ওরা চার বন্ধু—অলক, মৃদুল, পিয়াল আর টুই আড্ডা মারছিল ভার্সিটি গেটের পাশের ফুটপাতে মতিনের চায়ের দোকানে। সামনের একটা বেঞ্চ আগেই দখল করে নিয়েছে দুই জোড়া ছেলেমেয়ে। ওরা জায়গা না পেয়ে অনেকের মতো ফুটপাতে পা লটকে বসল। ওখানে দুই প্রস্থ চা-সিঙ্গাড়া আর ক্রমাগত সিগারেটের ধোঁয়া গিলে পিয়ালের বোধহয় একটু বিরক্ত ধরে গেছল। সে খেদের গলায় বলল, ‘দুস শালা, চা তো নয়, ঘোড়ার পেচ্ছাব। চল, অন্য কোথাও যাই।’
মৃদুল কথাটা লুফে নিয়ে বলল, ‘দ্যাটস ফাইন, আমার ওখানে চল। জন্মদিনটা ইয়ে দিয়ে সেলিব্রেট করি!’
ইয়ের গন্ধ পেয়ে অলকের কপাল খুশিতে চওড়া হয়ে গেল, ‘আলবত যাব, কিন্তু বাসায় তোর বাবা-মা আছে না?’
‘ও নিয়ে চিন্তা করিস না। এক্কেবারে ফাঁকা ময়দান। মাম ন্যুইয়র্কে। ড্যাড সিঙ্গাপুরে গেছেন গত পরশু। অতএব বুঝতেই পারছ। চল, চল, কুইক।’
টুই কপালের ওপর ঝুঁকে পড়া চুলের গুচ্ছে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘সরি, এই ভরদুপুরে খালি পেটে ওসব ছাই-পাশ গিলতে পারব না। আমার ক্লাস আছে।’
‘খালি পেটে কে বলল! মালের সঙ্গে যথেষ্ট টালও থাকবে। কী খেতে চাও, জাস্ট বলে দেবে। লোক গিয়ে নিয়ে আসবে।’ জন্মদিনের কারণে কি না কে জানে, মৃদুল এখন বন্ধুদের জন্য উদার হাতেম তাই বনে গেছে।
খাদ্য আর পানীয়ের গন্ধ পেয়ে পিয়ালের পেট কুটকুট করে উঠল, ‘জরুর, জরুর, লেটস্ মুভ।’
অলক মুখ ভেংচে বলল, ‘তোর আর কি, যেখানে পাত, সেখানেই কাত। আমাদের সঙ্গে টুই কেন অ্যাকম্প্যানি করতে চাচ্ছে না বুঝতে পারছি না! হ্যাঁ, ও না গেলে, আমিও যাচ্ছি না।’
কথাটা শোনা মাত্র টুই জিভ বের করে একটা ভঙ্গি করল, ‘কেন, তোমার আবার কী হলো! আমার না-যাওয়ার সঙ্গে তোমার যাওয়ার সম্পর্ক কী? যত সব, ন্যাকা...।’
অলকও কম যায় না, ‘কেন চাঁদু, তুমি গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে! মজুমদারের দু-একটা ক্লাস ইগনোর করলেও তোমার ফার্স্ট ক্লাস হয়ে যাবে।’
‘থাক, থাক, তোমার অতো পাম্পু দিতে হবে না। যেতে চাও, যাও। বাট আমার আজকে মুড নেই। শরীরটা গুলোচ্ছে।’ টুই কথাটা বলে আড়চোখে অলকের মুখখানা দেখল।
ওরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর দুয়েক ধরে পড়ছে। আবাসিক এলাকার মধ্যে তাদের ফ্যাকালটিটা অতটা ছড়ানো-বিছানো না হলেও ভেতরটা বেশ ছিমছাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত! পড়াশোনার জন্য কোনো চাপাচাপি নেই। টিচারদের সঙ্গে হাই-হ্যালো সম্পর্ক। প্রকাশ্যে বারান্দায় জোড় বেঁধে বসে থাকে ছেলেমেয়েরা। আড়ালে আবডালে কিস করলে কেউ ফিরে তাকায় না। অলকরা অবশ্য ছুটির ফাঁকে ক্যান্টিনে না বসে সোজা চলে আসে ফুটপাতে মতিনের দোকানে। গাছপালার আড়ালে একটু নিরিবিলি হওয়ায় আড্ডাটা জমে ভালো। মতিনটা যতই খচ্চর হোক, চা-টা বানায় ভালো। পিয়াল অবশ্য এটা মানতে নারাজ। তার ভাষায়, চা না বলে এটাকে ঘোড়ার পেচ্ছাবের উন্নত সংস্করণ বলা ভালো। মুখে যাই বলুক, এই তরল কয়েক দফা না গিললে পিয়ালের ভাত হজম হয় না।
ওদের আড্ডায় টুই যেসব সময় থাকে, তা নয়। সে একটু অন্য ধাঁচের মেয়ে। খুব দামি গাড়িতে চড়ে। অনেকটা ডোন্ট কেয়ার টমবয় টাইপের। তার মুখে কিছু আটকায় না। জিন্স আর টি শার্টেই তাকে চমত্কার মানিয়ে যায়। অলক, পিয়ালদের সঙ্গে প্রকাশ্যে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে তার কোনো সংকোচ নেই। সে তুখোড় টেনিস খেলোয়াড়। জিম, বিলিয়্যার্ডজ, সুইমিং, ডান্স, মিউজিক, লংড্রাইভ আর শপিং নিয়ে মেতে থাকলেও বন্ধুদের সঙ্গ এড়াতে পারে না। এমনকি সামারে লন্ডনের বাড়িতে বসে লং ডিসট্যান্সে কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে। যে কারণে মৃদুলের জন্মদিনের পান-উত্সব টুই ছাড়া অচল হবে, এটাই স্বাভাবিক।
মৃদুলদের পেল্লায় বাড়িটা লেক ছুঁয়ে এমন মনোহর ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, যেন পানি সাঁতরে একটা রাজহাঁস কেবলই কূলে উঠে দাঁড়িয়েছে উড়ালের ভঙ্গিতে। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য রীতির সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে তৈরি বাড়িটা আদ্যোপান্ত আভিজাত্যের ছোঁয়ায় মোড়ানো। চারদিকে এন্তার গাছ-গাছালি। নির্জন ছায়া ছায়া। দুই খানা গাড়ি ভেতরে চলে আসার পরও নিদ্রা ভাঙল না বাড়িটার।
মৃদুলের সাড়া পেয়ে ভেতর থেকে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে একজন লোক এসে দাঁড়াল। কেয়ারটেকার গোছের কেউ হবে হয়তো। লোকটার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে কি-সব আনতে পাঠাল মৃদুল। তারপর টুইয়ের গাড়ির দরজা খুলে কুর্নিশের ভঙ্গিতে বলল, ‘ম্যায় আপকে লিয়ে ক্যায়া কর সকতা হুঁ।’
‘খুব ফাজলামো হচ্ছে, কিছু করতে হবে না তোমাকে।’ টুই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই মৃদুলের ঠোঁটে আবারও সেই দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল, ‘কৃপয়া অনদর আইয়ে।’
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ভেতরে এসে বোঝা গেল মৃদুল ছাড়া কাছের কেউ নেই বাড়িতে। বাবার সঙ্গে কি একটা খিটিমিটি হওয়ার পর মা চলে গেছেন ন্যুইয়র্কে। ছুটি-ছাটায় সে দু-একবার ঘুরে এসেছে মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু পালাই পালাই স্বভাব আর আড্ডার টানে সেখানে মন বসেনি বেশিদিন। তাছাড়া ড্যাডকে সে খুব মিস করে। একটু রাশভারি হলেও কাজ-পাগল মানুষ। ব্যবসার কাজে প্রায়ই উড়ে বেড়াতে হয় লন্ডন, পারি, সিঙ্গাপুর। বিশাল বাড়িটায় মৃদুল একা একা কী করবে, ভেবে পায় না।
