেছে। খুব পছন্দও করে গেছে।
— ছেলে দেখেছো?
— দেখেছি।
— দেনা-পাওনা আছে?
— না।
ভয়টা কেটে গিয়ে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। রনো আমাকে নিয়ে গেল বাড়ির মধ্যে। ওর ঘরে গিয়ে বসলাম। একটু পর রনোর মা-বাবা দু’জনই এলেন। আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। আমার বাবা-মার কথা শুনলেন। রনোদের গ্রামের পরিবেশ আর আমাদের শহরের পরিবেশ দু’রকম হলেও স্নেহ-মমতায় ওর বাবা-মার তুলনা হয় না। আমার খুব ভালো লাগল। কথার ফাঁকে রনোর মা বললেন, অনেক কষ্ট করে তুমি শহর থেকে গরিবের বাড়িতে এসেছো। আমি খুব খুশি হয়েছি। আর একটা কথা। তোমার যখন যা খেতে ইচ্ছে করে, আমাকে বলো।
আমি বললাম, খালাম্মা আমাকে নিয়ে আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আমার বাড়তি কিছু চাওয়ার নেই। রনো যা খায়, আমিও তাই খেতে পারব। রনো বলল, মা আমাদের খাবার নিয়ে আস। অনুকেও আসতে বলো। ও কি রঞ্জুকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে?
আমাদের রাতের খাবার এলো। রনোর মায়ের সঙ্গে অনুও এলো। রনো বলল, এই হলো অনু। আমার একমাত্র বোন। এবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। ইচ্ছে ছিল, ঢাকা নিয়ে গিয়ে পড়াব। কিন্তু তার আগেই বেজে উঠল বিয়ের সানাই। পরশু দিন চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি।
অনু লজ্জায় লাল হয়ে গেল। গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে ভিজিয়ে দিল খাওয়ার টেবিল। লজ্জায় ঘর থেকে বের হয়ে কেঁদে ফেলল ও। রনো হাসতে হাসতে বলল, বিয়ের ফুল ফুটলে বিয়ে তো হবেই। এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমিও তো বিয়ে করব।
খালাম্মা বললেন, তুই চুপ করবি? মেয়েটা এমনিতেই লাজুক। তার ওপর এই ছেলেটার সামনে এত কিছু বলার দরকার কী তোর? রনো হাসতে হাসতে বলল, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। অনু মণি এই যে আমি কান ধরছি, আর বলব না। প্রথমে অনুকে বিব্রত করার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছিল। পরে রনোর কাণ্ড দেখে আমি হো-হো করে হাসতে লাগলাম। ভাইবোনের এমন মধুর সম্পর্ক দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। অনুর ছিপছিপে গড়ন। মিষ্টি মুখ, লম্বা চুল। গায়ের রংটাও উজ্জ্বল শ্যামলা, যা আমার প্রিয়।
পরদিন নদীতে সাঁতার কাটলাম। বিকালে রনোর সঙ্গে বাজারে গেলাম বেড়াতে। বাজারের পাশেই হিন্দু এলাকা। যার সঙ্গেই দেখা হয়, সে-ই মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য নাছোড় হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে একটু হলেও খেতে হয়। সন্ধ্যার পর ফিরে এসে দেখি উঠোন ভরে গেছে পাড়ার মানুষে। তাছাড়া রনোদের বাড়িতেও অনেক মেহমান এসেছে বিয়ে উপলক্ষে।
ঝাড়া-মোছা আকাশে হাসছে চাঁদ। বইছে ঝিরঝির মিষ্টি হাওয়া। থেমে গেছে পাখিদের কলকাকলি। নদীর ওপাড় থেকে ভেসে আসছে মেঠো গানের সুর। একটি ছেলে জ্বলন্ত হারিকেন এনে টেবিলে রাখল। আমি বললাম, এমন সুন্দর চাঁদের আলোয় হারিকেন জ্বালানোর দরকার কী।
রনো বলল, এমন সুন্দর রাত, এই রাতে তোর গান না শুনে মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছিনা রে রঞ্জু। গান ধর। এই রাতটা সবার মনে স্মৃতি হয়ে থাকবে। রনোর এমন সুন্দর কথায় আমার মন গলে গেল। তবু বললাম, গান গাইলে সবাই আমাকে পাগল ভাববে। রতন ছুটে এসে মিনতি করে বলল, প্লিজ রঞ্জু ভাইয়া, আপনি আর না বলবেন না।
শেষে টেবিলে টোকা দিয়ে আমিও শুরু করলাম। ‘সজনি গো যদি এলে, রজনীকে বলো সে যেনো ভোর না হয়...।” গান শেষ না হতেই দেখি ফ্ল্যাক্স ভরে চা এসে গেছে। রতন খুব যত্নসহকারে কাপে চা ঢেলে আমার সামনে রাখল। রনো বলল, আমাকেও এক কাপ দিস। আজ সারারাত আমরা রঞ্জুর গান শুনব। আমি চা খেয়ে আবার গান শুরু করলাম। ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে...।’ তারপর ‘আমার বলার কিছু ছিল না, না গো... চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...।’ গান চলছে। একটা শেষ হতেই অনুরোধ আসছে আরেকটা গাওয়ার জন্য। আমি লক্ষ্য করলাম, ভিতর বাড়ির সব ঘরের জানালা খুলে গেছে। মেয়েরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে জানালায়। অত বড় উঠোনটাও ভরে গেছে ছোট-বড় নানান বয়সের মানুষে। শেষে গাইলাম কবি নজরুলের বিখ্যাত গানটি। মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল...।
