কাজী নজরুল ইসলাম একটি নাম-একটি জীবন। কালের গতিতে সে নাম বা জীবন আবদ্ধ নয়, সে চির ভাস্বর, চিরস্থায়ী, অনন্ত ও অনাদিকাল বিজয়ী। তার এ সত্তাটুকু কবি নিজেই বেঁধে দিয়েছেন এই বলে :
“মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে,
শোনাও, শোনাও, অনন্তকাল ধরি;
অনন্ত জীবন-প্রবাহ বহে।
মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে।”
১৯৪৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত কবি জীবিত থেকেও ছিলেন মৃতবত্। তাঁর জন্মদিনে কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করার না কোনো স্বাদ আছে, না আছে কোনো অবকাশ। সাহিত্য মানব-জীবনের একটা অংশমাত্র। আর, নজরুল স্মৃতি সেই আংশিক ইতিহাসের সীমা ছাড়িয়ে পূর্ণাঙ্গে বিস্তৃত। তাই বিশ্ব সাহিত্যে নজরুলের স্থান স্বভাবতই অদ্বিতীয়।
‘বিদ্রোহী,’ ‘সাম্যবাদ,’ ‘মানুষ’, ‘কুলি-মজদুর’, ‘ফরিয়াদ’, ‘কৃষকের ঈদ’, ‘আমরা ছাত্রদল’, ‘আমার কৈফিয়ত্’, ‘বারাঙ্গনা’ এবং এমনই আরও কবিতায় তিনি যেভাবে নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরে প্রতিবাদ করেছেন, এমন নজির বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে বিরল বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাস্তবধর্মী কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম সাধারণ মানুষের মুখপাত্র হয়ে মানুষের মনের মণিকোঠায় তাঁর আসন চিরস্থায়ী করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাক-ভারত উপ-মহাদেশের কোটি কোটি মানুষ যখন ঘোর-তিমির-ঘন-নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্চ্ছিত পরিবেশে সুযোগ্য প্রেরণাদাতার অভাবে উত্কণ্ঠিত, ঠিক সেই ঝঞ্ঝাচঞ্চল পরিস্থিতিতে হঠাত্ উল্কার মতো তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর প্রেরণায় হিন্দুকুশ থেকে আরাকান পর্যন্ত দলিত মথিত করে তুলেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বেপরোয়া সৈনিকের দল। শত সহস্র কণ্ঠে ঘোষিত হলো :
“কারার ওই লৌহ কপাট,
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট,
রক্তজমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।
লাথি মার ভাঙের তালা,
যত সব বন্দীশালা
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি।”
দরিদ্রের কবি নজরুল। চিরবঞ্চিত সাধারণের কবি নজরুল আত্মপ্রকাশ করেছেন তাঁর কথায় :
“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান...।”
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, মানব জীবনের এই তিনটি মূল প্রয়োজনের কত কাছে থেকে কত আপন করে অনুভব করেছেন কবি, তার দ্বিতীয় কোনো নজির আমাদের সামনে এখনও ধরা পড়েনি।
ইংরেজ শাসকের চক্রান্তে মানুষ যখন নিয়তই জর্জরিত, সেই সময় তিনি ধ্বনি তুললেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সারমর্ম দিয়ে, মহারোষে তিনি ফেটে পড়লেন :
“মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেইদিন হবো-শান্ত;
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল
আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।”
এখানেও কবি নজরুল তার বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্য ও রাজনীতির যে সুন্দর সমন্বয় তিনি ঘটিয়েছেন, রাজনীতির ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। শুধু তাই নয়,- নজরুলের আর এক অদ্বিতীয় প্রতিভার বিকাশ হয়েছে তার ভাষার সমন্বয়ে। অপরিচিত বিদেশি ভাষাকে জয় করে ছন্দে রূপ দিয়েছেন তিনি তার বাংলা কাব্যমালায়। এই প্রতিভা এমনি নিখুঁত ও সাবলীল হয়ে আর কোনো কবির কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কিনা জানা যায় না। যেমন, তিনি বলেছেন :
“আমি চির দুরন্ত দুর্মদ,-
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা
হরদম্ হ্যায় ভরপুর মদ।”
এই ছত্র কয়টিতে বাংলা ভাষা ছাড়াও বিদেশি ভাষার আগমন হওয়া সত্ত্বেও কবিতার না হয়েছে ছন্দপতন, আর তা না হয়েছে শ্রুতিকটু। তেমনই আবার ‘কোরবানী’ কবিতায় কবির এই সংমিশ্রণ আরও প্রবলভাবে ধরা পড়েছে :
“ওরে হত্যা নয় আজ
সত্যাগ্রহ, সত্যের উদ্বোধন।
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো ওহো খামোখা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর—
আজিকার এ খুন কোরবানীর!