বিশাল ড্রইংরুমে ওরা হাত-পা ছড়িয়ে বসল। ঘরটা ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক। দুই জোড়া ঢাউশ সোফা পরপর সাজানো। পুরু দামি কার্পেট। সেন্টার টেবিলে একজোড়া তাজা কদম। শোকেসে থরোথরো দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিকস। সামনের অ্যাকুয়ারিয়ামে একজোড়া পিরানহা মাছ চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে নতুন আগন্তুকের দিকে। এক কোণে পেল্লায় টেলিভিশন আর পিয়ানোর সঙ্গে করুণ দাঁড়িয়ে আছে ক্যাকটাস একটা। দেয়ালে নামি শিল্পীর দুটো তৈলচিত্র। শিল্পীর নামটা মনে পড়ল না।
সুরভিত হিমঠাণ্ডায় চোখ জুড়িয়ে আসছিল পিয়ালের। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। কড়া ট্যাবলেট নিয়েও নেশাটা ধরে না সহজে। অনেক রাত জেগে গোটা কয়েক নতুন লপ্পা লপ্পা দেখেছে। এটা নীল ছবির কোড নেম। বন্ধুদের ভেতর চালু আছে শব্দটি। মা রাত জাগা পছন্দ করেন না। কিন্তু তারপরও টুক টুক করে অনেক রাত জাগতে হয় তাকে। এর ভেতর পড়াশোনা যেমন থাকে, ইন্টারনেট চ্যাট করে কেটে যায় অনেকটা সময়। তবে মোবাইলে টুম্পার সঙ্গে একবার লেগে গেলে নিদেনপক্ষে একটা ঘণ্টা খেয়ে নেবে অনায়াসে। তবে জিসানের দেয়া তিনটা লপ্পা লপ্পা এমন হট আর বারুদে ঠাসা ছিল, যার বিস্ফোরণটা বাথরুমে না ঘটিয়ে আর উপায় ছিল না।
রাতের সেই ক্রিয়াকর্মের কারণে কিনা কে জানে, শরীরটা একটু জেরবার লাগছিল সকাল থেকে। মা অফিসে যাওয়ার আগে রোজ একটু উঁকি দেন তার ঘরে। আজও দিয়েছিলেন হয়তো, টের পায়নি। সচরাচর সে যখন ঘুম থেকে ওঠে, ততক্ষণে বাবা-মা দু’জনই বেরিয়ে যান অফিসে। ছেলেবেলা থেকে এমনটা দেখে আসছে মৃদুল। নানা কথায় ভুলিয়ে মা তাকে সঁপে দিয়ে যেতেন মিনু খালার কাছে। কিন্তু একটা কান্নাকাটির নাটক রোজই অভিনীত হতো সকালবেলা। মা বিব্রত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ছোট্ট হাতখানা ছাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠতেন। এখন অবশ্য সেই বোধটা আর হয় না।
ঘুম থেকে উঠেই সব তৈরি পেয়ে যায়। মতির মা-ই করে দেয় সবকিছু। কিন্তু ছেলেবেলার সেই অতিকায় ফর্সা, শীর্ণ, হাসি হাসি মুখের মিনু খালার মুখখানা কিছুতেই ভুলতে পারে না। এই খালার সঙ্গে বাবাকে জড়িয়ে একটা অশান্তি হয়েছিল সংসারে। মা খুব কান্নাকাটি করতেন। বাবাও অফিস থেকে ফিরতেন রাত করে। শেষে খালাই একদিন চোখের জলে ভেসে চলে গিয়েছিলেন এক বস্ত্রে। সেই ঝমঝমে বৃষ্টিমুখর রাতে মানুষটা কোথায় হারিয়ে গেল। কেন গেল, এই কষ্টের পীড়নটুকু এখনও রয়ে গেছে বুকে।
পিয়াল বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ল। পাশের ঘরে হাঁকডাক দিয়ে কাকে যেন কী বলছে মৃদুল। টুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে লেকের দৃশ্য দেখতে দেখতে কথা বলছে লন্ডনে। তার হাত নাড়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল কোনো ব্যাপারে ক্ষেপে উঠেছে সে।
অলক কী করি কী করি করে মোবাইলে দুটো মেসেজ পাঠাল জুঁই আর রুনিকে। দু’জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। জুঁই মডেলিং করে। প্রমিজিং। সেই তুলনায় রুনি কিছুটা এগিয়ে। চমত্কার নাচ করে। গানের গলাটিও বেশ। মডেলিং আর গানের সূত্র ধরে দু’জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। প্রথম প্রথম হৈ-হুল্লোড় আর চুমুটুমুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে দৈহিক ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে যায় সম্পর্কটা। জুঁইয়ের অবশ্য নাটকের একটা ছেলের সঙ্গে নতুন অ্যাফেয়ার শুরু হয়েছে। সেয়ানা ছেলে। সব জেনেও প্রেমের খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছে। একেকবার ইচ্ছে হয় রতনদের বলে লাশ ফেলে দেয়। দেবেও হয়তো কোনোদিন...।
রুনি অবশ্য এদিক থেকে যথেষ্ট উদার। তার কোনো ঢাক গুড়গুড় নেই। খুব অল্প বয়সে সে ভার্জিনিটি হারায়। আর এই অপকম্মটির জন্য দায়ী তার এক কাজিন। রুনি খুব আপসেট হয়ে গেছল এ ঘটনায়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটা ছিল আরও বেশি ভয়াবহ আর নিষ্ঠুর। দুপুরে খালি বাসায় হাউস টিউটর অত্যন্ত নির্মমভাবে চড়াও হয়েছিল তার ওপর। এটা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক আর লজ্জার। এ অপমানের জ্বালা ঘোচাতে সে সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই হঠাত্ ক্ষমা করে দিয়েছিল স্কাউনড্রেলটাকে। লাভ-ক্ষতির হিসাবটা এভাবে চুকে গেলেও একটু বেপরোয়া হয়ে গেল রুনি। নিত্যনতুন বন্ধুর আনাগোনা শুরু হলো তার জীবনে। এ যেন অনেকটা খেলার মতন। বড়শি গেঁথে তুলছে আর ছুঁড়ে ফেলছে। এ নিয়ে তার কোনো সংস্কার নেই। সে কিছুই জমিয়ে রাখতে নারাজ। খুচরো পয়সার মতন দেদার উড়িয়ে তার আনন্দ।
এই হলো রুনি। তার ওপরটা যতই উগ্র আর জৌলুসের চটকে বাঁধা, ভেতরটা একেবারে নরম কাদায় মোড়ানো। অলক তাকে কাব্যি করে কখনও কখনও মৃত্তিকা বলে ডাকে। রুনি উত্তরে চোখ মটকে বলে, ‘মৃত্তিকা না, ছাই।’
‘বাহ বেশতো, ছাই চাপা আগুন!’