কিন্তু শেষ হইয়াও হইল না শেষ। আবার অনুরোধ। আরও দুটো গান গাওয়ার পর রনো বলল, আজ এখানেই শেষ। ভাগ্যে থাকলে আবার হবে। আমরা শুতে গেলাম ভেতরে। লোকজন তখনও বসে আছে।
পরদিন সকালে অনেক ছেলেমেয়ে এলো আমার সঙ্গে বিয়ের গেট তৈরি করবে বলে। ভ্যানে মাইক এলো। মাইকে গানও শুরু হলো। গেট তৈরির কাজ প্রায় শেষ। এর মধ্যে দুটো মোটরসাইকেলে চারটি ছেলে এলো। উঠানের পাশে গাড়ি রেখেই ওরা বাড়ির ভেতর চলে গেল। একটু পরই ভেতর থেকে রনোর ডাক এলো। আমরা কাজ শেষ করে চা খাচ্ছি।
লক্ষ্য করলাম বাড়ির সবাই কেমন চুপ হয়ে গেছে। কারও মধ্যেই আগের সেই উচ্ছ্বাস নেই। খুশি খুশি ভাব নেই। কি ভেবে আমি সোজা বাড়ির মধ্যে গেলাম। রনোকে বললাম, কী ব্যাপার? সবাইকে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে। রনো গম্ভীর হয়ে বলল, একটা দুঃসংবাদ।
— আমাকে বলা যায় না?
— কেন যাবে না। যে ছেলেটির সঙ্গে অনুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তাকে গতরাতে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
— অপরাধ?
— ও নাকি সন্ত্রাসী।
— কী নাম ছেলেটির।
— সুজন শরীফ।
— ডাকনাম কি সুজন? সে কি ভার্সিটির হলে থাকত?
— হ্যাঁ।
— আমি যে সুজনকে জানি, তার বাড়িও তোদের উপজেলায়। সে তার রুমমেটের বাবার কাছ থেকে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়েছিল। লোকটা গ্রাম থেকে এসেছিল ছেলেকে টাকা দিতে। হলে যাওয়ার পথেই এই সুমন লোকটাকে রাস্তা থেকে গলির মধ্যে ডেকে নিয়ে বুকের ওপর অস্ত্র ধরে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল। পর দিন খুব সকালে ঘুমন্ত সুজনকে দেখে লোকটা তার ছেলেকে বলেছিল। এই সেই ছিনতাইকারী, যে তার কাছ থেকে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে। রুমমেট ছেলেটি বাবাকে শান্ত করে তখনই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ছেলেটি ভদ্র। একদিন কথায় কথায় ঘটনাটা বলেছিল আমাদের। আমি আগে জানলে কিছুতেই এখানে আসতাম না।
তারপর রনো বাড়ির সবাইকে ঘটনাটা জানাল। তখন সবার মনে এই শান্তি ফিরে এলো যে, বিয়ে না হয়ে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। রতনের কাছে জানলাম, অনু খুব খুশি হয়েছে। তবে তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার জন্য কারও মনেই আনন্দ নেই।
দুপুরে অনুর মা আমাদের খেতে দিয়ে কেঁদে ফেললেন। বললেন, বাবা, তুমি কত আশা করে আনন্দ করতে এসেছিলে, কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল। আমি একটি কথাও বলতে পারলাম না। সামান্য খেয়েই বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। রনো একদম চুপ হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলছে না। আমি সন্ধ্যায় একা একা নদীর চরে বসে আছি। ভাবছিলাম, এত আয়োজন এত হাসি-খুশি কেন এমন করে শেষ হয়ে গেল। আমার খুব খারাপ লাগছিল। এমন সময় রনো এসে বলল, যা হওয়ার হয়েছে আমরা কাল সকালেই ঢাকা রওনা দেব।
ফিরে এসে নাস্তা করে চা খেলাম। রনো ওর মাকে বলল, মা, আমরা কাল সকালেই চলে যাব। মা বললেন, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তাছাড়া আমাদের এ অবস্থায় ফেলে তুই কীভাবে যাবি।
কথা শেষ না হতেই রনো আমাকে বলল, তুই কি আমার সঙ্গে বাজারে যাবি? আমি বললাম, না। আমি বরং রতনকে নিয়ে নদীর দিকে যাই। নদীর পাড়ে বসে অনেক গল্প করলাম রতনের সঙ্গে। এক সময় রতনকে বললাম, রতন, অনু তো তোমার ফুফাতো বোন, তাই না? আমি যদি অনুকে নিতে চাই, তাহলে তোমার ফুফা-ফুফু কি রাজি হবে!
