রশীদ জমাদ্দারের নামের ‘জমাদ্দার’ বিশেষণটি তার অলৌকিক ক্ষমতাপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে রাতারাতি উঠে গেল। নামের ‘জমাদ্দার’ বিশেষণটির স্থলে ‘ফকির’ শব্দটি বসে তার নাম দাঁড়াল রশীদ ফকির।
একদিন শেষরাতের দিকে রশীদ জমাদ্দার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। তার বউ রাহীর ঘুম বেশ পাতলা। কোলের বাচ্চাটা বেশ জ্বালায়। মায়ের স্তনের বোঁটা মুখে নিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস ওর। বাচ্চাকে দুধ দিতে দিতে রাহী আলগোছে ঘুমিয়ে পড়ে। আর থেকে থেকে বাচ্চাটি বারবার কেঁদে উঠে মায়ের স্তন-বোঁটা চুষতে থাকে।
ঘুমাতে গিয়ে বাচ্চাটির মতো বাচ্চার বাবাও কি রাহীকে কম জ্বালায়? নানা কারণে রাহীর ঘুম গাঢ় হওয়ার উপায় নেই। তাই শেষ রাতের দিকে স্বামী যখন বিছানা ছেড়ে বাইরে বের হলো, রাহী তা টের পেল। তবে টের পাওয়াই সই, মুহূর্তে তন্দ্রা ভর করল রাহীর চোখে। কিন্তু বাচ্চাটি আবার যখন কেঁদে উঠল তন্দ্রা ভেঙে রাহী দেখল তার স্বামী তখনও বিছানায় ফেরেনি। রাত তখনও শেষ হয়নি—এই অনুমান রাহীর আছে। আরেক অনুমান, তার স্বামী হয়তো প্রস্রাব-পায়খানার উদ্দেশে ঘরের বাইরে নেমেছে! তাই সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে খুঁজে না পেয়ে রাহীর কেমন ভয় ভয় লাগে! দ্রুত ঘরে ঢুকে শাশুড়ির ঘুম ভাঙায় সে। ছেলের টানে বৃদ্ধা মা তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে একদম উঠোনে এসে দাঁড়ায়। আর ঘুম ঘুম চোখে ‘রইশ্যা’ ‘রইশ্যা’ বলে ডাকতে থাকে। আর রাহী শুক্কুরের বাপ বলে ডাকতে ডাকতে একশেষ।
বউ-শাশুড়ির ডাকাডাকিতে উঠোনঘেরা বাকি তিনটি ঘরের লোকের ঘুম ভাঙে। বিছানায় শুয়েই বয়স্করা গলা হাঁকে, ‘অইচে কী? রইশ্যা গ্যাছে কই?’
রশীদ জমাদ্দারের মা বলে, ‘রইশ্যারে দেহি না। ঘরে গোনে নাইম্যা কোমনে যে গ্যাছে!’
বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক লোক করিম জমাদ্দার বলল, কও কী মাতারি! এই শ্যাষ রাইতে জুয়ান ব্যাডাডা যাইবে কই?
আস্তে আস্তে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙল। এমনকি রাহীর বাচ্চাটিরও। সবাই বাইরে নেমে এলো। পুরুষরা উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নামল। ততক্ষণে অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে এসেছে।
কিন্তু রশীদ জমাদ্দারকে কোথায় খোঁজা যাবে?
আশপাশের আরও দু-চার বাড়ির নামাজি মানুষ ফজরের নামাজ পড়তে বেরিয়ে তারাও জানল এই ঘটনা। এক-দুই কান হতে হতে সবার দৃষ্টি যখন রশীদ জমাদ্দারকে খুঁজতে লাগল, তখন কোনো একজনের চোখে পড়ল, বাড়ির উত্তর দিকের জঙ্গলে একমনে হেঁটে বেড়াচ্ছে রশীদ জমাদ্দার। যেন নিগূঢ় চিন্তায় মগ্ন এবং প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ—এমন ভঙ্গিতে পা ফেলছে আর এগাছ-ওগাছ খুঁটিয়ে দেখছে; লতাপাতা তুলে নিচ্ছে হাতে।
গুঞ্জন ছড়াতে সময় লাগে না, রশীদ জমাদ্দারের ওপর অলৌকিক ক্ষমতা ভর করেছে!
