আওয়ামী লীগ সরকার দাপটের সঙ্গেই জাতিকে স্বাধীনতা সংগ্রামের ‘সঠিক’ ইতিহাস শিখিয়ে চলেছে। কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় হলো, সরকারের এই ‘সঠিক’ ইতিহাসের সবটুকু কৃতিত্ব চলে গেছে একজন মাত্র নেতার দখলে। তিনি প্রধানমন্ত্রীর পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। অন্যদিকে ‘সঠিক’ ইতিহাস কিন্তু সরকারের উদ্ভট এ চেষ্টাকে বাতিল করে দেয়। একটি উদাহরণ হিসেবে মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর ভূমিকার কথা উল্লেখ করা যায়। স্বায়ত্তশাসনের পর্যায়ক্রমিক যে আন্দোলন ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছিল, মওলানা ভাসানী ছিলেন তার প্রধান নির্মাতা। স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার ডাকও তিনিই প্রথম দিয়েছিলেন (৩০ নভেম্বর, ১৯৭০)। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তাঁর সন্তোষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার পর কোনো কোনো নামকরা নেতার মতো গ্রেফতার বরণের নিরাপদ পন্থা নেয়ার পরিবর্তে তিনি ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন (১৫ এপ্রিল, ১৯৭১)। ইন্দিরা গান্ধীর সরকার তাঁকে অঘোষিতভাবে নজরবন্দি রাখলেও বিবৃতি ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে তিনি জনগণের প্রতি স্বাধীনতা যুদ্ধ এগিয়ে নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন, বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে বংলাদেশকে সমর্থন করার ও স্বীকৃতি দেয়ার অনুরোধ জানিয়ে তারবার্তা পাঠিয়েছেন।
কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তত্কালীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাত্ করে দেয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাঁকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। অর্থাত্ ১৯৫০-এর দশকে সূচিত স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সঠিক’ ইতিহাসে তাঁর স্থান হয়নি।
মওলানা ভাসানীর পর দ্বিতীয় একজন প্রধান নেতা হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের কথা উল্লেখ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এত সুসংগঠিত হতে এবং এত অল্প সময়ে বিজয় অর্জন করতে পারতো না। স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার গঠন থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও ভারতের সহযোগিতা নিয়ে দেশকে স্বাধীন করা পর্যন্ত সমগ্র কর্মকাণ্ডে প্রধান এবং সফল নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার এবং অন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা আদায়ের ক্ষেত্রেও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযোদ্ধাদেরও তিনিই সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন। এই ভূমিকার জন্যই যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের অবদানের কথা স্মরণ করা দরকার। কারণ ‘সঠিক’ ইতিহাস হলো, স্বাধীনতা কারও ঘোষণা শুনে আসেনি। জনগণও কারও ঘোষণা শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল যে অস্থায়ী ‘মুজিবনগর’ সরকার, সে সরকারও হঠাত্ করে গঠিত হয়নি।
১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের একেবারে শেষ বাক্যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কোনো পর্যায়েও শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। তিনি বরং তার ৭ মার্চের চার দফা দাবি অনুযায়ী সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার সৃষ্টি হবে। এই পর্যায়ে শেখ মুজিবের প্রস্তাবে ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে লে. জেনারেল শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। প্রথম বৈঠকে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার প্রশ্নে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করতে পারেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৭ মার্চের একান্ত বৈঠকে নতুন এক প্রস্তাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে মিলিত হয়ে দুই অঞ্চলের জন্য দু’টি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে ওই দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে। প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিলেন, যে ঘোষণাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরি করার আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন। ১৯ মার্চ আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব নিজেও বলেছিলেন, কোনো ‘অগ্রগতি না হলে’ তিনি কি শুধু শুধু আলোচনা চালাচ্ছেন?