রতন হঠাত্ পাগলের মতো আমাকে জাপটে ধরে বলল, রঞ্জু ভাইয়া, একি আপনার মনের কথা? এ কথা শুনলে ফুফা-ফুফু আপনাকে মাথায় তুলে নাচবে। আর সবচেয়ে বেশি খুশি হবে আমাদের অনু। আমি বললাম, যদি তাই হয়, তাহলে ঢাকা থেকে আমার মাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো।
রতন খুশিতে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে গেল বাড়ির দিকে। আমি জোছনা ঝিলমিল নদীর দিকে চেয়ে মনে মনে হাসলাম। আর অনুর লজ্জা রাঙা মুখটা যেন আমার চতুর্দিকে জোনাকির মতো লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠল!
সূত্র : আমার দেশ
হঠাত্ রনোর এমন ব্যবহারে আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। কিছু না বলে মায়ের মুখের দিকে তাকালাম। মা হাসছেন। ভয়টা কেটে গেল ঠিকই, তবে একটা সন্দেহ উঁকি দিল মনের মধ্যে। কেননা আমার বিয়ের জন্য বেশ পীড়াপীড়ি চলছিল কিছুদিন ধরেই। আমি রনোকে বললাম, আগে হাত ছাড়। ও কিছুতেই হাত ছাড়ে না। শেষে বললাম, আচ্ছা, তুই যে এমন করছিস, বলতো, আমি তোর কোন কথাটা শুনিনি? রনো আমার হাত ছেড়ে বলল, আমার সঙ্গে তোকে যেতে হবে।
— কোথায়?
— আমাদের গ্রামের বাড়িতে।
— হঠাত্ সেখানে আমি যাব কেন? সন্দেহটা এবার পুষ্ট হতে শুরু করল।
— বিয়ে।
— তোর?
— আরে না-না। আমার ছোট বোনের।
— বুঝলাম, কিন্তু আমি যাব কেন?
— কেন যাবি না? আমার একমাত্র ছোটবোনের বিয়ে, তুই যাবি না তো কে যাবে?
সন্দেহটা আরও জটিল আকার ধারণ করল। ভাবলাম তবে কি...। বললাম কবে বিয়ে? ও বলল, টরশু। আমরা কাল সকালেই রওনা হবো। মাঝে এক দিন রেস্ট। পরদিন বিয়ে। আমার সন্দেহটা দোল খেতে লাগল। বললাম, ছেলের বাড়ি কোথায়? কী করে?
— বাড়ি আমাদের উপজেলা সদরে। বড় লোকের ছেলে। বিয়ের পর বিদেশ চলে যাবে। দেখতে শুনতেও ভালো।
আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। এতক্ষণ ধরেই নিয়েছিলাম যে, রনোর সঙ্গে হয়তো মায়ের পাকা কথা হয়ে গেছে। আমাকে কৌশলে সেখানে নিয়ে গিয়ে জোর করে একটা কিছু ঘটাবে রনো। এসব মনে করে আমি হো -হো করে হেসে উঠলাম। মাকে বললাম, মা একটু চা দাও না! ওর পাল্লায় পড়ে গলাটা আমার শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
চা খেতে খেতে রনো বলল, এখান থেকে আমার এক মামাতো ভাই যাবে। আর বন্ধুদের মধ্যে তুই। প্রাইভেট কার ঠিক করে রেখেছি। সোজা বাড়িতে পৌঁছে দেবে। তোকে এক কদমও হাঁটতে হবে না।
ওর কথা শুনে মায়ের সামনে আমার কেমন লজ্জা লজ্জা করতে লাগল। আমি হাসতে হাসতে বললাম, শহরে তোর এত বন্ধু থাকতে তুই আমাকে নিয়ে যেতে চাইছিস কেন?
এ কথার উত্তর খুঁজে না পেয়ে রনো মায়ের দিকে চেয়ে বলল, বলেন তো খালাম্মা, এই পিছলা বাইমটার কী উত্তর দেই। মা শুধু হাসলেন। রনো বলল, রেডি থাকবি, তোকে বাসা থেকে নিয়ে যাব।
আমি রনোর মতো শক্ত করে কিছু বলতে পারি না। ভাবছি কী বলব! রনো আমার রানের ওপর একটা চাটি মেরে বলল, কিরে, কিছুই তো বলছিস না।
— কী বলব?
— কী বলবি মানে? রেডি হয়ে থাকবি তো?
— প্রাইভেট কারে আমি যাব না।
— দেখ রঞ্জু, বগুড়ায় যদি এয়ারপোর্ট থাকত, তা হলে তোকে আমি প্লেনে করেই নিয়ে যেতাম। টাকাপয়সা কোনো ফ্যাক্টর নয়।
— আমি যেতে চাই খুব সাধারণ ভাবে। বাস, রিকশা, নৌকা এবং পায়ে হেঁটে।
রনো প্রশান্তির শ্বাস ফেলে কাদার মতো হয়ে বলল, তুই বাঁচালি আমাকে। আমি একটু রসিকতা করে বললাম, তোর অনেক টাকা বেঁচে গেল। আমার ধারণা ছিল, কথাটা শুনে ও চটে যাবে। কিন্তু রনো কণ্ঠটা আরও মোলায়েম করে বলল, আরে চান্দু, আসলে তা নয়। তুই যে যেতে চেয়েছিস, এতেই আমার শান্তি।
রনো চলে গেলে মা বললেন, যাবিই যখন তখন গাড়িতে যেতে চাইলি না কেন? আমি বললাম, মা, গ্রামে যাব কিন্তু গাড়ি কেন! গ্রামের ধুলোমাটি যদি পায়েই না লাগল তা হলে গ্রামে গিয়ে লাভ কী!
