তাঁরা তিনজন সাহিত্যিক। পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। সময় ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতবর্ষ। আত্মসম্মান, জ্ঞান ও নীতিবোধের কারণে চাকরিতে সৃষ্টি হয়েছে দ্বন্দ্ব, পাড়ি দিতে হয়েছে বন্ধুর এক পথ। যা উঠে এসেছে এই লেখায়
উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতকে হিরণ্ময় দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন তিন মহারথী—বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। পেশায় তাঁরা সবাই ছিলেন সেই সময়েরই ইংরেজি শিক্ষিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাগেদবীর সেবার পাশাপাশি ইংরেজ প্রভুর অধীনে কলম পিষেছিলেন দীর্ঘদিন তাঁরা। অবশ্য প্রায় সময়ই এই সেবা ‘দাস্য সুখে হাস্য মুখে’ হয়ে ওঠেনি। আত্মসম্মান, জ্ঞান ও নীতিবোধের কারণে সব সময় উপরিওয়ালার সব সিদ্ধান্ত চোখ বুজে মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। ফলে বিলম্বিত পদোন্নতি এবং দ্রুত বদলি তাঁদের কপালে ছিল বাঁধাধরা। উপরি ছিল হাড়ভাঙা খাটুনি। এ সত্ত্বেও তাঁদের মননশীলতার এবং সৃজনীশক্তির স্রোত কখনো রুদ্ধ হয়নি। এই তিন খ্যাতনামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিজীবনের খতিয়ানই এর বড় প্রমাণ।
১৮৫৮ থেকে ১৮৯১—প্রায় ৩৩ বছর সরকারি চাকরি করেছিলেন বঙ্কিম। দীর্ঘ ২৬ বছর অপেক্ষার পর অবসর নেওয়ার মাত্র সাত বছর আগে প্রথম শ্রেণীর ডেপুটির মর্যাদা পেয়েছিলেন তিনি। ‘চাকরি আমার জীবনের অভিশাপ’ বন্ধু শ্রীশ মজুমদারের কাছে লেখা এই চিঠিতে তাঁর হতাশা লুকিয়ে থাকেনি। দীর্ঘ কর্মজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাডারের ওপরে অন্য কোনো প্রমোশনের সুযোগ পাননি তিনি, যদিও উপরিওয়ালার কাছ থেকে তাঁর কর্মদক্ষতা, সততা ও সাফল্যের প্রশংসাপূর্ণ প্রতিবেদনের ঘাটতি ছিল না। চাকরিজীবনে মাত্র দুবার তিনি কিছুটা চোখে পড়ার মতো পোস্টিং পেয়েছিলেন, প্রথমবার ১৮৬৭ সালের আমলাদের জন্য গঠিত বেতন কমিশনে নিযুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। আর চাকরিজীবনের প্রায় প্রান্তে ১৮৮১ সালে তাঁকে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সহকারী সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই ওই পদটি উঠিয়ে এক ঘণ্টার নোটিশে তাঁকে বদলি করা হয়। পদটি আকস্মিকভাবে উঠিয়ে দেওয়া এবং যেভাবে তাঁকে সরানো হয়, তাতে পত্রপত্রিকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।
বঙ্কিম জীবনীকারদের মতে, বদলি ও নিয়োগ নিয়ে তাঁকে বারবার নানা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৮৮২ থেকে ১৮৯২-এ অবসর নেওয়া পর্যন্ত সোয়া আট বছরে প্রায় নয়বার তাঁকে বদলি হতে হয়েছিল। ‘এত ঘন ঘন বদলি কোনো কর্মকর্তার প্রতি সরকারের সহানুভূতি বা আস্থার পরিচয় বহন করে না। মনে হয়, তিতিবিরক্ত-হতাশ বঙ্কিম তাই স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছিলেন।’ (লাডলীমোহন রায় চৌধুরী)
বঙ্কিমের চাকরিজীবনের শুরুটা ছিল উজ্জ্বল। তাঁর কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা এবং কর্তব্যনিষ্ঠার প্রশংসা করে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন একাধিকবার। কোনো কোনো রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিনি যে রকম কর্মদক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন, তা একমাত্র ইউরোপীয় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষেই সম্ভব। ১৮৮২-৮৩ সালের প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টের একটা অংশে লেখা:
১৮৮১-৮৩ সালে বঙ্কিম প্রশংসাসূচক রিপোর্টের ফাঁকে ফাঁকে কিছু তির্যক মন্তব্যের সম্মুখীন হন। ১৮৮১-৮২-তে বর্ধমান বিভাগের প্রশাসনিক রিপোর্টে জেলা প্রশাসক বঙ্কিমের সাহিত্যপ্রতিভার স্বীকৃতি জানিয়েও ‘তার সারবত্তাহীন এবং অগোছালো কাজের ধারা ও বাগাড়ম্বর সম্পর্কে’ কটাক্ষ করেন।
১৮৮৩-৮৪ সালে জেলা কানেক্টর আরও কট্টর মন্তব্য লেখেন। তাঁর মতে, ‘বঙ্কিমকে যথাযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তাঁকে সব সময়ে নজরে রাখা দরকার এবং তিনি নিশ্চিত খামখেয়ালি ধরনের মানুষ।’ তবে সবচেয়ে নির্দয় মন্তব্য চোখে পড়ে ১৮৮৫-৮৬ সালের রিপোর্টে, ‘তিনি একজন মামুলি ধরনের অফিসার (অ্যান অ্যাভারেজ অফিসার) ছাড়া আর কিছু নন এবং তাঁর অফিসের কাজে আরও আগ্রহ দেখানো উচিত।’
বঙ্কিম তাঁর চাকরিজীবনে বহু মামলার বিচার করেছেন। বিচারক হিসেবে খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারেননি তিনি। তাঁর বিচারবিভ্রাটের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত সমসময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিতও হয়েছিল। তবে বিচারকার্যে তাঁর সততা সম্পর্কে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারকার্যে এমন কিছু অদ্ভুত খুঁত লক্ষ করা গিয়েছে, যা তাঁর মতো একজন বিদগ্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে কিছুতেই আশা করা যায় না।’ গ্যারেট লিখেছেন, ‘মামলার বিচারকাজে তিনি অনেক সময় নানা রকম অস্বাভাবিক মতামত করতে অভ্যস্ত এবং তাঁর রায়গুলো কিছুটা বাগাড়ম্বরপূর্ণ (ভারবোস) (লাডলীমোহন রায় চৌধুরী)।
