জারুল গাছের ফাঁক দিয়ে কচ্ছপের মতো বাঁকা সেতুটা পার হতেই একটা জিনিস শ্যাম প্রাসাদের নজরে পড়ে, একটা প্রতিবিম্ব। জলের মধ্যে প্রতিবিম্বটা এপার হতে ওপারে চলে যাচ্ছে। জলের মধ্যে ঢেউগুলো তীর তীর করে নড়ছে, আর ক্ষুদ্র রেখাগুলো দীর্ঘায়িত হয়ে জলের আলোর ঝিলমিল খেলাকে প্রতিসারিত করছে। এরকম দৃশ্য আজই সে খেয়াল করলো। অনেক বার এই পথ দিয়ে গেছে কিন্তু কিছুই নজরে আসেনি। তার মনের মধ্যে একটা কৌতূহল জেগে উঠলো, প্রতিবিম্বটা কী? এমন উত্তেজনাকর? সে খেয়াল করলো জল সংলগ্ন প্রতিবিম্বটা একটা বিরাট বাড়ির আর তার থেকে আসা আলোটাই জলের মধ্যে পড়ে প্রতিবিম্ব হয়ে একূল ছেড়ে ওকূলে চলে যাচ্ছে ওরকম ভাবে প্রতিবিম্ব সৃষ্টি করায় স্থানীয় মানুষেরা বাড়ির নাম দিয়েছে তাজমহল, আর তাজমহলের মালিক হচ্ছে ডাকসাঁইটের নেতা এমপি কিরিট মোহন।
শ্যাম প্রসাদের চোখটা আটকে যায়, মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে, প্রতিবিম্ব এতটা স্বচ্ছ আর দীর্ঘ হতে পারে? কোনোদিন তো সে খেয়াল করেনি, এপার হয়ে ওপারে চলে যাচ্ছে? অদ্ভুত ব্যাপার, দেখবারও বটে। এ পথ দিয়ে সে বহুবার গেছে আবার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে এসেছে কিন্তু আজকের মত নতুন কিছুই তো তার নজরে আসেনি। নজরে আসবে কী করে কিছুই তো নজরে আসবার মতো ছিল না। কিন্তু নজরে আসলো কেন? কী ঘটেছে এমন কিছু যা নজরে আসবার মত। খুঁজতে থাকে শ্যাম প্রসাদ, কী হতে পারে? কাউকে পাওয়া দরকার যে এর কারণ আবিষ্কার করতে পারে।
সামনে এগুতেই একটা ছেলের সাথে দেখা হয়ে যায়, তাকেই সে জিজ্ঞাসা করে সে, আচ্ছা বলতে পার এই যে জলাশয়ের ভেতর এতটা প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়েছে আর একূল ছেড়ে ওকূলে চলে যাচ্ছে তার কারণটা কী? তুমি কি খেয়াল করেছো আমি কিসের কথা বলছি?
ছেলেটি প্রথমে থমকে যায়, দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। শ্যাম প্রসাদের আঙুলের নিশান দেখে ছেলেটা জলের দিকে তাকায়। আসলেই তো একটা বিরাট ব্যাপার থইথই জলের মধ্যে আলো পড়ে একূল ছেড়ে ওকূলে যাচ্ছে। প্রতিসারিত আলোর অপূর্ব রোশনাই। আলোর সমাহার। ছেলেটা মনের মধ্যে এর জন্য একটা শব্দ দেয়ার চেষ্টা করে। কী হতে পারে এই দৃশ্যটা। সে পড়েছিল 'নয়নাভিরাম'। আসলেই দৃশ্যটা নয়নাভিরাম। ছেলেটি নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। হারিয়ে যায় সেন্ট মার্টিনের সন্ধ্যার পর পূর্ণিমার রাতে সে দৃশ্য সে তার বাবা-মায়ের সাথে দেখেছিল সেই দৃশ্যে। আলোর বন্যা একূল থেকে সেকূলে ভেসে যাচ্ছে যেন গলন্ত মুক্তোর দানা। শ্যাম প্রসাদের কথায় তার সম্বিৎ ফিরে আসে। কই তুমি তো কিছু বলছো না? চুপ করে গেলে যে? ছেলেটি এবার মুখ খোলে,- জানেন না বুঝি, এমপি বাবু এবার তাজমহলে দুর্গাপূজা করছে?
-তাজমহলে দুর্গাপূজা! দুর্গাপূজা তো অন্য জায়গায় হয়।
- না, এবার এখানেই হবে। বহু কাল আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া মন্দিরে এবার পুজো হবে। গ্রামের মানুষ হিসাব করে দেখেছে প্রায় ষাট বছর আগে এ বাড়িতে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। এমপি বাবুই পুরনো শীতল রায়ের বাড়ি দখলে নিয়ে দুর্গাপূজার বোধন করেছে। তাই এত আলোর রোশনাই।
শ্যাম প্রসাদ তথমত খেয়ে নেয়। মনে মনে আওড়ায় শীতল রায়ের জমিদার সদৃশ বাড়ি দখলে নিয়েছে এমপি? শীতল রায়েরা পুরনো ব্যবসাদার তাদের বিত্তের কথা সবাই জানে। অনেক দিন হয় সেই ব্যবসা আর নেই, বাড়িটি অযত্নে ঝোঁপ ঝাড়ে পূর্ণ হয়ে ছিল, বহুদিন বাড়িটাতে কোনো বড় আলো জ্বলেনি। ছেলে বেলায় দেখেছে কী বিরাট বাড়িই না ছিল এটি, সব সময় লোকের পদচারণায় গমগম করতো, সব ধরনের পূজা হতো এ বাড়িতে। এ বাড়ির মেয়ে সুনীতা ছিল তার দিদির সহপাঠী, দিদির সাথে সে এ বাড়িতে এসেছে বহুবার। পুজোর সময় কী আনন্দই না হতো! সেই বাড়ি এখন কিরিট মোহনের! ব্যাপারটা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। আস্তে আস্তে জলাশয় পার হয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা দেয় শ্যাম প্রসাদ।