রশীদ জমাদ্দর অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে কি না কে জানে, কিন্তু তিন-চার দিনের মাথায় তাকে ঘিরে গুঞ্জন একটু বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আনাড়ি লোকরা মগ-গ্লাস ভরে পানি নিয়ে এলো তাতে রশীদ জমাদ্দারের দম নেয়ার জন্য। কেউ বানিয়ার দোকান থেকে মাদুলি আনল, কেউ লতাপাতার রস সেবন করতে এলো। রশীদ জমাদ্দারকে সবাই ‘ফকির’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করল।
রশীদ ফকির দেখল কেউ কেউ দু-চার-পাঁচ টাকা খুব ভক্তির সঙ্গে তার পায়ের কাছে রাখছে। এতে একটা আয়ের পথ তৈরি হয়েছে তার। দরিদ্র ঘর। এর-ওর ক্ষেতখামারে বদলা দিতে হয়। এমন একটা আয়ের পথ তৈরি হলে মন্দ কী? তাছাড়া গ্রামে একটা রব উঠেছে—শুধু গ্রামে কেন, রশীদ ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতার খবর ছড়িয়েছে দূর-দূরান্তেও। তাই বাড়িতেও লোকজনের ভিড় লেগে থাকে। সে কারণে সকাল-বিকাল ফকিরকে ঘরেই কাটাতে হয়।
কিন্তু মাস ছয়েক পর ফকির যখন দেখল তার বাড়িতে লোকজনের ভিড় আগের চেয়ে কিছুটা কম, ফকির তখন নিজের কাছে প্রশ্ন রাখে—তার দাওয়াইতে কি কাজ হয়? নইলে হঠাত্ ওঠা দরটা হঠাত্ই পড়ে যেতে পারে—এ নিয়ে শঙ্কা ঢুকে গেল ফকিরের মনে। তেমন হলে তো আগের অবস্থানে ফিরে যেতে হবে। ভাতের জন্য কামলা খাটতে হবে। গেরস্থবাড়িতে ধান ভানতে যেতে হবে রাহীকে। শঙ্কিত মনেও রশীদ ফকিরের চৌত্রিশ বছর আগের কথা মনে পড়ে। গ্রামের লোকেরা তাকে নিয়ে আরেকবার মেতে উঠেছিল তখন। গ্রামে ফেরার পর প্রতিটি মানুষ কেমন অদ্ভুত চোখে দেখত তাকে! তার প্রতি লোকজনের কোমল দৃষ্টি যেন অন্য কিছু বলত! রশীদ জমাদ্দার এসব বেশ উপভোগ করত। তার উধাও হওয়া নিয়ে গ্রামের মানুষ কত না গল্প ফেঁদেছে!
গ্রামের হাটে উঠলে কত লোক জোর করে চা খাওয়াত! যুদ্ধের কথা জানতে চাইত। সেসব কথা বলতে বলতে অনেক সময় কেটে যেত। আর নদীর তীর ভাঙার মতো একে একে রশীদ জমাদ্দারের ভাবনা তীর ভাঙত তাকে নিয়ে গ্রামের মানুষের নানা ভাবনার কথা জেনে। রশীদ জমাদ্দারের মনে হতো, গ্রামে সে যেন একটুকরো রত্নে পরিণত হয়েছে। তাকে নিয়ে লোকজনের মাতামাতি কিছুদিন গরম জিলাপির মতো চলল। তারপর মিয়ানো মুড়ির মতো হয়ে উঠল তা। এমনটা স্বাভাবিক। কেননা এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতার ছিটেফোঁটাও লাগেনি। মিলিটারিরা জেলা শহর পর্যন্ত এসে ঠাঁই গেড়েছিল। জেলা শহর থেকেই থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম তদারকি করিয়েছে রাজাকার-আলবদরদের দিয়ে। ওই পর্যন্তই। শুধু গ্রামের সেকান্দার খাঁকে ঘিরে গ্রামবাসীর মনে একটু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল প্রথম দিকে। পরে তা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। কেননা সেকান্দার খাঁ-ই খবর নিয়ে এসেছিল রশীদ জমাদ্দার যুদ্ধে গেছে।
রশীদ জমাদ্দার তখন মংলা বন্দরে কুলির কাজ করত। তিন মাস অন্তর একবার গ্রামে আসত। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রশীদ জমাদ্দারের আর গ্রামে আসার নাম-গন্ধ নেই। স্বামীর খবরের জন্য রাহী শহর থেকে ফেরা মানুষের কাছে যেত—হোক তারা ঢাকা থেকে কিংবা অন্য কোথাও থেকে গ্রামে আসা লোকজন।
স্বামীর কোনোরকম খোঁজখবর না পাওয়ায় রাহী স্বামীর পথ চেয়ে যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁদত।
একবার খবর ছড়াল—পাকবাহিনী মংলা বন্দরে অনেক লোক মেরে ফেলেছে। তাদের মধ্যে রশীদ জমাদ্দারও আছে।
