আরশী মোবাইলের বাটন টিপলো, দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহপুর্বক কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।
আরশী মোবাইলটা বিছানার ওপর ছুঁড়ে দিল, তোমারই বা দোষ কী? তোমার সঙ্গে তো আমি নিজেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছি, তুমিই বা নতুন করে সংযোগ দিবে কেন? তুমি কোথায় ফিরোজ? কতদিন থেকে তোমাকে খুঁজছি, কতবার তোমার মোবাইলে রিং দিয়েছি, কোনদিন তোমাকে খুঁজে পেলাম না। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন, তুমি আমাকে বড় হওয়ার স্বপ্নদেখাতে, তুমি বলতে আমি যেদিন প্রমোশন পেয়ে অফিসার হবো সেদিন তুমিই সবচেয়ে বেশি খুশি হবে। আমি প্রমোশন পেয়েছি ফিরোজ, আগামী মাসে আমার রেঙ্ক (Rank) লাগবে, তুমি দেখবে না?
লিজা রুমে ঢুকল, এই আরশী একটা খবর শুনেছিস?
কী খবর?
আমাদের আগামী মাসের পঁচিশ তারিখে রেঙ্ক (Rank) পরানো হবে।
আরশীর দু'চোখ ছলছল করে উঠল, সে আপন মনে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, আর শুধু মনে মনে বা মোবাইলে খুঁজলে হবে না, আমি কাল থেকে সশরীরে তোমাকে খুঁজতে মাঠে নামবো, আমাকে রেঙ্ক পরতে দেখলে সবচেয়ে খুশি হতে তুমি, তুমি, তুমিই আমার সব ফিরোজ। আমি তোমাকে বাবার মতো শ্রদ্ধা করেছি, প্রেমিকের মতো ভালোবেসেছি, বন্ধুর মতো নির্ভর করেছি, তুমিই আমার সব ফিরোজ। যদি ফিরোজকে পেয়ে যাই, আমি যখন ওর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো তখন ও যদি আমাকে তাড়িয়ে দেয়? আমার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কের কথা অস্বীকার করে? যদি বলে তোমার সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক আছে? আসলে আমার সঙ্গে ওর সম্পর্কটা আত্মার, আইন বা সামাজের কাছে যার কোন মূল্য নেই, কোন কোন ক্ষেত্রে অপরাধও।
লিজা জিজ্ঞেস করল, এই আরশী তুই কি ঘুমাচ্ছিস নাকি?
না রে।
তবে চুপ করে আছিস কেন? কথা বল?
না রে মনটা ভালো নেই।
কেন? হঠাৎ করে আবার কার কথা মনে পড়ল?
লিজা তুই তো জানিস, পৃথিবীতে আমার একজনই ছিল, সে চলে গেছে তারপর থেকে আমার আমার কেউ নেই, কেউ আসবেও না।
যদি কেউ আসে?
বললাম তো আসবে না, কোনদিন দেখেছিস কেউ আমার খোঁজ নিতে এসেছে? আমার মোবাইলের রিং কখনো কখনো বেজে ওঠে রিসিভ করলেই অনেক যন্ত্রণা, বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব, প্রেম করার প্রস্তাব, বিয়ে করার প্রস্তাব, অনেক আকর্ষণীয় প্রস্তাব কিন্তু আমি কারো প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছি?
লিজা বলল, সবগুলোই তো জীবনের জন্য প্রয়োজন, তো অসুবিধা কি? তুই একটা অবিবাহিতা মেয়ে, চেহারা সুন্দর, তাই তোর মোবাইলে ফোন আসে। আমি তোর মতো সুন্দর না, তারপরও বিয়ের আগে আমার অনেক ফোন আসতো, আকর্ষণীয় প্রস্তাব পেতাম, বিয়ের পরও মাঝে মাঝে ফোন আসতো হয়ত কেউ কেউ অবিবাহিতা মনে করতো, এনিয়ে তোর দুলাভাইর সঙ্গে মাঝে মাঝে ভুল বোঝাবুঝি হতো। আমার বিয়ের খবরটা জানাজানির পর আর তেমন ফোন আসে না।
আরশী একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, তাহলে কি আমিও সবাইকে জানিয়ে দিব নাকি যে আমার বিয়ে হয়েছে, তাহলে অন্ততঃ বাড়তি ফোনের ঝামেলা থেকে বেঁচে যেতাম।
বিয়ে না করেই সবাইকে বিয়ে হয়েছে বলবি? তারচেয়ে বিয়ে করে ফেললেই তো হয়?
ইচ্ছা করলেই কি যাকে তাকে বিয়ে করা যায়?
তা অবশ্য ঠিক, তাতে যন্ত্রণা বেড়ে যেতে পারে।
সেই যন্ত্রণার চেয়ে এই যন্ত্রণাই ভালো।
আচ্ছা আরশী তুই না কাকে যেন ভালোবাসতিস, আমাদের ডিপার্টমেণ্টেরই কী নাম যেন?
আরশীর মনটা ঘৃণায় ভরে গেল। কারণ যে তার সঙ্গে প্রতারণা করেছে সে আর কোনদিন তার নাম মুখে আনতে চায়নি, তার কথা মনে করতে চায়নি। আজ লিজা সেই প্রতারকের নামটা তাকে স্মরণ করে দিল, সেই প্রতারকের জন্যই ফিরোজের সঙ্গে তার দুরত্ব বেড়ে গিয়েছিল, আরশী ফিরোজকে অপমান করেছিল।
আরশী কিছুটা রাগান্বিতস্বরেবলল, লিজা তুই তো সবই জানিস তারওপর আমি যার নাম জীবনে মুখে আনতে চাই না তার কথা স্মরণ করে দিচ্ছিস কেন?
আরশী হঠাৎ করে মুখে চলে এলো তাই বললাম, আমি তোকে কষ্ট দেয়ার জন্য বলিনি।
ট্রেনিং শেষে আরশীর প্রথম পোস্টিং হয় রাজশাহী জেলার বাঘমারা থানায়। আরশী ট্রেনিং সেন্টারে থাকতেই ফিরোজ তাকে একটা মোবাইল সেট কিনে দিয়েছিল। আরশীর মোবাইলে শুধুমাত্র তার বাবা-মা, দুলাভাই-আপা আর ফিরোজ মোবাইল করতো। তাছাড়া সারাদিন মোবাইলে তেমন কারো কল আসতো না, নতুন মোবাইল ফোন হাতে পাওয়ায় আরশীর মোবাইলে কথা বলার আগ্রহ ছিল বেশি। তাই কোন মোবাইল থেকে একটা মিস কল এলে সে যেন নিজেই উৎসাহী হয়ে বার বার মিস্ কল দিত।
আরশীর সেই অতি উৎসাহী আচরণটা ফিরোজের একেবারেই পছন্দ না। সে আরশীর মোবাইল ব্যস্ত দেখলেই রেগে যেত।
আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থায় মহিলাদের সবাই গৃহিণী কিংবা সাধারণ কোন পেশা যেমন শিক্ষকতার মতো পেশায় কাজ করতে দেখে অভ্যস্থ। যখন কেউ একজন মহিলা পুলিশকে রাস্তায় ডিউটি করতে দেখে তখন অনেকেই একটু কৌতুহলী হয়ে তাকিয়ে থাকে। কথা বলার অজুহাত খুঁজে, আগ বাড়িয়ে উপকার করার জন্য হাত বাড়িয়ে দেয়, সহানুভূতি দেখায়। এটা শুধু অফিসের বাইরেই নয়, ডিপার্টমেণ্টের অনেকেই এখনো মেয়েদের প্রতি সাধারণ মানুষের মতোই।
মহিলা পুলিশের সংখ্যা অনেক কম। এই কোর্টে যেসব মহিলা পুলিশ আসামী নিয়ে আসে তাদের সবার নাম যেন সবার মুখস্থ। কোন কাজে কারো কাছে গেলেই যেন সহজে নাম ধরে ডাকে। এমনি অবস্থায় ডিউটি করতে করতে আরশীর অনেকের সাথে পরিচয় হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন পুলিশ কনস্টেবল এর সাথে আরশীর একটা সুন্দর বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
প্রায়ই রাতেই আরশী তার সেই বন্ধুর সঙ্গে দীর্ঘ সময় মোবাইলে কথা বলতো। আরশীর মোবাইল দীর্ঘ সময় ব্যস্ত দেখে ফিরোজ মোবাইলে বকাবকি করতো, আরশী তুমি রাতে মোবাইলে কার সঙ্গে এত কথা বলো?
বাঃ আমি এখন চাকরি করছি, ছাত্র জীবনের অনেক বন্ধু, চাকরি জীবনের কলিগ সবার সঙ্গে কথা বলি।
আরশী, বন্ধু বা কলিগের সঙ্গে কি কারো প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা কি আলাপ থাকতে পারে?
দেখ আমি এখন চাকরি করছি, আমার ভালো-মন্দ নিজে বোঝার আমার বয়স হয়েছে, আমার ভবিষ্যতটা তুমি আমাকে বুঝতে দাও।
বাঃ আরশী তুমি তো খুব সুন্দর যুক্তি তৈরি করেছ।
তুমি কিছু মনে করলে নাকি?
না আমি তোমার কে? তোমার মোবাইল ব্যস্ত দেখলে আমি রাগ করবো কেন? বলে ফিরোজ মোবাইল রেখে দিয়েছিল।
পরদিন সকালবেলা আরশীই প্রথম মোবাইল করেছিল, হ্যালো।
ফিরোজ রিসিভ করেছিল, হ্যালো আরশী।
শোনো তুমি বোধ হয় আমার কথায় কিছু মনে করেছ, আসলে বাড়ি থেকে আপা মোবাইল করেছিল।
কাল না তুমি বললে, তোমার কলিগ মোবাইল করেছে?
আমি তোমাকে ক্ষেপানোর জন্য বলেছিলাম, আসলে তুমি ছাড়া আমার আর কে আছে বলো? আমি তোমাকে বলেছি না আমাকে সন্দেহ করবে না, তুমি যেভাবে চলতে বলেছ আমি সেভাবেই চলবো।
আরশী আমি এখন কাজে ব্যস্ত আছি সুযোগ হলে পরে তোমাকে রিং দিব।
আচ্ছা শোনো, আমার মোবাইলে টাকা নাই, এক'শ টাকা রিচার্জ করে দাও তো।
আরশী তোমার মোবাইলে না কালকেই এক'শ টাকা দিয়েছি?
হ্যাঁ, খরচ হয়ে গেছে, বললাম না আপার সঙ্গে কথা বলেছি, আমার এক বান্ধবীর সঙ্গে কথা বলেছি, তাই সব টাকা শেষ হয়ে গেছে, তুমি না দিতে চাইলে থাক।
তুমি রাগ করলে, আচ্ছা আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ফিরোজ কয়েকমিনিটের মধ্যে আরশীর মোবাইলে এক'শ টাকা রিচার্জ করে দিয়েছিল।
এমনিভাবে আরশী যখন যা চাইতো তাই যেন আলাদীনের চেরাগের মতো ফিরোজ তার হাতে পৌঁছে দিত। মাঝে মাঝে রাজশাহী চলে আসতো, তারপর আরশীকে সঙ্গে নিয়ে কেনা-কাটা করতো, ঘুরে বেড়াতো একেবারে পঁচিশ বছরের যুবকের মতো। আরশীর বেলায় ফিরোজের বাজেটের কোন কমতি ছিল না। আরশী আঙ্গুল দিয়ে যে কাপড়টা দেখিয়ে দিত ফিরোজ সেটাই কিনে দিত, যখন যা খেতে চাইতো তাই খাওয়াতো।
যে ছেলেটির সঙ্গে আরশীর সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তার নাম নূর। পুরো নাম নূর আলম। গায়ের রং ফর্সা, স্মার্ট, বাচনভঙ্গী সুন্দর, খুব সহজে দৃষ্টি কাড়ার মতো।
প্রায় দিন অফিসের কাজ শেষে সুযোগ হলে আরশী আর নূর কোথাও আড্ডা দিত, অফিস বন্ধের দিন হলে দু'জনে পদ্মার পাড়ে ঘুরে বেড়াতো। একদিন আরশী আর নূর পদ্মার পাড়ে বেড়াতে গিয়েছিল। এমন সময় ফিরোজ মোবাইল করেছিল, হ্যালো আরশী।
হ্যাঁ বলো।
আরশী তুমি এখন কোথায়?
পদ্মার পাড়ে।
কেন? কার সাথে?
আমার এক কলিগসহ বেড়াতে এসেছি।
ফিরোজ বিশ্বাস করেনি, সে হাসতে হাসতে বলেছিল, আমার সঙ্গে ইয়ার্কি করছ, না?
নূর জিজ্ঞেস করেছিল, কে আরশী?
তোমাকে বলেছিলাম না, আমাদের ভাড়াটে।
তোমাকে কেন মোবাইল করেছে?
এমনিতেই মাঝে মাঝে মোবাইল করে আমার খোঁজ-খবর নেয়।
তোমার খোঁজ নেয় কেন?
এমনিতেই।
আরশী সহজভাবে বললেও নূর তার কথাটা সহজভাবে গ্রহণ করেনি। তার মনে একটা সন্দেহ বাসা বেঁধেছিল। সে আরশীর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমাদের আত্মীয়?
না কিন্তু আত্মীয়ের চেয়ে বেশি।
কী নাম ভদ্র লোকের?
ফিরোজ।
ফিরোজের কি শুধু তোমার সঙ্গে ভালো সম্পর্ক নাকি তোমাদের বাড়ির সবার সঙ্গে?
তুমি সন্দেহ করছ?
না ঠিক সন্দেহ করছি না।
তবে শোনো ফিরোজ একজন বয়স্ক মানুষ, একটা মেয়ে আছে বুঝলে।
নূর এর মুখ থেকে সন্দেহের মেঘটা যেন কিছুটা সরে গিয়েছিল, তুমি কিছু মনে করলে নাকি?
না।
ফিরোজ আমাকে নিজের মেয়ে রিমার মতো স্নেহ করতো, বন্ধুর মতো ভালোবাসতো। আমার যে কোন প্রয়োজনে ঝাঁপিয়ে পড়তো। যেসব বিষয়ে আমি আমার বাবা-মা, বোন-দুলাভাই সবার সঙ্গে কথা বলে কোন সিদ্ধান্ত বা সহযোগিতা পেতাম না সেসব বিষয়ে ফিরোজ আমাকে সুন্দর সমাধান দিত, প্রয়োজনে টাকাও দিত। ফিরোজ বলতো তুমি যেদিন প্রমোশন পাবে সেদিন আমি মনে করবো তোমার জন্য আমার মেধা, অর্থ এবং শ্রম সার্থক হয়েছে।
হ্যাঁ ফিরোজ আমি প্রমোশন পাচ্ছি, তোমার মেধা, অর্থ এবং শ্রম সব সার্থক হয়েছে, তুমি একবার তোমার মোবাইলটা চালু করো, আমি তোমার জন্য সেই সিমকার্ডটাই রেখেছি, কই তুমি তো কোনদিন মোবাইল করলে না? তুমি না বলতে রাগ কখনো মানুষের জীবনে ভালো ফল বয়ে আনতে পারে না। তবে তুমি আমার ওপর রাগ করে আছ কেন? তুমি বিশ্বাস করো সেদিনের ঘটনার জন্য আমার কোন দোষ নেই। আমি জানি আমার জন্য তোমার এবং আমার দু'জনের জীবনে যে ক্ষতি হয়েছে তা কোনদিন পূরণ হবার নয়, তুমি বিশ্বাস করো আমার কোন দোষ ছিল না। আমি ষড়যন্ত্রের শিকার।
আরশী পাশ ফিরে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।
না আরশীর চোখে ঘুম নেই, একটা অপরাধবোধ তাকে তাড়া করছে। তার জীবনে ফিরোজের অবদানের কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। আসলে আইন-আদালত মানুষকে যে শাস্তি দেয় তা সবার চোখে পড়ে, অপরাধীকে সবাই ঘৃণা করে কিন্তু বিবেকের দেয়া শাস্তি লোক-চক্ষুর আড়ালে অপরাধীকে দিন-রাত যে শাস্তি দেয় তা কারো চোখে পড়ে না ঠিকই কিন্তু অপরাধীর হৃদয়কে সব সময় দগ্ধ করে। এই দুই শাস্তির মধ্যে কোন শাস্তি বেশি জ্বালাময়ী তা শুধু ভুক্তভোগী মাত্রই অনুভব করে। আরশী আর একদিনও বিবেকের শাস্তি ভোগ করতে চায় না। সে আপন মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ব্যক্ত করে, আমি তোমাকে খুঁজে বের করবো ফিরোজ, কিন্তু কীভাবে? তোমার কথা তো আমি কাউকে বলতেও পারবো না, তোমাকে আমার খুঁজে বের করতে হবে, আমার বিবেকের কাছে আমি আর অপরাধী হয়ে থাকতে পারবো না।
দুই
রাতের খাবারের পর ফিরোজকে কয়েকটা ঔষধ খেতে হয়, এমনিতেই ফিরোজের কোনদিন ঔষধ খেতে ভুল হয় না তারপরও প্রতিদিন সকাল এবং রাতের খাবারের পর তার বাবার প্রেসক্রিপশন আর ঔষধের ঝুড়িটা নিয়ে রিমা তার বাবার সামনে আসে, রাতের ঔষধ খাওয়ার আগে জিজ্ঞেস করে, বাবা দুপুরে ঠিক মতো ঔষধ খেয়েছো তো?
ফিরোজ বলে, হ্যাঁ রে মা খেয়েছি, আচ্ছা তুই বলতো আমি কি কোনদিন কোন কাজ করতে ভুলে গেছি? আমার কি সবকিছু ভুলে যাবার মতো বয়স হয়েছে?
সরি বাবা তোমাকে আসলে এত বুড়ো ভাবা আমার ঠিক হয়নি।
রিমা ফিরোজকে প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সব ঔষধগুলো খাওয়ানোর পর তার বাবার পাশে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল, বাবা তুমি তো প্রতিদিন এতগুলো করে ঔষধ খাও, তোমার আসলে অসুখটা কী?
ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, অসুখের কথা কি ডাক্তাররা কখনো বলে রে মা, শুধু বলে ঔষধ খান ঠিক হয়ে যাবেন আর আমরা বেঁচে থাকার আশায়, সুস্থ থাকার আশায় ঔষধ খাই।
রিমা আর কোন কথা বলল না। কয়েকমুহূর্ত বসে রইল তারপর জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা বাবা আমি তো এখন বড় হয়েছি, তাই না?
ফিরোজ রিমার মুখের দিকে তাকালো, হঠাৎ করে বড় হয়েছিস বললি কেন বলো তো?
বাবা তুমি কিন্তু আমাকে কিছু নিয়ম শিখিয়েছো কারো প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করতে হয় না, আগে উত্তর দিতে হয়।
ও তাই তো, বলে ফিরোজ আবার রিমার মুখের দিকে তাকালো, হ্যাঁ মা তুই তো বড় হয়ে গেছিস, আমি খেয়ালই করিনি। আমি তোর প্রশ্নের উত্তর দিলাম এখন আমাকে বল তো তুই হঠাৎ করে বড় হওয়ার কথা বললি কেন? তুই কোথাও প্রেম-ট্রেম করছিস নাকি?
বাবা আমি প্রেম করলে তুমি অবশ্যই জানবে, আমি তো সবার আগে তোমাকে বলবো, তুমি আমার ভালো বন্ধু না?
তবে?
বাবা আমার তো এইচ.এস.সি পরীক্ষা শেষ হলো।
হ্যাঁ।
আমি কোথায় ভর্তি হবো?
তোর যেখানে পছন্দ, যেখানে তুই ভর্তির সুযোগ পাবি সেখানেই ভর্তি হবি।
বাবা!
হ্যাঁ বল।
তোমাকে কে দেখবে বাবা? বলতে বলতে রিমার চোখ থেকে পানি ছিটকে পড়ল।
ফিরোজ রিমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, তোর কী হয়েছে রে মা? হঠাৎ করে তোর মনটা খারাপ হয়ে গেল কেন?
রিমা চোখ মুছলো।
ফিরোজ বলল, পৃথিবীতে কাউকে কারো দেখতে হয় না মা, আর নিজের চলার পথে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হয় কখনো পিছু ফিরে তাকাতে হয় না।
বাবা তুমি কিন্তু স্ববিরোধী কথা বলছো।
যেমন?
বাবা মা মারা যাওয়ার পর তুমি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখলে কেন? তুমি আবার বিয়ে করে সামনের দিকে এগিয়ে গেলে না কেন?
ফিরোজ রিমার কথার কোন জবাব দিল না।
রিমা তার বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ফিরোজ বলল, রিমা তুই আসলে খুব বড় হয়ে গেছিস মা।
বাবা তুমি আমাকে শৈশব থেকে স্বপ্নদেখিয়েছো অনেক বড় হওয়ার, প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কিন্তু তুমি একটা কথা খেয়াল রাখো বাবা আমি তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবো না, তোমাকে একা ফেলে গিয়ে লেখাপড়া শিখে অনেক বড় হওয়ার মতো স্বার্থপরআমি কোনদিন হবো না।
রিমা একটু আগেই বললাম তুই বড় হয়েছিস, এখন মনে হচ্ছে তুই আসলে ছোটই আছিস।
না আমি এখন বড় হয়েছি, অনেক বড় হয়েছি, আমি এখন সবকিছু বুঝি বাবা।
তুই আসলে কী বলতে চাচ্ছিস? বলতো?
বাবা তুমি আমার জন্য অনেক করেছো, আসলে আমি বুঝিনি কথাটা তোমাকে আমার আরো আগে বলা উচিত ছিল।
এত চিন্তা করছিস কেন? আমি তো তোর ভালো বন্ধু যা বল্বি কোন রকমের ভনিতা ছাড়াই সোজা বলে দিবি?
বাবা মা যখন আমাকে রেখে মারা গেল আসলে তখনই তোমার বিয়ে করা উচিত ছিল, তখন না হয় আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বিয়ে করলে না এখন তো আমি বড় হয়েছি, এখন তুমি একটা বিয়ে করো।
ফিরোজ হো হো করে হেসে উঠলো, তুই আমাকে হাসালি, আমার বয়স কত জানিস?
হ্যাঁ, পঁয়তাল্লিশ বছর।
পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সে কেউ বিয়ে করে?
হ্যাঁ এটা তো স্বাভাবিক।
ফিরোজ রিমার দিকে রাগান্বিতি চোখে তাকালো।
রিমা বলল, বাবা মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সঙ্গীর প্রয়োজন, মানুষ একা বাঁচতে পারে না। তাছাড়া তোমার বয়স বাড়ছে, তুমি এক সময় বার্ধক্যে ভুগবে তখন কে তোমার দেখাশুনা করবে? তুমিই বলো?
আচ্ছা তুই বলতো এখন মানুষের গড় আয়ু ক'বছর?
পঁয়ষট্টি বছর।
আমার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ বছর, মানুষের গড় আয়ু অনুযায়ী আমি আর চৌদ্দ বছর বাঁচবো আবার যে কোন সময় মরেও যেতে পারি। সঙ্গী বলতে তুই যা বলছিস সেই সঙ্গী ছাড়াই আমি কত বছর কাটালাম জানিস?
আগে কত বছর কাটানো আর বার্ধক্যে কয়েকদিন কাটানোর মধ্যে অনেক তফাৎ বাবা।
আচ্ছা যাক ওসব কথা, তুই এডমিশন টেস্টের জন্য পড়ছিস তো?
রিমা রেগে গেল, বাবা তুমি কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টাচ্ছো, এটা আমি একেবারে পছন্দ করি না। কীসের আমার লেখাপড়া? কীসের প্রতিষ্ঠিত হওয়া? যে বাবা প্রায় দেড় যুগ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিজের জীবনের সবকিছু উৎসর্গ করতে পারে তাকে ছেড়ে আমি যাবো লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হতে, না? বাবা তোমার বিয়ের পর আমি এডমিশন টেস্টের ফরম তুলতে যাবো, তার আগে আমি এক পা নড়বো না। আমার জিদ সম্পর্কে তুমি খুব ভালো করেই জানো আমি কিন্তু অনঢ়।
ফিরোজ রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, যা মা রাত হয়েছে, ঘুমাতে যা।
আমি ঘুমাতে যাচ্ছি, কাল সকালে আবার আলাপ হবে। তুমি প্রসঙ্গ পাল্টাবে না, আমি কিন্তু কাল থেকেই মাঠে নামবো।
রিমা, বাবা মেয়েকে বিয়ে দেয়, কোন মেয়ে বাবাকে বিয়ে দেয় না।
সেটা আমি বুঝবো, থ্যাংক ইউ বাবা, গুড নাইট, বলে রিমা ফিরোজকে কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বেরিয়ে গেল।
ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হাসলো, পাগলি মা আমার।
সেদিনের মেয়ে রিমা, আজ বাবাকে শাসন করছে।
তখন ফিরোজের পোস্টিং ছিল নীলফামারী জেলায়। তার স্ত্রী প্রমী তখন সন্তান সম্ভবা। প্রমীর ডেলিভারির তারিখ অতিক্রম করার পরও ডেলিভারি না হওয়ায় ফিরোজ দুশ্চিন্তায় দিন কাটাচ্ছিল। ফিরোজের বন্ধু-বান্ধবরা ঘন ঘন খবর নিচ্ছিল। একদিন গভীর রাতে প্রমীর প্রসব বেদনা শুরু হলো। বাসায় প্রমী, ফিরোজের মা আর ফিরোজ, এত রাতে কাকে ডাকবে? কী করবে? ফিরোজ নিচতলায় বাড়িওয়ালার বাসায় দরজায় নক করলো।
বাড়িওয়ালা তো ফিরোজকে দেখে অবাক, ফিরোজ সাহেব এত রাতে? কোন সমস্যা?
আপনার টেলিফোনটা ঠিক আছে?
হ্যাঁ, কোথায় ফোন করবেন বলুন?
আমার স্ত্রী অসুস্থ, হাসপাতালে ফোন করতে হবে।
ভদ্র লোক খুব আন্তরিক ছিলেন। তিনি নিজে বাড়ির নাম ঠিকানা বলে হাসপাতাল থেকে এ্যাম্বুলেন্স আনিয়েছিলেন।
প্রমীর ডেলিভারির তারিখ-এর কয়েকদিন আগেই ফিরোজ তার মাকে এনেছিল। প্রমীর ভালো-মন্দগুলো তিনিই দেখতেন।
নীলফামারী সদর হাসপাতালে নেওয়ার পর ডাক্তার ভালোভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বললেন, সরি ফিরোজ সাহেব পেশেন্টের অবস্থা ভালো না, রিস্ক নেয়া ঠিক হবে না, আপনি রংপুরে নিয়ে যান।
ফিরোজ হাসপাতালের টেলিফোন থেকেই তার শ্বশুরবাড়ি দিনাজাপুরে টেলিফোন করেছিল।
রাতেই প্রমীকে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছিল। গাড়ি যখন হাসপাতালে পৌঁছেছিল তখন ভোর পাঁচটা।
প্রচণ্ড ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে প্রমী একবার চোখ মেলে তাকিয়েছিল, তুমি একটু আমার পাশে বসো।
ফিরোজ প্রমীর পাশে বসেছিল।
আমি বোধ হয় আর বাঁচবো না। কয়েক বছরের সংসার জীবনে তুমি আমার সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছো, আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। আসলে আমি খুব জেদি আর অহংকারী ছিলাম, অনেক সময় খুব ছোট-খাট কারণে তোমার সঙ্গে খুব দুর্ব্যবহার করেছি, আমি যদি মরে যাই তবে আমাকে মাফ করে দিও।
ফিরোজ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল, তুমি খুব জেদি আর অহঙ্কারী বলেই আমি তোমাকে পেয়েছি। আমি তোমাকে মরতে দিবো না প্রমী। আমি তোমাদের বাড়িতে টেলিফোন করেছি, হয়তো সকাল হতে হতেই আব্বা-আম্মা, ভাবী সবাই চলে আসবে।
তুমি আমাদের বাড়িতে টেলিফোন করলে কেন?
ফিরোজ বলেছিল, প্রমী বিপদের সময় প্রিয়জনদের কাছে ডাকতে হয়, সবাই এলে তুমি মনোবল পাবে, সাহস পাবে।
তুমি দেখ কেউ আসবে না, আমার বাবাকে তো আমি চিনি, আমার চেয়ে তাঁর কাছে আভিজাত্যে আর অহঙ্কারের দাম অনেক বেশি।
ফিরোজ প্রমীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছিল, কথা বলো না প্রমী, আমার দায়িত্ব আমি পালন করেছি তারা না এলে সেটা তাদের ব্যাপার।
প্রমীকে ও.টি'তে নিয়ে যাওয়ার পর ফিরোজ করিডোরে পায়চারি করছিল। তার মনের মধ্যে তখন অসংখ্য চিন্তা ভিড় করছিল। প্রমী ছাড়া তার জীবন অচল, এখন সে মধ্য বয়সী মানুষ, চলার পথ এখনো অনেকদূর বাকি। সত্যি সত্যি যদি প্রমীর কিছু হয় তবে সে কী নিয়ে বাঁচবেন?
কয়েক ঘণ্টা পর ডাক্তাররা ও.টি থেকে মলিনমুখে বেরিয়ে এসেছিলেন, ফিরোজ সাহেব আপনার মেয়ে হয়েছে।
প্রমী?
সরি ফিরোজ সাহেব, আপনার স্ত্রীকে বাঁচানো সম্ভব হলো না।
খবরটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে ফিরোজ কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিল। সত্যি সত্যি সে আজ একা হয়ে গেল। প্রমী আজ তাকে ছেড়ে গেল। এখন জীবনের বাকি দিনগুলো একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে তাকে কাটাতে হবে। সে এই ছোট্ট মেয়েকে কীভাবে মানুষ করবে, প্রমী তুমি চলে গেলে শুধু তোমার স্মৃতি হিসেবে মেয়েকে রেখে গেলে এখন আমি কী করবো? একদিনের বাচ্চা রিমাকে কীভাবে লালন-পালন করবে একথা ভেবে ফিরোজের মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়েছিল।
প্রমী বেঁচে থাকতে তার বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য কেউ ফিরোজ কিংবা প্রমী কারো সঙ্গে যোগাযোগ করেনি কিন্তু সকালবেলা হাসপাতালে এসে প্রমী মারা যাওয়ার খবর শুনে তাঁরা ফিরোজকে দোষারোপ করেছিল। ফিরোজের শ্বশুর একবার মামলা করারও হুমকি দিয়েছিলেন কিন্তু তার শাশুড়ি এবং অন্যান্যআত্মীয়-স্বজনরা তাকে বুঝিয়ে শান্ত করেছিলেন।
প্রমী মারা যাওয়ার পর ফিরোজের মা তার বাসায় ছিলেন। তিনি প্রায় প্রায় ফিরোজকে বিয়ে করতে বলতেন ফিরোজ মলিন হেসে বলতো, মা আমার রিমাকে কি তোমার বোঝা মনে হচ্ছে?
না, নিজের নাতনিকে বোঝা মনে হবে কেন? আমি যতদিন বেঁচে আছি ততদিন তো কোন অসুবিধা নেই কিন্তু তারপর? একদিন তো আমি চলে যাবো তখন রিমাকে কে দেখবে আর তোর নিজের কথা একবার ভেবে দেখ, তোর বয়সও তো কম, বাকি জীবনটা কি একাই কাটাবি?
আমার কথা তুমি বাদ দাও মা, আর রিমার কথা বলছো, তুমি যতদিন বেঁচে আছো ততদিন তুমি দেখ, তারপর আমি দেখব। তুমি দেখ হয়তো তারপর আর আমার মেয়েকে দেখতেই হবে না, ও নিজেই নিজেকে দেখবে, আমার মেয়ে না?
তার মা-ই রিমাকে লালন-পালন করেছে।
ফিরোজ, তাঁর মা আর রিমা এই তিন সদস্যের সংসার তাদের মন্দ চলছিল না। সুঃখ-দুঃখ সবকিছু তারা সমানভাবে ভাগ করে নিত।
ফিরোজের মা যখন মারা যায় তখন রিমার বয়স বারো বছর তারপর থেকে রিমা সত্যি সত্যি নিজেই নিজেকে দেখেছে।
সেদিনের সেই একদিনের বাচ্চাই আজকের রিমা। এই রিমা-ই ফিরোজের সব। বন্ধুর মতো সম্পর্ক তাদের দু'জনের মধ্যে। রিমার কলেজ, কোচিং এবং টুকটাক রান্নার কাজ শেষ করে দু'জনে একসঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে প্রায় দিনই বাপ-মেয়ে চুটিয়ে আড্ডা দেয়।
তিন
রিমার বয়স যখন আট বছর, তখন ফিরোজ বদলি হলো জয়পুরহাট। বদলির অর্ডারটা হয়েছিল ডিসেম্বর মাসে, রিমার পরীক্ষা শেষ হয়েছে এমন সময়।
ফিরোজ জয়পুরহাট জয়েন করে অফিসের কাছেই একটা বাসা ভাড়া নিলো। নিচতলায় বাড়িওয়ালা নিজে থাকতেন, সে বাসারই দ্বিতীয় তলার তিন রুম বিশিষ্ট একটা ফ্ল্যাট বাসায় ছিল ফিরোজ।
নীলফামারী থেকে জয়পুরহাট মালামাল শিফ্ট করার পর রিমা আর তার দাদি মিলে প্রতিদিন একটু একটু করে বাসা গুছাতো।
একদিন ফিরোজ অফিস থেকে ফিরে দেখল তার মা আর রিমার সঙ্গে একটি মেয়ে বাসার জিনিসপত্র গুছাচ্ছে।
ফিরোজকে বাসায় ঢুকতে দেখে মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল।
কী নাম তোমার?
আরশী।
বসো।
আরশী সোফায় বসল।
রিমা বলল, বাবা তুমি তো জানো না, আমরা যেদিন এসেছি সেদিন থেকেই আরশী আন্টি কাজ করছে তাই তো তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছানো হয়েছে।
তাই নাকি?
আরশী মাথা নত করে বসল।
রিমা বলল, তুমি নাহলে দাদিকে জিজ্ঞেস করো?
ছিঃ মা এভাবে বলতে হয় না। আমি কি তোকে অবিশ্বাস করছি যে তোর দাদিকে জিজ্ঞেস করতে হবে?
আরশী উঠে দাঁড়ালো, খালা আম্মা আমি আসি।
আসি কেন মা বসো? তোমরা গল্প কর আমি তোমাদের জন্য চা করছি।
আরশী আবার বসল।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, তুমি কোন ক্লাসে পড়?
অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে।
কোথায়?
বগুড়া সরকারী আযিযুল হক কলেজে।
তোমরা ক'ভাই বোন?
আমরা তিন বোন এক ভাই, বোনদের মধ্যে আমি মেজো।
এই দেখো আমরা তোমাদের বাসায় ভাড়া থাকি অথচ তোমাদের সঙ্গে আমাদের ভালোভাবে পরিচয়ই হয়নি, আসলে বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় আমি নিজে থাকলে হয়ত তোমাদের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত হওয়া যেত, তোমার বাবা কী করেন?
বাবা সরকারি চাকরি করতো।
এখন।
রিটায়ার্ড করেছে। আগে আমাদের শুধু নিচতলাটা ছিল, বাবা রিটায়ার্ড করার পর পেনশনের টাকা দিয়ে উপরতলাটা করেছে, বড় বোনের বিয়ে হয়েছে। এক ভাই আমার চেয়ে বড়, সবার ছোটভাই এ বছর একটা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে।
ফিরোজ আরশীর দিকে তাকাল। সে আসলে এতকিছু জানতে চায়নি কিন্তু আরশী নিজে থেকেই বলছিল। আরশীর চোখে-মুখে একটা সরলতা ছিল যা কিনা তার কথার মধ্যে ফুটে উঠছিল। ফিরোজ আপন মনে হাসল।
রিমা আরশীকে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাদের গ্রামের বাড়ি জানেন?
না তো।
দিনাজপুর, এখান থেকে অনেক দূর, আমি আমাদের গ্রামের বাড়িতে অনেকদিন আগে একবার গেছিলাম।
ফিরোজ রিমাকে কোলে নিয়ে চুমু দিল, কথা শোনো আমার মায়ের, একেবারে খাঁটি বাংলা ভাষায়।
আচ্ছা তোমরা গল্প করো আমি দাদিকে চা নিয়ে আসতে বলছি, বলে রিমা চলে গেল।
তারপর থেকে ফিরোজ বাসায় না থাকলে আরশী প্রায় উপরে উঠে আসতো। কোন কোন দিন ফিরোজের সঙ্গে সিঁড়িতে দেখা হতো কোনদিন আরশী জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতো আবার কোনদিন দরজায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতো।
সেদিন ফিরোজ অফিস থেকে বাসায় ফেরার সময় দেখে আরশী বাসার গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, ফিরোজকে দেখে সামনে এগিয়ে আসে, কেমন আছেন?
হ্যাঁ ভালো, তুমি?