অলকের ভালোবাসার বোধটা কম। যত সহজে টোপ ফেলে মাছটা তুলে আনতে পারে, রেঁধে-বেটে খাবার মতন সুখকর ধৈর্য তার নেই? রুনির চরিত্রেও এই ধাতটা আছে বলেই হয়তো সম্পর্কটা নেই নেই করেও ঝুলে আছে অদৃশ্য সুতোয়। কিন্তু এর বাইরে কি আরও কিছু সত্যি নেই, না হলে সেদিন রেকর্ডিং স্টুডিওতে সেই লম্বু গায়কটার সঙ্গে একান্তে বসে যখন ফুসুর ফুসুর করছিল, তখন অমন করে রক্ত চড়ে গেছল কেন মাথায়। দ্যাত শালা, গোল্লায় যাক দুনিয়া। চল মন বৃন্দাবন।
একেক সময় অলকের মনটা কেন জানি ফুঁসে ওঠে। বড় বেশি অভিশপ্ত আর খাপছাড়া মনে হয় জীবনটা। এক বিঘা জমির ওপর তাদের মস্ত লালচে বাড়িটা যেন প্রাণহীন এক কারাগার। নাকি ইটপাথরে গাঁথা প্রাচীন কোনো পরিত্যক্ত দুর্গ। এখানে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। অতি নির্জন, নির্বান্ধব, রুখু মরুভূমির কাঁকর বালিতে শিকড় আঁকড়ে পড়ে থাকা এক টুকরো শুকনো লতানো ঘাসের মতন যে জীবনটা লালচে বাড়ির ইট পাথরের ফাঁকে আটকে আছে, তাতে কি জীবন চলবে, না কি অন্য কিছু।
মা যতদিন বেঁচেছিলেন, অন্যরকম প্রাণ ছিল বাড়িটায়। সবকিছু নিয়ম করে চলত ঘড়ির কাঁটায়। মুক্তিযুদ্ধে দুই ভাই হারানো বাবা একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেও মা ছিলেন উচ্ছলতায় ভরপুর। সব সময় টগবগ করতেন প্রাণপ্রাচুর্যে। একবার বলা-কওয়া নেই, হঠাত্ দলবল নিয়ে বেড়াতে গেলেন বাগেরহাট ছোট ফুফুর বাড়িতে। স্কুল খোলা ছিল। টুলু আর তাকে রেখে গেলেন বাবার কাছে। কথা ছিল যতদিন মা না আসবেন, ড্রাইভার রহম চাচা তাদের গাড়িতে করে স্কুলে আনা-নেয়া করবেন। বাবা প্রস্তাবে মৌনভাবে মাথা হেলালেন। তিনি মাকে চিনতেন। কথা বলে লাভ হবে না।
সেই যে মা খুশিতে নাচতে নাচতে গেলেন, দুইদিন পর ফিরে এলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। ব্রেন হেমোরেজের কথাটা সেই প্রথম শুনল অলক। এ আবার কেমনতরো অসুখ রে বাবা। কোনো লক্ষণ নেই, শুয়ে থাকা নেই বিছানায়, হঠাত্ মনে হলো টুপ করে মরে গেলাম, বাহ!
মার ওপর তখন থেকে বড় বেশি অভিমান অলকের। বাবা দিন দিন আরও বেশি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অফিস-অন্তঃপ্রাণ মানুষ। মা চলে যাওয়ার পর অফিসটাই হয়ে উঠল তার আসল ঠিকানা। মস্ত লাল বাড়িটায় দুটো শিশু কেমন আছে, কেমন করে কাটছে তাদের সময়, সে খবর কে রাখে! টুলু আপুটা কেমন যেন বদলে গেল। পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় চুরমার হলো ডাক্তার হওয়ার সাধ। শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না হতেই প্রবাসী বরের হাত ধরে পাড়ি দিল সুইডেনে। আপু কারাগার থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু সে? সেই অন্ধকার ঘেঁটে এখন আর কী হবে? কী যে হয়েছে শালার আজকাল, মনের ভেতরটা কেবল টাকি মাছের মতন ঘাই মারে। কুলক্ষণ নিশ্চয়।
‘এই ব্যাটা, বোম্ মেরে আছিস কেন, মাল খেয়েছিস নাকি?’
মৃদুল রামচাঁটি মেরে তাকে সোফা থেকে ওঠাল। টলোমলো পায়ে অলক বিশাল হাই তুলে বলল, ‘আবে না, সে-সুযোগ আর পেলাম কই।’
‘তা দোস্, মালপত্তর কিছু এনেছিস?’
