তোমাদের তো এখন স্কুল ছুটি, পরীক্ষা শেষ। সবাই নিশ্চয়ই মহানন্দে মামার বাড়ি বেড়াতে বেড়িয়েছো! তুমি যেমন শীতের ছুটিতে গ্রামে গেছো বেড়াতে, তেমনি কিছু পাখিও কিন্তু শীতকালে আমাদের দেশে বেড়াতে আসে। ভাবছো, ওমা! ওদেরও কি স্কুল আছে? আর পরীক্ষা শেষ করে শীতের ছুটি পেয়েই ওরাও ঘুরতে বেড়িয়ে গেছে? মোটেও তা নয়। ওদের কোনো স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ই নেই। তাই নিয়ম করে পড়া তৈরি করার কষ্টও যেমন নেই, তেমনি ছুটিতে মামা বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার মজাও ওদের নেই। ওরা আমাদের দেশে আসলে বেড়াতে আসে না, আসে নিজেদের জীবন বাঁচাতে। জীবন বাঁচাতে ওরা সারাজীবন পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুটে বেড়ায়। তোমাদের কেউ হয়তো এরই মধ্যে ফস করে বলে বসলে, নিশ্চয়ই এ কোনো দুষ্টু রাক্ষসের কাজ। পাখি খেতে খুব পছন্দ করে বলে খালি পাখিদের তাড়িয়ে বেড়ায়। আর পাখিরাও ওর হাত বাঁচার জন্যে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়! তা অবশ্য মন্দ বলোনি, শুনেই কেমন যেন রূপকথার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে রূপকথা না হয় আমরা আরেকদিন শুনবো। আজকে আমরা আমাদের সে সব অতিথি পাখির কথাই শুনি, কেমন? আমাদের অতিথি বলে কথা!
অতিথি পাখি বলতে বলতে আমরা কিন্তু ওদের আসল নামটাই ভুলে গেছি! ওদের নাম আসলে পরিযায়ী পাখি। সারাজীবন পর্যটকদের মত পৃথিবীটা ঘুরে ঘুরে কাটিয়ে দেয় কিনা, তাই ওদের এমনতর নাম। তবে পর্যটকদের মতো মনের সুখে কিন্তু তারা পৃথিবীকে জানার জন্যে ঘুরতে বের হয় না। এমনও না যে দূরে ওদের অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে, বছরে একবার তাদের সঙ্গে দেখা করে যায়। তবু প্রতি বছর ওরা পৃথিবীর এক জায়গা থেকে উড়ে উড়ে চলে যায় আরেক জায়গায়। এর প্রধান কারণ হলো শীত।
শীতকাল আসলেই তো মায়েরা বাসার কোথা না কোথা থেকে একগাদা লেপ-কম্বল আর সোয়েটার বের করেন। তারপর তুমি সারাদিন গায়ে একটা সোয়েটার পরে মজা করে ঘুরে বেড়াও, আর রাত হলেই লেপের নিচে শুয়ে কী আরামেই না ঘুমিয়ে পড়ো। বাইরের দেশে, যেখানে শীতকাল এলে ঠাণ্ডায় একেবারে তুষার পড়তে শুরু করে, সেখানে সবাই আরো বেশি করে গরম কাপড় পড়ে। ইয়া মোটা মোটা সোয়েটার পরে, হাতে পরে গ্লাভস, আর পায়ে মোটা মোটা চামড়ার মোজা। কিন্তু সেখানেও তো পাখি থাকে। ওরা তো আর ইয়া মোটা মোটা সোয়েটার পরতে পারে না, ওদের কচি কচি পাখায় গ্লাভসও পরতে পারে না, ওদের টুকটুকে পায়ে পরতে পারে না চামড়ার ভারি মোজা। আমাদের দেশের পাখিরা না হয় শীতকালে মানিয়ে নিতে পারে, ওখানকার পাখিরা তো ঐ শীতে জমেই মরে যাবে! ঐ মরে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যেই শীতকালে দলবেঁধে সব উড়ে আসতে থাকে আমাদের দেশের মতো মোটামুটি গরম দেশে। ঐ বরফ জমানো শীতকে অবশ্য তোমরা রাক্ষসও বলতে পারো। তখন আমরা ওদের নিয়ে একটা রূপকথাও বানাতে পারবো!
