১.
ব্যতিক্রম শব্দটা ভাঙ্গলে দাড়ায় ক্রমের ব্যত্যয় অর্থাৎ প্রবহমান ধারাটায় বিচ্যুতি। মাত্র দুইশত বৎসর আগেও মানুষের কাছে যা ছিল রহস্যময় তা বিজ্ঞানের কল্যাণে এতটাই সুস্পষ্ট যে আস্তে আস্তে মানুষ সত্যের প্রায় কাছে এসে দাড়াচ্ছে। কোন কিছুই এখন আর রহস্য মনে করা হয় না। হাতে নাতে প্রমানের ভিত্তিতে এখন ব্যাখ্যা করা যায় প্রকৃতির নানা খাম খেয়ালীপনার। আগে যেখানে এসে থমকে গেছে মানুষ সেখানে এসে একজন অতিপ্রাকৃতিক মহাশক্তির উপস্থিতির মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা করা হতো। এখন মানুষের মাঝে সে প্রবণতা ক্রমে ক্রমে ফ্যাকাসে হতে যাচ্ছে। সত্যি কি যাচ্ছে? আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমাদের এই গল্পে সেই সব বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে না। তবে ব্যতিক্রমটা এখানে লক্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতির খাম-খেয়ালীপনার একটি চিত্র এখানে দেখা যেতে পারে।
ব্যতিক্রম শব্দটা ভাঙ্গলে দাড়ায় ক্রমের ব্যত্যয় অর্থাৎ প্রবহমান ধারাটায় বিচ্যুতি। মাত্র দুইশত বৎসর আগেও মানুষের কাছে যা ছিল রহস্যময় তা বিজ্ঞানের কল্যাণে এতটাই সুস্পষ্ট যে আস্তে আস্তে মানুষ সত্যের প্রায় কাছে এসে দাড়াচ্ছে। কোন কিছুই এখন আর রহস্য মনে করা হয় না। হাতে নাতে প্রমানের ভিত্তিতে এখন ব্যাখ্যা করা যায় প্রকৃতির নানা খাম খেয়ালীপনার। আগে যেখানে এসে থমকে গেছে মানুষ সেখানে এসে একজন অতিপ্রাকৃতিক মহাশক্তির উপস্থিতির মাধ্যমে তার ব্যাখ্যা করা হতো। এখন মানুষের মাঝে সে প্রবণতা ক্রমে ক্রমে ফ্যাকাসে হতে যাচ্ছে। সত্যি কি যাচ্ছে? আমরা সেদিকে যাচ্ছি না। আমাদের এই গল্পে সেই সব বিষয়ের অবতারণা হচ্ছে না। তবে ব্যতিক্রমটা এখানে লক্ষনীয় হয়ে উঠতে পারে। প্রকৃতির খাম-খেয়ালীপনার একটি চিত্র এখানে দেখা যেতে পারে।
দিনটি অন্যান্য দিনের মতোই ছিল। পাওয়ার লোমে কাজ করতে গিয়েছিল মোহাইমেন। তাদের ডিউটি হয় দুই শিফট্। ডে-শিফট্ আর নাইট-শিফট্। এক সপ্তাহে দিনে আর এক সপ্তাহ রাতে। দিন রাত চলে কাজ। রমজানের মাস আসছে সামনে। কাপড়ের ব্যবসায় এই সময়টা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহাজনরা কাপড়ের উৎপাদন বাড়ানোর জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠে। সুযোগটা নেয় শ্রমিকেরা। একে তো দক্ষ শ্রমিকের অভাব, তার উপর মহাজনের বার বার উৎপাদনের তাগাদাটাকে বেশ কাজে লাগায় শ্রমিকেরা। তারা জানে এখন এমন একটা সময় যখন কিছু টাকা অগ্রীম হিসেবে নেয়া যায় তার গজ প্রতি রেট টাও বাড়ানো যায় একটু মোচড় দিলেই। প্রায় ৫০ জন শ্রমিক