২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান নিজেদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণায় তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে—(১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
এবং (৩) পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (‘পূর্ব পাকিস্তান’) জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা। উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে সম্মত হন। পরদিনই এ কে ব্রোহী এক লিখিত অভিমতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।
২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল। খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দু’টি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছিল—(১) প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে; এবং (২) যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে, সেহেতু প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউসে আগের দিন ঢাকায় আগত জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাত্ হয়েছিল। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, তেমন কোনো আয়োজন বা সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া পৌঁছে দিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টাদের বৈঠক শেষ হয়েছিল কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া। ২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার নতুন এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বিষয়টি শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব তোলেন এবং ঘোষণার অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সান্ধ্য বৈঠকে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের জানানো হয়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে আওয়ামী লীগকে অবহিত করবেন। জেনারেল পীরজাদা জানিয়েছিলেন, তিনি পরদিন অর্থাত্ ২৫ মার্চ ‘কোনো এক সময়’ ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোনে জানাবেন, কখন তারা আবার বসবেন এবং কবে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি প্রচার করা হবে।
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়া এবং তাদের উপদেষ্টাদের মধ্যকার সমঝোতা অলোচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ২৫ মার্চ সারাদিন অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা কোনো টেলিফোন করেননি, প্রচারিত হয়নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণাটিও। অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি যখন (২৫ মার্চ) রাত ১০টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেই, তখনও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তেমন কোনো টেলিফোন আমি পেয়েছি কি না। আমি তাকে জানিয়েছি, আমি কোনো টেলিফোন পাইনি।’ (ড. কামাল হোসেনের বিবরণী, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খণ্ড, পৃ-২১০-২৭৮)। এখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণীও উল্লেখযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন না আসার কথা জেনে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অনুরোধ করলেও শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হননি। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ রাত ১০টার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত্ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। তারা যাওয়ার পরপর ইপিআরের একজন হাবিলদার এসে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ইপিআরের সব বাঙালি সদস্য পিলখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এ কথা শুনেই তাজউদ্দীন আহমদ তাদের দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পথে কামাল হোসেন ধানমন্ডির চার নাম্বার রোডের একটি বাসায় ঢুকেছিলেন দেয়াল টপকে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে। (দেখুন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খণ্ড)। লক্ষণীয়, রাত ১০টার মধ্যে ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার তথ্যটি কিন্তু পিলখানা থেকে ট্রান্সমিটারযোগে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের দাবিকে অসত্য প্রমাণ করে। তাছাড়া দৈনিক ইত্তেফাকসহ ২৬ মার্চের দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিব ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছেন।
