"ভাই সিগারেটটা দেন তো।"
বা দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা কম বয়সী ছেলে, হাত বাড়িয়ে সিগারেট চাচ্ছে। মাঝে মাঝে এমন হয়, কেউ সিগারেট ধরাবার জন্য সিগারেট চায়। কিন্তু ছেলেটার হাতে কোন সিগারেট দেখছি না।
জিজ্ঞেস করলাম "কেন? কি করবা"
বা দিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা কম বয়সী ছেলে, হাত বাড়িয়ে সিগারেট চাচ্ছে। মাঝে মাঝে এমন হয়, কেউ সিগারেট ধরাবার জন্য সিগারেট চায়। কিন্তু ছেলেটার হাতে কোন সিগারেট দেখছি না।
জিজ্ঞেস করলাম "কেন? কি করবা"
"খামু, বড্ড ঠান্ডা পরছে।"
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। দেশের মানুষ ভাত পায় না, আর এই বেটা আয়েশ করে সিগারেট টানবে। তাও যেই সেই সিগারেট না, সাড়ে পাচ টাকা দামের বেনসন এন্ড হেইজেস। বুঝলাম একটু পাগল কিছিমের লোক, বেশি ঘাটিয়ে লাভ নাই। বললাম "সিগারেট নাই, যাও ভাগো"।
ছেলেটা দেখি একেবারে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকালো। যেন বিশ্বাসই করতে পারছে না যে আমি তাকে একটা সিগারেট দিলাম না। হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। তার দৃষ্টিতে অপমানের ছাপ বেশ স্পষ্ট। এত আত্মসম্মান বোধ নিয়ে বেটা রাস্তার মানুষের কাছে সিগারেট চাচ্ছে, এ মাথা খারাপ না হয়ে যায় না।
কি মনে হতে সিগারেটের প্যাকেটটা বাড়িয়ে দিলাম। আমার দামী লাইটারটা দিয়ে ধরিয়েও দিলাম। ছেলেটার আর কোন ভাবান্তর নাই, সিগারেটে জোরে একটা টান দিয়ে হেটে চলে গেল। যেন এটাই খুব স্বাভাবিক। হাটার ভঙ্গি বেশ স্বাভাবিক, তবে পাগল যে তা বোঝা যাচ্ছিল। সাই সাই করে গাড়ি যাচ্ছে, তার কোন বিকার নাই। গাড়িকে একটুও পাত্তা না দিয়ে রাস্তা পার হয়ে গেল।
আমিও রাস্তা পার হবার জন্য হাটা শুরু করলাম। সামনে নীতুর বাসা।
প্রতিদিন নীতুর বাসায় যাবো যাবো করেও কেন জানি যাওয়া হচ্ছে না। ওর বাসায় একবার যাওয়া দরকার। নীতুর বাবার নাকি হার্টে সমস্যা দেখা দিয়েছে। হার্ট বেশ ফুলে গেছে, অপারেশনের দরকার পরতে পারে। নীতুর মারও শরীর ভাল যাচ্ছে না, ডায়াবেটিক ধরা পরেছে কদিন হল। তাকেও দেখতে যাওয়া দরকার।
এসব চিন্তা করতে করতে একেবারে নীতুর বাসার সামনেই চলে আসলাম। যাবো যাবো ভাবতে ভাবতে পেরিয়ে আসলাম নীতুর বাসাটা। কেন জানি যাওয়া যাচ্ছে না ওর বাসায়, যখনি ওর বাসায় যাবো ভেবে বের হচ্ছি, পা আটকে যাচ্ছে।
এরেকটা সিগারেট ধরিয়ে রিকশা নিলাম। আমার বাসা খুব বেশি দুরে না, হেটেই যাওয়া যায়। কিন্তু বৃষ্টি বেশ জাকিয়ে বসেছে, বাসায় যেতে যেতে পুরো ভিজে যাবো। রিকশাওয়ালাদেরও পোয়াবারো, তিনগুন ভাড়া চেয়ে বসেছে। কি আর করা, একটু মুলামুলি করে উঠে পরলাম রিকশাতে। রিকশাওয়ালারা ঢাকার প্রান, তাদের ক্ষেপাতে নাই।
নীতুর সাথে যখন রিকশায় চড়তাম, সারাটা রাস্তা আমাকে ক্ষেপাতে থাকতো। নতুন অফিসে জয়েন করার পরে আমার অল্প একটু ভুড়ি হয়েছে, ভুড়িতে খোঁচা দিয়ে বলতো "মোটু কোথাকার, আর একটু বাড়লেই তো আর এক সাথে রিকশায় চড়া যাবে না। তা ক'মাস?"
