প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Thursday, July 26, 2012

মুসলমানের খোঁজে... | তৈয়ব খান

“আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা’ সে মুসলমান.....” নজরুল গীতির এ লাইটা আজ ক’দিন হলো মনের ভেতর গুনগুনিয়ে বাজছে হুমায়ূন কবিরের। কিছুতেই ভুলে যেতে পারছেন না, বহু চেষ্টা করেও। উঠতে বসতে, নাইতে, পড়তে-পড়াতে, খেতে বসে সবসময়েই শুধু ঐ ক’টি লাইনই উনি গুনগুনিয়ে ফিরছেন। ক্ষেত্র বিশেষ এ গুনগুনানোর আওয়াজটাই কেবল বাড়ে কমে। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, গানের বাকি লাইনগুলো উনার মন থেকে বেমালুম ডিলিট হয়ে গেছে। কসরত করেও গাইতে পারছেন না, তাতে একটু অস্বস্তিও লাগছে।
হুমায়ুন সাহেব শিক্ষিত মানুষ। জীবনে অনেক বড়ো কিছু হওয়ার ইচ্ছে ছিলো, হতে পারতেনও, কিন্তু পারেন নি। এর কারণও অনেক। কর্মজীবনে নীতির সাথে আপোষ করতে পারেন নি বলে একের পর এক বেশ ক’টা চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজেই কিছু একটা করতে চেয়েছেন। ঢাকা শহরে ব্যবসা করতে গিয়ে পুঁজির অভাব বোধ করেছেন প্রচ-ভাবে। পুঁজির যোগান পেতে বন্ধুর সাথে পার্টনারশিপ ব্যবসা করতে গিয়েও হোঁচট খেয়েছেন। শেষে টিকতে না পেরে ফিরে এসেছেন নিজ এলাকা- বাহ্মণবাড়িয়ায়। সম্বলগুলো একত্র করে ছোট একটা মনোহরী দোকান দিয়েছেন রসুল্লাবাদ বাজারে। গড় পড়তায় দৈনিক বিক্রি তেমন না হলেও টিকে থাকা যায় কোন মতে। খরচ তো আর কম নয়! বড়ো ছেলেমেয়ে দু’টি ঢাকায় থেকে ওখানকার দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছে, ছোট মেয়েটিও স্থানীয় স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী। সংসারের চারদিক সামলাতে হীমসীম খেতে হয় মারাত্মক। জমির ফসল থেকে খানিকটা সাপোর্ট পান বলেই রক্ষে। তা নইলে, টানাপোড়েন কাকে বলে; হাড়ে হাড়ে টের পেতেন। দোকানটা সাজাতে আরও পুঁজির দরকার কিন্তু পুঁজির যোগান দেবে এমন কাউকে উনি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন না। এদিকে রোজা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের রমজান মাস মানেই কারও কারও পোয়াবারো, এটা তিনি বেশ টের পান। উনি ভাবতেই পারেন না, জেনে-শুনে-বুঝে একটা শ্রেণি অকস্মাৎই জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করে। এরা এমনভাবে হঠাৎ করেই পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দেয় যে, হতবাক হয়ে যেতে হয়। উনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পাইকারদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করেন। রোজা শুরু হতে না হতেই নিত্য প্রয়োজনীয় চাল-ডাল-তেল-নুন-রসুন-পেঁয়াজ কিনতে গিয়েই হোঁচট খান। সবকিছুর দামই বেড়ে গেছে কেজি প্রতি দু’তিন টাকা। এখন বাড়তি টাকা দিয়ে পণ্য কিনে, ওগুলো আনতে গিয়ে খান আরেক ধাক্কা। পরিবহণ খরচও কেমন করে রাতারাতি যেন বেড়ে গেছে। এতকিছু করে যখন মালগুলো দোকানে সাজিয়ে হিসেব করে দেখলেন; কেজিপ্রতি অন্তত পাঁচ টাকা বাড়তি না ধরলে চালানই উঠবে না। তাহলে গ্রাহক! গ্রাহকের কথা মনে হতেই চমকে উঠেন। কী জবাব দেবেন তিনি গ্রাহকদের? ওরা তো মানতেই চাইবে না এ উচ্চমূল্য! এখন উপায়?
উপায় খুঁজতে গিয়ে বোবা হয়ে যান তিনি। ঠিক তখনই উনার মনের সেতারে নজরুল গীতির ঐ লাইনটি বেজে উঠে। প্রথমে গানটি খুব মিহি করে বেজে উঠেছিলো। তারপরই সুর চরতে থাকে। একসময় মনের সেতারটার জোশ এসে যায়, তাই সুরটা উনার কণ্ঠনালী বেয়ে দমকা হাওয়ার মতো জোরে বেরিয়ে আসে- “আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা’ সে মুসলমান....।” গানের কলিটা গলা ছেড়ে জোরে বেরিয়ে আসতেই উনার মনে পড়ে বাসায় বাজার পাঠানো দরকার। বাবা মায়ের সাথে রমজানের প্রথম সেহেরি খেতে ঢাকা থেকে রিক্তা আর রাকিব দু’ভাইবোনই বাড়ি আসবে আজ। কী কী লাগবে জানার জন্য বাসায় ফোন করতেই ছোট মেয়ে শান্তা কল রিসিভ করে জানান দেয়, ‘হ্যালো আব্বু, আম্মু তো রান্না করছে। আম্মুকে দেবো?’