চাকরির ক্ষেত্রে তাঁকে হতে হয়েছে অনেক বৈষম্যের মুখোমুখি। বাংলাদেশের কৃষক ও মুচিরাম গুড়ের জীবনীতে ইংরেজের বিচারব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করেছেন। তাঁর লেখায় কোনো কোনো জায়গায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর ঘোর মতবিরোধের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইলবার্ট বিল নিয়েও তাঁর সমালোচনা অনেক সাহেবের মধ্যে রোষের জন্ম দিয়েছিল। অনেকে মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি সকারের সহানুভূতিহীনতার মূল কারণ তাঁর উপন্যাস আনন্দমঠ। যদিও এই উপন্যাসের দরুন তাঁকে সরাসরিভাবে কোনো অভিযোগ সরকার করেছিল বলে জানা নেই, কিন্তু উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তাঁর চাকরির চরিত্রলিপিতে তিক্ত মন্তব্যের আবির্ভাব হতে থাকে।
১৮৮২ সালে উপন্যাস প্রকাশের সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিদ্বেষের কিছু কিছু নমুনা ছিল বলে অনেকের ধারণা। বিপদের আঁচ পেয়ে বঙ্কিম পরবর্তী সংস্করণে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটান। সরকারের সন্দেহ নিরসনের জন্য আনন্দমঠ-এর বিজ্ঞাপনে এর বিষয়বস্তুর আভাস দিয়ে জানালেন, ‘রাজনীতি নয়, ধর্মকথা বলাই লেখকের উদ্দেশ্য।’ সশস্ত্র বিপ্লব অনেক সময়ই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী ‘ইংরেজরা বাংলাদেশকে অরাজকতা থেকে উদ্ধার করিয়াছে—এই সকল কথা এই গ্রন্থে বুঝান গেল।’ ইংরেজের ক্রোধ এড়াতে, ‘ইংরেজ’, ‘গোরা’ ‘ব্রিটিশ’ শব্দগুলো ছেঁটে দিলেন। ‘মুসলমান’ ‘নেড়ে’ ‘যবন’ প্রভৃতি শব্দ আমদানি করে বোঝাতে চাইলেন যে ‘সন্তানদের’ বিদ্রোহ ইংরেজের বিরুদ্ধে নয়। কারণ ‘ইংরেজমিত্র রাজা। তাঁদের রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে।’ বিদ্রোহী ঝাঁসির রানিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। কিন্তু আনন্দমঠ-এর প্রতি ইংরেজের মনোভাব জানতে পেরে তিনি আর এগোননি। সন্দেহ নেই, চাকরি বঙ্কিমের শিল্পীসত্তার টুঁটি চেপে ধরেছিল নিষ্ঠুরভাবে।
চাকরিজীবনের বৈষম্যের শিকার হয়ে ব্যক্তিজীবনে বঙ্কিম ছিলেন নিখাদ রাজভক্ত। ‘লর্ড রিপনের উৎসবের জমা খরচ’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন—‘রাজভক্তি বড়ো বাঞ্ছনীয়।’ ইংরেজ চরিত্রে তাঁর আস্থা কখনোই টোল খায়নি। সরকারও তাঁকে রায়বাহাদুর ও সিআইই খেতাব দিতে কার্পণ্য করেনি। তবে এই খেতাব তিনি পেয়েছিলেন ‘রাজ সরকারের চাকরি অপেক্ষা বিদ্ব্যৎমণ্ডলীতে তাঁর খ্যাতির জন্য’, (জীবন মুখোপাধ্যায়) প্রাদেশিক সরকারের একজন প্রখ্যাত কর্মকর্তা হিসেবে নয়।
উনিশ শতকের খ্যাতিসম্পন্ন কবি নবীনচন্দ্র সেন পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৮৬৮ থেকে ১৯০৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন স্থানে ডেপুটিগিরি করেছেন। ডেপুটি আমলাতন্ত্রের নিম্নতম সপ্তম ধাপ থেকে প্রথম ধাপে পৌঁছাতে তাঁর মতো করিৎকর্মা অফিসারের দীর্ঘ ৩৬টি বছর লেগেছিল। এই দীর্ঘ কর্মজীবনকে তিনি আত্মজীবনী আমার জীবন-এ উল্লেখ করেছেন। ‘ঘোরতর বিপদসঙ্কুল চাকরিজীবন’ হিসেবে।
চাকরিজীবনে তাঁর মনে কোনো শঙ্কা বা বেদনাবোধ হতে দেখা যায়নি। অবসর নেওয়ার প্রসঙ্গে আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘৩৬ বছরের চাকরি হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া হাসিতে হাসিতে কোর্ট হইতে বহির্গত হইলাম এবং গৃহে যাইতে যাইতে আকাশের দিকে চাহিয়া বলিলাম—দয়াময়, তোমার দয়ায় এই ঘোরতর বিপদসঙ্কুল চাকরিজীবন শেষ করিলাম...বাকি জীবন আমাকে শান্তি দিও...।’
বঙ্কিমের মতো নবীনচন্দ্রও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায়ই নানা মতভেদ এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু বিরোধে জড়িয়ে পড়তেন। ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রামে চা-শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবিধানে সক্রিয় ভূমিকা ইংরেজ শাসকদের অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে ওঠে।
মাদারীপুরে তাঁর একটি রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ তীর্যক মন্তব্য করে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করে তোলেন। শুদ্ধ নবীনচন্দ্র লিখেছেন—‘আমি ষড়যন্ত্রে পড়িয়া এই রূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলাম যে আমার চাকরি যদি পণ্যদ্রব্য হইত, তবে সিকি পয়সা দিয়াও তাহা কেহ কিনিত না।’ হাইকোর্ট তাঁর রায় বহাল রাখায় তিনি সেই যাত্রায় রক্ষা পান। মাদারীপুরে একের পর এক তিনি বিভাগীয় তদন্তের মুখে পড়েছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের সম্পর্কে কিছু অতিশয়োক্তি থাকলেও চাকরিজীবনের বিভ্রাট এবং বদলির বিপত্তির নানা বর্ণনা মূলত তথ্যনির্ভর ও বাস্তবানুগ বলেই গবেষকদের ধারণা। বেশ জাঁক করে নিজেই লিখেছেন, ‘সার্ভিসের মধ্যে আমি একজন বিষম সাহসী (ডেয়ার ডেভিল) প্রকৃতির লোক বলিয়া পরিচিত।’ অথচ আমার জীবন-এ এই সাহসী পুরুষকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘দয়াময়, তুমি আমাকে এক মহাবিপদ হইতে উদ্ধার করিয়া আবার এই বিপদে ফেলিলে।’ মোকদ্দমার বিচারবিভ্রাটে আতঙ্কিত হাকিম নবীনচন্দ্রকে নিয়মিত দয়াময়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ‘নিঃসহায় হইয়া সেই বিপদভঞ্জনকে ডাকিতে লাগিলাম’—একদম করুণ আর্তি ঘুরেফিরে তাঁর লেখায় উঁকি দিয়েছে বারবার।