ভালো।
আমাদের বাসায় আসুন।
না।
এসো না বাবা, ভিতরে এসো। আরশীর মায়ের কণ্ঠস্বর।
ফিরোজ একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে আরশীর সঙ্গে গেল।
ফিরোজ ড্রয়িং রুমে এদিক-সেদিক তাকাচ্ছিল। নিচতলার কাজ অনেক আগে করা হয়েছে তারপর আর কোনদিন হয়ত চুনকাম করা হয়নি। উপর তলার কাজ শেষ করার পর ফিরোজই প্রথম ভাড়াটে, দ্বিতীয় তলার কাজ শুরু করার আগে হয়ত ছাদ দিয়ে পানি চুয়াতো সে কারণে ছাদের তলার প্লাস্টার খসে পড়তে শুরু করেছে। ঘরের আসবাবপত্রগুলো অনেক পুরাতন, সোফার কাঠ হয়ত অনেক আগে বার্ণিশ করা হয়েছে, রং উঠে যাওয়ায় সোফাগুলো সৌন্দর্য হারিয়েছে, সোফার কভারগুলো পরিস্কার কিন্তু একটু একটু করে ছিঁড়তে শুরু করেছে বাসার সবকিছুতে যেন একটা দারিদ্রের ছাপ ফুটে উঠেছে।
আরশী পরিচয় করে দিল, আমার মা।
হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি।
আমাদের বড় সংসার, সব সময় কোন না কোন টানাটানি লেগেই থাকে, আগে তোমার খালুর চাকরি ছিল। সে সময় বাসার ফার্নিচারগুলো করা হয়েছে, এখন পেনশনের সামান্য টাকায় ফার্নিচারগুলো রং করতেই পারছি না।
ফিরোজ লক্ষ্য করেছে, আরশীর মতো তার মাও নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করেছে, তাদের মধ্যে দারিদ্র লুকানোর কোন চেষ্টা বা ইচ্ছা নেই। তাদের নিজে থেকে এই দারিদ্র প্রকাশের কারণ বুঝতে ফিরোজের অনেকদিন সময় লাগল। ফিরোজ বলল, এভাবে বলবেন না খালা আম্মা, আল্লাহ্ যখন যেভাবে রাখে সেভাবেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করতে হয়।
আরশী ডাক দিল, মা।
হ্যাঁ মা আসছি।
কয়েকমিনিট পর আরশী ট্রেতে করে নাস্তা নিয়ে এলো।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, আরশী তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে?
কোন মতে?
কোন মতে মানে?
এই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে।
কেন? পড়ালেখা আবার খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলবে কেন? ভালোভাবে পড়ালেখা করো।
করতে তো চাই।
সমস্যা কী?
আপনি সুখী মানুষ, আমাদের সমস্যার কথা বুঝবেন না, আপনি বসুন আমি চা নিয়ে আসছি।
আরশী চা নিয়ে এলো।
ফিরোজ চা শেষ করে বলল, খালা আম্মা ওপরে রিমা আছে, মা আছে আপনি একটু খেয়াল রাখবেন, মাঝে মাঝে ওপরে গিয়ে মা'র সঙ্গে গল্প করবেন, আরশী তুমিও এসো।
আরশী বলল, সেকথা আর আপনাকে বলতে হবে না, আমি তোকাজ না থাকলেই আপনার বাসায় যাই।
হ্যাঁ, রিমাও তোমাকে খুব পছন্দ করে।
সেদিন রিমা স্কুল থেকে ফিরে অনেকটা অভিমানের সুরে বলল, বাবা আমার এক বন্ধু আছে ওর বাবা ওকে প্রায় আনতে যায়, চকলেট কিনে দেয়, তুমি তো আমাকে একদিনও আনতে যাও না, আমার খুব খারাপ লাগে।
মন খারাপ করো না মা, আমি যে চাকরি করি, তোমার স্কুল আর আমার অফিস যে একই সময়ে।
বাবা আজ তো শনিবার তোমার অফিস বন্ধ ছিল তুমি গেলে না কেন?
ফিরোজের দু'চোখ দিয়ে কয়েকফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ল। সে রিমাকে কোলে নিয়ে অনেক আদর করল।
তারপর থেকে প্রতি শনিবার ফিরোজ স্কুল থেকে রিমাকে আনতে যেতে।
ফিরোজ একবার মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখল, রাত এগারোটা বাজে।
সে ডাঃ হায়দারকে মোবাইল করল, হ্যালো, হায়দার।
ফিরোজ কেমন আছিস এখন?
দোস্ত ভালো থাকলে তো তোকে ডিসটার্ব করি না।
ডিসটার্বের কথা বলছিস কেন? আমি কি তোর সঙ্গে কমার্শিয়াল আচরণ করি?
না দোস্ত, মন ভালো নেই তো তাই তোকে কী বলতে কী বলে ফেললাম? হায়দার আমরা প্রাইমারি স্কুলে যারা একসঙ্গে লেখাপড়া করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছি তাদের মধ্যে বোধ হয় আমাকে আগে যেতে হচ্ছে?
ফিরোজ এভাবে ভাবছিস কেন? তোকে তাহলে একটা গল্প বলি, শোন।
বাঃ দেশের শীর্ষস্থানীয় অন্তত দশজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের মধ্যে তুই একজন আর তোর কি না সময় আছে একজন রোগীকে গল্প শোনাবার, ঠিক আছে বল।
আমি যে ক্লিনিকে প্র্যাকটিস করি সেই ক্লিনিকে একবার এক পেশেন্ট এসেছিলেন কিডনি ডায়োলাইসিস করতে। কয়েকদিন ঢাকায় থাকার পর একদিন ডাক্তারকে ডায়োলাইসিস করার মেশিনের দাম জিজ্ঞেস করলেন।
ডাক্তার মেশিনের দাম বলার পর তিনি একটা মেশিন কিনে তাঁর শহরের বাসার নিচতলায় স্থাপন করলেন এবং ডাক্তার তার বাসায় গিয়ে সময়মতো ডায়োলাইসিস করে আসতেন। বেশ ভালোই যাচ্ছিল তার শারীরিক অবস্থা। তারপর তিনি একদিন মাইক্রোবাস নিয়ে তার গ্রামের বাড়িতে চাষ-আবাদ দেখতে গেলেন, ফেরার পথে তিনি সড়ক দূর্ঘটনায় মারা গেলেন।
হায়দার তুই আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিস? আমার যে অসুখ হয়েছে সে অসুখে না মরে আমি অন্য অসুখেও মরে যেতে পারি?
এক্সাক্টলি।
আচ্ছা হায়দার আমি কি আর বেশিদিন বাঁচবো না, না মানে আমি বলছিলাম আমাকে কত তাড়াতাড়ি সবকিছু গুছাতে হবে?
ফিরোজ এভাবে জানতে চাচ্ছিস কেন? জীবনের সব ভালো কাজই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গুছাতে হয়।
হায়দার ডাক্তারদের সবচেয়ে আগে হতে হয় একজন ভালো মনোবিজ্ঞানী, তারপর ডাক্তার। ভলো মনোবিজ্ঞানী না হলে কেউ বড় ডাক্তার হতে পারে না। আসলে আমি এখন বুঝতে পাচ্ছি কেন তুই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি নাম করেছিস।
থ্যাঙ্ক ইউ দোস্ত, এখন ঘুমানোর চেষ্টা কর।
চার
ছাত্র জীবনে ফিরোজের বাবা যখন মারা যায় তখন থেকে পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত বিষয়-সম্পত্তি তার মা দেখাশুনা করতো। ফিরোজের চাকরির পর সে আর কোনদিন সেসব বিষয়-সম্পত্তির কোন খোঁজ-খবর নেয়নি। চাচাতো ভাইয়েরা তার জমি-জমা দেখাশুনা করে আয়-ব্যয়ের যা হিসাব দিত তাতেই সে সন্তুষ্ট থাকতো। জমিজমার কাগজ-পত্র চাচাতো ভাইয়েরাই দেখাশুনা করতো। তাছাড়া সে নিজেও কিছু জমিজমা কিনেছে, সেসব জমির খারিজ চাচাতো ভাইয়েরাই করেছে এবং কখন কোন জমির খাজনা দিতে হবে তাও তারাই করতো। সে মাঝে মাঝে তাদের কাছ থেকে খোঁজ খবর নিত। তবে তাদের সমস্ত জমি জমার কাগজ-পত্র দেখাশুনা করতো জলিল মহুরি।
সকালবেলা নাস্তার পর ফিরোজ জলিল মহুরিকে ডেকে পাঠালো।
জলিল মহুরি ফিরোজের প্রতিবেশী, মাঝে মাঝে রাস্তায় দেখা হলে শুধু সালাম বিনিময় হতো কিন্তু আজ হঠাৎ করে তাকে ডেকে পাঠানোয় সে কিছুটা অবাক হলো, প্রায় ঘণ্টা খানেক পর জলিল মহুরি এলো, ভাইজান কী মনে করে হঠাৎ আমাকে ডেকেছেন?
জলিল তোমার সঙ্গে আমার অনেক কাজ আছে।
জি ভাইজান বলুন কী কাজ?
তুমি তো অনেকদিন থেকে আমাদের জমি-জমার কাগজ দেখাশুনা করো।
জি।
ফিরোজ একটা ফাইল জলিল মহুরির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, বাবার অংশ থেকে পাওয়া এবং আমার কেনা জমির কিছু কাগজ-পত্র মনে হয় এই ফাইলে আছে। যেসব জমির কাগজ-পত্র নেই সেগুলো হয়ত আমার চাচাতো ভাইদের কাছে কিংবা তোমার কাছে আছে।
জলিল মহুরি সব কাগজগুলো দেখে বলল, ভাইজান আপনার কেনা জমির কাগজ-পত্রগুলো তো ঠিক আছে, শরিকের জমির কাগজ-পত্রগুলো আমি খুঁজে বের করি, আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
তুমি সবগুলো কাগজ-পত্র খুঁজে বের করো, জমি রেজিস্ট্রি করতে যেসব কাগজ লাগবে সব যোগাড় করো।
জমি রেজিস্ট্রি করার কথা শুনে জলিল মহুরি মুখ তুলে কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে ফিরোজের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমার বিষয়-সম্পত্তি যা আছে সব আমার মেয়ে রিমার নামে দান করে দিব।
জি ভাইজান।
কত খরচ পড়বে?
হিসাব করে দেখতে হবে ভাইজান।
তুমি হিসাব করে আজ সন্ধ্যায় আমাকে জানাবে, আগামীকাল রেজিস্ট্রি হবে।
জি ভাইজান।
একটা কথা মনে রাখবে।
জলিল মহুরি মুখ তুলে তাকাল, কী কথা ভাইজান?
কথাটা যেন কেউ না জানে, এমন কি রিমাও যেন না জানে।
ঠিক আছে ভাইজান, কেউ জানবে না।
টেবিলে খাবার দিয়ে রিমা সব সময় তার বাবার দিকে খেয়াল করে, কতটুকু খাচ্ছে, কোনটা তার বাবা বেশি পছন্দ করে, কোনটা কম পছন্দ করে এসব।
ফিরোজ আগে শাক-সব্জি দিয়ে খাওয়া শুরু করতো তারপর মাছ কিংবা মাংস যেটা তার পছন্দ সেই তরকারি দিয়ে খেত। আজ তার ব্যতিক্রম ঘটল।
ফিরোজ বলল, মা মাংসের বাটিটা এদিকে দে তো।
বাবা সব্জি খাবে না?
খাবো পরে?
বাবা তুমি কি খাবার ধরণটাও পাল্টিয়েছ নাকি?
হ্যাঁ।
কেন?
আগে কম পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে খাওয়া শুরু করতাম, বেশি পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে পরে খেতাম কিন্তু আমার মনে হয়েছে নিয়মটা ঠিক ছিল না।
কেন?
এই ধর আমি কম পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে খাওয়া শুরু করলাম এবং বেশি পছন্দের তরকারিগুলো দিয়ে খাওয়া শুরু করার আগে মরে গেলাম, তখন তো আর আমার বেশি পছন্দের তরকারিগুলো খাওয়া হলো না। তাই নিয়মটা একটু পাল্টিয়েছি।
রিমা হেসে ফেলল।
হ্যাঁ শুধু তাই না আমার মনে হয় জীবনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো তাড়াতাড়ি সেরে ফেলা উচিত।
রিমা শাসনের সুরে বলল, বাবা তুমি এমন করে কথা বলছ কেন? বলতো?
না এমনি।
খাওয়া শেষ করে নিত্য দিনের মতো ফিরোজ ড্রয়িং রুমে বসল।
পিছনে পিছনে রিমাও তার বাবার পাশে বসল।
বাবা তুমি যা-ই বলো না কেন? আমি বুঝতে পাচ্ছি তুমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য এসব আধ্যাত্মিক কথা বলছ।
আমি প্রসঙ্গ পাল্টানোর জন্য বলব কেন? কোনটা সত্যি কথা না তুই বল?
আচ্ছা যাক এখন তোমার কথা বলো।
কী কথা?
বাবা তোমার কি কাউকে পছন্দ আছে?
ফিরোজ রেগে গেল, রিমা।
না বাবা, আমি বলছিলাম যদি থাকে তো ভালো, আর না হলে তো আবার আমাকে মা খুঁজতে হবে।
রিমা ফাজলামি করবি না।
বাবা!
ছোটবেলায় তোর মা মারা গেছে দেখে আমি তোকে বাবা-মা দু'জনের স্নেহ, মায়া-মমতা দিয়ে বড় করেছি, তোকে কোনদিন শাসন করিনি তাই তুই আমার মাথায় উঠেছিস, আমার সঙ্গে যাচ্ছেতাই কথা বলছিস।
রিমা কোন কথা বলল না, তার চোখ দিয়ে পানি ছিটকে পড়ল। সে আর কোন কথা না বলে তার রুমে গিয়ে বিছানায় শুয়ে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল।
ফিরোজ কয়েক মিনিট বসে রইল। তারপর রিমার রুমে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল, আমার ভুল হয়ে গেছে মা, আসলে তোকে কী বলতে কী বলে ফেলেছি, আয় বসি দু'জনে কিছুক্ষণ গল্প করি।
রিমা মাথা থেকে তার বাবার হাত সরিয়ে দিয়ে বলল, আমি তোমার সঙ্গে গল্প করবো না, আমি এখন ঘুমাবো।
তাহলে আমি কার সঙ্গে গল্প করবো, তুই ছাড়া যে আমার আর কেউ নেই, বলতে বলতে ফিরোজের কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এলো।
রিমা বিছানায় শুয়ে থেকেই চোখ মুছে বলল, আমি তোমার সঙ্গে গল্প করতে পারি তবে তোমাকে একটা প্রমিজ করতে হবে?
কী প্রমিজ?
তুমি আর কোনদিন আমার ওপর রাগ করতে পারবে না।
এ রকম শর্ত দিয়ে কখনো প্রমিজ করতে হয় না, কারণ তুই যদি কোন অন্যায় করিস তবে আমি তোকে শাসন করতে পারবো না?
আমি প্রমিজ করলাম, আমি কোন অন্যায় করবো না। এখন তুমি প্রমিজ করো তুমিও আমাকে কোনদিন ধমক দিবে না।
প্রমিজ।
রিমা বিছানা থেকে উঠল।
ফিরোজ রিমার হাত ধরে বিছানা থেকে তাকে নিয়ে এসে আবার সোফায় বসল।
ফিরোজ রিমার চোখ মুছে দিতে দিতে বলল, বাবা আমার মাথায় একটা নতুন বুদ্ধি এসেছে।
কী বুদ্ধি?
তার আগে তোকে একটা গল্প শুনতে হবে।
বলো।
আমাদের সঙ্গে এক মেয়ে লেখাপড়া করতো তারপর সে যখন এস.এস.সি পাস করল তখন একদিন হঠাৎ করে তার বাবা-মা তাকে বিয়ে দিয়ে দিল।
তারপর।
আমাদের ধারণা ছিল মেয়েটার লেখাপড়া হয়ত এ পর্যন্তই শেষ হবে, কিন্তু শেষ হয়নি। সে সংসার করতে করতে মাস্টার্স পাস করার পর এখন সরকারি চাকরি করছে।
এটা আবার নতুন কী? এটা কোন নতুন ঘটনাও না, আকর্ষণীয় ঘটনাও না।
ফিরোজ রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, আমিও তোকে বিয়ে দিতে চাই মা।
বাবা!
হ্যাঁ মা তোর যদি কোন ছেলেকে পছন্দ থাকে তো বল?
আমার কোন পছন্দ নেই বাবা, থাকলে তোমাকে বলতাম আর আমি সবে মাত্র এইচ.এস.সি পরীক্ষা দিয়েছি, আমি এখনি বিয়ে করবো কেন?
বিয়ের পর লেখাপড়া করবি, আচ্ছা তোর এক বন্ধু যে একদিন বাসায় এসেছিল ইমন না কী নাম?
ইমন, বন্ধু না কাজিন।
ইমনকে রিমা ভালোবাসে, সুযোগ পেলেই দু'জনে একসঙ্গে ঘুরে বেড়ায় কিন্তু রিমা ইমনকে বিয়ে করবে এবং রিমার বাবা সেটা এত সহজে মেনে নিবে এটা দু'জনের কেউ কোনদিন ভাবেনি আজ যখন ফিরোজ নিজে থেকেই ইমনের নাম বলল তখন রিমা মনে মনে অনেকটা খুশি হলো।
ওকে তোর পছন্দ না?
বাবা আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়নি।
তা হয়নি আগামী মাসের পনেরো তারিখে তোর বয়স আঠারো বছর হবে তখন তোর বিয়ের বয়স হবে এখন থেকে বিয়ের আলাপ শুরু করলে বিয়ে হতে হতে তোর বয়সও পূর্ণ হবে।
বাবা।
হ্যাঁ তোর জন্ম তারিখ আমার মনে থাকবে না?
বাবা তুমি না বলতে আমি আগে লেখাপড়া করে প্রতিষ্ঠিত হবো, নিজের পায়ে দাঁড়াবো তারপর তুমি আমার বিয়ে দিবে, এখন হঠাৎ করে মত পাল্টাচ্ছ কেন?
ঐ যে বললাম ভালো তরকারি দিয়ে ভাত খাওয়া শুরু করতে, এখন আমার মনে হচ্ছে আমার সব কাজের মধ্যে তোর বিয়েটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তাই আগে বিয়ের কথা বলছি। তুই আমার মেয়ে, বিয়ের পরও তুই ঠিকই নিজেকে গুছিয়ে নিতে পারবি।
না বাবা, না।
মা তুই যখন যা বলেছিস আমি তাই করেছি। আমার আদর স্নেহে তু্ই একটু বেশি জেদি হয়েছিস্, আমিও তোর সব কথা শুনেছি তুই আমাকে আমার এই ইচ্ছাটা পূরণ করতে দে।
বাবা তুমি এভাবে কথা বলছ কেন? তুমি কোথাও চলে যাচ্ছ নাকি?
ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হেসে বলল, কীভাবে বলছি একেবারে স্বাভাবকিভাবে বলছি, তুই আমার কথা ভাবিস না মা, যা তুই এখন ঘুমিয়ে পড়।
রিমা তার রুমে গেল।
ফিরোজ একবার মোবাইলের ঘড়িতে দেখল।
রাত দশটা বাজে।
সে কামালকে মোবাইল করল, হ্যালো কামাল।
জি ভাইজান।
তুমি কি বাসায়?
জি ভাইজান।
তুমি একবার আমার বাসায় আসতে পারবে?
ভাইজান জরুরী কিছু? কোন সমস্যা?
না কোন সমস্যা না, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
ভাইজান আসছি।
কিছুক্ষণের মধ্যে কামাল চলে এলো।
রিমা দরজা খুলে দিল, আঙ্কেল আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসলাম, কামাল ড্রয়িং রুমে বসল।
ফিরোজ বলল, তুই তোর রুমে যা মা।
ভাইজান হঠাৎ আমাকে কী মনে করে ডেকেছেন?
কামাল রিমা আমার একমাত্র মেয়ে, ওর মা যদি বেঁচে থাকতো তবে হয়ত বিষয়টা আমাকে ভাবতে হতো না, আমি কোথাও গেলে মেয়েটা সারাদিন বাসায় একা থাকে, একা কোথাও বেরও হয়না, বলতে গেলে ও একেবারে নিঃসঙ্গ। আমারও অনেক বয়স হয়েছে আল্লাহ না করুন হঠাৎ করে যদি মরে যাই তবে মেয়েটার আর পৃথিবীতে কেউ থাকবে না।
একথা মুখে আনবেন না ভাইজান।
না, হায়াত মউতের কথা তো আর বলা যায় না। তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমার মা রিমাকে আমি বিয়ে দিব।
ভাইজান হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত নিলেন?
কামাল তোমার ছেলে আছে না, ইমন।
জি।
রিমা আর ইমন পরষ্পরকে ভালোবাসে, তুমি সম্মতি দিলে আমি ওদের বিয়ে দিতে চাই।
ভাইজান আপনি আমার চাচাতো ভাই এবং বংশের সবার বড় ছেলে, আপনাকে আমরা সবাই মুরুব্বী মানি, তাই আপনি যখন চাচ্ছেন তো আমার আর আপত্তি কি, তা না হলে তো আমার ছেলে আপনার মেয়ের জামাই হওয়ার যোগ্য না। আপনি আরো ভেবে দেখেন ভাইজান।
আমি যোগ্যতা দেখে মেয়ে বিয়ে দিচ্ছি না, আমি মনে করি ছেলে-মেয়ে দু'টাই আমার এবং আমার মেয়ে ইমনকে পছন্দ করে। আমি ওর ইচ্ছা পূরণ করে মরতে চাই।
ভাইজান আপনি কিন্তু বার বার করে মরে যাবার কথা বলছেন, এটা আর একবারও বলবেন না।
আমি ভেবে দেখেছি কামাল, আমার শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, তুমি সবকিছুর আয়োজন কর, মনে কর বর-কনে দু'জনেরই গার্জিয়ান তুমি।
ভাইজান, আপনার কী কোন অসুখ করেছে?
ফিরোজ কিছু বলল না।
ভাইজান হঠাৎ করে আপনার এরকম সিদ্ধান্ত? আপনি আমাদের সবাইকে মেয়েদের শিক্ষিত,স্বাবলম্বীরে গড়ার কথা বলে নিজের একমাত্র আদরের মেয়েকে বিয়ে দিতে চাচ্ছেন?
ফিরোজ কামালের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই তার রাগান্বিত চোখ দেখে কামাল চোখ নামাল।
রিমা চায়ের ট্রে নিয়ে ভিতরে ঢুকল।
পাঁচ
সেদিন ছিল শনিবার। রিমাকে তার স্কুল থেকে নিয়ে এসে বাসার কলিং বেল টিপতেই ফিরোজের কানে তার মায়ের কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, মা আরশী দরজাটা খুলে দাও তো।
আরশী দরজা খুলে দিয়ে ভিতরে চলে গেল।
হঠাৎ করেই ফিরোজের মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিল। আরশী তো অনেকদিন থেকে জয়পুরহাটেই আছে, একটানা এতদিন কলেজ বন্ধ থাকে নাকি? ফিরোজ মনে মনে হিসাব করছিল, এখন কি মাস? এখন কলেজে কোন পরীক্ষা চলছে নাকি বা কোন ছুটি বিশেষ করে গ্রীস্মকালীন বা শীতকালীন ছুটি? না কোন কিছুই তার মনে আসছে না। সে আরশীকে ডাক দিয়েছিল, আরশী।
আরশী সামনে এসে দাঁড়ালো।
দাঁড়িয়ে আছ কেন? বস।
আরশী ফিরোজের সামনের সোফায় সঙ্কুচিত হয়ে বসল।
ফিরোজ সাহেব জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা আরশী তোমাকে তো অনেকদিন থেকে বাসায় দেখছি, তোমার কলেজ বন্ধ নাকি?
না, কলেজ খোলা আছে।
তবে তুমি যাচ্ছ না যে?
না, এমনিতেই যাচ্ছি না।
কিন্তু ফিরোজ বিশ্বাস করতে পারেনি। তার মনে হচ্ছিল নিশ্চয়ই অন্য কোন কারণ আছে। সাধারণত এই অঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়ার হার কম। বেশিরভাগ অভিভাবক তাদের মেয়েদের লেখাপড়ার পাশাপাশি বিয়ের জন্য ঘর-বর খুঁজতে থাকে। তারপর ভালো ঘর-বর পেয়ে গেলে লেখাপড়ার সমাপ্তি ঘটে সে পর্যন্তই। আরশীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরোজের মনে হচ্ছিল সে যেন কিছু লুকাচ্ছে। ফিরোজ প্রশ্ন করল, এমনিতেই যাচ্ছ না, নাকি কোন সমস্যা?
আরশী কোন কথা বলেনি, মাথা নত করে বসেছিল।
আরশী আজকাল লেখাপড়া, চাকরি, সবক্ষেত্রেই যা প্রতিযোগিতা তাতে ভালোভাবে লেখাপড়া না করলে তো হবে না, কলেজ খোলা আছে অথচ তুমি কলেজে যাচ্ছ না, ক্লাস করছ না।
আরশী মাথা নত করেই মৃদু কণ্ঠে বলল, আগামী মাসের তিন তারিখে যাবো।
আজ তো কেবল একুশ তারিখ, তিন তারিখ আসতে তো অনেক দেরি, তারমানে তুমি পনেরো দিন ক্লাস করবে না?
বাবা বলেছে এক কিংবা দুই তারিখে পেনশনের টাকা পাবে। আমার বই, হোস্টেলে খাওয়া-থাকার খরচের টাকা লাগবে তো, বাবা টাকা দিলেই চলে যাবো।
তো আপাততঃ ক'টাকা হলে তুমি বগুড়া যেতে পারছো?
দু'হাজার।
ফিরোজ মানি ব্যাগ থেকে দু'হাজার টাকা বের করে আরশীর হাতে টাকা দিতে চাইল, তুমি বগুড়া চলে যাও, যদি খালা বা খালু টাকার কথা জিজ্ঞেস করে তবে আমার কথা বলবে। খালু যখন পেনশনের টাকা পাবে তখন আমাকে দিলেও চলবে।
আরশী যেন লজ্জায় আরো জড়সড় হয়ে গেল, না, লাগবে না।
ফিরোজ গম্ভীরস্বরে বলল, নাও, বড়দের কথা না করতে হয় না। আমি তো বললাম খালা কিংবা খালুকে আমার কথা বলবে।
আরশী টাকা নিল, তার দু'চোখ যেন পানিতে টলমল করছিল।
তুমি এখন যাও, ব্যাগ-ট্যাগ গুছিয়ে চলে যাও।
আচ্ছা।
আরশী পরদিনই বগুড়া চলে গিয়েছিল।
সেদিনের পর থেকে আরশী প্রায় দিনই তার বান্ধবীর মোবাইল ফোন থেকে ফিরোজের মোবাইলে মিস কল দিত। আর ফিরোজ কল ব্যাক করে কথা বলতো।
প্রায় মাস খানেক পর আরশী বাড়িতে এলো।
এসেই বাসায় ব্যাগ রেখে ওপর তলায়।
তখন রাত আটটা বাজে ফিরোজ টি.ভি দেখছিল।
আরশী সালাম দিয়ে একটা মুচকি হেসে বলল, কেমন আছেন?
হ্যাঁ ভালো, তুমি?
জি ভালো।
চলে আসলে কেন? কলেজ বন্ধ নাকি?
কাল পুলিশে লোক নিবে, আমি একবার লাইনে দাঁড়াবো মনে করছি, আমার জন্য দোয়া করবেন।
তুমি লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরি করবে?
তাছাড়া আর উপায় কী? আপনি তো আমাদের সংসারের অবস্থা কিছুটা হলেও জানেন, যদি চাকরিটা হয়ে যায় তবে বাবার বোঝা কিছুটা হাল্কা হবে।
তুমি কি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছো?
জি, আপনি দোয়া করবেন।
অবশ্যই দোয়া করবো।
পরদিন আরশী পুলিশ লাইন ইণ্টারভিউ দিয়ে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত হলো। নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথমে মোবাইলে ফিরোজকে খবরটা দিল তারপর রাতে বাসায় ফিরে ফিরোজের পা ছুঁয়ে সালাম করল।
তারপর এই ইনকোয়ারি, সেই ইনকোয়ারি সবকিছু শেষে আরশীকে পাঠানো হলো রংপুর পুলিশ ট্রেনিং সেন্টারে।
কয়েকদিন যেতে না যেতেই আরশী ফিরোজকে মোবাইল করে অনেকক্ষণ কান্নাকাটি করেছিল। ফিরোজ তো অবাক। যে মেয়ে অনেক উৎসাহ নিয়ে পুলিশে যোগ দিল সে মেয়ে ক'দিন পরেই ভেঙ্গে পড়বে কেন? আরশী কাঁদছ কেন?
আপনি আমাকে কি চাকরিতে পাঠালেন? এখানে চাকরি করলে তো আমি মরে যাবো।
আমি পাঠালাম কীভাবে? তুমি তো খুব আগ্রহী ছিলে, আমি কিন্তু তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি নাকি সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছ তাই আমি আর তোমাকে বাধা দিলাম না।
আপনি সবকিছু জানতেন কিন্তু জেনে-শুনেও আমাকে নিষেধ করেননি, আপনার নিজের মেয়ে হলে আপনি কখনো এখানে চাকরি করতে পাঠাতেন না।
কাঁদছ কেন? কী হয়েছে?
এখানকার খাবার-দাবার খুব খারাপ আর সব সময় শুধু ট্রেনিং আর ট্রেনিং, এই ক'দিনে আমার স্বাস্থ্যটা একেবারে শেষ হয়ে গেছে, আপনার মেয়ে হলে আপনি আমাকে ফেরত নিয়ে যেতেন।
আরশী কষ্ট করে ট্রেনিংটা শেষ কর, ট্রেনিং শেষ হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
ঠিক হয়ে যাবে না, ট্রেনিং শেষ হতে হতে আমি মরে যাবো।
তুমি তোমাদের বাড়িতে বলেছ?
হ্যাঁ।
কী বলেছে?
কেউ কিছু বলেনি।
আচ্ছা ঠিক আছে ওখানে সরকারিভাবে যে খাবার দেয় তার বাইরে কি অতিরিক্ত টাকা দিয়ে খাবার কিনে খাওয়ার সুযোগ আছে?
আছে কিন্তু কেন্টিনে টাকা দিয়ে কিনে খেতে হবে।
তাহলে আমি তোমার জন্য কিছু টাকা পাঠিয়ে দিই?
কেন? আপনি একবার দেখতে আসতে পারেন না?
আমি তোমাকে দেখতে আসবো?
হ্যাঁ, আসেন না একবার, আগামী শুক্রবার, শনিবার তো আপনার অফিস ছুটি আছে।
ফিরোজ চুপ করেছিল।
কী হলো? আসবেন না?
আসবো।
আরশীর মুখের দিকে তাকিয়ে ফিরোজের খুব মায়া হয়েছিল। এই ক'দিনে আরশীর চোখ দু'টো কোটরে বসে গেছে, চেহারায় ক্লান্তির ছাপ।
ফিরোজকে দেখে আরশীর দু'চোখ ছলছল করে উঠল।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ আরশী?
আপনি দেখে বুঝতে পাচ্ছেন না, আমি কেমন আছি?
হ্যাঁ, তা বুঝতে পাচ্ছি। আসলে ট্রেনিং-এর সময় একটু কষ্ট হয়, ট্রেনিং শেষ হলে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
ট্রেনিং শেষ হলে সব ঠিক হয়ে যাবে, ট্রেনিং তো কেবল শুরু হলো ট্রেনিং শেষ হওয়া পর্যন্ত আমি বেঁচে থাকলে তো?
আরশী এভাবে বলতে হয় না, আচ্ছা আমি দেখছি কী করা যায়?
আরশী আপন মনে বলতে শুরু করল, এখানে যে খাবার দেয় এগুলো আমি খেতে পারি না, সব সময় ক্ষিদে লেগেই থাকে, তারওপর ট্রেনিং সেই ভোর বেলা থেকে।
আরশী তুমি তো সেদিন বললে তোমাদের কেন্টিনে আলাদাভাবে খাবার কিনতে পাওয়া যায়, আমি তোমাকে টাকা দিয়ে যাচ্ছি তুমি কিনে খাবে, বলে ফিরোজ আরশীর হাতে এক হাজার টাকা দিল।
আরশী টাকাগুলো হাতে নিয়ে চোখ মুছল।
ফিরোজ উঠে দাঁড়ালো, আরশী আমি তাহলে আসি।
একটু বসুন প্লিজ, আমি আপনার সঙ্গে বাইরে যাবো, আমি এখানে আসার পর একদিনও এই ট্রেনিং সেন্টার থেকে বের হইনি। আমি একবার আপনার সঙ্গে বের হবো, বাইরে হোটেলে বসে কিছু খাবো তারপর ভিতরে ঢুকব। আপনি একটু বসুন আমি,তৈরি হয়ে স্যারকে বলে আসছি।
এমনিভাবে আরশী ধীরে ধীরে ফিরোজের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল।
ফিরোজ পাশ ফিরে শুইলো।
ছয়
আরো দু'দিন অতিক্রান্ত হলো। আরশী ফিরোজকে খুঁজে বের করার উপায় খুঁজে পেল না। আরশীর পাশের বেড-এ লিজা ঘুমাচ্ছে দেখে আরশীর খুব হিংসা হলো। তার জীবনটাও একদিন এমন সুখের ছিল, ইচ্ছা করলেই যখন ইচ্ছা তখন ঘুমাতে পারতো, প্রাণ খুলে হাসতে পারতো। ফিরোজের প্রেমে পড়াটা তার জন্য ভুল ছিল কিনা সে এটা নিয়ে ভাবতে চায় না কিন্তু ফিরোজের মতো একজন ভালো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে নূরের প্রেমে পড়া ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। ফিরোজের একটা মেয়ে ছিল, রিমা। খুব সুন্দর হাস্যজ্জ্বল একটা মেয়ে, ফিরোজ কোনদিন বাসায় কোন ভালো খাবার বা রিমার জন্য বাজার থেকে কিছু নিয়ে এলে আরশীও কোনদিন তার ভাগ থেকে বঞ্চিত হতো না। তার জীবনে নূর না এলে ফিরোজের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোনদিন নষ্ট হতো না, আর ফিরোজ তার সঙ্গে থাকলে আর তার কিছু প্রয়োজন ছিল না। আসলে সে নিজেই তার জীবনটাকে জটিল করে ফেলেছে।
ট্রেনিং শুরু হওয়ার প্রায় দেড় মাস পর আরশী ছুটি নিয়ে বাড়ি গিয়েছিল। বাড়ি গিয়েই সে সুযোগ খুঁজছিল ফিরোজকে একা পাবার।
সেদিন বিকেলবেলা আরশী ফিরোজের বাসায় গিয়েছিল।
ফিরোজ তখন সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছে, রিমা বিকেলবেলা কোচিং-এ। খালা আম্মা রান্নাঘরে নাস্তা তৈরি করছিল।
আরশী কলিং বেল টিপতেই ফিরোজ দরজা খুলে দিল।
খালা আম্মা রান্না ঘর থেকে বলল, কে?
খালা আম্মা আমি।
বসো মা।
জি খালা আম্মা আমি বসছি, নাস্তা খেয়ে যাবো কিন্তু, আপনি একাই তৈরি করবেন নাকি আমিও রান্না ঘরে যাবো।
তুমি বসো মা।
আরশী মুচকি হেসে বলল, কেমন আছেন?
ভালো, তুমি?
আমিও ভালো আছি।
আরশী ফিরোজের পাশের সোফায় বসল, আপনি খুব নিষ্ঠুর, আমি কাল এসেছি, আপনি জানেন আমি এসেছি তারপরও আপনি একবার খবর নেননি।
আরশী আমি আসলে অনেক কাজে ব্যস্ত থাকি তো।
আমি কিন্তু হাজার চিন্তায় ব্যস্ত থাকলেও সব সময় আমার শুধু আপনার কথা মনে পড়ে। আমার ভালোর কথা আপনার মতো কেউ ভাবে না।
তাই নাকি?
জি।
তাই আমি একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
কী সিদ্ধান্ত?
আরশী একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে ফিরোজের হাতে একটা খাম দিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করল, এটা আমার রোজগারের প্রথম টাকা আমি আপনাকে দিলাম, আমার জন্য দোয়া করবেন।
ফিরোজ আরশীর থুতনি উঁচু করে ধরে তার চোখে চোখ রাখল, আরশী বসো, পাগলামি করো না।
আরশীর দু'চোখ পানিতে ছলছল করছিল। সে রুদ্ধকন্ঠে বলল, পাগলামি না, আমি যা করেছি জেনে-শুনে করেছি।
আরশী এই টাকাটা তোমার বাবা-মা'র কাছে দাও, তারা তোমাকে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করেছে।
হ্যাঁ তারা আমাকে ছোটবেলা থেকে লালন-পালন করেছে কিন্তু আপনি এই ক'দিনেই আমার বাবা-মা, ভাই-বোন ও বন্ধুর স্থান দখল করেছেন, আপনি বলুন আপনি সবসময় আমার পাশে থাকবেন?
আরশী।
আগে বলুন?
হ্যাঁ বলছি।
আরশী ফিরোজের পাশের সোফায় বসল। ফিরোজ আরশীর চোখ মুছে দিল।
তখন মোবাইল ফোনের দাম সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরে ছিল, কারো সঙ্গে কথা বলার জন্য বেশিরভাগ মানুষ কমার্শিয়াল ফোনের ওরপ নির্ভর করতো। ট্রেনিং সেন্টারের নিচতলায় একটা কমার্শিয়াল ফোনের দোকান ছিল। সেখান থেকে আরশী প্রায়ই ফিরোজকে মোবাইল করতো।
একদিন মোবাইলে কথায় কথায় আরশী বলেছিল, আপনার সঙ্গে আমার সব সময় কথা বলতে ইচ্ছা করে কিন্তু কী করবো আমার তো মোবাইল ফোন নেই।
মোবাইল ফোন তোমার কী দরকার? তোমার আমার সঙ্গে কথা বলার দরকার হলে ট্রেনিং সেন্টারের নিচের কমার্শিয়াল ফোন থেকে আর না হয় তোমার কোন বান্ধবীর মোবাইল থেকে আমার মোবাইলে মিস কল দিও আমি কল ব্যাক করে তোমার সঙ্গে কথা বলব।
আমি আমার বন্ধবীর মোবাইল থেকে আপনার মোবাইলে মিস কল দিব কেন? আপনার মতো মানুষ আমার সঙ্গে থাকতে আমি আমার বান্ধবীর কাছে ছোট হবো কেন?