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই শ্যাম প্রসাদ দেখতে পায় তার বাবার সাথে পাশের বাড়ির পরেশ চক্রবর্তী ও সুধীন ম-ল কী যেন আলাপ করছে। বাবাকে পরেশ চক্রবর্তী বলছে, দেখেছো ভায়া, এমপি কিরিট মোহন কেমন করে রায়েদের বাড়িটা দখল করেছে? দুর্গাপূজার নাম করে বাড়িটা দখল করে বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছে। আসলে দুর্গাপূজা টুজা কিছু নয়, বাড়িটা দখল করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যদিও সত্যি সত্যি অনেক দিন হয় বাড়িতে কোন জনমানব ছিল না, ঝোপ-ঝাঁড়ে পূর্ণ হয়ে সাপখোপের আবাসে পরিণত হয়েছিল এবং অসামাজিক কর্মকা-ের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল, সেদিক থেকে বাড়িতে একটা দখল পড়েছে বিষয়টি ভালো কিন্তু মন্দের বিষয়টা হলো বাড়ি দখলের প্রক্রিয়া নিয়ে।
সুধীন ম-ল সন্ত্রস্ত একটা ভাব নিয়ে বলল, পুলিশ নাকি এসেছিল? তা আসবে না, আলবাত আসবে, এত বড় একটা বাড়ি দখল হয়ে গেল, আর তারা খোঁজ খবর নেবে না। অন্যদিকে শুনলাম শিল্পপতি শুভ্রব্রত সাহা ও আইনজীবী সুনীল মিত্রও নাকি বাড়ি দখলের খেলায় নেমেছে। তাড়াও নাকি ছাড়বে না। ত্রিমুখী লড়াই, দেখা যাক কে হারে আর কে জেতে তবে এমপি বাবু দাবার খেলায় একচাল এগিয়ে গেল।
শ্যাম প্রসাদের বুঝতে আর বাকি কিছু রইল না, রাজনীতির তকমা যে এখানেও ভালো করছে লেগেছে তার বুঝ নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো।
সপ্তমী পুজোর দিন বাড়ি ছেড়ে বড় রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় তাজমহলের সামনে এমপি কিরিট মোহন আর তার চেলা চামু-ারা। একজন সাগরেদ কিরিট মোহনকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলল,
- দেখেছেন স্যার, বাড়িটা কী সুন্দরই না লাগছে, মন্দিরের সাথে মায়ের শ্রী একীভূত হয়ে গেছে, গৌরের সাথে গৌরী যেন মিশে গেছে। এমন বড় বাড়ি কি সকলের মানায়? যাদের এক সময় মানাত তারা তো মরে গেছে- চলে গেছে, এখন বাড়িটা পড়ে থেকে সাপ খোপের আর অসামাজিক কর্মকা-ের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে? তার থেকে আপনার মত মহান মানুষ এই বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, দুর্গাপূজা শুরু করেছে। সবাই কি এ বাড়ির মর্যাদা বুঝবে, না বোঝে? যে বুঝে তার হাতেই পড়েছে। আর ঈশ্বর তারই হাতে সেই জিনিস দেন যে তার মর্যাদা বোঝে। সৌভাগ্য সবার হয় না। বড় জিনিসের জন্য বড় সৌভাগ্যের প্রয়োজন।
- তুমি তো বাড়ির বিশালত্বের সাথে আমার মর্যাদার সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছো কিন্তু এর পেছনে কী রকম শক্তি এবং কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তুমি কি তা জান?
- না স্যার, আমরা জানবো কী করে?
- এখনো অনেক মানুষ এর পেছনে লেগে আছে। বিশেষ করে এক শিল্পপতি এবং এক আইনজীবী। তারা দুজন একত্র হয়ে আমার পেছনে লেগে আছে। বাড়ি যখন আয়ত্তে নিয়েছি এবং দুর্গাপূজা শুরু করেছি সেহেতু আমাকে উচ্ছেদ করা এতটা সহজ হবে না। আর এ সমস্ত বিষয়ে আমার থেকে অভিজ্ঞতা কার বেশি? আমি সহজে ছাড়বার পাত্র নাই।
- পুলিশ নাকি এসেছিল?
- আসতেই পারে। পুলিশের কাজ পুলিশ করবে, আমার কাজ আমি করবো। তবে পুলিশ আমাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। তারাও জানে আমাকে ঘাঁটানো অত সহজ হবে না, আমি এখানকার নির্বাচিত এমপি। আমার দলের লোকদের লেলিয়ে দিলে তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।
-স্যার, আমরা আছি না? কোন শালাকে এই চত্বরে প্রবেশ করতে দেবো না, এটা দিয়ে..., বলেই সে মাজায় থাকা পিস্তলটা বের করে। তারপর বলে- শুধু আদেশ দেবেন স্যার। লাশ ফেলে দেব।
-স্যার, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? আর একজন বলল।
- কী জিনিস?
-একটা প্রতিবিম্ব। সামনে একটি জলাশয় আছে এবং জলাশয়টা দূরবিস্তৃত। রাতের বেলা যখন আলোর রোশনাই জ্বলে তখন আলোর প্রতিবিম্ব কেমন করে জলাশয়ের একুল ছেড়ে ওকুলে চলে গিয়ে দিগন্তের সাথে মিশে যায় তা কি কখনো আপনি খেয়াল করেছেন? তাজমহলের তাজ যেন জলের মধ্যে আলোর বহ্নি।
কিরিট মোহন অবাক হয়ে যায়, ক্ষণকালের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ে। সত্যি কি তাই, তার এই বাড়িতে যমুনার ছায়া ভেসে উঠছে। আরামে চোখ দুটো মুদে আসে। একটা পরম আয়াস যে তার নামটা সম্রাট শাজাহান এর সাথে ভেসে উঠবে। শাজাহানের মত তার কীর্তিও কি ইতিহাসে অক্ষয় হবে? তার এই স্বপ্ন কি সত্যি বাস্তবায়িত হবে? তার এই বিহ্বলতা বাড়িটির নিয়ন্ত্রণে সাথে সরাসরি জড়িত, নিয়ন্ত্রণ আর স্বপ্ন, স্বপ্ন আর নিয়ন্ত্রণ। কিরিট মোহন মুহূর্তের জন্য পার্থিব জগত ত্যাগ করে অন্যলোকে চলে যায়। তার এই বিহ্বলতা কি নষ্ট হয়ে যাবে কিছু শয়তান মানুষের জন্য? তার সখের তাজমহল হাত ছাড়া হয়ে যাবে? পুলিশকে সে আয়ত্তে আনতে পারবে কিন্তু শিল্পপতি আর আইনজীবীকে সে সামলাবে কীভাবে? শরীরটা উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে যায়, কানের মধ্যে একটা গরমভাব অনুভব করে। নাকের ডগায় শীতলতা স্পর্শ করে।
সপ্তমি পূজোর সংস্কৃত শোকের উচ্চরণিত মন্ত্র উচ্চারণের মাঝে নিহিত হয়ে যায় তাজমহলের তাজের বহ্নি, বাদ্যকারের ঢাকের শব্দ সেই বহ্নিকে স্থায়ী রূপদানের সিঁড়ি হয়ে দেখা দেয় কিরিট মোহনের মনে। সে মনে মনে বলে- মা মাগো যে সৌভাগ্য নিজে এসে ধরা দিয়েছে তাকে তুমি স্থায়ী করো, হে দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী তুমি তো রক্ষাকর্তা, তুমি আমায় রক্ষা কর, সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত শক্তি দাও, আমায় অভয় দান কর।
কিরিট মোহন মন্দিরের চৌকাঠে সষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। তার প্রণাম আর প্রার্থনার সাথে বাড়িটির ভাগ্যও যেন জড়িয়ে ফেলতে চায়। সে এমপি, সে যদি বাড়িটাকে আয়ত্তে না নিতে পারে, তবে কে নেবে? তারই তো প্রাপ্য অধিকার এই বাড়ির। শুনেছে অন্য দুজন তারাও এ বাড়িতে চড়াও হয়ে এই বাড়ির দখল নেবে, তাদের কাছে নাকি রায়েদের শেষ বংশধরের স্বাক্ষরসহ দলিল আছে- সেই দলিলের বলে এই বাড়ির মালিকানা দাবি করে বাড়ির নিয়ন্ত্রণ তাদের অধিকারে নিতে চায়। তারা যদি পারে তো আসুক, ও রকম কাগজ তো তার কাছেও কত আছে। শুধু শেষ বংশধরের নয় তারও আগের কারো স্বাক্ষর সংবলিত দলিল। কাগজতো কতই বানানো যায়। সেও তাদের সামনে তুলে ধরবে, বলবে নগদ দামে খরিদ করা। আর তা যদি মানতে না চায় তাহলে সে এতদিন কী করলো, কিসের জন্য রাজনীতি করলো? প্রায় তিরিশ বছর সে রাজনীতি করছে, রাজনীতির প্রতিটি অক্ষর তার জানা- বহু টাকা খরচ করে এমপি হয়েছে। রাজনীতিতে এই বিনিয়োগ যদি হাজারগুণ হয়ে ফিরে না আসে তাহলে সে রাজনীতি করে কী লাভ! তার থেকে তেল লবণের দোকানে অনেক লাভ সেখানেই সে বিনিয়োগ করবে। অসংখ্য মানুষকে সহায়তা দিয়ে তাদের দলভুক্ত করেছে, তারা যদি এখন কাজে না লাগে তবে কখন কাজে লাগবে, আর তাদের যে এত বছর ধরে পুশল তার কোন ফায়দা হবে না? পারবে না তারা সম্মিলিত পশুশক্তির বিরুদ্ধে জয়ী করতে বা দখল নিয়ন্ত্রণে নিতে? তাহলে তার এত বছরের শ্রম মিছে, রাজনীতি মিছে, সমস্ত বিনিয়োগ ফর্দাফাই।
পুলিশের দুটি গাড়ি মন্দিরের সামনে বাড়ির চত্বরে প্রবেশ করে। দারোগাসহ বেশ কিছু কনস্টেবল গাড়ি থেকে নিচে নেমে আসে। সামনে যাকে পায় তাকে জিজ্ঞাসা করে,
- এই দুর্গা পূজোর নেতৃত্বে কে আছেন?
-এমপি কিরিট মোহন। তিনি রায় বাড়িতে দুর্গাপূজা করছেন।
-আমরা জেলা ভিজিলেন্স টিম, আমরা পুজোর সার্বিক নিরাপত্তা বিধান ও তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত আছি। এখানে তিন জন কনস্টেবলকে আমরা দিয়ে যাচ্ছি, এই তিন জন দশমীর বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত এখানে ডিউটিতে থাকবে। তাদের খাবার এবং যাবতীয় সহায়তা প্রদান করবেন। যিনি এই পুজোর দায়িত্বে আছেন তাকে এই কাগজে একটা সহি প্রদান করতে হবে।
তিনজনকে নামিয়ে রেখে পুলিশের ভ্যান পূজোর চত্বর ছেড়ে শব্দ করে বেরিয়ে গেল। পুলিশের ভ্যান বেরিয়ে যেতেই কিরিট মোহন তার দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেল। চেলাদের বলে গেল বাড়ির নিয়ন্ত্রণ যেন কোনো মতেই ছুটে না যায়।
