প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Monday, December 19, 2011

আমিও ছিলাম, আমিও থাকব || আল মাহমুদ

বিজয়ের চল্লিশ বছর অতিক্রম করছি। এর মধ্যে কত ঘটনাই ছবির মতো চোখের সামনে এসেই মিলিয়ে যাচ্ছে। আমি অবশ্য অতীত নিয়ে চর্চা করতে অভ্যস্ত নই। কারণ অতীত প্রকৃতপক্ষে কবির মনে একপলক স্মৃতি ছাড়া আর কিছুই নয়। একাকী বসে থাকলে মানুষ স্বভাবতই একটু অতীতাশ্রয়ী হয়ে পড়ে। আর আমি যেহেতু একজন কবি এবং কবি ছাড়া আর কিছুই নই, সে কারণে কবিতা নির্মাণের অনেক স্মৃতি, বিস্তৃতি এবং বিবরণ আমার মনে উদিত হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে। যদিও আমি কবিতা ছাড়াও গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধ লিখেছি অনেক, তবুও আমার সামান্য খ্যাতি ও প্রতিপত্তি কাব্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠা আমাকে মনে মনে পুলকিত করে।
জীবন কাটিয়েছি লিখে, যদিও শুধু কবিতা লিখে একজন কবির জীবন অতিবাহিত হয় না। গল্প, উপন্যাস এবং প্রবন্ধাদিও আমি লিখে গেছি। বর্তমানে আমার দৃষ্টি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। কাছের মানুষকেও আর চিনতে পারি না। কিন্তু কী করে ভুলি যে আমার যৌবনে আমি কবিতাকেই উচ্চকিত করে তুলেছিলাম। কত স্বপ্ন দেখেছি। বাস্তবতার ঘাত-প্রতিঘাতে, কঠোর বাস্তবে হুমড়ি খেয়ে পড়তে হয়েছে। আমাদের দেশের মাটি আমার সর্বাঙ্গে শিহরণ তোলে, লেগে আছে, আমি সেটা অনুভব করি। দেশ ও জাতির প্রতি যদিও আমার কোনো প্রতিশ্রুতি ছিল না, তবু অলিখিত অনেক প্রতিশ্রুতি কবির থেকেই যায়। তবে একথা আমি বলতে পারি, আমি যা কিছু লিখেছি তা আমার দেশের মানুষ, মাটি, প্রকৃতি এবং পরিবেশের কাহিনীতে কলরবমুখর হয়ে আছে।
যখন ভবিষ্যতের দিকে তাকাই, তখন আপনা থেকেই মনে অনুভব করি একটি সুন্দর, সুস্থ ও শান্ত বাংলাদেশ। সৃষ্টির আয়োজন আপনা থেকেই অনিবার্য হয়ে ধরা দেবে। দেশপ্রেম কবিদের হৃদয়ে একটি সাধারণ সত্য হিসেবে অনুভূত হয়। আমি আমার দেশ ও জাতির জন্য যৌবনে অবিশ্রান্তভাবে লিখে গেছি। আমার লেখার পরিমাণ একেবারে সামান্য নয়। তবে সব কথা, কল্পনা এবং স্বপ্নকে ভাষায় রূপ দিতে হয়তো ঠিকমত পারিনি। কিন্তু আমার সযত্ন প্রয়াস সব বিষয়ের ওপর ছড়িয়ে আছে। আজ দেখতে পাচ্ছি, বৃহদাকারের কাব্যসমগ্র, গল্পসমগ্র, এবং উপন্যাস ইত্যাদি তাকে উপচে পড়ছে। দেখি আর ভাবি আমি কখন, কীভাবে এত কাজ করতে সমর্থ হয়েছিলাম।
মানুষের যৌবন একটা পরিশ্রমের সময়। আমি সেটা অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে করেছিলাম বলেই কত মানুষের
সঙ্গে আমার হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব এবং সৌহার্দ্য স্থাপিত হয়েছিল। আমি এজন্য মনে মনে অত্যন্ত পুলক অনুভব করি। আমি লিখেছি আমার সাধ্যমত। জমে উঠেছে ক্রমে ক্রমে। বেড়ে গেছে লেখার পরিধি। আগেই বলেছি তাক উপচে পড়ছে। অনেক জিনিস আছে, যা ভাঁজ করে রাখা যায় না। তার মধ্যে কাব্যই সবচেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। আমি মনে মনে অনুভব করি আমি কবি ছাড়া আর কীই-বা হতে পারতাম, না, কিছুই হতাম না।
দুই চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্নের এক চলচ্চিত্র যেন চলতে থাকে। বাংলাদেশে লিখে প্রতিষ্ঠা পাওয়া সহজ নয়। কারণ আধুনিক বাংলা সাহিত্যে যারা কাজ করেছেন, তাদের কাজের পরিধি এবং মান আকাশকে স্পর্শ করে আছে। সহজে এসেই কেউ এই মেঘস্পর্শী কৃতিত্বের পাশে নতুন কোনো স্তম্ভ নির্মাণ করে সার্থকতার অর্জন করে, এটা সহজ কাজ নয়। অনাদিকাল থেকেই সেই চর্যাপদের সময় থেকেই বাঙালি কবিরা সৃষ্টির সূচনা করেছিলেন, তা একেবারে সামান্য নয়। এক কথায় আমি অবশ্যই বলব যে, এক সামান্য উচ্চতায় বাংলা ভাষা ও কাব্যকে তারা নিয়ে গেছেন। এর মধ্যে আমি একজন সামান্য কবি। আমারও অতি সামান্য কিছু অবদান আছে বলে মনে করি। হয়তো এ কথার সহজ স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু আমার পরিশ্রম নিয়ে যদি আমি পরাক্রম প্রকাশ করি, তাতে দোষ বর্তায় না। কারণ আমি তো কবি, স্বপ্নচারী এবং সৃষ্টিশীল মানুষ। কোনো সময়ই আমার কোনো ক্লান্তি আমাকে বশে রাখতে পারেনি। ক্রমাগত লিখেছি। অবশ্য কাব্যচর্চা সব সময় স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারেনি।
দেশের নানা দুর্যোগ, দুর্ঘটনায়, বিপ্লবে, অন্তর্বিপ্লবে যেহেতু আমি কবি, আমিও শিহরিত হয়েছি। এবং আমার এতে অংশগ্রহণ আছে। আজ যখন দেখি, বৃহদাকার অনেক পুস্তক আমারই নামাঙ্কিত হয়ে শোভা পাচ্ছে, তখন হৃদয়ে এক ধরনের শান্তি অনুভব করি। আর সাহসের সঙ্গে বলতে চাই যে, আধুনিক বাংলা সাহিত্য বহু কীর্তিমান কবি, লেখকদের অবদানে অনতিক্রম্য উচ্চতায় উপনীত হয়েছে। আমিও আমার সামান্য শক্তি নিয়ে এতে অংশগ্রহণ করেছি। চর্যাপদ থেকে শুধু ধরলে এই সাম্প্রতিককালের বাংলা কবিতা পর্যন্ত একটি সুন্দর ধারাবাহিকতা নির্মিত হয়েছে। কত কবির অশ্রু, হাসি, ক্রন্দন, আনন্দ, কলরব এর মধ্যেই মিশ্রিত হয়েছে। আমার আনন্দ হলো আমি আছি, আমিও ছিলাম, আমিও থাকব। এর জন্যে কারও কোনো স্বীকৃতির প্রয়োজন নেই। হ

শ্রুতিলিখন : আহমদ বাসির
সূত্র : আমার দেশ

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