কিন্তু তোমার তো এখনো মোবাইল ফোন কেনার সময় হয়নি।
আমি মনে করেছিলাম আপনাকে বললে আপনি কম দামি হলেও একটা মোবাইল ফোন কিনে দিবেন কিন্তু মোবাইল ফোন কিনে দিবেন না বলে আপনি আমাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, আমি বড় মুখ করে আমার বান্ধবীদের মোবাইল কেনার কথা বলেছি তাদের কাছে আমার মান-সম্মান থাকল না আর কি।
আমাকে জিজ্ঞেস না করে তুমি বললে কেন?
আপনার ওপর আমার বিশ্বাস ছিল, আগে বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি আমার ভুল হয়ে গেছে আপনাকে আর জেরা করতে হবে না।
আমি তোমাকে মোবাইল কিনে দিব না এমন কথা বলছি না, তবে তুমি কাজটা ঠিক করোনি, আর কখনো এমন বড় মুখ করে কথা বলবে না।
ঠিক আছে।
ফিরোজ বলল, তাহলে আমি তোমাকে টাকা দিয়ে পাঠাবো তুমি তোমার কোন বান্ধবীকে নিয়ে একটা মোবাইল ফোন কিনে নিও।
না, আপনি যদি আমাকে মোবাইল ফোন দেন তবে নিজে এসে কিনে দিবেন, আমি আপনার কাছে টাকা নিব না।
কিন্তু আমি তো খুব ব্যস্ত আমার সময় হতে আরো কয়েকদিন দেরি হবে।
তা হোক কিন্তু তাড়াতাড়ি আসার জন্য চেষ্টা করবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে আমি তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য চেষ্টা করবো।
কয়েকদিন পরেই আরশী জিদ ধরল ফিরোজকে তার কাছে যাওয়ার জন্য। তার জিদ আর ভালোবাসার কাছে ফিরোজ অনেকটা নমনীয় হয়ে গেল।
সেদিন আরশী ছুটি নিয়েছিল।
ফিরোজ গেটে যেতেই আরশী বেরিয়ে এলো।
তারপর দু'জনে রংপুর জেলা পরিষদ সুপার মার্কেটে গেল।
ফিরোজ আরশীকে প্রথমে একটা মোবাইল সেট কিনে দিল, তারপর থ্রি-পিস, স্যান্ডেল, কসমেটিকস কিনতে কিনতে ফিরোজের অনেক টাকা খরচ হয়ে গিয়েছিল। ফিরোজ একটা জিনিস খেয়াল করেছিল আরশীর চাহিদা বেশি, সে খুব উচ্চাভিলাসী মেয়ে যা তার চাকরি আর তাদের পারিবারিক অবস্থার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। সাধারনত এমন মেয়েরা জীবনে চলার পথে খুব সহজে পা পিছলে পড়ে যায়, ভুল করে বেশি। যে কোন জিনিস তার চোখে পড়লেই সে কিনে দেওয়ার জন্য জিদ ধরতো। কেনা-কাটা শেষে বিকেলবেলা ফিরোজ আরশীকে রংপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে গিয়েছিল।
ফিরোজ একটা বিষয় লক্ষ্য করেছে এখানে যারা এসেছে তাদের বেশির ভাগই তরুণ-তরুণী। তার মতো বয়সের তেমন কেউ চোখে পড়ল না। তার মধ্যে তখন কেমন একটা পিছুটান কাজ করছিল। সে কিছুটা অস্বস্বিবোধ করছিল।
আরশী জোর করে হাত ধরে ফিরোজকে টেনে নিয়ে গেল, আসুন তো এই মুহূর্তে মনে করুন আমি আপনার বন্ধু, আমি আপনার বউ।
ফিরোজ আরশীর হাত চেপে ধরল, আরশী তুমি কী বললে?
আমি বললাম এই মুহূর্তে মনে করুন আমি আপনার বন্ধু, আমি আপনার বউ।
ফিরোজ আরশীর চোখে চোখ রাখল, তুমি আমার বউ হবে?
আরশী জোরে বলল, জি জনাব, জি।
ফিরোজ আরশীর মুখে হাত দিল, আরশী।
আরো জোরে বলব, সবাইকে শুনিয়ে বলব।
না, সবাইকে শুনিয়ে বলতে হবে না।
জি এই চিড়িয়াখানার সব পশু-পাখিকে সাক্ষী রেখে বলব।
আরশীর আবেগ, তারুণ্য আর ভালোবাসা যেন ফিরোজের বয়স, সামাজিক অবস্থান এবং চাকরির পদমর্যাদা সবকিছুকেই হার মানিয়েছিল। সে আরশীর প্রেমে পড়ে গিয়েছিল।
রংপুর থেকে ফিরে ফিরোজ প্রায় প্রতিদিনই গভীর রাত পর্যন্ত আরশীর সঙ্গে কথা বলতো। আরশীর কথার যেন শেষ ছিল না। মাঝে মাঝে রিমার খবর নিত, সে যেন একরকম সবকিছুকেই খুব স্বাভাবিকভাবে নিয়েছিল।
ট্রেনিং-এর পর আরশীর প্রথম পোস্টিং হয়েছিল বাঘমারা থানায়। পোস্টিং-এর খবর জানার সঙ্গে সঙ্গে আরশী ফিরোজকে মোবাইল করল।
ফিরোজ মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো।
মোবাইলে আরশীর কান্নাজড়িত কণ্ঠ ভেসে এসেছিল, আমার পোস্টিং হয়েছে।
কোথায়?
বাঘমারা থানায়।
কাঁদছ কেন?
কাঁদছি কেন মানে? আমি ওখানে কীভাবে থাকবো? ট্রেনিং সেন্টারে কোনকিছু প্রয়োজন হলে আপনি সঙ্গে সঙ্গে কিনে দিতেন, ভালো হোক আর মন্দই হোক খাওয়া-থাকার একটা ব্যবস্থা ছিল। ওখানে কিছু নেই, সবকিছু নিজেকে করে নিতে হবে।
হ্যাঁ নিবে?
নিব? আপনি বললেন আর হয়ে গেল। বাসা ভাড়া নিতে হবে, খাট, বিছানা বালিশ থেকে শুরু করে থালা-বাসন, ফ্যান, আলনা সবকিছু কিনতে হবে।
হ্যাঁ কিনবে, আমি কিনে দিব, তুমি কিচ্ছু ভেবো না, আমি সবকিছু কিনে দিব।
তাহলে আপনাকে এসে সবকিছু কিনে দিতে হবে, শুধু টাকা পাঠিয়ে দিয়েই দায়িত্ব শেষ করলে হবে না।
আরশী এখনো কী সেরকম কিছু দেখেছ, আগে তুমি জয়েন কর, ওখানকার অবস্থা দেখ, তোমার অন্যান্য কলিগরা কীভাবে আছে? তুমি কীভাবে থাকবে? তোমার থাকার জন্য কী কী কেনা লাগবে? সবকিছু দেখ, তারপর আমি সবকিছু কিনে দিব।
আসলে আপনি পাশে আছেন দেখে আমি ট্রেনিং শেষ করে চাকরিতে আসতে পারলাম আর এখনো চাকরি করতে পারবো বলে ভরসা পাচ্ছি।
আরশী ফিরোজের দেয়া আংটিটা বের করে দেখে চোখ মুছল। তারপর মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকাল রাত বারোটা বাজে সে তার ব্যাসমেট জেসমিনকে মোবাইল করল।
হ্যালো জেসমিন।
কে?
আমি আরশী, ট্রেনিং সেন্টারে আমরা একসঙ্গে ট্রেনিং করেছি।
হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, কেমন আছিস বল?
আরশী একটা নিঃশ্বাস টেনে বলল, ভালো।
এতদিন খবর নেই কেন? আবার হঠাৎ করে এত রাতে মোবাইল করেছিস?
আচ্ছা জেসমিন তোর পোস্টিং এখন কোথায়?
ডি.এম.পি'তে (ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ)।
জেসমিন তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে, তুই একটু মনোযোগ দিয়ে শোন।
বল।
আরশী জেসমিনকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলল।
জেসমিন সবকিছু শুনে বলল, এখন কী করতে চাচ্ছিস সেকথা বল।
আমি ওকে খুঁজে বের করবো।
তুই আগে জয়পুরহাট অফিসে টেলিফোন কর।
করেছি।
তারপর?
সেখান থেকেও তিনি অনেকদিন আগে বদলি হয়ে গেছেন, ঝিনাইদহ।
ঝিনাইদহ টেলিফোন কর।
আমি আর কাউকে জানাতে চাচ্ছি না রে, আসলে বিষয়টা তখন আমাদের ডিপার্টমেন্টের সবার কাছে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল তো। তাই আমি মনে করছিলাম, হেড কোয়ার্টারের ঠিকানা জানলে আমি গিয়ে উনার পোস্টিং কোথায় জেনে সেখানে চলে যেতাম। আমি রেঙ্ক পরার আগেই উনার সঙ্গে দেখা করে ওকে জানাতে চাই, আমি রেঙ্ক পরলে তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।
আমি তোর ইচ্ছার কথা বুঝতে পেরেছি, আমার এক স্যার ঝিনাইদহ বদলি হয়ে গেছেন, আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলে তোকে ঝিনাইদহ অফিসের টেলিফোন নাম্বার যোগাড় করে দিচ্ছি, তারপর তুই টেলিফোনে উনার অবস্থা জানতে পারবি, আমার মনে হয় সেটাই ভালো হবে।
জেসমিন তুই আমাকে টেলিফোন নাম্বারটা কালকে দিতে পারবি?
আগে স্যারের সঙ্গে কথা বলি।
যেমন করেই হোকতুই আমাকে কালকেই নাম্বারটা যোগাড় করে দিস। প্লিজ!
আচ্ছা চেষ্টা করবো।
সাত
রিমা ইমনকে মোবাইল করল কিন্তু মোবাইলের স্ক্রিনে বার বার করে নাম্বার ব্যস্ত লেখা ভেসে উঠছিল। একবার সংযোগ হতেই রিমা ধমকের সুরে বলল, এই নাম্বার বিজি কেন রে? কার সঙ্গে কথা বলছিলি?
কারো সঙ্গে কথা বলিনি, তোকে মোবাইল করছিলাম তাই-
কেন? আমাকে মোবাইল করছিলি কেন? তোর তো সাহস কম না, আমাকে মোবাইল করার চেষ্টা করছিলি?
ইমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, সাহসের আর দেখেছিস কী? তোকে একটা খবর দেওয়ার জন্য মোবাইল করছিলাম।
কী খবর?
তোর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা চলছে।
রিমা কৃত্রিম ধমকের সুরে বলল, তোর সঙ্গে আমার বিয়ের কথা মানে?
হ্যাঁ।
তুই আমাকে বিয়ে করবি?
আমি তোর মতো একটা আনসোস্যাল মেয়েকে বিয়ে করতে চাবো কেন? গার্জিয়ানরা পারিবারিকভাবে বিয়ের আয়োজন করছে তাই, আমি তো আবার মুরুব্বীদের কথা না করতে পারি না।
তুই মুরুব্বীদের প্রতি অনুগত হতে পারিস, আমি কিন্তু তোর মতো অনুগত না, একটু ডানপিটে। আমি কারো কথার ধার ধারি না। গার্জিয়ানরা আমাকে বিয়ে দিতে চাইল আর আমি তোকে বিয়ে করলাম, দুনিয়াটা কি এখনো উনবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আছে যে গার্জিয়ানরা বলছে আর মেয়েরা তাদের পছন্দ হোক বা না হোক গার্জিয়ানদের পছন্দ করা ছেলের হাতের পুতুল হয়ে গেছে। বাঃ গার্জিয়ানরা বলল আর উনি সেই খুশিতে তুই আমাকে মোবাইল করার চেষ্টা শুরু করল।
ইমন কোন কথা বলল না।
রিমা আবার কথা বলতে শুরু করল, তুই তো নিজেই এখনো ছাত্র, তুই আমাকে বিয়ে করলে খাওয়াবি কী করে? তুই তো এখনো নিজেই বাপের সংসারে বসে বসে খাচ্ছিস।
এখন আমি যদি বলি দুনিয়াটা কি এখনো উনবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে আছে নাকি যে ছেলেরা বিয়ে করবে আর মেয়েরা ছেলেদের ঘাড়ে বসে খাবে। ছেলেরা মেয়েদের খাওয়াবে কেন? মেয়েরাও কাজ করবে, সংসারে দু'জনের অধিকার যদি সমান হয় তবে একজনের খাওয়া-থাকার ব্যাবস্থা আরেকজন করবে কেন? তুই কি আশা করে আছিস নাকি যে আমি তোকে বিয়ে করে বসে বসে খাওয়াবো?
এটা আশা করা তো স্বাভাবিক, এদেশের সব মেয়েরা যা আশা করে আমিও তাই আশা করছি।
তুই কি এদেশের অন্য দু'চার জন মেয়ের মতো যে স্বামীর অনুগত হয়ে থাকবি, তুই তো একটা দস্যু প্রকৃতির মেয়ে, তুই তো আমাকে শাসন করবি সে কি আর আমি বুঝি না।
বুঝেছি তোর মুখ ফুটেছে তোকে বিয়ে করলে আমাকে কষ্ট পেতে হবে, আমাকে আমার পছন্দের কাউকে বিয়ে করতে হবে, তোকে বিয়ে করা একেবারে ঠিক হবে না।
কেন তুই আমাকে পছন্দ করিস না? আমাকে ভালোবাসিস না?
হ্যাঁ পছন্দ করি, তোকে আমি ভালোবাসি তারমানে তোকে বিয়ে করতে হবে একথা তোকে কে বলেছে? প্রেম করলেই বিয়ে করতে হবে একথা কোথাও লেখা আছে?
ইমনের রুদ্ধ কণ্ঠস্বর ভেসে এলো, সরি রিমা, আমি আসলে তোকে ক্ষেপানোর জন্য বললাম ওগুলো আমার মনের কথা না।
এতবড় অন্যায় করে শুধু সরি বলেই শেষ, না?
ইমন কোন কথা বলল না।
রিমা বলল, তুই একবার আমাদের বাসায় আয় তো?
আমি?
হ্যাঁ, মোবাইলে তো আমি তোর সঙ্গে কথা বলছি আর কাকে আসতে বলব?
এখনি আসতে হবে?
হ্যাঁ, এখনি আসতে হবে, জরুরী।
রিমা মোবাইলটা রেখে আপন মনে হেসে উঠল।
কয়েকমিনিটের মধ্যে ইমন চলে এলো।
ইমনের গায়ের রং ফর্সা ধবধবে, লম্বা, স্মার্ট, চোখ দু'টো খয়েরী, ঠোঁট দু'টো লাল দেখলে মনে হয় সব সময় ঠোঁটে লিপস্টিক পরেছে। আজ সে জিন্সের প্যান্ট আর গেঞ্জি পরেছে।
রিমা দরজা খুলে দিয়ে ইমনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইল।
ইমন বলল, এই কী রে বসতে দিবি না? নাকি চলে যাবো?
রিমা চমকে উঠল, হ্যাঁ ভিতরে আয়, বস।
ইমন একটা সোফায় বসল, হ্যাঁ আর কী বলতে বাকী আছে বল?
আসলে তোর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা শুরু হয়েছে ঝগড়া দিয়ে আর শেষ করতেও চাই ঝগড়া দিয়ে, তাই তোর সঙ্গে শেষ ঝগড়াটা করে নিলাম।
শেষ ঝগড়া মানে?
বলছি, বলছি তুই বস আমি আসছি বলে রিমা ফ্রিজ থেকে নাস্তা এনে টেবিলে রেখে বলল, আচ্ছা তুই বলতো বাবা এসব কী পাগলামি শুরু করেছে?
কী পাগলামি শুরু করেছে?
আমাকে বিয়ে দিবে!
নিশ্চয়ই তোর আচরণে বড় আব্বা এমন কিছু দেখেছেন যাতে উনার মনে সংশয় দেখা দিয়েছে যে তুই যে কোন সময় বংশের মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিতে পারিস, তাই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমাদের সবার উচিত তোকে বিয়ে দিয়ে বংশের মান-সম্মানকে ঝুঁকিমুক্ত করা।
এই আমাকে আমাকে আবার ক্ষেপাচ্ছিস, না? আগে কিন্তু মোবাইলে কথা বলছিলি এখন হাতের কাছে আছিস, মারবো কিন্তু।
আজ থেকেই শুরু করবি?
রিমা হেসে ফেলল, আসলে বিয়েটা খুব সহজে হয়ে যাচ্ছে, ভাবছিলাম প্রেম করবো, বাবা কসাইয়ের মতো ঘরে বন্দি রেখে অন্য ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চাইবে, আমি ঘর থেকে পালিয়ে বিয়ে করার চেষ্টা করবো, বাবা জোর করে ধরে এনে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করবে এমন মজার ঘটনা ঘটবে তাহলে প্রেম করার আনন্দ পেতাম, বাবা এত সহজে তোর সঙ্গে আমার বিয়ে দিচ্ছে যে প্রেম করার আনন্দটাই নষ্ট হয়ে গেল।
খুব সহজে সবকিছু পেয়ে যাচ্ছিস তো তাই বুঝতে পাচ্ছিস না, যদি সত্যি সত্যি সে রকম কিছু ঘটতো তবে মুখের এই হাসিটা হারিয়ে যেত, আচ্ছা যাক ঝগড়া তাহলে শুরু হচ্ছে?
মানে?
হ্যাঁ বিয়ে হওয়া মানে তো ঝগড়া শেষ হওয়া না, শুরু হওয়া।
তাই নাকি? তুই আমার সঙ্গে ঝগড়া করবি?
আমি ঝগড়া করবো কেন? ঝগড়া এমনি এমনিতেই তৈরি হবে।
এমনি এমনিতেই ঝগড়া তৈরি হবে মানে?
হ্যাঁ আমাদের ভাড়াটে আছে না ওরা প্রেম করে বিয়ে করেছে, এখন প্রায় দিনই ঝগড়া করে।
কী নিয়ে?
এই ধর স্বামী সন্ধ্যাবেলা ছোট মাছ নিয়ে এসেছে, স্ত্রী মাছ কুটতে গিয়ে বকাবকি শুরু করেছে, স্বামী বেচারা ঢাকা থেকে শখ করে বউ'র জন্য শাড়ি নিয়ে এসেছে বউ'র পছন্দ হয়নি। আবার বউ তরকারিতে লবণ বেশি দিয়েছে স্বামী এই নিয়ে বকাবকি করছে।
তাই তো? আমি তো এভাবে চিন্তা করিনি।
ইমন বলল, আমি বাবা ঝগড়া করবো না, একেবারে মারামারি করবো, ঝগড়া করলে মানুষ শুনতে পাবে কেলেঙ্কারী রটে যাবে, তারচেয়ে ধুমধাম করে মার দিব। কেউ কোনদিন বুঝতেও পারবে না যে আমি বউকে মারি।
কি? তুই আমাকে মারবি?
মারবো মানে ঠিক এভাবে বলে ইমন রিমাকে জড়িয়ে ধরার জন্য হাত বাড়িয়ে দিল।
রিমা সরে গিয়ে বলল, থাক, থাক আর তোকে দেখিয়ে দিতে হবে না।
রিমার মোবাইল বেজে উঠল।
আট
রাতে খাবার টেবিলে আবার বাবা-মেয়ের গল্প। ফিরোজ সারাদিন বাসাতেই থাকে তারপরও খাবার টেবিলে জিজ্ঞেস করে, কী রে মা দিনটা কেমন গেল?
রিমা হেসে বলে, ভালো বাবা।
অনেকদিন থেকে ফিরোজ সাধারনত বাসার বাইরে যায় না। আজ হঠাৎ করে দুপুরে বাসার বাইরে থাকায় রিমার মনে একটা প্রশ্ন দেখা দিল, বাবা তুমি আজ সারাদিন কী করলে বলতো? দুপুরে বাইরে খেয়েছ? আমাকে বললে আমিও তোমার সঙ্গে খাবার খেতাম, আজ আর রান্না করতে হতো না?
ফিরোজ বিষয়টাকে সহজ করার জন্য মৃদু হেসে বলল, তোকে যে বলা যাবে না রে মা, বিষয়টা একান্ত ব্যক্তিগত।
বাবা আমি জানি তোমার ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই, তোমার জীবনে এমন কিছু নেই যা আমি জানি না। অযথা রহস্য করছ কেন?
ততক্ষণে ফিরোজের খাওয়া শেষ হয়েছে। সে বেসিনে হাত ধুয়ে এসে আবার চেয়ারে বসে রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, তোর বাবা সম্পর্কে তোর এই ধারণাটা যদি কোনদিন মিথ্যা হয় তবে আমাকে ক্ষমা করিস মা।
বাবা কথাটা সিনেমাটিক হয়ে গেল না, বলে রিমা তার বাবার মুখের দিকে তাকাল।
তখন ফিরোজের দু'চোখ পানিতে ছলছল করছিল। বাবার চোখে পানি দেখে রিমার চোখ থেকেও পানি বের হলো, বাবা তোমার চোখে পানি?
রিমা প্লেটে খাবার রেখে উঠল।
ফিরোজ রিমার হাত টেনে ধরল, ভাত রেখে উঠলি কেন?
রিমা হাত ছাড়িয়ে নিল, বাবা আমার মনে হয় তুমি কিছু লুকোচ্ছ? হঠাৎ করে তোমার মধ্যে আমি কিছু অস্বাভাবিক আচরণ দেখছি, আমি তোমাকে বিয়ে করতে বললাম আর তুমি আমাকে বিয়ে দিচ্ছ, তুমি অনেকদিন থেকে দীর্ঘক্ষণ বাসার বাইরে কাটাও না, আজ দুপুরে বাইরে ভাত খেয়েছ, বাবা আমি কি তোমাকে চিনতে ভুল করছি?
ফিরোজ প্রসঙ্গ পাল্টালো, রিমা আমি খুব ক্লান্ত আজকের মতো আমাকে ছেড়ে দে মা, যা বলার কাল বলিস।
বাবা তুমি কিন্তু প্রসঙ্গ পাল্টালে, অন্যদিন হলে আমি তোমার উপর রাগ করতাম কিন্তু আজ তোমাকে সত্যি সত্যিই ক্লান্ত দেখাচ্ছে, তুমি রেস্ট নাও, আমি তোমার ঔষধ নিয়ে আসছি।
ফিরোজ তার রুমে গেল, কিছুক্ষণ পর রিমা ঔষধ নিয়ে তার বাবার রুমে ঢুকল।
ফিরোজ ঔষধ খাওয়া শেষ করে একবার মোবাইলের ঘড়ির দিকে তাকাল।
রিমা শাসনের সুরে বলল, বাবা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে লাভ নেই তুমি এখনি লাইট অফ করে ঘুমিয়ে পড়, আজ কিন্তু অনেক অনিয়ম করেছ আমি কিছু বলিনি, আমি যাবার দশ মিনিটের মধ্যে তুমি লাইট অফ করে দিবে।
রিমা চলে গেল।
ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হাসল, আসলে এখন নিজেকে দিয়ে বুঝতে পারছি মানুষ বড়ই বিচিত্র।
দিনে দিনে ফিরোজ যেন আরশীর একজন বিশ্বস্থ বন্ধু এবং উদার মনের প্রেমিকের পরিচয় দিয়েছিল। সে সবসময় আরশীর ভালো-মন্দের খোঁজ-খবর রাখত। আরশীর সামান্য অপ্রাপ্তিকে সে অত্যন্ত নিজের ঐকান্তিক চাহিদা বলে মনে করতো। সে যেন তার সমস্ত সম্বল নিয়ে আরশীকে উদ্ধার করার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ত।
আরশী বাঘমারা থানায় জয়েন করার পর আবার মোবাইল করে ফিরোজকে রাজশাহীতে যেতে বলেছিল। ফিরোজ রাজশাহী গিয়েছিল। আরশীর কাছ থেকে শুনে তার প্রয়োজন মতো বিছানা বালিশ, ফ্যান, থালা-বাসন কিনে দিল। আরশী যে কোন দোকানে গিয়ে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেই সে তাই কিনে দিত। তাতে প্রায় সন্ধ্যা পর্যন্ত সময় লাগল।
ফিরোজ একবার মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখে বলল, আরশী আমি তো আজ যেতে পারছি না, কোন একটা হোটেলে উঠতে হবে, তুমি কোথায় থাকবে?
আপনার সঙ্গে?
আরশী একথার মানে বোঝ?
হ্যাঁ আমি জেনে-শুনেই থাকতে চাচ্ছি।
না, আমি তোমাকে আমার সঙ্গে রাখব না।
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে আমি রাতের খাবার খেয়ে পুলিশ লাইনে চলে যাব, কাল কিন্তু আমার আরো অনেক কেনা-কাটা আছে।
বলেছি তো আমি তোমার ঘর-দোর সাজিয়ে দিয়ে যাবো।
তা আমি বুঝতে পেরেছি, আসলে আমি অনেক কিছু জিনিসের কথা চিন্তাই করিনি অথচ আপনি নিজে মনে করে আমাকে কিনে দিলেন। আপনার মতো কেউ আমাকে ভালোবাসতে পারবে না।
আরশী এটা বাজার, সব কথা সব জায়গায় বলতে হয় না।
তাহলে কালকেও আপনাকে থাকতে হবে আপনি একেবারে রবিবার এখান থেকে গিয়ে অফিস করবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আরো কথা আছে?
বলো।
আজ আপনি আমাকে যেখানে নিয়ে গেছেন, যা কিনে দিয়েছেন সবকিছু হয়েছে আপনার ইচ্ছামতো আর কাল সবকিছু হবে আমার ইচ্ছামতো।
আরশী!
হ্যাঁ, ভয় নেই আপনার বেশি টাকা খরচ করতে হবে না।
ফিরোজ গম্ভীর মুখে বলল, আরশী আমি কি তোমাকে কিছু দিতে গিয়ে টাকার হিসাব করেছি? তোমার কিছু খেতে ইচ্ছা করেছে, কিছু কিনতে ইচ্ছা করছে আর আমি দিইনি এমন ঘটনা কি ঘটেছে?
আরশী মনে মনে হাসল।
পরদিন সকালেই আরশী বেরিয়ে এলো। দু'জনে একসঙ্গে নাস্তা খেল।
তারপর প্রথমে আর.ডি.এ মার্কেট, নিউ মার্কেট ঘুরে আরশী দু'সেট থ্রি-পিস, একটা শাড়ি, শাড়ি এবং থ্রি-পিস এর সঙ্গে ম্যাচ করে কয়েক রকম কসমেটিকস কিনল। ফিরোজও আরশীর কেনাকাটায় কোন কার্পণ্য করেনি কিন্তু আরশী যখন ফিরোজকে জুয়েলার্সে নিয়ে গেল তখন ফিরোজ অবাক হয়ে গেল, আরশী, জুয়েলার্সে কেন?
আরশী ফিরোজের কানে ফিস ফিস করে বলল, নতুন বউকে স্বর্ণের জিনিস দিয়ে বরণ করবেন না?
ফিরোজ কিছু বলেনি, আসলে সে আরশীর ভালোবাসার কাছে বোবা হয়ে গিয়েছিল।
ফিরোজ একটা আংটি কিনে আরশীর হাতে দিচ্ছিল, আরশী বলল, এখন আপনার হাতে রাখুন, আমি যখন দিতে বলব তখন দিবেন।
মার্কেট থেকে বেরিয়ে আরশী একটা রিক্সায় উঠল।
কোথায় যাবে?
আপনি উঠুন তো?
ফিরোজ রিক্সায় উঠতেই আরশী রিক্সাওয়ালাকে বলল, ভদ্রা পার্কে যাও।
ফিরোজ কোনদিন ভদ্রা পার্কে যায়নি। রাজশাহী শহর তার কাছে একেবারে নতুন। আরশীও কোনদিন ভদ্রা পার্কে যায়নি। সে পুলিশ লাইনের ব্যারাকে থাকার সময় তার এক কলিগের কাছ থেকে রাজশাহী শহরের দর্শনীয় স্থানগুলো সম্পর্কে জেনেছিল।
রিক্সা ভদ্রা পার্কের সামনে এসে দাঁড়াল।
দু'জনে রিক্সা থেকে নেমে টিকেট নিয়ে ভিতরে ঢুকল।
মাঝখানে একটা পুকুর। পুকুরে একটা পুরাতন ইঞ্জিনবিহীন স্পীড বোট অযত্নে পড়ে ছিল। তার পাশে একটা ছোট নৌকা দীর্ঘদিনের অব্যবহারে গায়ে শ্যাওলা জমেছে। পুকুর পাড়ে কিছুদুর পর পর কংক্রিটের বেঞ্চের ওপরের প্লাস্টার উঠে গেছে, সমস্ত পার্কটি যেন কর্তৃপক্ষের অবহেলা আর অযত্নের সাক্ষ্য বহন করছিল।
পুকুরের পাড় ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফিরোজ আর আরশী পশ্চিম প্রান্তে চলে গিয়েছিল। কোন কোন বেঞ্চে তরুণ-তরুণীরা গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিল। ফিরোজ যেন লজ্জা পাচ্ছিল।
আরশী তার একটা হাত ফিরোজের হাতের মধ্যে দিল।
ফিরোজ আরশীর হাতটা ধরল।
পার্কের কোণা থেকে উচ্চ স্বরে মাইকের শব্দ ভেসে আসছিল। ফিরোজ আর আরশী সেদিকে গেল। সেখানে একটা টি-কর্ণার অদুরে একটা বেঞ্চে দু'জনে বসল।
টি-কর্ণার থেকে একটা বয় এলো।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, আরশী কিছু খাবে?
আরশী বয়কে জিজ্ঞেস করল, এখানে কফি আছে?
না।
ঠাণ্ডা কী কী আছে?
বয় একে একে কয়েকটি কোল্ড ড্রিঙ্কস এর নাম বলল।
আরশী দু'টা ড্রিঙ্কস আনতে বলল।
কোল্ড ড্রিঙ্কস শেষ করে দু'জনে উঠল।
ফিরোজ আরশীর একটা হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। আরশী বলল, আপনি কি বের হতে চাচ্ছেন না কি?
হ্যাঁ।
একটু ঐদিকে চলুন।
ফিরোজ আরশীর দেখিয়ে দেওয়া আঙ্গুলের দিকে তাকাল। সেদিকে ঘন ঘন গাছ, গাছের আড়ালে তরুণ-তরুণীরা অশ্লীলভাবে পরষ্পরকে জড়িয়ে ধরে কেউ বা ঘাসের ওপর বসে আবার কেউবা দাঁড়িয়ে কথা বলছিল।
ফিরোজ গম্ভীর কণ্ঠে বলল, আরশী।
আরশী ফিরোজের গম্ভীরস্বরে মোটেই ভীত হয়নি।
সে হেসে বলল, ধমক দিবেন না, এখানে আপনি আমার গার্জিয়ান না, বন্ধু।
তাই বলে!
চলুন না, প্লিজ, বলতে বলতে আরশী ফিরোজকে একরকম টানতে টানতে সেদিকে নিয়ে যাচ্ছিল।
ফিরোজ আর আরশী একটা গাছের আড়ালে দাঁড়াল।
আরশী ফিরোজের চোখে চোখ রাখল, আপনি আমাকে খুব ভালোবাসেন, না?
সে কথা কি ঢাক-ঢোল পিটিয়ে, পার্কে এসে বলতে হবে?
না তা বলতে হবে না, আমি বুঝতে পেরেছি, আপনি আমাকে সারাজীবন এভাবে ভালোবাসবেন তো?
ফিরোজ থমকে গেল, আমি কোন ভুল করছি না তো? আরশী ছোট মেয়ে, ওর সহজ-সরল মনের ওপর এভাবে-
থামলেন কেন? বলুন?
আরশী চলো, এখানে আমার ভালো লাগছে না।
আমাকে আংটি পরিয়ে দিবেন না?
আরশী আংটি পরিয়ে দেওয়ার মানে তুমি বোঝ?
হ্যাঁ বুঝি বলেই তো আংটি পরিয়ে দিতে বলছি, আমি শুধু আপনার কাছেই থাকতে চাই আর কারো কাছে যেতে চাই না।
আমিও তোমাকে তাড়িয়ে দিতে চাই না, তবে আংটি পরাতেও চাই না। তুমি আংটিটা রেখে দাও কোথাও গেলে তুমি আংটিটা পরে যেও।
আরশী ফিরোজের পা ছুঁয়ে সালাম করল।
সেদিনের কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনই ছিল ফিরোজের প্রতি আরশীর শেষ শ্রদ্ধা। তারপর আরশী যেন হঠাৎ করেই বদলে গেল। ফিরোজ আপন মনে নিজেকে জিজ্ঞেস করল, আরশীরই বা কী দোষ? উনিশ-বিশ বছর বয়সের একটা মেয়ে যে একদিন প্রমোশন পেয়ে সাব-ইন্সপেক্টর হবে, ইন্সপেক্টর হবে সে তার প্রফেশনের কাউকে বিয়ে করে সংসারী হবে এটাই তো স্বাভাবিক। হয়ত এতদিন একটা প্রমোশন হয়েছে, সংসার করছে, ছেলে-মেয়ের মা হয়েছে আসলে পৃথিবীতে সবাই নিজ নিজ কক্ষপথে ঘূর্ণায়মান, কেউ কারো জন্য অপেক্ষা করে না।
নয়
ভদ্রা পার্ক থেকে বেরিয়ে সাহেব বাজার ফিরতে প্রায় তিনটা বেজে গেল। সেখানে একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে খেতে ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, আরশী তোমার আর কী প্রোগ্রাম আছে?
এখনই তো আসল প্রোগ্রাম।
মানে?
মানে জিয়া পার্ক যাবো, এখনো দেরি আছে তার আগে আমার আর একটা শখের জিনিস কিনবো আপনি কিন্তু না করতে পারবেন না।
কী জিনিস?
একটা খাঁচাসহ পাখি।
না আমি তোমাকে পাখি কিনে দিব না।
কেন? এতকিছু কিনে দিলেন আর সামান্য একটা পাখি কিনে দিতে আপনার আপত্তি?
আমার আপত্তি আছে কারণ তুমি পাখি লালন-পালন করতে পারবে না, পাখিটাকে শেষ পর্যন্ত মেরে ফেলবে।
আরশীর মুখ কালো মেঘে ঢেকে গেল, ঠিক আছে।
তারচেয়ে চলো রাজশাহী রেল স্টেশনে, রেল স্টেশনটা খুব সুন্দর, তোমার ভালো লাগবে।
দু'জনে হোটেল থেকে বেরিয়ে রাজশাহী রেল স্টেশনে গিয়েছিল তারপর সেখান থেকে রওয়ানা দিল জিয়া পার্কের উদ্দেশ্যে।
জিয়া পার্কে ঢোকার পরই আরশীর উচ্ছ্বলতা যেন আরো বেড়ে গিয়েছিল। উচ্ছ্বলতা বললে ভুল হবে বরং শিশুসুলভ আচরণ বলাই সঙ্গত হবে।
প্রথমেই আরশী বলল ট্রেনে উঠবে।
ফিরোজ বোঝাতে চেষ্টা করল, আরশী তুমি তো আসল ট্রেনে অসংখ্যবার উঠেছ এখন আবার পার্কের ট্রেনে কেন?
পার্কের ট্রেনে ওঠার মজাই আলাদা দেখুন একটা পাহাড় আছে, আমি তো পাহাড়ের ভিতর দিয়ে ট্রেন যায় এমন ট্রেনে কোনদিন উঠিনি।
বেশ তুমি উঠো আমি দাঁড়িয়ে আছি।
না, আপনাকেও উঠতে হবে আসুন বলে হাত ধরে টানতে টানতে একে একে অনেকগুলো রাইডে তুলল কিন্তু অক্টোপাসে ওঠার সময় ফিরোজ জোর আপত্তি জানাল, আরশী আমি কোনদিন অক্টোপাসে উঠিনি, আমার খুব ভয় করছে।
আমি তো মেয়ে, আমি ভয় পাচ্ছি না আর আপনি ছেলেমানুষ হয়ে ভয় পাবেন একথা আমাকে বলেছেন আর যেন কাউকে বলবেন না।
আরশী বললাম তো আমার ভয় করে, শুধু তোমাকে বললাম আর কাউকে বলব না, প্লিজ তুমি যাও।
আরশী বলল, দেখুন দেখুন কত ছোট ছোট বাচ্চারা উঠছে, বুঝছেন না কেন আমি একাই উঠলে কোন আনন্দই পাবো না। দেখছেন না সামনে ধরে থাকার ফ্রেম আছে, বেল্ট আছে আর আমি তো পাশে আছি, আমাকে জড়িয়ে ধরবেন?
ফিরোজ ধমকের সুরে বলল, কী বললে তুমি?
