প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, October 26, 2012

জোস্ন্যা | কামাল উদ্দিন রায়হান


রবির কিরন অস্তমিত হয়
পূব আকাশে মিটমিটি থালার মত,
ছড়িয়ে যায় রূপালি আলোয়
মিষ্টি আলোর একি মায়া,
দিনের আলোয় যেন মিথ্যা ছায়া।

তনুখানি কোমল বাতাসে দক্ষিণা হাওয়া
জুড়িয়ে দিয়ে যায় দেহ মন,
ঝিরিঝিরি মায়াময় একি কোমল ছোঁয়া
 বইছে দক্ষিণা পবন।
দুপুর রজনী বয়ে যায়,
তবু চোখে নিদ নাহি হায়,
মায়াময় একি আলোয় ,
 মোহ করেছে এ কোন আভায়,
ভালবাসার অপার জুটি লিখে গান লিখে নানান কবিতা,
রাখে সবাই চাদের মত সুন্দর নিজের ছবিটা।
দু একটা মেঘের পুঞ্জী ঢেকে দেয় চাঁদ,
গোমড়া রুপে ধারন করে পরিবেশ
আলোর মায়ায় ছেলেখেলায় একি কোন ফাঁদ।

এমন করে কি মানুষ আড়াল হলে হয় ভিন্ন রুপ?
আড়ালে কি মানুষের এই রূপ থেকে যায়?
যেভাবে চাঁদ বাহিরে তার সর্বস্ব ঢেলে দেয়
কিন্তু ঢাকা পড়ে যখন অশ্মরিরীরুপ করে ধারন ,
মানুষের এই উপরকার চর্মের আড়ালে করে বারণ।
মায়া কি এভাবে ছড়ায় চন্দ্রের মত আলো?
আহা! মানুষ তার রুপ কত! বিপদে তার পরিচয় ,
চন্দ্রের মত দেখায় বাহির থেকে কত ভাল।।


Tuesday, October 23, 2012

খুঁজে ফিরি তারে । জিল্লুর রহমান

আরশী মোবাইলের বাটন টিপলো, দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহপুর্বক কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।

আরশী মোবাইলটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল, তোমারই বা দোষ ক? তোমার সঙ্গে তো আমি নিজেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি, তুমিই বা নতুন করে সংযোগ দিবে কেন? তুমি কোথায় ফিরোজ? কতদিন থেকে তোমাকে খুঁজছি, কতবার তোমার মোবাইলে রিং দিয়েছি, কোনদিন তোমাকে খুঁজে পেলাম না। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন, তুমি আমাকে বড় হওয়ার স্বপ্নদেখাতে, তুমি বলতে আমি যেদিন প্রমোশন পেয়ে অফিসার হবো সেদিন তুমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। আমি প্রমোশন পেয়েছি ফিরোজ, আগামী মাসে আমার রেঙ্ক (Rank) লাগবে, তুমি দেখবে না?

লিজা রুমে ঢুকল, এই আরশী একটা খবর শুনেছিস?

কী খবর?

আমাদের আগামী মাসের পঁচিশ তারিখে রেঙ্ক (Rank) পরানো হবে।

আরশীর দু'চোখ ছলছল করে উঠল, সে আপন মনে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, আর শুধু মনে মনে বা মোবাইলে খুঁজলে হবে না, আমি কাল থেকে সশরীরে তোমাকে খুঁজতে মাঠে নামবো, আমাকে রেঙ্ক পরতে দেখলে সবচেয়ে খুশি হতে তুমি, তুমি, তুমিই আমার সব ফিরোজ। আমি তোমাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করেছি, প্রেমিকের মতো ভালোবেসেছি, বন্ধুর মতো নির্ভর করেছি, তুমিই আমার সব ফিরোজ। যদি ফিরোজকে পেয়ে যাই, আমি যখন ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো তখন ও যদি আমাকে তাড়িয়ে দেয়? আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে? যদি বলে তোমার সঙ্গে আমার ক সম্পর্ক আছে? আসলে আমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা আত্মার, আইন বা সামাজের কাছে যার কোন মূল্য নেই, কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধও।

লিজা জিজ্ঞেস করল, এই আরশী তুই কি ঘুমাচ্ছিস নাকি?

না রে।

তবে চুপ করে আছিস কেন? কথা বল?

না রে মনটা ভালো নেই।

কেন? হঠাৎ করে আবার কার কথা মনে পড়ল?

লিজা তুই তো জানিস, পৃথিবীতে আমার একজনই ছিল, সে চলে গেছে তারপর থেকে আমার আমার কেউ নেই, কেউ আসবেও না।

যদি কেউ আসে?

বললাম তো আসবে না, কোনদিন দেখেছিস কেউ আমার খোঁজ নিতে এসেছে? আমার মোবাইলের রিং কখনো কখনো বেজে ওঠে রিসিভ করলেই অনেক যন্ত্রণা, বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব, প্রেম করার প্রস্তাব, বিয়ে করার প্রস্তাব, অনেক আকর্ষণীয় প্রস্তাব কিন্তু আমি কারো প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছি?

লিজা বলল, সবগুলোই তো জীবনের জন্য প্রয়োজন, তো অসুবিধা কি? তুই একটা অবিবাহিতা মেয়ে, চেহারা সুন্দর, তাই তোর মোবাইলে ফোন আসে। আমি তোর মতো সুন্দর না, তারপরও বিয়ের আগে আমার অনেক ফোন আসতো, আকর্ষণীয় প্রস্তাব পেতাম, বিয়ের পরও মাঝে মাঝে ফোন আসতো হয়ত কেউ কেউ অবিবাহিতা মনে করতো, এনিয়ে তোর দুলাভাইর সঙ্গে মাঝে মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হতো। আমার বিয়ের খবরটা জানাজানির পর আর তেমন ফোন আসে না।

আরশী একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, তাহলে কি আমিও সবাইকে জানিয়ে দিব নাকি যে আমার বিয়ে হয়েছে, তাহলে অন্ততঃ বাড়তি ফোনের ঝামেলা থেকে বেঁচে যেতাম।

বিয়ে না করেই সবাইকে বিয়ে হয়েছে বলবি? তারচেয়ে বিয়ে করে ফেললেই তো হয়? 

ইচ্ছা করলেই কি যাকে তাকে বিয়ে করা যায়?

তা অবশ্য ঠিক, তাতে যন্ত্রণা বেড়ে যেতে পারে।

সেই যন্ত্রণার চেয়ে এই যন্ত্রণাই ভালো।

আচ্ছা আরশী তুই না কাকে যেন ভালোবাসতিস, আমাদের ডিপার্টমেণ্টেরই কী নাম যেন?

আরশীর মনটা ঘৃণায় ভরে গেল। কারণ যে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে সে আর কোনদিন তার নাম মুখে আনতে চায়নি, তার কথা মনে করতে চায়নি। আজ লিজা সেই প্রতারকের নামটা তাকে স্মরণ করে দিল, সেই প্রতারকের জন্যই ফিরোজের সঙ্গে তার দুরত্ব বেড়ে গিয়েছিল, আরশী ফিরোজকে অপমান করেছিল।

আরশী কিছুটা রাগান্বিতস্বরেবলল, লিজা তুই তো সবই জানিস তারওপর আমি যার নাম জীবনে মুখে আনতে চাই না তার কথা স্মরণ করে দিচ্ছিস কেন?

