প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, September 16, 2011

১লা আশ্বিন বাংলা কবিতা দিবস || সাযযাদ কাদির

বাংলায় সারা বছরই কবিতা। সারা জীবনই কবিতা জড়িয়ে থাকে বাঙালিদের। তাই প্রতিটি দিনই কবিতার দিন। তবুও একটি বিশেষ দিনের থাকে আলাদা এক তাত্পর্য। সেদিনের আয়োজন, অনুষ্ঠান, আনন্দ — সব কিছুর থাকে এক বিশেষ মহিমা। হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাস-ঐতিহ্য, কীর্তি-গৌরব বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে তাই বাংলা কবিতা দিবস এত জরুরি। কানুপা, সরহপা, বিদ্যাপতি, চণ্ডীদাস, আলাওল, ভারতচন্দ্র, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, জসীম উদ্দীন, শামসুর রাহমান — অসংখ্য কবির প্রাণবন্দনায় সঞ্জীবিত বাংলা কবিতা বিশ্বসংস্কৃতিতে রেখে চলেছে কালজয়ী অবদান। সে অবদানের প্রতি বাংলাভাষী সকলকে সচেতন করে তুলতে আজ ১লা আশ্বিন ১৬ই সেপটেম্বরকে বাংলা কবিতা দিবস ঘোষণা করা হয়েছে। দিনটিকে নানা আয়োজন ও অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে অর্থপূর্ণ করে তুলতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে বসবাসকারী বাংলাভাষীদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলা ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র। এ দিনে তারা বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, বিভিন্ন সংগঠনকেও নিজস্ব কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটি পালনের আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলা কবিতার জন্য বিশেষ একটি দিবস পালনের কোনও প্রয়োজন আছে কি — এ প্রশ্ন অনেকের। আমাদের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত বেশ কিছু দিবস তো আমরা পালন করি। সবার উপরে আছে মুখের ভাষার জন্য বুকের রক্ত ঢেলে দেয়া একুশে ফেব্রুয়ারি। এ দিবস আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জীবনে এক প্রধান উত্সব। এ দিবসটি এখন ব্যাপকতর মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। আমরা একুশে ফেব্রুয়ারিকে পালন করি শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। আমাদের আরেক সাংস্কৃতিক উত্সব ১লা বৈশাখ। সেদিন নববর্ষ দিবস পালন করি আমরা এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল ও দেশ। সে উত্সব পরিণত হয়েছে চারু ও কারু পণ্যের মেলায়, মিছিলে ও পানতা-ইলিশে। কোথাও-কোথাও আছে হালখাতার আপ্যায়ন। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে ২৫শে বৈশাখ ও নজরুলকে নিয়ে ১১ই জ্যৈষ্ঠ পালন আমাদের আরও দু’টি সাংস্কৃতিক উত্সব আয়োজিত হয় ব্যাপক পরিসরে। দু’টি দিবসেই বিশেষ প্রাধান্য থাকে সরকার ও মিডিয়ার। তাতে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা ও প্রাতিষ্ঠানিকতা ছাপিয়ে ওঠে সব কিছুকে।
এক সময় সুকান্তকেও স্মরণ করা হতো রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের সঙ্গে। এখন বিশেষ-বিশেষ সংগঠনের আয়োজনে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে সে স্মরণ। এছাড়া আছে মধুমেলা (২৫শে জানুয়ারি) ও জসীমমেলা (১লা জানুয়ারি)। এ দু’টি দিবস আঞ্চলিকতা ও মেলার সমারোহে কবিতার গৌরব হারিয়েছে অনেকখানি। এসবের চেয়ে অনেক আড়ম্বর দেখা যায় যায়যায়দিন-এর সূত্রে জনপ্রিয় হয়ে ওঠা ভালোবাসা, মা, বাবা, বন্ধু প্রভৃতি দিবস। মিডিয়া, কার্ড ও অন্যান্য উপহার-পণ্য ব্যবসায়ী, বিপণন সংস্থা, বিনোদন ও বিপণি কেন্দ্রগুলোর প্রচার-প্রচারণায় এ দিবসগুলি ইদানীং বিশেষ প্রাধান্য পাচ্ছে আমাদের সাংস্কৃতিক আয়োজনে। বিশেষ করে ভালোবাসা দিবস (১৪ ফেব্রুয়ারি) দিনে-দিনে যেন ছাড়িয়ে