সমাজে যখন অত্যাচার, উত্পীড়ন, শোষণ-নির্যাতন চরমে ওঠে, ঠিক তখনই দু-চারজন ক্ষণজন্মা পুরুষের আবির্ভাব ঘটে। যারা এই সঙ্কটের জন্য সংগ্রাম করেন, প্রাণপাত করেন। তাদেরই আত্মত্যাগ ও পথনির্দেশে জেগে ওঠে ঘুমন্ত জাতি। ফিরে পায় হৃতগৌরব। উপমহাদেশে মুসলিম আবেগ ও হৃতমর্যাদার জন্য যে দু-চারজন মনীষী ক্ষুরধার লেখনী ও জ্বালাময়ী বক্তৃতাকে মাধ্যম করে নেমে পড়েছিলেন—গাজী এ-বলকান মরহুম মওলানা আবু মোহাম্মদ সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী ছিলেন নিঃসন্দেহে তাদের অন্যতম। আর সে দিনের সিরাজগঞ্জ ছিল মুসলিম বাংলার সাহিত্য, রাজনীতি, নব চিন্তাধারার প্রাণকেন্দ্র। এই শহরের পশ্চিম প্রান্তে শিরাজী ভবন ‘বাণীকুঞ্জ’ ছিল মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজীর কর্মকেন্দ্র। ‘বাণীকুঞ্জ’ শিরাজী সাহেবের জন্ম ও কর্মস্থলই শুধু নয়, এখানে তিনি চিরনিদ্রিত রয়েছেন। তিনি ১৮৭৯ সালের ১৩ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩১ সালের ১৭ জুলাই ইন্তেকাল করেন।
ব্রিটিশ সরকারের ভিত কাঁপানো গ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ’ (ব্রিটিশ সরকার যে গ্রন্থ রচনার জন্য শিরাজীকে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল) থেকে শুরু করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই সাধক কবি তার বাণী রচনা করেছেন এই পুণ্যভূমিতে বসেই। ‘বাণীকুঞ্জ’ হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-তীর্থ, ঘুমন্ত মুসলিম বঙ্গের নবজীবন সঞ্চারের উত্স কেন্দ্র। ইসলামী জীবনবোধের নবরূপায়ণ ক্ষেত্র। দীর্ঘ ৫১ বছরের জীবনে শিরাজীর সাহিত্য ও কর্ম জীবনের পরিধি ছিল মাত্র ৩১ বছর। ‘ইংরেজ শক্তির শাসনামলে গোটা মুসলিম জাতির শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছিল। শিরাজী এই শিরদাঁড়া ভাঙা জাতির যুগ প্রতিনিধি ছিলেন। নবজাগরণের অভয় মন্ত্র তিনি শোনাতেন। বাণীকুঞ্জ থেকে যে বাণী ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল সেদিন, তাই সেকালের বাঙালি মুসলমানদের কালঘুম ভাঙিয়েছে, মুক্তির পথের সন্ধান দিয়েছে। কবি, সাহিত্যিক, ধর্ম প্রচারক, রাজনৈতিক নেতা, যোদ্ধা, সমাজ সংস্কারক, সাংবাদিক, বাগ্মী প্রভৃতি বহুবিধ বৈশিষ্ট্য তিনি একাই লালন করেছেন নিজের মধ্যে। তাতে তিনি সফলকামও হয়েছেন।
শিরাজীর বক্তৃতা, সঙ্গীত, সাহিত্য যে শুধু বিপুল আবেগের পরিচয় বহন করে তা নয়, তার সবটার মধ্যেই নয়া জিন্দেগির স্বপ্ন ছিল। জাতির জাগরণের কামিয়াবির জন্য সাধনা ছিল, দরদ ছিল।
ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা কবি ড. জনসন এক দিন তার ‘সাহিত্যচক্র’ গঠন করেছিলেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে একখানা গ্রন্থই লিখিত হলো ‘ড. জনসন অ্যান্ড হিজ সার্কেল’। জনসনের গ্রন্থ রসিকের আনন্দের ভাণ্ডার। সেদিনের মুসলিম বাংলার জনসন ছিলেন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। যার ‘বাণীকুঞ্জে’ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাহিত্য রসিকদের সমাগম হতো। তাঁর যোগ্য পরিচালনায় সিরাজগঞ্জের সাহিত্যগোষ্ঠীর নাম হয়েছিল ‘শিরাজীচক্র’। শিরাজী সার্কেলে যারা ছিলেন তারা প্রায় সবাই কবি, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, শিল্পী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। কেউ কেউ শিরাজীর সান্নিধ্যে এসে নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন।
