আজ যদি শুধুমাত্র সংস্কৃত পুস্তকপত্র থেকে ভারতবর্ষের ইতিহাস লিখতে হয় তাহলে এদেশে মুসলমান ধর্ম আদৌ প্রবেশ করেছিল কি না সে নিয়ে বিলক্ষণ তর্কের অবকাশ থাকবে। অথচ আমরা ভালো করেই জানি, মুসলমান-আগমনের পরও প্রচুর সংস্কৃত পুস্তক লেখা হয়েছে, ব্রাহ্মণপণ্ডিতগণ রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতা পাননি সত্য, কিন্তু তাদের ব্রহ্মোত্তর দেবোত্তর জমিজমার উপর হস্তক্ষেপ না হওয়ার ফলে তাদের ঐতিহ্যগত বিদ্যাচর্চা বিশেষ মন্দীভূত হয়নি। কিন্তু এইসব পণ্ডিতগণ পার্শ্ববর্তী মুসলমানদের সম্বন্ধে সম্পূর্ণ অচেতন থেকেই আপন আপন লেখনি সঞ্চালনা করেছেন।১ অল্পোপনিষদ্ জাতীয় দু-চারখানা পুস্তক নিতান্তই প্রক্ষিপ্ত। বরঞ্চ এরা সত্যানুসন্ধানকারীকে পথভ্রষ্ট করে।
এ এক চরম বিস্ময়ের বস্তু। দশম, একাদশ শতাব্দীতে গজনীর মাহমুদ বাদশার সভাপতিত্বে আবু-র-বইহান মুহম্মদ আল বীরুনী ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁর প্রামাণিক পুস্তকে একাধিকবার সবিনয়ে বলেছেন, ‘আমরা (অর্থাত্ আরবীতে) যাঁরা জ্ঞানচর্চা করি, দার্শনিক চিন্তা আমাদের মজ্জাগত নয়। দর্শন নির্মাণ করতে পারে একমাত্র গ্রিক ও ভারতীয়রা।’
সেই ষড়দর্শননির্মাতা আর্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান-আগমনের পর সাত শত বত্সর ধরে আপন আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বত্সর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু আলীসিনা (লাতিনে আভিসেনা), অল-গজ্জালী২ (লাতিনে অল-গাজেল), আবু রুশদ্ (লাতিনে আভেরস) ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চা হল তার কোন সন্ধান পেলেন না। এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো-আরিস্ততলের দর্শনচর্চায় সোত্সাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি একেবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। তিনিও জানতে পেলেন না যে, তিনি প্লাতোর আদর্শবাদ দৃঢ়ভূমিতে নির্মাণ করার জন্য যেসব যুক্তি আকাশ-পাতাল থেকে আহরণ করেছেন তাঁর পাশের চতুষ্পাঠীতেই হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্যের আদর্শবাদ সমর্থনার্থে সেইসব যুক্তিই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনি ‘গুলাত’ নাস্তিকদের জড়বাদ যেভাবে খণ্ডন করছেন, ব্রাহ্মণও চার্বাকের নাস্তিকতা সেইভাবেই খণ্ডন করছেন। এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক-সুশ্রুতের আরবি অনুবাদে পুষ্ট বু আলীসিনার চিকিত্সাশাস্ত্র-‘য়ুনানী’ নামে প্রচলিত (কারণ তার গোড়াপত্তন গ্রিক [আইওনিয়ান=‘য়ুনানী’] চিকিত্সাশাস্ত্রের উপর)-আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিত্সার্থে প্রয়োগ করছেন, সেই চরক-সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ানো হচ্ছে। সিনা উল্লিখিত যে-ভেষজ কি, তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, কিংবা সিনা বলেছেন, ফলানা ওষুধিবনস্পতি এদেশে (অর্থাত্ আরবে) জন্মে না, সেগুলো যে তাঁর বাড়ির পিছনে আঁস্তাকুড়ে গজাচ্ছে তারও সন্ধান তিনি পেলেন না। কিঞ্চিত্ কল্পনাবিলাস করলে, এ পরিস্থিতিও অনুমান করা অসম্ভব নয় যে মৌলানার বেগমসায়েবা সিনা-উল্লিখিত কোন শাক তাঁকে পাক করে খাওয়ালেন, আর তিনি সেটি চিনতেই পারলেন না।
পক্ষান্তরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ মুসলমানদের ইউনানী চিকিত্সাশাস্ত্র থেকে বিশেষ কিছু নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এই দুস্তর মরুভূমির মাঝখানে মাত্র একটি লোক দেখতে পাই। আওরঙ্গজেবের অগ্রজ যুবরাজ মুহম্মদ দারাশীকূহ্। ইনিই সর্বপ্রথম দুই ধর্মের সমন্বয় সম্বন্ধে বহুতর পুস্তক লেখেন। তার অন্যতম মজমা-উল্-বহরেন, অর্থাত্ দ্বিসিন্ধুসঙ্গম। দারাশীকূহ্ বহু বত্সর
অনাদৃত থাকার পর তাঁর সম্বন্ধে প্রামাণিক গবেষণা বিশ্বভারতীতেই হয়। শ্রীযুত বিক্রমজিত্ হস্রত্ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ‘দারাশীকূহ্ : লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্কস নামক একখানি অত্যুত্তম গ্রন্থ লেখেন এবং বিশ্বভারতী কর্তৃক সেটি প্রকাশিত হয়। প্রয়োজনমত আমরা এই পুস্তকখানি সদ্ব্যবহার করব।
আরও তিন শত বত্সর পর প্রাতঃস্মরণীয় রাজা রামমোহন রায় ফার্সীতে রচনা করেন তাঁর সর্বপ্রথম পুস্তক, ‘তুহাফতু অল্-মূওয়াহিহদীন:‘একেশ্বরবাদীদের প্রতি উত্সর্গ’। রাজা খ্রিস্টধর্মের সঙ্গেও সুপরিচিত ছিলেন বলে তাঁর পুস্তককে ‘ত্রিরত্ন’ধারী বা ত্রিপিটক বললে অত্যুক্তি হয় না। ব্রাহ্মধর্মের উত্পত্তি সম্বন্ধে যাঁরা সামান্যতম অনুসন্ধান করেছেন তাঁরাই জানেন রাজার শিক্ষাদীক্ষা ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির নিকট কতখানি ঋণী এবং পরবর্তী জীবনে যদিও তিনি উপনিষদের উপর তাঁর ধর্মসংস্কারসৌধের দৃঢ়ভূমি নির্মাণ করেছিলেন তবু শেষদিন পর্যন্ত ইসলামের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কণামাত্র হ্রাস পায়নি। প্রয়োজনমত আমরা তাঁর রচনাবলীরও সদ্ব্যবহার করব।
