তুষার পড়া থেমেছে আজ দু’দিন হলো। রাস্তায় ইতিমধ্যে জমা বরফগুলো সবে গলতে শুরু করেছে। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে তুষারে ঢাকা মাঠ, রাস্তাঘাটের দিকে তাকিয়ে ক্যাথেরিন মেঘলা মলিন আবহাওয়া নিয়ে ভাবছিলো। আজ কি আবার তুষারপাত হবে? ওয়েদার ফোরকাষ্টে অবশ্য শুধু মেঘলা আকাশের কথা বলা আছে। নিতান্তই সাদামাটা মেঘলা আকাশ তার পছন্দ না, আকাশের স্থির মেঘগুলো কেমন যেন মন খারাপ করে দেয়। এর চেয়ে তুষার পড়াই ভালো। অবশ্য আজকের দিনটির কথা ভিন্ন। আজ ক্যাথেরিন মনে মনে চাইছে কোনভাবেই যেন তুষারপাত শুরু না হয়। কিছুক্ষনের মধ্যে তাকে বের হতে হবে। এখান থেকে প্রায় ৪০ মাইল দূরের একটা শহরে তার চাকুরী হয়েছে। আজকে তার জীবনে প্রথম অফিসে যাওয়া।
আজ আরো একটি কাজ সে প্রথমবারের মতো করতে যাচ্ছে। কিন্তু এই দ্বিতীয় কাজটির কথা সে তার বাবা-মা কে জানায়নি। অবশ্য জানানোর কথাও নয়। বাবা-মা’র সাথে গত কয়েকমাস ধরে তার সম্পর্ক শীতল। এখানে যতদিন থাকবে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। তাই সে ঠিক করেছে চাকরীস্থল ব্র্যাডফোর্ডেই সে বাসা নিয়ে থাকবে, সপ্তাহান্তে মা-বাবার সাথে দেখা করতে এখানে আসবে।
‘ক্যাথি, তুমি কি এখন নাস্তা করবে?’ নীচতলার সিঁড়ির কাছ থেকে ক্যাথি তার মায়ের ডাক শুনতে পেল।
‘হ্যাঁ, আমি আসছি মা’, ক্যাথি জবাব দিল।
কাপড় চোপড়, কাগজপত্র সব ব্যাগে গুছিয়ে রেডী করে রেখে ক্যাথি নাস্তা করার জন্য নীচে নামল।
‘ব্র্যাডফোর্ডে কি তোমার বাসা ঠিক হয়েছে?’ খাওয়ার টেবিলে বসে বাবা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ হয়েছে’, ক্যাথি জবাব দিল।
‘তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছো ক্যাথি। কাজেই নিজের ভালোমন্দ তুমি নিজেই বুঝতে পারো। কিন্তু আমি তোমাকে আগে যে কথাটি বলেছিলাম সেটা মনে রেখ। আরো কিছুদিন সময় নাও, তারপর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারো’।
ক্যাথি মাথানিচু করে বসে আছে। সে তার বাবার কথার উত্তরে কিছুই বলল না। মাথানিচু করে রাখলেও সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাবার পাশে বসা তার মা উত্তরের আশায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মা-ই প্রথম ক্যাথির ধর্মান্তরের বিষয়টি বুঝতে পারেন। মাসখানেক ধরে তিনি মেয়ের আচরনে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিলেন। ক্যাথি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম, সে তার আর দুই ভাইবোনের মতো নয়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লা করার বা উইক এন্ডে পার্টি দেয়ার, এলকোহল পান করার, কিংবা ধুমপান করার অভ্যাস ওর কখনোই ছিল না। তবে তিনি যখন খেয়াল করলেন সে পর্ক খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তখনই সেটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। তিনি খেয়াল করলেন মেয়ের পোশাক আশাকেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। টাইট-ফিট জামা ছেড়ে সে ফুলহাতা লুজ জামা কাপড় পড়ছে। কিন্তু সেটা