‘-হ্যাঁ মা, তোমার আম্মুকে একটু দাও’ বলে মোবাইল নিয়ে মেয়ের রান্নাঘর অব্দি দৌঁড়ে যাওয়ার দৃশ্যটি কল্পনায় দেখে নেন হুমায়ুন কবির। স্ত্রী সাদিয়ার কণ্ঠ কানে যেতেই বলেন, ‘কই, কী কী লাগবে কিছু তো বললে না?’ সাদিয়া বলেন, ‘তেমন কিছু লাগবে না বলে, তোমাকে আর বলি নি। পোষা মোরগটাকে জবাই করে নিয়েছি, তুমি একটু চিনি আর কিসমিস নিয়ে এসো।’ ‘-আচ্ছা’ বলে লাইন কেটে দেন হুমায়ুন কবির। তারপরে ভাবতে বসেন চিনির কেজি কতো টাকায় পাইকারি দরে কিনেছেন। নিজের দোকান বলে উনি পাইকারি দরেই চিনি খরচ করতে পারবেন, কিন্তু বাকি জনতা!
আজ রাতে রমজানের প্রথম সেহেরি। ছেলেমেয়ে দু’টির চেহারাটা উনার মনের পর্দায় ভেসে উঠে। রিক্তা আর রাকিব প্রায় ছ’মাস বাদে ঢাকা থেকে বাড়ি আসছে। কতো স্নেহের সন্তান ওরা, অথচ সে তুলনায় কী-ইবা দিতে পারেন তিনি ওদের? হুমায়ুন কবিরের মনের অজান্তেই চোখজোড়া ছলছল করে উঠে। হঠাৎ চলে আসা কোন খদ্দেরের নজরে পড়ে গেলে লজ্জা পেতে হবে ভেবে চট-জলদি পাঞ্জাবির আস্তিনে চোখ মোছেন। এশার আজান শুরু হয়েছে। মনোযোগ দিয়ে আজানের সবক’টি লাইন শুনেন তিনি, জবাবও দেন। নাহ্! আজ আর কিচ্ছু ভাল লাগছে না। বাসায় গিয়েই নামাজ পড়বেন ভেবে দোকানের শাটার বন্ধ করেন, তারপর নেমে আসেন রাস্তায়।
বাড়ির গেটের কাছে আসতেই মোবালেই রিং টোন বেজে উঠে হুমায়ুন কবিরের। চিনি, কিসমিস আর টুকিটাকি বাজার সমেত বাঁ হাতটা বাড়িয়ে গেট মেলে ধরে ডান হাতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে মোবাইল বের করেই দেখেন রিক্তার নম্বর। হা করে মেলে ধরা গেটের ভেতর দিয়ে উনার চোখ পড়ে উঠানে সাদিয়াকে ঘিরে গোল হয়ে দাঁড়ানো তিন ছেলেমেয়ের দিকে। ওদের পায়ের কাছে দু’টি ট্রাভেল ব্যাগ নামানো আছে। তার মানে রাকিব আর রিক্তা সম্ভবত এই মাত্রই এসে পৌঁছেছে, ঘরে ঢোকা হয় নি। তিনি কল রিসিভ না করে ক্যানসেল করে দেন। এদিকে কানের অনতিদূরে গেটের দিকে পরিচিত রিং টোন শুনে চারজনেই গেটের দিকে তাকিয়ে দেখে হুমায়ুন কবিরকে। রিক্তা দৌঁড়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে আব্বুর বুকে। মুঠোয় মোবাইল ধরা ডান হাতটা মেয়ের মাথায় আদর করে ঘঁষে দেন হুমায়ুন। সাদিয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে স্বামীর বাঁ হাতটার ভারমুক্ত করেন। এদিকে রাকিব আর শান্তা এসে আব্বুর দু’পাশে দাঁড়ায়। সদ্য ভারমুক্ত বাঁ হাতে শান্তাকে জড়িয়ে নেন হুমায়ুন কবির। মোবাইলটা পাঞ্জাবির পকেটে ঢুকিয়ে ডান হাত তুলে রাকিবকে আদর করতে গিয়ে দেখেন, ছেলে তারচে’ ইঞ্চি চারেক লম্বা হয়ে গেছে। সেদিনের পুঁচকে ছেলে- বাপকে ছাড়িয়ে লম্বা হয়ে যাওয়ায় ডান হাতের চেটো দিয়ে রাকিবের মাথায় একটা আদুরে চাটি মারেন। মাথায় আব্বুর হাতের মিষ্টি চাটি খেয়ে রাকিবের মনে হলো, এ চাটিটা যদি তবলায় পড়তো, তবে ‘তাক’ করে একটা মিষ্টি বোল ফোটতো। ভাবনাটা মাথায় আসতেই হো হো করে হেসে ফেলে রাকিব।
হুমায়ুন কবির তিন ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরা অবস্থাতেই আবারও গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলেন- ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা’ সে মুসলমান...... কোথা’ সে মুসলমান।’
শান্তা, রিক্তা এবং রাকিব অবাক চোখে ওদের আব্বুর দিকে তাকিয়ে রইলো। সাদিয়া অবাক হলেন না, কেননা তিনি বেশ ক’দিন ধরেই স্বামীর মুখে নজরুল সঙ্গীতের নির্দিষ্ট এ লাইনটা শুনছেন। তাই মুখটিপে হেসে বাজারের ব্যাগ নিয়ে কিচেনে ঢুকলেন। ছেলেমেয়েদের অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে হুমায়ুন কবিরের চোখজোড়া উদাসী হয়ে গেলো। তিনি ওদের বাঁধন কাটিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে শান্তাকে বললেন, ‘মাগো, আমাকে একটু ওজুর পানি দে তো।’