প্রায় ছশ’ বত্সর ধরে এদেশে ফার্সীচর্চা হল। হিন্দুরা না হয় বিদেশাগত ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতি কৌতূহল না দেখাতে পারেন, কিন্তু যাদের রাজ্যচালনা করতে হয়েছে তাদের বাধ্য হয়ে এদেশের ভাষা রীতিনীতি অল্পবিস্তর শিখতে হয়েছে। উত্তম সরকারী কর্ম পাবার জন্য বহু হিন্দুও ফার্সী শিখেছিলেন। মাত্র একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে : এদেশে বহু হিন্দুর পদবী মুনশী। আমরা বাঙলায় বলি, লোকটির ভাষায় মুন্সিয়ানা বা মুন্শীয়ানা আছে, অর্থাত্ সে নাগরিক বিদগ্ধ চতুর (স্কিলফুল) ভাষা লেখে। এর থেকেই বোঝা যায়, কতখানি ফার্সী জানা থাকলে তবে মানুষ বিদেশী ভাষায় এ রকম একটা উপাধি পায়। তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে : আমরা প্রচুর ইংরেজি চর্চা করেছি, কিন্তু ইংরেজ মুনশী-জাতীয় কোনো উপাধি আমাদের কাউকে দেয়নি-বরঞ্চ আমাদের ‘ব্যাবু-ইংলিশ’ নিয়ে ব্যঙ্গই করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সবিস্তর আলোচনা পরে হবে, উপস্থিত এইটুকু উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই মুন্শী-শ্রেণীর যাঁরা উত্তম ফার্সী শিখেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই কায়স্থ, সংস্কৃতের পটভূমি তাঁদের ছিল না, কাজেই উভয় ধর্মশাস্ত্রের সম্মেলন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। উপরন্তু এঁরা ফার্সী শিখেছিলেন অর্থোপার্জনের জন্য—জ্ঞানান্বেষণে নয়। তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে, আমরা প্রায় দুই শত বত্সর ইংরেজি বিদ্যাভ্যাস করেছি বটে, তথাপি খ্রিস্টধর্মগ্রন্থ বাঙলায় অনুবাদ করার প্রয়োজন অতি অল্পই অনুভব করেছি।
শ্রীচৈতন্যদেব নাকি ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। কথিত আছে বৃন্দাবন থেকে সশিষ্য বাংলাদেশে আসার সময় পথিমধ্যে এক মোল্লার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই মোল্লা নাকি তাঁকে প্রশ্ন করেন, তিনি তাঁর শিষ্যদের ভ্রান্ত ধর্মপথে চালনা করছেন কেন? শ্রীচৈতন্যদেব নাকি তখন মুসলমান শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে তিনি ভ্রান্ত ধর্মপ্রচার করছেন না। মুসলমান ধর্মে বলা হয়, যে লোক আর্তের সেবা করে, মিথ্যাচরণ বর্জন করে সত্পথে চলে—অর্থাত্ কুরান-শরীফ-বর্ণিত নীতিপথে চলে—তাকে ‘পয়গম্বরহীন’ মুসলমান বলা যেতে পারে, হজরত্ মুহম্মদকে পয়গম্বররূপে স্বীকার করেনি বলেই সে ধর্মহীন নয়। (আমরা এস্থলে ‘কাফির’ না বলে ‘ধর্মহীন’ শব্দ ইচ্ছা করেই ব্যবহার করছি; পরে এর বিস্তৃত আলোচনায় প্রয়োজন হবে। অতএব অনুমান করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয় যে, বোধ হয় চৈতন্যদেবের শর্ত উদার প্রকৃতিবান ব্যক্তির পক্ষে হজরত্ মুহম্মদকে অন্যতম মহাপরুষ বা পয়গম্বররূপেও স্বীকার করে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বস্তুত সে যুগে এবং এ যুগেও বহু হিন্দু সজ্জন মহাপুরুষ মুহম্মদকে আল্লার প্রেরিত পুরুষরূপে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
দ্বিতীয় ঘটনা, কাজী-কর্তৃক সংকীর্তন বন্ধ করা নিয়ে। কথিত আছে, সেবারেও তিনি যুক্তিতর্কে কাজীকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। পূর্বের অনুমান এস্থলেও প্রযোজ্য।
কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। বস্তুত তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুধর্মের সংগঠন ও সংস্কার এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নবযৌবনের পথে নিয়ে যাবার।
তবুও এ বিষয় নিয়ে সবিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
এ যাবত্ আমাদের মূল বক্তব্য ছিল, মুসলমান যে জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সঙ্গে এনেছিলেন, এবং পরবর্তী যুগে, বিশেষ করে মোগল আমলে আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মঙ্গোল-জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র সহস্র কবি পণ্ডিত ধর্মজ্ঞ দার্শনিক এদেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব পাণ্ডিত্য নিঃশেষে উজাড় করে দিলেন তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ, পণ্ডিত, দার্শনিকরা কণামাত্র লাভবান হননি। এবং বিদেশাগত পণ্ডিত দার্শনিক এ দেশে এসেছিলেন একমাত্র অর্থলাভের উদ্দেশ্যে—কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের পর এঁদের অধিকাংশ তাঁদের চরম নিমকহারামির পরিচয় দিয়েছেন পঞ্চমুখে এদেশের নিন্দাবাদ করে। নিন্দা করেছেন মুসলমান রাজা এবং আমীর ওমরাহরাই—হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁদের কোন যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি।
ফার্সী সাহিত্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্রাউন উপরে উল্লিখিত যুগকে ফার্সী সাহিত্যের ইন্ডিয়ান সামার পুনরুচ্ছলিত যৌবন নাম দিয়েছেন। বস্তুত বর্বর মঙ্গোল অভিযানে ফলস্বরূপ ফার্সী সাহিত্যের যে অনাহারে মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল সে তখন অন্নজল পায় মোগল-দরবারে। ইরান আজকের দিনে ভারতের কাছে কতখানি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছায় না, কিন্তু ভারতবর্ষে ফার্সী সাহিত্যের এই যুগ নিয়ে অতিঅল্প আলোচনাই হয়েছে, তাও উর্দুতে, বাঙলাতে কিছুই হয়নি।
এ তো প্রধানত সাহিত্য ও অন্যান্য বাঙ্ময়ের কথা, কিন্তু আমাদের কাছে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি বলে মনে হয় এই দেখে যে, ভুবনবিখ্যাত ষড়দর্শনের দেশের লোক মুসলমান মারফতে প্লাতো-আরিস্ততল, সিনা রুশ্দ্ নিয়ে সপ্তম দর্শন নির্মাণ করল না। কল্পনা করতে এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার হয়—ভারতবর্ষ তাহলে দর্শনের ক্ষেত্রে কত না দিক্চক্রবাল উত্তীর্ণ হয়ে যেত—দেকার্ত কান্টের অগ্রগামী পথপ্রদর্শক এ দেশেই জন্মাতেন!