দুম্বাশির রুমবাসীর
শহীদের শির সেরা আজি।
রহমান কি রুদ্র নন?
ব্যস্! চুপ, খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর “খুন দে, জান দে,
শির দে, বত্স শোন্!”
এমনই করে আবার বিভিন্ন ভাষার সংযোজন করেছেন ‘মহরম’ কবিতায়। তিনি দেখিয়েছেন:
‘জাগো, ওঠো মুসলিম, হাঁকো হায়দরী হাঁক।
শহীদের দিনে সব লালে লাল হয়ে যাক।
নওশার সাজ নাও, খুন-খচা আস্তিন্,
ময়দানে লুটাতেরে লাশ এই খাস দিন।’
স্নিগ্ধ-শ্যামল বাংলার মিঠেল-পেলব ভাষার সঙ্গে ঊষর প্রকৃতির কর্কশ ভাষার মিলন ঘটিয়ে কবি কেমন ভাবের আবেগে বিভোর করে দিয়েছেন তা বলতে গেলে আবার উদ্ধৃত করতে হয় :
‘চলে আন্জাম্, দোলে তান্জাম্,
খোলে হুরপরী যত ফিরদৌসের হাম্মাম্।’
তাছাড়াও, তাঁর উর্দু কবিতার কয়েকটি ছত্র প্রমাণ করে দেয় যে, উর্দু সাহিত্য-প্রতিভায়ও তিনি কতদূর বিকশিত ছিলেন :
‘বাহার কি আগ্ মে ভ্যরা দীল্ দাগেম,
কাঁহা মেরী পিয়ারা, আও-আও পিয়ারা।
দুরু দুরু ছাতিয়াঁ, ক্যায়সে এ-রাতিয়াঁ। কাটু বিনা সাথীয়া।
ঘাব্রায়ে জিয়ারা, ত্যড়প্যত্ জিয়ারা।
* * * *
জীগর্ কা খুন নেহী ড্যরো ম্যত্ সাকীয়া,
আঙ্গুরী লহুয়ো, কাহে ভিঙা আখিয়া?
পেয়ালা তু ধ্যরেদ, ম্যস্তানা ক্যরেদ,
সঙ্দীল্ ইয়ারা, সঙ্দীল ইয়ারা।
শ্যরাব্কা নুরসে, রওশ্যন্ ক্যরদে,
সখী গুলিনয়ারা, সখী গুল্ নিয়ারা।’
‘বঙ্গবাণী’ কবির প্রশংসা গাইতে গিয়ে এ পর্যন্ত বলেছেন, ‘তুর্কীর নব সৌভাগ্যের প্রতিষ্ঠাতা কামাল পাশার নামে যে কবিতাটি রচিত হইয়াছে সেটি বঙ্গসাহিত্যে এক অপূর্ব সৃষ্টি,..যুদ্ধের অভিযানে জয়ডঙ্কার তালে তালে যোদ্ধাদের যে জয়োল্লাস এই ‘কামাল পাশা’ কবিতাটিতে পাই তা এদেশের সাহিত্যে নতুন।
অগ্নিবীণা প্রকাশান্তে ‘প্রবাসী’ নজরুলের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন : ছন্দের বৈচিত্র্যে, শব্দের ঝঙ্কারে, ভাবের উদ্দাম প্রবাহে, বলিবার শক্তিমান ভঙ্গিতে এবং হিন্দু-মুসলমানের সাহিত্যের ইতিহাসে, ধর্ম ও সভ্যতার ধারার ও চিন্তা প্রণালীর সঙ্গে সুপরিচয়ে, দুয়ের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় ঘটাইবার অসাধারণ শক্তিতে কবিতাগুলো আগুনের শিখার মতোই উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল ও লেলিহান :-
‘ধরি বাসুকীর ফণা জাপিট’
ধরি’ স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপিট........’