আরশী হঠাৎ করে মুখে চলে এলো তাই বললাম, আমি তোকে কষ্ট দেয়ার জন্য বলিনি।

 

ট্রেনিং শেষে আরশীর প্রথম পোস্টিং হয় রাজশাহী জেলার বাঘমারা থানায়। আরশী ট্রেনিং সেন্টারে থাকতেই ফিরোজ তাকে একটা মোবাইল সেট কিনে দিয়েছিল। আরশীর মোবাইলে শুধুমাত্র তার বাবা-মা, দুলাভাই-আপা আর ফিরোজ মোবাইল করতো। তাছাড়া সারাদিন মোবাইলে তেমন কারো কল আসতো না, নতুন মোবাইল ফোন হাতে পাওয়ায় আরশীর মোবাইলে কথা বলার আগ্রহ ছিল বেশি। তাই কোন মোবাইল থেকে একটা মিস কল এলে সে যেন নিজেই উৎসাহী হয়ে বার বার মিস্‌ কল দিত।

আরশীর সেই অতি উৎসাহী আচরণটা ফিরোজের একেবারেই পছন্দ না। সে আরশীর মোবাইল ব্যস্ত দেখলেই রেগে যেত।

 

আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের সবাই গৃহিণী কিংবা সাধারণ কোন পেশা যেমন শিক্ষকতার মতো পেশায় কাজ করতে দেখে অভ্যস্থ। যখন কেউ একজন মহিলা পুলিশকে রাস্তায় ডিউটি করতে দেখে তখন অনেকেই একটু কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার অজুহাত খুঁজে, আগ বাড়িয়ে উপকার করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, সহানুভূতি দেখায়। এটা শুধু অফিসের বাইরেই নয়, ডিপার্টমেণ্টের অনেকেই এখনো মেয়েদের প্রতি সাধারণ মানুষের মতোই।

মহিলা পুলিশের সংখ্যা অনেক কম। এই কোর্টে যেসব মহিলা পুলিশ আসামী নিয়ে আসে তাদের সবার নাম যেন সবার মুখস্থ। কোন কাজে কারো কাছে গেলেই যেন সহজে নাম ধরে ডাকে। এমনি অবস্থায় ডিউটি করতে করতে আরশীর অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন পুলিশ কনস্টেবল এর সাথে আরশীর একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।

প্রায়ই রাতেই আরশী তার সেই বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ সময় মোবাইলে কথা বলতো। আরশীর মোবাইল দীর্ঘ সময় ব্যস্ত দেখে ফিরোজ মোবাইলে বকাবকি করতো, আরশী তুমি রাতে মোবাইলে কার সঙ্গে এত কথা বলো?

বাঃ আমি এখন চাকরি করছি, ছাত্র জীবনের অনেক বন্ধু, চাকরি জীবনের কলিগ সবার সঙ্গে কথা বলি।

আরশী, বন্ধু বা কলিগের সঙ্গে কি কারো প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কি আলাপ থাকতে পারে?

দেখ আমি এখন চাকরি করছি, আমার ভালো-মন্দ নিজে বোঝার আমার বয়স হয়েছে, আমার ভবিষ্যতটা তুমি আমাকে বুঝতে দাও।

বাঃ আরশী তুমি তো খুব সুন্দর যুক্তি তৈরি করেছ।

তুমি কিছু মনে করলে নাকি?

না আমি তোমার কে? তোমার মোবাইল ব্যস্ত দেখলে আমি রাগ করবো কেন? বলে ফিরোজ মোবাইল রেখে দিয়েছিল।

পরদিন সকালবেলা আরশীই প্রথম মোবাইল করেছিল, হ্যালো।

ফিরোজ রিসিভ করেছিল, হ্যালো আরশী।

শোনো তুমি বোধ হয় আমার কথায় কিছু মনে করেছ, আসলে বাড়ি থেকে আপা মোবাইল করেছিল।

কাল না তুমি বললে, তোমার কলিগ মোবাইল করেছে?

আমি তোমাকে ক্ষেপানোর জন্য বলেছিলাম, আসলে তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো? আমি তোমাকে বলেছি না আমাকে সন্দেহ করবে না, তুমি যেভাবে চলতে বলেছ আমি সেভাবেই চলবো।

আরশী আমি এখন কাজে ব্যস্ত আছি সুযোগ হলে পরে তোমাকে রিং দিব।

আচ্ছা শোনো, আমার মোবাইলে টাকা নাই, এক'শ টাকা রিচার্জ করে দাও তো।

আরশী তোমার মোবাইলে না কালকেই এক'শ টাকা দিয়েছি?

হ্যাঁ, খরচ হয়ে গেছে, বললাম না আপার সঙ্গে কথা বলেছি, আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাই সব টাকা শেষ হয়ে গেছে, তুমি না দিতে চাইলে থাক।

তুমি রাগ করলে, আচ্ছা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

ফিরোজ কয়েকমিনিটের মধ্যে আরশীর মোবাইলে এক'শ টাকা রিচার্জ করে দিয়েছিল।

এমনিভাবে আরশী যখন যা চাইতো তাই যেন আলাদীনের চেরাগের মতো ফিরোজ তার হাতে পৌঁছে দিত। মাঝে মাঝে রাজশাহী চলে আসতো, তারপর আরশীকে সঙ্গে নিয়ে কেনা-কাটা করতো, ঘুরে বেড়াতো একেবারে পঁচিশ বছরের যুবকের মতো। আরশীর বেলায় ফিরোজের বাজেটের কোন কমতি ছিল না। আরশী আঙ্গুল দিয়ে যে কাপড়টা দেখিয়ে দিত ফিরোজ সেটাই কিনে দিত, যখন যা খেতে চাইতো তাই খাওয়াতো।  

 

 যে ছেলেটির সঙ্গে আরশীর সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার নাম নূর। পুরো নাম নূর আলম। গায়ের রং ফর্সা, স্মার্ট, বাচনভঙ্গী সুন্দর, খুব সহজে দৃষ্টি কাড়ার মতো।

প্রায় দিন অফিসের কাজ শেষে সুযোগ হলে আরশী আর নূর কোথাও আড্ডা দিত, অফিস বন্ধের দিন হলে দু'জনে পদ্মার পাড়ে ঘুরে বেড়াতো। একদিন আরশী আর নূর পদ্মার পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল। এমন সময় ফিরোজ মোবাইল করেছিল, হ্যালো আরশী।

হ্যাঁ বলো।

আরশী তুমি এখন কোথায়?

পদ্মার পাড়ে।

কেন? কার সাথে?

আমার এক কলিগসহ বেড়াতে এসেছি।

ফিরোজ বিশ্বাস করেনি, সে হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ, না?

নূর জিজ্ঞেস করেছিল, কে আরশী?

তোমাকে বলেছিলাম না, আমাদের ভাড়াটে।

তোমাকে কেন মোবাইল করেছে?

এমনিতেই মাঝে মাঝে মোবাইল করে আমার খোঁজ-খবর নেয়।

          তোমার খোঁজ নেয় কেন?

এমনিতেই।

আরশী সহজভাবে বললেও নূর তার কথাটা সহজভাবে গ্রহণ করেনি। তার মনে একটা সন্দেহ বাসা বেঁধেছিল। সে আরশীর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাদের আত্মীয়?

না কিন্তু আত্মীয়ের চেয়ে বেশি।

কী নাম ভদ্র লোকের?

ফিরোজ।

ফিরোজের কি শুধু তোমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নাকি তোমাদের বাড়ির সবার সঙ্গে?

তুমি সন্দেহ করছ?

না ঠিক সন্দেহ করছি না।

তবে শোনো ফিরোজ একজন বয়স্ক মানুষ, একটা মেয়ে আছে বুঝলে।

নূর এর মুখ থেকে সন্দেহের মেঘটা যেন কিছুটা সরে গিয়েছিল, তুমি কিছু মনে করলে নাকি?