আছে এই ফ্যাক্টরীতে। যতক্ষন বিদ্যুৎ আছে পাওয়ার লোম- এর বিকট আওয়াজটা গম গম করতে থাকে আশ-পাশের এলাকাতে। আজকে ব্যতিক্রম। আজ ধর্মঘট। মোহাইমেন নির্দেশ দিয়েছে- কেউ যেন কোন লোম চালু না করে। মালিকের সাথে রেট নিয়ে ফয়সালা হবে তারপর চালু হবে। একটা ভৌতিক নীরবতা বিরাজ করছে। মহাজন ঢাকায় গেছেন তাগাদায়, ফিরতে রাত হবে। তিনি ফিরে এলে মিটিং শেষে বাড়ি ফিরবে। সকলে অপেক্ষায় আছে।
খবরটা আসল ঠিক তখন। মোহাইমেনের বউয়ের প্রসববেদনা শুরু হয়ে গেছে। সম্ভবত: যমজ বাচ্চা হবে। বউটার পুরো আকৃতি ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। পেটটা যেন একটি মটকির মতো বড় হয়ে উঠেছে। নড়াচড়া করতে ভীষন কষ্ট হচ্ছে , তার উপর পানি নেমে গেছে শরীরে। হাত-পা ফোলে ফোলে উঠেছে। অস্থির হয়ে উঠল মোহাইমেন। তাদের প্রথম বাচ্চা আসছে, কোন কিছুই খেয়াল না করে সে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল। ফ্যাক্টরী থেকে তার বাড়ি পৌঁছতে সময় লাগে আধ ঘন্টার উপর। সময়টা যেন কিছুতেই কাটতে চাচ্ছেনা। দৌড়ের উপর ছুটছে সে, বিন্দু বিন্দু ঘাম ঝরছে তার কপাল থেকে। পথ যেন ফুরাতে চায় না। অবশেষে বাড়ির পাশে এসে থমকে দাঁড়ালো। উঠান ভর্তি মানুষ। পাড়ার সকল মানুষ যেন ভেঙ্গে পড়েছে এই বাড়িটিতে।
মোহাইমেনকে পথ ছেড়ে দিল সকলে। সে বার বার জিজ্ঞেস করতে লাগল- ব্যাপার কি? কেউ কোন জবাব দিল না। সকলে চোখে মুখে এক বিস্ময় নিয়ে দাড়িয়ে আছে। এতো লোক তবুও কোথাও কোন শব্দ নেই। মোহাইমেন ভাবল- বউটি মারা গেল না কি? না, সেরকম কোন ব্যাপার নয়, কোথাও কান্নার কোন শব্দ পাওয়া গেল না। বুড়ি দাই-কে দেখা গেল থর থর করে কাঁপছে।
-ও খালা কি অইছে ? আমারে কেউ কিছু কও না ক্যান ? কি হইছে?
-আমি কইতে পারুম না। তুই ভিতরে গিয়া দ্যাখ।
ভিতরে ঢুকল মোহাইমেন। না, বউ জীবিত-ই আছে। জ্বল জ্বল করে তাকিয়ে আছে তার দিকে। তারপর তার চোখ গেল পাশে রাখা ছোট বাচ্চাটার দিকে। কাঁথার উপর বাচ্চাটি কাঁদছে না এক ফোঁটাও। কিন্তু হাত দুটি নাড়ছে। নীচের দিকে চোখ যেতেই থমকে গেল সে। বাচ্চাটার নীচের দিকে দুটি পা ঠিকই নড়ছে। তার পাশেই আরও দুটি পা, দুটি হাত সামান্য ঝুলছে।
ব্যাপারটা একসাথে খেয়াল করল মোহাইমেন। বউ তার বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে মরে যায়নি, ভীষন কান্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। উঠান ভর্তি মানুষ, বাচ্চাটি জীবিত কিন্তু কাঁদছে না এক ফোঁটাও। উপরের দিকে স্বাভাবিক এক মেয়ের অবয়ব। কিন্তু নীচের দিকে কিম্ভুতকিমাকার এক প্রাণীবিশেষ। স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল সে।
২.