প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত হয়ে থাকত বাণীকুঞ্জ। মিলাদ শরিফ, সঙ্গীতের জলসা, পিয়ারা নবীর (সা.) পুণ্যময় জীবনের কত খুঁটিনাটি দিক, স্ত্রী শিক্ষা, সুদ সমস্যা—এগুলো নিয়েও শিরাজীচক্রে রীতিমত আলোড়ন উঠত। বাণীকুঞ্জের সাহিত্যের আসরে যেমন আলোচনা হতো ফার্সি কবিকুল শ্রেষ্ঠ ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, হাফিজ ও সাদীর কাব্য নিয়ে, তেমনি জার্মান দার্শনিক কান্ট ও নিটশে, হেগেল, আবু সিনা, ইমাম গাজ্জালী নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বাদ পড়ত না। শিরাজী ছিলেন তাদের মধ্যমণি। তার সঙ্গে থাকতেন গোলাম আম্বিয়া, লোহানী, শেখ আবদুল গফুর জালালী, আবদুল মনসুর এলাহী বখস্, এম সিরাজুল হক, মানবজীবনের কর্তব্য প্রণেতা আব্বাস আলী তালুকদার, পণ্ডিত জিগ্রীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, পণ্ডিত সত্যেন্দ্রনাথ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শেখ জমির উদ্দিন বিদ্যাবিনোদ, শেখ মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী, শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, দিল্লির সুপ্রসিদ্ধ নিজাম উদ্দিন আওলিয়ার ওয়ারিশ বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক কবি ও সাধক সামছুল ওলামা। খাজা হাসান নিজামী, ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত, চারণ কবি মুকুন্দ দাস, সত্যেন্দ্র চন্দ্র মিত্র (হাইকোর্টের উকিল ও অভিভক্ত ভারতের কাউন্সিল সভাপতি), ডাক্তার সাইফ উদ্দিন কিসলু (তাঞ্জিল আন্দোলনের সংগঠক), বাংলার হৃদয়জয়ী গায়ক আব্বাস উদ্দীন প্রমুখ সুধী নানা সময়ে নানা বিষয়ে উপলক্ষে শিরাজীর সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভের জন্য তার ‘বাণীকুঞ্জে’ এসেছেন। তারা এলেই মুহূর্তের মধ্যে আনন্দ ও উত্সবে মুখর হয়ে উঠত বাণীকুঞ্জ। রাজনীতিবিদদের মধ্যে কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু, দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাস, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-ই-বাংলা একেএম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল্লাহেহল বাকী, ডা. হেমেন্দ্র নাথ দাস গুপ্ত, ভূতপূর্ব খাদ্যমন্ত্রী গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ, মো. আবদুল জব্বার পাহলোয়ান, ব্যারিস্টার কে আহম্মেদ, মৌলানা মোসাহেব আলী খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবদুল হালিম গজনভী, ওয়াহেদ আলী খান পন্নী প্রমুখ জননেতা ও কৃতী পুরুষ এখানে এসেছেন। এই ‘বাণীকুঞ্জ’ পাক-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই বাণীকুঞ্জ বাংলা সাহিত্যের নব প্রেরণার উত্সস্থল ছিল।
শ্যামল সবুজ ছায়াঘেরা প্রকৃতির রম্য কুঞ্জ নামে পরিচিত শিরাজীর সেই সাধের ‘বাণীকুঞ্জ’ এখন আর বাণী ছড়ায় না। নেই সেই সৌরভ-মাখা মনমাতানো ফুলের কুঞ্জ কিংবা শিরাজীর স্বহস্তে রোপিত ছায়াঘেরা নানান বর্ণের ফুল ও ফলের গাছগুলো। এক কথায় বাণীকুঞ্জের সেই সৌন্দর্য আর শোভা এখন চোখে পড়ে না। অরক্ষিত ‘বাণীকুঞ্জ’ এখন ক্রমেই তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এক সময়ের সবুজ ছায়াঘেরা সবার দৃষ্টিকাড়া ‘বাণীকুঞ্জ’ এখন নিষ্প্রাণ। প্রখ্যাত ব্যক্তিদের পদচারণায় ধন্য ও মুখরিত এ কুঞ্জ এখন নীরব-নিস্তব্ধ। বাণীকুঞ্জের বৈঠকখানার এখন জীর্ণদশা। আর্থিক দৈন্যের কারণে পরিবারের সদস্যদের পক্ষে শিরাজীর শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু রক্ষা করাও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশের স্বাধীনতা লাভের দেড় যুগেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও শিরাজীর মাজার সংস্কার ও বাণীকুঞ্জের উন্নয়নে কোনো মঞ্জুরি মেলেনি। হাজার স্মৃতিবিজড়িত বাণীকুঞ্জ ও শিরাজীর মাজার শরিফ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়েছে। হারিয়ে ফেলেছে তার জৌলুস।
