ভয়ঙ্কর সর্দি হয়েছে। নাক দিয়ে যা জল বেরম্নচ্ছে তা সামলানো রম্নমালের কর্ম নয়। ডবল সাইজ বিছানার চাদর নিয়ে আগুনের কাছে বসেছি। হাঁচছি আর নাক ঝাড়ছি, নাক ঝাড়ছি আর হাঁচছি। বিছানার চাদরের অর্ধেকখানা হয়ে এসেছে, এখন বেছে বেছে শুকনো জায়গা বের করতে হচ্ছে। শীতের দেশ, দোর জানালা বন্ধ, কিচ্ছু খোলার উপায় নেই। জানলা খুললে মনে হয় গৌরীশঙ্করের চূড়োটি যেন হিমালয় ত্যাগ করে আমার ঘরে নাক গলাবার তালে আছেন।
জানি, একই রম্নমালে বারবার নাক ঝাড়লে সর্দি বেড়েই চলে, কিন’ উপায় কি? দেশে হলে রকে বসে বাইরে গলা বাড়িয়ে দিয়ে সশব্দে নাক ঝাড়তুম, এ নোংরামির হাত থেকে রক্ষা তো পেতুমই, নাকটাও কাপড়ের ঘষায় ছড়ে যেতো না।
হঠাৎ মনে পড়ল পরশু দিন এক ডাক্তারের সঙ্গে অপেরাতে আলাপ হয়েছে। ডাকসাঁইটে ডাক্তার- ম্যুনিক শহরে নাম করতে পারাটা চাট্টিখানি কথা নয়। যদিও জানি ডাক্তার করবে কচু, কারণ জর্মন ভাষাতেই প্রবাদ আছে ওষুধ খেলে সর্দি সারে সাত দিনে, না খেলে এক সপ্তায়।
তবু গেলুম তাঁর বাড়ী। আমার চেহারা দেখেই তিনি বুঝতে পারলেন ব্যাপারটা কি। আমি শুধালাম, সর্দির ওষুধ আছে? আপনার প্রথম এবং খুব সম্ভব শেষ ভারতীয় রোগীর একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমার এক নাক দিয়ে বেরম্নচ্ছে রাইন, অন্য নাক দিয়ে ওডার।
ডাক্তার যদিও জর্মন তবু হাত দু’খানি আকাশের দিকে তুলে ধরলেন ফরাসিস্ কায়দায়। বললেন, ‘অবাক করলেন, স্যার! সর্দির ওষুধ নেই? কত চান? সর্দির ওষুধ হয় হাজারো রকমের।’
বলে আমাকে পাশের ঘরে নিয়ে গিয়ে খুললেন লাল কেল্লার সদর দরজা পরিমাণ এক আলমারি। চৌকো, গোল, কোমর-মোটা, পেট-ভারী বাহান্ন রকমের বোতল-শিশিতে ভর্তি। নানা রঙের লেবেল আর সেগুলোর উপর লেখা রয়েছে বিকট বিকট সব লাতিন নাম।
এবারে খানদানী ভিয়েনীজ কায়দায় কোমরে দু’ভাঁজ হয়ে বাও করে বাঁ হাতটা পেটের ওপর রেখে ডান হাত দিয়ে তলোয়ার চালানোর কায়দায় দেরাজের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি দেখিয়ে বললেন, ‘বেছে নিন, মহারাজ (কথাটা জর্মন ভাষায় চালু আছে) সব সর্দির দাওয়াই।’
আমি সন্দিগ্ধ নয়নে তাঁর দিকে তাকালুম। ডাক্তার মুখব্যাদন করে পরিতোষের ঈষৎ হাস্য দিয়ে গালের দুটি টোল খোলতাই করে দিয়েছেন- হা’ টা লেগে দিয়েছে দু’কানের ডগায়।
একটা ওষুধের কটমটে লাতিন নাম অতি কষ্টে উচ্চারণ করে বললুম, ‘এর মানে তো জানিনে।’
সদয় হাসি হেসে বললেন, ‘আমিও জানিনে, তবে এটুকু জানি, ঠাকুরমা মার্কা কচু-ঘেঁচু মেশানো দিশী দাওয়াই মাত্রেরই লম্বা লম্বা লাতিন নাম হয়।’
আমি শুধালাম, ‘খেলে সর্দি সারে?’
বললেন, ‘গলায় একটু আরাম বোধ হয়, নাকের সুড়সুড়িটা হয়ত একটু আধটু কমে। আমি কখনো পরখ করে দেখিনি। সব পেটেন্ট ওষুধ-নমুনা হিসাবে বিনা পয়সায় পাওয়া। তবে সর্দি সারে না, এ কথা জানি।’
আমি শুধালুম, ‘তবে যে বললেন সর্দির ওষুধ আছে?’
বললেন, ‘এখনো বলছি আছে কিন্তু সর্দি সারে সে কথা বলিনি।’
বুঝলুম, জর্মনি কান্ট হেগেলের দেশ। বললুম, ‘অ’।
ফিসফিস করে ডাক্তার বললেন, ‘আরেকটা তত্ত্বকথা এই বেলা শিখে নিন। যে ব্যামোর দেখবেন সাতান্ন রকমের ওষুধ, বুঝে নেবেন, সে ব্যামো ওষুধে সারে না।’
ততক্ষণে আবার আমি হাঁচ্ছো হাঁচ্ছো আরম্ভ করে দিয়েছি। নাক-চোখ দিয়ে এবার রাইন-ওড়ার না এবারে পদ্মা-মেঘনা। ডাক্তার ডজন দুই কাগজের রম্নমাল আর একটা ওয়েস্ট-পেপার বাক্সেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন।
ধাক্কাটা সামলে ওঠে প্রাণভরে জর্মন সর্দিকে অভিসম্পাত দিলুম।
দেখি, ডাক্তার আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছেন।
আমার মুখে হয়ত একটু বিরক্তি ফুটে উঠেছিল। বললেন, ‘সর্দি-কাশির গুণও আছে।’
আমি বললুম, ‘কচু, হাতী, ঘণ্টা!’