পক্ষান্তরে মুসলমান যে-আরবি দর্শন সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাই নিয়ে পড়ে রইলেন। মঙ্গোল কর্তৃক বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হওয়ার পর, এবং স্পেন থেকে মুররা বিতাড়িত হওয়ার ফলে আরব-জগতে দর্শনের অপমৃত্যু ঘটে। এদেশের মুসলমান দার্শনিককে অনুপ্রাণিত করার জন্য বাইরের সব উত্স সম্পূর্ণ শুষ্ক হল। হায়, এঁরা যদি পাকে-চক্রে কোন গতিকে ষড়যদর্শনের সন্ধান পেতেন।
এ তো কিছু অসম্ভব কল্পনা-বিলাস নয়। আজকের দিনের হিন্দু দার্শনিক এক দিকে নব্যন্যায় চর্চা করেন, অন্য দিকে দেকার্ত অধ্যয়ন করেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁদের পথ-প্রদর্শক। কবি ইক্বালের ঐতিহ্যভূমি আভেরস-আভেচেন্নার উপর—তাঁর সৌধনির্মাণে তিনি সাহায্য নিয়েছেন কান্ট-হেগেলের।
আমরা এতক্ষণ যে অবস্থার বর্ণনা করলেম তার থেকে আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্ত করা সম্পূর্ণ অনুচিত নয় যে, ভারতবর্ষে তাহলে হিন্দু-মুসলমানের মিলন হয়নি। যেহেতু ব্রাহ্মণের দেবোত্তর বাদশা কেড়ে নেননি তাই তিনি নিশ্চিন্ত মনে আপন শাস্ত্রচর্চা করে যেতে লাগলেন, এবং যেহেতু আলিম-ফাজিলরা ওয়াক্ফ্-সম্পত্তি পেয়ে গেলেন তাই তাঁরাই পরমানন্দে তাঁদের মক্তব-মাদ্রাসায় কোরান-হাদীসের চর্চা করে যেতে লাগলেন। একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করার কোন প্রয়োজন অনুভব করলেন না।
কিন্তু দেশের সকলের তো লাখেরাজ ব্রহ্মোত্তর ওয়াক্ফ্-সম্পত্তি নেই। চাষা তিলি জোলা কাঁসারি মাঝি চিত্রকর কলাবত্ বৈদ্য কারকুন এবং অন্যান্য শত শত ধান্দার লোককে অর্থোপার্জন করে জীবনধারণ করতে হয়। সে স্থলে হিন্দু মুসলমানকে বর্জন করে চলতে পারে না, মুসলমানকেও হিন্দুর সংস্পর্শে আসতে হয়। তদুপরি উচ্চাঙ্গের চিত্রকলা সঙ্গীত স্থাপত্য বাদশা ও তাঁর অর্থশালী আমীর-ওমরাহের সাহায্য বিনা হয় না। বাদশারও দরকার হিন্দু রাজকর্মচারীর। কোনো দেশ জয় করা এক কর্ম, সে দেশ শাসন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া। বাদশা ইরান-তুরান থেকে দিগ্বিজয় করার সময় রাজকর্মচারী সঙ্গে আনেননি। আর আনবেনই বা কি? তারা এ-দেশের ভাষা জানে না, রাজস্বব্যবস্থা বোঝে না, কোন্ দণ্ডনীতি কঠোর আর কোন্টাই বা অতি সদয় বলে দেশের লোকের মনে হবে—এ সম্বন্ধে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বখ্শী (চীফ পে-মাস্টার, অ্যাকাউন্টেন্ট-কাম্-অডিটার জেনারেল), কানুনগো (লিগেল রিমেমব্রেন্সার), সরকার (চীফ সেক্রেটারি), মুন্শী (হুজুরের ফরমান লিখনেওলা, নূতন আইন নির্মাণের খসড়া প্রস্তুতকারী), ওয়াকে-নওয়ীস্ (যার থেকে ডধয়হরং), পর্চা-নওয়ীস্ (রাজকর্মচারীর আচরণ তথা দেশের জনসাধারণ সম্বন্ধে রিপোর্ট তৈরি করনেওলা) এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করবে কারা?
আমরা জানি, কায়স্থরা স্মরণাতীতকাল থেকে এসব কাজ করে আসছেন। এঁরাই এগিয়ে এলেন। মুসলমানপ্রাধান্য প্রায় দুশ’ বত্সর হল লোপ পেয়েছে, কিন্তু আজও এসব পদবী—প্রধানত কায়স্থদের ভিতর—সম্পূর্ণ লোপ পায়নি।
এ দেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, উর্দু ভাষা এবং অন্যান্য বহু জিনিস যে হিন্দু-মুসলমানের অনিবার্য মেলামেশার ফলে হয়েছিল সে কথা সকলেই জানেন।
শুধু ভাস্কর্য ও নাট্যকলা বাদশা-আমীর-ওমরার কোনো সাহায্য পায়নি। তার কারণ, ইসলামে মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ এবং নাট্যকলা ভারতের বাইরে মুসলিম জগতে সম্পূর্ণ অজানা।
হিন্দুধর্ম ভিন্নধর্মাবলম্বীকে আপন ধর্মে গ্রহণ করে না। কাজেই অন্য ধর্ম সম্বন্ধে তার ঔত্সুক্য নেই। মুসলমান বিধর্মীকে মুসলমান করতে চায়। উভয়ের মিলনের চিন্তা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কিংবা মুসলমান মৌলবী কেউ করেন না হিন্দু পণ্ডিত মুসলমানকে বলেন, ‘তুমি দূরে থাকো’। মুসলমান মৌলবী হিন্দুকে বলেন, ‘এসো, তুমি মুসলমান হবে’। তৃতীয় পন্থাও যে থাকতে পারে সেটা কারও মনে উদয় হয় না। হিন্দু হিন্দু থাকবে, মুসলমান মুসলমান থাকবে অথচ উভয়ের মধ্যে মিলন হবে, হৃদ্যতা হবে।
এ পন্থার চিন্তা করেছিল জনগণ। এটাতে ছিল তাদের প্রয়োজন। তাই এলেন ধর্মের জগতে জননেতা, জনাবতার কবীর দাদু নানক ইত্যাদি। পরম শ্লাঘার বিষয়, শান্তিনিকেতনেই এঁদের সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। এতদিন ধরে ভারতের হিন্দু-মুসলমান গুণী-জ্ঞানীরা যেসব মহাপুরুষদের সম্পূর্ণ অবহেলা করেছিলেন, শান্তিনিকেতনেই সে সময়ের ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী তাঁদের নিয়ে সমস্ত জীবন ব্যয়িত করেন। তাঁর ‘দাদু’ ‘কবীরে’র পরিচয় এস্থলে নূতন করে দেবার প্রয়োজন নেই।
সে পুণ্যকর্ম এখনো বিশ্বভারতীতে পূর্ণোদ্যমে অগ্রগামী। ক্ষিতিমোহনের বৃদ্ধ বয়সের সহকর্মী বিশ্বভারতীর অধ্যাপক শ্রীযুত রামপুজন তিওয়ারীর ‘সুফীমত-সাধনা ঔর সাহিত্য’ সুচিন্তিত স্বয়ং-সম্পূর্ণ পুস্তক হিন্দি সাহিত্য তথা মধ্যযুগীয় লোকায়ত ধর্ম-চর্চার গৌরব বৃদ্ধি করেছে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ সরল ভাষায় লিখিত এ ধরনের গ্রন্থ সর্ব ভাষায়ই বিরল।