প্রকৃতির খামখেয়ালিপনার এক নিদর্শন হয়ে জন্ম নিয়েছে মেয়েটি। জন্মের পর থেকেই তার পিতার ভাগ্য বদলাতে শুরু করেছে। এ কারনে তার নাম রাখা হয়েছে ভাগ্যলক্ষী। অসাধারণ মেধা নিয়ে জন্ম নিয়েছে সে। অল্প সময়ে কথা বলতে পারা, তীক্ষ্ম স্মৃতি শক্তি আর মাঝে মাঝে ভবিষ্যৎ বলে দিয়ে সে অনন্য অবস্থান তৈরী করেছে। এখন আর মোহাইমেন পাওয়ার লোমে কাজ করতে যায় না। সারাদিন কোন্ মেলায় কোন্ প্রদর্শনী আছে তার হিসাব করে। অদ্ভুত এই মেয়েটিকে দেখতে দলে দলে লোক আসে। সার্কাসের যে অংশে মেয়েটাকে প্রদর্শন করা হয় সেখানে কেবল মানুষের ভীড়। মানুষ আর মানুষ। আর মানুষের ভীড়, যত মানুষ তত টাকা। এই অর্থ সমাগমে স্বপ্নের একটা বিরাট ভূমিকা আছে।
কয়েক দিন একটানা বৃষ্টিতে সারা প্রকৃতি ভিজে আছে। বৃষ্টিটা থেমেছে। চমৎকার রাত। পূর্ণিমা হবে হয়তো। এমন দিনে কবি আর পাগল ছাড়া কেউ জেগে জেগে জ্যোস্না দেখে না। গরমের মধ্যে বৃষ্টির এই পরশগুলি শীতলতা নিয়ে আসে দেহে। তখন বড় ঘুম পায়, বড় আরামের ঘুম। মোহাইমেন গভীর ঘুমে মগ্ন ছিল। আর এমন সময় স্বপ্নটা এলো। সাধারণ কোন স্বপ্ন নয়, যেন বাস্তবের মতো স্বচ্ছ।
বর্ষার থৈ থৈ পানিতে ডুবে আছে নীচু জমিন। চারিদিকে পানি আর পানি। শুধু ভেসে আছে বাড়িটা। চারিদিক থেকে নাও-কোষা নিয়ে দলে দলে লোক আসছে, হাজারে হাজারে, অসংখ্য মানুষ। ভয় পেয়ে গেল মোহাইমেন। সে বার বার জিজ্ঞেস করছে- কোথায় যান আপপনারা ? যেন তাকে কেউ শুনতেই পেল না। সকলের একই উদ্দেশ্য। মোহাইমেন তাদের অনুসরন করতে করতে এসে দাঁড়ালো ভাগ্যলক্ষ্মীর ঘরটায়। ঘরটা আর ঘর থাকে না। ক্রমাগত বড় হতে হতে একটি খোলা মাঠে রূপ নেয়। হঠাৎ তাকাল মেয়েটির দিকে আর একবার মানুষের দিকে। সকল মানুষগুলো মাথানত করে প্রণামের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। মোহাইমেন খেয়াল করল ভাগ্যলক্ষ্মীর পায়ের দিকে। তার বর্ধিত পা দুটিতে ঝুলে আছে দুটি সাপ, ফনা তুলে পাহাড়া দিচ্ছে যেন। আর কি উজ্জ্বল মেয়েটার চেহারা! যেন পূর্ণিমার চাঁদ নেমে এসেছে তার প্রাঙ্গনে। সমবেত সকলের মতো মোহাইমেনও নত হয়ে তাকিয়ে আছে উজ্জ্বল সে আলোর দিকে।
এই স্বপ্ন আর স্বপ্ন থাকে না যখন মোহাইমেনের বউ এসে ধাক্কা দেয় তাকে।
-এখানে কি করছেন আপনে? ঘর থেকে কখন আইছেন এহানে? চান্দের দিকে তাকাইয়া কি করতাছেন?