তাঁর চাকরিজীবনে বদলি-বিপর্যয়ের উদাহরণ প্রচুর। মাত্র সাত মাসের মাথায় পুরী থেকে মাদারীপুরে বদলি হওয়ায় বড় দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর চাকরিজীবনের বদলিবিভ্রাটের একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। ১৮৯৮ সালে চট্টগ্রামে নবীনচন্দ্র তাঁর অফিসে কেরানির পদে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিয়োগ দেন। প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহের ইচ্ছা প্রকাশ করে আবদুল করিম স্থানীয় জ্যোতি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। এই বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে নানা প্রশাসনিক বিতর্কের সৃষ্টি হওয়ার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর আমার জীবন-এ। বিতর্ক বহুদূর গড়ায় এবং এর জের ধরে আবদুল করিম চাকরিচ্যুত হন। নবীনচন্দ্র কুমিল্লায় বদলি হয়ে তাঁর সাধের চট্টগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন।
তাঁর পলাশীর যুদ্ধ কাব্য বঙ্কিমের আনন্দমঠ-এর মতো দেশবাসীকে উদ্বেলিত এবং শাসকমহলের অংশবিশেষকে বিচলিত করেছিল। সন্দেহ নেই, নবীনচন্দ্র তাঁর এই কাব্যে ইংরেজের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় সিরাজকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরেননি।
সিরাজ ও মীরজাফর উভয়েই তাঁর চোখে অগ্রহণীয়। মোহনলাল এই কাব্যের নায়ক। ক্লাইভকেও কোনো দোষারোপ বা খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত করেননি নবীনচন্দ্র। বরং সিরাজের পরাজয়ের পর মোহনলালের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘ভারতের নহে আজি অসুখের দিন।’ শুধু এ-ই নয়, আরও বলেছেন, ‘এ সুখের দিনে প্রফুল্ল অন্তরে গাও মিলি সবে ব্রিটিশের ভয়ে।’ রাজশক্তির ভয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নবীন পলাশীর যুদ্ধ-এর প্রথম সংস্করণের অনেক পাঠ বদল করেছেন। প্রথম সংস্করণ থেকে ‘ইংরেজের রক্তে আজি করিব তর্পণ’ বাদ দেওয়া হয়। বাদ দেওয়া হয় ‘আসিবে ভারতে চির বিষাদ-রজনী!...’-এর মতো পঙিক্ত। ‘সেই শোণিতের স্রোতে হইল তখন বঙ্গ-স্বাধীনতা-শেষ আশা বিসর্জন’-এর মতো বিপজ্জনক পঙিক্ত ছেঁটে ফেলা হয়। নবীনচন্দ্রের কবিসত্তা ডেপুটি লীলার পায়ে এমনিভাবেই মাথা নত করেছিল।
পাশাপাশি সিরাজ চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক লেপনের জন্য তিনি সম সময়ই ধিক্কৃত হয়েছেন তীব্র ভাষায়। এত কিছু করার পরও শাসক কর্তৃপক্ষের একটি অংশ তাঁর ওপর রুষ্ট হয়েছিল। দীনবন্ধু ও বঙ্কিমের মতো রাজরোষ আঘাত হেনেছিল তাঁকে গুপ্ত বা প্রকাশ্যে। শোনা যায়, এই বইয়ের কারণে তাঁর পদোন্নতি স্থগিত রাখা হয় কিছুদিনের জন্য। তবে বিলম্বে হলেও তাঁর পদোন্নতি ঠিকই হয়েছিল।
‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ ও ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’-এর মতো কালজয়ী সৃষ্টি, যার কৃতিত্ব সেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সংক্ষেপে ডি এল রায় পেশায় ছিলেন সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মেদিনীপুরের সুজমুঠা পরগনায় সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে স্থানীয় কৃষকদের খাজনা কমিয়ে দিয়ে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট গভর্নরের প্রচণ্ড রোষে পড়েছিলেন তিনি। কৃতজ্ঞ চাষিরা ডি এল রায়ের ন্যায়পরায়ণতার জন্য তাঁর নাম দিয়েছিলেন দয়াল রায়।
১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তাঁর চাকরিজীবনের শুরু। তাঁর ভাষায় ‘দাস্য’জীবনের বিড়ম্বনা, যার অবসান ঘটে ১৯১৩ সালে ক্লান্তি ও অপমানের মধ্যে, তাঁর মৃত্যুর তিন মাস আগে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে।
তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাব ও তেজস্বী স্বভাব ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পদে পদে মতান্তর সৃষ্টি করে। ফলে অনবরত বদলি হতে হয়েছে এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে নানা প্রান্তিক অঞ্চলে বদলি হয়েছিলেন ২৫ বারেরও বেশি। কখনো কখনো বছরের এ-মাথা ও-মাথায় বদলি হতে হয়েছে তাঁকে।
বঙ্কিম ও নবীনচন্দ্রের ভাগ্যেও বদলি-বিড়ম্বনা ঘটেছিল প্রচুর; তবে বুদ্ধি, কৌশল ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন তাঁরা। কিন্তু আত্মাভিমানী দ্বিজেন্দ্রলাল এই অনবরত বদলিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। এক চিঠিতে তাঁর জীবনীকার দেবকুমার রায় চৌধুরীকে লেখেন, ‘ক্রমাগত বদলি আমাকে যেন অস্থির করে তুলেছে।’ এই অস্থিরতা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে ব্যাহত করেছে আর মানসিক গ্লানিকে করেছে তীব্র থেকে তীব্রতর। নাবালক ছেলে দিলীপ কুমার রায়কে চিঠি লেখেন, ‘মনিবরা আমাকে ফের বদলি করলেন—দেবই এবার চাকরি ছেড়ে। আমি কি ফুটবল নাকি যে ওরা যখন যেখানে খুশি “শট” করে পাঠাবেন!’ পরিণত বয়সে ছেলে দিলীপ কুমার রায় তাঁর বাবার চাকরি প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘নিয়তির কী পরিহাস—স্বধর্মে যিনি কবি, স্বভাবে যিনি স্বাধীন, তাঁকেও কিনা বারবার চাকরি ছাড়ার পণ নেওয়া সত্ত্বেও চিরটা কাল ওই চাকরিতে কায়েম থাকতে হলো।’ বাবার চাকরি প্রসঙ্গে ছেলের কী বাস্তব ও নির্মোহ মূল্যায়ন!