কিন্তু মিলিটারিরা জেলা শহরে আসার পর কীসব কমিটি-টমিটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেকান্দার খাঁ। হঠাত্ তার মুখে রাজনীতির কথাটথা শোনা যেত। মুসলিম লীগের গুণকীর্তন করে বেড়াত সে। তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ানোর মতো কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জুটে গিয়েছিল। আর এভাবেই সেকান্দার খাঁ নিজেকে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাবতে শুরু করেছিল। সে-ই খবর এনেছিল, রশিদ জমাদ্দার যুদ্ধে গেছে। এই খবরটা ছড়িয়ে সেকান্দার খাঁ তার অন্য এক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। মূলত সে ভেবেছিল, মুসলিম লীগ প্রিয় গ্রামের মানুষের মানসিকতায় রশীদ জমাদ্দারের পাকিস্তানবিরোধিতা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। এই সুযোগে সে রশীদ জমাদ্দারের পরিবারটিকে নাজেহাল করবে। পরিবার বলতে সেকান্দার খাঁর দৃষ্টি রাহীর দিকে। সে অনেক আগে থেকেই। রশীদ জমাদ্দার রাহীকে বিয়ে করে আনার পর রাহীর শরীরটা তার চোখে ভেসে উঠলে সে এক অতুল যন্ত্রণায় ছটফট করে। সে যন্ত্রণা লাঘবের সুযোগ খুঁজছিল সেকান্দার খাঁ। রশীদ জমাদ্দারের যুদ্ধে যাওয়াটা তার জন্য সুযোগ এনে দিল—সেকান্দার খাঁ এমন করেই ভেবেছিল। আর পাকিস্তানি মিলিটারির কাছে রশীদ জমাদ্দারের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার খবর পৌঁছলে কী ভয়াবহ হবে, সুযোগমত রাহীকে রাস্তায় একা পেয়ে সেকান্দার খাঁ সে কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। এ-ও বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, সে-ই পারে মিলিটারির হাত থেকে ওদের বাঁচাতে; রাহীকে রক্ষা করতে।
রাহী এই মারপ্যাঁচের কলাকৌশল কতটা বুঝেছে, কে জানে! কিন্তু সেকান্দার খাঁকে তার সুবিধের মনে হয়নি। দেশ, যুদ্ধ, মানুষ হিসেবে টিকে থাকা—এসব বোঝার ক্ষমতা রাহীর না থাকলেও সে এটুকু বুঝেছিল, সেকান্দার খাঁ কোনো এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত; সে ভালো কিছু করছে না। আর সেকান্দার খাঁ বুঝেছিল, স্বামীর কথা ভেবে তার কাছে অবনত হবে রাহী। সুযোগ তখন হাতের নাগালে আসবে। মোহগ্রস্তের মতো রাতের আঁধারে রাহীর ঘরের মুলিবাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে স্বর নামিয়ে রাহীকে ডাকত সেকান্দার খাঁ। কিন্তু রাহী অনড়, অটুট।
সেকান্দার খাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে একে একে। তারপর রশীদ জমাদ্দার যুদ্ধ থেকে ফিরলে সেকান্দার খাঁর দিন একটু ভয়ে ভয়ে কেটেছে—‘রইশ্যা গোল পাকাইলে মান-সম্মানের প্রশ্ন দ্যাহা দিব।’
রশীদ জমাদ্দার গ্রামে ফিরে সবই জেনেছে। কিন্তু কী কারণে সে সেকান্দার খাঁকে কিছু বলেনি, সেটা সে-ই জানে। সেকান্দার খাঁ যেমন তাকে এড়িয়ে চলত, সেকান্দার খাঁকেও এড়িয়ে চলত রশীদ জমাদ্দার।
যে গ্রামে যুদ্ধের আঁচ লাগেনি, সে গ্রামের মানুষ যুদ্ধফেরত এই মানুষটির দেশপ্রেমকেও সরল গ্রাম্যতায় ঢেকে দেবে একসময়—দরিদ্র-অশিক্ষিত রশীদ জমাদ্দারের পক্ষে তা এতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করার কথা নয়। তবে এই গ্রামে যেমন একজনই মুক্তিযোদ্ধা আছে, রাজাকারও তেমনি সেকান্দার খাঁ একাই—বিষয়টি ভেবে এখনও মজা পায় রশীদ জমাদ্দার। আর সেকান্দার খাঁর প্রতি তাই সব ঘৃণা রশীদ জমাদ্দারের বুকের গভীরে তলানির মতো জমেছিল—কখনও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশ বছর পরে এসে সেকান্দার খাঁকে একবার দেখে নিতে ইচ্ছে হলো রশীদ ফকিরের। দারিদ্রে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা মানুষটি অলৌকিক ক্ষমতার উছিলায় যখন কিছুটা আর্থিক সঙ্গতির মুখ দেখেছিল—হোক মিথ্যেয় জড়ানো উপার্জন—তাকে কিছুদিন আধপেটা অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কিছুদিন তার বউকে অন্যের বাড়ির কাজ করতে যেতে হয়নি; তার ছোট ছোট ছেলেগুলোকে পেটের দায়ে অন্যের ফরমাস খাটতে হয়নি; অকথ্য গালাগাল শুনতে হয়নি; তখন সেকান্দার খাঁ-ই লোক ঠকিয়ে খাওয়ার জন্য তার বিচার বসাতে চেয়েছিল। তখন চল্লিশ বছর ধরে জিইয়ে রাখা হিসাবটা একবার শানিয়ে নেয়ার ইচ্ছে জেগেছিল রশীদ ফকিরের। কিন্তু এখন সেকান্দার খাঁর দল বেশ ভারি। সে এখন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। তার পেছনে গ্রামের দু-চারজন লোক সব সময় দেহরক্ষীর মতো লেগে থাকে। লেগে থাকে সেকান্দার খাঁর ক্ষমতার আঠায়।
শিকারির ফাঁদে পা দেয়ার মতো সেকান্দার খাঁ এবার রশীদ ফকিরের ঘরমুখো হলো। সেকান্দার খাঁ যে স্বেচ্ছায় এসেছে তা নয়; সে বাধ্য হয়েছে। রশীদ ফকিরও টের পেয়ে গিয়েছিল, সেকান্দার খাঁর মস্তক অবনত হয়ে আসছে। কিন্তু তার ভেতরে অবদমিত দ্রোহ ক্রমে বেড়ে উঠছে। আর সেকান্দার খাঁ স্বেচ্ছায় সে জ্বালামুখে এসে ধরা দিচ্ছে। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার কারণে সুযোগ এবার আপনিতে হাতছাড়া হয়ে যায় ফকিরের। ছ’মাস ধরে সে শয্যাগত। রোগের ভার তাকে বিছানায় আঁকড়ে রেখেছে। সে দেখল, জীবনে আরেকবার তার দর উঠল। সে কারণে শুধু সেকান্দার খাঁ কেন, এবার গ্রামের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির পা পড়ল তার বাড়িতে। ফকিরকে তাদের প্রয়োজন। না, ঝাড়-ফুঁকের জন্য নয়, যেমন করে হোক রশীদ ফকিরকে একবার মঞ্চে উঠে দাঁড়াতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে হবে। আসছে বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেমন করে হোক একটা আয়োজন করার তাগিদ। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পর্যন্ত এ নিয়ে মহাব্যস্ত। আর গ্রামে তো এই একজনই মুক্তিযোদ্ধা—রশীদ জমাদ্দার কিংবা রশীদ ফকির।
ফকির জানতে পারল, বেশ বড় আয়োজন। ১৬ ডিসেম্বর হাইস্কুল মাঠে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। এ উপলক্ষে তাকে কিছু টাকা-পয়সাও দেয়া হতে পারে। আর অনুষ্ঠানে সেকান্দার খাঁ থাকবে প্রধান অতিথি।
এই প্রলোভন নিয়ে সেকান্দার খাঁ এলো রশীদ ফকিরের বাড়িতে। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল নানাভাবে—আরে মিয়া, শুধু কি একখান ক্রেস্ট, কিছু টাকাও পাবা। হেই টাকায় ডাক্তার দ্যাহাইতে পারবা।
রশীদ ফকির কারও সঙ্গেই হ্যাঁ-না করে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে। শারীরিক অক্ষমতাই কেবল দমিয়ে রাখে তাকে। একটি নয়, একাধিক রোগে আক্রান্ত সে। একবার কোনোমতে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছে, কিডনি রোগ, লিভারের রোগ, এমনকি শরীরে আরও অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। তবু রোগ তাকে দমিয়ে রাখতে পারত না, হাইস্কুল মাঠের অনুষ্ঠানে সে যেত। কিন্তু সেকান্দার খাঁ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তৃতা দেবে। সে বক্তৃতার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর কী তার কানে তীরের মতো বিঁধবে না! তাছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরে কেন এসবের প্রয়োজন হলো? এই লোকগুলো আরও আগেও তো এসব করতে পারত!