আমি কৃষ্ণকণ্ঠ মন্থন বিষ পিয়া—
ব্যথা বারিধির,
আমি ব্যোমকেশ ধরি’ বন্ধন হারা
ধারা গঙ্গোত্রীর।
আমি বজ্র, ঈশাণ বিষাণে ওঙ্কার
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার।’
উপসংহারে কবি রবীন্দ্রনাথের একটা কথা মনে পড়ে। তিনি নজরুল সম্পর্কে বলেছেন:
‘জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন....।’
বাস্তবিকই তিনি যেন হঠাত্ এসে চমক মেরেই সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে গেলেন। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা ছিলাম সুপ্ত। তিনিই আমাদের সামনে আমাদের একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনের ছবি তুলে ধরলেন। আমাদের জীবনের সত্যিকার ছবিকে আমরা বাস্তব দৃষ্টিতে দেখতে ও চিনতে শিখলাম। মানব জীবনের যে মহান দীক্ষা তিনি দিয়ে গেলেন, তারই মাধ্যমে জীবনকে আমরা অনুভব করতে শিখলাম। তিনিই জানিয়ে দিয়ে গেলেন যে, সমস্ত মানব জীবন এক সুতোয় বাঁধা, সেখানে পরস্পর একই অনির্বচনীয় সুর ধ্বনিত।
কিন্তু তাতে সম্ভবত কবির কোনো লক্ষ্য ছিল না,—কোনো স্বার্থ ছিল না। চিরস্থায়িত্বের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তাই বুঝি তিনি বললেন :
‘পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি
যুগের হুজুগ কেটে গেলে।
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি
রয়েছে সোনার শত ছেলে।’
তাঁর সেই বাসনার সোনার ছেলে আজ জেগে উঠেছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়। তারা কৃত-সঙ্কল্প হলেই কবির স্বপ্নের সার্থকতা।
“মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে,
শোনাও, শোনাও, অনন্তকাল ধরি;
অনন্ত জীবন-প্রবাহ বহে।
মৃত্যু জীবনের শেষ নহে নহে।”
১৯৪৩ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত কবি জীবিত থেকেও ছিলেন মৃতবত্। তাঁর জন্মদিনে কোটি কোটি মানুষের শ্রদ্ধাঞ্জলি গ্রহণ করার না কোনো স্বাদ আছে, না আছে কোনো অবকাশ। সাহিত্য মানব-জীবনের একটা অংশমাত্র। আর, নজরুল স্মৃতি সেই আংশিক ইতিহাসের সীমা ছাড়িয়ে পূর্ণাঙ্গে বিস্তৃত। তাই বিশ্ব সাহিত্যে নজরুলের স্থান স্বভাবতই অদ্বিতীয়।
‘বিদ্রোহী,’ ‘সাম্যবাদ,’ ‘মানুষ’, ‘কুলি-মজদুর’, ‘ফরিয়াদ’, ‘কৃষকের ঈদ’, ‘আমরা ছাত্রদল’, ‘আমার কৈফিয়ত্’, ‘বারাঙ্গনা’ এবং এমনই আরও কবিতায় তিনি যেভাবে নানাবিধ সমস্যা তুলে ধরে প্রতিবাদ করেছেন, এমন নজির বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডারে বিরল বললেও অত্যুক্তি হয় না। বাস্তবধর্মী কবি হিসেবে কাজী নজরুল ইসলাম সাধারণ মানুষের মুখপাত্র হয়ে মানুষের মনের মণিকোঠায় তাঁর আসন চিরস্থায়ী করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাক-ভারত উপ-মহাদেশের কোটি কোটি মানুষ যখন ঘোর-তিমির-ঘন-নিবিড় নিশীথে পীড়িত মূর্চ্ছিত পরিবেশে সুযোগ্য প্রেরণাদাতার অভাবে উত্কণ্ঠিত, ঠিক সেই ঝঞ্ঝাচঞ্চল পরিস্থিতিতে হঠাত্ উল্কার মতো তাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর প্রেরণায় হিন্দুকুশ থেকে আরাকান পর্যন্ত দলিত মথিত করে তুলেছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের বেপরোয়া সৈনিকের দল। শত সহস্র কণ্ঠে ঘোষিত হলো :