আমার খুব রাগ লাগে আমাকে কেউ মোটু বললে। কিন্তু নীতু এত মিষ্টি করে মোটু বলে, আমার আর রাগ করার উপায় থাকে না। অনেক চেষ্টা করেও রাগ করতে পারি না।
সেবার ডিসেম্বর মাসেই, হ্যা ডিসেম্বরেই আমরা দুজন দুজনকে মোটু, ইতর, বদমাইশ বলতে বলতে রিকশায় করে যাচ্ছিলাম। আমাদের ভালবাসাটাও অদ্ভুত রকমের ছিল, কেউ কখনও কাউকে জড়িয়ে ধরে বলিনি ভালবাসি, বা কোন রোমান্টিক কথা, আবেগের কথাও বলিনি। কিন্তু দুজন দুজনকে ছেড়ে একদিনও থাকতে পারতাম না। আমাদের সব কথা, সব যুদ্ধ, মারামারি, একে অন্যকে খোঁচা মেরে কথা বলাই ছিল আমাদের সম্পর্ক।
সেই ডিসেম্বরে আকাশে চমৎকার চাঁদ উঠেছিল। আমি চাঁদের দিকে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে ছিলাম, আমারও একটু রোমান্টিক হবার ইচ্ছা করছিল। যদিও আমার ওসব একেবারেই আসে না।
চাঁদের আলোয় নীতুকে কেমন জানি অচেনা মনে হচ্ছিল। আমার কিছু বলতে ইচ্ছা করছিল, কোন কবিতার লাইন, কোন প্রচন্ড আবেগের কথা। স্মৃতি হাতরে তন্নতন্ন করেও কোন লাইন মনে আসছিল না। শেষমেষ মুখ ফস্কে বেড়িয়ে গেল,"তোমাকে চাঁদের মত লাগছে"
বলার পরেই ভুল বুঝতে পারলাম, সর্বনাশ হয়ে গেছে। নীতু চোখ ছোট ছোট করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,"তোমার মাথা ঠিক আছে তো? বাংলা সিনেমা দেখা শুরু করলে নাকি।"
আমি প্রচন্ড অপমানে তখন অন্যদিকে তাকিয়ে আছি। কি ঝামেলায় পরলাম, এই ডায়লগের খোঁচা আমাকে আগামী এক মাস শুনতে হবে। সুযোগ পেলেই আমাকে বলবে বাংলা সিনেমা দেখা ছাড়ো। ঐসব বলে মেয়ে পটানো যায় না। একটু স্মার্ট হও। যেমন গাধা ছিলা তাই রয়ে গেলা, মানুষ হলা না।
অন্যদিকে তাকিয়ে ছিলাম, ভাব দেখাচ্ছিলাম কিছুই শুনছি না। রাস্তায় দেখি জয় বাংলা পাগলটা চিৎকার করছে। জয় বাংলা পাগলটার বয়স কত, কিভাবে পাগল হল আমি কিছুই জানি না। ছোট বেলা থেকেই এলাকায় দেখে আসছি ওকে। যেকোন মিছিলে গিয়ে জয় বাংলা বলে চিৎকার দিয়ে দেয়। পাগলটা এমনই আহাম্মক, বুঝতেই চায় না জয় বাংলা এখন আর চিৎকার দিয়ে বলার মত স্লোগান না। এই স্লোগানটা একটা রাজনৈতিক দল দখল করে নিয়েছে। বেচারা বিএনপির মিছিলে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে বেশ কয়েকবার মার খেয়েছে, যুবদলের ষন্ডামার্কা নেতারা একবার ওকে মেরে পুরা ছেচে ফেলেছিল মিছিলের মাঝখানে গিয়ে জয় বাংলা বলার অপরাধে। কিন্তু আহাম্মকের বাচ্চা এখনও বুঝে উঠতে পারে নি যে এটা ৭১ নয়, এটা স্বাধীন বাংলাদেশ। এখানে জয় বাংলা বলে চেচামেচি করলে জনগনের কোমল অনুভূতিতে আঘাত লাগে, তাদের বিএনপিয়ানুভূতি, জামাতানুভূতি প্রবল ভাবে আক্রান্ত হয়। এরকম পাগলকে দেশ থেকে বের করে দেয়া দরকার।
ঐদিকে নীতু আমাকে বেশ পেয়ে বসেছে, সমানে পচাচ্ছে আমাকে। কিন্তু নীতুর কথায় খেয়াল করতে পারছি না। জয় বাংলা পাগলটা দেখলাম বেশ জোরে জোরে চেচাচ্ছে, "তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা। বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।" খেয়াল করে দেখলাম মিছিলটা ছাত্র শিবিরের। তারা কি কারনে জানি মিছিল করছে, কার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত বা কোন কার্টুনে কি আঁকা তা নিয়ে। পাগলটা বরাবরের মতই কিছু না বুঝে মিছিলে ভিড়ে গেছে, আর জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে যাচ্ছে।
সামনের সাড়িতে শিবিরের নেতাদের চেহারায় দেখলাম প্রবল হতাশা, তাদের মিছিল না এখানেই পন্ড হয়ে যায়। তারা কিছু পাতি নেতাকে কি জানি নির্দেশ দিল। কয়েকজন পাগলটাকে টেন হিচড়ে রেললাইনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি রিকশা থেকে নেমে গেলাম, নীতুকে বললাম বাসায় চলে যেতে। আমি পরে ফিরবো।
শিবিরের নেতাগুলো আমাকে চেনে ভালকরেই। আমি এগিয়ে যেতেই চাপ দাড়িওয়ালা ছাগলা সগির বলে উঠলো "আরে নাস্তিক সাহেব, কি খবর। আপনার নাস্তিকি দাওয়াত কার্যক্রম কেমন চলছে। কটা ছেলের মাথা আবার নষ্ট করলেন। একবার পার্টি অফিসে আসতে কইলা আইলেন না। আপনের মত লোক আমাগো দলে থাকলে মনে করেন বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বড় মাপের নেতা হইয়া যাইতেন। আপনের কথা পুলাপান যেমন খায়, মাশাল্লাহ।"
আমি বললাম, "জয় বাংলা পাগলটা কই? তারে কই নিয়া গেল?"
