কথাটা শুনেই জোনাব আলীর মুখ বিকৃত হয়ে গেলো- বলে কি? এত কাজ কি একদিনে করা সম্ভব? আতা, অফিস সহকারী আতাউর তার পাশের চেয়ারে বসা ছিলো-সে বললো সম্ভব না হলে যাও প্রিন্সিপালকে বলে এসো।
-হ্যাঁ তাই যাব। সারা বছরের কাজ কি একদিনে করা যায়?
প্রিন্সিপাল আজহারুল ইসলাম পাশের রুমেই ছিলেন-তিনি কলিং বেল বাজালেন। বকুলি গিয়ে হাজির হলো-প্রিন্সিপাল বললেন, -বুয়া। শান্তি কোথায়?
প্রিন্সিপাল-পিয়ন শান্তি রানী সাহা আর ঝাড়ুদার বকুলিকে বুয়া বলে ডাকেন।
-স্যার শান্তি তো-আসে নাই আসতে দেরী হবে।
-রোজই তার দেরি হয়, কোন সময়ই তাকে ডাকলে পাওয়া যায় না। আগামীকাল আউট, অফিসে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে শান্তির দেখা নাই। জোনাব আলীকে ডাক। জোনাব আলীকে ডাকার আগেই সে এসে হাজির হলো- এতক্ষণ দর্জার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো।
-স্যার।
-শুনছেন তো-কাল আউট হবে।
-জ্বি স্যার। কিন্তু...?
-কোনো কিন্তু নয়। আজ রাতের মধ্যে সব কাজ সারবেন। কলেজ এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। এখন অডিটে কোনো ঘাপলা হলে আর কোনোদিনই আমাদের একপিও'র মুখ দেখতে হবে না।
-এত কাজ স্যার-একা কিভাবে করবো?
-এতদিন তো একাই করেছেন-আতাউর-সাব তো বোর্ড অফিসে দৌড়াদৌড়ি' সভাপতির কাছে যাওয়া আসা আর ছাত্রদের বেতন তোলা নিয়ে ব্যস্ত।
-জানি স্যার।
-জানেন-তবে করছেন না কেন? কলেজ হয়েছে ষোল বছর, জানেন না বছর বছর অডিট হয়?
-জানি স্যার। এখানে যা পাই তাতে তো কিছুই হয় না। বাড়িতে দোকান করি টিউশনি করি। কোনো কোনো সময় নিজের জমিতেও কাজ করি।
-আপনারা সামান্য বেতন পান-আর আমি কি খুব বেশি পাই। কলেজের আয় কোথায়? ছাত্র-ছাত্রীরা তো বেতনই দিতে চায় না। টিএনও'র হাতে-পায়ে ধরে দু'টো পুকুর লিজ নিয়েছি, বছরে চার পাঁচ লাখ টাকা আসে-এর মধ্যে কতজনকে কতভাবে খুশি রাখতে হয়।
প্রিন্সিপাল আজহারুল ইসলাম বাউনবীর। খর্বাকৃতি, তিনি হাফশার্ট গায়ে, সাদা প্যান্ট পরে সাইকেল নিয়ে কলেজে আসেন। দড়িবহর থেকে বালিয়াটি আসতে তার দেড় দুই ঘণ্টা চলে যায়। এজন্য রোজ তার দর্শন মিলে না। দু'চারদিন পর পর কলেজে আসেন। ছাত্ররাও নিয়মিত আসে না- তবে শিক্ষকদের মধ্যে ইংরেজির এম কে রহমান খান, বাংলার রতন চন্দ্র বালু, কৃষির সিরাজুল ইসলাম আর সমাজ কল্যাণের মুন্নী রানী সরকার নিয়মিত আসেন।
-স্যার অডিট কয়দিন চলবে? জোনাব আলী জানতে চাইলো।
-হিসাব-কিতাব ঠিক থাকলে একদিনেই শেষ করতে পারবো।
-স্যার অডিট তো শুধু হিসাব-কিতাবের ব্যাপার নয়, ছাত্র হাজিরা, শিক্ষক হাজিরা আর-
-আর কি? খাতাপত্র ঠিকঠাক রাখুন।
জোনাব আলী আর কথা বাড়ালো না।
কথা বাড়িয়েও লাভ নেই, তিন মাসের বেতন বাকি বালু বাবু তো সেদিন বলেই গেছেন, এবার তিনি প্রিন্সিপালের সাথে ফাইনাল আলাপ করবেন। এভাবে কি কলেজ চলে?
ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল একদিন আসেন তো তিনদিন আসেন না। বেতনের বেলায় কথা নেই, শুধু কাজ কর। কাজ কি শুধু কেরানী আর একাউন্ট্যান্ট করবে! প্রিন্সিপালের কাজ নেই!
প্রিন্সিপাল বোধ হয়- জোনাব আলীর নীরবতা দেখে বিষয়টি অাঁচ করতে পারলেন-
-জোনাব আলী সাব, ধৈর্য ধরুন। এমপিওটা হয়ে গেলে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
-সেটা তো পরের কথা স্যার। এখন কি করবো-
-তিন মাসের বেতন বাকি।
-পুকুরের টাকা পেলেই দিয়ে দিব। এমন সময় প্রবেশ করলো রহমান।
-রহমান সাব।
-জ্বি!
অডিট এসে গেছে-টাকা পয়সা খরচ হবে, আপনাদের এ মাসেও বেতন দিতে পারবো না।
-রহমান চুপ করে রইলেন।
-চুপ করে আছেন কেন?
-কী বলবো? আমাদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট সিরাজ সাহেব-তাকে বলুন।
২.
জোনাব আলী আগেই বের হয়ে গিয়ে টিচার্স রুমে সিরাজ সাহেবকে ব্যাপারটা জানিয়েছিল সিরাজ সাহেব বললেন, আমি গিয়ে কি করবো, যেখানে আমার কথার কোন মূল্য নাই, সেখানে যেতে চাই না। বালু বাবু তার মেদবহুল দেহের ভুঁড়ি নাড়াতে নাড়াতে বললেন, কিছু বলা উচিত। উনি নিজের জন্য বেতন নিবেন, কনভেন্স নিবেন, মোবাইলের টাকা নিবেন আর আমরা খেটে মরবো।
সিরাজ সাহেব বললেন, বালু সাহেব, আমি সব জানি। এমপি'র কথা বলে এখানে আগে যেসব শিক্ষক ছিল সবার কাছ থেকেই টাকা নেয়া হয়েছে।
-তারা কিছু বলে না কেন?
-বলতে বলতে হয়রান হয়ে অন্য জায়গায় চাকরি নিয়েছে।
-এখনতো আমরা চারজন এই কলেজটা টিকিয়ে রেখেছি-সিরাজ সাহেব, রহমান সাহেব, রতন চন্দ্র বালু আর মুন্নী সরকার। এরা চারজনে মুখোমুখি বসে থাকে। ক্লাস অনিয়মিত। প্রিন্সিপাল এলে বালু বাবু সিরাজদ্দৌলাকে তাগিদ দেয়। সিরাজ সাহেব বলেন-
-কোনো লাভ হবে না। টাকা কুমীরের পেটে গেছে।
-কুমীর?
