প্রিয় পাঠক লক্ষ্য করুন

Friday, November 25, 2011

মুসলমানদের হাতেই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছে || হাসান শান্তনু

উনিশ শতকের নবজাগরণে বাঙালি মুসলমানের অংশগ্রহণ অনেকটা বিলম্বিত ও বিঘ্নিত হলেও বিশ শতকের প্রথম তিন দশকে অতি দ্রুত তারা এ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে সমর্থ হন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও রুশ বিপ্লবের রক্তিম অভিজ্ঞতার ছোঁয়া তাদের নবজাগরণের তারুণ্যদীপ্ত উদ্দীপনার সঙ্গে সাম্যবাদী রাজনীতির গণমুখী চেতনা যুক্ত করে দেয়। অধঃপতন থেকে উত্তরণের জন্য উনিশ শতকের শেষ চতুর্থাংশে শুরু হয় নানা কর্মপ্রচেষ্টা। মুক্তির উপায় হিসেবে যেসব পথ তখন বিবেচিত হয়, মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্যচর্চা সেগুলোর মধ্যে অন্যতম। ওই সময়ে গুরুত্ব দেয়া হয় মুসলমানের ধর্মজীবন, তার ধর্মতত্ত্ব, ইতিহাস, ঐতিহ্য, বীরত্বগাথা ইত্যাদি চর্চার ওপর।
বিষয়টি ব্যাখ্যার জন্য ইতিহাসবিদ নারায়ণ দত্তের আলোচিত একটি উক্তি ধার করা যায়। তিনি বলে গেছেন, ‘জন্মের সেই পরম লগ্নেই কলকাতার অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির মানুষ এক অসুস্থ খেলায় মেতেছিল। তাতে স্বার্থবুদ্ধিই একমাত্র বুদ্ধি, দুর্নীতিই একমাত্র নীতি, ষড়যন্ত্রের চাপা ফিসফিসানিই একমাত্র আলাপের ভাষা।’ মুসলমানদের আত্মপ্রতিষ্ঠা তাই সেই সময়ে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। চিন্তাশীল ব্যক্তিরা অনুধাবন করেন আত্মজাগরণ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য সংঘ-সমিতি প্রতিষ্ঠা আর পত্রিকা, বই প্রকাশের কথা। তারাই মূলত কলকাতাকেন্দ্রিক বাংলা সাহিত্য ও মুসলমানদের অবমাননাকর অবস্থা থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে উদ্ধার করেন। পূর্ববাংলার প্রকৃতি ও জীবন তাদের সাহিত্যে আপন হয়ে ওঠার ফলে আধুনিক বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলমানদের চেহারা ফুটে উঠতে শুরু করে। যা কলকাতার হিন্দু সাহিত্যিকরা পারেননি। মুসলমান লেখকদের আবির্ভাবের মধ্য দিয়েই মূলত বাংলা সাহিত্যের চেহারাটা পুরোপুরি বদলে যায়। সাহিত্যের প্রকৃত রূপটিও তখন নির্মিত হয়। আজ স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা বাংলা সাহিত্যের রাজধানী হয়ে ওঠার পেছনে অবদান ওই লেখকদেরই। মুসলমানদের অবদানের ফলেই পূর্ব বাংলা, পরে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্য বিকশিত হয়।
অতীতে ত্রয়োদশ শতক থেকে মুসলমান সুলতানগণ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে আসছেন। ওই সময় আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র আমলে নতুনভাবে বাংলা ভাষার চর্চা শুরু হয়। এক সময় বাংলা ভাষাকে বলা হতো ‘পক্ষী ভাষা’ অর্থাত্ পাখিদের ভাষা। কথাটি অবজ্ঞা ভরে বলতেন বর্ণহিন্দুরা। এই ভাষা সম্পর্কে একটি সংস্কৃত শ্লোকে বলা হয়েছে— অষ্টাদশ পুরাণানী রামস্যচরিতানিচ/ভাষায়ং শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেত্। অর্থত্ এই ভাষায় অষ্টাদশ পুরাণ ও রামায়ন যারা পাঠ করবেন তারা রৌরব নরকে জ্বলবেন। এ অবস্থা থেকে বাংলা ভাষাকে উদ্ধার করেন মুসলমান সুলতানগণ।
মুসলমান লেখকরা কলকাতায় ও ঢাকায় কিছু কিছু সংগঠন গড়ে তোলেন। অবশ্য যথার্থ ও শক্তিশালী সাহিত্য সংগঠনের জন্য বাঙালি মুসলমানদের অপেক্ষা করতে হয় বেশ কয়েক বছর। ১৯১১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয় বাঙালি মুসলমানের প্রথম উল্লেখযোগ্য সাহিত্য প্রতিষ্ঠান ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতি’।
বাঙালি মুসলিম সমাজে এ সমিতির ভূমিকার মূল্যায়ন করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার এএফ রহমান ১৯৪৩ সালের মে মাসে কলকাতার ইসলামিয়া কলেজে অনুষ্ঠিত সমিতির শেষ সাহিত্য-সম্মেলনে বলেন, ‘নবীন মুসলমান সাহিত্যিকদের উত্সাহ দেয়ার জন্য, তাঁদের রচিত জিনিসগুলো জনসাধারণের সম্মুখে ফুটিয়ে তোলার জন্য মুসলিম সাহিত্য সমিতির প্রয়োজন হয়। এই সমিতি অনেকটা সফলতা লাভ করেছে। নবীন সাহিত্যিকরা আজ বঙ্গসাহিত্যে উচ্চ স্থান অধিকার করে সমাজের মুখোজ্জ্বল করেছেন, সেটা এই সমিতির অক্লান্ত পরিশ্রম, চেষ্টা ও একনিষ্ঠ সেবার ফল। যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই সমিতির গঠন, তা সফল হয়েছে। এর অক্লান্ত কর্মীদের কাছে আমাদের সমাজের ও বঙ্গ-সাহিত্যের ঋণ অপূরণীয়’।