বললেন, ‘তর্জমা করে বলুন।’
আমি বললুম, ‘কচুর’ লাতিন নাম জানিনে; ‘হাতী’ হল ‘এলেফান্ট’ আর ‘ঘণ্টা’ মানে ‘গস্নকে’।
‘মানে! আর বুঝে দরকার নেই; এগুলো কটুবাক্য।’
আকাশ পানে হানি যুগলভুরম্ন বললেন, ‘অদ্ভুত ভাষা! হাতি আর ঘণ্টা গালাগালি হয় কি করে! একটা গল্প শুনবেন? সঙ্গে গরম ব্রান্ডি?’
আমি বললুম, ‘প্রথমটাই চলুক। মিক্স্ করা ভালো নয়।’
ডাক্তার বললেন, আমি ডাক্তারি শিখেছি বার্লিনে। বছর তিনেক প্র্যাকটিস করার পর একদিন গিয়েছি স্টেশনে, বন্ধুকে বিদেয় দিতে। ফেরার সময় স্টেশন-রেস্তোরাঁয় ঢুকেছি একটা ব্রান্ডি খাব বলে!
ঢুকেই থমকে দাঁড়ালুম। দেখি, এক কোণে এক অপরূপ সুন্দরী। অত্যন্ত সাদা সিদে বেশভূষা-গরীব বললেও চলে- আর তাই বোধ হয় সৌন্দর্যটা পেয়েছে তার চরম খোলতাই। নর্থসী দেখেছেন? তবে বুঝতেন হব-হব সন্ধ্যায় তার জল কি রকম নীল হয়-তারই মত সুন্দরীর চোখ। দক্ষিণ ইটালীতে কখনো গিয়েছেন? না? তবে বুঝতেন সেখানে সোনালি রোদে রূপালী প্রজাপতির কি রাগিণী। তাই মত তাঁর ব্লন্ড চুল। ডানয়ুব নদী দেখছেন? না? তা হলে আমার সব বর্ণনাই বৃথা।
আমি বললুম, ‘বলে যান, রসগ্রহণে আমার কণামাত্র অসুবিধে হচ্ছে না।’
‘না, থাক। ওরকম বেয়ারিং পোস্টের বর্ণনা দিতে আমার মন মানে না। আমরা ডাক্তার-বদ্যি মানুষ, ভাষা বাবদে মুখ্য-সুখ্যু। অনেক মেহনত করে যে একটি মাত্র বর্ণনা কব্জায় এনেছি সেইটেও যদি না বোঝেন তবে আমার শোকটা কোথায় রাখি বলুন তো।’
কাতর হয়ে বললুম, ‘নিরাশ করবেন না।’
‘তবে চলুক ত্রিলেগেড্ রেস। ডানয়ুব নদীর শান্ত-প্রশান্ত ভাবখানা তাঁর মুখের উপর। অথচ জানেন, ডানয়ুব অগভীর নদী নয়। আর ডানয়ুবের উৎপত্তিস’ল দেখেছেন। না। তাহলে বুঝতেন সেখানে তন্বঈ ডানয়ুব যে রকম লাজুক মেয়ের মত এঁকে বেঁকে আপন শরীর ঢাকতে ব্যস্ত, এ-মেয়ের মুখে তেমনি ছড়ানো রয়েছে লজ্জার কেমন যেন একটা আঁকুবাঁকু ভাব।
‘এই লজ্জা ভাবটার উপরই আমি বিশেষ করে জোর দিতে চাই। আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, লজ্জা-শরম বলতে আমরা যা কিছু বুঝি সে সব মধ্যযুগের পুরম্ননো গল্প থেকে। বেয়াত্রিচে দানেত্মকে দেখে লাজুক হাসি হেসেছিলেন- আমরা তাই নিয়ে কল্পনার জাল বুনি। আজকের দিনে এসব তো আর বার্লিন শহরে পাওয়া যায় না। মধ্যযুগের নাইটদের শিভালরি গেছে আর যাবার সময় সঙ্গে নিয়ে গিয়েছে মেয়েদের মুখ থেকে সব লজ্জা সব ব্রীড়া।
‘কিন’ আপনাদের দেশে নিশ্চয়ই এখনো এই মধুর জিনিসটি দেখতে পাওয়া যায় আর তার চেয়েও নিশ্চয়, আপনাদের দেশের লোক এখানো অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করে প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে।
‘তাই আপনি বিশ্বাস করবেন, কিন’ আমি নিজে এখনো ঠিক করতে পারিনি, কি করে যে আমার তখন মনে হ’ল এ-মেয়েকে না পেলে আমার চলবে না।
‘হাসলেন না যে? তার থেকেই বুঝলুম, আপনি ওয়াকিবহাল, আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পেরেছেন; কিন’ জর্মনরা আমার এ-অবস্থার কথা শুনে হাসে। আর হাসবেই বা না কেন? চেনা নেই, শোনা নেই, বিদ্যাবুদ্ধিতে মেয়েটা হয়ত অফিসবয়ের চেয়েও আকাট, হয়ত মাতালদের আড্ডায় বিয়ার বিক্রি করে পয়সা কামায়, কিম্বা এও তো হতে পারে যে তার বিয়ে হয়ে গিয়েছে। এ সব কোনো কিছুর তত্ত্ব-তাবাশ না করে এক ঝটকায় মনস্থির করে ফেলা, এ-মেয়ে না হলে আমার চলবে না! আমি কি খামখেয়ালির চেঙ্গিসখান, না হাজারো প্রেমের ডন্ জুয়ান্?