শিরাজী দেশের জন্য, জাতির জন্য, মানবকল্যাণের জন্য কি না করেছেন? জেল খেটেছেন, অর্ধাহারে অনাহারে জীবন কাটিয়েছেন। যতদূর জানা যায়, বাংলা সাহিত্যে আজাদীর বাণী প্রচার করে শিরাজী সাহেবই সর্ব প্রথম জেলে গিয়েছিলেন। শিরাজীর বিরুদ্ধে ৮২ বার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২৮ বার তিনি বিভিন্ন মেয়াদে কারাবরণ করেন। তাঁর মনে কোনো কালিমা ছিল না, প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী শিরাজী যখনই কারো লেখার গভীরতা পরখ করতে পেরেছেন, তখনই তিনি তাকে নানাভাবে উত্সাহ-উদ্দীপনা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কবি কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি আবদুল কাদির তার উজ্জ্বল সাক্ষ্য। কায়কোবাদের মহাশ্মশান কাব্য লেখার পর শিরাজী সর্ব প্রথম তাকে মহাকবি আখ্যা দেন। সোনার কলম ও রুপোর দোয়াত উপঢৌকন দেয়ার উদ্যোগ নেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিরাজীর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ধন্য হয়েছেন। কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ হয়েছেন। দান-খয়রাতে শিরাজী দরাজ দেলের পরিচয় দেন। সে সময়ে তিনি একত্রে ৬০০ টাকা দান করেছেন। যার মূল্য আজকের দিনে ৬০ হাজার টাকারও বেশি। তাঁর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ সরকার তাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হন। মুক্তি সংগ্রামের তূর্যবাদক নবজাগরণের অগ্রদূত শিরাজীর অভাবগ্রস্ত সংসার, স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের ফেলে শির উঁচু করে মুসলমান স্বার্থে কারাবরণকেই বেশি গৌরবজনক মনে করেছেন। বলা যায় সর্বক্ষেত্রে শিরাজীর নিঃস্বার্থ বিচরণ তাকে আরো মহত্ ও তুলনাহীন ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। উল্লেখ্য, অনল প্রবাহ বাজেয়াপ্ত করার পর তল্লাশি করতে এসে ব্রিটিশ মহাকুমা ম্যাজিস্ট্রেট লয়েড সিরাজীর ফ্যামিলি লাইব্রেরির গ্রন্থগুলো আগ্রহ সহকারে দেখে মন্তব্য করেন শিরাজী "ঘঙঞ ঙঘখণ অ ঘঅঞওঙঘঅখ চঙঊঞ অঘউ এজঊঅঞ ঙজঅঞঙজ ইটঞ অখঝঙ অ এজঊঅঞ ঝঈঐঙখঅজ" (মি. শিরাজী শুধু একজন জাতীয় কবি এবং উচ্চস্তরের বাগ্মীই নন, একজন বিরাট পণ্ডিত ব্যক্তি)। এই শিরাজীর প্রতি আমরা এ মর্যাদাই প্রদান করছি। প্রশ্ন ওঠে দেশ-দশ-জাতির কাছে এই কি প্রাপ্য ছিল শিরাজীর? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ সফরে এসেছেন একাধিকবার। অথচ কেউ তাঁর মাজারে আসেননি। তাঁর মাজার সংস্কারের কথা ভাবেননি। শিরাজীর ইন্তেকালের পর বড় দুরবস্থার মধ্যে তার সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী ২২ বছর বয়সে এতিম ৩ ভাই ও ৩ বোনের সংসারে হাল ধরেন। ১৯৫২ সালের ১ মে মাতা বেগম ওয়াজেদুন নেছার মৃত্যুর এক বছর পর প্রথমবারের মতো তিনি পিতা ও মাতার মাজার দু’টি পাকা করেন। ১৯৬৩ সালে শিরাজী স্মৃতি সংসদ গঠিত হয়। শিরাজীর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজীর ব্যক্তিগত ৫ হাজার, ১৯৬৪ সালের পাকিস্তানের গভর্নর ৫ হাজার ও পাবনা জেলা কাউন্সিলের ৫ হাজার মোট ১৫ হাজার টাকা ব্যয় শিরাজীর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়।
