প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Monday, July 2, 2012

বঙ্গের নদীখাদক বনাম প্রতিবেশি মাসতুতো দাদাগণ | তৈয়ব খান

আমরা কতিপয় বাঙালি এই মর্মে ঘোষণা করিতেছি যে, সর্বপ্রকার চর্বণ-চুষ্য-লেহ্য-পেয় খাদ্যবস্তু অতিশয় আনন্দের সাথে গ্রহণ করিয়া থাকি। রসনায় আমাদের কান্তি নাই। আমরা খাইব এবং খাইতে থাকিব। সর্বপ্রকার খাবারেই আমাদের অত্যাধিক রুচি রহিয়াছে। বোধ করি সর্বভূক তেলাপোকাও আমাদের রুচির কাছে নতি স্বীকার করিবে। তেলাপোকা সকল কিছু খাইয়া যদি হজম করিতে পারে, আমরা আশরাফুল মাকলুকাত হইয়া উহা পারিব না কেন? আমাদের পারিতেই হইবে, কেননা আমরা তো আর বিধাতার জাত মারিতে পারি না। আমরা পাহাড় খাইয়া রেকর্ড করিয়াছি, বনজঙ্গল খাইয়া সাবাড় করিয়াছি। আমাদের মত এইরূপ আর কেহ পারে নাই। এইবার আমরা নদী খাওয়া শুরু করিয়াছি। নদী খাওয়াতে যে কী পরিমাণ আনন্দ উহা যে না খাইয়াছে, তাহাকে বুঝাইবার মত বিড়ম্বনা আর নাই। তবে তাহাদের জ্ঞাতার্থে শুধু এইটুকুই বলিব, নদী ভক্ষণের সুখ খানিকটা ঘুষ খাওয়ার মতই মজাদার। বলিতে কি, ঘুষ খাওয়ার মধ্যে খানিকটা রিস্ক থাকিয়া যায় কিন্তু নদী খাওয়ায় কোন রিস্ক নাই এবং যেহেতু রিস্ক নাই, সেহেতু ইহা খাইতে ভয় কিসের? ইহা আমরা ১০০% হালাল খাবার মনে করিয়াই খাইতেছি। অবশ্য আমরা এইরূপ খাইতে পারিতাম না, ভারতমাসির কতিপয় সুসন্তান আমাদের খাওয়া সহজ করিয়া দিয়াছে। সম্পর্কে উহারা আমাদের মাসতুতো দাদা, তাই অপর ভাইদের প্রতি উহাদের মমতা থাকাটা খুবই স্বাভাবিক। উহারা আমাদের গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র নদী প্রবাহকে খাইয়া ফেলিতেছে। প্রতিবেশি মাসির দেশ ভারতের মাসতুতো ভ্রাতাগণ আন্ত:নদী সংযোগের মাধ্যমে সমস্ত জল নিজেরা পান করিতেছে। এখন উহারা পরিকল্পনা করিতেছে আরও ৫৩টি নদীর জল বাঁধ দিয়া নিজেরা পান করিবে। কেননা, উহাদের একটি মহৎ উদ্দেশ্য আছে। সেই উদ্দেশ্যটা হইতেছে, দিনে দিনে বঙ্গমাতাকে সাহারা, গোবি, আতাকামা মরুভূমি করিয়া দেওয়া। যাহার জন্য উহারা ফারাক্কা বাঁধ, গজালডোবা বাঁধ, টিপাইমুখ বাঁধ ইত্যাদি নির্মাণ করিয়াছে। মাসতুতো দাদাদের আন্ত:নদী সংযোগ বাস্তবায়ন সম্পন্ন হইলে বঙ্গবালা আর নদীমাতৃক থাকিবে না, মরুমাতৃক হইয়া যাইবে বলিয়া নদীবিশেষজ্ঞগণ আনন্দবার্তা শোনাইয়াছেন। আন্ত:নদী সংযোগ হইতেছে একটি মহান ও বিজ্ঞানভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা। প্রকৃতিকে নিজেদের মতন করিয়া গড়িয়া লইতে পারিলে কতবড় বিজ্ঞান সাধনা হইবে, উহা একটি ভাবিবার বিষয়ও বটে। টেকনোলজিতে চৌকস ভারতমাসি আগামী ৫০ বছরের ক্রমবর্ধমান জল ও খাদ্যের চাহিদা মিটানোর লক্ষ্যে দেশিয় ৩৮টি নদীকে ৩০টি সংযোগকারী খালের মাধ্যমে