আরশী ফিরোজের গা ঘেঁষে দাঁড়াল, আমি বলেছি না এখানে আপনি আমার গার্জিয়ান না, বন্ধু। আর বিপদে বন্ধুর পাশে দাঁড়ানো বন্ধুর দায়িত্ব। আপনি যদি অক্টোপাসে উঠে ভয় পান তবে আমি তো আছি, আমাকে জড়িয়ে ধরবেন।
অগত্যা ফিরোজ আরশীর সঙ্গে অক্টোপাসে উঠল।
সত্যি সত্যি ফিরোজ খুব ভয় পেয়েছিল। সে দু'চোখ বন্ধ করে আরশীকে জড়িয়ে ধরল।
আরশীর দু'চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল, যে মানুষ আমার সঙ্গে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করতো, ভয় পেলে আমাকে জড়িয়ে ধরতো, আমি নিজেও সবকিছুতেই যাকে আপন মনে করতাম তাকে আমি চরম অপমান করেছি শুধু নূরের জন্য, নূর তোমাকে আমি ছাড়বো না, তোমার জন্য আমি ফিরোজকে অপমান করেছি, বয়সের যতই তফাৎ হোক না কেন ফিরোজ আমার প্রথম প্রেম। আমি আমার মন থেকে প্রথম প্রেমের দাগ মুছতে পারছি না। আমার বিশ্বাস যে কেউ যত জনের সঙ্গেই প্রেম করুক না কেন, যার সঙ্গেই ঘর বাধুক না কেন প্রথম প্রেমের দাগ কেউ সহজে হৃদয় থেকে মুছতে পারে না। অথচ তোমার জন্য আমি আমার প্রথম প্রেমের সঙ্গে প্রতারণা করেছি। ফিরোজকে অপমান করার শাস্তি এখন আমি তিলে তিলে ভোগ করছি, জানি না এই অপরাধের শাস্তি আমাকে কতদিন ভোগ করতে হবে? জানি না ফিরোজকে আমি খুঁজে বের করতে পারবো কি না? যদি পারি তবে আমার অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইব না, শাস্তি চাইব। আমার অপরাধের শাস্তি হওয়া উচিৎ, আর যদি না পাই কিংবা যদি খুঁজে বের করতে করতে শেষ পর্যন্ত দেখা করতে না পারি তবে কি আমাকে এই অপরাধের শাস্তি আমাকে সারাজীবন ভোগ করতে হবে?
আরশীর মোবাইলের এলার্ম বেজে উঠল। রাত বারোটা বাজার এলার্ম, রাতে জেসমিনের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইলে এলার্ম দিয়ে রেখেছিল।
আরশী জেসমিনকে মোবাইল করল।
জেসমিন মোবাইল রিসিভ করেছে, হ্যালো আরশী।
জেসমিন কেমন আছিস?
ভালো, তুই?
আমার আর ভালো থাকা, জেসমিন স্যারকে মোবাইল করেছিলি?
হ্যাঁ, তুই কাগজ-কলম হাতে নে, আমি বলছি।
আরশী কাগজ-কলম হাতে নিয়ে ফিরোজের ঝিনাইদহ অফিসের টেলিফোন নাম্বারটা লিখে নিল।
পরদিন সকালবেলা অফিসে গিয়েই আরশী ফিরোজের ঝিনাইদহ অফিসের নাম্বারে টেলিফোন করল, হ্যালো আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম।
আরশী কণ্ঠস্বর শুনেই বুঝতে পারল, ফিরোজ সাহেব না, সে আগে ফিরোজের অফিসের নাম এবং টেলিফোন নাম্বার জিজ্ঞেস করল। হ্যাঁ ফিরোজের ঝিনাইদহ অফিসের নাম এবং নাম্বার ঠিক আছে। আরশী জিজ্ঞেস করল, আমি একবার ফিরোজ সাহেবের সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম, তিনি আছেন কি?
অপর পাশ থেকে যে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তাতে বোঝা গেল তিনি কোনদিন ফিরোজ সাহেবের নামই শোনেন নি।
আমি ফিরোজ সাহেবের কথা বলছিলাম তিনি আগে জয়পুরহাট ছিলেন তারপর বদলি হয়েছেন ঝিনাইদহ।
ফিরোজ সাহেব, ফিরোজ সাহেব, ও তিনি তো অনেকদিন আগেই চাকরি থেকে রিজাইনড করেছেন।
তিনি এখন কোথায় আপনি কি বলতে পারবেন, প্লিজ?
আমি তো ফিরোজ সাহেবের ঠিকানা জানি না, আপনি কে বলছেন প্লিজ?
আরশী জবাব না দিয়ে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে টেলিফোন রেখে দিল, আপনি যখন তার ঠিকানাই জানেন না তখন আপনাকে আর পরিচয় দিয়ে কী লাভ?
পাশেই তার একজন সিনিয়র আপা বসে ছিলেন, তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আরশী কোন সমস্যা?
না আপা।
আরশী আর ক'দিন পরেই তোমার প্রমোশন, তোমার রেঙ্ক লাগবে এখন তো আনন্দে থাকার কথা কিন্তু ক'দিন থেকে দেখছি তোমার মন খারাপ, ব্যাপার কী? কোন সমস্যা? কোন সমস্যা থাকলে আমাকে বলো? আমি যদি পারি তোমাকে সহযোগিতা করবো।
আপা প্রয়োজন হলে আপনাকে বলব।
আরশী কয়েকমুহূর্ত মলিন মুখে বসে রইল। তারপর আড়ালে গিয়ে জেসমিনকে মোবাইল করল।
জেসমিন মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো আরশী কী খবর?
আরশী রুদ্ধ কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, জেসমিন ফিরোজ ঝিনাইদহ নেই, সে তো অনেকদিন আগে চাকরি থেকে রিজাইনড করেছে।
এখন?
জেসমিন আমার ফিরোজের পারমানেন্ট এড্রেসটা দরকার?
ঝিনাইদহ অফিস থেকে দিতে পারল না?
না।
আচ্ছা তুই এত খোঁজাখুঁজি করছিস কেন? তুই তো এটুকু জানিস যে ফিরোজ সাহেবের বাড়ি দিনাজপুর, তুই উনার দিনাজপুর অফিসে যোগাযোগ করে দেখ, আমার মনে হয় বলতে পারবে।
জেসমিন আমি আসলে সেভাবে সবাইকে জানিয়ে তার ঠিকানা যোগাড় করতে চাচ্ছি না বিষয়টা আসলে সেসময় তার অফিসে এবং আমাদের ডিপার্টমেন্টে বেশ জানাজানি হয়েছিল তো?
তাহলে তো ঠিকানাটা তার হেড অফিস থেকে যোগাড় করতে হবে।
প্লিজ জেসমিন, আমাকে একটু হেল্প কর।
আচ্ছা আরশী আমি তো এখন ডিউটিতে আছি, ডিউটি শেষে আমি খুঁজে বের করবো, রাতে রিং দিস।
থ্যাঙ্ক ইউ জেসমিন।
আরশী মোবাইল রেখে তার চেয়ারে এসে বসল। সে মনে মনে হিসাব করল, আজ রাতে যদি অফিসের ঠিকানা পাই তবে কাল ছুটির দরখাস্ত দিবো, পরশুদিন থেকে সাতদিনের ছুটি নিয়ে ফিরোজের সঙ্গে দেখা করে তবেই রাজশাহী ফিরবো।
দশ
ফিরোজ একটা বিষয় লক্ষ্য করেছিল। বাঘমারা বদলি হওয়ার পর প্রথম কিছুদিন আরশী ফিরোজের সঙ্গে আগের মতোই যোগাযোগ রেখেছিল তারপর আরশী যখন রাজশাহী যাতায়াত শুরু করেছে তখন থেকে তার আচরণে অস্বাভাবিক পরিবর্তন ঘটেছিল।
আরশীকে মহিলা আসামি নিয়ে প্রায়ই রাজশাহী যেতে হতো। সেখানে তার পরিচয় হয়েছিল নূরের সঙ্গে। তখন নূরের পোস্টিং ছিল রাজশাহী মেট্রোপলিটন কোর্টে।
একদিন আরশী নূরের কাছে কাগজ-পত্রগুলো বুঝে দিচ্ছিল। নূর মৃদু হেসে বলল, আরশী বসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?
আরশী নূরের সামনের চেয়ারে বসল। নূর কাজের ফাঁকে ফাঁকে আরশীর সঙ্গে কথা বলছিল, আরশী আপনার বাড়ি কোথায় যেন?
জয়পুরহাট।
বাগমারা থানায় কতদিন হলো?
কয়েকমাস।
আগে কোথায় ছিলেন?
এটাই ফার্স্ট পোস্টিং।
নূর মাথা তুলতেই আরশীর চোখে চোখ পড়েছিল।
নূর হাসল।
আরশী নূরের কাছ থেকে কাগজ-পত্রগুলো নিয়ে উঠল, নূর একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, চলুন চা খাই, আসলে এখানে চা খাওয়ার ব্যবস্থা নেই তো, বাইরের দোকানে গিয়ে চা খেতে হয়।
আরশী বলল, না থাক।
না থাকবে কেন? স্যার নাই এ সময় আমরা চা খাই, চলুন।
সেদিন দু'জনে কোর্টের সামনে একটা দোকানে গিয়ে চা খেতে খেতে অনেক গল্প করেছিল।
কয়েকদিন পর নূর মোবাইল করেছিল। নূরের মোবাইল নাম্বার আরশীর মোবাইলে সেভ করা ছিল না।
আরশী মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো আসসালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম।
আপনি কে বলছেন প্লিজ?
আমি নূর।
কেমন আছেন আপনি?
ভালো, আপনি?
হ্যাঁ ভালো আছি, নূর সাহেব হঠাৎ কী মনে করে আমাকে...
না কিছু মনে করে না, আজ তো কোর্ট বন্ধ, কাজ নেই, ব্যারাকে বসে ছিলাম তাই আপনাকে মোবাইল করলাম।
হ্যাঁ আপনার তো আরামের চাকরি, আর আমার ডিউটি থানায়, ডিউটি করতে করতে অবস্থা খারাপ।
আপনি এখন কোথায়?
থানায়।
ব্যস্ত?
হ্যাঁ, আপনি রাতে রিং দিলে আমি কথা বলতে পারবো।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
রাতে নূর মোবাইল করল, তারপর দু'জনে দীর্ঘ আলাপ।
নূর একে একে আরশীরা কয় ভাইবোন, বাবা-মা বেঁচে আছে কি না সব জেনে নিল।
আরশী জিজ্ঞেস করল, এত কিছু জানতে চাচ্ছেন কেন?
এমনিই জিজ্ঞেস করছি, কোনদিন কাজে লাগতেও তো পারে।
আপনি তো আমার পুরো একটা ইণ্টারভিউ নিলেন আর আমি সব বলে ফেললাম। আমারও তো কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা করছে।
বেশ তো করুন।
আপনার গ্রামের বাড়ি কোথায়?
লালমনিরহাট জেলার হাতিবান্ধা উপজেলায়।
আপনার বাবা-মা বেঁচে আছেন?
হ্যাঁ সবাই বেঁচে আছে। বাবা কৃষক, মা গৃহিণী, বয়স দু'জনেরই ষাটের উপরে।
আপনারা কয় ভাই-বোন?
দু'ভাই এক বোন।
আপনি?
আমি সবার ছোট।
অন্যরা?
সবার বড় বোন, বিয়ে হয়েছে, বড় ভাই একটা এন.জি.ও'তে চাকরি করে ভাবী বাচ্চাসহ ঠাকুরগাঁও থাকে।
তাহলে তো আপনাদের পরিবার বেশ গুছানো।
হ্যাঁ সামনে আমার সিরিয়াল, বাবা-মা'র শারীরিক অবস্থা ভালো না, তাদের শেষ ইচ্ছা আমার বিয়ে দেখা।
আরশী শুনতে চায়নি, তবু নূর তার বিয়ে করার ইচ্ছাটা এমনভাবে বলে ফেলল যেন আরশীর সাথে তার অনেকদিনের সম্পর্ক কিংবা আরশীর সাথে তার বিয়ের কথা বলছে। নূর ইচ্ছা করলে একটু কৌশলে বলতে পারতো বা বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলে অন্য কাউকে দিয়ে প্রস্তাব দিতে পারতো। অন্য কেউ হলে আরশী ভদ্রভাবে একটা শক্ত জবাব দিত কিন্তু অফিসের কাজে নূর-এর কাছে তাকে প্রায় যেতে হয়। তাছাড়া ইতোমধ্যে কয়েকবার নূর-এর সঙ্গে কথা বলে আরশীরও যেন নূরকে ভালো লাগতে শুরু করেছে। নূর-এর সঙ্গে কথা বলার সময় তার মনের মধ্যে ফিরোজের ছবি ভেসে ওঠে, ফিরোজ বয়সে তার চেয়ে অনেক বড়, বিপত্নীক, এক মেয়ের বাবা। তাকে বিয়ে করলে অফিস এবং সমাজে সবাই তাকে তিরস্কার করবে আর নূরের সঙ্গে তার বয়সের সামঞ্জস্য আছে, দেখতে সুন্দর, তার সঙ্গে আরশীকে মানাবে ভালো। নূর নিজে থেকেই তার বিয়ে করার আগ্রহ যে তাকে লক্ষ্য করেই সেকথা বুঝতে আরশীর কোন সমস্যা হলো না। তাই সে হাসতে হাসতে নূরকে বলল, করে ফেলুন।
হ্যাঁ খুঁজছি।
খুঁজছি কেন? আপনার বয়স তো কম না, এখনো খুঁজে পাননি?
এখনো পাইনি তবে মনে হচ্ছে শীঘ্রই পেয়ে যাবো।
আরশী মনে মনে বলেছিল, নূর সাহেব খুঁজে পাবো বলতে আপনি কাকে বোঝাতে চাচ্ছেন আমি বুঝছি কিন্তু আপনাকে একটু বাজিয়ে না নিয়ে ছাড়ছি না।
আরশীর মোবাইলে ফিরোজের রিং ঢুকল।
আরশী যেন চমকে উঠল আবার পরক্ষণেই মনে হলো, কথা বললেই বা কি ফিরোজ তো কারো সঙ্গে কোনদিন কথা বলতে নিষেধ করেনি আর নিষেধ করলেই বা কি, এক সময় ফিরোজ আমাকে সহযোগিতা করেছে তারমানে এই নয় যে কারো সঙ্গে কথা বললে তার অনুমতি নিতে হবে বা কারো সঙ্গে প্রেম কিংবা বন্ধুত্ব করলে অনুমতি নিতে হবে।
হ্যালো আরশী, নূরের কণ্ঠস্বর।
হ্যাঁ বলুন।
আগামী দিন এলে একটু সময় নিয়ে আসবেন।
কেন?
দুপুরে একসঙ্গে ভাত খাবো।
দেখুন আমি তো অফিসের কাজে যাই আর কাজ শেষ হলেই চলে আসি।
তাহলে যেদিন অফিস বন্ধ থাকবে সেদিন একবার আসুন।
আচ্ছা দেখি যদি এ সপ্তাহে অফিসের কাজে যাওয়া পড়ে তবে তো দেখা হচ্ছেই।
আরশীর মোবাইলে আবার ফিরোজের রিং ঢুকল।
আরশী বলল, নূর তাহলে রাখি।
আচ্ছা।
আরশী নূরের মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ফিরোজের মোবাইলে একটা মিস কল দিয়েছিল।
ফিরোজ আরশীর মোবাইলে কল ব্যাক করল, হ্যালো আরশী।
জি বলুন।
মোবাইল এত ব্যস্ত কেন?
কথা বলছিলাম।
সে তো বুঝলাম, কার সঙ্গে এতক্ষণ কথা বললে?
আমার এক কলিগের সঙ্গে।
কী নাম? কোথায় পোস্টিং?
নাম নূর আলম, পোস্টিং রাজশাহী মেট্রোপলিটন কোর্টে, আমাকে আসামি নিয়ে আমাকে প্রায় কোর্টে যেতে হয় তো, ও কোর্টে ডিউটি করে।
ও তাহলে তো প্রায়ই দেখা হয়।
জি।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি রাখলাম।
কেন? কথা বলুন, আমার ব্যস্ততা নেই তো।
আরশী তুমি সারাদিন ডিউটি করো আবার কখনো কখনো রাতেও ডিউটি করতে হয় তুমি এখন ঘুমাও, বলে আরশীকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে ফিরোজ মোবাইল রেখে দিয়েছিল।
এগারো
সন্ধ্যাবেলা কামাল এলো।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, কামাল কী করলে?
ভাইজান সেজন্যই তো আমি এসেছি।
ফিরোজ বলতে শুরু করল, কামাল আমি বাবা-মা'র একমাত্র সন্তান, রিমাও আমার একমাত্র সন্তান। আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা দু'জন, তুমি আমার চাচাতো ভাই, তোমরা তিন ভাই-বোন, আমি তোমাদের সব সময় নিজের ভাই-বোনের মতোই জানি। আমার রিমা অনেক বড় হয়ে জানতে পেরেছে যে, তোমরা আমার চাচাতো ভাই, আগে রিমা তোমাদের আমার মায়ের পেটের ভাই বলে জানতো।
ভাইজান আপনি কি আমাদের কোন আচরণে কষ্ট পেয়েছেন?
ফিরোজ মৃদু হেসে বলল, না তোমাদের আচরণে আমি নিজেও কোনদিন ভাবিনি যে তোমরা আমার চাচাতো ভাই।
ভাইজান এখন?
এখনো, তবে কথাগুলো কেন বললাম জানো?
না ভাইজান।
কামাল তোমরা তো জানো রিমার মাকে আমি তার বাবা-মা'র ইচ্ছার বিরুদ্ধে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছিলাম কাজেই শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কোনদিন ভালো ছিল না। রিমার মা বেঁচে থাকলে হয়ত রিমার কারণে এতদিন সম্পর্কটা আবার ঠিক হয়ে যেত কিন্তু রিমার মা মারা যাওয়ার পর আবার যোগাযোগের সম্ভাবনাটাও একেবারে বন্ধ হয়ে গেছে। ওদের বিয়ের দাওয়াত দিব, এলে আসতেও পারে আবার নাও আসতে পারে বলে ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হাসলো, কামাল আসলে আমার পক্ষ থেকে রিমার বিয়ের আয়োজন করার মতো তোমরা ছাড়া আর কেউ নেই।
ভাইজান আমরা কি কোনদিন আপনার মতের বাইরে কিছু বলেছি বা করেছি, আপনি বলেছেন না আমি ইমন, রিমা দু'জনেরই বাবা, আমি সব আয়োজন করবো ভাইজান।
কামাল তুমি এক কাজ করো।
বলুন ভাইজান।
তুমি আমার ইচ্ছার কথা সবাইকে বলেছ?
জি ভাইজান।
কারো কোন দ্বিমত আছে?
না ভাইজান কারো দ্বিমত নেই কিন্তু সবাই রিমার লেখাপড়া কথা বলছে, সবাই কিছুটা অবাক হয়েছে আপনি আমাদের সবাইকে মেয়েদের উচ্চশিক্ষিত করার কথা বলেন অথচ রিমার বেলায়-
ফিরোজ আনমনা হয়ে গেল কামাল সেটা লক্ষ্য করেছে সে আর কথা বাড়ালো না। ফিরোজ একবার ক্যালেন্ডারের দিকে তাকাল, তাহলে তুমি এক সপ্তাহের মধ্যে বিয়ের সব আয়োজন করো, তুমি তো জানো, আমাকে শুধু তারিখটা কালকে জানাবে।
তা কী করে হয় ভাইজান, আমরা সবাই এক সঙ্গে বসি, এক সপ্তাহের মধ্যে সুবিধাজনক একটা দিন ঠিক করে ফেলব।
তাহলে কালই বসার ব্যবস্থা করো, বলে ফিরোজ একটা শুষ্ক হাসি হেসে মনে মনে বলল, তোমরা কেউ জানো না আমার দিন শেষ হয়ে আসছে।
ভাইজান আমি তাহলে আসি।
ফিরোজের চোখে ঘুম নেই। বিছানায় এদিক-সেদিক পাশ ফিরছিল। অনেকক্ষণ দু'চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল, না কিছুতেই ঘুম আসছে না, সেদিনের সেই ছোট্ট মেয়েটি ক'দিন পরেই বউ সাজবে। রিমাকে বউ সাজালে খুব সুন্দর লাগবে। কিন্তু একি? রিমার পাশাপাশি ফিরোজের স্মৃতিতে আরশীর বউ সাজানো ছবি ভেসে উঠছে কেন?
ফিরোজ আর আরশীর কথা মনে করতে চায় না, আরশীর জন্য তাকে জয়পুরহাট থেকে বদলি হয়ে আসতে হয়েছে, ব্যাপারটা ডিপার্টমেন্টের সবাই একরকম জেনে ফেলেছে। আরশীর জন্য একজন দায়িত্ববান কর্মকর্তার প্রতি সবাই আজে বাজে ঘৃণ্য বাক্য ছুঁড়েছে। সহকর্মী এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে তার মাথা হেঁট হয়ে গেছে। তবুও আজ রিমার বিয়ের সময় বার বার করে আরশীর ছবি তার চোখের সামনে তার সমস্ত চিন্তার মাঝে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।
আরশীর কাছ থেকে নূরের নাম প্রথম শোনার পর থেকে তার মোবাইল প্রায় সময় ব্যস্ত থাকতো।
একদিন রাতে ফিরোজ মোবাইল করেছিল কিন্তু আরশীর মোবাইল ব্যস্ত আর ব্যস্ত, প্রায় দেড় ঘণ্টা পর আরশীর মোবাইলের ব্যস্ততা শেষ হয়েছিল।
হ্যালো আরশী।
কেমন আছেন আপনি?
ভালো, তুমি?
ভালো আছি, আরশী তোমার মোবাইল এত ব্যস্ত কেন?
আমার কলিগের সঙ্গে কথা বলছিলাম।
নূরের সঙ্গে নিশ্চয়ই?
জি।
আরশী নূর তোমার কলিগ, একজন কলিগের সঙ্গে রাত বারোটার পর দেড় ঘণ্টা কী আলাপ থাকতে পারে?
নূর শুধু আমার কলিগই না, ও আমার খুব ভালো বন্ধু।
বন্ধু থাকতেই পারে তাই বলে সারাদিন কাজ করে রাত বারোটার পর মোবাইলে কথা বললে তো তোমার স্বাস্থ্য নষ্ট হয়ে যাবে।
আরশী কোন কথা বলেনি।
সেদিনের পর থেকে ফিরোজ প্রায় দিনই রাতে আরশীর মোবাইলে রিং দিয়ে মোবাইল ব্যস্ত পেত।
কয়েকদিন পর ফিরোজ আরশীর সঙ্গে যোগাযোগ করে রাজশাহী গিয়েছিল। আরশীও বাঘমারা থেকে রাজশাহী গিয়েছিল। আরশীর আচরণে ফিরোজ বুঝতে পেরেছিল আরশী আসলে আর আগের আরশী নেই, বার বার করে আরশীর মোবাইলে কল আসছিল আর সে লাইন কেটে দিচ্ছিল।
ফিরোজ একবার জিজ্ঞেস করল, কে মোবাইল করে তোমাকে বার বার?
কেউ না?
কেউ মোবাইল না করলে মোবাইল বাজবে কেন?
আরশীর মোবাইল আবার বেজে উঠল।
ফিরোজ আরশীর কাছ থেকে মোবাইলটা নিয়ে রিসিভ করল, হ্যালো।
এটা আরশীর মোবাইল না?
হ্যাঁ বলুন, আপনি কে?
আমি নূর, আপনি?
আমি আপনার নাম আগেও শুনেছি, আপনার সঙ্গে আরশীর সম্পর্ক কী বলুন তো?
আমি আরশীকে ভালোবাসি।
আপনি কি আরশীকে বিয়ে করবেন?
তার আগে আমার জানা দরকার আপনার সঙ্গে আরশীর সম্পর্ক কী?
আমার নাম ফিরোজ, আরশীর সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী সেটা আরশীর কাছ থেকেই জেনে নিবেন।
আপনি কি আরশীকে মোবাইলটা দিবেন?
অবশ্যই।
ফিরোজ মোবাইলটা আরশীর হাতে দিয়েছিল।
মোবাইলটা হাতে নিয়েই আরশী সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল, দেখুন নূর আমার কলিগ, আমরা এক সঙ্গে চাকরি করি এর চেয়ে বেশি কিছু না আর আপনি, আপনিই আমার সব।
ফিরোজ আরশীর চোখের দিকে তাকিয়েছিল কিন্তু তার চোখে যে প্রতারণা আর অবিশ্বাস লুকিয়েছিল তা সে বুঝতে পারেনি। সে কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েছিল, নূরের কথার সঙ্গে তো আরশীর কথা মিলছে না, নূর আরশীকে ভালোবাসতে পারে, বেচারা হয়ত জানে না তার আরশী আরেকজনকে ভালোবাসে।
আরশী ফিরোজের চোখে চোখ রেখে বলেছিল, আজ আপনার কাছে একটা অনুমতি চাইব, দিতে হবে কিন্তু।
আগে তো বলো শুনি।
আমি আজ থেকে আপনাকে তুমি বলে ডাকবো।
তুমি সবার সামনে আমাকে তুমি বলে ডাকবে, লোকে শুনে হাসবে তো।
হাসবে কেন? হ্যাজবেন্ডকে তো সবাই তুমি বলেই ডাকে তখন তো কেউ হাসে না, আমি ডাকলে হাসবে কেন?
আসলে তোমার আর আমার ব্যাপারটা একটু ভিন্ন তো।
কী ভিন্ন? তুমি সবসময় তোমার বয়স নিয়ে একটা হীনমন্যতায় ভুগো এটা ঠিক না।
আমি কিন্তু তোমাকে তুমি বলে ডাকার অনুমতি দিইনি।
দাওনি, এখন দাও।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আমার আর একটা ইচ্ছা আছে।
বলো।
আমি ঈদ বোনাস পেয়ে তোমাকে একটা শার্ট কিনে দিব।
ফিরোজ মুচকি হেসেছিল, তুমি ক'টাকাই বা বোনাস পাবে, সেখান থেকে আবার আমাকে শার্ট কিনে দিবে?
নিতে সঙ্কোচ হচ্ছে? আমি কম টাকা বোনাস পাবো বলে তুমি আমাকে অবহেলা করছ।
অবহেলা করছি না, ঠিক আছে তুমি যখন চাচ্ছ তখন দিবে।
বারো
রাতে আরশী জেসমিনকে মোবাইল করল, হ্যালো জেসমিন।
আরশী বল।
জেসমিন আমি যে তোকে ফিরোজের হেড কোয়ার্টারের ঠিকানা যোগাড় করতে বলেছিলাম ।
হ্যাঁ করেছি তো, লিখে নিবি?
হ্যাঁ লিখে নিব তবুও তোকে আমার সঙ্গে যেতে হবে কিন্তু?
অবশ্যই যাবো, তুই ঢাকা আসার আগে আমাকে মোবাইল করিস।
হ্যাঁ আমি তোকে মোবাইল করে আসবো এখন ঠিকানাটা বল আমি লিখে নিচ্ছি।
জেসমিন আরশীকে ঠিকানা বলল আর আরশী লিখে নিয়ে বলল, জেসমিন আমি কিন্তু কালই ছুটির দরখাস্ত দিব, ছুটি পেলে কালই তোকে জানাবো।
আচ্ছা ঠিক আছে।
জেসমিনের সঙ্গে কথা বলার পর আরশী ফিরোজের মোবাইলে রিং দিল, দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন।
আরশী মোবাইলটা বিছানায় রেখে আপন মনে বলল, দুঃখিত তো বলবেই, একদিন যে আমার মোবাইল ব্যস্ত দেখেই রেগে যেত, আমার প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিজের প্রয়োজন মনে করে হাতের কাছে এনে দিত, আমি চাইবার আগেই সবকিছু আমার কাছে এসে হাজির হতো, পৃথিবীতে কোন বাপ তার মেয়ের ভালো-মন্দের কথা এভাবে ভাবে না, কোন বন্ধু তার বন্ধুর জন্য নিজের শ্রম, মেধা, অর্থ সবকিছু এভাবে উৎসর্গ করে না, আজকাল কোন প্রেমিক তার প্রেমিকাকে এত বেশি ভালোবাসে না। অথচ এমন একজন মানুষকে আমি নূরের মতো একজন স্বার্থপর, সঙ্কীর্ণ মনের প্রতারকের জন্য অপমান করেছি, ছিঃ।
আরশী মনে মনে কয়েকবার নিজেকে ধিক্কার দিল।
তার চোখের সামনে নূরের ছবি ভেসে উঠল। সেদিন ফিরোজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আরশী নূরকে মোবাইল করেছিল।
নূর জিজ্ঞেস করছিল, তুমি এখন কোথায়?
সাহেব বাজার।
তুমি দাঁড়াও আমি আসছি।
কিছুক্ষণ পর নূর সাহেব বাজার এসে আরশীর সঙ্গে দেখা করল।
নূর আরশীর সঙ্গে দেখা করেই জিজ্ঞেস করল, তোমার ফিরোজ সাহেব কোথায়?
চলে গেছে।
ও তাই আমাকে আসতে বলেছ, তোমার সবসময় কাউকে না কাউকে চাই-ই নাকি?
নূর ফিরোজ সাহেব আমার গার্জিয়ানের মতো, রাজশাহীতে কাজে এসেছিলেন, তাই আমার সঙ্গে দেখা করেছেন, এর বেশি কিছু না।
আমার তো মনে হয় তুমি যা বললে ফিরোজ সাহেব তারচেয়ে অনেক বেশি।
আরশী বলল, নূর আমি রাঘমারা থেকে এসেছি, তুমি ফিরোজ সাহেবকে মাঝখানে টেনে আমাদের সুন্দর মুহূর্তগুলো নষ্ট করে দিও না।
তাহলে এখন আমাকে কী করতে হবে?
আবার কীভাবে কথা বলে?
কীভাবে বলব?
বলবে, চল জান কোথাও বেড়িয়ে আসি।
নূর আপন মনে বলেছিল, হ্যাঁ আরশী তো সত্যি কথাই বলেছে, ভালো কথাই বলেছে, যেটুকু সময় আরশীকে কাছে পাই সেই সময়টুকু ঝগড়া করে লাভ কী তারচেয়ে বরং এনজয় করাই ভালো।
আরশী বলল, নূর এখানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে নাকি কোথাও যাবো, প্লিজ চলো কোথাও গিয়ে একটু বেড়িয়ে আসি।
কোথায় যাবে?
তুমি জানো না? কোথায় যাবো সেটাও কি আমাকে বলে দিতে হবে?
দু'জনে একটা রিক্সায় উঠল।
কিছুদুর যাওয়ার পর রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করল, মামা কোথায় যাবো?
ভদ্রা পার্ক যাও।
ভদ্রা পার্কের কথা শুনে আরশী যেন একটু অপ্রস্তুত হয়েছিল। ফিরোজের সঙ্গে সে ভদ্রা পার্কে এসেছিল আবার এখন নূরের সঙ্গে যাচ্ছে কেউ চিনে ফেলবে না তো? আবার পরক্ষণেই মনে হলো ভদ্রা পার্কে তো অনেক ছেলে-মেয়েই আসে কার কাজ নেই যে চিনে রাখবে।
পার্কে ঢুকেই নূর আরশীর হাত ধরে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে গেল। সেখানে দু'জনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসল। আরশীর বার বার করে ফিরোজের কথা মনে পড়ছিল। ফিরোজকে সে জোর করে গাছের আড়ালে নিরিবিলি গল্প করতে নিয়ে গিয়েছিল এটা ফিরোজের বয়সের জড়তা নাকি সততা? আর নূর তাকেই হাত ধরে গাছের আড়ালে নিয়ে গেল আরশী একবার নূর-এর চোখের দিকে তাকাল কিন্তু তার চোখের ভাষা বুঝতে পারল না।
নূর জিজ্ঞেস করল, আরশী ফিরোজ সাহেব তোমার কে হয়?
আমাদের বাসায় ভাড়া থাকে, আমার গার্জিয়ানের মতো।
কিন্তু তিনি যেভাবে কথা বললেন তাতে তো মনে হলো তিনি তোমার গার্জিয়ান না, তারচেয়ে বেশি।
নূর তুমি আবার শুরু করলে? একটা কথা আমি তোমাকে কতবার বলব। আমি যা বলেছি সত্য বলেছি এর চেয়ে বেশি আমি তোমাকে বলতে চাই না, তিনি কিন্তু বলেননি তার সঙ্গে আমার সম্পর্কের কথা, বলেছেন আমাকে জিজ্ঞেস করতে। অন্য কিছু হলে তো তিনিই বলতেন আমাকে জিজ্ঞেস করতে বলতেন না। তুমি যদি অন্যকিছু মনে করে থাকো তবে সেটা তোমার বিষয় আমি আশা করি তুমি আর কখনো আমাদের দু'জনের মাঝে ফিরোজ সাহেবকে টেনে আনবে না। এমনকি আমাকে কিছু জিজ্ঞেসও করবে না।
মুহূর্তেই নূর বদলে গিয়েছিল। সে শান্ত কন্ঠে বলেছিল, ঠিক আছে তুমি যদি না বলতে চাও তবে-
তবে কী?
নূর কয়েকমুহূর্ত চুপ করেছিল। তার মনে তখন অনেক কথার ঝড় বইছিল, ঠিক আছে আর কোনদিন জানতে চাইব না, তুমি খুব চালাক মেয়ে ভেবেছো ফিরোজ সাহেব সম্পর্কে আমি না জানতে চাইলেই হলো। ফিরোজ সাহেব আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তার কথা বলার ধরণটা আমার আজো মনে আছে। তার কথাবার্তার ধরণটা মোটেই গার্জিয়ানের মতো ছিল না।
আরশী নূরকে মৃদু ধাক্কা মেরে বলল, এই কী ভাবছো?
কই কিছু না তো?
না নিশ্চয়ই কিছু ভাবছিলে, আমাকে বলো?
আরশী তুমি ভালো আছ?
না।
কেন?
শুধু ডিউটি আর ডিউটি। ডিউটি করতে করতে ক্লান্ত হয়ে গেলাম।
আচ্ছা আরশী তুমি কি আর.এম.পি'তে আসবে?
আসতে চাইলেই কি আসতে পারবো?
তুমি যদি আসতে চাও তবে আমি চেষ্টা করবো।
আর.এম.পি'তে আসতে পারলে তো ভালোই হবে, বিয়ে করবো, আমরা একটা বাসা ভাড়া নিব, সকালবেলা দু'জনে এক সঙ্গে অফিস যাবো, বিকেলবেলা এক সঙ্গে বাসায় ফিরবো, দারুণ ভালো হবে, আমি তো এমন একটা জীবনের স্বপ্নই দেখছি।
নূর আপন মনে ভাবছিল, দেখো, খুব ভালো করে স্বপ্ন দেখো, রঙীন স্বপ্ন দেখো। ফিরোজ সাহেবের কথা বললে তুমি কেমন যেন এড়িয়ে যাও, মন খারাপ করো। তুমি ভেবেছো আমি এসব বুঝিনা, জেনে-শুনে আমি তোমার মতো একটা মেয়েকে বিয়ে করবো, না? আমিও তোমার কাছ থেকে সবকিছু নগদ আদায় করে নিব, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখার চেয়ে যেটুকু সময় কাছে পাওয়া যায় সেটুকু সময় ফুর্তি করাই ভালো।
আরশী নূরকে জিজ্ঞেস করল, নূর তুমি মাঝে মাঝেই আনমনা হয়ে যাচ্ছ, আজ এত কী ভাবছো তুমি?
নূর আরশীকে নিবীড়ভাবে কাছে টেনে নিল।
আরশী নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, নূর!
কিছু মনে করলে?
না, কিছু মনে করিনি তবে খুশিও হইনি।
কেন? খুশি হওনি কেন?
আরশী গম্ভীরভাবে বলল, নূর তুমি আমাকে বিয়ে করবে তো?
এতক্ষণ পর এই কথা?
মানে?
মানে আমি তো মনে মনে তোমাকে নিয়ে ঘর সাজাতে শুরু করেছি আর তুমি বলছ আমি তোমাকে বিয়ে করবো কি না?
কথা দিলে তো?
অবশ্যই, বলে নূর আরশীকে আরো কাছে টেনে নিল, আরশী আজ মাসের দশ তারিখ, এ মাসের মধ্যে বিয়েটা হয়ে গেলে তো আগামী মাসে বাসায় উঠতে হবে, আমি আজ থেকেই বাসা খুঁজতে শুরু করবো, মাসের শেষ দিকে বাসা পাওয়া কঠিন হবে।
আগে তোমার গার্জিয়ানদের বলো, আমিও আমার গার্জিয়ানদের বলি।
নূর কয়েক মুহূর্ত আনমনা হয়ে বসেছিল।
আরশী নূরকে মৃদু ঠেলা মেরে বলল, আবার আনমনা হয়ে যাচ্ছ কেন?
ভাবছি না, স্বপ্ন দেখছি। স্যারকে বলে তোমাকে আমি আর.এম.পি'তে বদলি করে নিয়ে আসবো। কোর্ট এলাকার কাছেই একটা বাসা ভাড়া নিব, প্রতিদিন সকালবেলা একসঙ্গে নাস্তা খেয়ে অফিসে আসবো, দুপুরে বাসায় এক সঙ্গে ভাত খেয়ে আবার অফিস যাবো। ও ভালো কথা, তুমি রান্না করতে জানো তো?
হ্যাঁ।
বিকেলে কোনদিন পদ্মার পাড়, কোনদিন ভদ্রা পার্ক আবার কোনদিন জিয়া পার্ক বেড়াতে যাবো। আমাদের জীবনটা সিনেমার মতো হয়ে যাবে।
আরশী নিজেই নূর-এর আরো নিবীড়ভাবে গা ঘেঁষে বসে বলল, আমিও তোমার মতোই স্বপ্ন দেখছি নূর, আমার মনে হচ্ছে যেন সামনে আমাদের জন্য স্বর্গ অপেক্ষা করছে।
অবশ্যই।
নূর আমি কি আমাদের বাড়িতে তোমার কথা বলব?
না তোমার বলার দরকার নেই, আমি তো কয়েকদিন পর বাড়িতে যাচ্ছি আমি বাড়িতে বলে তোমাদের বাড়িতে প্রস্তাব পাঠানোর ব্যবস্থা করবো।
তুমি আমাকে নিশ্চিন্ত করলে নূর।
কয়েকদিন পর ফিরোজ আরশীকে মোবাইল করেছিল কিন্তু মোবাইল রিসিভ করল রুবিনা, হ্যালো ফিরোজ ভাই ভালো আছেন?