প্রধান নেতা শেখ মুজিবের দিক থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকায় এর পরের প্রতিটি পদক্ষেপ তাজউদ্দীন আহমদ নিয়েছিলেন একক সিদ্ধান্তে। বিভিন্ন পর্যায়ে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিয়ে ভারতীয়দের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে তার একটি ভাষণও প্রচার করেছিল ভারত সরকার। ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। সেদিন থেকে বৈদ্যনাথতলার নাম হয়েছে মুজিবনগর।
‘সঠিক’ ইতিহাসের মূল্যায়নে সময়োচিত ও দিক-নির্ধারণী হিসেবে প্রমাণিত হলেও ভারতে চলে যাওয়া থেকে সরকার গঠন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়াটা তাজউদ্দীন আহমদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বরং বাধাগ্রস্ত, সমালোচিত এবং প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একক সিদ্ধান্তে তিনি এমন এক সময়ে সরকার গঠন করেছিলেন, যখন আওয়ামী লীগের সব নেতাই ছিলেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং পলায়নরত। শেখ মুজিবের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অনেকেই। শেখ ফজলুল হক মনি, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি তুলেছিলেন। তাদের সঙ্গে উস্কানিদাতার ভূমিকায় নেমেছিলেন সেকালের ‘মস্কোপন্থী’রা—মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রমুখ। কিন্তু একদিকে তাজউদ্দীন আহমদের নিজের নিষ্ঠা, সততা ও নিখাদ দেশপ্রেম এবং অন্যদিকে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সমর্থন তাকে রক্ষা করেছিল। এ জন্যই তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সঠিক’ ইতিহাসে স্থান না পেলেও দেশপ্রেমিক নেতা তাজউদ্দীন আহমদেরও ছিল দীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস। তাকে শেখ মুজিবের চাটুকারিতা করতে দেখা যায়নি, বাকশালেও যোগ দেননি তিনি। এটাই অবশ্য তাজউদ্দীন আহমদকে ‘সঠিক’ ইতিহাসে স্থান না দেয়ার একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আওয়ামী লীগের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোভাব—যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কারও অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার উপাদান নেই।
কলকাতায় গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানানো এবং ওই সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের একটি অংশের ও তত্কালীন মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের ষড়যন্ত্র নস্যাত্ করে দেয়া ছিল মওলানা ভাসানীর বিশেষ অবদান। মুজিবনগর সরকার তাঁকে উপদেষ্টা পরিষদের সভাপতি বানিয়েছিল এবং সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত পরিষদের একমাত্র সভায় তিনি সভাপতিত্ব করেছিলেন। অর্থাত্ ১৯৫০-এর দশকে সূচিত স্বায়ত্তশাসনের প্রাথমিক আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত দীর্ঘ সংগ্রামের প্রতিটি পর্যায়ে মওলানা ভাসানীর ভূমিকা ছিল বলিষ্ঠ ও গৌরবোজ্জ্বল। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সঠিক’ ইতিহাসে তাঁর স্থান হয়নি।
মওলানা ভাসানীর পর দ্বিতীয় একজন প্রধান নেতা হিসেবে তাজউদ্দীন আহমদের কথা উল্লেখ করতে হবে। বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ইতিহাস প্রমাণ করেছে, তাজউদ্দীন আহমদ না থাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ এত সুসংগঠিত হতে এবং এত অল্প সময়ে বিজয় অর্জন করতে পারতো না। স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকার গঠন থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও ভারতের সহযোগিতা নিয়ে দেশকে স্বাধীন করা পর্যন্ত সমগ্র কর্মকাণ্ডে প্রধান এবং সফল নির্ধারকের ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। আওয়ামী লীগ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ রাখার এবং অন্য সব রাজনৈতিক দলের সহযোগিতা আদায়ের ক্ষেত্রেও তাজউদ্দীন আহমদের ভূমিকা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযোদ্ধাদেরও তিনিই সফলভাবে পরিচালনা করেছিলেন। এই ভূমিকার জন্যই যথাযথ গুরুত্বের সঙ্গে তাজউদ্দিন আহমদের অবদানের কথা স্মরণ করা দরকার। কারণ ‘সঠিক’ ইতিহাস হলো, স্বাধীনতা কারও ঘোষণা শুনে আসেনি। জনগণও কারও ঘোষণা শোনার জন্য অপেক্ষা করেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল যে অস্থায়ী ‘মুজিবনগর’ সরকার, সে সরকারও হঠাত্ করে গঠিত হয়নি।