জুড়িয়া দিয়া এক নদীর বেসিন হইতে অন্য নদীর বেসিনে জল স্থানান্তর করিবার পরিকল্পনা আঁটিয়াছে। সেই জন্য বাঁধ দিয়া নদীর গতিধারা পাল্টাইয়া দিতেছে। উহাদের দেওয়া বাঁধের নামগুলোও কর্ণে মধু ঢালিয়া দেয়। কী সুন্দর সুন্দর একেকটি বাঁধের নাম! আহা মরি মরি! ফারাক্কা হইতেছে নট ফার ফ্রম অক্কা অর্থাৎ মরণ থেকে দূরে নহে। গজলডোবা হইতেছে; গজাল মারিয়া ডুবাইয়া দেওয়া, আর টিপাইমুখ হইতেছে টিপিয়া মুখ বন্ধ করিবার অপূর্ব কৌশল। জাতিসংঘ পানিবিশেষজ্ঞ ড. এসআই খান (আমার জাত ভাই, অর্থাৎ খান ভাই) আনন্দের সাথে জানাইয়াছেন, গঙ্গা পানি চুক্তিতে আমাদের অনেক সফলতা রহিয়াছে। সফলতাগুলি হইতেছে- চুক্তিতে পানি পাওয়ার গ্যারান্টি কজ যেমন নাই, তেমনি পানি না পাইলে আরবিট্রেশনের সুযোগও নাই। হিসাবে নাকি ধরা হইয়াছে ফারাক্কা পয়েন্টের প্রাপ্ত পানি। কী চমৎকার কথার্বার্তা! ফারাক্কা পয়েন্টের পানিপ্রবাহ শূন্য হইলে সেই শূন্যকে তো আর ভাগ করা চলে না। গঙ্গার ৭২% পানি আসে নেপাল থেকে, ১০% আসে চীন থেকে এবং ভারতের অংশ মাত্র ২০%। অথচ তাহারা পুরোটাই নিজের মনে করিয়া হজম করিতেছে। কেননা, নদীর পানি পান করিয়া বঙ্গবালা কি আমাশয়ে ভুগিবে! বাঙালির তো ভাল খাবার খাইয়াই এমনি এমনিই পেট খারাপের অভ্যাস আছে। সুতরাং ভারতমাসি আমাদের এত বড় ক্ষতি নিশ্চয়ই করিতে পারেন না। নদীর জল পান করিয়া বাঙালি মরিবে ইহা কোনক্রমেই মাসির কামনা হইতে পারে না। বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পানি কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. সাব্বির মোস্তফা খান (উনিও আমার জাত ভাই, কেননা আমরা শুধুই খাই। খাই বলিয়াই এত চিন্তা, এইজন্যই আমরা খান) মারাত্মক আনন্দের সাথে জানাইয়াছেন, ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প বাস্তাবায়ন হইলে; আমরা এখন যে পানি পাই, উহাও পাইব না। ফলে ভূ-গর্ভস্থ পানির তীব্র সংকট দেখা দিবে। আর্সেনিক বাড়িয়া যাইবে, বঙ্গপসাগর হইতে নোনা পানি প্রবেশ করিবে, অসুন্দরবন ধ্বংস হইয়া সুন্দরবন হইবে। শষ্য ও পশু সম্পদের উৎপাদন হ্রাস পাইবে (পাইলেই ভাল, এত শষ্য কে খাইবে? পশু বাড়িয়া গেলে গুতা কিংবা কামড় খাইবার ভয় আছে। আশঙ্কা হইতেছে, প্রফেসর সাহেবের কথা ফলিবে তো? নাকি শুধু শুধু আনন্দের সংবাদ দেওয়া! আর্সেনিক শব্দটায় কী চমৎকার একটা রিনিঝিনি বাদ্য আছে। কেমন কাব্যিক একটা শব্দ আ-র্সে-নি-ক। আহাহা! আগের দিনে মানুষের কেমন আজেবাজে রোগ হইত। সবরোগের শেষেই ইয়া ইয়া। যেমন: ডিপথেরিয়া, পাইয়েরিয়া, ডাইয়েরিয়া, ম্যালেরিয়া, গনেরিয়া, লিউকোমিয়া, হার্নিয়া। অথচ এখন মানুষ কতো সুন্দর রোগে আক্রান্ত হয়। নামের কি বাহার! কেমন বিদেশি বিদেশি লাগে। এখনকার রোগগুলির