বিদেশি ডিগ্রি, কর্মদক্ষতা, সততা, বংশকৌলিন্য ও ব্যক্তিত্ব—চাকরিজীবনে উন্নতি করার যা যা প্রয়োজন, তার সবই ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের। সুস্থিরভাবে চাকরি করলে তাঁর পক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া অসম্ভব ছিল না। তা ছাড়া সেই সময়ে হাকিমের চাকরির সামাজিক কৌলীন্য ও প্রতিপত্তি ছিল প্রবাদসম। ছেলে দিলীপ রায় লিখেছেন, ‘হলে কী হবে? তাঁর স্বভাবই হয় দাঁড়ানো তাঁর পথ আগলে। জীবিকার জন্য তাঁকে বিদেশি রাজতন্ত্রের আমলা হতে হলো, এ দুঃখ চিরদিন তাঁর মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিল।’
মতবিরোধ ছোট লাট অর্থাৎ প্রদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেনি কখনো, প্রকাশ্য আলোচনা তো দূরের কথা। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে ছোট লাট স্যার চার্লস এলিয়টের জমির খাজনা-সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে এবং ছোট লাট এই মতদ্বৈধতায় ভ্রান্ত প্রতিপন্ন এবং আদালতে সমালোচিত হয়ে যারপরনাই ক্রুদ্ধ ও অপমানিত বোধ করেন।
সরকারি জরিপ বিভাগে কাজ করার সময় মেদিনীপুর জেলায় জমি সেটেলমেন্ট করতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল একটি বিচিত্র ব্যবস্থার হদিস পেলেন। ওই এলাকায় জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সময় কোনো সঠিক মাপজোখ করা হতো না। আন্দাজে জমির পরিমাণ ধরে নিয়ে জমি বন্দোবস্ত ও খাজনা ঠিক করা হতো। নতুন বদলি হয়ে আসা সেটেলমেন্ট অফিসাররা প্রত্যেকই আবার নতুন করে জমি মেপে বেশি জমি আছে এই যুক্তিতে খাজনা বাড়িয়ে দিতেন। তিনি নিজেই ঘটনাটি লিখে গেছেন। তাঁর বয়ানেই শোনা যাক পুরো বিষয়টি, ‘আমি এই অভিপ্রায় প্রকাশ করি যে এরূপ খাজনা বৃদ্ধি অন্যায় ও আইনবিরুদ্ধ...রাজা যদি বেশি জমির জন্য বেশি খাজনা দাবি করেন, তবে তাহার দেখাইতে হইবে যে প্রজা কোন বেশি জমিটুকু অধিকার করিয়াছে। আরও সেচের খাল বন্ধ হওয়ায় জমির বাৎসরিক ফসল কম হইয়া যাওয়ায় আমি প্রজাদিগের খাজনা কমাইয়া রায় দেই। ওই রায় হইতে জজের নিকট আপিল হয় এবং তাহাতে জজ সাহেব আমার রায় উল্টাইয়া দিয়া প্রজাদিগের খাজনা বৃদ্ধি করিয়া দেন।’
বাংলাদেশের ছোট লাট স্যার চার্লস এলিয়ট এ বিষয়ে তদন্ত করতে নিজে মেদিনীপুরে এসে কাগজপত্র দেখে দ্বিজেন্দ্রলালকে ভর্ৎসনা করেন। ‘আমি আমার মত সমর্থন করিয়া বঙ্গদেশীয় সেটেলমেন্ট আইন বিষয়ে তাঁহার (ছোট লাট) অনভিজ্ঞতা বুঝাইয়া দেই।’ স্বয়ং ছোট লাটকে আইন অনভিজ্ঞ বললে একজন সামান্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি বিপদাপন্ন হবে, এ তো স্বাভাবিক। এরপর হতাশ দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে বলে বসলেন, অনেস্টি ইজ নট দ্য বেস্ট পলিসি। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে রেগে তলব করেন আর তাঁর চাকরিচ্যুতির বন্দোবস্ত করতে নেমে পড়লেন। ডি এল রায়ের কপাল ভালো। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে প্রজাদের আপিলের জবাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রায় বহাল রাখার আদেশ হয়। তিনি পদচ্যুতির আশঙ্কা থেকে রেহাই পেলেন। আদালতে রায়ের কাছে মাথা নত করলেও ছোট লাট দ্বিজেন্দ্রলালের সার্ভিস বুকে লিখিত মন্তব্য করলেন, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল শ্রমবিমুখ ও অলস’ কিন্তু তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দৃঢ়ভাবে দ্বিজেন্দ্রলালকে সমর্থন করে তাঁর রিপোর্টে লিখলেন যে ‘তিনি কাজ, পরিশ্রম ও দক্ষতায় কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ।’ কিউনিফেন তাঁর পাশে না দাঁড়ালে দ্বিজেন্দ্রলালের পদচ্যুতি অবধারিত ছিল। ছোট লাট তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর উচ্চতর পদে প্রমোশন বন্ধ করে দিলেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা দেখা যাক। এবার তিনি লিখে গেছেন, ‘আমি সত্যই ইহা শ্লাঘার বিষয় বিবেচনা করি যে আমি ক্ষুদ্র ক্ষমতাতেই উক্ত রায়ে নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত বঙ্গদেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত করিয়াছি—নিরীহ প্রজাদিগকে অন্যায় কর বৃদ্ধি হইতে বাঁচাইয়াছি।’
সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি স্বদেশি আন্দোলনের আমলের আগুনের আঁচে জর্জরিত হয়ে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটিতে লিখে বসেছিলেন, ‘আমরা ঘুচাবো মা তোর কালিমা হূদয় রক্ত করিয়া শেষ।’ পরে সুহূদদের পরামর্শে এই উত্তেজক বিদ্রোহমূলক পঙিক্ত বদলে লেখেন, ‘মানুষ আমরা নাহি তো মেষ।’ বন্ধুদের পরামর্শে আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেন। স্বদেশি আন্দোলন উপলক্ষে লেখা দেশাত্মবোধক সংগীতগুলো সব পুড়িয়ে ফেললেন। পরে আরও সংহত হয়েছিল তাঁর অনুভূতি। রাজশক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়া তিনি সরকারি কর্মচারী হয়ে সমীচীন মনে করেননি।