না।

 

ফিরোজ আমাকে নিজের মেয়ে রিমার মতো স্নেহ করতো, বন্ধুর মতো ভালোবাসতো। আমার যে কোন প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়তো। যেসব বিষয়ে আমি আমার বাবা-মা, বোন-দুলাভাই সবার সঙ্গে কথা বলে কোন সিদ্ধান্ত বা সহযোগিতা পেতাম না সেসব বিষয়ে ফিরোজ আমাকে সুন্দর সমাধান দিত, প্রয়োজনে টাকাও দিত। ফিরোজ বলতো তুমি যেদিন প্রমোশন পাবে সেদিন আমি মনে করবো তোমার জন্য আমার মেধা, অর্থ এবং শ্রম সার্থক হয়েছে।

হ্যাঁ ফিরোজ আমি প্রমোশন পাচ্ছি, তোমার মেধা, অর্থ এবং শ্রম সব সার্থক হয়েছে, তুমি একবার তোমার মোবাইলটা চালু করো, আমি তোমার জন্য সেই সিমকার্ডটাই রেখেছি, কই তুমি তো কোনদিন মোবাইল করলে না? তুমি না বলতে রাগ কখনো মানুষের জীবনে ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। তবে তুমি আমার ওপর রাগ করে আছ কেন? তুমি বিশ্বাস করো সেদিনের ঘটনার জন্য আমার কোন দোষ নেই। আমি জানি আমার জন্য তোমার এবং আমার দু'জনের জীবনে যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনদিন পূরণ হবার নয়, তুমি বিশ্বাস করো আমার কোন দোষ ছিল না। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার।

আরশী পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।

না আরশীর চোখে ঘুম নেই, একটা অপরাধবোধ তাকে তাড়া করছে। তার জীবনে ফিরোজের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আসলে আইন-আদালত মানুষকে যে শাস্তি দেয় তা সবার চোখে পড়ে, অপরাধীকে সবাই ঘৃণা করে কিন্তু বিবেকের দেয়া শাস্তি লোক-চক্ষুর আড়ালে অপরাধীকে দিন-রাত যে শাস্তি দেয় তা কারো চোখে পড়ে না ঠিকই কিন্তু অপরাধীর হৃদয়কে সব সময় দগ্ধ করে। এই দুই শাস্তির মধ্যে কোন শাস্তি বেশি জ্বালাময়ী তা শুধু ভুক্তভোগী মাত্রই অনুভব করে। আরশী আর একদিনও বিবেকের শাস্তি ভোগ করতে চায় না। সে আপন মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে, আমি তোমাকে খুঁজে বের করবো ফিরোজ, কিন্তু কীভাবে? তোমার কথা তো আমি কাউকে বলতেও পারবো না, তোমাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে, আমার বিবেকের কাছে আমি আর অপরাধী হয়ে থাকতে পারবো না।

 

দুই

 

রাতের খাবারের পর ফিরোজকে কয়েকটা ঔষধ খেতে হয়, এমনিতেই ফিরোজের কোনদিন ঔষধ খেতে ভুল হয় না তারপরও প্রতিদিন সকাল এবং রাতের খাবারের পর তার বাবার প্রেসক্রিপশন আর ঔষধের ঝুড়িটা নিয়ে রিমা তার বাবার সামনে আসে, রাতের ঔষধ খাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে, বাবা দুপুরে ঠিক মতো ঔষধ খেয়েছো তো?

          ফিরোজ বলে, হ্যাঁ রে মা খেয়েছি, আচ্ছা তুই বলতো আমি কি কোনদিন কোন কাজ করতে ভুলে গেছি? আমার কি সবকিছু ভুলে যাবার মতো বয়স হয়েছে?

সরি বাবা তোমাকে আসলে এত বুড়ো ভাবা আমার ঠিক হয়নি।

রিমা ফিরোজকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সব ঔষধগুলো খাওয়ানোর পর তার বাবার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি তো প্রতিদিন এতগুলো করে ঔষধ খাও, তোমার আসলে অসুখটা কী?

ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, অসুখের কথা কি ডাক্তাররা কখনো বলে রে মা, শুধু বলে ঔষধ খান ঠিক হয়ে যাবেন আর আমরা বেঁচে থাকার আশায়, সুস্থ থাকার আশায় ঔষধ খাই।

রিমা আর কোন কথা বলল না। কয়েকমুহূর্ত বসে রইল তারপর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বাবা আমি তো এখন বড় হয়েছি, তাই না?

ফিরোজ রিমার মুখের দিকে তাকালো, হঠাৎ করে বড় হয়েছিস বললি কেন বলো তো?

বাবা তুমি কিন্তু আমাকে কিছু নিয়ম শিখিয়েছো কারো প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করতে হয় না, আগে উত্তর দিতে হয়।

তাই তো, বলে ফিরোজ আবার রিমার মুখের দিকে তাকালো, হ্যাঁ মা তুই তো বড় হয়ে গেছিস, আমি খেয়ালই করিনি। আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দিলাম এখন আমাকে বল তো তুই হঠাৎ করে বড় হওয়ার কথা বললি কেন? তুই কোথাও প্রেম-ট্রেম করছিস নাকি?

বাবা আমি প্রেম করলে তুমি অবশ্যই জানবে, আমি তো সবার আগে তোমাকে বলবো, তুমি আমার ভালো বন্ধু না?

তবে?

বাবা আমার তো এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হলো।

হ্যাঁ।

আমি কোথায় ভর্তি হবো?

তোর যেখানে পছন্দ, যেখানে তুই ভর্তির সুযোগ পাবি সেখানেই ভর্তি হবি।

বাবা!

হ্যাঁ বল।

তোমাকে কে দেখবে বাবা? বলতে বলতে রিমার চোখ থেকে পানি ছিটকে পড়ল।

ফিরোজ রিমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, তোর কী হয়েছে রে মা? হঠাৎ করে তোর মনটা খারাপ হয়ে গেল কেন?

রিমা চোখ মুছলো।

ফিরোজ বলল, পৃথিবীতে কাউকে কারো দেখতে হয় না মা, আর নিজের চলার পথে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয় কখনো পিছু ফিরে তাকাতে হয় না।

বাবা তুমি কিন্তু স্ববিরোধী কথা বলছো।

যেমন?

বাবা মা মারা যাওয়ার পর তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলে কেন? তুমি আবার বিয়ে করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে না কেন?

ফিরোজ রিমার কথার কোন জবাব দিল না।

রিমা তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ফিরোজ বলল, রিমা তুই আসলে খুব বড় হয়ে গেছিস মা।

বাবা তুমি আমাকে শৈশব থেকে স্বপ্নদেখিয়েছো অনেক বড় হওয়ার, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিন্তু তুমি একটা কথা খেয়াল রাখো বাবা আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না, তোমাকে একা ফেলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হওয়ার মতো স্বার্থপরআমি কোনদিন হবো না।

রিমা একটু আগেই বললাম তুই বড় হয়েছিস, এখন মনে হচ্ছে তুই আসলে ছোটই আছিস।

না আমি এখন বড় হয়েছি, অনেক বড় হয়েছি, আমি এখন সবকিছু বুঝি বাবা।

তুই আসলে কী বলতে চাচ্ছিস? বলতো?

বাবা তুমি আমার জন্য অনেক করেছো, আসলে আমি বুঝিনি কথাটা তোমাকে আমার আরো আগে বলা উচিত ছিল।

এত চিন্তা করছিস কেন? আমি তো তোর ভালো বন্ধু যা বল্‌বি কোন রকমের ভনিতা ছাড়াই সোজা বলে দিবি?

বাবা মা যখন আমাকে রেখে মারা গেল আসলে তখনই তোমার বিয়ে করা উচিত ছিল, তখন না হয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করলে না এখন তো আমি বড় হয়েছি, এখন তুমি একটা বিয়ে করো।

ফিরোজ হো হো করে হেসে উঠলো, তুই আমাকে হাসালি, আমার বয়স কত জানিস?

হ্যাঁ, পঁয়তাল্লিশ বছর।

পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে কেউ বিয়ে করে?

হ্যাঁ এটা তো স্বাভাবিক।

ফিরোজ রিমার দিকে রাগান্বিতি চোখে তাকালো।

রিমা বলল, বাবা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সঙ্গীর প্রয়োজন, মানুষ একা বাঁচতে পারে না। তাছাড়া তোমার বয়স বাড়ছে, তুমি এক সময় বার্ধক্যে ভুগবে তখন কে তোমার দেখাশুনা করবে? তুমিই বলো?

আচ্ছা তুই বলতো এখন মানুষের গড় আয়ু ক'বছর?