তোমাদের অনেকের মনেই হয়তো একটা প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি মারতে শুরু করেছে, পাখিরা যেমন শীতের জ্বালায় অস্থির হয়ে আরেক জায়গায় পালিয়ে যায়, পশুরা তো সেরকম যায় না। কখনো তো শুনিনি, রাশিয়া থেকে একটা বাঘ শীতে অতিষ্ঠ হয়ে ভারতে চলে এসেছে! আসলে পশুরা শীতকালে মানিয়ে নেওয়া শিখে গেছে। বেশিরভাগ পশুই শীতকালে কোনো গুহা বা অন্য কোনো মোটামুটি লুকোনো আর গরম জায়গা বেছে নিয়ে সেখানে দেয় এক ঘুম। এক ঘুমে একেবারে পুরো শীতকালই পার করে দেয়। আর তারপর যখন শীতকাল শেষ হয়ে যায়, বরফ গলতে শুরু করে, তখন আবার জেগে ওঠে।
ওদের নিজেদের বাসা ছেড়ে এভাবে ঘুরতে বের হওয়ার আরেকটি কারণ আছে, সেটাও অবশ্য শীতের কারণেই হয়; সেটা হলো খাদ্যের অভাব। শীতকালে যখন সব কিছু বরফে ঢেকে যায়, তখন ওরা আর খাবার কোত্থেকে পাবে বলো? পশুরা তো ওদের বাসায় নয়তো শরীরের ভেতর পুরো শীতকালের জন্য খাবার সঞ্চয় করে রাখে। কিন্তু পাখিরা তো তা করতে পারে না। ওদের শরীরে যেমন খাবার সঞ্চয়ের কোনো ব্যবস্থা নেই, সেরকম বাসাও বানাতে পারে না ভালো করে, যেখানে খাবার জমা করে রাখা যাবে পুরো শীতকালের জন্য। ওরা অনেকটা দিনে আনে দিনে খায় ধরনের প্রাণী। সারাদিন উড়ে বেড়ায় আর দিনের খাবার দিনে জোগাড় করে খেয়ে বাসায় গিয়ে মনের সুখে ঘুমিয়ে পরে। আর তাই শীতকালে খাবারের অভাবে ওরা বের হয়ে আসে বাসা থেকে, উড়ে যায় এমন জায়গায়, যেখানে বরফ পরে ওদের খাবারের উৎস বন্ধ হয়ে যায়নি।
পাখিরা কিন্তু ওদের বাসা থেকে বের হয়ে যেদিকে চোখ যায়, সেদিকেই উড়তে শুরু করে না। পুরো পৃথিবীতে যতো পরিযায়ী পাখি আছে, তারা নির্দিষ্ট কিছু পথে যাওয়া-আসা করে। আমরা যেমন রাস্তা ব্যবহার করি, সেরকমই আরকি! তার মধ্যে একটি উত্তরে রাশিয়া থেকে শুরু করে দক্ষিণে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। পরিযায়ী পাখিদের এই পথটির নাম সেন্ট্রাল এশিয়ান ফ্লাইওয়ে। বুঝতেই পারছো, আমাদের দেশও এই পথের মাঝেই পড়েছে। আমাদের দেশে যেসব অতিথি পাখিরা আসে, ওরা এই পথে চলাচল করলেও সবাই অবশ্য এতোটা পথ পাড়ি দেয় না। মূলত ওরা আসে হিমালয়ের পাদদেশ থেকে। তবে দূর থেকেও যে কেউ কেউ আসে না, এমন নয়। এমনকি সেই সুদূর ঠাণ্ডার রাজ্য সাইবেরিয়া থেকেও কিছু কিছু পাখি চলে আসে আমাদের বাংলাদেশে।