‘ভাবছি আর মাথার চুল ছিঁড়ছি-কোন্ অজুহাতে কোন্ অছিলায় এঁর সঙ্গে আলাপ করা যায়।
‘কিছুতেই কোনো হদিশ পাচ্ছিনে, আমাদের মাঝখানে তিনখানা মাত্র ছোট্ট টেবিলের যে উত্তাল সমুদ্র সেটা পেরিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছই কি প্রকারে। প্রবাদ আছে, প্রেমে পড়লে বোকা নাকি বুদ্ধিমান হয়ে যায়- প্রিয়াকে পাওয়ার জন্য তখন তার ফন্দি-ফিকির আর আবিষ্কার কৌশল দেখে পাঁচজনের তাক লেগে যায়, আর বুদ্ধিমান নাকি প্রেমে পড়লে হয়ে যায় একদম গবেট-এমন সব কা- তখন করে বসে যে দশজন তাজ্জব না মেনে যায়না, এ লোকটা এ-সব পাগলামি করছে কি করে!
‘এ জীবনে সেই সেদিন আমি প্রথম আবিষ্কার করলুম যে আমি বুদ্ধিমান, কারণ পূর্ণ একঘণ্টা ধরে ভেবেও আমি সামান্যতম কৌশল আবিষ্কার করতে পারলুম না, আলাপ করি কোন্ কায়দায়। কিন’ এহেন হৃদয়াভিরাম তত্ত্ব আবিষ্কার করেও মন কিছুমাত্র উল্লাসিত হল না। তখন বরঞ্চ বোকা বনতে পারলেই হয়ত কোনো একটা কৌশল বেরিয়ে যেত।
‘ফ্রলাইন উঠে দাঁড়ালেন। কি আর করি। পিছু নিলুম। তিনি গিয়ে উঠলেন ম্যুনিকের গাড়িতে। আমিও ছুটে গিয়ে টিকিট কাটলুম ম্যুনিকের। কিন’ এসে দেখি সে কামরার আটটা সিটই ভর্তি হয়ে গিয়েছে। আরো প্রমাণ হয়ে গেল, আমি বুদ্ধিমান, কারণ এ কথা সবাই জানে, বুদ্ধিমানকে ভগবান সাহায্য করলে এ-পৃথিবীতে বোকাদের আর বাঁচতে হত না। আমি ভগবানের কাছ থেকে কোনো সাহায্য পেলুম না।’
আমি বললুম, ‘ভগবানকে দোষ দিচ্ছেন কেন? এতো কন্দর্প ঠাকুরের ডিপার্টমেন্ট।’
বললেন, ‘তাতেই বা কি লাভ? তিনি তো অন্ধ। মেয়েটাকে বানিয়ে দিয়েছেন তাঁরই মত অন্ধ। এই যে আমি একটা এত বড় অ্যাপলো, আমার দিকে একবারের তরে ফিরেও তাকালো না। ওঁকে ডেকে হবে-’
আমি বললুম, ‘কচু’, ‘হাতী’, ‘ঘণ্টা’।
এবার ডাক্তার বাঙলা কটুকাটব্যের কদর বুঝলেন। বললেন, ‘আহা-হা-হা।’ তারপর জর্মন উচ্চারণে বললেন, ‘কশু, হাটি, গণ্টা! খাসা গালাগাল।’
আমি বললুম, কোমরাতে আটজনের সিট ছিল তো রয়েই গেল। প্রবাসে নিয়ম নাসিত্ম। আপনি কোনো গতিকে ধাক্কা ধাক্কি করে-’
বললেন, ‘তাজ্জব করলেন। একি আপনার ইন্ডিয়ান ট্রেন, না সাইবেরিয়াগামী প্রিজনার-ভ্যান! চেকার পত্রপাঠ কামরা থেকে বের করে দেবে না?’