‘শুধু মাল নয়, টালও এনেছি। আয়, ওরা বসে আছে।’ মৃদুল কথার ফাঁকে দুই আঙুলের একটা বিশেষ ভঙ্গি করে চোখ মারল।
‘ওয়াও’ বলে শূন্যে একটা লাফ মারল অলক। উত্তেজনায় তার ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে উঠল। প্রাচীর ভাঙার আনন্দে নিষ্প্রভ চোখ দুটো চকচক করছে।
মৃদুলের ঘরখানা বেশ বড়। স্নিগ্ধ, আরামদায়ক। বিদেশি শৌখিন মালামালে ঠাসা। ঘরের মানুষটি যে পরম বিলাসী, তা এক নজরে ধরা পড়লেও অগোছালো চেহারাটিও সুস্পষ্ট।
বলতে গেলে আয়োজনের কোনো ঘাটতি রাখেনি মৃদুল। সে লোক পাঠিয়ে প্রচুর খাবার এনেছে দামি দোকান থেকে। কয়েক রকমের সুস্বাদু কাবাব, বার্গার, গ্রিলড চিকেন, তন্দুরি, সালাদ, কাজুবাদাম, ফল, কেক, সন্দেশ এবং চোখ-জুড়ানো চার বোতল অতি মূল্যবান হুইস্কি।
মৃদুল গ্লাসে বরফ কুচি তুলে দিতে দিতে কপট রাগের গলায় বলল, ‘এই যে নবাব পুত্তুরেরা, ঠুঁটো হয়ে বসে থাকলে হবে! দয়া করে এগুলো গিলে আমায় ধন্য করো।’
‘সিওর, সিওর...।’ অলক ব্যস্ততার ভঙ্গিতে টকাস করে চুমু খেল বোতলের গায়ে। তারপর ছিপিটিপি খুলে কিছুটা ঢেলে নিল নিজের গ্লাসে, অন্যদেরও ঢেলে দিল সমান মাপে। শেষে গ্লাসে গ্লাসে চিয়ার্স করে শুরু হলো বন্ধুর স্বাস্থ্যপান।
শূন্য পেটে দু’পেগ পড়তেই সবার মুখ ওয়াসার খোলা-ট্যাপ হয়ে গেল। কড়া মিউজিকের সঙ্গে ননস্টপ বকবকানিটা এখন আর কোনো নির্দিষ্টে থেমে নেই। আড্ডার রথ ক্রমেই আকাশে চড়তে শুরু করেছে। টুইয়ের অবশ্য কেন জানি ছন্দপতন হচ্ছিল। যদিও পানে তার বিরাগ নেই। তাদের বাড়িতে এটা নিয়মিত চলে। এসব ব্যাপারে কোনো সংস্কার নেই তাদের। মা নিয়মিত ক্লাবে যান। ড্যান্স করেন। বেশুমার পুরুষ বন্ধু আছে তার। একবার তো ডাক্তার মজুমদারকে জড়িয়ে একটা ভালোরকম স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েছিলেন মা। বাবা শক্ত হাতে সামাল দিয়েছিলেন বলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ায়নি।
বাবা বরাবর একটু নিরীহ আর শক্ত টাইপের। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশাল পসার সামলাতেই কেটে যায় প্রচুর সময়। নিজেকে তিনি যতই ব্যস্ততার রজ্জুতে জড়ান না কেন, ঘরের আগল বন্ধ রাখেননি কখনও। সেখানে ভরা আলো-হাওয়া খেলেছে সারাদিন। সেই খোলা আগল খুলে মা মুক্ত ডানায় উড়েছেন যত্রতত্র। যখন যা মন চেয়েছে, করেছেন। মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়েছেন নিজের শখ-আহ্লাদের পেছনে। শুধু ক্লাবেই নয়, বাড়িতেও নিয়মিত আসর জমেছে খানা-পিনা আর হৈ-হুল্লোড়ের। বাবা ইচ্ছে করেই রজ্জুটা টানেননি কখনও, বরং লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে দিয়েছেন যতদূর যায়। যেতে যেতে হঠাত্ একদিন একেবারেই আছড়ে পড়ল যখন, তখনই টেনে বাঁধলেন সুতোটা।
কিন্তু তাতে লাভটা হলো কী? বাবা-মায়ের সম্পর্কটা সেই ধোঁয়াটেই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের মতন সুখী দম্পতি আর হয় না। কিন্তু এই বিশ্বাস টলে যায় যখন মধ্যরাতে বেডরুম থেকে ভেসে আসে চিত্কার-চেঁচামেচির আওয়াজ। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে ছুড়ে মারা গ্লাসের শব্দ। আবার হয়তো সুনসান। শুধু রিনরিনে চিকন একটা কান্নার সুর বিলাপের মতো ভেসে থাকে মধ্যরাতের বাতাসে।
টুই এমনটাই দেখে আসছে ছেলেবেলা থেকে। ভয়ঙ্কর এক ভীতি আর জড়তার ছাপ সারাক্ষণ লেগে থাকে তার মুখে। প্রাচুর্য আর বন্ধনহীন উচ্ছলতার ভেতর বেড়ে উঠলেও সেই অজানা ভীতিটা সহসা কুঁকড়ে ধরে তাকে। রৌদ্র-ছায়ার এই খেলাটা এখন হয়ে গেছে তার চরিত্রের অংশ। যে কারণে কখন তার মন ভালো থাকবে, কখন রেগে কাঁই হবে, নয়তো তুচ্ছ কোনো কারণে ভয়ে ছটফট করবে মৃগী রোগীর মতন—এটা বলা শক্ত। তার এই অস্থিরতাকে অনেকে দাম্ভিকতা বলে অপবাদ দেয়, ভুল বুঝে এড়িয়ে থাকে দূরে দূরে, কিন্তু যারা তাকে কিছুটা হলেও চেনে, তারা ঠিকই আঠার মতন লেগে থাকে ছায়াসঙ্গী হয়ে। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কে এল, কে গেল, কেউ তার পাশে থাকল, কী থাকল না, সে থোড়াই কেয়ার করে। সে আছে আপন ভুবনের পাটেশ্বরী হয়ে। তার প্রাসাদ থেকে কেউ খালি হাতে ফেরত যায় না।
মদ, মাংস আর সিগারেটের লাগামহীন ধোঁয়ায় ঘরের ভেতরটা চুরিয়ে উঠছিল। খুব কড়া ডোজের লপ্পা লপ্পা চলছে। কয়েক পেগ পেটে পড়তেই পাগল হয়ে উঠল মৃদুল। সে জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে কোমর দুলিয়ে নাচছিল হিজড়াদের মতো। পিয়াল গ্লাসে চামচ ঠুকে দরাজ গলায় গাইছিল খুব কষ্টের একটা গান। অলক দুই দফা বাথরুম ঘুরে এলো। তার চোখ-মুখ রীতিমত উত্তেজিত। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে হঠাত্ সে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
টুইয়ের শরীর ভালো নেই। খুব চওড়া বমি হয়েছে তার। কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে মাথাটা। তার খুব ঠাণ্ডা ধরে গেল। আরে জ্বরটর এল নাকি? মৃদুল শেষ আবরণটুকু ছুড়ে ফেলে দিয়ে হঠাত্ দিগম্বর হয়ে গেল। অলক আর পিয়াল হাততালি দিয়ে উত্সাহ দিল বন্ধুকে। মৃদুলের উত্তেজনা তখন চরমে উঠেছে। এ যেন অন্য এক মানুষ। কাপালিকের মতন উলঙ্গ নাচতে নাচতে হঠাত্ হ্যাঁচকা টান মেরে তুলে নিল টুইকে। পালকের মতন নরম শরীরটা দুই বাহুর মাঝখানে ছটফট করছিল কেবলই। কিন্তু সেই উদ্দাম নৃত্যভঙ্গি হঠাত্ এমনই ক্রুদ্ধ আর ঝড়ো-হাওয়ার রূপ নিল যেখানে সমূলে আছড়ে পড়ল ফুলন্ত বৃষটা। চোখের পলকে সেই ভেঙে পড়া ফুলের শরীরে কাম-লালা-ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজন আদিম নর্তক।
অবশেষে ক্ষান্ত হলো ছায়া নৃত্যের ঝড়।
তিনজন শোকার্ত মানুষ শবযাত্রার শোক পালনের মতো ধীরে ধীরে নতজানু হলো সেই হেলেপড়া বিধ্বস্ত পুষ্পবৃক্ষের পাশে।
ভয়ঙ্কর লজ্জা আর হতাশায় তারা দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।
মৃদুল কথাটা লুফে নিয়ে বলল, ‘দ্যাটস ফাইন, আমার ওখানে চল। জন্মদিনটা ইয়ে দিয়ে সেলিব্রেট করি!’
ইয়ের গন্ধ পেয়ে অলকের কপাল খুশিতে চওড়া হয়ে গেল, ‘আলবত যাব, কিন্তু বাসায় তোর বাবা-মা আছে না?’