সাধারনত ধর্মীয় পোশাক বলতে যা বুঝায় তা নয়। স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকতেও তাকে তিনি কখনো দেখেননি। তাই ধর্মান্তরের বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি মেয়েকে বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করেলন। মায়ের সুতীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসার সামনে ক্যাথি ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করতে পারলো না। কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে শেষে জানালো সে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি চিন্তা করছে। মা তাকে আর কিছু বলেননি।
সেই রাতে বাবা তার রুমে আসলেন। বাবা এর আগে কখনো তার রুমে আসেননি। ক্যাথি বুঝতে পারলো বাবা বিষয়টা খুব সিরিয়াসলী নিয়েছেন। সে কি বলবে সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিল। বাবা বললেন, ‘আমি বিষয়টি তোমার মা’র কাছে শুনেছি। যাহোক, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে তোমার বয়স এখনো অনেক কম। কাজেই আমি বলব সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরো কিছুদিন সময় নাও। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে। আমার বিশ্বাস তুমি ভুল কোন সিদ্ধান্ত নেবে না’।
ক্যাথি কোন কথা বলল না। অবশ্য বাবা সম্ভবত তার কাছে কোন উত্তর আশা করেননি। তিনি তার কথাগুলো বলেই গুডনাইট জানিয়ে চলে গেলেন। বাবা রুম থেকে চলে যাওয়ার পর ক্যাথি একটি স্বস্তির নিঃশাস ফেলল।বাবা-মা জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা নিয়ে সে চিন্তিত ছিল। খুব সহজভাবে তারা ব্যাপারটা মেনে নেবে সেটা সে আশা করেনি।
তবে সে যতটা ভেবেছিল পরিস্থিতি এর পরের কয়েকদিনে আরো কঠিন হয়ে উঠল। মা তার চলাফেরা, চালচলনের উপর সজাগ নজর রাখতেন লাগলেন, সুযোগ বুঝে তীর্যক কথাবার্তাও বলতে লাগলেন। যেমন একদিন সকালবেলা ক্যাথি লিভিংরুমে বসে টিভি দেখছিল। বাবা-মা দু’জনও ছিলেন। মা হঠাৎ করে সেদিনকার পত্রিকার একটা খবরে আফগানিস্তানের কোন এক গ্রামের সম্পূর্ণ বোরকা পরিহিতা দুই মহিলার ছবির দিকে ইংগিত করে বাবাকে বলতে লাগলেন, ‘এই হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত ক্যাথি’। আরেকদিন রাতে খাবার টেবিলে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাসতে হাসতে বললেন, ‘জানো তো ক্যাথি, তোমার ঐ নতুন ধর্মের মেয়েদের বিয়ের পর রাস্তায় হাঁটার সময় স্বামী থেকে কমপক্ষে তিনহাত পিছনে থাকতে হয়!’ ক্যাথি বুঝতে পারে এসব তীর্যক কথাবার্তার উত্তরে সে অনেক কিছু বলতে পারে, কিন্তু সে কিছুই বলে না। সে জানে এর উত্তর দেয়া মানে এগুলোকে আরো উস্কে দেয়া। সে বুঝতে পারছিলো এসব থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া। তাই সে কিছুদিন হন্যে হয়ে চাকরী খুঁজল।