‘দাঁড়িয়ে রইলুম বাইরের করিডরে ঠায়। দেখি মেয়েটি যদি খানাকামরায় যায়। স্টেশনে তো খেয়েছে শুধু কফি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটল, কত লোক কত কামরা থেকে উঠলো নামলো কিন’ আমার স্বর্গপুরী থেকে কোনো- (কটুবাক্য)- নামলো না। সব ব্যাটা নিশ্চয়ই যাচ্ছে ম্যুনিক। আর কোথাও যেতে পারে না? ম্যুনিক কি পরীস্থান না ম্যুনিকের ফুটপথ সোনা দিয়ে গড়া? অবাক করলে এই ইডিয়টগুলো।
‘প্রেমে পড়লে নাকি ক্ষুধাতৃষ্ণা লোপপায়। একবেলার জন্য হয়ত পায়। আমি লাঞ্চ খাইনি, ওদিকে ডিনারের সময় হয়ে গিয়েছে- আমার পেটের ভিতর হুলুধ্বনি জেগে উঠেছে। এমন সময় মা মেরির করম্নণা হল। মেয়েটি চলল খানা-কামরার দিকে। আমি চললুম ঠিক পিছনে পিছনে। আহা, যদি একটা হোঁচট খেয়ে আমার ওপর পড়ে যায়। দুত্তোর, তারও উপায় নেই- উঁচু হিলের জুতো হলে গাড়ির কাঁপুনিতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে- এ পরেছে ক্রেপসোল্।
‘ঠিক পিছনে পিছনে গিয়ে খানা-কামরায় ঢুকলুম। ওয়েটারটা ভাবলে স্বামী-স্ত্রী। না হলে তরম্নণ তরম্নণী এ রকম মুখ গুমসো করে খানা-কামরায় ঢুকবে কেন? বসলো গিয়ে একই টেবিলে- মুখোমুখি। হে মা মেরী, নত্রদাম গির্জেয় তোমার জন্য আমি একশ’টা মোমবাতি মানত করলুম। দয়া করো, মা একটা কিছু ফিকির বাৎলাও আলাপ করবার।
‘বুদ্ধিমান, বুদ্ধিমান, কোনো সন্দেহ নেই আমি বুদ্ধিমান! কোনো ফিকিরই জুটলো না, অথচ মেয়েটি বসে আছে আমার থেকে দু’হাত দূরে এবং মুখোমুখি! দু’হাত না হয়ে দু’লক্ষ যোজনও হতে পারত- কোনো ফারাক হ’ত না।
‘জানালা দিয়ে এক ঝটকা কয়লার গুঁড়ো এসে টেবিলের উপর পড়ল। মেয়েটি ভুরম্ন কুচকে সেদিকে তাকাতেই আমি ঝটিতি জানালা বন্ধ করতে গিয়ে করে ফেললুম আরেক কান্ড। ঠাস করে জানালাটা বুড়ো আঙুলের উপর পড়ে সেটাকে দিল থেৎলে। ফিনকি দিয়ে রক্ত।
‘মা-মেরীর অসীম দয়া কান্ডটা যে ঘটলো। মেয়েটি তড়াক করে লাফ দিয়ে বসল, “দাঁড়ান আমি ব্যান্ডেজ নিয়ে আসছি।”
‘আমি নিজে ডাক্তার, বিবেচনা করম্নন অবস্থাটা। রম্নমাল দিয়ে চেপে ধরলুম আঙুলটাকে। মেয়েটি ছুটে নিয়ে এল কামরা থেকে ফার্স্ট এডের ব্যান্ডেজ। তারপর আঙুলটার তদারকি করল শাস্ত্রসম্মত ডাক্তারি পদ্ধতিতে। বুঝলুম মেডিকেল কলেজে পড়ে! ঝানু ডাক্তার ফার্স্ট এডের ব্যান্ডেজ বয়ে বেড়ায় না আর আনাড়ি লোক এরকম ব্যান্ডেজ বাঁধতে পারে না।
‘আমি তো, ‘না, না’ ‘আপনি কেন মিছে মিছে’, ‘ধন্যবাদ, ধন্যবাদ’, ‘উঃ, বড্ড লাগছে’, ‘এতেই হবে’, ‘ব্যস বাস’ করেই যাচ্ছি আর সেই লিলির মতো সাদা হাতের পরশ পাচ্ছি। সে কি রকম মখমলের হাত জানেন? বলছি, আপনি কখনো রাইল্যান্ডে গিয়েছেন? না? থাক, ভুলেই গিয়েছিলুম, প্রতিজ্ঞা করছি, আপনাকে কোনো বর্ণনা দেব না।
‘প্রথম পরশে সর্বাঙ্গে বিদ্যুৎ খেলে যায়, বলে না? বড় খাঁটি কথা। আমি ডাক্তার মানুষ, আমার হাতে কোনো প্রকারের স্পর্শ কাতরতা থাকার কথা নয় তবু আমার কী অবস্থাটা হয়েছিল আপনাকে সেটা বোঝাই কী করে? মেয়েটি বোধহয় টের পেয়েছিল, কারণ একবার চকিতের তরে ব্যান্ডেজ বাঁধা বন্ধ করে আমার দিকে মাথা তুলে তাকিয়েছিল।
তাতে ছিল বিস্ময়, প্রশ্ন এবং হয়ত বা একটুখানি, অতি সামান্য খুশীর ঝিলিমিলি। তবে কি আমার হাতের স্পর্শ-? কোন্ সাহসে এ বিশ্বাস মনের কোণে ঠাঁই দিই, বলুন।’
আমি গুন্ গুন্ করে বললুম,
“জয় করে তবু ভয় কেন তোর যায় না,
হায় ভীরম্নপ্রেম হায় রে।”
ডাক্তার বললেন, ‘খোশা মেলডি তো। মানেটাও বলুন।’
বললুম, ‘আফ্টার ইউ। আপনি গল্পটা শেষ করম্নন।’
বললেন, ‘গল্প নয়, স্যার, জীবনমরণের কথা হচ্ছে।’
আমি শুধালুম, ‘কেন, সেপ্টিকের ভয় ছিল নাকি?’