‘ও নিয়ে চিন্তা করিস না। এক্কেবারে ফাঁকা ময়দান। মাম ন্যুইয়র্কে। ড্যাড সিঙ্গাপুরে গেছেন গত পরশু। অতএব বুঝতেই পারছ। চল, চল, কুইক।’
টুই কপালের ওপর ঝুঁকে পড়া চুলের গুচ্ছে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘সরি, এই ভরদুপুরে খালি পেটে ওসব ছাই-পাশ গিলতে পারব না। আমার ক্লাস আছে।’
‘খালি পেটে কে বলল! মালের সঙ্গে যথেষ্ট টালও থাকবে। কী খেতে চাও, জাস্ট বলে দেবে। লোক গিয়ে নিয়ে আসবে।’ জন্মদিনের কারণে কি না কে জানে, মৃদুল এখন বন্ধুদের জন্য উদার হাতেম তাই বনে গেছে।
খাদ্য আর পানীয়ের গন্ধ পেয়ে পিয়ালের পেট কুটকুট করে উঠল, ‘জরুর, জরুর, লেটস্ মুভ।’
অলক মুখ ভেংচে বলল, ‘তোর আর কি, যেখানে পাত, সেখানেই কাত। আমাদের সঙ্গে টুই কেন অ্যাকম্প্যানি করতে চাচ্ছে না বুঝতে পারছি না! হ্যাঁ, ও না গেলে, আমিও যাচ্ছি না।’
কথাটা শোনা মাত্র টুই জিভ বের করে একটা ভঙ্গি করল, ‘কেন, তোমার আবার কী হলো! আমার না-যাওয়ার সঙ্গে তোমার যাওয়ার সম্পর্ক কী? যত সব, ন্যাকা...।’
অলকও কম যায় না, ‘কেন চাঁদু, তুমি গেলে কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হবে! মজুমদারের দু-একটা ক্লাস ইগনোর করলেও তোমার ফার্স্ট ক্লাস হয়ে যাবে।’
‘থাক, থাক, তোমার অতো পাম্পু দিতে হবে না। যেতে চাও, যাও। বাট আমার আজকে মুড নেই। শরীরটা গুলোচ্ছে।’ টুই কথাটা বলে আড়চোখে অলকের মুখখানা দেখল।
ওরা এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বছর দুয়েক ধরে পড়ছে। আবাসিক এলাকার মধ্যে তাদের ফ্যাকালটিটা অতটা ছড়ানো-বিছানো না হলেও ভেতরটা বেশ ছিমছাম। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত! পড়াশোনার জন্য কোনো চাপাচাপি নেই। টিচারদের সঙ্গে হাই-হ্যালো সম্পর্ক। প্রকাশ্যে বারান্দায় জোড় বেঁধে বসে থাকে ছেলেমেয়েরা। আড়ালে আবডালে কিস করলে কেউ ফিরে তাকায় না। অলকরা অবশ্য ছুটির ফাঁকে ক্যান্টিনে না বসে সোজা চলে আসে ফুটপাতে মতিনের দোকানে। গাছপালার আড়ালে একটু নিরিবিলি হওয়ায় আড্ডাটা জমে ভালো। মতিনটা যতই খচ্চর হোক, চা-টা বানায় ভালো। পিয়াল অবশ্য এটা মানতে নারাজ। তার ভাষায়, চা না বলে এটাকে ঘোড়ার পেচ্ছাবের উন্নত সংস্করণ বলা ভালো। মুখে যাই বলুক, এই তরল কয়েক দফা না গিললে পিয়ালের ভাত হজম হয় না।
ওদের আড্ডায় টুই যেসব সময় থাকে, তা নয়। সে একটু অন্য ধাঁচের মেয়ে। খুব দামি গাড়িতে চড়ে। অনেকটা ডোন্ট কেয়ার টমবয় টাইপের। তার মুখে কিছু আটকায় না। জিন্স আর টি শার্টেই তাকে চমত্কার মানিয়ে যায়। অলক, পিয়ালদের সঙ্গে প্রকাশ্যে হাত ধরাধরি করে ঘুরতে তার কোনো সংকোচ নেই। সে তুখোড় টেনিস খেলোয়াড়। জিম, বিলিয়্যার্ডজ, সুইমিং, ডান্স, মিউজিক, লংড্রাইভ আর শপিং নিয়ে মেতে থাকলেও বন্ধুদের সঙ্গ এড়াতে পারে না। এমনকি সামারে লন্ডনের বাড়িতে বসে লং ডিসট্যান্সে কথা বলে বন্ধুদের সঙ্গে। যে কারণে মৃদুলের জন্মদিনের পান-উত্সব টুই ছাড়া অচল হবে, এটাই স্বাভাবিক।
মৃদুলদের পেল্লায় বাড়িটা লেক ছুঁয়ে এমন মনোহর ভঙ্গিতে দাঁড়ানো, যেন পানি সাঁতরে একটা রাজহাঁস কেবলই কূলে উঠে দাঁড়িয়েছে উড়ালের ভঙ্গিতে। ভিক্টোরিয়ান স্থাপত্য রীতির সঙ্গে আধুনিকতার মিশেলে তৈরি বাড়িটা আদ্যোপান্ত আভিজাত্যের ছোঁয়ায় মোড়ানো। চারদিকে এন্তার গাছ-গাছালি। নির্জন ছায়া ছায়া। দুই খানা গাড়ি ভেতরে চলে আসার পরও নিদ্রা ভাঙল না বাড়িটার।
মৃদুলের সাড়া পেয়ে ভেতর থেকে ব্যস্ত সমস্ত হয়ে একজন লোক এসে দাঁড়াল। কেয়ারটেকার গোছের কেউ হবে হয়তো। লোকটার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে কি-সব আনতে পাঠাল মৃদুল। তারপর টুইয়ের গাড়ির দরজা খুলে কুর্নিশের ভঙ্গিতে বলল, ‘ম্যায় আপকে লিয়ে ক্যায়া কর সকতা হুঁ।’
‘খুব ফাজলামো হচ্ছে, কিছু করতে হবে না তোমাকে।’ টুই দরজা খুলে বাইরে এসে দাঁড়াতেই মৃদুলের ঠোঁটে আবারও সেই দুষ্টুমির হাসি ফুটে উঠল, ‘কৃপয়া অনদর আইয়ে।’
সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
ভেতরে এসে বোঝা গেল মৃদুল ছাড়া কাছের কেউ নেই বাড়িতে। বাবার সঙ্গে কি একটা খিটিমিটি হওয়ার পর মা চলে গেছেন ন্যুইয়র্কে। ছুটি-ছাটায় সে দু-একবার ঘুরে এসেছে মায়ের কাছ থেকে। কিন্তু পালাই পালাই স্বভাব আর আড্ডার টানে সেখানে মন বসেনি বেশিদিন। তাছাড়া ড্যাডকে সে খুব মিস করে। একটু রাশভারি হলেও কাজ-পাগল মানুষ। ব্যবসার কাজে প্রায়ই উড়ে বেড়াতে হয় লন্ডন, পারি, সিঙ্গাপুর। বিশাল বাড়িটায় মৃদুল একা একা কী করবে, ভেবে পায় না।