মোহাইমেন প্রকৃতিস্থ হল। না, সে তো এখানেই দাঁড়িয়েছিল, খোলা প্রান্তরে, হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে। মানুষেরা সব গেল কই! আর ভাগ্যলক্ষ্মী কোথায়? তার পায়ের কাছে ঝুলে থাকা সাপ দুটো ? ফনা তুলে পাহাড়া দিচ্ছিল…… মোহাইমেন আপন মনে বলতে থাকল।
-আপনি পাগল হইছেন নি?
প্রকৃতিতস্থ হলো মোহাইমেন । খেয়াল করে দেখল সে দাড়িয়ে আছে তার উঠানে এবং থর থর করে কাঁপছে। সে তার স্বপ্নের বিবরণ বর্ণনা করল। এর পর দিন এই স্বপ্নের বিবরণ ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত গ্রামের মধ্যে। স্বপ্ন কি সংক্রামক হয় নাকি? কিছুদিন পর দশটি গ্রাম থেকে দশটি স্বপ্নের বিবরণ এলো বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে। কিন্তু বিষয়বস্তু একই, আর তা হলো ভাগ্যলক্ষ্মী একটি সাধারণ মানবী নয়। সে এক অলৌকিক মানবী। যাকে পুঁজি করে জোয়ারের জলের মতো অর্থ সমাগত হতে লাগলো মোহাইমেনের।
কিন্তু সেই রাতে শুধু একটি স্বপ্নই দেখা হয়নি। মোহাইমেনের সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে জেগে উঠেছিল এক ক্রন্দন।
মোহাইমেন ও তার বউ দৌড়ে গেল ভাগ্যলক্ষ্মীর ঘরে। এত রাতেও মেয়েটি ঘুমায়নি। চোখ ফুলে আছে। কান্নার স্পষ্ট চিহ্ন তার চেহারায়। যেই মেয়ে জন্মের সময় কাঁদেনি, শুধু হাত নেড়ে জানান দিয়েছিল সে বেঁচে আছে। সেই মেয়ের এই কান্নায় মোহাইমেনের বুকে তীব্র শেলের মতো বিঁধেছিল। এমনিতেই তীব্র বাস্তবের মতো স্বপ্ন তার উপর এই কান্না হকচকিয়ে গেল মোহাইমেন. . .
-ক, মা তোর কি হইছে, আমারে ক। আমার টাকা পয়সার অভাব নাই। সবই তোর। ক মা তুই কি চাস? যা চাইবি আমি তাই আইন্যা দিমু।
এই মেয়ে যখন কথা বলছিল তখন তার পা চারটি একসাথে নড়ে নড়ে উঠছিল। তার হাত দুটিও মুষ্টিবদ্ধ ছিল। যেন বা সারা পৃথিবী সে খামছে ধরেছে, বলল-
-বাবা, আমি হাঁটতে পারি না কেন? বাবা, আমি দাঁড়াতে চাই, বাবা গো তোমরা সবাই হাঁট, তোমরা সবাই কি সুন্দর হাঁট, আমি পারি না কেন? বাবা, আমি দাঁড়াতে চাই।
মোহাইমেন বলেছিল- মাগো আমি তোকে নিয়ে যেখানেই যাই মানুষ আমারে টাকা দেয়। সেই টাকায় আমি সোনার পালঙ্ক কইরা দিতে পারি, নিজে শুতে পারি রূপার খাটে। কিন্তু আমি যে তোকে দাঁড়াতে দিতে পারি না, পারি না মা। আল্লা যে তোরে হেইভাবে পাঠায় নাই.. .. ..
তারপর তিনটি মানুষ কেঁদেছিল বহু ক্ষন, বহু বহুক্ষন .. .. ..
৩.