শিল্পপতি শুভব্রত ও অমিত মিত্র তাজমহলের সামনে এসে দাঁড়ালেন লোকজন পরিব্রত হয়ে। তাদের সাথে বহু শ্রমিক এবং ভাড়াটে গু-া। তারা তাজমহলের সামনে মাইক সহকারে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলো।
-তাজমহলের অধিকার নিয়েছে এমপি কিরিট মোহন, আপনারা জানেন তার কোন বৈধ কাগজপত্র নেই, তবু ক্ষমতার জোরে আর পুলিশকে পয়সা দিয়ে এ বাড়ির দখল নিয়ে এখানে দুর্গাপূজার আসর জমিয়েছে, ভেবেছে দুর্গাপূজার আসর বসিয়েই তাজমহলের অধিকার তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কিন্তু আমরা শপথ করে বলছি এ নিয়ন্ত্রণ তিনি কিছুতেই নিজের আয়ত্তে রাখতে পারবেন না, আমরা তা হতে দেব না। আইন এবং বিচারালয় আমাদের পক্ষে আছে, জনগণও আমাদের পক্ষে আছে। কিরিট মোহন ভেবেছেন শুধু সাগরেদ আর অর্থ দিয়ে দখলদারিত্ব বজায় রাখবেন কিন্তু তিনি এ দখলদারিত্ব বজায় রাখতে পারবেন না। বাড়ি তাকে ছাড়তেই হবে, তা না হলে এখানে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে। লাশের গন্ধ বাতাসে উঠবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও ছাড়িয়ে যাবে। আমরা সমস্ত বিরোধী বন্ধুদের অনুরোধ করি এ চত্বর খালি করে দিয়ে এলাকা ত্যাগ করতে এবং এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। আমরা শান্তির পক্ষে, আমরা চাই অন্য পক্ষও আমাদের শান্তির পতাকা তলে শরিক হোক, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুক। তা না হলে আমাদের মিলিত শক্তি একত্রিত হয়ে ফুৎকারে অগি্ন বলাকা হয়ে ধ্বংস করবে, আর আমরা চাই না এমন কোন দ্বন্দ্ব। শিল্পপতি সুব্রত সাহার বলার পর উঠে দাঁড়ালেন আইনজীবী অমিত মিত্র:
-আমরা চাই না এই পবিত্র দিনে এমন রক্তক্ষয় হোক। আমরা দশমীর দিনে দুর্গা বিসর্জনের পর এই বাড়ি দখলে নেব। মা আমাদের সহায়, তার আশীর্বাদ নিয়েই এই বাড়ির অধিকার আমরা নিতে চাই। আমরা অমানবিক নই, কিন্তু দুর্বলও নই, চাইলে আজই আমরা এই বাড়ি আমাদের আয়ত্তে নিতে পারি, চড়কাবাজির খেলায় খেলিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারি। বোমার তুর্কিবাজির সকল খেলাই আমাদের হাতে কিন্তু সেই মহড়ায় আজ নাই বা গেলাম। কিরিট মোহন যদি মনে করেন তিনি এমপি হয়েছেন বলে সব কিছুই তার ভোগে যাবে তবে ভুল করছেন, হিসাব সবসময় পাঁকা হয় না, আর হবেও না, আমরা তা হতে দেব না। আমরা ফিরে গেলাম এই প্রত্যাশায় তিনি স্বেচ্ছায় আমাদের এই বাড়ি খালি করে দিয়ে চলে যাবেন। নতুবা আমরা দশমীর দিন আবার আসবো। সেদিন আজকার মতো কোনো শান্তির কথা থাকবে না, থাকবে ন্যাকড়াবাজির কথা, রক্তের লেলিহান উঠবে, মৃত্যুর হলিখেলা চলবে। অসুর শক্তি বিনাসের মাধ্যমে এই ধরা ধামে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, মহিশাসুর বধের মাধ্যমে রায় বাড়ি দখলে নেয়া হবে।
অবস্থা এমনি হয়ে দাঁড়ালো যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম যে কোন মুহূর্তে শুরু হয়ে যেতে পারে, পুলিশ অবস্থার গুরুত্ব বুঝে চারিদিকে কঠোর বেষ্টনি দিয়ে ফেলল। রায় বাড়িতে যে পূজো কিরিট মোহন শুরু করেছিল তা প্রশাসন নিজের হাতে তুলে নিল। কোন পক্ষের বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশের অধিকার রইল না।
অন্যদিকে প্রতিবিম্বের কথাটা কেমন করে যেন জানাজানি হয়ে যায়। প্রতিদিনই মানুষ জলের ভেতর আলোর রোশনাই দেখবার জন্য হাজির হতে লাগল। দলে দলে, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। সকলে কুলে দাঁড়িয়ে দেখে কী অপূর্ব আলোর রোশনাই, মুক্তোর দানার মত এক কূল ছাড়িয়ে অন্য কূলে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করে রায়েদের পুরনো ঐতিহ্য মা আবার ফিরিয়ে দিয়েছে, এই জল আর এই রোশনাই দেখবে যারা তারা হবে পুণ্যবান এবং তাদের জীবনে রায়েদের সেই সৌভাগ্য আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে।
রোশনাইয়ের দৃশ্য যা কিরিট মোহন যমুনার তীরে দেখতে পেয়েছিল এবং পরম আয়েশে দেখেছিল তা মানুষের মুখে মুখে তার কানেও গিয়ে পেঁৗছায়, হাজার হাজার মানুষ তাজমহলের সামনে গিয়ে আলোর রোশনাই দেখছে এবং মানুষজন সেই জলে স্নান করে পুণ্যবান হচ্ছে। কিরিট মোহন আবেগে বিহ্বলিত হয়ে দশমীর দিন তাজমহলের জলাশয়ের সামনে গিয়ে হাজির হয়। শিল্পপতি ও আইনজীবী মানুষের কথা শুনে তারাও দেখতে যায় প্রতিবিম্ব, কেমন করে তা এই কুল থেকে ওকুলে ভেসে যাচ্ছে।
জলাশয়ের সামনে তিনজনে হাজির। একে অপরকে দেখতে পায়। কিরিট মোহন অপর দুজনকে দেখতে পেয়ে বলে, - কী হে ভায়া, তোমরাও কি আমার মতো তাজের প্রতিবিম্ব দেখতে এসেছো? কী অপূর্ব না? একটা আলোর বহ্নি, প্রচ- আলোরচ্ছটা!