যা হোক, পরদিন তিনজন বগুড়ার উদ্দেশে রওনা করলাম। চেয়ার কোচে টিকিট কাটা হয়েছে। একটা বড় সিটে আমরা তিনজন। আমি জানালার পাশে। সাঁইসাঁই শব্দে ছুটে চলেছে বাস। হুড়পাড় করে বাতাস এসে ঢলে পড়ছে সারা শরীরে। ভালো লাগার ভেতর থেকে অকল্পিত কিছু মুখ মনের মধ্যে এই ভাসে, এই আবার মিলিয়ে যায়। আমার ভাবার মতো নিরূপিত কোনো মুখ নেই বলে আমার ভাবনার বিস্তার আছে। কখনও কখনও রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে মন ও শরীর। তখন সুর এসে ভর করে কণ্ঠে। কিন্তু বাসের মধ্যে গান গাইলে কিল একটাও মাটিতে পড়বে না। তবু গুনগুনিয়ে একটি গানের সুর তুললাম। রনো ফিসফিসিয়ে বলল, আর একটু গলা ছাড়। সামনের দুটো মেয়ে গান শুনে কেমন নড়াচড়া করছে। শুনেই আমি গুনগুনানি বন্ধ করলাম। রনো পড়িমড়ি করে বলে উঠল, থামলি কেন?
— কেউ মাইন্ড করতে পারে।
— ড্রাইভাররা যখন ক্যাসেট চালায়, তখন কি কেউ...।
ঠিক তখনই সামনের সিটের একটি মেয়ে অন্য মেয়েটিকে বলল, ভালোই তো লাগছিল, থামল কেন? অন্য মেয়েটি বলল, মনে হয় ব্যাটারিতে চার্জ নেই। বলেই ফিক করে হেসে উঠল। কথাটা শুনে আমিও হাসলাম। ভাগ্য ভালো, রনো শুনতে পায়নি। তারপর এ গল্প সে গল্প করতে করতে কত গ্রাম, কত মাঠ-ঘাট পার হয়ে একটা বড় নদীর ঘাটে পৌঁছলাম। নদীর ওপর বিশাল একটা ব্রিজ। রনো চেঁচিয়ে বলল, আমরা এখানেই নেমে যাব। বাস থামান। ওর মামাতো ভাই বলল, এখানে নামার কী দরকার? নদী পার হয়ে বটতলা নামলেই তো হতো। সেখান থেকে রিকশা নিয়ে যেতাম।
রনো সে কথার উত্তর না দিয়ে বলল, লাগেজগুলো হাতে নিয়ে ডান দিকে হাঁটা শুরু করো। তারপর ও আমার হাত থেকে আমার ব্যাগটাও ছোঁ দিয়ে নিয়ে বলল, এবার চল। কিছুটা পথ হাঁটতে হবে। মুন্সীপাড়ার ঘাটে গিয়ে নৌকায় যাব। আমি বললাম, আমার ব্যাগটা অন্তত আমার কাছে দে।
— অসুবিধা নেই। ব্যাগ নিয়ে ধুলোর মধ্যে তুই হাঁটতে পারবি না।
— তুই কি ভাবিস আমি দুর্বল? তোদের দু’জনের চেয়ে আমার গায়ে শক্তি বেশি। তা জানিস?
কে কার কথা শোনে। ওরা দু’জন আমাকে ফেলেই এগিয়ে চলল। ইট বিছানো রাস্তা—কোথাও গর্ত হয়ে আছে। পা ঠিকঠাক না পড়লে মচকানোর আশঙ্কা। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর বাঁ হাতে আমবাগান, বাঁশঝাড়ের মাঝ দিয়ে ছায়া সুনিবিড় পথ নেমে গেছে নদীর চরে। সেই ঢালু পথে লাগেজ নিয়ে কখনও ধীরে কখনও দৌড়ে ওরা চরে গিয়ে দাঁড়াল। রনো বলল, রঞ্জু, একা নামতে পারবি, না ধরতে হবে? ওর কথা শুনে আমার খুব হাসি এলো। আমিও দৌড়ে নামতে গেলাম। দু-চার পা ফেলার পরই বালু ফসকে গড়াতে গড়াতে একেবারে নিচে। রনো দৌড়ে এসে বলল, হলো তো। আমি হো হো শব্দে হাসতে হাসতে বললাম, দারুণ! এ যেন মায়ের হাতের মিষ্টি চড়। রনো দাঁত খিঁচিয়ে উঠল।
— তুই বুঝিস কম, বলিস বেশি।
— এখন কী করতে হবে, তাই বল।
— এখান থেকে নৌকায় যাব, তার পর অন্য ব্যবস্থা। গাড়িতে এলে কখন ঘরের দরজায় গিয়ে নামতে পারতাম। শুধু তোর জন্য এত ঝামেলা করতে হচ্ছে।
বেশ বড় নৌকা। কাঠের পাটাতনের ওপর পাটি বিছানো। আমি বললাম, চমত্কার। সব পরিশ্রম এবার উশুল হয়ে যাবে। রনো একটা চাদর বিছিয়ে দিয়েছে। মাঝি বসে আছে হাল ধরে। পালতোলা নৌকা এগিয়ে চলল উজানে। একটু বিশ্রামের পরই ছইয়ের বাইরে এসে দাঁড়ালাম। নদীর ঘাটে ঘাটে কিশোর-কিশোরীরা দল বেঁধে ঝাঁপাঝাঁপি করছে। শরীর মাঞ্জনে ব্যস্ত গাঁয়ের বধূরা। কেউ বা কলস কাঁখে ফিরে যাচ্ছে বাড়িতে। কোথাও কিশোর ছেলেরা দৌড়ে এসে লুঙ্গি খুলে উদোম গায়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে পানিতে।