ভাবছো উল্টো পাল্টা কথা বলছি? অবশ্য ভাবতেই পারো। কারণ তোমরা প্রতিদিনই তো ছাদে ওঠো, বিকালে মাঠে গিয়ে নয়তো বাড়ির সামনের রাস্তায় কতোই না খেলা করো, কিন্তু কই, নতুন কোনো পাখির তো দেখা পাও না! সেই আগের মতোই একগাদা কাক, কয়েকটা দোয়েল, চড়ুই, শালিক আর ফিঙেই তো দেখা যায় শুধু। আসলে ওরা তো আর আমাদের দেশে এসে যেখানে সেখানে থাকা শুরু করে না। কারণ, সব জায়গায় তো ওদের থাকার পরিবেশই নেই। তাছাড়া খাবার জোগাড় করারও একটা ব্যাপার আছে। যেখানে ওদের খাবার সহজে পাওয়া সম্ভব, সেখানেই ওরা গিয়ে শীতকালীন বাসা বানায়।
সাধারণত, ওদের থাকার জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত জায়গা হলো জলাভূমি। সে হাওড়ও হতে পারে, বিলও হতে পারে, আবার হতে পারে ম্যানগ্রোভ বন। আমাদের দেশে এসে ওরা মূলত কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় বাসা বাঁধে। বিভিন্ন বিল-হাওড়-বাওড়ে, যেমন টাঙ্গুয়ার হাওড়ে, হাকালুকি হাওড়ে, চলন বিলে, তারপর মেঘনা নদীর মোহনায়, সুন্দরবনে, হাতিয়া আর নিঝুম দ্বীপের ম্যানগ্রোভ বনে ওরা বাসা বাঁধে। এখন অবশ্য ওরা আরো কয়েকটা জায়গায় নিয়মিত শীতকালে এসে পাখিরা থাকতে শুরু করেছে। এরমধ্যে আছে ঢাকার কাছেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেক, তারপর রাজশাহীর পুঠিয়ার কয়েকটি গ্রামের মতো আরো কিছু জায়গা। কিন্তু আমরা যেভাবে নিজেদের প্রয়োজনে একের পর এক জলাভূমি ভরাট করছি, আর বনজঙ্গল ধ্বংস করছি, তাতে অন্যান্য প্রাণীরা যেমন দিনদিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তেমনি এই অতিথি পাখি আসাও কিন্তু কমে গেছে। বরিশালে দূর্গা সাগর দিঘি নামে এক বিশাল দিঘি আছে, তাতে আগে শীতকালে অনেক অতিথি পাখি আসতো। কয়েক বছর ধরে সেখানে নাকি অতিথি পাখির কোনো নাম-নিশানাই নেই!