রাগের ভাব করে বললেন, ‘ইয়োরোপে এসে আপনার কি সব রসকস শুকিয়ে গিয়েছে? আমাকে হেনেছে প্রেমের বাণ আর আপনি বলছেন আন্টিসেপ্টিক্ আন।’
আমি বললুম, ‘অপরাধ নেবেন না।’
বললেন, তারপর আমি সুযোগ পেয়ে আরম্ভ করলুম নানা রকমের কথা কইতে। গোল গোল। আমি যে পরিচয় করার জন্য জান কবুল সেটা ঢেকে চেপে। সঙ্গে সঙ্গে কখনো নূনটা এগিয়ে দি, কখনো ক্রুয়েটটা সরিয়ে নি, কখনো বা বলি, ‘মাছটা খাসা ভেজেছে, আপনি একটা খান না’; ওহে খানসামা, এদিকে-, ইত্যাদি।
‘করে করে সুন্দরীর মনটা একটু মোলায়েম করতে পেরেছি বলে মনে একটু ক্ষীণ আশার সঞ্চার হল।
মেয়েটি লাজুক বটে কিন্তু ভারী ভদ্র! আমার ভ্যাজর ভ্যাজর কান পেতে শুনলো, দু’একবার বস্নাশ্ করলো, সে যা গোলাপি- আপনি কখনো, না থাক।
‘কিন’ খেল মাত্র একটি অমলেট আর দু’স্লাইট রম্নটি। নিশ্চয়ই গরীব। ক্ষীণ আশাটার গায়ে একটু গত্তি লাগল।’ এমন সময় ডাক্তারের অ্যাসিস্টান্ট এসে জানলো রম্নগী এসেছে। ডাক্তার বললেন, ‘এখখুনি আসছি।’
ফিরে এসে কোনো ভূমিকা না দিয়েই বললেন, ‘ম্যুনিকে নাবলুম এক বস্ত্রে। এমন ভান করে কেটে পড়লুম যাতে মেয়েটি মনে করে আমি ভ্যান থেকে মাল নামাতে গেলুম। যখন ‘গুড্ বাই’ বলে হাত বাড়ালুম তখন সে একবার আমার দিকে তাকিয়েছিল। প্রেমে পড়লে নাকি মানুষের পাখা গজায়- হবেও বা, কিন্তু এ কথা নিশ্চয় জানি মানুষ তখন চোখে মুখে এমন সব নতুন ভাষা পড়তে পারে যার জন্য কোনো শব্দরূপ মুখস্থ করতে হয় না। তবে সে পড়াতে ভুল থাকে বিস্তর, কাকতলীয় এনত্মার।
“আমি দেখলুম লেখা রয়েছে ‘বিষাদ’ কিন্তু পড়লুম, ‘এই কি শেষ?”
আমিও অবাক হয়ে শুধালুম, ‘বার্লিন থেকে ম্যুনিক অবধি হামলা করে স্টেশনে খেই ছেড়ে দিলেন?’
ডাক্তারদের বাঁকা হাসি হেসে বললেন, আদপেই না। কিন্তু কি আর দরকার পিছু নিয়ে? মেডিকেল কলেজে পড়ে, ওতেই ব্যস্।
সেদিনই গেলুম মেডিকেল কলেজের রেস্তোরাঁয়। লাঞ্চ খেতে নিশ্চয়ই আসবে। এবারে মেয়েটি আর লজ্জা দিয়ে মনের ভাবঢাকতে পারল না। আমাকে দেখা মাত্র আপন অজানাতে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালো, সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত মুখে যে খুশি ছড়িয়ে পড়ল তা দেখে আমার মনে আর কোনো সন্দেহ রইল না, ভগবান মাঝে মাঝে বুদ্ধিমানকেও সাহায্য করেন।
‘ততক্ষণে মেয়েটি তার আপন-হারা আচরণটাকে সামলে নিয়েছে- লজ্জা এসে আবার সমস্ত মুখ ঢেকে ফেলেছে।’
ডাক্তার খানিকক্ষণ ভেবে নিয়ে বললেন, এখানেই যদি শেষ করা যেত তবে মন্দ হত না কিন্তু সর্দি-কাশির তো তা হলে কোনো হিল্লে হয় না। তাই কমিয়েসমিয়ে তাড়াতাড়ি শেষ করে দি।’
আমি বললুম, ‘কমাবেন না! তালটা একটু দ্রম্নত করে দিন। আমাদের দেশের ওস্তাদরা প্রথম খানিকটে গান করেন বিলম্বিত একতালে, শেষ করেন দ্রম্নত তালে।’
ডাক্তার বললেন, ‘দুঃখিনী মেয়ে, বাপ-মা নেই! এক খান্ডার পিসির বাড়ীতে মানুষ হয়েছে। দু’মুঠো খেতে দেয় পরতে দেয়, ব্যস্। কলেজের ফিজটি পর্যন্ত বেচারী যোগাড় করে মাস্টারি করে।
‘তাতে আমার কিছু বলার নেই। কিন’ আমার ঘোরতর আপত্তি এভাবে বুড়ী এমনি নজরবন্দী করে রেখেছে যে, চকিতা হরিণীর মত সমস্তক্ষণ সে ডাইনে বাঁয়ে তাকায়, ঐ বুঝি পিসি দেখে ফেললে, সে পরপুরম্নষের সঙ্গে কথা কইছে। আমি তো বিদ্রোহ করে বললুম, ‘একি বুখারার হারেম, না তুর্কী পাশার জেনানা? এ অত্যাচার আমি কিছুতেই সইব না।’ এভা শুধু আমার হাত ধরে বলে, ‘পস্নীজ, প্লীজ, তুমি একটু বরদাস্ত করে নাও, আমি তোমাকে হারাতে চাইনে।’ এর বেশী সে কক্খনো কিছু বলেনি।
এই মোকামে পৌঁছতে আমার লেগেছিল ঝাড়া একটি মাস। বিবেচনা করম্নন। সাত দিন লেগেছিল প্রেম নিবেদন করতে। পনেরো দিন লেগেছিল হাতখানি ছুঁতে। তারো এক সপ্তাহ পরে সে আমায় বললে কেন সে এমন ভয়ে ভয়ে ডাইনে বাঁয়ে তাকায়।