পঁয়ষট্টি বছর।

আমার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ বছর, মানুষের গড় আয়ু অনুযায়ী আমি আর চৌদ্দ বছর বাঁচবো আবার যে কোন সময় মরেও যেতে পারি। সঙ্গী বলতে তুই যা বলছিস সেই সঙ্গী ছাড়াই আমি কত বছর কাটালাম জানিস?

আগে কত বছর কাটানো আর বার্ধক্যে কয়েকদিন কাটানোর মধ্যে অনেক তফাৎ বাবা।

আচ্ছা যাক ওসব কথা, তুই এডমিশন টেস্টের জন্য পড়ছিস তো?

রিমা রেগে গেল, বাবা তুমি কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছো, এটা আমি একেবারে পছন্দ করি না। কীসের আমার লেখাপড়া? কীসের প্রতিষ্ঠিত হওয়া? যে বাবা প্রায় দেড় যুগ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করতে পারে তাকে ছেড়ে আমি যাবো লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হতে, না? বাবা তোমার বিয়ের পর আমি এডমিশন টেস্টের ফরম তুলতে যাবো, তার আগে আমি এক পা নড়বো না। আমার জিদ সম্পর্কে তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কিন্তু অনঢ়।

ফিরোজ রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, যা মা রাত হয়েছে, ঘুমাতে যা।

আমি ঘুমাতে যাচ্ছি, কাল সকালে আবার আলাপ হবে। তুমি প্রসঙ্গ পাল্টাবে না, আমি কিন্তু কাল থেকেই মাঠে নামবো।

রিমা, বাবা মেয়েকে বিয়ে দেয়, কোন মেয়ে বাবাকে বিয়ে দেয় না।

          সেটা আমি বুঝবো, থ্যাংক ইউ বাবা, গুড নাইট, বলে রিমা ফিরোজকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল।

ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হাসলো, পাগলি মা আমার।

 

সেদিনের মেয়ে রিমা, আজ বাবাকে শাসন করছে।

তখন ফিরোজের পোস্টিং ছিল নীলফামারী জেলায়। তার স্ত্রী প্রমী তখন সন্তান সম্ভবা। প্রমীর ডেলিভারির তারিখ অতিক্রম করার পরও ডেলিভারি না হওয়ায় ফিরোজ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিল। ফিরোজের বন্ধু-বান্ধবরা ঘন ঘন খবর নিচ্ছিল। একদিন গভীর রাতে প্রমীর প্রসব বেদনা শুরু হলো। বাসায় প্রমী, ফিরোজের মা আর ফিরোজ, এত রাতে কাকে ডাকবে? কী করবে? ফিরোজ নিচতলায় বাড়িওয়ালার বাসায় দরজায় নক করলো।

বাড়িওয়ালা তো ফিরোজকে দেখে অবাক, ফিরোজ সাহেব এত রাতে? কোন সমস্যা?

আপনার টেলিফোনটা ঠিক আছে?

হ্যাঁ, কোথায় ফোন করবেন বলুন?

আমার স্ত্রী অসুস্থ, হাসপাতালে ফোন করতে হবে।

ভদ্র লোক খুব আন্তরিক ছিলেন। তিনি নিজে বাড়ির নাম ঠিকানা বলে হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স আনিয়েছিলেন।

প্রমীর ডেলিভারির তারিখ-এর কয়েকদিন আগেই ফিরোজ তার মাকে এনেছিল। প্রমীর ভালো-মন্দগুলো তিনিই দেখতেন।

নীলফামারী সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, সরি ফিরোজ সাহেব পেশেন্টের অবস্থা ভালো না, রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না, আপনি রংপুরে নিয়ে যান।

ফিরোজ হাসপাতালের টেলিফোন থেকেই তার শ্বশুরবাড়ি দিনাজাপুরে টেলিফোন করেছিল।

রাতেই প্রমীকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। গাড়ি যখন হাসপাতালে পৌঁছেছিল তখন ভোর পাঁচটা।

প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে প্রমী একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিল, তুমি একটু আমার পাশে বসো।

ফিরোজ প্রমীর পাশে বসেছিল।

আমি বোধ হয় আর বাঁচবো না। কয়েক বছরের সংসার জীবনে তুমি আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছো, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আসলে আমি খুব জেদি আর অহংকারী ছিলাম, অনেক সময় খুব ছোট-খাট কারণে  তোমার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছি, আমি যদি মরে যাই তবে আমাকে মাফ করে দিও।

ফিরোজ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল, তুমি খুব জেদি আর অহঙ্কারী বলেই আমি তোমাকে পেয়েছি। আমি তোমাকে মরতে দিবো না প্রমী। আমি তোমাদের বাড়িতে টেলিফোন করেছি, হয়তো সকাল হতে হতেই আব্বা-আম্মা, ভাবী সবাই চলে আসবে।

তুমি আমাদের বাড়িতে টেলিফোন করলে কেন?

ফিরোজ বলেছিল, প্রমী বিপদের সময় প্রিয়জনদের কাছে ডাকতে হয়, সবাই এলে তুমি মনোবল পাবে, সাহস পাবে।

তুমি দেখ কেউ আসবে না, আমার বাবাকে তো আমি চিনি, আমার চেয়ে তাঁর কাছে আভিজাত্যে আর অহঙ্কারের দাম অনেক বেশি।

ফিরোজ প্রমীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, কথা বলো না প্রমী, আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি তারা না এলে সেটা তাদের ব্যাপার।

প্রমীকে ও.টি'তে নিয়ে যাওয়ার পর ফিরোজ করিডোরে পায়চারি করছিল। তার মনের মধ্যে তখন অসংখ্য চিন্তা ভিড় করছিল। প্রমী ছাড়া তার জীবন অচল, এখন সে মধ্য বয়সী মানুষ, চলার পথ এখনো অনেকদূর বাকি। সত্যি সত্যি যদি প্রমীর কিছু হয় তবে সে কী নিয়ে বাঁচবেন?

কয়েক ঘণ্টা পর ডাক্তাররা ও.টি থেকে মলিনমুখে বেরিয়ে এসেছিলেন, ফিরোজ সাহেব আপনার মেয়ে হয়েছে।

প্রমী?

সরি ফিরোজ সাহেব, আপনার স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হলো না।

খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফিরোজ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। সত্যি সত্যি সে আজ একা হয়ে গেল। প্রমী আজ তাকে ছেড়ে গেল। এখন জীবনের বাকি দিনগুলো একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তাকে কাটাতে হবে। সে এই ছোট্ট মেয়েকে কীভাবে মানুষ করবে, প্রমী তুমি চলে গেলে শুধু তোমার স্মৃতি হিসেবে মেয়েকে রেখে গেলে এখন আমি কী করবো? একদিনের বাচ্চা রিমাকে কীভাবে লালন-পালন করবে একথা ভেবে ফিরোজের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল।

প্রমী বেঁচে থাকতে তার বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য কেউ ফিরোজ কিংবা প্রমী কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি কিন্তু সকালবেলা হাসপাতালে এসে প্রমী মারা যাওয়ার খবর শুনে তাঁরা ফিরোজকে দোষারোপ করেছিল। ফিরোজের শ্বশুর একবার মামলা করারও হুমকি দিয়েছিলেন কিন্তু তার শাশুড়ি এবং অন্যান্যআত্মীয়-স্বজনরা তাকে  বুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন।

প্রমী মারা যাওয়ার পর ফিরোজের মা তার বাসায় ছিলেন। তিনি প্রায় প্রায় ফিরোজকে বিয়ে করতে বলতেন ফিরোজ মলিন হেসে বলতো, মা আমার রিমাকে কি তোমার বোঝা মনে হচ্ছে?

না, নিজের নাতনিকে বোঝা মনে হবে কেন? আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তো কোন অসুবিধা নেই কিন্তু তারপর? একদিন তো আমি চলে যাবো তখন রিমাকে কে দেখবে আর তোর নিজের কথা একবার ভেবে দেখ, তোর বয়সও তো কম, বাকি জীবনটা কি একাই কাটাবি?