সৌভাগ্যক্রমে সে অন্য একটি শহরে চাকুরী পেয়েছে। এখন অনায়াসে সে চাকুরীর কথা বলে এখান থেকে দূরে থাকতে পারবে। যদিও একা বাসা নিয়ে থাকা কিংবা চাকুরী করা কোনটাই তার পছন্দ নয়, তবুও বাব-মা’র সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক না পর্যন্ত সে এভাবেই থাকতে চায়। অন্তত, এখন নামাজ পড়ার সময় তাকে আর তটস্থ থাকতে হবে না যে কখন মা ঘরে এসে পড়ে, কিংবা নীচ থেকে ডাকাডাকি শুরু করে। প্রথম যেদিন সে নামাজ পড়ে সেদিন সে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল। নামাজের নিয়ম কানুন সদ্য শিখে সে সবে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, অমনি কি জন্য যেন মা তাকে নীচ তলা থেকে ডাকতে শুরু করলেন। তার সাড়া না পেয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলেন। তাদের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের এই বাড়িটির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে বড্ড শব্দ হয়। শব্দ শুনে ক্যাথি মনে মনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ভাগ্যিস তখনি নীচ তলার লিভিংরুম থেকে ফোনটা বেজে উঠল। মা ফোনে কথা শেষ করে যখন ক্যাথির রুমে আসলেন তখন দেখা গেলো সে ঘুমুচ্ছে; আসলে সে ঘুমোচ্ছিলো না।
তবে তার জন্য সবচেয়ে কৌতুহল আর আনন্দের সময় ছিল রমজান মাসটা। রমজান মাসে রোজা রাখার বিষয়টা সে শিখেছিল ছিল ইন্টারনেট থেকে। তার ধর্মান্তরের দেড় মাস পরেই ছিল রমজান মাস। রোজা রাখার বিষয়টি অবশ্য তার বাসার কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু সেই সময়টা সে উৎকন্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিল, মা কোন কারনে ডাকলেই মনের ভিতর একটা আশংকা ভর করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশংকাজনক কিছু হয়নি। না খেয়ে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে তার মধ্যে সামান্য ভয়ও ছিল, সে বুঝতে পারছিলো না এতোটা সময় সে না খেয়ে থাকতে পারবে কি-না। তবে এটা নিয়েও তার কোন সমস্যা হয়নি। বরং স্বেচ্ছায় সারাদিন না খেয়ে থাকার মধ্যে যে এমন পবিত্র অনুভূতি থাকতে পারে সে এটা আগে কল্পনাও করতে পারেনি। প্রথমদিন রোজা রাখার পর তার মনে মুক্তির যে অনুভূতি জেগে উঠল সেটা এর আগে সে কখনো অনুভব করেনি। তার মনে হয়েছে এখন সে নির্দ্ধিধায় তার নতুন ধর্মের কথা সবাইকে জানাতে পারে। যেন সে এতোদিনের সকল ভয়, সংকোচ, আড়ষ্টতার উর্দ্ধে চলে গেছে।
তবু সে তার সংকোচ পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। সে জানে তার জন্য মুখমন্ডল এবং হাতের কিছু অংশ ছাড়া আর কিছু জনসন্মুখে অনাবৃত রাখা বৈধ নয়। কিন্তু এই কাজটি সে করতে পারছে না। সে লং স্লিভ জামা পড়ে এখন, শুধু টাইটস পড়ে সে এখন আর বাইরে বের হয় না, যতটা মেনে চললে তার মা-বাবা বুঝতে পারবে না ততটা সে মেনে চলছে। বেশ কয়েকবার সে ভেবেছিল স্কার্ফ পড়া শুরু করবে। কিন্তু সেটা এমন একটা কাজ যেটা গোপনে বা সবার অলক্ষ্যে করা যায় না। সে কি করবে বুঝতে পারে না। এমন দ্বৈত আচরণ সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। একদিন মার্কেটে গিয়ে সে একটি স্কার্ফ কিনেও নিয়ে আসল। কিন্তু পরার সাহস পায়নি। সেটা তার হ্যান্ড ব্যাগের মধ্যেই পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে বের করে দেখে, কিন্তু পরা হয় না।
অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় সে স্কার্ফটি পরবে। যেদিন সে তার চাকুরী হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হলো সেদিনই সে ঠিক করে তার প্রথম অফিসে যাওয়ার দিন থেকেই সে স্কার্ফ পড়বে। এতো সহজ অথচ এতো কঠিন সিদ্ধান্তটি নেয়ার পরপর সে শিহরন অনুভব করে, সে বুঝতে পারে সেটা তার জীবনকে বদলে দেবে, তার নতুনত্বকে সম্পুর্ন করবে। সে অপেক্ষা করতে থাকে দিনটির জন্য। আজ সেইদিন।
বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে ক্যাথি বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বাস আসতে এখনো তিন মিনিট বাকী। বাসে করে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত যেতে ১৫ মিনিট লাগবে, ট্রেন ছাড়ার ৪/৫ মিনিট আগে আগে হয়তো সে স্টেশনে পৌঁছাবে। বাসা থেকে বের হতেই দেরী হয়ে গেলো। বাবা সম্ভবত তার স্বেচ্ছায় দূরে থাকার বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছেন, তাই শেষ মুহুর্তে অনেক উপদেশ, পরামর্শ দিলেন। মা বলেছেন একটা বিদেশী ধর্মের জন্য নিজের ইচ্ছা, নিজের স্বাধীনতাকে নিজেই নষ্ট করার কোন কারনই তিনি দেখতে পাননা। কিন্তু ক্যাথি বুঝে উঠতে পারে না সে কিভাবে বাবা-মা কে বোঝাবে যে সে আগের চেয়ে অনেক বেশী মুক্ত। এতোদিন সে অনেকের খেয়াল খুশি মতো চলেছে, অনেকের আঁকা ছকে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। এখন সে কেবল একজনের ইচ্ছামতো চলার চেষ্টা করছে।
ট্রেন স্টেশনে পৌঁছেই দ্রুত টিকেট দেখিয়ে ক্যাথি স্টেশনে ঢুকে পরে। ট্রেন খুঁজে নিয়ে কামরায় উঠতে উঠতেই ট্রেন ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে গেলো। কামরায় যত যাত্রী থাকবে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশীই আছে। প্রায় সব সিটই ভর্তি। তাকে তাড়াহুড়ো করে উঠতে দেখে তার আশেপাশের সীটের যাত্রীরা তার দিকে তাকালো। ক্যাথি দ্রুততার সাথে তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে স্কার্ফটি বের করল। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল, সে তো স্কার্ফ বাঁধতে পারে না, সে আগে কখনো চেষ্টা করে দেখেনি, অন্য কাউকেও স্বচক্ষে বাঁধতে দেখেনি যদিও স্কার্ফ পরা অবস্থায় অনেককে দেখেছে। এটা নিশ্চয় খুব কঠিন কাজ হবে না, একটু চেষ্টা করলেই হয়ত পারবে। কিন্তু এরপর দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল। নিজে নিজে পরতে গেলেতো অন্তত একটা আয়না লাগবে যেখানে দেখে দেখে সে পড়বে। সে একই সাথে উদ্বেলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে স্কার্ফ হাতে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল। কামরার প্রায় মাঝখানে যেখানে ব্যাগ, লাগেজ রাখার জন্য একপাশে তাকের মতো আছে সেখানে তাকের এক পাশেই একটা স্টিলের ডাস্টবিন তার চোখে পড়ল। মুহুর্তেই তার মনে হলো ডাস্টবিনটির চকচকে আবরনকে আয়না হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রায় সাথে সাথেই সে বিনটার সামনে চলে গেলো। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে।
উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। নিতান্তই অনভিজ্ঞ হাতে বিনের অবয়বের দিকে তাকিয়ে ক্যাথি বার বার স্কার্ফটি বাঁধার চেষ্টা করছে। ট্রেনের বেশীর ভাগ যাত্রী এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অধিকাংশই অবজ্ঞা ভরে তাকাচ্ছে, কেউ কেউ কৌতুহলী চোখে দেখছে মেয়েটার কর্মকান্ড। কিন্তু সে দিকে ক্যাথির বিশেষ নজর নেই। সে আপ্রান চেষ্টা করছে স্কার্ফটা যথাসম্ভব সুন্দরভাবে পরতে। শেষ পর্যন্ত সে বাঁধতে সফল হলো। বাঁধাটা খুব বেশী সুন্দর হয়নি, কিন্তু সে বিনটার দেয়ালের ঝাপসা অবয়বে নিজেকে দেখে পুরোপুরি অভিভুত হলো। নিজের সত্তাকে সে নতুনভাবে অনুভব করল এবং এই প্রথম সে নিজেকে সম্পুর্ন মুক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল।।
বিঃ দ্রঃ- ঘটনাটি অনেকটাই বাস্তব।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/SubehSadiq
আজ আরো একটি কাজ সে প্রথমবারের মতো করতে যাচ্ছে। কিন্তু এই দ্বিতীয় কাজটির কথা সে তার বাবা-মা কে জানায়নি। অবশ্য জানানোর কথাও নয়। বাবা-মা’র সাথে গত কয়েকমাস ধরে তার সম্পর্ক শীতল। এখানে যতদিন থাকবে সম্পর্কের আরো অবনতি হবে। তাই সে ঠিক করেছে চাকরীস্থল ব্র্যাডফোর্ডেই সে বাসা নিয়ে থাকবে, সপ্তাহান্তে মা-বাবার সাথে দেখা করতে এখানে আসবে।
‘ক্যাথি, তুমি কি এখন নাস্তা করবে?’ নীচতলার সিঁড়ির কাছ থেকে ক্যাথি তার মায়ের ডাক শুনতে পেল।
‘হ্যাঁ, আমি আসছি মা’, ক্যাথি জবাব দিল।
কাপড় চোপড়, কাগজপত্র সব ব্যাগে গুছিয়ে রেডী করে রেখে ক্যাথি নাস্তা করার জন্য নীচে নামল।
‘ব্র্যাডফোর্ডে কি তোমার বাসা ঠিক হয়েছে?’ খাওয়ার টেবিলে বসে বাবা জিজ্ঞেস করল।
‘হ্যাঁ হয়েছে’, ক্যাথি জবাব দিল।
‘তুমি এখন যথেষ্ট বড় হয়েছো ক্যাথি। কাজেই নিজের ভালোমন্দ তুমি নিজেই বুঝতে পারো। কিন্তু আমি তোমাকে আগে যে কথাটি বলেছিলাম সেটা মনে রেখ। আরো কিছুদিন সময় নাও, তারপর চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারো’।
ক্যাথি মাথানিচু করে বসে আছে। সে তার বাবার কথার উত্তরে কিছুই বলল না। মাথানিচু করে রাখলেও সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাবার পাশে বসা তার মা উত্তরের আশায় তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছেন। মা-ই প্রথম ক্যাথির ধর্মান্তরের বিষয়টি বুঝতে পারেন। মাসখানেক ধরে তিনি মেয়ের আচরনে কিছুটা অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করছিলেন। ক্যাথি অবশ্য ছোটবেলা থেকেই একটু অন্যরকম, সে তার আর দুই ভাইবোনের মতো নয়। বন্ধুবান্ধব নিয়ে হৈ-হুল্লা করার বা উইক এন্ডে পার্টি দেয়ার, এলকোহল পান করার, কিংবা ধুমপান করার অভ্যাস ওর কখনোই ছিল না। তবে তিনি যখন খেয়াল করলেন সে পর্ক খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তখনই সেটা তার কাছে অস্বাভাবিক মনে হলো। তিনি খেয়াল করলেন মেয়ের পোশাক আশাকেও কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। টাইট-ফিট জামা