রাত সাড়ে ন’টার দিকে খাওয়া দাওয়া সেরে হুমায়ুন কবির নিজের রুমের খাটে গিয়ে বসলেন। হাতের কাজ গুছিয়ে সাদিয়া এসে স্বামীর সামনে এসে ডান পায়ে দেহের আংশিক ভার চাপিয়ে কোমরের দু’পাশে দু’হাত রেখে গ্রীবা বাঁকিয়ে দাঁড়ালেন। তারপর বাঁ পায়ের গোড়ালির উপর দেহের বাকি ভারটুকু দিয়ে একবার সামনে আরেকবার পেছনে দোল খেতে থাকলেন। স্ত্রীর এ মোহনীয় ভঙ্গিটি হুমায়ুনের খুব চেনা। সাদিয়ার এ ভঙ্গিটি দেখলে ওঁর মনে হয়, টলমলে ঝিলের জলে কোন রাজহংসী ভাসছে। রিক্তাটাও ঠিক এভাবেই দাঁড়ায়। মায়ের অনেক অভ্যাস বুঝি মেয়েরা এমনিতেই পেয়ে যায়। আচ্ছা, উনি না হয় মায়ের এমন মোহনীয় ভঙ্গি দেখে আকৃষ্ট হন, কিন্তু মেয়ের একই রকম ভঙ্গি দেখে কোন ছেলে এমন আকৃষ্ট হবে, এমন ছেলের খোঁজ তো করা হলো না! কেননা, প্রত্যেক বাবাই চায়; তার মেয়ের জামাই যেন ঠিক তার নিজের মতো হয়, আর মায়েরা চায়; তাদের ছেলের বউ যেন তার নিজের মতো হয়। কিন্তু বাস্তবে তা সবসময় সম্ভব হয়ে উঠে না। ভাবনাটা মাথায় আসতেই উনি হো হো হেসে উঠেন। স্বামীকে অনেকক্ষণ নিজের দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ এমন প্রাণখোলা হাসি শুনে সাদিয়া দুলুনি থামিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ান। তারপর মিটিমিটি হেসে প্রশ্ন করেনÑ, ‘আচ্ছা তোমার হলো কী বলো তো! ক’দিন ধরেই লক্ষ্য করছি, তোমার মনের আকাশে শেষ শ্রাবণের ঘন মেঘ, আবার ঠিক সেই মেঘের ফাঁকেই রোদেল ঝিলিক! সেই সাথে হঠাৎ হঠাৎই গেয়ে ফিরছো নির্দিষ্ট একটা গানের কলি?
স্ত্রীর কথা শুনে হুমায়ুন খানিকটা ঝিম মেরে গেলেন। তারপরই উনার কণ্ঠ বেয়ে বোতল থেকে তেল চুঁইয়ে পড়ার মতো গানটার ওই নির্দিষ্ট কলিটাই নেমে এলো। ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান.........। গানের কলিটা কানে যাওয়া মাত্রই পাশের রুম থেকে তিন ভাইবোন মিলে হল্লা করতে করতে মা-বাবার রুমে গিয়ে গোল হয়ে বসলো। শান্তা আবদার করলো, ‘পুরো গানটা গাও না আব্বু, কতোদিন তোমার গান শুনি না।’ ওর প্রস্তাব শোনা মাত্রই রাকিব উঠে গিয়ে খাটের নিচ থেকে একটা ব্যাগ টেনে তার ভেতর থেকে ডুগি-তবলা বের করে আনলো। ভাইয়ার দেখাদেখি রিক্তা নেমে গিয়ে হারমনিয়াম বের করলো, ওটাও খাটের নিচেই রাখা ছিলো। কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হারমনিয়ামটা অনেকদিন বাজানো হয় না, ফলে ধুলির একটা আস্তর বসে গেছে। ওরা দু’ভাইবোন ডুগি-তবলা আর হারমনির গা থেকে আলগা ধূলো ময়লা মুছে ফেললো। তারপর রিক্তা গানের কলিটা হারমনিতে তুলতে লাগলো আর রাকিব তবলাটায় চাটি মেরে দেখলো টিউন ঠিক আছে কি না। সব কিছু ঠিকঠাক করে আব্বুর দিকে তাকাতেই হুমায়ুন কবির বললেন, ‘পুরো গানটা কিছুতেই মনে করতে পারছি না রে। স্মৃতি বিভ্রাট হচ্ছে ইদানিং। কেবল এ লাইনটাই ক’দিন যাবত জ্বালিয়ে মারছে।’ আব্বুর অপারগতায় শান্তা মায়ের দিকে তাকালো। ওরা জানে মা-ও একসময় খুব ভাল গান করতেন। সাদিয়া স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে সমর্থনের আভাস পেলেন। তারপর গাইতে শুরু করলেনÑ
আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান।
কোথা সে আরি অভেদ যাহার জীবন-মৃত্যু-জ্ঞান।।
যার মুখে শুনি তওহিদের কালাম
ভয়ে মৃত্যুও করিত সালাম।
যার দ্বীন দ্বীন রবে কাঁপিত দুনিয়া জ্বীন পরী ইনসান।।
স্ত্রী-পুত্ররে আল্লাহরে সঁপি জেহাদে যে নির্ভীক
 সেহে কোরবানী দিত প্রাণ হায়! আজ তারা মাগে ভিখ।
কোথা সে শিক্ষা আল্লাহ ছাড়া
ত্রিভুবনে ভয় করিত না যারা।
আজাদ করিতে এসেছিল যারা সাথে ল’য়ে কোরআন।।

রাকিব ভালোই তবলা বাজায়। চমৎকার দাদরা বাজালো ও। ‘ধা ধি না না তুন না’ বোলগুলো যেন ওর আঙ্গুলের আঘাতে কথা বলে উঠলো। আর প্রথম অন্তরা গেয়ে সঞ্চারিতে ফিরে যাবার সময় মায়ের সাথে রিক্তাও এমনভাবে গলা মেলালো যে বোঝাই গেলো না, একজন নাকি দু’জনে গাইছে। গানটা থেমে গেলেও সুরের রেশটা রয়ে গেল বেশ কিছুক্ষণ। শান্তার হঠাৎ হাততালি ওদের বাস্তবে ফিরিয়ে আনলো। হাততালি দিয়ে শান্তা ঘোষণা দিলো ‘মারহাবা মারহাবা’। ‘দারুণ গেয়েছো আম্মু’ বলে রিক্তা গিয়ে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরলো। রাকিব বললো, ‘আম্মু, তোমার কণ্ঠ সেই আগের মতোই আছে।’ স্বামীর সামনে ছেলেমেয়েদের উচ্চকিত প্রশংসা শুনে সাদিয়া একটু লজ্জাই পেলেন। লজ্জা লজ্জা চেহারা নিয়ে তিনি স্বামীর দিকে তাকালেন। কিন্তু তাকায়েই একটা ধাক্কা খেলেন সাদিয়া। আম্মুর লাজুক হাসিমাখা মুখটা মুহূর্তেই ছাই বর্ণ হয়ে যেতে তিন ভাইবোনই মায়ের দৃষ্টি অনুসরণ করে অবাক হয়ে দেখলো, হুমায়ুন কবিরের চোখ দিয়ে নিরবে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে নামছে। এ কী! উনি কাঁদছেন কেন?