ফিরোজের সঙ্গে রুবিনার কোনদিন দেখা হয়নি কিন্তু মোবাইলে কয়েকবার কথা হওয়াতে কণ্ঠস্বরটা ফিরোজের কাছে পরিচিত ছিল।
হ্যাঁ ভালো, তুমি?
ভালো আছি, রুবিনা আরশী নেই?
ভাই ও তো থানায় গেছে, মোবাইলে চার্জ ছিল না তো তাই মোবাইলটা চার্জে দিয়ে ও থানায় গেছে।
কখন আসবে?
দুপুরে খেতে আসবে, আবার বিকেলে রাজশাহী যাবে।
রাজশাহী কেন?
তা তো জানি না, আমাকে বলল মনটা ভালো যাচ্ছে না তাই রাজশাহী যাবে, তো ফিরোজ ভাই শার্টটা আপনার পছন্দ হয়েছে তো? ওটা কিন্তু আমিসহ কিনেছি, আরশী আপনার যে বর্ণনা দিয়েছে তাতে আমার মনে হয় শার্টটা আপনাকে ভালো মানাবে।
কোন শার্ট?
আরশী ঈদ বোনাস পেয়ে একটা শার্ট কিনেছে, বলল আপনাকে দিবে।
ফিরোজ বুঝতে পেরেছিল নিশ্চয়ই কোন অঘটন আছে। সে আর কথা বাড়ায়নি, রুবিনা আরশী এলে আমাকে রিং করতে বলো।
জি বলব।
ফিরোজ আরশীর মোবাইলের অপেক্ষা করতে করতে তার ফোন না পেয়ে আবার মোবাইল করেছিল কিন্তু বার বার মোবাইল করার পর আরশী মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম, আরশী।
জি বলুন।
তোমাকে অনেকক্ষণ থেকে মোবাইল করছি।
হ্যাঁ সে তো বুঝতেই পাচ্ছি, মোবাইলে তো কল রেকর্ড আছে।
তুমি রিসিভ করছ না কেন?
ব্যস্ত ছিলাম।
তুমি এখন কোথায়?
আমার রুমে।
তুমি মোবাইলটা একবার রুবিনাকে দাও তো?
কেন?
বললাম তো, দাও না কথা বলি।
রুবিনা রুমে নেই, কোথায় গেছে আমি জানি না।
রুবিনা রুমে নেই নাকি তুমি রুমে নেই?
বুঝতেই যখন পাচ্ছেন তখন আবার বিরক্ত করছেন কেন?
আমি তোমাকে বিরক্ত করছি?
হ্যাঁ।
আরশী তুমি আমার নামে শার্ট কিনে নূরকে দিয়েছ, না?
হ্যাঁ দিয়েছি।
নূর আরশীর হাত থেকে মোবাইলটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করল, হ্যালো ফিরোজ সাহেব।
ও সঙ্গে আপনিও আছেন তাহলে?
হ্যাঁ আপনি আরশীর কাছ থেকে আপনার সঙ্গে আরশীর সম্পর্কের কথা জানতে বলেছিলেন এখন তো জানলাম, আপনি বয়স্ক মানুষ কেন যে এখনো মেয়ের পেছনে ঘুর ঘুর করছেন?
কে বলেছে আমি আরশীর পিছনে ঘুর ঘুর করছি?
আমি তো নিজের কানেই শুনলাম এখন একবার আরশীর কাছ থেকে শুনুন, বলে নূর আরশীকে মোবাইলটা দিয়েছিল।
আরশী মোবাইল হাতে নিয়েই রেগে গিয়েছিল, হ্যালো ফিরোজ সাহেব আমি আপনাকে বললাম, আমাকে বিরক্ত করবেন না, তারপরও আপনি নূরের সঙ্গে ঝগড়া করে কেন আমাকে নূরের কাছে ছোট করলেন? আমাকে একই ডিপার্টমেন্টে সারাজীবন চাকরি করতে হবে না? ও আমাকে কী ভাববে? তাছাড়া নূরকে আমি ভালোবাসি, কয়েকদিনের মধ্যে ওর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে, আর আপনি নূর-এর সঙ্গে ঝগড়া করলেন?
আমি তো নূরের সঙ্গে ঝগড়া করিনি, আমার জানতে ইচ্ছা করছিল নূরের সঙ্গে তোমার সম্পর্কটা, জানা হয়ে গেছে।
জানা হয়ে গেছে কিন্তু আমারও বারোটা বাজিয়ে দিয়েছেন, নূরের সঙ্গে আমার বিয়ের কথা এক রকম পাকাপাকি হয়ে গিয়েছিল আপনার কারণে যদি নূরের সঙ্গে আমার বিয়ে না হয় তবে আপনাকে আমি ছাড়বো না।
আমার কারণে নূরের সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না কেন?
বিয়ের কথাবার্তা চলার সময় আপনি যে পরিস্থিতিটা তৈরি করলেন তাতে যে কোন মানুষের জন্য প্রশ্ন দেখা দেওয়াটা স্বাভাবিক আপনি মনে রাখবেন ফিরোজ সাহেব, আমার দুর্দিনে আপনি আমার পাশে দাঁড়িয়েছেন তারমানে এই নয় যে আপনি আমার মাথা কিনে নিয়েছেন? আমি কারো সঙ্গে মোবাইলে কথা বলতে পারবো না, আমি কারো সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারবো না, আমি কাউকে ভালোবাসতে পারবো না, এটা হয় না।
আরশী তুমি কি কথাগুলো নূর-এর সামনে থেকে তাকে খুশি করার জন্য বললে?
হ্যাঁ বললাম, নূর উদার মনের ছেলে, আমি ওকে সবকিছু বলেছি, ও কিছু মনে করেনি। ও এ যুগের ছেলে, বিয়ের আগে কোন অবিবাহিত একজন মেয়ের কারো সঙ্গে সম্পর্ক থাকতেই পারে সেটা নিয়ে নূর কিছু বলবে না। আমিও নূর-এর অতীত নিয়ে কোনদিন কোন প্রশ্ন তুলব না।
আরশী আমি আর কোনদিন তোমাদের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়াবো না, তবে তোমাকে একটা কথা বলি, নূর তোমাকে বিয়ে করবে না। সে তোমাকে ব্যবহার করে পণ্যের মতো ছুঁড়ে ফেলবে। তোমার জীবনে কলঙ্ক লেপে দিবে।
ফিরোজ সাহেব আমার ভালো-মন্দ নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না, আমার ভালো-মন্দটা আমাকেই বুঝতে দিন। প্লিজ আপনি আর কোন দিন আমার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন না।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তেরো
আরশী আর নূর আরো কাছাকাছি হয়ে গিয়েছিল। কয়েকদিনের ব্যবধানে আরশী তার হৃদয় থেকে ফিরোজের স্মৃতি মুছে ফেলল। সে কয়েকদিন আগেই ফিরোজকে তুমি বলে সম্বোধন করার অনুমতি চেয়েছিল। ফিরোজের পা ছুঁয়ে সালাম করে বুকে মাথা রাখল। আবার কয়েকদিন পরই নূরকে স্বামীর আসনে বসাল। আরশীর চিন্তা-চেতনায় সব সময় ছিল নূর। নূরও আরশীকে সেরকমই কথা দিয়েছিল।
একদিন আরশী নূরকে তাদের বিয়ের কথা বলল। প্রত্যুত্তরে নূর বলল, আরশী তুমি নিজেও কনস্টেবলের চাকরি করো, তুমিও জানো আমাদের দু'জনের চাকরি করেও সংসার চালানো কত কঠিন?
তুমি না সেদিন বললে আমাকে বিয়ে করবে আর এখন বলছ বেতনের কথা। আমাদের দু'জনের বেতন দিয়ে খুব ভালোভাবে না হলেও কোন রকমে দিন চলে যাবে।
হ্যাঁ তা যাবে কিন্তু সংসারের জিনিস-পত্র তো কিছু কিনতে হবে, এই যেমনঃ একটা ভালো খাট, বিছানা-বালিস, হাঁড়ি-পাতিল, ফ্রিজ, কালার টি.ভি।
ধীরে ধীরে সব হবে।
আরশী আমি বলছিলাম মেয়েরা তো বিয়ের সময় বাপের বাড়ি থেকে এসব জিনিস নিয়ে আসে এটা এক রকম প্রচলন, কাউকে বলতে হয় না।
আরশী চমকে উঠল, নূর তুমি কি যৌতুকের কথা বলছ?
যৌতুকের কথা বলব কেন?
এগুলো তো আজকাল চাইতে হয় না, আসলে এগুলো তোমারই বলা উচিৎ ছিল।
নূর আমি যতটুকু জানি তাতে আমাদের বাড়ি থেকে এতকিছু দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই তবু আমি বাবার সঙ্গে কথা বলে তোমাকে জানাবো।
ঠিক আছে, আমি কয়েকটা বাসা দেখেছি, তুমি যেহেতু গৃহিণী হবে বাসাটা তোমারও একবার দেখা দরকার, চলো।
দু'জনে কোর্ট এলাকার কয়েকটি বাসা দেখেছিল। নূর আরশীর সঙ্গে খুব ভালো ব্যবহার করেছিল। আরশী একবারও বুঝতে পারেনি যে তার সাথে ভালো ব্যবহারের পিছনে কোন অসৎ উদ্দেশ্য আছে। বরং নূর-এর পছন্দের প্রশংসা করেছিল, নূর তোমার পছন্দ খুব ভালো। আমার তো প্রত্যেকটা বাসায় পছন্দ হয়েছে। এখন শুধু কাবিনটা হলেই আমরা নতুন বাসায় উঠতে পারি।
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছি।
কিন্তু আমার বদলি?
আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি, তোমার বদলির বিষয়টা তুমি আমার ওপর ছেড়ে দাও। বুঝছ না কেন বিয়ের পর আমি কি আমার বউকে ছেড়ে থাকবো?
আরশী ছুটি নিয়ে জয়পুরহাট গিয়ে তার বাবা-মা এবং বোন-দুলাভাই'র সঙ্গে নূর-এর সঙ্গে তার সম্পর্ক এবং বিয়ের বিষয় কথা বলল। আরশীর বিয়েতে তাদের কোন আপত্তি ছিল না কিন্তু নূরের চাহিদা মতো যৌতুক দিতে তাদের অপারগতার কথা তার বাবা আরশীকে বলেছিল।
আরশী জয়পুরহাট থেকেই নূরকে তার বাবা-মা'র অবস্থা জানাল। কিন্তু নূর আরশীর কথা শুনে বলল, আরশী তুমি কী বলছ? আজকাল অনেক নিম্নবিত্ত পরিবারের বিয়েতেও এসব ডিমান্ড তো খুব সামান্য ব্যাপার। এই মনে করো আমি যখন তোমাদের বাড়িতে আমাদের বিয়ের প্রস্তাব দিতে বলব তখন সবাই তো লেনদেনের বিষয় জানতে চাইবে। আমি যদি বলি এসবের কোন প্রয়োজন নেই তবুও হয়ত বিয়ে হবে কিন্তু সবাই মন খারাপ করবে। আবার বিয়ের পর প্রতিবেশিরা যখন জানবে তুমি একেবারে খালি হাতে এসেছ তখন তুমি বা কী বলবে? তুমি কি সারাজীবন সবার কাছে মাথা উঁচু করে কথা বলতে পারবে?
তাহলে আমি কী করবো বলো?
সেটা তুমি ভালো বোঝ, আমার আত্মীয়-স্বজনদেরকাছে তুমি আমাকে ছোট করবে না এটা আমার বিশ্বাস।
নূরকে আরশী কোনভাবেই তার অবস্থা বোঝাতে পারেনি অবশেষে সে তার আপা এবং দুলাভাই'র কাছে টাকা চেয়েছিল। আরশীর দুলাভাই মোতাহার জটিল প্রকৃতির মানুষ। সবকিছু শুনে সে বলল, ফিরোজ সাহেব তো তোমাকে খুব ভালোবাসে, তাকে বলো?
দুলাভাই ফিরোজ সাহেবকে কি একথা বলা যায়?
বললাম তো তিনি তোমাকে খুব ভালোবাসেন, আর্থিকভাবেও স্বচ্ছল মানুষ তার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা কোন ব্যাপার না।
দুলাভাই ফিরোজ সাহেবের কাছে কী বলে টাকা চাইব?
তুমি একটা বুদ্ধি বের করো কীভাবে তুমি বিষয়টা উপস্থাপন করবে। তবে তুমি ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারলে তিনি তোমাকে টাকা দিবেন।
আপনি আমার নিজের দুলাভাই, আপনিই যখন টাকা দিচ্ছেন না তখন শুধু ভালো সম্পর্কের কারণে কি একজন এতগুলো টাকা দিবে, বলে আরশী মনে মনে বলল, তাছাড়া ফিরোজকে আমি যেভাবে অপমান করেছি তাতে তার কাছ থেকে আমার টাকা চাওয়ার মুখ নেই।
মোতাহার বলল, আমি দিবো না তুমি কীভাবে বুঝলে? আগে দেখা যাক তিনি দিচ্ছেন কী না? তিনি টাকা না দিলে কি আমরা তোমাকে ফেলে দিব?
আরশীর বিবেক তাকে বাধা দিচ্ছিল আবার নূরের সঙ্গে তার বিয়েটাও যেন টাকার জন্য আটকে গিয়েছিল তাই একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আরশী তার দুলাভাই'র পরামর্শে ফিরোজকে টাকার জন্য অনুরোধ করার সিদ্ধান্ত নিল।
সেদিন সন্ধ্যায় আরশী ফিরোজকে মোবাইল করল।
কয়েকবার রিং হওয়ার পরও ফিরোজ মোবাইল রিসিভ না করায় আরশী বার বার রিং দিল। অবশেষে ফিরোজ মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো।
হ্যালো আরশী বলছি।
হ্যাঁ তোমার মোবাইল নাম্বার আমার মোবাইলে সেভ করা আছে তো।
তবে রিসিভ করছ না যে।
কেন রিসিভ করছি না তুমি বুঝতে পারছ না?
সেটা একটা বিশেষ পরিস্থিতি ছিল যে কারণে তোমাকে বলতে আমি বাধ্য হয়েছি।
বিশেষ পরিস্থিতি আর কী, তোমার নূর-এর সঙ্গে ডেটিং ছিল তাই তাকে খুশি করার জন্য বলেছিলে। বেশ তো আমি তো আর তোমাকে সেদিন থেকে মোবাইল করিনি, এখন আবার কেন মোবাইল করলে।
ঐসব অভিমানের কথা এখন রাখো, তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে?
বলো।
মোবাইলে বলব না তুমি আমাদের বাড়িতে এসো।
তোমাদের বাড়িতে কেন?
আমি কি তোমার এত পর হয়ে গেলাম? এই তো ক'দিন আগে তুমি আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজশাহী গেলে আর আজ শুধু ওপর তলা থেকে নিচে নামতেই এত কৈফিয়ত? এ কয়েকদিনে আমি এত পর হয়ে গেছি?
যে আরশীর জন্য জয়পুরহাট থেকে রাজশাহী গিয়েছিলাম সে আরশী আর তুমি তো এক মেয়ে নও।
এসো না প্লিজ!
ফিরোজ আরশীদের বাড়িতে গিয়েছিল।
আরশী ফিরোজের গা ঘেঁষে বসে বলল, সরি ফিরোজ তোমাকে ওভাবে বলা আমার ঠিক হয়নি, আমার ভুল হয়ে গেছে তুমি আমাকে মাফ করে দাও, প্লিজ!
ফিরোজ গম্ভীরভাবে বলল, আরশী তুমি কি আমাকে এসব কথা বলার জন্য ডেকেছ?
না তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে, বলতে বলতে আরশী ফিরোজের কাছে আরো নিবিড় হয়ে বসল।
ফিরোজ অস্বস্থিবোধ করছিল। সে একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, আরশী তোমাদের বাড়িতে আর কেউ নেই।
এমনসময় আরশীর আপা-দুলাভাই এবং তাদের সঙ্গে একজন অপরিচিত লোক বাড়িতে ঢুকল।
মোতাহার যেন ফিরোজকে দেখে অবাক, ফিরোজ সাহেব আপনি!
ফিরোজ একটা ঢোক গিলল, না মানে-
ঠিক আছে আর মানে মানে করতে হবে না, আরশী তুমি ভিতরে যাও।
আরশীও কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল, আমি তো ফিরোজকে কিছু বললামই না, তার আগেই দুলাভাই আমাকে ভিতরে যেতে বলছে কেন?
আরশী তার দুলাভাই'র মুখের দিকে তাকাল।
মোতাহার ধমক দিল, তুমি দাঁড়িয়ে কী দেখছ? ভিতরে যাও।
আরশীকে তার বড় আপা এক রকম জোর করে ভিতরে নিয়ে গিয়েছিল।
মোতাহার জিজ্ঞেস করল, ফিরোজ সাহেব আপনি একজন বয়স্ক মানুষ, আমাদের ধারণা ছিল আপনি আরশীকে নিজের মেয়ের মতো স্নেহ করেন কিন্তু আমাদের ধারণা মিথ্যে পরিণত হয়েছে। আপনি কম বয়সের একটা মেয়েকে পেয়ে এভাবে দিনের পর দিন-
ফিরোজ রাগান্বিতস্বরে বলল, মোতাহার সাহেব।
আর কথা বলবেন না ফিরোজ সাহেব, আপনি এমন একটা কাজ করলেন যে এ ঘটনা জানাজানি হলে আরশীর বিয়ের কী হবে আপনি বলুন?
মোতাহার সাহেব আপনি যেভাবে বলছেন তাতে মনে হচ্ছে আরশীর সঙ্গে আমি অনৈতিক কাজ করেছি, আপনি আরশীকে ডাকুন তার সঙ্গে আমার সম্পর্কে কোন বিতর্ক নেই।
সেকথা আপনি বললেই তো হবে না, সমাজের মানুষ তো আর এটা বুঝবে না, এই যে সাংবাদিক সাহেব আপনাকে একা এক ঘরে আরশীর সঙ্গে দেখলেন তিনিই বা কী ভাববেন?
আপনারা একবার আরশীকে ডাকুন, আমি কী করেছি সেটা আমি একবার আরশীর মুখ থেকে শুনতে চাই।
ও কী বলবে? ও তো ছোট মেয়ে, এখন ওর ভালো-মন্দ আমাদেরকেই ভাবতে হবে।
বেশ তো ভাবুন, বলে ফিরোজ উঠতে যাচ্ছিল।
মোতাহার বলল, উঠছেন কেন? আপনি যে আরশীর চরিত্রে কলঙ্ক লেপে দিলেন তার কী হবে?
ফিরোজ আরশীর মোবাইলে রিং দিল, মোবাইল বন্ধ।
ব্যাপারটাই যে পরিকল্পিত একথা বুঝতে ফিরোজের আর কোন অসুবিধা হয়নি। সে আর কিছু বলেনি, মাথা নত করে বসেছিল।
সাংবাদিক পরিচয়ধারী লোকটি তার পকেট থেকে কলম আর একটা ছোট প্যাড বের করে কী যেন লিখতে শুরু করল।
মোতাহার রাগান্বিতস্বরে বলল, সাংবাদিক সাহেব একটু থামুন, আসলে কী যে বলি, আপনাকে আমি নিয়ে এলাম একটু সুখ-দুঃখের কথা বলতে আর আপনি এসে কী একটা কাজে আটকে গেলেন।
সাংবাদিক সাহেব বললেন, আমি সাংবাদিক মানুষ, সংবাদ সংগ্রহ করাই আমার কাজ। ফিরোজ সাহেবদের মতো ভদ্রবেশি অপরাধীদের অপরাধ আমি নিসঙ্কোচে প্রকাশ করি, তাই মিডিয়াতে অনেকেই আমাকে একজন সাহসী সাংবাদিক হিসেবে সবাই জানে। আর শালার পড়বি তো পড় একেবারে আমার চোখের সামনে। মোতাহার ভাই আসলে আমার হাত দিয়ে আপনার শ্যালিকার নামে একটা নিউজ করতে হবে এটা লিখতে আমার হাত কেঁপে উঠছে।
একটু অপেক্ষা করুন প্লিজ, দেখি ফিরোজ সাহেব কী বলেন?
ফিরোজ ফ্যাকাশে মুখ তুলে বলল, আমি কী বলব?
আপনি কী বলবেন মানে? আরশীর বিয়ের দায়িত্ব এখন আপনাকে নিতে হবে।
বিয়ের দায়িত্ব আমাকে নিতে হবে মানে?
হ্যাঁ, আপনি যদি নিজে এ দায়িত্ব পালন করতে না পারেন তবে আরশীর বিয়েতে যে ডিমান্ড লাগবে তা আপনাকে দিতে হবে।
ফিরোজ ঘৃণার সুরে বলল, তারমানে আপনারা টাকার জন্য আরশীকে দিয়ে ফাঁদ পেতেছিলেন?
আমরা ফাঁদ পাতবো কেন? আপনি সহযোগিতা করার নামে একটা মেয়েকে দিনের পর দিন ভোগ করতে গিয়ে ফেঁসে গেছেন।
মোতাহার সাহেব আপনারা আরশীকে আমার সামনে নিয়ে আসুন, সে বলুক আমি কোনদিন তার কাছে কোন অনৈতিক কাজের প্রস্তাব দিয়েছি নাকি? আমি আরশীকে একান্ত আপনজন মনে করে সহযোগিতা করেছি।
হ্যাঁ সহযোগিতা করেছেন ঠিকই, আপনার মতো একজন বিপত্নীক লোক একটা অল্প বয়সের মেয়েকে কেন সহযোগিতা করে তা বুঝতে আমাদের বাকী নেই, এখন কীভাবে একটা সমাধানে আসা যায় তাই বলুন?
খুব সম্ভব কথাবার্তার শব্দ শুনে পাশের বাড়ির দু'য়েকজন দরজা নক করেছিল।
মোতাহার দরজা খুলে দিতেই তারাও ভিতরে ঢুকল।
তাদের বেশিরভাই ফিরোজ সাহেবের বিপরীতে অবস্থান নিল।
ফিরোজ সাহেব অপরাধীর মতো মাথা নত করে বসেছিল।
শেষ পর্যন্ত একটা বড় অংকের টাকার বিনিময়ে দফা-রফা হয়ে ফিরোজ আরশীকে সহযোগিতা করার অভিশাপ থেকে মুক্তি পেল।
জীবনের মধ্য বয়সে এ রকম একটা মানসিক আঘাতে ফিরোজ ভেঙ্গে পড়ল। সে বদলি নিয়ে ঝিনাইদহ গিয়েছিল। ধীরে ধীরে ব্যাপারটা একরকম অনেকেই জেনে ফেলেছিল। ফিরোজ সাহেবের কোন কোন কলিগ বদলির সময় হওয়ার আগে নিজেই ইচ্ছা করে বদলি হওয়াকে বাঁকা দৃষ্টিতে দেখছিল। মোবাইলে বিভিন্ন জন ফিরোজকে বিভিন্ন প্রশ্ন করতো। ফিরোজ ধীরে ধীরে চাকরিতে অমনোযোগী হয়ে পড়ল।
দূর্ভাগ্যক্রমে ঝিনাইদহ বদলির প্রায় বছর দু'য়েক পরই ফিরোজের মা মারা গেল।
মা মারা যাওয়ার শোক কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ফিরোজ নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ল।
প্রথমে ঝিনাইদহ ডাক্তার অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা শেষ করে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিৎ করছেন।
ফিরোজ শুনে যেন আঁতকে উঠলেন, হেপাটাইটিস বি ভাইরাস মানে যে ভাইরাস থেকে লিভার আক্রান্ত হয়?
ডাক্তার ফিরোজকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য বললেন, এখন হেপাটাইটিস বি আক্রান্ত রোগীও সুস্থ হয়। আপনি কোন চিন্তা করবেন না।
ধীরে ধীরে ফিরোজের শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হলো। সে আবার ডাক্তারদের স্মরণাপন্ন হলো। ডাক্তার ফিরোজকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন তারই এক বাল্য বন্ধু ডাঃ হায়দার চাকরি করতেন।
আবার শুরু হলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তিনি ফিরোজকে যে সান্ত্বনার বাণী শোনালেন তাতে ফিরোজ স্পষ্টতই বুঝতে পারল তার সময় দ্রুতগতিতে ফুরিয়ে আসছে।
ফিরোজ ঝিনাইদহ ফিরে কাউকে কিছু না বলে তার সার্ভিস রেকর্ড দেখে স্বেচ্ছায় অবসরের সিদ্ধান্ত নিল। অনেকেই অবাক হলো, কেউ কেউ ফিরোজকে আরশীর সঙ্গে তার সম্পর্ককে ইঙ্গিত করে বোঝাতে চেষ্টা করল, এ রকম দুর্ঘটনা প্রায় সব মানুষের জীবনেই ঘটে তাই বলে এ রকম একটা তরতাজা মানুষ চাকরি ছেড়ে দিয়ে অবসরে যাবে?
ফিরোজ তার অসুস্থতার কথা কাউকেই জানায়নি। সে নিজের কাছে একটাই সান্ত্বনা দাঁড় করেছিল, যে অসুখে মানুষের কোন হাত নেই সে অসুখের কথা মানুষকে জানিয়ে কী লাভ? অযথা রিমা ভেঙ্গে পড়বে, আত্মীয়-স্বজনরা ছুটাছুটি করবে। তার চেয়ে নিজের কষ্ট নিজের কাছেই থাক, ধীরে ধীরে নিজেকে গুছাতে থাকি।
অবসর নেওয়ার পর ফিরোজ দিনাজপুর শহরে তার পৈত্রিক ভিটেমাটিতে বসবাস শুরু করে। বাপ-মেয়ে দু'জনের সংসার। একটা কাজের মেয়ে আছে সে রান্নার কাজ করে, রিমা কলেজ যায়, কলেজ থেকে কোন কোন দিন রিমা দেরিতে ফিরলেও ফিরোজ রিমাকে ছেড়ে কোনদিন খাবার খায় না।
রিমা কলেজে যাওয়ার পর ফিরোজ নিঃসঙ্গতায় ভুগে, এই পৃথিবীর কাছে তার নিজেকে বেমানান মনে হয়, নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়।
ফিরোজ পৃথিবীতে তার দেনা-পাওনা মিটিয়ে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে।
ফিরোজ একবার মোবাইলের ঘড়িতে সময় দেখল, রাত একটা বাজে।
সে ঘুমানোর চেষ্টা করল, না, কিছুতেই তার চোখে ঘুম আসে না।
ফিরোজ ঘুমের মধ্যে তার মাকে দেখে। তার স্নেহময়ী মা সাদা ধব্ধবে শাড়ি পরে তাসবীহ জপতে জপতে ফিরোজকে দেখে তাসবীহ জপা বন্ধ করে তাকে ডাকলেন, ফিরোজ আয় বাবা, আমি জানি তোর মনে অনেক কষ্ট, আমার কাছে আয় আমি তোকে ছোটবেলায় যেমন আদর, স্নেহ দিয়ে লালন-পালন করেছি সেভাবে লালন-পালন করবো।
মা তুমি আমাকে ডাকছ, তুমি না মরে গেছ?
হ্যাঁ সবাইকে তো মরতে হবে বাবা, তোর বিশ্বাস হচ্ছে না?
ফিরোজ কিছু বলল না।
আমি মারা যাওয়ার আগে তোর বাবাও আমাকে ডেকেছিল, দেখ না আমি কেমন তোর বাবার কাছে চলে এসেছি। তুইও আমার কাছে আয় বাবা।
না, না আমি যাবো না, তুমি চলে যাও, বলে ফিরোজ তার মায়ের উল্টাদিকে দৌড়াতে লাগল।
ফিরোজের ঘুম ভেঙ্গে গেল। সে বিছানায় উঠে হাঁপাতে লাগল।
তার ইচ্ছা হলো একবার ডাক্তার হায়াদারের সঙ্গে কথা বলতে কিন্তু ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মোবাইল করল না।
চৌদ্দ
ফিরোজ সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই ডাঃ হায়দারকে মোবাইল করল, হ্যালো হায়দার।
হ্যাঁ ফিরোজ বল এখন কেমন আছিস?
না বন্ধু ভালো নেই, আমি ধীরে ধীরে অসুস্থ হয়ে পড়ছি, আমি মনে হয় আর বেশিদিন বাঁচবো না রে।
কেন? কী হয়েছে?
ফিরোজ তার দু:স্বপ্নর কথা ডাঃ হায়দারকে বলল।
ডাঃ হায়দার সবকিছু হেসে উড়িয়ে দিলেন।
হায়দার তুই হাসছিস? মৃত মানুষ কাউকে ডাকলে সে আর বেশিদিন বাঁচে না।
কে বলেছে তোকে এসব কথা?
কেউ বলবে কেন? এটা তো সবার জানা।
কই আমিও তো সবার মধ্যে, আমি তো জানি না। আসলে তোর শুধু শারীরিক চিকিৎসা দিয়ে কাজ হবে না, তোকে একজন ভালো মনোরোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে, তোর দরকার মানসিক চিকিৎসা। তুই ঢাকায় চলে আয়।
হ্যাঁ ঢাকায় তো আসবো এ সপ্তাহে মেয়েটার বিয়ে, ওর বিয়ের পরদিনই আমি ঢাকা রওয়ানা হবো।
আচ্ছা ঠিক আছে আমার একটু তাড়া আছে, তুই রাতে রিং দিস কথা বলব।
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে রাখি, বলে মোবাইল রাখতেই রিমা ডাক দিল, বাবা নাস্তা রেডি তাড়াতাড়ি চলে এসো।
ফিরোজ মোবাইল রেখে ব্রাশ করে ডাইনিং টেবিলে বসল।
ফিরোজের চোখের দিকে তাকিয়ে রিমা চমকে উঠল, বাবা তুমি ঘুমাওনি? তোমার চোখ লাল কেন?
কেন ঘুমিয়েছি তো, আমার চোখ লাল দেখা যাচ্ছে নাকি?
হ্যাঁ।
তোদের মেয়েদের এই একটা দোষ।
কী দোষ বাবা?
এই যেমন আমার মা যখন বেঁচে ছিল তখন যে কোন জায়গা থেকে এলে প্রথমেই বলতো, তোর মুখ শুক্না কেন বাবা? চোখ দু'টো একেবারে বসে গেছে কেন? চুলগুলো এলোমেলো কেন? কোন অসুখ করেছে নাকি বলে আমার কপালে হাত দিত। তোর মা ছিল সেও এমনিভাবে সব সময় আমার মুখ শুক্না, চোখ লাল, চেহারা রোগা রোগা দেখেছে, এখন তুই দেখতে শুরু করেছিস।
বাবা তুমি কিন্তু কিছু লুকাচ্ছ?
কী লুকাচ্ছি?
নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হয়েছে?
না কোন সমস্যা হয়নি, আমার বয়স হয়েছে, কোন কোন রাতে ঘুম কম হতেই পারে এনিয়ে তোর দুঃশ্চিন্তা করার করার কিছু নেই।
বাবা আমি কিন্তু তোমার ভালো বন্ধু তুমি ইচ্ছা করলে আমাকে বলতে পারো।
বললাম তো কোন সমস্যা হয়নি।
না হলেই ভালো।
ফিরোজ নাস্তা খেতে খেতে রিমাকে বলল, তুই আজ কোথাও যাবি নাকি?
বাবা তুমি তো জানো আমি কোথাও যাই না, আজ আবার হঠাৎ করে কোথাও যাবো কিনা জিজ্ঞেস করছ কেন?
না বলছিলাম তুই তো শুনছিস তোর বিয়ের আয়োজন চলছে, তোর বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে কথা থাকতে পারে, আড্ডা থাকতে পারে, ও ভালো কথা তুই কাকে কাকে দাওয়াত করবি ঠিক করেছিস?
আমি কাকে কাকে দাওয়াত করবো এটা আবার কেমন কথা? তুমি যাকে ইচ্ছা দাওয়াত করবে।
না এই যেমন তোর বন্ধু-বান্ধবরা আছে, তাদের দাওয়াত করতে হবে না? তুই একটা লিস্ট কর, তোর গেস্ট কত হবে তা ঠিক কর। আমিও একটা লিস্ট করছি তারপর দু'জনে আজ রাতে বসে লিস্টটা ফাইনাল করবো।
রিমা লজ্জা পেল, বাবা।
হ্যাঁ মা, তুই দিনের মধ্যে লিস্টটা করে ফেল, আমাকে একটা কাগজ-কলম দে, তোর ছোট চাচা এসব কাজে খুব পাকা, আজ রাতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হলে কাজে লেগে পড়তে হবে।
রিমা কিছু বলল না, সে রান্নাঘরে চলে গেল।
রিমা চা এনে তার বাবার সামনে দিল।
ফিরোজ চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ড্রয়িং রুমে গেল।
চা শেষ করে বলল, রিমা আমাকে একটা কাগজ আর কলম দে মা।
রিমা ফিরোজকে কাগজ আর কলম দিল।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, তোর কাছে লাবলুর মোবাইল নাম্বার আছে?
আছে বাবা মোবাইলে সেভ করা আছে, তোমাকে দিচ্ছি।
ফিরোজ লিস্ট করতে শুরু করল।
রিমা তার বাবাকে লাবলুর মোবাইল নাম্বার দিল।
ফিরোজ লাবলুকে মোবাইল করল, হ্যালো লাবলু।
ভাইজান আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম সালাম।
জি ভাইজান, বলুন।
তুই একবার আমার বাসায় আয় তো।
ভাইজান আসছি।
কিছুক্ষণ পর লাবলু চলে এলো।
ফিরোজ কলম টেবিলের ওপর রেখে বলল, লাবলু বস তারপর রিমাকে জোরে বলল, রিমা তোর চাচাকে চা দে।
লাবলু রিমাকে চা দিতে নিষেধ করার একবার এদিক-সেদিক তাকাল কিন্তু আশে-পাশে রিমাকে না দেখে কিছু বলল না।
ফিরোজ বলল, লাবলু রিমার বিয়ের কথা তো শুনেছিস।
জি ভাইজান।
এখন বিয়ের সব আয়োজন করতে হবে, এই ক'দিন তুই আমার সঙ্গে থাকবি? নাকি তোকে আবার নতুন করে দাওয়াত দিতে হবে?
ভাইজান আপনি যখন বলেছেন এই ক'দিন আপনার সঙ্গে থাকতে হবে তখনই তো দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে, আমি আপনার সঙ্গেই থাকবো।
আজ রাতে বিয়ের দিন তারিখ ঠিক হবে, বিয়ে হবে এক সপ্তাহের মধ্যে, কী কী করতে হবে একটা কাগজে লিখে নে, বিয়ে বাড়িতে যেন কোন কিছুর ত্রুটি না হয়, বলে ফিরোজ লাবলুর দিকে কাগজ-কলম এগিয়ে দিল।
লাবলু কাগজ-কলম নিয়ে লিখতে শুরু করল।
ফিরোজ একে একে লাবলুকে তার করণীয় কাজগুলো বলতে শুরু করল। লাবলুর লিখা শেষ হলে ফিরোজ একটা সাধারণ কাগজের বানানো দাওয়াত পত্র লাবলুর হাতে দিয়ে বলল, এটা হলো বিয়ের দাওয়াত পত্র, একবার পড়ে দেখ তো।
লাবলু পড়ল।
ফিরোজ দাওয়াত পত্রের ওপর রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনন্ত প্রেম কবিতার দু'লাইন লিখেছে,
''তোমারেই যেন ভালোবাসিয়াছি শতরূপে শতবার
জনমে জনমে যুগে যুগে অনিবার"।
নিয়ম-মাফিক বিষয়বস্তু লিখার পর দিনক্ষণ-এর স্থান ফাঁকা রেখে একটা বক্সে লিখেছে, আপনার উপস্থিতি এবং আশীর্বাদ একান্তভাবে কাম্য, কোন উপহার সামগ্রী কাঙ্খিত নয়।
রাতে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হওয়ার পর নিত্য দিনে মতো ফিরোজ ঘুমানোর চেষ্টা করল। কিন্তু আবার সেই এলোমেলো চিন্তা তাঁকে আঁকড়ে ধরল।
অনেকক্ষণ পর ফিরোজের দু'চোখে একটু ঘুমের ভাব এসেছে।
ফিরোজের চোখের সামনে প্রমীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, তুমি?
অবাক হচ্ছ বুঝি?
হ্যাঁ, তুমি না মরে গেছ?
মরে গেছি বলে কি কিছু দেখতি পাই না, তুমি আমাকে দেখতে পাও না ঠিকই কিন্তু আমি তোমাকে দেখতে পাই।
তাই নাকি?
তাই তো আজ তোমার কাছে এসেছি।
কেন?
তুমি রিমার বিয়ে দিচ্ছ আমাকে বলেছ?
ফিরোজ কিছু বলল না।
রিমা তোমার একার মেয়ে না সে আমারও মেয়ে, ওর বিয়ের আগে আমাকে একবার বলা তোমার উচিৎ ছিল।
আমি তোমাকে কীভাবে বলব?
আমি কিছু মনে করিনি, বরং খুব খুশি হয়েছি, তুমি নিজের বিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে করতে পারোনি বলে তোমার মনের মধ্যে একটা ক্ষোভ ছিল তাই তুমি আনুষ্ঠানিকভাবে ধুমধাম করে রিমার বিয়ে দিচ্ছ, না?