তারপর বালু বাবু কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে রহমান সাহেবের দিকে তাকান।
-দেখুন সিরাজ সাহেব-আমরা দুইজন বন্ধু টাকা টাকা বলে চিৎকার করি, রহমান সাহেব কিছুই বলেন না।
-রহমান নির্বিকার। মুন্নী সরকার বলেন-
-আমি আসি।
-আসি মানে-বালু বাবু যেন অবাক হয়ে গেছেন। আজ টাকা ছাড়া যাব না। তিনি প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে ঢুকলেন-
-টাকা দেন।
বালু বাবুর এ রকম কথা বলার ধরন। ভূমিকা নেই-সৌজন্য প্রকাশ নেই, সোজাসুজি টাকার কথা। সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্টের পর সব মানুষই এ রকম হয়ে যায়। বালু বাবু সাটুরিয়া উপজেলার এটিও ছিলেন-অবসর নিয়েছেন তিন বছর। বালিয়াটি কলেজে আছেন দু' বছর ধরে। বালু বাবুর কথায় প্রিন্সিপাল প্রথম প্রথম হতভম্ব হতেন-এদিক-ওদিক তাকাতেন, রহমান সাহেব ধারে-কাছে থাকলে তাকে বলতেন, রহমান সাব, আপনি বাবুর সাথে কথা বলুন।
রহমানকে জড়ানোর কারণ হলো-রহমানই বালু বাবুকে এ কলেজে এনেছেন। বাংলার টিচার নেই। বাংলা ভাইটাল সাবজেক্ট-এ কারণে একজন টিচার দরকার। বালু বাবু সাটুরিয়ায় তাকে, রহমানের সাথে তার খাতির-দুইজন মানিকজোড়, একসাথে চা খায়। ঘোরাঘুরি করে।
-বালিয়াটি কলেজের কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলেন বালু বাবু, এমএ বিএড, এলএলবি, আদ্য, মধ্য, উপাধি।
প্রিন্সিপাল বললেন, দেখুন বালু বাবু, আপনি তো এখন রিটায়ার্ড, পেনশন পান। কলেজে আছেন এতে আপনার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে-এত টাকা টাকা করেন কেন?
বালু বাবু এবার গ্যাস লাইটের মতো জ্বলে উঠলেন-কি বললেন, কলেজে আছি বলে আমার মর্যাদা বেড়ে যাচ্ছে, আমি শিক্ষা অফিসার, এডভোকেট আমার সামাজিক মর্যাদা কি কম? তারপর তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের নাম ধরে বলতে লাগলেন, সিরাজ সাহেব টাকা চায় না, রহমান সাহেবও চুপচাপ আর মুন্নী তো এমপিও করানোর জন্য টাকা দিয়ে বসে আছে সব রতন চন্দ্র বালুকে করতে হবে সব। বালু বাবু বেরিয়ে গেলেন।
প্রিন্সিপাল এবার ডাকলেন বুয়া।
বকুলি এসে হাজির হলো-বকুলি মধ্যবয়সী মহিলা, এক ছেলে দুই মেয়ে, দু'মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি ভ্যানগাড়ি চালায়। স্বামী নেই বিধবা-শোনা যায় আবার নাকি বিয়ে করেছে কিন্তু কেউ জানতে চাইলে বলে, আর মাতা বেচুম না।
-বলেন স্যার।
-জোনাব আলীকে ডাকো।
-জোনাব স্যার তো চইল্যা গেছে। খাতাপত্র নিয়া, বাড়িতে হিসাব-কিতাব করবো।
-ঠিক আছে।
প্রিন্সিপাল তার দফতর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় সাইকেলটির সিট রুমাল দিয়ে ঝাড়লেন, তারপর ঠেলে নামালেন বারান্দা থেকে, না প্রিন্সিপালের সাইকেলে করে আসা শোভা পায় না। একটা হোন্ডা দরকার। সামনে গভর্নিং বডির মিটিংয়ে কথা তুলবেন, কলেজ থেকে যদি হোন্ডার জন্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা লোন নেয়া যায়, তাহলে বাকি টাকা অন্যভাবে যোগাড় হয়ে যাবে।
এমপিও যে এবার হবে না, এটা তিনি বুঝে গেছেন-কিন্তু মুখ খুলতে পারছেন না। দেখা যাক-অডিটে কি হয়, কোন ভাউচারই তো ভাউচার নয়, নিজের খরচ। সব কিছু টাকা দিয়ে ঠিক করতে হবে আর এ কাজটা করতে হবে আজই। তিনি সাইকেলে চড়ে প্যাডেল ঘোরাতে লাগলেন।
সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম
-হ্যাঁ তাই যাব। সারা বছরের কাজ কি একদিনে করা যায়?