সাদিয়া আক্তার তাঁর চব্বিশ বছরের বিবাহিত জীবনে স্বামীকে কখনও কাঁদতে দেখেন নি। কিন্তু আজ ওঁর কী হলো, উনি কাঁদছেন কেন? তবে কী তিনি স্বামীর মনে কোন ব্যথা দিয়েছেন? সাদিয়া নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেন না। তাঁর ডানপাশে বসা স্বামীর বাঁ হাতটি তিনি ডানহাতে খপ করে চেপে ধরে ব্যাকূল কণ্ঠে জানতে চাইলেনÑ, ‘এ্যাই, কী হয়েছে তোমার! হ্যাঁ, কাঁদছো কেন?
হুমায়ুন অনেক কষ্টে কোনমতে নিজেকে সংযত করে বললেন, ‘না না, তেমন কিছু না।’
‘Ñতবে কাঁদছো কেন?’ ব্যাকূল হয়ে জানতে চাইলেন সাদিয়া।
হুমায়ুন কবির জানালেন, ‘Ñসত্যিকারের মুসলমানের খোঁজে আমার এ কান্না।’
সাদিয়া বললেন, ‘মানে?’
হুমায়ুন কবির বললেন, ‘তার আগে বলো- এদেশে মুসলমানরা কতো শতাংশ?’
‘-তা, প্রায় আশি শতাংশ।’ মায়ের হয়ে রিক্তাই আব্বুর প্রশ্নের জবাব দিলো।
হুমায়ুন কবির খেদ ভরা কণ্ঠে বললেনÑ, ‘তা হলে ধরে নেওয়া যায় যে, এদেশের ব্যবসায়ীদের প্রায় আশি শতাংশ ব্যবসাদার, অন্তত তোমার শুমারী যদি সঠিক হয়। এবং এ বিষয়টিই আমাকে আজ ক’দিন ধরে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে।’
রিক্তা কিছুই বুঝতে না পেরে আব্বুর দিকে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো।
‘Ñআব্বু, ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না’ প্রশ্নটা করে হুমায়ুন কবিরের দিকে চেয়ে রইলো রাকিব।
হুমায়ুন কবির বললেন, ‘এটা মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ট দেশ, এদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করছে সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম ব্যবসায়ীরা। আর আমরা এমন একটা দেশে বসবাস করছি, যারা সম্পূর্ণভাবে এসব ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছি।’
‘-জিম্মি হয়ে পড়েছি মানে?’ জানতে চাইলেন সাদিয়া।
‘মানেটা খুব সহজ। এদেশের এই সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম ব্যবসায়ীরা নিজেদের ইচ্ছে মতো নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিভিন্ন উৎসব-পার্বণ এলে তো কথাই নেই। এই যে রমজান শুরু হয়েছে; বাজারে গিয়ে দেখে এসো জিনিসপত্রের কী পরিমাণ দাম বেড়েছে। যে যেভাবে সুযোগ পাচ্ছে, ফায়দা তুলে নিচ্ছে। প্রতিদিনই হু হু করে বেড়ে যাচ্ছে পণ্যমূল্য। এদেশের প্রায় সত্তর পার্সেন্ট লোক দরিদ্র সীমার নিচে বসবাস করে। পণ্যমূল্যের সাথে পাল্লা দিয়ে তাদের আয় বাড়ছে না। ফলে আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে সামাজিক অপরাধ বাড়ছে। ইচ্ছে করলেই এখানে কেউ ভাল থাকতে পারছে না। দুঃখজনকভাবে বলতে হচ্ছে, পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারী কোন পদক্ষেপও চোখে পড়ছে না। দায়সারা গোছের একটা বক্তব্য-বিবৃতি দিয়েই সরকার জনগণকে ভুলিয়ে রাখতে চেষ্টা করছে আর মিডিয়াতে ফলাও করে প্রচার করছে, আমার সরকার হ্যান করেছে, আমার সরকার ত্যান করেছে। অথচ আশ্চর্য ব্যাপার কী জানো, যে সরকার এসব দরিদ্র-অনাহার কিষ্ট জনগণের কর আদায় করে দেশ চালাতে কর্তৃত্ব তুলে নিচ্ছে, তারা কিন্তু কেউ-ই খারাপ অবস্থানে নেই। তাঁদের গাড়ির অভাব নেই, বাড়ির অভাব নেই, চাকর-বাকর, আরদালি-পিয়ন, মালি-ধোপা-নাপিত ইত্যাদির সুযোগ সুবিধা পেয়ে তারা বেশ বহাল তবিয়তেই আছে। আরও আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানোÑ; সরকার বলো, বিরোধী দল বলো অর্থাৎ রাজনীতির সাথে সংশ্লিষ্ট প্রায় প্রত্যেকেই নামে বেনামে ব্যবসার সাথে জড়িত। তো, তারা কেমন করে সাধারণ মানুষের দুঃখ দুর্দশা অনুভব করবে, বলতে পারো?” কথা ক’টি একনাগাড়ে বলে একটু দম নেন হুমায়ুন কবির।