কিন্তু চিন্তাজগতে—দর্শন-ধর্মশাস্ত্র-জ্ঞানবিজ্ঞানে—হিন্দু-মুসলমানের মিলনভাব অথচ অনুভূতির ক্ষেত্রে—চারুকলা সঙ্গীত লোকসাহিত্যে গণধর্মে—আশাতীত মিলন। এ বিষয়ে অধ্যয়ন এবং চর্চা করতে হলে উভয় জনসমাজের মূল ধর্ম, সামাজিক আচার-ব্যবহার গোড়া থেকে অধ্যয়ন করতে হয়। হিন্দুধর্ম ও সমাজ সম্বন্ধে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু মুসলমান ধর্মের উত্পত্তি ও বিকাশ সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় প্রায় কিছুই নেই। যা-কিছু আছে তা সরল ধর্মোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ এবং স্বধর্মবিশ্বাসীর হৃদয়-মনে উত্সাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার করার জন্য-বিধর্মীর সম্মুখে আপন ধর্ম যুক্তিবিচারের উপর নির্মাণ করে তাকে আকর্ষণ করার কোনো প্রচেষ্টা তাতে নেই, আপন ধর্মের স্বতঃসিদ্ধ নীতিও যে বিধর্মীর কাছে প্রামাণ্যভাবে অসিদ্ধ হতে পারে সে দুশ্চিন্তাও এ-সাহিত্যকে বিক্ষুব্ধ করেনি। উপরন্তু ইংরেজ-আগমনের পর এদেশের ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুরা ইংরেজির মারফতে পেলেন ইসলামের এক বিকট বিকৃত রূপ। সরল হিন্দু জানত না, খ্রিস্টান এবং মুসলিমে স্বার্থসংঘাত লেগে যায় মহাপুরুষের মৃত্যুর অল্প দিন পরেই, শত শত বত্সর ক্রুসেডের নামে একে অন্যের মরণালিঙ্গনে তারা সম্পিষ্ট; ফলে খ্রিস্টান কর্তৃক ইসলাম ও হজরত্ মুহম্মদের বিরুদ্ধে অকথ্য কটুবাক্য এদেশে এসেছে ‘নিরপেক্ষ গবেষণা’র ছদ্মবেশ ধরে। সাধারণ সরল হিন্দু এ ছদ্মবেশ বুঝতে পারেনি। (এস্থলে বলে রাখা ভালো, মুসলমান কিন্তু খ্রিস্টানকে প্রাণভরে ‘জাত তুলে’ গালাগাল দিতে পারেনি, কারণ কুরান-শরীফ যীশুখ্রিস্টকে অন্যান্য মহাপরুষদের একজন বলে যে স্বীকার করে নিয়েছে তাই নয়, তিনি মুহম্মদের পূর্বে সর্বপ্রধান পয়গম্বর বলে তাঁকে বিশেষ করে ‘রূহুল্লা’ ‘আল্লাহ আত্মা’ ‘পরমাত্মার খণ্ডাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। পক্ষান্তরে খ্রিস্টান যুগ যুগ ধরে হজরত্ মুহম্মদকে ‘ফলস ‘প্রফেট’ ‘শ্যালট্যান ইত্যাদি আখ্যায় বিভূষিত করেছে। প্রায় চল্লিশ বত্সর পূর্বেও ঐতিহাসিক ওয়েলস তাঁর ‘বিশ্ব-ইতিহাসে’ মুহম্মদ যে ঐশী অনুপ্রেরণার সময় স্বেদাসক্ত বেপথুমান হতেন তাকে মৃগারুগীর লক্ষণ বলে মহাপুরুষকে উভয়ার্থে লাঞ্ছিত করেছেন)।
রামমোহন রামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ সর্বদেশেই বিরল। এদেশে তো অবশ্যই।
ইতিমধ্যে আর-একটি নূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
এতদিন যে হিন্দু পণ্ডিত দার্শনিক মুসলমানের ধর্ম আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেননি তাতে হয়তো তাঁদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি, কিন্তু স্বরাজলাভের পর তাঁদের সে দৃষ্টিবিন্দু পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তান ইরান ইরাক সিরিয়া সউদি আরব ইয়েমেন মিশর তুনিস আলজিরিয়া মরক্কো তথা মুসলমানপ্রধান ইন্দোনেশিয়া ও নবজাগ্রত মুসলিম অধ্যুষিত আফ্রিকার একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা স্থাপন করতে হবে। মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানও এ ফিরিস্তির অন্তর্ভুক্ত। এদের ধর্ম, তার উত্পত্তি ও ক্রমবিকাশ, রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক বাতাবরণ-পার্থক্যে তাদের ভিন্ন ভিন্ন রূপ-পরিবর্তন— এসব এখন অল্পবিস্তর অধ্যয়ন না করে গত্যন্তর নেই। সত্য, আমাদের ইস্কুল-কলেজে এখনো আরবী-ফার্সীর চর্চা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি, কিন্তু এই নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়াটা সমীচীন হবে না। কিছু কিছু হিন্দুদেরও আরবী-ফার্সী শিখতে হবে। এবং এই সাতশ’ বত্সরের প্রাচীন আরবী-ফার্সীর শিক্ষাপদ্ধতিও পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ যতই প্রয়োজনীয় হোক, এ স্থানে কিঞ্চিত্ অবান্তর।
আমরা যে মূল উেসর সন্ধানে বেরুচ্ছি তার জন্য আজ আর প্রাচীন মানচিত্র কাজে লাগবে না। ভাবোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ অথবা সন্দেহে কণ্টাকাকীর্ণ প্রাচীন কোনো পদ্ধতির অনুসরণ করলে আজ আর চলে না। ধর্মকেও আজ রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির কষ্টিপাথর দিয়ে যাচাই করতে হয়।
কিন্তু অনুসন্ধিত্সু মনের সঙ্গে থাকবে সহানুভূতিশীল হৃদয়।
[১ টয়িনবি সাহেব যে রীতিতে পৃথিবীর সর্বত্র একই প্যাটার্নের অনুসন্ধান করেন বর্তমান লেখক সে নীতি অনুসরণে বিরত থাকবে। শুধু যেখানে প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি দেখিয়ে দিলে আলোচ্য বিষয়বস্তু স্পষ্টতর হবে সেখানেই এই নীতি মানা হবে। এস্থলে তাই শুধু উল্লেখ করি, যখনই কোন জাতি বৈদেশিক কোন ভিন্নধর্মাবলম্বী দ্বারা পরাজিত হয় তখন নূতন রাজা এঁদের পণ্ডিতমণ্ডলীকে কোন প্রধানকর্মে আমন্ত্রণ জানান না বলে এঁদের এক মানসিক পরিবর্তন হয়। এঁদের চিন্তাধারা তখন মোটামুটি এই : ‘আমাদের ধর্ম সত্য এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমরা ম্লেচ্ছ বা যবন কর্তৃক পরাজিত হলুম কেন? এর একমাত্র কারণ এই হতে পারে যে, আমরা আমাদের ধর্মের প্রকৃত রূপ বুঝতে পারিনি। ধর্মের অর্থকরণে (ইন্টারপ্রিটেশনে) নিশ্চয়ই আমাদের ভুল রয়ে গিয়েছে। আমরা তা হলে নূতন করে ব্যাখ্যা করে দেখি, ত্রুটি কোন্ স্থলে হয়েছে।’ ফলে পরাজয়ের পরবর্তী যুগে তাবত্ সৃষ্টশক্তি টীকাটিপ্পনী রচনায় ব্যয় হয়।]
[২ ইসলামের অন্যতম প্রখ্যাত পথপ্রদর্শক বা ইমাম। ইনি দার্শনিক-কিয়ত্কালের জন্য নাস্তিক- এবং পরিণত-বয়সে সূফী (মিস্টিক, ভক্তিমার্গ ও যোগের সমন্বয়কারী) হয়ে যান। এঁর জনপ্রিয় পুস্তক ‘কিমিয়া সাদত্’ এই শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলায় অনূদিত হয়ে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতীর সর্বপ্রথম অধ্যক্ষ স্বর্গত বিধুশেখর শাস্ত্রী এই পুস্তকের বড়ই অনুরাগী ছিলেন এবং আমাদের মন্দিরের উপাসনায় একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। বিধুশেখর অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ ‘টোলো পণ্ডিত’ ছিলেন। স্মরণ রাখবার সুবিধার জন্য উল্লেখযোগ্য-গজ্জালীর মৃত্যু ১১১১ খিস্টাব্দে।]
সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী থেকে পুনর্মুদ্রিত
এ এক চরম বিস্ময়ের বস্তু। দশম, একাদশ শতাব্দীতে গজনীর মাহমুদ বাদশার সভাপতিত্বে আবু-র-বইহান মুহম্মদ আল বীরুনী ভারতবর্ষ সম্বন্ধে তাঁর প্রামাণিক পুস্তকে একাধিকবার সবিনয়ে বলেছেন, ‘আমরা (অর্থাত্ আরবীতে) যাঁরা জ্ঞানচর্চা করি, দার্শনিক চিন্তা আমাদের মজ্জাগত নয়। দর্শন নির্মাণ করতে পারে একমাত্র গ্রিক ও ভারতীয়রা।’
