ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০-১৮৯১) বাঙালির চিন্তাজগতে দুটো কারণে স্মরণীয়। একটি তার সামাজিক দায়িত্বশীলতা ও দ্বিতীয়টি তার বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মপ্রবণতা। বিধবা-বিবাহ চালু করা এবং বহু বিবাহ প্রথা রোধ করার জন্য তিনি গ্রন্থ লিখেছেন। লেখালেখির ব্যাপারে এটি তাঁর সামাজিক দায়বদ্ধতা। ইংরেজি, হিন্দি ও সংস্কৃত ভাষা থেকে শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ অনুবাদ করে বাঙালির বুদ্ধিবৃত্তিকে তিনি উচ্চপর্যায়ে নিয়ে গেছেন—এটি তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মশীলতা। এভাবে বিদ্যাসাগর সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক—উভয় ক্ষেত্রে প্রাজ্ঞ ও দূরদর্শী ভূমিকা পালন করেছেন।
বিদ্যাসাগর খুব বাস্তব-সচেতনতাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। সামাজিক কুসংস্কারকে শোধন করে সমাজের মানুষের মধ্যে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রণোদনা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সাহিত্যচর্চাও ছিল সমাজশোধনকেন্দ্রিক। সাহিত্য ও সমাজ দুটোকেই তিনি সমান্তরালে উপস্থাপিত করে সমাজের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন।
বিধবা-বিবাহ তিনি আপন স্বজনের মধ্যেই প্রবর্তিত করে তাঁর হৃদয়গত উদারতা ও বাস্তবসম্মত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। হিন্দু বিধবা নারীদের পুনরায় বিয়ে না হওয়ায় সমাজে নানা অনাচার ও পতিতাবৃত্তি বেড়ে চলছিল। বিদ্যাসাগর বিধবাদের বিবাহ চালু করার জন্য গ্রন্থ রচনা ও সামাজিক ভূমিকা পালন করে সমাজকে পাপ ও পঙ্কিলতামুক্ত করতে চেয়েছেন।
হিন্দু-ব্রাহ্মণরা বহুসংখ্যক নারীকে বিয়ে করত। সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব প্রবল হয়। নারীদের মানবেতর জীবনযাপনের কষ্টকে অনুভব করে বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রোধকল্পে গ্রন্থ রচনাই নয় শুধু; সামাজিক আন্দোলনও সংগঠিত করে এই কুপ্রথাকে দূর করে সমাজকে শোধন করেছেন। তাঁর জ্ঞানকে তাই মধুসূদন দত্ত বলেছেন, প্রাচীন ঋষির জ্ঞান, যা মানবিক, উদার ও কল্যাণময় এবং সেই ঋষিদের মতো তিনি ছিলেন প্রতিভাধর। তাঁর কর্মচাঞ্চল্য ছিল ইংরেজের মতো; অথচ নারীদের তথা মানুষের দুঃখ দূরীকরণে তাঁর হৃদয় ছিল বাঙালি মায়ের মতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মৌল রহস্য ও জীবনসত্তা মধুসূদনের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতির মধ্যে প্রাপ্তব্য : ঞযব সধহ ঃড় যিড়স ও যধাব ধঢ়ঢ়বধষবফ যধং ঃযব মবহরঁং ধহফ রিংফড়স ড়ভ ধহ ধহপরবহঃ ঝধমব, ঃযব বহবত্মু ড়ভ ধহ ঊহমষরংযসধহ ধহফ ঃযব যবধত্ঃ ড়ভ ইবহমধষর সড়ঃযবত্. মাইকেল মধুসূদনের এই ভাষ্যটি বিদ্যাসাগরের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বিদ্যাসাগর শিশু শিক্ষার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ শিশুদের বর্ণমালা শিক্ষা, ভাষা, ব্যাকরণ, মনীষীদের জীবনী, ইতিহাস ইত্যাদি সঠিকভাবে শেখাতে না পারলে জ্ঞান ও ভাষার ওপর তাদের দখল সৃষ্টি হবে না এবং মনীষীদের জীবনবৃত্তান্ত না জানলে মহত্ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রবণতা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে না। সে জন্য তিনি নিজেও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থগুলো হলো : বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবনচরিত, বোধোদয়, ঋজুপাঠ, বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী ও আখ্যানমঞ্জরি। শিশুদের শিক্ষার ভিত্তিকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে প্রায় দেড়শ বছর আগে তাঁর এই প্রচেষ্টা যে কত দূরদর্শী প্রাজ্ঞতাপ্রসূত, তা শিক্ষাবিদরা খুবই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাধ্যমে স্মরণ করেন।
