দিনকয়েক থেকে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাবেক ইঞ্জিনিয়ার জাহাঙ্গীর খানের ভালো ঘুম হচ্ছে না। একটা অস্বস্তিকর মানসিকতায় তার সময় কাটছে। খেতে ইচ্ছা করে না, কারও সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করে না। বই পড়তে বা টিভি দেখতেও ভালো লাগে না। অন্তহীন বিশ্রামে সুখ নেই। সব মানুষের জীবনেই কি এমন একটা সময় আসে, যখন কোনো কিছুই ভালো লাগে না? নিজেকে প্রশ্ন করেন জাহাঙ্গীর খান।
স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে একদিন জাহাঙ্গীর খানকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো। সব শুনে ডাক্তার বললেন, ঘুম না হওয়ার জন্য মানসিক দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বয়স বাড়লে ঘুম কমে, খাওয়া কমে, শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়। জাহাঙ্গীর খান যোগ করেন, এবং আয়ুও কমে। ডাক্তার বললেন, তা তো অবশ্যই। একটু থেমে বললেন, আপনার সময় কাটে কী করে?
জাহাঙ্গীর খান জবাব দেন, সময় কাটে না বলেই তো আপনার কাছে এলাম। সময় কাটানোর জন্য যে বয়সে মানুষের প্রচুর ঘুমের দরকার, আপনি বলছেন সে বয়সে ঘুম কমে যায়। অদ্ভুত প্রকৃতির নিয়ম! কর্মহীন এক একটি মুহূর্ত আমার কাছে শতবর্ষের মতো এবং এক একটি রাত সহস্র রজনীর মতো দীর্ঘ মনে হয়।
ডাক্তার বললেন, সব সমস্যা দূর হবে যদি আপনি আমার কথা মেনে চলেন। জাহাঙ্গীর খান বললেন, বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপনার সব নির্দেশ আমি মেনে চলব। ডাক্তার বললেন, আপনাকে প্রতিদিন সকালে অথবা বিকেলে ঘড়ি ধরে দু’ঘণ্টা হাঁটতে হবে। জাহাঙ্গীর খান বললেন, বেশি হাঁটাহাঁটি আমার ভালো লাগে না। সারাজীবন অনেক হেঁটেছি। আর হাঁটতে চাই না। ডাক্তার বললেন, সারাজীবন ভাত খেয়েছেন বলে কি আর ভাত খাবেন না? জাহাঙ্গীর খান বললেন, ভাত খেতে হয় জীবনধারণ করার জন্য। ডাক্তার বললেন, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য হাঁটতে হয়। হাঁটলে আনন্দ পাবেন। আনন্দই জীবনের ঐশ্বর্য।
জাহাঙ্গীর খান বললেন, সকালে হাঁটতে পারব না।
ডাক্তার বললেন, বেশ তাহলে বিকেলেই হাঁটবেন। খুব দ্রুত হাঁটবেন। শরীর ক্লান্ত হবে। ভালো ঘুম হবে। ঘুম ভালো হলে সব রোগ সেরে যাবে।
ডাক্তার জাহাঙ্গীরকে ঘুমের ওষুধ দিলেন না। বললেন, ওষুধ খেয়ে ঘুমের অভ্যাস করা ভালো নয়।
জাহাঙ্গীর খানের বাড়ির অদূরে ধানমন্ডি লেক। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য প্রতিদিন নানান বয়সী নারী-পুরুষকে সেখানে হাঁটতে দেখা যায়। এদের মধ্যে প্রৌঢ়ের সংখ্যা বেশি হলেও তরুণ-তরুণীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জাহাঙ্গীর খান নিয়মিত হাঁটতে শুরু করেন। প্রথম প্রথম ভালো লাগেনি। অল্পতে হাঁপিয়ে উঠতেন। পরে ব্যাপারটি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। অভ্যাস নিয়মিত হলে তা স্বভাবে পরিণত হয়। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও জাহাঙ্গীর খান হাঁটতে থাকেন।
মানুষের হাঁটার জন্য লেকের দু’ধার পাকা করে দেয়া হয়েছে। উত্তরে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোড থেকে দক্ষিণে দু’নম্বর রোড পর্যন্ত লেকটি এঁকেবেঁকে গেছে। লেকের দু’ধারে নানান জাতের গাছ; কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, মেহগনি, সেগুন, বকুল, শিশু, অশ্বত্থ, রেইনট্রি, নারিকেল, নিমগাছ—আরও কত কী। সব গাছের নাম জানেন না জাহাঙ্গীর খান। সমগ্র লেকটি এক চক্কর ঘুরতে তার এক ঘণ্টা সময় লাগে। সুতরাং দু’চক্কর দিলেই যথেষ্ট।
লেকের ধারে গাছের নিচে একটু আলো-আঁধারি জায়গায় তরুণ-তরুণীরা বসে গল্প করে। তারা একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেই লোকজন বিরূপ মন্তব্য করে। পুলিশ আলাপরত তরুণ-তরুণীদের উঠিয়ে দেয়। অনেকে প্রতিবাদ করে, আবার অনেকে বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে যায়। একদিন জাহাঙ্গীর খান পুলিশদের উদ্দেশ করে বললেন, সরকার কি দেশে প্রেম করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে? একজন পুলিশ বলল, সরকার নিষিদ্ধ করেছে কিনা জানি না, কিন্তু এলাকাবাসী থানায় অভিযোগ করেছে।
একদিন হাঁটতে হাঁটতে জাহাঙ্গীর খান এক পুলিশকে বললেন, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে ভালোবাসবে এটাই তো স্বাভাবিক। ওদের একটু মেলামেশা করতে দিন। দেশ আজ সন্ত্রাসীতে ভরে গেছে। এর প্রধান কারণ ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে মেলামেশা করতে পারে না। যে ছেলে একবার কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছে, সে কখনও সন্ত্রাসী হয় না। ওদের মেলামেশায় বাধা না দিলে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও অনেক কমে যাবে। তার কথা শুনে পুলিশ কী বুঝল, জানা গেল না। তবে সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