১৯৭১ সালের মার্চের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কম-বেশি সবারই জানা রয়েছে। ৭ মার্চের ভাষণের একেবারে শেষ বাক্যে ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বলার পরও প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের সামরিক শাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন। ১৬ মার্চ থেকে ঢাকার প্রেসিডেন্ট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কোনো পর্যায়েও শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার প্রস্তাব উত্থাপন করেননি। তিনি বরং তার ৭ মার্চের চার দফা দাবি অনুযায়ী সামরিক শাসন প্রত্যাহার করে আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, সংবিধান প্রণয়নের আগে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হলে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার সৃষ্টি হবে। এই পর্যায়ে শেখ মুজিবের প্রস্তাবে ১৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে মুজিব-ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাদের মধ্যে বৈঠক শুরু হয়েছিল। আওয়ামী লীগের পক্ষে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হোসেন এবং ইয়াহিয়া খানের পক্ষে লে. জেনারেল শরীফ উদ্দিন পীরজাদা, বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস ও কর্নেল হাসান এসব বৈঠকে অংশ নিয়েছেন। প্রথম বৈঠকে আইনগত শূন্যতা ও জটিলতার প্রশ্নে পাল্টা যুক্তি দেখিয়ে ড. কামাল হোসেন বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান এমন একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা আদেশ জারি করতে পারেন, যা সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংবিধান গৃহীত হওয়ার মধ্যবর্তী সময়কে আইনসম্মত করবে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ১৭ মার্চের একান্ত বৈঠকে নতুন এক প্রস্তাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন, ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যরা প্রথমে পৃথক পৃথক অধিবেশনে মিলিত হয়ে দুই অঞ্চলের জন্য দু’টি সংবিধান রচনা করবেন এবং পরে এক যৌথ অধিবেশনে ওই দুটির ভিত্তিতে পাকিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করা হবে। প্রেসিডেন্ট এ ব্যাপারে একটি ঘোষণায় স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়েছিলেন, যে ঘোষণাকে সামরিক আইন প্রত্যাহার ও নতুন সংবিধান গ্রহণের মধ্যবর্তী সময়ের জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সাংবিধানিক ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। দু’পক্ষের ১৭ মার্চের বৈঠকে এই মর্মে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া তৈরি করার আগে উভয় পক্ষের আইন উপদেষ্টারা শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক যৌথ বৈঠকে মিলিত হবেন। ১৯ মার্চ আলোচনায় ‘অগ্রগতি’ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়েছিল। শেখ মুজিব নিজেও বলেছিলেন, কোনো ‘অগ্রগতি না হলে’ তিনি কি শুধু শুধু আলোচনা চালাচ্ছেন?
২০ মার্চ শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খান নিজেদের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণায় তিনটি মৌলিক বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করা হবে—(১) সামরিক আইন প্রত্যাহার, (২) নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর
এবং (৩) পূর্বাঞ্চলীয় অংশের (‘পূর্ব পাকিস্তান’) জন্য ব্যাপকভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের ব্যবস্থা। উভয় পক্ষ এ ব্যাপারে বিশিষ্ট আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ এ কে ব্রোহীর অভিমত নিতে সম্মত হন। পরদিনই এ কে ব্রোহী এক লিখিত অভিমতে বলেছিলেন, প্রেসিডেন্ট অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা হিসেবে ঘোষণা জারি করলে আইনগত শূন্যতার সৃষ্টি হবে না এবং আইনসম্মতভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা যাবে।