বিদ্যাসাগর শেক্সপিয়র ও কালিদাসের নাটক যথাক্রমে ইংরেজি ও সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করেছিলেন। শেক্সপিয়রের ইংরেজ পাত্রপাত্রীদের তিনি বাঙালিয়ানায় জারিত করে অনুবাদ করেছেন বলে তাঁর অনুবাদ মৌলিকত্ব পেয়েছেন। ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি শেক্সপিয়রের মানবচেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।
কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে তিনি শকুন্তলা নামে সংস্কৃত থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন প্রায় দেড়শ বছরেরও আগে। তখন বাংলা গদ্য মাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে। কালিদাসের নাটককে তিনি উপন্যাসোপম ভাষায় বঙ্গানুবাদ করেছেন। বাঙালির উপন্যাস-রচনার সূচনাপর্বের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর ব্যাপারে প্রচণ্ড প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন তিনি সে জন্য বিদ্যাসাগরকে বাংলা উপন্যাস রচয়িতাদের গুরু হিসেবেও আখ্যায়িত করতে চাই।
বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী—এটি সর্বজনবিদিত কথা। তিনি বিরতি চিহ্ন ও বাংলা ভাষার অভ্যন্তরীণ ছন্দ ও বৈভবের রহস্যকে উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলেন বলেই বাংলা ভাষাকে তিনি ভিত্তি দিতে সমর্থ হয়েছেন। বাংলা গদ্যকে তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন বলেই বাংলা প্রবন্ধ, নাটক ও উপন্যাস রচনার ভিত্তি নির্মিত হয়েছে বলে মনে করি। সে জন্য বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ, নাটক ও উপন্যাসের ভিত্তি নির্মাতা হিসেবেও তাঁকে চিহ্নিত করা চলে।
বিদ্যাসাগরকে অনেক সাহিত্য-সমালোচক ও চিন্তাবিদ অনুবাদক ও সমাজকর্মী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। মৌলিক সাহিত্যস্রষ্টার মর্যাদা তাঁকে দিতে চান না। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে নই। বিদ্যাসাগর চিন্তাবিদ-প্রাবন্ধিক। প্রবন্ধকারও মৌলিক চিন্তা করে থাকেন—সে জন্য তিনিও মৌলিক চিন্তাবিদ ও সাহিত্যস্রষ্টা। তাঁর ‘প্রভাবতী-সম্ভাষণ’ গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা স্বীকার করতে বাধ্য যে মৌলিক সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবেও তাঁর মনন কত উচ্চ শ্রেণীর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করে ছিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা-গদ্যকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর স্থাপন করেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব প্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর হইতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলির মধ্যে অংশ যোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবল সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন, তাহা নহে। তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। গদ্যের পদগুলোর মধ্যে একটি ধ্বনি সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া, তাহার গতির মধ্যে একটা অনতিলক্ষ্য ছন্দস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য ও সরল শব্দগুলো নির্বাচন করিয়া বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন।’
বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ চালুকরণ, বহু বিবাহ রোধ, শিশু শিক্ষার প্রতি মনোযোগ, ইংরেজি, সংস্কৃত ও হিন্দি থেকে অনুবাদ—সব কিছুই সমাজ-উন্নয়নকেন্দ্রিক। বাংলা ভাষাকে বিরতি-চিহ্ন দিয়ে সুগঠিত করার ক্যারিশমাও তাঁর সাহিত্যিক বুদ্ধিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ দিক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, পাণ্ডিত্য, শিশু মনস্তত্ত্ব বিকাশ প্রচেষ্টা, দয়ার্দ্রচিত্ততা ও তেজস্বিতাময় দূরদর্শী প্রাজ্ঞতা বাঙালি সমাজে তাঁকে বিরল খ্যাতিতে বিভূষিত করেছে নিঃসন্দেহে।
বিদ্যাসাগর খুব বাস্তব-সচেতনতাসম্পন্ন মানুষ ছিলেন। সামাজিক কুসংস্কারকে শোধন করে সমাজের মানুষের মধ্যে তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রণোদনা সৃষ্টি করেছেন। তাঁর সাহিত্যচর্চাও ছিল সমাজশোধনকেন্দ্রিক। সাহিত্য ও সমাজ দুটোকেই তিনি সমান্তরালে উপস্থাপিত করে সমাজের কল্যাণ সাধনে ব্রতী হয়েছিলেন।
বিধবা-বিবাহ তিনি আপন স্বজনের মধ্যেই প্রবর্তিত করে তাঁর হৃদয়গত উদারতা ও বাস্তবসম্মত দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। হিন্দু বিধবা নারীদের পুনরায় বিয়ে না হওয়ায় সমাজে নানা অনাচার ও পতিতাবৃত্তি বেড়ে চলছিল। বিদ্যাসাগর বিধবাদের বিবাহ চালু করার জন্য গ্রন্থ রচনা ও সামাজিক ভূমিকা পালন করে সমাজকে পাপ ও পঙ্কিলতামুক্ত করতে চেয়েছেন।
হিন্দু-ব্রাহ্মণরা বহুসংখ্যক নারীকে বিয়ে করত। সমাজে এর নেতিবাচক প্রভাব প্রবল হয়। নারীদের মানবেতর জীবনযাপনের কষ্টকে অনুভব করে বিদ্যাসাগর বহুবিবাহ রোধকল্পে গ্রন্থ রচনাই নয় শুধু; সামাজিক আন্দোলনও সংগঠিত করে এই কুপ্রথাকে দূর করে সমাজকে শোধন করেছেন। তাঁর জ্ঞানকে তাই মধুসূদন দত্ত বলেছেন, প্রাচীন ঋষির জ্ঞান, যা মানবিক, উদার ও কল্যাণময় এবং সেই ঋষিদের মতো তিনি ছিলেন প্রতিভাধর। তাঁর কর্মচাঞ্চল্য ছিল ইংরেজের মতো; অথচ নারীদের তথা মানুষের দুঃখ দূরীকরণে তাঁর হৃদয় ছিল বাঙালি মায়ের মতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের চরিত্রের মৌল রহস্য ও জীবনসত্তা মধুসূদনের নিম্নোক্ত উদ্ধৃতির মধ্যে প্রাপ্তব্য : ঞযব সধহ ঃড় যিড়স ও যধাব ধঢ়ঢ়বধষবফ যধং ঃযব মবহরঁং ধহফ রিংফড়স ড়ভ ধহ ধহপরবহঃ ঝধমব, ঃযব বহবত্মু ড়ভ ধহ ঊহমষরংযসধহ ধহফ ঃযব যবধত্ঃ ড়ভ ইবহমধষর সড়ঃযবত্. মাইকেল মধুসূদনের এই ভাষ্যটি বিদ্যাসাগরের সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উভয় দায়িত্বশীলতার ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
বিদ্যাসাগর শিশু শিক্ষার ওপর অত্যধিক গুরুত্ব দিয়েছেন। কারণ শিশুদের বর্ণমালা শিক্ষা, ভাষা, ব্যাকরণ, মনীষীদের জীবনী, ইতিহাস ইত্যাদি সঠিকভাবে শেখাতে না পারলে জ্ঞান ও ভাষার ওপর তাদের দখল সৃষ্টি হবে না এবং মনীষীদের জীবনবৃত্তান্ত না জানলে মহত্ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার প্রবণতা তাদের মধ্যে সৃষ্টি হবে না। সে জন্য তিনি নিজেও শিশুতোষ গ্রন্থ রচনা করেছেন। গ্রন্থগুলো হলো : বাঙ্গালার ইতিহাস, জীবনচরিত, বোধোদয়, ঋজুপাঠ, বর্ণপরিচয়, কথামালা, চরিতাবলী ও আখ্যানমঞ্জরি। শিশুদের শিক্ষার ভিত্তিকে মজবুত করার উদ্দেশ্যে প্রায় দেড়শ বছর আগে তাঁর এই প্রচেষ্টা যে কত দূরদর্শী প্রাজ্ঞতাপ্রসূত, তা শিক্ষাবিদরা খুবই শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাধ্যমে স্মরণ করেন।
বিদ্যাসাগর শেক্সপিয়র ও কালিদাসের নাটক যথাক্রমে ইংরেজি ও সংস্কৃত থেকে অনুবাদ করেছিলেন। শেক্সপিয়রের ইংরেজ পাত্রপাত্রীদের তিনি বাঙালিয়ানায় জারিত করে অনুবাদ করেছেন বলে তাঁর অনুবাদ মৌলিকত্ব পেয়েছেন। ভাষা ও সাহিত্যকে তিনি শেক্সপিয়রের মানবচেতনা ও বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন।
কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে তিনি শকুন্তলা নামে সংস্কৃত থেকে বাংলা অনুবাদ করেছেন প্রায় দেড়শ বছরেরও আগে। তখন বাংলা গদ্য মাত্র বিকশিত হতে শুরু করেছে। কালিদাসের নাটককে তিনি উপন্যাসোপম ভাষায় বঙ্গানুবাদ করেছেন। বাঙালির উপন্যাস-রচনার সূচনাপর্বের প্রচেষ্টাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর ব্যাপারে প্রচণ্ড প্রভাব সৃষ্টি করেছিলেন তিনি সে জন্য বিদ্যাসাগরকে বাংলা উপন্যাস রচয়িতাদের গুরু হিসেবেও আখ্যায়িত করতে চাই।
বিদ্যাসাগর বাংলা ভাষার প্রথম যথার্থ শিল্পী—এটি সর্বজনবিদিত কথা। তিনি বিরতি চিহ্ন ও বাংলা ভাষার অভ্যন্তরীণ ছন্দ ও বৈভবের রহস্যকে উদ্ঘাটন করতে পেরেছিলেন বলেই বাংলা ভাষাকে তিনি ভিত্তি দিতে সমর্থ হয়েছেন। বাংলা গদ্যকে তিনি প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন বলেই বাংলা প্রবন্ধ, নাটক ও উপন্যাস রচনার ভিত্তি নির্মিত হয়েছে বলে মনে করি। সে জন্য বাংলা সাহিত্যের প্রবন্ধ, নাটক ও উপন্যাসের ভিত্তি নির্মাতা হিসেবেও তাঁকে চিহ্নিত করা চলে।
বিদ্যাসাগরকে অনেক সাহিত্য-সমালোচক ও চিন্তাবিদ অনুবাদক ও সমাজকর্মী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। মৌলিক সাহিত্যস্রষ্টার মর্যাদা তাঁকে দিতে চান না। আমি এই দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে নই। বিদ্যাসাগর চিন্তাবিদ-প্রাবন্ধিক। প্রবন্ধকারও মৌলিক চিন্তা করে থাকেন—সে জন্য তিনিও মৌলিক চিন্তাবিদ ও সাহিত্যস্রষ্টা। তাঁর ‘প্রভাবতী-সম্ভাষণ’ গল্পটি যারা পড়েছেন, তারা স্বীকার করতে বাধ্য যে মৌলিক সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবেও তাঁর মনন কত উচ্চ শ্রেণীর।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে সর্বোচ্চ মর্যাদায় সমাসীন করে ছিলেন। বিদ্যাসাগর বাংলা-গদ্যকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর স্থাপন করেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথের পক্ষে তা সম্ভব হয়েছে। বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরের অবদান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য উদ্ধৃতিযোগ্য : ‘বাংলা ভাষাকে পূর্ব প্রচলিত অনাবশ্যক সমাসাড়ম্বর হইতে মুক্ত করিয়া তাহার পদগুলির মধ্যে অংশ যোজনার সুনিয়ম স্থাপন করিয়া বিদ্যাসাগর যে বাংলা গদ্যকে কেবল সর্বপ্রকার ব্যবহারযোগ্য করিয়াই ক্ষান্ত ছিলেন, তাহা নহে। তিনি তাহাকে শোভন করিবার জন্যও সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন। গদ্যের পদগুলোর মধ্যে একটি ধ্বনি সামঞ্জস্য স্থাপন করিয়া, তাহার গতির মধ্যে একটা অনতিলক্ষ্য ছন্দস্রোত রক্ষা করিয়া, সৌম্য ও সরল শব্দগুলো নির্বাচন করিয়া বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্যকে সৌন্দর্য ও পরিপূর্ণতা দান করিয়াছেন।’
বিদ্যাসাগরের বিধবা-বিবাহ চালুকরণ, বহু বিবাহ রোধ, শিশু শিক্ষার প্রতি মনোযোগ, ইংরেজি, সংস্কৃত ও হিন্দি থেকে অনুবাদ—সব কিছুই সমাজ-উন্নয়নকেন্দ্রিক। বাংলা ভাষাকে বিরতি-চিহ্ন দিয়ে সুগঠিত করার ক্যারিশমাও তাঁর সাহিত্যিক বুদ্ধিবৃত্তির শ্রেষ্ঠ দিক। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সমাজসংস্কার, শিক্ষাবিস্তার, পাণ্ডিত্য, শিশু মনস্তত্ত্ব বিকাশ প্রচেষ্টা, দয়ার্দ্রচিত্ততা ও তেজস্বিতাময় দূরদর্শী প্রাজ্ঞতা বাঙালি সমাজে তাঁকে বিরল খ্যাতিতে বিভূষিত করেছে নিঃসন্দেহে।
No comments:
Post a Comment