স্বামীর দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থেকে একটু বোঝার চেষ্টা করলেন সাদিয়া। তারপর বললেন, ‘কে বলেছে সরকার জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা ভাবছে না, বা পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করছে না? এই তো সেদিন পত্রিকায় পড়লামÑ, বেগুন, কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ ও রসুন এই চারটি পণ্যের রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে সরকার। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, ঈদুল ফিতরের পরের সপ্তাহ পর্যন্ত এই চার পণ্য রপ্তানি করা যাবে না। রমজানে দেশে সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যেন স্থিতিশীল থাকে, সেজন্য জরুরি ভিত্তিতে কয়েকটি পণ্যের রপ্তানি বন্ধ কিংবা নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারের কাছে আহ্বান জানায় দেশের ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই।
স্ত্রীর কথা শুনে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন হুমায়ুন কবির। বললেন, ‘যার কোন গুণই নেই, সেই বেগুন রপ্তানি বন্ধ করে সরকার কী দেশের আমজনতাকে শুধু বে-গুণ(ন) বানাতে চায়?’
আব্বুর এ কথাটায় ফোড়ন কাটে পিচ্চি শান্তা। ও’ খুব ভাব-গম্ভির হয়ে বলে, ‘কে বলেছে আব্বু যে, বেগুনের গুণ নেই? বেদানায় (ডালিম জাতীয় ফল) যদি দানা থাকে, তবে নিশ্চয়ই বেগুনেরও গুণ আছে।’ ওর কথা শুনে হুমায়ুন কবির ছাড়া বাদবাকি সবাই হো হো করে হেসে উঠে।
শান্তার কথার রেশ ধরে রিক্তা বললোÑ, ‘সত্যিই তো, বেগুনের যদি গুণই না থাকতো তবে কাজী নজরুল তার কবিতায় বেগুন নিয়ে রসিকতা করতেন না। এই যেমন, “গুণিরা খান বেগুন পোড়া, বেগুন চড়ে গাড়ি-ঘোড়া।” ওর কথা শুনে আরেকবার হাসির তুফান উঠে।
ওদের হাসি থামলে হুমায়ুন কবির বলেনÑ, শোন সাদিয়া। পত্রিকার কথাই যখন তুললে, তখন শোনÑ, রমজানে কম দামে পণ্য খাওয়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার। কিন্তু কোনো নিত্যপণ্যের দামই ক্রেতার হাতের নাগালে নেই। শবে বরাতের ঠিক আগে এক দফা বাড়ানোর পর চার দিনের মধ্যে আরেক দফা বেড়েছে পণ্যের দাম। কয়েক বছর ধরেই দাম বাড়ানোর কাজটি রমজানের আগেই সেরে নেওয়ার কৌশলে ব্যবসায়ীরা এবারও সফল হলেন। আর এর সত্যতা নিশ্চিত করছে সরকারি বিপণন সংস্থা  ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ওয়েবসাইট। সেখানে দেখা যায়, মূল্যবৃদ্ধির তালিকায় থাকা পণ্যের দীর্ঘ সারি। ব্যবসায়ীরা একদিকে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিচ্ছেন, অন্যদিকে দাম বাড়ানো হবে না বলে প্রতিশ্রুতিও দিচ্ছেন সরকারকে। বাজারের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই সরকারের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং নামেই শুধু আছে, এর কোনো কার্যকারিতা নেই। এ যেন কাজীর গরু; হিসেবের খাতায় আছে কিন্তু গোয়াল শূন্য। কী বুঝলে? পেঁয়াজ-রসুনের বাজারে আগুন, ভোজ্য তেলের দাম বেড়েছে, শাক-সব্জির বাজার অস্থির, ডাল জাতীয় শষ্যের মূল্য বেড়েছে কয়েক দফা। মাছ-মাংশ তো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ডিমের দাম হাতের নাগাল থেকে বাইরে চলে গেছে। কী খেয়ে রোজা পালন করবে এদেশের মানুষ? তবে কি ধরে নেবো, রমজান শুধু বাংলাদেশের বাঙালিদের কষ্ট দিতেই আসে?’
রাকিব এতোক্ষণ চুপচাপ বাবা-মায়ের কথা শুনছিলো। এবারে ও-ও আলোচনায় অংশ নেয়। বলে-, ‘আব্বু, রমজান তো সিয়াম সাধনার মাস। এ মাসে যদিও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমূল্য বেড়ে যায়, তবে এর একটা সুফলও আছে।’
ওর কথা শেষ হতেই রিক্তা কৌতুহলী হয়ে জানতে চায়, কী রকম ভাইয়া?’