-আমরাও অবিভূত হয়েছি এই দৃশ্য দেখে। শুনছি রায়েদের সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য মানুষ জলে অবগাহন করছে। হবো নাকি সেই জলে স্নান করে পুণ্যবান? শিল্পপতি সুব্রত সাহা বলে।
তাদের কথা চলাকালে শ্যাম প্রসাদ ও তার বন্ধুরা সাড়ম্বরে দশমীর রাতে মা দুর্গাকে বিসর্জন দেয়ার জন্য দেবীকে জলাশয়ের কিনারায় নিয়ে আসে। জলের প্রতিবিম্বের দিকে প্রতিমার মুখ স্থাপন করে। দেবী দুর্গাকে কিনারে আনতেই কিরিট মোহন কাঠামো ধরে এবং তার দেখাদেখি শুভ্রত ও সুনীলও নিরঞ্জনে শরিক হয়। হাজারো মানুষের সাথে তারাও জলাশয়ের মধ্যে নেমে দেবী দুর্গাকে বিসর্জন দেয়। বাড়ি দখলের খেলায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে, জলে অবগাহন করে তারাও রায়েদের সৌভাগ্যে শরিক হয়। নিজেদের ভিজিয়ে নেয় পূর্ণিমা আর জোনাকির প্রশান্ত আলোর বন্যায়।সূত্র : যায়যায়দিন
শ্যাম প্রসাদের চোখটা আটকে যায়, মাথাটা বনবন করে ঘুরতে থাকে, প্রতিবিম্ব এতটা স্বচ্ছ আর দীর্ঘ হতে পারে? কোনোদিন তো সে খেয়াল করেনি, এপার হয়ে ওপারে চলে যাচ্ছে? অদ্ভুত ব্যাপার, দেখবারও বটে। এ পথ দিয়ে সে বহুবার গেছে আবার কাজ শেষে বাড়ি ফিরে এসেছে কিন্তু আজকের মত নতুন কিছুই তো তার নজরে আসেনি। নজরে আসবে কী করে কিছুই তো নজরে আসবার মতো ছিল না। কিন্তু নজরে আসলো কেন? কী ঘটেছে এমন কিছু যা নজরে আসবার মত। খুঁজতে থাকে শ্যাম প্রসাদ, কী হতে পারে? কাউকে পাওয়া দরকার যে এর কারণ আবিষ্কার করতে পারে।
সামনে এগুতেই একটা ছেলের সাথে দেখা হয়ে যায়, তাকেই সে জিজ্ঞাসা করে সে, আচ্ছা বলতে পার এই যে জলাশয়ের ভেতর এতটা প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়েছে আর একূল ছেড়ে ওকূলে চলে যাচ্ছে তার কারণটা কী? তুমি কি খেয়াল করেছো আমি কিসের কথা বলছি?
ছেলেটি প্রথমে থমকে যায়, দ্বিধান্বিত হয়ে পড়ে। শ্যাম প্রসাদের আঙুলের নিশান দেখে ছেলেটা জলের দিকে তাকায়। আসলেই তো একটা বিরাট ব্যাপার থইথই জলের মধ্যে আলো পড়ে একূল ছেড়ে ওকূলে যাচ্ছে। প্রতিসারিত আলোর অপূর্ব রোশনাই। আলোর সমাহার। ছেলেটা মনের মধ্যে এর জন্য একটা শব্দ দেয়ার চেষ্টা করে। কী হতে পারে এই দৃশ্যটা। সে পড়েছিল 'নয়নাভিরাম'। আসলেই দৃশ্যটা নয়নাভিরাম। ছেলেটি নিজের মধ্যে সেঁধিয়ে যায়। হারিয়ে যায় সেন্ট মার্টিনের সন্ধ্যার পর পূর্ণিমার রাতে সে দৃশ্য সে তার বাবা-মায়ের সাথে দেখেছিল সেই দৃশ্যে। আলোর বন্যা একূল থেকে সেকূলে ভেসে যাচ্ছে যেন গলন্ত মুক্তোর দানা। শ্যাম প্রসাদের কথায় তার সম্বিৎ ফিরে আসে। কই তুমি তো কিছু বলছো না? চুপ করে গেলে যে? ছেলেটি এবার মুখ খোলে,- জানেন না বুঝি, এমপি বাবু এবার তাজমহলে দুর্গাপূজা করছে?
-তাজমহলে দুর্গাপূজা! দুর্গাপূজা তো অন্য জায়গায় হয়।
- না, এবার এখানেই হবে। বহু কাল আগে বন্ধ হয়ে যাওয়া মন্দিরে এবার পুজো হবে। গ্রামের মানুষ হিসাব করে দেখেছে প্রায় ষাট বছর আগে এ বাড়িতে পুজো বন্ধ হয়ে যায়। এমপি বাবুই পুরনো শীতল রায়ের বাড়ি দখলে নিয়ে দুর্গাপূজার বোধন করেছে। তাই এত আলোর রোশনাই।
শ্যাম প্রসাদ তথমত খেয়ে নেয়। মনে মনে আওড়ায় শীতল রায়ের জমিদার সদৃশ বাড়ি দখলে নিয়েছে এমপি? শীতল রায়েরা পুরনো ব্যবসাদার তাদের বিত্তের কথা সবাই জানে। অনেক দিন হয় সেই ব্যবসা আর নেই, বাড়িটি অযত্নে ঝোঁপ ঝাড়ে পূর্ণ হয়ে ছিল, বহুদিন বাড়িটাতে কোনো বড় আলো জ্বলেনি। ছেলে বেলায় দেখেছে কী বিরাট বাড়িই না ছিল এটি, সব সময় লোকের পদচারণায় গমগম করতো, সব ধরনের পূজা হতো এ বাড়িতে। এ বাড়ির মেয়ে সুনীতা ছিল তার দিদির সহপাঠী, দিদির সাথে সে এ বাড়িতে এসেছে বহুবার। পুজোর সময় কী আনন্দই না হতো! সেই বাড়ি এখন কিরিট মোহনের! ব্যাপারটা ভাবতেই শিউরে উঠতে হয়। আস্তে আস্তে জলাশয় পার হয়ে নিজেদের বাড়ির দিকে রওনা দেয় শ্যাম প্রসাদ।
বাড়িতে প্রবেশ করতেই শ্যাম প্রসাদ দেখতে পায় তার বাবার সাথে পাশের বাড়ির পরেশ চক্রবর্তী ও সুধীন ম-ল কী যেন আলাপ করছে। বাবাকে পরেশ চক্রবর্তী বলছে, দেখেছো ভায়া, এমপি কিরিট মোহন কেমন করে রায়েদের বাড়িটা দখল করেছে? দুর্গাপূজার নাম করে বাড়িটা দখল করে বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নিয়েছে। আসলে দুর্গাপূজা টুজা কিছু নয়, বাড়িটা দখল করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। যদিও সত্যি সত্যি অনেক দিন হয় বাড়িতে কোন জনমানব ছিল না, ঝোপ-ঝাঁড়ে পূর্ণ হয়ে সাপখোপের আবাসে পরিণত হয়েছিল এবং অসামাজিক কর্মকা-ের আখড়ায় পরিণত হয়েছিল, সেদিক থেকে বাড়িতে একটা দখল পড়েছে বিষয়টি ভালো কিন্তু মন্দের বিষয়টা হলো বাড়ি দখলের প্রক্রিয়া নিয়ে।