ছেড়ে সে ফুলহাতা লুজ জামা কাপড় পড়ছে। কিন্তু সেটা সাধারনত ধর্মীয় পোশাক বলতে যা বুঝায় তা নয়। স্কার্ফ দিয়ে মাথা ঢাকতেও তাকে তিনি কখনো দেখেননি। তাই ধর্মান্তরের বিষয়ে তিনি নিশ্চিত ছিলেন না। তিনি মেয়েকে বিষয়টি সরাসরি জিজ্ঞেস করেলন। মায়ের সুতীক্ষ্ণ জিজ্ঞাসার সামনে ক্যাথি ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার করতে পারলো না। কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে থেকে শেষে জানালো সে ধর্মান্তরিত হওয়ার বিষয়টি চিন্তা করছে। মা তাকে আর কিছু বলেননি।
সেই রাতে বাবা তার রুমে আসলেন। বাবা এর আগে কখনো তার রুমে আসেননি। ক্যাথি বুঝতে পারলো বাবা বিষয়টা খুব সিরিয়াসলী নিয়েছেন। সে কি বলবে সেটা মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছিল। বাবা বললেন, ‘আমি বিষয়টি তোমার মা’র কাছে শুনেছি। যাহোক, এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পক্ষে তোমার বয়স এখনো অনেক কম। কাজেই আমি বলব সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে আরো কিছুদিন সময় নাও। তুমি যথেষ্ট বুদ্ধিমতি একটা মেয়ে। আমার বিশ্বাস তুমি ভুল কোন সিদ্ধান্ত নেবে না’।
ক্যাথি কোন কথা বলল না। অবশ্য বাবা সম্ভবত তার কাছে কোন উত্তর আশা করেননি। তিনি তার কথাগুলো বলেই গুডনাইট জানিয়ে চলে গেলেন। বাবা রুম থেকে চলে যাওয়ার পর ক্যাথি একটি স্বস্তির নিঃশাস ফেলল।বাবা-মা জানার পর তাদের প্রতিক্রিয়া কি হবে সেটা নিয়ে সে চিন্তিত ছিল। খুব সহজভাবে তারা ব্যাপারটা মেনে নেবে সেটা সে আশা করেনি।
তবে সে যতটা ভেবেছিল পরিস্থিতি এর পরের কয়েকদিনে আরো কঠিন হয়ে উঠল। মা তার চলাফেরা, চালচলনের উপর সজাগ নজর রাখতেন লাগলেন, সুযোগ বুঝে তীর্যক কথাবার্তাও বলতে লাগলেন। যেমন একদিন সকালবেলা ক্যাথি লিভিংরুমে বসে টিভি দেখছিল। বাবা-মা দু’জনও ছিলেন। মা হঠাৎ করে সেদিনকার পত্রিকার একটা খবরে আফগানিস্তানের কোন এক গ্রামের সম্পূর্ণ বোরকা পরিহিতা দুই মহিলার ছবির দিকে ইংগিত করে বাবাকে বলতে লাগলেন, ‘এই হচ্ছে আমাদের ভবিষ্যত ক্যাথি’। আরেকদিন রাতে খাবার টেবিলে নিতান্তই অপ্রাসঙ্গিকভাবে হাসতে হাসতে বললেন, ‘জানো তো ক্যাথি, তোমার ঐ নতুন ধর্মের মেয়েদের বিয়ের পর রাস্তায় হাঁটার সময় স্বামী থেকে কমপক্ষে তিনহাত পিছনে থাকতে হয়!’ ক্যাথি বুঝতে পারে এসব তীর্যক কথাবার্তার উত্তরে সে অনেক কিছু বলতে পারে, কিন্তু সে কিছুই বলে না। সে জানে এর উত্তর দেয়া মানে এগুলোকে আরো উস্কে দেয়া। সে বুঝতে পারছিলো এসব থেকে রক্ষা পাওয়ার উপায় এই বাসা ছেড়ে চলে যাওয়া। তাই সে কিছুদিন হন্যে হয়ে চাকরী খুঁজল।