বিশাল ড্রইংরুমে ওরা হাত-পা ছড়িয়ে বসল। ঘরটা ঠাণ্ডা এবং আরামদায়ক। দুই জোড়া ঢাউশ সোফা পরপর সাজানো। পুরু দামি কার্পেট। সেন্টার টেবিলে একজোড়া তাজা কদম। শোকেসে থরোথরো দুষ্প্রাপ্য অ্যান্টিকস। সামনের অ্যাকুয়ারিয়ামে একজোড়া পিরানহা মাছ চোখ বড় করে তাকিয়ে আছে নতুন আগন্তুকের দিকে। এক কোণে পেল্লায় টেলিভিশন আর পিয়ানোর সঙ্গে করুণ দাঁড়িয়ে আছে ক্যাকটাস একটা। দেয়ালে নামি শিল্পীর দুটো তৈলচিত্র। শিল্পীর নামটা মনে পড়ল না।
সুরভিত হিমঠাণ্ডায় চোখ জুড়িয়ে আসছিল পিয়ালের। রাতে ভালো ঘুম হয়নি। কড়া ট্যাবলেট নিয়েও নেশাটা ধরে না সহজে। অনেক রাত জেগে গোটা কয়েক নতুন লপ্পা লপ্পা দেখেছে। এটা নীল ছবির কোড নেম। বন্ধুদের ভেতর চালু আছে শব্দটি। মা রাত জাগা পছন্দ করেন না। কিন্তু তারপরও টুক টুক করে অনেক রাত জাগতে হয় তাকে। এর ভেতর পড়াশোনা যেমন থাকে, ইন্টারনেট চ্যাট করে কেটে যায় অনেকটা সময়। তবে মোবাইলে টুম্পার সঙ্গে একবার লেগে গেলে নিদেনপক্ষে একটা ঘণ্টা খেয়ে নেবে অনায়াসে। তবে জিসানের দেয়া তিনটা লপ্পা লপ্পা এমন হট আর বারুদে ঠাসা ছিল, যার বিস্ফোরণটা বাথরুমে না ঘটিয়ে আর উপায় ছিল না।
রাতের সেই ক্রিয়াকর্মের কারণে কিনা কে জানে, শরীরটা একটু জেরবার লাগছিল সকাল থেকে। মা অফিসে যাওয়ার আগে রোজ একটু উঁকি দেন তার ঘরে। আজও দিয়েছিলেন হয়তো, টের পায়নি। সচরাচর সে যখন ঘুম থেকে ওঠে, ততক্ষণে বাবা-মা দু’জনই বেরিয়ে যান অফিসে। ছেলেবেলা থেকে এমনটা দেখে আসছে মৃদুল। নানা কথায় ভুলিয়ে মা তাকে সঁপে দিয়ে যেতেন মিনু খালার কাছে। কিন্তু একটা কান্নাকাটির নাটক রোজই অভিনীত হতো সকালবেলা। মা বিব্রত ভঙ্গিতে ধীরে ধীরে ছোট্ট হাতখানা ছাড়িয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠতেন। এখন অবশ্য সেই বোধটা আর হয় না।
ঘুম থেকে উঠেই সব তৈরি পেয়ে যায়। মতির মা-ই করে দেয় সবকিছু। কিন্তু ছেলেবেলার সেই অতিকায় ফর্সা, শীর্ণ, হাসি হাসি মুখের মিনু খালার মুখখানা কিছুতেই ভুলতে পারে না। এই খালার সঙ্গে বাবাকে জড়িয়ে একটা অশান্তি হয়েছিল সংসারে। মা খুব কান্নাকাটি করতেন। বাবাও অফিস থেকে ফিরতেন রাত করে। শেষে খালাই একদিন চোখের জলে ভেসে চলে গিয়েছিলেন এক বস্ত্রে। সেই ঝমঝমে বৃষ্টিমুখর রাতে মানুষটা কোথায় হারিয়ে গেল। কেন গেল, এই কষ্টের পীড়নটুকু এখনও রয়ে গেছে বুকে।
পিয়াল বোধহয় ঘুমিয়েই পড়ল। পাশের ঘরে হাঁকডাক দিয়ে কাকে যেন কী বলছে মৃদুল। টুই বারান্দায় দাঁড়িয়ে লেকের দৃশ্য দেখতে দেখতে কথা বলছে লন্ডনে। তার হাত নাড়ার ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল কোনো ব্যাপারে ক্ষেপে উঠেছে সে।
অলক কী করি কী করি করে মোবাইলে দুটো মেসেজ পাঠাল জুঁই আর রুনিকে। দু’জনের সঙ্গে তার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। জুঁই মডেলিং করে। প্রমিজিং। সেই তুলনায় রুনি কিছুটা এগিয়ে। চমত্কার নাচ করে। গানের গলাটিও বেশ। মডেলিং আর গানের সূত্র ধরে দু’জনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। প্রথম প্রথম হৈ-হুল্লোড় আর চুমুটুমুর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে দৈহিক ঘনিষ্ঠতায় জড়িয়ে যায় সম্পর্কটা। জুঁইয়ের অবশ্য নাটকের একটা ছেলের সঙ্গে নতুন অ্যাফেয়ার শুরু হয়েছে। সেয়ানা ছেলে। সব জেনেও প্রেমের খেলাটা চালিয়ে যাচ্ছে। একেকবার ইচ্ছে হয় রতনদের বলে লাশ ফেলে দেয়। দেবেও হয়তো কোনোদিন...।
রুনি অবশ্য এদিক থেকে যথেষ্ট উদার। তার কোনো ঢাক গুড়গুড় নেই। খুব অল্প বয়সে সে ভার্জিনিটি হারায়। আর এই অপকম্মটির জন্য দায়ী তার এক কাজিন। রুনি খুব আপসেট হয়ে গেছল এ ঘটনায়। কিন্তু দ্বিতীয় ঘটনাটা ছিল আরও বেশি ভয়াবহ আর নিষ্ঠুর। দুপুরে খালি বাসায় হাউস টিউটর অত্যন্ত নির্মমভাবে চড়াও হয়েছিল তার ওপর। এটা ছিল অত্যন্ত দুঃখজনক আর লজ্জার। এ অপমানের জ্বালা ঘোচাতে সে সুইসাইডের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল প্রায়। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই হঠাত্ ক্ষমা করে দিয়েছিল স্কাউনড্রেলটাকে। লাভ-ক্ষতির হিসাবটা এভাবে চুকে গেলেও একটু বেপরোয়া হয়ে গেল রুনি। নিত্যনতুন বন্ধুর আনাগোনা শুরু হলো তার জীবনে। এ যেন অনেকটা খেলার মতন। বড়শি গেঁথে তুলছে আর ছুঁড়ে ফেলছে। এ নিয়ে তার কোনো সংস্কার নেই। সে কিছুই জমিয়ে রাখতে নারাজ। খুচরো পয়সার মতন দেদার উড়িয়ে তার আনন্দ।
এই হলো রুনি। তার ওপরটা যতই উগ্র আর জৌলুসের চটকে বাঁধা, ভেতরটা একেবারে নরম কাদায় মোড়ানো। অলক তাকে কাব্যি করে কখনও কখনও মৃত্তিকা বলে ডাকে। রুনি উত্তরে চোখ মটকে বলে, ‘মৃত্তিকা না, ছাই।’
‘বাহ বেশতো, ছাই চাপা আগুন!’