সুধীন ম-ল সন্ত্রস্ত একটা ভাব নিয়ে বলল, পুলিশ নাকি এসেছিল? তা আসবে না, আলবাত আসবে, এত বড় একটা বাড়ি দখল হয়ে গেল, আর তারা খোঁজ খবর নেবে না। অন্যদিকে শুনলাম শিল্পপতি শুভ্রব্রত সাহা ও আইনজীবী সুনীল মিত্রও নাকি বাড়ি দখলের খেলায় নেমেছে। তাড়াও নাকি ছাড়বে না। ত্রিমুখী লড়াই, দেখা যাক কে হারে আর কে জেতে তবে এমপি বাবু দাবার খেলায় একচাল এগিয়ে গেল।
শ্যাম প্রসাদের বুঝতে আর বাকি কিছু রইল না, রাজনীতির তকমা যে এখানেও ভালো করছে লেগেছে তার বুঝ নিয়ে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করলো।
সপ্তমী পুজোর দিন বাড়ি ছেড়ে বড় রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় তাজমহলের সামনে এমপি কিরিট মোহন আর তার চেলা চামু-ারা। একজন সাগরেদ কিরিট মোহনকে সন্তুষ্ট করার জন্য বলল,
- দেখেছেন স্যার, বাড়িটা কী সুন্দরই না লাগছে, মন্দিরের সাথে মায়ের শ্রী একীভূত হয়ে গেছে, গৌরের সাথে গৌরী যেন মিশে গেছে। এমন বড় বাড়ি কি সকলের মানায়? যাদের এক সময় মানাত তারা তো মরে গেছে- চলে গেছে, এখন বাড়িটা পড়ে থেকে সাপ খোপের আর অসামাজিক কর্মকা-ের আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে? তার থেকে আপনার মত মহান মানুষ এই বাড়ির নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, দুর্গাপূজা শুরু করেছে। সবাই কি এ বাড়ির মর্যাদা বুঝবে, না বোঝে? যে বুঝে তার হাতেই পড়েছে। আর ঈশ্বর তারই হাতে সেই জিনিস দেন যে তার মর্যাদা বোঝে। সৌভাগ্য সবার হয় না। বড় জিনিসের জন্য বড় সৌভাগ্যের প্রয়োজন।
- তুমি তো বাড়ির বিশালত্বের সাথে আমার মর্যাদার সম্পর্ক খুঁজে পাচ্ছো কিন্তু এর পেছনে কী রকম শক্তি এবং কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তুমি কি তা জান?
- না স্যার, আমরা জানবো কী করে?
- এখনো অনেক মানুষ এর পেছনে লেগে আছে। বিশেষ করে এক শিল্পপতি এবং এক আইনজীবী। তারা দুজন একত্র হয়ে আমার পেছনে লেগে আছে। বাড়ি যখন আয়ত্তে নিয়েছি এবং দুর্গাপূজা শুরু করেছি সেহেতু আমাকে উচ্ছেদ করা এতটা সহজ হবে না। আর এ সমস্ত বিষয়ে আমার থেকে অভিজ্ঞতা কার বেশি? আমি সহজে ছাড়বার পাত্র নাই।
- পুলিশ নাকি এসেছিল?
- আসতেই পারে। পুলিশের কাজ পুলিশ করবে, আমার কাজ আমি করবো। তবে পুলিশ আমাকে সরাসরি কিছু জিজ্ঞাসা করেনি। তারাও জানে আমাকে ঘাঁটানো অত সহজ হবে না, আমি এখানকার নির্বাচিত এমপি। আমার দলের লোকদের লেলিয়ে দিলে তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়বে।
-স্যার, আমরা আছি না? কোন শালাকে এই চত্বরে প্রবেশ করতে দেবো না, এটা দিয়ে..., বলেই সে মাজায় থাকা পিস্তলটা বের করে। তারপর বলে- শুধু আদেশ দেবেন স্যার। লাশ ফেলে দেব।
-স্যার, একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? আর একজন বলল।
- কী জিনিস?
-একটা প্রতিবিম্ব। সামনে একটি জলাশয় আছে এবং জলাশয়টা দূরবিস্তৃত। রাতের বেলা যখন আলোর রোশনাই জ্বলে তখন আলোর প্রতিবিম্ব কেমন করে জলাশয়ের একুল ছেড়ে ওকুলে চলে গিয়ে দিগন্তের সাথে মিশে যায় তা কি কখনো আপনি খেয়াল করেছেন? তাজমহলের তাজ যেন জলের মধ্যে আলোর বহ্নি।
কিরিট মোহন অবাক হয়ে যায়, ক্ষণকালের জন্য বিহ্বল হয়ে পড়ে। সত্যি কি তাই, তার এই বাড়িতে যমুনার ছায়া ভেসে উঠছে। আরামে চোখ দুটো মুদে আসে। একটা পরম আয়াস যে তার নামটা সম্রাট শাজাহান এর সাথে ভেসে উঠবে। শাজাহানের মত তার কীর্তিও কি ইতিহাসে অক্ষয় হবে? তার এই স্বপ্ন কি সত্যি বাস্তবায়িত হবে? তার এই বিহ্বলতা বাড়িটির নিয়ন্ত্রণে সাথে সরাসরি জড়িত, নিয়ন্ত্রণ আর স্বপ্ন, স্বপ্ন আর নিয়ন্ত্রণ। কিরিট মোহন মুহূর্তের জন্য পার্থিব জগত ত্যাগ করে অন্যলোকে চলে যায়। তার এই বিহ্বলতা কি নষ্ট হয়ে যাবে কিছু শয়তান মানুষের জন্য? তার সখের তাজমহল হাত ছাড়া হয়ে যাবে? পুলিশকে সে আয়ত্তে আনতে পারবে কিন্তু শিল্পপতি আর আইনজীবীকে সে সামলাবে কীভাবে? শরীরটা উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে যায়, কানের মধ্যে একটা গরমভাব অনুভব করে। নাকের ডগায় শীতলতা স্পর্শ করে।