শেষে ‘ইস্’ আর ‘আস্’ যুক্ত থাকে। যেমন: ব্রঙ্কাইটিস, এপেন্ডোসাইটিস, হুপিংকাশ। ধন্য তুমি ভানুবাবু। আর্সেনিকে কোন প্রকারে যদি আক্রান্ত হওয়া যায়, কতই না মধুর সময় কাটিবে! আহহারে! এই রোগে যে তামাম বাঙালি করে আক্রান্ত হইবে! কেমন ‘ইক’ করা একটা শব্দ! অদূর ভবিষ্যতে এই ‘ইক’ নিয়া কাব্য লিখিব বলিয়া এই মুহূর্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম)। বঙ্গ সন্তানের অসম্ভব রকমের সুন্দর স্বাস্থ্যহানী হইয়া স্লিম ফিগারে পরিণত হইবে, গ্ল্যামার বাড়িবে। হাড্ডির সাথে চর্মের মিলনে বাঙালি হাড্ডিচর্মসার হইয়া পড়িবে, ভাবিলেই মনে পুলক জাগে! অথচ কী আশ্চর্য! ভারতমাসির এই চমৎকার কর্মকা-ের কেহ কেহ বিরোধিতাও করিতেছে। কত বড় সাহস! ইচ্ছা করে, ওই বিরোধীদের নাসিকায় মুষ্ঠাঘাত, পশ্চাতে পদাঘাত, পৃষ্ঠে বেত্রাঘাত, গ-ে চপেটাঘাতের ন্যায় যত প্রকার আঘাত রহিয়াছে, তাহাই করি, আঘাতে আঘাতে জর্জরিত করিয়া দেই। কেননা, ভারতের আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্প সম্পর্কে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মতিন জ্ঞাত করাইয়াছেন যে, ২০০৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতমাসির পরিবেশবাদিদের যৌথ আন্দোলনের মুখে ভারত সরকার হিমালয়ভিত্তিক নদীগুলিতে আন্ত:নদী সংযোগ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রাখে। বাংলাদেশে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে কয়েকটি সম্মেলন হইয়াছে। যদিচ ভারত আন্তর্জাতিক নদীগুলিতে বাঁধ বন্ধ রাখিলেও নিজস্ব নদীগুলিতে আন্ত:সংযোগের কাজ অব্যাহত রাখে। এরই মধ্যে ভারতমাসি তার নিজের অভ্যন্তরে প্রায় ৭০০ বাঁধ নির্মাণ করিয়াছে। এই প্রকল্পটি মাসির একটি অতি পুরাতন পরিকল্পনা। টিপাইমুখ এই পরিকল্পনারই অংশ। ২০০২ সালে এই প্রকল্প নিয়া তোড়জোড় শুরু হইলে বাংলাদেশ, ভারত ও নেপালে আন্দোলন শুরু হয়। কারণ এই প্রকল্পের ফলে বাংলাদেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হইবে; তেমনি ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হইবে। ইহা বাস্তবায়ন হইলে বাংলাদেশ ও ভারতের ৯টি রাজ্য মরুভূমিতে পরিণত হইবে। ফলে দুই দেশের উদ্যোগে যৌথ প্রতিবাদের মুখে তৎকালীন ভারত সরকার কাপুরুষের মত পিছু হটে। ব্রহ্মপুত্র নদ হইতে পানি নিতে হইলে উত্তর-পূর্ব ভারত ও মধ্য-ভারতে অন্তত দুইটি রাজ্যে পাহাড়ের উঁচু  প্লেটের ওপর দিয়া পানি নিতে হইবে। এইজন্য বিশেষ যন্ত্রচালিত মেশিন ব্যবহার করিতে হইবে। যাহা হইবে খুবই ব্যয়বহুল। ওই পানি দূর-দূরান্তে নেওয়ার সময়ও অনেক অপচয় হইবে। এই কারণে ওই সময় গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এ প্রকল্পের পানি না নেওয়ার