অলকের ভালোবাসার বোধটা কম। যত সহজে টোপ ফেলে মাছটা তুলে আনতে পারে, রেঁধে-বেটে খাবার মতন সুখকর ধৈর্য তার নেই? রুনির চরিত্রেও এই ধাতটা আছে বলেই হয়তো সম্পর্কটা নেই নেই করেও ঝুলে আছে অদৃশ্য সুতোয়। কিন্তু এর বাইরে কি আরও কিছু সত্যি নেই, না হলে সেদিন রেকর্ডিং স্টুডিওতে সেই লম্বু গায়কটার সঙ্গে একান্তে বসে যখন ফুসুর ফুসুর করছিল, তখন অমন করে রক্ত চড়ে গেছল কেন মাথায়। দ্যাত শালা, গোল্লায় যাক দুনিয়া। চল মন বৃন্দাবন।
একেক সময় অলকের মনটা কেন জানি ফুঁসে ওঠে। বড় বেশি অভিশপ্ত আর খাপছাড়া মনে হয় জীবনটা। এক বিঘা জমির ওপর তাদের মস্ত লালচে বাড়িটা যেন প্রাণহীন এক কারাগার। নাকি ইটপাথরে গাঁথা প্রাচীন কোনো পরিত্যক্ত দুর্গ। এখানে প্রাণের কোনো অস্তিত্ব আছে বলে মনে হয় না। অতি নির্জন, নির্বান্ধব, রুখু মরুভূমির কাঁকর বালিতে শিকড় আঁকড়ে পড়ে থাকা এক টুকরো শুকনো লতানো ঘাসের মতন যে জীবনটা লালচে বাড়ির ইট পাথরের ফাঁকে আটকে আছে, তাতে কি জীবন চলবে, না কি অন্য কিছু।
মা যতদিন বেঁচেছিলেন, অন্যরকম প্রাণ ছিল বাড়িটায়। সবকিছু নিয়ম করে চলত ঘড়ির কাঁটায়। মুক্তিযুদ্ধে দুই ভাই হারানো বাবা একটু গম্ভীর প্রকৃতির হলেও মা ছিলেন উচ্ছলতায় ভরপুর। সব সময় টগবগ করতেন প্রাণপ্রাচুর্যে। একবার বলা-কওয়া নেই, হঠাত্ দলবল নিয়ে বেড়াতে গেলেন বাগেরহাট ছোট ফুফুর বাড়িতে। স্কুল খোলা ছিল। টুলু আর তাকে রেখে গেলেন বাবার কাছে। কথা ছিল যতদিন মা না আসবেন, ড্রাইভার রহম চাচা তাদের গাড়িতে করে স্কুলে আনা-নেয়া করবেন। বাবা প্রস্তাবে মৌনভাবে মাথা হেলালেন। তিনি মাকে চিনতেন। কথা বলে লাভ হবে না।
সেই যে মা খুশিতে নাচতে নাচতে গেলেন, দুইদিন পর ফিরে এলেন ঠিকই, তবে লাশ হয়ে। ব্রেন হেমোরেজের কথাটা সেই প্রথম শুনল অলক। এ আবার কেমনতরো অসুখ রে বাবা। কোনো লক্ষণ নেই, শুয়ে থাকা নেই বিছানায়, হঠাত্ মনে হলো টুপ করে মরে গেলাম, বাহ!
মার ওপর তখন থেকে বড় বেশি অভিমান অলকের। বাবা দিন দিন আরও বেশি গম্ভীর হয়ে গেলেন। অফিস-অন্তঃপ্রাণ মানুষ। মা চলে যাওয়ার পর অফিসটাই হয়ে উঠল তার আসল ঠিকানা। মস্ত লাল বাড়িটায় দুটো শিশু কেমন আছে, কেমন করে কাটছে তাদের সময়, সে খবর কে রাখে! টুলু আপুটা কেমন যেন বদলে গেল। পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়ায় চুরমার হলো ডাক্তার হওয়ার সাধ। শেষমেশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে না হতেই প্রবাসী বরের হাত ধরে পাড়ি দিল সুইডেনে। আপু কারাগার থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। কিন্তু সে? সেই অন্ধকার ঘেঁটে এখন আর কী হবে? কী যে হয়েছে শালার আজকাল, মনের ভেতরটা কেবল টাকি মাছের মতন ঘাই মারে। কুলক্ষণ নিশ্চয়।
‘এই ব্যাটা, বোম্ মেরে আছিস কেন, মাল খেয়েছিস নাকি?’
মৃদুল রামচাঁটি মেরে তাকে সোফা থেকে ওঠাল। টলোমলো পায়ে অলক বিশাল হাই তুলে বলল, ‘আবে না, সে-সুযোগ আর পেলাম কই।’
‘তা দোস্, মালপত্তর কিছু এনেছিস?’