সেই ষড়দর্শননির্মাতা আর্য মনীষীগণের ঐতিহ্যগর্বিত পুত্রপৌত্রেরা মুসলমান-আগমনের পর সাত শত বত্সর ধরে আপন আপন চতুষ্পাঠীতে দর্শনচর্চা করলেন, কিন্তু পার্শ্ববর্তী গ্রামের মাদ্রাসায় ঐ সাত শত বত্সর ধরে যে আরবীতে প্লাতো থেকে আরম্ভ করে নিওপ্লাতনিজম তথা কিন্দী, ফারাবী, বু আলীসিনা (লাতিনে আভিসেনা), অল-গজ্জালী২ (লাতিনে অল-গাজেল), আবু রুশদ্ (লাতিনে আভেরস) ইত্যাদি মনীষীগণের দর্শনচর্চা হল তার কোন সন্ধান পেলেন না। এবং মুসলমান মৌলানারাও কম গাফিলী করলেন না। যে মৌলানা অমুসলমান প্লাতো-আরিস্ততলের দর্শনচর্চায় সোত্সাহে সানন্দে জীবন কাটালেন তিনি একেবারের তরেও সন্ধান করলেন না, পাশের চতুষ্পাঠীতে কিসের চর্চা হচ্ছে। তিনিও জানতে পেলেন না যে, তিনি প্লাতোর আদর্শবাদ দৃঢ়ভূমিতে নির্মাণ করার জন্য যেসব যুক্তি আকাশ-পাতাল থেকে আহরণ করেছেন তাঁর পাশের চতুষ্পাঠীতেই হিন্দু দার্শনিক শঙ্করাচার্যের আদর্শবাদ সমর্থনার্থে সেইসব যুক্তিই খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তিনি ‘গুলাত’ নাস্তিকদের জড়বাদ যেভাবে খণ্ডন করছেন, ব্রাহ্মণও চার্বাকের নাস্তিকতা সেইভাবেই খণ্ডন করছেন। এবং সবচেয়ে পরমাশ্চর্য, তিনি যে চরক-সুশ্রুতের আরবি অনুবাদে পুষ্ট বু আলীসিনার চিকিত্সাশাস্ত্র-‘য়ুনানী’ নামে প্রচলিত (কারণ তার গোড়াপত্তন গ্রিক [আইওনিয়ান=‘য়ুনানী’] চিকিত্সাশাস্ত্রের উপর)-আপন মাদ্রাসায় পড়াচ্ছেন, সুলতান বাদশার চিকিত্সার্থে প্রয়োগ করছেন, সেই চরক-সুশ্রুতের মূল পাশের টোলে পড়ানো হচ্ছে। সিনা উল্লিখিত যে-ভেষজ কি, তিনি কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না, কিংবা সিনা বলেছেন, ফলানা ওষুধিবনস্পতি এদেশে (অর্থাত্ আরবে) জন্মে না, সেগুলো যে তাঁর বাড়ির পিছনে আঁস্তাকুড়ে গজাচ্ছে তারও সন্ধান তিনি পেলেন না। কিঞ্চিত্ কল্পনাবিলাস করলে, এ পরিস্থিতিও অনুমান করা অসম্ভব নয় যে মৌলানার বেগমসায়েবা সিনা-উল্লিখিত কোন শাক তাঁকে পাক করে খাওয়ালেন, আর তিনি সেটি চিনতেই পারলেন না।
পক্ষান্তরে ভারতীয় আয়ুর্বেদ মুসলমানদের ইউনানী চিকিত্সাশাস্ত্র থেকে বিশেষ কিছু নিয়েছে বলে আমার জানা নেই।
এই দুস্তর মরুভূমির মাঝখানে মাত্র একটি লোক দেখতে পাই। আওরঙ্গজেবের অগ্রজ যুবরাজ মুহম্মদ দারাশীকূহ্। ইনিই সর্বপ্রথম দুই ধর্মের সমন্বয় সম্বন্ধে বহুতর পুস্তক লেখেন। তার অন্যতম মজমা-উল্-বহরেন, অর্থাত্ দ্বিসিন্ধুসঙ্গম। দারাশীকূহ্ বহু বত্সর
অনাদৃত থাকার পর তাঁর সম্বন্ধে প্রামাণিক গবেষণা বিশ্বভারতীতেই হয়। শ্রীযুত বিক্রমজিত্ হস্রত্ ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে ‘দারাশীকূহ্ : লাইফ অ্যান্ড ওয়ার্কস নামক একখানি অত্যুত্তম গ্রন্থ লেখেন এবং বিশ্বভারতী কর্তৃক সেটি প্রকাশিত হয়। প্রয়োজনমত আমরা এই পুস্তকখানি সদ্ব্যবহার করব।
আরও তিন শত বত্সর পর প্রাতঃস্মরণীয় রাজা রামমোহন রায় ফার্সীতে রচনা করেন তাঁর সর্বপ্রথম পুস্তক, ‘তুহাফতু অল্-মূওয়াহিহদীন:‘একেশ্বরবাদীদের প্রতি উত্সর্গ’। রাজা খ্রিস্টধর্মের সঙ্গেও সুপরিচিত ছিলেন বলে তাঁর পুস্তককে ‘ত্রিরত্ন’ধারী বা ত্রিপিটক বললে অত্যুক্তি হয় না। ব্রাহ্মধর্মের উত্পত্তি সম্বন্ধে যাঁরা সামান্যতম অনুসন্ধান করেছেন তাঁরাই জানেন রাজার শিক্ষাদীক্ষা ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতা-সংস্কৃতির নিকট কতখানি ঋণী এবং পরবর্তী জীবনে যদিও তিনি উপনিষদের উপর তাঁর ধর্মসংস্কারসৌধের দৃঢ়ভূমি নির্মাণ করেছিলেন তবু শেষদিন পর্যন্ত ইসলামের প্রতি তাঁর গভীর শ্রদ্ধার কণামাত্র হ্রাস পায়নি। প্রয়োজনমত আমরা তাঁর রচনাবলীরও সদ্ব্যবহার করব।
প্রায় ছশ’ বত্সর ধরে এদেশে ফার্সীচর্চা হল। হিন্দুরা না হয় বিদেশাগত ধর্ম ও ঐতিহ্যের প্রতি কৌতূহল না দেখাতে পারেন, কিন্তু যাদের রাজ্যচালনা করতে হয়েছে তাদের বাধ্য হয়ে এদেশের ভাষা রীতিনীতি অল্পবিস্তর শিখতে হয়েছে। উত্তম সরকারী কর্ম পাবার জন্য বহু হিন্দুও ফার্সী শিখেছিলেন। মাত্র একটি উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট হবে : এদেশে বহু হিন্দুর পদবী মুনশী। আমরা বাঙলায় বলি, লোকটির ভাষায় মুন্সিয়ানা বা মুন্শীয়ানা আছে, অর্থাত্ সে নাগরিক বিদগ্ধ চতুর (স্কিলফুল) ভাষা লেখে। এর থেকেই বোঝা যায়, কতখানি ফার্সী জানা থাকলে তবে মানুষ বিদেশী ভাষায় এ রকম একটা উপাধি পায়। তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে : আমরা প্রচুর ইংরেজি চর্চা করেছি, কিন্তু ইংরেজ মুনশী-জাতীয় কোনো উপাধি আমাদের কাউকে দেয়নি-বরঞ্চ আমাদের ‘ব্যাবু-ইংলিশ’ নিয়ে ব্যঙ্গই করেছে। কিন্তু এ বিষয়ে সবিস্তর আলোচনা পরে হবে, উপস্থিত এইটুকু উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই মুন্শী-শ্রেণীর যাঁরা উত্তম ফার্সী শিখেছিলেন তাঁদের অধিকাংশই কায়স্থ, সংস্কৃতের পটভূমি তাঁদের ছিল না, কাজেই উভয় ধর্মশাস্ত্রের সম্মেলন করা তাঁদের পক্ষে সম্ভবপর ছিল না। উপরন্তু এঁরা ফার্সী শিখেছিলেন অর্থোপার্জনের জন্য—জ্ঞানান্বেষণে নয়। তুলনা দিয়ে বলা যেতে পারে, আমরা প্রায় দুই শত বত্সর ইংরেজি বিদ্যাভ্যাস করেছি বটে, তথাপি খ্রিস্টধর্মগ্রন্থ বাঙলায় অনুবাদ করার প্রয়োজন অতি অল্পই অনুভব করেছি।
শ্রীচৈতন্যদেব নাকি ইসলামের সঙ্গে সুপরিচিত ছিলেন। কথিত আছে বৃন্দাবন থেকে সশিষ্য বাংলাদেশে আসার সময় পথিমধ্যে এক মোল্লার সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। সেই মোল্লা নাকি তাঁকে প্রশ্ন করেন, তিনি তাঁর শিষ্যদের ভ্রান্ত ধর্মপথে চালনা করছেন কেন? শ্রীচৈতন্যদেব নাকি তখন মুসলমান শাস্ত্র থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে প্রমাণ করেন যে তিনি ভ্রান্ত ধর্মপ্রচার করছেন না। মুসলমান ধর্মে বলা হয়, যে লোক আর্তের সেবা করে, মিথ্যাচরণ বর্জন করে সত্পথে চলে—অর্থাত্ কুরান-শরীফ-বর্ণিত নীতিপথে চলে—তাকে ‘পয়গম্বরহীন’ মুসলমান বলা যেতে পারে, হজরত্ মুহম্মদকে পয়গম্বররূপে স্বীকার করেনি বলেই সে ধর্মহীন নয়। (আমরা এস্থলে ‘কাফির’ না বলে ‘ধর্মহীন’ শব্দ ইচ্ছা করেই ব্যবহার করছি; পরে এর বিস্তৃত আলোচনায় প্রয়োজন হবে। অতএব অনুমান করা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয় যে, বোধ হয় চৈতন্যদেবের শর্ত উদার প্রকৃতিবান ব্যক্তির পক্ষে হজরত্ মুহম্মদকে অন্যতম মহাপরুষ বা পয়গম্বররূপেও স্বীকার করে নিতে আপত্তি থাকার কথা নয়। বস্তুত সে যুগে এবং এ যুগেও বহু হিন্দু সজ্জন মহাপুরুষ মুহম্মদকে আল্লার প্রেরিত পুরুষরূপে স্বীকার করতে কুণ্ঠাবোধ করেন না।