শেষে চাকরির প্রতি তাঁর হয়তো আর তেমন আকর্ষণ ছিল না। ২৫ বছর পূর্ণ হলে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার কথা প্রায়ই তাঁকে বলতে শোনা যেত। ‘বেশ একটা নতুন ধরনের আইডিয়াল (আদর্শ) মাসিক কাগজ বের করার ইচ্ছে ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের অবসরের দিনগুলোয়। ভারতবর্ষ-এর সম্পাদক হওয়ার সব ব্যবস্থাও সম্পন্ন হয়েছিল। অবসরের সরকারি অনুমোদন হয়ে না আসায় নিজের নাম সম্পাদক হিসেবে দেওয়া যথোচিত মনে হয়নি তাঁর। কিন্তু রাজপুরুষের অনুমতি আসার আগেই পৃথিবীর সম্রাটের ডাক এসে গেল। ৫০ বছর বয়সে স্বেচ্ছা অবসরের তিন মাস আগে ১৯১৩ সালে অকস্মাৎ তিনি মারা যান।
এই তিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বাধীনচেতা হলেও তাঁরা ছিলেন রাজভক্ত। চাকরির বিধিনিষেধের লক্ষণরেখা কখনো উপেক্ষা করেননি। ঔপনিবেশিককে কাঠামোর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তাঁদের বিরোধী সত্তাকে সময় সময় সমঝোতা করতে হয়েছে। চাকরিজীবনে হতাশা, স্বীকৃতির অভাব ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও তাঁদের সৃজনশীলতায় কখনো ভাটা পড়েনি। যে কালজয়ী সৃষ্টি তাঁরা রেখে গেছেন, আজও তা ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
উনিশ শতকে বাংলা সাহিত্য ও সংগীতকে হিরণ্ময় দ্যূতিতে উজ্জ্বল করেন তিন মহারথী—বঙ্কিমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র ও দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। পেশায় তাঁরা সবাই ছিলেন সেই সময়েরই ইংরেজি শিক্ষিত ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। বাগেদবীর সেবার পাশাপাশি ইংরেজ প্রভুর অধীনে কলম পিষেছিলেন দীর্ঘদিন তাঁরা। অবশ্য প্রায় সময়ই এই সেবা ‘দাস্য সুখে হাস্য মুখে’ হয়ে ওঠেনি। আত্মসম্মান, জ্ঞান ও নীতিবোধের কারণে সব সময় উপরিওয়ালার সব সিদ্ধান্ত চোখ বুজে মেনে নিতে পারেননি তাঁরা। ফলে বিলম্বিত পদোন্নতি এবং দ্রুত বদলি তাঁদের কপালে ছিল বাঁধাধরা। উপরি ছিল হাড়ভাঙা খাটুনি। এ সত্ত্বেও তাঁদের মননশীলতার এবং সৃজনীশক্তির স্রোত কখনো রুদ্ধ হয়নি। এই তিন খ্যাতনামা ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরিজীবনের খতিয়ানই এর বড় প্রমাণ।
১৮৫৮ থেকে ১৮৯১—প্রায় ৩৩ বছর সরকারি চাকরি করেছিলেন বঙ্কিম। দীর্ঘ ২৬ বছর অপেক্ষার পর অবসর নেওয়ার মাত্র সাত বছর আগে প্রথম শ্রেণীর ডেপুটির মর্যাদা পেয়েছিলেন তিনি। ‘চাকরি আমার জীবনের অভিশাপ’ বন্ধু শ্রীশ মজুমদারের কাছে লেখা এই চিঠিতে তাঁর হতাশা লুকিয়ে থাকেনি। দীর্ঘ কর্মজীবনে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ক্যাডারের ওপরে অন্য কোনো প্রমোশনের সুযোগ পাননি তিনি, যদিও উপরিওয়ালার কাছ থেকে তাঁর কর্মদক্ষতা, সততা ও সাফল্যের প্রশংসাপূর্ণ প্রতিবেদনের ঘাটতি ছিল না। চাকরিজীবনে মাত্র দুবার তিনি কিছুটা চোখে পড়ার মতো পোস্টিং পেয়েছিলেন, প্রথমবার ১৮৬৭ সালের আমলাদের জন্য গঠিত বেতন কমিশনে নিযুক্তি পেয়েছিলেন তিনি। আর চাকরিজীবনের প্রায় প্রান্তে ১৮৮১ সালে তাঁকে বেঙ্গল গভর্নমেন্টের সহকারী সচিব নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু কয়েক মাস না যেতেই ওই পদটি উঠিয়ে এক ঘণ্টার নোটিশে তাঁকে বদলি করা হয়। পদটি আকস্মিকভাবে উঠিয়ে দেওয়া এবং যেভাবে তাঁকে সরানো হয়, তাতে পত্রপত্রিকায় সমালোচনার ঝড় ওঠে।
বঙ্কিম জীবনীকারদের মতে, বদলি ও নিয়োগ নিয়ে তাঁকে বারবার নানা বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ১৮৮২ থেকে ১৮৯২-এ অবসর নেওয়া পর্যন্ত সোয়া আট বছরে প্রায় নয়বার তাঁকে বদলি হতে হয়েছিল। ‘এত ঘন ঘন বদলি কোনো কর্মকর্তার প্রতি সরকারের সহানুভূতি বা আস্থার পরিচয় বহন করে না। মনে হয়, তিতিবিরক্ত-হতাশ বঙ্কিম তাই স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেছিলেন।’ (লাডলীমোহন রায় চৌধুরী)
বঙ্কিমের চাকরিজীবনের শুরুটা ছিল উজ্জ্বল। তাঁর কর্মদক্ষতা, বুদ্ধিমত্তা এবং কর্তব্যনিষ্ঠার প্রশংসা করে তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তারা সন্তোষ প্রকাশ করেছেন একাধিকবার। কোনো কোনো রিপোর্টে বলা হয়েছে, তিনি যে রকম কর্মদক্ষতার সঙ্গে কাজ করেন, তা একমাত্র ইউরোপীয় জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেটের পক্ষেই সম্ভব। ১৮৮২-৮৩ সালের প্রেসিডেন্সি ডিভিশনের জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিপোর্টের একটা অংশে লেখা:
১৮৮১-৮৩ সালে বঙ্কিম প্রশংসাসূচক রিপোর্টের ফাঁকে ফাঁকে কিছু তির্যক মন্তব্যের সম্মুখীন হন। ১৮৮১-৮২-তে বর্ধমান বিভাগের প্রশাসনিক রিপোর্টে জেলা প্রশাসক বঙ্কিমের সাহিত্যপ্রতিভার স্বীকৃতি জানিয়েও ‘তার সারবত্তাহীন এবং অগোছালো কাজের ধারা ও বাগাড়ম্বর সম্পর্কে’ কটাক্ষ করেন।
১৮৮৩-৮৪ সালে জেলা কানেক্টর আরও কট্টর মন্তব্য লেখেন। তাঁর মতে, ‘বঙ্কিমকে যথাযোগ্য করে গড়ে তোলার জন্য তাঁকে সব সময়ে নজরে রাখা দরকার এবং তিনি নিশ্চিত খামখেয়ালি ধরনের মানুষ।’ তবে সবচেয়ে নির্দয় মন্তব্য চোখে পড়ে ১৮৮৫-৮৬ সালের রিপোর্টে, ‘তিনি একজন মামুলি ধরনের অফিসার (অ্যান অ্যাভারেজ অফিসার) ছাড়া আর কিছু নন এবং তাঁর অফিসের কাজে আরও আগ্রহ দেখানো উচিত।’