কয়েকজন মুসলিম তরুণের প্রবল উত্সাহে প্রতিষ্ঠিত হয় ওই সাহিত্য-সমিতি। এর অন্তত ১৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গেও মুসলমান লেখকদের কেউ কেউ যুক্ত ছিলেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতে, ‘মুসলমান সাহিত্যিকদের সেখানে দারিদ্র্যের দরুন বড় লোকের ঘরে গরিব আত্মীয়ের মতন মন-মরা হয়ে যোগদান করতে হতো।’
নবীন লেখকদের সংগঠিত করে উত্সাহ-উদ্দীপনা জোগানো আর সাহিত্যের মাধ্যমে মুসলমান সমাজ-জীবনের বিভিন্ন দিকের প্রতিফলন ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করে যাওয়া তাই ঐতিহাসিক কারণে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেজন্য দরকার ছিল নিজেদের একটি সংগঠন।
ওই সাহিত্য সমিতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আবদুল করিম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, কাজী নজরুল ইসলাম, কবি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক, কাজী ইমদাদুল হক, কমরেড মুজাফফর আহমদ, কাজী আবদুল ওদুদ, প্রকাশক আফজাল উল হক, এয়াকুব আলী চৌধুরী, গোলাম মোস্তফা, হবিবুল্লাহ বাহার, আইনুল হক খান, আবুল মনসুর আহমদসহ আরও অনেকে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ইংরেজ শাসনের সমকালে বাংলায় হিন্দুর চেয়ে মুসলমানের সংখ্যা কম ছিল না। তবু কলকাতাশাসিত আধুনিক বাংলা সাহিত্যে তাদের জীবন আদৌ কোনো উপস্থিতি ছিল কিনা, এ প্রশ্নও রাখা যায়।
১৮৭০ সাল অব্দি মুসলমানরা সাহিত্যকর্মে হাত না দেয়া পর্যন্ত তাদের জীবনও সাহিত্যে ঠাঁই পায়নি। জসীম উদ্দীনের ‘কবর’ কবিতা লেখার আগে আধুনিক বাংলা সাহিত্যে কবর আর কায়কোবাদের ‘আজান’ কবিতা লেখার আগে আজান কোনোরকম বিশেষত্ব পায়নি। গুটিকয় কবি-সাহিত্যিকের আকস্মিক আবির্ভাব না হলে মুসলমান বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন আধুনিক বাংলা সাহিত্য পাঠকের মনে কোনো ধরনের আগ্রহেরই উদ্রেক করত না। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন— মীর মশাররফ হোসেন, কায়কোবাদ, বেগম রোকেয়া, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, দীনেশচন্দ্র সেন, কাজী নজরুল ইসলাম ও জসীম উদ্দীন।
বিষয়টি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণার জন্য ভারতের বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের মন্তব্য উল্লেখ করা যায়। তিনি ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান সমাজ ও চরিত্র’ শিরোনামে পিএইচডি থিসিস প্রণয়ন করেন। এতে তিনি রবীন্দ্র-সাহিত্যে মুসলিম সমাজ ও চরিত্র সম্পর্কে বলেন, ‘সমগ্র রবীন্দ্র-সাহিত্যে মুসলমান সমাজ-জীবন ও চরিত্র তুলনামূলকভাবে কম হলেও একথা স্বীকার করেত হবে, রবীন্দ্রনাথই ভারতবর্ষীয় তথা বাঙালি মুসলমান সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি সুবিচার করেছেন।’ মুসলমানরা যে কলকাতার সাহিত্যে উপেক্ষিত ছিল, তা ওই শিক্ষকের মন্তব্য থেকেও ফুটে ওঠে। কেননা, শরত্চন্দ্রকে লেখা চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ ‘স্বীকার’ করেন, মুসলমানদের ঘরের কথা তিনি তেমন জানেন না।
শুধু রবীন্দ্রনাথই নয়, মাইকেল মধুসূদন, ঈশ্বরচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল, মোহিতলাল, যতীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতিভূষণদের সাহিত্যেও মুসলমানরা উপেক্ষিত ছিলেন। অন্যদিকে মশাররফ, কায়কোবাদ, নজরুলসহ মুসলিম সমাজের অধিকাংশ কবি-সাহিত্যিকের কবিতা ও সাহিত্যে সেই অভেদ শিল্প-সংস্কৃতির রূপরেখা অকপটে ফুটে ওঠে। তারা মুসলমানদের প্রাণের কথাকে নিজেদের প্রাণের কথা হিসেবে যেমন গুরুত্ব দেন, হিন্দুর প্রাণের কথাকেও তাদের প্রাণের কথা হিসেবে তেমন গুরুত্ব দেন। হ
(তথ্যসূত্র : ড. মুনতাসীর মামুন, রফিকউল্লাহ খান, হাবীব রহমানের প্রবন্ধ)

No comments:

Post a Comment

নির্বাচিত বিষয়গুলো দেখুন

Labels

মাসের পঠিত শীর্ষ দশ

 

জোনাকী | অনলাইন লাইব্রেরী © ২০১১ || টেমপ্লেট তৈরি করেছেন জোনাকী টিম || ডিজাইন ও অনলাইন সম্পাদক জহির রহমান || জোনাকী সম্পর্কে পড়ুন || জোনাকীতে বেড়াতে আসার জন্য ধন্যবাদ