জীবদ্দশায় শিরাজী বলতেন আমার জ্যেষ্ঠপুত্র আসাদ আমার প্রার্থনার পুত্র। ওর জন্মের আগেই তার নাম ঠিক করে রাখা হয়েছিল ‘আসাদ উদ্দৌলা’ (সাম্রাজ্যের সিংহ)। কবি নজরুল ইসলাম রাজদ্রোহের অভিযোগে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর আসাদ সিরাজীর উদ্দেশে লিখেছিলেন—
‘হে বাগ্মী! হে কবি!! কর্মী!!! প্রতিভার-মূর্ত অবতার। তোমার জনমে ধন্য নব্য বঙ্গ করে নমস্কার। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের যাদের দেখেছি ও ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনের ‘ছোট থেকে বড়’ পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে। শিরাজী সাহেব মৃত্যুকালে কোনো ধনরত্ন রেখে যেতে পারেননি কথা ঠিক নয়, কেননা তিনি তার সুযোগ্য পুত্র আসাদ শিরাজীকে রেখে গেছেন যিনি পিতার যোগ্য উত্তরসূরি এবং ধনরত্ন অপেক্ষা কম নন। যাই হোক, পিতার সেই সাধনার পুত্র আসাদ শিরাজী ‘বাণীকুঞ্জের’ পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারিবারিকভাবে এক বিঘা জমি মাজারের নামে ওয়াকফ করার ব্যবস্থা করেন। এবং পিতা গাজী শিরাজীর শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় যে মাজারের সামনে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। সেখানে ওয়াক্তিয়া ও জুমার নামাজ ছাড়াও নিয়মিত কোরআন শরিফ তাফসির ও হাদিস শরিফের আলোচনা এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। মসজিদ ও স্মৃতিসৌধের পশ্চিম পাশে একটি সভাকক্ষ, গ্রন্থাগার, মোসাফিরখানা, সাহিত্য ও সমাজবিষয়ক গবেষণাগার থাকবে। এখানে মাঝেমধ্যে সাহিত্য সভার আয়োজন করা হবে এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে ধর্ম, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞানের ওপর বক্তৃতা ও আলোচনার ব্যবস্থা থাকবে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিন জ্ঞানী-গুণী ও সাধারণ মানুষ আসে শিরাজীর মাজার জিয়ারতের জন্য। মাজারসংলগ্ন মোসাফিরখানা তাদের অবস্থানের জন্য ব্যবহৃত হবে। শিরাজী ছিলেন অত্যন্ত গুল্মপ্রিয়, স্বহস্তে উদ্যান রচনা ও ফুলগাছগুলোর পরিচর্যা করা ছিল তাঁর শখ। তাই স্মৃতিসৌধের দক্ষিণ দিকে একটি ক্ষুদ্রাকার গুল্মোদ্যান ও ফোয়ারা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। সর্বসাকুল্যে ওই সময়ে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল লক্ষাধিক টাকা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পিতার প্রার্থনার পুত্র শেষ পর্যন্ত তার সাধারণ পরিকল্পনা শেষ রক্ষা করতে পারলেন না।
১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর সুপরিকল্পিতভাবে সৈয়দ আসাদউদ্দৌলা শিরাজীকে হত্যা করার পর থেকে পরিকল্পনাটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পরিকল্পনার নীলনকশাই স্মৃতি আকারে রয়েছে, যার বাস্তবরূপ হচ্ছে না।
কবি-সাহিত্যিক ও লেখকরা শিরাজীর রচনাসম্ভার থেকে যেমন অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন, তেমনি তাঁর কর্মস্থলে জীবনের ঘটনা জুগিয়েছে চলার পথের পাথেয়। দেশ ও জাতির জন্য যিনি নিরলসভাবে সারা জীবন সাধনা করে গেছেন, কালজয়ী এই জাতীয় পুরুষের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা, তাঁর স্মৃতিচিহ্নকে জাগিয়ে রাখা জাতির অবশ্য কর্তব্য হলেও শিরাজীর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়নি।