আমার কথা তুমি বাদ দাও মা, আর রিমার কথা বলছো, তুমি যতদিন বেঁচে আছো ততদিন তুমি দেখ, তারপর আমি দেখব। তুমি দেখ হয়তো তারপর আর আমার মেয়েকে দেখতেই হবে না, নিজেই নিজেকে দেখবে, আমার মেয়ে না?

তার মা-ই রিমাকে লালন-পালন করেছে।

ফিরোজ, তাঁর মা আর রিমা এই তিন সদস্যের সংসার তাদের মন্দ চলছিল না। সুঃখ-দুঃখ সবকিছু তারা সমানভাবে ভাগ করে নিত।

ফিরোজের মা যখন মারা যায় তখন রিমার বয়স বারো বছর তারপর থেকে রিমা সত্যি সত্যি নিজেই নিজেকে দেখেছে।

সেদিনের সেই একদিনের বাচ্চাই আজকের রিমা। এই রিমা-ই ফিরোজের সব। বন্ধুর মতো সম্পর্ক তাদের দু'জনের মধ্যে। রিমার কলেজ, কোচিং এবং টুকটাক রান্নার কাজ শেষ করে দু'জনে একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে প্রায় দিনই বাপ-মেয়ে চুটিয়ে আড্ডা দেয়।

 

তিন

 

রিমার বয়স যখন আট বছর, তখন ফিরোজ বদলি লো জয়পুরহাট। বদলির অর্ডারটা হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে, রিমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে এমন সময়।

ফিরোজ জয়পুরহাট জয়েন করে অফিসের কাছেই একটা বাসা ভাড়া নিলো নিচতলায় বাড়িওয়ালা নিজে থাকতেন, সে বাসারই দ্বিতীয় তলার তিন রুম বিশিষ্ট একটা ফ্ল্যাট বাসায় ছিল ফিরোজ।

নীলফামারী থেকে জয়পুরহাট মালামাল শিফ্‌ট করার পর রিমা আর তার দাদি মিলে প্রতিদিন একটু একটু করে বাসা গুছাতো।

একদিন ফিরোজ অফিস থেকে ফিরে দেখল তার মা আর রিমার সঙ্গে একটি মেয়ে বাসার জিনিসপত্র গুছাচ্ছে।

ফিরোজকে বাসায় ঢুকতে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।

কী নাম তোমার?

আরশী।

বসো।

আরশী সোফায় বসল।

রিমা বলল, বাবা তুমি তো জানো না, আমরা যেদিন এসেছি সেদিন থেকেই আরশী ন্টি কাজ করছে তাই তো তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছানো হয়েছে।

তাই নাকি?

আরশী মাথা নত করে বসল।

রিমা বলল, তুমি নাহলে দাদিকে জিজ্ঞেস করো?

ছিঃ মা এভাবে বলতে হয় না। আমি কি তোকে অবিশ্বাস করছি যে তোর দাদিকে জিজ্ঞেস করতে হবে?

আরশী উঠে দাঁড়ালো, খালা আম্মা আমি আসি।

আসি কেন মা সো? তোমরা গল্প কর আমি তোমাদের জন্য চা করছি।

আরশী আবার বসল।

ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন ক্লাসে পড়?

অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে।

কোথায়?

বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজে।

তোমরা ক'ভাই বোন?

আমরা তিন বোন এক ভাই, বোনদের মধ্যে আমি মেজো।

এই দেখো আমরা তোমাদের বাসায় ভাড়া থাকি অথচ তোমাদের সঙ্গে আমাদের ভালোভাবে পরিচয়ই হয়নি, আসলে বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় আমি নিজে থাকলে হয়ত তোমাদের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া যেত, তোমার বাবা কী করেন?

বাবা সরকারি চাকরি করতো।

এখন।

রিটায়ার্ড করেছে। আগে আমাদের শুধু নিচতলাটা ছিল, বাবা রিটায়ার্ড করার পর পেনশনের টাকা দিয়ে উপরতলাটা করেছে, বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। এক ভাই আমার চেয়ে বড়, সবার ছোটভাই বছর একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।

ফিরোজ আরশীর দিকে তাকল। সে আসলে এতকিছু জানতে চায়নি কিন্তু আরশী নিজে থেকেই বলছিল। আরশীর চোখে-মুখে একটা সরলতা ছিল যা কিনা তার কথার মধ্যে ফুটে উঠছিল। ফিরোজ আপন মনে সল।

রিমা আরশীকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাদের গ্রামের বাড়ি জানেন?

না তো।

দিনাজপুর, এখান থেকে অনেক দূর, আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেকদিন আগে একবার গেছিলাম।

ফিরোজ রিমাকে কোলে নিয়ে চুমু দিল, কথা শোনো আমার মায়ের, একেবারে খাঁটি বাংলা ভাষায়।

আচ্ছা তোমরা গল্প করো আমি দাদিকে চা নিয়ে আসতে বলছি, বলে রিমা চলে গেল।

তারপর থেকে ফিরোজ বাসায় না থাকলে আরশী প্রায় উপরে উঠে আসতো। কোন কোন দিন ফিরোজের সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা হতো কোনদিন আরশী জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো আবার কোনদিন দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো।

সেদিন ফিরোজ অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় দেখে আরশী বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ফিরোজকে দেখে সামনে এগিয়ে আসে, কেমন আছেন?

হ্যাঁ ভালো, তুমি?

ভালো।

আমাদের বাসায় আসুন।

না।

এসো না বাবা, ভিতরে এসো। আরশীর মায়ের কণ্ঠস্বর।

ফিরোজ একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে আরশীর সঙ্গে গেল।

ফিরোজ ড্রয়িং রুমে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল। নিচতলার কাজ অনেক আগে করা হয়েছে তারপর আর কোনদিন হয়ত চুনকাম করা হয়নি। উপর তলার কাজ শেষ করার পর ফিরোজই প্রথম ভাড়াটে, দ্বিতীয় তলার কাজ শুরু করার আগে হয়ত ছাদ দিয়ে পানি চুয়াতো সে কারণে ছাদের তলার প্লাস্টার খসে পড়তে শুরু করেছে। ঘরের আসবাবপত্রগুলো অনেক পুরাতন, সোফার কাঠ হয়ত অনেক আগে বার্ণিশ করা হয়েছে, রং উঠে যাওয়ায় সোফাগুলো সৌন্দর্য হারিয়েছে, সোফার কভারগুলো পরিস্কার কিন্তু একটু একটু করে ছিঁড়তে শুরু করেছে বাসার সবকিছুতে যেন একটা দারিদ্রের ছাপ ফুটে উঠেছে। 

আরশী পরিচয় করে দিল, আমার মা।

হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি।

আমাদের বড় সংসার, সব সময় কোন না কোন টানাটানি লেগেই থাকে, আগে তোমার খালুর চাকরি ছিল। সে সময় বাসার ফার্নিচারগুলো করা হয়েছে, এখন পেনশনের সামান্য টাকায় ফার্নিচারগুলো রং করতেই পারছি না।

ফিরোজ লক্ষ্য করেছে, আরশীর মতো তার মাও নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করেছে, তাদের মধ্যে দারিদ্র লুকানোর কোন চেষ্টা বা ইচ্ছা নেই। তাদের নিজে থেকে এই দারিদ্র প্রকাশের কারণ বুঝতে ফিরোজের অনেকদিন সময় গল। ফিরোজ বলল, এভাবে বলবেন না খালা আম্মা, আল্লাহ্‌ যখন যেভাবে রাখে সেভাবেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয়।

আরশী ডাক দিল, মা।

হ্যাঁ মা আসছি।

কয়েকমিনিট পর আরশী ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে লো

ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, আরশী তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?

কোন মতে?

কোন মতে মানে?

এই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।

কেন? পড়ালেখা আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে কেন? ভালোভাবে পড়ালেখা করো।

করতে তো চাই।

সমস্যা কী?