পাঠক, আপনাদের মনে আছে? যেদিন মোহাইমেন খরবটা শুনতে পায় যে, তার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হয়ে গেছে সেদিন সে নেতৃত্ব দিচ্ছিল একটি ধর্মঘটের। কারখানার মালিক ঢাকা গিয়েছিল তাগাদা করতে। গল্পের এই অংশে সেই মালিকের সাথে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেয়া দরকার। গ্রামের এই পাওয়ার লুম কারখানা পরিচলনা করলেও আর এই গ্রামের ছেলে হলেও সে বড় হয়েছে শহরে, লেখা পড়া করেছে নানা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেউ কেউ সন্দেহ পোষন করে সে হয়তো লেখা পড়া শেষ করতে পারেনি, না হলে চাকুরী না করে এই ধরনের কাপড়ের ব্যবসায় কেন জড়াবে? আমরা সে দিকে যাব না, আমরা শুধু মোহাইমেনের সাথে তার বিরোধের আর সহযোগিতার ব্যাপারটা তুলে ধরব।
মোহাইমেন যখন শ্রমিক তখন সে মহাজন। আর এখন মোহাইমেন সামান্য শ্রমিক নয়, সমাজ সংসারে, বিচার মজলিসে এখন তার কদর আছে। বিশ্বাসের নেতৃত্ব দিয়ে সে এখন সামনের কাতারের মানুষ আর সেই মহাজন এখন যেন আন্দোলনকারী। সে বলে বেড়ায়, ভাগ্যলক্ষী কোন ঐশ্বরিক মানবী নয়। প্রকৃতির ব্যতিক্রমের সে একটি নিদর্শন মাত্র। সে বলে, ভাগ্যলক্ষী জমজ দুই বাচ্চার একত্রে লেগে যাওয়া এক বিরল নিদর্শন বটে কিন্তু সে-ই প্রথম নয়। এর আগেও আরো অনেক ঘটনা ঘটেছে, সবচেয়ে আলোচিত ইরানের দুই জমজ মেয়েরা যাদের মাথা দুটি জোড়া লেগে ছিল। তার এসব কথা কেউ বুঝে না, বিশ্বাস ও করে না।
যে রাতে অদ্ভুতরে মেয়েটি তার সমস্ত স্বত্ত্বা দিয়ে কেঁদে উঠেছিল- বাবা তোমরা সকলে কি সুন্দর হাটতে পারো, আমি কেন দাঁড়াতে পারি না? সে রাতের পর হতে মোহাইমেন তার এই প্রতিপক্ষ মহাজনকে আর প্রতিপক্ষ ভাবলো না।
আমরা তাদের সর্বশেষ সম্পর্কটিকে একটু দেখে আসতে পারি-
: তাইলে আপনে আমাকে অপারেশন করতে বলেন?
: দেখ আমি কিছু বলতে চাই না, সিদ্ধান্ত তোমার। আমার বন্ধু ডা: তুহিন বলেছে অষ্ট্রেলিয়া থেকে অনেক বড় একজন ডা: এসেছেন। তিনি এধরনের জটিল অপারেশন করেন। ডা: তুহিনের সাথে তার আলাপ হয়েছে, তিনি এই অপারেশন করতে চান। এখন তোমার ইচ্ছা।
: আমার সব যাবে, বুঝতে পারছেন? মানুষজন আর আইবো না আমার কাছে, আইবো না সার্কাসের সেই লোকেরা। আমার টাকা পয়সা সব যাক, সব যাক……. শুধু বলেন আমার মাইয়াডা বাচবো তো…..
: এই ব্যাপারটা তোমাকে বলে রাখা দরকার, এর আগে ইরানের জোড়ামাথা দু’জন মেয়েকে আলাদা করতে পৃথিবীর বড় বড় ডাক্তারা চেষ্টা করেছেন কিন্তু তারা তাদের বাচাতে পারেননি। দুজনই মারা গেছে। তবে তোমার মেয়ের জোড়াটা কোমড়ে , হয়ত বাঁচবে। আমি কিছু বলব না- সিদ্ধান্ত তোমার, তোমাকেই নিতে হবে…. শুধু এটুকু বলতে পারি যদি অপারেশন সাকসেস হয় তোমার মেয়ে স্বাভাবিক ভাবে দাঁড়াতে পারবে, নিজের পায়ের উপর ভর করে নাড়া চড়া করতে পারবে, এগুতে পারবে সামনের দিকে….