ফিরোজ কিছু বলল না।
আমি দোয়া করবো রিমা যেন সুখে থাকে, বলে সে হারিয়ে গেল।
ফিরোজ প্রমী, প্রমী বলে ডাকতে ডাকতে ঘুম থেকে উঠল।
ফিরোজ বিছানায় বসে হাঁপাতে হাঁপাতে আলো জ্বালিয়ে এক গ্লাস পানি খেল।
পনেরো
আরশী সকালবেলা অফিসে গিয়েই সাতদিন ছুটির জন্য দরখাস্ত দিল। আরশীর ছুটির দরখাস্ত দেখে তার বস বললেন, কাল থেকে সাত দিনের ছুটি?
আরশী বিনয়ের সুরে বলল, জি স্যার।
আপনি জানেন না পরশুদিন ভি.আই.পি ডিউটি আছে? আপনি ক'দিন পর অফিসার হবেন অথচ এখনো দায়িত্ববোধ সম্পর্কে এতটুকু ধারণা নেই?
আরশী মুখে কিছু বলল না, মনে মনে বলল, ক'দিন পরে আমি অফিসার হবো সেজন্যই তো ছুটিটা আমার বেশি প্রয়োজন স্যার।
আপনি ভি.আই.পি ডিউটি শেষ করে যান, দরখাস্তে তারিখটা ঠিক করে দিন।
আরশী দরখাস্তে তারিখটা পরিবর্তন করে দিয়ে কোন কথা না বলে তার চেয়ারে বসতে বসতে চোখ মুছল।
লিজা জিজ্ঞেস করল, কি রে ছুটি হলো?
ছুটি হলো তবে ভি.আই.পি ডিউটির পর।
এই তো মাঝখানে দু'টা দিন।
আরশী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে মনে মনে বলল, দু'দিন কী কম সময়? দু'দিনে পৃথিবীতে কত কী ঘটতে পারে? আজ এই মুহূর্তে যে কাজ হওয়ার কথা তা যদি এই মুহূর্তে না হয় তবে আর কোনদিন নাও হতে পারে, আমি যদি আর দু'দিন না বাঁচি তবে তো আর কোনদিন ফিরোজের সঙ্গে দেখাই হবে না। আবার ফিরোজ যদি কোন কারণে কোথাও চলে যায়, যদি এমন হয় আর দু'দিন আগে গেলে তার সঙ্গে দেখা হতো তবে তো আর দেখাই হবে না। যদি দেখা না হয় তবে-
না, না আরশী আর ভাবতে পারে না, আবার কোন কাজে মনোযোগ দিতেও পারছেও না। সে চেয়ারে বসে এমনিভাবে নানান চিন্তার মধ্যে ডুবে গেল।
কয়েকমিনিট পর লিজা তার টেবিলে ঠোকা মেরে বলল, এই আরশী, কী ভাবছিস?
আরশী চমকে উঠল, না রে, কিছু না।
রাতে বিছানায় শুয়ে আরশী আঙ্গুলে দিন গুণলো, আরো অনেক দিন, শেষ পর্যন্ত ফিরোজের সঙ্গে দেখা হবে তো? সে একদিন আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতো। প্রায়ই বলত, তুমি একদিন সাব-ইন্সপেক্টোর হবে, ইন্সপেক্টোর হবে কোন না কোন থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) হবে। তুমি ওসি হলে তোমাকে মানাবে ভালো।
আরশী মনে মনে বলল, ফিরোজ তোমার আরশী প্রথম প্রমোশন পাবে, তুমি দেখবে না? আমি চাকরির প্রথম বেতনের টাকা তোমাকে দিয়েছি, আমার প্রমোশনের খবরটাও আমি প্রথম তোমাকে দিতে চাই। প্লিজ তুমি একবার তোমার সেই সিমকার্ডটা চালু করো, আমি কতদিন থেকে তোমার নাম্বারে রিং দিচ্ছি, সেই একই কণ্ঠস্বর, এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না, অনুগ্রহপুর্বক কিছুক্ষণ পর আবার ডায়াল করুন। আমি আর কতদিন এভাবে ডায়াল করবো বল? আমি তোমার জন্য তোমার দেয়া সিম কার্ডটা চালু করে রেখেছি, দিনের পর দিন অপেক্ষা করছি তুমি যদি একবার রিং করো। আগে তুমি এরকম ছিলে না, এখন খুব নিষ্ঠুর হয়ে গেছ, তোমার রিমা কোন অপরাধ করলে কি তুমি তাকে ক্ষমা করতে না? তবে আমাকে ক্ষমা করতে পারছ না কেন?
লিজা ডাক দিল, এই আরশী কী ভাবছিস?
আরশী চমকে উঠল, কী রে?
চমকে উঠলি কেন? এতক্ষণ মনে হয় অন্য জগতে ছিলি?
আরশী কিছু বলল না।
এতদিন ছুটি নিয়ে বাড়িতে কী করবি?
বাড়িতে কেন?
কেন মানে? প্রমোশনের খবরটা বাড়িতে দিবি না?
ও তাইতো, খবরটা তো বাড়িতে দিতেই হবে, বলে মনে মনে বলল, তার আগে যাকে খবরটা দেয়া বেশি জরুরী তাকে দিতে হবে।
তোকে আনমনা দেখাচ্ছে কেন? এত কী ভাবছিস?
না কিছু না।
আচ্ছা লিজা আমাদের রেঙ্ক পরাতে আর কতদিন বাকী আছে?
দশ দিন।
আরশী আবার আঙ্গুলে হিসাব করে দেখল, তার ঢাকা যাওয়া, সেখান থেকে ফিরোজের বাড়ি যাওয়া তারপর সেখান থেকে ফিরে আসার সব সময় হবে। সে একটা নিঃশ্বাস নিল।
আচ্ছা আরশী আমার তো মনে হচ্ছে তুই আসলে ছুটিতে বাড়ি যাবি না, ফিরোজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে যাবি।
আরশী রুদ্ধ কন্ঠে বলল, হ্যাঁ তুই ঠিকই বলেছিস।
দেখা করে কী করবি? ফিরোজ সাহেবকে বিয়ে করবি?
ফিরোজ আমাকে বিয়ে করবে?
যদি করতে চায়?
কোনদিন বিয়ে করতে চাইবে না, বলে আরশী মনে মনে বলল, বিয়ে তো করতে চাইবে না, আমাকে দেখে ভয় পেতে পারে। আসলে ফিরোজের কাছে পৃথিবীতে আমিই সবচেয়ে খারাপ মেয়ে, কোন ভীতিকর এবং বিপজ্জনক মেয়ে। তার দৃষ্টিতে আমি লোভী, নীতিহীন, অর্থলিপ্সু। আমি কোনকিছুর ধার ধারি না, সুযোগ পেলে ধর্ম, সমাজ এবং স্বামী কিংবা গার্জিয়ানদের চোখ এড়িয়ে সামান্য দামে আমি নিজেকে বিক্রি করে দিতে পারি। এমন একজন মেয়েকে শুধু ফিরোজ কেন কেউ বিয়ে করবে না? শুধু বিয়ে নয় নিরাপদও মনে করবে না।
দেখ ভালোবাসায় মান-অভিমান হতেই পারে তাই বলে তো সম্পর্ক একেবারে শেষ হয়ে যেতে পারে না। তুই যেমন ফিরোজ সাহেবের কথা ভাবছিস, তিনিও তো তেমনি তোর কথা ভাবছেন। অনেকদিন পর তোকে দেখে নিশ্চয়ই কাছে টেনে নিবে।
আমি এটা আশা করি না লিজা, আমি একবার নিজ মুখে আমার প্রমোশনের খবরটা জানাবো তারপর পা ছুঁয়ে সালাম করে চলে আসবো।
তা হবে না রে, দেখা হলে তুই ঠিক হয়ে যাবি। বিয়ের আগে আমাদেরও মাঝে মাঝে এরকম হতো, মনে হতো আর কেউ বুঝি কোনদিন কারো সঙ্গে কথা বলব না, কয়েকদিন পর আবার ঠিক হয়ে যেত। এখনো দেখিস না প্রায়দিনই তোর দুলাভাইর সঙ্গে আমার মোবাইলে ঝগড়া হয়, মনে হয় রাঙামাটি না থেকে আমার হাতের কাছাকাছি থাকলে হয়ত হাতাহাতি হয়ে যেত কিন্তু আসলে কি তাই হতো? আবার কিছুক্ষণ পরেই সব ঠিক হয়ে যায়। ভালোবাসার মানুষের সঙ্গে ঝগড়া করাও আনন্দের।
আরশী কোন কথা বলল না, সে একটা বিরক্তির ভাব দেখালো। লিজা বুঝতে পারল তার কথার প্রতি আরশীর আগ্রহ নেই।
আরশী একবার ঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর জেসমিনকে মোবাইল করল।
আরশী জেসমিনকে মোবাইল করল, হ্যালো জেসমিন?
আরশী বল।
জেসমিন আমার পরশুদিন ভি.আই.পি ডিউটি আছে, ডিউটি শেষ করে আমি পরদিন ডে কোচে উঠব।
আচ্ছা আয়।
জেসমিন আমি তো ঢাকার রাস্তা চিনি না, আমি তোর কাছে যাবো কীভাবে?
তুই কোন বাসে আসছিস আমাকে বলিস আমি তোকে নিয়ে আসবো।
আরশী রাজশাহীতে বাসে উঠে জেসমিনকে মোবাইল করে তার বাসের নাম জানালো।
জেসমিন বলল, আচ্ছা ঠিক আছে তোর আসতে কতক্ষণ সময় লাগবে?
পাঁচ ঘণ্টা।
তুই কালিয়াকৈর বা নবীনগর এসে আমাকে রিং দিস।
আরশী সারাটা রাস্তায় ফিরোজকে নিয়ে ভেবেছে। আজ একান্তে তার ফিরোজের কথাগুলো মনে পড়ল। ফিরোজ আরশীকে মেয়ের মতো স্নেহ করতো, বন্ধুর মতো ভালোবাসতো। ফিরোজকে আরশী সবকিছু উজাড় করে দিতে গিয়েও সে তা গ্রহণ করেনি। সে বুঝেছিল আরশীর বয়স কম, সে আবেগের বশে এমন আচরণ করলেও যখন সে বাস্তবে ফিরে আসবে তখন তাকে ঘৃণা করবে, তাই সে আরশীকে ফিরিয়ে দিয়েছিল।
আর নূর!
সেদিনের পর থেকে আরশী অফিসের কাজে কিংবা ছুটি নিয়ে রাজশাহীতে যেত। সেদিন আগের রাতে নূর আরশীর সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলল।
পরদিন বাসে উঠেই আরশী নূরকে মোবাইল করল। নূর আরশীর জন্য বাস স্ট্যান্ড অপেক্ষা করছিল।
আরশী বাস থেকে নামতেই নূর সামনে এসে দাঁড়াল, আরশী।
সেদিন নূরকে খুব স্মার্ট দেখাচ্ছিল। চোখে চোখ পড়তেই আরশীর চোখ যেন স্থির হয়ে গিয়েছিল। বুকের মধ্যে যেন একটা অস্বাভাবিক অনুভুতি সৃষ্টি করেছিল। নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে অষ্ফুটস্বর বেরিয়ে এসেছিল, নূর।
দু'জনে একটা রিক্সায় উঠল।
নূর জিজ্ঞেস করল, আরশী কোথায় যাবে?
আগে আর.ডি.এ মার্কেটে চলো।
কেন?
ভয় পেলে নাকি? বেশি কিছু নিতে চাইব না। কাল রাতে তুমি বলেছ না আমাকে কী রকম শাড়ি পরলে ভালো মানাবে, কী রকম লিপস্টিক পরলে ভালো মানাবে, কানে কী রকম অর্নামেন্ট পরলে ভালো মানাবে। সেগুলো কিনে দিবে না?
নূর মনে মনে বলল, বলার কথা তাই বলেছি, এখন কি সত্যি সত্যি কিনে দিতে হবে নাকি?
দাও না প্লিজ, তোমার কাছে তো টাকা আছে। আর তোমার টাকাটা তো অন্য কারো পিছনে খরচ করছ না। আমার জন্য খরচ করছ, আমি তোমার বউ না?
নূর কিছু বলেনি। দু'জনে আর.ডি.এ মার্কেটে ঢুকল।
মার্কেট থেকে বেরিয়ে হোটেল সিলি'স-এ দু'জনে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার রিক্সায় উঠল। আরশী জিজ্ঞেস করল, এখন কোথা যাবো?
নূর মনে মনে বলল, এখনই তো যাবো আসল জায়গায়।
কী চুপ করে আছ কেন?
না কিছু না।
আজ তোমার মনটা খুব ভালো দেখলাম, খুব উদার। মনে হয় তোমার টাকার অভাব নেই।
তুমিই তো বললে, তুমি আমার বউ। বউয়ের কোন আব্দারকে না করা ঠিক না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
আমার ভাগ্য ভালো যে তোমার মতো একজন ভালো মনের মানুষের সঙ্গে আমার বিয়ে হতে যাচ্ছে।
এমনিভাবে নানান কথা বলতে বলতে রিক্সা একটা দ্বিতল বাসার সামনে এসে দাঁড়াল।
আগে নূর রিক্সা থেকে নেমে আরশীকে রিক্সা থেকে নামতে বলতেই আরশী জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
নামো, বাসা দেখবে না?
আরশী রিক্সা থেকে নেমেই একটা মুচকি হেসেছিল, বাঃ, তুমি তো খুব সংসারী ছেলে।
আমাকে চিনতে তোমার বেশ দেরি লাগল।
দু'জনে সিঁড়ি বেয়ে সোজা উপরে।
বাসায় মধ্য বয়সী এক মহিলা আর ছোট বাচ্চা ছিল।
নূর আরশীকে পরিচয় করে দিল, আরশী আমার ভাবী, আর ভাবী ও হচ্ছে আরশী যার কথা তোমাকে আগে বলেছি।
বাঃ তোমার তো পছন্দ আছে, ভিতরে এসো, বসো, বলে তিনি একটা রুমে বসতে দিলেন।
নূর আর আরশী মুখোমুখি বসল।
তোমরা বসো, গল্প করো আমি চা-নাস্তার ব্যবস্থা করছি, বলে ভাবী চলে গেলেন।
কিছুক্ষণ পর ভাবী চা-নাস্তা নিয়ে ভিতরে ঢুকলেন।
আরশী বলল, ভাবী এত কিছুর কী দরকার আছে?
কি দরকার আছে মানে? এটাই শেষ না, দুপুরে ভাত খেয়ে তারপর যাবে।
আমরা তো খাবার খেয়ে এসেছি। যদিও একটু আগে খাওয়া হয়ে গেছে। আপনি আমাদের জন্য এত কষ্ট করলেন কেন?
বেশি কথা বলো না তো, তোমরা নাস্তা খাও, আমি ভাত রান্না করছি।
নাস্তা খাওয়া শেষ করে চা খেতে খেতে নূর চায়ের কাপ টেবিলে রেখে দরজা বন্ধ করে দিল।
আরশীর বুক কেঁপে উঠল, নূর দরজা বন্ধ করলে কেন?
এমনি।
এমনি কেন?
ভাবী আমাদের সব কথা শুনে ফেলতে পারে তো তাই।
নূর চা খাওয়া শেষ করে আরশী গা ঘেঁষে বসে আরশীর একটা হাত তার হাতের মধ্যে নিল।
আরশী নূরের ইচ্ছার কথা বুঝতে পেরে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করল কিন্তু ততক্ষণে নূর আরশীর হাত আরো শক্তভাবে ধরেছে।
আরশী নূরকে অনুরোধ করল, প্লিজ নূর, আর ক'দিন পর তো সবই পাচ্ছ, আমি তো তোমার জন্য সবকিছু নিয়ে অপেক্ষা করছি আর সামান্য ক'টা দিন দেরি করো, প্লিজ!
কিন্তু আমি যে আর দেরি করতে পারছি না আরশী।
আরশী নূরের হাত তার মাথার ওপর নিয়ে বলল, আমার মাথা ছুঁয়ে বলো তুমি আমাকে বিয়ে করবে? কোনদিন পালিয়ে যাবে না?
নূর বলল, এই তোমার মাথা ছুঁয়ে বলছি আমি তোমাকে বিয়ে করবো।
নূর আরশীর সবকিছু লুটে নিয়েছে কিন্তু তাকে বিয়ে করেনি। আরশী তাকে বিয়ের কথা বললে সে কৌশলে এড়িয়ে যেত, বিয়ে না করার অজুহাতে ফিরোজের সঙ্গে তার অনৈতিক সম্পর্ক ছিল বলে খোঁটা দিত।
একদিন আরশী নূরকে বলেছিল, নূর আমি তোমার কাছ থেকে একটা পাকাপাকি কথা চাই, তুমি আমাকে বিয়ে করবে কি না?
আরশী তোমাকে বিয়ে করবো না তা তো বলিনি তবে তোমার সঙ্গে ফিরোজের সম্পর্কটা আমি কোনভাবে মেনে নিতে পারছি না। তুমি আমাকে কিছুদিন সময় দাও। তাছাড়া তুমি তো জানো আমার বড় বোন আছে ওকে বিয়ে না দিয়ে তো বাবা আমাকে বিয়ে দিবে না।
সেদিন তুমি যে বললে এখন তোমার বিয়ের সিরিয়াল, তুমি আমাকে বললে বিয়েতে ডিমান্ডের কথা, আমি বোন-দুলাভাইকে বলে সবকিছু ঠিক করেছি আর এখন বলছ আগে বোনকে বিয়ে দিয়ে তারপর নিজে বিয়ে করবে, তবে আমাকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কেন? কেন আমার মাথা ছুঁয়ে বলেছিলে তুমি আমাকে বিয়ে করবে?
নূর আরশীর কথার কোন প্রতিবাদ করল না।
আরশী ক্ষেপে গেল, নূর তুমি ভেবো না আমার সঙ্গে প্রতারণা করে তুমি পার পাবে, আমি তোমাকে দেখে ছাড়বো, আমাকে লোভ দেখিয়ে, বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে তুমি আমার সর্বনাশ করেছ, আমি তোমার প্রতারণার প্রতিশোধ নিব।
নূর মৃদু কন্ঠে বলল, আরশী রাগ করো না প্লিজ, তুমি তো আগামীকাল বাড়ি যাচ্ছ, তুমি যাও আমি বাবাকে সবকিছু বলে তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবো। তুমি বাড়ি থেকে ফিরে এসো তারপর তুমি আর আমি বসে সবকিছু ফাইনাল করবো।
আরশী সাতদিনের ছুটিতে গ্রামের বাড়ি গিয়েছিল। আরশী বাড়িতে গিয়েও প্রায় সবসময় নূরের সঙ্গে মোবাইলে যোগাযোগ রেখেছিল কিন্তু তিন দিন পর থেকে আরশী আর মোবাইলে নূরকে পায়নি, নূরের বাড়ি থেকে কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়েও আসেনি। সে নূরের মোবাইলে বার বার রিং দিচ্ছিল, মোবাইল বন্ধ।
আরশী তার ছুটি শেষ হওয়ার একদিন আগেই প্রথমে রাজশাহী গিয়েছিল কিন্তু রাজশাহী গিয়ে জানতে পেরেছিল নূর বদলি নিয়ে রাঙামাটি চলে গেছে। কথাটা শুনে আরশীর মাথায় যেন বজ্রপাত পড়েছিল। সে ভেবে পাচ্ছিল না আসলে তার কী করা উচিৎ। সে কাউকে কিছু বলতে পারেনি একটা বেদনা সে নীরবে কেঁদে কেঁদে হজম করেছিল আর নূরকে অভিশাপ দিচ্ছিল, তুমি একটা কথা মনে রেখো নূর আমি তোমার ওপর প্রতিশোধ নিতে পারলাম না কিন্তু আল্লাহ যেন তোমাকে ক্ষমা না করে। তোমার জন্য আমি ফেরেস্তার মতো একজন মানুষকে অপমান করেছি, ফিরোজ বলেছিল তুমি আমাকে পণ্যের মতো ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দিবে, তুমি সত্যি সত্যি তাই করলে। আমি ফিরোজের পবিত্র ভালোবাসাকে অপমান করার শাস্তি পেয়েছি আমার আমার পবিত্র ভালোবাসার সঙ্গে প্রতারণা করার শাস্তি যেন আল্লাহ তোমাকে দেয়।
আরশী চোখ মুছে একবার ঘড়ির দিকে তাকাল। তারপর দু'চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করল।
ষোল
রিমার বিয়েতে ফিরোজ টাকার অংকের হিসাব করেনি। আত্মীয়-স্বজনছাড়াও সে বিয়েতে মহল্লার অনাত্মীয় গরীব-দুঃখীদের দাওয়াত করেছে। ফিরোজ বিয়ের কার্ড নিয়ে শ্বশুরবাড়ি গেছে। শ্বশুরবাড়ি ফিরোজের এবার দ্বিতীয়বার যাওয়া। ফিরোজের শ্বশুর-শাশুড়ি তাকে খুব ভালোভাবে আপ্যায়ন করেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে ফেরার পর ফিরোজের বার বার করে প্রমীর কথা মনে পড়ল।
ফিরোজের সঙ্গে প্রমীর প্রথম পরিচয় হয়েছিল, বৈশাখী মেলায়। প্রমীর এক মামাতো বোন বন্যা একটা এন.জি.ও'তে চাকরি করতো সেই এন.জি.ও'র কারু পণ্য সামগ্রীর দোকানে সেদিন প্রমী বসেছিল।
ফিরোজ তার চাচাতো বোন স্নেহাসহ দোকানে বিভিন্ন ধরণের জিনিস দেখছিল। তাদের সঙ্গে কখনো প্রমী আবার কখনো বন্যা কথা বলছিল।
বন্যা ফিরোজের দিকে একটা মালা বাড়িয়ে দিল, ভাইয়া এটা নেন ভাবীকে ভালো মানাবে।
ফিরোজ একবার এদিক-সেদিক তাকাল।
বন্যা তার ভুল বুঝতে পারল, সরি আমি বুঝতে পারিনি।
স্নেহা বলল, না ঠিক আছে আসলে এই গাধাটার সঙ্গে বিয়ে হলে আমাকে মানাতো ভালো কিন্তু কী করবেন? এর আবার আমার চেয়ে সুন্দর মেয়ে দরকার। কী আর করা আল্লাহ আমাকে যে সৌন্দর্য দিয়েছে তা তো আর ইচ্ছা করলেই বাড়াতে পারি না।
ফিরোজ বলল, আমাকে না পাওয়ার বেদনা ভুলে গিয়ে সংসারে মনোযোগ দে, সেটাই ভালো হবে।
তারমানে ভাইয়া আপনাকে ছেঁকা দিয়েছে, খুব খারাপ মানুষ তো, প্রমী বলল।
স্নেহা বলল, গাধা না বাঁদর, বুদ্ধিসুদ্ধি বেশি, তাই ছেঁকা দিতে পেরেছে। সেজন্যই তো একটা বাঁদর মেয়ে খুঁজছি, যেন ওকে কান ধরে উঠাতে এবং বসাতে পারে।
বন্যা প্রমীর দিকে ঈঙ্গিত করে বলল, দেখেন তো আপা এই পিচ্চিটাকে পছন্দ হয় নাকি?
স্নেহা বলল, মেয়েটা তো খুব মিষ্টি, কী নাম তোমার?
প্রমী।
কোন ক্লাসে পড়?
অনার্স সেকেন্ড ইয়ারে।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, কোন কলেজে?
দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজে।
স্নেহা ফিরোজকে ধমকের সুরে বলল, এই তোর এত আগ্রহ কেন রে? যেখানে আমি তোর গার্জিয়ান হিসেবে আলাপ করছি সেখানে তুই আগ বাড়িয়ে কথা বলছিস কেন?
সরি স্নেহা।
নাম ধরে ডাকছিস কেন? আপা বল, বিয়ের দিক থেকে আমি তোর বড়, তাছাড়া এখন আমি তোর গার্জিয়ান হিসেবে কথা বলছি।
ফিরোজ মনে মনে অনেকদিন প্রমীকে খুঁজেছিল কিন্তু আর কোনদিন দেখা পায়নি।
একদিন হঠাৎ করে গুলশান মার্কেটের দোতলায় ফিরোজের সামনে এসে প্রমী বলল, এই যে ফিরোজ ভাই কেমন আছেন?
ও প্রমী, কেমন আছ?
ভালো, আপনি?
হ্যাঁ ভালো আছি।
প্রমী বলল, আপনি সেই যে গেলেন আর কোনদিন দেখাই হলো না।
তুমিও তো দেখা করলে না।
আমি তো আপনার ঠিকানা জানি না।
আমিও-
প্রমী ফিরোজের কথার মাঝে বাধা দিয়ে বলল, আমি কিন্তু আপনাকে আমার ঠিকানা বলেছিলাম আপনি ইচ্ছা করলে দেখা করতে পারতেন?
সরি প্রমী।
আচ্ছা ঠিক আছে।
এখানে কোথায় তোমার কাজ?
কাজ হয়ে গেছে, এখন চলে যাবো।
প্রমী তুমি কিছু মনে না করলে চলো না একসঙ্গে বসে চা খাই।
বেশ তো চলুন।
দু'জনে হাঁটতে হাঁটতে মডার্ন মোড়ের দক্ষিণে একটা দোতলা হোটেলে বসে কফি খেতে খেতে অনেকক্ষণ গল্প করল।
প্রমী প্রথমে কথা বলল, আপনি এখন কী করছেন?
মাস্টার্স পরীক্ষা দিয়েছিলাম, ক'দিন আগে রেজাল্ট বেরিয়েছে, সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি।
এখন চাকরির জন্য চেষ্টা চলছে?
হ্যাঁ।
আচ্ছা আপনারা ক'ভাই-বোন?
আমি একা, তোমরা?
আমরা দু'ভাই এক বোন, আমি সবার ছোট।
তাহলে তো তুমি খুব ভাগ্যবতী।
ভাগ্যবতী কী না জানি না, তবে সবাই আমাকে খুব স্নেহ করে, এটাই হয়েছে আমার জ্বালা।
জ্বালা কেন?
সবাই সবসময় আমার খোঁজখবর রাখে, আমি কোথায় গেলাম? কী করলাম?
ভালো তো।
ভালো কীভাবে? আমি এখন বড় হয়েছি না? আমাকে তো একটু স্বাধীনতা দেয়া দরকার।
হ্যাঁ তা অবশ্য ঠিক, তবে একটা কথা কি জানো প্রমী, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম দরকার, লড়াই দরকার।
আমি তাতেও রাজি আছি।
তাই-
দু'জনে হেসে ফেলল।
কিছুক্ষণ পর ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, তুমি তো এবার অনার্স ফাইনাল দিচ্ছ?
জি, দোয়া করবেন।
অবশ্যই।
আসুন না একদিন আমাদের বাসায়?
তোমাদের বাসায়?
হ্যাঁ, বলে প্রমী তাদের বাসার ঠিকানা বলল।
ফিরোজ বলল, হ্যাঁ বুঝতে পেরেছি।
আমাদের বাসার টেলিফোন নাম্বার লিখে নিন, ফোন করে আসবেন।
ফিরোজ টেলিফোন নাম্বারলিখে নিয়ে বলেছিল, নাম্বার তো লিখে নিলাম, আমাদের বাসায় তো টেলিফোন নেই, বাইরে থেকে ফোন করতে হবে।
করবেন, হারিয়ে যাবেন না কিন্তু।
না, হারাবো কেন?
প্রমী তার ব্যাগ থেকে একটা কাগজ-কলম বের করে বলল, এই নিন, এই কাগজে আপনার ঠিকানাটা লিখে দিন।
ফিরোজ তার ঠিকানাটা লিখে দিল।
কয়েকদিন পর ফিরোজ একদিন কমার্শিয়াল ফোন থেকে প্রমীদের বাসায় টেলিফোন করল।
প্রমীর বড় ভাবী টেলিফোন রিসিভ করল, হ্যালো।
হ্যালো, এটা কি প্রমীদের বাসা?
হ্যাঁ, আপনি কাকে চাচ্ছেন?
প্রমীকে।
আপনি কে?
জি আমার নাম ফিরোজ।
ও তোমার তো আরো আগে ফোন করার কথা ছিল, দেরি করলে কেন ভাই?
জি মানে।
আহা রে বেচারা, বিয়ের আগে ও তোমার নাম কতবার বলল। তুমি ক'দিন আগে ফোন করলে না কেন?
ফিরোজ বুকে একটা আঘাত পেল। প্রমীর সঙ্গে ফিরোজের দু'দিন দেখা হয়েছে তাতেই প্রমীর বিয়ের কথা শুনে ফিরোজের বুক যেন হাহাকার করে উঠল। সে কী বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তার গলা শুকিয়ে যেন কাঠ হয়ে গেল, না মানে।
মানে মানে করে লাভ হবে না, ও প্রতিদিন খবর নিত ওর কোন ফোন এসেছে কি না, আর তুমি ফোন করলে এতদিন পর, তোমার শাস্তি হওয়া উচিৎ।
না আসলে-
বলে আর কী হবে? যাক বিয়ে হয়েছে তো আর কী হয়েছে, তুমি লাইনে থাকো আমি ডেকে দিচ্ছি, আহা রে বেচারা।
তারপর প্রমীকে টেলিফোনের রিসিভার দিল, হ্যালো।
প্রমী আমি ফিরোজ।
কেমন আছেন আপনি?
ভালো, তুমি?
আপনি আর ভালো রাখলেন কই, আমি তো মনে করলাম কাল একবার আপনার খোঁজে বের হবো। ঘাসিপাড়া আমার এক বান্ধবী আছে, আপনার প্রতিবেশি ওকে নিয়ে আপনার বাসায় যাবো।
আসলে খুব ভালো হতো।
আপনি কোথা থেকে টেলিফোন করেছেন?
স্টেশন রোডের একটা কমার্শিয়াল ফোনের দোকান থেকে।
আপনার অনেক টাকা বিল আসবে তো, আপনি রাখুন আমি কল ব্যাক করছি।
ফিরোজ টেলিফোনের রিসিভার রাখার সঙ্গে সঙ্গে প্রমী কল ব্যাক করল।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, প্রমী তোমার ভাবী যে বলল তোমার বিয়ে হয়েছে?
আরে না, ভাবি আপনার সঙ্গে ইয়ার্কি করল। ভাবীরা তো একটু রসিকতা করবেই, সবাই তো আর আপনার মতো কাঠখোট্টা মানুষ না।
আমি কাঠখোট্টা মানুষ?
এক'শ ভাগ।
কীভাবে বুঝলে?
আপনার সঙ্গে সেদিন কতক্ষণ কথা হলো আমি ভাবলাম আপনি আরো আগে ফোন করবেন।
আমি বললাম না আমাদের বাসায় টেলিফোন নেই।
আজ যেভাবে ফোন করলেন কয়েকদিন আগেও তো সেভাবে ফোন করতে পারতেন।
সরি প্রমী।
দেখুন বার বার সরি বললে কিন্তু হবে না। আজকেই আপনার শেষ সরি আর কোনদিন সরি বলতে হয় এমন ভুল করবেন না।
আচ্ছা ঠিক আছে।
আচ্ছা একটা কথা বলুন তো, সেদিন এতক্ষণ কথা বলার পর কি আমার কথা আপনার একবারও মনে হয়নি?
হয়েছে।
কী মনে হয়েছে?
তোমার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে, দেখা করতে ইচ্ছা করছে।
বেশ তো দেখা করতে ইচ্ছা করলে দেখা করবেন, কাল আপনি ফ্রি আছেন?
কালকেই?
হ্যাঁ কাল শুক্রবার বাবা গ্রামের বাড়ি যাবে, আপনি ঠিক সকাল দশটায় সিকদার মোড়ে থাকবেন, রামসাগর যাবো।
প্রমী আসলে কারো জন্য অপেক্ষা করতে আমি খুব অস্বস্থিবোধ করি, তাছাড়া আমার কি আর সেই ছাত্রজীবন আছে?
কারো জন্য অপেক্ষা করতে আমিও খুব অস্বস্থিবোধ করি আর ছাত্রজীবনের কথা বলছেন? ছাত্রজীবন শেষ হয়েছে তো কী হয়েছে? বয়স হয়েছে, লজ্জা শরম হয়েছে? দেখুন লজ্জা শরম থাকলে প্রেম হয় না।
আমরা তাহলে প্রেম করছি।
ইয়ার্কি না?
না ঠিক আছে।
আবার হারিয়ে যাবেন না তো?
না।
সতেরো
সিকদার একটি ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা। সকাল হতেই সেখানে মানুষের পদচারণায় মুখর হয়ে উঠে। এই বাজারের মধ্যে থেকে দাঁড়িয়ে থেকে কারো প্রতি লক্ষ্য রাখা একটু কঠিনই। তাই ফিরোজ মোড় থেকে কিছুটা উত্তর দিকে যে রাস্তাটি শহর থেকে বেরিয়ে এসেছে সেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে বার বার ঘড়ি দেখছিল, না ফিরোজকে দেরি করতে হয়নি। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা হুড তোলা রিক্সা সামনে এসে দাঁড়াল।
ফিরোজ এক রকম চমকে উঠল, প্রমী।
উঠুন।
ফিরোজ একবার এদিক-সেদিক তাকিয়ে রিক্সায় উঠল।
প্রমী বলল, কি সঙ্কোচ করছেন মনে হয়?
হ্যাঁ, সঙ্কোচ তো বটেই।
কোন সঙ্কোচ করবেন না, আসলে যারা সঙ্কোচ করে তারা খুব সহজে কাউকে আপন করতে পারে না।
হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ।
রিক্সা সামনের দিকে এগিয়ে চলল।
কয়েকমিনিট পর রিক্সা রামসাগরের গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
রিক্সা রামসাগরের পাড় দিয়ে একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে চলে গেল। তারপর দু'জনে নেমে পাড়ের উপর দিয়ে পুর্ব প্রান্তে একটা নিরিবিলি স্থানে বসল। পিছনের দিকে উঁচু পাড়, ঢালের ওপর ছোট বড় বেশ কিছু বিভিন্ন প্রজাতির গাছ। সামনের দিকে তাকালে কয়েক'শ ফুট দুরে দিনাজপুর থেকে সোজা উত্তর দিকে একটা রাস্তা ভারত বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে চলে গেছে। সামনে রামসাগরের সীমানা বরাবর ছোট ছোট গাছ যা দর্শনার্থীদের রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী পথচারীদের থেকে আলাদা করেছে।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, প্রমী কেমন আছ?
হ্যাঁ খুব ভালো।
হঠাৎ খুব ভালো মানে?
আপনি খুব ভালো রেখেছেন তো ভালো থাকবো না?
তাই নাকি?
হ্যাঁ মিস্টার, আপনি?
কীভাবে?
কিভাবে আপনি বুঝেন না?
ফিরোজ না সূচক মাথা ঝাঁকাল।
মাথা ঝাঁকাচ্ছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে বলো?
ফিরোজ বুঝতে পারল, প্রমী তাকে আপনি থেকে তুমি বলে সম্বোধন করতে শুরু করেছে।
ফিরোজ প্রমীর চোখে চোখ রেখে বলল, প্রমী আমি তোমাকে ভালোবাসি।
আমিও তোমাকে খুব, খুব ভালোবাসি।
কোথায় যেন একটা টিকটিকি তিন বার টিক টিক করে উঠল। দু'জনের পরষ্পরের ওপর ঢলে পড়ল।
তারপর কয়েকমুহূর্তের নীরবতা।
ফিরোজ নীরবতা ভঙ্গ করে বলল, আচ্ছা প্রমী এই ধরো তুমি তো আমাকে চেনো না, তুমি যে আমাকে খুব ভালোবেসে ফেললে?
তাতে কী, তোমাকে আমি প্রথম দিন থেকে ভালোবেসেছি, প্রথম দিন থেকে না প্রথম চোখে চোখ পড়া থেকে। তোমার চোখে চোখ পড়তেই মনে হয়েছিল, আমি যেন কোথায় হারিয়ে গেলাম। সেজন্য আমি একটু চালাকি করে আমার ঠিকানাটা তোমাকে বলে দিয়েছিলাম কিন্তু তুমি লা-পাত্তা।
প্রমী আমিও বুঝতে পেরেছিলাম আমিও সেদিন থেকেই তোমাকে মনে মনে ভালোবেসেছি কিন্তু যখন জানতে পেরেছি তুমি এই শহরের একজন স্বনামধন্য ধনাঢ্য পরিবারের মেয়ে তখন আর আমার ভালোবাসার কথাটা তোমাকে দেখা করে বলতে পারিনি।
সেদিন থেকে তোমাকে আমিও মনে মনে অনেক খুঁজেছি তোমার এক প্রতিবেশী আমার বান্ধবী, অনেকবার ভেবেছি তোমার বাড়িতে যাবো আবার মনে করেছি একদিনের একটা দোকানে সামান্য পরিচয়ে কারো বাড়িতে যাওয়া ঠিক হবে কিনা? তাই আর যাওয়া হয়নি, তবে সেদিন ভাগ্যক্রমে দেখা হওয়াতে ভালোই হয়েছে। তুমি যা-ই মনে করো না কেন তোমাকে আমার খুব হার্টলেস মনে হয়।
কেন?
এই যে তুমি আমাকে ভালোবাসলে আবার ভয় পেলে, আসলে ভালোবাসা ভীরু, কাপুরুষের জন্য নয়, ভালোবাসায় বিশ্বাস থাকতে হয়, সাহস করতে হয়, রিস্ক নিতে হয় কিন্তু আমার মনে হয় সেরকম কিছু করতে হলে তুমি হারিয়ে যাবে!
এত হারাবার ভয় পাও কেন? তুমি কাউকে হারিয়েছ নাকি?
কাউকে তো পেলামই না, হারানো তো পরের কথা।
তাই নাকি?
আসলে আমাদের পরিবারে অনেক বিধি-নিষেধ আছে।
যেমন?