আয়োজন তবু থেমে থাকে না। আয়োজকদের বিশ্বাস, রশীদ ফকিরকে তারা রাজি করাবেই। এটা তাদের জন্য বেশ জরুরিও। কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের ব্যাপার আছে।
অক্ষম রশীদ ফকির খোঁজে নিজের নিস্তারের পথ।
একে রোগাক্রান্তি, অপরদিকে মানসিক টানাপড়েনে রশীদ ফকিরের রোগযন্ত্রণা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তাই প্রবলভাবে মুক্তির পথ খোঁজে সে।
একদিন শেষরাতের দিকে রশীদ জমাদ্দার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ল। তার বউ রাহীর ঘুম বেশ পাতলা। কোলের বাচ্চাটা বেশ জ্বালায়। মায়ের স্তনের বোঁটা মুখে নিয়ে ঘুমানোর অভ্যেস ওর। বাচ্চাকে দুধ দিতে দিতে রাহী আলগোছে ঘুমিয়ে পড়ে। আর থেকে থেকে বাচ্চাটি বারবার কেঁদে উঠে মায়ের স্তন-বোঁটা চুষতে থাকে।
ঘুমাতে গিয়ে বাচ্চাটির মতো বাচ্চার বাবাও কি রাহীকে কম জ্বালায়? নানা কারণে রাহীর ঘুম গাঢ় হওয়ার উপায় নেই। তাই শেষ রাতের দিকে স্বামী যখন বিছানা ছেড়ে বাইরে বের হলো, রাহী তা টের পেল। তবে টের পাওয়াই সই, মুহূর্তে তন্দ্রা ভর করল রাহীর চোখে। কিন্তু বাচ্চাটি আবার যখন কেঁদে উঠল তন্দ্রা ভেঙে রাহী দেখল তার স্বামী তখনও বিছানায় ফেরেনি। রাত তখনও শেষ হয়নি—এই অনুমান রাহীর আছে। আরেক অনুমান, তার স্বামী হয়তো প্রস্রাব-পায়খানার উদ্দেশে ঘরের বাইরে নেমেছে! তাই সম্ভাব্য জায়গাগুলোতে খুঁজে না পেয়ে রাহীর কেমন ভয় ভয় লাগে! দ্রুত ঘরে ঢুকে শাশুড়ির ঘুম ভাঙায় সে। ছেলের টানে বৃদ্ধা মা তড়িঘড়ি বিছানা ছেড়ে একদম উঠোনে এসে দাঁড়ায়। আর ঘুম ঘুম চোখে ‘রইশ্যা’ ‘রইশ্যা’ বলে ডাকতে থাকে। আর রাহী শুক্কুরের বাপ বলে ডাকতে ডাকতে একশেষ।
বউ-শাশুড়ির ডাকাডাকিতে উঠোনঘেরা বাকি তিনটি ঘরের লোকের ঘুম ভাঙে। বিছানায় শুয়েই বয়স্করা গলা হাঁকে, ‘অইচে কী? রইশ্যা গ্যাছে কই?’
রশীদ জমাদ্দারের মা বলে, ‘রইশ্যারে দেহি না। ঘরে গোনে নাইম্যা কোমনে যে গ্যাছে!’
বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক লোক করিম জমাদ্দার বলল, কও কী মাতারি! এই শ্যাষ রাইতে জুয়ান ব্যাডাডা যাইবে কই?
আস্তে আস্তে বাড়ির সবার ঘুম ভাঙল। এমনকি রাহীর বাচ্চাটিরও। সবাই বাইরে নেমে এলো। পুরুষরা উঠোন পেরিয়ে রাস্তায় নামল। ততক্ষণে অন্ধকার একটু ফিকে হয়ে এসেছে।
কিন্তু রশীদ জমাদ্দারকে কোথায় খোঁজা যাবে?
আশপাশের আরও দু-চার বাড়ির নামাজি মানুষ ফজরের নামাজ পড়তে বেরিয়ে তারাও জানল এই ঘটনা। এক-দুই কান হতে হতে সবার দৃষ্টি যখন রশীদ জমাদ্দারকে খুঁজতে লাগল, তখন কোনো একজনের চোখে পড়ল, বাড়ির উত্তর দিকের জঙ্গলে একমনে হেঁটে বেড়াচ্ছে রশীদ জমাদ্দার। যেন নিগূঢ় চিন্তায় মগ্ন এবং প্রতিটি পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ—এমন ভঙ্গিতে পা ফেলছে আর এগাছ-ওগাছ খুঁটিয়ে দেখছে; লতাপাতা তুলে নিচ্ছে হাতে।
গুঞ্জন ছড়াতে সময় লাগে না, রশীদ জমাদ্দারের ওপর অলৌকিক ক্ষমতা ভর করেছে!