জাহাঙ্গীর খান নিয়মিত দু’ঘণ্টা করে হাঁটেন। লেকের ধারে অনেক নারী-পুরুষ হাঁটে। সবার হাঁটার গতি দ্রুত। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেও কথা বিশেষ হয় না। কেননা, তাতে হাঁটার গতি কমে যায়।
আট নম্বর রোডের ব্রিজের উত্তর-পশ্চিম কোণে কাচ-ঘেরা একটি রেস্টুরেন্ট। নাম ডিঙ্গি। সুন্দর নাম। রেস্টুরেন্টের সামনে লেকের পানিতে বাঁধা থাকে বেশকিছু প্লাস্টিকের ছোট ছোট বোট বা ডিঙ্গি। ডিঙ্গিগুলো ভাড়া দেয়া হয়। প্রতি অর্ধঘণ্টা একশ’ টাকা। আরোহীরা নিজেরাই পা দিয়ে ডিঙ্গি চালায়। লেকের পানিতে একসঙ্গে যখন অনেক ডিঙ্গি ভাসতে থাকে তখন শরতের ‘নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা’র মতো মনে হয়।
লেকে অনেকে ছিপ ফেলে মাছ ধরে। মাছ ধরা পড়তে বড় একটা দেখা যায় না। কখনও দু’একটা মাছ ধরা পড়লে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। লোকজন ভিড় করে দেখতে থাকে।
ধানমন্ডি লেকের একটা অংশের নতুন নামকরণ করা হয়েছে—‘রবীন্দ্র সরোবর’। রবীন্দ্র সরোবরের মাঝামাঝি জায়গায় পশ্চিম পাড়ে রয়েছে একটি মুক্ত মঞ্চ। নাম ‘রবীন্দ্র-মঞ্চ’। রবীন্দ্র-মঞ্চের সামনে স্টেডিয়ামের মতো চক্রাকারে বহু স্তরবিশিষ্ট আসন রয়েছে। কোনো অনুষ্ঠান থাকুক বা না থাকুক, আসনগুলো কখনও খালি থাকে না।
হাঁটার সময় প্রতিদিন একটি মেয়ে বিপরীত দিক থেকে এসে জাহাঙ্গীর খানের পাশ ঘেঁষে চলে যায়। মেয়েটির পরনে সালোয়ার-কামিজ এবং ওড়না। মাথার বেণি দুটোর সঙ্গে শরীরও দোল খায়। মেয়েটি হাঁটে নতমুখী হয়ে। খুব দ্রুত হাঁটে মেয়েটি। মেয়েটিকে দেখলে জাহাঙ্গীরের নূরজাহানের কথা মনে পড়ে। নূরজাহান তার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রথম ভালোবাসা। প্রথম প্রেমের স্মৃতি কখনও ম্লান হয় না। আজ এত বছর পরেও নূরজাহানের কথা মনে হলে বুকটা কেমন যেন করে ওঠে। তখন বয়সের ব্যবধান ঘুচে যায়। নূরজাহানও এমনি বেণি দুলিয়ে নতমুখী হয়ে হাঁটত।
জাহাঙ্গীর তখন বিএসসি পড়ে। নূরজাহান তাদের পাশের বাসার নতুন ভাড়াটের মেয়ে। ক্লাস টেনের ছাত্রী। কত বছর আগের কথা। কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিন।
প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে জাহাঙ্গীরের। জাহাঙ্গীর তার মায়ের পাশে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। এমন সময় মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গে তাদের বাসায় আসে আলাপ-পরিচয়ের জন্য। মেয়েটি তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। সলজ্জ দৃষ্টি। প্রথম দৃষ্টিতেই মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় জাহাঙ্গীরের।
নূরজাহান অঙ্ক শেখার নাম করে জাহাঙ্গীরের কাছে আসত। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ভালোবাসা জন্ম নেয়। দুজনে নীড় বাঁধার স্বপ্ন দেখতে থাকে।
জাহাঙ্গীরের ছোটবোন মনিরা ওদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিত। মনিরা দুষ্টুমি করে নূরজাহানকে ভাবী বলে ডাকত। বন্ধু-বান্ধবরা সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রেমকাহিনী নিয়ে তার সঙ্গে তামাশা করত। জাহাঙ্গীর কৃত্রিম রাগ করে ওদের ধমক দিত। নূরজাহান কথা দিয়েছিল জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে সে কখনও যাবে না। জাহাঙ্গীর বলেছিল, বিএসসি পাস করেই সে একটা চাকরি নেবে এবং নূরজাহানের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু হায়! মানুষ ভাবে এক, ঘটে তার বিপরীত। বছরখানেক না যেতেই হঠাত্ একদিন ঢাকার এক কলেজের অধ্যাপকের সঙ্গে নূরজাহানের বিয়ে হয়ে গেল। নূরজাহান অনেক আপত্তি করেছিল, কেঁদেছিল। কিন্তু অভিভাবকরা তা আমলে নেয়নি। নূরজাহানের বিয়ের সংবাদ শুনে জাহাঙ্গীর বজ্রাহতের মতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। বিচ্ছেদের প্রথম ধাক্কা কাটতেই সে বাড়ি ছেড়ে বহুদূর সুনামগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। দিন-রাত নদীর তীরে বসে থাকত আর কাঁদত। নূরজাহানকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন। জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়, নূরজাহানই যদি তার কাছে না থাকল!