৪.
পুবের আকাশে সুর্য্য উদয়ের রক্তিম আভা ভেসে উঠছে। বাতাসে হিম হিম নির্মল পরশ লেগে আছে । হিজল গাছের ডালে একটা ডাহুক ডেকে যাচ্ছে অনবরত। জমি চাষের জন্য কৃষাণ গরুকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পাজনের আঘাতে। হাম্বা হাম্বা স্বরে ডেকে উঠছে গাভী, বালতি নিয়ে যায় কৃষাণী দুধ ধুয়াতে, বাছুরটা ঘুর ঘুর করছে আসে পাশে।
এই অনিন্দ সুন্দর সকালের সৌন্দর্য্যরে মাত্রা বহুগুন বাড়িয়ে ভাগ্যলক্ষী আস্তে আস্তে হেটে যাচ্ছে মোহাইমেনের হাত ধরে, একটু খুড়িয়ে খুড়িয়ে।
অপারেশনগুলো সাকসেসফুল ছিল একটির পর একটি। গত নয় মাসে বেশ কয়েকটি অপারেশনের পর, দেহের সাথে লেগে থাকা অপর একটি দেহের বিসর্জনের পর ভাগ্যলক্ষী দাড়িয়ে গেছে, খুড়িয়ে খুড়িয়ে এগুচ্ছে সামনের দিকে পিতার হাত ধরে।
আমরা মোহাইমেনের হৃদয়ের অবস্থার বর্ননা করতে পারি না। সে হারিয়েছে তার সমস্ত অর্জিত অর্থ, আর হারিয়েছে উপার্জনের মাধ্যম। তবু তার সন্তান অন্যসব সাধারণ প্রনীর মত হাটছে, এই দৃশ্য দর্শনে তার হৃদয়ের প্রতিক্রিয়া বর্ননা করার মতো মতা আমাকে প্রকৃতি দেয়নি। শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে বহুবার আমি চেষ্টা করেছি হৃদয়ের এই অনুভবকে ফুটিয়ে তুলতে, আমি ব্যর্থ হয়েছি। আমার ভাবনায় একটি অপ্রাসঙ্গিক দৃশ্য ফুটে উঠছে, সেইদিকে একটু ঘুরে আসি।
প্রকৃতির তান্ডবলীলায় ঝড়ের উন্মক্ততায় উপকুলের মানুষ দিশেহারা। সেইসব হৃদয় বিদারক দৃশ্যাবলী পুজি করে মিডিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া হলো সহানুভুতির আবেদন। দলে দলে সাহায্য আসতে লাগল। হেলিকপ্টারে ছিটিয়ে দেয়া হচ্ছে খাদ্যদ্রব্য আর মানুষের পাল ছুটে চলছে সেই খদ্যের পিছনে পিছনে। এইসব দৃশ্যাবলী পুজি করে চললো রাজনীতি বানিজ্য। একটি জাতি আর দাঁড়াতেই পারলনা কেবল সহানুভুতি আর দানের দিকে তাকিয়ে রইল।
এই হচ্ছে আমার সমস্যা। লোকে পাগলতো আর শুধু শুধু বলে না। কোথায় এক প্রকৃতির ব্যতিক্রম ভাগ্যলক্ষীর গল্প বলতে এলাম, এলাম তার পিতার ত্যাগকে ফুটিয়ে তুলতে, কোত্থেকে কথা নেই বর্তা নেই একটা খন্ড চিত্রের বর্ননা করে দিলাম। পাঠক ধৈর্য্য ধরে আমার লেখাটি পড়েছেন, ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করতে চাই না, আপনাদের ধৈর্য্যকে সালাম। আসুন, আপনাদের একটা গান শুনাই। আমার গান, আমাদের গান , আমাদের প্রিয় গান…
পূর্ব দিগন্তে সূর্য্য উঠেছে
রক্ত লাল রক্ত লাল…
No comments:
Post a Comment