রশীদ জমাদ্দর অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হয়েছে কি না কে জানে, কিন্তু তিন-চার দিনের মাথায় তাকে ঘিরে গুঞ্জন একটু বেশি মাত্রায় ছড়িয়ে পড়লে গ্রামের কুসংস্কারাচ্ছন্ন আনাড়ি লোকরা মগ-গ্লাস ভরে পানি নিয়ে এলো তাতে রশীদ জমাদ্দারের দম নেয়ার জন্য। কেউ বানিয়ার দোকান থেকে মাদুলি আনল, কেউ লতাপাতার রস সেবন করতে এলো। রশীদ জমাদ্দারকে সবাই ‘ফকির’ বলে সম্বোধন করতে শুরু করল।
রশীদ ফকির দেখল কেউ কেউ দু-চার-পাঁচ টাকা খুব ভক্তির সঙ্গে তার পায়ের কাছে রাখছে। এতে একটা আয়ের পথ তৈরি হয়েছে তার। দরিদ্র ঘর। এর-ওর ক্ষেতখামারে বদলা দিতে হয়। এমন একটা আয়ের পথ তৈরি হলে মন্দ কী? তাছাড়া গ্রামে একটা রব উঠেছে—শুধু গ্রামে কেন, রশীদ ফকিরের অলৌকিক ক্ষমতার খবর ছড়িয়েছে দূর-দূরান্তেও। তাই বাড়িতেও লোকজনের ভিড় লেগে থাকে। সে কারণে সকাল-বিকাল ফকিরকে ঘরেই কাটাতে হয়।
কিন্তু মাস ছয়েক পর ফকির যখন দেখল তার বাড়িতে লোকজনের ভিড় আগের চেয়ে কিছুটা কম, ফকির তখন নিজের কাছে প্রশ্ন রাখে—তার দাওয়াইতে কি কাজ হয়? নইলে হঠাত্ ওঠা দরটা হঠাত্ই পড়ে যেতে পারে—এ নিয়ে শঙ্কা ঢুকে গেল ফকিরের মনে। তেমন হলে তো আগের অবস্থানে ফিরে যেতে হবে। ভাতের জন্য কামলা খাটতে হবে। গেরস্থবাড়িতে ধান ভানতে যেতে হবে রাহীকে। শঙ্কিত মনেও রশীদ ফকিরের চৌত্রিশ বছর আগের কথা মনে পড়ে। গ্রামের লোকেরা তাকে নিয়ে আরেকবার মেতে উঠেছিল তখন। গ্রামে ফেরার পর প্রতিটি মানুষ কেমন অদ্ভুত চোখে দেখত তাকে! তার প্রতি লোকজনের কোমল দৃষ্টি যেন অন্য কিছু বলত! রশীদ জমাদ্দার এসব বেশ উপভোগ করত। তার উধাও হওয়া নিয়ে গ্রামের মানুষ কত না গল্প ফেঁদেছে!
গ্রামের হাটে উঠলে কত লোক জোর করে চা খাওয়াত! যুদ্ধের কথা জানতে চাইত। সেসব কথা বলতে বলতে অনেক সময় কেটে যেত। আর নদীর তীর ভাঙার মতো একে একে রশীদ জমাদ্দারের ভাবনা তীর ভাঙত তাকে নিয়ে গ্রামের মানুষের নানা ভাবনার কথা জেনে। রশীদ জমাদ্দারের মনে হতো, গ্রামে সে যেন একটুকরো রত্নে পরিণত হয়েছে। তাকে নিয়ে লোকজনের মাতামাতি কিছুদিন গরম জিলাপির মতো চলল। তারপর মিয়ানো মুড়ির মতো হয়ে উঠল তা। এমনটা স্বাভাবিক। কেননা এই গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের তীব্রতার ছিটেফোঁটাও লাগেনি। মিলিটারিরা জেলা শহর পর্যন্ত এসে ঠাঁই গেড়েছিল। জেলা শহর থেকেই থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম তদারকি করিয়েছে রাজাকার-আলবদরদের দিয়ে। ওই পর্যন্তই। শুধু গ্রামের সেকান্দার খাঁকে ঘিরে গ্রামবাসীর মনে একটু সন্দেহ দানা বেঁধেছিল প্রথম দিকে। পরে তা আরও গাঢ় হয়ে উঠেছিল। কেননা সেকান্দার খাঁ-ই খবর নিয়ে এসেছিল রশীদ জমাদ্দার যুদ্ধে গেছে।
রশীদ জমাদ্দার তখন মংলা বন্দরে কুলির কাজ করত। তিন মাস অন্তর একবার গ্রামে আসত। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর রশীদ জমাদ্দারের আর গ্রামে আসার নাম-গন্ধ নেই। স্বামীর খবরের জন্য রাহী শহর থেকে ফেরা মানুষের কাছে যেত—হোক তারা ঢাকা থেকে কিংবা অন্য কোথাও থেকে গ্রামে আসা লোকজন।
স্বামীর কোনোরকম খোঁজখবর না পাওয়ায় রাহী স্বামীর পথ চেয়ে যেখানে-সেখানে দাঁড়িয়ে কাঁদত।
একবার খবর ছড়াল—পাকবাহিনী মংলা বন্দরে অনেক লোক মেরে ফেলেছে। তাদের মধ্যে রশীদ জমাদ্দারও আছে।