গভীর দুঃখের রাত একসময় শেষ হয়। পুত্রশোকে কাতর মাও একসময় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে শুরু করে। জাহাঙ্গীরের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। একসময় সেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে দূরবর্তী প্রদীপের ক্ষীণ আলোকের মতো নূরজাহানের স্মৃতি চির অমলিন হয়ে রইল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাহাঙ্গীর শুনল, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা নূরজাহানের স্বামীকে হত্যা করে এবং নূরজাহানকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়। এরপর থেকে নূরজাহানের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
প্রতিদিন একটু একটু করে দেখা হতে হতে মেয়েটি ক্রমেই জাহাঙ্গীর খানের কাছে আপনার হয়ে উঠতে লাগল। কেমন এক আত্মীয়তার আকর্ষণ অনুভব করতে লাগল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটির পারফিউমের গন্ধ, এমনকি তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও তিনি শুনতে পান। ওর প্রতিটি পোশাকের রঙ তার নখদর্পণে।
জাহাঙ্গীর খান মেয়েটিকে চেনেন না, জানেন না। তার সঙ্গে কথাও হয় না। তবু যেন মনে হয়, মেয়েটি তার কতদিনের চেনাজানা। দীর্ঘদিন পাশাপাশি হাঁটার ফলে মেয়েটির সঙ্গে জাহাঙ্গীর খানের এক অদৃশ্য যোগসূত্র গড়ে উঠল। অপরিচয়ের ব্যবধান ঘুচে যেতে লাগল। একে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। এক অনিন্দ্যসুন্দর অনুভূতির স্বাদ জাহাঙ্গীর খান একা একা উপভোগ করেন, যা সম্পূর্ণ একপেশে।
একদিন হঠাত্ মেয়েটি জাহাঙ্গীর খানের মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল মুহূর্তের জন্য। জাহাঙ্গীর খানের সারাশরীর শিহরিত হলো। মনে পড়ল, বহু বছর আগেকার নূরজাহানের সঙ্গে তার প্রথম দৃষ্টিবিনিময়ের কথা। জাহাঙ্গীর খান চোখ ফিরিয়ে নেন। এরপর তারা দু’জন বহুবার মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু দৃষ্টিবিনিময় আর হয়নি।
হাঁটার প্রতি জাহাঙ্গীর খানের আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে যায়। মেয়েটিকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ভালোলাগার এক অনির্বচনীয় অনুভূতি তার হৃদয়ে দোল খেতে লাগল।
মেয়েটিকে ভালোলাগার পর থেকে জাহাঙ্গীর খানের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ফুলের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। দোকান থেকে ফুল কিনে এনে ড্রয়িংরুম সাজান। নিত্যনতুন পোশাক পরেন। আয়নায় ঘন ঘন চেহারা দেখেন। সাদা চুলে কলপ লাগাতে আর ভুল হয় না। আগে স্ত্রীর সঙ্গে ছোটখাটো ব্যাপারে খিটিমিটি লেগে থাকত। এখন আর তেমন হয় না। দু’জনে পাশাপাশি বসে গল্প করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন। টিভি দেখেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন। জোছনা রাতে বাড়ির ছাদে গিয়ে পায়চারি করেন। জাহাঙ্গীর খানের আচরণের এই পরিবর্তনে স্ত্রী অবাক হন। বহুদিন পর জাহাঙ্গীর খানের জীবনে নতুন সুবাতাস বইতে থাকে। অর্থহীন জীবনটাকে অর্থপূর্ণ মনে হতে লাগল। অবসাদ যাচ্ছে কেটে।
ধীরে ধীরে জাহাঙ্গীর খানের মধ্যে একটি অপরাধবোধ জেগে উঠতে থাকে। তার বয়সের তিন ভাগের এক ভাগ বয়সী একটি মেয়ের প্রতি তার এ দুর্বলতা শুধু অশোভন নয়, অনুচিতও বটে। তিনি নিজেকে বার বার ধিক্কার দিতে থাকেন। মেয়েটির ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না। মেয়েটির আসন যে তার মস্তিষ্কে নয়, হৃদয়ের গভীরে। হৃদয় থেকে ওকে তাড়াবেন কেমন করে? হৃদয় যে কাউকে তাড়াতে পারে না, শুধু আশ্রয় দিতে জানে।
জীবনের প্রান্তসীমানায় এসে প্রত্যেক মানুষ কমবেশি স্মৃতির প্রতারণার শিকার হয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া জীবনের কিছু ঘটনা তার বর্তমান জীবনকে বিভ্রান্ত করে। ক্ষণকালের জন্য হলেও সে ভুলে যায় তার বর্তমান অবস্থানের কথা। তার বয়সের কথা। সে ফিরে পেতে চায় তার অতীত জীবনকে। এ বিভ্রান্তির বেড়াজালের ঘেরে আটকে আছেন ষাটোর্ধ্ব জাহাঙ্গীর খান। নূরজাহান এখনও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাই মাঝে মাঝে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
অনেক চেষ্টা করেও জাহাঙ্গীর খান যখন মেয়েটির ভাবনা মন থেকে তাড়াতে পারলেন না তখন ঠিক করলেন, ওকে মন থেকে তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা না করে তাকে ভালোবাসবেন। ভালোবাসায় কোনো দোষ নেই। ভালোবাসা বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ভালোবাসার বয়স নেই। আমি ওকে ভালোবাসব। প্রাণভরে ভালোবাসব। হোক না তা একপেশে। জাহাঙ্গীর খান আপন মনে বলতে থাকেন, আমি ওর সঙ্গে কথা বলব, গল্প করব। ওর মুখের কথা আমি রচনা করব।
—তোমার নাম কী?