আপনি সুখী মানুষ, আমাদের সমস্যার কথা বুঝবেন না, আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি।

আরশী চা নিয়ে লো

ফিরোজ চা শেষ করে বলল, খালা আম্মা ওপরে রিমা আছে, মা আছে আপনি একটু খেয়াল রাখবেন, মাঝে মাঝে ওপরে গিয়ে মা'র সঙ্গে গল্প করবেন, আরশী তুমিও এসো।

আরশী বলল, সেকথা আর আপনাকে বলতে হবে না, আমি তোকাজ না থাকলেই আপনার বাসায় যাই।

হ্যাঁ, রিমাও তোমাকে খুব পছন্দ করে।

 

সেদিন রিমা স্কুল থেকে ফিরে অনেকটা অভিমানের সুরে বলল, বাবা আমার এক বন্ধু আছে ওর বাবা ওকে প্রায় আনতে যায়, চকলেট কিনে দেয়, তুমি তো আমাকে একদিনও আনতে যাও না, আমার খুব খারাপ লাগে।

মন খারাপ করো না মা, আমি যে চাকরি করি, তোমার স্কুল আর আমার অফিস যে একই সময়ে।

বাবা আজ তো শনিবার তোমার অফিস বন্ধ ছিল তুমি গেলে না কেন?

ফিরোজের দু'চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে রিমাকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করল।

তারপর থেকে প্রতি শনিবার ফিরোজ স্কুল থেকে রিমাকে আনতে যেতে।

ফিরোজ একবার মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখল, রাত এগারোটা বাজে।

সে ডাঃ হায়দারকে মোবাইল করল, হ্যালো, হায়দার।

ফিরোজ কেমন আছিস এখন?

দোস্ত ভালো থাকলে তো তোকে ডিসটার্ব করি না।

ডিসটার্বের কথা বলছিস কেন? আমি কি তোর সঙ্গে কমার্শিয়াল আচরণ করি?

না দোস্ত, মন ভালো নেই তো তাই তোকে কী বলতে কী বলে ফেললাম? হায়দার আমরা প্রাইমারি স্কুলে যারা একসঙ্গে লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি তাদের মধ্যে বোধ হয় আমাকে আগে যেতে হচ্ছে?

ফিরোজ এভাবে ভাবছিস কেন? তোকে তাহলে একটা গল্প বলি, শোন।

বাঃ দেশের শীর্ষস্থানীয় অন্তত দশজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মধ্যে তুই একজন আর তোর কি না সময় আছে একজন রোগীকে গল্প শোনাবার, ঠিক আছে বল।

আমি যে ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করি সেই ক্লিনিকে একবার এক পেশেন্ট এসেছিলেন কিডনি ডায়োলাইসিস করতে। কয়েকদিন ঢাকায় থাকার পর একদিন ডাক্তারকে ডায়োলাইসিস করার মেশিনের দাম জিজ্ঞেস করলেন।

ডাক্তার মেশিনের দাম বলার পর তিনি একটা মেশিন কিনে তাঁর শহরের বাসার নিচতলায় স্থাপন করলেন এবং ডাক্তার তার বাসায় গিয়ে সময়মতো ডায়োলাইসিস করে আসতেন। বেশ ভালোই যাচ্ছিল তার শারীরিক অবস্থা। তারপর তিনি একদিন মাইক্রোবাস নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে চাষ-আবাদ দেখতে গেলেন, ফেরার পথে তিনি সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলেন।

হায়দার তুই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস? আমার যে অসুখ হয়েছে সে অসুখে না মরে আমি অন্য অসুখেও মরে যেতে পারি?

এক্সাক্টলি।

আচ্ছা হায়দার আমি কি আর বেশিদিন বাঁচবো না, না মানে আমি বলছিলাম আমাকে কত তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছাতে হবে?

ফিরোজ এভাবে জানতে চাচ্ছিস কেন? জীবনের সব ভালো কাজই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুছাতে হয়।

হায়দার ডাক্তারদের সবচেয়ে আগে হতে হয় একজন ভালো মনোবিজ্ঞানী, তারপর ডাক্তার। ভলো মনোবিজ্ঞানী না হলে কেউ বড় ডাক্তার হতে পারে না। আসলে আমি এখন বুঝতে পাচ্ছি কেন তুই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম করেছিস।

থ্যাঙ্ক ইউ দোস্ত, এখন ঘুমানোর চেষ্টা কর।

 

চার

 

ছাত্র জীবনে ফিরোজের বাবা যখন মারা যায় তখন থেকে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত বিষয়-সম্পত্তি তার মা দেখাশুনা করতো। ফিরোজের চাকরির পর সে আর কোনদিন সেসব বিষয়-সম্পত্তির কোন খোঁজ-খবর নেয়নি। চাচাতো ভাইয়েরা তার জমি-জমা দেখাশুনা করে আয়-ব্যয়ের যা হিসাব দিত তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকতো। জমিজমার কাগজ-পত্র চাচাতো ভাইয়েরাই দেখাশুনা করতো। তাছাড়া সে নিজেও কিছু জমিজমা কিনেছে, সেসব জমির খারিজ চাচাতো ভাইয়েরাই করেছে এবং কখন কোন জমির খাজনা দিতে হবে তাও তারাই করতো। সে মাঝে মাঝে তাদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিত। তবে তাদের সমস্ত জমি জমার কাগজ-পত্র দেখাশুনা করতো জলিল মহুরি

সকালবেলা নাস্তার পর ফিরোজ জলিল মহুরিকে ডেকে পাঠালো।

জলিল মহুরি ফিরোজের প্রতিবেশী, মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হলে শুধু সালাম বিনিময় হতো কিন্তু আজ হঠাৎ করে তাকে ডেকে পাঠানোয় সে কিছুটা অবাক হলো, প্রায় ঘণ্টা খানেক পর জলিল মহুরি এলো, ভাইজান কী মনে করে হঠাৎ আমাকে ডেকেছেন?

জলিল তোমার সঙ্গে আমার অনেক কাজ আছে।

জি ভাইজান বলুন কী কাজ?

তুমি তো অনেকদিন থেকে আমাদের জমি-জমার কাগজ দেখাশুনা করো।

জি।

ফিরোজ একটা ফাইল জলিল মহুরি দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বাবার অংশ থেকে পাওয়া এবং আমার কেনা জমির কিছু কাগজ-পত্র মনে হয় এই ফাইলে আছে। যেসব জমির কাগজ-পত্র নেই সেগুলো হয়ত আমার চাচাতো ভাইদের কাছে কিংবা তোমার কাছে আছে।

জলিল মহুরি সব কাগজগুলো দেখে বলল, ভাইজান আপনার কেনা জমির কাগজ-পত্রগুলো তো ঠিক আছে, শরিকের জমির কাগজ-পত্রগুলো আমি খুঁজে বের করি, আপনি কোন চিন্তা করবেন না।

তুমি সবগুলো কাগজ-পত্র খুঁজে বের করো, জমি রেজিস্ট্রি করতে যেসব কাগজ লাগবে সব যোগাড় করো।

জমি রেজিস্ট্রি করার কথা শুনে জলিল মহুরি মুখ তুলে কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে ফিরোজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

আমার বিষয়-সম্পত্তি যা আছে সব আমার মেয়ে রিমার নামে দান করে দিব।

জি ভাইজান।

কত খরচ পড়বে?

হিসাব করে দেখতে হবে ভাইজান।

তুমি হিসাব করে আজ সন্ধ্যায় আমাকে জানাবে, আগামীকাল রেজিস্ট্রি হবে।

জি ভাইজান।

একটা কথা মনে রাখবে।

জলিল মহুরি মুখ তুলে তাকাল, কী কথা ভাইজান?