কিন্তু মিলিটারিরা জেলা শহরে আসার পর কীসব কমিটি-টমিটি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল সেকান্দার খাঁ। হঠাত্ তার মুখে রাজনীতির কথাটথা শোনা যেত। মুসলিম লীগের গুণকীর্তন করে বেড়াত সে। তার পেছনে পেছনে ঘুরে বেড়ানোর মতো কিছু সাঙ্গপাঙ্গ জুটে গিয়েছিল। আর এভাবেই সেকান্দার খাঁ নিজেকে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ভাবতে শুরু করেছিল। সে-ই খবর এনেছিল, রশিদ জমাদ্দার যুদ্ধে গেছে। এই খবরটা ছড়িয়ে সেকান্দার খাঁ তার অন্য এক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। মূলত সে ভেবেছিল, মুসলিম লীগ প্রিয় গ্রামের মানুষের মানসিকতায় রশীদ জমাদ্দারের পাকিস্তানবিরোধিতা বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করবে। এই সুযোগে সে রশীদ জমাদ্দারের পরিবারটিকে নাজেহাল করবে। পরিবার বলতে সেকান্দার খাঁর দৃষ্টি রাহীর দিকে। সে অনেক আগে থেকেই। রশীদ জমাদ্দার রাহীকে বিয়ে করে আনার পর রাহীর শরীরটা তার চোখে ভেসে উঠলে সে এক অতুল যন্ত্রণায় ছটফট করে। সে যন্ত্রণা লাঘবের সুযোগ খুঁজছিল সেকান্দার খাঁ। রশীদ জমাদ্দারের যুদ্ধে যাওয়াটা তার জন্য সুযোগ এনে দিল—সেকান্দার খাঁ এমন করেই ভেবেছিল। আর পাকিস্তানি মিলিটারির কাছে রশীদ জমাদ্দারের মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার খবর পৌঁছলে কী ভয়াবহ হবে, সুযোগমত রাহীকে রাস্তায় একা পেয়ে সেকান্দার খাঁ সে কথা বোঝাতে চেষ্টা করেছিল। এ-ও বোঝাতে চেষ্টা করেছিল, সে-ই পারে মিলিটারির হাত থেকে ওদের বাঁচাতে; রাহীকে রক্ষা করতে।
রাহী এই মারপ্যাঁচের কলাকৌশল কতটা বুঝেছে, কে জানে! কিন্তু সেকান্দার খাঁকে তার সুবিধের মনে হয়নি। দেশ, যুদ্ধ, মানুষ হিসেবে টিকে থাকা—এসব বোঝার ক্ষমতা রাহীর না থাকলেও সে এটুকু বুঝেছিল, সেকান্দার খাঁ কোনো এক ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত; সে ভালো কিছু করছে না। আর সেকান্দার খাঁ বুঝেছিল, স্বামীর কথা ভেবে তার কাছে অবনত হবে রাহী। সুযোগ তখন হাতের নাগালে আসবে। মোহগ্রস্তের মতো রাতের আঁধারে রাহীর ঘরের মুলিবাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে স্বর নামিয়ে রাহীকে ডাকত সেকান্দার খাঁ। কিন্তু রাহী অনড়, অটুট।
সেকান্দার খাঁর সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে একে একে। তারপর রশীদ জমাদ্দার যুদ্ধ থেকে ফিরলে সেকান্দার খাঁর দিন একটু ভয়ে ভয়ে কেটেছে—‘রইশ্যা গোল পাকাইলে মান-সম্মানের প্রশ্ন দ্যাহা দিব।’
রশীদ জমাদ্দার গ্রামে ফিরে সবই জেনেছে। কিন্তু কী কারণে সে সেকান্দার খাঁকে কিছু বলেনি, সেটা সে-ই জানে। সেকান্দার খাঁ যেমন তাকে এড়িয়ে চলত, সেকান্দার খাঁকেও এড়িয়ে চলত রশীদ জমাদ্দার।
যে গ্রামে যুদ্ধের আঁচ লাগেনি, সে গ্রামের মানুষ যুদ্ধফেরত এই মানুষটির দেশপ্রেমকেও সরল গ্রাম্যতায় ঢেকে দেবে একসময়—দরিদ্র-অশিক্ষিত রশীদ জমাদ্দারের পক্ষে তা এতটা গভীরভাবে উপলব্ধি করার কথা নয়। তবে এই গ্রামে যেমন একজনই মুক্তিযোদ্ধা আছে, রাজাকারও তেমনি সেকান্দার খাঁ একাই—বিষয়টি ভেবে এখনও মজা পায় রশীদ জমাদ্দার। আর সেকান্দার খাঁর প্রতি তাই সব ঘৃণা রশীদ জমাদ্দারের বুকের গভীরে তলানির মতো জমেছিল—কখনও মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেনি।
কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চল্লিশ বছর পরে এসে সেকান্দার খাঁকে একবার দেখে নিতে ইচ্ছে হলো রশীদ ফকিরের। দারিদ্রে আষ্টেপৃষ্ঠে থাকা মানুষটি অলৌকিক ক্ষমতার উছিলায় যখন কিছুটা আর্থিক সঙ্গতির মুখ দেখেছিল—হোক মিথ্যেয় জড়ানো উপার্জন—তাকে কিছুদিন আধপেটা অবস্থা থেকে মুক্তি দিয়েছিল। কিছুদিন তার বউকে অন্যের বাড়ির কাজ করতে যেতে হয়নি; তার ছোট ছোট ছেলেগুলোকে পেটের দায়ে অন্যের ফরমাস খাটতে হয়নি; অকথ্য গালাগাল শুনতে হয়নি; তখন সেকান্দার খাঁ-ই লোক ঠকিয়ে খাওয়ার জন্য তার বিচার বসাতে চেয়েছিল। তখন চল্লিশ বছর ধরে জিইয়ে রাখা হিসাবটা একবার শানিয়ে নেয়ার ইচ্ছে জেগেছিল রশীদ ফকিরের। কিন্তু এখন সেকান্দার খাঁর দল বেশ ভারি। সে এখন ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার। তার পেছনে গ্রামের দু-চারজন লোক সব সময় দেহরক্ষীর মতো লেগে থাকে। লেগে থাকে সেকান্দার খাঁর ক্ষমতার আঠায়।
শিকারির ফাঁদে পা দেয়ার মতো সেকান্দার খাঁ এবার রশীদ ফকিরের ঘরমুখো হলো। সেকান্দার খাঁ যে স্বেচ্ছায় এসেছে তা নয়; সে বাধ্য হয়েছে। রশীদ ফকিরও টের পেয়ে গিয়েছিল, সেকান্দার খাঁর মস্তক অবনত হয়ে আসছে। কিন্তু তার ভেতরে অবদমিত দ্রোহ ক্রমে বেড়ে উঠছে। আর সেকান্দার খাঁ স্বেচ্ছায় সে জ্বালামুখে এসে ধরা দিচ্ছে। কিন্তু শারীরিক অক্ষমতার কারণে সুযোগ এবার আপনিতে হাতছাড়া হয়ে যায় ফকিরের। ছ’মাস ধরে সে শয্যাগত। রোগের ভার তাকে বিছানায় আঁকড়ে রেখেছে। সে দেখল, জীবনে আরেকবার তার দর উঠল। সে কারণে শুধু সেকান্দার খাঁ কেন, এবার গ্রামের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তির পা পড়ল তার বাড়িতে। ফকিরকে তাদের প্রয়োজন। না, ঝাড়-ফুঁকের জন্য নয়, যেমন করে হোক রশীদ ফকিরকে একবার মঞ্চে উঠে দাঁড়াতে হবে, মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতে হবে। আসছে বিজয় দিবসে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেমন করে হোক একটা আয়োজন করার তাগিদ। ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পর্যন্ত এ নিয়ে মহাব্যস্ত। আর গ্রামে তো এই একজনই মুক্তিযোদ্ধা—রশীদ জমাদ্দার কিংবা রশীদ ফকির।
ফকির জানতে পারল, বেশ বড় আয়োজন। ১৬ ডিসেম্বর হাইস্কুল মাঠে তাকে সংবর্ধনা দেয়া হবে। এ উপলক্ষে তাকে কিছু টাকা-পয়সাও দেয়া হতে পারে। আর অনুষ্ঠানে সেকান্দার খাঁ থাকবে প্রধান অতিথি।
এই প্রলোভন নিয়ে সেকান্দার খাঁ এলো রশীদ ফকিরের বাড়িতে। তাকে বোঝাতে চেষ্টা করল নানাভাবে—আরে মিয়া, শুধু কি একখান ক্রেস্ট, কিছু টাকাও পাবা। হেই টাকায় ডাক্তার দ্যাহাইতে পারবা।
রশীদ ফকির কারও সঙ্গেই হ্যাঁ-না করে না। কিন্তু ভেতরে ভেতরে জ্বলতে থাকে। শারীরিক অক্ষমতাই কেবল দমিয়ে রাখে তাকে। একটি নয়, একাধিক রোগে আক্রান্ত সে। একবার কোনোমতে ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল। ডাক্তার বলেছে, কিডনি রোগ, লিভারের রোগ, এমনকি শরীরে আরও অনেক রোগ বাসা বেঁধেছে। তবু রোগ তাকে দমিয়ে রাখতে পারত না, হাইস্কুল মাঠের অনুষ্ঠানে সে যেত। কিন্তু সেকান্দার খাঁ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বক্তৃতা দেবে। সে বক্তৃতার প্রতিটি বাক্য, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি অক্ষর কী তার কানে তীরের মতো বিঁধবে না! তাছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার এত বছর পরে কেন এসবের প্রয়োজন হলো? এই লোকগুলো আরও আগেও তো এসব করতে পারত!
আয়োজন তবু থেমে থাকে না। আয়োজকদের বিশ্বাস, রশীদ ফকিরকে তারা রাজি করাবেই। এটা তাদের জন্য বেশ জরুরিও। কর্তৃপক্ষের কাছে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণের ব্যাপার আছে।
অক্ষম রশীদ ফকির খোঁজে নিজের নিস্তারের পথ।
একে রোগাক্রান্তি, অপরদিকে মানসিক টানাপড়েনে রশীদ ফকিরের রোগযন্ত্রণা আরও প্রবল হয়ে ওঠে। তাই প্রবলভাবে মুক্তির পথ খোঁজে সে।
সূত্র: আমার দেশ
No comments:
Post a Comment