—আমার নাম মাধুরী।
—না, তোমার নাম নূরজাহান।
—ও নামটা বড্ড সেকেলে।
—আমিও যে সেকেলে।
—আপনি অত ধীরে ধীরে হাঁটেন কেন?
—ভদ্রলোকেরা ভদ্রভাবেই হাঁটে।
—তাতে ভদ্রতা রক্ষা হয় বটে, কিন্তু স্বাস্থ্য রক্ষা হয় না।
—তুমি বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পার!
—ধন্যবাদ।
—তোমার বেণি দুটো খুব সুন্দর।
—শুধু বেণি?
—তুমিও বেশ সুন্দর।
—সামনের ছুটিতে আমি দেশের বাড়িতে যাব।
—তাহলে তো তোমার হাঁটা হবে না।
—আপনার সঙ্গেও দেখা হবে না।
—আমার সঙ্গে দেখা না হলে তোমার খারাপ লাগবে?
—খুব খারাপ লাগবে।
—মন খারাপ করো না। ছুটির পর ফিরে এলে আবার আমরা দু’জন একসঙ্গে হাঁটতে পারব।
কাল্পনিক কথার বুনুনি গেঁথে গভীর মনোযোগ দিয়ে জাহাঙ্গীর খান হাঁটছেন। হঠাত্ উপুড় হয়ে পড়ে তিনি মাথায় আঘাত পেলেন। সেই মুহূর্তে মেয়েটি তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
ছুটে এসে মেয়েটি তাকে ধরে বলল, খুব লেগেছে? গায়ের ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে জাহাঙ্গীর খান সলজ্জ হাসি হেসে বললেন, তেমন কিছু নয়। মেয়েটি অস্ফুট চিত্কার করে বলে উঠল, ইস কত রক্ত! কপালের বাঁ দিকটা কেটে গেছে।
মেয়েটি জাহাঙ্গীর খানকে পার্শ্ববর্তী একটি ক্লিনিকে নিয়ে ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করল। ডাক্তার তাকে একটু বিশ্রাম নিতে বললেন। মেয়েটি জাহাঙ্গীর খানের মাথায় আলতো করে সস্নেহে হাত বুলাল। আবেগে জাহাঙ্গীর খানের চোখে পানি এলো। মেয়েটি তার পারফিউম মাখানো রুমাল দিয়ে চোখ মুছে দিল। একটা রিকশায় তুলে দিয়ে বলল, একটু সাবধানে চলবেন। আরও মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। জাহাঙ্গীর খানের চোখে নূরজাহানের মুখ ভেসে উঠল।
মেয়েটি জানল না, ওর একটুখানি সহানুভূতি এবং স্পর্শে এরচেয়ে বড় দুর্ঘটনা জাহাঙ্গীর খানের জীবনে এই মুহূর্তে ঘটে গেছে। এই ‘দুর্ঘটনার’ সুখ-স্মৃতি তার জীবনে সবচেয়ে বড় আনন্দের। ডাক্তারের কথা মনে পড়ল। ডাক্তার বলেছিল, আনন্দই জীবনের ঐশ্বর্য!
সূত্র : আমার দেশ
স্ত্রীর পীড়াপীড়িতে একদিন জাহাঙ্গীর খানকে ডাক্তারের শরণাপন্ন হতে হলো। সব শুনে ডাক্তার বললেন, ঘুম না হওয়ার জন্য মানসিক দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। বয়স বাড়লে ঘুম কমে, খাওয়া কমে, শ্রবণশক্তি হ্রাস পায়। দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়। জাহাঙ্গীর খান যোগ করেন, এবং আয়ুও কমে। ডাক্তার বললেন, তা তো অবশ্যই। একটু থেমে বললেন, আপনার সময় কাটে কী করে?