সৌভাগ্যক্রমে সে অন্য একটি শহরে চাকুরী পেয়েছে। এখন অনায়াসে সে চাকুরীর কথা বলে এখান থেকে দূরে থাকতে পারবে। যদিও একা বাসা নিয়ে থাকা কিংবা চাকুরী করা কোনটাই তার পছন্দ নয়, তবুও বাব-মা’র সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক না পর্যন্ত সে এভাবেই থাকতে চায়। অন্তত, এখন নামাজ পড়ার সময় তাকে আর তটস্থ থাকতে হবে না যে কখন মা ঘরে এসে পড়ে, কিংবা নীচ থেকে ডাকাডাকি শুরু করে। প্রথম যেদিন সে নামাজ পড়ে সেদিন সে প্রায় ধরা পড়ে যাচ্ছিল। নামাজের নিয়ম কানুন সদ্য শিখে সে সবে নামাজ পড়তে শুরু করেছে, অমনি কি জন্য যেন মা তাকে নীচ তলা থেকে ডাকতে শুরু করলেন। তার সাড়া না পেয়ে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলেন। তাদের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের এই বাড়িটির সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গেলে বড্ড শব্দ হয়। শব্দ শুনে ক্যাথি মনে মনে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। ভাগ্যিস তখনি নীচ তলার লিভিংরুম থেকে ফোনটা বেজে উঠল। মা ফোনে কথা শেষ করে যখন ক্যাথির রুমে আসলেন তখন দেখা গেলো সে ঘুমুচ্ছে; আসলে সে ঘুমোচ্ছিলো না।
তবে তার জন্য সবচেয়ে কৌতুহল আর আনন্দের সময় ছিল রমজান মাসটা। রমজান মাসে রোজা রাখার বিষয়টা সে শিখেছিল ছিল ইন্টারনেট থেকে। তার ধর্মান্তরের দেড় মাস পরেই ছিল রমজান মাস। রোজা রাখার বিষয়টি অবশ্য তার বাসার কেউ জানতে পারেনি। কিন্তু সেই সময়টা সে উৎকন্ঠা নিয়ে কাটিয়েছিল, মা কোন কারনে ডাকলেই মনের ভিতর একটা আশংকা ভর করত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আশংকাজনক কিছু হয়নি। না খেয়ে থাকার ব্যাপারটা নিয়ে তার মধ্যে সামান্য ভয়ও ছিল, সে বুঝতে পারছিলো না এতোটা সময় সে না খেয়ে থাকতে পারবে কি-না। তবে এটা নিয়েও তার কোন সমস্যা হয়নি। বরং স্বেচ্ছায় সারাদিন না খেয়ে থাকার মধ্যে যে এমন পবিত্র অনুভূতি থাকতে পারে সে এটা আগে কল্পনাও করতে পারেনি। প্রথমদিন রোজা রাখার পর তার মনে মুক্তির যে অনুভূতি জেগে উঠল সেটা এর আগে সে কখনো অনুভব করেনি। তার মনে হয়েছে এখন সে নির্দ্ধিধায় তার নতুন ধর্মের কথা সবাইকে জানাতে পারে। যেন সে এতোদিনের সকল ভয়, সংকোচ, আড়ষ্টতার উর্দ্ধে চলে গেছে।
তবু সে তার সংকোচ পুরোপুরি দূর করতে পারেনি। সে জানে তার জন্য মুখমন্ডল এবং হাতের কিছু অংশ ছাড়া আর কিছু জনসন্মুখে অনাবৃত রাখা বৈধ নয়। কিন্তু এই কাজটি সে করতে পারছে না। সে লং স্লিভ জামা পড়ে এখন, শুধু টাইটস পড়ে সে এখন আর বাইরে বের হয় না, যতটা মেনে চললে তার মা-বাবা বুঝতে পারবে না ততটা সে মেনে চলছে। বেশ কয়েকবার সে ভেবেছিল স্কার্ফ পড়া শুরু করবে। কিন্তু সেটা এমন একটা কাজ যেটা গোপনে বা সবার অলক্ষ্যে করা যায় না। সে কি করবে বুঝতে পারে না। এমন দ্বৈত আচরণ সে কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছিল না। একদিন মার্কেটে গিয়ে সে একটি স্কার্ফ কিনেও নিয়ে আসল। কিন্তু পরার সাহস পায়নি। সেটা তার হ্যান্ড ব্যাগের মধ্যেই পড়ে থাকে, মাঝে মাঝে বের করে দেখে, কিন্তু পরা হয় না।
অবশেষে সে সিদ্ধান্ত নেয় সে স্কার্ফটি পরবে। যেদিন সে তার চাকুরী হওয়া সম্পর্কে নিশ্চিত হলো সেদিনই সে ঠিক করে তার প্রথম অফিসে যাওয়ার দিন থেকেই সে স্কার্ফ পড়বে। এতো সহজ অথচ এতো কঠিন সিদ্ধান্তটি নেয়ার পরপর সে শিহরন অনুভব করে, সে বুঝতে পারে সেটা তার জীবনকে বদলে দেবে, তার নতুনত্বকে সম্পুর্ন করবে। সে অপেক্ষা করতে থাকে দিনটির জন্য। আজ সেইদিন।