প্রিন্সিপাল আজহারুল ইসলাম পাশের রুমেই ছিলেন-তিনি কলিং বেল বাজালেন। বকুলি গিয়ে হাজির হলো-প্রিন্সিপাল বললেন, -বুয়া। শান্তি কোথায়?
প্রিন্সিপাল-পিয়ন শান্তি রানী সাহা আর ঝাড়ুদার বকুলিকে বুয়া বলে ডাকেন।
-স্যার শান্তি তো-আসে নাই আসতে দেরী হবে।
-রোজই তার দেরি হয়, কোন সময়ই তাকে ডাকলে পাওয়া যায় না। আগামীকাল আউট, অফিসে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে শান্তির দেখা নাই। জোনাব আলীকে ডাক। জোনাব আলীকে ডাকার আগেই সে এসে হাজির হলো- এতক্ষণ দর্জার পাশে দাঁড়িয়ে সব শুনছিলো।
-স্যার।
-শুনছেন তো-কাল আউট হবে।
-জ্বি স্যার। কিন্তু...?
-কোনো কিন্তু নয়। আজ রাতের মধ্যে সব কাজ সারবেন। কলেজ এখনো এমপিওভুক্ত হয়নি। এখন অডিটে কোনো ঘাপলা হলে আর কোনোদিনই আমাদের একপিও'র মুখ দেখতে হবে না।
-এত কাজ স্যার-একা কিভাবে করবো?
-এতদিন তো একাই করেছেন-আতাউর-সাব তো বোর্ড অফিসে দৌড়াদৌড়ি' সভাপতির কাছে যাওয়া আসা আর ছাত্রদের বেতন তোলা নিয়ে ব্যস্ত।
-জানি স্যার।
-জানেন-তবে করছেন না কেন? কলেজ হয়েছে ষোল বছর, জানেন না বছর বছর অডিট হয়?
-জানি স্যার। এখানে যা পাই তাতে তো কিছুই হয় না। বাড়িতে দোকান করি টিউশনি করি। কোনো কোনো সময় নিজের জমিতেও কাজ করি।
-আপনারা সামান্য বেতন পান-আর আমি কি খুব বেশি পাই। কলেজের আয় কোথায়? ছাত্র-ছাত্রীরা তো বেতনই দিতে চায় না। টিএনও'র হাতে-পায়ে ধরে দু'টো পুকুর লিজ নিয়েছি, বছরে চার পাঁচ লাখ টাকা আসে-এর মধ্যে কতজনকে কতভাবে খুশি রাখতে হয়।
প্রিন্সিপাল আজহারুল ইসলাম বাউনবীর। খর্বাকৃতি, তিনি হাফশার্ট গায়ে, সাদা প্যান্ট পরে সাইকেল নিয়ে কলেজে আসেন। দড়িবহর থেকে বালিয়াটি আসতে তার দেড় দুই ঘণ্টা চলে যায়। এজন্য রোজ তার দর্শন মিলে না। দু'চারদিন পর পর কলেজে আসেন। ছাত্ররাও নিয়মিত আসে না- তবে শিক্ষকদের মধ্যে ইংরেজির এম কে রহমান খান, বাংলার রতন চন্দ্র বালু, কৃষির সিরাজুল ইসলাম আর সমাজ কল্যাণের মুন্নী রানী সরকার নিয়মিত আসেন।
-স্যার অডিট কয়দিন চলবে? জোনাব আলী জানতে চাইলো।
-হিসাব-কিতাব ঠিক থাকলে একদিনেই শেষ করতে পারবো।
-স্যার অডিট তো শুধু হিসাব-কিতাবের ব্যাপার নয়, ছাত্র হাজিরা, শিক্ষক হাজিরা আর-
-আর কি? খাতাপত্র ঠিকঠাক রাখুন।
জোনাব আলী আর কথা বাড়ালো না।
কথা বাড়িয়েও লাভ নেই, তিন মাসের বেতন বাকি বালু বাবু তো সেদিন বলেই গেছেন, এবার তিনি প্রিন্সিপালের সাথে ফাইনাল আলাপ করবেন। এভাবে কি কলেজ চলে?
ভারপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল একদিন আসেন তো তিনদিন আসেন না। বেতনের বেলায় কথা নেই, শুধু কাজ কর। কাজ কি শুধু কেরানী আর একাউন্ট্যান্ট করবে! প্রিন্সিপালের কাজ নেই!
প্রিন্সিপাল বোধ হয়- জোনাব আলীর নীরবতা দেখে বিষয়টি অাঁচ করতে পারলেন-
-জোনাব আলী সাব, ধৈর্য ধরুন। এমপিওটা হয়ে গেলে সব কষ্ট দূর হয়ে যাবে।
-সেটা তো পরের কথা স্যার। এখন কি করবো-
-তিন মাসের বেতন বাকি।
-পুকুরের টাকা পেলেই দিয়ে দিব। এমন সময় প্রবেশ করলো রহমান।
-রহমান সাব।
-জ্বি!
অডিট এসে গেছে-টাকা পয়সা খরচ হবে, আপনাদের এ মাসেও বেতন দিতে পারবো না।
-রহমান চুপ করে রইলেন।
-চুপ করে আছেন কেন?
-কী বলবো? আমাদের মধ্যে সিনিয়র মোস্ট সিরাজ সাহেব-তাকে বলুন।
২.
জোনাব আলী আগেই বের হয়ে গিয়ে টিচার্স রুমে সিরাজ সাহেবকে ব্যাপারটা জানিয়েছিল সিরাজ সাহেব বললেন, আমি গিয়ে কি করবো, যেখানে আমার কথার কোন মূল্য নাই, সেখানে যেতে চাই না। বালু বাবু তার মেদবহুল দেহের ভুঁড়ি নাড়াতে নাড়াতে বললেন, কিছু বলা উচিত। উনি নিজের জন্য বেতন নিবেন, কনভেন্স নিবেন, মোবাইলের টাকা নিবেন আর আমরা খেটে মরবো।
সিরাজ সাহেব বললেন, বালু সাহেব, আমি সব জানি। এমপি'র কথা বলে এখানে আগে যেসব শিক্ষক ছিল সবার কাছ থেকেই টাকা নেয়া হয়েছে।
-তারা কিছু বলে না কেন?
-বলতে বলতে হয়রান হয়ে অন্য জায়গায় চাকরি নিয়েছে।
-এখনতো আমরা চারজন এই কলেজটা টিকিয়ে রেখেছি-সিরাজ সাহেব, রহমান সাহেব, রতন চন্দ্র বালু আর মুন্নী সরকার। এরা চারজনে মুখোমুখি বসে থাকে। ক্লাস অনিয়মিত। প্রিন্সিপাল এলে বালু বাবু সিরাজদ্দৌলাকে তাগিদ দেয়। সিরাজ সাহেব বলেন-
-কোনো লাভ হবে না। টাকা কুমীরের পেটে গেছে।
-কুমীর?