ঘোষণা দিয়াছিলেন। ইহাছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভারতের পশ্চিমাঞ্চলের খরা পরিস্থিতির উন্নতি হইয়াছে, সেইখানে বৃষ্টি হইতেছে, এমনকি বন্যাও হইয়াছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ওইসব এলাকার পানির সমস্যা দূর হইয়াছে। ফলে ওই অঞ্চলে এই নদী সংযোগ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা অনেকটাই কমিয়া গিয়াছে। ইহারপরও ভারতীয় এবং বিদেশি কিছু বেনিয়াগোষ্ঠী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাহিতেছে। কারণ সেইখানে বিশাল বিশাল ঠিকাদারি পাওয়া যাইবে, বাঁধ হইবে, খাল খনন হইবে, রাস্তা তৈয়ার হইবে, যাহার সঙ্গে জড়িত রহিয়াছে হাজার হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য। ফলে বেনিয়াগোষ্ঠী এই প্রকল্পের বাস্তবায়ন চাহিতেছে। এই পরিবেশবিদ বলেন, বাংলাদেশের মিঠা পানির তিন ভাগের দুই ভাগই আসে ব্রহ্মপুত্র দিয়ে। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হইলে ওই নদীর ৬০ ভাগ পানি উজান হইতে চলিয়া যাইবে। এমনিতেই চীন ব্রহ্মপুত্রের ওপর বাঁধ নির্মাণের পাঁয়তারা করিতেছে। তাহার উপর এই ৬০ ভাগ পানি প্রত্যাহার হইয়া গেলে বাংলাদেশ ও ভারতের ৯টি রাজ্যের জন্য এক অমানবিক পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে।
হইলে হইবে। তাহাতে কাহার কি যায় আসে! বঙ্গবালা মরুভূমি হইবে। পৃথিবীর অন্যান্য মরুদেশ কি বাঁচিয়া নাই? যদি কেউ অন্তর্জাতিক নদীতে বাঁধ দিয়া প্রতিবেশি দেশভগ্নিকে মরুভূমি বানাইতে চায়, তবে তাই করুক। কেননা, মরু জীবনযাত্রার প্রতি আমাদেরও আকর্ষণ কম নয়। তাই ভারতমাসির এই শুভ উদ্দেশ্যকে আমরা স্বাগত জানাইয়া, মাসতুতো দাদাদের সাথে আমরাও একাত্মতা ঘোষণা করিয়া কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়াছি। তাহার একটি হইতেছে নদীভক্ষণ, আরেকটি নদীদূষণ। অপরাপর আরও কিছু কার্যক্রম আমাদের হাতে আছে, সেসব লইয়া পরে আলোচনা করিলেও চলিবে। মাসতুতো ভাইদের কল্যাণে যে সমস্ত নদী ইতোমধ্যে শুকাইয়া গিয়াছে, আমরা সেইসব নদীর জমি দখল করিয়া লইতেছি। কিছু নদীর নিচুজমি আমরা মাটি দ্বারা ভরাট করিয়া দিতেছি। এইসব জমিগুলিকে আমরা প্লট আকারে বাঙালদের কাছে বিক্রয় করিতেছি। শুধু মাত্র মাসতুতো ভাইয়েরাই ব্যবসা করিবে, ইহা মানিয়া লই কী প্রকারে! উহাদের সাথে আমরা এখন প্রতিযোগিতায় নামিয়াছি, দেখি কে কত লাভ করিতে পারে। ইতোমধ্যে আমরা দেশের প্রায় সকল নদীর উপরেই দখল প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছি। আমরা নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যায় আগ্রাসন চালাইয়াছি। অবৈধ বালু উত্তোলন করিতেছি এবং ইহা বেসরকারিভাবে। সরকারিভাবেও আমাদের