এই যেমন মেয়েদের কোন বয় ফ্রেন্ড থাকতে পারবে না, ছেলেদের কোন গার্ল ফ্রেন্ড থাকতে পারবে না। বিয়ের ব্যাপারে বাবা-মা'র সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত।
তবে তুমি আমাকে ভালোবাসার মতো রিস্ক নিচ্ছ কেন? শেষে যদি বিয়েই না হয় তবে প্রেম করে আর লাভ কী?
বিয়ে হবে না কেন? পাত্র-পাত্রী রাজি থাকলে বিয়ে হবে না কেন? আমাকে নিয়ে তুমি কোন চিন্তা করো না কিন্তু তোমাকে অনেক সাহসী হতে হবে, আমার জন্য, আমাদের ভালোবাসার জন্য তোমাকে রিস্ক নিতে হবে বলে প্রমী হঠাৎ করেই চোখ-মুখ লাল করে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিল, আমি দূর্ভেদ্য সেই দেয়ালটা ডিঙ্গাতে চাই ফিরোজ।
পারবে?
তোমার সঙ্গে আমার পরিচয় বেশি দিনের না তাই আমার সম্পর্কে তোমার ধারণা কম। আমার ক্লাস ফ্রেন্ডরা এবং আত্মীয়-স্বজনরাসবাই আমার জেদ সম্পর্কে জানে।
প্রমী তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি আমাকে অনেকদিন থেকে চেনো, আমাদের ভালোবাসা অনেকদিনের অথচ দেখা হয়েছে মাত্র দু'দিন, আর তোমার সঙ্গে আমার ভালোভাবে কথা হয়েছে মাত্র একদিন।
কাউকে ভালোবাসার জন্য, কাউকে বিশ্বাস করার জন্য, কারো ওপর নির্ভর করার জন্য একদিন কেন এক সেকেন্ড সময়ই যথেষ্ট, আবার কাউকে বুঝবার জন্য এক জীবন সময়ও যথেষ্ট না, তোমাকে আমি এক সেকেন্ডে চিনেছি।
ফিরোজ প্রমীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল, তুমি দার্শনিকের মতো কথা বলছ।
প্রমী আর কোন কথা বলেনি।
দু'জনে বসে অনেকক্ষণ গল্প করতে করতে কখন যে সুর্য পশ্চিম দিকে হেলে পড়েছে কেউ খেয়াল করেনি। একটা ফেরিওয়ালা সামনে এসে দাঁড়াল, আপা চিপস্ নিবেন? ঠাণ্ডা কিছু? ফ্রিজ থেকে কেবল আনলাম?
ফিরোজ প্রমীকে জিজ্ঞেস করল, প্রমী কিছু খাও, দুপুর গড়িয়েছে, তোমার মনে হয় ক্ষিদে লেগেছে?
প্রমী ঘড়ির দিকে তাকাল, ও মাই গড, বেলা একটা বাজে?
কিছু খাবে না?
হ্যাঁ শুধু একটা ঠাণ্ডা, বলে প্রমী একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস নিয়ে এবং ফিরোজকে একটা নিতে বলল। তারপর তার ছোট ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিল।
প্রমী কি করছ?
কেন? অসুবিধা কি?
তুমি টাকা দিবে কেন?
আমি যদি বলি তুমি টাকা দিবে কেন?
আমি বড় তাই।
বাঃ এখন থেকে নিজেকে বড় ভাবতে শুরু করেছ? ভালোবাসা, বন্ধুত্ব কিংবা সংসার কোথাও কিন্তু বড় ছোট বলে কিছু নেই, সবখানে সবাই সমান, তাছাড়া আমি তোমাকে দাওয়াত করেছি।
হয়েছে, হয়েছে আর বলতে হবে না।
দু'জনে টিলার উপর উঠতেই একটা খালি রিক্সা দেখে ফিরোজ ডাক দিল, এই রিক্সা, দাঁড়াও।
দু'জনে রিক্সায় উঠে রামসাগর একবার প্রদক্ষিণ করে বেরিয়ে এলো।
আবার সিকদার মোড়ে আসার আগেই প্রমী জিজ্ঞেস করল, আবার দেখা হবে কবে?
তুমি যখন চাইবে?
আমি তোমাকে কীভাবে ডাকবো?
আমি তোমাকে টেলিফোন করবো।
হ্যাঁ কিন্তু যে কোন সময় টেলিফোন করলে তো আমাকে পাবে না। আবার বাবা রিসিভ করতে পারে তখন একেবারে বিশ্রী কাণ্ড ঘটে যাবে, তুমি কাল বিকেল পাঁচটায় আমাকে টেলিফোন করো তখন আমি তোমাকে বলে দিব প্রতিদিন কখন তুমি আমাকে টেলিফোন করবে।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
দেখ কিন্তু আমাকে না জানিয়ে হঠাৎ করে টেলিফোন করো না।
না তোমাকে আমি সেরকম বিপদে ফেলব না।
রিক্সা সিকদার মোড়ে আসতেই ফিরোজ নামতে যাচ্ছিল। প্রমী ফিরোজের একটা হাত টেনে ধরে বলল, টেলিফোন করো কিন্তু!
হ্যাঁ করবো।
আঠারো
ফিরোজ আর প্রমীর দিন যাচ্ছিল বেশ ভালোভাবেই। তখনো টেলিফোন সেট-এ স্বাভাবিকভাবেকলার আই.ডি (Caller I.D) পদ্ধতি চালু হয়নি, বিশেষ শর্তে টি.এন্ড টি বিভাগ কলার আই.ডি সিস্টেম চালু করে দিত। প্রমীদের বাসার টেলিফোন সেটটিতে কলার আই.ডি পদ্ধতি চালু করা ছিল, ফিরোজ স্টেশন রোড এর একটা কমার্শিয়াল ফোনের দোকান থেকে টেলিফোনে একটা মিস কল দিয়ে প্রমীর কল ব্যাক এর জন্য অপেক্ষা করতো। প্রমীও ফিরোজের টেলিফোনের অপেক্ষায় থাকতো, ফিরোজের কল পাওয়া মাত্র কল ব্যাক করতো তারপর কথা চলতো অনেকক্ষণ। প্রমীর এ বিষয়টা হয়ত তার বাবা লক্ষ্য করতো।
একদিন ফিরোজ মিস কল দিয়ে অপেক্ষা করছিল, কয়েকমিনিটের মধ্যে কল ব্যাক করতেই ফিরোজ রিসিভ করল, হ্যালো প্রমী।
গম্ভীর এক ভয়ঙ্কর কণ্ঠস্বর ভেসে এসেছিল, কে তুমি?
ফিরোজের বুক ভয়ে কেঁপে উঠল, সে টেলিফোন রেখে দিল।
তারপর আর প্রমীর সঙ্গে কোন যোগাযোগ হয়নি। দু'দিন পর একদিন রাত প্রায় দশটার সময় ফিরোজ বাসায় ছিল। একটা ছেলে এসে ফিরোজকে ডাক দিল।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, কে?
একটু বাইরে আসেন।
কেন?
প্রমী আপা আপনাকে ডাকে।
কোথায়?
রাস্তায়।
ফিরোজ এক রকম দৌড়ে গেল।
প্রমী তখন একটা মাইক্রোবাসে বসা। তার চেহারায় সমপ্রতি বয়ে যাওয়া ঝড়ের বিধস্থ চিহ্ন, সঙ্গে বড় আকারের একটা ট্রাভেল ব্যাগ।
প্রমী! কী ব্যাপার?
গাড়িতে ওঠো।
কোথায়?
আমি বলছি আগে গাড়িতে ওঠো।
আগে বলো।
রাত দশটার সময় রক্ষণশীল পরিবারের একটা প্রগ্রেসিভ মেয়ে বাবা-মা'র শাসন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য এ অবস্থায় কোথায় যেতে পারে জানো না?
প্রমী আমি বাসা থেকে আসি।
না, তুমি যেভাবে আছ সেভাবেই চলো।
প্রমী আমি প্রস্তুতি নিয়ে আসি, মানে কাপড়-চোপড়, টাকা-পয়সা?
কিচ্ছু লাগবে না, আমি সবকিছু নিয়ে এসেছি।
মাকে বলে আসি।
প্রমী রাগান্বিত চোখে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আসবে, নাকি আমি চলে যাবো?
ফিরোজ আর কোন কথা বলল না।
গাড়ি দ্রুত গতিতে ছুটে চলছে। ফিরোজ একবার প্রমীর দিকে তাকিয়ে কথা বলতে গিয়েও যেন থেমে গেল।
গাড়ি দশ মাইল মোড়ে পৌঁছার আগে ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, প্রমী কোথায় যাবে?
প্রমী ড্রাইভারকে বলল, ডানে যাও।
প্রমী আমাকে বলো?
ফিরোজ তুমি টেলিফোন করার পর আমার ওপর দিয়ে ঝড় বয়ে গেছে, বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে, আমি একটু চালাকি করে পালিয়ে এসেছি। তুমি আমাকে কোথাও নিয়ে চলো, প্লিজ!
সেজন্যই তো আমি বাসা থেকে প্রস্তুতি নিয়ে আসতে চাইলাম, তুমি তো আমাকে সময় দিলে না।
আমি সব প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি, আমার কাছে টাকা আছে, অনেক গয়না নিয়ে এসেছি। এই টাকা আর গয়না দিয়ে আমাদের অনেকদিন চলবে।
তাই বলে আমার কোন অংশগ্রহণ থাকবে না?
তোমার-আমার বলে তো কোন কথা নেই। আমার সঙ্গে যা আছে সব আমাদের, তুমি এখন আমাকে নিয়ে চলো।
তুমি কিছু ভেবো না আমি সব দেখছি, বলে ফিরোজ সব দায়িত্ব নিল। গাড়ি সৈয়দপুর পৌঁছাবার আগে ফিরোজ প্রমীর কানে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, ড্রাইভার কি তোমার পরিচিত?
না, তবে বাবা ওকে খুঁজে বের করবে, ওর মাধ্যমে আমাদের গন্তব্য বের করতে পারে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
গাড়ি সৈয়দপুর পৌঁছাতেই ফিরোজ গাড়ি দাঁড় করিয়ে প্রমীকে গাড়িতে রেখে নেমে গেল, ফিরে এলো প্রায় আধ ঘণ্টা পর ততক্ষণে প্রমী অনেকটা বিরক্ত হয়েছিল, ফিরোজ তুমি এত দেরি করলে?
প্রমী গাড়ি থেকে নামো, এই যে ড্রাইভার ভাই আপনার ভাড়া কত?
দেন, ইনসাফ করে...
প্রমী এক হাজার টাকা দাও।
প্রমী গাড়ি থেকে নেমে ড্রাইভারকে এক হাজার টাকা দিল।
তারপর দু'জনে রিক্সায়।
ফিরোজ কোথায় যাবে?
প্রমী আমি একটা প্রাইভেট কার ভাড়া করে রেখে এসেছি, চলো আমরা রংপুর যাবো। আমার এক বন্ধু আছে রংপুর শহরে ওদের বাড়ি, আগে ওর বাড়িতে যাই তারপর সব ব্যবস্থা হবে।
ও কী এখন রংপুরে থাকে?
হ্যাঁ, আমি গাড়ি ভাড়া করতে গিয়ে টেলিফোনে ওর সঙ্গে যোগাযোগ করে এসেছি, কোন অসুবিধা নেই।
তুমি খুব বুদ্ধিমান ফিরোজ।
গাড়ি যখন রংপুর পৌঁছাল তখন রাত প্রায় বারোটা। ফিরোজ গাড়ি থেকে নামতেই তার বন্ধু লিয়াকত সামনে এসে হাজির, ফিরোজ কোন সমস্যা হয়নি তো?
না।
চলো, চলো, ভিতরে চলো।
লিয়াকত ফিরোজের ফোন পেয়েই বিষয়টা তার বাবা-মা সবাইকে জানায়, তাই তাদের বাড়িতে এক ধরণের বিয়ে বিয়ে ভাব ছিল।
ফিরোজ আর প্রমীকে ড্রয়িং রুমে বসতে দিয়ে লিয়াকত বলল, তোমরা হাত-মুখ ধুয়ে নাও আমি খাবার দিতে বলি।
খাওয়ার পর লিয়াকত, ফিরোজ আর প্রমীর শুরু হলো রুদ্ধদ্বার বৈঠক।
লিয়াকত জিজ্ঞেস করল, ফিরোজ আমি কি-
ফিরোজ মুখে আঙ্গুল দিয়ে থামতে ইশারা করল।
সরি দোস্ত তোমরা ডিসিশন নাও, আমি একটু পরে আসছি, বলে লিয়াকত বেরিয়ে গেল।
লিয়াকত বেরিয়ে যেতেই ফিরোজ প্রমীর গা ঘেঁষে বসে প্রমীর থুতনি উঁচু করে ধরে তার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, প্রমী কী করবে?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ? তুমি জানো না কী করতে হবে?
ষ্পষ্ট করে বলো প্রমী, সব বিষয়ে ইশারা বুঝে নিতে বললে হয় না, আমি কি লিয়াকতকে বিয়ের আয়োজন করতে বলব?
প্রমী খুব অদ্ভুত সুন্দর একটা মুচকি হাসি হেসে বলল, হ্যাঁ।
কিছুক্ষণ পর লিয়াকত ফিরে এসে ফিরোজকে ইশারায় জিজ্ঞেস করল, তোমাদের ডিসিশন কী?
ফিরোজও ইশারায় জানাল, তুমি বিয়ের আয়োজন করো।
তোমরা রেস্ট নাও, বলে লিয়াকত জোরে ডাক দিল, এই লাকী এদিকে আয়।
পনেরো-ষোল বছর বয়সের একটা মেয়ে রুমে ঢুকে সালাম দিল।
লিয়াকত পরিচয় করে দিল, ফিরোজ আমার ছোট বোন, লাকী, ও হচ্ছে আমার ফ্রেন্ড ফিরোজ আর প্রমী, কিছুক্ষণ পর....
লাকী বলল, আর বলতে হবে না, বুঝতে পেরেছি।
লিয়াকত আর লাকী বেরিয়ে গেল।
উনিশ
কয়েক ঘণ্টার মধ্যে লিয়াকত সবকিছু খুব সুন্দরভাবে আয়োজন করল। লিয়াকত তার এক বন্ধু আর তার বোনকে নিয়ে রাতের মধ্যেই বিয়ের কেনাকাটা করল, মহল্লার এক পার্লার থেকে দু'জন মেয়ে এসে প্রমীকে বউ সাজালো, কসাই ডেকে বাড়িতে খাসি জবাই করে খাওয়ার আয়োজন করল। ফিরোজ সাহেবের মনে হয়েছিল সবকিছু যেন পরিকল্পিত।
কাজি বিয়ে পড়ালো ভোর তিনটায়। তারপর বাসর রাত।
আসলে সবকিছুই যেন মন্ত্রের মতো। বাসরঘর সাজানো হলো সুন্দরভাবে। ফিরোজ ঘোমটা তুলতেই প্রমী বলল, এই যে মিস্টার আল্লাহ তোমাকে এমন একটা বন্ধু জুটিয়ে দিয়েছে খুব সহজে, তুমি বাসরঘরে তো ঢুকতে পারলে যেন সবকিছু আলাদিনের চেরাগের মতো সবকিছু ম্যানেজ করে দিল। বাহ্, তোমার এমন বন্ধু আছে আগে তো কোনদিন বলোনি।
বলতে আর দিলে কই? দু'য়েকদিন কথা হলো আর ওমনি আমাকে বিয়ে করার জন্য ঘর ছাড়লে। তোমার সঙ্গে অনেকদিন প্রেম করার ইচ্ছা ছিল তা আর হতে দিলে কই?
এখন প্রেম করো, এখনো তো সারাজীবন পড়ে আছে।
বিয়ের পর প্রেম?
হ্যাঁ।
বিয়ের পর আবার প্রেম হয় নাকি?
প্রমী মুখ আংশিক বিকৃত করে বলল, না বিয়ের পর প্রেম হয় না, মানুষের মেয়ের সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে আজ রামসাগর, কাল স্বপ্নপুরী ঘুরে ঘুরে প্রেম করতে হয়, না?
এক্সাক্টলি।
থাক ঐ একটা কষ্ট মনের মধ্যেই থাক, বিয়েটা তো খুব ভালোভাবে হলো, বন্ধুর ওপর দিয়ে পার হলে এখন কাল কী করবে সেটা চিন্তা করো।
কাল কী করবো মানে?
হ্যাঁ তুমি একজনের মেয়েকে নিয়ে পালাবে আর তোমার শ্বশুর মশাই চুপ করে বসে থাকবে। দেখ কাল কপালে কী আছে আল্লাহ্ই জানে।
তুমি পাশে থাকলে আমি সব পারবো, কাল কপালে যা আছে তাই হবে, তাই বলে আজকের বাসর রাতটা নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নেই, বলে ফিরোজ প্রমীকে জড়িয়ে ধরল।
কয়েকদিন লিয়াকতের বাসায় প্রমী আর ফিরোজের ভালোভাবেই কেটে গেল। তারপর একদিন প্রমীই ফিরোজকে বলল, এই কয়েকদিন তো হলো এভাবে মানুষের বাড়িতে আর কতদিন?
হ্যাঁ আমিও তাই ভাবছিলাম এখন কী করবে?
কাল একবার ভাবীকে টেলিফোন করতে হবে।
কাল কেন আজকেই টেলিফোন করো।
হ্যাঁ আজ তোমার বন্ধুর টেলিফোন থেকে টেলিফোন করি আর বাবা জেনে ফেলুক আমরা কোথায় আছি? কাল আমি কমার্শিয়াল ফোন থেকে টেলিফোন করবো।
পরদিন প্রমী কমার্শিয়াল ফোন থেকে বন্যার অফিসের টেলিফোনে রিং করল, হ্যালো।
হ্যালো কে বলছেন প্লিজ!
আমার নাম প্রমী, আমি একবার বন্যার সঙ্গে কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
একটু লাইনে থাকুন ডেকে দিচ্ছি।
কয়েকমুহূর্ত পর বন্যা কথা বলল, হ্যালো প্রমী।
আপা, বলেই প্রমীর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেল।
প্রমী কী খবর? তুই কোথায়? ভালো আছিস?
হ্যাঁ আপা ভালো আছি।
প্রমী আসলে তোকে যে আমি কী বলে সান্ত্বনা দিব?
আপা আমি ভাবীর সঙ্গে কথা বলব, তুমি কি একবার কন্টাক্ট করে দিবে?
প্রমী শোন, তুই ঠিক এশার নামাজের সময় ফোন দিস, তখন তো ফুপা নামাজ পড়তে যাবে তখন আমি আর ভাবি টেলিফোনের কাছে থাকব।
আচ্ছা ঠিক আছে।
প্রমী ঠিক এশার নামাজের সময় টেলিফোন করল।
অপর পাশে টেলিফোন রিসিভ করেছিল বন্যা, হ্যালো আস্সালামুয়ালায়কুম।
হ্যালো আপা আমি প্রমী বলছি।
হ্যাঁ ভাবী পাশেই আছে কথা বল।
হ্যালো, প্রমী কেমন আছিস?
প্রমী প্রথমে কিছু বলতে পারেনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল।
হ্যালো প্রমী কাঁদছিস কেন? আমাকে বল? কোথায় আছিস? কোন সমস্যা?
ভাবী তুমি তো সবকিছু জানো, আমি এখন কী করবো?
শোন আব্বা খুব রেগে আছে, প্রথমে মামলা করতে চেয়েছিল, সবাই মান-সম্মানের কথা বলে অনেক বুঝিয়ে-সুজিয়ে থামিয়েছে, তুই বাসায় আসিস না, আমি আর কী বলব? তুই তো তোদের বাড়ির কথা জানিস।
ভাবী?
ফিরোজ কী বলছে? ওদের বাড়িতে কোন অসুবিধা আছে?
তুমি কথা বলো ভাবী।
তারপর ফিরোজ কথা বলল, হ্যালো ভাবী আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম।
ভাবী আমি ফিরোজ।
হ্যাঁ চিনতে পেরেছি, তুমি প্রমীকে বিয়ে করেছ না?
হ্যাঁ।
বিয়ের পর কি বউ নিয়ে কেউ পথে প্রান্তরে ঘুরে বেড়ায় নাকি বাড়িতে উঠে?
ভাবী।
হ্যাঁ বিয়ে করেছ এখন বউ নিয়ে বাড়িতে উঠবে, এত ভয় করলে কী হয়? এত ভয় পাচ্ছ কেন? তুমি প্রমীকে নিয়ে তোমাদের বাড়িতে ওঠো।
জি ভাবী।
টেলিফোনটা একবার প্রমীকে দাও।
ফিরোজ রিসিভার প্রমীকে দিতেই তার ভাবী বলল, প্রমী আমি ফিরোজকে বলেছি তুই ফিরোজদের বাড়িতে যা, এদিক আমি দেখছি, পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে দেখা যাবে।
ফিরোজ প্রমীকে তাদের বাড়িতে নিয়ে গেল। সৌভাগ্যক্রমে বিয়ের কয়েকমাস পরেই ফিরোজের চাকরিও হলো। প্রথম পোস্টিং হয় নীলফামারীতে। দিনাজপুর থেকে নীলফামারী যাওয়ার আগে ফিরোজ একবার প্রমীকে নিয়ে তার শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল। শ্বশুর বাড়ির সবাই দেখা করলেও তার শ্বশুর ফিরোজের সঙ্গে দেখা করেনি।
তারপর ফিরোজ আর কখনো শ্বশুরবাড়ি যায়নি। আজ বিয়ের কার্ড দিতে গিয়েও ফিরোজের সঙ্গে সবাই ভালো ব্যবহার করলেও তার শ্বশুর দেখা করেনি। ফিরোজ টেবিলের ওপর চশমা রেখে চোখ মুছল।
বিশ
নূরের প্রতারণার শিকার হওয়ার পর আরশীর জীবনের উচ্ছ্বলতা যেন থমকে গেছে। তার মনে পুরুষদের প্রতি এক রকম ঘৃণা জন্মেছে। আরশীর গায়ের রং শ্যামলা কিন্তু আকর্ষণীয়, লম্বা, চোখ দু'টো খুব সুন্দর যে কোন ছেলে খুব সহজে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
পুলিশের চাকরি দিনের প্রায় বেশির ভাগ সময়ই নারী-পুরুষ একসঙ্গে কাজ করতে হয়। দিনের পর দিন একসঙ্গে কাজ করতে করতে কারো সঙ্গে হৃদ্যতা হওয়া ছিল খুব স্বাভাবিক কিন্তু আরশী এই বিষয়টা খুব সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে চলতো। তবুও কোন না কোনভাবে কেউ তার প্রতি আকৃষ্ট হতো তেমনি একজনের সঙ্গে তার পরিচয় হয় পুলিশের এক এ.এস.আই'র সঙ্গে। ছেলেটির নাম শিহাব কনস্টেবল পদে জয়েন করে সম্প্রতি এ.এস.আই পদে প্রমোশন পেয়েছে। শিহাব প্রতিদিন আরশীকে মোবাইল করে তার খোঁজ-খবর নেয়। প্রথম প্রথম তার খোঁজ-খবর না নেওয়ার জন্য আরশী অনুরোধ করেছিল কিন্তু তারপরও শিহাব প্রায়ই আরশীকে মোবাইল করে।
আরশীর মোবাইলের রিং বেজে উঠল।
সে মোবাইল রিসিভ করল, হ্যালো স্যার।
আরশী তোমাকে না বলেছি আমাকে স্যার বলে ডাকবে না।
কেন?
দেখ তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অফিসিয়াল না, ব্যক্তিগত।
শুধু ব্যক্তিগত?
না অনেকটা হৃদয়ঘটিত।
স্যার বলুন কেমন আছেন?
ভালো নেই।
কেন? কোন অসুখ নাকি?
হ্যাঁ।
ডাক্তারের কাছে যান, সবার আগে নিজের শরীরের দিকে খেয়াল রাখবেন। কয়েকদিন বিছানায় পড়ে থাকলে কেউ খবর নিবে না।
তাই তো খোঁজ-খবর নেওয়ার মানুষ খুঁজছি।
এতদিনও পাননি?
পেয়েছি।
তাহলে তো সমাধান হয়ে গেল।
হয়নি।
কারণ?
কারণ অগ্রগতি ফিফটি পার্সেণ্ট।
ফিফটি পার্সেণ্ট মানে শুধু পাত্র রাজি, পাত্রি রাজি কিনা এখনো জানি না।
তাই নাকি?
আরশী একদিন দেখা করো না আমার সঙ্গে, কিছুক্ষণ গল্প করি, আসলে তোমার সঙ্গে আমার অনেক কথা আছে।
বলে ফেলুন?
মোবাইলে বলা যাবে না।
সরি স্যার, আমি রাজশাহীতে অনেকদিন থেকে চাকরি করছি, এমনিতেই মহিলা পুলিশের সংখ্যা কম তাই আমি না চিনলেও অনেকেই আমাকে চিনে। আমি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই না।
তাহলে রাজশাহীর বাইরে দেখা করি।
স্যার আমার বয়স সাতাশ বছর, আপনার বয়সও ত্রিশের ওপর, আমাদের কারোই আসলে পার্কে বা রেস্টুরেণ্টে প্রেম করার বয়স নেই, তাই আপনি যদি এমন কিছু বলতেই চান তবে মোবাইলেই বলুন।
আরশী তুমি বয়সে কম হলেও আমার চেয়ে অনেক ম্যাচূর্ড, তোমাকে আর আমি নতুন করে বলতে চাই না। তুমি যদি রাজি থাকো তবে আমি তোমাদের বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠাই তারপর পারিবারিকভাবে বিয়ে হবে।
তার আগে আমার কিছু কথা আছে?
বলো?
আপনি আমাকে কতদিন থেকে চিনেন?
এই প্রায় মাস খানেক হলো।
স্যার আপনি আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তারপর আমাকে মোবাইল করবেন, আসলে বিয়ে তো একদিনের জন্য না, সারাজীবনের, সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কোনকিছু না জেনেই আমাকে বিয়ে করলেন বিয়ের পর আপনি আমাকে নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন তুলবেন, তখন সংসারে অশান্তি দেখা দিবে তারচেয়ে আপনি বরং আমার সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে তারপর সিদ্ধান্ত নিন।
আরশী আমি যদি বলি আমি তোমার সম্পর্কে কিছু জানতে চাই না, বিয়ের আগে তুমি কী করেছ সে বিষয়ে আমি কোন প্রশ্ন করবো না, তবে বিয়ের পর পিছনের কোন কিছুর যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটলেই হলো।
স্যার আমি ঢাকা যাচ্ছি তো, আমি না হয় পরে আপনার সঙ্গে কথা বলি।
হঠাৎ ঢাকায় কেন?
আমার একটা ব্যক্তিগত কাজ আছে, আরো আগে ছুটির দরখাস্ত দিয়েছিলাম কিন্তু ভি.আই.পি ডিউটির জন্য ছুটি পিছিয়ে গেছে।
আরশী আমি তোমার সম্পর্কে কিছু জানবো না, তুমি ঢাকা থেকে ফিরে এসো তারপর কথা হবে।
আরশী কিছুটা বিরক্তির সুরে বলল, স্যার বললাম তো আমি একটা ব্যক্তিগত কাজে ঢাকা যাচ্ছি, আপনার মোবাইল নাম্বারতো আমার কাছে আছে ফিরে এসে আমি আপনাকে রিং দিব, প্লিজ আমি রিং না দিলে আপনি আর কোনদিন রিং দিবেন না।
আরশী মোবাইল রেখে দিতেই মোবাইলের কল রেকর্ডে ভেসে উঠল, একত্রিশ মিনিট।
আরশীর মনে পড়ল ফিরোজের কথা। এতক্ষণ মোবাইলে কথা বলতে গেলে ফিরোজ কয়েকবার মোবাইলে রিং দিত। আধ ঘণ্টা মোবাইল ব্যস্ত দেখলে অনেক প্রশ্ন করতো, কার সঙ্গে এত কথা বললে? একজন কলিগ বা স্যারের সঙ্গে এত কী কথা থাকতে পারে?
আরশী প্রথম মোবাইল হাতে পাবার পর তার মোবাইলে কথা বলার খুব আগ্রহ ছিল কারো মোবাইল থেকে একটা মিস কল পেলেই সে কল ব্যাক করতো।
এমনিভাবে মোবাইল করতে করতে আরশীর একজন মোবাইল ফ্রেন্ড জুটল। প্রতিদিন ছেলেটি আরশীকে মোবাইল করে অনেকক্ষণ মোবাইলে কথা বলতো।
একদিন সে মোবাইলে কথা বলতে বলতে ফিরোজ বার বার মোবাইল করছিল। আরশীর কথা বলা শেষ হতেই ফিরোজ আবার মোবাইল করল।
হ্যালো, আসসালামুয়ালায়কুম।
আরশী কে মোবাইল করেছিল?
আমার এক বান্ধবী।
আমার সঙ্গে মিথ্যা কথা বলছ, না?
আরশী কোন কথা বলল না।
আচ্ছা ঠিক আছে তোমাকে আর বলতে হবে না, তুমি মোবাইলের কল রেকর্ডটা ডিলিট করবে না আমি কাল সকালে আসছি তোমার মোবাইলের কল রেকর্ড দেখব।
আরশী আর কোন কথা বলেনি।
পরদিন ছিল অফিস বন্ধ, ফিরোজ সত্যি সত্যিই বাঘমারায় আরশীর বাসায় ঢুকে তাকে মোবাইল করেছিল, হ্যালো আরশী।
তুমি?
হ্যাঁ আমি এখন তোমার বাসায়।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি বসো আমি আসছি।
কয়েকমিনিটের মধ্যেই আরশী বাসায় এলো।
ফিরোজের মুখের দিকে তাকিয়ে আরশীর মুখ শুকিয়ে গিয়েছিল, তুমি কী মনে করে?
তোমাকে বলেছিলাম না, আমি আসছি।
তাই বলে সামান্য একটা মোবাইলের কল রেকর্ড দেখার জন্য সত্যি সত্যি-
তোমার মোবাইলটা দাও, কালকের কল-রেকর্ডগুলো দেখি?
আচ্ছা দেখবে, আগে বসো, আমি নাস্তা দিচ্ছি, নাস্তা খেয়ে তারপর দেখবে।
না আমি আগে দেখব, বলে সে আরশীর কাছ থেকে মোবাইলটা কেড়ে নিয়ে কল রেকর্ড দেখে বলল, এটা কার নাম্বার?
আমার এক বন্ধুর।
ফিরোজ সেই নাম্বারে মোবাইল করল।
অপর পাশ থেকে ছেলেটি বলল, হ্যালো আরশী?
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, এই ছেলে আরশী তোমার কেমন বন্ধু?
বন্ধু আবার কেমন হয়? বন্ধু বন্ধুই।
আরশীর সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছে কীভাবে?
অপর পাশ থেকে কোন সাড়া না পেয়ে ফিরোজ আরো বেশি রেগে গিয়েছিল, লাইন কেটে দিয়েছে।
ফিরোজের চোখ-মুখ লাল হয়ে গেল, সে মোবাইলটা জোরে দেওয়ালে ছুঁড়ে মারল।
সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটা ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে গেল।
আরশী কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, আমার এত সুন্দর মোবাইলটা ভেঙ্গে দিলে?
হ্যাঁ ভেঙ্গে দিলাম মোবাইলের মানুষটা যখন নষ্ট হয়ে গেছে তখন আর মোবাইলটা ভালো থেকে কী হবে?
ফিরোজ ভাঙ্গা মোবাইল সেট থেকে সিমকার্ডটাও খুলে নিয়ে ভেঙ্গে দিল।
আরশী কান্না ভাঙ্গা গলায় বলল, এখন আমি কী দিয়ে তোমার সঙ্গে কথা বলব?
আমার সঙ্গে আর তোমাকে কথা বলতে হবে না।
না আমি তোমার সঙ্গে কথা না বলে থাকতে পারবো না।
তুমি আমার সঙ্গে কথা না বলেও থাকতে পারবে?
ফিরোজ আরশীর চোখের পানি মুছে দিল, আরশী আমি তোমার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলব।
অফিসের টেলিফোনে কি সব কথা বলা যায়?
ফিরোজ কিছুক্ষণ চুপ করেছিল তারপর বলল, তুমি তোমার স্যারকে বলে এসো, চলো তুমি আমার সঙ্গে রাজশাহী, আমি তোমাকে মোবাইল কিনে দিচ্ছি কিন্তু আমার কয়েকটা কন্ডিশন আছে?
বলো তোমার কন্ডিশন?
ফিরোজ এক এক করে বলল, প্রয়োজন ছাড়া মোবাইলে কথা বলা যাবে না, মোবাইলে কোন ছেলে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা যাবে না।
আরশী ফিরোজের সব শর্তই মেনে নিল কিন্তু শর্ত রক্ষা করতে পারেনি।
যে মানুষটা মোবাইল ব্যস্ত দেখে মোবাইলের কল রেকর্ড দেখার জন্য জয়পুরহাট থেকে রাজশাহী এসে মোবাইলের কল রেকর্ড চেক করতে পারে এবং মোবাইলে কোন ছেলের নাম দেখে মোবাইল ভেঙ্গে দিতে পারে আমি তার ভালোবাসা বুঝতে পারিনি আর যখন বুঝতে পেরেছি তখন তাকে আর কোনদিন পাইনি। জানি না তাকে পাবো কি না? একথা ভাবতে ভাবতে আরশী বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো। তার দু'চোখ পানিতে ছল ছল করে উঠল।
আরশী একবার বাইরে তাকাল।
বাস কালিয়াকৈর এসে পৌঁছেছে। সে জেসমিনকে মোবাইল করল।
জেসমিন মোবাইল রিসিভ করেছে, হ্যালো আরশী।
আরশী বলল, জেসমিন আমি কালিয়াকৈর পৌঁছেছি।
আচ্ছা ঠিক আছে, আমি আসছি। তুই কোন বাস-এ উঠেছিস?
আরশী তার বাস-এর নাম বলল।
আমি গাবতলী কাউন্টারে থাকবো, তুই কিন্তু কাউণ্টার থেকে কোথাও যাবি না।
আচ্ছা ঠিক আছে।
একুশ
জেসমিন আগেই কাউন্টারে এসে পৌঁছেছে। আরশী গাড়ি থেকে নামতেই জেসমিন আরশীকে জড়িয়ে ধরে বলল, আরশী, কতদিন পর দেখা সেই কবে ট্রেনিং শেষ হয়েছে আর তো দেখাই হলো না?
আর যখন দেখা হলো তখন এলাম তোর ঝামেলা করতে।
জেসমিন রেগে গেল, আরশী এটা কিন্তু তোর বলা ঠিক হলো না।
সরি জেসমিন।
দু'জনে রাতে অনেক কথা হলো।
আরশী জিজ্ঞেস করল, তোর কথা তো কিছুই শুনলাম না।
আমার কোন কথা নেই রে।
দুলাভাই'র পোস্টিং কোথায়?
খুলনা।
তুই কোনভাবে খুলনা পোস্টিং নিতে পারিস না?
কীভাবে?
ডিপার্টমেন্টে দরখাস্ত করে।
হ্যাঁ দরখাস্ত করেছি, চেষ্টাও করছি কিন্তু বুঝছিস তো আমাদের ডিপার্টমেন্টে আইনের প্রয়োগ সবচেয়ে বেশি কনস্টেবলের ওপর। ছোট চাকরি করি বলে বদলির জন্য তদবির করতে পারি না, ডিউটি বেশি বেতন কম। ফ্যামিলি পারমিশন নেই, যেন পদে পদে শুধু আইন। নিজে বুঝছিস না সারাজীবন শুধু ছুটে চলা গায়ে যখন ইউনিফর্ম থাকে তখন পাবলিক মনে করে না জানি কত টাকা বেতন পাই আর আমরা কতই না সুখে আছি। তুই নিজেও তো ব্যারাকে থাকিস আমাদের খাওয়া-থাকার যে পরিবেশ তা কি স্বাস্থ্যসম্মত? তুই তো পরীক্ষায় পাস করেছিস প্রমোশন পাবি, আপার স্কেল পাবি, ইচ্ছা করলে বাসা ভাড়া নিয়ে বাইরে থাকতে পারবি আর আমার মাথায় তো শুধু গোবর আছে তাই পাস করতেই পারলাম না।
আবার চেষ্টা কর এবার ঠিকই পাস করবি?
আমার কথা থাক, আমি তোর ফিরোজ সাহেবের হেড কোয়ার্টারের ঠিকানা খুঁজে বের করেছি, কবে যাবি?
আমার তো একটাই কাজ, কালকেই যাবো, তোর ডিউটির কী অবস্থা?
ফার্স্ট হাফ-এ আমার ডিউটি নেই।
তাহলে কাল সকালেই যাবো।
আচ্ছা ঠিক আছে এখন ঘুমা।
পরদিন সকালবেলা দু'জনে বের হলো। রাজারবাগ থেকে ফিরোজ সাহেবের অফিসে যেতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না কিন্তু আরশীর মনে হলো রিক্সা যেন আগাচ্ছে না আর ঘন ঘন ট্রাফিক সিগনাল পড়ছে। সে জেসমিনকে বলল, আচ্ছা ঢাকা শহরে এত জ্যাম তোরা চলাফেরা করিস কীভাবে?
শুধু আমাকে কেন সবাইকে এভাবেই চলতে হয়, তুই আজ তোর ফিরোজ সাহেবের অফিসের উদ্দেশ্যে যাচ্ছিস তাই সময়টা তোর কাছে লম্বামনে হচ্ছে।
আরশী মুখে কিছু বলল না, মনে মনে বলল, জেসমিন তুই ঠিকই বলেছিস।
রিক্সা অফিসের সামনে এসে দাঁড়ালো।
দু'জনে রিক্সা থেকে নামতেই গেটে পুলিশ দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করল, আপা আপনারা কার কাছে যাবেন?