“কারার ওই লৌহ কপাট,
ভেঙ্গে ফেল কররে লোপাট,
রক্তজমাট শিকল পূজার পাষাণ বেদী।
লাথি মার ভাঙের তালা,
যত সব বন্দীশালা
আগুন জ্বালা, আগুন জ্বালা ফেল উপাড়ি।”
দরিদ্রের কবি নজরুল। চিরবঞ্চিত সাধারণের কবি নজরুল আত্মপ্রকাশ করেছেন তাঁর কথায় :
“হে দারিদ্র্য, তুমি মোরে করেছ মহান,
তুমি মোরে দানিয়াছ খৃষ্টের সম্মান...।”
অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান, মানব জীবনের এই তিনটি মূল প্রয়োজনের কত কাছে থেকে কত আপন করে অনুভব করেছেন কবি, তার দ্বিতীয় কোনো নজির আমাদের সামনে এখনও ধরা পড়েনি।
ইংরেজ শাসকের চক্রান্তে মানুষ যখন নিয়তই জর্জরিত, সেই সময় তিনি ধ্বনি তুললেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সারমর্ম দিয়ে, মহারোষে তিনি ফেটে পড়লেন :
“মহা বিদ্রোহী রণক্লান্ত,
আমি সেইদিন হবো-শান্ত;
যবে উত্পীড়িতের ক্রন্দন-রোল
আকাশে-বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়্গ-কৃপাণ ভীম রণভূমে রণিবে না।”
এখানেও কবি নজরুল তার বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন। সাহিত্য ও রাজনীতির যে সুন্দর সমন্বয় তিনি ঘটিয়েছেন, রাজনীতির ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। শুধু তাই নয়,- নজরুলের আর এক অদ্বিতীয় প্রতিভার বিকাশ হয়েছে তার ভাষার সমন্বয়ে। অপরিচিত বিদেশি ভাষাকে জয় করে ছন্দে রূপ দিয়েছেন তিনি তার বাংলা কাব্যমালায়। এই প্রতিভা এমনি নিখুঁত ও সাবলীল হয়ে আর কোনো কবির কবিতায় প্রকাশ পেয়েছে কিনা জানা যায় না। যেমন, তিনি বলেছেন :
“আমি চির দুরন্ত দুর্মদ,-
আমি দুর্দম, মম প্রাণের পেয়ালা
হরদম্ হ্যায় ভরপুর মদ।”
এই ছত্র কয়টিতে বাংলা ভাষা ছাড়াও বিদেশি ভাষার আগমন হওয়া সত্ত্বেও কবিতার না হয়েছে ছন্দপতন, আর তা না হয়েছে শ্রুতিকটু। তেমনই আবার ‘কোরবানী’ কবিতায় কবির এই সংমিশ্রণ আরও প্রবলভাবে ধরা পড়েছে :
“ওরে হত্যা নয় আজ
সত্যাগ্রহ, সত্যের উদ্বোধন।
দুর্বল! ভীরু! চুপ রহো ওহো খামোখা ক্ষুব্ধ মন!
ধ্বনি ওঠে রণি দূর বাণীর—
আজিকার এ খুন কোরবানীর!
দুম্বাশির রুমবাসীর
শহীদের শির সেরা আজি।
রহমান কি রুদ্র নন?
ব্যস্! চুপ, খামোশ রোদন!
আজ শোর ওঠে জোর “খুন দে, জান দে,
শির দে, বত্স শোন্!”
এমনই করে আবার বিভিন্ন ভাষার সংযোজন করেছেন ‘মহরম’ কবিতায়। তিনি দেখিয়েছেন:
‘জাগো, ওঠো মুসলিম, হাঁকো হায়দরী হাঁক।
শহীদের দিনে সব লালে লাল হয়ে যাক।
নওশার সাজ নাও, খুন-খচা আস্তিন্,
ময়দানে লুটাতেরে লাশ এই খাস দিন।’
স্নিগ্ধ-শ্যামল বাংলার মিঠেল-পেলব ভাষার সঙ্গে ঊষর প্রকৃতির কর্কশ ভাষার মিলন ঘটিয়ে কবি কেমন ভাবের আবেগে বিভোর করে দিয়েছেন তা বলতে গেলে আবার উদ্ধৃত করতে হয় :
‘চলে আন্জাম্, দোলে তান্জাম্,
খোলে হুরপরী যত ফিরদৌসের হাম্মাম্।’
তাছাড়াও, তাঁর উর্দু কবিতার কয়েকটি ছত্র প্রমাণ করে দেয় যে, উর্দু সাহিত্য-প্রতিভায়ও তিনি কতদূর বিকশিত ছিলেন :
‘বাহার কি আগ্ মে ভ্যরা দীল্ দাগেম,
কাঁহা মেরী পিয়ারা, আও-আও পিয়ারা।
দুরু দুরু ছাতিয়াঁ, ক্যায়সে এ-রাতিয়াঁ। কাটু বিনা সাথীয়া।
ঘাব্রায়ে জিয়ারা, ত্যড়প্যত্ জিয়ারা।
* * * *
জীগর্ কা খুন নেহী ড্যরো ম্যত্ সাকীয়া,
আঙ্গুরী লহুয়ো, কাহে ভিঙা আখিয়া?