কাজের ইন্ধন পাইতেছি। পর্যটন কর্পোরেশন, মৎস উন্নয়ন কর্পোরেশন, নৌবাহিনীর জেটি ইত্যাদি সংস্থা আমাদের সাথে হাত মিলাইয়া নদী ভরাট করিতেছে। ইহা ছাড়া শীতলক্ষ্যার দুই পাড়ে মীর সিমেন্ট, সিমেক্স ডকইয়ার্ড, পূবালী সল্ট, মেরিন টেকনোলজি, ডিপিডিসি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, নারায়ণগঞ্জ খাদ্য গুদাম, আকিজ সিমেন্ট, পারটেক্স, ড্যানিশ, ক্রাউন সিমেন্ট, শাহ সিমেন্ট ইত্যাদিরা যে যেভাবে পারিতেছি নদীর দখল লইতেছি। আমরা মেঘনা নদীর দখল করিতেছি। বঙ্গদেশে আমাদের এইরূপ রঙ্গ করিয়া নদীর জমি দখল করায় ইতোমধ্যে মিডিয়াতে অনেক খবর প্রচার হইতেছে। কিন্তু আমরা তাহা থোড়াই কেয়ার করি। এত কেয়ার করিয়া চলিলে বাণিজ্য চলে না। তবে মিডিয়াতে আমাদের বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ হইলে আমাদের গাত্র জ্বালা করে। এইরূপ জ্বালাময়ী খবরের অন্ত নাই। উহারা কুমিল্লার গোমতী নদীর পাড় কাটিয়া সাবাড় করার খবর প্রকাশ করিয়াছে। নদীর পাড়ের মাটি কাটা দ্রুত বন্ধ না করিলে নদীর ক্ষতি তো হইবেই, পাশের রেলসেতুটিও হুমকির মুখে পড়িবে বলিয়া যে খবর প্রকাশিত হইয়াছে, তাহাদের আমাদের ভ্রুক্ষেপ নাই। গোমতী নদীর দুই পাড়ের প্রায় ৩৮ কিলোমিটার এলাকা জুড়িয়া আমাদের মাটি কাটার উৎসব চলিতেছে। কুমিল্লার সীমান্তবর্তী এলাকা কটক বাজার হইতে বুড়িচং উপজেলার কংসনগর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়িয়া শত শত ট্রাক্টরে করিয়া প্রতিদিন পাড়ের মাটি কাটিয়া লইয়া যাইতেছি। এইভাবে কীর্তনখোলা নদী ভরাট করিয়া বিশাল এলাকা লইয়া আমাদের জ্ঞাতিভাই অপসোনিন তাহাদের কারখানা নির্মান করিতেছে। যদিও কীর্তনখোলার জমি দখলের পাশাপাশি নলছিটি উপজেলার বিভিন্ন মৌজার জমি দখলের অভিযোগে এই পর্যন্ত ৮টি মামলা দায়ের হইয়াছে। আরও দুইটি মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হইয়াছে। কিন্তু আমাদের জ্ঞাতি ভাই অপসোনিন কোম্পানীর মালিক প্রভাবশালী ব্যক্তি হওয়ায় তাহারা বহাল তবিয়তেই আছে।
আমরা এইরূপ বহাল তবিয়তেই থাকিব। কেহ আমাদের কিছু করিতে পারিবে না। সরকার আমাদের, বিরোধী দল আমাদের। স্বাধীন দেশে আমরাও সবাই স্বাধীন। এই দেশে যে যেভাবে পারিব মারিয়া কাটিয়া খাইব। তাই বঙ্গবালার প্রায় সব কয়টি নদীর উপরেই আমাদের দখল প্রতিষ্ঠা হইয়াছে। 