জাহাঙ্গীর খান জবাব দেন, সময় কাটে না বলেই তো আপনার কাছে এলাম। সময় কাটানোর জন্য যে বয়সে মানুষের প্রচুর ঘুমের দরকার, আপনি বলছেন সে বয়সে ঘুম কমে যায়। অদ্ভুত প্রকৃতির নিয়ম! কর্মহীন এক একটি মুহূর্ত আমার কাছে শতবর্ষের মতো এবং এক একটি রাত সহস্র রজনীর মতো দীর্ঘ মনে হয়।
ডাক্তার বললেন, সব সমস্যা দূর হবে যদি আপনি আমার কথা মেনে চলেন। জাহাঙ্গীর খান বললেন, বর্তমান অবস্থা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আপনার সব নির্দেশ আমি মেনে চলব। ডাক্তার বললেন, আপনাকে প্রতিদিন সকালে অথবা বিকেলে ঘড়ি ধরে দু’ঘণ্টা হাঁটতে হবে। জাহাঙ্গীর খান বললেন, বেশি হাঁটাহাঁটি আমার ভালো লাগে না। সারাজীবন অনেক হেঁটেছি। আর হাঁটতে চাই না। ডাক্তার বললেন, সারাজীবন ভাত খেয়েছেন বলে কি আর ভাত খাবেন না? জাহাঙ্গীর খান বললেন, ভাত খেতে হয় জীবনধারণ করার জন্য। ডাক্তার বললেন, সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার জন্য হাঁটতে হয়। হাঁটলে আনন্দ পাবেন। আনন্দই জীবনের ঐশ্বর্য।
জাহাঙ্গীর খান বললেন, সকালে হাঁটতে পারব না।
ডাক্তার বললেন, বেশ তাহলে বিকেলেই হাঁটবেন। খুব দ্রুত হাঁটবেন। শরীর ক্লান্ত হবে। ভালো ঘুম হবে। ঘুম ভালো হলে সব রোগ সেরে যাবে।
ডাক্তার জাহাঙ্গীরকে ঘুমের ওষুধ দিলেন না। বললেন, ওষুধ খেয়ে ঘুমের অভ্যাস করা ভালো নয়।
জাহাঙ্গীর খানের বাড়ির অদূরে ধানমন্ডি লেক। স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য প্রতিদিন নানান বয়সী নারী-পুরুষকে সেখানে হাঁটতে দেখা যায়। এদের মধ্যে প্রৌঢ়ের সংখ্যা বেশি হলেও তরুণ-তরুণীর সংখ্যা একেবারে কম নয়।
ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী জাহাঙ্গীর খান নিয়মিত হাঁটতে শুরু করেন। প্রথম প্রথম ভালো লাগেনি। অল্পতে হাঁপিয়ে উঠতেন। পরে ব্যাপারটি অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেল। অভ্যাস নিয়মিত হলে তা স্বভাবে পরিণত হয়। ঝড়-বৃষ্টি উপেক্ষা করেও জাহাঙ্গীর খান হাঁটতে থাকেন।
মানুষের হাঁটার জন্য লেকের দু’ধার পাকা করে দেয়া হয়েছে। উত্তরে ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বর রোড থেকে দক্ষিণে দু’নম্বর রোড পর্যন্ত লেকটি এঁকেবেঁকে গেছে। লেকের দু’ধারে নানান জাতের গাছ; কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, মেহগনি, সেগুন, বকুল, শিশু, অশ্বত্থ, রেইনট্রি, নারিকেল, নিমগাছ—আরও কত কী। সব গাছের নাম জানেন না জাহাঙ্গীর খান। সমগ্র লেকটি এক চক্কর ঘুরতে তার এক ঘণ্টা সময় লাগে। সুতরাং দু’চক্কর দিলেই যথেষ্ট।
লেকের ধারে গাছের নিচে একটু আলো-আঁধারি জায়গায় তরুণ-তরুণীরা বসে গল্প করে। তারা একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলেই লোকজন বিরূপ মন্তব্য করে। পুলিশ আলাপরত তরুণ-তরুণীদের উঠিয়ে দেয়। অনেকে প্রতিবাদ করে, আবার অনেকে বিনাবাক্য ব্যয়ে উঠে যায়। একদিন জাহাঙ্গীর খান পুলিশদের উদ্দেশ করে বললেন, সরকার কি দেশে প্রেম করা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে? একজন পুলিশ বলল, সরকার নিষিদ্ধ করেছে কিনা জানি না, কিন্তু এলাকাবাসী থানায় অভিযোগ করেছে।
একদিন হাঁটতে হাঁটতে জাহাঙ্গীর খান এক পুলিশকে বললেন, উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে ভালোবাসবে এটাই তো স্বাভাবিক। ওদের একটু মেলামেশা করতে দিন। দেশ আজ সন্ত্রাসীতে ভরে গেছে। এর প্রধান কারণ ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে মেলামেশা করতে পারে না। যে ছেলে একবার কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছে, সে কখনও সন্ত্রাসী হয় না। ওদের মেলামেশায় বাধা না দিলে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডও অনেক কমে যাবে। তার কথা শুনে পুলিশ কী বুঝল, জানা গেল না। তবে সে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