বঙ্কিম তাঁর চাকরিজীবনে বহু মামলার বিচার করেছেন। বিচারক হিসেবে খুব একটা দক্ষতা দেখাতে পারেননি তিনি। তাঁর বিচারবিভ্রাটের কিছু কিছু দৃষ্টান্ত সমসময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিতও হয়েছিল। তবে বিচারকার্যে তাঁর সততা সম্পর্কে কখনো কোনো প্রশ্ন ওঠেনি। একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তাঁর সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের বিচারকার্যে এমন কিছু অদ্ভুত খুঁত লক্ষ করা গিয়েছে, যা তাঁর মতো একজন বিদগ্ধ ব্যক্তির কাছ থেকে কিছুতেই আশা করা যায় না।’ গ্যারেট লিখেছেন, ‘মামলার বিচারকাজে তিনি অনেক সময় নানা রকম অস্বাভাবিক মতামত করতে অভ্যস্ত এবং তাঁর রায়গুলো কিছুটা বাগাড়ম্বরপূর্ণ (ভারবোস) (লাডলীমোহন রায় চৌধুরী)।
চাকরির ক্ষেত্রে তাঁকে হতে হয়েছে অনেক বৈষম্যের মুখোমুখি। বাংলাদেশের কৃষক ও মুচিরাম গুড়ের জীবনীতে ইংরেজের বিচারব্যবস্থাকে ব্যঙ্গ করেছেন। তাঁর লেখায় কোনো কোনো জায়গায় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাঁর ঘোর মতবিরোধের দৃষ্টান্ত রয়েছে। ইলবার্ট বিল নিয়েও তাঁর সমালোচনা অনেক সাহেবের মধ্যে রোষের জন্ম দিয়েছিল। অনেকে মনে করেন, বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি সকারের সহানুভূতিহীনতার মূল কারণ তাঁর উপন্যাস আনন্দমঠ। যদিও এই উপন্যাসের দরুন তাঁকে সরাসরিভাবে কোনো অভিযোগ সরকার করেছিল বলে জানা নেই, কিন্তু উপন্যাসটি প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই তাঁর চাকরির চরিত্রলিপিতে তিক্ত মন্তব্যের আবির্ভাব হতে থাকে।
১৮৮২ সালে উপন্যাস প্রকাশের সময় ব্রিটিশ সরকারের প্রতি বিদ্বেষের কিছু কিছু নমুনা ছিল বলে অনেকের ধারণা। বিপদের আঁচ পেয়ে বঙ্কিম পরবর্তী সংস্করণে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটান। সরকারের সন্দেহ নিরসনের জন্য আনন্দমঠ-এর বিজ্ঞাপনে এর বিষয়বস্তুর আভাস দিয়ে জানালেন, ‘রাজনীতি নয়, ধর্মকথা বলাই লেখকের উদ্দেশ্য।’ সশস্ত্র বিপ্লব অনেক সময়ই আত্মপীড়ন মাত্র। বিদ্রোহীরা আত্মঘাতী ‘ইংরেজরা বাংলাদেশকে অরাজকতা থেকে উদ্ধার করিয়াছে—এই সকল কথা এই গ্রন্থে বুঝান গেল।’ ইংরেজের ক্রোধ এড়াতে, ‘ইংরেজ’, ‘গোরা’ ‘ব্রিটিশ’ শব্দগুলো ছেঁটে দিলেন। ‘মুসলমান’ ‘নেড়ে’ ‘যবন’ প্রভৃতি শব্দ আমদানি করে বোঝাতে চাইলেন যে ‘সন্তানদের’ বিদ্রোহ ইংরেজের বিরুদ্ধে নয়। কারণ ‘ইংরেজমিত্র রাজা। তাঁদের রাজ্যে প্রজা সুখী হইবে।’ বিদ্রোহী ঝাঁসির রানিকে নিয়ে একটি উপন্যাস লেখার পরিকল্পনা তাঁর ছিল। কিন্তু আনন্দমঠ-এর প্রতি ইংরেজের মনোভাব জানতে পেরে তিনি আর এগোননি। সন্দেহ নেই, চাকরি বঙ্কিমের শিল্পীসত্তার টুঁটি চেপে ধরেছিল নিষ্ঠুরভাবে।
চাকরিজীবনের বৈষম্যের শিকার হয়ে ব্যক্তিজীবনে বঙ্কিম ছিলেন নিখাদ রাজভক্ত। ‘লর্ড রিপনের উৎসবের জমা খরচ’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন—‘রাজভক্তি বড়ো বাঞ্ছনীয়।’ ইংরেজ চরিত্রে তাঁর আস্থা কখনোই টোল খায়নি। সরকারও তাঁকে রায়বাহাদুর ও সিআইই খেতাব দিতে কার্পণ্য করেনি। তবে এই খেতাব তিনি পেয়েছিলেন ‘রাজ সরকারের চাকরি অপেক্ষা বিদ্ব্যৎমণ্ডলীতে তাঁর খ্যাতির জন্য’, (জীবন মুখোপাধ্যায়) প্রাদেশিক সরকারের একজন প্রখ্যাত কর্মকর্তা হিসেবে নয়।
উনিশ শতকের খ্যাতিসম্পন্ন কবি নবীনচন্দ্র সেন পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। ১৮৬৮ থেকে ১৯০৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত তিনি বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার বিভিন্ন স্থানে ডেপুটিগিরি করেছেন। ডেপুটি আমলাতন্ত্রের নিম্নতম সপ্তম ধাপ থেকে প্রথম ধাপে পৌঁছাতে তাঁর মতো করিৎকর্মা অফিসারের দীর্ঘ ৩৬টি বছর লেগেছিল। এই দীর্ঘ কর্মজীবনকে তিনি আত্মজীবনী আমার জীবন-এ উল্লেখ করেছেন। ‘ঘোরতর বিপদসঙ্কুল চাকরিজীবন’ হিসেবে।
চাকরিজীবনে তাঁর মনে কোনো শঙ্কা বা বেদনাবোধ হতে দেখা যায়নি। অবসর নেওয়ার প্রসঙ্গে আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘৩৬ বছরের চাকরি হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া হাসিতে হাসিতে কোর্ট হইতে বহির্গত হইলাম এবং গৃহে যাইতে যাইতে আকাশের দিকে চাহিয়া বলিলাম—দয়াময়, তোমার দয়ায় এই ঘোরতর বিপদসঙ্কুল চাকরিজীবন শেষ করিলাম...বাকি জীবন আমাকে শান্তি দিও...।’
বঙ্কিমের মতো নবীনচন্দ্রও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রায়ই নানা মতভেদ এবং দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যহেতু বিরোধে জড়িয়ে পড়তেন। ১৮৭৭ সালে চট্টগ্রামে চা-শ্রমিকদের ওপর গুলিবর্ষণের প্রতিবিধানে সক্রিয় ভূমিকা ইংরেজ শাসকদের অসন্তুষ্টির কারণ হয়ে ওঠে।
মাদারীপুরে তাঁর একটি রায়ের বিরুদ্ধে জেলা জজ তীর্যক মন্তব্য করে তাঁকে বিপদগ্রস্ত করে তোলেন। শুদ্ধ নবীনচন্দ্র লিখেছেন—‘আমি ষড়যন্ত্রে পড়িয়া এই রূপ বিপদগ্রস্ত হইয়াছিলাম যে আমার চাকরি যদি পণ্যদ্রব্য হইত, তবে সিকি পয়সা দিয়াও তাহা কেহ কিনিত না।’ হাইকোর্ট তাঁর রায় বহাল রাখায় তিনি সেই যাত্রায় রক্ষা পান। মাদারীপুরে একের পর এক তিনি বিভাগীয় তদন্তের মুখে পড়েছিলেন। তাঁর আত্মজীবনীতে নিজের সম্পর্কে কিছু অতিশয়োক্তি থাকলেও চাকরিজীবনের বিভ্রাট এবং বদলির বিপত্তির নানা বর্ণনা মূলত তথ্যনির্ভর ও বাস্তবানুগ বলেই গবেষকদের ধারণা। বেশ জাঁক করে নিজেই লিখেছেন, ‘সার্ভিসের মধ্যে আমি একজন বিষম সাহসী (ডেয়ার ডেভিল) প্রকৃতির লোক বলিয়া পরিচিত।’ অথচ আমার জীবন-এ এই সাহসী পুরুষকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, ‘দয়াময়, তুমি আমাকে এক মহাবিপদ হইতে উদ্ধার করিয়া আবার এই বিপদে ফেলিলে।’ মোকদ্দমার বিচারবিভ্রাটে আতঙ্কিত হাকিম নবীনচন্দ্রকে নিয়মিত দয়াময়ের শরণাপন্ন হতে হয়েছে। ‘নিঃসহায় হইয়া সেই বিপদভঞ্জনকে ডাকিতে লাগিলাম’—একদম করুণ আর্তি ঘুরেফিরে তাঁর লেখায় উঁকি দিয়েছে বারবার।