রনো বলল, এবার গলা ছেড়ে গান ধর। তোর কথাই ঠিক রে। আমারও ভালো লাগছে। কত দিন নৌকায় চড়িনি। আমি অবশ্য প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। তখনই গান ধরলাম, ও নদীরে একটি কথা শুধাই শুধু তোমারে...। ঘাটে ঘাটে স্নানরত মেয়ে-পুরুষ সবাই মাজা পানিতে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে। গান শেষ হতেই রনো বলল, চালিয়ে যা। যতক্ষণ না আমরা ঘাটে পৌঁছাচ্ছি। আমি আবার ধরলাম—ও কেন এত সুন্দরী হলো...। আরও কিছুদূর যাওয়ার পর নদীর পাড়েই একটা স্কুল দেখলাম। স্কুলের মাঠে কয়েকজন ছেলেমেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের দেখে মনে হলো, ওরা হয়তো কোনো শহরের কলেজে পড়ালেখা করে। তখন বেলা পড়ে গেছে। বইছে মিষ্টি বিকেলের ঝিরঝির হাওয়া। আকাশে সাদা-কালো মেঘেরা একে অন্যের শরীর ছুঁয়ে ভাবে বিহ্বল। আমি আবার শুরু করলাম, ‘কতদিন দেখিনি তোমায়, মনে পড়ে তব মুখখানি।’ নৌকা এগিয়ে চলেছে। কোথাও নদীর একদিকে খাড়া পাড় অন্যদিকে বালুচর। তারপর গ্রাম। হঠাত্ লক্ষ্য করলাম, স্কুল মাঠের সেই ছেলেমেয়েরা নৌকার সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলেছে। গান শেষ হলে মেয়েরা হাত নাড়ল, আমিও নাড়লাম।
নদী বাঁক নিলো উত্তরে। নৌকা চলছে। রনো আগেই মোবাইলে আমাদের আগমন বার্তা পৌঁছে দিয়েছে বাড়িতে। চরের ঘাটে যেন লোকজন উপস্থিত থাকে। সন্ধ্যার ছায়া ক্রমেই গাঢ় হয়ে আসছে। হঠাত্ বাতাস পড়ে গেল। মাঝি কূল ঘেঁষে হাল ঠেলছে দু’হাতে। তখন চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে নদীর বুক। আমরাও ঘাটে পৌঁছলাম।
রতন নৌকা থেকে নেমে উপরে গেল। আমরাও নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। তখন মাঝি একগাল হেসে বলল, বাবা একটা কথা কবার চাই। রনো বলল, বকশিশ তো? মাঝি বলল, না বাবা। বলছিলাম ওই বাবাজি কি রেডিও-টেলিভিশনে গান গায়? মনে হয় তারে আমি দেখছি।
— না, ও কোথাও গায় না।
— বড় মিষ্টি গলা। ফিরার দিন আমার নৌকায় যাবেন।
— কোন পথে ফিরব, এখন ঠিক বলা যাচ্ছে না।
তিন-চারটি ছেলে সঙ্গে নিয়ে ফিরে এলো রতন। হাতে হাতে লাগেজগুলো নিয়ে উপরে চলে গেল ওরা। আমি আর রনো গিয়ে ভ্যানে বসলাম পা ঝুলিয়ে। অন্যরা ভ্যানের সঙ্গে তাল রেখে চলতে লাগল। চলতে চলতে একটা খালের সামনে এসে ভ্যান দাঁড়াল। পথটা ঢালু। রনোকে নামতে দেখে আমিও ভ্যান থেকে নামতে গেলাম। হায় হায় করে উঠল রনো।
তুই নামছিস কেন? তুই বসে থাক। অন্যরাও বলল, আপনি বসে থাকেন। ওরা দু’দিক থেকে ভ্যান ধরে নিচে নামিয়ে, আবার উপরে টেনে তুলল। এবার খুব বড় একটা আম বাগানের সামনে এলাম। বাইরে চাঁদের আলো বাগানের ভেতরে জমাট অন্ধকার। এই বাগানটার মাঝ দিয়েই পথ। হঠাত্ সামনে দিয়ে দু-তিনটা শিয়াল দৌড়ে রাস্তা পার হলো। দু-একটা বাদুড়ও উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। মনে পড়ল শরত্চন্দ্রের বিলাসী গল্পের কথা। এ যেন মৃত্যুঞ্জয়ের সেই আমবাগান। আমার সঙ্গে কেউ নেই। আমি অন্ধকার হাতড়ে সাপ বিচ্ছুর ভয় না করে বিলাসীর কাছে যাচ্ছি। বিলাসী মাটির প্রদীপ জ্বেলে আমার পথ চেয়ে বসে আছে। বাগানটা পার হয়ে ছোট্ট মাঠের মধ্যে গিয়ে বললাম, আর কত দূর?