জাহাঙ্গীর খান নিয়মিত দু’ঘণ্টা করে হাঁটেন। লেকের ধারে অনেক নারী-পুরুষ হাঁটে। সবার হাঁটার গতি দ্রুত। পরিচিত কারও সঙ্গে দেখা হলেও কথা বিশেষ হয় না। কেননা, তাতে হাঁটার গতি কমে যায়।
আট নম্বর রোডের ব্রিজের উত্তর-পশ্চিম কোণে কাচ-ঘেরা একটি রেস্টুরেন্ট। নাম ডিঙ্গি। সুন্দর নাম। রেস্টুরেন্টের সামনে লেকের পানিতে বাঁধা থাকে বেশকিছু প্লাস্টিকের ছোট ছোট বোট বা ডিঙ্গি। ডিঙ্গিগুলো ভাড়া দেয়া হয়। প্রতি অর্ধঘণ্টা একশ’ টাকা। আরোহীরা নিজেরাই পা দিয়ে ডিঙ্গি চালায়। লেকের পানিতে একসঙ্গে যখন অনেক ডিঙ্গি ভাসতে থাকে তখন শরতের ‘নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা’র মতো মনে হয়।
লেকে অনেকে ছিপ ফেলে মাছ ধরে। মাছ ধরা পড়তে বড় একটা দেখা যায় না। কখনও দু’একটা মাছ ধরা পড়লে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। লোকজন ভিড় করে দেখতে থাকে।
ধানমন্ডি লেকের একটা অংশের নতুন নামকরণ করা হয়েছে—‘রবীন্দ্র সরোবর’। রবীন্দ্র সরোবরের মাঝামাঝি জায়গায় পশ্চিম পাড়ে রয়েছে একটি মুক্ত মঞ্চ। নাম ‘রবীন্দ্র-মঞ্চ’। রবীন্দ্র-মঞ্চের সামনে স্টেডিয়ামের মতো চক্রাকারে বহু স্তরবিশিষ্ট আসন রয়েছে। কোনো অনুষ্ঠান থাকুক বা না থাকুক, আসনগুলো কখনও খালি থাকে না।
হাঁটার সময় প্রতিদিন একটি মেয়ে বিপরীত দিক থেকে এসে জাহাঙ্গীর খানের পাশ ঘেঁষে চলে যায়। মেয়েটির পরনে সালোয়ার-কামিজ এবং ওড়না। মাথার বেণি দুটোর সঙ্গে শরীরও দোল খায়। মেয়েটি হাঁটে নতমুখী হয়ে। খুব দ্রুত হাঁটে মেয়েটি। মেয়েটিকে দেখলে জাহাঙ্গীরের নূরজাহানের কথা মনে পড়ে। নূরজাহান তার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রথম ভালোবাসা। প্রথম প্রেমের স্মৃতি কখনও ম্লান হয় না। আজ এত বছর পরেও নূরজাহানের কথা মনে হলে বুকটা কেমন যেন করে ওঠে। তখন বয়সের ব্যবধান ঘুচে যায়। নূরজাহানও এমনি বেণি দুলিয়ে নতমুখী হয়ে হাঁটত।
জাহাঙ্গীর তখন বিএসসি পড়ে। নূরজাহান তাদের পাশের বাসার নতুন ভাড়াটের মেয়ে। ক্লাস টেনের ছাত্রী। কত বছর আগের কথা। কিন্তু মনে হয় এই তো সেদিন।
প্রথম দেখার কথা মনে পড়ে জাহাঙ্গীরের। জাহাঙ্গীর তার মায়ের পাশে বসে মুড়ি খাচ্ছিল। এমন সময় মেয়েটি তার মায়ের সঙ্গে তাদের বাসায় আসে আলাপ-পরিচয়ের জন্য। মেয়েটি তার দিকে চোখ তুলে তাকায়। সলজ্জ দৃষ্টি। প্রথম দৃষ্টিতেই মেয়েটিকে ভালো লেগে যায় জাহাঙ্গীরের।
নূরজাহান অঙ্ক শেখার নাম করে জাহাঙ্গীরের কাছে আসত। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে আলাপচারিতা চলতে থাকে। ধীরে ধীরে তাদের মধ্যে ভালোবাসা জন্ম নেয়। দুজনে নীড় বাঁধার স্বপ্ন দেখতে থাকে।
জাহাঙ্গীরের ছোটবোন মনিরা ওদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিত। মনিরা দুষ্টুমি করে নূরজাহানকে ভাবী বলে ডাকত। বন্ধু-বান্ধবরা সম্রাট জাহাঙ্গীর ও নূরজাহানের প্রেমকাহিনী নিয়ে তার সঙ্গে তামাশা করত। জাহাঙ্গীর কৃত্রিম রাগ করে ওদের ধমক দিত। নূরজাহান কথা দিয়েছিল জাহাঙ্গীরকে ছেড়ে সে কখনও যাবে না। জাহাঙ্গীর বলেছিল, বিএসসি পাস করেই সে একটা চাকরি নেবে এবং নূরজাহানের বাবার কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবে। কিন্তু হায়! মানুষ ভাবে এক, ঘটে তার বিপরীত। বছরখানেক না যেতেই হঠাত্ একদিন ঢাকার এক কলেজের অধ্যাপকের সঙ্গে নূরজাহানের বিয়ে হয়ে গেল। নূরজাহান অনেক আপত্তি করেছিল, কেঁদেছিল। কিন্তু অভিভাবকরা তা আমলে নেয়নি। নূরজাহানের বিয়ের সংবাদ শুনে জাহাঙ্গীর বজ্রাহতের মতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। বিচ্ছেদের প্রথম ধাক্কা কাটতেই সে বাড়ি ছেড়ে বহুদূর সুনামগঞ্জে তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে গিয়েছিল। দিন-রাত নদীর তীরে বসে থাকত আর কাঁদত। নূরজাহানকে ছাড়া তার জীবন অর্থহীন। জীবনে বেঁচে থাকার সার্থকতা কোথায়, নূরজাহানই যদি তার কাছে না থাকল!