যাচ্ছে অন্য সব দিবসের মহিমাকে। এ অবস্থায় বাংলা কবিতাকে স্মরণের বিশেষ তাত্পর্য রয়েছে আমাদের সমাজে। আমাদের সুখ দুঃখ হাসি কান্না প্রেম প্রীতি বিরহ মিলন পরিপূর্ণ সংসার ও জীবনে কবিতা দিয়েছে বিশেষ উপলব্ধি, চেতনা ও দিশা। হাজার বছর আগের কবিতায় জেনেছি হাঁড়িতে ভাত না থাকা অসচ্ছল জীবনের কথা, — শুনেছি ওদনের (ভাতের) তরে শিশুর কান্না, দুধে-ভাতে সন্তানের বেঁচে থাকার পরম প্রার্থনা। এত দুর্গতি, এত দুর্বিপাক — তারপরও বাংলা কবিতা ঘোষণা করেছে, সবার উপরে মানুষ সত্য। আমাদের নিত্যদিনের আশায় বেঁচে থাকা জীবনে কবিতা আসে হঠাত্ আলোর ঝলকানি হয়ে। বরণীয় সে, তাই আয়োজন করি স্মরণীয় করে রাখার।
হাজার বছর আগে বাংলা কবিতার উদ্ভব ও বিকাশের সূচনা। তখন তার রূপ ছিল পদ নামে চিহ্নিত, আর তার প্রেরণা ছিল সহজিয়া ধর্মদর্শন ও সাধনতত্ত্ব এবং সে অনুযায়ী আচরণীয় নিয়ম অর্থাত্ ‘চর্যা’। প্রাচীন বাংলা ভাষায় রচিত বৌদ্ধ সহজিয়াদের ধর্ম ও সাধনা সম্পর্কিত গীতিকবিতা এই চর্যাপদ। চর্যাকারেরা পরিচিত ছিলেন সিদ্ধাচার্য হিসেবে। নিজেদের দর্শন ও তত্ত্ব গানে-গানে প্রচার করতে গিয়ে “তাঁদের আশ্রয় করতে হয়েছে মানবচেতনার প্রকাশভঙ্গির আদি সম্বল উপমা-অলঙ্কারকে। চর্যাগীতিতে তাই যেমন ধর্মদর্শন আছে, সাধনতত্ত্ব আছে, তেমনি আছে নদনদীর কথা, নদী পারাপারের কথা, সাঁকো বাঁধার কথা, শিকারের বর্ণনা, শবর-শবরীর প্রণয়োন্মত্ততার বর্ণনা, অসামাজিক প্রণয়কাহিনীর বর্ণনা প্রভৃতি। চর্যাগীতিতে তাই বিষয়বস্তু আছে, প্রকাশরীতি আছে, আর আছে গভীরভাবে উপলব্ধির জন্য এক একটি সাধকহৃদয়।...” সেই থেকে বাংলা কবিতা এখনও ভাব, ভাষা, নির্মাণে অনন্য হয়ে আছে হৃদয়ের কথা বলার ব্যাকুলতায়। এ কবিতা মনের কথা বলে মুখের ভাষায়, বানিয়ে-বানিয়ে কিছু বলে না, অমার্জিত হয় না কখনও। সেই সঙ্গে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষাকে সবসময় জানায় স্বাগত। এ জন্যই বৈচিত্র্যে ও বৈভবে বাংলা কবিতা বিপুল, সৃষ্টির সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ।
এখন বলতে হয় বিশেষ করে কেন ১লা আশ্বিন দিনটিকে বাংলা কবিতা দিবস হিসেবে বেছে নেয়া, সেই কথা। বাংলা কবিতাকে নিয়ে উত্সবের জন্য বিশেষ একটি দিন হিসেবে মধ্য শরতের এই সময়টাকে বেছে নেয়ার উপলক্ষ যদিও নেই তেমন কিছু, তবে বর্ষা-বসন্তের মতো শরত্-ও বাংলার, বাঙালির ও বাংলা কবিতার প্রিয় ঋতু। বর্ষাকে রানী ও বসন্তকে রাজা বলা হলে শরেক বলতে হয় প্রাণসখা। “শরত্” প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, “শরতের রঙটি প্রাণের রঙ। অর্থাত্ তাহা কাঁচা, বড় নরম। রৌদ্রটি কাঁচা সোনা, সবুজটি কচি, নীলটি তাজা। এইজন্যে শরতে নাড়া দেয় আমাদের প্রাণকে, যেমন বর্ষায় নাড়া দেয় আমাদের ভিতর-মহলের হৃদয়কে, যেমন বসন্তে নাড়া দেয় আমাদের বাহির মহলের যৌবনকে।” প্রাণের রঙে রাঙা শরত্ তাই আমাদের প্রিয় প্রাণসখা। এ ঋতুর মেঘমুক্ত সোনারোদে উজ্জ্বল দিনে তাই প্রসন্ন আকাশ হাসে বন্ধুর মতো। কবির মন-প্রাণ হয়ে ওঠে সৃষ্টিচঞ্চল — “শরত-আলোর কমলবনে / বাহির হয়ে বিহার করে / যে ছিল মোর মনে-মনে”। সেই সঙ্গে “মেঘমুক্ত শরতের দূরে চাওয়া আকাশেতে ভারমুক্ত চিরপথিকের বাঁশিতে বেজেছে ধ্বনি।” প্রায় চার শ’ বছর আগে আলাওল-ও লিখেছেন — “আইল শরত্ ঋতু নির্মল আকাশ। দোলায় চামর কাশ কুসুম বিকাশ\” আসলে এ এক উত্সবের সময়, আমাদের মিলিত হওয়ার — স্মরণ করার সময়, আমাদের গর্বিত ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রাণিত হওয়ার সময়। তাই আসুন, ১লা আশ্বিনকে আমরা সফল ও সার্থক করে তুলি আবহমান বাংলা কবিতার চিরউজ্জ্বল মহিমায়। 

সূত্র :  আমার দেশ

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