পরিবেশবিদদের প্রতি আমাদের বড়ই ক্রোধ জমিয়া রহিয়াছে। ওই বে-আক্কেল পরিবেশবিদরা কেবলই জীব বৈচিত্র লইয়া লাফালাফি করে। উহাদের জানা উচিত- দেশীয় বৃক্ষ-লতা-পাতা-ফুল-ফসল নিমূল করিয়া আমরা নতুন কিছু আবিষ্কার করিতেছি। তাহা কত্ত বড় আবিষ্কার বিজ্ঞান একদিন উহার মূল্য বুঝিবে। অথচ কী আশ্চর্য, পরিবেশবিদদের কাহারও আমাদের এই আবিষ্কারের প্রাতি মানবিক সমর্থন নাই! ছি! ইহা অতিশয় মন্দ স্বভাব। পরিবেশবিদদের স্বভাব পরিবর্তন করিবার সুযোগ আসিয়াছে কিন্তু উহারা সেই সুযোগ আহাম্মকের ন্যায় হাতছাড়া করিতেছে। উহারা জানে না মরুভূমির কত বৈচিত্র! আহাহা! বঙদেশ মরুভূমি হইলে কত্ত মজা হইবে! এই দেশে ক্যাকটাস জন্মাইবে, ম্যানজানিটার ঝোপঝাড় হইবে, কত্ত ধরনের মরু উদ্ভিদ জন্মাইবে! গরুর বদলে লোকজন উট পুষিবে, ছাগলের পরিবর্তে দুম্বা, আর মহিষের পরিবর্তে ঘোড়া পুষিবে। আর মরুজীবনের স্বাদ যে কত্ত আনন্দের, উহা কী কেহই একবারও ভাবিয়া দেখিবে না! আমরা তাম্বুর নিচে বসবাস করিব, কত্ত মজা হইবে! বঙ্গবালার সাথে রঙ্গলীলা করিতে আমরা নদীমাতৃক বঙভূমিকে মরুমাতৃক করিয়া দিব। পরিবেশবিদরা কবি নজরুলের কবিতা “ভেঙ্গে আবার গড়তে জানে সে বড় সুন্দর/তোরা সব জয়ধ্বনি কর/ ঐ নতুনের কেতন উড়ে......” ভুলিয়া গিয়া অকারণে লাফালাফি করিতেছে। বার্ধক্য উহাদের আকড়াইয়া ধরিয়াছে, তাই নতুন সৃষ্টিতে ভয় পায়। সাহিত্যে ‘কাপুরুষ’ বলিয়া অভিশম্পাত করিলেও এই বে-আক্কেল পরিবেশবিদদের একটুও লজ্জা হয় না। ছি!
বঙ্গবালাকে মরুকরণে একটা সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে আমাদের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কে সকলকে জানাইয়া দেওয়ার বাসনা আমরা দীর্ঘকাল বুকের মধ্যে লালন করিয়া চলিয়াছি। কিন্তু সময়ের অভাবে তাহা আর হইয়াই উঠে না। সকলের জানা থাকা দরকার যে, ভারতমাসি পানির মত তুচ্ছ একটা জলজ পদার্থকে আটকাইয়া রাখিয়া বঙ্গবালার নদ-নদীগুলিকে শুকাইয়া দিয়া আমাদের কত কল্যাণ করিয়াছে। এখন ঐ সকল নদ-নদীর জমিসমূহকে আমরা দখল করিয়া লইব। জাতীয় সম্পদ আমাদের ব্যক্তিগত হইয়া যাইবে। কেননা, আমরা তো জাতিরই একটা অংশ। সেই হিসাবে আমরা ঐ জমির নিশ্চয়ই হকদার! দখলিস্বত্বে আমরা সেই জমি বিক্রয় করিব, কল-কারখানা গড়িয়া তুলিব, বাড়ি বানাইব। কৃষিনির্ভর বাংলাকে আমরা শিল্পে সমৃদ্ধ করিব। জমি দখল করিতে আমরা দশের নদ-নদীগুলিতে তিরতির করিয়া বহিয়া যাওয়া জলধারায় প্রথমেই কল-কারখানার বিষাক্ত রাসায়নিক বর্জ দিয়া দূষণ আরম্ভ করিয়া দেখিলাম, তাহাতে বেশ কাজ দিল। বঙ্গভূমির নদ-নদী হইতে ভোজবাজির ন্যায় মৎসকূলের কতক পালাইয়া গেল, কতক মরিয়া ঢোল হইয়া জলে ভাসিতে লাগিল। নদীর জলে সাপ-ব্যাঙ-কুমির-মৎস নির্মূল হইতে না হইতেই পানির স্বাদ ও গন্ধ বিদূরিত হইয়া এমন মনোরম বিটকেলে এবং মোহনীয় দুর্গন্ধ ছড়াইতে লাগিল যে, নাসিকায় ভয়ানক আরামের শিহর অনুভব করিতে লাগিলাম। সুগন্ধি আতরের এমন বিপরীত সুবাসিত দুর্গন্ধে বুঝিয়া গেলাম, কাজ দিবে। আমরা পারিব। এমন বিটকেলে গন্ধজলে স্নান করিয়া যদি কেহ ঈদের জামাতে নামাজে শরিক হয়, তবে সে যে কত কিসিমের পুরস্কার পাইবে, তাহার ভাগ তো কেহ আমাদের দিবে না! নাই বা দিল, আফসোস করিয়া কী লাভ! শেষে পুরস্কারের ভাগ লইতে যাইয়া কোলাকুলির পরিবর্তে কিলাকিলি করিতে আমাদের শখ নাই।