পেয়ালা তু ধ্যরেদ, ম্যস্তানা ক্যরেদ,
সঙ্দীল্ ইয়ারা, সঙ্দীল ইয়ারা।
শ্যরাব্কা নুরসে, রওশ্যন্ ক্যরদে,
সখী গুলিনয়ারা, সখী গুল্ নিয়ারা।’
‘বঙ্গবাণী’ কবির প্রশংসা গাইতে গিয়ে এ পর্যন্ত বলেছেন, ‘তুর্কীর নব সৌভাগ্যের প্রতিষ্ঠাতা কামাল পাশার নামে যে কবিতাটি রচিত হইয়াছে সেটি বঙ্গসাহিত্যে এক অপূর্ব সৃষ্টি,..যুদ্ধের অভিযানে জয়ডঙ্কার তালে তালে যোদ্ধাদের যে জয়োল্লাস এই ‘কামাল পাশা’ কবিতাটিতে পাই তা এদেশের সাহিত্যে নতুন।
অগ্নিবীণা প্রকাশান্তে ‘প্রবাসী’ নজরুলের ওপর আলোকপাত করতে গিয়ে বলেছেন : ছন্দের বৈচিত্র্যে, শব্দের ঝঙ্কারে, ভাবের উদ্দাম প্রবাহে, বলিবার শক্তিমান ভঙ্গিতে এবং হিন্দু-মুসলমানের সাহিত্যের ইতিহাসে, ধর্ম ও সভ্যতার ধারার ও চিন্তা প্রণালীর সঙ্গে সুপরিচয়ে, দুয়ের সংমিশ্রণ ও সমন্বয় ঘটাইবার অসাধারণ শক্তিতে কবিতাগুলো আগুনের শিখার মতোই উজ্জ্বল, প্রোজ্জ্বল ও লেলিহান :-
‘ধরি বাসুকীর ফণা জাপিট’
ধরি’ স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপিট........’
আমি কৃষ্ণকণ্ঠ মন্থন বিষ পিয়া—
ব্যথা বারিধির,
আমি ব্যোমকেশ ধরি’ বন্ধন হারা
ধারা গঙ্গোত্রীর।
আমি বজ্র, ঈশাণ বিষাণে ওঙ্কার
আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার।’
উপসংহারে কবি রবীন্দ্রনাথের একটা কথা মনে পড়ে। তিনি নজরুল সম্পর্কে বলেছেন:
‘জাগিয়ে দেরে চমক মেরে
আছে যারা অর্ধচেতন....।’
বাস্তবিকই তিনি যেন হঠাত্ এসে চমক মেরেই সবাইকে জাগিয়ে দিয়ে গেলেন। মানব জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমরা ছিলাম সুপ্ত। তিনিই আমাদের সামনে আমাদের একটা পূর্ণাঙ্গ জীবনের ছবি তুলে ধরলেন। আমাদের জীবনের সত্যিকার ছবিকে আমরা বাস্তব দৃষ্টিতে দেখতে ও চিনতে শিখলাম। মানব জীবনের যে মহান দীক্ষা তিনি দিয়ে গেলেন, তারই মাধ্যমে জীবনকে আমরা অনুভব করতে শিখলাম। তিনিই জানিয়ে দিয়ে গেলেন যে, সমস্ত মানব জীবন এক সুতোয় বাঁধা, সেখানে পরস্পর একই অনির্বচনীয় সুর ধ্বনিত।
কিন্তু তাতে সম্ভবত কবির কোনো লক্ষ্য ছিল না,—কোনো স্বার্থ ছিল না। চিরস্থায়িত্বের কোনো উদ্দেশ্য ছিল না। তাই বুঝি তিনি বললেন :
‘পরোয়া করি না বাঁচি বা না বাঁচি
যুগের হুজুগ কেটে গেলে।
মাথার ওপরে জ্বলিছেন রবি
রয়েছে সোনার শত ছেলে।’
তাঁর সেই বাসনার সোনার ছেলে আজ জেগে উঠেছে পৃথিবীর কোনায় কোনায়। তারা কৃত-সঙ্কল্প হলেই কবির স্বপ্নের সার্থকতা।
সূত্র : আমার দেশ
No comments:
Post a Comment