সপ্তমি পূজোর সংস্কৃত শোকের উচ্চরণিত মন্ত্র উচ্চারণের মাঝে নিহিত হয়ে যায় তাজমহলের তাজের বহ্নি, বাদ্যকারের ঢাকের শব্দ সেই বহ্নিকে স্থায়ী রূপদানের সিঁড়ি হয়ে দেখা দেয় কিরিট মোহনের মনে। সে মনে মনে বলে- মা মাগো যে সৌভাগ্য নিজে এসে ধরা দিয়েছে তাকে তুমি স্থায়ী করো, হে দুর্গা, দুর্গতিনাশিনী তুমি তো রক্ষাকর্তা, তুমি আমায় রক্ষা কর, সকল অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মত শক্তি দাও, আমায় অভয় দান কর।
কিরিট মোহন মন্দিরের চৌকাঠে সষ্টাঙ্গে প্রণাম করে। তার প্রণাম আর প্রার্থনার সাথে বাড়িটির ভাগ্যও যেন জড়িয়ে ফেলতে চায়। সে এমপি, সে যদি বাড়িটাকে আয়ত্তে না নিতে পারে, তবে কে নেবে? তারই তো প্রাপ্য অধিকার এই বাড়ির। শুনেছে অন্য দুজন তারাও এ বাড়িতে চড়াও হয়ে এই বাড়ির দখল নেবে, তাদের কাছে নাকি রায়েদের শেষ বংশধরের স্বাক্ষরসহ দলিল আছে- সেই দলিলের বলে এই বাড়ির মালিকানা দাবি করে বাড়ির নিয়ন্ত্রণ তাদের অধিকারে নিতে চায়। তারা যদি পারে তো আসুক, ও রকম কাগজ তো তার কাছেও কত আছে। শুধু শেষ বংশধরের নয় তারও আগের কারো স্বাক্ষর সংবলিত দলিল। কাগজতো কতই বানানো যায়। সেও তাদের সামনে তুলে ধরবে, বলবে নগদ দামে খরিদ করা। আর তা যদি মানতে না চায় তাহলে সে এতদিন কী করলো, কিসের জন্য রাজনীতি করলো? প্রায় তিরিশ বছর সে রাজনীতি করছে, রাজনীতির প্রতিটি অক্ষর তার জানা- বহু টাকা খরচ করে এমপি হয়েছে। রাজনীতিতে এই বিনিয়োগ যদি হাজারগুণ হয়ে ফিরে না আসে তাহলে সে রাজনীতি করে কী লাভ! তার থেকে তেল লবণের দোকানে অনেক লাভ সেখানেই সে বিনিয়োগ করবে। অসংখ্য মানুষকে সহায়তা দিয়ে তাদের দলভুক্ত করেছে, তারা যদি এখন কাজে না লাগে তবে কখন কাজে লাগবে, আর তাদের যে এত বছর ধরে পুশল তার কোন ফায়দা হবে না? পারবে না তারা সম্মিলিত পশুশক্তির বিরুদ্ধে জয়ী করতে বা দখল নিয়ন্ত্রণে নিতে? তাহলে তার এত বছরের শ্রম মিছে, রাজনীতি মিছে, সমস্ত বিনিয়োগ ফর্দাফাই।
পুলিশের দুটি গাড়ি মন্দিরের সামনে বাড়ির চত্বরে প্রবেশ করে। দারোগাসহ বেশ কিছু কনস্টেবল গাড়ি থেকে নিচে নেমে আসে। সামনে যাকে পায় তাকে জিজ্ঞাসা করে,
- এই দুর্গা পূজোর নেতৃত্বে কে আছেন?
-এমপি কিরিট মোহন। তিনি রায় বাড়িতে দুর্গাপূজা করছেন।
-আমরা জেলা ভিজিলেন্স টিম, আমরা পুজোর সার্বিক নিরাপত্তা বিধান ও তদারকির দায়িত্বে নিয়োজিত আছি। এখানে তিন জন কনস্টেবলকে আমরা দিয়ে যাচ্ছি, এই তিন জন দশমীর বিসর্জন না হওয়া পর্যন্ত এখানে ডিউটিতে থাকবে। তাদের খাবার এবং যাবতীয় সহায়তা প্রদান করবেন। যিনি এই পুজোর দায়িত্বে আছেন তাকে এই কাগজে একটা সহি প্রদান করতে হবে।
তিনজনকে নামিয়ে রেখে পুলিশের ভ্যান পূজোর চত্বর ছেড়ে শব্দ করে বেরিয়ে গেল। পুলিশের ভ্যান বেরিয়ে যেতেই কিরিট মোহন তার দলবল নিয়ে বেরিয়ে গেল। চেলাদের বলে গেল বাড়ির নিয়ন্ত্রণ যেন কোনো মতেই ছুটে না যায়।
শিল্পপতি শুভব্রত ও অমিত মিত্র তাজমহলের সামনে এসে দাঁড়ালেন লোকজন পরিব্রত হয়ে। তাদের সাথে বহু শ্রমিক এবং ভাড়াটে গু-া। তারা তাজমহলের সামনে মাইক সহকারে বক্তৃতা দিতে আরম্ভ করলো।
-তাজমহলের অধিকার নিয়েছে এমপি কিরিট মোহন, আপনারা জানেন তার কোন বৈধ কাগজপত্র নেই, তবু ক্ষমতার জোরে আর পুলিশকে পয়সা দিয়ে এ বাড়ির দখল নিয়ে এখানে দুর্গাপূজার আসর জমিয়েছে, ভেবেছে দুর্গাপূজার আসর বসিয়েই তাজমহলের অধিকার তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে কিন্তু আমরা শপথ করে বলছি এ নিয়ন্ত্রণ তিনি কিছুতেই নিজের আয়ত্তে রাখতে পারবেন না, আমরা তা হতে দেব না। আইন এবং বিচারালয় আমাদের পক্ষে আছে, জনগণও আমাদের পক্ষে আছে। কিরিট মোহন ভেবেছেন শুধু সাগরেদ আর অর্থ দিয়ে দখলদারিত্ব বজায় রাখবেন কিন্তু তিনি এ দখলদারিত্ব বজায় রাখতে পারবেন না। বাড়ি তাকে ছাড়তেই হবে, তা না হলে এখানে রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে। লাশের গন্ধ বাতাসে উঠবে। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধও ছাড়িয়ে যাবে। আমরা সমস্ত বিরোধী বন্ধুদের অনুরোধ করি এ চত্বর খালি করে দিয়ে এলাকা ত্যাগ করতে এবং এলাকার শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে। আমরা শান্তির পক্ষে, আমরা চাই অন্য পক্ষও আমাদের শান্তির পতাকা তলে শরিক হোক, শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখুক। তা না হলে আমাদের মিলিত শক্তি একত্রিত হয়ে ফুৎকারে অগি্ন বলাকা হয়ে ধ্বংস করবে, আর আমরা চাই না এমন কোন দ্বন্দ্ব। শিল্পপতি সুব্রত সাহার বলার পর উঠে দাঁড়ালেন আইনজীবী অমিত মিত্র:
-আমরা চাই না এই পবিত্র দিনে এমন রক্তক্ষয় হোক। আমরা দশমীর দিনে দুর্গা বিসর্জনের পর এই বাড়ি দখলে নেব। মা আমাদের সহায়, তার আশীর্বাদ নিয়েই এই বাড়ির অধিকার আমরা নিতে চাই। আমরা অমানবিক নই, কিন্তু দুর্বলও নই, চাইলে আজই আমরা এই বাড়ি আমাদের আয়ত্তে নিতে পারি, চড়কাবাজির খেলায় খেলিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিতে পারি। বোমার তুর্কিবাজির সকল খেলাই আমাদের হাতে কিন্তু সেই মহড়ায় আজ নাই বা গেলাম। কিরিট মোহন যদি মনে করেন তিনি এমপি হয়েছেন বলে সব কিছুই তার ভোগে যাবে তবে ভুল করছেন, হিসাব সবসময় পাঁকা হয় না, আর হবেও না, আমরা তা হতে দেব না। আমরা ফিরে গেলাম এই প্রত্যাশায় তিনি স্বেচ্ছায় আমাদের এই বাড়ি খালি করে দিয়ে চলে যাবেন। নতুবা আমরা দশমীর দিন আবার আসবো। সেদিন আজকার মতো কোনো শান্তির কথা থাকবে না, থাকবে ন্যাকড়াবাজির কথা, রক্তের লেলিহান উঠবে, মৃত্যুর হলিখেলা চলবে। অসুর শক্তি বিনাসের মাধ্যমে এই ধরা ধামে শান্তি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, মহিশাসুর বধের মাধ্যমে রায় বাড়ি দখলে নেয়া হবে।
অবস্থা এমনি হয়ে দাঁড়ালো যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম যে কোন মুহূর্তে শুরু হয়ে যেতে পারে, পুলিশ অবস্থার গুরুত্ব বুঝে চারিদিকে কঠোর বেষ্টনি দিয়ে ফেলল। রায় বাড়িতে যে পূজো কিরিট মোহন শুরু করেছিল তা প্রশাসন নিজের হাতে তুলে নিল। কোন পক্ষের বাড়ির অভ্যন্তরে প্রবেশের অধিকার রইল না।
অন্যদিকে প্রতিবিম্বের কথাটা কেমন করে যেন জানাজানি হয়ে যায়। প্রতিদিনই মানুষ জলের ভেতর আলোর রোশনাই দেখবার জন্য হাজির হতে লাগল। দলে দলে, শয়ে শয়ে, হাজারে হাজারে। সকলে কুলে দাঁড়িয়ে দেখে কী অপূর্ব আলোর রোশনাই, মুক্তোর দানার মত এক কূল ছাড়িয়ে অন্য কূলে চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ বলতে শুরু করে রায়েদের পুরনো ঐতিহ্য মা আবার ফিরিয়ে দিয়েছে, এই জল আর এই রোশনাই দেখবে যারা তারা হবে পুণ্যবান এবং তাদের জীবনে রায়েদের সেই সৌভাগ্য আশীর্বাদ হয়ে আসতে পারে।
রোশনাইয়ের দৃশ্য যা কিরিট মোহন যমুনার তীরে দেখতে পেয়েছিল এবং পরম আয়েশে দেখেছিল তা মানুষের মুখে মুখে তার কানেও গিয়ে পেঁৗছায়, হাজার হাজার মানুষ তাজমহলের সামনে গিয়ে আলোর রোশনাই দেখছে এবং মানুষজন সেই জলে স্নান করে পুণ্যবান হচ্ছে। কিরিট মোহন আবেগে বিহ্বলিত হয়ে দশমীর দিন তাজমহলের জলাশয়ের সামনে গিয়ে হাজির হয়। শিল্পপতি ও আইনজীবী মানুষের কথা শুনে তারাও দেখতে যায় প্রতিবিম্ব, কেমন করে তা এই কুল থেকে ওকুলে ভেসে যাচ্ছে।
জলাশয়ের সামনে তিনজনে হাজির। একে অপরকে দেখতে পায়। কিরিট মোহন অপর দুজনকে দেখতে পেয়ে বলে, - কী হে ভায়া, তোমরাও কি আমার মতো তাজের প্রতিবিম্ব দেখতে এসেছো? কী অপূর্ব না? একটা আলোর বহ্নি, প্রচ- আলোরচ্ছটা!
-আমরাও অবিভূত হয়েছি এই দৃশ্য দেখে। শুনছি রায়েদের সেই সৌভাগ্যের অধিকারী হওয়ার জন্য মানুষ জলে অবগাহন করছে। হবো নাকি সেই জলে স্নান করে পুণ্যবান? শিল্পপতি সুব্রত সাহা বলে।
তাদের কথা চলাকালে শ্যাম প্রসাদ ও তার বন্ধুরা সাড়ম্বরে দশমীর রাতে মা দুর্গাকে বিসর্জন দেয়ার জন্য দেবীকে জলাশয়ের কিনারায় নিয়ে আসে। জলের প্রতিবিম্বের দিকে প্রতিমার মুখ স্থাপন করে। দেবী দুর্গাকে কিনারে আনতেই কিরিট মোহন কাঠামো ধরে এবং তার দেখাদেখি শুভ্রত ও সুনীলও নিরঞ্জনে শরিক হয়। হাজারো মানুষের সাথে তারাও জলাশয়ের মধ্যে নেমে দেবী দুর্গাকে বিসর্জন দেয়। বাড়ি দখলের খেলায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের পরিবর্তে, জলে অবগাহন করে তারাও রায়েদের সৌভাগ্যে শরিক হয়। নিজেদের ভিজিয়ে নেয় পূর্ণিমা আর জোনাকির প্রশান্ত আলোর বন্যায়।সূত্র : যায়যায়দিন
No comments:
Post a Comment