‘থিয়েটার সিনেমা মাথায় থাকুক, আমার সঙ্গে রাস্তায় পর্যন্ত বেরতে রাজী হয় না- পাছে পিসি দেখে ফেলে। আমি একদিন থাকতে না পেরে বললুম তোমার পিসির কুইনটুপ্লেট আছে নাকি যে তারা ম্যুনিকের সব স্ট্র্যাটেজিক পয়েন্টে দাঁড়িয়ে তোমার উপর নজর রাখছে? উত্তরে শুধু কাতর স্বরে বলে, প্লীজ, প্লীজ।’
যা-কিছু আলাপ পরিচয়, ঘনিষ্ঠতা আত্মীয়তা সব ঐ কলেজ রেস্তোরাঁয় বসে। সেখানে সার্ডিন-টিনের ভিতর মাছের মত। চেয়ারে চেয়ারে ঠাসাঠাসি কিন’ তার হাতে যে হাতখানা রাখব তারও উপায় নেই। কেউ যদি দেখে ফেলে।’ আমি বললুম,
‘সমুখে রয়েছে সুধা পারাবার
নাগাল না পায় তবু আঁখি তার
কেমনে সরাব কুহেলিকার এই বাধা রে।’
ডাক্তার বললেন, ‘মানে বলুন।’
আমি বললুম, ‘আপ যাইয়ে, পরে বলবো।’
ডাক্তার বললেন, ‘সেই ভিড়ের মাঝখানে, কিম্বা করিডরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আলাপচারি। করিডরে কথা কওয়া যায় প্রাণ খুলে, কিন’ তবু আমি রেস্তোরাঁর ভিড়ই পছন্দ করতুম বেশী, কারণ সেখানে দৈবাৎ, ক্বচিৎ কখনো এভা তার ছোট্ট জুতোটি দিয়ে আমার পায়ের উপর দিত চাপ।’
‘তার মাধুর্য আপনাকে কি করে বোঝাই? এভাকে পরে নিবিড়তর করে চিনেছি কিন’ সেই পায়ের চাপ যে আমাকে কত কথা বলেছে, কত আশ্বাস দিয়েছে সেটা কি করে বোঝাই?’
‘হয়ত তার চেনা কোনো এক ছোকরা স্টুডেন্ট এসে হাসিমুখে তাকে দুটি কথা বললে। অত্যন্ত হার্মলেস আমি কিন’ হিংসেয় জরজর। টেবিলের উপর রাখা আমার হাত দুটো কাঁপতে আরম্ভ করছে, আমি আর নিজেকে সামলাতে পারছিনে-
‘এমন সময় সেই পায়ের মৃদু চাপ।
সব সংশয়ের অবসান, সব দুঃখ অন্তর্ধান।’
ডাক্তার বললেন, ‘তাই আমার দুঃখ আর বেদনার অবধি রইল না। এই বিরাট ম্যুনিক শহরের লক্ষ লক্ষ নরনারী নিভৃতে মনের ভার নামাচ্ছে, নিষ্ঠুর সংসারে লড়বার শক্তি একে অন্যের সঙ্গসুখ স্পর্শসুখ থেকে আহরণ করে নিচ্ছে, আর আমি তারই মাঝখানে এমন কিছুই করে উঠতে পারছিনে যাতে করে এভাকে অন্তত একবারের মত কাছে টেনে আনতে পারি!
‘শেষটায় আর সইতে না পেরে একদিন এভাকে কিছু না বলে ফিরে গেলুম বার্লিন। সেখান থেকে লিখে জানলুম, ‘ওরকম কাছে থেকে না পাওয়ার দুঃখ আমার পক্ষে সহ্য করা অসম্ভব হয়ে উঠেছে- আমার নার্ভস একদম গেছে। তোমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসা আমার কিছুতেই হয়ে উঠত না- তোমার মুখের কাতর ছবি আমার চলে আসার সব শক্তি নষ্ট করে ফেলত।’
আমি বললুম, ‘আপনি তো দারম্নণ লোক মশাই। তবে, হ্যাঁ, আপনাদের নীচশেই বলেছেন, কড়া না হলে প্রেম মেলে না।’
ডাক্তার বললেন, ‘ঠিক উল্টো! কড়া হতে পারলে আমি ম্যুনিক থেকে পালাতুম না। পলায়ন জিনিসটা কি বীরের লক্ষণ? তা সে কথা থাক।
‘উত্তর পেলুম সঙ্গে সঙ্গেই। সে চিঠিটি আমি এতবার পড়েছি যে তার ফুলস্টপ কমা পর্যন্ত আমার মুখসত্ম হয়ে গিয়েছে। এবং তার চেয়েও বড় কথা, সে চিঠিটির বক্তব্য আমার কাছে সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য ঠেকলো।’
আপনাদের দেশে অবিশ্বাস্য বলে কোনো জিনিস নেই- ভিখিরিকে মাথায় তুলে নিয়ে আপনাদের দেশে হাতী হামেশাই রাজা বানায়। কিন’ জর্মনিতে তো সে রকম ঐতিহ্য নেই। চিঠিতে লেখা ছিল-
বেশী লিখব না- আমারও অসহ্য হয়ে উঠেছে। তাই স্থির করেছি, তোমার ইচ্ছামত তোমায় আমায় একবার নিভৃতে দেখা হবে। তারপর বিদায়। যত দিন পিসি আছেন ততদিন আমি আর কোনো পন্থা খুঁজে পাচ্ছিনে। তুমি আসছে বুধবার দিন আমাদের বাড়ীর সামনে ফুটপাতে অপেক্ষা করো। আমি তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে আসব।”
ডাক্তার বললেন, ‘বিশ্বাস হয় আপনার! যে মেয়ে পিসির ভয়ে আমার সঙ্গে কলেজ রেসেত্মারাঁয় বাইরে পর্যন্ত যেতে রাজী হত না, সে আমাকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছে আপন ঘরে?’