রতন হাসতে হাসতে বলল, ওই যে সামনের গ্রাম। হ্যাজাক লাইট জ্বলছে, ওটাই রনো ভাইদের বাড়ি। ধুলো মাড়িয়ে বাড়ির সামনে ভ্যান পৌঁছাতেই এক পাল ছেলেমেয়ে ছুটে এলো আমাদের দেখতে। পথের ওপর ঠেলাঠেলি করে আমাকে দেখছে ওরা। হঠাত্ মনের মধ্যে সেই সন্দেহটা আবার নড়াচড়া করে উঠল। মনে মনে বললাম, এত জামাই আদরের অর্থ কী! ঢাকার মেহমান, সে কি চিড়িয়াখানার জীব? বিষ ভাঙা সাপের মতো মনটা যেন অসহায় হয়ে পড়ল। আপন মনেই বললাম, ওরে রনো, তোর মনে কি এই ছিল!
সুপারি গাছের মাঝ দিয়ে পথ চলে গেছে ওদের বাড়ির উঠোনে। প্রথমেই ওয়াল করা বড় একটা টিনের কাচারি। উঠোনের পরই থাকার ঘরগুলো। খোলা উঠোনে চেয়ার-টেবিল সাজানো। সেখানেই বসলাম আমরা। এ বাড়ি সে বাড়ি থেকে লোকজন এলো আমাদের দেখতে। তারপর মুখ-হাত ধুয়ে ফ্রেশ হতেই দেখি, টেবিল ভরে গেছে নানান পদের নাস্তায়। রনো বলল, নে একটু নাস্তা করে নে। রতনও বলল, রঞ্জু ভাই, নাস্তা করেন। তারপর চা খাওয়া যাবে। সবাই অপেক্ষা করছে আমার জন্য। আমি শুরু করলে সবাই তখন হাত লাগাতে পারে। শেষে গরম চিতই পিঠা আর চিংড়ি মাছ দিয়ে শাক পিঠালু দেখে বড় লোভ হতে লাগল। রুটি, মাংস, সেমাই ছাড়াও মিষ্টি রয়েছে কয়েক পদের। আমি চিতই পিঠা খেতে শুরু করলাম। তখন অন্যরাও যার যার ইচ্ছেমত খেতে শুরু করল।
নাস্তা শেষ হলে রতন বলল, রঞ্জু ভাইয়া কাল একটা গেট তৈরি করতে হবে। আমরা এমন কিছু করতে চাই, যা দেখে বরযাত্রীরা অবাক হয়ে যায়।
— বেশ তো। আমি নিজে কখনও এসব কাজ না করলেও কিছু আইডিয়া আছে আমার মাথায়।
— আপনি যেভাবে বলবেন, আমরা সেভাবেই করতে পারব।
— রতন তুমি কি আমার সঙ্গে একটু যাবে?
— কোথায়?
— ওই রাস্তার দিকে।
আমরা হাঁটতে হাঁটতে সুপারি গাছগুলোর মধ্যে গিয়ে দাঁড়ালাম। চাঁদের আলোয় সুপারি গাছের ছায়া যেন মিষ্টি এক আলপনা আঁকা। রতনকে বললাম, ছেলেপক্ষ মেয়ে দেখেছে?
— দেখেছে। খুব পছন্দও করে গেছে।
— ছেলে দেখেছো?
— দেখেছি।
— দেনা-পাওনা আছে?
— না।
ভয়টা কেটে গিয়ে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠল। রনো আমাকে নিয়ে গেল বাড়ির মধ্যে। ওর ঘরে গিয়ে বসলাম। একটু পর রনোর মা-বাবা দু’জনই এলেন। আমার সঙ্গে আলাপ করলেন। আমার বাবা-মার কথা শুনলেন। রনোদের গ্রামের পরিবেশ আর আমাদের শহরের পরিবেশ দু’রকম হলেও স্নেহ-মমতায় ওর বাবা-মার তুলনা হয় না। আমার খুব ভালো লাগল। কথার ফাঁকে রনোর মা বললেন, অনেক কষ্ট করে তুমি শহর থেকে গরিবের বাড়িতে এসেছো। আমি খুব খুশি হয়েছি। আর একটা কথা। তোমার যখন যা খেতে ইচ্ছে করে, আমাকে বলো।
আমি বললাম, খালাম্মা আমাকে নিয়ে আপনি একটুও চিন্তা করবেন না। আমার বাড়তি কিছু চাওয়ার নেই। রনো যা খায়, আমিও তাই খেতে পারব। রনো বলল, মা আমাদের খাবার নিয়ে আস। অনুকেও আসতে বলো। ও কি রঞ্জুকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে?