তাঁর চাকরিজীবনে বদলি-বিপর্যয়ের উদাহরণ প্রচুর। মাত্র সাত মাসের মাথায় পুরী থেকে মাদারীপুরে বদলি হওয়ায় বড় দুঃখ পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর চাকরিজীবনের বদলিবিভ্রাটের একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে। ১৮৯৮ সালে চট্টগ্রামে নবীনচন্দ্র তাঁর অফিসে কেরানির পদে আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিয়োগ দেন। প্রাচীন পুঁথি সংগ্রহের ইচ্ছা প্রকাশ করে আবদুল করিম স্থানীয় জ্যোতি পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন। এই বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে নানা প্রশাসনিক বিতর্কের সৃষ্টি হওয়ার বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তাঁর আমার জীবন-এ। বিতর্ক বহুদূর গড়ায় এবং এর জের ধরে আবদুল করিম চাকরিচ্যুত হন। নবীনচন্দ্র কুমিল্লায় বদলি হয়ে তাঁর সাধের চট্টগ্রাম ছাড়তে বাধ্য হন।
তাঁর পলাশীর যুদ্ধ কাব্য বঙ্কিমের আনন্দমঠ-এর মতো দেশবাসীকে উদ্বেলিত এবং শাসকমহলের অংশবিশেষকে বিচলিত করেছিল। সন্দেহ নেই, নবীনচন্দ্র তাঁর এই কাব্যে ইংরেজের বিরাগভাজন হওয়ার আশঙ্কায় সিরাজকে নায়ক হিসেবে তুলে ধরেননি।
সিরাজ ও মীরজাফর উভয়েই তাঁর চোখে অগ্রহণীয়। মোহনলাল এই কাব্যের নায়ক। ক্লাইভকেও কোনো দোষারোপ বা খলনায়ক হিসেবে চিত্রিত করেননি নবীনচন্দ্র। বরং সিরাজের পরাজয়ের পর মোহনলালের মুখ দিয়ে বলিয়েছেন, ‘ভারতের নহে আজি অসুখের দিন।’ শুধু এ-ই নয়, আরও বলেছেন, ‘এ সুখের দিনে প্রফুল্ল অন্তরে গাও মিলি সবে ব্রিটিশের ভয়ে।’ রাজশক্তির ভয়ে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নবীন পলাশীর যুদ্ধ-এর প্রথম সংস্করণের অনেক পাঠ বদল করেছেন। প্রথম সংস্করণ থেকে ‘ইংরেজের রক্তে আজি করিব তর্পণ’ বাদ দেওয়া হয়। বাদ দেওয়া হয় ‘আসিবে ভারতে চির বিষাদ-রজনী!...’-এর মতো পঙিক্ত। ‘সেই শোণিতের স্রোতে হইল তখন বঙ্গ-স্বাধীনতা-শেষ আশা বিসর্জন’-এর মতো বিপজ্জনক পঙিক্ত ছেঁটে ফেলা হয়। নবীনচন্দ্রের কবিসত্তা ডেপুটি লীলার পায়ে এমনিভাবেই মাথা নত করেছিল।
পাশাপাশি সিরাজ চরিত্রে মিথ্যা কলঙ্ক লেপনের জন্য তিনি সম সময়ই ধিক্কৃত হয়েছেন তীব্র ভাষায়। এত কিছু করার পরও শাসক কর্তৃপক্ষের একটি অংশ তাঁর ওপর রুষ্ট হয়েছিল। দীনবন্ধু ও বঙ্কিমের মতো রাজরোষ আঘাত হেনেছিল তাঁকে গুপ্ত বা প্রকাশ্যে। শোনা যায়, এই বইয়ের কারণে তাঁর পদোন্নতি স্থগিত রাখা হয় কিছুদিনের জন্য। তবে বিলম্বে হলেও তাঁর পদোন্নতি ঠিকই হয়েছিল।
‘ধনধান্য পুষ্পভরা’ ও ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’-এর মতো কালজয়ী সৃষ্টি, যার কৃতিত্ব সেই দ্বিজেন্দ্রলাল রায় সংক্ষেপে ডি এল রায় পেশায় ছিলেন সরকারের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। মেদিনীপুরের সুজমুঠা পরগনায় সেটেলমেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে স্থানীয় কৃষকদের খাজনা কমিয়ে দিয়ে ইংরেজ লেফটেন্যান্ট গভর্নরের প্রচণ্ড রোষে পড়েছিলেন তিনি। কৃতজ্ঞ চাষিরা ডি এল রায়ের ন্যায়পরায়ণতার জন্য তাঁর নাম দিয়েছিলেন দয়াল রায়।
১৮৮৬ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে তাঁর চাকরিজীবনের শুরু। তাঁর ভাষায় ‘দাস্য’জীবনের বিড়ম্বনা, যার অবসান ঘটে ১৯১৩ সালে ক্লান্তি ও অপমানের মধ্যে, তাঁর মৃত্যুর তিন মাস আগে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে।
তাঁর স্বাধীনচেতা মনোভাব ও তেজস্বী স্বভাব ইংরেজ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পদে পদে মতান্তর সৃষ্টি করে। ফলে অনবরত বদলি হতে হয়েছে এক জেলা থেকে আরেক জেলায়। ২৭ বছরের চাকরিজীবনে নানা প্রান্তিক অঞ্চলে বদলি হয়েছিলেন ২৫ বারেরও বেশি। কখনো কখনো বছরের এ-মাথা ও-মাথায় বদলি হতে হয়েছে তাঁকে।
বঙ্কিম ও নবীনচন্দ্রের ভাগ্যেও বদলি-বিড়ম্বনা ঘটেছিল প্রচুর; তবে বুদ্ধি, কৌশল ও আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছিলেন তাঁরা। কিন্তু আত্মাভিমানী দ্বিজেন্দ্রলাল এই অনবরত বদলিকে সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। এক চিঠিতে তাঁর জীবনীকার দেবকুমার রায় চৌধুরীকে লেখেন, ‘ক্রমাগত বদলি আমাকে যেন অস্থির করে তুলেছে।’ এই অস্থিরতা তাঁর সৃষ্টিশীলতাকে ব্যাহত করেছে আর মানসিক গ্লানিকে করেছে তীব্র থেকে তীব্রতর। নাবালক ছেলে দিলীপ কুমার রায়কে চিঠি লেখেন, ‘মনিবরা আমাকে ফের বদলি করলেন—দেবই এবার চাকরি ছেড়ে। আমি কি ফুটবল নাকি যে ওরা যখন যেখানে খুশি “শট” করে পাঠাবেন!’ পরিণত বয়সে ছেলে দিলীপ কুমার রায় তাঁর বাবার চাকরি প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘নিয়তির কী পরিহাস—স্বধর্মে যিনি কবি, স্বভাবে যিনি স্বাধীন, তাঁকেও কিনা বারবার চাকরি ছাড়ার পণ নেওয়া সত্ত্বেও চিরটা কাল ওই চাকরিতে কায়েম থাকতে হলো।’ বাবার চাকরি প্রসঙ্গে ছেলের কী বাস্তব ও নির্মোহ মূল্যায়ন!