রাকিব বলে, ‘রমজান আসে- সংযম শিক্ষা দিতে। এ মাসে ভোগ্য বস্তু থেকে সংযমী হতে হয়। যেমন কম খাওয়া, কম আরাম করা, কম কথা বলা, পারলে প্রাত্যাহিক প্রাকৃতিক কাজ-কাম ছাড়া আল্লাহর বেশি এবাদত করা। তাই রমজানে যদি জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েই থাকে, তবে আমাদের উচিৎ কম কম জিনিস-পত্র কেনা ও ভোগ করা। তাতে দুই দিকে লাভ। এক. সংযমের অভ্যাস গড়ে উঠলো আর দুই. ব্যয় কম হলো।’
হুমায়ুন কবির তাঁর সন্তানদের বুদ্ধিমান হিসেবেই জানেন, ছাত্রছাত্রী হিসেবেও ওরা এলাকার সেরা। কিন্তু রাকিবের মন্তব্য শুনে তিনি বুঝতে পারলেন না, কথাগুলোতে শ্লেষ মেশানো আছে, নাকি সত্যিই ও’ সংযমী হতে আহ্বান জানাচ্ছে। তিনি তাঁর অপারগতা মনে মনে স্বীকার করে নিয়ে প্রকাশে বললেন, ‘তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না। একটু পরিষ্কার করে বলো তো দেখি।’
রাকিব বললো, ‘পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ার কারণে রমজানে আমরা কম খাবো। শুধু আমরা কেন, দেশের সব মুসলিম সম্প্রদায় কম খেয়ে, কম ভোগ করে সংযমের শিক্ষা লাভ করবে। ব্যাস।’
‘Ñতোমার কথা যদি তাই হয়ে থাকে, তবে.......’ এটুকু বলে ছেলের দিকে তাকান হুমায়ুন কবির। রাকিব আব্বুর চোখের দিকে চেয়েই হকচকিয়ে যায়। আমতা আমতা করে বলে, ‘তবে?’
ছেলের চোখে চোখ রেখেই হুমায়ুন কবির বলেনÑ, ‘তবে তোমার জানা উচিৎ, এদেশে বারো জাতির মানুষের বসবাস। ধরে নাও, ব্যবসায়ীদের অতি লোভের চক্করে পড়ে মুসলমানরা খাওয়া কমিয়ে দিয়ে সংযমী হলো। কিন্তু তাতে করে সব সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। কেননা, এদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান-সাঁওতাল, গারো, খাসিয়া, মার্মা, চাকমা, রাখাইনরা সংখ্যালঘু এবং প্রত্যেকেই নিজ নিজ ধর্ম-কর্ম করে। তো, মুসলমানদের সাথে সাথে তুমি তাদেরও কষ্ট করার কথা বলতে পার না। তুমি এ কথা বলতে পারো না যে, ওরাও রোজা রাখুক, কম খাক। আমি তো মনে করি, রমজান এলে ওরা যে অবর্ণনীয় কষ্ট ভোগ করে, তাতে আমাদের উপর অভিশাপ নেমে আসে। ওরা সম্ভাবত বিধাতার দরবারে ফরিয়াদ জানায় এই বলে যে, হে প্রভু, বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর রমজানটা তুমি ফরজ না করলেই পারতে, ঈদ উৎসব না দিলেই পারতে। এদেশে ব্যবসায়ীদের জন্য আমাদের বড়ো কষ্ট হচ্ছে প্রভু, বড়ো কষ্ট।’ একটু থেমে তিনি আবার শুরু করেনÑ, দুঃখজনক কথা কি জানো! বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম দেশে রমজান এলে পণ্যমূল্য কমিয়ে দেওয়া হয়, যাতে জনগণের কোন কষ্ট না হয়। অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের দেশে বড়দিনের উৎসব কিংবা অন্যান্য পূজা-পার্বণ উপলক্ষে পণ্যমূল্য ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হয়, যেন সর্বস্তরের জনগণ আনন্দের সাথে উৎসব উদ্যাপন করতে পারে। অথচ আমাদের দেশে.................।
ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরে গেছে আমাদের দেশের ব্যবসায়ী সমাজ। অতি মুনাফা ওদের আজ অন্ধ করে দিয়েছে, তাই আজ সাধারণ মানুষের দুঃখ কষ্ট ওরা দেখতে পায় না। ওরা বধির হয়ে গেছে, তাই গরীব-দুঃখি খেটে খাওয়া মানুষের কান্না ওদের কানে পৌঁছুয় না। এদেশের গরীব-দুঃখি অভাবী মানুষের মুখের ভাষাও ওরা কেড়ে নিতে বসেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যমুল্য বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ করার উপায় নেই। প্রতিবাদ করতে গেলেও বিপদ আছে, সহিংসতায় জড়িয়ে পড়ার ভয় আছে। তাই আমার মনে হয়, বাঙালি এসব ব্যবসায়ীরা মুসলমান না, ওদের পরিচয়; ওরা মুনাফাখোর। তা না হলে ওরা খাদ্য মওজুত করে ক্রিতিম সংকট সৃষ্টি করে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে দিতো না। কম মূল্যে উৎপাদকের কাছ থেকে পণ্য এনে উচ্চমূল্যে বিক্রি করতে পারতো না।’ আবেগের উত্তেজনার উনার গলা রুদ্ধ হয়ে আসে। কথা বলতে কষ্ট হয়। তাই কথা শেষ না করে তিনি শান্তাকে একগ্লাস পানি আনতে বলেন, গলা শুকিয়ে গেছে উনার। খাটের কিনারায় বসা রাকিব উঠে গিয়ে এক গ্লাস পানি এনে আব্বুর হাতে তুলে দেয়। হুমায়ুন কবির ঢকঢক করে পান করে শূন্য গ্লাসটা হাতে নিয়েই বলতে থাকেনÑ, শুধু কি তাই! গুদামজাত এসব পণ্যসামগ্রী তরতাজা রাখতে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য মিশিয়ে এরা জনস্বাস্থ্যকে হুমকীর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। চালের মধ্যে মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে কাঁকর, বালি। ইরির মোটা চালকে মেশিনে কেটে এমনভাবে চিকন করে মিনিকেট বানিয়ে বেশি দামে বিক্রি করে গ্রাহকদের ঠকানো হচ্ছে। খোলা আটার মধ্যে বালুর কণা মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যাতে বেশি দামে প্যাকেটজাত আটা বেশি দামে বিক্রি করা যায়। পোকা খাওয়া ছোলা, কীট যুক্ত বেসন, তেল মাখানো খেজুর, কার্বাইডে পাকানো কলা, পোড়া তেলে ভাজা পিঁয়াজু-বেগুনি-চপ, মবিলে ভাজা জিলিপি গেলানো হচ্ছে আমাদের। তাহলে নৈতিকতা কোথায়! ধর্ম কোথায়! সত্য কোথায় হারিয়ে গেলো বলতে পারো? দাড়ি রেখে টুপি পড়ে, হজ্ব করে এসেও এসব ব্যবসায়ীদের ভেতর ধর্মের ছিটেফোটাও চোখে পড়ে না।’ আবেগ আপ্লুত হয়ে তিনি আবারও গাইতে শুরু করেনÑ ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান....।’
দীর্ঘ সংসার জীবনে সাদিয়া তাঁর স্বামীকে চেনেন। তিনি জানেন, হুমায়ুন কোন অন্যায় সইতে পারেন না। জীবনের প্রতিটি স্তরে ধর্মীয় মূল্যবোধকে গুরুত্ব দেন। ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্ট হলেও উনি অন্যান্যদের মতো নৈতিকতাকে বিসর্জন দিতে পারেন নি, পারেন নি মিথ্যা, ছলনার আশ্রয় নিতে। স্বামীর আদর্শকে তিনি দারুণ রকম শ্রদ্ধা করেন। তাই বলেনÑ ‘আচ্ছা, যেসব ব্যবসায়ীরা এসব দুর্নীতি করে লোক ঠকাচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায় না?’
মায়ের কথা শুনে রাকিব বলে, ‘কেন নেওয়া যাবে না। নিশ্চয়ই নেওয়া যায়। আইন আছেও। এখন শুধু এসব দুর্নীতিবাজ, মওজুদদার,  খাদ্যে ভেজাল মিশেলকারী, মুনাফাখোর ব্যবসায়ীদের চিহ্নিত করে শাস্তি দেওয়া যায়। আব্বু, তুমি কী বলো?’
হুমায়ুন কবির চুপচাপ ওদের কথা শুনছিলেন। রাকিব উনার মন্তব্য জানতে চাইলে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের অনৈতিক কাজ থেকে ভোক্তাদের রক্ষা করতেই বিভিন্ন আইন করা হয়। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় শাস্তির বিধান রেখে তাই সম্প্রতি প্রতিযোগিতা আইন করেছে সরকার। হলে কী হবে! এদিকে রাজস্ব আদায়ের অন্যতম খাত মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাট (মূসক) খাতে প্রতিবছরই আদায় বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা। পরোক্ষ এই কর বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির এই সময়ে বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। কিন্তুু এ খাতে শৃঙ্খলা না থাকায় ক্রেতাদের পকেট কাটা যাচ্ছে। সাধারণের কাছ থেকে আদায় করা টাকা ঠিকমত সরকারের তহবিলে জমা হচ্ছে না। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ সহায়তার অর্থ পেতে সরকার সম্প্রতি ভ্যাট আইন যুগোপযোগী করারও উদ্যোগ নিয়েছে। সংশোধিত ভ্যাট আইন সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে রয়েছে। তবে সংশোধিত ভ্যাট আইনটিও প্রকৃত অর্থে  ভোক্তা বান্ধব হয় নি। বাংলাদেশের মত এত বেশি হারে কোথাও ভ্যাট আরোপিত নেই। অন্যান্য দেশে জেনারেল সেলস ট্যাক্স বা জিএসটি নামেও খুচরা বিক্রির ওপর কর নিয়ে থাকে। তবে তা তিন থেকে পাঁচ শতাংশের বেশি নয়। কিন্তুু বাংলাদেশে পনের শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে গিয়ে অন্যান্য করের সঙ্গে মিলিয়ে পণ্যের দামও বেড়ে যায়। আবার পণ্য ও  সেবার বিপরীতে আদায়কৃত এই ভ্যাট সরকারের কাছেও যাচ্ছে না। ইলেক্ট্রনিক ক্যাশ রেজিস্ট্রার বা ইসিআর চালু করা হলেও সুকৌশলে এই মেশিন টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে ভ্যাট ফাঁকি দেয়া হচ্ছে। কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশেও ফাঁকির মহোৎসব চলছে। আবার কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাট আরোপিত না হলেও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট কেটে রাখা হচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে ভ্যাটের নামে জনগণের কাছ থেকে বাড়তি টাকা আদায়ের সুযোগ করে দেওয়ায় পণ্য মূল্য বৃদ্ধির এই দিনে ক্রেতারা মারাত্মক ঠকা ঠকছে।
রক্ষকই যখন ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তখন আইন কেবলমাত্র কাগুজে হয়ে যায়। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যখন নিজেরাই দুর্নীতির সাথে যুক্ত হয়ে পড়ে, তখন বলার আর কিছুই থাকে না। প্রবল চাপে পড়লে এরা ভেজালকারী, ক্রিতিম সংকট সৃষ্টিকারী অনেককেই ধরে, ধরে জরিমানা করে। কিন্তু সত্যটা হলো, এসব ব্যবসায়ীরা জরিমানার টাকা দিয়ে খালাস পেয়ে আবার পুরোদমে আগের মতোই সব শুরু করে।’
রিক্তা বাবার কথায় ভীত হয়ে পড়ে। ব্যাকূল হয়ে জানতে চায়Ñ, ‘তাহলে উপায়?’