‘শুধু মাল নয়, টালও এনেছি। আয়, ওরা বসে আছে।’ মৃদুল কথার ফাঁকে দুই আঙুলের একটা বিশেষ ভঙ্গি করে চোখ মারল।
‘ওয়াও’ বলে শূন্যে একটা লাফ মারল অলক। উত্তেজনায় তার ফর্সা মুখখানা লাল হয়ে উঠল। প্রাচীর ভাঙার আনন্দে নিষ্প্রভ চোখ দুটো চকচক করছে।
মৃদুলের ঘরখানা বেশ বড়। স্নিগ্ধ, আরামদায়ক। বিদেশি শৌখিন মালামালে ঠাসা। ঘরের মানুষটি যে পরম বিলাসী, তা এক নজরে ধরা পড়লেও অগোছালো চেহারাটিও সুস্পষ্ট।
বলতে গেলে আয়োজনের কোনো ঘাটতি রাখেনি মৃদুল। সে লোক পাঠিয়ে প্রচুর খাবার এনেছে দামি দোকান থেকে। কয়েক রকমের সুস্বাদু কাবাব, বার্গার, গ্রিলড চিকেন, তন্দুরি, সালাদ, কাজুবাদাম, ফল, কেক, সন্দেশ এবং চোখ-জুড়ানো চার বোতল অতি মূল্যবান হুইস্কি।
মৃদুল গ্লাসে বরফ কুচি তুলে দিতে দিতে কপট রাগের গলায় বলল, ‘এই যে নবাব পুত্তুরেরা, ঠুঁটো হয়ে বসে থাকলে হবে! দয়া করে এগুলো গিলে আমায় ধন্য করো।’
‘সিওর, সিওর...।’ অলক ব্যস্ততার ভঙ্গিতে টকাস করে চুমু খেল বোতলের গায়ে। তারপর ছিপিটিপি খুলে কিছুটা ঢেলে নিল নিজের গ্লাসে, অন্যদেরও ঢেলে দিল সমান মাপে। শেষে গ্লাসে গ্লাসে চিয়ার্স করে শুরু হলো বন্ধুর স্বাস্থ্যপান।
শূন্য পেটে দু’পেগ পড়তেই সবার মুখ ওয়াসার খোলা-ট্যাপ হয়ে গেল। কড়া মিউজিকের সঙ্গে ননস্টপ বকবকানিটা এখন আর কোনো নির্দিষ্টে থেমে নেই। আড্ডার রথ ক্রমেই আকাশে চড়তে শুরু করেছে। টুইয়ের অবশ্য কেন জানি ছন্দপতন হচ্ছিল। যদিও পানে তার বিরাগ নেই। তাদের বাড়িতে এটা নিয়মিত চলে। এসব ব্যাপারে কোনো সংস্কার নেই তাদের। মা নিয়মিত ক্লাবে যান। ড্যান্স করেন। বেশুমার পুরুষ বন্ধু আছে তার। একবার তো ডাক্তার মজুমদারকে জড়িয়ে একটা ভালোরকম স্ক্যান্ডালে জড়িয়ে পড়েছিলেন মা। বাবা শক্ত হাতে সামাল দিয়েছিলেন বলে পরিস্থিতি খারাপের দিকে গড়ায়নি।
বাবা বরাবর একটু নিরীহ আর শক্ত টাইপের। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিশাল পসার সামলাতেই কেটে যায় প্রচুর সময়। নিজেকে তিনি যতই ব্যস্ততার রজ্জুতে জড়ান না কেন, ঘরের আগল বন্ধ রাখেননি কখনও। সেখানে ভরা আলো-হাওয়া খেলেছে সারাদিন। সেই খোলা আগল খুলে মা মুক্ত ডানায় উড়েছেন যত্রতত্র। যখন যা মন চেয়েছে, করেছেন। মুঠো মুঠো টাকা উড়িয়েছেন নিজের শখ-আহ্লাদের পেছনে। শুধু ক্লাবেই নয়, বাড়িতেও নিয়মিত আসর জমেছে খানা-পিনা আর হৈ-হুল্লোড়ের। বাবা ইচ্ছে করেই রজ্জুটা টানেননি কখনও, বরং লাটাইয়ের সুতো ছেড়ে দিয়েছেন যতদূর যায়। যেতে যেতে হঠাত্ একদিন একেবারেই আছড়ে পড়ল যখন, তখনই টেনে বাঁধলেন সুতোটা।
কিন্তু তাতে লাভটা হলো কী? বাবা-মায়ের সম্পর্কটা সেই ধোঁয়াটেই রয়ে গেল। মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের মতন সুখী দম্পতি আর হয় না। কিন্তু এই বিশ্বাস টলে যায় যখন মধ্যরাতে বেডরুম থেকে ভেসে আসে চিত্কার-চেঁচামেচির আওয়াজ। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে ছুড়ে মারা গ্লাসের শব্দ। আবার হয়তো সুনসান। শুধু রিনরিনে চিকন একটা কান্নার সুর বিলাপের মতো ভেসে থাকে মধ্যরাতের বাতাসে।
টুই এমনটাই দেখে আসছে ছেলেবেলা থেকে। ভয়ঙ্কর এক ভীতি আর জড়তার ছাপ সারাক্ষণ লেগে থাকে তার মুখে। প্রাচুর্য আর বন্ধনহীন উচ্ছলতার ভেতর বেড়ে উঠলেও সেই অজানা ভীতিটা সহসা কুঁকড়ে ধরে তাকে। রৌদ্র-ছায়ার এই খেলাটা এখন হয়ে গেছে তার চরিত্রের অংশ। যে কারণে কখন তার মন ভালো থাকবে, কখন রেগে কাঁই হবে, নয়তো তুচ্ছ কোনো কারণে ভয়ে ছটফট করবে মৃগী রোগীর মতন—এটা বলা শক্ত। তার এই অস্থিরতাকে অনেকে দাম্ভিকতা বলে অপবাদ দেয়, ভুল বুঝে এড়িয়ে থাকে দূরে দূরে, কিন্তু যারা তাকে কিছুটা হলেও চেনে, তারা ঠিকই আঠার মতন লেগে থাকে ছায়াসঙ্গী হয়ে। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। কে এল, কে গেল, কেউ তার পাশে থাকল, কী থাকল না, সে থোড়াই কেয়ার করে। সে আছে আপন ভুবনের পাটেশ্বরী হয়ে। তার প্রাসাদ থেকে কেউ খালি হাতে ফেরত যায় না।
মদ, মাংস আর সিগারেটের লাগামহীন ধোঁয়ায় ঘরের ভেতরটা চুরিয়ে উঠছিল। খুব কড়া ডোজের লপ্পা লপ্পা চলছে। কয়েক পেগ পেটে পড়তেই পাগল হয়ে উঠল মৃদুল। সে জামাকাপড় ছুড়ে ফেলে কোমর দুলিয়ে নাচছিল হিজড়াদের মতো। পিয়াল গ্লাসে চামচ ঠুকে দরাজ গলায় গাইছিল খুব কষ্টের একটা গান। অলক দুই দফা বাথরুম ঘুরে এলো। তার চোখ-মুখ রীতিমত উত্তেজিত। হাত-পা ছুড়তে ছুড়তে হঠাত্ সে শুয়ে পড়ল মেঝেতে।
টুইয়ের শরীর ভালো নেই। খুব চওড়া বমি হয়েছে তার। কেমন যেন ঝিম ঝিম করছে মাথাটা। তার খুব ঠাণ্ডা ধরে গেল। আরে জ্বরটর এল নাকি? মৃদুল শেষ আবরণটুকু ছুড়ে ফেলে দিয়ে হঠাত্ দিগম্বর হয়ে গেল। অলক আর পিয়াল হাততালি দিয়ে উত্সাহ দিল বন্ধুকে। মৃদুলের উত্তেজনা তখন চরমে উঠেছে। এ যেন অন্য এক মানুষ। কাপালিকের মতন উলঙ্গ নাচতে নাচতে হঠাত্ হ্যাঁচকা টান মেরে তুলে নিল টুইকে। পালকের মতন নরম শরীরটা দুই বাহুর মাঝখানে ছটফট করছিল কেবলই। কিন্তু সেই উদ্দাম নৃত্যভঙ্গি হঠাত্ এমনই ক্রুদ্ধ আর ঝড়ো-হাওয়ার রূপ নিল যেখানে সমূলে আছড়ে পড়ল ফুলন্ত বৃষটা। চোখের পলকে সেই ভেঙে পড়া ফুলের শরীরে কাম-লালা-ক্রোধে ঝাঁপিয়ে পড়ল তিনজন আদিম নর্তক।
অবশেষে ক্ষান্ত হলো ছায়া নৃত্যের ঝড়।
তিনজন শোকার্ত মানুষ শবযাত্রার শোক পালনের মতো ধীরে ধীরে নতজানু হলো সেই হেলেপড়া বিধ্বস্ত পুষ্পবৃক্ষের পাশে।
ভয়ঙ্কর লজ্জা আর হতাশায় তারা দুই হাতে মুখ ঢেকে ডুকরে কেঁদে উঠল।
সুত্র : আমার দেশ
No comments:
Post a Comment