আমি বললুম, পীরিতী-সায়রে ডোবার পূর্বে যে রাধা সাপের ছবিমাত্র দেখেই অজ্ঞান হতেন সেই রাধাই অভিসারে যাওয়ার সময় আপন হাত দিয়ে পথের পাশের সাপের ফণা চেপে ধরেছেন পাছে সাপের মাথার মণির আলোকে কেউ কেউ তাঁকে দেখে ফেলে।’
ডাক্তার বললেন, ‘তাই বটে। তবে কি না আমি রাধার প্রেমকাহিনী কখনো পড়িনি। সে কথা থাক।
‘আমি ম্যুনিকে পৌঁছলুম বুধবার সন্ধ্যের দিকে। কয়লার গুঁড়োয় সর্বাঙ্গ ঢেকে গিয়েছিল বলে ঢুকলুম একটা পাবলিক বাথে স্নান করতে। টাবে বসে সর্বশরীর ডলাই-মলাই করে আর গরম জলে সেদ্ধ হয়ে চিংরিটার মত লাল হয়ে যখন বেরলুম তখন আর হাতে বেশী সময় নেই। অথচ টাব থেকে ওরকম হুট করে ঠান্ডায় বেরলে যে সঙ্গে সঙ্গে ঝপ্ করে সর্দি হয় সে কথাও জানি। চানটা না করলেও যে হত সে তত্ত্বটা বুঝতে পারলুম রাসত্মায় বেরিয়ে কিন’ তখন আর আফসোস করে কোনো ফায়দা নেই। সেই ডিসেম্বরের শীতে চললুম এভার বাড়ির দিকে- মা-মেরীর উপর ভরসা করে, যে এ যাত্রায় সর্দিটা নাও হতে পারে।
আমি বললুম, ‘আমরা বাঙলায় বলি, ‘দুর্গগা বলে ঝুলে পড়লুম’।’
ডাক্তার বললেন, ‘সাড়ে এগারোটার সময় গিয়ে দাঁড়ালুম এবার বাড়ির সামনের রাসত্মায়। টেম্পারেচার তখন শূন্যেরও নীচে- আপনাদের পাগলা ফারন্হাইটের হিসেবে বত্রিশের ঢের নীচে! রাস্তায় এক ফুট বরফ। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, আর আমার চতুর্দিকে যে হিম ঘনাতে লাগলো তার সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলতে পারি আমাকে যেন কেউ একটা বিরাট ফ্রিজিডেরের ভিতর তালাবন্ধ করে রেখে দিল।
তিন মিনিট যেতে না যেতে নামল মুষলধারে…বৃষ্টি নয়-সর্দ্দি। সঙ্গে সঙ্গে ডাইনামাইট ফাটার হাঁচি-হাঁচ্চো, হাঁচ্চো, হাঁচ্চো। আপনার আজকের সর্দি তার তুলনায় নস্যি, অর্থাৎ নস্যির খোঁচায় নামানো আড়াই ফোঁটা জল। হাঁচি আর জল, জল আর হাঁচি।
‘কি করি, কি করি ভাবছি, এমন সময় এভা এসে নিঃশব্দে আমার হাত ধরলো- বরফের গুঁড়োর উপর পায়ের শব্দ শোনা যায় না। তার উপর সে পরেছে সেই ক্রেপসোলের জুতো- বেচারীর মাত্র ঐ এক জোড়াই সম্বল!
‘কোনো কথা না বলে আমাকে নিয়ে চলল তার সঙ্গে। ফ্ল্যাটের দরজা খুলে, করিডরের খানিকটে পেরিয়েই তার কামরা। নিঃশব্দে আমাকে সে ঢুকিয়ে দরজায় খিল দিয়ে মাথা নিচু করে আমার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।
‘ওভার গোলাপি মুখ ডাচ্ পনিরের মত হলদে, টুকটুকে লাল ঠোঁট দুটি বলু ডানয়ুবের মত ঘন বেগুনি- নীল- ভয়ে, উত্তেজনায়।
‘আর সঙ্গে সঙ্গে শুরম্ন হল আবার আমার সেই ডাইনামাইট ফাটানো হ্যাঁচ্চো, হাঁচ্চো।
‘এভা আমাকে ধরে নিয়ে আমার মাথা গুঁজে দিল বিছানায়। মাথার উপর চাপালো বালিশ আর সব ক’খানা লেপ-কম্বল। বুঝতে পারলুম কেন, পাশের ঘরে পিসি যদি শুনতে পান তবেই হয়েছে। আমি প্রাণপণ হাঁচি চাপাবার চেষ্টা করছি আর লেপ-কম্বলের ভিতর বম্-শেল্ ফাটাচ্ছি।
‘কতক্ষণ এ রকম কেটেছিল বলতে পারব না। হাঁচির শব্দ কিছুতেই থামছে না। এভা শুধু কম্বল চাপাচ্ছে, আমার দম বন্ধ হবার উপক্রম কিন’ নিবিড় পুলকে বার বার আমার সর্বশরীর শিহরিত হচ্ছে- এভার হাতের চাপ পেয়ে।
‘এমন সময় দরজায় ধাক্কা আর নারীকণ্ঠের তীব্র চীৎকার, ‘দরজা খোল।’
‘পিসি!’