বিদেশি ডিগ্রি, কর্মদক্ষতা, সততা, বংশকৌলিন্য ও ব্যক্তিত্ব—চাকরিজীবনে উন্নতি করার যা যা প্রয়োজন, তার সবই ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের। সুস্থিরভাবে চাকরি করলে তাঁর পক্ষে ম্যাজিস্ট্রেট হওয়া অসম্ভব ছিল না। তা ছাড়া সেই সময়ে হাকিমের চাকরির সামাজিক কৌলীন্য ও প্রতিপত্তি ছিল প্রবাদসম। ছেলে দিলীপ রায় লিখেছেন, ‘হলে কী হবে? তাঁর স্বভাবই হয় দাঁড়ানো তাঁর পথ আগলে। জীবিকার জন্য তাঁকে বিদেশি রাজতন্ত্রের আমলা হতে হলো, এ দুঃখ চিরদিন তাঁর মনে কাঁটা হয়ে বিঁধে ছিল।’
মতবিরোধ ছোট লাট অর্থাৎ প্রদেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেনি কখনো, প্রকাশ্য আলোচনা তো দূরের কথা। কিন্তু দ্বিজেন্দ্রলালের সঙ্গে ছোট লাট স্যার চার্লস এলিয়টের জমির খাজনা-সংক্রান্ত বিষয়ে বিরোধ প্রকাশ্যে চলে আসে এবং ছোট লাট এই মতদ্বৈধতায় ভ্রান্ত প্রতিপন্ন এবং আদালতে সমালোচিত হয়ে যারপরনাই ক্রুদ্ধ ও অপমানিত বোধ করেন।
সরকারি জরিপ বিভাগে কাজ করার সময় মেদিনীপুর জেলায় জমি সেটেলমেন্ট করতে গিয়ে দ্বিজেন্দ্রলাল একটি বিচিত্র ব্যবস্থার হদিস পেলেন। ওই এলাকায় জমি বন্দোবস্ত দেওয়ার সময় কোনো সঠিক মাপজোখ করা হতো না। আন্দাজে জমির পরিমাণ ধরে নিয়ে জমি বন্দোবস্ত ও খাজনা ঠিক করা হতো। নতুন বদলি হয়ে আসা সেটেলমেন্ট অফিসাররা প্রত্যেকই আবার নতুন করে জমি মেপে বেশি জমি আছে এই যুক্তিতে খাজনা বাড়িয়ে দিতেন। তিনি নিজেই ঘটনাটি লিখে গেছেন। তাঁর বয়ানেই শোনা যাক পুরো বিষয়টি, ‘আমি এই অভিপ্রায় প্রকাশ করি যে এরূপ খাজনা বৃদ্ধি অন্যায় ও আইনবিরুদ্ধ...রাজা যদি বেশি জমির জন্য বেশি খাজনা দাবি করেন, তবে তাহার দেখাইতে হইবে যে প্রজা কোন বেশি জমিটুকু অধিকার করিয়াছে। আরও সেচের খাল বন্ধ হওয়ায় জমির বাৎসরিক ফসল কম হইয়া যাওয়ায় আমি প্রজাদিগের খাজনা কমাইয়া রায় দেই। ওই রায় হইতে জজের নিকট আপিল হয় এবং তাহাতে জজ সাহেব আমার রায় উল্টাইয়া দিয়া প্রজাদিগের খাজনা বৃদ্ধি করিয়া দেন।’
বাংলাদেশের ছোট লাট স্যার চার্লস এলিয়ট এ বিষয়ে তদন্ত করতে নিজে মেদিনীপুরে এসে কাগজপত্র দেখে দ্বিজেন্দ্রলালকে ভর্ৎসনা করেন। ‘আমি আমার মত সমর্থন করিয়া বঙ্গদেশীয় সেটেলমেন্ট আইন বিষয়ে তাঁহার (ছোট লাট) অনভিজ্ঞতা বুঝাইয়া দেই।’ স্বয়ং ছোট লাটকে আইন অনভিজ্ঞ বললে একজন সামান্য ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি বিপদাপন্ন হবে, এ তো স্বাভাবিক। এরপর হতাশ দ্বিজেন্দ্রলাল প্রকাশ্যে ব্যঙ্গ করে বলে বসলেন, অনেস্টি ইজ নট দ্য বেস্ট পলিসি। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁকে রেগে তলব করেন আর তাঁর চাকরিচ্যুতির বন্দোবস্ত করতে নেমে পড়লেন। ডি এল রায়ের কপাল ভালো। ইতিমধ্যে হাইকোর্টে প্রজাদের আপিলের জবাবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের রায় বহাল রাখার আদেশ হয়। তিনি পদচ্যুতির আশঙ্কা থেকে রেহাই পেলেন। আদালতে রায়ের কাছে মাথা নত করলেও ছোট লাট দ্বিজেন্দ্রলালের সার্ভিস বুকে লিখিত মন্তব্য করলেন, ‘দ্বিজেন্দ্রলাল শ্রমবিমুখ ও অলস’ কিন্তু তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দৃঢ়ভাবে দ্বিজেন্দ্রলালকে সমর্থন করে তাঁর রিপোর্টে লিখলেন যে ‘তিনি কাজ, পরিশ্রম ও দক্ষতায় কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ।’ কিউনিফেন তাঁর পাশে না দাঁড়ালে দ্বিজেন্দ্রলালের পদচ্যুতি অবধারিত ছিল। ছোট লাট তাঁর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে না পারলেও প্রকৃতপক্ষে তাঁর উচ্চতর পদে প্রমোশন বন্ধ করে দিলেন।
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কী প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, তা দেখা যাক। এবার তিনি লিখে গেছেন, ‘আমি সত্যই ইহা শ্লাঘার বিষয় বিবেচনা করি যে আমি ক্ষুদ্র ক্ষমতাতেই উক্ত রায়ে নিজের পায়ে কুঠারাঘাত করিলেও সমস্ত বঙ্গদেশব্যাপী একটি উপকার সাধিত করিয়াছি—নিরীহ প্রজাদিগকে অন্যায় কর বৃদ্ধি হইতে বাঁচাইয়াছি।’
সরকারি কর্মচারী হয়েও তিনি স্বদেশি আন্দোলনের আমলের আগুনের আঁচে জর্জরিত হয়ে ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটিতে লিখে বসেছিলেন, ‘আমরা ঘুচাবো মা তোর কালিমা হূদয় রক্ত করিয়া শেষ।’ পরে সুহূদদের পরামর্শে এই উত্তেজক বিদ্রোহমূলক পঙিক্ত বদলে লেখেন, ‘মানুষ আমরা নাহি তো মেষ।’ বন্ধুদের পরামর্শে আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিলেন। স্বদেশি আন্দোলন উপলক্ষে লেখা দেশাত্মবোধক সংগীতগুলো সব পুড়িয়ে ফেললেন। পরে আরও সংহত হয়েছিল তাঁর অনুভূতি। রাজশক্তির সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে যাওয়া তিনি সরকারি কর্মচারী হয়ে সমীচীন মনে করেননি।
শেষে চাকরির প্রতি তাঁর হয়তো আর তেমন আকর্ষণ ছিল না। ২৫ বছর পূর্ণ হলে স্বেচ্ছা অবসর নেওয়ার কথা প্রায়ই তাঁকে বলতে শোনা যেত। ‘বেশ একটা নতুন ধরনের আইডিয়াল (আদর্শ) মাসিক কাগজ বের করার ইচ্ছে ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের অবসরের দিনগুলোয়। ভারতবর্ষ-এর সম্পাদক হওয়ার সব ব্যবস্থাও সম্পন্ন হয়েছিল। অবসরের সরকারি অনুমোদন হয়ে না আসায় নিজের নাম সম্পাদক হিসেবে দেওয়া যথোচিত মনে হয়নি তাঁর। কিন্তু রাজপুরুষের অনুমতি আসার আগেই পৃথিবীর সম্রাটের ডাক এসে গেল। ৫০ বছর বয়সে স্বেচ্ছা অবসরের তিন মাস আগে ১৯১৩ সালে অকস্মাৎ তিনি মারা যান।
এই তিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট স্বাধীনচেতা হলেও তাঁরা ছিলেন রাজভক্ত। চাকরির বিধিনিষেধের লক্ষণরেখা কখনো উপেক্ষা করেননি। ঔপনিবেশিককে কাঠামোর সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তাঁদের বিরোধী সত্তাকে সময় সময় সমঝোতা করতে হয়েছে। চাকরিজীবনে হতাশা, স্বীকৃতির অভাব ও অসম্পূর্ণতা সত্ত্বেও তাঁদের সৃজনশীলতায় কখনো ভাটা পড়েনি। যে কালজয়ী সৃষ্টি তাঁরা রেখে গেছেন, আজও তা ভাস্বর হয়ে রয়েছে।
সূত্র : দৈনিক প্রথম আলো
No comments:
Post a Comment