সিরাজী স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণব্রতী এক চিন্তানায়ক, জাতীয় জীবন গঠনের জন্য তার অসাধারণ ত্যাগ ও কর্মপ্রচেষ্টা আত্মবিশ্বাসহীন জাতির প্রাণে নবচেতনার সঞ্চার করেছিল একথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়। অথচ তার রচিত গ্রন্থগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমী শিরাজী রচনাবলীটিও ছাপানোর দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। ফলে আজকের স্বাধীন দেশের মাটিতে বসে এ প্রজন্মের পক্ষে শিরাজী এবং তার সহকর্মীদের ভূমিকা অনুধাবন করা সত্যিই কঠিন। কালের ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়ার মতো পুরনো তিনি নন। তাকে জানতে হলে ইতিহাস জানতে হবে। সে ইতিহাস জাতির স্বার্থেই আমাদের জানা প্রয়োজন।
ব্রিটিশ সরকারের ভিত কাঁপানো গ্রন্থ ‘অনল প্রবাহ’ (ব্রিটিশ সরকার যে গ্রন্থ রচনার জন্য শিরাজীকে দুই বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল) থেকে শুরু করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এই সাধক কবি তার বাণী রচনা করেছেন এই পুণ্যভূমিতে বসেই। ‘বাণীকুঞ্জ’ হয়ে উঠেছিল জ্ঞান-তীর্থ, ঘুমন্ত মুসলিম বঙ্গের নবজীবন সঞ্চারের উত্স কেন্দ্র। ইসলামী জীবনবোধের নবরূপায়ণ ক্ষেত্র। দীর্ঘ ৫১ বছরের জীবনে শিরাজীর সাহিত্য ও কর্ম জীবনের পরিধি ছিল মাত্র ৩১ বছর। ‘ইংরেজ শক্তির শাসনামলে গোটা মুসলিম জাতির শিরদাঁড়া ভেঙে গিয়েছিল। শিরাজী এই শিরদাঁড়া ভাঙা জাতির যুগ প্রতিনিধি ছিলেন। নবজাগরণের অভয় মন্ত্র তিনি শোনাতেন। বাণীকুঞ্জ থেকে যে বাণী ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল সেদিন, তাই সেকালের বাঙালি মুসলমানদের কালঘুম ভাঙিয়েছে, মুক্তির পথের সন্ধান দিয়েছে। কবি, সাহিত্যিক, ধর্ম প্রচারক, রাজনৈতিক নেতা, যোদ্ধা, সমাজ সংস্কারক, সাংবাদিক, বাগ্মী প্রভৃতি বহুবিধ বৈশিষ্ট্য তিনি একাই লালন করেছেন নিজের মধ্যে। তাতে তিনি সফলকামও হয়েছেন।
শিরাজীর বক্তৃতা, সঙ্গীত, সাহিত্য যে শুধু বিপুল আবেগের পরিচয় বহন করে তা নয়, তার সবটার মধ্যেই নয়া জিন্দেগির স্বপ্ন ছিল। জাতির জাগরণের কামিয়াবির জন্য সাধনা ছিল, দরদ ছিল।
ইংল্যান্ডের প্রথিতযশা কবি ড. জনসন এক দিন তার ‘সাহিত্যচক্র’ গঠন করেছিলেন এবং তার ওপর ভিত্তি করে একখানা গ্রন্থই লিখিত হলো ‘ড. জনসন অ্যান্ড হিজ সার্কেল’। জনসনের গ্রন্থ রসিকের আনন্দের ভাণ্ডার। সেদিনের মুসলিম বাংলার জনসন ছিলেন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী। যার ‘বাণীকুঞ্জে’ জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সাহিত্য রসিকদের সমাগম হতো। তাঁর যোগ্য পরিচালনায় সিরাজগঞ্জের সাহিত্যগোষ্ঠীর নাম হয়েছিল ‘শিরাজীচক্র’। শিরাজী সার্কেলে যারা ছিলেন তারা প্রায় সবাই কবি, সাহিত্যিক, সমাজ সংস্কারক, শিল্পী, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদ। কেউ কেউ শিরাজীর সান্নিধ্যে এসে নিজেকে নতুন করে উপলব্ধি করতে চেয়েছিলেন।
প্রাণের স্পন্দনে মুখরিত হয়ে থাকত বাণীকুঞ্জ। মিলাদ শরিফ, সঙ্গীতের জলসা, পিয়ারা নবীর (সা.) পুণ্যময় জীবনের কত খুঁটিনাটি দিক, স্ত্রী শিক্ষা, সুদ সমস্যা—এগুলো নিয়েও শিরাজীচক্রে রীতিমত আলোড়ন উঠত। বাণীকুঞ্জের সাহিত্যের আসরে যেমন আলোচনা হতো ফার্সি কবিকুল শ্রেষ্ঠ ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, হাফিজ ও সাদীর কাব্য নিয়ে, তেমনি জার্মান দার্শনিক কান্ট ও নিটশে, হেগেল, আবু সিনা, ইমাম গাজ্জালী নিয়ে তর্ক-বিতর্ক বাদ পড়ত