আমাদের রাতের খাবার এলো। রনোর মায়ের সঙ্গে অনুও এলো। রনো বলল, এই হলো অনু। আমার একমাত্র বোন। এবার ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছে। ইচ্ছে ছিল, ঢাকা নিয়ে গিয়ে পড়াব। কিন্তু তার আগেই বেজে উঠল বিয়ের সানাই। পরশু দিন চলে যাবে শ্বশুরবাড়ি।
অনু লজ্জায় লাল হয়ে গেল। গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে ভিজিয়ে দিল খাওয়ার টেবিল। লজ্জায় ঘর থেকে বের হয়ে কেঁদে ফেলল ও। রনো হাসতে হাসতে বলল, বিয়ের ফুল ফুটলে বিয়ে তো হবেই। এতে লজ্জা পাওয়ার কী আছে। তোর বিয়ে হয়ে গেলে আমিও তো বিয়ে করব।
খালাম্মা বললেন, তুই চুপ করবি? মেয়েটা এমনিতেই লাজুক। তার ওপর এই ছেলেটার সামনে এত কিছু বলার দরকার কী তোর? রনো হাসতে হাসতে বলল, আমার খুব অন্যায় হয়ে গেছে। অনু মণি এই যে আমি কান ধরছি, আর বলব না। প্রথমে অনুকে বিব্রত করার জন্য আমার খুব খারাপ লাগছিল। পরে রনোর কাণ্ড দেখে আমি হো-হো করে হাসতে লাগলাম। ভাইবোনের এমন মধুর সম্পর্ক দেখে আমি মুগ্ধ হলাম। অনুর ছিপছিপে গড়ন। মিষ্টি মুখ, লম্বা চুল। গায়ের রংটাও উজ্জ্বল শ্যামলা, যা আমার প্রিয়।
পরদিন নদীতে সাঁতার কাটলাম। বিকালে রনোর সঙ্গে বাজারে গেলাম বেড়াতে। বাজারের পাশেই হিন্দু এলাকা। যার সঙ্গেই দেখা হয়, সে-ই মিষ্টি খাওয়ানোর জন্য নাছোড় হয়ে ওঠে। বাধ্য হয়ে একটু হলেও খেতে হয়। সন্ধ্যার পর ফিরে এসে দেখি উঠোন ভরে গেছে পাড়ার মানুষে। তাছাড়া রনোদের বাড়িতেও অনেক মেহমান এসেছে বিয়ে উপলক্ষে।
ঝাড়া-মোছা আকাশে হাসছে চাঁদ। বইছে ঝিরঝির মিষ্টি হাওয়া। থেমে গেছে পাখিদের কলকাকলি। নদীর ওপাড় থেকে ভেসে আসছে মেঠো গানের সুর। একটি ছেলে জ্বলন্ত হারিকেন এনে টেবিলে রাখল। আমি বললাম, এমন সুন্দর চাঁদের আলোয় হারিকেন জ্বালানোর দরকার কী।
রনো বলল, এমন সুন্দর রাত, এই রাতে তোর গান না শুনে মনের মধ্যে শান্তি পাচ্ছিনা রে রঞ্জু। গান ধর। এই রাতটা সবার মনে স্মৃতি হয়ে থাকবে। রনোর এমন সুন্দর কথায় আমার মন গলে গেল। তবু বললাম, গান গাইলে সবাই আমাকে পাগল ভাববে। রতন ছুটে এসে মিনতি করে বলল, প্লিজ রঞ্জু ভাইয়া, আপনি আর না বলবেন না।
শেষে টেবিলে টোকা দিয়ে আমিও শুরু করলাম। ‘সজনি গো যদি এলে, রজনীকে বলো সে যেনো ভোর না হয়...।” গান শেষ না হতেই দেখি ফ্ল্যাক্স ভরে চা এসে গেছে। রতন খুব যত্নসহকারে কাপে চা ঢেলে আমার সামনে রাখল। রনো বলল, আমাকেও এক কাপ দিস। আজ সারারাত আমরা রঞ্জুর গান শুনব। আমি চা খেয়ে আবার গান শুরু করলাম। ‘মুছে যাওয়া দিনগুলো আমায় যে পিছু ডাকে, স্মৃতি যেন বেদনার রঙে রঙে ছবি আঁকে...।’ তারপর ‘আমার বলার কিছু ছিল না, না গো... চেয়ে চেয়ে দেখলাম তুমি চলে গেলে...।’ গান চলছে। একটা শেষ হতেই অনুরোধ আসছে আরেকটা গাওয়ার জন্য। আমি লক্ষ্য করলাম, ভিতর বাড়ির সব ঘরের জানালা খুলে গেছে। মেয়েরা দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে জানালায়। অত বড় উঠোনটাও ভরে গেছে ছোট-বড় নানান বয়সের মানুষে। শেষে গাইলাম কবি নজরুলের বিখ্যাত গানটি। মোর প্রিয়া হবে এসো রাণী দেবো খোঁপায় তারার ফুল...।
কিন্তু শেষ হইয়াও হইল না শেষ। আবার অনুরোধ। আরও দুটো গান গাওয়ার পর রনো বলল, আজ এখানেই শেষ। ভাগ্যে থাকলে আবার হবে। আমরা শুতে গেলাম ভেতরে। লোকজন তখনও বসে আছে।
পরদিন সকালে অনেক ছেলেমেয়ে এলো আমার সঙ্গে বিয়ের গেট তৈরি করবে বলে। ভ্যানে মাইক এলো। মাইকে গানও শুরু হলো। গেট তৈরির কাজ প্রায় শেষ। এর মধ্যে দুটো মোটরসাইকেলে চারটি ছেলে এলো। উঠানের পাশে গাড়ি রেখেই ওরা বাড়ির ভেতর চলে গেল। একটু পরই ভেতর থেকে রনোর ডাক এলো। আমরা কাজ শেষ করে চা খাচ্ছি।
লক্ষ্য করলাম বাড়ির সবাই কেমন চুপ হয়ে গেছে। কারও মধ্যেই আগের সেই উচ্ছ্বাস নেই। খুশি খুশি ভাব নেই। কি ভেবে আমি সোজা বাড়ির মধ্যে গেলাম। রনোকে বললাম, কী ব্যাপার? সবাইকে কেমন মনমরা দেখাচ্ছে। রনো গম্ভীর হয়ে বলল, একটা দুঃসংবাদ।
— আমাকে বলা যায় না?