কথাটা যেন কেউ না জানে, এমন কি রিমাও যেন না জানে।

ঠিক আছে ভাইজান, কেউ জানবে না।

 

টেবিলে খাবার দিয়ে রিমা সব সময় তার বাবার দিকে খেয়াল করে, কতটুকু খাচ্ছে, কোনটা তার বাবা বেশি পছন্দ করে, কোনটা কম পছন্দ করে এসব।

ফিরোজ আগে শাক-সব্জি দিয়ে খাওয়া শুরু করতো তারপর মাছ কিংবা মাংস যেটা তার পছন্দ সেই তরকারি দিয়ে খেত। আজ তার ব্যতিক্রম ঘটল।

ফিরোজ বলল, মা মাংসের বাটিটা এদিকে দে তো।

বাবা সব্জি খাবে না?

খাবো পরে?

বাবা তুমি কি খাবার ধরণটাও পাল্টিয়েছ নাকি?

হ্যাঁ।

কেন?

আগে কম পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে খাওয়া শুরু করতাম, বেশি পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে পরে খেতাম কিন্তু আমার মনে হয়েছে নিয়মটা ঠিক ছিল না।

কেন?

এই ধর আমি কম পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম এবং বেশি পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে খাওয়া শুরু করার আগে মরে গেলাম, তখন তো আর আমার বেশি পছন্দের তরকারিগুলো খাওয়া হলো না। তাই নিয়মটা একটু পাল্টিয়েছি।

রিমা হেসে ফেলল।

হ্যাঁ শুধু তাই না আমার মনে হয় জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা উচিত।

রিমা শাসনের সুরে বলল, বাবা তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? বলতো?

না এমনি।

খাওয়া শেষ করে নিত্য দিনের মতো ফিরোজ ড্রয়িং রুমে বসল।

পিছনে পিছনে রিমাও তার বাবার পাশে বসল।

বাবা তুমি যা-ই বলো না কেন? আমি বুঝতে পাচ্ছি তুমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য এসব আধ্যাত্মিক কথা বলছ।

আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলব কেন? কোনটা সত্যি কথা না তুই বল?

আচ্ছা যাক এখন তোমার কথা বলো।

 কী কথা?

 বাবা তোমার কি কাউকে পছন্দ আছে?

 ফিরোজ রেগে গেল, রিমা।

 না বাবা, আমি বলছিলাম যদি থাকে তো ভালো, আর না হলে তো আবার আমাকে মা খুঁজতে হবে।

 রিমা ফাজলামি করবি না।

 বাবা!

 ছোটবেলায় তোর মা মারা গেছে দেখে আমি তোকে বাবা-মা দু'জনের স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে বড় করেছি, তোকে কোনদিন শাসন করিনি তাই তুই আমার মাথায় উঠেছিস, আমার সঙ্গে যাচ্ছেতাই কথা বলছিস

রিমা কোন কথা বলল না, তার চোখ দিয়ে পানি ছিটকে পড়ল। সে আর কোন কথা না বলে তার রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল।

ফিরোজ কয়েক মিনিট বসে রইল। তারপর রিমার রুমে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে মা, আসলে তোকে কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আয় বসি দু'জনে কিছুক্ষণ গল্প করি।

রিমা মাথা থেকে তার বাবার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি তোমার সঙ্গে গল্প করবো না, আমি এখন ঘুমাবো।

তাহলে আমি কার সঙ্গে গল্প করবো, তুই ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই, বলতে বলতে ফিরোজের কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এলো।

রিমা বিছানায় শুয়ে থেকেই চোখ মুছে বলল, আমি তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারি তবে তোমাকে একটা প্রমিজ করতে হবে?

কী প্রমিজ?

তুমি আর কোনদিন আমার ওপর রাগ করতে পারবে না।

রকম শর্ত দিয়ে কখনো প্রমিজ করতে হয় না, কারণ তুই যদি কোন অন্যায় করিস তবে আমি তোকে শাসন করতে পারবো না?

আমি প্রমিজ করলাম, আমি কোন অন্যায় করবো না। এখন তুমি প্রমিজ করো তুমিও আমাকে কোনদিন ধমক দিবে না।

প্রমিজ।

রিমা বিছানা থেকে উঠল।

ফিরোজ রিমার হাত ধরে বিছানা থেকে তাকে নিয়ে এসে আবার সোফায় বসল।

ফিরোজ রিমার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল, বাবা আমার মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি এসেছে।

কী বুদ্ধি?

তার আগে তোকে একটা গল্প শুনতে হবে।

বলো।

আমাদের সঙ্গে এক মেয়ে লেখাপড়া করতো তারপর সে যখন এস.এস.সি পাস করল তখন একদিন হঠাৎ করে তার বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দিল।

তারপর।

আমাদের ধারণা ছিল মেয়েটার লেখাপড়া হয়ত পর্যন্তই শেষ হবে, কিন্তু শেষ হয়নি। সে সংসার করতে করতে মাস্টার্স পাস করার পর এখন সরকারি চাকরি করছে।

এটা আবার নতুন কী? এটা কোন নতুন ঘটনাও না, আকর্ষণীয় ঘটনাও না।

ফিরোজ রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমিও তোকে বিয়ে দিতে চাই মা।

বাবা!

হ্যাঁ মা তোর যদি কোন ছেলেকে পছন্দ থাকে তো বল?

আমার কোন পছন্দ নেই বাবা, থাকলে তোমাকে বলতাম আর আমি সবে মাত্র এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি, আমি এখনি বিয়ে করবো কেন?

বিয়ের পর লেখাপড়া করবি, আচ্ছা তোর এক বন্ধু যে একদিন বাসায় এসেছিল ইমন না কী নাম?

ইমন, বন্ধু না কাজিন।

ইমনকে রিমা ভালোবাসে, সুযোগ পেলেই দু'জনে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু রিমা ইমনকে বিয়ে করবে এবং রিমার বাবা সেটা এত সহজে মেনে নিবে এটা দু'জনের কেউ কোনদিন ভাবেনি আজ যখন ফিরোজ নিজে থেকেই ইমনের নাম বলল তখন রিমা মনে মনে অনেকটা খুশি হলো।

ওকে তোর পছন্দ না?

বাবা আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।

তা হয়নি আগামী মাসের পনেরো তারিখে তোর বয়স আঠারো বছর হবে তখন তোর বিয়ের বয়স হবে এখন থেকে বিয়ের আলাপ শুরু করলে বিয়ে হতে হতে তোর বয়সও পূর্ণ হবে।

বাবা।

হ্যাঁ তোর জন্ম তারিখ আমার মনে থাকবে না?

বাবা তুমি না বলতে আমি আগে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর তুমি আমার বিয়ে দিবে, এখন হঠাৎ করে মত পাল্টাচ্ছ কেন?

যে বললাম ভালো তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করতে, এখন আমার মনে হচ্ছে আমার সব কাজের মধ্যে তোর বিয়েটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই আগে বিয়ের কথা বলছি। তুই আমার মেয়ে, বিয়ের পরও তুই ঠিকই নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবি।

না বাবা, না।

মা তুই যখন যা বলেছিস আমি তাই করেছি। আমার আদর স্নেহে তু্‌ই একটু বেশি জেদি হয়েছিস্‌, আমিও তোর সব কথা শুনেছি তুই আমাকে আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে দে।

বাবা তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? তুমি কোথাও চলে যাচ্ছ নাকি?

ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, কীভাবে বলছি একেবারে স্বাভাবকিভাবে বলছি, তুই আমার কথা ভাবিস না মা, যা তুই এখন ঘুমিয়ে পড়।

রিমা তার রুমে গেল।

ফিরোজ একবার মোবাইলের ঘড়িতে দেখল।

রাত দশটা বাজে।

সে কামালকে মোবাইল করল, হ্যালো কামাল।

জি ভাইজান।

তুমি কি বাসায়?

জি ভাইজান।

তুমি একবার আমার বাসায় আসতে পারবে?

ভাইজান জরুরী কিছু? কোন সমস্যা?

না কোন সমস্যা না, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

ভাইজান আসছি।

কিছুক্ষণের মধ্যে কামাল চলে এলো।

রিমা দরজা খুলে দিল, ঙ্কে আস্‌সালামুয়ালায়কুম।

ওয়ালেকুম আসলাম, কামাল ড্রয়িং রুমে বসল।

ফিরোজ বলল, তুই তোর রুমে যা মা।

ভাইজান হঠাৎ আমাকে কী মনে করে ডেকেছেন?