মেয়ের প্রশ্ন শুনে হুমায়ুন কবির বলেন, ‘-হ্যাঁ মা, উপায় নিশ্চয়ই আছে। উপায়টা হচ্ছে ব্যক্তির ভেতর সত্যিকারের ধর্মীয় বোধকে জাগিয়ে নিজেকে শুদ্ধ করে তোলা। নামকাওয়াস্তে মুসলমান হয়ে কোন লাভ নেই। এদেশের মসজিদ ভর্তি মুসুল্লি অথচ মনের মসজিদ শূন্য পড়েই রইলো, আবাদ হলো না। যে কলেমা-নামাজ-রোজা-হজ্ব-যাকাত মনের মাঝে আল্লাহর প্রেম জাগায় না, সে ধর্ম কর্মে কোন ফায়দা নেই। নামের আগে মোহাম্মাদ শব্দ জুড়ে দিয়ে, দাড়ি রেখে, টুপি পড়ে, ইসলামি লেবাস ধরে বাইরে মুসলমানের রূপ ফুটিয়ে তোলে কোন লাভ নেই। লাভ তখনই হবে, যখন নিজের বুকের ভেতর সত্যটা উপলব্দি করার ক্ষমতা জন্মাবে। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। অথচ সেই ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষগুলো মুসলমান নাম ধারণ করে সেই বিধানের মর্যাদা রক্ষা করছে না। বিশ্বের অন্যান্য ধর্মের লোকেরা তাদের নিজ নিজ ধর্মীয় বিধানকে যেভাবে মেনে চলে, ভয় পায়; মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ততোটা মেনে চলে না বলেই এই অরাজকতা।
ধর্ম মানুষকে কী শিক্ষা দেয়! ধর্ম শিক্ষা দেয় সৎ জীবন যাপন করতে, অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে, কাউকে ঠকিয়ে নিজে লাভবান না হতে। জাগতিক ও পরকালীন মুক্তির জন্যই ইসলামের আবির্ভাব। কিন্তু বাংলাদেশে তা হচ্ছে কই? এখানে তো ঠিক এর উল্টো চিত্র চোখে পড়ে। বড়ো দুঃখের সাথেই বলতে হয়, এদেশে মজুরেরও ন্যায্য মজুরি দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা হয়। এদেশে সবাই ব্যবসায়ী, শুধুই ব্যবসায়ী। তাই আমি বড়ো বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি দিনকে দিন। বিভ্রান্ত আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলও হয়েছিলেন। তাই তাঁকে খুঁজতে হয়েছিলোÑ ‘আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা’ সে মুসলমান।’ নজরুলের মতোই এখন আমার মনের অবস্থা। আমিও সেই পূর্ণ ঈমানদার মুসলমানের খোঁজ করছি, অথচ পাচ্ছি না। যদিওবা কাউকে কাউকে পাচ্ছি, তাঁরা কেউ এক হতে পারছে না। থাক এসব কথা। রাত অনেক হলো, তোমরা অনেক পথ জার্নি করে এসেছো। যাও বিশ্রাম নাও।’
সাদিয়া দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখেন রাত দু’টো। রমজানের প্রথম সেহেরি শুরু হবে আর ঘণ্টাখানেক পর। বাবার নির্দেশ পেয়ে শান্তা, রিক্তা এবং পাশের রুমে বিশ্রাম নিতে যায়। ওরা চলে গেলে সাদিয়া এসে হুমায়ুন কবিরের সামনে পা ভাঁজ করে বসে স্বামীর হাত দু’টো কোলে টেনে নেন। স্ত্রীর ছোঁয়া পেয়ে হুমায়ুন কবিরের থমথমে মুখে খানিক হাসির রেখা ফোটে উঠে। কিন্তু এ হাসি বড়ো কিষ্ট, বড়ো বেদনার, সাদিয়া তা টের পান। পরম মমতায় নিজের দু’হাতে ধরা স্বামীর হাত দু’টোতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলেন-, কী হলো! ঘুমাবে না!!
‘-কী হবে ঘুমিয়ে, একটু পরেই তো সেহেরি খেতে উঠতে হবে। তারচে’ বরং এ ঘণ্টা খানেক মুখোমুখি বসে থাকি। আর মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকি, মহান প্রভু যেন আমাদের মনে সতত বিরাজ করেন, আমরা যেন অন্তত আর সবার মতো ¯্রােতে গা না ভাসিয়ে দিই।’ কথা ক’টি বলে সাদিয়ার দু’হাত নিজের দু’হাতের মুঠোয় চেপে ধরেন। সাদিয়া হুমায়ুন কবিরের হাতে প্রশান্তি আর নির্ভরতার ছোঁয়া খোঁজে পান। হাতটি তিনি ধরেই থাকেন ঘোষণা স্থানীয় মসজিদ থেকে সেহেরির ঘোষণা না হওয়া অব্দি।
বি:দ্র: লিখতে গেলে প্রায়ই নাম নির্বাচনের বিভ্রাটে ভোগতে হয়। তাই এ লেখার পাঁচটি চরিত্রের মধ্যে যদি কোন ব্যক্তি বা পরিবারের নামের সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়, তিনি বা তারা যেন ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখেন। -লেখক।

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