না। শিরাজী ছিলেন তাদের মধ্যমণি। তার সঙ্গে থাকতেন গোলাম আম্বিয়া, লোহানী, শেখ আবদুল গফুর জালালী, আবদুল মনসুর এলাহী বখস্, এম সিরাজুল হক, মানবজীবনের কর্তব্য প্রণেতা আব্বাস আলী তালুকদার, পণ্ডিত জিগ্রীন্দ্র নারায়ণ ভট্টাচার্য, পণ্ডিত সত্যেন্দ্রনাথ মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, শেখ জমির উদ্দিন বিদ্যাবিনোদ, শেখ মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী, শ্রীযুক্ত অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়, দিল্লির সুপ্রসিদ্ধ নিজাম উদ্দিন আওলিয়ার ওয়ারিশ বিখ্যাত উর্দু সাহিত্যিক কবি ও সাধক সামছুল ওলামা। খাজা হাসান নিজামী, ঐতিহাসিক রামপ্রাণ গুপ্ত, চারণ কবি মুকুন্দ দাস, সত্যেন্দ্র চন্দ্র মিত্র (হাইকোর্টের উকিল ও অভিভক্ত ভারতের কাউন্সিল সভাপতি), ডাক্তার সাইফ উদ্দিন কিসলু (তাঞ্জিল আন্দোলনের সংগঠক), বাংলার হৃদয়জয়ী গায়ক আব্বাস উদ্দীন প্রমুখ সুধী নানা সময়ে নানা বিষয়ে উপলক্ষে শিরাজীর সাহচর্য ও সান্নিধ্য লাভের জন্য তার ‘বাণীকুঞ্জে’ এসেছেন। তারা এলেই মুহূর্তের মধ্যে আনন্দ ও উত্সবে মুখর হয়ে উঠত বাণীকুঞ্জ। রাজনীতিবিদদের মধ্যে কায়দে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহরু, দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন দাস, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শের-ই-বাংলা একেএম ফজলুল হক, মওলানা আবদুল্লাহেহল বাকী, ডা. হেমেন্দ্র নাথ দাস গুপ্ত, ভূতপূর্ব খাদ্যমন্ত্রী গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদ, মো. আবদুল জব্বার পাহলোয়ান, ব্যারিস্টার কে আহম্মেদ, মৌলানা মোসাহেব আলী খাঁ, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, আবদুল হালিম গজনভী, ওয়াহেদ আলী খান পন্নী প্রমুখ জননেতা ও কৃতী পুরুষ এখানে এসেছেন। এই ‘বাণীকুঞ্জ’ পাক-ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম কর্মকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই বাণীকুঞ্জ বাংলা সাহিত্যের নব প্রেরণার উত্সস্থল ছিল।
শ্যামল সবুজ ছায়াঘেরা প্রকৃতির রম্য কুঞ্জ নামে পরিচিত শিরাজীর সেই সাধের ‘বাণীকুঞ্জ’ এখন আর বাণী ছড়ায় না। নেই সেই সৌরভ-মাখা মনমাতানো ফুলের কুঞ্জ কিংবা শিরাজীর স্বহস্তে রোপিত ছায়াঘেরা নানান বর্ণের ফুল ও ফলের গাছগুলো। এক কথায় বাণীকুঞ্জের সেই সৌন্দর্য আর শোভা এখন চোখে পড়ে না। অরক্ষিত ‘বাণীকুঞ্জ’ এখন ক্রমেই তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এক সময়ের সবুজ ছায়াঘেরা সবার দৃষ্টিকাড়া ‘বাণীকুঞ্জ’ এখন নিষ্প্রাণ। প্রখ্যাত ব্যক্তিদের পদচারণায় ধন্য ও মুখরিত এ কুঞ্জ এখন নীরব-নিস্তব্ধ। বাণীকুঞ্জের বৈঠকখানার এখন জীর্ণদশা। আর্থিক দৈন্যের কারণে পরিবারের সদস্যদের পক্ষে শিরাজীর শেষ স্মৃতিচিহ্নটুকু রক্ষা করাও দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশের স্বাধীনতা লাভের দেড় যুগেরও বেশি সময় অতিবাহিত হওয়া সত্ত্বেও শিরাজীর মাজার সংস্কার ও বাণীকুঞ্জের উন্নয়নে কোনো মঞ্জুরি মেলেনি। হাজার স্মৃতিবিজড়িত বাণীকুঞ্জ ও শিরাজীর মাজার শরিফ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে পড়েছে। হারিয়ে ফেলেছে তার জৌলুস।