‘আর লুকিয়ে থেকে লাভ নেই। আমি লেপের ভিতর থেকে বেরলুম। এভা ভয়ে ভিরমি গিয়েছে, খাটের উপর নেতিয়ে পড়েছে।
‘আমি দরজা খুলে দিলুম। সাক্ষাৎ শকুনির মত বীভৎস এক বুড়ী ঘরে ঢুকে আমার দিকে না তাকিয়েই এভাকে বললো, ‘কাল সকালেই তুই এ-বাড়ি ছাড়বি’।
‘সঙ্গে সঙ্গে আর কি সব বকুনি দিয়েছিল, ঘেন্না, কেলেঙ্কারি, শোবার ঘরে পরপুরম্নষ’, ‘রাসত্মার মেয়ের ব্যাভার’, এই সব, সে আমার আর মনে নেই। বুড়ী আমার দিকে তাকায় না, গালের উপর গাল চড়ছে যেন ছ’ গজি পিয়ানোর এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত অবধি কেউ আঙ্গুল চালাচ্ছে। ‘আমি থাকতে পারলুম না। বুড়ীর দুই বাহু দু’হাত দিয়ে চেপে ধরে বললুম, ‘আমার নাম পেটার সেল্বাখ। বার্লিনে ডাক্তারি করি। ভদ্রঘরের ছেলে। আপনার ভাইঝিকে বিয়ে করতে চাই’।’
ডাক্তার বললেন, মামেরী সাক্ষী আমি এভাকে বিয়ে করার প্রসত্মাব এতদিন করিনি পাছে সে ‘না’ বলে বসে। আমি অপেক্ষা করেছিলুম পরিচয়টা ঘনাবার জন্য। বিয়ের প্রসত্মাবটা আমার মুখ দিয়ে যে তখন কি করে বেরিয়ে গেল আমি আজও বুঝে উঠতে পারিনি।
‘পিসি আমার দিকে হাবার মতো তাকালো- এক বিঘৎ চওড়া হা করে। পাকা দু’মিনিট তার লেগেছিল ব্যাপারটা বুঝতে। তারপর ফুটে উঠল মুখের উপর খুশীর পয়লা ঝলক। সেটা দেখতে আরো বীভৎস! মুখের কুঁচকানো এবড়ো থেবড়ো গাল, ভাঙা-চোরা-নাক-মুখ-ঠোঁট যেন আরও বিকৃত হয়ে গেল।
‘আমাকে জড়িয়ে ধরে কি যেন বললে ঠিক বুঝতে পারলুম না। তারপর হঠাৎ আমাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটল করিডরের দিকে। চীৎকার করে কাকে যেন ডাকছে।
‘এভা তখনো অচৈতন্য।’
‘বুড়ী ফিরে এল বুড়োকে নিয়ে। বুড়ো ব্যাপারটা বুঝে নিয়েছে চট করে। তার চেহারাটা খুশীর পিছনে দেখলুম সেই ভীত ভাব-এভার মুখে যেটা অষ্টপ্রহর লেপা থাকে। বুঝলুম, পিসির দাপটে এ বাড়ির সকলেরই কণ্ঠশ্বাস।
‘মনে হল বুড়ো খুশী হয়েছে, এভা যে এ বাড়ির অত্যাচার থেকে নিষ্কৃতি পেয়েছে তার জন্য। হায়, তার তো নিষ্কৃতি নেই।’
ডাক্তার বললেন, ‘সেই দুপুর রাতে ওয়াইন এল, শ্যাম্পেন এল। হোটেল থেকে সসেজ্ কট্লেট্ এল। হৈ হৈ রৈ রৈ। এভা সম্বিতে ফিরেছে। বুড়ো শ্যাম্পেন টানছে জলের মতো। বুড়ী এক গেলাসেই টং। আমাকে জড়িয়ে শুধু কাঁদে আর এভার বাপের কথা স্মরণ করে বলে, ভাই বেঁচে থাকলে আজ সে কী খুশীটাই না হত।
‘আর এভা? আমাকে একবার শুধু কানে কানে বলল, ‘জীবনে এই প্রথম শ্যাম্পেন খাচ্ছি। তুমি আমার উপর একটু নজর রেখো।’
ডাক্তার উৎসাহিত হয়ে আরো কি যেন বলতে যাচ্ছিলেন এমন সময় আস্তে আস্তে দরজা খুলে ঘরে ঢুকলেন এক সুন্দরী- হাঁ, সুন্দরী বটে।
এক লহমায় আমি নর্থ সীর ঘন নীল জল, দক্ষিণ ইটালির সোনালি রোদে রূপালি প্রজাপতি, ডানয়ুবের শান্ত-প্রশান্ত ছবি, সেই ডানয়ুবেরই লজ্জাশীল দেহচ্ছন্দ রাইল্যান্ডের শ্যামলিয়া মোহনীয়া ইন্দ্রজাল সব কিছুই দেখতে পেলুম। আর সে কী লাজুক হাসি হেসে আমার দিকে তিনি হাত বাড়ালেন।
আমি মাথা নীচু করে ফরাসিস কায়দায় তাঁর চম্পক করাঙ্গুলি-প্রান্তে ওষ্ঠ স্পর্শ করে মনে মনে বললুম,
‘বেঁচে থাকো সর্দি-কাশি
চিরজীবী হয়ে তুমি।’
No comments:
Post a Comment