তারপর বালু বাবু কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে রহমান সাহেবের দিকে তাকান।
-দেখুন সিরাজ সাহেব-আমরা দুইজন বন্ধু টাকা টাকা বলে চিৎকার করি, রহমান সাহেব কিছুই বলেন না।
-রহমান নির্বিকার। মুন্নী সরকার বলেন-
-আমি আসি।
-আসি মানে-বালু বাবু যেন অবাক হয়ে গেছেন। আজ টাকা ছাড়া যাব না। তিনি প্রিন্সিপালের রুমে গিয়ে ঢুকলেন-
-টাকা দেন।
বালু বাবুর এ রকম কথা বলার ধরন। ভূমিকা নেই-সৌজন্য প্রকাশ নেই, সোজাসুজি টাকার কথা। সরকারি চাকরি থেকে রিটায়ারমেন্টের পর সব মানুষই এ রকম হয়ে যায়। বালু বাবু সাটুরিয়া উপজেলার এটিও ছিলেন-অবসর নিয়েছেন তিন বছর। বালিয়াটি কলেজে আছেন দু' বছর ধরে। বালু বাবুর কথায় প্রিন্সিপাল প্রথম প্রথম হতভম্ব হতেন-এদিক-ওদিক তাকাতেন, রহমান সাহেব ধারে-কাছে থাকলে তাকে বলতেন, রহমান সাব, আপনি বাবুর সাথে কথা বলুন।
রহমানকে জড়ানোর কারণ হলো-রহমানই বালু বাবুকে এ কলেজে এনেছেন। বাংলার টিচার নেই। বাংলা ভাইটাল সাবজেক্ট-এ কারণে একজন টিচার দরকার। বালু বাবু সাটুরিয়ায় তাকে, রহমানের সাথে তার খাতির-দুইজন মানিকজোড়, একসাথে চা খায়। ঘোরাঘুরি করে।
-বালিয়াটি কলেজের কথা বলতেই রাজি হয়ে গেলেন বালু বাবু, এমএ বিএড, এলএলবি, আদ্য, মধ্য, উপাধি।
প্রিন্সিপাল বললেন, দেখুন বালু বাবু, আপনি তো এখন রিটায়ার্ড, পেনশন পান। কলেজে আছেন এতে আপনার সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি পাচ্ছে-এত টাকা টাকা করেন কেন?
বালু বাবু এবার গ্যাস লাইটের মতো জ্বলে উঠলেন-কি বললেন, কলেজে আছি বলে আমার মর্যাদা বেড়ে যাচ্ছে, আমি শিক্ষা অফিসার, এডভোকেট আমার সামাজিক মর্যাদা কি কম? তারপর তিনি অন্যান্য শিক্ষকদের নাম ধরে বলতে লাগলেন, সিরাজ সাহেব টাকা চায় না, রহমান সাহেবও চুপচাপ আর মুন্নী তো এমপিও করানোর জন্য টাকা দিয়ে বসে আছে সব রতন চন্দ্র বালুকে করতে হবে সব। বালু বাবু বেরিয়ে গেলেন।
প্রিন্সিপাল এবার ডাকলেন বুয়া।
বকুলি এসে হাজির হলো-বকুলি মধ্যবয়সী মহিলা, এক ছেলে দুই মেয়ে, দু'মেয়েরই বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটি ভ্যানগাড়ি চালায়। স্বামী নেই বিধবা-শোনা যায় আবার নাকি বিয়ে করেছে কিন্তু কেউ জানতে চাইলে বলে, আর মাতা বেচুম না।
-বলেন স্যার।
-জোনাব আলীকে ডাকো।
-জোনাব স্যার তো চইল্যা গেছে। খাতাপত্র নিয়া, বাড়িতে হিসাব-কিতাব করবো।
-ঠিক আছে।
প্রিন্সিপাল তার দফতর থেকে বেরিয়ে বারান্দায় সাইকেলটির সিট রুমাল দিয়ে ঝাড়লেন, তারপর ঠেলে নামালেন বারান্দা থেকে, না প্রিন্সিপালের সাইকেলে করে আসা শোভা পায় না। একটা হোন্ডা দরকার। সামনে গভর্নিং বডির মিটিংয়ে কথা তুলবেন, কলেজ থেকে যদি হোন্ডার জন্য হাজার পঞ্চাশেক টাকা লোন নেয়া যায়, তাহলে বাকি টাকা অন্যভাবে যোগাড় হয়ে যাবে।
এমপিও যে এবার হবে না, এটা তিনি বুঝে গেছেন-কিন্তু মুখ খুলতে পারছেন না। দেখা যাক-অডিটে কি হয়, কোন ভাউচারই তো ভাউচার নয়, নিজের খরচ। সব কিছু টাকা দিয়ে ঠিক করতে হবে আর এ কাজটা করতে হবে আজই। তিনি সাইকেলে চড়ে প্যাডেল ঘোরাতে লাগলেন।
সূত্র : দৈনিক সংগ্রাম
No comments:
Post a Comment