শিরাজী দেশের জন্য, জাতির জন্য, মানবকল্যাণের জন্য কি না করেছেন? জেল খেটেছেন, অর্ধাহারে অনাহারে জীবন কাটিয়েছেন। যতদূর জানা যায়, বাংলা সাহিত্যে আজাদীর বাণী প্রচার করে শিরাজী সাহেবই সর্ব প্রথম জেলে গিয়েছিলেন। শিরাজীর বিরুদ্ধে ৮২ বার ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ২৮ বার তিনি বিভিন্ন মেয়াদে কারাবরণ করেন। তাঁর মনে কোনো কালিমা ছিল না, প্রশস্ত হৃদয়ের অধিকারী শিরাজী যখনই কারো লেখার গভীরতা পরখ করতে পেরেছেন, তখনই তিনি তাকে নানাভাবে উত্সাহ-উদ্দীপনা অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন। কবি কায়কোবাদ, জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলাম ও কবি আবদুল কাদির তার উজ্জ্বল সাক্ষ্য। কায়কোবাদের মহাশ্মশান কাব্য লেখার পর শিরাজী সর্ব প্রথম তাকে মহাকবি আখ্যা দেন। সোনার কলম ও রুপোর দোয়াত উপঢৌকন দেয়ার উদ্যোগ নেন।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শিরাজীর কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়ে ধন্য হয়েছেন। কৃতজ্ঞতাবোধে আবদ্ধ হয়েছেন। দান-খয়রাতে শিরাজী দরাজ দেলের পরিচয় দেন। সে সময়ে তিনি একত্রে ৬০০ টাকা দান করেছেন। যার মূল্য আজকের দিনে ৬০ হাজার টাকারও বেশি। তাঁর দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে ব্রিটিশ সরকার তাকে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ গ্রহণের অনুরোধ জানিয়ে ব্যর্থ হন। মুক্তি সংগ্রামের তূর্যবাদক নবজাগরণের অগ্রদূত শিরাজীর অভাবগ্রস্ত সংসার, স্ত্রী ও শিশু সন্তানদের ফেলে শির উঁচু করে মুসলমান স্বার্থে কারাবরণকেই বেশি গৌরবজনক মনে করেছেন। বলা যায় সর্বক্ষেত্রে শিরাজীর নিঃস্বার্থ বিচরণ তাকে আরো মহত্ ও তুলনাহীন ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। উল্লেখ্য, অনল প্রবাহ বাজেয়াপ্ত করার পর তল্লাশি করতে এসে ব্রিটিশ মহাকুমা ম্যাজিস্ট্রেট লয়েড সিরাজীর ফ্যামিলি লাইব্রেরির গ্রন্থগুলো আগ্রহ সহকারে দেখে মন্তব্য করেন শিরাজী "ঘঙঞ ঙঘখণ অ ঘঅঞওঙঘঅখ চঙঊঞ অঘউ এজঊঅঞ ঙজঅঞঙজ ইটঞ অখঝঙ অ এজঊঅঞ ঝঈঐঙখঅজ" (মি. শিরাজী শুধু একজন জাতীয় কবি এবং উচ্চস্তরের বাগ্মীই নন, একজন বিরাট পণ্ডিত ব্যক্তি)। এই শিরাজীর প্রতি আমরা এ মর্যাদাই প্রদান করছি। প্রশ্ন ওঠে দেশ-দশ-জাতির কাছে এই কি প্রাপ্য ছিল শিরাজীর? দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রী থেকে শুরু করে প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত সিরাজগঞ্জ সফরে এসেছেন একাধিকবার। অথচ কেউ তাঁর মাজারে আসেননি। তাঁর মাজার সংস্কারের কথা ভাবেননি। শিরাজীর ইন্তেকালের পর বড় দুরবস্থার মধ্যে তার সুযোগ্য পুত্র সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজী ২২ বছর বয়সে এতিম ৩ ভাই ও ৩ বোনের সংসারে হাল ধরেন। ১৯৫২ সালের ১ মে মাতা বেগম ওয়াজেদুন নেছার মৃত্যুর এক বছর পর প্রথমবারের মতো তিনি পিতা ও মাতার মাজার দু’টি পাকা করেন। ১৯৬৩ সালে শিরাজী স্মৃতি সংসদ গঠিত হয়। শিরাজীর স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা নেয়া হয়। সৈয়দ আসাদ উদ্দৌলা শিরাজীর ব্যক্তিগত ৫ হাজার, ১৯৬৪ সালের পাকিস্তানের গভর্নর ৫ হাজার ও পাবনা জেলা কাউন্সিলের ৫ হাজার মোট ১৫ হাজার টাকা ব্যয় শিরাজীর স্মৃতিসৌধ নির্মাণ কাজ শুরু করা হয়।
জীবদ্দশায় শিরাজী বলতেন আমার জ্যেষ্ঠপুত্র আসাদ আমার প্রার্থনার পুত্র। ওর জন্মের আগেই তার নাম ঠিক করে রাখা হয়েছিল ‘আসাদ উদ্দৌলা’ (সাম্রাজ্যের সিংহ)। কবি নজরুল ইসলাম রাজদ্রোহের অভিযোগে ২ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হওয়ার পর আসাদ সিরাজীর উদ্দেশে লিখেছিলেন—