গভীর দুঃখের রাত একসময় শেষ হয়। পুত্রশোকে কাতর মাও একসময় স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে শুরু করে। জাহাঙ্গীরের বেলায়ও তার ব্যতিক্রম ঘটল না। একসময় সেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলো। কিন্তু হৃদয়ের গভীরে দূরবর্তী প্রদীপের ক্ষীণ আলোকের মতো নূরজাহানের স্মৃতি চির অমলিন হয়ে রইল।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাহাঙ্গীর শুনল, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকাররা নূরজাহানের স্বামীকে হত্যা করে এবং নূরজাহানকে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে তুলে দেয়। এরপর থেকে নূরজাহানের কোনো খবর পাওয়া যায়নি।
প্রতিদিন একটু একটু করে দেখা হতে হতে মেয়েটি ক্রমেই জাহাঙ্গীর খানের কাছে আপনার হয়ে উঠতে লাগল। কেমন এক আত্মীয়তার আকর্ষণ অনুভব করতে লাগল। পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় মেয়েটির পারফিউমের গন্ধ, এমনকি তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দও তিনি শুনতে পান। ওর প্রতিটি পোশাকের রঙ তার নখদর্পণে।
জাহাঙ্গীর খান মেয়েটিকে চেনেন না, জানেন না। তার সঙ্গে কথাও হয় না। তবু যেন মনে হয়, মেয়েটি তার কতদিনের চেনাজানা। দীর্ঘদিন পাশাপাশি হাঁটার ফলে মেয়েটির সঙ্গে জাহাঙ্গীর খানের এক অদৃশ্য যোগসূত্র গড়ে উঠল। অপরিচয়ের ব্যবধান ঘুচে যেতে লাগল। একে দেখা যায় না, ছোঁয়া যায় না। শুধু অনুভব করা যায়। এক অনিন্দ্যসুন্দর অনুভূতির স্বাদ জাহাঙ্গীর খান একা একা উপভোগ করেন, যা সম্পূর্ণ একপেশে।
একদিন হঠাত্ মেয়েটি জাহাঙ্গীর খানের মুখের দিকে মুখ তুলে তাকাল মুহূর্তের জন্য। জাহাঙ্গীর খানের সারাশরীর শিহরিত হলো। মনে পড়ল, বহু বছর আগেকার নূরজাহানের সঙ্গে তার প্রথম দৃষ্টিবিনিময়ের কথা। জাহাঙ্গীর খান চোখ ফিরিয়ে নেন। এরপর তারা দু’জন বহুবার মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু দৃষ্টিবিনিময় আর হয়নি।
হাঁটার প্রতি জাহাঙ্গীর খানের আকর্ষণ বহুগুণ বেড়ে যায়। মেয়েটিকে এক নজর দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠেন। ভালোলাগার এক অনির্বচনীয় অনুভূতি তার হৃদয়ে দোল খেতে লাগল।
মেয়েটিকে ভালোলাগার পর থেকে জাহাঙ্গীর খানের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ফুলের প্রতি আকর্ষণ বেড়ে যায়। দোকান থেকে ফুল কিনে এনে ড্রয়িংরুম সাজান। নিত্যনতুন পোশাক পরেন। আয়নায় ঘন ঘন চেহারা দেখেন। সাদা চুলে কলপ লাগাতে আর ভুল হয় না। আগে স্ত্রীর সঙ্গে ছোটখাটো ব্যাপারে খিটিমিটি লেগে থাকত। এখন আর তেমন হয় না। দু’জনে পাশাপাশি বসে গল্প করেন। রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনেন। টিভি দেখেন। তাদের দাম্পত্য জীবনের প্রথম দিনগুলোর স্মৃতিচারণ করেন। জোছনা রাতে বাড়ির ছাদে গিয়ে পায়চারি করেন। জাহাঙ্গীর খানের আচরণের এই পরিবর্তনে স্ত্রী অবাক হন। বহুদিন পর জাহাঙ্গীর খানের জীবনে নতুন সুবাতাস বইতে থাকে। অর্থহীন জীবনটাকে অর্থপূর্ণ মনে হতে লাগল। অবসাদ যাচ্ছে কেটে।
ধীরে ধীরে জাহাঙ্গীর খানের মধ্যে একটি অপরাধবোধ জেগে উঠতে থাকে। তার বয়সের তিন ভাগের এক ভাগ বয়সী একটি মেয়ের প্রতি তার এ দুর্বলতা শুধু অশোভন নয়, অনুচিতও বটে। তিনি নিজেকে বার বার ধিক্কার দিতে থাকেন। মেয়েটির ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে চেষ্টা করেন। কিন্তু পারেন না। মেয়েটির আসন যে তার মস্তিষ্কে নয়, হৃদয়ের গভীরে। হৃদয় থেকে ওকে তাড়াবেন কেমন করে? হৃদয় যে কাউকে তাড়াতে পারে না, শুধু আশ্রয় দিতে জানে।