দ্বিতীয় ঘটনা, কাজী-কর্তৃক সংকীর্তন বন্ধ করা নিয়ে। কথিত আছে, সেবারেও তিনি যুক্তিতর্কে কাজীকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছিলেন। পূর্বের অনুমান এস্থলেও প্রযোজ্য।
কিন্তু চৈতন্যদেব উভয় ধর্মের শাস্ত্রীয় সম্মেলন করার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমাদের জানা নেই। বস্তুত তাঁর জীবনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল, হিন্দুধর্মের সংগঠন ও সংস্কার এবং তাকে ধ্বংসের পথ থেকে নবযৌবনের পথে নিয়ে যাবার।
তবুও এ বিষয় নিয়ে সবিস্তর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন।
এ যাবত্ আমাদের মূল বক্তব্য ছিল, মুসলমান যে জ্ঞানবিজ্ঞান ধর্মদর্শন সঙ্গে এনেছিলেন, এবং পরবর্তী যুগে, বিশেষ করে মোগল আমলে আকবর থেকে আওরঙ্গজেব পর্যন্ত মঙ্গোল-জর্জরিত ইরান-তুরান থেকে যেসব সহস্র সহস্র কবি পণ্ডিত ধর্মজ্ঞ দার্শনিক এদেশে এসে মোগল রাজসভায় আপন আপন কবিত্ব পাণ্ডিত্য নিঃশেষে উজাড় করে দিলেন তার থেকে এ দেশের হিন্দু ধর্মশাস্ত্রজ্ঞ, পণ্ডিত, দার্শনিকরা কণামাত্র লাভবান হননি। এবং বিদেশাগত পণ্ডিত দার্শনিক এ দেশে এসেছিলেন একমাত্র অর্থলাভের উদ্দেশ্যে—কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, স্বদেশ-প্রত্যাবর্তনের পর এঁদের অধিকাংশ তাঁদের চরম নিমকহারামির পরিচয় দিয়েছেন পঞ্চমুখে এদেশের নিন্দাবাদ করে। নিন্দা করেছেন মুসলমান রাজা এবং আমীর ওমরাহরাই—হিন্দু পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁদের কোন যোগসূত্র স্থাপিত হয়নি।
ফার্সী সাহিত্যের বিখ্যাত ঐতিহাসিক ব্রাউন উপরে উল্লিখিত যুগকে ফার্সী সাহিত্যের ইন্ডিয়ান সামার পুনরুচ্ছলিত যৌবন নাম দিয়েছেন। বস্তুত বর্বর মঙ্গোল অভিযানে ফলস্বরূপ ফার্সী সাহিত্যের যে অনাহারে মৃত্যুর আশঙ্কা ছিল সে তখন অন্নজল পায় মোগল-দরবারে। ইরান আজকের দিনে ভারতের কাছে কতখানি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করে সে খবর আমাদের কাছে পৌঁছায় না, কিন্তু ভারতবর্ষে ফার্সী সাহিত্যের এই যুগ নিয়ে অতিঅল্প আলোচনাই হয়েছে, তাও উর্দুতে, বাঙলাতে কিছুই হয়নি।
এ তো প্রধানত সাহিত্য ও অন্যান্য বাঙ্ময়ের কথা, কিন্তু আমাদের কাছে ভারতবর্ষের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি বলে মনে হয় এই দেখে যে, ভুবনবিখ্যাত ষড়দর্শনের দেশের লোক মুসলমান মারফতে প্লাতো-আরিস্ততল, সিনা রুশ্দ্ নিয়ে সপ্তম দর্শন নির্মাণ করল না। কল্পনা করতে এক অদ্ভুত অনুভূতির সঞ্চার হয়—ভারতবর্ষ তাহলে দর্শনের ক্ষেত্রে কত না দিক্চক্রবাল উত্তীর্ণ হয়ে যেত—দেকার্ত কান্টের অগ্রগামী পথপ্রদর্শক এ দেশেই জন্মাতেন!
পক্ষান্তরে মুসলমান যে-আরবি দর্শন সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন তাই নিয়ে পড়ে রইলেন। মঙ্গোল কর্তৃক বাগদাদ বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস হওয়ার পর, এবং স্পেন থেকে মুররা বিতাড়িত হওয়ার ফলে আরব-জগতে দর্শনের অপমৃত্যু ঘটে। এদেশের মুসলমান দার্শনিককে অনুপ্রাণিত করার জন্য বাইরের সব উত্স সম্পূর্ণ শুষ্ক হল। হায়, এঁরা যদি পাকে-চক্রে কোন গতিকে ষড়যদর্শনের সন্ধান পেতেন।
এ তো কিছু অসম্ভব কল্পনা-বিলাস নয়। আজকের দিনের হিন্দু দার্শনিক এক দিকে নব্যন্যায় চর্চা করেন, অন্য দিকে দেকার্ত অধ্যয়ন করেন। ব্রজেন্দ্রনাথ শীল, দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর এঁদের পথ-প্রদর্শক। কবি ইক্বালের ঐতিহ্যভূমি আভেরস-আভেচেন্নার উপর—তাঁর সৌধনির্মাণে তিনি সাহায্য নিয়েছেন কান্ট-হেগেলের।
আমরা এতক্ষণ যে অবস্থার বর্ণনা করলেম তার থেকে আপাতদৃষ্টিতে সিদ্ধান্ত করা সম্পূর্ণ অনুচিত নয় যে, ভারতবর্ষে তাহলে হিন্দু-মুসলমানের মিলন হয়নি। যেহেতু ব্রাহ্মণের দেবোত্তর বাদশা কেড়ে নেননি তাই তিনি নিশ্চিন্ত মনে আপন শাস্ত্রচর্চা করে যেতে লাগলেন, এবং যেহেতু আলিম-ফাজিলরা ওয়াক্ফ্-সম্পত্তি পেয়ে গেলেন তাই তাঁরাই পরমানন্দে তাঁদের মক্তব-মাদ্রাসায় কোরান-হাদীসের চর্চা করে যেতে লাগলেন। একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করার কোন প্রয়োজন অনুভব করলেন না।
কিন্তু দেশের সকলের তো লাখেরাজ ব্রহ্মোত্তর ওয়াক্ফ্-সম্পত্তি নেই। চাষা তিলি জোলা কাঁসারি মাঝি চিত্রকর কলাবত্ বৈদ্য কারকুন এবং অন্যান্য শত শত ধান্দার লোককে অর্থোপার্জন করে জীবনধারণ করতে হয়। সে স্থলে হিন্দু মুসলমানকে বর্জন করে চলতে পারে না, মুসলমানকেও হিন্দুর সংস্পর্শে আসতে হয়। তদুপরি উচ্চাঙ্গের চিত্রকলা সঙ্গীত স্থাপত্য বাদশা ও তাঁর অর্থশালী আমীর-ওমরাহের সাহায্য বিনা হয় না। বাদশারও দরকার হিন্দু রাজকর্মচারীর। কোনো দেশ জয় করা এক কর্ম, সে দেশ শাসন করা সম্পূর্ণ ভিন্ন শিরঃপীড়া। বাদশা ইরান-তুরান থেকে দিগ্বিজয় করার সময় রাজকর্মচারী সঙ্গে আনেননি। আর আনবেনই বা কি? তারা এ-দেশের ভাষা জানে না, রাজস্বব্যবস্থা বোঝে না, কোন্ দণ্ডনীতি কঠোর আর কোন্টাই বা অতি সদয় বলে দেশের লোকের মনে হবে—এ সম্বন্ধে তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। বখ্শী (চীফ পে-মাস্টার, অ্যাকাউন্টেন্ট-কাম্-অডিটার জেনারেল), কানুনগো (লিগেল রিমেমব্রেন্সার), সরকার (চীফ সেক্রেটারি), মুন্শী (হুজুরের ফরমান লিখনেওলা, নূতন আইন নির্মাণের খসড়া প্রস্তুতকারী), ওয়াকে-নওয়ীস্ (যার থেকে ডধয়হরং), পর্চা-নওয়ীস্ (রাজকর্মচারীর আচরণ তথা দেশের জনসাধারণ সম্বন্ধে রিপোর্ট তৈরি করনেওলা) এসব গুরুত্বপূর্ণ পদ গ্রহণ করবে কারা?