পাখিরা তো এইভাবে শীতের হাত থেকে পালাচ্ছে সেই আদ্যিকাল থেকেই। কিন্তু মানুষ কবে এই অদ্ভূত ঘটনাটা টের পেলো বলো তো? তুমি নিশ্চয়ই ভাবছো, সে আর কবে, এই হবে দুই-তিনশ’ বছর আগে। আসলে কবে মানুষ এগুলো খেয়াল করেছে বললে তুমি একেবারে চমকে উঠবে। সে প্রায় ৩ হাজার বছর আগে! তারপর প্রাচীনকালের অন্ধ মহাকবি হোমার, মহান দার্শনিক অ্যারিস্টটল, তোমাদের অনেকেরই চোখের বিষ ‘ইতিহাস’ বিষয়টির স্রষ্টা হেরোডেটাস, সবার লেখাতেই পরিযায়ী পাখির উল্লেখ পাওয়া গেছে। এমনকি খ্রিস্টানদের ধর্মগ্রন্থ বাইবেলেও পরিযায়ী পাখিদের বিষয়ে উল্লেখ আছে। প্রাচীনকালের পাখি যে আসলেই শীতের হাত থেকে বাঁচতে ঘুরে বেড়াতো তার হাতে-নাতে প্রমাণ হয়ে যায় একটি ঘটনায়।
ঘটনাটি ঘটে জার্মানিতে। ফসিল কি তা তো তোমরা জানোই। কোনো প্রাণীর মৃতদেহ লক্ষ লক্ষ বছর মাটির নিচে নির্দিষ্ট তাপ-চাপে থাকতে থাকতে যখন একেবারে কঠিন শিলা বা পাথরের মতো শক্ত হয়ে যায়, কিন্তু তার চেহারা-সুরত থেকে যায় প্রায় অবিকৃত, তখন সেটাকে বলা হয় ফসিল। তো জার্মানির এক গ্রামে পাওয়া গেলো একটা সারস পাখির ফসিল। সাদা রঙের সারস পাখিটার গায়ে কি বিঁধে ছিলো জানো? একটা তীর। ভাবছো, একটা তীরই তো? কিন্তু প্রশ্ন হলো, এমন তীর তো জার্মানরা কখনোই ব্যবহার করতো না! তাহলে এই তীর আসলো কোত্থেকে? এই নিয়ে সবার মাঝে বিশাল হই-চই পড়ে গেলো, আসলেই তো! কোত্থেকে আসলো এই তীর? অনেক খোঁজাখুঁজি করে বের করা হলো, এই তীর জার্মানদের তো নয়-ই, এমনকি জার্মানীর আশে পাশের কোনো দেশেরও নয়! এই তীর বানানো হতো আফ্রিকাতে। সাদা রঙের সারসটি নিশ্চয়ই শীতকালে শীতের হাত থেকে বাঁচতে চলে গিয়েছিলো আফ্রিকায়, আর সেখানে কোনো এক নির্দয় আফ্রিকান সারসটিকে শিকার করার জন্য তীর মেরেছিল। কিন্তু সারসটি তীরসহই ফিরে এসেছিল তার নিজের দেশে, তারপর মারা গিয়েছিল তার নিজের পরিচিত আঙিনায়।
তবে বিজ্ঞানীরা এইসব ঘটনা দিয়েই পাখিদের এই ঘুরে বেড়ানোর ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেননি। তারা পাখিদের এই পরিভ্রমণ নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, এখনো করছেন। আর সেই গবেষণার জন্য তারা অনেক কৌশলই অবলম্বন করেছেন। একবার তারা পরিযায়ী পাখিদের পায়ে রিং পরিয়ে পরীক্ষা করলেন। আরেকবার তারা রাডার ব্যবহার করে ওদের পর্যবেক্ষণ করলেন। এমনকি ওদের পরিভ্রমণের রহস্য উদ্ঘাটন করতে স্যাটেলাইটও ব্যবহার করা হয়েছে। ভাবছো, কতোগুলো পাখি একটু ঘোরাঘুরি করছে, তাতেও বিজ্ঞানীদের যতো খুঁতখুঁতানি! কিন্তু একবার চিন্তা করে দেখো, ওদের কাছে কোনো রাডার নেই, কম্পাস নেই, এমনকি একটা ম্যাপও নেই, অথচ অচেনা জায়গার উপর দিয়ে, জলাশয়ের উপর দিয়ে, সাগরের উপর দিয়ে ওরা ঠিকই পথ চিনে শীতকাল শেষে ফিরে যাচ্ছে ওদের নিজেদের দেশে। সেটা কিভাবে সম্ভব? তারা অবশ্য, এতোটুকু নিশ্চিত হতে পেরেছেন, পাখিরা দিনের বেলা দিক ঠিক করতে ব্যবহার করে সূর্য, আর রাতে চাঁদ-তারা। তবেই চিন্তা করো, এই পাখিগুলো কতো বুদ্ধিমান!
বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম/নাবীল/এসএ/সাগর/এইচআর/জানুয়ারি ০৬/১১
No comments:
Post a Comment