২১ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া আওয়ামী লীগের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এই খসড়ায় ‘পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের’ জাতীয় পরিষদ সদস্যদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাব ছিল। খসড়ার অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়, প্রদেশগুলোতে মন্ত্রিসভা শপথ নেয়ার দিন থেকে সামরিক আইন প্রত্যাহৃত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। আওয়ামী লীগ খসড়া ঘোষণাটিকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে চিহ্নিত করে দু’টি প্রশ্নে দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার তাগিদ দিয়েছিল—(১) প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি অবিলম্বে প্রচার করতে হবে; এবং (২) যেহেতু মন্ত্রিসভা গঠনে বিলম্ব ঘটতে পারে, সেহেতু প্রদেশগুলোতে নতুন গভর্নর নিযুক্তি দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে অথবা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা প্রচারিত হওয়ার সাতদিনের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।
২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউসে আগের দিন ঢাকায় আগত জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে শেখ মুজিবের সাক্ষাত্ হয়েছিল। শেখ মুজিব তার প্রস্তাব মেনে নেয়ার জন্য ভুট্টোকে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রের আগে প্রদেশগুলোতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের প্রশ্নে ভুট্টো বলেছিলেন, তেমন কোনো আয়োজন বা সমঝোতা অনুমোদনের জন্য হলেও প্রথমে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতারা ২২ মার্চ সারাদিন সারারাত প্রেসিডেন্টের ঘোষণা চূড়ান্ত করার কাজে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছিলেন। ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ প্রেসিডেন্টের প্রস্তাবিত ঘোষণার খসড়া পৌঁছে দিয়েছিল। সেদিন সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত উপদেষ্টাদের বৈঠক শেষ হয়েছিল কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়া। ২৪ মার্চের সর্বশেষ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেশের নাম ‘কনফেডারেশন অব পাকিস্তান’ রাখার নতুন এক প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। ইয়াহিয়ার পক্ষ এতে তীব্র আপত্তি জানায়। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টারা বিষয়টি শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের ওপর ছেড়ে দেয়ার প্রস্তাব তোলেন এবং ঘোষণার অন্য দিকগুলো নিয়ে আলোচনা চূড়ান্ত করার জন্য চাপ দেন। কিন্তু সান্ধ্য বৈঠকে আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদের জানানো হয়, ইয়াহিয়ার প্রতিনিধিরা আগে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে পরে আওয়ামী লীগকে অবহিত করবেন। জেনারেল পীরজাদা জানিয়েছিলেন, তিনি পরদিন অর্থাত্ ২৫ মার্চ ‘কোনো এক সময়’ ড. কামাল হোসেনকে টেলিফোনে জানাবেন, কখন তারা আবার বসবেন এবং কবে প্রেসিডেন্টের ঘোষণাটি প্রচার করা হবে।
এভাবেই মুজিব-ইয়াহিয়া এবং তাদের উপদেষ্টাদের মধ্যকার সমঝোতা অলোচনার সমাপ্তি ঘটেছিল। শেখ মুজিবসহ আওয়ামী লীগ নেতারা ২৫ মার্চ সারাদিন অপেক্ষায় কাটিয়েছিলেন। কিন্তু জেনারেল পীরজাদা কোনো টেলিফোন করেননি, প্রচারিত হয়নি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সেই ঘোষণাটিও। অভিজ্ঞতা বর্ণনাকালে ড. কামাল হোসেন লিখেছেন, ‘আমি যখন (২৫ মার্চ) রাত ১০টা ৩০ মিনিটে শেখ মুজিবের কাছ থেকে শেষবারের মতো বিদায় নেই, তখনও তিনি জানতে চেয়েছিলেন, তেমন কোনো টেলিফোন আমি পেয়েছি কি না। আমি তাকে জানিয়েছি, আমি কোনো টেলিফোন পাইনি।’ (ড. কামাল হোসেনের বিবরণী, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খণ্ড, পৃ-২১০-২৭৮)। এখানে ড. কামাল হোসেনের সঙ্গী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বিবরণীও উল্লেখযোগ্য। তিনি জানিয়েছেন, শেখ মুজিব তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলেন। জেনারেল পীরজাদার টেলিফোন না আসার কথা জেনে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন। কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম অনুরোধ করলেও শেখ মুজিব তাদের সঙ্গে যেতে রাজি হননি। এর পরের ঘটনাক্রম জানাতে গিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জানিয়েছেন, ২৫ মার্চ রাত ১০টার পর শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাত্ শেষে তিনি এবং ড. কামাল হোসেন গিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের ধানমন্ডির বাসভবনে। তারা যাওয়ার পরপর ইপিআরের একজন হাবিলদার এসে জানিয়েছিলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কায় ইপিআরের সব বাঙালি সদস্য পিলখানা থেকে বেরিয়ে পড়েছে। এ কথা শুনেই তাজউদ্দীন আহমদ তাদের দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন। পথে কামাল হোসেন ধানমন্ডির চার নাম্বার রোডের একটি বাসায় ঢুকেছিলেন দেয়াল টপকে। অন্যদিকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে তাজউদ্দীন আহমদ পা বাড়িয়েছিলেন ভারতের দিকে। (দেখুন ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’, ১৫শ খণ্ড)। লক্ষণীয়, রাত ১০টার মধ্যে ইপিআরের বাঙালি সদস্যদের পালিয়ে যাওয়ার তথ্যটি কিন্তু পিলখানা থেকে ট্রান্সমিটারযোগে শেখ মুজিবের স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচারের দাবিকে অসত্য প্রমাণ করে। তাছাড়া দৈনিক ইত্তেফাকসহ ২৬ মার্চের দেশি-বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছিল, শেখ মুজিব ২৭ মার্চ হরতালের ডাক দিয়েছেন।
প্রধান নেতা শেখ মুজিবের দিক থেকে কোনো নির্দেশনা না থাকায় এর পরের প্রতিটি পদক্ষেপ তাজউদ্দীন আহমদ নিয়েছিলেন একক সিদ্ধান্তে। বিভিন্ন পর্যায়ে রীতিমতো ইন্টারভিউ দিয়ে ভারতীয়দের কাছে তাকে প্রমাণ করতে হয়েছিল যে, তিনিই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ। পরিচিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর তাকে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ দেয়া হয়েছিল (৩ এপ্রিল, ১৯৭১)। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পরামর্শে তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং নিজেকে প্রধানমন্ত্রী করে ১০ এপ্রিল অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার গঠন করেছিলেন। জাতির উদ্দেশে তার একটি ভাষণও প্রচার করেছিল ভারত সরকার। ১০ এপ্রিল গঠিত সরকারই ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় এসে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী সরকার হিসেবে শপথবাক্য পাঠ করেছিল। সেদিন থেকে বৈদ্যনাথতলার নাম হয়েছে মুজিবনগর।
‘সঠিক’ ইতিহাসের মূল্যায়নে সময়োচিত ও দিক-নির্ধারণী হিসেবে প্রমাণিত হলেও ভারতে চলে যাওয়া থেকে সরকার গঠন পর্যন্ত প্রতিটি বিষয়ে একক সিদ্ধান্ত নেয়াটা তাজউদ্দীন আহমদের জন্য মোটেও সহজ ছিল না। প্রতি পদক্ষেপে তাকে বরং বাধাগ্রস্ত, সমালোচিত এবং প্রচণ্ড বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। একক সিদ্ধান্তে তিনি এমন এক সময়ে সরকার গঠন করেছিলেন, যখন আওয়ামী লীগের সব নেতাই ছিলেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় এবং পলায়নরত। শেখ মুজিবের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় তাজউদ্দীন আহমদের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন অনেকেই। শেখ ফজলুল হক মনি, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ কয়েকজন নেতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দাবি তুলেছিলেন। তাদের সঙ্গে উস্কানিদাতার ভূমিকায় নেমেছিলেন সেকালের ‘মস্কোপন্থী’রা—মণি সিংহ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রমুখ। কিন্তু একদিকে তাজউদ্দীন আহমদের নিজের নিষ্ঠা, সততা ও নিখাদ দেশপ্রেম এবং অন্যদিকে জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর সমর্থন তাকে রক্ষা করেছিল। এ জন্যই তাজউদ্দীন আহমদের পক্ষে সাফল্যের সঙ্গে সরকার পরিচালনা করা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব হয়েছিল।
আওয়ামী লীগ সরকারের ‘সঠিক’ ইতিহাসে স্থান না পেলেও দেশপ্রেমিক নেতা তাজউদ্দীন আহমদেরও ছিল দীর্ঘ ও গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিহাস। তাকে শেখ মুজিবের চাটুকারিতা করতে দেখা যায়নি, বাকশালেও যোগ দেননি তিনি। এটাই অবশ্য তাজউদ্দীন আহমদকে ‘সঠিক’ ইতিহাসে স্থান না দেয়ার একমাত্র কারণ নয়। আসল কারণ আওয়ামী লীগের ব্যক্তিকেন্দ্রিক মনোভাব—যেখানে শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া অন্য কারও অবদানের স্বীকৃতি দেয়ার উপাদান নেই।
সূত্র : আমার দেশ