জেসমিন বলল, অফিসে।
এই অফিসে তো ফার্স্ট হাফ-এ ভিতরে ঢোকার পারমিশন নেই।
জেসমিন তার আই. ডি কার্ড বের করে দেখাল।
আপা আগে পরিচয় দিবেন তো, আসুন, বলে পুলিশ গেট খুলে দিল।
দু'জনে ভিতরে ঢুকল।
সকালবেলা লিফ্ট এ উঠতে গিয়ে দু'জনকে দীর্ঘ লাইনে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হলো। তারপর দু'জনে উপরে উঠল। লম্বাকরিডোর প্রায় প্রতিটি দরজার সামনে একজন করে পিয়ন টুলে বসে আছে। দু'জনে প্রথমে বুঝতে পারল না আসলে কার কাছে গেলে তারা ফিরোজ সাহেবের বিষয় জানতে পারবে।
আরশী একজন পিয়নকে ফিরোজের নাম এবং পদবী বলে জিজ্ঞেস করল, আপনি কি আমাকে একটু হেল্প করবেন?
জি বলুন।
আরশী ফিরোজ এর নাম, পদবী বলে তার সম্পর্কে কার কাছে গেলে তথ্য জানতে পারবে তা জিজ্ঞেস করল।
আপনারা আমার সঙ্গে আসুন, বলে সে সামনে হাঁটতে লাগল।
জেসমিন আর আরশী তার পিছনে পিছনে গেল। করিডোর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আরশী মাথা উঁচু করে একে একে ন্যাম প্লেটগুলো পড়ে দেখল, হ্যাঁ ফিরোজ যে পদে চাকরি করতো সে পদেই অনেক কর্মকর্তা এখানে চাকরি করে। আরশী মনে মনে ভাবল, ফিরোজ যদি রিজাইনজ্ড না করতো, যদি এখানে তার পোস্টিং হতো তবে সে খুব তৃপ্তি পেত।
একটা দরজার সামনে গিয়ে পিয়ন বলল, আপনারা একটু দাঁড়ান আমি স্যারের কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে আসি।
সে প্রশাসনিক কর্মকর্তার রুমে ঢুকল। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে বলল, আসুন।
জেসমিন আর আরশী ভিতরে ঢুকে সালাম দিল।
মধ্য বয়সী একজন ভদ্র লোক গম্ভীর মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা?
আরশী তার পরিচয় দিল, স্যার আমি আরশী আর ও হচ্ছে জেসমিন আমরা দু'জনে পুলিশে চাকরি করি।
ভদ্রলোক একটু হতচকিত হয়ে বললেন, পুলিশে চাকরি করেন! আমার কাছে কী মনে করে?
জি না স্যার, আমরা আসলে কোন অফিসিয়াল কাজ নিয়ে আসিনি।
ও তাই বলুন।
স্যার ফিরোজ সাহেব নামে এক ভদ্র লোক আপনাদের অফিসে এক সময় জয়পুরহাট চাকরি করতেন, তারপর সেখান থেকে বদলি হয়েছিলেন ঝিনাইদহ, শুনেছি সেখান থেকে তিনি চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, বলতে বলতে আরশীর কণ্ঠস্বর ভারি হয়ে এলো।
ভদ্রলোক আপন মনে ফিস ফিস করে ফিরোজ সাহেব নামটা উচ্চারণ করলেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, ফিরোজ সাহেব আপনার কে হয়?
তিনি আমার পরম শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
আপনি ঠিকই শুনেছেন, তিনি ঝিনাইদহ থাকা অবস্থায় চাকরি থেকে রিজাইন করেছেন।
আরশী চোখ মুছে রুদ্ধ কন্ঠে বলল, আমি একবার তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই, স্যার প্লিজ আপনি যদি তাঁর ঠিকানাটা আমাকে দিতেন?
অবশ্যই।
তিনি ইন্টারকম-এর রিসিভার তুলে ফিরোজ সাহেবের নাম এবং পদবী বলে তাঁর ফাইলটা পাঠিয়ে দিতে বললেন। তারপর আপন মনে বললেন, ফিরোজ সাহেব খুব সচেতন এবং দায়িত্ববান অফিসার ছিলেন, খুব ভালো মানুষও ছিলেন। একজন ভালো মানুষ হিসেবেও ডিপার্টমেন্টে তাঁর সুনাম ছিল অথচ এমন একটা তরতাজা মানুষ কেন যে হঠাৎ করে চাকরিতে রিজাইন দিলেন?
আরশী আর জেসমিন পরষ্পরের মুখের দিকে তাকাল।
তিনি জিজ্ঞেস করলেন, আপনারা কিছু জানেন নাকি?
আরশী বলল, না স্যার।
তিনি আবার বলতে শুরু করলেন, শুনেছি জয়পুরহাটে চাকরি করার সময় তিনি একটা নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আমি অবশ্য বিশ্বাস করিনি। তিনি আমার অনেকদিনের পরিচিত, আমি তাকে খুব ভালোভাবে চিনি, আমার বিশ্বাস তিনি এমন কাজ করতে পারেন না। কিন্তু আমার বিশ্বাস অবিশ্বাস দিয়েই বা কী কাজ?
আরশীর বুক ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইল। সে অনেক কষ্টে চোখের পানি থামিয়ে আপন মনে বলল, আপনি ঠিকই বলেছেন স্যার আসলে এত ভালোমানুষ কখনো এমন কাজ করতে পারে না। কিন্তু সে মুখে কিছু বলল না।
কয়েক মিনিটের মধ্যে পিয়ন একটা ফাইল নিয়ে এলো।
আরশী আড় চোখে তাকিয়ে দেখল, হ্যাঁ ফাইলের ওপর ফিরোজের নাম লিখা আছে।
আরশী তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট প্যাড-এর পাতা বের করল।
তিনি বলতে শুরু করলেন, নাম লিখুন।
লিখেছি।
তিনি ফাইলে রাখা ফিরোজ সাহেবের স্থায়ী ঠিকানাটা বললেন।
আরশী লিখে নিয়ে বলল, ধন্যবাদ স্যার, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
দু'জনে প্রশাসনিক কর্মকর্তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলো।
রিক্সা রাজারবাগ পৌঁছাল বেলা দু'টায়।
আরশী বলল, জেসমিন আমি আজ রাতেই দিনাজপুর যাবো।
হ্যাঁ তুই বললি আর আমি তোকে যেতে দিলাম? চল আগে খেয়ে আসি, সেকেন্ড হাফ-এ আমার ডিউটি আছে, খাওয়ার পর আমি স্যারকে বলে আমার ডিউটি কাউকে দিয়ে আমরা একসঙ্গে বেড়াতে যাবো।
না রে।
আরশী আমিও অনেকদিন থেকে কোথাও যাই না, তুই এসেছিস একসঙ্গে বিকেলবেলা ঘুরে বেড়াবো কাল সকালে তোকে আমি বাস-এ উঠিয়ে দিয়ে আসবো।
আরশী আর কিছু বলল না কিন্তু তার মন কেমন যেন অস্বস্থিবোধ করল।
বাইশ
ফিরোজ ঘুমানোর চেষ্টা করছে কিন্তু তার চোখে ঘুম আসছে না। তার চোখের সামনে কখনো রিমার বউ সাজার ছবি ভেসে উঠছে আবার কখনো আরশীর বউ সাজার ছবি ভেসে উঠছে। ফিরোজের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে, সে একবার চোখের পানি মুছে একটা শুষ্ক হাসির ব্যর্থ চেষ্টা করে আপন মনে বলল, আরশী এতদিন পর বউ সাজবে কেন? হয়ত আরশীর নূর-এর সঙ্গে বিয়ে হয়েছে, আরশী ছেলে-মেয়ের মা হয়েছে। আসলে আমি সারাজীবন অনেকের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করলাম, আমার জন্য কেউ কিছু করল না। সবাই নিজ নিজ গন্তব্যে চলে গেল। আর আমি বসে বসে মৃত্যুর অপেক্ষায় দিন গুণছি।
ফিরোজের কানের মধ্যে যেন মোবাইলের রিং বেজে উঠল, যেন খুব পরিচিত রিং-টোন, সে আরশীর মোবাইল নাম্বারটির রিং টোন এটা সেভ করে রেখেছিল। সে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে দেখল, না কেউ রিং করেনি তো।
সে আবার ঘুমানোর চেষ্টা করল কিন্তু ঘুম আসছে না, একবার ঘড়ির দিকে তাকাল রাত এগারোটা বাজে। সে বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় পায়চারি করতে লাগল। রিমার বিয়ের আগে সে কোনদিন বারান্দায় পায়চারি করলে রিমার মোবাইলে কথা বলা শব্দ ভেসে আসতো। এই তো ক'দিন আগে একদিন ফিরোজ বারান্দায় পায়চারি করছিল এমন সময় তার কানে ভেসে এলো রিমার কণ্ঠস্বর।
সে আপন মনে হাসল, রিমা হয়ত ইমনের সঙ্গে কথা বলছে। সে কিছুটা সঙ্কোচ বোধ করল, রিমা যদি দেখে ফেলে তবে হয়ত মনে করবে আমি বাবা হয়ে মেয়ের তার হবো স্বামীর সঙ্গে কথা বলা শুনছি।
ফিরোজ তার রুমে ঢুকল। দরজা বন্ধ করার সময় একটু শব্দ হলো।
সে রুমে ঢোকার কিছুক্ষণ পর রিমা তার রুমে ঢুকল, বাবা তুমি ঘুমাওনি?
হ্যাঁ ঘুমিয়েছিলাম।
ঘুম ভেঙ্গে গেছে?
হ্যাঁ।
কেন এমন হলো? আজ তো ঘুমের ঔষধ খেয়েছ?
হ্যাঁ তুই তো ঔষধ খাইয়েছিস?
রিমা তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, বাবা তোমার চোখ লাল কেন? চোখে পানির ছাপ মনে হয় কেঁদেছো?
ফিরোজ ধমকের সুরে বলল, হ্যাঁ আমি কেঁদেছি?
রিমা পাল্টা ধমক দিল, বাবা তুমি কিন্তু আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছ?
ফিরোজ কিছু বলেনি।
রিমা কান্নাজড়িত কন্ঠে বলল, বাবা ক'দিন থেকে দেখছি তুমি কিছু খেতে পারছ না, খেতে বসলে মনে হয় তোমার মুখে খাবার যাচ্ছে না। মনে হয় তোমার মুখে রুচি নেই, ইচ্ছার বিরুদ্ধে খাচ্ছ? বাবা তোমার কি অসুখটা বেড়েছে?
না রে মা তুই অযথা চিন্তা করছিস?
বাবা তুমি ভেঙ্গে পড়লে আমি কী করবো?
ফিরোজের চোখ থেকে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল, রিমা সব কান্না কষ্টের না, তোকে বিয়ে দেওয়ার জন্য যদি আমি কাঁদি তবে সে কান্না আনন্দের আর যদি হাসি তবে সে হাসি বেদনার।
রিমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল, বাবা তুমি এমন হয়ে যাচ্ছ কেন? আমি কি আমার চিরচেনা বাবাকে চিনতে ভুল করছি?
ফিরোজ রিমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, তুই যা মা ঘুমা।
তুমি ঘুমাবে?
হ্যাঁ।
রিমা একটা ঘুমের ঔষধ বের করে তার বাবার হাতে দিয়ে বলল, নাও এটা খাও।
একটা ঘুমের ঔষধ তো খেয়েছি।
আরো একটা খাও।
না আর খেতে হবে না।
রিমা শাসনের সুরে বলল, খাও, আমি বলছি খাও।
খাবো?
হ্যাঁ।
ফিরোজ ঔষধ খেল।
রিমা বলল, এখন লাইট অফ করে বিছানায় শুয়ে থাকো, ঘুমানোর চেষ্টা করো।
আচ্ছা।
আজ ফিরোজ বিছানায় শুয়ে আলো নিভিয়ে আবার ঘুমাবার চেষ্টা করেছিল কিছুক্ষণের মধ্যে তার সমস্ত শরীর ধীরে ধীরে শিথিল হয়ে এলো। তার চোখের সামনে প্রমীর প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠল।
ফিরোজ জিজ্ঞেস করল, তুমি?
হ্যাঁ আমি, কয়েকদিন থেকে তোমার সঙ্গে কথা হচ্ছে না তাই আজ কথা বলতে এলাম।
বলো।
খুব চিন্তা করছ না?
না কীসের চিন্তা করবো?
আমার কাছে কিন্তু তুমি কোনদিন কিছু লুকাওনি।
আজও লুকাচ্ছি না।
তুমি কিন্তু আমাকে কোনদিন মিথ্যা কথা বলোনি?
আজও বলছি না।
বলছ, তুমি আরশীকে খুব মিস করছ?
তুমি কীভাবে জানলে?
আমি কীভাবে জানলাম মানে? আমি তো বেঁচে থাকতেও তোমার মনের সব কথা বলতে পারতাম, তুমিও আমার মুখ দেখে সবকিছু বুঝতে পারতে। আসলে পরষ্পরের মধ্যে প্রকৃত ভালোবাসা থাকলে শুধু দু'জনের দেহ দু'টোই আলাদা থাকে আত্মা যেন এক হয়ে যায়। তাই একজনের মনের খবর জানা আরেকজনের জন্য কঠিন হয় না।
হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ।
তোমার নিজেকে খুব নিঃসঙ্গ মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ।
কখনো নিঃসঙ্গ মনে করবে না, আমি তোমার পাশে আছি না?
প্রমী?
হ্যাঁ তুমি তো আমার কাছে চলে আসছ।
তোমার কাছে চলে আসছি মানে?
তুমি আমার কাছে এসো আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করছি।
কিন্তু তুমি তো মরে গেছ?
হ্যাঁ তাই তো তোমাকে ডাকছি, বলে প্রমী হারিয়ে গেল।
ফিরোজ চমকে উঠল, প্রমী, প্রমী।
ফিরোজের শরীর ভয়ে ছম ছম করে উঠল। সে কোনদিন ভুত-প্রেত এসব বিশ্বাস করেনি কিন্তু আজ যেন তার মনে হলো এই মাত্র প্রমী তার কাছ থেকে চলে গেল। সেই সাদা ধবধবে শাড়ি, পিঠে ছড়ানো চুলগুলো বাতাসে দোল খাচ্ছে। ফিরোজ একবার ওপরের দিকে তাকাল, ফ্যান চলার শব্দ নেই কিন্তু ঘরের মধ্যে যেন প্রচণ্ড গতিতে বাতাস বইছে, এখনো তার চোখের সামনে প্রমী দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে ফিরোজের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, সে খাটের স্ট্যান্ডের সঙ্গে ঝুলানো সুইচটা চালু করার চেষ্টা করতেই আর হাত বাড়াতে পারল না। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে আসছে। সে মনে মনে কয়েকবার দোয়া পাঠ করল, লা ইলাহা ইল্লা আন্তা সুবহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজ যোয়ালেমিন।
ধীরে ধীরে যেন তার হাত দু'টো একটু সচল হলো। সে হাত বাড়িয়ে সুইচটা চালু করে বিছানায় অনেকক্ষণ শুয়ে রইল। তারপর আবার ঘড়ির দিকে তাকাল, এত রাতে কি ডাঃ হায়দারকে মোবাইল করা ঠিক হবে?
সে বিছানায় শুয়ে রইল, অসুস্থতা আরো বেড়ে গেল। সে ডাক্তারকে মোবাইল করল, হ্যালো হায়দার।
হ্যাঁ ফিরোজ বল এখন কেমন আছিস?
ফিরোজ হাঁপাতে হাঁপাতে তার অসুস্থতার বিবরণ দিয়ে বলল, হায়দার আমার খুব খারাপ লাগছে, আমার মনে হয় আমার সময় শেষ হয়ে আসছে।
ফিরোজ তোর বাসায় আর কে কে আছে?
কেউ নেই।
বাসায় তুই একা?
হ্যাঁ।
তোর মেয়েকে খবর দে, কাছের আত্মীয়-স্বজনদেরখবর দে, তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আয়।
রিমাকে মোবাইল করবো? সদ্য বিবাহিত মেয়েকে এত রাতে বিরক্ত করবো?
ফিরোজ আমি এজ এ ডক্টর বলছি, তুই তাড়াতাড়ি ঢাকায় চলে আয় নাহলে সিচ্যূয়েশন কন্ট্রলের বাইরে চলে যেতে পারে, প্লিজ ফিরোজ এখন এসব ভাববার সময় না।
আচ্ছা ঠিক আছে, বলে ফিরোজ মোবাইলের লাইন কেটে দিয়ে ডাক্তারের কথা মতো সবাইকে মোবাইল করতে শুরু করল।
তেইশ
রিমা তার বাবার শয্যাপাশে বসে মাঝে মাঝে দু'একটা করে কথা বলছে। ফিরোজ কখনো জবাব দিচ্ছে আবার কখনো ফ্যালফ্যাল করে রিমার মুখের দিকে তাকাচ্ছে।
একবার ফিরোজ রিমার মুখের দিকে তাকাতেই সে জিজ্ঞেস করল, বাবা এখন একটু ভালো লাগছে?
হুঁ।
আচ্ছা বাবা তোমার অসুখটা আসলে কী?
রিমা আমি কি ডাক্তার যে আমি আমার অসুখ জানি?
বাবা ডাক্তার তোমার বন্ধু, তিনি নিশ্চয়ই তোমাকে বলেছেন?
ফিরোজ কিছু বলল না।
কিছুক্ষণ পর ডাঃ হায়দার এলেন। তিনি ফিরোজের পাল্স, প্রেসার, চোখের পাতা দেখে বললেন, না তেমন কিছু হয়নি, ফিরোজ তুই কোন চিন্তা করিস না, সেরে উঠবি ইনশাআল্লাহ।
তুই তো ডাক্তার তুই তো বলবি সেরে উঠব কিন্তু আমি রোগী আমি বুঝতে পাচ্ছি আমার সময় শেষ হয়ে এসেছে।
আমরা ডাক্তার, আমরা পেশেন্টের চিকিৎসা করতে পারি, রোগ সারানোর চেষ্টা করতে পারি, রোগীকে বাঁচিয়ে রাখার গ্যারান্টি দিতে পারি না। তাই যদি পারতাম তবে তো নিজের মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিৎ হতে পারতাম। তবে তোর অসুখটা এখনো আমাদের নিয়ন্ত্রণে আশা করি তুই সেরে উঠবি। শুধু একজন ডাক্তার না আমি তোর বন্ধু আমি যেখানে সাধ্যমতো চেষ্টা করছি তখন তো তোর নিরাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। আল্লাহ্র ওপর ভরসা রাখ। সিস্টার আপনি একটু খেয়াল রাখুন, মা তুমি আমার সঙ্গে এসো।
রিমা ডাক্তার হায়দারের সঙ্গে গেলেন।
হায়দার সাহেব তার এপ্রোন চেয়ারের পিছনে ঝুলিয়ে রেখে বসতে বসতে বললেন, মা তোমার সঙ্গে আর কেউ আসেনি?
আঙ্কল আমার এক চাচা আর আপনাদের জামাই এসেছে।
তুমি তোমার চাচাকে আসতে বলো।
রিমা মোবাইলে তার লাবলু চাচাকে আসতে বলল।
লাবলু হায়দার সাহেবকে সালাম দিয়ে ভিতরে ঢুকল।
হায়দার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তুমি ফিরোজের ভাই?
জি।
কয়েকটা টেস্ট করতে হবে, আমি লিখে দিচ্ছি তোমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টেস্টের রিপোর্ট নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করো।
রিমা রুদ্ধ কন্ঠে জিজ্ঞেস করল, আঙ্কল বাবা কি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে পারবে?
একথা তো বলতে পারছি না মা, তোমরা টেস্টগুলো করে আমাকে দেখাও তারপর দেখা যাবে তবে আমার মনে হচ্ছে পেশেন্টের অবস্থা ভালো না।
আঙ্কল বাবার অসুখটা কি অনেকদিনের? মানে আমি বলছিলাম বাবা কি আগে থেকে জানতো?
হায়দার সাহেব মাথা নেড়ে সায় দিলেন।
তারপরও বাবা আমাকে বলেনি?
তোমাকে বলে কি লাভ হতো?
রিমার বুক কেঁপে উঠল, সে মনে মনে বলল, আমাকে বলে লাভ হতো না, মানে বাবাও জানতো তার যে অসুখ হয়েছে সে রোগের পরিণতি নিশ্চিৎ মৃত্যু।
হায়দার সাহেব চেয়ার থেকে উঠলেন, তোমরা তাহলে টেস্টের রিপোর্ট না পাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করো, রিমা তুমি সবসময় তোমার বাবার সঙ্গে থাকো, আর হ্যাঁ তোমার বাবার কিন্তু কোন কিছু খেতে নিষেধ নেই, কিছু খেতে চাইলে লাবলু বা জামাইকে দিয়ে এনে দিও।
রিমা জোরে কেঁদে উঠল, বাবা যা খেতে চাইবে তাই খেতে দিব? তারমানে বাবা আর বাঁচবে না?
বাঁচবে না তো বলিনি।
প্লিজ আঙ্কল আমাকে বলুন বাবার আসলে অসুখটা কী?
তোমার বাবা প্রথমে হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিল তারপর লিভার ক্যান্সার।
রিমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
হায়দার সাহেব ফিরোজের অসুখের কথা বলে, রিমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি তোমার বাবার কাছে যাও মা।
হায়দার সাহেব বেরিয়ে গেলেন।
রিমা মুখে রুমাল চেপে তার বাবার কেবিনে গিয়ে ঢুকল।
ফিরোজ যেন খুব স্বাভাবিকভাবে বলল, মা তোর কী হয়েছে? কাঁদছিস কেন?
তোমার জীবনের জন্য এমন একটা দুঃসবাদ, তোমার জীবন-মরণের বিষয় আমার কাছে লুকালে কেন বাবা?
ফিরোজ সাহেব বুঝতে পারল রিমা সবকিছু জানতে পেরেছে। সে জিজ্ঞেস করল, এই রিমা কী হয়েছে? হায়দার কি তোকে কিছু বলেছে? আসুক আগে, আমার মেয়ের মন খারাপ হয় এমন কথা বলবে আর আমি ওকে ছেড়ে দিব, না?
বাবা অনেকদিন লুকিয়েছ, আসলে নিজের মৃত্যুর কথা জেনে তুমি পৃথিবীর সবকিছু খুব সহজভাবে করতে পারলে? বাবা তুমি বলতে মেয়েদের আগে শিক্ষিত, স্বাবলম্বী হওয়া দরকার যাতে তারা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে পারে কিন্তু হঠাৎ করে কেন তুমি আমার লেখাপড়া বাদ দিয়ে আমাকে বিয়ে দিলে আমি এখন বুঝতে পাচ্ছি। বাবা একজন মানুষ নিজের নিশ্চিৎ মৃত্যুর কথা জেনেও মানুষের মঙ্গলের কথা এভাবে ভাবতে পারে? মানুষ বিদেশ যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়, পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেয়, এভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর জন্য কেউ প্রস্তুতি নেয় এটা মনে হয় তুমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ কোনদিন করেনি? বাবা তুমি সারাজীবন শুধু মানুষের কথা ভাবলে একবারও নিজের কথা ভাবলে না।
ফিরোজের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ল, রিমা শুধু তুই বলবি, আমাকে কিছু বলতে দিবি না? আমার চেয়ে তুই বেশিদিন কথা বলার সুযোগ পাবি আমি তো আর বেশিদিন কথা বলার সুযোগ পাবো না, আমাকে কিছু বলার সুযোগ দে।
রিমা চোখ মুছল।
ফিরোজ বলতে শুরু করল, রিমা তুই ঠিকই বলছিস, আসলে আমি আগে থেকেই জানতাম তাই মৃত্যুর প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, আমার সব প্রস্তুতি শেষ হয়েছে, চাকরি থেকে রিজাইন্ড করার সময় আমি যে টাকা পেয়েছি, পৈত্রিক সূত্রে আমি যা জমি-জমা পেয়েছি সব আমি তোর নামে রেজিস্ট্রি করে দিয়েছি, তোর পছন্দের ছেলের সঙ্গে তোকে বিয়ে দিয়েছি, তুই জীবনে খুব সুখী হবি মা তবে কয়েকটা কথা মনে রাখবি, জীবনে সেক্রিফাইজ করবি বেশি, কারো কাছ থেকে আশা করবি কম, সবসময় নিজের অবস্থানের জন্য আল্লাহ্র কাছে শুকরিয়া আদায় করবি।
রিমা বলল, বাবা তোমার কি খুব কষ্ট হচ্ছে?
ফিরোজ সাহেব প্রসঙ্গ পাল্টালো, মা তুই একবার ইমনকে ডেকে দিবি আমি একবার কথা বলতাম।
রিমা মোবাইল করল।
কয়েকমিনিট পর ইমন এলো।
ফিরোজ হাতের ইশারায় ইমনকে বসতে বলল।
ইমন বসল।
ইমন তুমি তো জানো রিমা আমার খুব আদরের মেয়ে, ওর জন্মের দিনই ওর মা মারা যায়, সেদিন থেকে আমি ওর বাবা-মা দু'জনেরই দায়িত্ব পালন করেছি। আমি কোনদিন ওর গায়ে ফুলের আঁচড় লাগতে দিইনি, সেজন্য ও খুব জেদি আর অভিমানী হয়েছে তুমি ওর দিকে খেয়াল রেখো বাবা, বলতে বলতে ফিরোজের কণ্ঠস্বররুদ্ধ হয়ে এলো, সে আরো কথা বলার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না।
রিমা ফিরোজের বুকের ওপর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল।
চব্বিশ
ট্রেন ছুটে চলছে দ্রুতগতিতে। তবুও পথের শেষ নেই। সময়ের পরিমাপ যেন আজ আরশীর কাছে বেশ গড়মিল মনে হচ্ছে। সে-ই সকালবেলা সে একতা এক্সপ্রেসে উঠেছে কখন পৌঁছাবে সে নিজেই জানে না। আরশী জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে, দ্রুতগতিতে সবুজ মাঠ যেন স্মৃতির মতো হারিয়ে যাচ্ছে কোন দাগ ছাড়াই। আরশী কত মাঠ, কত নদী পেরিয়ে এসেছে তার মনে নেই, সে বার বার করে ঘড়ি দেখছে আর তার মুখ কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। ঢাকা থেকে এতদূর পর্যন্ত আসতে কী কী দেখেছে সে মনে করার চেষ্টা করছে। না তার অনেক কিছুই মনে নেই। অথচ ফিরোজের সঙ্গে তার হৃদ্যতা, তার দু'য়েকটা কথাবার্তা যেন আজও ষ্পষ্ট মনে আছে, আরশী আপন মনে একবার হাসল, জীবনের বেদনাময় দিনগুলি যদি এত দ্রুতগতিতে স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেত তবে খুব ভালো হতো।
ছাত্র জীবনে কোন লেখাপড়া করতে গিয়ে আরশী অনেক সময় বিরক্ত হতো, কোন কিছু লেখাপড়া শিখে স্মৃতিতে ধরে রাখা খুব কঠিন বলে মনে হতো। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে শেখার চেয়ে ভুলে যাওয়া আরো বেশি কঠিন। সে আবার ঘড়ির দিকে তাকাল।
ট্রেন থামল। আরশী একবার প্লাটফরমের দিকে তাকাল, জয়পুরহাট রেল স্টেশন। আরশীর জন্মস্থান জয়পুরহাট, ট্রেন দিনাজপুর পৌঁছাতে আরো প্রায় তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। অন্য সময় হলে সে আজ রাতে জয়পুরপাট থেকে যেত আজ একথা তার একবারও মনে হলো না। তার দেহটা যেন এখনো ট্রেন-এ আছে আর মনটা চলে গেছে দিনাজপুর। সে ভাবতে লাগল ফিরোজের সঙ্গে যে দুর্ব্যবহার করেছে তার কাছে আবার কীভাবে দাঁড়াবে? প্রথম কী কথা বলবে? তার মধ্যে একটা অপরাধবোধ কাজ করছে, আবার মনে হলো ফিরোজ বড় মনের মানুষ, নিশ্চয়ই সবকিছু তাকে মাফ করে দিবে।
আর ফিরোজ যদি জিজ্ঞেস করে তুমি আমার কাছে আবার এসেছ কেন? তুমি এবং তোমার আত্মীয়-স্বজনতো আমাকে জিম্মী করে আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করলে। নূরকে বিয়ে করার জন্য আমাকে অপমান করলে, তারপরও তো আমি তোমাকে কিছু বলিনি সবকিছু মাফ করে দিয়েছি। আত্মসম্মান রক্ষার জন্য নিজেই চলে এসেছি তারপরও কারো কাছে সম্মানের সাথে কথা বলতে পারিনি। শেষ পর্যন্ত নিজেকে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ থেকে আলাদা রাখার জন্য চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। তুমি কী চাও আমার কাছ থেকে? আবার টাকা লাগবে নাকি?
ছিঃ আরশীর নিজের কাছে নিজেকে খুব অপরাধী বলে মনে হচ্ছে. সে আপন মনে বলল, তুমি বিশ্বাস করো ফিরোজ আমি তোমাকে অপমান করতে চাইনি, আসলে নূর আমাকে তোমার কাছ থেকে আলাদা করেছে, তখন আমার বয়স কম ছিল, আবেগটা একটু বেশি ছিল, আমি তখন সহজ-সরল ছিলাম আর নূর আমার সরলতার সুযোগে, আমাকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। যে সম্পদ আমি নিজেই তোমাকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিলাম তুমি তা ফিরিয়ে দিয়েছিলে সে সম্পদ সে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে নিঃস্ব করেছে। সরি ফিরোজ আমার ভুল হয়েছে, তুমি আমাকে মাফ করে দাও।
আমি তোমাকে জিম্মী করে টাকা আদায় করতে চাইনি। কিন্তু তোমার সঙ্গে গল্প করার সময় আমাকে আলাদা করে তোমাকে অপমান করবে, তোমার কাছ থেকে টাকা আদায় করবে একথা আমি একবিন্দুও বুঝতে পারিনি। তারা আমাকে তোমার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে আমাকে একটা রুমে আটকিয়ে রেখেছিল যেন আমি সবার সামনে গিয়ে তোমাকে অপমান করার প্রতিবাদ করতে না পারি। আমি জানি তুমি এসব কিছু বিশ্বাস করবে না, শুধু তুমি কেন কেউ একথা বিশ্বাস করতো না।
আমি তোমার কাছে বিশ্বাস-অবিশ্বাস, বিনয়ী-প্রতারণা এসব নিয়ে তর্ক করতে আসিনি। আমি জানি আমার যে কোন উন্নতিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আনন্দিত হবে তুমি, গর্বিত হবে তুমি, তাই আমি তোমার কাছে এসেছি। আমি তোমাকে আমার প্রমোশনের খবর দিব, তোমার কাছে মাফ চাইবো তোমার কাছে সারাজীবন থাকতে চাইবো তারপর তুমি যা চাইবে তা-ই হবে। তুমি যদি মাফ করে দাও আমি খুব খুশি হবো, তুমি যদি কুকুরের মতো তাড়িয়ে দাও তবে বুঝবো সেটা আমার পাওনা ছিল।
কিন্তু আমি জানি তুমি এত শক্ত হৃদয়ের মানুষ না, তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না। আমি তোমাকে চিনি না? তোমাকে আমার চেয়ে বেশি কেউ চিনতে পেরেছে? আমার সঙ্গে কথা বলতে না পেরে, আমার সঙ্গে দেখা করতে না পেরে তুমি এতদিন কেমন আছ আমি সব সময় অনুভব করি। আমার চোখের পানি তুমি কোনদিন দেখতে পারবে না। আরশী চোখ মুছল। চোখের এই পানি যেন আনন্দের।
আরশী ট্রেন থেকে থামল। আরশী ট্রেন থেকে নেমে প্লাটফরম দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে স্টেশন থেকে বের হলো। তারপর একটা রিক্সায় উঠল।
কোথায় যাবে সে এখন? ঢাকায় থাকতে জেসমিনকে জিজ্ঞেস করেছিল, দিনাজপুরে তাদের কোন বেসম্যাট আছে কি না?
আরশী নিজেও মনে মনে খুঁজেছে তেমন কাউকে তার মনে পড়েনি। অবশ্য জেসমিন বলেছিল, পুলিশ লাইনে গিয়ে পরিচয় দিলে তোর থাকার অসুবিধা হবে না।
কিন্তু আরশী পুলিশ লাইনে গেল না। হঠাৎ করে দিনাজপুর আসায় সবাই তাকে নানান প্রশ্ন করবে, সে অনেকটা বিব্রতকর অবস্থায় পড়বে। আরশী পুলিশ লাইনে গেল না।
রিক্সাওয়ালা জিজ্ঞেস করল, আপা কোথায় যাবেন?
একটা ভালো আবাসিক হোটেলে নিয়ে যাও।
রিক্সাওয়ালা একবার আরশীর দিকে তাকাল, তার পিছনে ফিরে তাকানোর মধ্যে যেন একটা সন্দেহের তীর। সে আবার রিক্সা চালাতে শুরু করল।
ততক্ষণে রিক্সা লিলির মোড়ে এসে পৌঁছেছে, রিক্সাওয়ালা পিছনে তাকাল, আপা আগে বলবেন তো, স্টেশন রোডে কয়েকটা হোটেল ছিল, আচ্ছা যাক মালদহপট্টিতে বেশ কয়েকটা হোটেল আছে।
ঠিক আছে তাহলে মালদহপট্টি নিয়ে চলো।
কয়েকমিনিটের মধ্যে রিক্সা মালদহপট্টি একটা হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালো।
আরশী সামনের দিকে তাকাল। সামনে আরো কয়েকটা হোটেল তার চোখে পড়ল।
সে রিক্সা থেকে নেমে সিঁড়ি বেয়ে হোটেলের রিসিপশনে গেল, একটা সিঙ্গেল সিট হবে?
হ্যাঁ হবে?
দিন।
কে থাকবে?
আমি।
আপনার সঙ্গে কোন ছেলে-মানুষ নেই?
না।
তাহলে তো সিট দেওয়া যাবে না।
কেন?
একা একজন মেয়ে মানুষ, কোন ঝামেলা হয় নাকি?
আরশী বিনয়ের সুরে বলল, দিন না প্লিজ, আমি কথা দিচ্ছি কোন ঝামেলা হবে না।
সরি আপা, আপনি অন্য কোন হোটেলে চেষ্টা করুন।
আরশী সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে একটা ক্লান্তির নিঃশ্বাস নিল। তারপর সামনে অন্য একটা হোটেলে গেল।
আবার সেই একই রকম প্রশ্ন, অবশেষে আরশী তার আই.ডি কার্ড বের করে দেখাল।
ম্যানেজার হাসতে হাসতে বলল, আপা আগে বলবেন তো?
না আসলে আমি পরিচয় দিতে চাইনি, বাধ্য হয়ে পরিচয় দিতে হলো।
সরি আপা আসলে পুলিশ ঝামেলা করে তো।
আরশী কিছু বলল না।
পরদিন সকালবেলা বিছানা থেকে উঠেই আরশী রিক্সা নিয়ে ফিরোজের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। কয়েকমিনিটের মধ্যে রিক্সা একটা মোড়ে এসে দাঁড়ালো। মোড়ে তিনটা রাস্তা তিন দিকে গেছে। আরশী অনেকটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ল, এখন কোন দিকে যাবে?
আরশী সকালবেলা হোটেল ম্যানেজারকে জিজ্ঞেস করে জানতে পেরেছে, ফিরোজ সাহেবের বাড়ি এই মোড়েরই আশে-পাশে। সে রিক্সা ছেড়ে দিল।
তখনো মোড়ের দোকানগুলো খুলেনি। আরশী কাউকে জিজ্ঞেস করার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলো। একজন বযস্ক ভদ্র লোক আসছে, আরশী তাঁকে জিজ্ঞেস করার জন্য সামনে এগিয়ে গিয়ে সালাম দিল, আস্সালামুয়ালায়কুম।
ওয়ালেকুম আসসালাম।
আচ্ছা আঙ্কল এখানে ফিরোজ সাহেবের বাড়িটা কোন দিকে?
ভদ্রলোক থমকে দাঁড়ালেন।
আঙ্কল ফিরোজ সাহেবের বাড়িটা কোন দিকে প্লিজ যদি বলতেন?
তিনি অদুরে আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে বললেন, ফিরোজের বাড়িটা তো ঐদিকে কিন্তু ও তো-
কী হয়েছে আঙ্কল?
তোমার নাম কী মা?
আরশী।
ও তোমার কে হয়?
আরশী আবেগপ্রবণ হয়ে গেল, তার দু'চোখ পানিতে ভরে গেল। কী জবাব দিবে সে? সে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল।
ভদ্রলোক আরশীর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
আরশীও চুপ করে রইল।
ভদ্রলোক জিজ্ঞেস করলেন, চুপ করে আছ কেন মা?
আঙ্কল ফিরোজ সাহেব আমার পরম শ্রদ্ধেয় একজন মানুষ, তার এক মেয়ে আছে নাম রিমা তিনি আমাকে রিমার মতো স্নেহ করেন।
ভদ্র লোক চুপ করে রইলেন, তার দু'চোখ ছল ছল করে উঠল, আরশীর দৃষ্টি এড়াল না। আরশীর বুক কেঁপে উঠল, সে আরো উত্তেজিত হয়ে বলল, কেন বলছেন না আঙ্কল? প্লিজ তাড়াতাড়ি বলুন, ফিরোজ সাহেব আমার গার্জিয়ানের মতো, বন্ধুর মতো, তিনিই আমার সব।
ভদ্র লোক অশ্রুসিক্ত কন্ঠে বললেন, তাহলে তো তুমি সব হারিয়েছ মা।
সমাপ্ত