কামাল রিমা আমার একমাত্র মেয়ে, ওর মা যদি বেঁচে থাকতো তবে হয়ত বিষয়টা আমাকে ভাবতে হতো না, আমি কোথাও গেলে মেয়েটা সারাদিন বাসায় একা থাকে, একা কোথাও বেরও হয়না, বলতে গেলে একেবারে নিঃসঙ্গ। আমারও অনেক বয়স হয়েছে আল্লাহ না করুন হঠাৎ করে যদি মরে যাই তবে মেয়েটার আর পৃথিবীতে কেউ থাকবে না।

একথা মুখে আনবেন না ভাইজান।

না, হায়াত মউতের কথা তো আর বলা যায় না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মা রিমাকে আমি বিয়ে দিব।

ভাইজান হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন?

কামাল তোমার ছেলে আছে না, ইমন।

জি।

রিমা আর ইমন পরষ্পরকে ভালোবাসে, তুমি সম্মতি দিলে আমি ওদের বিয়ে দিতে চাই।

ভাইজান আপনি আমার চাচাতো ভাই এবং বংশের সবার বড় ছেলে, আপনাকে আমরা সবাই মুরুব্বী মানি, তাই আপনি যখন চাচ্ছেন তো আমার আর আপত্তি কি, তা না হলে তো আমার ছেলে আপনার মেয়ের জামাই হওয়ার যোগ্য না। আপনি আরো ভেবে দেখেন ভাইজান।

আমি যোগ্যতা দেখে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছি না, আমি মনে করি ছেলে-মেয়ে দু'টাই আমার এবং আমার মেয়ে ইমনকে পছন্দ করে। আমি ওর ইচ্ছা পূরণ করে মরতে চাই।

ভাইজান আপনি কিন্তু বার বার করে মরে যাবার কথা বলছেন, এটা আর একবারও বলবেন না।

আমি ভেবে দেখেছি কামাল, আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তুমি সবকিছুর আয়োজন কর, মনে কর বর-কনে দু'জনেরই গার্জিয়ান তুমি।

ভাইজান, আপনার কী কোন অসুখ করেছে?

ফিরোজ কিছু বলল না।

ভাইজান হঠাৎ করে আপনার এরকম সিদ্ধান্ত? আপনি আমাদের সবাইকে মেয়েদের শিক্ষিত,স্বাবলম্বীরে গড়ার কথা বলে নিজের একমাত্র আদরের মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?

ফিরোজ কামালের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই তার রাগান্বিত চোখ দেখে কামাল চোখ নামাল।

রিমা চায়ের ট্রে নিয়ে ভিতরে ঢুকল।

 

পাঁচ

 

সেদিন ছিল শনিবার। রিমাকে তার স্কুল থেকে নিয়ে এসে বাসার কলিং বেল টিপতেই ফিরোজের কানে তার মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে লো, মা আরশী দরজাটা খুলে দাও তো।

আরশী দরজা খুলে দিয়ে ভিতরে চলে গেল।

হঠাৎ করেই ফিরোজের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিল। আরশী তো অনেকদিন থেকে জয়পুরহাটেই আছে, একটানা এতদিন কলেজ বন্ধ থাকে নাকি? ফিরোজ মনে মনে হিসাব করছিল, এখন কি মাস? এখন কলেজে কোন পরীক্ষা চলছে নাকি বা কোন ছুটি বিশেষ করে গ্রীস্মকালীন বা শীতকালীন ছুটি? না কোন কিছুই তার মনে আসছে না। সে আরশীকে ডাক দিয়েছিল, আরশী।

আরশী সামনে এসে দাঁড়ালো

দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।

আরশী ফিরোজের সামনের সোফায় ঙ্কুচিত হয়ে বসল।

ফিরোজ সাহেব জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আরশী তোমাকে তো অনেকদিন থেকে বাসায় দেখছি, তোমার কলেজ বন্ধ নাকি?

না, কলেজ খোলা আছে।

তবে তুমি যাচ্ছ না যে?

না, এমনিতেই যাচ্ছি না।

কিন্তু ফিরোজ বিশ্বাস করতে পারেনি। তার মনে হচ্ছিল নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে। সাধারণত এই অঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়ার হার কম। বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি বিয়ের জন্য ঘর-বর খুঁজতে থাকে। তারপর ভালো ঘর-বর পেয়ে গেলে লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে সে পর্যন্তই। আরশীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরোজের মনে হচ্ছিল সে যেন কিছু লুকাচ্ছে। ফিরোজ প্রশ্ন করল, এমনিতেই যাচ্ছ না, নাকি কোন সমস্যা?

আরশী কোন কথা বলেনি, মাথা নত করে বসেছিল।

আরশী আজকাল লেখাপড়া, চাকরি, সবক্ষেত্রেই যা প্রতিযোগিতা তাতে ভালোভাবে লেখাপড়া না করলে তো হবে না, কলেজ খোলা আছে অথচ তুমি কলেজে যাচ্ছ না, ক্লাস করছ না।

আরশী মাথা নত করেই মৃদু কণ্ঠে বলল, আগামী মাসের তিন তারিখে যাবো।

আজ তো কেবল একুশ তারিখ, তিন তারিখ আসতে তো অনেক দেরি, তারমানে তুমি পনেরো দিন ক্লাস করবে না?

বাবা বলেছে এক কিংবা দুই তারিখে পেনশনের টাকা পাবে। আমার বই, হোস্টেলে খাওয়া-থাকার খরচের টাকা লাগবে তো, বাবা টাকা দিলেই চলে যাবো।

তো আপাততঃ ক'টাকা হলে তুমি বগুড়া যেতে পারছো?

দু'হাজার।

ফিরোজ মানি ব্যাগ থেকে দু'হাজার টাকা বের করে আরশীর হাতে টাকা দিতে াইল, তুমি বগুড়া চলে যাও, যদি খালা বা খালু টাকার কথা জিজ্ঞেস করে তবে আমার কথা বলবে। খালু যখন পেনশনের টাকা পাবে তখন আমাকে দিলেও চলবে।

আরশী যেন লজ্জায় আরো জড়সড় হয়ে গেল, না, লাগবে না।

ফিরোজ গম্ভীরস্বরে বলল, নাও, বড়দের কথা না করতে হয় না। আমি তো বললাম খালা কিংবা খালুকে আমার কথা বলবে।

আরশী টাকা নিল, তার দু'চোখ যেন পানিতে টলমল করছিল।

তুমি এখন যাও, ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে চলে যাও।

আচ্ছা।

 

আরশী পরদিনই বগুড়া চলে গিয়েছিল।

সেদিনের পর থেকে আরশী প্রায় দিনই তার বান্ধবীর মোবাইল ফোন থেকে ফিরোজের মোবাইলে মিস কল দিত। আর ফিরোজ কল ব্যাক করে কথা বলতো।

প্রায় মাস খানেক পর আরশী বাড়িতে লো

এসেই বাসায় ব্যাগ রেখে ওপর তলায়।

তখন রাত আটটা বাজে ফিরোজ টি.ভি দেখছিল।

আরশী সালাম দিয়ে একটা মুচকি হেসে বলল, কেমন আছেন?

হ্যাঁ ভালো, তুমি?

জি ভালো

চলে আসলে কেন? কলেজ বন্ধ নাকি?

কাল পুলিশে লোক নিবে, আমি একবার লাইনে দাঁড়াবো মনে করছি, আমার জন্য দোয়া করবেন।

তুমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি করবে?

তাছাড়া আর উপায় ? আপনি তো আমাদের সংসারের অবস্থা কিছুটা হলেও জানেন, যদি চাকরিটা হয়ে যায় তবে বাবার বোঝা কিছুটা হাল্কা হবে।

তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো?

জি, আপনি দোয়া করবেন।