আমরা জানি, কায়স্থরা স্মরণাতীতকাল থেকে এসব কাজ করে আসছেন। এঁরাই এগিয়ে এলেন। মুসলমানপ্রাধান্য প্রায় দুশ’ বত্সর হল লোপ পেয়েছে, কিন্তু আজও এসব পদবী—প্রধানত কায়স্থদের ভিতর—সম্পূর্ণ লোপ পায়নি।
এ দেশের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য, উর্দু ভাষা এবং অন্যান্য বহু জিনিস যে হিন্দু-মুসলমানের অনিবার্য মেলামেশার ফলে হয়েছিল সে কথা সকলেই জানেন।
শুধু ভাস্কর্য ও নাট্যকলা বাদশা-আমীর-ওমরার কোনো সাহায্য পায়নি। তার কারণ, ইসলামে মূর্তি নির্মাণ নিষিদ্ধ এবং নাট্যকলা ভারতের বাইরে মুসলিম জগতে সম্পূর্ণ অজানা।
হিন্দুধর্ম ভিন্নধর্মাবলম্বীকে আপন ধর্মে গ্রহণ করে না। কাজেই অন্য ধর্ম সম্বন্ধে তার ঔত্সুক্য নেই। মুসলমান বিধর্মীকে মুসলমান করতে চায়। উভয়ের মিলনের চিন্তা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত কিংবা মুসলমান মৌলবী কেউ করেন না হিন্দু পণ্ডিত মুসলমানকে বলেন, ‘তুমি দূরে থাকো’। মুসলমান মৌলবী হিন্দুকে বলেন, ‘এসো, তুমি মুসলমান হবে’। তৃতীয় পন্থাও যে থাকতে পারে সেটা কারও মনে উদয় হয় না। হিন্দু হিন্দু থাকবে, মুসলমান মুসলমান থাকবে অথচ উভয়ের মধ্যে মিলন হবে, হৃদ্যতা হবে।
এ পন্থার চিন্তা করেছিল জনগণ। এটাতে ছিল তাদের প্রয়োজন। তাই এলেন ধর্মের জগতে জননেতা, জনাবতার কবীর দাদু নানক ইত্যাদি। পরম শ্লাঘার বিষয়, শান্তিনিকেতনেই এঁদের সম্বন্ধে অনুসন্ধান আরম্ভ হয়। এতদিন ধরে ভারতের হিন্দু-মুসলমান গুণী-জ্ঞানীরা যেসব মহাপুরুষদের সম্পূর্ণ অবহেলা করেছিলেন, শান্তিনিকেতনেই সে সময়ের ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী তাঁদের নিয়ে সমস্ত জীবন ব্যয়িত করেন। তাঁর ‘দাদু’ ‘কবীরে’র পরিচয় এস্থলে নূতন করে দেবার প্রয়োজন নেই।
সে পুণ্যকর্ম এখনো বিশ্বভারতীতে পূর্ণোদ্যমে অগ্রগামী। ক্ষিতিমোহনের বৃদ্ধ বয়সের সহকর্মী বিশ্বভারতীর অধ্যাপক শ্রীযুত রামপুজন তিওয়ারীর ‘সুফীমত-সাধনা ঔর সাহিত্য’ সুচিন্তিত স্বয়ং-সম্পূর্ণ পুস্তক হিন্দি সাহিত্য তথা মধ্যযুগীয় লোকায়ত ধর্ম-চর্চার গৌরব বৃদ্ধি করেছে। পাণ্ডিত্যপূর্ণ অথচ সরল ভাষায় লিখিত এ ধরনের গ্রন্থ সর্ব ভাষায়ই বিরল।
কিন্তু চিন্তাজগতে—দর্শন-ধর্মশাস্ত্র-জ্ঞানবিজ্ঞানে—হিন্দু-মুসলমানের মিলনভাব অথচ অনুভূতির ক্ষেত্রে—চারুকলা সঙ্গীত লোকসাহিত্যে গণধর্মে—আশাতীত মিলন। এ বিষয়ে অধ্যয়ন এবং চর্চা করতে হলে উভয় জনসমাজের মূল ধর্ম, সামাজিক আচার-ব্যবহার গোড়া থেকে অধ্যয়ন করতে হয়। হিন্দুধর্ম ও সমাজ সম্বন্ধে আমাদের যথেষ্ট জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা আছে, কিন্তু মুসলমান ধর্মের উত্পত্তি ও বিকাশ সম্বন্ধে বাংলা ভাষায় প্রায় কিছুই নেই। যা-কিছু আছে তা সরল ধর্মোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ এবং স্বধর্মবিশ্বাসীর হৃদয়-মনে উত্সাহ-উদ্দীপনা সঞ্চার করার জন্য-বিধর্মীর সম্মুখে আপন ধর্ম যুক্তিবিচারের উপর নির্মাণ করে তাকে আকর্ষণ করার কোনো প্রচেষ্টা তাতে নেই, আপন ধর্মের স্বতঃসিদ্ধ নীতিও যে বিধর্মীর কাছে প্রামাণ্যভাবে অসিদ্ধ হতে পারে সে দুশ্চিন্তাও এ-সাহিত্যকে বিক্ষুব্ধ করেনি। উপরন্তু ইংরেজ-আগমনের পর এদেশের ইংরেজি শিক্ষিত হিন্দুরা ইংরেজির মারফতে পেলেন ইসলামের এক বিকট বিকৃত রূপ। সরল হিন্দু জানত না, খ্রিস্টান এবং মুসলিমে স্বার্থসংঘাত লেগে যায় মহাপুরুষের মৃত্যুর অল্প দিন পরেই, শত শত বত্সর ক্রুসেডের নামে একে অন্যের মরণালিঙ্গনে তারা সম্পিষ্ট; ফলে খ্রিস্টান কর্তৃক ইসলাম ও হজরত্ মুহম্মদের বিরুদ্ধে অকথ্য কটুবাক্য এদেশে এসেছে ‘নিরপেক্ষ গবেষণা’র ছদ্মবেশ ধরে। সাধারণ সরল হিন্দু এ ছদ্মবেশ বুঝতে পারেনি। (এস্থলে বলে রাখা ভালো, মুসলমান কিন্তু খ্রিস্টানকে প্রাণভরে ‘জাত তুলে’ গালাগাল দিতে পারেনি, কারণ কুরান-শরীফ যীশুখ্রিস্টকে অন্যান্য মহাপরুষদের একজন বলে যে স্বীকার করে নিয়েছে তাই নয়, তিনি মুহম্মদের পূর্বে সর্বপ্রধান পয়গম্বর বলে তাঁকে বিশেষ করে ‘রূহুল্লা’ ‘আল্লাহ আত্মা’ ‘পরমাত্মার খণ্ডাত্মা’ উপাধি দেওয়া হয়ে গিয়েছে। পক্ষান্তরে খ্রিস্টান যুগ যুগ ধরে হজরত্ মুহম্মদকে ‘ফলস ‘প্রফেট’ ‘শ্যালট্যান ইত্যাদি আখ্যায় বিভূষিত করেছে। প্রায় চল্লিশ বত্সর পূর্বেও ঐতিহাসিক ওয়েলস তাঁর ‘বিশ্ব-ইতিহাসে’ মুহম্মদ যে ঐশী অনুপ্রেরণার সময় স্বেদাসক্ত বেপথুমান হতেন তাকে মৃগারুগীর লক্ষণ বলে মহাপুরুষকে উভয়ার্থে লাঞ্ছিত করেছেন)।