— কেন যাবে না। যে ছেলেটির সঙ্গে অনুর বিয়ে ঠিক হয়েছিল, তাকে গতরাতে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
— অপরাধ?
— ও নাকি সন্ত্রাসী।
— কী নাম ছেলেটির।
— সুজন শরীফ।
— ডাকনাম কি সুজন? সে কি ভার্সিটির হলে থাকত?
— হ্যাঁ।
— আমি যে সুজনকে জানি, তার বাড়িও তোদের উপজেলায়। সে তার রুমমেটের বাবার কাছ থেকে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়েছিল। লোকটা গ্রাম থেকে এসেছিল ছেলেকে টাকা দিতে। হলে যাওয়ার পথেই এই সুমন লোকটাকে রাস্তা থেকে গলির মধ্যে ডেকে নিয়ে বুকের ওপর অস্ত্র ধরে সব কিছু কেড়ে নিয়েছিল। পর দিন খুব সকালে ঘুমন্ত সুজনকে দেখে লোকটা তার ছেলেকে বলেছিল। এই সেই ছিনতাইকারী, যে তার কাছ থেকে টাকাপয়সা ছিনিয়ে নিয়েছে। রুমমেট ছেলেটি বাবাকে শান্ত করে তখনই তাকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়। ছেলেটি ভদ্র। একদিন কথায় কথায় ঘটনাটা বলেছিল আমাদের। আমি আগে জানলে কিছুতেই এখানে আসতাম না।
তারপর রনো বাড়ির সবাইকে ঘটনাটা জানাল। তখন সবার মনে এই শান্তি ফিরে এলো যে, বিয়ে না হয়ে বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। রতনের কাছে জানলাম, অনু খুব খুশি হয়েছে। তবে তাদের একমাত্র মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাওয়ার জন্য কারও মনেই আনন্দ নেই।
দুপুরে অনুর মা আমাদের খেতে দিয়ে কেঁদে ফেললেন। বললেন, বাবা, তুমি কত আশা করে আনন্দ করতে এসেছিলে, কিন্তু কী হতে কী হয়ে গেল। আমি একটি কথাও বলতে পারলাম না। সামান্য খেয়েই বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। রনো একদম চুপ হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে তেমন কথা বলছে না। আমি সন্ধ্যায় একা একা নদীর চরে বসে আছি। ভাবছিলাম, এত আয়োজন এত হাসি-খুশি কেন এমন করে শেষ হয়ে গেল। আমার খুব খারাপ লাগছিল। এমন সময় রনো এসে বলল, যা হওয়ার হয়েছে আমরা কাল সকালেই ঢাকা রওনা দেব।
ফিরে এসে নাস্তা করে চা খেলাম। রনো ওর মাকে বলল, মা, আমরা কাল সকালেই চলে যাব। মা বললেন, আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন। তাছাড়া আমাদের এ অবস্থায় ফেলে তুই কীভাবে যাবি।
কথা শেষ না হতেই রনো আমাকে বলল, তুই কি আমার সঙ্গে বাজারে যাবি? আমি বললাম, না। আমি বরং রতনকে নিয়ে নদীর দিকে যাই। নদীর পাড়ে বসে অনেক গল্প করলাম রতনের সঙ্গে। এক সময় রতনকে বললাম, রতন, অনু তো তোমার ফুফাতো বোন, তাই না? আমি যদি অনুকে নিতে চাই, তাহলে তোমার ফুফা-ফুফু কি রাজি হবে!
রতন হঠাত্ পাগলের মতো আমাকে জাপটে ধরে বলল, রঞ্জু ভাইয়া, একি আপনার মনের কথা? এ কথা শুনলে ফুফা-ফুফু আপনাকে মাথায় তুলে নাচবে। আর সবচেয়ে বেশি খুশি হবে আমাদের অনু। আমি বললাম, যদি তাই হয়, তাহলে ঢাকা থেকে আমার মাকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করো।
রতন খুশিতে আত্মহারা হয়ে দৌড়ে গেল বাড়ির দিকে। আমি জোছনা ঝিলমিল নদীর দিকে চেয়ে মনে মনে হাসলাম। আর অনুর লজ্জা রাঙা মুখটা যেন আমার চতুর্দিকে জোনাকির মতো লুকোচুরি খেলায় মেতে উঠল!
সূত্র : আমার দেশ
No comments:
Post a Comment