ছাগলা সগির বলল, "ঐটা নিয়া টেনশন নিয়েন না। ও বেজায় ত্যাক্ত করে। ওরে একটা বিড়ি কিন্না দিতে পাঠাইলাম। হালায় যেইখানে সেইখানে জয় বাংলা কয়, এইটা তো ঠিক না, তাই না। এইটা স্বাধীন বাংলাদ্যাশ। এইখানে এই সব তো বলা যাইবো না।"
আমি দৌড়ে চলে গেলাম রেল লাইনের দিকে। কিন্তু ততক্ষণে পাতি নেতারা জয় বাংলা পাগলটাকে নিয়ে গেছে। পেলাম না।
বাসায় ফিরে আসলাম। এই শিবিরের নেতাগুলো বেশ ক্ষমতাশালী। এলাকার যুবদলের নেতারাও এদের ভয় পায়। এদের সাথে আমি ঝামেলা করতে চাই না, এদের ক্ষমতা নাকি অসীম। বাসায় ফিরে নেটে বসলাম।
সকাল বেলা নাস্তা খাবার সময় কাজের ছেলেটার মুখে শুনলাম জয় বাংলা পাগলটা মারা গেছে। কারা জানি পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। মৃত্যু নিশ্চিত করার জয় পায়ের একটা রগও কেটে দিয়েছে।
পেটের ভেতরে কেমন জানি মোচড় দিয়ে উঠলো। গা গুলিয়ে উঠছিল, গরগর করে কিছুক্ষণ বমি করলাম।
সেই ডিসেম্বরের পরে মাঝে মাঝেই পাগলটাকে মনে পরতো। আর তেমন কেউ হয়তো মনে রাখে নি। পাগলটার লাশ কি করা হয়েছিল তাও খোজঁ নেই নি। কি দরকার আমার? পাগলামী ছাগলামী করতে গিয়ে দেশপ্রেমিক জনগনের হাতে মার খেলে কে বাঁচাতে আসবে? এই ধরনের পাগলের মরে যাওয়াই উচিৎ। বেঁচে থেকে এরা দেশ জাতির কি এমন উন্নতি করবে?
পাগলটার কথা মনে হলেই নীতুর কথা আরও বেশি মনে পরে। নীতু পাগলটাকে আমার একটা শার্ট দিয়েছিল। সেই শার্টটা পরে পাগলটার কি খুশি, নীতুকে জড়িয়ে ধরেছিল। এতদিন প্রেম করার পরেও আমি নীতুকে কখনও জড়িয়ে ধরতে পারলাম না, একটু হাত ধরতে চাইলেই ধমকে ধমকে কান ঝালা পালা হয়ে যেত, অথচ নীতু পাগলটাকে কিছুই বলে নি।
ইচ্ছা করছে নীতুকে একটা ফোন দিতে। কিন্তু নীতুকে ফোন দেয়া অনেক খরচের ব্যাপার। নীতুও ফোন সহজে ছাড়তে চায় না, এতক্ষণ কথা বলাও সম্ভব না, তাই ফোন দেবার চিন্তাটা বাদ দিতে হল।
বৃষ্টির ভেতরে সব ঝাপসা হয়ে আসছে, বাসায় ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি। একটু পরেই অন্ধকার নামবে, সেই অন্ধকারে নিশাচর জীবেরা খাবারের সন্ধানে বের হবে। আধুনিক হিংস্র প্রানীরা হামলে পরে কামড়ে ধরবে না, ধীরে ধীরে রক্ত চুষে নেবে। তারা দখল করে নেবে, আমাদের শিকলে আটকে ফেলবে। যেমন দখল করে নিয়েছে নীতুকেও।
No comments:
Post a Comment