‘হে বাগ্মী! হে কবি!! কর্মী!!! প্রতিভার-মূর্ত অবতার। তোমার জনমে ধন্য নব্য বঙ্গ করে নমস্কার। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের যাদের দেখেছি ও ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশনের ‘ছোট থেকে বড়’ পুস্তকে উল্লেখ করা হয়েছে। শিরাজী সাহেব মৃত্যুকালে কোনো ধনরত্ন রেখে যেতে পারেননি কথা ঠিক নয়, কেননা তিনি তার সুযোগ্য পুত্র আসাদ শিরাজীকে রেখে গেছেন যিনি পিতার যোগ্য উত্তরসূরি এবং ধনরত্ন অপেক্ষা কম নন। যাই হোক, পিতার সেই সাধনার পুত্র আসাদ শিরাজী ‘বাণীকুঞ্জের’ পূর্ব গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারিবারিকভাবে এক বিঘা জমি মাজারের নামে ওয়াকফ করার ব্যবস্থা করেন। এবং পিতা গাজী শিরাজীর শেষ ইচ্ছে পূরণের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় যে মাজারের সামনে একটি মসজিদ নির্মাণ করা হবে। সেখানে ওয়াক্তিয়া ও জুমার নামাজ ছাড়াও নিয়মিত কোরআন শরিফ তাফসির ও হাদিস শরিফের আলোচনা এবং ধর্মীয় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা থাকবে। মসজিদ ও স্মৃতিসৌধের পশ্চিম পাশে একটি সভাকক্ষ, গ্রন্থাগার, মোসাফিরখানা, সাহিত্য ও সমাজবিষয়ক গবেষণাগার থাকবে। এখানে মাঝেমধ্যে সাহিত্য সভার আয়োজন করা হবে এবং বিশিষ্ট পণ্ডিত ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ করে ধর্ম, সাহিত্য, সমাজবিজ্ঞানের ওপর বক্তৃতা ও আলোচনার ব্যবস্থা থাকবে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রতিদিন জ্ঞানী-গুণী ও সাধারণ মানুষ আসে শিরাজীর মাজার জিয়ারতের জন্য। মাজারসংলগ্ন মোসাফিরখানা তাদের অবস্থানের জন্য ব্যবহৃত হবে। শিরাজী ছিলেন অত্যন্ত গুল্মপ্রিয়, স্বহস্তে উদ্যান রচনা ও ফুলগাছগুলোর পরিচর্যা করা ছিল তাঁর শখ। তাই স্মৃতিসৌধের দক্ষিণ দিকে একটি ক্ষুদ্রাকার গুল্মোদ্যান ও ফোয়ারা তৈরির পরিকল্পনা করা হয়। সর্বসাকুল্যে ওই সময়ে এর ব্যয় ধরা হয়েছিল লক্ষাধিক টাকা। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পিতার প্রার্থনার পুত্র শেষ পর্যন্ত তার সাধারণ পরিকল্পনা শেষ রক্ষা করতে পারলেন না।
১৯৭১ সালের ২৪ ডিসেম্বর সুপরিকল্পিতভাবে সৈয়দ আসাদউদ্দৌলা শিরাজীকে হত্যা করার পর থেকে পরিকল্পনাটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। পরিকল্পনার নীলনকশাই স্মৃতি আকারে রয়েছে, যার বাস্তবরূপ হচ্ছে না।
কবি-সাহিত্যিক ও লেখকরা শিরাজীর রচনাসম্ভার থেকে যেমন অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন, তেমনি তাঁর কর্মস্থলে জীবনের ঘটনা জুগিয়েছে চলার পথের পাথেয়। দেশ ও জাতির জন্য যিনি নিরলসভাবে সারা জীবন সাধনা করে গেছেন, কালজয়ী এই জাতীয় পুরুষের প্রতি যথোপযুক্ত সম্মান প্রদর্শন করা, তাঁর স্মৃতিচিহ্নকে জাগিয়ে রাখা জাতির অবশ্য কর্তব্য হলেও শিরাজীর ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য হয়নি।
সিরাজী স্বদেশ ও স্বজাতির কল্যাণব্রতী এক চিন্তানায়ক, জাতীয় জীবন গঠনের জন্য তার অসাধারণ ত্যাগ ও কর্মপ্রচেষ্টা আত্মবিশ্বাসহীন জাতির প্রাণে নবচেতনার সঞ্চার করেছিল একথা দ্বিধাহীন চিত্তে বলা যায়। অথচ তার রচিত গ্রন্থগুলো বাজারে পাওয়া যায় না। বাংলা একাডেমী শিরাজী রচনাবলীটিও ছাপানোর দিকে দৃষ্টি দিচ্ছে না। ফলে আজকের স্বাধীন দেশের মাটিতে বসে এ প্রজন্মের পক্ষে শিরাজী এবং তার সহকর্মীদের ভূমিকা অনুধাবন করা সত্যিই কঠিন। কালের ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়ার মতো পুরনো তিনি নন। তাকে জানতে হলে ইতিহাস জানতে হবে। সে ইতিহাস জাতির স্বার্থেই আমাদের জানা প্রয়োজন।
সূত্র : আমার দেশ
No comments:
Post a Comment