জীবনের প্রান্তসীমানায় এসে প্রত্যেক মানুষ কমবেশি স্মৃতির প্রতারণার শিকার হয়। বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া জীবনের কিছু ঘটনা তার বর্তমান জীবনকে বিভ্রান্ত করে। ক্ষণকালের জন্য হলেও সে ভুলে যায় তার বর্তমান অবস্থানের কথা। তার বয়সের কথা। সে ফিরে পেতে চায় তার অতীত জীবনকে। এ বিভ্রান্তির বেড়াজালের ঘেরে আটকে আছেন ষাটোর্ধ্ব জাহাঙ্গীর খান। নূরজাহান এখনও তার স্মৃতিতে উজ্জ্বল। তাই মাঝে মাঝে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন।
অনেক চেষ্টা করেও জাহাঙ্গীর খান যখন মেয়েটির ভাবনা মন থেকে তাড়াতে পারলেন না তখন ঠিক করলেন, ওকে মন থেকে তাড়াবার ব্যর্থ চেষ্টা না করে তাকে ভালোবাসবেন। ভালোবাসায় কোনো দোষ নেই। ভালোবাসা বিধাতার শ্রেষ্ঠ দান। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। ভালোবাসার বয়স নেই। আমি ওকে ভালোবাসব। প্রাণভরে ভালোবাসব। হোক না তা একপেশে। জাহাঙ্গীর খান আপন মনে বলতে থাকেন, আমি ওর সঙ্গে কথা বলব, গল্প করব। ওর মুখের কথা আমি রচনা করব।
—তোমার নাম কী?
—আমার নাম মাধুরী।
—না, তোমার নাম নূরজাহান।
—ও নামটা বড্ড সেকেলে।
—আমিও যে সেকেলে।
—আপনি অত ধীরে ধীরে হাঁটেন কেন?
—ভদ্রলোকেরা ভদ্রভাবেই হাঁটে।
—তাতে ভদ্রতা রক্ষা হয় বটে, কিন্তু স্বাস্থ্য রক্ষা হয় না।
—তুমি বেশ সুন্দর করে কথা বলতে পার!
—ধন্যবাদ।
—তোমার বেণি দুটো খুব সুন্দর।
—শুধু বেণি?
—তুমিও বেশ সুন্দর।
—সামনের ছুটিতে আমি দেশের বাড়িতে যাব।
—তাহলে তো তোমার হাঁটা হবে না।
—আপনার সঙ্গেও দেখা হবে না।
—আমার সঙ্গে দেখা না হলে তোমার খারাপ লাগবে?
—খুব খারাপ লাগবে।
—মন খারাপ করো না। ছুটির পর ফিরে এলে আবার আমরা দু’জন একসঙ্গে হাঁটতে পারব।
কাল্পনিক কথার বুনুনি গেঁথে গভীর মনোযোগ দিয়ে জাহাঙ্গীর খান হাঁটছেন। হঠাত্ উপুড় হয়ে পড়ে তিনি মাথায় আঘাত পেলেন। সেই মুহূর্তে মেয়েটি তার পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল।
ছুটে এসে মেয়েটি তাকে ধরে বলল, খুব লেগেছে? গায়ের ধূলা ঝাড়তে ঝাড়তে জাহাঙ্গীর খান সলজ্জ হাসি হেসে বললেন, তেমন কিছু নয়। মেয়েটি অস্ফুট চিত্কার করে বলে উঠল, ইস কত রক্ত! কপালের বাঁ দিকটা কেটে গেছে।
মেয়েটি জাহাঙ্গীর খানকে পার্শ্ববর্তী একটি ক্লিনিকে নিয়ে ফার্স্ট এইডের ব্যবস্থা করল। ডাক্তার তাকে একটু বিশ্রাম নিতে বললেন। মেয়েটি জাহাঙ্গীর খানের মাথায় আলতো করে সস্নেহে হাত বুলাল। আবেগে জাহাঙ্গীর খানের চোখে পানি এলো। মেয়েটি তার পারফিউম মাখানো রুমাল দিয়ে চোখ মুছে দিল। একটা রিকশায় তুলে দিয়ে বলল, একটু সাবধানে চলবেন। আরও মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটতে পারত। জাহাঙ্গীর খানের চোখে নূরজাহানের মুখ ভেসে উঠল।
মেয়েটি জানল না, ওর একটুখানি সহানুভূতি এবং স্পর্শে এরচেয়ে বড় দুর্ঘটনা জাহাঙ্গীর খানের জীবনে এই মুহূর্তে ঘটে গেছে। এই ‘দুর্ঘটনার’ সুখ-স্মৃতি তার জীবনে সবচেয়ে বড় আনন্দের। ডাক্তারের কথা মনে পড়ল। ডাক্তার বলেছিল, আনন্দই জীবনের ঐশ্বর্য!
সূত্র : আমার দেশ
No comments:
Post a Comment