রামমোহন রামকৃষ্ণ রবীন্দ্রনাথ বিবেকানন্দ সর্বদেশেই বিরল। এদেশে তো অবশ্যই।
ইতিমধ্যে আর-একটি নূতন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
এতদিন যে হিন্দু পণ্ডিত দার্শনিক মুসলমানের ধর্ম আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে কোনো কৌতূহল প্রকাশ করেননি তাতে হয়তো তাঁদের কোনো ক্ষতিবৃদ্ধি হয়নি, কিন্তু স্বরাজলাভের পর তাঁদের সে দৃষ্টিবিন্দু পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আফগানিস্তান ইরান ইরাক সিরিয়া সউদি আরব ইয়েমেন মিশর তুনিস আলজিরিয়া মরক্কো তথা মুসলমানপ্রধান ইন্দোনেশিয়া ও নবজাগ্রত মুসলিম অধ্যুষিত আফ্রিকার একাধিক রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের হৃদ্যতা স্থাপন করতে হবে। মুসলিমপ্রধান পাকিস্তানও এ ফিরিস্তির অন্তর্ভুক্ত। এদের ধর্ম, তার উত্পত্তি ও ক্রমবিকাশ, রাজনৈতিক তথা অর্থনৈতিক বাতাবরণ-পার্থক্যে তাদের ভিন্ন ভিন্ন রূপ-পরিবর্তন— এসব এখন অল্পবিস্তর অধ্যয়ন না করে গত্যন্তর নেই। সত্য, আমাদের ইস্কুল-কলেজে এখনো আরবী-ফার্সীর চর্চা সম্পূর্ণ লোপ পায়নি, কিন্তু এই নিয়ে সন্তুষ্ট হওয়াটা সমীচীন হবে না। কিছু কিছু হিন্দুদেরও আরবী-ফার্সী শিখতে হবে। এবং এই সাতশ’ বত্সরের প্রাচীন আরবী-ফার্সীর শিক্ষাপদ্ধতিও পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু সে প্রসঙ্গ যতই প্রয়োজনীয় হোক, এ স্থানে কিঞ্চিত্ অবান্তর।
আমরা যে মূল উেসর সন্ধানে বেরুচ্ছি তার জন্য আজ আর প্রাচীন মানচিত্র কাজে লাগবে না। ভাবোচ্ছ্বাসে পরিপূর্ণ অথবা সন্দেহে কণ্টাকাকীর্ণ প্রাচীন কোনো পদ্ধতির অনুসরণ করলে আজ আর চলে না। ধর্মকেও আজ রাজনীতি অর্থনীতি সমাজনীতির কষ্টিপাথর দিয়ে যাচাই করতে হয়।
কিন্তু অনুসন্ধিত্সু মনের সঙ্গে থাকবে সহানুভূতিশীল হৃদয়।
[১ টয়িনবি সাহেব যে রীতিতে পৃথিবীর সর্বত্র একই প্যাটার্নের অনুসন্ধান করেন বর্তমান লেখক সে নীতি অনুসরণে বিরত থাকবে। শুধু যেখানে প্যাটার্নের পুনরাবৃত্তি দেখিয়ে দিলে আলোচ্য বিষয়বস্তু স্পষ্টতর হবে সেখানেই এই নীতি মানা হবে। এস্থলে তাই শুধু উল্লেখ করি, যখনই কোন জাতি বৈদেশিক কোন ভিন্নধর্মাবলম্বী দ্বারা পরাজিত হয় তখন নূতন রাজা এঁদের পণ্ডিতমণ্ডলীকে কোন প্রধানকর্মে আমন্ত্রণ জানান না বলে এঁদের এক মানসিক পরিবর্তন হয়। এঁদের চিন্তাধারা তখন মোটামুটি এই : ‘আমাদের ধর্ম সত্য এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তবে আমরা ম্লেচ্ছ বা যবন কর্তৃক পরাজিত হলুম কেন? এর একমাত্র কারণ এই হতে পারে যে, আমরা আমাদের ধর্মের প্রকৃত রূপ বুঝতে পারিনি। ধর্মের অর্থকরণে (ইন্টারপ্রিটেশনে) নিশ্চয়ই আমাদের ভুল রয়ে গিয়েছে। আমরা তা হলে নূতন করে ব্যাখ্যা করে দেখি, ত্রুটি কোন্ স্থলে হয়েছে।’ ফলে পরাজয়ের পরবর্তী যুগে তাবত্ সৃষ্টশক্তি টীকাটিপ্পনী রচনায় ব্যয় হয়।]
[২ ইসলামের অন্যতম প্রখ্যাত পথপ্রদর্শক বা ইমাম। ইনি দার্শনিক-কিয়ত্কালের জন্য নাস্তিক- এবং পরিণত-বয়সে সূফী (মিস্টিক, ভক্তিমার্গ ও যোগের সমন্বয়কারী) হয়ে যান। এঁর জনপ্রিয় পুস্তক ‘কিমিয়া সাদত্’ এই শতাব্দীর প্রারম্ভে বাংলায় অনূদিত হয়ে রাজশাহী থেকে প্রকাশিত হয়। বিশ্বভারতীর সর্বপ্রথম অধ্যক্ষ স্বর্গত বিধুশেখর শাস্ত্রী এই পুস্তকের বড়ই অনুরাগী ছিলেন এবং আমাদের মন্দিরের উপাসনায় একাধিকবার ব্যবহার করেছেন। বিধুশেখর অত্যন্ত আচারনিষ্ঠ ‘টোলো পণ্ডিত’ ছিলেন। স্মরণ রাখবার সুবিধার জন্য উল্লেখযোগ্য-গজ্জালীর মৃত্যু ১১১১ খিস্টাব্দে।]
সৈয়দ মুজতবা আলী রচনাবলী থেকে পুনর্মুদ্রিত
সূত্র : আমার দেশ
The Eight-Way Strategy – Titanium Color.
ReplyDeleteTitanium Color titanium frames is one suppliers of metal of the world's most popular 2014 ford fusion energi titanium colors and is one of ford escape titanium for sale the most popular colors used in casino games. The revlon titanium max edition color-changing colors