যে সকল উজবুকেরা নদীর জলে মৎস নাই মৎস নাই বলিয়া চেঁচামেচি করে, মৎসের পরিবর্তে আমরা তাহাদের পোল্টির মুরগা খাওয়াইব। ফরেন মুরগার স্বাদ একবার ধরাইয়া দিতে পারিলে পোল্ট্রি করিতে দোষ কোথায়! হাইব্রিড মুরগার মাংশ বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা রূপে আবিভুত হইয়াছে বলিয়াই আমাদের বিশ্বাস। ঐদিকে, নদীর জমি ভরাট করিয়া কারখানা করিতে সমস্যা কোথায়! যদি বেকার সমস্যার সমাধান হয় তবে ফরেন কান্ট্রি থেকে আমরা মৎস আমদানি করিয়া আনিব। আমিষের অভাব পূরণ হওয়া লইয়াই কথা! মাছ খাইব না; মাংশ খাইব, ভাত খাইব না; পোলাও খাইব। চাইকি বিরিয়ানিও হইতে পারে।
কিন্তু আফসোস! আমাদের মহৎ উদ্দেশ্য কেহই বুঝিল না। বর্তমান দুনিয়ায় বুঝদার মানুষের বড়ই অভাব। তবে আমরা আশাবাদি, আমাদের ভাবি বংশধরেরা বুঝদার হইবে। শাখামৃগ কিছু পরিবেশবিদদের সাথে আঁতাত করিয়া সরকার আমাদের কল-কারখানায় কয়েকদফা ভ্রাম্যমান আদালত পাঠাইয়া যদিও বেশ কিছু জরিমানা আদায় করিয়া লইয়াছে। তা করুক না, কত আর আদায় করবে! আমরা উসুল তুলিতে জানি।
আমরা আমাদের কার্যক্রম শতভাগ গতিতে চালাইয়া যাইব। কেহই রোধ করিতে পারিবে না। কিছু লোক অবশ্য চেষ্টা করিবে যাহাতে আমাদের ক্ষতি হয়। তাহা করুক। পৃথিবীর সমস্ত ভাল কাজের বিরোধিতা অনেকেই করিয়াছে, ইতিহাস স্বাক্ষী। আমাদের বিরোধিতাও অনেকে করিবে, আমরা জানি। টেলিভিশনে, পত্রিকায়, ইন্টারনেটে আমাদের কর্মকা-ের বিরুদ্ধে নিয়মিত খবর প্রচারিত হইতেছে, তথ্য আদান প্রদান হইতেছে, রাজপথে মানব বন্ধন হইতেছে। হউক, হ্ইবেই  তো। কিন্তু সকলেই একদিন বুঝিবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমরা আরেকটি কতবড় নতুন মরুভূমি নির্মাণ করিয়া গেলাম। নতুন প্রজন্ম কোনদিন হয়ত আমাদের এই মহৎ কাজের সম্মানে “নদীখাদক” খেতাবে ভূষিত করিয়া মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার জন্য বঙ্গ নামের নতুন মরুর বুকে তিক্তানুষ্ঠান করিবে। কিন্তু ঐ মরণোত্তর পুরস্কার লইয়া আমরা কী করিব, জীবিত থাকিয়াই যদি না পাইলাম! তাই, উহাও আমরা নতুন প্রজন্মকে দান করিয়া দিয়া গেলাম। দানে আমরা হাজি মোহাম্মদ মহসীনকেও ছাড়াইয়া যাইতে চাই, যাহাতে গিনিচ বুকে আমাদের নামও দানবীর হিসাবে লেখা থাকে।
তারিখ: ২৯ জুন, ২০১২

পরিচিতি: কবি, লেখক ও সাংবাদিক এবং  ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, পাক্ষিক সময়ের বিবর্তন
ইমেলঃ auronalok70@yahoo.com

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