বাস স্টপেজে দাঁড়িয়ে ক্যাথি বার বার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। বাস আসতে এখনো তিন মিনিট বাকী। বাসে করে ট্রেন স্টেশন পর্যন্ত যেতে ১৫ মিনিট লাগবে, ট্রেন ছাড়ার ৪/৫ মিনিট আগে আগে হয়তো সে স্টেশনে পৌঁছাবে। বাসা থেকে বের হতেই দেরী হয়ে গেলো। বাবা সম্ভবত তার স্বেচ্ছায় দূরে থাকার বিষয়টা আঁচ করতে পেরেছেন, তাই শেষ মুহুর্তে অনেক উপদেশ, পরামর্শ দিলেন। মা বলেছেন একটা বিদেশী ধর্মের জন্য নিজের ইচ্ছা, নিজের স্বাধীনতাকে নিজেই নষ্ট করার কোন কারনই তিনি দেখতে পাননা। কিন্তু ক্যাথি বুঝে উঠতে পারে না সে কিভাবে বাবা-মা কে বোঝাবে যে সে আগের চেয়ে অনেক বেশী মুক্ত। এতোদিন সে অনেকের খেয়াল খুশি মতো চলেছে, অনেকের আঁকা ছকে নিজেকে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা করেছে। এখন সে কেবল একজনের ইচ্ছামতো চলার চেষ্টা করছে।
ট্রেন স্টেশনে পৌঁছেই দ্রুত টিকেট দেখিয়ে ক্যাথি স্টেশনে ঢুকে পরে। ট্রেন খুঁজে নিয়ে কামরায় উঠতে উঠতেই ট্রেন ছাড়ার সময় প্রায় হয়ে গেলো। কামরায় যত যাত্রী থাকবে ভেবেছিল তার চেয়ে বেশীই আছে। প্রায় সব সিটই ভর্তি। তাকে তাড়াহুড়ো করে উঠতে দেখে তার আশেপাশের সীটের যাত্রীরা তার দিকে তাকালো। ক্যাথি দ্রুততার সাথে তার হ্যান্ড ব্যাগ থেকে স্কার্ফটি বের করল। কিন্তু তখনই তার মনে পড়ল, সে তো স্কার্ফ বাঁধতে পারে না, সে আগে কখনো চেষ্টা করে দেখেনি, অন্য কাউকেও স্বচক্ষে বাঁধতে দেখেনি যদিও স্কার্ফ পরা অবস্থায় অনেককে দেখেছে। এটা নিশ্চয় খুব কঠিন কাজ হবে না, একটু চেষ্টা করলেই হয়ত পারবে। কিন্তু এরপর দ্বিতীয় সমস্যা দেখা দিল। নিজে নিজে পরতে গেলেতো অন্তত একটা আয়না লাগবে যেখানে দেখে দেখে সে পড়বে। সে একই সাথে উদ্বেলিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে স্কার্ফ হাতে এদিকে ওদিকে তাকাতে লাগল। কামরার প্রায় মাঝখানে যেখানে ব্যাগ, লাগেজ রাখার জন্য একপাশে তাকের মতো আছে সেখানে তাকের এক পাশেই একটা স্টিলের ডাস্টবিন তার চোখে পড়ল। মুহুর্তেই তার মনে হলো ডাস্টবিনটির চকচকে আবরনকে আয়না হিসেবে ব্যবহার করা যায়। প্রায় সাথে সাথেই সে বিনটার সামনে চলে গেলো। ইতিমধ্যে ট্রেন চলতে শুরু করেছে।
উত্তেজনায় তার হাত কাঁপছে। নিতান্তই অনভিজ্ঞ হাতে বিনের অবয়বের দিকে তাকিয়ে ক্যাথি বার বার স্কার্ফটি বাঁধার চেষ্টা করছে। ট্রেনের বেশীর ভাগ যাত্রী এখন তার দিকে তাকিয়ে আছে। অধিকাংশই অবজ্ঞা ভরে তাকাচ্ছে, কেউ কেউ কৌতুহলী চোখে দেখছে মেয়েটার কর্মকান্ড। কিন্তু সে দিকে ক্যাথির বিশেষ নজর নেই। সে আপ্রান চেষ্টা করছে স্কার্ফটা যথাসম্ভব সুন্দরভাবে পরতে। শেষ পর্যন্ত সে বাঁধতে সফল হলো। বাঁধাটা খুব বেশী সুন্দর হয়নি, কিন্তু সে বিনটার দেয়ালের ঝাপসা অবয়বে নিজেকে দেখে পুরোপুরি অভিভুত হলো। নিজের সত্তাকে সে নতুনভাবে অনুভব করল এবং এই প্রথম সে নিজেকে সম্পুর্ন মুক্ত অবস্থায় আবিষ্কার করল।।
বিঃ দ্রঃ- ঘটনাটি অনেকটাই বাস্তব।
http://www.sonarbangladesh.com/articles/SubehSadiq
No comments:
Post a Comment